সাহিত্য
ভাষার কথা
ভারতবর্ষ
সমাজ
বিচিত্র

সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা

সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা

সম্প্রতি ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’ নামক পুস্তিকাকারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ আমার হস্তগত হয়েছে। লেখক শ্রীযুক্ত ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন এম.এ. আমার সতীর্থ। একই যুগে একই বিদ্যালয়ে, একই শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে পরস্পরের মনোভাবে মিল থাকা কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়। বোধ হয় সেই কারণে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গভাষা সম্বন্ধীয় আমার প্রবন্ধটির সঙ্গে উক্ত প্রবন্ধের যে শুধু নামের মিল আছে তা নয়, মতামতেরও অনেকটা মিল আছে। এমন- কি, স্থানে স্থানে আমরা উভয়ে একই যুক্তি প্রায় একই ভাষায় প্রকাশ করেছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ ললিতবাবুর প্রবন্ধ হতে একটি প্যারা উদ্ধৃত করে দিচ্ছি,

যাঁহারা সাধুভাষার অতিমাত্র পক্ষপাতী, তাঁহারা যদি কখনো দায়ে ঠেকিয়া একটা চলিত শব্দ ব্যবহার করিতে বাধ্য হয়েন, তবে সেটা উদ্ধরণচিহ্নের মধ্যে লেখেন; যেন শব্দটা অপাঙ্ক্তেয়, সাধুভাষার শব্দগুলি সংস্পর্শজনিত পাপে লিপ্ত না হয়, সেই জন্য এই সাবধানতা। ইহা কি জাতিভেদের দেশে অনাচরণীয় জাতিদিগের প্রতি সামাজিক ব্যবহারের অনুবৃত্তি?

বাংলা কথাকে সাহিত্যসমাজে জাতিচ্যুত করবার বিষয়ে আমার পূর্ব প্রবন্ধে যা বলেছি, তার সঙ্গে তুলনা করলে পাঠকমাত্রই দেখতে পাবেন যে, আমরা উভয়েই মাতৃভাষার উপর এরূপ অত্যাচারের বিরোধী। তবে ললিতবাবুর সঙ্গে আমার প্রধান তফাত এই যে, তিনি সাধুভাষার সপক্ষে এবং বিপক্ষে কি বলবার আছে, অথবা কি সচরাচর বলা হয়ে থাকে, সেই-সকল কথা একত্র করে গুছিয়ে, পাশাপাশি সাজিয়ে, পাঠকদের চোখের সুমুখে ধরে দিয়েছেন; কিন্তু পূর্ব পক্ষের মতামত বিচার করে কোনোরূপ মীমাংসা করে দেন নি। আর আমি উত্তর পক্ষের মুখপাত্র স্বরূপে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি যে, একটু পরীক্ষা করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে, পূর্ব পক্ষের তর্কযুক্তির ষোলো-কড়াই কানা।

ললিতবাবু দেখাতে চান যে, সমস্যাটা কি। আমি দেখাতে চাই যে, মীমাংসাটা কি হওয়া উচিত। ললিতবাবু বলেছেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে বিষয়টির আলোচনা করা। তাই, যদিচ তাঁর মনের ঝোঁক আসলে বঙ্গভাষার দিকে, তবুও তিনি পদে পদে সে ঝোঁক সামলাতে চেষ্টা করেছেন। আমি অবশ্য সে ঝোঁকটি সামলানো মোটেই কর্তব্য বলে মনে করি নে। কোনো পক্ষের হয়ে ওকালতি করা দূরে থাক্, তিনি বিচারকের আসন অলংকৃত করতে অস্বীকৃত হয়েছেন। এমন-কি, এই উভয় পক্ষের মধ্যস্থ হয়ে একটা আপস-মীমাংসা করে দেওয়াটাও তিনি আবশ্যক মনে করেন নি

অপরপক্ষে, আমি বঙ্গসাহিত্যের পক্ষে যা শ্রেয় মনে করি, তার জন্য ওকালতি করাটা কর্তব্যের মধ্যে গণনা করি। সেই কারণে আমি আমার নিজের মত কেবলমাত্র প্রচার করেই ক্ষান্ত থাকি নে, সেই মতের অনুসারে বাংলাভাষা লিখতেও চেষ্টা করি। অপরকে কোনো জিনিসেরই এপিঠ-ওপিঠ দুপিঠ দেখিয়ে দেবার বিশেষ কোনো সার্থকতা নেই, যদি না আমরা বলে দিতে পারি যে, তার মধ্যে কোটি সোজা আর কোনটি উলটো।

সব দিক রক্ষা করে চলবার উদ্দেশ্য এবং অর্থ হচ্ছে নিজেকে রক্ষা করা। আমরা সামাজিক জীবনে নিত্যই সে কাজ করে থাকি। কিন্তু কি জীবনে, কি সাহিত্যে, কোনো একটা বিশেষ মত কি ভাবকে প্রাধান্য দিতে না পারলে আমাদের যত্ন চেষ্টা এবং পরিশ্রম সবই নিরর্থক হয়ে যায়। মনোজগতেও যদি আমরা শুধু ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির দেখি, তা হলে আমাদের পক্ষে তটস্থ হয়ে থাকা ছাড়া উপায়ান্তর নেই।

সে যাই হোক, যখন লেখবার একটা বিশেষ রীতি সাহিত্যে চলন করা নিয়ে কথা, তখন আমাদের একটা কোনো দিক অবলম্বন করতেই হবে। কেননা একসঙ্গে দুদিকে চলা অসম্ভব। তা ছাড়া যখন দুটি পথের মধ্যে কোটি ঠিক পথ, এ সমস্যা একবার উপস্থিত হয়েছে, তখন ‘এ-পথও জানি ও-পথও জানি, কিন্তু কি করব মরে আছি’, এ কথা বলাও আমাদের মুখে শোভা পায় না; কারণ, বাজে লোকে যাই মনে করুক-না কেন, সাহিত্যসেবী এবং অহিফেনসেবী একই শ্রেণীর জীব নয়।

ললিতবাবুর মতে ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা, এই মামলার মীমাংসা করিতে হইলে আধা ডিক্রি আধা ডিমিস্ ছাড়া উপায় নাই।’ এর উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, তরমিন ডিক্রি লাভে বাদীর খরচা পোষায় না। ওরকম জিত প্রকারান্তরে হার। এ ক্ষেত্রে আমরা যে বাদী, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই, কারণ আমাদের নাবালক অবস্থায় সাধুভাষীদের দল সাহিত্যক্ষেত্র দখল করে বসে আছেন। আমরা শুধু আমাদের অন্বয়াগত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি।

প্রতিবাদীরা জানেন যে, possession is nine points of the law, সুতরাং তাঁদের বিশ্বাস যে, আমাদের মাতৃভাষার দাবি তামাদি হয়ে গেছে, ও সম্বন্ধে তাঁদের আর উচ্চবাচ্য করবার দরকার নেই। এ বিষয়ে বাক্যব্যয় করা তাঁরা কথার অপব্যয় মনে করেন। এ অবস্থায় কোনো বিচারপতির নিকট পুরা ডিক্রি পাবার আশা আমাদের নেই, সুতরাং আমরা যদি আবার তা জবর- দখল করে নিতে পারি, তা হলেই বঙ্গসাহিত্য আমাদের আয়ত্তের ভিতর আসবে, নচেৎ নয়।

এই সমস্যার একটি চূড়ান্ত মীমাংসার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে যে, পূর্ব পক্ষের বক্তব্যটি যে কি, তা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই নে। যদি কোনো একটি বিশেষ রীতি সমাজে কিংবা সাহিত্যে কিছুদিন ধরে চলে যায়, তা হলে সেটি নিজের ঝোঁকের বলেই, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে inertia, তারই বলে চলে। যা প্রচলিত তার জন্য কোনোরূপ কৈফিয়ত দেওয়াটা কেউ আবশ্যক মনে করেন না। অধিকাংশ লোকের পক্ষে জিনিসটা চলছে, এইটেই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে তা চলা উচিত। তা ছাড়া যাঁরা মাতৃভাষাকে ইতর ভাষা বলে গণ্য করেন তাঁরা হয়তো বঙ্গভাষায় সাহিত্য রচনা ব্যাপারটি ‘নীচের উচ্চভাষণ’-স্বরূপ মনে করেন, এবং সুবুদ্ধিবশত ওরূপ দাম্ভিকতা হেসে উড়িয়ে দেওয়াটাই সংগত বিবেচনা করেন।

সাধারণত লোকের বিশ্বাস এই যে, প্রচলিত আচারব্যবহারকে মন দিয়ে যাচিয়ে নেওয়াতে বিপদ আছে, কেননা তাদের মতে, শুধু স্ত্রী-বুদ্ধি নয়, বুদ্ধি মাত্রই প্রলয়ংকরী। সমাজ সম্বন্ধে এ মতের কতকটা সার্থকতা থাকলেও সাহিত্য সম্বন্ধে মোটেই নেই; কারণ, যে লেখার ভিতর মানব- মনের পরিচয় পাওয়া না যায়, তা সাহিত্য নয়। সুতরাং ললিতবাবু পূর্ব পক্ষের মত লিপিবদ্ধ করবার চেষ্টা করে বিষয়টি আলোচনার যোগ্য করে তুলেছেন। একটা ধরাছোঁয়ার মতো যুক্তি না পেলে তার খণ্ডন করা অসম্ভব। কেবলমাত্র ধোঁয়ার উপর তলোয়ার চালিয়ে কোনো ফল নেই। ললিতবাবু বহু অনুসন্ধান করে সাধুভাষার সপক্ষে দুটি যুক্তি আবিষ্কার করেছেন,

১. সাধুভাষা আর্টের অনুকূল।

২. চলিত ভাষার অপেক্ষা সাধুভাষা হিন্দুস্থানি মারাঠি গুজরাটি প্রভৃতি ভিন্নজাতীয় লোকদের নিকট অধিক সহজবোধ্য।

আর্টের দোহাই দেওয়া যে কতদূর বাজে, এ প্রবন্ধে আমি সে সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করতে চাই নে। এ দেশে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় যে, যুক্তি যখন কোনো দাঁড়াবার স্থান পায় না, তখন আর্ট প্রভৃতি বড়ো বড়ো কথার অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করে। যে বিষয়ে কারো কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, সে বিষয়ে বক্তৃতা করা অনেকটা নিরাপদ, কেননা সে বক্তৃতা যে অন্তঃসারশূন্য, এ সত্যটি সহজে ধরা পড়ে না। তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোনো স্থান নেই। এ বিষয়ে আমার যা বক্তব্য আছে তা আমি সময়ান্তরে স্বতন্ত্র প্রবন্ধে বলব। এ স্থলে এইটুকু বলে রাখলেই যথেষ্ট হবে যে, ‘রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন, সরলতা এবং স্পষ্টতা’১—লেখায় সেই গুণটি আনবার জন্য যথেষ্ট গুণপনার দরকার। আর্টহীন লেখক নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে কৃতকার্য হন না।

[১. বঙ্কিমচন্দ্র। “বাঙ্গলা ভাষা”, বিবিধ প্ৰবন্ধ।]

দ্বিতীয় যুক্তিটি এতই অকিঞ্চিৎকর যে, সে সম্বন্ধে কোনোরূপ উত্তর করতেই প্রবৃত্তি হয় না। আমি আজ দশ-এগারো বৎসর পূর্বে, আমার লিখিত এবং ভারতী পত্রিকাতে প্রকাশিত ‘কথার কথা’ নামক প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে যে কথা বলেছিলুম, এখানে তাই উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। যুক্তিটি বিশেষ পুরনো, সুতরাং তার পুরনো উত্তরের পুনরাবৃত্তি অসংগত নয়—

এ বিষয়ে শাস্ত্রী মহাশয়ের বক্তব্য যদি ভুল না বুঝে থাকি, তা হলে তাঁর মত সংক্ষেপে এই দাঁড়ায় যে, বাংলাকে প্রায় সংস্কৃত করে আনলে, আসামি হিন্দুস্থানি প্রভৃতি বিদেশী লোকদের পক্ষে বঙ্গ ভাষা-শিক্ষাটা অতি সহজসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত, অন্য ভাষায় যে সুবিধাটুকু নেই, বাংলার তা আছে—যে-কোনো সংস্কৃত কথা যেখানে হোক লেখায় বসিয়ে দিলে বাংলা ভাষার বাংলাত্ব নষ্ট হয় না অর্থাৎ যাঁরা আমাদের ভাষা জানেন না তাঁরা যাতে সহজে বুঝতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে সাধারণ বাঙালির পক্ষে আমাদের লিখিত ভাষা দুর্বোধ করে তুলতে হবে। কথাটা এতই অদ্ভুত যে, এর কি উত্তর দেব ভেবে পাওয়া যায় না। সুতরাং তাঁর অপর মতটি ঠিক কি না দেখা যাক। আমাদের দেশে ছোটো ছেলেদের বিশ্বাস যে, বাংলা কথার পিছনে অনুস্বর জুড়ে দিলেই সংস্কৃত হয়; আর প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের মত যে, সংস্কৃত কথার অনুস্বর-বিসর্গ ছেঁটে দিলেই বাংলা হয়। দুটো বিশ্বাসই সমান সত্য। বাঁদরের লেজ কেটে দিলেই কি মানুষ হয়?

যদি কারো এরূপ ধারণা থাকে যে, উক্ত ‘উপায়ে রাষ্ট্রীয় একতা সংস্থাপিত হইবার পথ প্রশস্ত হইবে, কালে ভারতের সর্বত্র এক ভাষা হইবে’ তা হলে সে ধারণা নিতান্ত অমূলক। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সভ্যতা যে আকারই ধারণ করুক-না কেন, একাকার হয়ে যাবে না। যা পূর্বে কস্মিন্ কালেও হয় নি, তা পরে কস্মিন কালেও হবে না। ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি যে ভাষা ভাব আচার এবং আকার সম্বন্ধে নিজেদের বিশেষত্ব হারিয়ে এক জাতি হয়ে উঠবে এ আশা করাও যা, আর কাঁঠালগাছ ক্রমে আমগাছ হয়ে উঠবে এ আশা করাও তাই। পুরাকালেও এ দেশের দার্শনিকেরা যে সমস্যার মীমাংসা করবার চেষ্টা করেছিলেন, এ যুগের দার্শনিকদেরও সেই একই সমস্যার মীমাংসা করতে হবে। সে সমস্যা হচ্ছে, বহুর মধ্যে এক দেখা। রাষ্ট্রীয় ঐক্যস্থাপনের একমাত্র উপায় হচ্ছে, ভারতবর্ষের নানা জাতির বিশেষত্ব রক্ষা করেও সকলকে এক যোগসূত্রে বন্ধন করা। রাষ্ট্রীয় ভাবনাও যখন অতি ফলাও হয়ে ওঠে, এবং দেশে-বিদেশে চারিয়ে যায়, তখন সে ভাবনা দিগ্‌বিদিজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। বঙ্গসাহিত্যের যত শ্রীবৃদ্ধি হবে, তত তার স্বাতন্ত্র্য আরো ফুটে উঠবে, লোপ পাবে না।

ললিতবাবু পণ্ডিতি বাংলার উপর বিশেষ নারাজ। আমি অবশ্য সেরকম রচনা-পদ্ধতির পক্ষপাতী নই। তবে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত লেখকদের সপক্ষে এই কথা বলবার আছে যে, তাঁরা সংস্কৃত শব্দ ভুল অর্থে ব্যবহার করেন নি। তাঁদের হাতে সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ মিষ্টপ্রয়োগ না হলেও দুষ্টপ্রয়োগ নয়। প্রবোধচন্দ্রিকা কিংবা পুরুষপরীক্ষা পড়লে বাংলা আমরা শিখতে না পারি, কিন্তু সংস্কৃত ভুলে যাই নে! প্রবোধচন্দ্রিকার রচয়িতা স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের আমি বিশেষ পক্ষপাতী। কেননা তিনি সুপণ্ডিত এবং সুরসিক। একাধারে এই উভয় গুণ আজকালকার লেখকদের মধ্যে নিতান্ত দুর্লভ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের গল্প বলবার ক্ষমতা অসাধারণ। অল্প কথায় একটি গল্প কি করে সর্বাঙ্গসুন্দর করে বলতে হয়, তার সন্ধান তিনি জানতেন। পুরুষপরীক্ষার ভাষা ললিতবাবু যে কি কারণে ‘শব্দাড়ম্বরময় জড়িমা-জড়িত ভাষা’ মনে করেন, তা আমি বুঝতে পারলুম না, কারণ সে ভাষা নদীর জলের ন্যায় স্বচ্ছ এবং স্রোতস্বতী। প্রবোধচন্দ্রিকার পূর্বভাগের ভাষা কঠিন হলেও শুষ্ক নয়। যিনি তাতে দাঁত বসাতে পারবেন তিনিই তার রসাস্বাদ করতে পারবেন। আমাদের নব্যলেখকেরা যদি মনোযোগ দিয়ে প্রবোধচন্দ্রিকা পাঠ করেন, তা হলে রচনা সম্বন্ধে অনেক সদুপদেশ লাভ করতে পারবেন। যথা, ‘ঘট’কে ‘কম্বুগ্রীব বৃকোদর’ বলে বর্ণনা করলে তা আর্ট হয় না, এবং নর ও বিষাণ এই দুটি বাক্যকে একত্র করলে ‘নরবিষাণ’ রূপ পদ রচিত হলেও তার অনুরূপ মানুষের মাথায় শিং বেরোয় না; যদি কারো মাথায় বেরোয় তো সে পদকর্তার।

রাজা রামমোহন রায় এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের লেখার দোষ ধরা সহজ কিন্তু আমরা যেন এ কথা ভুলে না যাই যে, এঁরাই হচ্ছে বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম গদ্যলেখক। বাংলার গদ্যের রচনাপদ্ধতি এঁদেরই উদ্ভাবন করতে হয়েছিল। তাঁদের মুশকিল হয়েছিল শব্দ নিয়ে নয়, অন্বয় নিয়ে। রাজা রামমোহন রায়, তাঁর রচনা পড়তে হলে পাঠককে কি উপায়ে তার অন্বয় করতে হবে, তার হিসেব বলে দিয়েছেন। রাজা রামমোহনের গদ্য যে আমাদের কাছে একটু অদ্ভুত লাগে, তার প্রধান কারণ হচ্ছে যে, তাঁর বিচারপদ্ধতি ও তর্কের রীতি সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃতশাস্ত্রের ভাষ্যকারদের অনুরূপ। সে পদ্ধতিতে আমরা গদ্য লিখি নে, আমরা ইংরেজি গদ্যের সহজ এবং স্বচ্ছন্দ গতিই অনুকরণ করতে চেষ্টা করি। রামমোহন রায়ের গদ্যে বাগাড়ম্বর নেই, সমাসের নামগন্ধও নেই, এবং সে ভাষা সংস্কৃতবহুলও নয়।

তার পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গদ্য যে আমরা standard prose হিসাবে দেখি, তার কারণ, তিনিই সর্বপ্রথম প্রাঞ্জল গদ্য রচনা করেন। সে ভাষার মর্যাদা তার সংস্কৃতবহুলতার উপর নয়, তার syntaxএর উপর নির্ভর করে। রাজা রামমোহন রায়ের ভাষার সঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা তুলনা করে দেখলে পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, অন্বয়ের গুণেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।

এই-সব কারণেই পণ্ডিতি বাংলার সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়া নেই। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা বঙ্গভাষার কোনো ক্ষতি করেন নি, বরং অনেক উপকার করেছেন। বিশেষত সে ভাষা যখন কোনো নব্যলেখক অনুকরণ করেন না, তখন তার বিরুদ্ধে আমাদের খড়্গহস্ত হয়ে ওঠবার দরকার নেই। আসল সর্বনেশে ভাষা হচ্ছে ‘চন্দ্রাহত সাহিত্যিক’রা ইংরেজি বাক্য এবং পদকে যেমন-তেমন ক’রে অনুবাদ ক’রে যে খিচুড়ি-ভাষার সৃষ্টি করছেন, সেই ভাষা। সে ভাষার হাত থেকে উদ্ধার না পেলে বঙ্গসাহিত্য আঁতুড়েই মারা যাবে। এবং সেই কৃত্রিম ভাষার হাত এড়াতে হলে মৌখিক ভাষার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায়ান্তর নেই। সুতরাং ‘আলালি’ ভাষাকে আমাদের শোধন করে নিতে হবে। বাবু-বাংলার কোনোরূপ সংস্কার করা অসম্ভব, কারণ সে ভাষা হচ্ছে পণ্ডিতি বাংলার বিকারমাত্র। দুধ একবার ছিঁড়ে গেলে তা আর কোনো কাজে লাগে না। ললিতবাবুর মতে পণ্ডিতি বাংলার ‘কঠোর অস্থিপঞ্জর পাঠ্য-পুস্তক-নির্বাচন-সমিতির বায়ু-শূন্য টিনের কৌটায় রক্ষিত’। আমি বলি তা নয়। স্কুলপাঠ্য-পুস্তকরূপ টিনের কৌটায় যা রক্ষিত হয়ে থাকে, তা শুধু সাধুভাষারূপ নটানো গোরুর দুধ। সুতরাং সেই টিনের গোরুর দুধ খেয়ে যারা বড়ো হয়, মাতৃদুগ্ধ যে তাদের মুখরোচক হয় না, তা আর আশ্চর্যের বিষয় নয়।

আমাদের রচনায় কতদূর পর্যন্ত আরবি পারসি ইংরেজি প্রভৃতি বিদেশী শব্দের ব্যবহার সংগত, বিষয়ে ললিতবাবু এই সিদ্ধান্ত করেছেন যে,

এক সময়ে বাংলা ভাষায় আরবি পারসি শব্দের প্রবেশ ঘটিয়াছে, এবং আজকাল ইংরেজি শব্দের প্রবেশ ঘটিতেছে। ইহা প্রাকৃতিক নিয়ম। সকল ভাষাতেই যাহা ঘটিয়াছে বাংলা ভাষাতেও তাহাই ঘটিয়াছে ও ঘটিতেছে।

এক কথায়, প্রাকৃতিক নিয়মের বিপক্ষতাচরণ করায় কোনো লাভ নেই। যে-সকল বিদেশী শব্দ বেমালুম বঙ্গভাষার অন্তর্ভূত হয়ে গেছে, সে-সকল শব্দ অবশ্য কথার মতো লেখাতেও নিত্যব্যবহার্য হওয়া উচিত।

কোনো শব্দের উৎপত্তি বিচার করে যে লেখক সেটিকে জোর করে সাহিত্য হতে বহিষ্কৃত করে দেবেন তিনিই ঠকবেন, কারণ ও-উপায়ে শুধু অকারণে ভাষাকে সংকীর্ণ করে ফেলা হয়। আমি এ বিষয়ে ললিতবাবুর মতের সম্পূর্ণ পক্ষপাতী। কিন্তু একটি কথা আমাদের মনে রাখা কর্তব্য— বঙ্গভাষা বাঙালি হিন্দুর ভাষা; এ দেশে মুসলমান ধর্মের প্রাদুর্ভাবের বহুপূর্বে গৌড়ীয় ভাষা প্রায় বর্তমান আকারে গঠিত হয়ে উঠেছিল।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের মতে—

অন্যান্য দেশীয় ভাষা হইতে গৌড়দেশীয় ভাষা উত্তমা, সর্বোত্তমা সংস্কৃত ভাষা বাহুল্য-হেতুক।

গৌড়ীয় প্রাকৃত অপর-সকল প্রাকৃত অপেক্ষা উত্তম কি অধম, সে বিচার আমি করতে চাই নে, কিন্তু সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বঙ্গভাষার সম্বন্ধ যে অতি ঘনিষ্ঠ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংস্কৃত বৈয়াকরণিকদের মতে ভাষাশব্দ ত্রিবিধ, তজ্জ, তৎসম, দেশ্য। বঙ্গভাষায় তজ্জ এবং তৎসম শব্দের সংখ্যা অসংখ্য, দেশ্য শব্দের সংখ্যা অল্প, এবং বিদেশী শব্দের সংখ্যা অতি সামান্য।

এ বিষয়ে ফরাসি ভাষার সহিত বঙ্গভাষা একজাতীয় ভাষা। একজন ইংরেজি লেখক ফরাসি ভাষা সম্বন্ধে যা বলেছেন, সেই কথাগুলি আমি নীচে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। তার থেকে পাঠকমাত্রই দেখতে পাবেন যে, ল্যাটিন ভাষার সহিত ফরাসি ভাষার যেরূপ সম্বন্ধ, সংস্কৃত ভাষার সহিত বঙ্গভাষারও ঠিক সেই একইরূপ সম্বন্ধ—

With a very few exceptions, every word in the French vocabulary comes straight from Latin. The influence of pre-Roman Celts is almost imperceptible; while the number of words introduced by the Frankish conquerors amounts to no more than a few hundreds.

উদ্ধৃত পদটিতে Frenchএর স্থানে বঙ্গভাষা, pre-Romanএর স্থানে বাংলার আদিম অনার্য জাতি, Latinএর স্থলে সংস্কৃত, এর Frankishএর স্থলে মুসলমান এই কথা ক’টি বদলে নিলে, উক্ত বাক্য ক’টি বঙ্গভাষার সঠিক বর্ণনা হয়ে ওঠে।

ঐরূপ হওয়াতে, ফরাসি সাহিত্যের যা বিশেষ গুণ, বঙ্গসাহিত্যেরও সেই গুণ থাকা সম্ভব এবং উচিত। সে গুণ পূর্বোক্ত লেখকের মতে হচ্ছে এই—

French literature is absolutely homogeneous. The genius of the French language, descended from its single stock has triumphed most-in simplicity, in unity, in clarity, and in restraint.

সুতরাং জোর করে যদি আমরা বাংলা ভাষায় এমন-সব আরবি কিংবা পারসি শব্দ ঢোকাতে চেষ্টা করি, যা ইতিপূর্বে আমাদের ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে যায় নি, তা হলে ঐরূপ উপায়ে আমরা বঙ্গভাষাকে শুধু বিকৃত করে ফেলব।

সম্প্রতি বাংলা ভাষার উপর ঐরূপ জবরদস্তি করবার প্রস্তাব হয়েছে ব’লে এ বিষয়ে আমি বাঙালিমাত্রকেই সতর্ক থাকতে অনুরোধ করি। আগন্তুক ঢাকাইউনিভার্সিটির রিপোর্টে দেখতে পাই, একটু ঢাকা-চাপা দিয়ে ঐ প্রস্তাবই করা হয়েছে। স্কুলপাঠ্য গ্রন্থাবলীর উপর আর্য আক্রমণের বিষয়ে আমি অনেকরূপ ঠাট্টাবিদ্রূপ করেছি; কিন্তু ঐ স্কুলপাঠ্য গ্রন্থাবলীর উপর এই মুসলমান আক্রমণের প্রস্তাবটি আরো ভয়ংকর, কেননা বাংলা ভাষার তজ্জ শব্দকে রূপান্তরিত করে তৎসম করলেও বাংলা ভাষার ধর্ম নষ্ট হয় না, কিন্তু অপরিচিত এবং অগ্রাহ্য বিদেশী শব্দকে আমাদের সাহিত্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়াতে তার বিশেষত্ব নষ্ট করে তাকে কদর্য এবং বিকৃত করে ফেলা হয়। এই উভয়সংকট হতে উদ্ধার পাবার একটি খুব সহজ উপায় আছে। বাংলা ভাষা হতে বাংলা শব্দসকল বহিষ্কৃত করে দিয়ে অর্ধেক সংস্কৃত এবং অর্ধেক আরবি-পারসি শব্দ দিয়ে ইস্কুলপাঠ্য গ্রন্থ রচনা করলে, দু কূল রক্ষে হয়!

চৈত্র ১৩১৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *