ভারতবর্ষে আগন্তুক-মুসলমান

ভারতবর্ষে আগন্তুক-মুসলমান

ইদানীং ‘সঙ্ঘ পরিবার’-এর কথায় ও লেখায় প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, ভারতবর্ষে মুসলমান বহিরাগত এবং যেহেতু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র সেহেতু ভারতবর্ষের মুসলমানদের উচিত পাকিস্তানে চলে যাওয়া। নতুবা, ভারতবর্ষে নেহাতই যদি তাঁরা থাকতে চান তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ও ‘অভারতীয়’ সংজ্ঞা বহন করে চলতে হবে। ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র, হিন্দুই এখানে প্রথম শ্রেণির নাগরিক এবং হিন্দুই একমাত্র খাঁটি ভারতীয়। বছর দশেক আগে প্রথম বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যে বিরাট সমাবেশ হয় দিল্লিতে, তখন চার-পাঁচ হাত লম্বা অক্ষরে দিল্লির ইতস্তত বিরাট দেওয়াল জোড়া বিজ্ঞপ্তি (ইংরেজিতে!) দেখা যায়; ‘ভারতবর্ষে সকল অহিন্দুই অভারতীয়’ (All non-Hindus are aliens in India)। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, যাঁরা জন্মসূত্রে, কর্মসূত্রে ভারতবাসী, যাঁদের পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হিন্দু- তাঁরা, তেরো-চোদ্দোশো বছর আগে তাঁদের ধর্ম নিয়ে কিছু মানুষ ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলেন বলেই অভারতীয়। এ সংজ্ঞাকরণ যে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন তা স্পষ্টই প্রতীত হচ্ছে।

আর আগে অন্তত সওয়া তিন হাজার বছর আগে আর্যরাও তো ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলেন, ওই সুবাদে তা হলে আর্যরাও কি অভারতীয়? এর কোনও সদুত্তর নেই বলেই আজকাল ইতিহাসকে বিকৃত করে একদল লোক জোর গলায় বলতে শুরু করেছেন যে, সিন্ধুসভ্যতা আসলে আর্যদেরই কীর্তি। তা হলে আর্যরা আর বহিরাগত হন না, প্ৰায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে এক অব্যাহত ‘আর্য’ সভ্যতার ধারার অস্তিত্ব প্রতিপন্ন করা যায়। এঁরা মূর্খ নন, অজ্ঞ নন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যবাদী ও মিথ্যাচারী।

মুসলমানরা এ দেশে আসবার আগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত যবন, পারদ, পহ্লব, মুতিব, মুরুণ্ড, কুষাণ, শক, হুন ইত্যাদি বহু বহিরাগত জাতি বাইরে থেকে ক্রমান্বয়ে এসেছে কখনও যুদ্ধ করে জিতে, কখনও বা অল্প সংখ্যায় এসে অতিথির মতো আশ্রিত হয়ে, আর্যাবর্তের তখনকার অধিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিঃশেষে মিশে গিয়েছে। বর্ণবিভক্ত সমাজ তাদের প্রথমে শূদ্র, ম্লেচ্ছ বলেছে, পরে তাদের তেজ শক্তি ও বিজয়ী সত্তাকে স্বীকার করেছে ‘ক্ষত্রিয়’ সংজ্ঞা দিয়েছে। সমাজপতি ব্রাহ্মণরা তাদের আনুকূল্য করেছে কখনও হয়তো শাসকশ্রেণিকে দমন করবার জন্যে। কিন্তু আজ ভারতবর্ষে একজনও বলতে পারে না যে, তার পূর্বপুরুষ পারদ কি কুষাণ কি হুন ছিল। তার মানে, তারা আর্যাবর্তের সমাজসত্তায় সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এবং এই স্থিতিস্থাপকতা, আগন্তুককে আপন করার এই ক্ষমতাই তৎকালীন সমাজের জীবনীশক্তির প্রমাণ।

মুসলমানরা সিন্ধু অধিকার করবার পরেও বেশ কয়েক শতাব্দী হিন্দু মুসলমান আত্মীয়বন্ধুর মতো পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করেছে। মোগল সাম্রাজ্য স্থাপনের সময়ে কিছু ধর্মান্তরীকরণ হয় জোর করে। কিছু মঠ-মন্দির ভেঙে রাজশক্তি মসজিদ তৈরি করে। ভুলে গেলে চলবে না যে, পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বত্রই সর্বকালে বিজয়ী বিজিতের ওপরে এ ধরনের অত্যাচার করেছে। ফা-হিয়েন, হিউয়েনৎ সাঙ, ইৎসিঙ এঁরা যত বৌদ্ধ মঠ, বিহার, সঙ্ঘারাম দেখে বর্ণনা করেছেন, তার ক’টি রক্ষা পেয়েছিল? বৌদ্ধদের ওপর হিন্দুদের নানা অত্যাচারের কথা ইতিহাসে আছে। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে শুনি, বৌদ্ধ শ্রমণ বলছে অত্যাচারী রাজশ্যালকের প্রসঙ্গে যে, সে বৌদ্ধ শ্রমণদের নাক ফুটো করে দড়ি দিয়ে বলদের মতো করে টানিয়েছে। এবং নাটকে মিথ্যা বলা যায় না, যেহেতু দর্শকরা তা সহ্য করবেন না। তা ছাড়া মুসলমানদের জোর করে ধর্মান্তকরণের যে অপবাদ তা আংশিত সত্য হলেও সঙ্গে সঙ্গে এ-ও সত্য যে, ব্রাহ্মণ্য সমাজ শূদ্র, শ্বপাক, পুল্কস, চণ্ডাল ও ম্লেচ্ছদের ঊনমানব হিসেবে দেখত বলেই তাদের মধ্যে বৃহৎ এক অংশ মুসলমান হন, যেহেতু ওই সমাজে জাতিভেদ ছিল না। একই কারণে অনুরূপ নির্যাতিত নিম্নবর্গের মানুষ পরে খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম, শিখ, আর্যসমাজী হয়েছে।

মুসলমান রাজত্ব চলার সময়ে ভারতবর্ষ থকে একটি পাই-পয়সাও আরব বা পারস্যে যায়নি। ইংরেজ রাজত্বের দেড়শো বছরের মধ্যে বহু শত কোটি টাকা ‘হোমচার্জ’ ও অন্যান্য নানা খাতে ইংল্যাণ্ডে যেত। মন্ত্রী উইলিয়াম পিট (ছোট) প্রকাশ্য পার্লামেন্টে ভারতবর্ষকে ‘দুগ্ধবতী গাভী’ বলে উল্লেখ করেন। দোহন করার পুণ্যকাজটা ছিল ইংরেজ শাসকের। অথচ এই শ্বেতাঙ্গ আক্রমণকারীদের পদলেহন করতে আমাদের বিশেষ বাধেনি। বেদ অব্রাহ্মণের কানে গেলে সীসে গলিয়ে কানে ঢেলে দেবার বিধান ছিল; কিন্তু ম্যাক্স ম্যুলার এমনকী কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন যে, তাঁকে বেদে অধিকার দেওয়া গেল? ওই আগন্তুক ইংরেজের প্রসাদ পাবার জন্য বিংশ শতকের আগে পর্যন্ত অভারতীয়দের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল।

অন্য দিকে আগন্তুক মুসলমানদের রাজত্বকালে স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, সংগীতে, শিল্পে, সাহিত্যে, চিত্রাঙ্কনে সর্ব ভাবে হিন্দুর সঙ্গে সহযোগিতায় এমন একটি সমৃদ্ধ মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল যার তুলনা বিরল। ভারতীয় হিন্দু ‘অল্লোপনিষদ’ রচনা করেন, দারা শিকোহ উপনিষদ ফারসিতে অনুবাদ করেন, ঔপনেখট, যাঁর থেকে ক্রমে ক্রমে ফরাসি, জার্মান ইংরেজি অনুবাদ হয়। মুসলমান দরাফ খাঁ গঙ্গাস্তোত্র রচনা করেন সংস্কৃতে, হিন্দু রামমোহন ফারসিতে গ্রন্থ রচনা করেন। এই পারস্পরিক আদান-প্রদান তো সে দিন পর্যন্ত চালু ছিল। উভয়ের পূজাপার্বণে আনন্দে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, পরস্পরের সুখে-দুঃখে পাশাপাশি দাঁড়ানোই স্বাভাবিক ছিল।

১৯২০ সালে ‘হিন্দু মহাসভা’র গঠনে যার সূত্রপাত ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসে, ১৯৯২-এ তার ক্রান্তিকাল। শাখায় পল্লবে বিস্তারিত হয়ে ‘জনসঙ্ঘ’, ‘ভারতীয় জনতা পাৰ্টি, ‘বজরঙ দল’, ‘শিবসেনা’, ‘আমরা বাঙালী’, ‘সন্তানদল’ইত্যাদি নানা নামে ও আকারে একটি বীভৎস দানবিকতা বিকট রক্তাক্ত নখদন্ত মেলে আজ ভারতবর্ষের মানবিকতাকে গ্রাস করতে উদ্যত। এর চরিত্র এত নির্মম ও নির্লজ্জ যে, সিংহাসনের লোভে এর আস্ফালন আজ ধর্মের আবরণে ঢাকা পড়ছে না আর। মুসলমানকে শত্রু হিসেবে খাড়া করা আজ এর রাজনৈতিক প্রয়োজন। মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুর বিভেদ ঘটিয়ে রাষ্ট্রচালনা ছিল ইংরেজের নীতি। ইংরেজ রাজত্বের অবসানে এ ভার তুলে নিল ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা ‘সঙ্ঘ পরিবার’। শত্রু তো একটা চাই। শতকরা পনেরো-ষোলোটা মানুষ বৃহৎ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের পক্ষে সত্যিকার কোনও আতঙ্কের কারণ কখনওই হতে পারে না। কংগ্রেস রাজত্ব এমন মূর্খ নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর বদলে নিরতিশয় সংখ্যালঘু মুসলমানকে তোষণ করবে। ভোটের কথা ভাবলেও হিন্দু তোষণই তার স্বাভাবিক নীতি হবে। তবে? কেন এ মুসলমানবিদ্বেষ? সম্প্রদায় হিসেবে অনেক দিকে মুসলমান এখনও অনুন্নত। কাজেই তাকে নিয়ে সত্য কোনও আশঙ্কার হেতু নেই। মধ্যপ্রাচ্যে পেট্রল-ধনী যে মুষ্টিমেয় হঠাৎ-নবাব গজিয়েছে তাতে ওই ক’টি ধনীই লাভবান হচ্ছে, সাধারণ মুসলিম প্রজার অবস্থা যথাপূর্বই রয়ে গেছে। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যের ওই ক’জন ধনী এখানকার হিন্দুর কোনও প্রতিপক্ষ হতেই পারে না। তা হলে দাঁড়াচ্ছে, বিভেদের জন্যেই বিভেদ। ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত মুসলিমকে তাড়িয়ে একটি হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করা। কেমন সে রাষ্ট্র? রাম রাজ্য। কেমন রাম? ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’। অর্থাৎ ‘পুরুষের উৎকর্ষের সীমা’ আদর্শ পুরুষ। এবারে প্রশ্ন আসে কেমন সে আদর্শ? যেখানে সম্পূর্ণ নিরপরাধ নারীকে নারী বা স্ত্রী বলেই বারবার অকারণে মিথ্যা সন্দেহে, মিথ্যা ছলনায়, মিথ্যা ছুতোয় বিসর্জন দেওয়া যায়, যার মৃত্যু অনুমোদন করা যায়, সন্তানসম্ভবা নারীকে প্রতারণা করে নির্বাসন দেওয়া যায়, রাজমহিষী হলেও প্রজাদের সামনে অপমানসূচক আত্মশুদ্ধি প্রমাণের দায়িত্ব দেওয়া যায়। অর্থাৎ যেখানে শুচি নারী অশুচিমনা পুরুষের ক্রীড়নক, ভোগ্যবস্তু এবং ইচ্ছামতো পদাঘাতের যোগ্য বলে বিবেচিত। ভারতবর্ষের বৃহৎসংখ্যক নারীসমাজ সজ্ঞানে সুস্থশরীরে এই রামরাজ্য কামনা করতে পারে?

নিম্নবর্গের মানুষ এ-রাজত্বে সুবিচারের কোনও আশাই রাখতে পারে না। যে রাম বনবাসকালে অত্রি-অনসূয়া-ভরদ্বাজের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন, তিনি অনায়াসে বনবাসের প্রথম পর্বে তাঁর ‘সখা’ গুহকের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করে বলতে পারেন, ‘ঘোড়াদের খাবার দিলেই উপকৃত হই, আমরা বনবাসী, খাদ্য গ্রহণ করব না।’ মুখে উচ্চারণ না করলেও কারণটা গোপন থাকে না, যখন দেখি ব্রাহ্মণ মুনিদের আতিথ্য পরে গ্রহণ করছেন অনায়াসে। দশরথ যে সিন্ধুমুনির পুত্রকে না জেনে মেরে ফেলেন সেই মুনিও বৈশ্য ও শূদ্রের পুত্র, তপস্যা করার জন্যে তাকে কেউ মেরে ফেলেনি যেমন রাম মারলেন শম্বুককে। এবং মারলেন এক ব্রাহ্মণ-পুত্রের অকালমৃত্যুর প্রতিকার হিসেবে। অর্থাৎ এই রামরাজ্যে প্রাণের দামের তারতম্য আছে, ব্রাহ্মণের প্রাণ চণ্ডালের চেয়ে বেশি ‘দামি’। মানুষের প্রণের দামের এ আপেক্ষিকতা অমানবিক, রামরাজ্য আনতে হলে এ কথাও মেনে নিতে হবে।

ভারতবর্ষের সমাজে নারী, শূদ্র চিরদিনই অবহেলিত ও পদদলিত; এখন দেশে সে সম্বন্ধে সচেতনতা জেগেছে। গান্ধীজি, আম্বেদকর এবং আরও বহু মহাপ্রাণ মানুষের একান্ত চেষ্টায় ও সাধনায় আজ যখন দেশের মানুষ মৈত্রী, সমদৃষ্টি ও সমানাধিকার সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে, তখন এই ‘সঙ্ঘ পরিবার’ ঘড়ির কাঁটাকে কত শতাব্দী পিছিয়ে দিতে উদ্যত। আজ বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষের নারীর যখন আপন মানবিক অধিকার সম্বন্ধে চেতনা জাগ্রত হচ্ছে, তখন তাকে ‘গৃহিণীমাত্রে’ পর্যবসিত করাই এদের ঘোষিত নীতি, আবার ওই ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। আজ যখন ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের অন্নবস্ত্র, গৃহ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিছুই নেই, কিন্তু যখন সে প্রবুদ্ধ হয়েছে এই বিষয়ে, জেনেছে যে, এই না-থাকাটা অন্যায়-অবিচার এবং সে জন্যে সংগ্রাম করে সহজাত অধিকার আদায় করতে উদ্যত হচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তখন সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক, মহাকাব্যের নায়ক, এক কাল্পনিক চরিত্রের মন্দির ঠিক প্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায়ের ধর্মস্থান ভেঙে নির্মাণ করতে হবে? সত্যকার কোটি কোটি গৃহহীনের যে সংগ্রাম আশ্রয়স্থানের জন্যে, খাদ্য, বস্ত্র, বৃত্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের জন্যে তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেবার এই ফিকির কি মানুষ ধরে ফেলতে পারবে না? হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবেশী হয়ে থাকলে ক্ষতি কার? কোনও যথার্থ ধার্মিক ব্যক্তি এতে বিচলিত হতেই পারেন না। তিনি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাঁকে বিশ্বপিতা বলে স্বীকার করেন, এবং আপনিই মানুষ মাত্রকেই ভাই বা বোন বলে স্বীকার করতে বাধ্য হন, তখন কী করে বলতে পারেন যে, মুসলমান অভারতীয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, কারণ, ভারতবর্ষ তার জন্মভূমি হলেও তার কাছে পুণ্যভূমি নয়, যেমন মক্কা-মদিনা। যে আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে এ দেশে আসেন, তাঁদের পুণ্যভূমিও তো ভারতের ভৌগোলিক সীমান্তের বাইরেই ছিল, যবন, পারদ, পহ্লব, কুষাণ, শক, হূন এদের প্রত্যেকেরই পুণ্যভূমি ছিল ভারতবর্ষের বাইরে, কই সেদিন তো বৈদিক ধর্মনিষ্ঠ ভারতীয় আর্যরা তাদের ওই কারণে ভারতবর্ষে ঠাঁই দিতে দ্বিধা করেনি? ধীরে ধীরে ভারতীয় সমাজদেহে সকলেই নিশ্চিহ্ন ভাবে লীন হয়ে গিয়েছিল। মুসলমান রাজারা হিন্দু মন্দিরে যখন অনুদান দিয়েছেন, কোনও সদ ব্রাহ্মণ পুরোহিত তো কখনও তা প্রত্যাখ্যান করেননি। মোগল অন্তঃপুরে সেই রাজপুত কুলনারী মহিষী হয়ে এসেছিলেন, যাঁদের পরিবার ম্লেচ্ছ বলে যবনকে ঘৃণা করেছেন। প্রথম মোগল সম্রাটের সেনাপতির চাকরি করতে সেই অত্যন্ত জাত্যভিমানী রাজপুতের বাধেনি? বেদান্তদর্শনের গুণগানে ভারতবর্ষ মুখর। বেদান্ত ছুঁচো, কুকুর, পেঁচার মধ্যে দিব্যি ব্ৰহ্ম দেখতে পায়, ডোম-চণ্ডাল-মুসলমানে গিয়ে সেই উদার ব্রহ্মদৃষ্টি ঠেকে যায় কী করে? এই সব নানাবিধ ভণ্ডামির মধ্যে সযত্নে লালিত যে হিন্দুত্ব, তার মূলে আজ ভারতীয়ত্বের ওই সব আনকোরা সংজ্ঞা ‘পুণ্যভূমি’ ইত্যাদি কেমন বেমানান শোনায় না? বহু হিন্দু পদবি এখনও মুসলমান রাজাদের প্রসাদের চিহ্ন, খেতাব, তা সেই পদবিধারীরা সগৌরবে বহন করেন। এবং এইটেই স্বাভাবিক, কোনও গুণ বা কৃতিত্ব যখন মূল্য পেয়েছে তখন সে মূল্য যে-ই দিক সেটা গৌরবেরই চিহ্ন।

মুসলমানকে ঠেকাতে পারলে তাজমহল, সেকেন্দ্রা, বুলন্দ দরওয়াজা, লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি, কুতুব মিনারের গৌরবে ভারতবাসীর অধিকার চলে যাবে, মিঞা কী মলহার, দরবারি কানাড়া, ইমন ভূপালী গাওয়া যাবে না, মোগল চিত্রকলার মহিমায় অংশগ্রহণ করা চলবে না, বহু সাহিত্য, কাব্য, লোকসঙ্গীত অপাঙক্তেয় হয়ে যাবে। এই নয়া হিন্দুত্বের এমনই মাহাত্ম্য যে, এত সাংস্কৃতিক দৈন্য মেনে নিতে হবে ওই অমানবিক রামরাজ্য বনাম হিন্দুরাষ্ট্রের নামে। ভারতবর্ষের সুস্থ মানুষ ধিক্কার দেবে না এই সংকীর্ণতা, সংস্কারান্ধতাকে? বলবে না, ‘একবিংশ শতকে প্রবেশ করবে সমস্ত ভারতবাসী, বিশুদ্ধ ভারতের অধিবাসী মানুষ’, এই সংজ্ঞায় ভূষিত হবে? চাইনে তার রামরাজ্য, সেটা লালন করুক হনুমান-পূজক বজরঙবলীরা, ভারতবর্ষের সকল মানুষ মানবরাজ্যে বাস করুক, মানবিক মর্যাদায় উচ্চশিরে, সৌভ্রাত্র ও সম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ থাকুক তার জীবন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *