সাম্প্রদায়িকতা: প্রাচীন ভারত

সাম্প্রদায়িকতা: প্রাচীন ভারত

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি এসেছে সম্প্রদায় থেকে। ভারতবর্ষে সম্প্রদায় প্রথম কখন দেখা গেল ও কেন? খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত প্রায় সাত-আটশো বছরের মধ্যে বাইরে থেকে বহু জাতি উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে আসে এবং ছোট বড় যুদ্ধ জয় করে বা যুদ্ধ না করেও ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের জনসাধারণের সঙ্গে মিশে বসবাস করতে শুরু করে। এদের মধ্যে ছিল যবন অর্থাৎ গ্রিক, পারদ, পহ্লব, মুতিব, দরদ, কুষাণ, শক, হুন, নানা জাতি। এরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস আচার-অনুষ্ঠান সঙ্গে এনেছিল। ভারতবর্ষের প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান এ সবের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং এরাও এখানকার চলিত ব্রাহ্মণ্য-বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে আপোশ করে ক্রমে ক্রমে বৃহত্তর সমাজে মিশে যায়। শাস্ত্রকারদের কিছু মুশকিল হয়েছিল। আগন্তুকদের কোন বর্ণ বলে স্বীকার করবে? তাই প্রথমে ম্লেচ্ছ বা শূদ্র বলে সমাজ এদের স্থান দেয়, পরে এরা বিজয়ী ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় ক্ষত্রিয় বলে এদের স্বীকার করা হয়, কিন্তু মিশে যাবার পরে এদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস বা আচার-অনুষ্ঠানের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না।

প্রথম সম্প্রদায়ের কথা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকে কিছু শিলালিপিতে পাওয়া যায়। তার পর থেকে শিলালিপি ও মহাভারতে সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাই— পাঞ্চরাত্র, সাত্বত, নারায়ণীয়, ভাগবত, বৈষ্ণব, পাশুপত, লকুলীশ, শৈব, শাক্ত ইত্যাদি নামে। এ ছাড়াও দর্শনের দিক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন ও বৌদ্ধ, পরে বার্হস্পত্য, চার্বাক এদের দেখি, তার অনেক পরে ছটি দর্শন মীমাংসা, ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত— ধীরে ধীরে মত অনুসারে দর্শন সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। কিন্তু জৈন বৌদ্ধ মতের উৎপত্তির সময় থেকে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে মতের পার্থক্য থাকলেও এবং পরে ধর্মের পার্থক্য থাকলেও সম্প্রদায়গুলি পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ ভাবেই বসবাস করছিল। বুদ্ধির, যুক্তির জগতে এরা পরস্পরকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে চললেও সাম্প্রদায়িকতা কখনও অস্ত্র ধারণ করেনি।

মুসলমান আক্রমণের কয়েকশো বছর পর পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানও শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবেশীর মতো বাস করেছে। ত্রয়োদশ শতকের পর লক্ষণীয় ভাবে ধর্মান্তরীকরণের চেষ্টা করে মুসলমানরা, কিছু জুলুমও হয়েছিল, মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়া ইত্যাদি। ইতিহাসের এটা একটা দিক। অন্য দিক হচ্ছে, সব মোগল সম্রাটের হিন্দু মহিষী, হিন্দু সেনাপতি, হিন্দু সভাসদ ছিল। সকলেই হিন্দু মন্দিরেও অনুদান দিতেন ও হিন্দু গুণীদের শিরোপা, পুরস্কার দিতেন। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায় সাধারণত বন্ধুর মতো এক গ্রামে প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের অংশ নিয়ে বাস করতেন। যে দাঙ্গাগুলিকে সাম্প্রদায়িক বলে বলা হয়েছিল, এখনকার ঐতিহাসিক গবেষকদের মতে তার অধিকাংশই অর্থনৈতিক অর্থাৎ জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রজাদের বিদ্রোহ। মুসলমান রাজশক্তি কিছু মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করেছিল, এও যেমন সত্য, তেমনই সত্য হিন্দু সমাজের নীচের দিকে যে শূদ্র, ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্যরা ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই সমাজের অপমান ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে স্বেচ্ছায় ইসলামধর্ম গ্রহণ করে। কারণ, এ ধর্মে জাতিভেদ নেই। পরে একই কারণে বহু হতমান দরিদ্র মানুষ ব্ৰাহ্ম বা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে।

ইংরেজ আমলের আগে হিন্দুর বহু সম্প্রদায় ছিল। পরস্পর একে অন্যকে মতের দিকে ভ্রান্ত মনে করত, বিশেষত দর্শন প্রসঙ্গে, কিন্তু তার জন্যে সামাজিক শান্তির কোনও বিঘ্ন ঘটেনি। মুসলমান আমলেও তেমনই ধর্মমতের ও আচরণের ভিন্নতা সত্ত্বেও বিরোধ দেখা দেয়নি, যেমন দেখা গেল ব্রিটিশ আমলে। এটার মুখ্য একটি কারণ হল, ব্রিটিশ রাজ্যশাসনের মূলনীতিই ছিল এ দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজত্ব করা। নানা রকম ভেদবুদ্ধি দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানকে পরস্পরের শত্রু প্রতিপন্ন করা, পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে এই শত্রুতাকে স্থায়ী করাই ছিল ইংরেজের ভারতশাসনের মূল রাষ্ট্রনীতি।

দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকেই এ ভেদবুদ্ধি দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে এত সার্থক ভাবে সঞ্চার করেছিল ইংরেজরা যে, স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছিল একটি দেশ, কিন্তু স্বাধীন হল দু’টি দেশ; ওই বিভেদনীতির বিষবৃক্ষের দু’টি ফল। ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আগে থেকেই হিন্দু মহাসভা ছিল, মুসলিম লিগও ছিল। কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষে দুটি অসুবিধেও ছিল। রাষ্ট্রতন্ত্র বলল, ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, আর হিন্দু এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, দেশের জনসংখ্যার শতকরা বিরাশি ভাগই হিন্দু। এর ফলে এক দিকে যেমন সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপরে অত্যাচার করা অনেক সহজ হল, তেমনই সে অত্যাচার ওই শতকরা বিরাশি ভাগ ধিক্কারও অর্জন করল। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠের একটা নৈতিক দায় থাকে সংখ্যালঘুকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেবার, তার নিরাপত্তা বিধান করার। তার বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠ যদি সমাজের দুর্বলতর অংশের ওপর অত্যাচার করে তবে সেটা অনেক বেশি নিন্দনীয় হয়।

ভারতবর্ষ নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছে, তার অর্থ সব ধর্মে সমদৃষ্টি নয়, সমস্ত ধর্ম সম্বন্ধে সমান অপক্ষপাত ঔদাসীন্য, হিন্দু বা মুসলমান কেউই তার ধর্মের সুবাদে বাড়তি কোনও সুবিধে বা অসুবিধে ভোগ করবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা প্রায় প্রথম থেকেই সব ধর্মের প্রতি সমান আগ্রহ দেখিয়েছেন, যা স্বীকৃত নীতির বিরুদ্ধে। তাঁরা যা করে উঠতে পারেননি, হিন্দু ধর্মগুরুরা গত কয়েক দশক ধরে প্রচারে অনুষ্ঠানে তাই করছেন। অর্থাৎ স্পষ্ট করেই বলছেন, ভারতবর্ষ হিন্দুর দেশ, অতএব মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা এখানে স্বভাবতই হিন্দুর প্রাধান্য স্বীকার করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হল। ইদানীং বলা হচ্ছে, সিন্ধু সভ্যতা আর্যদেরই কীর্তি, তারাই হিন্দুধর্মের আদিপর্বের মানুষ অর্থাৎ মুসলমান আগন্তুক এবং এখানে জন্মে, জীবনধারণ করে মৃত্যুবরণ করলেও তারা ভারতীয় নয়।

এ কোন ভারতবর্ষের কথা? যে দেশ অসংখ্য আগন্তুককে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে আপন করে নিয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, নানা রকম প্রবল মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও, যার ফলে আজ পারদ, পহ্লব, শক হুনকে এ দেশে আলাদা করে চিহ্নিতই করা যায় না, এ কি সেই ভারতবর্ষের কথা? এখানে মুসলমান সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকাহিনি অবলম্বনে রাগসংগীত গেয়ে থাকেন অনায়াসে, হিন্দু রচনা করে অল্লোপনিষদ, দরাফ খাঁ লেখেন গঙ্গাস্তোত্র, অমর স্থাপত্য ভাস্কর্য সৃষ্টি করে দু’টি সম্প্রদায় মিলে, সেখানে আজ রামের বাসস্থানের নাম করে সাড়ে চারশো বছরের মসজিদ ভাঙে। এর পিছনে ক্ষমতালোভী, রাজ্যলোভী যারা উসকানি দেয়, আমরা তাদের রক্তাক্ত নখদন্ত দেখতে পাইনে? আমরা ভুলে যাই, যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম বলেছিলেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছুই নেই।’ মুসলমান মানুষ নয়? তা হলে তার চেয়ে বড় দেবতাও নয়, স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম মৃত্যুর আগে এ কথা উচ্চারণ করেছিলেন। চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ কোনও হিন্দু যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তো তাঁকে বিশ্বপিতা বলে মানে, তা হলে মুসলমান তাঁরই সন্তান, কাজেই হিন্দুর ভাই। বিবেকানন্দ বলেননি, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?’ এই বহুরূপ তো মানুষের রূপ, তার মধ্যে মুসলমান নেই? আমরা বলি, ‘সর্বজীবে শিব’, ‘জীবে দয়া করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ মুসলমান জীব নয়? আমরা পরম ঔদার্যে ঘোষণা করে থাকি, ছুঁচো, পেঁচা, ইঁদুর বিড়ালেও ব্রহ্ম আছে, কিন্তু এই উদার ব্রহ্মদৃষ্টি মুসলমানে তো পৌঁছয় না? তা হলে ওই সব বড় বড় কথা হল আগাগোড়াই ভণ্ডামি। তার চেয়ে বলা উচিত, ধর্মবিশ্বাস যার আছে থাক, ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসেবে না থাকে না থাক, কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের অনেক ওপরে মানবিকতার স্থান, যে মানবিকতায় মানুষ মাত্রকেই সম্মান, স্থান ও মান দিয়ে সৌভ্রাত্র্যের সম্পর্কে বাস করা যায়। কোনও ধর্মই এ কথা অস্বীকার করেনি এবং এর চেয়ে কোনও বড় সত্যের সন্ধানও দিতে পারেনি। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এ সব ভেদের সৃষ্টি সাম্প্রদায়িকতা থেকে। তার চেয়ে সত্যতর, ব্যাপকতর সংজ্ঞা আসে মানবিকতা থেকে, যেখানে মানুষ মাত্রই সমান, স্থানে, মানে ও অধিকারে। একবিংশ শতাব্দীতে যেন আমরা শুধু ‘মানুষ’ পরিচয়ে প্রবেশ করি, সকল সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে শতাব্দীর এপারে রেখে যাই।

সম্প্রদায় অর্থাৎ মত ও বিশ্বাস। এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচরণে মানুষের যে পরিচয় তা সংকীর্ণতাকেও সীমাবদ্ধ করে, সম্প্রদায়ের গণ্ডির মধ্যে। সে পরিচয় যতই সত্য হোক না কেন, তার বাইরে, যেখানে বৃহত্তর জগৎ, সেখানে ওই পরিচয়ের কোনও দাম নেই। সেখানে খাঁটি হল মানব প্রেম, মানুষ হিসেবে পরিচয়। মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্বও যেমন আছে, দানবত্বও তেমনই আছে। আজকের হিন্দু মহাপ্রভু আচার্যরা জাগিয়ে তুলতে চাইছে তার দানবতাকে। কেন? তারা হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী বলে নয়, হিন্দু শক্তিকে রাষ্ট্রশক্তিতে পরিণত করতে চায় বলে। ভোটের বা গদির লোভে ভ্রাতৃহত্যা করতে তাদের হাত কাঁপে না। কারণ, তারা নিজেদের মধ্যে ধর্মান্ধতার নামে দানবশক্তিকে পুরোপুরি জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। এইখানে আসে সাধারণ দেশবাসীর ভূমিকা। তারা ওই ক্ষমতালোভীদের রক্তাক্ত নখদন্ত যদি দেখতে পায়, চিনতে শেখে যে, কেন তাদের মিথ্যা জিগির তুলে তাতানো ও মাতানো হচ্ছে, তা হলে তারা ওই দাম্ভিক অত্যাচারী শক্তিলোভীদের হাতে হাতিয়ার তুলে দেবে না। বলবে, এ তো ধর্ম নয়, ধর্ম মানুষের সমাজকে ধারণ করে, সংহত করে, বিভেদ সৃষ্টি করে না, ধ্বংস করে না।

মধ্যযুগের সাধকরা— নানক, কবীর, দাদূ, চৈতন্য, রামদাস পরে নামদেব, শঙ্করদেব- এঁরা কেউই ভেদের কথা বলেননি, বলেছেন সম্প্রদায়ের পরিচয়টা নেহাত নগণ্য। আসল পরিচয় মনুষ্যত্বের, সেইখানে সব মানুষ এক, ভাই। তাঁরা যে বিশ্বপিতার কথা বলেছিলেন, সব মানুষ তাঁর সন্তান, অতএব সব মানুষই পরস্পরের ভাই। এইখানে ভারতবর্ষের মানুষ এমন একটি সত্যের সন্ধান পেয়েছিল যা তাদের শক্তি দিয়েছিল। এ শক্তি আসে সংহতি থেকে, সৌভ্রাত্র্য থেকে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ঘড়িটা সে দিন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এবং মনে রাখতে হবে, এই সাধকরা তাঁদের জাতিবর্ণ-পরিচয় সম্পূর্ণ অস্বীকার করে হিন্দু মুসলমানকে ও মুসলমান হিন্দুকে ভাই বলেছিলেন। প্রত্যেকেই ধিক্কার দিয়েছিলেন ধর্মগুরুদের, যারা ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধির ইন্ধন জোগায়। এঁরা তখনকার সমাজের বাইরে এসে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন, চারপাশের মানুষকে ভাই বলে আপন করতে। এবং তখনকার ধর্মগুরুদের দ্বারা চালিত সমাজ এঁদের ক্ষমা করেনি। পরম অসহিষ্ণুতা নিয়ে সমাজের সীমার বাইরে দূর করে দিয়েছিল, অত্যাচার করেছিল। রাজপুত্র হয়েও দারা শুকোহ এই ধর্মগুরুদের এবং রাজ্যলোভীদের কাছে ক্ষমা পাননি। প্রাণ দিয়ে তাঁকে শোধ করতে হয়েছিল তাঁর উদার বিশ্বাসের দাম। সাধারণ মানুষ কি তখন অনেকটা মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি খানিকটা সময়? কিন্তু এই সংহতি, এই সৌভ্রাত্র-পাণ্ডা- মোহন্ত- শংকরাচার্য-মোল্লা-মৌলভীদের সইবে কেন? তারা তো বিভেদকেই জিইয়ে রাখতে চায়। ধীরে ধীরে তারা শাস্ত্রের বাঁধন আরও শক্ত করল, বিভেদের শেকলগুলি আরও মজবুত করল। কিন্তু মানুষের সৌভ্রাত্র একটা সহজাত বোধ। তাই, একদিকে ভয় আর লোভকে তাতিয়ে যেমন ধর্মগুরুরা বিদ্বেষের বিষ ছড়াচ্ছিল, রাষ্ট্রক্ষমতা লোভীরা যেমন সম্প্রদায়গুলির পার্থক্যের ওপরেই জোর দিচ্ছিল, তেমনই অন্য দিকে সাধারণ মানুষ ধর্মকারার প্রাচীর ভাঙবার জন্যও উঠে পড়ে লাগল। এই টানাপোড়েনের মধ্যে চলল সমাজের গতি।

ঊনবিংশ শতক থেকে সাম্প্রদায়িক পরিচিতি যেন আচ্ছন্ন করে দিল মানুষের মানবিক পরিচয়। এবং এর পিছনে ছিল ব্রিটিশ রাষ্ট্রশক্তির স্বার্থ— যারা বিভেদের দ্বারাই ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন কায়েম করতে চাইছিল। এই উদ্দেশ্যকে পরোক্ষে মদত দিচ্ছিল সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ধর্মগুরুরা। রাষ্ট্রশক্তির হাত ধরে মানুষের শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে তাকে বোঝাচ্ছিল, যে-মানুষ ভিন্ন বিশ্বাসী, ভিন্ন আচারী সে হিন্দুর শত্রু, তাকে শেষ করে দেওয়া, ধনে প্রাণে মারা, উদ্বাস্তু ও নিরন্ন করা, তার ইজ্জৎ ও আশ্রয় ধ্বংস করাই হিন্দুত্ব। হিন্দু প্রশ্নটা উঠছে ওই শতকরা বিরাশিজন এ দেশে হিন্দু বলে। যে বিরাশিজনের নৈতিক দায়িত্ব ছিল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান করা, তাদেরই অনেকে বেছে নিল দানবের পথ, ধর্মগুরুদের প্ররোচনায়। তবু ঊনবিংশ শতক থেকে তলে তলে মুখ্য হিন্দুসমাজে অন্তঃস্রোতা আর একটি ধারারও উদ্ভব হয়েছিল। প্রতিবাদী এ ধারা নিজেকে মরমি অর্থাৎ সমবেদনশীল ও সংবেদনশীল বলেছিল। কারণ, বৃহত্তর সমাজ হিংসাবিদ্বেষ-বিষে জর্জর। এই মরমিয়ারা আউল, বাউল, ফকির দরবেশ নানা নামে আচারে, বিশ্বাসে সমাজের প্রত্যন্ত দেশে নিজেদের ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। লালন ফকির, সাহেবধনী, কর্তাভজা, খুশি-বিশ্বাসী— এমনই বহুতর নামে এঁরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সমাজের এক প্রান্তে বৃহত্তর সমাজের অবজ্ঞা, বিদ্রুপ মেনে নিয়ে প্রতিবাদে স্থির ছিলেন।

এঁদের উদ্ভব হল কেন? সমাজের যে কাজ করা উচিত ছিল, তথাকথিত ধর্মের যে কাজ করা উচিত ছিল, অর্থাৎ মানুষে মানুষে প্রীতি, বিশ্বাস, মিলন ঘটানো, সমাজপতি এবং ধর্মগুরুরা ঠিক তার উল্টো পথেই গেল, বলল, হিন্দুই এ দেশের মৌলিক এবং একমাত্র অধিবাসী, মুসলমান দেশের শত্রু, এখানে তাদের ঠাঁই নেই। মনে রাখতে হবে, ততদিনে ব্রিটিশ রাজত্ব পতনের মুখে এবং তার পরে দেশ স্বাধীন হবার পরেও একমাত্র যে ধর্মবিশ্বাসীরা সব মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে ভাই বলে বুকে টেনে নিতে পেরেছেন, জাতপাত সম্প্রদায় নির্বিশেষে— তাঁরা এই অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, হতদরিদ্র সাধারণ ক’টি মানুষ। যাঁরা গানে, কবিতায় তাঁদের এই মানবিক বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন এবং এই বিশ্বাসের জোরে বলতে পেরেছেন জাতিদভেদ, সম্প্রদায়ভেদ, সবই মানুষের হীন স্বার্থে ব্যবহার করছে শিকারির মতো সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতালোভী ওপরতলার গোষ্ঠী ও গুরুপুরোহিত মোল্লা-ইমামরা। যে দেশে মানুষ খেতে পায় না, মাথার ওপরে ছাদ জোটাতে পারে না, রোগে চিকিৎসা পায় না, শিক্ষা পায় না, মানুষের মর্যাদা পায় না, সেখানে ওই সব ধর্মের কচকচি তোলা থাক না শৌখিন ধর্ম-ব্যবসায়ীর জন্যে? সাধারণ মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের শতসহস্র অভাবের সুরাহা করবার চেষ্টা করুক।

ধর্মে যার প্রয়োজন আছে ধর্ম তারই থাক। অন্য পাঁচজনের ওপরে তা চাপিয়ে দেবার তো কোনও দরকার নেই। বিশেষত, আজ যখন ধর্ম বোঝাচ্ছে, যে আমার মত মানে না সে আমার শত্রু, তার বিশ্বাসের ধর্মস্থানকে গুঁড়িয়ে দেবার চেষ্টা করাই আমার একমাত্র ব্রত। ধর্ম এখন সমাজকে ধারণ করছে না ধ্বংস করছে, কাজেই আজ সে ধ্বংসবুদ্ধির প্রতীক। ধর্মবিশ্বাসকে ব্যক্তিগত জীবনে যে গ্রহণ করছে সে যেন তার ধর্ম অনুসারে সত্যি কথা বলতে পারে যে, ঈশ্বর মানবমাত্রের পিতা, অতএব সব মানুষই পরস্পরের ভাই। এ কথা যদি তার ধর্ম তাকে দিয়ে না বলায়, তা হলে তার ধর্ম মিথ্যা, সে নিজে ভণ্ড এবং প্রতারক। তাকে শত্রুজ্ঞান করবে পৃথিবীর সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।

হিন্দু সাহিত্যে বৌদ্ধদের ওপরে হিন্দুদের অত্যাচারের কথা আছে, তা হলে আজ হিন্দু কি বৌদ্ধের শত্রু হবে? না বৌদ্ধ হিন্দুর? প্রাচীনকালের অত্যাচার অনাচারকে জিইয়ে রাখার বুদ্ধি মানব-কল্যাণের বিরুদ্ধ বুদ্ধি, ধ্বংসাত্মক বুদ্ধি। যে কোনও নামে বা ছাপে এ বুদ্ধি দেখা দিক না কেন, আমরা, সাধারণ মানুষ যদি তার প্রতিবাদ না করি তা হলে, আজ ৬ ডিসেম্বরের পরে, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। কারণ, তা হলে ধর্মান্ধতার নামে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে হানাহানির বর্বরযুগে স্থাপন করা হবে। যারা ধর্মের নামে ভারতবর্ষের কোনও একটি মানুষকেও অভারতীয় বলার স্পর্ধা রাখে, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলবার দুশ্চেষ্টা করে, তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন, আজ তা পরম অধর্ম। কারণ, তা অমানবিক, তা মানুষের শত্রু এবং আজকের ভারতবর্ষের জনগণের শত্রু। তাকে ক্ষমা করা চলবে না, তাকে প্রতিহত করার জন্যে প্রাণপণ করতে হবে সমস্ত সুস্থবুদ্ধি মানুষকে একত্র এবং একাগ্র হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *