2 of 3

সান্যাল স্লিমিং

সান্যাল স্লিমিং

চোরবাজার থানার বড় দারোগা শ্ৰীযুক্ত দিগম্বর সান্যালমশায় একজন অতি সজ্জন ব্যক্তি। ছাত্রজীবনে তার ইচ্ছা ছিল ভাল করে লেখাপড়া শিখে অধ্যাপক হবেন। কিন্তু কলেজে পড়তে পড়তেই তার বাবা নটবর সান্যালমশায়, যিনি রাণাঘাট আদালতে পেশকার ছিলেন, তিনি হঠাৎ সেই রমরমা চাকরি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে খবর পাওয়া যায় তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন।

প্রথমে জানা যায় যে নটবরবাবু তারাপীঠে আছেন। তারাপীঠ মন্দিরের পিছনে যে বিখ্যাত শ্মশান আছে, সেখানেই তিনি এক সিদ্ধবাবার সাকরেদ হয়েছেন।

খবর পেয়ে দিগম্বরবাবু তার মাকে নিয়ে সেই তারাপীঠের শ্মশানে গেলেন। সেখানে তখন নটবরবাবু নেই, তিনি সারা গায়ে ছাইভস্ম মেখে তখন সাকরেদি ছেড়ে পুরো সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, তিনি নাকি হিমালয়ের দিকে চলে গেছেন।

এরপর আর নটবরবাবুর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে কয়েক বছর আগে একটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় কুম্ভমেলার যে আলোকচিত্র ছাপা হয়েছিল, তার মধ্যে জটাজুট এবং ত্রিশূলধারী এক কৌপীন সম্বল সন্ন্যাসীর মুখশ্রীর সঙ্গে রাণাঘাট কোর্টের প্রাক্তন পেশকার নটবরবাবুর বড় বেশি মিল। কিন্তু ততদিনে দিগম্বরবাবুর মা আর বেঁচে নেই এবং দিগম্বরবাবু অন্যান্য বিষয়ে এত ব্যস্ত যে এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না।

তা না থাকুক। নটবরবাবু আমাদের এ গল্পে আসছেন না। এলে খারাপ হত না, কিন্তু আমার সাহস নেই। বাংলা সাহিত্যে অনেক বাঘাবাঘা লেখক গল্পের মধ্যে সন্ন্যাসীকে ঢুকিয়ে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়েছেন।

কারণ এ গল্প ঠিক দিগম্বরবাবুকে নিয়ে নয়, নটবরবাবুকে নিয়েও নয়,–এ গল্প এক মোটা বিষয় নিয়ে যার সঙ্গে দিগম্বর সান্যাল বিশেষ করে তস্য পিতা নটবর সান্যালের কোনও সম্পর্ক নেই।

ভূমিকা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসল বিষয়ে পৌঁছানোর আগে আরও একটু বলার প্রয়োজন আছে। স্বস্তির কথা এই যে আসল বিষয় মোটেই সূক্ষ্ম নয়, সুতরাং ভূমিকা আরেকটু যেতে পারে।

ব্যাপারটা সোজাসুজি যেমন হয়, ঠিক তাই। দিগম্বর সান্যালমশাই পিতৃদেব নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে বুঝতে পারলেন লেখাপড়া চালিয়ে, ভালমতো পড়াশুনা করে, অধ্যাপনা করতে গেলে যে ধরনের আর্থিক সঙ্গতি দরকার সেটা তাদের সংসারে আর নেই। দিগম্বরবাবুর মাতুল কলকাতায় পুলিশের সদর অফিসে বড়বাবুর চাকরি করতেন। তাঁর বেশ নামডাক ছিল। অবশ্য নামডাক না বলে উপাধিডাক বলাই উচিত। কারণ সবাই তাকে চক্রবর্তীবাবু বলে ডাকত। তার আসল নামটা কেউই জানত না।

তাতে আমাদের কিছু আসে যাচ্ছে না। চক্রবর্তীবাবু তাঁর ভগিনীপতির আকস্মিক পলায়নের পর ভাগিনেয় দিগম্বরবাবুকে অধিকতর লেখাপড়া থেকে নিবৃত্ত করলেন। কারণ পুরো সংসারের দায়িত্ব পিতৃদেবের অনুপস্থিতিতে তাঁরই উপর এসেছে; সুতরাং দিগম্বরবাবুকে কাজে ঢুকতে হবে।

কাজ মানে একটাই, চক্রবর্তীবাবু তাঁর বড়সাহেবকে ধরাধরি করে দিগম্বরকে ছোট দারোগার কাজে ঢোকালেন।

পুলিশের চাকরিতে দিগম্বর সান্যালের নতুন জীবন শুরু হল। ছোট দারোগার কাজ বড় কঠিন। শুধু ছোটো আর ছোটো। এখানে চুরি, ওখানে রাহাজানি, সেখানে বদমায়েসিসব জায়গায় ছোটাই হল ছোট দারোগার কাজ।

 তা খুব ছোটাছুটি করলেন দিগম্বর সান্যাল। তিনি আর দশজন সরকারি কর্মচারির মতো নন। আর পুলিশের কাজে ঢুকলে যে দু-চারটে দোষ স্বভাবের মধ্যে অজান্তেই প্রবেশ করে যায়, সেগুলোকে তিনি প্রাণপণে বাধা দিয়ে অত্যন্ত সতোর সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখলেন।

অবশেষে একদিন বছর পনেরো চাকরির পর বড় দারোগা হলেন। বড় দারোগা হওয়ার পর দু-চার থানা ঘুরে অবশেষে আজ কয়েকমাস হল তিনি এই কুখ্যাত চোরবাজার থানায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। দিগম্বরবাবুই এখানকার বড় দারোগা, মানে সর্বেসর্বা।

চোরবাজার থানায় যোগদান করে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি পুরো এলাকাটাকে প্রায় ঠান্ডা করে দিয়েছেন।

 দিগম্বরবাবুর ঠান্ডা করার পদ্ধতি একটু অন্যরকম। তার মধ্যে একটা সাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক ভাব আছে। তিনি সদাসর্বদা সাত্ত্বিক প্রচেষ্টাতেই চোর-বদমাস-গুণ্ডাদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করেন।

অতি ভোরবেলায় প্রায় ব্রাহ্মমুহূর্তে জয় কালী জয় কালী বলতে বলতে ঘুম থেকে ওঠেন। থানার দোতলার কোয়ার্টারে তিনি একা থাকেন। পুলিশের চাকরির অসুবিধের কথা ভেবে বিয়ে করবার সাহস পাননি। মা বেশ কিছুদিন হল মারা গিয়েছেন। যে দু-চারজন নিজের লোক আছে, তারা রাণাঘাটের পুরনো বাড়িতেই রয়েছে।

তাঁর জয় কালী জয় কালী শুনলেই নীচতলার থানার ঘর থেকে ডিউটিতে একজন সেপাই উপরে উঠে আসে। তিনি ততক্ষণে এক গেলাস চিরেতার জল খেয়ে স্নান-প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে নেন।

এবার সেপাইটি এসে কাল লকআপে যেসব মহান ব্যক্তিরা পদধূলি দিয়েছেন, তাঁদের নাম ও কৃতিত্ব বর্ণনা করেন। সব মনোযোগ দিয়ে শুনে বিশেষভাবে বিবেচনার পর তিনি একজনকে বেছে নেন। তাকে সেপাই ওপরে নিয়ে আসে।

কাজটা কঠিন, সন্দেহ নেই। লকআপের ভিতরে ঢুকে বাছাই করা ঘুমন্ত আসামিটিকে আলাদা করে তুলে দোতলায় নিয়ে আসা সোজা কাজ নয়। বিশেষ করে সে ব্যক্তি যদি পুরনো পাপী হয় আর দিগম্বর দারোগার আধ্যাত্মিক উন্নয়ন বিষয়ে তার যদি কোনও প্রাক্তন অভিজ্ঞতা থাকে, তবে অনেক সময় রুল দিয়ে গুতিয়ে কিংবা কয়েকজনে মিলে টেনেহিঁচড়ে তাকে দোতলায় আনতে হয়।

দিগম্বরবাবুর শোধনপদ্ধতি অতি সরল এবং সনাতন। প্রথমে এক গেলাস চিরতার জল। রাত দুটো পর্যন্ত যে লোকটা মদ খেয়ে হল্লা করে থানায় চালান হয়েছে, এই ভোর চারটের সময় তার পক্ষে এক গেলাস মহাতেতো চিরতার জল অতি মারাত্মক। এক চুমুকে খেয়ে নিতে হয়। মাথার তালু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কনকন করে ওঠে।

এর বিপরীতও আছে। হয়তো কেউ বিকেলে কোনও কুকর্ম করে লকআপে ঢুকেছে, বারো-চোদ্দো ঘণ্টা পেটে কিছু নেই। খালি পেটে এক গেলাস চিরতার জল পড়া মাত্র সমস্ত পেটের ভেতরটা যকৃত, পিলে, নাড়িভুড়ি সব মোচড়াতে থাকে।

এর পরে গঙ্গাস্নান। না, গঙ্গা পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। সিঁড়ির একপাশে গঙ্গাজলের কলের সঙ্গে মোটা একটা হোসপাইপ লাগানো আছে। জামাকাপড় পরিহিত অবস্থায় আসামিটিকে সেই হোসপাইপে সুস্নাত করা হয়। গ্রীষ্মের কিছুদিন ছাড়া শেষরাতে সব সময়েই কিছু ঠান্ডা, আর এটা সবচেয়ে মারাত্মক শীতকালে।

তা শীত-গ্রীষ্ম যাই হোক, মিনিট পনেরো হোস পাইপের প্রবল ধারাজলে লোকটিকে চোবানো হয়।

 ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ভেজা জামাকাপড়ে এবার লোকটাকে নিয়ে যাওয়া হয় তিনতলার ছাদে, সেখানে একটি তুলসীমঞ্চ আছে। সেই তুলসীমঞ্চের সামনে পাশাপাশি দুটি আসন বিছানো রয়েছে।

ছাদের খোলা হাওয়ায় সিক্তবস্ত্রে আসামিটিকে একটি আসনে বসতে হয়। পাশের আসনটি স্বয়ং দিগম্বর সান্যালের।

প্রথমে আধঘণ্টা প্রাণায়াম। জোড়াসনে বসে গোড়ালির সঙ্গে গোড়ালি জুড়ে এক নাক চেপে আরেক নাকে, তারপরে সেই নাক চেপে আগের নাকে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নেওয়া।

ব্যাপার সোজা নয়। বলা উচিত ভয়াবহ। বহু কুখ্যাত ছিনতাইকারী, প্রতিষ্ঠিত পকেটমার, নগরবিদিত মদ্যপ সান্যাল দারোগার এই প্রাণায়ামে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু প্রাণায়ামে ব্যাপারটা শুরু। এর পর আরও দু ঘণ্টা সাধনা। তার মধ্যে পদ্মাসন আছে, বজ্ৰাসন আছে, এক হাজার আটবার স্তোত্রজপ করা আছে।

স্তোত্রটি শ্রীযুক্ত দিগম্বর সান্যালের স্বরচিত। তিনি নিজেও প্রতিদিন সকালে আসামির পাশের আসনে বসে স্তোত্রটি পাঠ করেন। সান্যাল দারোগার স্তোত্রটি খুবই সোজা ভাষায় সরাসরি লেখা, মা কালীকে বলা হয়েছে,

কালী কালী মহাকালী
ডাকি তোকে খালিখালি

এ হল সান্যালমশায়ের মতে, মা মহাকালীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। এক হাজার আটবার এই শ্লোকটি জপ করতে করতে অনেক বলশালী গুণ্ডাও গোঁ গোঁ করতে করতে কাটা কলাগাছের মতো ভূপতিত হয়েছে।

এর পরে যথাসময়ে অবশ্যই আসামিকে আদালতে চালান দেওয়া হয়। সেখানে বিচারে যার যা সাজা হয় হোক, কিন্তু দিগম্বরবাবুর শোধনপদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যে একবার গিয়েছে সে পরবর্তীকালে আর যাই করুক, চোরবাজার থানার এলাকার মধ্যে সহজে প্রবেশ করে না।

কিন্তু একদিন এর ব্যতিক্রম ঘটল। সেই ব্যতিক্রমের ঘটনাটা নিয়েই এই গল্প।

অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও শেষরাতে উঠে দিগম্বরবাবু জয় কালী, জয় কালী করেছেন এবং সেটা শুনে নীচের থানার ঘর থেকে সেপাই উঠে আসার কথা।

কিন্তু এদিন তা সহজে ঘটল না। প্রায় দশ পনেরো বার জয় কালী জয় কালী করার পরে থানা থেকে সবচেয়ে সাহসী সেপাই সরযূপ্রসাদ দ্বিধাজড়িত পদে এবং কম্পমান হৃদয়ে দোতলায় উঠে এল। সে এসে দারোগা সাহেবকে একটা লম্বা স্যালুট করে জানাল যে আজ নীচের লকআপ শূন্য। একজন আসামিও কাল বিকেল থেকে সারারাতে ধরা যায়নি, যে তাকে শোধনের জন্যে দারোগা সাহেবের কাছে পেশ করা যাবে।

সরযূপ্রসাদের বক্তব্য শুনে দিগম্বরবাবু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, এত বড় একটা থানায় তোমরা পনেরো-বিশজন লোক সারাদিন সারারাত কি ভেরেন্ডা ভাজছ? একটা বদমাশও ধরা পড়েনি কাল আর আজকের মধ্যে?

 দিগম্বরবাবুর হাঁকডাক শুনে ছোট দারোগা নিখিলচন্দ্র দোতলায় উঠে এলেন। এসে দিগম্বরবাবুকে বুঝিয়ে বললেন, স্যার, আপনার শোধন-প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ এলাকা পাজিমুক্ত হয়েছে। তাই চোর গুণ্ডা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আপনার রাগ না করে আনন্দিত হওয়াই উচিত।

সব শুনে চিরতার জল খেয়ে প্রাতঃকৃত্যাদি সারতে সারতে দিগম্বর সান্যালমশায় ভাল করে তলিয়ে ভেবে দেখলেন যে সত্যিই লকআপে যে আজ আসামির অভাব হচ্ছে, সেটা তারই শোধন প্রক্রিয়ার ফল। আজ কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্রমশই বদমাশ কম ধরা পড়ছিল, লকআপে কম লোক আসছিল। তবে আজকেই প্রথম লকআপ সম্পূর্ণ শূন্য।

কিন্তু এই কয়েকমাসে দিগম্বরবাবুর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে, শেষরাতে তার অধ্যাত্মসাধনা এবং কালীজপের একজন সঙ্গী না হলে চলবে না। তিনি নিখিলবাবুকেই ও ব্যাপারে নির্বাচিত করলেন, মুখে আদেশ দিলেন, নিখিল, তুমি এক গেলাস চিরতার জল খেয়ে গঙ্গাজলের হোসপাইপে ভাল করে স্নান সেরে নাও। তারপর আমার সঙ্গে প্রাণায়াম আর জপে বসবে। আজ যখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, তুমি ছোট দারোগা, তুমিই আমার অধ্যাত্মসাধনার সঙ্গী হও। তা ছাড়া তুমি তো ঘুষ-টুষ, মদ-টদ খাও শুনি, তোমার শোধন হওয়া দরকার।

ছোট দারোগা নিখিলবাবু শ্লেষ্মর ধাতের লোক, চিরকাল তাঁর সর্দিকাশির ভয়। এই বর্ষার ভোরবেলা, হু হু করে জোলো হাওয়া বইছে, এর মধ্যে ঠান্ডাজলে স্নান করে দু ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টা খোলা ছাদে প্রাণায়াম, আসন এবং এক হাজার আটবার ওই বিদঘুঁটে জপ করা তাঁর মতো লোকের কর্ম নয়।

চতুর নিখিলবাবু আসছি বলে নীচে নেমে সরাসরি থানার বাইরে পালিয়ে গিয়ে এক জমাদারকে দিয়ে বড় দারোগাকে লিখে পাঠালেন, স্যার, ওপাশের বস্তিতে কী একটা বড় গোলমাল হচ্ছে, আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হচ্ছে। আজ অধ্যাত্মসাধনায় আপনার সঙ্গী হতে পারছি না, পরে। একদিন চেষ্টা করব। ইতি সেবক নিখিল।

রামদিন নামক যে প্রাচীন জমাদারটি দোতলায় এই চিরকুটটি নিয়ে সরল চিত্তে বড় দারোগার কাছে এসেছিল, তাকেই সঙ্গে সঙ্গে পাকড়িয়ে ধরলেন দিগম্বরবাবু। রামদিনের বহুদিনের অভ্যেস সাতসকালে উঠে থানার ভিতরে বাঁধানো টিউবওয়েলের পাশে বসে লোটা লোটা জল ঢেলে জয় সিয়ারাম, জয় সিয়ারাম বলে স্নান করা।

আজও রামদিনের এর মধ্যেই স্নান সারা হয়ে গেছে। সুতরাং দিগম্বরবাবুর সুবিধেই হল। সোজা রামদিনকে নিয়ে তেতলার ছাদে তুলসীমঞ্চের পাশে সাধনা করতে বসে গেলেন। আর রামদিনকে বললেন, এতে তোমার সুবিধেই হবে। তুমি যে অত লোটাভর্তি ভাঙ খাও আর গুণ্ডাদের কাছ থেকে তোলা আদায় করো, তোমার শোধন হওয়া ভাল।

বিশাল বপু এবং বিশালতর উদর নিয়ে রামদিনের পক্ষে শোয়া-বসাই কঠিন, আজ বড় দারোগার আদেশে সে যখন প্রাণায়াম করার জন্যে জোড়াসনে বসতে গেল একদম উলটিয়ে মুখ থুবড়ে তুলসীমঞ্চের উপরে পড়ে গেল। তার বিরাট শরীরের পতনের ধাক্কায় পুরো থানাবাড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠল।

সবাই কী হয়েছে দেখতে ছুটে তিনতলার ছাদে চলে এল এবং ধরাধরি করে রামদিনকে সোজা করে দাঁড় করাল। রামদিনের পতন হয়েছিল, কিন্তু মূৰ্ছা হয়নি। বড় দারোগা তাকে ছাড়লেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তাকে আধ ঘণ্টা প্রাণায়াম, তারপর এক হাজার আটবার মহাকালী মন্ত্র জপ করান।

একবেলায় রামদিনের ভুড়ি চুপসিয়ে গেল। ওজনও বোধহয় বেশ কয়েক কেজি কমল।

এরপর থেকে লকআপে তোক না থাকলেই থানারই কোনও সেপাই বা জমাদার ধরে বড়বাবু শোধন করতে লাগলেন।

চোরবাজার থানার বিখ্যাত স্থূলোদর সেপাই জমাদাররা বড় দারোগার শোধন প্রক্রিয়ায় ক্রমশ চুপসে যেতে লাগল। তাদের মেদ-চর্বি অন্তর্হিত হল, ভুড়ি চুপসিয়ে গেল। ওজনও বোধহয় বেশ কয়েক কেজি কমল।

এই পরিবর্তন জনসাধারণের দৃষ্টি এড়াল না। প্রথমে আশেপাশের লোকজন, তারপরে পুরো থানা এলাকায়, এমনকী থানার এলাকার বাইরেও দিগম্বর সান্যালের এই আধ্যাত্মিক শোধন প্রক্রিয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ল।

আজকাল চারদিকে রোগা হওয়ার ফ্যাশন চালু হয়েছে। মোটা লোকেরা স্লিম হওয়ার জন্যে নানা উলটোপালটা স্লিমিং সেন্টারে যোগদান করে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করছে। তবু সব সময়ে রোগা হতে পারছে না। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে, কঠিন ব্যায়াম করে রোগা হতে হতে হঠাৎ সামান্য অসতর্ক বা অসাবধান হয়ে আবার মোটা হয়ে যাচ্ছে।

ক্রমশ এই ধরনের লোকেদের কানে পৌঁছল দিগম্বর সান্যালের শোধন প্রক্রিয়ার তাজ্জব কাহিনি। ধূর্ত মোটারা রাতের দিকে চোরবাজার থানার সামনে অহেতুক গোলমাল বাধিয়ে লকআপে ঢুকে পড়তে লাগল। তারপর পরদিন সকালে আধ্যাত্মিক শোধনের দ্বারা শরীর হালকা করে, নিখরচায় চর্বি ঝরিয়ে ফেলল।

দিগম্বর সান্যাল হাজার হলেও পুলিশের লোক। যখন একই ব্যক্তিরা বার বার লকআপ থেকে শোধনের জন্যে তার কাছে আসতে লাগল, তিনি খোঁজখবর লাগালেন।

খোঁজখবর যা পাওয়া গেল, তারপরে আর পুলিশের চাকরি করার কোনও মানে হয় না।

তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। চৌরঙ্গিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সান্যাল স্লিমিং নাম দিয়ে মেদ ঝরানোর ব্যবসা শুরু করেছেন। সান্যাল শোধন প্রক্রিয়ায় একমাসে ভুঁড়ি দশ ইঞ্চি এবং ওজন দশ কেজি কমবেই, এ ব্যাপারে গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে। মাসে মাত্র দেড় হাজার টাকা, এ টাকা দিলেই যেকোনও স্থূলোদর-স্থূলোদরা সুপুরুষ-সুপুরুষী হতে পারে।

শেষ খবর, দিগম্বর সান্যালের ব্যবসা রমরমা চলছে। তবে সান্যাল স্লিমিংয়ের মোটা টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে চেম্বারের সোফা বদলাতে। প্রতি সপ্তাহে সোফা বদলাতে হচ্ছে, অতিরিক্ত মোটা লোকের ভার সোফাগুলি বহন করতে পারছে না। কিন্তু দিগম্বরবাবু উপায় বার করেছেন। থানার

অফিসঘরে যেরকম সেগুন কাঠের হেলান দেওয়া বেঞ্চিতে সেপাই এবং জমাদাররা সারাদিন বসে ঝিমোয়, সেই রকম এক সেট সেগুন কাঠের বেঞ্চির স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়েছেন বউবাজারের এক ফার্নিচারের দোকানে। আশা করা যাচ্ছে সান্যাল স্লিমিংয়ের অতঃপর আর কোনও অসুবিধাই থাকবে না। আর সেগুন কাঠের বেঞ্চিও যদি মাসে মাসে ভাঙে, ভালই তো, খদ্দের লক্ষ্মীর দেহভার যত বেশি হবে ততই মঙ্গল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *