রামচরিত্রের পুনর্মূল্যায়ন

রামচরিত্রের পুনর্মূল্যায়ন

রামায়ণ সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে সংক্ষেপে তার রচনাকাল, স্তরবিন্যাস এবং রচনার প্রক্রিয়া বিষয়ে কিছু বলে নেওয়া দরকার। পণ্ডিতেরা মনে করেন, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকের কাছাকাছি এর রচনার সূত্রপাত এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় (কারও কারও মতে চতুর্থের প্রথমাংশে) এ রচনা তার বর্তমান কলেবর লাভ করে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কাহিনির বিভিন্ন অংশ অবলম্বনে নানা স্থানে কিছু কিছু গাথা রচিত হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে কিছু কিছু গাথা পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে রামায়ণের কাণ্ডগুলির আংশিক কাঠামো প্রস্তুত করে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শেষ ভাগে বাল্মীকি বা কোনও মহাকবি এগুলিকে সংহত রূপ দেন। তারই শ’খানেক বছরের মধ্যে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ দিক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে মূল রামায়ণ অর্থাৎ, অযোধ্যা থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত গ্রন্থটি বর্ণনা ও অলংকারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এর পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রথম ব্রাহ্মণ্য বা ভার্গব প্রক্ষেপ। অর্থাৎ, আদিকাণ্ডের প্রথমার্ধ ও উত্তরকাণ্ড, যা সমাপ্ত হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে। পরের প্রক্ষেপ সম্ভবত তৃতীয় শতকে এবং হয়তো চতুর্থের শুরুতে এর শেষতম প্রক্ষেপ।

মূল এবং প্রক্ষেপের পার্থক্য নিহিত আছে ভাষায়, ব্যাকরণে, অলংকারে, বিষয়বস্তুতে ও ধর্মীয়-দার্শনিক মূল্যবোধে। এগুলি অনুধাবন করেই আমরা রচনার বিভিন্ন স্তরের চরিত্র ও রূপ জানতে পারি। এর দু’টি প্রধান অংশ— মূল ক্ষত্রিয় কাহিনি: অযোধ্যা থেকে যুদ্ধ বা লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত এবং ব্রাহ্মণ্য বা ভার্গব প্রক্ষেপ। অর্থাৎ, আদি বা বালকাণ্ডের প্রথমাংশ ও উত্তরকাণ্ড। মূল রামায়ণে রাম দেবতা নন, মানুষ; প্রক্ষিপ্ত অংশে, বিষ্ণুর অবতার। আদি কাণ্ডের শুরুতে বাল্মীকি নারদকে জিজ্ঞেস করছেন: ‘এই পৃথিবীতে কে এমন গুণবান, বীর্যবান, ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যবাক, দৃঢ়ব্রত, চরিত্রবান, সর্বভূতে হিতকারী আছেন— যিনি বিদ্বান, সমর্থ, প্রিয়দর্শন, আত্মবান, জিতক্রোধ, দ্যুতিমান ও পরশ্রীকাতর নন? যুদ্ধে ক্রুদ্ধ হলে কাকে দেবতারাও ভয় পান? (১:২-৪) উত্তরে নারদ বলেন, ‘এই সব গুণযুক্ত যিনি বীর্যে বিষ্ণুর সদৃশ, সেই মানুষের কথা বলছি।’ (১:২:১৮) অন্য একটি সংস্করণে নারদ বলেন, ‘যে সব গুণের কথা বলছ, তার আধার তো দেবতাদের মধ্যেও কাউকে দেখতে পাইনে, যে মানুষটি এই সব গুণযুক্ত, তার কথা বলছি, শোনো।’ (১:১১ )

এই যে ‘অশেষবিধ গুণযুক্ত’ মানুষ রামচন্দ্র, তাঁর চরিত্রের কয়েকটি বিভিন্ন দিক আলোচনা করলে হয়তো রামায়ণের সামাজিক অর্থ ও তাৎপর্য আমাদের কাছে আরও খানিকটা স্পষ্ট হবে। রামায়ণে তাঁকে প্রথম দেখা যাচ্ছে পুত্ররূপে। প্রথমদিকে দেখি বাধ্য সন্তানের মতো তিনি পিতার আজ্ঞায় বিশ্বামিত্রের যজ্ঞে বিঘ্নকারী রাক্ষস মারতে গেলেন লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে। এ সময়ে অহল্যার শাপমুক্তি ঘটান পদস্পর্শে, এটা প্রক্ষিপ্ত অংশের, রামের দেবত্ব প্রতিপাদন করার জন্য সংযোজিত। তাড়কাকে বধ করতে রাম ইতস্তত করছেন দেখে বিশ্বামিত্র তাঁকে বললেন— এই স্ত্রীবধে কোনও অন্যায় হবে না। (১:১৫:২৭) রাক্ষস-বধে শৌর্য প্রমাণ হল, পরে বিশ্বামিত্র দুই রাজপুত্রকে নিয়ে জনকরাজার কন্যার বিবাহসভায় গেলেন। এই কন্যা বস্তুত ধরিত্রীদেবীর কন্যা, জনকরাজা হলকর্ষণের সময়ে এঁকে ক্ষেতের মধ্যে পান বলে এঁর নাম সীতা। অর্থাৎ, ইনি প্রকৃতপক্ষে দেবকন্যাই। জনকরাজার সভায় এ কন্যা বীর্যশুল্কা। লক্ষণীয়, কন্যাপণেরই একটি প্রকারভেদ এটি, যে কন্যাপণ আগে সমাজে চলিত ছিল। সভায় রাম অবলীলাক্রমে হরধনু ভঙ্গ করলে পর সীতার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হল। রাম বিয়েতে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে দাসদাসী ও একশত কন্যাও যৌতুক পান। চার ভাই বধূদের নিয়ে অযোধ্যায় এসে কিছুকাল সুখে বাস করার পর দশরথের ইচ্ছে হল, রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবেন। স্বাভাবিক নিয়মে জ্যেষ্ঠকুমারই রাজ্য পান, তবু রামায়ণে দেখি, দশরথ ভরতকে কেকয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং বৈবাহিক জনককে কোনও নিমন্ত্রণ করেননি, খবরও দেননি। কৈকেয়ী যখন পুরনো দু’টি বরে রামের বনবাস এবং ভরতের রাজত্বপ্রাপ্তি চেয়ে নেন এবং তা শুনে লক্ষ্মণ ক্রোধে অধীর হয়ে অনেক কটূক্তি করতে থাকেন, তখন রাম লক্ষ্মণকে বলেন,— ‘ভাই, আগেই, জননী কৈকেয়ীকে বিবাহ করার সময়েই মাতামহ কেকয়রাজের কাছে পিতা কৈকেয়ীর পুত্রকে রাজ্য দানে প্রতিশ্রুত ছিলেন।’ (২:১০৭:৩) অতএব কৈকেয়ী সেই কথা তুলে গোলমাল করতে পারেন বা ভরতও সে দাবি করতে পারেন এই আশঙ্কাতেই সম্ভবত ভরতকে মামার বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। যদিও দশরথ বলেন,— ‘ভরত তেমন ছেলেই নয়, সে রামের চেয়েও ধার্মিক।’ (২:১২:৬১-৬২) কৈকেয়ী অবশ্য সে কথা তোলেননি। দশরথের দেওয়া বরের জোরেই ইষ্টসিদ্ধি করেন।

এখানে লক্ষণীয়, আগের দিন যাঁর অভিষেক ঘোষণা করা হয়েছে, আগের রাত্রে যিনি সীতার সঙ্গে ব্রতশীল হয়ে অগ্নিগৃহে কাটিয়েছেন, সকালে কৈকেয়ীর মুখে নিজের মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ জানতে পেরেও সেই রাম মাত্র একটিই অভিযোগ করেছেন, ‘আমি পিতার কথায় অগ্নিতে প্রবেশ করতে পারি। কেন পিতা আগের মতো আমায় অভিনন্দন করছেন না? একটি অলীক ব্যাপার আমার চিত্তকে দগ্ধ করছে; রাজা নিজে কেন আমাকে ভরতের অভিষেকের সংবাদ দিলেন না? বললে, আমি খুশি হয়েই ভাই ভরতের জন্য সীতা, রাজ্য, প্রাণও দিতে পারতাম।’ (২:১৯:৬-৭) লক্ষণীয়, যৌতুকে পাওয়া শত কন্যার মতো বিবাহিত ভার্যা সীতাকেও দানের কথা ওঠে; যেন তিনি ব্যক্তি নন, বস্তুমাত্রই; সমাজ নারীকে মুখ্যত এই দৃষ্টিতেই দেখত।

বনে যাবার প্রসঙ্গে লক্ষ্মণ সঙ্গে যেতে চাইলে, খানিকটা আপত্তির পর রাম রাজি হলেন। সীতা যেতে চাইলে, বনবাসের কষ্টের কথা বলে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চাইলেন। বললেন, তুমি শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করো রাজধানীতে।’ ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে আমরা পড়ি, ‘কুলায় কন্যা প্রদীয়তে’ অর্থাৎ বধূটিকে শ্বশুর কুলে দান করা হয়। রামচন্দ্রও এখানে প্রায় তেমন কথাই বলছেন। সীতা যে যুক্তি দিলেন তাতে শ্বশুরকুলের পরিচর্যা গৌণ হয়ে গেল। যে সীতাকে রাম খুশি হয়েই ভরতকে দান করতে পারতেন সেই সীতা বললেন, ‘তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গে বাস করতেও অভিরুচি নেই। তোমার বিরহে, রাম, আমি এখানে প্রাণত্যাগ করব।’ (২:২৭:২১, ২:১৯:৫) এ কথা কোনও রকম কর্তব্যবোধে উচ্চারিত হয়নি, সতী সাধ্বীর মর্যাদা পাবার জন্যেও নয়, এর প্রেরণা এসেছে রামের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম থেকে। রাম সঙ্গে নিলেন সীতাকে; তেরো বছর বনবাসের সঙ্গিনী হলেন সীতা।

রামের সৌভ্রাতৃত্ব বারেবারেই দেখা গেছে। লক্ষ্মণ ও ভরতের সঙ্গে তিনি সস্নেহ ব্যবহার করেছেন, যদিও লক্ষ্মণ দাসের মতো নিরন্তর অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁদের পরিচর্যা করে গেছেন। রাম যখন রাজচিহ্ন হিসাবে নিজের উত্তরীয় বা বল্কল না দিয়ে পাদুকা দু’টি দিলেন, সেই পাদুকাকে সিংহাসনে রেখে নীচে বসে নন্দিগ্রামে চোদ্দো বছর রাজকার্য সম্পাদনের মধ্যেও রামের প্রতি ভরতের একটা দাস্যভাব আছে, যা তখনকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত মনোভাব। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতার বিকল্প, এ কথা লক্ষ্মণকে বিদায় দেবার সময়ে সুমিত্রার কথাতেও স্পষ্ট: ‘রামকে দশরথ বলেই মনে কোরো।’ প্রাচীন জগতে বড়ভাইকে বাবার প্রতিনিধি বলেই মনে করা হত; অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতাতেই জ্যেষ্ঠত্বের দাবি ও সম্মান এ ধরনেরই ছিল। যখন ভরত এসে রামকে বহু মিনতি করলেন সিংহাসন নেবার জন্য, তখন রাম পিতৃসত্য রক্ষায় ব্রতী বলে কোনও মতেই রাজি হলেন না। ভরতের ওপর তাঁর এ বিশ্বাস ছিল যে, বনবাসকাল পূর্ণ হলে তিনি অবশ্যই রামকে রাজত্ব ফিরিয়ে দেবেন। তা ছাড়া নির্বাসনের কথা শুনে বারেবারে রাম বলেছেন যে, রাজ্যে তাঁর লোভ নেই, এবং সত্যই তিনি এমন যুক্তি একবারও দেননি যে জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে সিংহাসনে তাঁর অপ্রতিহত দাবি, কৈকেয়ীর কাছে দশরথের প্রতিজ্ঞার কোনও মূল্য নেই। এ ব্যাপারে সত্যই তিনি নির্লোভতা দেখিয়েছেন। জাবালি, বশিষ্ঠ, লক্ষ্মণ ও কৌশল্যার যুক্তিতেও তিনি পিতৃসত্য রক্ষার দায়িত্ব ত্যাগ করেননি।

বনে অনেক রাক্ষস আক্রমণ করত, মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ এবং তপস্যার বিঘ্ন ঘটাত, রাম লক্ষ্মণকে প্রায়ই বহুসংখ্যক রাক্ষস মারতে হত। সীতার মনে হয়েছিল, এটা অনাবশ্যক প্রাণিবধ রাম অবশ্য বুঝিয়েছিলেন যে, মুনি-ঋষিদের জীবন বিঘ্নমুক্ত করার জন্যে এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সীতার কোমল চিত্ত এ আপত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে।

বনে যাবার পথে প্রথম রাত্রে তিনজন এলেন রামের বন্ধু নিষাদ রাজ গুহকের রাজ্যে। গুহক নানা খাদ্যসম্ভারে আপ্যায়ন করতে চাইলে রাম বললেন, ‘তাঁরা বনবাসী, ফলমূলই খাবেন, অন্যের দান প্রতিগ্রহণ করবেন না (২:৫০:৪৩,৪৪), গুহক যদি রথের ঘোড়াদের জন্য খাদ্য দেন তা হলে উপকার হয়।’ গুহক তাই করলেন। বনবাসে কিন্তু রাম-লক্ষ্মণ-সীতা, অত্রি-অনসূয়া, ভরদ্বাজ ও অন্যান্য মুনিদের দেওয়া ফলমূল ভোজন করেছেন, গুহকের কাছেও তা করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে রাত্রিতে তাঁরা উপবাসে কাটালেন। সেটা কি গুহক জাতিতে নিষাদ ছিল বলে?

রাবণের পরামর্শে মারীচ যখন সোনার হরিণ হয়ে এল, রাম সীতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেও না পেরে ধনুর্বাণ নিয়ে বেরোলেন, লক্ষ্মণের হাতে সীতার রক্ষার ভার দিয়ে। মারীচের মায়াতে বিপন্ন রামের ডাক শুনলেন সীতা, তখন আতঙ্কে হিতাহিতজ্ঞান-শূন্য হয়ে লক্ষ্মণকে কটুকথা বললেন, আদেশ করলেন রামের সাহায্যের জন্য তখনই যেতে। কাজটা অন্যায়, কিন্তু এই কটুকথার পিছনেও আছে প্রিয়তম রামের অমঙ্গল আশঙ্কা, এত পতিব্রতার কর্তব্য নয়, প্রেমের আকুতি।

লক্ষ্মণ চলে যাবার পরে, রাবণ প্রথমে সন্ন্যাসীর বেশে আশ্রমে আতিথ্য চাইলে, সীতা পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁকে অপেক্ষা করতে বললেন। তখন রাবণ স্বরূপ ধারণ করে সীতাকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেন। শক্তি ও ঐশ্বর্যের মোহ এবং প্রবল কামনার অভিব্যক্তির সঙ্গে ছিল দুর্বল নির্বাসিত মানুষ-স্বামীর সহদুঃখচারিণীর দৈন্য ও গ্লানির কথা। রাবণ এ কথাও বলেন যে, সীতা বিনা তিনি বাঁচতেই পারবেন না (৩:৬২:১৩)। উত্তরে সীতা বললেন- ‘তুমি শৃগাল হয়ে সিংহীকে পেতে চাইছ। কালসাপের মুখে হাত দিয়ে তার বিষদাঁত ওপড়াতে চাইছ। কালকূট বিষ পান করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছ, সূচি দিয়ে চক্ষু ভেদ করতে বা জিহ্বা দিয়ে ক্ষুর লেহন করতে চাইছ। রাঘবের প্রিয়াকে তুমি পেতে চাইছ? কণ্ঠে শিলাখণ্ড বেঁধে সমুদ্র উত্তরণ করতে চাইছ? দুই হাত দিয়ে চন্দ্র-সূর্য ধরতে চাইছ? তুমি রামের প্রিয়া বধূকে ধর্ষণ করতে চাইছ? জ্বলন্ত অগ্নিকে কাপড় দিয়ে আহরণ করতে চাইছ, তাই রামের কল্যাণী বধূকে হরণ করতে চাইছ? লৌহমুখ শূলের সামনে বিচরণ করতে চাও, তাই রামের অনুরূপ বধূকে পেতে চাইছ? বনে সিংহ আর শৃগালের যে পার্থক্য, ছোট খাল ও সমুদ্রের যে পার্থক্য, গরুড় ও সর্পের যে প্রভেদ, পানকৌড়ি ও ময়ূরের যে প্রভেদ, হাঁস ও শকুনির যে প্রভেদ— দাশরথি রামের সঙ্গে তোমারও সেই প্রভেদ।’ এই স্পর্ধিত উক্তি-পরম্পরা উদগত হয়েছে রামচন্দ্রের যোগ্যতায় একান্ত বিশ্বাস এবং তাঁর প্রতি গভীর প্রেম থেকে। সুখে-দুঃখে, প্রাসাদে-কান্তারে একান্ত ভাবে যে স্বামীকে তিনি দেখেছেন, বুঝেছেন, ভালবাসতে এবং নির্ভর করতে শিখেছেন, সেই স্বামীর সঙ্গে অন্য কারও তুলনা যেন তাঁর কাছে এক হাস্যকর প্রয়াস, যত প্রবল শক্তিমান ও ঐশ্বর্যবানই হোক না কেন সে প্রতিদ্বন্দ্বী।

রাম-লক্ষ্মণ জটায়ুর কাছে সীতা হরণের কথা শুনলেন। যেখানে কেউ সাক্ষী ছিল না, সেই নির্জন অরণ্যে জটায়ু বন্ধু দশরথের পুত্রবধূর অপমান ও অপহরণ দেখে, পরাজয়, আঘাত ও মৃত্যু অনিবার্য জেনেও, একাকী রাবণের প্রতিকূলতা করে মুমূর্ষু অবস্থায় বেঁচে ছিলেন যেন সীতার খবরটুকু রামকে দেবার জন্য। তাঁর মৃত্যুর পর রাম-লক্ষ্মণ পিতৃতর্পণের মতো করেই তাঁর অন্ত্যেষ্টি ও তর্পণ করলেন। এ রাম কর্তব্যনিষ্ঠ, সৌজন্যপরায়ণ। সীতা-বিরহে রাম দীর্ঘ বিলম্বিত বিলাপ করতে থাকেন লক্ষ্মণের সামনেই, লক্ষ্মণই তাঁকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। অযোধ্যা ত্যাগ করার সময় থেকে রামের মুখে একটিবারও শোনা যায়নি যে, নববিবাহিত লক্ষ্মণ বিনাবাক্যে ঊর্মিলাকে ফেলে রেখে তাঁর অনুগামী হয়েছেন। শূর্পণখা প্রসঙ্গে বরং মর্মান্তিক পরিহাস করে রাম রাক্ষসীকে বলেন, ‘লক্ষ্মণ অবিবাহিত, তুমি ওকেই বেছে নাও।’ পরিহাস হলেও কথাটা হৃদয়হীন। ভদ্র লক্ষ্মণ এ জন্যে রামকে কোনও অনুযোগও করেননি। রামের সৌভ্রাত্রের বিধানে এ কথা লেখে না যে, ছোট ভাইয়ের অকুণ্ঠ পরিচর্যার পশ্চাতে যে নীরব দীর্ঘ বিরহযাপন আছে তার কোনও স্বীকৃতি দেওয়া বা তার জন্য কৃতজ্ঞতারও প্রয়োজন আছে। সীতাও কোনও দিন এর উল্লেখ করেননি। বয়ঃকনিষ্ঠের কাছে যে কোনও রকম সেবা অকুণ্ঠ ভাবে নেওয়া সমাজে অনুমোদিত ছিল। ভ্রাতৃস্নেহের প্রমাণ দেখি যখন যুদ্ধে লক্ষ্মণ অজ্ঞান, তখন রামচন্দ্র বিলাপ করে বলছেন: ‘প্রাণ পেয়ে, সীতা পেয়ে কী লাভ আমার? মর্ত্যলোকে খুঁজলে সীতার মতো নারী আরও পাওয়া যাবে, কিন্তু লক্ষ্মণের মতো সচিব ও যোদ্ধা ভ্রাতা কোথাও পাওয়া যাবে না (৬:৪৯:৫)। পরে আবার শক্তিশেলে যখন লক্ষ্মণ অচেতন তখন রাম বলছেন, ‘দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, বন্ধুও পাওয়া যায়, কিন্তু তেমন দেশ তো দেখি না যেখানে সহোদর ভ্রাতা পাওয়া যায়।’ (৬:১০১:১৫) ‘(লক্ষ্মণ) তুমি যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন আমার জীবন নিরর্থক, সীতা বা বিজয়লাভ করাও নিরর্থক, (৬:১০১:৪৯)। বারবারই দেখছি, ভ্রাতৃস্নেহের কাছে পত্নীপ্রেম তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। এরই সঙ্গে স্বভাবতই চোখে পড়ে রামের প্রতি সীতার প্রেমের যে ঐকান্তিকতা, সীতার প্রতি রামের প্রেমে সে গভীরতা নেই। তাই স্ত্রী সুলভ, যত্রতত্র পাওয়া যায়, তাকে ইচ্ছামতো ত্যাগও করা যায়। এ বোধ রামের চিত্তে প্রথম থেকেই ছিল। যদি মেনেও নিই যে, শোকার্তের বিলাপে অত্যুক্তি কিছু থাকবেই, তবুও একই তুলনা— সীতার প্রতি প্রেমের সঙ্গে লক্ষ্মণের প্রতি স্নেহের— এটার কিছু ভিত্তি না মেনে উপায় থাকে না। এর অনেকটাই যুগধর্ম, পরে আলোচনা করছি। কিন্তু মূল কথা হল, লক্ষ্মণ শুধু ভাই নন, তিনি পুরুষ, অতএব সীতার ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান।

কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ডে সুগ্রীবের সঙ্গে রামের যে বন্ধুত্ব হয় তার মূল সূত্র ছিল পরস্পরের উপকার। সুগ্রীবের দাদা বালী সুগ্রীবের রাজ্য ও স্ত্রী ভোগ করেছে সুগ্রীবকে নির্বাসিত করে। রাম যেন সুগ্রীবের স্ত্রী ও রাজ্য উদ্ধার করে দেন, তা হলে সুগ্রীবও তাঁর বানর সেনাদের দিয়ে রামের অপহৃতা সীতার সন্ধান করবেন ও রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামের সহায়তা করবেন। দু’পক্ষই সত্যরক্ষা করেছিলেন। এর বাইরে যা, তা রামের দিক থেকে সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কিন্তু প্রথমেই প্রয়োজন ছিল বালীকে পরাজিত করা। এ ব্যাপারে রাম তার সামর্থ্য ঘোষণা করলেন একটি তিরে সাতটি তালগাছকে এক সঙ্গে ভেদ করে। পরে রামের প্ররোচনায় সুগ্রীব বালীকে আহ্বান করে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন, দু’ভাই একই রকম দেখতে বলে রাম বালীকে বধ করতে সাহস পেলেন না, পাছে তাঁর ভুলে সুগ্রীব নিহত হন। দ্বিতীয় বার সুগ্রীব গজপুষ্পীর হার পরে যাওয়ায় রাম গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে বাণ নিক্ষেপ করে বালীকে বধ করেন। বালী রামকে দেখতে পেয়ে প্রবল ধিক্কার দিলেন (৪:১৭:১৬) ক্ষত্রিয় হয়ে যুদ্ধনীতির মূল সূত্র লঙ্ঘন করে আড়াল থেকে শত্রু নিধন করার জন্য। কাজটা যে একটুও বীরোচিত নয়, বরং অত্যন্ত গর্হিত, এ কথা রাম কি জানতেন না? আগে বালী রাম সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ রাম কেমন করে পাপ করবেন?’ (৪:১৬:৫) দেখা গেল পাপ করতে রামের বাধল না, সীতা উদ্ধারের জন্য সুগ্রীবের সহায়তা তাঁর মতো নির্বাসিত অসহায় মানুষের পক্ষে যে অপরিহার্য, তাই অনায়াসে বীরনীতি পরিত্যাগ করলেন। বালীর অনুযোগ শুনে রাম একটার পর একটা কু-যুক্তির অবতারণা করলেন: ক্ষত্রিয় রাজারা মৃগয়া করে ভক্ষ্য মাংস সংগ্রহ করেই থাকে। উত্তরে বালী বললেন, ‘যে পাঁচটি মাত্র পঞ্চনখ ভক্ষ্য; সজারু, কুমির, গোসাপ, খরগোশ, কচ্ছপ— বানর তার মধ্যে পড়ে না। (৪:১৭:৩৯, ৪০) রাম বললেন, ‘রাজ্য ভরতের, আমি তার আজ্ঞায় পাপীর দণ্ড দিই, তুমি ভ্রাতৃবধূকে গ্রহণ করেছ, অতএব দণ্ডনীয়।’ কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যটা ইক্ষ্বাকুদের ছিল না, ছিল বানরদের। রাম বললেন, ‘শিকারি তো লুকিয়েই প্রাণী বধ করে।’ (৪:১৮:৩৮) বালী আগেই বলেছেন, ‘বানরমাংস ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের অভক্ষ্য।’ কাজেই শেষ পর্যন্ত স্বীকার না করলেও প্ৰতিপন্ন হয়ে রইল যে, রাম অধার্মিক উপায়ে কাপুরুষের মতো বালীকে বধ করেছেন। কেন এমন করলেন? একটি মাত্র উত্তরই সম্ভব: স্বার্থসিদ্ধি। বালী এত বড় বীর যে, রামের আশঙ্কা ছিল সম্মুখসমরে তিনি পরাজিতও হতে পারেন, তাই ক্ষাত্রধর্ম, বীরধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে ‘যেন তেন প্রকারেণ’ইষ্ট সিদ্ধি করলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বনবাসকালে চোদ্দো হাজার রাক্ষসবধ কেমন যেন অবাস্তব সাজানো কাহিনি, রূপকথার উপাদান মনে হয়। প্রথম সম্মুখসমরেই রাম নৈতিক ভাবে পরাজিত, বীরধর্মচ্যুত।

সীতাকে লঙ্কায় এনে রাবণ তাঁকে অশোকবনে রাখেন, রাক্ষসীদের নিযুক্ত করেন তাঁকে পাহারা দেবার জন্য। নিজে প্রায়ই এসে সীতাকে লঙ্কার সমস্ত ঐশ্বর্যের অধীশ্বরী হবার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে অনুরোধ করতেন রাবণকে গ্রহণ করতে। সীতা রাজি না হওয়ায়, শেষবারে এক মাস সময় দিয়ে বলেন, এক মাস পরেই তাকে কেটে রান্না করা হবে। এর মধ্যেই বানরসেনা চতুর্দিকে সীতার সন্ধানে গিয়ে হতাশ হলেন। হনুমান লাফ দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় এসে ঘুরতে ঘুরতে অশোকবনে এক অশোক গাছের উপরে বসে নীচে সীতাকে দেখতে পেলেন। রামের অদর্শনে বন্দিনী সীতার অবস্থা কী রকম? ‘উপবাসে কৃশতনু, দীনহীন, দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন বারেবারেই, যেন নির্মল প্রতিপদের চন্দ্রকলাটি।’ (৫:১৫:১৯) হনুমানের সঙ্গে রামের প্রথম দেখার সময়ে রাম সীতাবিরহে আর্ত, বহু বিলাপ করেছেন তার আগে, কিন্তু সেই অবস্থায় হনুমান রাম-লক্ষ্মণকে দেখেন, শ্রীযুক্ত, রূপবান, বিক্রমে বৃষভশ্রেষ্ঠের ন্যায়, করিকরের মতো তাঁদের বাহু, উজ্জ্বলকান্তি নরবৃষভ দু’টি।… বিশালবক্ষা, সিংহস্কন্ধ দুই বীর। তাঁদের দুই হাত আয়ত, গোল যেন প্রাচীরের মতো।’ (৪:৩:১০,১২, ১৪) এই বর্ণনায় আর যাই থাক, বিরহক্লিষ্ট শীর্ণতা নেই। সেই হনুমানই সীতাকে দেখেই প্রথম যা লক্ষ করলেন তা হল কৃশতনু, দীনহীনবেশ, ক্রমাগত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেন। হনুমান সীতাকে আশ্বস্ত করলে সীতা রামের প্রত্যয়ের জন্য একটি ছোট দাম্পত্য কাহিনি বলে নিজের চূড়ামণিটি তাঁকে দিলেন অভিজ্ঞান হিসেবে। সে মণি হনুমানের হাতে দেখে রাম বললেন, ‘সেই কৃষ্ণায়তনেত্রাকে না দেখে এক মুহূর্তও বাঁচব না।’ (৫:৬৬:১০) বললেন, ‘ঘন কালো যার চোখ দু’টি, সে রাক্ষসদের মধ্যে থেকে কোনও পরিত্রাতার সন্ধান পাচ্ছে না, আমিই তার নাথ, এখন সে অনাথার মতো আছে।’ (৬:৫:১৫)। হনুমানকে সীতা রামের বিষয়ে যখন কুশল প্রশ্ন করেন, ‘দীন ভ্রান্ত অবস্থায় তিনি কর্তব্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না তো? সেই রাজপুত্র পুরুষোচিত কাজগুলি সব করছেন তো?’ (৪:৩৬:১৮) এ প্রশ্ন শুধু স্বামীর শারীরিক মঙ্গলবার্তার জন্য নয়, এ হল কর্তব্যনিষ্ঠ ক্ষত্রিয়বীর, মর্যাদাবান রাজার শ্রেষ্ঠসত্তার কুশল সম্বন্ধে প্রশ্ন। এ প্রশ্নে রামের প্রতি সীতার সেই প্রেম দেখি, যে প্রেম সম্মুখপানে চলিতে, চালাতে জানে, যার মধ্য দিয়ে প্রেমিকযুগলের সত্তার উত্তরণ ঘটে। এ কথা বলতে হল এ জন্যে যে, এ প্রেমের জাত আলাদা এবং কাহিনির শেষ দিকে বারবার সীতার এই প্রেমই অপমানিত, ধূলি-লুণ্ঠিত হয়েছে।

রাম সম্বন্ধে সীতার আশঙ্কাও ছিল, হনুমানকে বললেন, আমার এই নির্বাসনে রাম আমার ওপরে স্নেহ ত্যাগ করেননি তো? এই বিপদ থেকে আমায় উদ্ধার করবেন তো? (৮:৩৬, ৪০) এর প্রথমাংশে হয়তো কতকটা সত্য ছিল; যুদ্ধ শেষে স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে দেখা গেল দীর্ঘ অদর্শনে রামের মনে সীতা সম্বন্ধে আশঙ্কা জন্মেছিল, স্নেহ যেন বিলীন হয়েছিল। প্রশ্নের দ্বিতীয়ার্ধে: এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করবেন তো? সত্যও হয়েছিল, মিথ্যাও হয়েছিল; সীতা লঙ্কাপুরীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর জন্য যুদ্ধ হয়নি, সে কথা রাম স্পষ্টই বলেন, এবং মুক্তি এল বঞ্চনার রূপ ধরে। সে কথা পরে।

লঙ্কায় প্রবেশ করে রামের মনে হয়েছিল, মৃগশাবকের মতো চোখ যার, সেই বৈদেহী কৃশ দেহে ভূমিশয্যায় শুয়ে আমার জন্যে শোকাতুরা হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। (৬:২৪:৮,৯) ‘দেবকন্যার মতো যে সীতা কখন সেই সাধ্বী উৎকণ্ঠিত হয়ে আমার কণ্ঠ আলিঙ্গন করে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করবেন?’ (৬:৫:২০) যুদ্ধ শেষে হনুমান রামকে বলেন, সীতা রামকে দেখতে চান। শুনে ধার্মিক-শ্রেষ্ঠ রাম ঈষৎ অশ্রুপ্লুত-নেত্রে যেন ধ্যানাবিষ্ট হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারদিক দেখে বিভীষণকে হুকুম দিলেন, (৬:১১৪:৪,৫) সীতা যেন স্নান করে সাজসজ্জা করে সভায় আসেন। দীর্ঘ অদর্শনে অধীরা সীতা অবশ্য যেমন ছিলেন সেই ভাবেই দেখা করতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীর হুকুম মেনেই যেতে হল। সীতা শিবিকায় করে আসছিলেন, চারিদিকে অসম্ভব ভিড়; বিভীষণ লোকদের সরিয়ে শিবিকাটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাম তা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘পায়ে হেঁটে আসুন সীতা।’(৬:১১৪:৩০) এতে হনুমান, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব মনে করলেন, যেন সীতার প্রতি অপ্রীত হয়ে সীতা সম্বন্ধে এ ভাবে এই দারুণ ইঙ্গিত দিয়েছেন রাম। (৬:১১৪:৩৩) জনাপবাদের ভয়ে রামেরও চিত্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। রাজনন্দিনী রাজকুলবধূ জনসমাকুল সভাগৃহে পায়ে হেঁটেই স্বামী সন্দর্শনে গেলেন।

সীতা রামের কাছে এসে প্রণাম করে দাঁড়ালে, নতমুখী মৈথিলীকে দেখে রাম তাঁর হৃদয়ের অন্তর্গতভাব ব্যক্ত করতে শুরু করলেন। (৬:১১৫:১) এ কথাটির উল্লেখ করছি এই জন্যে যে, সীতার তথাকথিত অগ্নিপরীক্ষার পরে রাম বলেছিলেন যে, সীতার শুদ্ধতা নিয়ে তাঁর কোনও সংশয় ছিল না, শুধু প্রজাদের অপবাদের ভয়েই তিনি তাঁকে পরিত্যাগ করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি যা বলেন তা তাঁর ‘হৃদয়ের অন্তর্গতভাব’, এ কথা বাল্মীকি স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন।

কী সেই ভাব? যে-সীতাকে না দেখতে পেয়ে বনে বনে হা-হুতাশ করে বেড়িয়েছিলেন রাম, তাঁকে দেখতে পেয়েই কী বললেন? ‘যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি, তোমাকেও মুক্ত করেছি, ভদ্রে। পৌরুষ দিয়ে যা করবার ছিল তা আমি করেছি। বৈরভাবের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি, ধর্ষণা প্রমার্জনা করেছি। শত্রু এবং অপমান এক সঙ্গেই শেষ করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আমার শ্রম আজ সফল হয়েছে। প্রতিজ্ঞা থেকে আজ উত্তীর্ণ হয়েছি, নিজের প্রভুত্ব ফিরে পেয়েছি। (৬:১১৫:১-৪) এ কথা শুনে সীতার চোখ দু’টি মৃগীর মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠল, জল ভরে এল চোখে। (৬:১১৫:১০) তার পর, তা দেখেও রাম বলতে লাগলেন, ‘তোমার কুশল হোক, জেনে রাখো, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্কমোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে তুমি আছো, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনি। তাই জনকাত্মজা, এই দশ দিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে— তোমাকে আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই। কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে স্ত্রী তাকে ফিরিয়ে নেবে? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব? যে জন্যে যুদ্ধজয় করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও তুমি: বুদ্ধিমান আমি তোমাকে বলছি, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে মনোনীত করে নাও। তোমার মতো দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে দেখে, রাবণ নিজগৃহে খুব বেশি দিন চুপচাপ সহ্য করেনি।’ (৬:১১৫:১৫-২৪)

এর উত্তরে বাল্মীকি রামায়ণে সীতা বললেন, ‘তুমি যেমন ভাবছ, মহাবাহু, আমি তেমন নই। নিজের চরিত্র দিয়ে আমাকে বিশ্বাস করো, এই শপথ করো।’ (৬:১১৬:৬) Gorresio সংস্করণের রামায়ণে এবং মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্গত রামোপাখ্যানে একটু অন্য পাঠ আছে। রাম সীতাকে বলছেন: ‘যাও বৈদেহী, তুমি মুক্ত। যা করণীয় ছিল, তা আমি করেছি।

আমাকে স্বামী পেয়ে তুমি রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে যাবে এটা হয় না, তাই রাক্ষস (রাবণ)-কে হত্যা করেছি। আমার মতো ব্যক্তি ধর্ম ও অধর্মের ভেদ জেনেও পরহস্তগতা নারীকে কেমন করে এক মুহূর্তও ধারণ করবে? তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রওই হও, মৈথিলি, তোমাকে আমি ভোগ করতে পারিনে, (তুমি) যেন কুকুরে চাটা ঘি।’ (৩:২৭৫:১০-১৩) এখানে কতগুলি লক্ষণীয় ব্যাপার আছে: পুরো কথোপকথনে রাম বা সীতার কেউই অপরকে প্রিয় সম্ভাষণ করেননি, স্বামী-স্ত্রী বলেও উল্লেখ করেননি। সীতা ‘মহাবাহু’ বলেছেন রামকে, রাম সীতাকে ‘বৈদেহী’ ‘মৈথিলী’ ‘ভদ্রা’ সম্বোধন করেছেন। রাম স্পষ্টই বলেছেন, সীতার চরিত্র ভাল হলেও তাকে গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ‘পরহস্তাগতা’ হয়েছিল, অতএব কুকুরে চাটা ঘি দিয়ে যেমন যজ্ঞীয় কর্ম করা যায় না, তেমনি সীতাকে তিনি ‘পরিভোগ করতে পারেন না। প্রাচীন ভারতবর্ষে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মূলমন্ত্র উচ্চারিত হল, ‘পরিভোগ’। খুব নির্মম ভাবে সীতাকে বলেছেন রাম, যে সীতা উদ্ধারের জন্যে তিনি মোটেই যুদ্ধ করেননি, করেছেন ইক্ষ্বাকুকুলের রাজবধূ রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে গেলে তাঁর বংশমর্যাদায় হানি হয়, তাই। লক্ষ্মণ বনাগমনের পূর্বে সুমিত্রাকে প্রণাম করতে এলে সুমিত্রা বলেন, ‘রামকে দশরথ মনে করবে, সীতাকে আমি (সুমিত্রা, জননী) মনে করবে।’ এখন সীতাকে পরিত্যাগকালে রাম অনায়াসে বলছেন, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব, বিভীষণ যাকে ইচ্ছা পতিত্বে বরণ করো। বিধবা নারীর পক্ষেই শুধু শাস্ত্রের বিধান ছিল, দেবরকে বরণ করা তবে কি রাম বলতে চান, সীতার পক্ষে তিনি মৃত? স্বামী-পরিত্যক্তা নারী কি বিধবার তুল্য? আর সুগ্রীব, বিভীষণ? বানর, রাক্ষসকেও সীতা গ্রহণ করতে পারেন? এ অপমান করবার অধিকার রাম কোথা থেকে পেলেন? শূর্পণখাও তো রামকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তবে কি রামও কুকুরে চাটা ঘি? সীতার জন্যে এত যে বিলাপ, তা কি শোকোচ্ছ্বাস, না পরিভোগ-বঞ্চিত কামুকের আর্তনাদ? বহুপত্নীক দশরথের পুত্র রাম একপত্নীক, সীতাকে নিয়ে তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু এটা এমন কিছু বড় কথা নয়, কারণ লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন ও একপত্নীকই ছিলেন। বরং রামের অভিষেক প্রসঙ্গে একটা উক্তি আছে মূল বাল্মীকি রামায়ণে; তখন রামের ‘পরমা স্ত্রীরা’ হৃষ্টা হলেন, (বহুবচন, স্ত্রিয়ঃ)। (২:৯:১২) যদি ধরে নিই, সেকালে রাজপুত্রদের বহু বিবাহের বিধি ছিল, তাই রামের আরও পত্নী ছিল, সীতা মহিষী ছিলেন বলেই অশ্বমেধ যজ্ঞ করবার সময়ে রাম আর বিয়ে না করে সোনার মহিষী দিয়েই যজ্ঞীয় প্রয়োজন সাধন করেছিলেন, তবু এ কথাটা থেকে যায়, যে চার রাজপুত্রই একপত্নীক ছিলেন, এ গৌরব একা রামের নয়। সীতাকে ভালবাসতেন এ কথা বৈশিষ্ট্য পেল সীতা হরণের পরে রামের উন্মাদপ্রায় আচরণে এবং ঠিক সেই কারণেই বহুদিন অদর্শনের পরে প্রথম দর্শনে ‘গচ্ছ বৈদেহী, মুক্তা ত্বম্’ বেশি রকম বিসদৃশ লাগে। পরে দেবতারা সীতাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করবার পর রাম বলেন, তিনি ঠিকই জানতেন, শুধু লোকাপবাদের ভয়ে ওই সব কথা বলেছিলেন। তখন প্রশ্ন ওঠে, প্রথমত, বাল্মীকি ওই সব কথার ভূমিকায় বলেছিলেন, রাম ‘হৃদয়ান্তর্গতভাব’ বলেছেন। দ্বিতীয়ত, সন্দেহ হয়ে থাকলে সীতাকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারতেন। তৃতীয়ত, হনুমান দেখেছিলেন, সীতাকে রাবণ প্রলোভন এবং ভয় দেখানো সত্ত্বেও সীতা অবিচলিতা ছিলেন। চতুর্থত, সন্দেহের প্রশ্ন উঠলে সীতাও রামের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে পারতেন। পঞ্চমত, সন্দেহ হলেই স্ত্রীকে ত্যাগ করতে হবে, এমন কথা কোনও শাস্ত্রে নেই। ষষ্ঠত, ত্যাগ করার জন্যে বানর রাক্ষস ছোটভাই সকলের সামনে কুকুরে চাটা ঘি বলবার প্রয়োজন ছিল না। সপ্তমত, ত্যাগ করে সকলের সামনে তিন দেবর, বানররাজ, রাক্ষসরাজকে সম্ভাব্য পতিরূপে উল্লেখ করার কোনও প্রয়োজন বা অধিকার তাঁর ছিল না। অষ্টমত, চক্ষু-ব্যাধিগ্রস্ত লোকের পক্ষে প্রদীপ যেমন অসহ্য তেমনি অসহ্য সীতা রামের দৃষ্টিতে। ব্যাধিটি কার? দোষটা কার?

রামের মর্মন্তুদ কথা শুনে সীতা বললেন, ‘আমার গাত্র যে স্পর্শ করা হয়েছে তখন তো আমি বিবশা, অর্থাৎ দুর্বল বলে প্রবলের বশে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। স্বেচ্ছায় আমি সেটা ঘটাইনি, এখানে অপরাধ দৈবের। আমার অধীন যেটা, আমার হৃদয়, সেটা তো তোমাতেই সমর্পিত। দেহটা পরের অধীনে গেলে অসহায় আমি কী করব? হে মানদ, তোমার সঙ্গে এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তাও যদি তুমি আমাকে না জেনে থাকো, তা হলে চিরদিনের মতোই আমি অভিশপ্তা।… লঘুচিত্ত মানুষের মতো তুমি আমার নারীত্বকেই সামনে রাখলে, জনকের সামনে পৃথিবী থেকে উত্থিত হয়েছিলাম সে কথাটা, আর, হে চরিত্রজ্ঞ, আমার চরিত্রের যে বহুতর যে নিদর্শন ছিল তাকে কোনও প্রাধান্য দিলে না। স্বীকার করলে না যে, আমার বালিকা বয়সেই তুমি আমার পাণিগ্রহণ করেছিলে, আমার ভক্তি, চরিত্র এ সব পিছনে ফেলে দিলে।’ (৬:১১৬:৬,৯,১০,১৫,১৬) বালিকাবয়সে বিবাহের উল্লেখের তাৎপর্য হল, সীতার যৌবন কেটেছে রামের সান্নিধ্যে, তাতে কখনওই কি কিছু সন্দেহের লেশমাত্র পেয়েছেন রাম? আর একটা বড় তাৎপর্য আছে দেহ ও মনের পার্থক্যে। যে দেহটাকে পরের স্পর্শ থেকে বাঁচানোর বল বা সামর্থ্য ছিল না সেইটেই বড় হয়ে উঠল? যে-মনটা আকৈশোর অবিচল ভাবে রামের উদ্দেশে সমর্পিত থেকেছে, তার কোনও মূল্য নেই? আগেই বলেছি, রামের সঙ্গে বনে আসার কোনও দরকারই ছিল না সীতার। শুধু রামকে ছেড়ে থাকা তাঁর পক্ষে দুঃসহ ছিল বলেই জোর করে সঙ্গে এসেছিলেন। এ সব তুচ্ছ হয়ে গেল, শুধু তার গায়ের জোরটা রাবণের চেয়ে কম ছিল বলে? লক্ষ্মণকে সীতা চিতা প্রস্তুত করতে বললেন, কারণ, রামের প্রেম ও বিশ্বাস থেকে যখন বঞ্চিত হয়েছেন, তখন বেঁচে থাকার কী সার্থকতা আছে? বাল্মীকি বলেছেন, চিতা নির্মাণের ব্যাপারে রাম কোনও আপত্তি করলেন না দেখে লক্ষ্মণ চিতা নির্মাণ করলেন। চিতা তিনবার প্রদক্ষিণ করতে করতে সীতা বললেন, ‘রামের থেকে আমার মন যখন সরে যায়নি তখন অগ্নি আমাকে সর্বতোভবে রক্ষা করুন।’ বৈদিক যুগ থেকে আত্মশুদ্ধি প্রমাণের এই উপায়টি প্রবর্তিত ছিল, একে বলে ‘সত্যক্রিয়া’। নিজের শুদ্ধির প্রমাণ দিতে দেবতাদের আহ্বান করা। প্রথমে অগ্নি, পরে অন্য দেবতাদের আহ্বান করলেন সীতা। তাঁরা এসে সীতাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সীতার অগ্নিপ্রবেশের কারণ যে রামের সীতা-চরিত্রে সংশয়, এ সম্বন্ধে প্রায়ই বলা হয় যে, প্রজাদের সংশয় নিরসনের জন্যেই রাম সীতাকে নিষ্পাপ জেনেও সন্দেহ ব্যক্ত করেন। এর উত্তরে দু’টি কথা বলা যায়, প্রথমত, বাল্মীকির মতে রাম ‘হৃদয়ান্তর্গতভাব’ প্রকাশ করেছেন, সে ভাব হল সীতার নিষ্পাপতায় রামের অবিশ্বাস, আর দ্বিতীয়ত, লঙ্কায় অযোধ্যার প্রজা একজনও ছিলেন না লক্ষ্মণ ছাড়া, এবং লক্ষ্মণ কখনওই সীতা-চরিত্রে সন্দিহান ছিলেন না। দেবতারা সীতাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করার পর রাম বললেন, ‘লোকসমাজে সীতার অগ্নি প্রবেশের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল, (কারণ) ইনি রাবণের অন্তঃপুরে দীর্ঘকাল বাস করেছেন। (৬:১১৮:১৩) আরও বললেন, ‘ত্রিলোকের প্রত্যয়ের জন্যে সত্যব্রত আমি এঁর হুতাশনে প্রবেশ উপেক্ষা করেছিলাম। (৬:১১৮:১৭)

প্রমাণের পরে অযোধ্যায় ফিরে এলেন। কিছুকাল আনন্দে কাটল। সীতাকে সন্তান-সম্ভবা জেনে রাম তাঁর ‘দোহদ’ বা সাধ পূরণ করতে চাইলে সীতা বাল্মীকির আশ্রম দেখতে চাইলেন, রাম সম্মত হলেন। ইতিমধ্যে প্রজারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘পূর্বকালে রাবণ যাঁকে বলপূর্বক হরণ করে কোলে বসিয়েছিল, সেই সীতার সম্ভোগে রামের কেমন সুখ হয়? আমাদের স্ত্রীদেরও এমন আচরণ সহ্য করতে হবে। রাজারা যেমন আচরণ করেন, প্রজারা তারই অনুবর্তন করে। (৭:৪৩:১৭,১৩) শুনে রাম চিন্তা করে সীতাকে নির্বাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু বললেন, ‘আমার অন্তরাত্মা জানে যে, সীতা শুদ্ধা এবং যশস্বিনী। (৭:৪৫:১০) ভাইদের ডেকে বললেন, ‘অপবাদ ভয়ে ভীত আমি নিজের প্রাণ দিতে পারি, পুরুষষভ তোমাদেরও ত্যাগ করতে পারি, জনকাত্মজাকে তো বটেই।’ (৭:৪৫:১৪,১৫) সংস্কৃত পাঠটির মধ্যে একটা যেন পর্যায় বিভাগ আছে— সবচেয়ে দামি মানুষের নিজের প্রাণ, তার পর বীর ভাইরা, তার পরে স্ত্রী— ‘কিং পুনর্জনকাত্মজাম্’-এর মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য নিহিত আছে।

এখানে ভেবে দেখতে হবে, স্ত্রীকে বনবাস দেওয়ার সপক্ষে কোনও শাস্ত্ৰ নেই। দ্বিতীয়ত, অগ্নিসাক্ষী করে যার পাণিগ্রহণ করেছেন, তাকে অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ ছাড়া ত্যাগ করা যায় না, তেমন অপরাধেও ত্যাগ সকল শাস্ত্রকার সমর্থন করেন না। তৃতীয়ত, যে ইক্ষ্বাকুকুলের সম্মানের জন্য লঙ্কার যুদ্ধ, সেই ইক্ষ্বাকুকুলের ভাবী সন্তান যাঁর গর্ভে তাঁকে ত্যাগ করা অত্যন্ত গর্হিত। চতুর্থত, বাল্মীকির আশ্রম দেখতে চেয়েছিলেন সীতা অন্তঃসত্ত্বা নারীর দোহদ বা সাধ হিসাবে, সেই আশ্রমে রাম তাঁকে পাঠালেন ছলনাকে আশ্রয় করে, এ এক মর্মান্তিক বিদ্রূপ সীতার প্রতি। রাম তাঁর জ্ঞাতসারে সীতাকে চিরতরে বিসর্জন দিচ্ছেন। তাঁদের দাম্পত্যের অন্তিমপর্বে স্ত্রীকে একটি মিথ্যা বলে বিদায় দিলেন। বনে সীতা লক্ষ্মণকে বললেন, ‘আমার এই দেহটি নিশ্চয় শুধু দুঃখের জন্যে সৃষ্ট হয়েছিল, লক্ষ্মণ।’ (৭:৪৮:৩) বললেন, ‘ধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত সেই রাজাকে বোলো, রাঘব, তুমি যথার্থই জানো যে, সীতা শুদ্ধা, পরম ভক্তিমতী, তোমার মঙ্গলে নিবিষ্টচিত্তা, সেই আমাকে তুমি সমাজে অযশের ভয়ে ত্যাগ করলে।’ (৭:৪৮:১২,১৩)

এবং এ ত্যাগ দ্বিতীয়বার। প্রথম পরিত্যাগ এবং দেবতাদের দ্বারা সীতার শুদ্ধি ঘোষণার সাক্ষী ছিলেন রাম, লক্ষ্মণ দু’জনেই। সীতার কথাগুলি লক্ষণীয়, ‘ধর্মে সুসমাহিত (বা সুপ্রতিষ্ঠিত) রাজাকে জানিও, লক্ষ্মণ, যে তিনি যথার্থই (বা স্পষ্টই, ‘তত্ত্বেন’) জানেন যে, প্রজাদের অভিযোগ মিথ্যা, তিনি জানেন সীতার একনিষ্ঠতা, রাম সম্বন্ধে তাঁর হিতৈষণা, তথাপি লোকাপবাদের ভয়ে তিনি নির্দোষ অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বনবাস দিচ্ছেন। নিত্যদিন প্রেমের একনিষ্ঠতা নিয়ে যে নারী স্বামীর সহচারিণী ছিলেন, তাঁকে ত্যাগ করবার আগে প্রজাদের কাছে নিজে একবার বলাও দরকার মনে করলেন না যে, সীতা লঙ্কায় অগ্নিশুদ্ধা, রাম ও লক্ষ্মণ তার সাক্ষী। সমস্ত কর্তব্য শুধু ভ্রান্ত সন্দেহে সন্দিহান প্রজাদের প্রতি, দীর্ঘদিন নিষ্কলুষ অন্তঃশুদ্ধা সঙ্গিনীর প্রতি কোনও কর্তব্য নেই?

এর কিছুদিন পরে এক ব্রাহ্মণের বালকপুত্র অসময়ে মারা যায়। রাজপুরোহিতরা রামকে বলেন, রাজ্যে কেউ পাপ করেছে, যার ফলে এই অঘটন ঘটল। খোঁজ করতে করতে দেখা গেল, শম্বুক নামে এক শূদ্র সশরীরে দেবত্ব পাবার জন্য তপস্যা করছে, সে নিজেই সে কথা স্বীকার করল। (৭:৬:২) ‘সেই শূদ্রটি কথা বলতে বলতেই উজ্জ্বল খঙ্গ কোষ থেকে বের করে তার মুণ্ড ছেদ করলেন রাঘব।’ তখন দেবতারা সাধুবাদ দিয়ে রামকে বললেন, ‘রাম তুমি দেবতাদের কার্যসাধন করলে, তোমার জন্য এই শূদ্র স্বর্গর্ভাক্ হতে পারল না।’ (৬৭:২, ৪,৭,৮)

সীতা বিসর্জনের কিছুদিন পরে রাম অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন ঠিক করলেন। সীতার স্বর্ণমূর্তি গড়িয়ে পাশে বসিয়ে যজ্ঞ সমাধা হল। বাল্মীকির আশ্রমে সীতার যে যমজ পুত্র জন্মেছিল, লব ও কুশ তারা ততদিনে কিশোর। বাল্মীকি তাদের নিজের রচনা রামায়ণ কাহিনি গাইতে শিখিয়েছেন। বাল্মীকির আজ্ঞায় যজ্ঞের সময় ব্রহ্মচারীর বেশে তারা সমবেত জনতাকে রামকাহিনি শুনিয়ে শুনিয়ে বেড়াচ্ছিল। রাম দেখতে পেয়ে ডেকে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জেনে বাল্মীকিকে বলে পাঠালেন, সীতা যেন প্রকাশ্য রাজসভায় এসে নিজের শুচিতা প্রমাণ করেন। বাল্মীকি রাজি হয়ে বললেন, ‘লোকাপবাদভীত হে মহাব্রত রাম, তুমি অনুমতি করলেই সীতা তোমার প্রত্যয় উৎপাদন করবেন। আমি কখনও মিথ্যাবাক্য বলেছি মনে পড়ে না। এ দু’টি তোমারই পুত্র।’ (৭:৯৬:১৭:১৯) আর বললেন, ‘আমি বহু সহস্র বৎসর তপস্যা করেছি। মৈথিলী যদি দুষ্টা হন তো আমি যেন সেই দীর্ঘ তপস্যার ফল না ভোগ করি। মনে, কথায়, বাক্যে কখনও পাপ করিনি, মৈথিলী যদি নিষ্পাপ হন তবেই যেন তার ফল ভোগ করি।’ (৭:৯৬:২০,২১) বাল্মীকির কথাগুলি শপথ, অর্থাৎ বাল্মীকি নিজের সমস্ত তপস্যার ফল বন্ধক রেখেছেন সীতার শুচিতার প্রমাণ হিসাবে। কায়মনোবাক্যে নিষ্পাপ বাল্মীকি এই নিষ্পাপতার সমস্ত পারলৌকিক পুরস্কার ও পুণ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে রাজি আছেন, যদি সীতার মধ্যে কোনও পাপ থাকে। শুধু রামায়ণের রচয়িতা নন, শুদ্ধাচারী নিষ্পাপ তপস্বী, যিনি সুদীর্ঘকাল তপস্যার দ্বারা বহু পুণ্য অর্জন করেছেন তিনি রামকে বলছেন, সীতা নিষ্পাপ না হলে আমি যেন সারাজীবনের কঠিন সাধনার কোনও পুণ্যফল না পাই।’ এই শপথই তো যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল রামের পক্ষে। হল না।

এ বার নিজের ছেলেদের সামনে, অযোধ্যার কৌতূহলী সন্দিগ্ধ জনতার সামনে, ঋষি পুরোহিতদের সামনে, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে আমন্ত্রিত বিপুলসংখ্যক মানুষের সামনে আজন্ম শুদ্ধচারিণী সীতাকে তৃতীয়বার পরীক্ষা দিতে হল। প্রথমবার লঙ্কায়, রামের প্রত্যাখ্যানের পরে, দ্বিতীয় বার সন্তানসম্ভবা অবস্থায় শুধুমাত্র জনশ্রুতির ভয়ে, তৃতীয়বার এইবার রাজসভার মধ্যে রাজনন্দিনী রাজকুলবধূ সীতা পরীক্ষা দিতে এগিয়ে এলেন। গুরুজনদের ও স্বামীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করবার পর তিনি বললেন: ‘যদি রাম ভিন্ন অন্য কাউকে মনেও চিন্তা না করে থাকি, যদি মনে কাজে কথায় রামকেই অভ্যর্থনা করে থাকি, এ সব কথা যদি সত্য বলে থাকি, তা হলে দেবী ধরিত্রী আমাকে স্থান দিন।’ (৭:৯৭:১৪,১৬) এ কথা বলার পরই পৃথিবী দু’ভাগ হল এবং দেবী বসুন্ধরা সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় আবির্ভূত হয়ে সীতাকে কোলে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন।

সীতা যে কথাগুলি বললেন, তার মধ্যে কতগুলি কথা লক্ষ করা উচিত। যে শুচিতা প্রতিপাদন রাম চাইছিলেন, সীতা তিনটি উক্তির দ্বারা তা সাধন করলেন। এ তাঁর শেষ সত্য-ক্রিয়া এবং তিনি যে প্রার্থনা করলেন শপথের সঙ্গে তা সফল হল অর্থাৎ, তাঁর শুচিতা প্রমাণিত হল এবং ধরিত্রী দেবী তাঁকে স্থান দিলেন। প্রাচীন পরিপ্রেক্ষিতে রামের চেয়ে জন্মস্বত্বে সীতা অধিক গৌরবের অধিকারিণী: এক দেবীর কন্যা। অথচ রামায়ণে বারবার রাম সগৌরবে ইক্ষ্বাকুবংশের কথা বলেন, ধরিত্রীকন্যা সীতার কথা কোথাও উল্লেখ করেন না। আরও লক্ষ করার বিষয়, রাম বা তাঁর প্রজারা স্থূল ধরনের শুচিতার কথা বারবার বলেন অর্থাৎ, পরপুরুষের সংস্পর্শ— সীতার শপথ তার চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের; মনে, কথায়, কাজে রাম ভিন্ন আর কাউকে স্থান দেননি, এই তাঁর শপথ। লঙ্কাতেও বলেছিলেন, ‘অবলা বলে দেহটাকে রাক্ষসের স্পর্শ থেকে রক্ষা করতে পারিনি, কিন্তু যে মনটা অকৈশোর তোমার উপর একনিষ্ঠ থেকেছে তার কোনও দাম দিলে না তুমি?’ আজও সেই কথাই বললেন, ‘মনেও যদি কখনও আর কাউকে ভেবে থাকি…। এ কথাগুলি দাম্পত্য প্রেমের অনেক উচ্চতর মানদণ্ড থেকে বলা, রাম ও প্রজারা শুধু দেহের শুচিতা নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন, সীতা যে অন্তরের শুচিতায় উজ্জ্বল, সে কথা এখানে প্ৰতিপন্ন হল।

এখন অযোধ্যার প্রজাদের রাম বলতে পারতেন, ‘লঙ্কায় দেবতারা স্বয়ং অগ্নিশুদ্ধ সীতার শুচিতা প্রতিপাদন করে গেছেন, আমরা দুই ভাই তার সাক্ষী এবং আমরা মিথ্যাবাদী নই, তা তোমরা মানো। দ্বিতীয়ত, পরের প্রজন্মের লোকেরা তো আবার কোনও কারণে সন্দিহান হয়ে বলতে পারত যে, সীতা শুচিতার প্রমাণ দিন আবার; এ তো বারেবারেই ঘটতে পারত। তৃতীয়ত, বাল্মীকির শপথের পরে রাম সমস্ত অযোধ্যাকেই বলতে পারতেন, এই তপস্বীর বাক্যই চূড়ান্ত প্রমাণ বহন করে যে, সীতা নিষ্পাপ, সেটা বললে প্রজাসাধারণ নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হত, কিন্তু খুব সম্ভব রাম নিজের প্রজারঞ্জকতার প্রমাণ দিয়ে ধর্মভীরু রাজার খাতিরটা পাবার চেষ্টা করেছিলেন। এটা পাবার উপায়, নির্দোষ সীতার প্রকাশ্য অসম্মানে। এবং বাল্মীকির কথাকেই চূড়ান্ত ভাবে প্রামাণ্য বলে না স্বীকার করা বরং বাল্মীকিকেও এই বিরাট জনসমাবেশে অপমান করা।

এ বার সীতা আর কিছুতেই রামের ফাঁদে পা দিলেন না। বললেন না যে, যদি শুচি হয়ে থাকি তো দেবতারা এসে সে কথা প্রমাণ করুন। বললেন, যদি কায়মনোবাক্যে একমাত্র রামকেই জীবনে জেনে থাকি, তা হলে দেবী বসুমতী স্থান দিন। মৃত্তিকার কন্যা মৃত্তিকাতে বিলীন হয়ে যেতে চাইলেন। চাইলেন না শুচি প্রতিপন্ন হয়ে আবার সিংহাসনে রামের পাশে মহিষী হয়ে বসে রাজপুত্রদের জননীর সম্মান পেতে। এটা শুধু অভিমানে নয়, আতঙ্কে এবং আত্মসম্মান রক্ষায় বলা কথা। আতঙ্ক, পুনর্বার এমন পরীক্ষা দেওয়ার সম্ভাবনার, সেটাকে প্রতিহত করলেন এবং নারী হিসেবে নিজের ধর্মনিষ্ঠতা প্রমাণ করে এ বার মানুষ হিসেবে নিজের সম্মান রক্ষার জন্য পৃথিবী থেকে সরে যেতে চাইলেন। স্ত্রী হিসেবে তাঁর শুচিতা শেষবার প্রমাণিত হল কিন্তু তার মানবিক মর্যাদার সম্মান রক্ষা করার জন্যে তো কেউ ছিল না। স্ত্রীকে সব রকম অসম্মান থেকে রক্ষা করা স্বামীর একান্ত কর্তব্য, রামায়ণে স্ত্রীকে চরমতম অসম্মানে ঠেলে দেওয়াই রামের ভূমিকা। তাই পরম অনীহা এবং জুগুপ্সায় তিনি জীবন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে সরে গেলেন। লঙ্কায় রাম বলেছিলেন, ‘তোমার শুচিতায় আমি সন্দিহান, তোমাকে ভোগ করতে পারি না।’ এ বার সীতা বিনা কথায় বললেন, ‘আমি শুচি, কিন্তু আমি তোমার ভোগ্যবস্তু নই আর। স্ত্রীর কর্তব্য যা তার অনেক বেশিই করেছি, কোনও মূল্য পাইনি তার, ইক্ষ্বাকুবংশই তোমার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে আছে, সেই বংশের দু’টি উত্তরাধিকারী দিয়ে গেলাম। ধর্ম-ক্রিয়ায় স্বর্ণসীতা দিয়েই কাজ চলবে। শুচিত্ব প্রমাণিত হলে আমাকে তোমার প্রয়োজন থাকবে, কিন্তু তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই।’ এই একবার সীতা সমস্ত নারী জাতির হয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করলেন। এর পরে রাম আবার বিলাপ করলেন, বসুমতীকে কটু কথা বললেন সীতাকে প্রত্যার্পণ না করার জন্যে, কিন্তু সত্যিকারের শুচিতার যে একটা অলঙ্ঘনীয় তেজ আছে তা এ বার তাঁকে ‘চড়া দাম’ দিয়ে বুঝতে হল বুঝতে হল, নারীকে অকারণে সন্দেহ করলে এবং সে সন্দেহের ভিত্তিতে দণ্ড দিলে সে দণ্ড ফিরে এসে লাগে।

এর পর বেশ কিছুকাল রাজত্ব করার পরে ব্রহ্মা এসে রামকে জানালেন যে, বিষ্ণুরূপে তাঁর স্বর্গে ফিরে যাবার সময় হয়েছে। তখন তিনি ধীরে ধীরে সরযূর জলে নেমে গেলেন এবং দেবাতারা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গেলেন, সেখানে তিনি বিষ্ণু, সীতা লক্ষ্মী।

স্বভাবতই রাম উপাখ্যানে কতগুলো প্রশ্ন জাগে। প্রথমত, বালী বধ বিষয়ে। স্পষ্টতই ক্ষত্রিয় বীরের পক্ষে কাজটা গর্হিত, এক বানররাজকে আড়ালে লুকিয়ে থেকে হত্যা করা, এটা কোনও নীতিকেই সমর্থন করা যায় না। উত্তরে যদি বলি, সীতাকে খুঁজে পাবার জন্যে সুগ্রীবের সাহায্য অত্যাবশ্যক ছিল, তা হলেও প্রশ্ন ওঠে যে, এতে রামের বীরত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে। সম্মুখ সমরে তা হলে বালীকে হারাবার শক্তি বা সে শক্তি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস রামের ছিল না। এটা এত যশস্বী ক্ষত্রিয়বীরের পক্ষে গ্লানিকর। কাজটা কাপুরুষোচিত, সম্পূর্ণ স্বার্থপ্রণোদিত। এবং আরও কলঙ্ককর হল, বালীকে নিজের প্রজা বলে শাসন করেছেন বলা, বানরমাংস অভক্ষ্য তবুও বালী-হত্যাকে মৃগয়া বলা এবং আনুষঙ্গিক বিস্তর কুযুক্তির অবতারণা করা।

গুহকের আতিথ্য গ্রহণ না করার মধ্যেও বর্ণ-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে। ফলাহারী ঋষিরাও অন্যের দেওয়া ফল খেতে পারেন, বনবাসকালে রাম বেশ কয়েকজন মুনিঋষির আতিথ্য নিয়েওছেন। গুহক চণ্ডাল, তাই তার কাছে শুধু পশুর খাদ্যই গ্রহণ করলেন।

অন্ধমুনি বৈশ্য, তাঁর স্ত্রী শূদ্রা। (২:৫৭:৬৩) তিনি নিজেকে ‘বানপ্রস্থী’ বলছেন কী করে? তা হলে শম্বুকের সাধনাও তো অশাস্ত্রীয় হয় না? এই শম্বুককে রাম বধ করেছেন এক ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রকে বাঁচাতে। তা হলে প্রাণের মূল্য রাম রাজত্বে বর্ণগত ভাবে আপেক্ষিক, ব্রাহ্মণ-পুত্রের প্রাণ শূদ্রের প্রাণের চেয়ে দামি? এটা মেনে নেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রক্ষিপ্ত অংশে। রামরাজ্যে চণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু কথায়? যে ফল জল ব্রহ্মণ ঋষিদের কাছে নেওয়া যায় তা চণ্ডাল বন্ধুর কাছে নেওয়া যায় না? শূদ্র শম্বুক তপস্বী, কৃচ্ছ্রসাধনে রত কিন্তু সাধারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের তুলনায় তার প্রাণের মূল্য কিছু নেই।

বালীকে বধ করা, শম্বুককে হত্যা করা ছাড়াও যেটি আমাদের বেশি ভাবায় তা হল, সীতা-প্রত্যাখ্যান। সুন্দরকাণ্ডে সীতাহরণের পরে রামের যে বিলাপ, তার ভাব সম্পূর্ণতই বিরহার্ত প্রেমিকের, কিন্তু সে কি শুধু আলঙ্কারিক বিরহ? শুধু সীতাসম্ভোগ-বঞ্চিতের বিলাপ? নতুবা দীর্ঘ অদর্শনের পরে রামের ‘হৃদয়ান্তর্গত ভাব’ এমন হল কেন যে, সীতাকে দেখা মাত্রই তাঁর দুই চক্ষু পীড়িত বোধ করল এবং রাজনন্দিনী রাজকুলবধূ সীতাকে শিবিকা থেকে নেমে হেঁটে আসবার হুকুম দিলেন, সীতা আসামাত্রই বললেন, ‘গচ্ছ বৈদেহী’ তোমার জন্য যুদ্ধ করিনি, করেছি ইক্ষ্বাকুবংশের গৌরব রক্ষার জন্য। কোথায় ছিল সে ইক্ষ্বাকুকুলের গর্ব যখন লঙ্কায় প্রকাশ্য সভায় অপ্রমাণিত, অসত্য আশঙ্কায় রাজকুলবধূকে কটু কথা বলেছিলেন? কোথায় ছিল সে কুলগর্ব যখন দেবতাদের সাক্ষ্য, ঋষি বাল্মীকির শপথ সব অগ্রহ্য করে পুত্রদের, প্রজাদের, অতিথিদের সামনে ইক্ষ্বাকু-কুলবধূ সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন? কোথায় রইল সে গর্ব যখন দেবী বসুমতী বারংবার সন্দেহ-পীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত কন্যাকে কোলে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন? কে অপরাধী প্রমাণিত হল? অকারণ সন্দেহ এবং তার বশে দণ্ডদানের অপরাধে কলঙ্কিত হলেন না ইক্ষ্বাকু-কুলতিলক রামচন্দ্র? সীতা লক্ষ্মণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘রামকে বোলো, আমাকে চিরদিনই সম্পূর্ণ নির্দোষ জেনে, রামের হিতব্রতিনী জেনে, শুধু লোকাপবাদের আতঙ্কে ভয় পেয়ে ত্যাগ করলেন তিনি।’ এতে কি ইক্ষ্বাকুকুলের গৌরব বাড়ল? গৌরব বাড়ল অন্যায় দণ্ডদাতা রাজার? এ-ই রাম রাজ্যের নমুনা?

‘রামাকিয়েন’-এ ‘হিকায়েৎ সেরি রাম’ (zeis 2627 ) এবং ‘কম্বন’ রামায়ণে (২:১,৫) বলা হয়েছে, মন্থরা রামের প্রতি প্রতিকূল ছিল। অর্থাৎ, কৈকেয়ী নিজের থেকে রামের বনবাস চাননি। কৈকেয়ীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলেও দশরথের অন্যায় খণ্ডিত হয় না কিন্তু কৈকেয়ীকে দেওয়া বর দু’টির গুরুত্ব কমে যায়। কিন্তু এই সব ও অন্যান্য সংস্করণেও রামের তিনটি প্রধান অন্যায়, বালীকে বধ করা, শম্বুককে বধ করা ও সীতা-পরিত্যাগ এগুলো প্রায় সর্বত্রই আছে। বাল্মীকির তৃতীয় অধ্যায়ে রামায়ণের যে চুম্বকটি দেওয়া আছে তাতে লঙ্কায় রামের সীতা-পরিত্যাগ ও অগ্নিপ্রবেশ নেই, কিন্তু অযোধ্যায় সীতা-বিসর্জন আছে। (৩:১:৩৮) বাল্মীকি লব-কুশকে যে রামায়ণ গাইতে শিখিয়েছিলেন তাতে রাবণবধ পর্যন্তই ছিল। (পৌলস্ত্য-বধমিত্যেবম্) অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ঋষি পুত্রদের শেখাননি তাদের গর্ভধারিণীর প্রকাশ্য অসম্মানের কাহিনি, কারণ তখনও সেটা ঘটেনি।

মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সব মহাকাব্যই যুদ্ধবিজয়ে শেষ হয় (তুলনীয়, মহাভারত, ঈলিয়াড, ওডিসি, এল সীড, কালেভ্লা, নীবেলুঙ্গেনলীড ইত্যাদি)। এক সময়ে রামায়ণও রাবণ বধ পর্যন্তই ছিল। ‘ভাসে’ বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ডের উল্লেখ নেই। লক্ষণীয় ষষ্ঠ শতকে, বাল্মীকি রামায়ণে শেষতম সংযোজনের অনেক পরে ভট্টি তাঁর মহাকাব্য লিখছেন, ‘রাবণবধম্’ নাম দিয়ে। যদিও তাতে অগ্নিপরীক্ষা আছে কিন্তু ‘রঘুবংশ’-এ লঙ্কায় সীতার প্রত্যাখ্যান নেই, যদিও একটি মাত্র দ্ব্যর্থক শব্দে সীতার অগ্নিশুদ্ধির ইঙ্গিত আছে (জাতবেদো-বিশুদ্ধাম্। রঘুবংশ ১২:১০৪; এর অর্থ অগ্নি দ্বারা পরিশুদ্ধও হতে পারে, আবার অগ্নির মতো বিশুদ্ধাও হতে পারে) কিন্তু চতুর্দশ সর্গে সীতা এই উপমিত রূপক সমাসের অবকাশ রাখলেন না, লক্ষ্মণকে দিয়ে রামকে বলে পাঠালেন ‘চোখের সামনে আমাকে অগ্নি দ্বারা শুদ্ধ দেখেও’ (বহ্নৌ বিশুদ্ধামপি যৎ সমক্ষম্ ১৪:৬৯) অর্থাৎ, রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডের অগ্নিপরীক্ষার বিবরণ কালিদাসের অরুচিকর ঠেকেছিল তাই তার বর্ণনা করেননি। কিন্তু সীতার আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সে ঘটনাটির তীক্ষ্ণ এই উল্লেখের দ্বারা সীতার প্রতি তাঁর সমস্ত সহানুভূতি জানিয়েছেন।

রামের চরিত্রের যে-সব অসঙ্গতি চোখে পড়ে তার কারণ কী? ক্ষত্রিয়কুলোচিত বীরত্বের আদর্শে দীক্ষিত ও শিক্ষিত রাম মানবিক নৈতিক আদর্শের মর্যাদা রক্ষা, পিতৃসত্য রক্ষার জন্য অকুণ্ঠ চিত্তে বনে গেলেন সিংহাসনের আশা ত্যাগ করে। তার আগে ঋষিদের তপোবিঘ্ন নিবারণ করবার জন্যে, এবং বনবাসকালেও সে কারণে বীরের মতো বহু রাক্ষস তিনি বধ করেন, পিতৃবন্ধু জটায়ুর প্রতি যথাকর্তব্যে শেষ-কৃত্য সমাধান করেন তিনি, এই মানুষ পরপর তিনটি গর্হিত অন্যায় আচরণ (বালী বধ, সীতাপরিত্যাগ ও শম্বুক বধ) করলেন কেন?

রাম ‘একপত্নীক’, তাঁর অন্য স্ত্রীদের উল্লেখ আছে কিন্তু তাঁর জীবনে তাদের কোনও স্থান ছিল না। তবে একপত্নীক হওয়া সত্ত্বেও সীতার প্রতি তাঁর যথেষ্ট আসক্তি, সীতাহরণের পর সাময়িক উন্মাদনা হওয়া সত্ত্বেও সীতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মুখ্যত সম্ভোগের, সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। সম্পর্কটা প্রধানত কামনার বলে মেনে নিলে সীতা তাঁর ভোগ্যবস্তু হয়ে ওঠেন, ‘তাই প্রত্যাখ্যানের সময়ে বলতে পারেন, তোমাকে আর পরিভোগ (সর্বপ্রকারে ভোগ) করতে পারব না।’ সীতার জন্যে রামকে কখনও কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি, হলে তাঁর প্রেমের পরীক্ষা হত। শূর্পণখা প্রলোভন ছিল না, কিন্তু রামের সঙ্গে পুনর্মিলন অসম্ভব জেনেও রাবণকে বিমুখ করা ছিল সীতার দিক থেকে সত্যকার প্রলোভন জয় করা। সেই অপহরণের সময়ে রাবণের প্রতি তাঁর কটূক্তি-পরম্পরা এবং লঙ্কায় রাবণের শৌর্য যশ সমৃদ্ধি এবং তাঁর আগ্রহাতিশয্য এই সবই সীতা অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করেছেন, মাসান্তে তাঁকে কেটে ফেলা হবে জেনেও। আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে এ ত্যাগ স্বীকার তাঁর গভীর প্রেমের পরিচায়ক। রাম যে যুদ্ধ করেছিলেন তা সীতার জন্য নয়, ইক্ষ্বাকুকুলের মর্যাদা রক্ষার জন্যে, এ কথা তিনি নিজেই উচ্চারণ করে বলেছেন। সীতা যে ত্যাগ স্বীকার ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তা কেবলমাত্র রামেরই জন্যে। প্রত্যাখ্যান করবার আগেই বাল্মীকি বলেছেন, রাম তাঁর ‘মনোগত ভাব’ প্রকাশ করেছেন: কাজেই পরে তিনি বলেছেন যে, আমি জানতাম সীতা নিষ্পাপ কিন্তু জনসাধারণের প্রত্যয়ের জন্যে বলেছি এই সব কথা, এটা সত্য নয়। দু’টি কারণে, প্রথমত, তিনি সে কথা উচ্চারণ করে বলতে পারতেন যে, ‘আমার সন্দেহ নেই, লোকের সন্দেহ মোচনের জন্য তুমি অগ্নিতে প্রবেশ করো।’ দ্বিতীয়ত, এই প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা বলেছেন যা নিজের সন্দেহ না থাকলে নিরর্থক হয়ে পড়ে। যেমন ‘চক্ষুপীড়াগ্রস্তের পক্ষে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক, আমার দৃষ্টিতে তুমিও তাই।’ কিংবা ‘কুকুরে চাটা ঘি-এর মতো তুমি অভোগ্যা’ অথবা লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, বিভীষণ, সুগ্রীব যাকে ইচ্ছা পতিত্বে বরণ করো। এই সব কথাই রামের নিজস্ব সন্দেহ বা এই প্রত্যয়ই প্ৰকাশ করে যে, সীতা পাপিষ্ঠা। না হলে সীতার হরণের পর উন্মত্তবৎ আচরণ করেন যিনি, দীর্ঘ এক বৎসর অদর্শনের পরে প্রথম দর্শনেই তিনি বলেন, ‘তুমি যাও, তোমাকে আমার কোনও প্রয়োজন নেই?’

সীতাকে বহু বৎসর ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার পর, হনুমানের কাছে তাঁর প্রলোভন জয় করার এবং বিরহক্লিষ্ট অবস্থার বর্ণনা শোনবার পর, নিঃসন্দিগ্ধ অভিজ্ঞান ও নিবিড় দাম্পত্য জীবনের প্রামাণ্য উপাখ্যান শোনবার পরে, সীতাকে দীনবেশে দেখে, রাম দর্শনে উৎফুল্ল তাঁর মুখ দেখবার পরেও রামের মনে এ সন্দেহ জাগল কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর সবটা রামচরিত্রের মধ্যে পাওয়া যাবে না। সেই যুগটাকেও দেখতে হবে। রামায়ণ রচনার কাল নির্ণয়ে দেখেছি মূল গ্রন্থ [আদিকাণ্ডের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত] মোটামুটি কুষাণ সাম্রাজ্যের সমকালীন: খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে। এই সময়ে ভারতবর্ষের সমাজ, দর্শন ও চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে। এর কিছু আগে থেকেই বারবার বিদেশি আক্রমণকারীরা আসেন ও ধীরে ধীরে তাঁদের মত, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক বিধি ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ক্রমাগত যবন, শক, পারদ, পহ্লব, কুষাণ, মুরুণ্ড ইত্যাদি আক্রমণগুলি ঘটে এবং এর দ্বারা ভারতবর্ষের সামাজিক ও মননগত জগতে যে বিরাট ও স্থায়ী পরিবর্তন আসে, তার সবচেয়ে স্পষ্ট চিহ্ন আছে রামায়ণ মহাভারতের ভার্গব প্ৰক্ষেপে।

এই কালসীমার মধ্যেই রচিত বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’, যেখানে দু’বার নারী সম্বন্ধে স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়েছে যে, সে ‘পণ্যদ্রব্য’। (পণ্যসধর্মত্বাৎ ২:১:১৩, ৪:১:১) এই কালসীমার মধ্যে রচিত ভগবদ্‌গীতা, যেখানে বর্ণসঙ্করের পুরো দায়িত্ব নারীকে দেওয়া হয়েছে (স্ত্রীষু দুষ্টাসু বায়ে জায়তে বর্ণসঙ্কর: ১/৪০) অথচ ভেবে দেখলে বোঝা যায়, পুরুষের ভূমিকা সমান সক্রিয় না হলে বর্ণসঙ্কর হওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ, বিদেশিদের সঙ্গে বৈবাহিক বা বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক সম্বন্ধে সমাজের আতঙ্ক তখন অত্যন্ত তীব্র। মহাভারতের ভার্গব সংযোজনে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘নারীর চেয়ে পাপিষ্ঠ আর কেউ নেই।’ (১৩:৪০:৪) এই মর্মে বিস্তর কথা তৎকালের সাহিত্যে পাওয়া যায়। ‘মনুসংহিতা’ আর একটি ভার্গব রচনা, গোবিন্দরাজের টীকায় দেখি, ভৃগুর কোনও শিষ্য ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত উপাদান সংগ্রহ করে মনুসংহিতা রচনা করেন। ব্যুলার বলেন, ‘ভৃগুর মনুসংহিতা হল বহু ছন্দোবদ্ধ মনুসংহিতার শেষতম অংশ।’ (সেক্রেড বুকস অব দি ঈস্ট গ্রন্থরাজিতে মনুসংহিতার ভূমিকা পৃ. ৯৭) মনুতে নারীর উপনয়ন নেই, আছে বিবাহ, বেদপাঠ হল পতিসেবা এবং পতিকুলে বাস হল ব্রহ্মচর্য। (২:৬৭) অর্থাৎ, সমাজের নারীর অবনমনের একটি দলিল।

তা হলে এই সেই যুগ, যখন নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বঞ্চিত, পণ্য-দ্রব্য রূপে পরিগণিত, একা তারই দোষে বর্ণসঙ্কর হয়, তার চেয়ে পাপিষ্ঠ কেউই নেই। বিদেশি আক্রমণের ফলে আরও প্রবল হল বর্ণসঙ্করের আতঙ্ক। বার্ডোসানেস নামে এক সিরীয় গ্রন্থকার রচনা করেন ‘বুক অব দ্য লস অব দ্য কান্ট্রিস’ ১৪০ খ্রিস্টাব্দে। তাতে তিনি লিখেছেন, কুষাণেরা নিজেদের স্ত্রীদের রক্ষিতার মতো দেখত, তাদর কাছে কোনও যৌন আনুগত্য প্রত্যাশা করত না। তা হলে হয়তো আক্রমণ-পরম্পরার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জাতির দাম্পত্য সম্পর্কের শিথিলতার প্রভাবে আর্যাবর্তের সমাজজীবনে কিছু শৈথিল্য দেখা দিয়ে থাকবে, যে আতঙ্কে নারীজাতিকে মোটামুটি অন্তঃপুরে বন্দিত্বের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে, তাকে সন্দেহ করা অত্যন্ত ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়। এই সন্দেহ প্রথমবার করেন রাম যখন বিরাধ রাক্ষস সীতাকে স্পর্শ করে, তখন। সীতাকে পরে সন্দেহ করেন রাম মূল গ্রন্থাংশে (লঙ্কাকাণ্ডে), পরে করে অযোধ্যার প্রজারা, প্রক্ষিপ্ত অংশে, উত্তরকাণ্ডে। ‘যুদ্ধকাণ্ডের শেষাংশ রামায়ণ রচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে, তখন ক্ষত্রিয় বীর আর শুধু শৌর্যে মহীয়ান নন, তাঁর আচরণের মানদণ্ডও মহাকাব্যের কেন্দ্রে দেখা দেয়। প্রথম অংশে রাম নিশ্চিতই মানব… ন্যায়বিধির ধারক ও বাহক। দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনায় শৌর্যের চেয়ে নান্দনিক অংশের দিকে একটা ঝোঁক দেখা যায়, যেটা শৈলীর মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর একটা প্রসারের দিকে সরে এসেছে।’ (জে এল ব্রকিংটন: দ্য রাইটিয়স রাম। অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটি প্রেস, ১৯৮৪, পৃ. ৩২৩, ৩২৪, ৩১৯) এই যে রাম ক্ষত্রিয় শৌর্যের আদর্শ থেকে আদর্শ রাজা হওয়ার চেষ্টা করলেন, এতে তাঁর ওপরে দায়িত্ব এল আদর্শ রাজা হবার নিরিখ অক্ষুণ্ণ রাখার। এই আদর্শ রাজার সম্বন্ধে মহাভারত, মনু ও সমকালীন ধর্মশাস্ত্র এবং শিলালিপিতে কতগুলি মানদণ্ড পাওয়া যায়। প্রথমত, মৌর্যযুগ থেকে এবং বিশেষত কুষাণ যুগে, রাজা দেবতা হয়ে ওঠেন। ‘কুষাণ সাম্রাজ্যের অবসংগঠনে ছিল রাজ-কর্মচারী সৈন্যদল এবং সামন্ত শক্তি, আর শীর্ষভাগে ছিল এক পূর্ণ নিরঙ্কুশ বা প্রায় নিরঙ্কুশ একক সৈন্যশাসিত সাম্রাজ্য’ (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রাইজ অ্যাণ্ড ফল অব দ্য কুষাণ এম্পায়ার ফার্মা কে এল মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৮, পৃ. ৪৪৮)। কুষাণ আমলেই প্রথম রাজকীয় মুদ্রার প্রচলন হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের ফলে ও দেশে কৃষি শিল্প বাণিজ্যের বিস্তারের ফলে সমৃদ্ধির বৃদ্ধি ও বিকাশ হয় এবং সে সমৃদ্ধির রক্ষাকর্তা হিসেবে রাজার দায়িত্ব বাড়ে। সমৃদ্ধিমান ও সমৃদ্ধিহীন মোটামুটি এই দুই অংশে ভাগ হয়ে যায় প্রজা। যেমন খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়, তৃতীয় শতকের জৈনপ্রাকৃত গ্রন্থ ‘অঙ্গ বিজ্জা’ বলে, বর্ণ দু’টিই, ‘অজ্জ ও পেস্স’ (বা মিলক্ষু) আর্য অর্থাৎ ধনী ও পেস= প্রেষ্য অর্থাৎ, দাস অর্থাৎ নিৰ্ধন। (পুণ্য বিজয়জীর সংস্করণ ৫৭তম অধ্যায়, পৃ. ২১৮) এর মধ্যে ধনিক শ্রেণির ধন যেন নিরাপদে থাকে, অজ্জ যেন পেস্স’কে বশীভূত রাখতে পারে, সেটার দায়িত্ব বর্তায় রাজার উপরেই। কাজেই মহাভারত এবং তৎকালীন অন্যান্য গ্রন্থে রাজাকে দেবত্বে উন্নীত করা হয়েছে। (মহাভারত ১২:৬৫:২৮,২৯,৩২,৩৩,৪০। মনু সংহিতা ৮:৫, ১৪) ‘অজ্জ’ হল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের মধ্যে ধনী সম্প্রদায়, আর প্রেস হল তাবৎ নির্ধন ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং প্রধানত শূদ্র।

শূদ্রের কাজ উচ্চ তিন বর্ণের সেবা। শাস্ত্র শূদ্রকে ধন সঞ্চয়ে অধিকার দেয়নি; সে যদি সঞ্চয় করেও, তবুও সে ধন ব্রাহ্মণ যজ্ঞের জন্যে আত্মসাৎ করতে পারে। শূদ্রনারীকে উচ্চ তিন বর্ণের পুরুষ যথেচ্ছ ভোগ করতে পারে। শাস্ত্র নানা ভাবে তাকে হীনতা স্বীকার করিয়ে অসম্মানের মধ্যে রাখতে চেয়েছে। কিছু বৈশ্য ক্রমেই বাণিজ্যের দিকে চলে যাওয়ার ফলে কৃষি ও পশুপালন ক্রমেই শূদ্রেরই করণীয় হল এবং কখনও কখনও সে ব্যক্তিগত কিছু ধন অর্জন করতে পারত। মনু ‘আত্মোপজীবী’ অর্থাৎ, স্বনির্ভর শূদ্রের কথা বলেছেন (৭:১৩৮), বলেছেন ‘ন্যায়বতী’ শূদ্রের কথা। টীকাকার মেধাতিথি বলেছেন, ‘ন্যায়বতী শূদ্র’ পাক যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারেন। যাজ্ঞবল্ক্য সংদ্রিহতা পঞ্চ-মহাযজ্ঞেও শূদ্রের অধিকার স্বীকার করছে। (১:১২১, মনু ৩:১৫৬) বৃহস্পতি বলেছেন, শূদ্র উচ্চবর্ণের খেতে-খামারে বেগার খাটার পরিবর্তে কাঞ্চন মূল্য দিতে পারে (১২:১৬), আর শূদ্র বণিকের পক্ষে রাজস্বের হার সর্বাধিক। তা হলে কিছু কিছু শূদ্র আর্থিক ভাবে সচ্ছল এবং সমৃদ্ধিমান এবং ধর্মের ক্ষেত্রে অনেকটা উন্নতমানের অবস্থান লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ, কিছু শূদ্র ধীরে ধীরে অজ্জ বর্ণের কাছে আশঙ্কা এবং আতঙ্কের হেতু হয়ে উঠেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রামায়ণে শম্বুকের তপশ্চর্যা সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা বোঝা যায়। গীতায় কৃষ্ণ বলেন— শূদ্র, নারী, বৈশ্য এরা পাপযোনি, কিন্তু কৃষ্ণকে অবলম্বন করলে এরা ‘পরাগতি’ প্রাপ্ত হয়। (৯:৩২) তাই যদি হবে, তা হলে সশরীরে স্বর্গে যাবার জন্য তার তপস্যা এত অসহ্য হবে কেন? মনে রাখতে হবে, শম্বুক নিধনের পরে দেবতারা রামের উপরে পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন— ‘তোমার জন্যে এই শূদ্র স্বর্গভাক হতে পারল না।’ অর্থাৎ, মৃত্যু না হলে শম্বুক স্বর্গে যেত, রাম সেটা নিবারণ করলেন। কিছু কিছু শূদ্রকে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখবার প্রয়োজন হচ্ছিল, অতএব পরবর্তী কালে ব্রাহ্মবৈবর্ত পুরাণে ‘মায়াতি’ ‘সদ্র’ জাতিকে বলি দেবার বিধান যে কারণে সেই কারণেই এই যুগেই শূদ্রকে সর্বতো ভাবে অবদমিত করে রাখার দায়িত্ব ছিল রাজার। যে শূদ্র দাস, পরিচারক, সে যদি ধনে বা ধর্মে কিছু স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে তা হলে ‘অজ্জবন্ন’ আতঙ্কিত হতে পারে।

ব্যাকট্রিয়ান, গ্রিক, রোমান, চিনে হান রাজারা, শক কুষাণ রাজারা, ইউয়েহ্ চিহ্ন ও পারসিক রাজারা এই কালসীমার মধ্যেই দেবায়িত হচ্ছেন। ভারতবর্ষে রাজার দেবায়নের সঙ্গে যে-সব দায়িত্ব আসছে তার মধ্যে প্রধান একটি হল, বর্ণ-ধর্মরক্ষা। নাসিক শিলালিপিতে (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে) রাজা নপানের জামাই উষভদাত ব্রাহ্মণ-কন্যার বিবাহে ধন দান করছেন। দ্বিতীয় সাতকর্ণীর নানাঘাট লিপিতে পড়ি, তিনি চারটি বর্ণের মধ্যে সঙ্কর নিবর্তন করেছেন (বিনিবতিততচাতুবনসঙ্কর)। মহাভারতে প্রথম যে রাজার উপাখ্যান পাই, তিনি ‘বেন’র পুত্র ‘পৃথু’। তিনি প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করেন, ‘বর্ণসঙ্কর’ থেকে দেশকে রক্ষা করবেন (১২:৫৯:১১৪-১৫)।

বর্ণসঙ্করে এত ভয় কেন? কারণ চারটি। ঐতিহাসিক ভাবে চারশো বছরের বেশি কালসীমার মধ্যে পাঁচ-ছ’টি বিদেশি আক্রমণ ঘটে এবং অনিবার্য ভাবে বর্ণসঙ্করেরও বিস্তার ঘটে, যার দ্বারা ধীরে ধীরে বৈদেশিকরা সমাজজীবনে অনুপ্রবিষ্ট হয়। প্রথমে শূদ্র রূপে ও পরে ক্ষত্রিয় রূপে। দ্বিতীয়ত, বর্ণসঙ্কর ঘটলে ওই চতুর্বর্ণের পরিচ্ছন্ন একটা ছক, শাস্ত্রে যা চলে আসছিল, সেটা এলোমেলো হয়ে যায়, সমাজপতিদের মিশ্রবর্ণ সম্বন্ধে নতুন আইন তৈরি করতে হয়, ক্রমে ক্রমে তা করতে বাধ্যও হয়েছিলেন তাঁরা। তৃতীয়ত, বৃত্তিভেদ অনুসারে বর্ণ ক্রমেই বহু বিভিন্ন জাতিতে ভাগ হয়ে গিয়েছিল এবং যাচ্ছিল। তার ওপরে বিদেশি জাতির সঙ্গে মিলনে আরও বহুধা-বিভক্ত সমাজের ছক নির্মাণ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। চতুর্থত, বিদেশিদের প্রথমে শূদ্র বললেও যেহেতু তাঁরা বিজেতা এবং শক্তিমান, তাই ধীরে ধীরে তাঁরা ক্ষত্রিয়ত্বে উন্নীত হলেন। এই যে উচ্চতর বর্ণে অধিরোহণ, এটা শাস্ত্রকারদের কাছে অগ্রাহ্য মনে হয়েছিল। (লক্ষণীয় মহাভারত ৭:১৫৮:২০) এর পশ্চাতে ছিল কলিযুগ সম্বন্ধে আতঙ্ক। কারণ, সব শাস্ত্র কলিযুগের একটা প্রধান লক্ষণই হল বর্ণসঙ্কর এবং কলিতে শূদ্র নিজের হীনত্ব মেনে নেবে না; সে যে শুধু উচ্চবর্ণের বৃত্তি অবলম্বন করবে তাই নয়, উচ্চবর্ণ সম্বন্ধে শ্রদ্ধাপোষণও করবে না। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষেই এই আতঙ্কের প্রকাশ দেখি ‘যুগপুরাণে’। (শ্লোক ৫০,৫৩,৫৪)

আর আতঙ্ক ছিল নারীদের নিয়ে। শাস্ত্র একবাক্যে উচ্চস্বরে বলছে, কলিকালে নারী পতিব্রতা থাকবে না, পুরুষের বশে থাকবে না, স্বয়ম্ভর এবং স্বাতন্ত্র্যপরায়ণ হয়ে উঠবে। (দ্রষ্টব্য যুগপুরাণ শ্লোক ৮৩–৮৬; মহাভারত ৩:১৮৮:৭৭) নারী কৃষিকাজ পর্যন্ত নিজে করবে; (যুগপুরাণ শ্লোক ৮৩) অর্থাৎ, আর্থিক ভাবেও আর সে পুরুষ-নির্ভর থাকবে না। সহজেই বোঝা যায়, কোনও কোনও অঞ্চলে স্বয়ংসম্পূর্ণা বিদেশিনীরা স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করত না এবং আর্থিক ভাবেও কতকটা স্বনির্ভর ছিল এবং এর দ্বারা আর্যাবর্তের কিছু নারী প্রভাবিত হয়েছিলেন। মহাভারতের বনপর্বে (ভার্গব সংযোজনের অংশে) সত্যভামার প্রশ্নের উত্তরে দ্রৌপদী নিজেকে যেমন পাঁচ স্বামীর দাসীর ভূমিকায় চিত্রিত করেন ও বলেন— ‘স্বামীদের ক্রুদ্ধ সর্পজ্ঞানে সেবা করি।’ বলা বাহুল্য, ওই উপমার মনোভাব স্বামী-স্ত্রী কারওর পক্ষেই সম্মানের নয়, কিন্তু ভার্গবসংযোজনে নারীর জন্যে এই স্থানই নির্ধারিত হল। নারীর বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা তখন মেনে নেওয়া হচ্ছে না, সে পরপুরুষের সকল রকম সাহচর্য সর্বতো ভাবে বর্জন করবে কেন? পূর্বে যে ঐশ্বর্যবৃদ্ধির কথা বলেছি, সেই ঐশ্বর্য সঞ্চিত হচ্ছিল সমাজের উপরের স্তরে মুষ্টিমেয় একটা শ্রেণির হাতে। তাঁরা সে সম্পত্তি নিজেদের ছেলেদের ও তার দ্বারা নিজেদের বংশে সংরক্ষণ করবার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলেন। সম্পত্তিমান ব্যক্তি কী করে নিশ্চিত হবেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর যে ছেলে বা ছেলেরা সম্পত্তি পাবে, তারা নিঃসংশয়ে তাঁরই ঔরসজাত ছেলে? তাঁর স্ত্রীর যদি স্বাধীনতা থাকে, অন্য পুরুষের সংস্পর্শে আসবার তা হলে এ নিশ্চিতি ধ্রুব হতে পারে না। কাজেই নারীর সব রকম স্বাধীনতা হরণ করা হল, বারবার নানা শাস্ত্রে বলা হল, কৈশোরে তার রক্ষক পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্ররা, নারী স্বাধীনতার যোগ্যই নয়।

বন্ধন এত দৃঢ় হল যে, পরপুরুষকে স্পর্শ করা, তার সান্নিধ্যে আসা নিতান্ত গর্হিত বলে গণ্য হল। স্বামীকে অন্য নারী স্পর্শ করলে স্ত্রীর কোনও অধিকার নেই সে জন্যে স্বামীর কাছে জবাবদিহি চাওয়া। কেমন করেই বা চাইবে? বহু-বিবাহ, বহু-উপপত্নী গ্রহণ ও গণিকাগমনে যার অধিকার, সে পুরুষ ওই অর্থে তো একনিষ্ঠ নয়ই। ‘সতী’ শব্দের সমার্থক কোনও পুংলিঙ্গ শব্দই তাই নেই। কিন্তু নারী যে-বংশধর গর্ভে ধারণ করে, সে যে একান্ত ভাবেই স্বামীরই, সে আশ্বাস পেতে গেলে নারীকে কঠোর ভাবে অন্তঃপুরচারিণী হতে হবে, যাতে পরপুরুষের সংস্রবের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা না থাকে।

তাই বিরাধ রাক্ষস যখন সীতাকে তুলে নেয় তখন রাম বিচলিত হন, নরমাংস-ভোজী রাক্ষসের হাতে স্ত্রী পড়েছে বলে নয়, পরপুরুষ তাকে স্পর্শ করেছে বলে। ওই একই কারণে, রাবণ স্পর্শ করে সীতাকে বিমানে তুলেছিল এ চিন্তা রামকে এত গভীর অস্বস্তিতে ফেলে যে, কোনও মতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে, সীতা আপন শুচিতা রক্ষা করেছেন। রাম তো বলেই ফেলেন, তোমার মতো সুন্দরী নারী পেয়ে রাবণ নিশ্চয়ই দীর্ঘকাল বিলম্ব করেনি তোমাকে ভোগ করতে। তাই পরহস্তগতা নারীকে আমি ভোগ করতে পারিনে। অর্থাৎ নিশ্চিত হতে পারাব না তোমার যে সন্তান হবে সে রাবণের না আমার; সে ইক্ষ্বাকুকুলের সম্পত্তি, সমৃদ্ধির আইনসিদ্ধ উত্তরাধিকারী কি না। সব আসামিকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ দেওয়া হয়, আদর্শ রাজা রামের বিচারপদ্ধতি অন্য রকম, সেখানে আসামি, আসামি প্রতিপন্ন হয়েছে সমাজের চাপে। প্রায় কাজির বিচার। এখানেও, শম্বুকের ক্ষেত্রেও।

এ আতঙ্ক ওই কলির আতঙ্ক, যে কলির প্রধান ভয় নারী ও শূদ্র যথাক্রমে স্বামী এবং উচ্চবর্ণের প্রভুকে লঙ্ঘন করবে। বিদেশি আক্রমণে অরক্ষিত নারীর পরহস্তগতা হওয়ার একটা রূপক চিত্র রাবণের সীতাহরণ। এই সব অপহৃতা নারীদের সমাজ ফিরে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখেনি। অথচ মহাভারতে বৃহস্পতির স্ত্রী তারা চন্দ্রের সহবাসে দীর্ঘদিন থেকে চন্দ্রের পুত্র বুধকে জন্ম দিয়ে এবং সে কথা নিজমুখে স্বীকার করবার পরও কিন্তু বৃহস্পতি তারাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। গৌতমও অহল্যাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। যেমন গ্রিক পুরাণে দেখি অপহৃতা স্ত্রী হেলেনকে মেনেলাওস ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ধর্মশাস্ত্রেও বলা আছে, পরপুরুষের দ্বারা অবহৃতা ও ভুক্তা নারীকে স্বামী মাসান্তে শুচি জ্ঞান করবে এবং স্বগৃহে তার সঙ্গে বাস করবে। তবে? তবে ইক্ষ্বাকুকুলের সুউচ্চ বংশমর্যাদা এমনই, যে সন্দেহের ছায়ামাত্র স্পর্শ করলেই তা ম্লান হয়ে যায়? অগ্নিসাক্ষী করে গ্রহণ করা স্ত্রীকে নিছক সন্দেহ বশে বিসর্জন দিলে কিন্তু সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না, ইক্ষ্বাকুকুলের বংশধরদের গর্ভে ধারণ করে আছেন যে নিষ্পাপ নারী, তাকেও নিষ্করুণ ছলনা করে নির্বাসন দিলে কোনও গ্লানি স্পর্শ করে না বংশগৌরবকে! সহস্র-বর্ষতপস্বী যখন নিজের সমস্ত তপস্যা পুণ্যফল গচ্ছিত রেখে আজন্ম দেহে মনে বাক্যে সত্যাচরণের পুরস্কার থেকে স্বেচ্ছাবঞ্চিত হতে প্রস্তুত হয়ে শপথ করেন, সীতা নিষ্পাপ, তখন রাম লক্ষ্মণ যদি তাঁর কণ্ঠ মিলিয়ে বলতেন যে, লঙ্কায় দেবতারাও প্রমাণ দিয়েছেন যে, সীতা নিষ্কলঙ্ক, তা হলে সন্দিহান অযোধ্যার প্রজাদের ঘাড়ে ক’টা মাথা ছিল ঋষি রাজা ও রাজভ্রাতার যৌথ প্রমাণের বিরুদ্ধে মাথা তোলবার?

তা নয়, ভয়টা ওই কলির। তখনই সমাজে নারী বিদ্রোহিনী। প্রথম শতাব্দী থেকে নিজের হাতে চাষ করছে কোনও কোনও নারী, স্বোপার্জন তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, চতুর্থ শতকে কার্টিয়াস বলেন— রণক্ষেত্রে আর্যনারী যুদ্ধ করছে। বিদেশি নারীদের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন আচরণ তাদের স্বনির্ভর করেছে। অনেক সময়ে স্বামীরা, বিশেষত বিদেশি স্বামীরা, নিগড়শৃঙ্খল হয়তো খুলে দিয়েছেন, পেয়েছেন দাসীর বদলে চিত্তসঙ্গিনীকে। হয়তো সম্পত্তি ঔরস সন্তানের হাতে পড়বে কি না এর চেয়েও উভয়ত খোলাখুলি মেশা ও দাম্পত্য-সুখ তাদের কাছে অধিক কাম্য মনে হয়েছে। কিছু ‘অহল্যা’ হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করে সংসারে পুনঃপ্রবেশ করেছেন। কিছু তারা হয়তো প্রায়শ্চিত্ত না করেও স্বামীর গৃহে ঢুকেছেন হেলেনের মতো। কিছু শৈথিল্য ও মুক্ত বাতাস হয়তো আগন্তুক বিদেশি নারী-পুরুষ সঙ্গে করে এনেছিলেন, সমাজের বিকারদুষ্ট আবহাওয়া হয়তো কতকটা সংশোধিত হচ্ছিল কোথাও কোথাও। যোদ্ধা নারী, তপস্বী নারী, অনূঢ়া নারী, পুনর্ভবা, গান্ধর্ব মতে বিবাহিত নারী এমনকী রাক্ষস, পৈশাচ বিবাহে বিবাহিতাকেও ‘অনুলোম’ বলে স্বীকার করা হচ্ছিল। যেমন কানীন সন্তান, ঊঢ়পূর্বা নারী এরাও স্থান পাচ্ছিল সমাজে, তাই শাস্ত্রকাররা আরও কঠিন নিগড়ের গ্রন্থিবন্ধন করলেন, তার জানালা দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এই হল রামরাজ্য। সেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শূদ্র অকালমৃত ব্রাহ্মণসন্তানকে বাঁচাতে প্রাণ দেয়; এবং সে প্রাণ নেবার পবিত্র কর্তব্য পালন করেন রাজা। সেখানে কলির ভয়ে উচ্চ ত্রিবর্ণের, ধনিক শ্রেণির এবং সমাজে ক্ষমতায় আসীন শ্রেণিটির স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্ধন, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ এবং নারীকে মানুষের মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে সমাজ। ভার্গব প্রক্ষেপে রামায়ণে, মহাভারতে, মনুসংহিতায়, কামশাস্ত্রে নারী পণ্যদ্রব্য, ভোগ্যবস্তু, তাই রাম সীতাকে প্রত্যাখ্যান করার সময় প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেন ‘তোমাকে পরিভোগ (=সর্বতো ভাবে ভোগ) করতে পারিনে।’ তাই ত্রিবর্ণের প্রতিস্পর্ধী শম্বুককে প্রাণ দিতে হয় (যেমন মহাভারতে উচ্চবর্ণ অর্জুনের অহমিকা চরিতার্থ করার জন্য একলব্যকে বিকলাঙ্গ হতে হয়)। ‘কলি’ মানে কী? প্রচলিত সমাজব্যবস্থার মধ্যে এমন আমূল পরিবর্তন, যার দ্বারা নিম্নবর্গের মানুষের স্বার্থসিদ্ধি হয়, ধনে-ধর্মে ক্ষমতাসীন মানুষের স্বার্থহানি ঘটে। এটা যাতে না ঘটে সেটা দেখার দায়িত্ব রাজার। প্রথম রাজা পৃথু বৈন্যের প্রথম প্রতিজ্ঞা বর্ণসঙ্কর ঠেকাবার অঙ্গীকার, তার নির্মাতা ব্রাহ্মণদের কাছে।

রামরাজ্যে প্রজারা নাকি অতি সুখে বাস করত। রামায়ণে তিনটি জাতির চারটি রাজার কথা পাই: দশরথ, সুগ্রীব ও রাবণ এবং অবশেষে রাম। ভুল, স্বার্থবিরোধী ও ধর্মবিরোধী প্রতিজ্ঞার ফলে মনঃকষ্টে দশরথের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অযোধ্যায় তাঁর রাজত্বের যে বর্ণনা পাই তা প্রজাদের পক্ষে হিতকর, সমৃদ্ধি ও শান্তির রাজত্ব। তেমনি বর্ণনা পাই কিষ্কিন্ধ্যায় সুগ্রীবের এবং লঙ্কায় রাবণের। গুণগত মানে তিনজনের রাজত্বই আদর্শ। এর মধ্যে আর্য মূল্যবোধ রামের আগেই দেখেছি দশরথের কালে এবং ভরতের পাদুকারাজ্যে। রামচন্দ্রের রাজত্বের ছকটিও ওই দুই পরবর্তী রাজ্যের অনুরূপ। বৈশিষ্ট্য দু’ জায়গায়, এক শম্বুক হত্যায়, দুই সীতা নির্বাসনে। প্রথমটি ব্রাহ্মণের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে শূদ্রের প্রাণহানি, দ্বিতীয়টি তথাকথিত প্রজারঞ্জনের জন্য নিষ্পাপ সন্তানসম্ভবা ধর্মপত্নীর বনবাসদণ্ড।

প্রথম যে রাজা দশরথ, তাঁর রাজত্বের বর্ণনায় শুনি প্রজারা সুখী, বর্ণসঙ্কর নেই (১৬:১২), শূদ্ররা স্বকর্মনিরত অর্থাৎ, উচ্চ তিন বর্ণের সেবায় নিরত। (১:৬:২৯) দ্বিতীয়, নন্দিগ্রামে ভরত সব রাজকার্য পাদুকাদু’টিকে নিবেদন করে সম্পাদনা করতেন। এ এক প্রতীকী রাজ্য, কিন্তু সহজেই অনুমান করা যায়, দশরথের মতোই সফল রাজত্ব ছিল এই প্রতীকী রাজার। বানর রাজ্যে প্রথম রাজা বালী তেজস্বী যোদ্ধা এবং স্বেচ্ছাচারী। তাঁর নিধন হলে পর, লঙ্কায় যুদ্ধ সমাপ্তির পরে রাম সুগ্রীবকে বানররাজ্যে অভিষিক্ত করেন। বানরদের মধ্যে জাতিভেদ ছিল না। তাই বর্ণসঙ্কর থেকে প্রজাদের রক্ষা করার দায় ছিল না রাজার; কিন্তু নারী যে ভোগ্য পদার্থ এ নিয়ে দ্বিমত ছিল না, তাই বালী নিরুদ্দিষ্ট হলে সুগ্রীব ভ্রাতৃবধূ তারাকে গ্রহণ করেন এবং বালীর বধের পর আবার তাঁকে এবং নিজের স্ত্রী রুমাকে নিয়ে এক সঙ্গে বাস করেন। বালীর পর তাঁর অনুরোধে পুত্র অঙ্গদ অভিষিক্ত হয়ে কিষ্কিন্ধ্যায় রাজত্ব করেন, কিন্তু বানর রাজ্যের বিস্তৃত বিবরণ পাই না। মনে হয়, সমস্ত প্রধান বানর ও সেনাপতিরা হৃষ্ট এবং তুষ্ট যখন ছিলেন তখন রাজ্য বিধিমতোই চলত, প্রজারা সুখে ছিল। রাবণের যে প্রতাপ ও ঐশ্বর্যের পরিচয় হনুমান ও বিভীষণের কথায় পাওয়া যায় তার মধ্যে বর্ণসংঙ্করের প্রশ্ন ওঠে না কিন্তু কামার্ত রাবণ বহু নারীর প্রতি অসম্মান ও অত্যাচার করেছেন এ কথা পাওয়া যায়। মন্দোদরীর বিলাপে আভাসে বোঝা যায়, রাজা হিসেবে রাবণ ভালই ছিলেন।

রাম রাজত্ব পেলেন উত্তর-যৌবনে এবং পিতা এবং বংশের সম্মান রক্ষার জন্যে যথাবুদ্ধি রাজত্ব করেছিলেন। প্রজাদের মুখে সর্বদাই রামনাম। ফলমূল সারা বছর ধরে পাওয়া যেত। যথাকালে (বা প্রয়োজন মতো) বৃষ্টি হত, বায়ু ছিল সুখস্পর্শ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নির্লোভ ছিল, প্রত্যেকে যথানির্দিষ্ট কর্ম করত এবং তাতেই সুখী ছিল। সকলে সুলক্ষণ, ধর্মপরায়ণ, মিথ্যাবর্জিত ছিল। এগারো হাজার বছর রাম রাজত্ব করেছিলেন। ভাইদের সঙ্গে। ধর্ম, যশ ও আয়ুর বর্ধক রাম অন্য রাজাদের জয় করে রাজত্ব করেছিলেন। (৬:১২৮:১০২-৭) এই বর্ণনার অতিরঞ্জন বাদ দিলেও মনে হয়, প্রজারা সুখে ছিলেন। সেই প্রজারাই সন্দেহ করল সীতার চরিত্রে, এবং রামায়ণ বলে, দূতদের ডেকে রাম বললেন, প্রজাদের সন্দেহ মোচনের জন্য এবং ‘আমারও সন্দেহ মোচনের জন্য’ সীতা সর্বসমক্ষে নিজের শুদ্ধি প্রমাণ করুন। (৭:৯৫:৬)

এই রামরাজ্যে শূদ্র ও নারীরা কখনও মানুষের মর্যাদা পায় না। শাস্ত্র বলে, শূদ্রের কর্ম হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের সেবা। বলা বাহুল্য, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সেবায় মর্যাদা আছে, শাস্ত্র-নির্দেশিত সেবায় নেই, কারণ তার মধ্যে বাধ্যবাধকতা আছে, বিকল্প নেই। অসহায় ভাবে এই সেবা করে শূদ্র রামরাজত্বে সুখী ছিল এটা ততটাই সত্য যতটা সত্য সারা বছর গাছে ফল থাকা বা এগারো হাজার বছর রামের রাজত্ব করা।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে আক্রমণকারী বিভিন্ন জাতি যখন আর্যাবর্তে বসবাস করল তখন গ্রিকদের সময়ের পর থেকেই নারীর অন্য একটা সামাজিক অবস্থান ভারতীয় নারীদের চোখে পড়ল। এই কালসীমার মধ্যে খোদাই করা ও আঁকা নারীচিত্রে নারীরা পুরুষের দলে মিশে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিয়ে যাচ্ছে এমন সব এমফোরা, পানপাত্র, ছোট বড় মাঝারি সুরাভাণ্ড বহু পাওয়া গেছে এ দেশে প্রত্ন খননে। ভারতীয় নারী নৃত্যপরা গ্রিক নারীর মূর্তি দেখল। আলেকজাণ্ডারের পরে গ্রিক প্রতিনিধিদের রাজত্বকালে বহুবার যে সব গ্রিক নাটক গ্রিক অভিনেতা-অভিনেত্রীর দ্বারা মুক্তমঞ্চে অভিনীত হত, তাতে নারী অনেক বেশি স্বতন্ত্র, স্ব-নির্ভর, এমনকী মধ্যে মধ্যে পুরুষ-পীড়কের ভূমিকাতেও দেখা দিত (নিউ এটিক কমেডির মুখ্য নাট্যকারদের মধ্যে টেরেন্স, মেনাণ্ডার, প্লটাস এঁদের নাটকে এমন নারীদের বারবার দেখা যায়)। মধ্য এশিয়া ও মিশর থেকে এল সিংহবাহিনী দেবী, আইসিস, ইনান্না, এস্টার, অর্ধোক্ষা ও অন্যেরা। প্রতাপের প্রতিমূর্তি কোনও দেবতার স্ত্রী রূপে নয়, স্বে মহিন্নি প্রতিষ্ঠিতা দেবী রূপে। মহাদেবীর আবির্ভাব, মহালক্ষ্মী, দুর্গা ও কালিকারূপে এই সময়েই। এঁরা স্বয়ং অসুরমর্দিনী অতএব পুরুষ-প্রধান দেবমণ্ডলীর তথা পুরুষশাসিত সমাজের পক্ষে আতঙ্কস্থল। শাস্ত্রে যখন পুরুষ এঁদের আলেখ্য সৃষ্টি করেন তখন তার পশ্চাতে থাকে নবসমাগতা ভিন্ন জাতির উপাস্যা দেবীরা, যাঁদের আর্যায়ন বা ব্রাহ্মণায়ন সাধিত হচ্ছে শাস্ত্রকারদের হাতে। (গ্রিক পল্লাস আথেনে হন ‘অপালা’, গ্রিক ইরিনে হন ইরিনী)।

ভারতীয় নারী একদিকে তখন বৃহত্তর পরিসরে স্বাধীন-সঞ্চারিনী নারীকে দেখল, অন্য সমাজের ধর্মে, নাটকে, সাহিত্যে এবং প্রত্যক্ষত সমাজে, তেমনই নারী-অবদমনের অন্যবিধ চিত্রও দেখতে পেল অন্যান্য সমাজে। শক রাজাদের মৃত্যুর পর রানিরা ‘সতী’ হতেন, হূন নারীরাও মৃত স্বামীর অনুগমন করতেন, হয়তো প্রাগার্যদের মধ্যেও এ প্রথা বর্তমান ছিল। অথর্ব বেদে দুটি উল্লেখে (১৮:৩:১,৩) তাই মনে হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ডিওডোরাস সেক্যুলাসের বর্ণনায় ‘সতী’ হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। মহাভারতের ভার্গব প্রক্ষেপে সতীর আদিকল্প রচিত হয়। হিমালয় ও মেনার দুহিতা সতী স্বামীনিন্দায় দেহত্যাগ করেন। এ সতীত্ব স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি; কাজেই পতিভক্তির এবং পাতিব্রাত্যের আদিকল্পটি নির্মাণ করেন এক দেবী। তা হলে দেখছি স্বাধীনচারিণী নারীর চিত্রকল্প— যেমন বৈদেশিক নাট্য সাহিত্য, ভাস্কর্য চিত্রে ও সামাজিক আচরণ দেখে আর্যাবর্তের নারী প্রভাবিত হচ্ছে এবং সে কারণে আতঙ্কিত হচ্ছেন সমাজপতিরা। তাই রামায়ণ-মহাভারত উভয় মহাকাব্যেরই ভার্গব প্রক্ষেপে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে, কলিকালের উপযুক্ত এ আচরণ বলে কলিকে সর্বদোষের আধার বলা হচ্ছে, তেমনি অন্য দিকে শক হুনদের মধ্যে ‘সতী’ হওয়া এবং মহাভারতে সতী উপাখ্যানে (ও অন্যত্র শত শত উপাখ্যানে) পতিব্রতা নারীর যথোচিত আচরণের আদর্শ সৃষ্টি করে সমাজ আত্মরক্ষা অর্থাৎ সমাজের স্বীকৃত কাঠামোটি রক্ষার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থায় নারী যাতে কোনও রকম স্বাধীন (লক্ষণীয় ‘স্বাধীনা’ শব্দটির অর্থ গণিকা) হয়ে উঠতে না পারে, তার পাতিব্রাত্যে, পতিসেবায় যেন বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি না ঘটতে পারে, সেই জন্যে তো তার স্বামীকে কঠোর হাতে শাসন করতে হবে। চরিত্র-লঙ্ঘনের আশঙ্কাতেই তাই দণ্ড দিতে হচ্ছে। এই আদর্শ স্বামী যিনি, তিনি স্ত্রীকে সর্বতো ভাবে আত্মসম্পত্তি জ্ঞান করেন এবং পরপুরুষের কলুষ স্পর্শমাত্রকেই চরিত্রভ্রংশ বলে গণ্য করে দণ্ডবিধান করেন, যাতে প্রজা অর্থাৎ সমাজ নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, ওই নারীতে কলির কালিমা লাগেনি। এই আদর্শ স্বামী রাম। এবং শাস্ত্র বলে ‘রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ’, রামের মতো আচরণ করা উচিত, রাবণের মতো নয়। রাবণ এক দিকে কামুক, স্বেচ্ছাচারী এবং লোভী ছিলেন, কিন্তু মন্দোদরীর প্রতি তাঁর আচরণের কোনও মালিন্য স্পর্শ করেনি, কোনও অকারণ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়নি, এ কথা মন্দোদরীর বিলাপ থেকেই বোঝা যায়।

কলিতে শূদ্র দ্বিজাতির প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে, এ কথা রামায়ণ-মহাভারত উভয় মহাকাব্যের ভার্গব প্রক্ষেপে অত্যন্ত স্পষ্ট। কাজেই এমন আদর্শ রাজার আকল্প নির্মাণ করতে হবে যিনি কঠোর হাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্রকে দমন করেন, বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায়। সেই আদর্শ রাজা রামচন্দ্র, যিনি শম্বুককে হত্যা করলে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন— তুমি দেবতাদের কাজ করেছ। বর্ণগুলোর ক্রম যাতে নষ্ট না হয় সেটা দেখা রাজার কর্তব্য। রাম সেই আদর্শ রাজা, যাঁর এক খঙ্গাঘাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্র মরল এবং বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রও বাঁচল। কলির আসন্ন সংক্রমণ থেকে যিনি প্রজাকুলকে বাঁচালেন, সমাজকে আশ্বস্ত এবং সুস্থির করলেন।

পিতৃভক্ত, বন্ধুবৎসল, প্রজাহিতৈষী ভ্রাতৃবৎসল দেবদ্বিজে ভক্তিমান, সুবিচারক যজ্ঞকারী— অতএব আদর্শ যুগোচিত নায়ক। শূদ্র যদি ত্রিবণের্র সেবা ছাড়া অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে তবে বর্ণ-ধর্মরক্ষাকারী রাজা তো তাকে মেরে ফেলবেনই। স্ত্রী যদি অনিচ্ছাতেও পরপুরুষের দ্বারা সৃষ্ট বা অপহৃত হয়— তবে যতই সচ্চরিত্রা হোন না তিনি, অগ্নিপরীক্ষা, নির্বাসন, পুনর্বার পরীক্ষা এই সব অবমাননা তাঁকে নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতেই হবে। সমাজ তাঁকে ব্যক্তি বলে স্বীকার করেনি, ভোগ্যবস্তু, পণ্যদ্রব্য এই সব আখ্যা দিয়েছে। স্বর্গারোহণের পূর্বে ভরতকে অযোধ্যার সিংহাসন দিলেন রাম, তাঁর ও সীতার দুই পুত্র কোশল ও উত্তর কোশলের রাজত্ব পেলেন। সীতার সচ্চরিত্রতা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হবার পরও তাঁর গর্ভজাত সন্তানদের ইক্ষ্বাকুকুলের রাজসিংহাসনে অধিকার দেওয়া গেল না। প্রজারা নিশ্চয়ই পুলকিত হল, আদর্শ রাজা রাজকুল-মর্যাদায় এতটুকু কলুষের স্পর্শও লাগতে দিলেন না।

এই যে নতুন আদর্শের প্রজাপালক রাজার নির্মাণ হল, ইনি কিন্তু মহাকাব্যের নায়ক নন। সে নায়ক ক্ষত্রিয় যোদ্ধা বীর, আদর্শ রাজা হওয়া তাঁর কাছে প্রতীক্ষিত ছিল না। ক্ষত্ৰিয় নায়কের অঙ্গীকার ও কর্তব্য শেষ হয়েছে যুদ্ধ-জয়ে, রাবণ-বধে। তার পর শুরু হল মহাকাব্যটিকে ঢেলে সাজানো, আদিকাণ্ডে প্রথমার্ধে ও উত্তরকাণ্ডে এঁর নবকলেবর রূপায়ণ ঘটল। এখন ইনি বর্ণধর্মের পরিপালক রাজা। শূদ্র ও নারীর কোনও রকম স্বাধীনতা, স্পর্ধা বা অধিকার স্বীকার করলে পাছে কলির স্পর্শদোষ ঘটে রাজ্যে, তাই ইনি সমাজের স্থিতাবস্থা রক্ষা করেছেন অতন্দ্র ভাবে। এর কিছু মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে, একপত্নীক রাজা সীতাকে হারালেন। সমাজে নারীর সতীত্ব শুচিতা নিয়ে যে নতুন নিরিখ তৈরি হয়েছে তার কাছে বলি দিতে হল আপন দাম্পত্যসুখ। কিন্তু এর মূল্য দিতে তাঁর বিশেষ বাজেনি, কারণ সীতাকে যখন তিনি প্রথম কঠিন কথাগুলো বলেন লঙ্কায়, তখন তা তাঁর হৃদয়ান্তর্গত ভাব। অর্থাৎ, সমাজের নির্মম নির্দেশ তিনি নিজ অন্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই পারলেন ওই কথাগুলি বলতে। এইখানে মহাকাব্যকারের পরাজয় ঘটল শাস্ত্রকারদের কাছে।

আজ যখন ‘রামরাজ্য’ সম্বন্ধে একটা স্বপ্নকে পুনর্বার কৃত্রিম ভাবে সৃষ্টি করার একটা উদগ্র চেষ্টা হচ্ছে এ দেশের লোকমানসে, তখন যেন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি: নারী শূদ্রের ওপর অত্যাচার যে তন্ত্রে অপরিহার্য ভাবে গৃহীত, যেখানে ধর্মাকাঙ্ক্ষী শূদ্র ব্রাহ্মণ-পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে বাধ্য হয়, নিষ্পাপ অন্তঃসত্ত্বা নারী নির্বাসনে যায়, দেওরালা-আড়ওয়ালের পরও আমরা কি সেই রাজতন্ত্রই চাই? এরই নায়ক কি ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’? অসহায়কে ও নারীকে রক্ষা করাই তো এতদিন আদর্শ পুরুষদের অবশ্য করণীয় ছিল, তাকে বর্জন করে যে রাজতন্ত্র, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অভিশাপ হয়ে উঠবে না? তাকে ঠেকানোই কি আজ আমাদের প্রধান কর্তব্য নয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *