2 of 3

লাথ্যৌষধি

লাথ্যৌষধি

ভদ্রলোককে ভোরবেলায় ময়দানে বেড়ানোর সময় কখনও কখনও দুর থেকে দেখেছি। দেখার মতো, সমীহ করার মতো চেহারা। সাড়ে ছফুটের চেয়ে কম নয় লম্বায় এবং তদনুপাতিক ছড়ানোবাড়ানো দশাসই কলেবর।

অনেককেই সকালে ময়দানে দেখি। কেউই ঠিক সাধারণ পর্যায়ের লোক বোধহয় নয়। তা না হলে চমৎকার সুন্দর ভোরবেলায় বিছানার আরাম ছেড়ে মাঠে দৌড়াতে আসবে কেন? এদের মধ্যে একেকজন বেশ বিপজ্জনক। আমি যখন প্রথম প্রথম ময়দানে হাঁটা শুরু করি, কাউকে কাউকে দেখে রীতিমতো ভয় হত। একজন আছেন দুপায়ের জুতো দু হাতে নিয়ে, ধুতি মালকোঁচা বেঁধে, দুপাশে দুটো হাত পাখির মতো ছড়িয়ে দিয়ে বিকট গগনভেদী আ-আ-আ চিৎকার করতে করতে মাঠের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে যান। উনি নাকি কোন সাবানের কারখানার মালিক, কোটিপতি। এইভাবে আ-আ-আ করে ছুটে প্রতিদিন তিনি শরীর ও মনের গ্লানি দূর করেন। অন্য এক বৃদ্ধ। আছেন, আজ চল্লিশ বছর নাকি ময়দানে আসছেন, ছত্রিশ বছর হল আবগারির বড় দারোগা পদ। থেকে অবসর নিয়েছেন। ভদ্রলোকের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা, কাঁধের দুপাশে দুটো হাতকে শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের মতো বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে পারেন, সত্যিই বোঁ বোঁ শব্দ হয়, আমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে শব্দ স্বকর্ণে শুনেছি।

হাফপ্যান্ট পরিহিতা এক তাড়কাকায়া ভদ্রমহিলা আসেন। কোনও একজন দরজির পক্ষে যে তাঁর হাফপ্যান্টের মাপ নেওয়া সম্ভব হয়নি, একজন ফিতে ধরে ছিল এবং অন্যজন চারপাশ ঘুরে এসেছিল, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, ইনি অবশ্য বিশেষ দৌড়ঝাঁপ করেন না। করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। মাঠের পাশের একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে শরীরের ভার ফেলে সেই বেঞ্চিটা ভাঙার চেষ্টা করেন আর সেই বেঞ্চি থেকে উঠতে কী কঠোর পরিশ্রম হয় তাঁর, বহু কষ্টে দম নিয়ে। যেন কোনও খাড়া পাহাড়ে উঠছেন এইভাবে দেহ উত্তোলন করেন।

এসব যা হোক, আমি প্রথমে যে দীর্ঘদেহী ভদ্রলোকের কথা বলেছি, যাঁর জন্যে আমাদের এই গল্প, তাঁর কাছে ফিরে আসি। ভদ্রলোক কাছাকাছি কোনও বহুতল অট্টালিকার বাসিন্দা, কোনও কোম্পানি বা কারখানার সম্ভবত ম্যানেজার হবেন। কোনও কোনও পরিচিত বায়ুসেবনকারী তাকে ওই নামেই সম্বোধন করেন শুনেছি এবং তিনিও সাড়া দেন। এই গল্পে আমরাও তাকে আপাতত ম্যানেজার সাহেব (ম্যা. সা.) বলব।

ম্যা. সা. একদিন আমাকে চাপা দিতে যাচ্ছিলেন। কোনও গাড়ি দিয়ে নয়, তার বিশাল বপু দিয়ে। আর আমি যদি ক্ষিপ্র না হতাম, এড়াতে না পারতাম তাহলে ওই চারমনি শরীরে চাপা পড়া গাড়ি চাপা পড়ার চেয়ে কম মারাত্মক হত না।

 ম্যা. সা. সকালবেলা ময়দানে উলটোদিকে দৌড়ান। আগে কখনও এ জিনিস দেখিনি, ময়দানে উলটোদৌড়ের কারিগর অনেক। মুখটা সামনের দিকে রয়েছে অথচ পা দুটো পিছন দিকে চরম গতিতে ছুটছে। এতে নাকি শিরদাঁড়া সোজা থাকে। তা নিয়ে আপত্তি নেই কিন্তু অসুবিধা হল এই মাথার পিছনে চোখ না থাকায় যিনি দৌড় দিচ্ছেন তিনি ধরতে পারছেন না কোথায় পৌঁছাচ্ছেন। একজনকে দেখেছিলাম পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে শেষে একটি ঘোড়ার উপরে গিয়ে পড়েন। ঘোড়াটিও পিছন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ফলে সে কিংবা তার আরোহী কেউই উলটো দৌড়বীরকে দেখতে পায়নি। ময়দানের মাউন্ট পুলিশের শিক্ষিত ঘোড়া, মুহূর্তের মধ্যে একটা ব্যাকভলি করে দৌড়শীল ভদ্রলোককে ভূপাতিত করল। ভদ্রলোক অতঃপর তিনমাস ময়দানে আসেনি। আজকাল আসেন। সামনে, পিছনে কোনওদিকে দৌড়ান না। মাঠের উলটোদিকে বটতলায় যোগব্যায়াম করেন কোমর সোজা করার জন্যে।

এ ঘটনার ঢের আগে বিপদে পড়েছিলাম আমি। তখন ময়দানে আমি প্রথম প্রথম যাচ্ছি। আগের অনুচ্ছেদে বর্ণিত ভদ্রলোকের অনুরূপ ভঙ্গিতে ঘটনার দিন ম্যা. সা. পিছনপানে ছুটছিলেন। আমি খালি পায়ে ভেজা ঘাসের ওপর খুব আলতো ভাবে হাঁটছিলাম। হঠাৎ পর্বতের মতো বিশাল কী একটা বস্তু আমার ওপরে এসে পড়ল, বস্তুটি ওই ম্যা. সা.। তিনিও আমাকে দেখতে পাননি, পেছন দিকে কী করে দেখবেন?

ভগবান আমাকে একটি অসামান্য ক্ষমতা দিয়েছেন। কোনও বিপদে পড়লেই আমি বাঁচাও, বাঁচাও করে চেঁচাই, এর জন্যে আমাকে কোনও চিন্তা করতে হয় না। বিপদের আভাস পাওয়া মাত্র। একা একাই আমার কর্কশ কণ্ঠ দিয়ে এই অন্তিম আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। আমার এই আর্তনাদ শুনে ইতিপূর্বে খ্যাপা কুকুর কামড়াতে এসে থমকে থেমে গেছে, উদ্যত শৃঙ্গ ষণ্ড হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে ছুটে গেছে, এমনকী বস্তির মাস্তানরা চাদার খাতা রাস্তায় ফেলে দৌড়ে পাশের গলিতে ঢুকে গেছে। এবারেও তাই হল, যখন ম্যা. সা. এবং আমার মধ্যে ব্যবধান মাত্র এক সেন্টিমিটার, আমার গলা থেকে আমার প্রায় অজান্তেই বেরিয়ে এল সেই বহু পরিচিত বুকের রক্ত হিম করা, কর্কশ আকৃতি, বাঁচাও বাঁচাও।

আচমকা শরীরের ব্রেক কষতে গিয়ে ম্যা, সা, সামনের দিকে মুখথুবড়ে পড়ে গেলেন। আর এ কী আর যা-তা পড়া, পড়তে গেলে এভাবেই পড়তে হয়, মহীরূহ পতন কাকে বলে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম। এই মহীরূহ যদি আমার উপরে পতিত হত, বাঁচতাম কী মরতাম বলতে পারি না তবে চিতল মাছের মতো চ্যাপটা হয়ে যেতাম।

ম্যা. সা. পড়ে গিয়ে আর ওঠেন না। যদিও তার পতনের ব্যাপারে আমার কোনও দায়িত্ব নেই কিন্তু আমিই তার কারণ, মনে মনে দুশ্চিন্তা বোধ করতে লাগলাম। ময়দানের চারপাশে ম্যা. সার। শুভানুধ্যায়ীর অভাব নেই, চারদিক থেকে তারা ছুটে এলেন, এসে আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন।

বেশ ভিড় হয়ে গেল। আমি রীতিমতো শঙ্কিত বোধ করতে লাগলাম। যখন ম্যা. সা-র পতনের ঘটনাটি ঘটে, তখন দুঃখের বিষয় আমাদের দুজনের কাছাকাছি কোনও লোক ছিল না। আসলে ম্যা, সা. সম্ভবত তার নিরুপদ্রব পশ্চাদ্দৌড়ের প্রয়োজনে একটু ফঁকা জায়গাই বেছে নিয়েছিলেন। আমি ভুলক্রমে তার মানসিক সীমানায় ট্রেসপাস করেছিলাম। সেটুকু অবশ্যই আমার দোষ, ম্যা. সা. কিন্তু পড়েছেন নিজ গুরুত্বে এবং নিজ দায়িত্বে। তাঁকে আমি কোনও মুহূর্তেই বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিনি।

যা হোক, এর মধ্যে বেশ ভিড় জমে গেছে। দু-একজন বুঝদার লোকও এঁদের মধ্যে আছেন সেটাই ভরসা। বুঝদার মানে, আমার মতো সামান্য শক্তির কোনও লোক যে ম্যা. সা.-র মতো অতিকায় প্রাণীকে ধরাশায়ী করতে পারে না সেটা তারা অনায়াসেই উপলব্ধি করেছেন।

বিপদ হল দু-একজন অত্যুৎসাহী লোক নিয়ে। তারা কিন্তু আমার বিপদের লোক নয়, বরং প্রশংসিত দৃষ্টিতে তারা আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আপাদমস্তক অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিল। কী করে তাদের মনে ধারণা হয়েছে যে আমি ক্যারাটে কিংবা ওই জাতীয় কোনও গুপ্ত বা গুহ্য শারীরবিদ্যা জানি এবং সেই মারাত্মক ক্ষমতায় আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এই বিপুল বপুকে সামান্য অঙ্গুলিহেলনে কাটা কলাগাছের মতো ধরাশায়ী করা।

আমি আর কী বলব? কাকেই বা বোঝাব? এমনকী আমার দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হচ্ছে কি না, নাকি মুহূর্তের মধ্যে স্থানত্যাগ করা উচিত, কোনটা আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক আমি কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না।

 এদিকে ম্যা. সা. সেই যে পড়েছেন একবার গড়িয়ে চিত হয়ে গিয়ে আর ওঠেন না। নড়াচড়া পর্যন্ত বন্ধ। আশঙ্কা হল মারা গেল নাকি? তা হলে রীতিমতো কেলেঙ্কারি; তখন পুলিশ আর আদালতের কাছে বোঝাতে হবে আমার কোনও দোষ নেই, নিতান্ত পৈতৃক প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আমি আর্তনাদ করে উঠেছিলাম এবং প্রয়োজনে আর্তনাদ নিশ্চয়ই ফৌজদারি আইনের আওতায় আসে না, ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে নির্দিষ্ট কারণে আর্তনাদ করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে না। আর তা ছাড়া ম্যা. সা.-কে ঠিকমতো পোস্টমর্টেম করলেই ধরা পড়বে তাকে আমি কিংবা কেউই কোনও রকম আঘাত করিনি।

অবশ্য কৌতূহলী জনতার মধ্যে আমার চেয়ে বেশি তৎপর একাধিক ব্যক্তি ছিলেন। তারা ইতিমধ্যে ম্যা. সা-র পাশে বসে পড়েছে। এঁরা অন্তত এঁদের মধ্যে কেউ কেউ, বোঝা যাচ্ছে, ম্যা. সা-র পূর্ব পরিচিত। একজন তো রীতিমতো ম্যা, সা-র নাম পর্যন্ত জানেন। তিনি ম্যা, সা-র কানের কাছে মুখ নিয়ে হ্যালো মিস্টার ত্রিবেদী, হ্যালো ঘনশ্যামজি বলে ডাকতে লাগলেন। অন্য এক উদ্যোগী ব্যক্তি ঘাসের নীচ থেকে এক টুকরো শুকনো মাটির ডেলা নিয়ে খইনি ডলার মতো করে বামহাতের তালুতে রেখে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে চিপে চিপে গুঁড়ো করে ফেলছেন, এবার সেই গুঁড়ো মিস্টার ত্রিবেদী ওরফে ম্যা. সা.-র নাসিকারন্ধ্রের সামনে আস্তে আস্তে ফেলা হল। পতনোম্মুখ ধূলিকণার মধ্যে কিঞ্চিৎ আলোড়ন দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল যে শ্রীযুক্ত ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর প্রাণবায়ু এখনও বইছে, সেটা অন্তর্হিত হয়ে যায়নি।

ইতিমধ্যে ঘনশ্যাম ত্রিবেদী একবার ঘোরের মধ্যে যে ব্যক্তি তার কানের কাছে মিস্টার ত্রিবেদী, মিস্টার ত্রিবেদী বলে ডাকছিলেন তাঁকে বিশাল বাহুর এক ধাক্কায় প্রায় চার হাত দুরে ছিটকে ফেলে দিলেন। পরোপকারী ভদ্রলোক এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি ওই চার হাত দূরে ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন। আমার কেমন মায়া হল। আমি পতিত ভদ্রলোককে নিচু হয়ে তুলতে গেলাম এবং তখনই বুঝতে পারলাম ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর অজ্ঞান অবস্থাতেও অতর্কিত আক্রমণের কারণ। ভদ্রলোকটির মাথায় মধ্যমনারায়ণ অথবা ওই জাতীয় কোনও আয়ুর্বেদীয় তেলের বিকট গন্ধ। এই ভোরবেলাতেই লোকটি জবজবে করে একবাটি মধ্যমনারায়ণ তেল মাথায় মেখে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। এই রকম গন্ধের যেকোনও তেলই পাগলের আইডেনটিটি কার্ড, অজ্ঞান অবস্থাতেও মাথার কাছে পাগলের আগমনে ত্রিবেদী সাহেবের যথেষ্ট আপত্তি আছে, অন্তত তাই বোঝা যাচ্ছে।

এবং আরেকটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, ত্রিবেদী সাহেব মারা যাননি। জ্ঞান-অজ্ঞানের মধ্যবর্তী পর্যায়ে আছেন। তবে অজ্ঞানের চেয়ে জ্ঞান বেশি টনটনে। তার প্রমাণ পাওয়া গেল এক সরল প্রকৃতির ব্যক্তি ত্রিবেদী সাহেবের হৃৎপিণ্ড এখনও ধুকধুক করছে কিনা সেটা অনুধাবন করার জন্যে এবং সম্ভবত অনুসন্ধানের সুবিধের জন্যে ত্রিবেদী সাহেবের জামার নীচে বুকের ওপর হাত দিয়েছিল। ত্রিবেদী সাহেবের গলায় মোটা বিছে হার, আগেকার দিনে সচ্ছল সংসারে ঠাকুমারা যেমন গলায় দিতেন। হৃৎপিণ্ড-সন্ধানী ভদ্রলোক ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় জামার নীচের সেই বিছে হারটি যে মুহূর্তে স্পর্শ করেছেন ত্রিবেদী সাহেব চমকে উঠে উপুড় হয়ে গেলেন।

ত্রিবেদী সাহেব এতক্ষণ চিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। এবার আবার উপুড় হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সেটা যতটা গুরুতর তার অধিকতর গুরুতর সেই হৃৎপিণ্ড অনুসন্ধানী স্বর্ণহার স্পর্শক ব্যক্তিটি মহামতি ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর অকস্মাৎ উপুড় হয়ে যাওয়া বিরাট দেহের নীর্চে বিনা বাক্যব্যয়ে চাপা পড়ে গেলেন। ক্ষীণতনু উক্ত ভদ্রলোক পিষ্ট হয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেও ত্রিবেদী সাহেবের নীচ থেকে নির্গত হতে পারলেন না, শুধু মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে উঃ, আঃ, বাবা, মা ইত্যাদি অক্ষর ও শব্দ নির্গত হতে লাগল।

অপেক্ষমাণ জনতার, এমন কী আমার নিজেরও এবার প্রধান সমস্যা হল ঘনশ্যাম ত্রিবেদী নয়, ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর পিষ্ট পরোপকারী ব্যক্তিটি। এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছেন, ঘনশ্যাম মারা যাননি, মারা যাবার ব্যক্তি নন। কিন্তু এই নতুন লোকটি যিনি ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর নীচে পড়েছেন, তাঁর তো সাংঘাতিক অবস্থা।

দু-একজন অসম সাহসী ব্যক্তি ঘনশ্যামজিকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু যতদূর বোঝা গেল উপুড় হয়ে পড়েই তিনি আবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি সংজ্ঞা হারালেও যে ব্যক্তিটি অধঃপাতিত রয়েছেন তার কিন্তু জ্ঞান রয়েছে, তিনি প্রাণান্তকর কোঁ-কোঁ-কোঁ করে চলেছেন।

ঘটনাবলির আকস্মিক মোচড়ে আমার ভূমিকা ইতিমধ্যে লোকচক্ষে গৌণ হয়ে এসেছে। কৌতূহলী জনতার সংখ্যা বেশ বেড়ে গেছে, তারা প্রথম থেকে ব্যাপারটা জানে না। এই নবাগতদের ধারণা মারামারি বা কুস্তি কিছু হচ্ছে, বোধহয় সৌজন্যমূলক প্যাঁচের লড়াই। আধুনিক সিনেমার তুঙ্গমুহূর্তে যেমন ফ্রিজ শট দেওয়া থাকে, সেই রকম নট নড়নচড়ন অবস্থা দেখে নবাগত জনতা কিঞ্চিৎ অভিভূত।

আমি এই সুযোগে গুটিগুটি কেটে পড়ার কথা ভাবছিলাম। কারণ সত্যি আমার কিছু করার নেই। আর তা ছাড়া বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেরই প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফেরার একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে, সেটা উত্তীর্ণ হয়ে গেলে চিন্তার ব্যাপার ঘটে।

এদিকে নতুন একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঘনশ্যামজির বিশেষ ঘনিষ্ঠ দু-চারজন লোক যাঁরা ময়দানের অপর প্রান্তে এতক্ষণ হাওয়া খাচ্ছিলেন তারা এসে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের মুখেই শোনা গেল রাস্তার ওপারে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উদ্যানের ভিতরে ঘনশ্যামজির স্ত্রী নাকি ভ্রমণ করছেন। তবে তাকে খবর দিতে এঁরা একটু ইতস্তত করতে লাগলেন।

এঁদের চাপা কথাবার্তা এবং টুকরো টুকরো আলোচনা শুনে বোঝা গেল শ্রীমতী ঘনশ্যাম ত্রিবেদী–যাঁর নাম হল রোমিলা ত্রিবেদী, যাঁকে এরা মিসেসজি বলে থাকেন, তিনি একটি মারাত্মক বিপজ্জনক মহিলা! আজ বেশ কিছুদিন হল তার সঙ্গে তাঁর পতিদেবতার বাদবিসম্বাদ, হস্তাহস্তি এবং অবশেষে ছাড়াছাড়ি চলছে। মিসেসজি বর্তমানে পিত্রালয়বাসিনী। তাকে ঘনশ্যাম ত্রিবেদী বাঘিনীর মতো ভয় করেন। তিনি প্রভাতে ভিক্টোরিয়া উদ্যানে চড়েন বলেই নিরাপদ ব্যবধানে এই ব্রিগেড প্যারেডের ময়দানে মাউন্ট পুলিশের নিরাপত্তার আড়ালে ঘনশ্যাম সকালে দৌড়াতে আসেন।

ছাড়াছাড়ি হলেও আসলে স্ত্রী তো, সাতজন্মের সাত পাকের বন্ধ, ডিভোর্স-টিভোর্স হয়নি। আজ ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর এই দুঃসময়ে তাকে একটু খবর জানানো দরকার, তা ছাড়া মিসেসজি যখন হাতের কাছেই রয়েছেন।

দ্রুত শলাপরামর্শ করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে তিনজন ছুটলেন মিসেসজিকে আনতে। আমি চলে আসছিলাম, শুধু রয়ে গেলাম কৌতূহলবশত মিসেসজিকে চাক্ষুষ করার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না।

একটু পরেই সংবাদদাতাদের ভিক্টোরিয়ার প্রান্ত থেকে ফিরতে দেখা গেল তাদের মধ্যমণি হয়ে আসছেন এক মহিলা, স্পষ্টতই তিনি মিসেস রোমিলা ত্রিবেদী।

কাছে আসতে মিসেস ত্রিবেদীকে দেখে বুঝলাম ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর জীবনসঙ্গিনী হবার উনি যোগ্য নন। যদিও কোমরে ফের দিয়ে শাড়ি পরা, পায়ে কাপড়ের ফিতেওলা জুতো, তবু এই মহিলা আরও দশজন প্রাতঃভ্রমণের দশাসই কলেবরধারিণীদের মতো নন। ঘনশ্যামজির সঙ্গে রীতিমতো বেমানান।

মিসেসজি দ্রুতগতিতে অকুস্থলে এগিয়ে এলেন। তখনও তার স্বামী উপুড় হয়ে সেই উদ্ধারকর্তাকে ভূমিতে নিষ্পিষ্ট করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন। নীচের ব্যক্তিটি প্রথম দিকে আর্তনাদের সঙ্গে শরীরের মুক্ত অংশ হাত পা ইত্যাদি ছোঁড়াছুড়ির চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এখন তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তবে জ্ঞান রয়েছে, সেটা অসহায় চিঠি ধ্বনিতে পর্যবসিত হয়েছে।

মিসেস ত্রিবেদীর উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশি নাও হতে পারে। স্বাস্থ্যও অতি সাধারণ, রোগা বলা চলে! তবে কাছ থেকে দেখলাম, তার মুখ অতি চোয়াড়ে, চোখের ভাষা অতি তীব্র। হাত-টাত ইত্যাদিও বেশ শক্ত মনে হল–সব মিলে যাকে সাদা বাংলায় পাকানো চেহারা বলা যায়, একেবারে ঠিক তাই।

মিসেস ত্রিবেদী এসে যেতে একটা অস্ফুট গুঞ্জন উঠল। ইতিমধ্যে অন্য একটা ঘটনা ঘটে গেছে। যে ভদ্রলোক ঘনশ্যামজির নীচে চাপা পড়েছিলেন তার সঙ্গে যে একটা কুকুর ছিল, বেশ বড়সড় বিলিতি কুকুর, সেটা এতক্ষণ কেউ খেয়াল করেনি। কুকুরটা এতক্ষণ কাছাকাছি কোথায় দাঁড়িয়ে প্রভুর জন্যে প্রতীক্ষা করছিল। এইবার মিসেসজির আগমনে চারদিকের ভিড় একটু চঞ্চল এবং এলোমেলো হতেই সে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গন্ধ শুকে প্রভুর সন্ধান পেয়ে গেছে এবং তার প্রভুর এই শোচনীয় পরিণতি তার মোটেই পছন্দ নয়। সে উত্তেজিত হয়ে গর্জন শুরু করে দিয়েছে। আশঙ্কা। হচ্ছে যেকোনও মুহূর্তে ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর উপরে কুকুরটি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

এত বড় একটা হিংস্র কুকুরকে কে ঠেকাবে? তার লকলকে জিব, কস্তু কণ্ঠ এবং ধারালো, বিকশিত দন্তরাজি কৌতুক উপভোগী জনতাকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। এই শোচনীয় পরিস্থিতিতে দু-একজন দর্শক মাউন্ট পুলিশকে ডেকে আনার কথা বলছে, ঘোড়সোয়ার পুলিশ মাঠের ওপ্রান্তেই টগবগ করে ছুটছে, ডাকলেই হয়তো আসবে।

 কিন্তু পুলিশ ডাকার প্রয়োজন হল না। তার পূর্বেই মিসেস ত্রিবেদী রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন। আর সে কী প্রবেশ! যে ভাবে মেঘ আসে ঝড়ের আগে ঈশান কোণে, যে ভাবে পাগলা হাতি ঢোকে ডুয়ার্সের গ্রামে, যে ভাবে মিনিবাস ওঠে ফুটপাথে নাকি এসব উপমাও তুচ্ছ! প্রায় একশো মাইল বেগে ছুটে এসে, তারপর ঘটনাস্থলের দশফুট আগে স্থিরভাবে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটি অনুধাবন করলেন তিনি, তারপরে ধাঁই করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর পিঠের পাশে। এরই মধ্যে বাঁ পায়ে একটি কিক চালিয়েছেন কুকুরটির মুখে এবং ডানপায়ে একটি কিক স্বামীর পৃষ্ঠদেশে।

কুকুরটি আচমকা আহত হয়ে কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে আরও জোরে চেঁচাতে লাগল। আর মিসেস ত্রিবেদী মুষলধারে দু পায়ে কিক চালাতে লাগলেন স্বামীর পিঠে এবং পিঠের নীচে কোনও কোনও বিশেষ খারাপ জায়গায়।

আমরা ভুল বুঝেছিলাম। লাথিতে কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ হল। দেখা গেল এই লাহৌষধির সঙ্গে ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর পরিচয় আছে। দু-চারটে লাথির পরেই একটা শক্ত জোড়া লাথির মাথাতে তাঁর গলা থেকে অস্ফুট স্বর বেরোতে লাগল, তারপর স্পষ্ট শোনা গেল, কে রোমিলা?

অজ্ঞান অবস্থায় চোখ বুজে উপুড় হয়ে শুধু লাথি খেয়ে জ্ঞান ফিরে এসেছে আর জ্ঞান আসা মাত্র ধরতে পেরেছেন এটা পরিচিত লাথি, এটা তার স্ত্রীর লাথি, ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর এই আশ্চর্য যোগ্যতা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমরা বাইরের লোক, কিছুই জানি না এঁদের দাম্পত্য আহ্লাদের, কিন্তু লাথির ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

নীচের ব্যক্তিটিকে ছেড়ে দিয়ে এবার চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন ঘনশ্যাম ত্রিবেদী, চিত হওয়ার মুখে রোমিলার একটা লাথিময় পা দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অনুনয় জড়িত কণ্ঠে বললেন, আঃ রোমিলা, কতদিন তোমার লাথি খাইনি!

মুহূর্তের অবকাশে নীচে পড়া চিড়ে চ্যাপটানো ব্যক্তিটি, এখনও তার ধড়ে প্রাণ ছিল, এক লাফে উঠে কুকুরটিকে সংগ্রহ করে সামনের দিকে দৌড় দিলেন। অন্যদিকে ঘনশ্যাম ত্রিবেদীর সবল বাহুর আকর্ষণে রোমিলা ত্রিবেদী পা হড়কিয়ে ঘনশ্যামের বুকের ওপর পড়ে গেছেন, আর ঘনশ্যাম বলে যাচ্ছেন, রোমিলা, আমাকে তুমি লাথি মারো, আমাকে তুমি একশো লাথি মারো।

উন্মুক্ত নীল আকাশের নীচে সবুজ ঘাসের গালিচায় দাম্পত্য পুনর্মিলন নাটক দেখতে যেটুকু চক্ষুলজ্জাহীনতার প্রয়োজন তার অভাব থাকায় আমি গুটি গুটি বাড়ির দিকে ফিরে এলাম। দেরি হয়ে গেছে, বাড়িতে যথেষ্ট রাগারাগি করবে কিন্তু আমাদের গৃহে লাহৌষধির প্রচলন নেই, সেটাই ভরসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *