প্রাচীন ভারতে ইতিহাস-চেতনা

প্রাচীন ভারতে ইতিহাস-চেতনা

প্রাচীন ভারতের আদিমতম নথিপত্র পাই বেদে এবং বেদ রচনা ছিল ‘আস্য’ অর্থাৎ মুখে মুখে তা রচিত হত এবং মুখেমুখেই সংরক্ষিত হত, যদিও পরে তা লিপিবদ্ধ হয়েছিল। বহিরাগত পশুচারী আর্যরা এ দেশে নাগরিক কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-নির্ভর সিন্ধু সভ্যতার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে সে অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করল। তাদের বিশ্বাস ছিল, যুদ্ধে জয়লাভ করতে তাদের আরাধ্য দেবতারা তাদের সাহায্য করেছেন; তাই দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত স্তবে যুদ্ধের কিছু কিছু বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করে দেবতাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। এই বাস্তব ঘটনাগুলির উল্লেখে তৎকালীন কিছু খণ্ড খণ্ড ইতিহাস বিধৃত হয়ে আছে। তেমনি উত্তরবৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক উপনিষদ সাহিত্যেও যজ্ঞ ও দর্শন ব্যাখ্যার মধ্যে কোনও কোনও খণ্ডিত আঞ্চলিক ইতিহাসের উপাদান ও রয়ে গেছে। এ ইতিহাস কিন্তু আকস্মিক বা প্রাসঙ্গিক মাত্র, ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে রচিত নয়। বৌদ্ধ ত্রিপিটক, জৈন পত্তাবলীতে প্রথম কিছু সঙ্গতিপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য দেখা গেল; বিশেষত জাতকগুলিকে বিশ্লেষণ করলে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন ‘ললিতবিস্তর’ ও ‘মহাবস্তু’তেও ছোট ছোট সামাজিক ইতিহাসের নিদর্শন রয়ে গেছে। ‘মহাভারত’ নিজেকে ইতিহাস বলেছে, যদিও বস্তুত মহাভারত যথাৰ্থ ইতিহাস নয়। যদিও এতে বিস্তর ঐতিহাসিক উপাদান আছে। একটা জাতির একটি দীর্ঘ যুগের মর্মর্গত উপলব্ধিই এর লক্ষ্যবস্তু। রামায়ণে ইতিহাস প্রত্যক্ষ ভাবে অনুপস্থিত, যা সংকলন করা যায় তাকে দেশকালের পটভূমিকাতে স্থাপন করা যায় না। প্রথম ইতিহাসে মেলে বিদেশিদের— গ্রিক রোমানদের রচনায়; অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সময়ে। তাঁর সঙ্গে যে সব অনুচর ছিলেন, তাঁরা আলেকজাণ্ডারের অভিযান ও যুদ্ধের যে বিবৃতি রেখে গেছেন তাতে এবং পরে রোমানদের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক নির্মিত হলে তাঁদের ঐতিহাসিক স্ট্রাবো প্রমুখের রচনায়। ভারতীয় কোনও রচনায় এ সময়কার কোনও ইতিবৃত্ত পাওয়া যায় না।

প্রকৃতপক্ষে মোগল আমলে রাজসভার ভারপ্রাপ্ত ঐতিহাসিকদের রচনায় প্রথম সচেতন ভাবে রচিত ইতিহাস পাওয়া যায়। তার আগে বাবর-নামাহ, হুমায়ুন-নামাহ ও পরে আকবর-নামাহ-তে সত্যিকারের ইতিহাস পাওয়া যায়। তার পর থেকে ইতিহাস রচনার ধারা মোগল যুগ অতিক্রম করে ব্রিটিশ আমলেও এবং আজ পর্যন্ত অব্যাহত চলছে। অর্থাৎ স্বাধীন প্রাক-মোগল যুগের ভারতীয়রা তাঁদের সমাজ ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে কোনও ইতিহাস রচনা করেননি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন এমনটা হল। গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেই হেরোডোটাস সচেতন ভাবে ইতিহাস রচনা করেছেন। আরও আগে মিশরে, মধ্যপ্রাচ্যে, চিনে ইতিহাস রচনার জন্যেই লেখা হয়েছিল সচেতন প্রয়াসে সে সব দেশের রাষ্ট্রিক, সামাজিক কৃষি-বাণিজ্যিক তথ্যের বিবরণ, সেখানে ভারতবর্ষে কেন ইতিহাস রচনা সম্পর্কে এত উদাসীন!

ইতিহাস মানে কালের প্রেক্ষাপটে ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ। এই কালকে ভারতবর্ষ কল্পনা করেছিল চক্রাকারে, অর্থাৎ একবারের সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয় মিলে হয় একটি কল্প; কল্পান্তে সব কিছুই মিলিয়ে যায় প্রলয়ে, থাকে শুধু বেদ। তখন বেদরূপে স্রষ্টা পুনর্বার সৃষ্টি করেন, তখন তার স্থিতি আর প্রলয় মিলে হয় একটি কল্প। এমনি করে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে কাল। ও ধারণায় অনুবর্তন আছে, বিবর্তন নেই। পৃথিবীর সভ্যতার যা বিবর্তন তা একটি কল্পেই সীমাবদ্ধ। তার প্রগতি বিলীন হয় সে কল্পের প্রলয়ে; পরবর্তী কল্পে সেই ‘সনাতন’ বেদ থেকেই আবার তেমনি ভাবেই অনুবৃত্ত হয় সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়। এক কল্পে মানুষের বোধবুদ্ধি জ্ঞানবিজ্ঞানের যে অগ্রগতি তার উত্তরাধিকার পরবর্তী কল্পে পৌঁছয় না; নতুন করে সৃষ্টি শুরু হয় সেই বেদ-বিন্দু থেকেই। এই যদি কাল সম্বন্ধে ধারণা হয়, তা হলে ইতিহাস রচনার অনুপ্রেরণা আসবে কোথা থেকে? মানুষের ইতিহাস যদি নিরন্তর চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে তবে তো তার যথার্থ কোনও অগ্রগতি নেই। তা হলে এ কল্পের ইতিহাস পরবর্তী কল্পে কোনও অর্থই তো বহন করবে না। সে ক্ষেত্রে কেন ইতিহাস রচনা করবে মানুষ? কার ইতিহাস? এক কল্পের ইতিহাসে পরকল্পে যদি নিরর্থক হয় তবে বাস করুক মানুষ মহাকালে। ক্ষুদ্রকালের কাহিনি রচনা তো ব্যর্থ প্রয়াস মাত্ৰ।

তার পরে, ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত যে দর্শন, যার প্রভাব ভারতীয় মানসে সবচেয়ে ব্যাপক এবং প্রত্যক্ষ, তা হল বেদান্ত। এবং বেদান্ত বলে দৃশ্যমান জগৎ ও ঘটনা মায়া। ধ্রুব বা সত্য পদার্থ একটিই, ব্রহ্ম। আর ব্রহ্ম তো সচ্চিদানন্দ, তার আবার ইতিহাস কী? মানুষের জীবনে যা অনুভূত বা উপলব্ধ হয় তা নিছক মায়া মাত্র; সে মায়ার ইতিহাস রচনা তো আত্যন্তিক অর্থে অসার।

ভারতীয় মানুষ তার ধর্মবোধের কাছে যখন প্রশ্ন এনেছে যে, যা ঘটে, তা ঘটে কেন, তখন তিনটি উত্তর পেয়েছে— ১. প্রকৃতি নিজের নিয়মে ঘটায় ২. ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে ঘটে ৩. নিয়তির নির্দেশে ঘটে। এবং এই তিনটিকেই পরিব্যাপ্ত করে আছে জন্মান্তর ও কর্মবাদ। মানুষের দৃশ্যমান এই জীবনটা মধ্যবিন্দু মাত্র। একটা ‘কার্য’ যার ‘কারণ’ নিহিত আছে তার পূর্বজন্মের সঞ্চিত বা প্রারব্ধ কর্মে, যার ফল ফলছে এ জন্মে। এবং এ জন্মের কর্মের কারণে পরজন্মের কার্য হবে কর্মফল, অর্থাৎ পরজন্মের অভিজ্ঞার মূল এ জন্মে বা আরও পূর্বের কোনও জন্মে, এবং এ জন্মের কর্মের ফল ফলবে আগামী কোনও এক জন্মে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কার্যকারণের এই জটিল গোলকধাঁধায় পড়ে কার ইতিহাস লিখবে? কারণের না কার্যের? কারণ, অভিজ্ঞতাগুলি তো বহুজন্মের সূত্রে গ্রথিত এবং কেন কী ঘটছে তার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও তো কোথাও নেই। কাজেই ইতিহাস রচনা হয়ে দাঁড়ায় অযৌক্তিক রহস্যময় নিয়তি বা ইশ্বরেচ্ছা বা প্রকৃতির আচরণের বিবরণ। তার কোনও সার্থকতাই তো নেই।

অতীতকাল থেকেই ভারতবর্ষ বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক। এদের মধ্যে নানা নৃতত্ত্বস্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী তাদের ভিন্ন বিচিত্র বিশ্বাস আচরণের ধারা বহন করে চলেছে; এদের মধ্যে কার ইতিহাস লেখা হবে, অর্থাৎ কাকে বাদ দিয়ে কাকে গ্রহণ করা হবে?

আমরা বলি, পুরাণের সেই শ্লোকটিতে অখণ্ড ভারতের বোধ প্রকাশিত— গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী। নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলে’স্মিন্ সন্নিধিং কুরু।। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সাতটি নদী এসে তর্পণের জন্যে অঞ্জলিতে ধরা জলে উপস্থিত হোক। এর মধ্যে নাকি ভারতবর্ষের সত্তা প্রকাশিত। এটা সর্বথা ভ্রান্ত ধারণা। তীর্থ করতে গিয়ে প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রকাররা ওই সাতটি নদী দিয়ে পরিবেষ্ঠিত ভূখণ্ডকে জেনেছিলেন কিন্তু সেটা যে তাদের দেশ, বিশিষ্ট ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক সত্তায় সীমাবদ্ধ, এমন কোনও ধারণা ব্রিটিশ শাসনের আগে গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রিক ভাবে নির্দিষ্ট সীমারেখা বর্ণিত হল এ দেশে ভারতে সার্বভৌম ব্রিটিশ শাসনের পত্তনের পর। কাজেই দেশবোধ, যার থেকে জন্মায় দেশাত্মবোধ, তা জন্মাবার কোনও পটভূমিকাই সৃষ্টি হয়নি গত দুশো বছরের আগে। আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করবার সময়ে উত্তর-পশ্চিমের সমস্ত খণ্ড রাজ্যগুলি একযোগে তাঁকে প্রতিহত করবার চেষ্টা করলে এখানকার ভূগোলে, ভাষায় ও জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ আগন্তুক কোনও মতেই জয় করতে পারতেন না। কিন্তু সে সংহতিই ছিল না খণ্ডরাজ্যগুলির। প্রত্যেকে শুধু নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেছে। যখন রাজ্য রক্ষা করতে পারেনি, তখন আত্মসমর্পণ করেছে। একা পুরুর সাধ্য কী যে অত শক্তিশালী অভিযান ঠেকাবেন? আসলে ভারতবাসী জানত না সে ভারতবাসী। সপ্তদ্বীপা বসুমতী; তার মধ্যে জম্বুদ্বীপের অষ্টাদশ ‘বর্ষের’ মধ্যে একটি হল ভারতবর্ষ। কিন্তু কীসে যে এ দেশের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক সংহতি, সে সম্বন্ধে দেশবাসী অবহিতই ছিল না। কারণ, ওই সংহতি তখনও আসমুদ্রহিমাচলের ভূমিভাগের অধিবাসীদের চেতনায় জন্ম নেয়নি। তাই ভারতবর্ষ প্রাক-ব্রিটিশযুগে একটি সুসংহত দেশ হয়ে ওঠেনি। ভারতীয়রা একটি জাতি হয়ে ওঠেনি আপন চেতনায়।

অতএব, কার ইতিহাস লেখা হবে? কেনই বা হবে? কারণ, বহু পুরাণ তো দাবি করে যে, তারা সমস্ত রাজবংশের আনুপূর্বিক কাহিনি লিপিবদ্ধ করছে; এবং কিছু কিছু পুরাণে তা লিপিবদ্ধ আছে। শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য, অন্ধ্র, গুপ্ত রাজ্যগুলির কাহিনি পুরাণগুলিতে পাওয়া যায়। মৌর্যযুগ প্রতিফলিত বিষ্ণু পুরাণে (৩২৬–১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), অন্ধ্র রাজবংশের কথা আছে মৎস্যপুরাণে (২২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর অবসান ঘটে)। কতকগুলি পুরাণের শেষভাগে আভীর, গর্দভ, শক, যবন, তুষার, হূন প্রভৃতি আক্রমণের কাহিনি এবং অন্তে কলিযুগ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী আছে। এ সব পুরাণের কাহিনির সঙ্গে ‘ললিতবিস্তর’ ‘মহাবস্তু’ ‘সদ্ধর্মপুণ্ডরীক’ও ‘কারণ্ডব্যুহের’ কাহিনির বিস্তর মিলও আছে। তবে কি এগুলি ইতিহাস? অংশত এগুলিতে ঐতিহাসিক উপাদান থাকলেও আমরা আজ ইতিহাস বলতে যা বুঝি, সে ধরনের তথ্যের আনুপূর্বিক অবিকৃত বিজ্ঞানসম্মত বিবরণ এগুলিতে নেই। যেখানে ভবিষ্যদ্বাণীর আকারে অতীত ঘটনার কথা আছে সেখানে তাও খানিকটা তথ্যনিষ্ঠতা আছে, যদিও রাজসভার পণ্ডিত বা যে পুরোহিতরা এগুলির রচয়িতা তাঁরা প্রতিকূল বা অসৎ বা তাঁদের স্বার্থের বিরুদ্ধচারী বেশ কিছু রাজাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। ফলে পিতামহের পৌত্র পিতার স্থান নিয়েছে। তেমনই বহু তথ্যও প্রয়োজন অনুসারে বিকৃত ভাবে পরিবেশিত হয়েছে। কী করে এটা সম্ভব হল? আসলে নির্ব্যক্তিক ভাবে যথাযথ তথ্যমালাকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে দেখে বিবৃত করা যে ঐতিহাসিক বিবেক থেকে সম্ভব হয় সে বিবেকবোধই ছিল না। কারণ, পূর্বেই বলেছি ইতিহাস রচনার কোনও যথার্থ প্রমাণ ছিল না। মোগল সাম্রাজ্যের আগে, আদি মধ্যযুগ পর্যন্ত ভারতবর্ষের চেহারা ছিল গ্রামীণ এবং গ্রামগুলি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পুরোহিতশাসিত। সুখে-দুঃখে যে কোনও অনুষ্ঠানে স্মার্ত পুরোহিতের অনুশাসনে নিয়ন্ত্রিত হত গ্রামজীবন। শস্যে এবং শিল্পে গ্রামগুলি ছিল স্বনির্ভর, অতএব নগরনিরপেক্ষ। তাদের জগৎটা আবর্তিত হত গ্রামেরই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে। বড়জোর আশপাশের কয়েকখানা গ্রামের সঙ্গে আত্মীয়কুটুম্বিতা পালাপার্বণ যাত্রা মেলার সূত্র ধরে সংযোগ ছিল। বহু দূরের কোনও বড় শহরে অবস্থিত রাজশক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনও যোগাযোগ ছিল না। বাৎসরিক খাজনাও আদায় করত কোনও রাজকর্মচারী। তা হলে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এই গ্রামবাসীদের বোধ সীমিত থাকত দু’-একটি আঞ্চলিক তীর্থের সঙ্গে। অত্যন্ত ধনী যারা, তারাই যেত দূরের তীর্থে। কিন্তু যে যাত্রার ফলে বিরল কিছু মনীষী ছাড়া দেশের ভূগোল সম্বন্ধে কোনও যথার্থ জ্ঞান তাদের জন্মাত না। এ ক্ষেত্রে ইতিহাস রচনা হবে কাকে কেন্দ্র করে? কার জন্যে? এ সব গ্রামের মানুষের এবং নগরের শিক্ষিত শ্রেণির, জমিদার বা রাজসভার পণ্ডিতেরা যখন সাহিত্য রচনা করতেন তখন আঞ্চলিক সংঘাত, প্রেমের কল্পিত কাহিনি অথবা পৌরাণিক উপাদান অবলম্বন করেই করতেন। কারণ, তা হলে কাব্যের পাঠক ও নাটকের দর্শক বিষয়টা অনুধাবন করতে পারবেন। রামায়ণ, মহাভারত, কথাসরিৎসাগর ও পুরাণই তাই অধিকাংশ সাহিত্যের উপজীব্য। যদি কোথাও কেউ বীরত্ব বা আত্মত্যাগ করে থাকে এবং তা নিয়ে সাহিত্য রচিত হয় তো সে গ্রাম, সে নগর ও আশপাশের কয়েকখানা গ্রামের ও নগরের লোকেরাই তার রসগ্রহণ করতে পারবে। ভ্রাম্যমান নাট্যদলগুলি কখনও কখনও নাটক দূরে দূরে নিয়ে যেত; কিন্তু তা কদাচিৎ। বাকি দেশের কাছে ব্যাপারটা দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। ফলে সীমিত পরিসরের অভিজ্ঞতা বা মহাকাব্য পুরাণের কাহিনি নিয়ে রচনা করলে তার প্রচার এবং শিল্পীর যশের প্রসার ঘটার সম্ভাবনা। এই কারণেই প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এ ধরনের উপজীব্যেরই প্রাধান্য, ইতিহাসনির্ভর রচনাও কিছু কিছু ছিল। সপ্তম শতকে বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ইতিহাসনিষ্ঠ, কল্পনার প্রাচুর্য থাকলেও ইতিহাস অংশটা মোটের ওপর তথ্যনির্ভর। বাক্পতিরাজের পৃষ্ঠপোষক কনৌজের যশোবর্মার হাতে গৌড়রাজের পরাজয় অবলম্বনে কবি রচনা করেন ‘গৌড়বহ’, আঞ্চলিক একটা ছোট ইতিহাসের কল্পনামিশ্রিত সংস্করণ। বিল্হণের ‘কর্ণসুন্দরী’তে বা ‘পদ্মগুপ্ত’র ‘নবসাহসাঙ্কচরিতে’ ইতিহাসকে কাব্য করে তুলতে প্রচুর অনৈতিহাসিক উপাদান এসেছে। একমাত্র কল্হণের ‘রাজতরঙ্গিণী’র দুই-তৃতীয়াংশ সত্যিকার ইতিহাসবোধসঞ্জাত, যদিও তার প্রথম তৃতীয়াংশ জনশ্রুতি ও পুরাণনির্ভর। কিন্তু একাদশ শতকের একটিমাত্র ইতিহাসাশ্রিত কাব্য— যার প্রথমাংশে প্রচুর অনৈতিহাসিক কথা আছে। শুধু সেটিকে দিয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাসরচনা প্রমাণ হয় না।

সাধারণ ভাবে বলা যায়, প্রাকমোগল যুগের কোনও ভারতীয় ইতিহাস কেউ রচনা করেননি। করেননি কারণ, প্রথমত গ্রামীণ সংকীর্ণ সমাজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা থেকে এক ধরনের কূপমণ্ডূকতা সৃষ্টি হয়। গ্রামের সীমার বাইরে বা যে ক’টি গ্রাম ও শহরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বৈষয়িক যোগ ছিল, তার পরিসরের বাইরের জগৎটা ছিল গ্রামবাসীর বোধের বাইরে। ওই বাইরের জগতের ঘটনা তার কাছে অস্পষ্ট, ধূসর। কাজেই ভারতবর্ষের বৃহৎ কোনও অঞ্চলের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনও রচনার ব্যাপক জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা ছিল না। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে য়ুরোপের যে সংযোগ পূর্বে ছিল, তা ধীরে ধীরে ছিন্ন হয়ে যায়। সমুদ্রবাণিজ্যের ওই পথে ভারতবর্ষ দিয়েছেও বিস্তর, পেয়েছেও বিস্তর। চিন্তাভাবনা, দর্শনসাহিত্য ও জীবনবোধের ভাণ্ডার তার সমৃদ্ধ হয়েছে ওই ভাবে। পরে দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লেও ওই জাতীয় সাংস্কৃতিক বিষয়ে ভারতবর্ষই দাতা, গ্রহীতা আর রইল না। ফলে এক ধরনের দ্বৈপায়ন সংকীর্ণতা ধীরে ধীরে গ্রাস করল তার চিন্তাজগৎকে।

ধর্মীয় অনুশাসনের সংখ্যা জটিলতা ও বৈচিত্র্য বাড়তে লাগল, মানুষ সন্তর্পণে ধর্মাচরণ করে চলল। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতেই পুরোহিত-নির্দিষ্ট প্রায়শ্চিত্ত, ব্রত, তীৰ্থ, মানত, জপ মন্দির, বিগ্রহ পূজায় ভরে উঠল তার দিনযাত্রা। তার সঙ্গে জুটল বেদান্তদর্শনের ভারতব্যাপী প্রসার। এ দর্শন বলল, ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’; সুতরাং যা বস্তুতই মিথ্যা, তার ইতিহাস রচনা তো নিষ্ফল প্রয়াস। এই বাতাবরণে ‘মায়া’ সম্বন্ধে যে দৃঢ়বোধ সৃষ্টি হল তাতে মানুষ জন্মান্তরের ধারা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হওয়ার চেষ্টাই একমাত্র সার্থক প্রয়াস বলে গণ্য করল। উপদেষ্টা পুরোহিতদের কিন্তু প্রণামী, দান ও দক্ষিণাকে মায়া বলে মনে হল না, বরং তারা চিরদুঃখী অভাবগ্রস্ত জনসাধারণের মনে মায়াবাদকে দৃঢ় ভাবে সঞ্চারিত করেছে এবং এই দৃষ্টিতেই ইতিহাস জনসাধারণের কাছে অর্থহীন হয়ে উঠেছিল।

সাধারণ মানুষকে ঘটনার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, অর্থাৎ প্রকৃতি, ঈশ্বর ও নিয়তি, তাতে মানুষ বোঝে ঘটনার ওপরে তার নিজের কোনও কর্তৃত্বই নেই। অতএব বহু যুগের কায়েমি অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এ সব নিয়তি-নির্দিষ্ট ভগবৎপ্রেরিত বা প্রকৃতির বিধান বলে মেনে নেয় মানুষ, ফলে ওই সব দুর্বিচারের বিরুদ্ধে সংঙ্ঘবদ্ধ ভাবে কোনও প্রতিবাদ করার প্রেরণা আসে না। মানুষ ইতিহাসকে প্রণিধান করে বোঝবার চেষ্টা করলে তবেই সে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে যৌথ চেষ্টায়। কিন্তু দুঃখী মানুষকে একদিকে বোঝানো হয়েছে, পূর্বজন্মের কর্মফলে, ঈশ্বরেচ্ছায়, প্রকৃতির বিধানে বা নিয়তির বলে তার এই দুর্দশা। অন্য দিকে বোঝানো হয়েছে, তার দুঃখটা আগাগোড়া মায়া। কাজেই এই মায়ার ইতিহাস রচনা করতে তার স্বাভাবিক অনীহা। তার আশু প্রয়োজন, উচ্চবর্ণের ও বিত্তবানের যথোচিত সেবার দ্বারা সে পরজন্মের জন্যে কিছু সুখ লগ্নি করে রাখুক এবং এই ভাবেই ধীরে ধীরে মোক্ষের দিকে অগ্রসর হোক। পৃথিবীর সব ধর্মেই স্বর্গ বা মোক্ষের আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, এ জন্মটা খরচ করো পরজন্মের জন্যে পুণ্য সঞ্চয় করে। এ থেকে এ জন্মে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্বন্ধে ঔদাসীন্য জন্মায়। এ ঔদাসীন্য থেকে মানুষ শুধু স্বার্থসংকীর্ণ লক্ষ্যে— নিজের সুখ, স্বর্গ ও মোক্ষের অভিমুখে যায়। গোষ্ঠী বা সমগ্র দেশবাসীর সম্পর্কে কোনও বোধই জন্মায় না। ফলে ওই সব সম্বন্ধে কোনও কাজেও তার উৎসাহ জাগে না। সাধারণ মানুষ সমষ্টিগত জীবন ও তাদের অধিকার সম্বন্ধে অবহিত হয়ে যৌথ সংগ্রামে ইতিহাসের চেহারা পালটে দিতে পারে। সমাজে ক্ষমতায় আসীন শাসক-শোষক ও পুরোহিত শ্রেণি কেন চাইবে এ ব্যাপার ঘটুক? অতএব ছোট ছোট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলে, নিজের ও নিজের চোদ্দোপুরুষের বড় জোর নিজের গোত্র-প্রবরের ইতিহাস ছাড়া অন্য কিছুতেই উৎসাহ দেখা দেয় না। এ দেশে সম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থা, ধর্মসংস্থান, দর্শনপ্রস্থান, নৈতিক মূল্যবোধ ইতিহাস-সচেতনতার প্রতিকূলে। ফলে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’, আমার যেন পরজন্মে উচ্চবংশে ধনীর গৃহে সুস্থ পুরুষরূপে পুনর্জন্ম হয়, এইটুকু স্বার্থের গণ্ডিতেই জীবনটা বেষ্টিত থাকে। এ গণ্ডির মধ্যে ইতিহাস-চেতনা জাগে না। এতে আশু আপাত সুখের সন্ধানে শাস্ত্রনির্দিষ্ট পথে জীবনটা কেটে যায়।

এ সমস্ত সত্ত্বেও মানুষ মাঝে মাঝেই নিজের অবস্থার চাপে ও দুঃখের ভারে ছোট ছোট পরিসরে বিদ্রোহ করেছে। কখনও জিতেছে কখনও বা হেরেছে। এ সব বিপ্লবের ইতিবৃত্ত সরাসরি পাওয়া যায় না। কিন্তু কোথাও কোথাও এদের কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। আজ ভারতবর্ষের মানুষ তার চারশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস জানে, এখনকার গবেষণা তার পূর্বের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের অনেকটাই জানে, বিদেশি পর্যটকের বিবরণ, শিলালেখ, তাম্রশাসন, প্রত্নখনন, বিক্ষিপ্ত সাহিত্য ও তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এ সব থেকে ভারতীয়দের কাছে তার অতীত ইতিহাস একটা বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে। আজ সে জানে, তার ইতিহাসে গৌরব কোথায়, কতটা, গ্লানিই বা কতখানি।

অতএব সাম্প্রতিক কালে মানুষ সকল ভারতীয়দের, বিশেষত নিগৃহীত, নিপীড়িত ভারতীয়দের উত্থান ও মঙ্গলের জন্য সমবেত চেষ্টায় ইতিহাসকে জেনে তাকে পরিবর্তিত করতে দৃঢ়পরিকর। ক্ষমতায় আসীন মানুষ সে ইতিহাসকে তার অনুকূলে বিকৃত করে সামগ্রিক পরিবর্তন বিলম্বিত করতে চেষ্টা করছে; কিন্তু মানুষ একবার চক্ষুষ্মান হলে শ্রেণিস্বার্থসচেতন হয়ে পীড়ন দমনের প্রতিকারের অঙ্গীকার নিলে ইতিহাস তার অনুকূল। আজ হোক, একশো বছর পরেই হোক, ইতিহাসই তাকে পথ দেখাবে; কোন কারণে সে নিপীড়িত এবং কোন পথে এর প্রতিকার, সে দিকে নির্দেশ দেবে। ইতিহাসচেতনা প্রাচীন ভারতবর্ষে ছিল না, এখন এসেছে, এবং এখনই এর সাহায্যে ইতিহাসকে সর্বজনীন জনকল্যাণের অভিমুখে পরিবর্তিত করার সময় উপস্থিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *