ধর্ম, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্র

ধর্ম, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্র

পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাসের প্রায় আদিপর্ব থেকেই এমন সব প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে যার থেকে অনুমান করা যায় যে, মানুষের খুব প্রাথমিক কতকগুলি বিশ্বাসের মধ্যে ধর্ম একটি প্রধান স্থান অধিকার করেছিল। এর মধ্যে ছিলেন অদৃশ্য এক মঙ্গলময় এবং ভয়াবহ বিশ্বনিয়ন্তা, যাঁকে সে ঈশ্বর বা ভগবান বলেছিল। এরই সঙ্গে প্রায় সর্বত্রই এ বিশ্বাস ছিল যে, মানুষের মৃত্যুর পরে আত্মা থাকে এবং পরলোকও আছে। এ পরলোক সব ধর্মে স্বর্গ-নরক রূপে ছিল না, কিন্তু মোটের ওপর পরলোকে ও আত্মায় বিশ্বাস এবং ভগবানে বিশ্বাস, এ তিনটিই ধর্মের মূলস্তম্ভ ছিল। ভারতবর্ষে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল জন্মান্তর ও কর্মবাদ। জন্মান্তরবাদ পৃথিবীতে অন্য কোথাও কোথাও থাকলেও তা ধর্মবিশ্বাসকে তেমন প্রভাবিত করেনি; কিন্তু ভারতবর্ষে জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে এখানকার ধর্মবিশ্বাসে দৃঢ়মূল হয়েছিল। ফলে ধর্মে ভগবানের স্থানে প্রথম বৈদিক দেব-দেবী এবং পরে পৌরাণিক দেব-দেবী এলেও কর্মবাদ স্বতন্ত্র এক শক্তি হয়ে প্রতিভাত হল, যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। ঠিক তেমনই নিয়তিও এক সার্বভৌম শক্তিরূপে দেখা দিল, তার ক্ষমতাও দেব-দেবী, ভগবান এমনকী অনেক ক্ষেত্রে কর্ম-নিরপেক্ষও। এতগুলি পরস্পর-অসংলগ্ন স্বয়ম্ভর শক্তির লীলা চলেছে বৈদিকোত্তর অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দুধর্মে।

এই ধর্ম মানুষকে প্রকৃতিতে তার একান্ত অসহায়তা থেকে কাল্পনিক এক মানসিক আশ্রয়ের সন্ধান দিয়েছে, যে-আশ্রয় কাল্পনিক হলেও মানুষের চিত্তের অসহায়তা ও অনিশ্চতাবোধকে পরাহত করে তাকে মানসিক স্থৈর্য, শান্তি ও ইহ-পরলোকে নির্ভরযোগ্য হিতৈষী সৰ্বশক্তিমান সহায়ের সন্ধান দিয়েছে। প্রাগার্য সিন্ধুসভ্যতার ধর্মবোধ সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। কিন্তু বেদের যুগে সমস্ত সমাজ যখন একত্র হয়ে যজ্ঞ সম্পাদন করত তখনই সমস্ত সমাজে একটা সংহতি ছিল। উত্তরবৈদিক কালে আরণ্যক উপনিষদের যুগে যখন জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সমাজ মোক্ষের সন্ধান করছে, ততদিনে জন্মান্তর একটা আতঙ্কের বস্তু হয়ে উঠেছে সমস্ত নিম্নবিত্ত মানুষের শোষিত জীবনযাত্রার পুনরাবৃত্তিরূপে। তখনও রাজা ও রাজন্যেরা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করছেন। অরণ্যে কিছু মানুষ আনুষ্ঠানিক ধর্মের থেকে নিজেদের মুক্ত করে অভিনিবিষ্ট হয়েছেন জ্ঞানচর্চাতে। এরই দু’-এক শতাব্দীর মধ্যে দেখা দিল পূজা। তখন এল সম্প্রদায়ভেদ; মহাভারতের শেষ পর্বে বৈষ্ণব, শৈব দু’টি সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান ও পরস্পরের মধ্যে বিরোধের একটা আভাস পাওয়া যায়, অনুশাসনপর্বে এবং অন্যত্রও। ‘আমার ইষ্টদেবতাই শ্রেষ্ঠ’ এ কথা বললেই অন্যের ইষ্টদেবতা হেয় প্রতিপন্ন হয়। সাম্প্রদায়িক ইষ্টদেবতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজটি নিহিত ছিল ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের পরিসরে, যা বর্তমানে দাক্ষিণাত্যে, বিশেষত তামিলনাড়ুতে শৈব-বৈষ্ণব বিদ্বেষে প্রতিফলিত। এইখানেই সূচনা হল ধর্মান্ধতার; শৈব, বৈষ্ণব দু’জনেই ভুলে গেল যে, শিব বা বিষ্ণুকে তারা সর্বেশ্বর বিশ্বপিতা বলেই পূজা করে, এবং তা হলেই মানুষ মাত্রেই দু’জনের আরাধ্য দেবতারই সন্তান এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটিই সম্পর্ক হতে পারে— ভ্রাতৃত্ব।

সম্প্রদায় বেড়েই চলল চক্রবৃদ্ধি হারে: সৌর, শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, গাণপত্য; এই পাঁচটি মুখ্য সম্প্রদায়; কিন্তু এদের প্রত্যেকটিই অন্তর্নিহিত নানা দেবতাদের বহু সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গেছে; যার ফলে ভারতীয় হিন্দুর মধ্যে আজ কয়েক হাজার সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। এখন প্রশ্ন: ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক কী? এ কথা সত্য যে, ধর্মের ছত্রতলেই সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং কতকদূর পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু সম্প্রদায় মানেই স্বতন্ত্র একটি আরাধ্য দেবতাকে ঘিরে একটি বিশ্বাসের অধিসংগঠন গড়ে উঠেছে; এ বিশ্বাস হল, ওই দেবতাই শ্রেষ্ঠ। ধর্মবিশ্বাসী যদি সাম্প্রদায়িকতাবিশ্বাসী হয়, তা হলে অন্যান্য সম্প্রদায় সম্বন্ধে তার মনোভাব কী হবে? নিজের ইষ্টদেবতাকে শ্রেষ্ঠ বলা মাত্রই অন্যের ইষ্টদেবতার ঊনতা প্রমাণিত হয়, এ সত্ত্বেও সম্প্রদায়ভুক্ত কিছু মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের মত সম্বন্ধে কতকটা সহিষ্ণুতা পোষণ করেন। কখনও তা শ্রেষ্ঠের সহিষ্ণুতার রূপে প্রতিভাত হয়, কখনও বা সহজাত সৌভ্রাত্র্য, পরমত-সহিষ্ণুতার দ্বারা বিরোধী মনোভাবটি গৌণ হয়ে যায়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, নিজের মতকে শ্রেষ্ঠ বললে অন্য মত সম্বন্ধে বিদ্বেষের একটা অবকাশ থেকেই যায়। অধিকাংশ সম্প্রদায়ই নিজের মতকে একমাত্র সত্য বলেই বিশ্বাস করে, যেমন গীতায় কৃষ্ণের কথা: ‘সর্বধর্ম ত্যাগ করে আমাকেই একান্ত ভাবে আশ্রয় করো, আমি তোমাকে সর্বপাপ থেকে মুক্তি দেব।’ এখানে ধর্মান্ধতার বীজ আছে ওই ‘সর্ব ধর্ম ত্যাগ করে… একান্ত ভাবে আশ্রয় করার কথায়। প্রায় সব ধর্মপ্রস্থানের উদ্ভাবকরাই নিজের পথকেই শ্রেষ্ঠ শুধু নয়, একমাত্র সত্য বলেছেন,— যিশুখ্রিস্ট, মহম্মদ, বুদ্ধ, জরথুষ্ট্র সকলেই। ইচ্ছে করলে প্রত্যেক মতাবলম্বীই ধর্মান্ধ হতে পারেন ওই অনন্যতার আড়ালে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকটি ধর্মমত আবার একাধিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত; হিন্দুর যেমন শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদি, মুসলমানের শিয়া-সুন্নি, খ্রিস্টানের প্রটেস্টান্ট-ক্যাথলিক, বৌদ্ধের হীনযান-মহাযান। এরও পরে আছে প্রত্যেকটি বিভাগের নানা উপবিভাগ। ফলে সমস্যা হয় এরা পরস্পরকে কী চোখে দেখবে?

ভুলে গেলে চলবে না, সব সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর একটি কায়েমি স্বার্থ আছে, গুরু-পুরোহিত, মোল্লা-মৌলভী, পাদ্রি-আচার্য সকলেই প্রমাণ করতে উদ্যত যে, তাদের প্রচারিত প্রস্থানটিই একমাত্র সত্য। একমাত্র সত্য হলেই, বাকিগুলি মিথ্যা বা হীন হয়ে যায়। এতে পুরোহিতের দক্ষিণা-বৃদ্ধির সম্ভাবনা, এবং সে তার দলভুক্তদের সেই কথাই বোঝায়, তাতে সাম্প্রদায়িক মানুষ অন্য সম্প্রদায়কে বিদ্বেষ বা অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখে। এই বিদ্বেষকে পোষণ করবার জন্যে নতুন নতুন শাস্ত্র, উপাখ্যান ও ভাষ্য নির্মিত হয়। দলভুক্ত মানুষ যদি স্বভাবত বিদ্বিষ্ট হয়, তা হলে ধর্মান্ধতাই তার পথ হয়ে ওঠে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটেছে। পুরোহিতরা স্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে এই বিদ্বেষকে ইন্ধন জোগায়, ফলে জন্ম নেয় ধর্মান্ধতা। শব্দটির ব্যাখ্যা করলে বোঝায়, ধর্মকে অবলম্বন করে অন্ধতা; প্রধান কথাটা হল অন্ধতা; দেখতে না পাওয়া। কী দেখতে না পাওয়া? প্রথমত, তার নিজের ধর্মই শ্রেষ্ঠ, এটা একটা গোঁড়ামি থেকে উদ্ভূত সেই কথাটা। দ্বিতীয়ত, অন্য ধর্মের মধ্যে কী ঐশ্বর্য আছে, তা দেখতে না পাওয়া। তৃতীয়ত, তার ধর্ম যাই হোক না কেন, মানুষমাত্রই যে বিশ্বপিতার সন্তানরূপে তার ভাই, এই সোজা কথাটা দেখতে না পাওয়া কিংবা দেখতে না চাওয়া। ফলে, একটা সাম্প্রদায়িক আত্মম্ভরিতার সৃষ্টি হয়, যার জোরে সে শুধু যে অন্য ধর্মকে হীন করে দেখতে শুরু করে শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী তার শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এবং পুরোহিতদের কুযুক্তি এবং স্বার্থসংকীর্ণ দৃষ্টি নিয়ে সে ক্রমশ বিশ্বাস করে যে, তার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র বলে প্রতিষ্ঠা করার একটি মাত্র উপায় হল বিধর্মীকে ধ্বংস করা, তার ধর্মস্থানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া।

পৃথিবী আদিম যুগ থেকেই বহু লোকক্ষয়ী যুদ্ধ দেখেছে, তার অধিকাংশই পার্থিব স্বার্থবুদ্ধির সংঘর্ষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। পাশের দেশটা দখল করা, অন্যের জমি, পশু, স্ত্রীকে দখল করা, উৎকৃষ্ট চারণভূমি, খনিজ সম্পত্তি, বাণিজ্যের জন্য বন্দর ও সুযোগ আদায় করা— এই সব ঐহিক স্বার্থপ্রণোদিত উদ্দেশ্য থেকে। আবার এই সবেরই জন্যে, ধর্মের ছুতো করেও বহু যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলো কোনও ভাবেই ধর্মযুদ্ধ নয়। স্বার্থসিদ্ধির যুদ্ধই ধর্মের পতাকার নীচে সাধিত হয়েছে। এই সব দলীয় সংঘর্ষ নিজের সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করবার জন্য, অন্য সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব লোপ করার জন্যই ঘটেছে বারেবারে। ঘটছে এখনও। এর জন্যে অত্যাবশ্যক হল ধর্মান্ধতা অর্থাৎ ১. আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ ২. আমার ধর্ম বিপন্ন ৩. একে বাঁচাতে হলে অন্য ধর্মকে প্রতিস্পর্ধী বলে জ্ঞান করতে হবে ৪. তাকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিগত শতাব্দী ধরে খুব বেশি করে ধর্মান্ধতা পরধর্মী সম্প্রদায়ের উচ্ছেদের জন্য রক্তাক্ত নখদন্ত প্রকাশ করেছে। হিটলার, মুসোলিনির ইহুদিবিদ্বেষ, আয়ারল্যাণ্ডে প্রটেস্টান্ট-ক্যাথলিক সংঘর্ষ, মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইহুদি সংঘাত। এ ছাড়া ইতিহাসের পথে পথে বিকীর্ণ বহু ধর্মবিদ্বেষের হিংস্র চেহারা বারেবারে দেখা দিয়েছে। এবং বহু ক্ষেত্রেই ধর্মের মুখোশের আড়ালে নেহাত ঐহিক, স্বার্থ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার শঙ্কাই ধর্মীয় দলগুলিকে প্রণোদিত করেছে অন্য ধর্মাবলম্বী দলকে ধ্বংস করতে। ধর্মান্ধতা শব্দে অন্ধতা শব্দটি কী সূচিত করে? দৃষ্টিহীনতা অর্থাৎ ওই প্রসঙ্গে কোন সদ্যুক্তিকে দেখবার, বোঝবার ইচ্ছে বা চেষ্টা না থাকা। অন্ধ যেমন দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য ভাবে এগোয়, পথের সম্বন্ধে কোনও বোধই তার নেই, তাই সে সহসা ধাক্কা লাগিয়ে যেমন ক্ষতি করতে পারে, ধর্মান্ধ ব্যক্তিও তেমনি কোনও যুক্তিতর্ক সদ্বুদ্ধির ধার ধারে না। এই অন্ধতাকে তাই তর্ক করে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না; নিরঙ্কুশ ভাবে সে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যায়। বর্তমানে ধর্মের আবরণের আড়ালে ঐহিক স্বার্থ সাম্প্রদায়িক ধ্বংসকাণ্ডে একাগ্র। এই ধর্মান্ধতায় ধর্ম গৌণ। কারণ আগেই বলেছি, যে কোনও যথার্থ ধর্ম-বিশ্বাসের অপরিহার্য ফল হল বিশ্বসৌভাত্ৰ। কিন্তু ধর্মের প্রবক্তরা প্রায়ই ঘোষণা করে যে, তাদের নির্দেশিত পথই একমাত্র পথ, অন্যগুলি সব ভ্রান্ত, অতএব ধ্বংসযোগ্য। ধর্মের এই বিষাক্ত দিকটিই সৃষ্টি করে সংকীর্ণ, স্বার্থান্ধ বিদ্বেষ যা দলভুক্ত মানুষকে প্রবর্তিত করে বিরোধীদের নির্মূল করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে। সত্যকার নৈতিক, মানবিক ধর্মে বিশ্বাসীরা যদি এই বিরোধাত্মক ধ্বংসাত্মক দিকটিকে তার স্বরূপে অর্থাৎ অমানবিকতার রূপে উদ্ঘাটন করে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ায় ও বলে যে, ধর্মের মানেই বিধর্মীর বিনাশ নয়, তা হলে বিদ্বেষীদের রক্তাক্ত নখদন্ত উদ্ঘাটিত হয় এবং ধ্বংসক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়।

এ সব ধ্বংসাত্মক চেষ্টার পিছনে রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির কাছে প্রত্যাশিত যে, সেখানে থাকবে ধর্ম-নিরপেক্ষতা। এর অর্থ, বর্তমান ভারতে ঘোষিত সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ, রাষ্ট্র দেশবাসীর ধর্ম সম্বন্ধে সর্বদা উদাসীন থাকবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে দেশবাসীর হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন পরিচয় সম্পূর্ণ অবান্তর ও অর্থহীন, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে দেশবাসীর একটাই পরিচয়— সে ভারতীয়। কাজেই রাষ্ট্র কোনও ধর্ম সম্বন্ধে কোনও রকম পক্ষপাতিত্ব, আনুকূল্য, অনুদান বা প্রশ্রয় দিতে পারে না। দেশের মানুষের কাছেও ধর্মনিরপেক্ষতাই প্রত্যাশিত, সে ধর্মবিশ্বাসী হলে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে তার বিশ্বাসের কোনও প্রকাশ থাকবে না। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে বাবরি মসজিদ ভাঙা আইনত অসম্ভব ছিল। কিছু ধর্মান্ধ দানব সঙ্ঘ পরিবারের ছত্রছায়ায় পুষ্ট হয়ে ক্ষণিক উত্তেজনায় ওই সাড়ে চারশো বছরের মসজিদ ভেঙেছে, এ কথা বাতুলের প্রলাপ। নিশ্চয়ই সঙ্ঘ পরিবারে দানবিক ধর্মান্ধতার প্রশ্রয় নিয়েই এ কাজ সম্পাদিত হয়েছে সে দিন। কিন্তু দেশে একটা সংবিধান ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ থাকা সম্বন্ধে যে সংবিধান অঙ্গীকারবদ্ধ। ধ্বংসকার্য সূচনার এক মিনিটের মধ্যে দিল্লিতে খবর যায়, আধ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি বিমান এসে কাঁদানে গ্যাসবোমা দিয়ে, প্রনয়োজন হলে লাঠি-গুলি চালিয়ে ওই নারকীয় কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটাতে পারত। করেনি, তার কারণ, সরকার সঙ্ঘ পরিবারের ধর্মান্ধতার এবং ধ্বংসকাণ্ডের সমর্থক এবং স্বয়ং এ কাজে প্রবর্তনা জুগিয়েছিল। শিলান্যাস থেকে শুরু করে সুদীর্ঘ কালের যে কুচক্রী প্রস্তুতি চলছিল, তার পর এ ঘটনা নিরোধ করা সরকারের শক্তির অভাবে নয়, ইচ্ছার অভাবে। এবং এ-ইচ্ছার অভাব হল ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব।

ছয়-ই ডিসেম্বর আমরা জেনেছি, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের। অর্থাৎ হিন্দুর রাষ্ট্র। অথচ ভারতবর্ষকে স্বয়ম্বর গণতন্ত্র হয়ে টিকে থাকতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ হতেই হবে।। কাজেই যা ছিল রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন তা বর্তেছে দেশবাসীর ওপরে, অর্থাৎ জনসাধারণকে সচেতন ভাবে, সক্রিয় ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে হবে, অন্যদের বোঝাতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায় আছে সংখ্যালঘুকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া। মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভাই হিসেবেই দেখতে হবে, শত্রুপক্ষ হিসেবে নয়। তাদের ধর্ম যতক্ষণ অন্যকে আঘাত না করে ততক্ষণ তারা যেন ধর্মাচরণে বাধা না পায় এবং হিন্দুর সংখ্যাগুরুত্বের একটা দায় থেকেই যায় সংখ্যালঘুর সব রকম নিরাপত্তা বিধান করা। জওহরলাল নেহরু একবার বলেছিলেন, ‘মুসলমান ধর্মান্ধতা ভারতবর্ষের প্রভুত ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু একমাত্র হিন্দু ধর্মান্ধতাই ভারতবর্ষের সর্বনাশ সাধন করতে পারে।’ ধর্মনিরপেক্ষতা এখন ভারতবাসীমাত্রেই জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। আত্মানুসন্ধান করে অন্তরের গোপন কোণে যদি কোথাও সাম্প্রদায়িকতা থাকে তবে আগে তাকে নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে নির্মূল করে তার পরে আশেপাশের প্রতিবেশী দেশবাসীকে বোঝাতে হবে কেন আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা আত্মরক্ষারই নামান্তর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *