2 of 3

বইমেলা

বইমেলা

নরোত্তমবাবু সমস্ত জীবন ধরে বই লিখেছেন, শুধু বই আর বই।

তবে বই লেখার জন্য নরোত্তম দত্তগুপ্ত যে রকম পরিশ্রম করেছেন সেই পরিমাণ খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। তার একটা কারণ অবশ্য যে নরোত্তমবাবুর অধিকাংশ বইই পাণ্ডুলিপির পর্যায়ে আছে, মুদ্রিত বা প্রকাশিত হয়নি।

নরোত্তম দত্তগুপ্ত রচিত বইগুলির প্রকাশকের বড়ই অভাব। নরোত্তমবাবু যে ধরনের বিষয়ে লেখেন সেই সব বিষয়ে, এদেশে এমনকী বিদেশেও খুব বেশি লোক লেখেননি। কিন্তু প্রকাশকেরা ভরসা পান না এই রকম বই ছাপতে। তারা বলেন, যত ইচ্ছে নভেল দিন, বাচ্চাদের বই দিন– ছাপব। কিন্তু ছেলে বউ নিয়ে সংসার চালাই, ব্যবসায়ে লস দিতে পারব না।

সত্যিই লস মানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নরোত্তমবাবুর বইতে রয়েছে। এ কথা নরোত্তমবাবুর অতি বড় বন্ধুও স্বীকার করতে বাধ্য। যদিও নরোত্তম দত্তগুপ্ত নিজে এ কথা মনেন না।

গত সাড়ে তিন মাস প্রাণপণ পরিশ্রম করে নরোত্তমবাবু একটি গ্রন্থ রচনা সদ্য সমাপ্ত করেছেন। বইটির বিষয়বস্তু যেমন অভিনব, তেমনই অতি প্রয়োজনীয়, বইটির নামও খুব সরাসরি, নাম পড়ে আর কারও মনে সংশয় থাকে না বইটি কী নিয়ে লেখা, কিনে ঠকবার সম্ভাবনা নেই। সত্যিই নিজের চুল নিজে কাটুন বইটি একটি অসামান্য চিন্তার ফসল।

নিজের চুল নিজে কাটুন বইটিতে বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে নরোত্তমবাবু দেখিয়েছেন যে সামান্য যোগব্যায়াম জানলে, মানুষ যেভাবে নিজের দাড়ি নিজে কামায় কিংবা মহিলারা যেভাবে নিজের চুল নিজে বাঁধে ঠিক সেভাবেই নিজের কেশকর্তন করতে পারবে। মাথার সামনের দিকের চুল কাটা কোনও সমস্যাই নয়। শুধু পিছনের অর্থাৎ ঘাড়ের দিকের চুল কাটার জন্যে মিনিট পাঁচেক কুম্ভাসনে ঘাড়টাকে হাতের কাছে আনতে হবে আর দুদিকে দুটো আয়না লাগবে।

এই বইটির জন্যে কোনও প্রকাশকই পাওয়া যায়নি এ কথা বলা অনুচিত হবে। একজন প্রকাশক পতিতুণ্ডি ইন্টারন্যাশনাল রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু তারা বললেন, আমরা আন্তর্জাতিক প্রকাশক, ইংরেজি করে দিন ছাপব।

নরোত্তমবাবু এ প্রস্তাবে যথেষ্টই রাজি হয়েছিলেন এবং পরিশ্রম করে স্বরচিত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু তখন পতিতুণ্ডিরা বললেন, অনুবাদ তাঁরাই করাবেন, আর তার জন্যে নরোত্তমবাবুকে চার হাজার টাকা অগ্রিম দিতে হবে।

টাকা দিয়ে বই ছাপানোর অভিজ্ঞতা নরোত্তমবাবুর দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে এই প্রথম নয় এবং প্রত্যেকবারই এরকম ব্যাপারে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা একই সঙ্গে মর্মান্তিক ও নিদারুণ।

এ ছাড়াও নিজের চুল নিজে কাটুন বইটির জন্যে আরও একজন প্রকাশক পাওয়া গিয়েছিল। তিনি অনেক দূর এগিয়েছিলেন, তিনি এর আগে এ জাতীয় বই কিছু কিছু প্রকাশ করেছেন, যেমন চন্দ্রমল্লিকা চাষের প্রণালী কিংবা বাংলার পিঠেপুলি। কিন্তু বাদ সাধলেন ওই প্রকাশকের বড়মামা। সেই ভদ্রলোক অতি সাবধানী। তিনি বললেন, আগের বইগুলি ছিল মোটামুটি নিরীহ জাতের কিন্তু এ বই ছাপলে সেলুনওলা আর রাস্তার ক্ষৌরকারদের বিক্ষোভ হবে, তাদের জীবিকায় টান পড়বে এমনকী নিখিল কলকাতা কেশশিল্পী সমিতি মিছিল প্রসেশনও বার করতে পারেন।

সুতরাং নরোত্তম দত্তগুপ্তের শেষতম গ্রন্থটি রচিত হয়ে পড়ে আছে, এখনও ছাপা হয়নি। কোনওদিন হবে কি না তাই বা কে জানে!

নরোত্তমবাবুর বইয়ের এইরকম ভাগ্য নতুন নয়। সেই যে তিরিশ বছর আগে প্রথম বই তিনি রচনা করেছিলেন তখন থেকেই সরস্বতী ঠাকরুণ না কি ভাগ্যলক্ষ্মী তার সঙ্গে পরিহাস করে যাচ্ছেন।

নরোত্তমবাবুর প্রথম বইটির নাম ছিল, ইঁদুর-বিড়াল। বইটা দুই খণ্ডে বিভক্ত ছিল।

১ম খণ্ড: ইঁদুর আমাদের শত্রু না বন্ধু?
২য় খণ্ড: বিড়াল আমাদের শত্রু না বন্ধু?

দুটি খণ্ডই ছিল চল্লিশ পৃষ্ঠা করে, এরপরে প্রায় একশো পৃষ্ঠার একটি পরিশিষ্ট ছিল, যাতে ইঁদুর ও বিড়ালের তুলনামূলক উপকারিতা এবং অপকারিতা প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করা হয়েছিল। এই অসামান্য পরিশিষ্টটির নাম দেওয়া হয়েছিল,

ইঁদুর : বিড়াল :
কাকে ফেলে কাকে চাই
দোষগুণ ভাই ভাই।

সেই সময় নরোত্তমবাবুর ধারণা হয়েছিল, যেহেতু এটি তার প্রথম গ্রন্থ সেইজন্য প্রকাশক পাওয়া যাচ্ছে না। দু-একটি বই প্রকাশিত হলেই যখন পাঠক সমাজে তার নাম সুপরিচিত হয়ে যাবে তখন আর তাকে প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে না, তারাই যেচে এসে তার বাড়িতে ধরনা দেবেন।

ভবিষ্যতের এই উজ্জ্বল স্বপ্নে বিভোর হয়ে নরোত্তমবাবু দেশের বাড়ির একটা আটচালা টিনের। ঘর এগারোশো টাকায় বিক্রি করে দিয়ে ইঁদুর-বিড়াল বইটি নিজের খরচায় প্রকাশ করেন।

বইটি নিজের হাতে বহু বিখ্যাত লেখক ও পণ্ডিত ব্যক্তির বাড়িতে নরোত্তম দত্তগুপ্ত পৌঁছে দিয়ে আসেন। সবাই বলেন, ঠিক আছে, রেখে যান, পড়ে দেখব।

পরে নরোত্তমবাবু বহু বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে এই জ্ঞান অর্জন করেন যে এই জাতীয় নামকরা লোকেরা প্রায় কোনও বই-ই পড়েন না, বিশেষ করে কোনও অজ্ঞাতকুলশীল লেখকের প্রথম গ্রন্থ তো নয়ই। দু-একজন যাঁরা মলাট অবধি দেখেছিলেন তাঁদের কথাবার্তাতেই নরোত্তম দত্তগুপ্ত খুব মর্মাহত হয়েছিলেন।

একজন বলেছিলেন, হাসির গল্পে আপনার হাত আছে। আপনি চেষ্টা করে যান, আপনার হবে। এই রকম একটা গম্ভীর বিষয়ের বইকে কী করে ওই পণ্ডিত ব্যক্তি হাসির বই ভেবেছিলেন সেটা নরোত্তমবাবু কখনওই অনুধাবন করতে পারেননি।

কিন্তু এর চেয়েও ভুল করেছিলেন অন্য একজন। তিনি প্রতিষ্ঠিত কবি, তিনি ভেবেছিলেন এটাও কোনও একটা আধুনিক কবিতার বই, খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, বলেছিলেন, শুধু নামকরণে আধুনিক হলেই চলবে না, লেখার মধ্যে, জীবনের মধ্যেও আধুনিকতা আনতে হবে।

এরপর থেকে নরোত্তম দত্তগুপ্ত খ্যাতনামা লোকেদের আর বই দিতে যেতেন না। যদি খুব ইচ্ছা হত রেজেস্ট্রি ডাকে পাঠিয়ে দিতেন, কিন্তু স্বশরীরে কখনওই খোঁজখবর নিতে যাননি।

অবহেলায় বা অনাদরে নরোত্তম লেখা ছেড়ে দেননি। তিনি তো আর সাধারণ কবি, গল্পলেখক বা ঔপন্যাসিকের মতো নন, তাঁর লেখা শৌখিন বা কাল্পনিক নয়, নেহাতই বাস্তব জীবনের প্রতিদিনের প্রয়োজন ও সমস্যা নিয়ে তাঁর চুলচেরা বিশ্লেষণ। সমাজ ও জাতির কল্যাণের কথা ভেবেই তিনি কলম চালানো বন্ধ করে দিলেন না, কিন্তু তার ভাগ্যে সমঝদার পাঠক বেশি জুটল না।

অবশ্য দু-একবার যে তাঁর লেখা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি তা নয়। বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখতে লিখতে অবশেষে উনিশশো সাতষট্টি সাল নাগাদ তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন, তার নাম দিয়েছিলেন বাঙালিরা পারে, সাহেবরা পারে না।

প্রায় দশ বারোটি বই পাণ্ডুলিপি অবস্থায় অমুদ্রিত থাকার পরে নরোত্তম দত্তগুপ্তের এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বিলাতফেরত এক দেশপ্রেমিক চিকিৎসক যিনি আবার নরোত্তমবাবুর একটু দূর সম্পর্কের ভাগিনেয়ি জামাতা তিনি বইটির নাম শুনেই মুগ্ধ হয়ে যান। আসলে প্রবাসে দীর্ঘদিন থেকে তার মনে প্রচণ্ড গ্লানি জন্মেছে, সাহেব মেমদের ব্যবহারে তাঁর বিতৃষ্ণা এসে গেছে, তিনি নরোত্তমবাবুকে বলেন, মামা, আমি আপনাকে একশো পাউন্ড দিচ্ছি, আপনি বইটি বার করুন।

একশো পাউন্ড কম টাকা নয়, তখন প্রায় দুহাজার টাকা। নরোত্তম দত্তগুপ্ত অসাধু লোক নন।

তিনি ভাগিনেয়ি জামাতার কাছে ঋণ রাখতে চাননি সাহায্যও নিতে পারেননি। ওই টাকা দিয়ে যুগ্মভাবে একটি প্রকাশক প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। প্রকাশক প্রতিষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয় দত্তগুপ্ত অ্যান্ড নেফিউ ইন ল পাবলিশিং কোম্পানি।

বাঙালিরা পারে, সাহেবরা পারে না সত্যিই কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। নরোত্তমবাবু দেখিয়েছিলেন শতকরা নব্বই জন বাঙালি সাঁতার জানে, অথচ সাহেবদের মধ্যে মাত্র শতকরা পনেরো জন। কতকগুলো জিনিস বাঙালিদের সহজাত যেমন একহাতে ছাতা ধরে অন্যহাতে সাইকেল চালানো কিংবা এক রিকশায় একসঙ্গে তিনজন চারজন বসে যাওয়া। নরোত্তমবাবু দেখালেন এসব ব্যাপারে সাহেবরা বাঙালিদের ধারে কাছে ঘেঁষার যোগ্যতা রাখে না।

বই পড়ে কিছু কিছু লোক বাহবা দিয়েছিল, দু-একটা ছোটবড় কাগজে অল্পবিস্তর প্রশংসাও বেরিয়েছিল কিন্তু বিক্রি বিশেষ কিছু হয়নি। ফলে বাঙালিরা পারে, সাহেবরা পারে না বইটি দত্তগুপ্ত অ্যান্ড নেটিভ ইন ল পাবলিশিং কোম্পানির প্রথম ও একমাত্র বই হয়ে রইল।

কিন্তু নরোত্তম দত্তগুপ্ত অদমিত। কোনও ঠান্ডা অভ্যর্থনা বা অনুদার সমালোচনা তাকে আটকিয়ে বা থামিয়ে রাখতে সমর্থ হয়নি।

সেই অদমিত প্রয়াসের শেষ ফসল তার নবতম গ্রন্থ নিজের চুল নিজে কাটুন। বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হবে কি না তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু সম্প্রতি নরোত্তমবাবুর মাথায় একটা নতুন আইডিয়া বা পরিকল্পনা এসেছে। ময়দান এবং এদিক ওদিকে কয়েকটা বুক ফেয়ার বা বইমেলায় ঘুরে ঘুরে তাঁর মাথায় এক অভিনব বুদ্ধি এসেছে।

বহু লেখকের বহু প্রকাশকের অনেক রকম বই দিয়ে যদি বইমেলা হতে পারে তবে একজন লেখকের নিজস্ব বইমেলাই বা হতে পারবে না কেন?

নরোত্তম দত্তগুপ্ত মনস্থির করে ফেলেছেন। ওই সব প্যান্ডেল, গেট, স্টল এসবের ঝামেলার মধ্যে তিনি যাবেন না। তার সর্বসমেত তিনটি মুদ্রিত গ্রন্থ এবং ছাব্বিশটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি একক ভ্রাম্যমাণ বইমেলা করবেন।

খবর পাওয়া গেছে এরই মধ্যে কোথাও নরোত্তমবাবু ময়দানের আশেপাশে কোনও গাছের ছায়ায় কিংবা গাড়িবারান্দার নীচে মুদ্রিত গ্রন্থত্রয় এবং অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপিগুলি নিয়ে একক বইমেলা শুরু করে দিয়েছেন। সেখানে সকলেরই নিমন্ত্রণ, তবে নরোত্তমবাবুর টাকাপয়সা নেই। বিজ্ঞাপন করতে পারেননি, মেলাটা কোথায় সেটা একটু কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *