2 of 3

খদ্দের

খদ্দের

ওই বসে রয়েছে রমেশ। একটা ভাঙা সুটকেস, সেটা নারকেলের দড়ি দিয়ে বাঁধা, তার মধ্যে দুটো ছেঁড়া পুরনো জামা প্যান্ট। পরনে একটা হাফপ্যান্ট, দু সাইজ বড় ময়লা হাওয়াই শার্ট। পায়ের হাওয়াই চটিজোড়া অবশ্য নতুন, শেষ সম্বল মাইনের টাকা থেকে আজকে সকালেই কিনেছে।

রমেশের হাতে একটা টিকিট ধরা রয়েছে, এখনই কিনেছে টিকিটের কাউন্টার থেকে, টিকিটটা হাওড়া থেকে খঙ্গপুর। রমেশ বসে আছে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উপরে, সে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। কলকাতায় তার পোষালো না, সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সে হাওড়া থেকে যাবে খড়গপুরে, সেখান থেকে বাসে দু ঘণ্টা, তারপর হেঁটে দেড়ঘণ্টা–সেখানে তাদের গ্রাম, সেখানে তার গরিব বিধবা মা, ছোট ছোট ভাইবোনেরা রয়েছে। রমেশ গাঁয়ের একজন লোকের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল উপার্জন করতে। কিছুই বিশেষ চায়নি সে, সামান্য চাকরের কাজ নিয়েই সে সন্তুষ্ট ছিল অথবা সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না।

রমেশ বাসন মাজতে পারে, ঘর মুছতে পারে, কাপড় কাঁচতে পারে। বাজার করে হিসেব দিতে পারে। গাঁয়ের স্কুলে সে পাঁচ ক্লাস পড়েছিল।

রমেশ শেষরাতে ভোর চারটের সময় উঠে কয়লা ভাঙতে পারে। দরকার পড়লে উনুন থেকে। ভাতের হাঁড়ি নামাতে পারে। কলকাতা শহরে তার চাহিদা কিছু কম নয় কিন্তু সে এখানে কাজ করতে পারল না।

কলকাতায় আসার আগে রমেশ কাঁথিতে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে অল্প কিছুদিন কাজ করেছিল। সেই ভদ্রলোক ছিলেন উকিল। রমেশদের গ্রামের বাড়িতে বাইরের লোকজন বিশেষ কেউ আসে না। কেই বা আসবে কীসের দরকারে? পাড়া-প্রতিবেশী যারা আসে সবাই চেনাজানা। কিন্তু কাঁথির উকিলবাবুর বাড়িতে রমেশ দেখল সকাল, সন্ধ্যা, রবিবারে, ছুটির দিনে অনেক লোকজন আসে। বাইরের ঘরটা গমগম করে লোকের ভিড়ে আর কথাবার্তায়।

অল্পদিনের মধ্যে রমেশ জানতে পারে, এই যারা দুবেলা উকিলবাবুর বাড়িতে আসে, উকিলবাবুর সঙ্গে আদালতে ছোটাছুটি করে, তাদের বলে মক্কেল। কিছুকালের মধ্যেই সে বাইরের ঘর খুলে দিয়ে লোকজন বসিয়ে বাড়ির মধ্যে থেকে উকিলবাবুকে ডেকে আনা শিখে গেল, কর্তামশায়, মক্কেল এসেছে। উকিলবাবু হেঁকে বলতেন, ওদের বসাও। আমি যাচ্ছি। একটা ঝাড়ন দিয়ে চেয়ারগুলো ঝেড়ে মক্কেলদের বসিয়ে রমেশ এসে উকিলবাবুকে জানাত, মক্কেলবাবুদের ভাল করে বসিয়ে এসেছি।

কিন্তু কাঁথির এই উকিলবাবুর বাড়িতে রমেশের বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। উকিলবাবুর এক মক্কেলের মামলায় হেরে গিয়ে ছয় মাস জেল হয়, কী একটা মারামারির মামলা ছিল সেটা। মক্কেলটাও ছিল খুব মারকুটে। ছয়মাস কারাবাসের পর জেল থেকে বেরিয়েই সে উকিলবাবুর খোঁজে আসে। উকিলবাবুর ভাগ্য ভাল যে ঠিক সেই সময় বাসায় ছিলেন না। কিন্তু জেলখাটা মক্কেলটির কোপ গিয়ে পড়ে রমেশের উপর। রমেশ যথারীতি যখন ঝাড়ন দিয়ে চেয়ার পরিষ্কার করে মক্কেলটিকে বসাতে গেছে এবং ঘোষণা করেছে যে উকিলবাবু বাড়ি নেই, একটু অপেক্ষা করতে হবে–সেই মুহূর্তে লোকটি রমেশের হাত থেকে কাপড়ের ঝাড়নটি কেড়ে নিয়ে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে এবং জুনপুটে বা দিঘায় নিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে বলে ক্রুদ্ধ ইচ্ছা জ্ঞাপন করে। রমেশের হাত বাঁধা ছিল, কিন্তু মুখ বাঁধা ছিল না, সে প্রাণভয়ে যথাসাধ্য চেঁচাতে থাকে।

রমেশের চিৎকারে রাস্তা থেকে লোকজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী ছুটে এসে বিপজ্জনক মক্কেলটিকে ধরে ফেলে, তারপর পুলিশ এসে তাকে হাজতে চালান দেয়। তারপর আবার ফৌজদারি মামলা।

কী এক অজ্ঞাত, অবোধ্য কারণে এবারেও এই মারকুটে অধোম্মাদ লোকটি রমেশের উকিলবাবুকে তার মামলায় নিযুক্ত করে। ফলে যদিও রমেশই ভুক্তভোগী, উকিলবাবুর প্ররোচনায় রমেশ মামলার দিন আদালতে সাক্ষ্য দিতে যায় না। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী ও রাস্তার লোকজনের সাক্ষ্যে এবং বিশেষ করে এই কারণে যে লোকটি জেল থেকে ছাড়া পেয়েই আবার গোলমাল করেছে সেই দিনই, এই সব বিবেচনা করে মহামান্য আদালত এই দাগি আসামিকে আবার ছয় মাসের জেল দেন। রমেশের উকিলবাবু বহু ধরাধরি, অনুনয়, বিনয়, যুক্তিতর্ক দিয়েও লোকটির জেলখাটা আটকাতে পারলেন না। রোষ কষায়িত লোচনে লোকটি উকিলবাবুর দিকে তাকাতে তাকাতে পুলিশের সঙ্গে আবার জেলে চলে গেল।

লোকটির জেল হয়েছে এই খবর শোনার পরে রমেশ খুবই আতঙ্কিত বোধ করতে লাগল এবং ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই উকিলবাবুর গৃহ তথা কথি থেকে পালাল।

গাঁয়ে গিয়ে দু-এক মাস থাকার পর সে অন্য এক গ্রামবাসীর সঙ্গে অতঃপর কলকাতায় এল। সেই ব্যক্তি কলকাতায় এক ডাক্তারবাবুর বাড়িতে রান্নার কাজ করে, সেই বাড়িতেই রমেশের জন্য একটা ফাঁইফরমাস খাটার কাজ জুটল।

চাকরের কাজে যে হতভাগ্য বালকের জীবন শুরু তার যে ভাগ্য ভাল নয় সে কথা বলার অবকাশ রাখে না। তারই মধ্যে কারও কারও ভাগ্য একটু কম খারাপ হয়। রমেশের ভাগ্য কিন্তু খুবই খারাপ।

 রমেশ যে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে এসেছে সেই ডাক্তাবাবু মনস্তত্ত্ববিদ অর্থাৎ দুই কথায় পাগলের ডাক্তার। ঠিক রাস্তার ন্যাংটো পাগল বা উন্মাদ, বদ্ধ পাগল নয়, রোগীদের প্রত্যেকেরই মাথায় অল্পবিস্তর গোলমাল। প্রায় প্রত্যেকেই সুবেশ ও মার্জিত রুচির। কিন্তু এদের সকলের চোখের মধ্যে একটা ঘোলাটে ভাব আছে যে ভাবটা কাথির সেই উকিলবাবুর মক্কেলের চোখে মার খাওয়ার মুহূর্তে রমেশ দেখতে পেয়েছিল।

প্রথমে কিন্তু গোলমালটা বাধল অন্যভাবে। রমেশ কাঁথির কাজ থেকে শিখে এসেছে বাইরের লোক যারা আসে তারা হল মক্কেল। তার কাজ পড়েছিল সকাল-সন্ধ্যায় বাইরের ঘরের চেম্বারে রোগী এলে বসিয়ে ডাক্তারবাবুকে ভিতরে খবর দেয়া। সে এখানেও চেয়ার ঝেড়েঝুড়ে রোগীকে বসাত, বলত, বসুন মর্কেলবাবু। তারপর ভিতরে গিয়ে খবর দিত, একজন মক্কেল এসেছে।

দু-একদিনের মধ্যে খটকা লাগল ডাক্তারবাবুর, রোগী আবার মক্কেল হল কী করে? ছোকরা চাকরটা ইয়ার্কি করছে না তো? এক আধপাগল উকিল এসেছিলেন ডাক্তারকে দেখাতে, তাঁর মাথার মধ্যে অহরহ টং টং করে কী একটা বাজে, বেজেই যায়। তিনি রমেশের মুখে মক্কেলবাবু সম্বোধন শুনে হেসে কুটিপাটি। তাঁর মাথার টং টং ভুলে তিনি ডাক্তারবাবুকে না দেখিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে গেলেন হাসতে হাসতে। সেদিন সন্ধ্যায় একমাত্র পাগল বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় ডাক্তারবাবু রমেশের উপরে খেপে গেলেন। পরে অনেক কষ্ট করে রমেশকে শেখালেন, আমার কাছে যারা আসে তারা মক্কেল নয়, পেশেন্ট।

রমেশের বঙ্গোপসাগরীয় জিহ্বায় যত সহজে মক্কেল কথাটা আসে পেশেন্ট তত সোজা নয়। অনেক কসরত করে সে শেষ পর্যন্ত পিসেন্ট বলা শিখে উঠতে পারল। পিসেন্টদের চেয়ার ঝেড়ে বসিয়ে সে ডাক্তারবাবুকে ডাকতে যেত, বাবু, পিসেন্ট এসেছে।

মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছিল রমেশ। কিন্তু ফ্যাসাদ বাধল ডাক্তারবাবুকে নিয়ে। ডাক্তারবাবুর একটা মারাত্মক খারাপ ব্যাপার ছিল, সন্ধ্যার পর সেজেগুঁজে রোগী দেখার নাম করে বেরোতেন আর সহজে গৃহমুখী হতে চাইতেন না। একেকদিন গভীর রাতে পা টিপে টিপে চোরের মতন ঘরে ঢুকতেন। চেম্বারের বাইরের দরজায় খুব আস্তে দুটো টোকা দিলে, রমেশ রাতে চেম্বারের মেঝেতে শুত, সে দরজাটা আলগোছে খুলে দিত। এই রাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে ডাক্তার-গিন্নির সঙ্গে ডাক্তারবাবুর কোনও কোনও সময় তুলকালাম কাণ্ড হত।

বিপদ হয়েছিল রমেশের। তাকেই সাক্ষী মানতেন ডাক্তারগিন্নি, তুই বল তো, ঠিক কটায় বাড়ি ফিরেছে? চেম্বারে একটা দেয়ালঘড়ি আছে, ভদ্রমহিলা রমেশকে ঘড়ি দেখা ভাল করে শিখিয়ে নিয়েছিলেন স্বামীর ফেরার হিসেব রাখতে। কারণ তিনি নিজে কদাচিৎ কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে স্বামীর ফেরার তদারকি করতেন। যা চেঁচামেচি, তাণ্ডব সেটা করতেন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে চা-টা খেয়ে, নিজের সুবিধাজনক সময়ে। ফুটন্ত কড়া ও উনুনের মধ্যে অর্থাৎ ডাক্তারবাবুর আর ডাক্তার-গিন্নির মধ্যে কোনওটাই রমেশের পক্ষে কম বিপজ্জনক নয়। সে যদি সঠিক সময় বলত, ডাক্তারবাবু খেপে যেতেন আর বানিয়ে সময় বললে ডাক্তার-গিন্নির হাতে ধরা পড়লে রক্ষা নেই। ভদ্রমহিলা বিছানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে কী করে যে আসল সময়টা ধরে ফেলতেন সেটা রমেশ এবং রমেশের ডাক্তারবাবু উভয়েরই সমস্যা ছিল।

কিছুটা বুদ্ধি খরচ করে মোটামুটি জোড়াতালি দিয়ে রমেশ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষে আর পারল না। একদিন একেবারে রাত কাবার করে দিয়ে ডাক্তারবাবু বাড়ি ফিরছেন, ফিরেই চাপা গলায় রমেশকে শাসিয়েছেন, এই সাবধান! যদি বলবি তো রাত কাবার করে ফিরেছি, একদম ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।ডাক্তারবাবু তো বাড়িতে ঢুকেই নিজের বিছানায় গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। পাশের খাটে গৃহিণী তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। মহিলা সময়মতো ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে উঠে পরিতৃপ্তির সঙ্গে প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন স্বামীকে বিছানা থেকে চুলের মুঠি ধরে তুললেন, তোমার এত বাড় বেড়েছে, রাতে বাড়িতেই ফিরছ না! দাঁড়াও আজ পাগলের ইলেকট্রিক শক তোমাকেই দেব! সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙা রাত্রির অত্যাচারে ক্লান্ত ডাক্তারবাবু শেষ পর্যন্ত রমেশের শরণাপন্ন হলেন। স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, রমেশ তো দেখেছে কখন ফিরেছি, ওকে জিজ্ঞাসা করো।

রমেশকে ডাকতে সে এল। ডাক্তারগিন্নি গর্জন করে উঠলেন, এই কী রে! এই লোকটা কখন বাড়ি ফিরেছে? ঠিক সময় বললে বিপদ, ডাক্তারবাবু মারবে, তাড়াবে। আবার বেঠিক সময় বলে গিন্নির হাতে ধরা পড়লে সে তো আরও মারকুটে, আরও দজ্জাল। দুপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে সে খুব বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু যখন ফিরলেন তখন তো আমি ঘড়ি দেখতে পারিনি। তাই বলতে পারছি না সময়টা। গিন্নি গর্জে উঠলেন, কেন ঘড়ি দ্যাখোনি? তোমাকে বলিনি আমি? রমেশ বলল, কী করে দেখব, তখন যে আমি ঘুম থেকে উঠে কলতলায় মুখ ধুচ্ছিলাম।

বলাবাহুল্য, অতঃপর রমেশের অন্ন ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে উঠল। কিন্তু কলকাতা শহরে চাকরের কাজের অভাব হয় না। গলির মোড়েই থাকেন এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, কাপড়ের পাইকারি বিক্রেতা, বাড়িতেই একতলায় তার গদি। যাতায়াতের পথে রমেশকে তিনি দেখেছেন, তার প্রতি দৃষ্টিও ছিল। তার গদিঘরের একজন বয় দরকার। রমেশ বেকার হওয়া মাত্র উক্ত ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, নকুলবাবু, তাকে লুফে নিলেন।

নকুলবাবুর গদিতে গিয়ে রমেশ আরেকবার বোকা বনল। ওই ডাক্তারবাবুর বাড়ির কায়দায় যারা গদিতে আসে রমেশ তাদের সরল চিত্তে পিসেন্ট বলে। গদি পরিষ্কার করে ঝাড়ন দিয়ে ঝেড়ে তাদের বসতে বলে, দোতলায় নকুলবাবুকে গিয়ে বলে, চারজন পিসেন্ট এসেছে।

নকুলবাবু প্রথমে ধরতে পারেননি। পরে রমেশকে বললেন, আরে গাধা, আমি কি ডাক্তার নাকি যে ওরা পেশেন্ট হবে? রমেশ বোকা নয়, সে প্রাক্তন অভিজ্ঞতা থেকে বলল, ও বুঝতে পেরেছি, ওরা মক্কেল।নকুলবাবু স্থিতধী ব্যবসায়ী, খুব শান্ত কথায় রমেশকে বোঝালেন, যারা এসেছে, যারা গদিতে আছে, আসবে তারা পেশেন্ট নয়, মক্কেল নয়, তারা খদ্দের।

রমেশ এ ব্যাপারটা বুঝল। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপারে নকুলবাবুর ওখানে রমেশের পোষালো। রমেশকে আগে ডাক্তারবাবুর ওখানে নকুলবাবু দেখেছেন, কিন্তু তার নামটা জানতেন না। যখন জানলেন নতুন চাকরের নাম রমেশ, তিনি একটু বেকায়দায় পড়লেন, কারণ তার শ্বশুরের নামও রমেশ। তিনি রমেশকে বললেন, তোমাকে আমরা রমেশ না বলে গদাই বলে ডাকব।

কিন্তু রমেশ গরিব হলে কী হবে, তার আত্মাভিমান অতি প্রখর। সে প্রতিবাদ করল, না, আমাকে রমেশ নামেই ডাকবেন। গদাই আবার একটা নাম নাকি!

ব্যাপারটা ঝুলে রইল। কিন্তু নকুলবাবুর সাহস নেই পূজনীয় শ্বশুরমশায়ের নামে চাকরকে ডাকেন। তিনি ওরে, হরে করে চালাতে গেলেন।

এ ব্যাপারটাও রমেশের অপছন্দ। এমন চমৎকার তার একটা নাম, এর আবার ওরে, হরে কী?

ইতিমধ্যে অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছে। রাস্তার ওপরেই থাকেন এক নবীনা চিত্রতারকা ও তার তৃতীয় স্বামী। মহিলা অতি নাবালিকা বয়েস থেকেই সাতিশয় পক্ক এবং একাধিক স্বামী ও স্বামীস্থানীয়ের কণ্ঠলগ্না হয়েছেন। তার বাড়িতে অনিবার্য নানা কারণে কাজের লোক থাকে না। সুন্দরীর বর্তমান স্বামী একটি উপযুক্ত কাজের লোকের সন্ধানে আকাশ-পাতাল খুঁজছিলেন। নিজের নামের প্রশ্নে দ্বিধা ও সংশয়ে আচ্ছন্ন রমেশকে ভাঙিয়ে নিতে তাঁর এক মুহূর্ত সময়ও লাগল না। এর চেয়ে তার অনেক বেশি সময় এবং পরিশ্রম ব্যয় হয়েছিল সুন্দরীকে তার দ্বিতীয় স্বামীর হাত থেকে ভুলিয়ে আনতে।

সে যা হোক, রমেশ এই চিত্রতারকার বাড়ি থেকে প্রথম দিনেই, বলা উচিত সন্ধ্যাবেলাতেই, বিতাড়িত হল। সন্ধ্যাবেলা তারকা শয়নঘরে সাজগোজ করছেন। এমন সময় বাইরের দরজায় বেল বাজল। রমেশ গিয়ে দরজা খুলে তিনজন সুসজ্জিত ভদ্রলোককে ড্রইংরুমের সোফায় বসাল। তারপর ভিতরের ঘরে গিয়ে সুন্দরীকে খবর দিল। সুন্দরী এতক্ষণ এঁদের প্রতীক্ষা করছিলেন, এঁরা তার আগামী ছবির প্রযোজক এবং প্রযোজকের বন্ধুরা। নকুলবাবুর বাড়িতে সদ্য রপ্ত করা বুলিতে রমেশ সুন্দরীকে জানাল, বাইরের ঘরে তিনজন খদ্দের এসেছে। সুন্দরীর হাত থেকে পাউডারের পাফ পড়ে গেল। সুন্দরীর স্বামী বিছানায় শুয়ে চিত হয়ে সিগারেট টানছিলেন।

খদ্দের এসেছে শুনে তার মাথায় কেন যেন রক্ত উঠে গেল, রমেশকে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে হারামজাদা, রাস্কেল ইত্যাদি অবর্ণনীয়, অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে ভাঙা সুটকেস সমেত পিছনের দরজা দিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিলেন।

ওই বসে রয়েছে রমেশ। সে তার দুঃখিনী মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সে শহরে এসে বুঝতে পারেনি, বাবুদের বাড়িতে যারা আসে তারা মক্কেল, না পেশেন্ট, না খদ্দের? নাকি আরও কিছু আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *