সাহিত্য
ভাষার কথা
ভারতবর্ষ
সমাজ
বিচিত্র

ভারতবর্ষের ঐক্য

ভারতবর্ষের ঐক্য

শ্ৰীযুক্ত রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় উপরোক্ত নামে পুস্তিকা-আকারে ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যাঁরা দিবারাত্র জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের পক্ষে, অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেরই পক্ষে, এই ক্ষুদ্র পুস্তকের আলোচ্য বিষয়ের যথেষ্ট মূল্য আছে।

স্বদেশ কিংবা স্বজাতির নাম উল্লেখ করবামাত্রই এক দলের লোক আমাদের মুখ-ছোপ দিয়ে বলেন, ও-সব কথা উচ্চারণ করবার তোমাদের অধিকার নেই, কেননা ভারতবর্ষ বলে কোনো-একটা বিশেষ দেশ নেই এবং ভারতবাসী বলে কোনো-একটা বিশেষ জাতি নেই। ভারতবর্ষের অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং পরপর-অসংযত নানা খণ্ড দেশ এবং ভারতবাসীর অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরপর-সম্পর্কহীন নানা ভিন্ন জাতি।

ভারতবর্ষ যে একটি প্রকাণ্ড মহাদেশ, এ সত্য আবিষ্কার করবার জন্য পায়ে হেঁটে তীর্থ পর্যটন করবার দরকার নেই। একবার এ দেশের মানচিত্রখানির উপর চোখ বুলিয়ে গেলেই আমাদের শ্রান্তি বোধ হয়, এবং শরীর না হোক মা অবসন্ন হয়ে পড়ে। এবং ভারতবর্ষের জনসংখ্যা যে অগণ্য, আর এই কোটি কোটি লোক যে জাতি ধর্ম ও ভাষায় শত শত ভাগে বিভক্ত, এ সত্য আবিষ্কার করবার জন্যও সেন্সস রিপোর্ট গড়বার আবশ্যক নেই; চোখ-কান খোলা থাকলেই তা আমাদের কাছে নিত্যপ্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।

আমাদের জীবনের যে ঐক্য নেই, এ কথাও যেমন সত্য–আমাদের মনে যে ঐক্যের আশা আছে, সে কথাও তেমনি সত্য। এক-ভারতবর্ষ হচ্ছে এ যুগের শিক্ষিত লোকের ইউটোপিয়া, সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলে গন্ধর্বপুরী। সে পুরী আকাশে ঝোলে এবং সকলের নিকট তা প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু যিনি একবার সে পুরীর মর্মরপ্রাচীর মণিময়তেরণ রজতসৌধ ও কনকচড়ার সাক্ষাৎলাভ করেছেন, তিনি আকাশরাজ্য হতে আর চোখ ফেরাতে পারেন না। এক কথায় তিনি ভারতবর্ষের একতার দিবাস্বপ্ন দেখতে বাধ্য। অনেকের মতে দিবাঘন দেখাটা নিন্দনীয়, কেননা ও ব্যাপারে শুধু অলীকের সাধনা করা হয়। মানুষে কিন্তু বাস্তবজগতের অজ্ঞতাবশত নয়, তার প্রতি অসন্তোষবশতই, চোখ-চেয়ে ঘন দেখে; সে ঘরে মূল মানবহৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত। এবং ইতিহাস এ সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, আজকের কল্পনারাজ্য কখনো কখনো কালকের বাস্তবজগতে পরিণত হয়, অর্থাৎ দিবাধন কখনো কখনো ফলে। সুতরাং ভারতবর্ষের ঐক্যসাধন জাতীয় জীবনের লক্ষ্য কবে তোলা অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক এবং সকলের পক্ষেই আবশাক। সমগ্র সমাজের বিশেষ-একটা-কোনো লক্ষ্য না থাকায় দিন দিন আমাদের সামাজিক জীবন নিজীব এবং ব্যক্তিগত জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। পূর্বে যে ঐক্যের কথা বলা গেল, তা অবশ্য আইডিয়াল ইউনিটি; এবং অধিকাংশ শিক্ষিত লোকের মনে এক ভারতবর্ষ একটি বিরাট আইডিয়াল-রূপেই বিরাজ করছে। আমাদের বাঞ্ছিত ইউটোপিয়া ভবিষ্যতের অঙ্কস্থ রয়েছে।

কিন্তু এই আইডিয়ালকে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে নিত্যই আক্রমণ সহ্য করতে হয়। এক দিকে ইংরেজি সংবাদপত্র, অপর দিকে বাংলা সংবাদপত্র এই আইডিয়ালটিকে নিতান্ত উপহাসের পদার্থ মনে করেন; উভয়েই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপর বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন। কাগজওয়ালাদের মতে এই মনোভাবটি বিদেশী-শিক্ষালন্ধ, এবং সেইজন্যই স্বদেশী-ভিত্তিহীন; কেননা ভারতবর্ষের অতীতের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। ইংরেজি সংবাদপত্রের মতে ভারতবর্ষের সভ্যতার মূল এক নয়, বহ; এবং যা গোঁড়া হতেই পৃথক, তার আর কোনোরূপ মিলন সম্ভব নয়। কুকুর আর বেড়াল নিয়ে এক-সমাজ গড়ে তোলা যায় না; ও দুই শ্রেণীর জীব শুধু গহস্বামীর চাবুকের ভয়ে একসঙ্গে ঘর করতে পারে। অপর পক্ষে বাংলা সংবাদপত্রের মতে হিন্দুসমাজের বিশেষত্বই এই যে, তা বিভক্ত। এ সমাজ শতরঞ্জের ঘরের মতো ছক-কাটা। এবং কার কোন ছক, তাও অতি সুনির্দিষ্ট। এই সমাজের ঘরে কে সিধে চলবে, কে কোনাকুনি চলবে, কে এক পা চলবে, আর কে আড়াই পা চলবে, তারও বাঁধাবাঁধি নিয়ম আছে। এর নাম হচ্ছে বর্ণশ্রমধর্ম। নিজের নিজের গণ্ডির ভিতর অবস্থিতি করে নিজের নিজের চাল রক্ষা করাই হচ্ছে ভারতবাসীর সনাতন ধর্ম। সুতরাং যাঁরা সেই দাবার ঘরের রেখাগুলি মুছে দিয়ে সমগ্র সমাজকে একঘরে করতে চান, তাঁরা দেশের শত্র। শিক্ষিত সম্প্রদায় যে ঐক্য চান তা ভারতবর্ষের ধাতে নেই, সুতরাং জাতির উন্নতির যে ব্যবস্থা তারা করতে চান, তাতে শুধু সামাজিক অরাজকতার সৃষ্টি করা হবে। সমাজের সুনির্দিষ্ট গণ্ডিগুলি তুলে দিলে সমাজতরী কোনাকুনি চ’লে তীরে আটকে যাবে, এবং সমাজের ঘোড়া আড়াই পা’র পরিবর্তে চার পা তুলে ছুটবে। এ অবশ্য মহা বিপদের কথা। সুতরাং ভারতবর্ষের অতীতে এই ঐক্যের আইডিয়ালের ভিত্তি আছে কি না, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। এই কারণেই সম্ভবত রাধাকুমুদবাবু দু হাজার বৎসরের ইতিহাস খুড়ে সেই ভিত বার করবার চেষ্টা করেছেন, যার উপরে সেই কাম্যবস্তুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এ যে অতি, সাধু উদ্দেশ্য সে বিষয়ে বোধ হয় দ্বিমত নেই।

 

২.

রাধাকুমুদবাবু জাতীয় জীবনের ঐক্যের মূল যে প্রাচীন যুগের সামাজিক জীবনে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন, তার জন্য তিনি আমার নিকট বিশেষ ধন্যবাদার্হ। অনেকে, দেখতে পাই, এই ঐক্যের সন্ধান, ঐতিহাসিক সত্যে নয়, দার্শনিক তথ্যে লাভ করেন। এ শ্রেণীর লোকের মতে সমগ্র ভারতবর্ষ এক ব্রহ্মপুত্রে গ্রথিত; কেননা অদ্বৈতবাদে সকল অনৈক্য তিরস্কৃত হয়। কিন্তু যে সমস্যা নিয়ে আমরা নিজেদের বিব্রত করে তুলেছি, তার মীমাংসা বেদান্তদর্শনে করা হয় নি; বরং ঐ দর্শন থেকেই অনুমান করা অসংগত হবে না যে, প্রাচীন যুগে জাতীয় জীবনে কোনো ঐক্য ছিল না। মানবজীবনের সঙ্গে মানবমনের যোগ অতি ঘনিষ্ঠ। কাব্যের মতো দর্শনও জীবনবৃক্ষের ফল; তবে এ ফল এত সক্ষম বতে ভর করে এত উচ্চে ফুটে ওঠে যে, হঠাৎ দেখতে তা আকাশকুসুম বলে ভ্রম হয়। আমার বিশ্বাস, একটি ক্ষুদ্র দেশের এক রাজার শাসনাধীন জাতির মন একেশ্বরবাদের অনুকল। ঐরূপ জাতির পক্ষে বিশ্বকে একটি দেশ হিসেবে এবং ভগবানকে তার অদ্বিতীয় শাসনও পালনকর্তা হিসেবে দেখা স্বাভাবিক এবং সহজ। অপর পক্ষে যে মহাদেশ নানা রাজ্যে বিভক্ত এবং বহু রাজা-উপরাজার শাসনাধীন, সে দেশের লোকের পক্ষে আকাশদেশে বহু দেবতা এবং উপদেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করাও তেমনি স্বাভাবিক। সাধারণত মানুষে মর্তের ভিত্তির উপরেই স্বর্গের প্রতিষ্ঠা করে। যে দেশের পূর্বপক্ষ একেশ্বরবাদী সে দেশের উত্তরপক্ষ নাস্তিক, এবং যে দেশের পূর্বপক্ষ বহুদেবতাবাদী সে দেশের উত্তরপক্ষ অদ্বৈতবাদী। অদ্বৈতবাদী বহুর ভিতর এক দেখেন না, কিন্তু বহুকে মায়া বলে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সুতরাং উত্তরমীমাংসার সার কথা— ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’–এই অর্ধ শ্লোকে যে বলা হয়েছে, তার আর সন্দেহ নেই। এই কারণেই বেদান্তদর্শন সাংখ্যদর্শনের প্রধান বিরোধী। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, সংখ্যা বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে শুধু শূন্য। সুতরাং মায়াবাদ যে ভাষান্তরে শূন্যবাদ এবং শংকর যে প্রচ্ছন্নবৌদ্ধ–এই প্রাচীন অভিযোগের মূলে কতকটা সত্য আছে। যে একাত্মজ্ঞান কর্ম শূন্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত, সে জ্ঞানের চর্চায় আত্মার যতটা চর্চা করা হয়, বিশ্বমানবের সঙ্গে আত্মীয়তার চর্চা ততটা করা হয় না। আরণ্যক-ধর্ম যে সামাজিক, এ কথা শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিকেবাই বলতে পারেন। সমাজ ত্যাগ করাই যে সন্ন্যাসের প্রথম সাধনা, এ কথা বিস্মৃত হবার ভিতর যথেষ্ট আরাম আছে।

সোহহং হচ্ছে ইনভিভিডুয়ালিজমের চরম উক্তি। সুতরাং বেদান্তমত আমাদের মনোজগৎকে যে পরিমাণে উদার ও মুক্ত করে দিয়েছে, আমাদের ব্যাবহারিক জীবনকে সেই পরিমাণে বদ্ধ ও সংকীর্ণ করে ফেলেছে। বেদান্তের দর্পণে প্রাচীন যুগের সামাজিক মন প্রতিফলিত হয় নি, প্রতিহত হয়েছে। বেদান্তদর্শন সামাজিক জীবনের প্রকাশ নয়, প্রতিবাদ। অদ্বৈতবাদ হচ্ছে সংকীর্ণ কর্মের বিরুদ্ধে উদার মনের প্রতিবাদ, সীমার বিরুচ্ছে অসীনের প্রতিবাদ, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আত্মজ্ঞানের প্রতিবাদ। এক কথায় জড়ের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবা। সমাজের দিক থেকে দেখলে জীবের এই ঘরাটন শুধু বিরাট অহংকার মাত্র। সুতরাং যে সূত্রে একালের লোকেরা জাতিকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান তা ব্রহ্মসূত্র নয়, কিন্তু তার অপেক্ষা ঢের স্থূল জীবনসূত্র।

কেন যে পুরাকালে অদ্বৈতবাদীরা কৌপীনকমণ্ডল, ধারণ করে বনে যেতেন, তার প্রকৃত মর্ম উপলদ্ধি না করতে পারায় একালের অদ্বৈতবাদীরা চোগাচাপকান পরে আপিসে যান।, উভয়ের ভিতর মিল এইটুকু যে, একজন হচ্ছেন উদাসী আর-একজন শুধু উদাসীন–পরের সম্বন্ধে।

রাধাকুমুদবাবুর প্রবন্ধের প্রধান মর্যাদা এই যে, তিনি ভারতের আত্মজ্ঞানের ভিত্তি অতীতের জীবনক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে কতদূর কৃতকার্য হয়েছেন সেইটেই বিচার্য। ভবিষ্যতের শুন্যদেশে যা-খুশি-তাই স্থাপনা করবার যে স্বাধীনতা মানুষের আছে, অতীত সম্বন্ধে তা নেই। ভবিষ্যতে সবই সম্ভব হতে পারে, কিন্তু অতীতে যা হয়ে গেছে তার আর একচুলও বদল হতে পারে না। কল্পনার প্রকৃত লীলাভূমি ভূত নয়, ভবিষ্যৎ। আকাশে আশার গোলাপ ফুল অথবা নৈরাশ্যের সরষের ফল দেখবার অধিকার আমাদের সকলেরই আছে; কিন্তু অতীত ফলের নয়, মূলের দেশ। যে মূল আমরা খুঁজে বার করতে চাই তা সেখানে পাই তো ভালোই; না পাই তো, না পাই।

 

৩.

জীবের অহংজ্ঞান যেমন একটি দেহ আশ্রয় করে থাকে জাতির অহংজ্ঞানও তেমনি একটি দেশ আশ্রয় করে থাকে। মানুষের যেমন দেহাত্মজ্ঞান তার সকল বিশিষ্টতার মূল, জাতির পক্ষেও তেমনি দেশাত্মজ্ঞান তার সকল বিশিষ্টতার মূল। ভারতবাসীর মনে এই দেশাত্মজ্ঞান যে অতি প্রাচীনকালে জন্মলাভ করেছিল, রাধাকুমুদবাবু নানারূপ প্রমাণপ্রয়োগের বলে তাই প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছেন।

ভারতবর্ষ মহাদেশ হলেও যে একদেশ এবং ভারতবাসীদের যে সেটি স্বদেশ, এ সত্যটি অন্তত দু হাজার বৎসর পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল।

উত্তরে অলঙ্ঘ্য পর্বতের প্রাকার, এবং পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্বে দুর্লঙ্ঘ্য সাগরের পরিখা যে ভারতবর্ষকে অন্যান্য সকল ভূভাগ হতে বিশেষরূপে পৃথক ও স্বতন্ত্র করে রেখেছে, এ হচ্ছে প্রত্যক্ষসত্য। তার পর, এ দেশ অসংখ্যযোজনবিস্তৃত হলেও সমতল; এত সমতল যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে একক্ষেত্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিন্ধ্যাচল সম্ভবত এ মহাদেশকে দুটি চিরবিচ্ছিন্ন খণ্ডদেশে বিভক্ত করতে পারত, যদি অগস্ত্যের আদেশে সে চিরদিনের জন্য নতশির হয়ে থাকতে বাধ্য না হত। রাধাকুমুদবাবু দেখিয়েছেন যে, এই স্বদেশজ্ঞান ভারতবাসীর পক্ষে কেবলমাত্র শুষ্ক জ্ঞান নয়, কিন্তু তাদের আত্যন্তিক প্রীতি ও ভক্তির সঙ্গে জড়িত। ভারতবাসীর পক্ষে ভারতবর্ষ হচ্ছে পূণ্যভূমি। সে দেশের প্রতি ক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র, প্রতি নদী তীর্থ, প্রতি পর্বত দেবতাত্মা। কিন্তু এই ভক্তিভাব আর্য মনোভাব কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বেদ হতে পঞ্চনদের আবাহনস্বরূপ একটিমাত্র শ্লোক উদধৃত করে রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ করতে চান যে, ঋষিদের মনে এই একদেশীয়তার ভাব সর্বপ্রথমে উদয় হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈদিক মনোভাব যে ক্ৰমে বৃদ্ধি এবং বিস্তার লাভ করে শেষে লৌকিক মনোভাবে পরিণত হয়েছিল, তার কোনো প্রমাণ নেই। আমার বিশ্বাস, বৈদিক ধর্ম নয়, লৌকিক ধর্মই ভারতবর্ষকে পূণ্যভূমি করে তুলেছে। ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের ধর্ম হচ্ছে লৌকিক ধর্ম, বিদেশী বিজেতা আর্যদের ধর্ম হচ্ছে বৈদিক ধর্ম। ভারতবর্ষের মাটি ও ভারতবর্ষের জলই হচ্ছে লৌকিক ধর্মের প্রধান উপাদান। সে ধর্ম আকাশ থেকে পড়ে নি, মাটি থেকে উঠেছে। ভারতবর্ষের জনগণ চিরদিন কৃষিজীবী। যে ত্রিকোণ পৃথিবী তাদের চিরদিন অন্নদান করে সেই হচ্ছে অন্নদা এবং যে জল তাদের শস্যক্ষেত্রে রসসঞ্চার করে সেই হচ্ছে প্রাণদা। তাই ভারতবর্ষের অসংখ্য লৌকিক দেবতা সেই অন্নদার বিকাশ। সীতার মতো এ-সকল দেবতা হলমুখে ধরণী হতে উত্থিত হয়েছে। তাই এ দেশের প্রতিমা মাটির দেহ ধারণ করে এবং জলে তার বিসর্জন হয়। ‘তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ এ কথা মোটেই বৈদিক মনোভাবের পরিচায়ক নয়। কেননা, পঞ্চনদবাসী আর্যেরা মন্দিরও গড়াতেন না, প্রতিমাও পুজা করতেন না। এই দেশভক্তি পৌরাণিক সাহিত্যে অতি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তার কারণ, বৈদিক যুগ ও পৌরাণিক যুগের মধ্যে যে বৌদ্ধ যুগ ছিল সেই যুগেই এই দেশজ্ঞান ও স্বদেশপ্রীতি ভারতবর্ষময় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। বৌদ্ধধর্ম অবৈদিক ধর্ম, এবং সার্বজনীন বলে তা সার্বভৌম ধর্ম। অপর পক্ষে বৈদিক ধর্ম আর্যদের গৃহধর্ম, বড়োজোর কুলধর্ম। সমগ্র দেশকে একাত্ম করবার ক্ষমতা সে ধর্মের ছিল না। যেমন অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে সুরেরা এক ঈশানকোণ ব্যতীত আর-সকল দিকেই পরাস্ত হয়েছিলেন, তেমনি সম্ভবত ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা দেশজ দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে এক গৃহকোণ ব্যতীত আর সর্বত্রই পরাস্ত হয়েছিলেন। অন্তত আকাশের দেবতারা যে মাটির দেবতাদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার প্রমাণ পৌরাণিক হিন্দুধর্ম। বৈদিক ও লৌকিক মনোভাবের মিশ্রণে এই নবধর্মভাবের জন্ম। আর্যরা যে কস্মিনকালেও সমগ্র ভারতবর্ষকে একদেশ বলে স্বীকার করতে চান নি, তার প্রমাণ স্মৃতিশাস্ত্রে পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্মের অধঃপতন এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যুদয়ের সময় মনুসংহিতা লিখিত হয়। এই সংহিতাকারের মতে ব্রহ্মাবর্ত-এবং আর্যাবর্ত-বহির্ভূত সমগ্র ভারতবর্ষ হচ্ছে ঘৃণ্য ম্লেচ্ছদেশ। মনুর টীকাকার মেধাতিধি বলেন যে, দেশের ম্লেচ্ছত্বদোষ কিংবা আর্যগুণ নেই। যে দেশে বেদবিহিত ক্রিয়াকর্মনিরত আর্যেরা বাস করেন, সেই হচ্ছে আর্যভূমি, বাদবাকি সব ম্লেচ্ছদেশ। আর্যদের এই স্বজাতিজ্ঞান সমগ্র ভারতবর্ষের স্বদেশজ্ঞানের প্রতিকূল ছিল। পঞ্চনদের পঞ্চনদীর উল্লেখ করে তর্পণের মন্ত্র উচ্চারণপক বৈদিক ঋষিরা যে গণ্ডূষ করতেন, সে কতকটা সেই ভাবে, যে ভাবে একালে বিলাতি আর্যেরা মহোৎসবের ভোজনাতে The Land we live inএর নামোচ্চারণ করে সুরার আচমন করেন। প্রাচীন আর্যজাতির মনে দেশপ্রীতির চাইতে আত্মপ্রীতি ঢের বেশি প্রবল ছিল। দেশের স্বাতন্ত্র রক্ষা নয়, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষাই ছিল তাঁদের স্বধর্ম। রাধাকুমুদবাবু এমন-কোনো বিরুদ্ধপ্রমাণ দেখাতে পারেন নি, যাতে করে আমার এই ধারণা পরিবর্তিত হতে পারে।

 

৪.

ইংরেজ যে সর্বপ্রথমে ভারতবর্ষের মানচিত্র লালবর্ণে চিত্রিত করেছেন, তা নয়। আজ দু হাজার বৎসরেরও পূর্বে আশোকও একবার ঐ মানচিত্র গেরুয়ারঙে রঞ্জিত করেছিলেন। এ কথা শিক্ষিত লোকমাত্রেরই জানা না থাক, শোনা আছে। যা সপরিচিত তার আর নতুন করে আবিষ্কার করা চলে না, সুতরাং রাধাকুমুদবাবু প্রাচীন ভারতের একরাস্ট্রীয়তার মূল বৈদিক সাহিত্যে অনুসন্ধান করেছেন, তাঁর পুস্তিকার মৌলিকতা এইখানেই। সুতরাং তিনি অনুসন্ধানের ফলে যে নূতন সত্য আবিষ্কার করেছেন, তা বিনাপরীক্ষায় গ্রাহ্য করা যায় না।

শাস্ত্রকারেরা বেদকে স্মৃতির মূল বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বেদ যে শূদ্ররীতি কিংবা বৌদ্ধনীতির মূল, এ কথা তারা কখনো মুখে আনেন নি; বরং বৌদ্ধচার্যেরা যখন বেদের কোনো উৎসন্ন শাখা থেকে বৌদ্ধধর্ম উদ্ভূত হয়েছে এই দাবি করতেন, তখন বৈদিক ব্রাহ্মণেরা কানে হাত দিতেন। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ইতিহাস যে প্রাচীন সাম্রাজ্যের পরিচয় দেয় তা বৌদ্ধযুগে ব্রাত্যদেশে শূদ্রভূপতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মগধের নন্দবংশও শূদ্রবংশ, মৌর্যবংশও শূদ্রবংশ ছিল। এবং অশোক সমগ্র ভারতবর্ষে শুধু রাজচক্র নয় ধর্মচক্রেরও স্থাপনা করে সসাগরা বসুন্ধরার সার্বভৌম চক্রবর্তীর পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুতরাং একরাষ্ট্রীয়তার মূল বৈদিক মনে পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে স্বতই সন্দেহ উপস্থিত হয়।

বৌদ্ধযুগের পূর্বে কোনো একরাটের পরিচয় ইতিহাস দেয় না। কিন্তু ইতিহাসের পশ্চাতে কিংবদন্তি আছে; সেই কিংবদন্তির সাহায্যে, দেশের বিশেষকোনো ঘটনা না হোক, জাতির বিশেষ মনোভাবের পরিচয় আমরা পেতে পারি। রাধাকুমুদবাবু ব্রাহ্মণ এবং শ্রৌত সূত্র প্রভৃতি নানা বৈদিক গ্ৰন্থ থেকে রাজনীতি সম্বন্ধে আর্যজাতির মনোভাব উদ্ধার করবার চেষ্টা করেছেন।

রাধাকুমুদবাবুর দাখিলি বৈদিক দলিলগুলির কোনো তারিখ নেই, সুতরাং তার সবগুলি যে মাগধসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্বে লিখিত হয়েছিল, তা বলা যায় না। অতএব কোনো বিশেষ ব্রাহ্মণগ্রন্থ বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্ভুত হলেও তার প্রতি বাক্য যে বৈদিক মনোভাবের পরিচয় দেয় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে না। ওরূপ দলিলের বলে তর্কিত বিষয়ের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি করা অসম্ভব, বিশেষত যখন তাঁর সংগৃহীত দলিল তাঁর মতের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেয়। রাধাকুমুদবাবুর প্রধান দলিল হচ্ছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ। ঐ গ্রন্থেই তিনি সাম্রাজ্য শব্দের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, এবং সেই শব্দই হচ্ছে তাঁর মতের মূলভিত্তি। উক্ত ব্রাহ্মণের একখানি বাংলা অনুবাদ আছে; তারই সাহায্যে রাধাকুমুদবাবুর মত যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে। সম্রাট কাকে বলে, তার পরিচয় ঐ ব্রাহ্মণে এইরূপ আছে—

পূর্ব দিকে প্রাচ্যগণের যে-সকল রাজা আছেন তাঁহারা দেবগণের ঐ বিধান অনুসারে সাম্রাজ্যের জন্য অভিষিক্ত হন, অভিষেকের পর তাঁহারা সম্রাট নামে অভিহিত হন। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৩৮শ অধ্যায়)

রাধাকুমুদবাবু বলেন যে, এ স্থলে মাগধসাম্রাজ্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যদি তাঁর উক্ত অনুমান গ্রাহ্য হয় তা হলে প্রাচীন ভারতসাম্রাজ্যের বৈদিক ভিত্তি ঐ এক কথাতেই নষ্ট হয়ে যায়।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে নানারূপ রাজ্যের উল্লেখ আছে, যথা : রাজ্য, সাম্রাজ্য, ভৌজ্য, স্বারাজ্য, বৈরাজ্য, পারমেষ্ঠ্য রাজ্য, মাহারাজ্য ইত্যাদি। রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ করতে চান যে, ঐ-সকল নাম উচ্চনীচহিসাবে একরাটের অধীন ভিন্ন ভিন্ন রাজপদ নির্দেশ করে। কিন্তু ঐ ব্রাহ্মণগ্রন্থেই প্রমাণ আছে যে, ঐ-সকল নাম হচ্ছে পৃথক পৃথক দেশের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের নাম। তার সকল দেশই পঞ্চনদের বহির্ভূত, কোনো কোনো দেশ ভারতবর্ষেরও বহির্ভুত, এবং বিশেষ করে একটি দেশ পৃথিবীর বহিভূত। যথা–

পূর্ব দিকে প্রাচ্যগণের রাজ্য সম্রাট, দক্ষিণ দিকে সত্ত্বৎগণের রাজা ভোজী; পশ্চিম দিকে নীচ্য ও অপাচ্যদিগের রাজা স্বরাট; উত্তর দিকে হিমবানের ওপারে যে উত্তরকুরু ও উত্তরমদ্র জনপদ আছে, তাহারা দেবগণের ঐ বিধানানুসারে বৈরাজ্যের জন্য অভিষিক্ত হয়, অভিষেকের পরে তাহারা বিরাট নামে অভিহিত হয়। মধ্যমদেশে সবশ উশীনরগণের ও কুরপাঞ্চালগণের যে-সকল রাজা আছেন তাঁহারা রাজা নামে অভিহিত হন। এবং ঊর্ধ্বদেশে (অন্তরীক্ষে) ইন্দ্র পরমেষ্ঠ্য লাভ করিয়াছিলেন।

উপরোক্ত উদধৃত বাক্যগলি থেকে দেখা যায় যে, দেশভেদ অনুসারে সে যুগের রাজাদের নামভেদ হয়েছিল, পদমর্যাদা অনুসারে নয়। উক্ত ব্রাহ্মণে একরাট শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সে একরাট, একসঙ্গে স্বরাট্‌ বিরাট্‌ সম্রাট, সব রাট্‌ হতে পারতেন; অর্থাৎ তিনি স্বদেশ বিদেশ এবং আকাশদেশের রাজা হতে পারতেন। বলা বাহুল্য, এরূপ একরাটের নিকট ভারতবর্ষের একরাষ্ট্রীয়তার সন্ধান নিতে যাওয়া বৃথা।

আসল কথা এই যে, রাজনীতি অর্থে আমরা যা বুঝি ও চাণক্য যা বুঝতেন, ব্রাহ্মণগ্রন্থে তার নামগন্ধও নেই। বাজপেয় রাজসূয় অশ্বমেধ পুনরভিষেক ঐন্দ্রমহাভিষেক–এ-সব হচ্ছে যজ্ঞ। এবং এসকল যজ্ঞের উদ্দেশ্য রাজ্যস্থাপনা নয়, পুরোহিতকে ভূরি দান করানো এবং ঐরূপ যজ্ঞ দ্বারা যজমানের অভ্যুদয় সাধিত হতে পারে, তাই প্রমাণ করা। রাধাকুমুদবাবু তাঁর পুস্তিকাতে পুরাকালে যাঁরা একরাট-পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁদের নামের একটি লম্বা ফর্দ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ হতে তুলেছিলেন। সম্ভবত তিনি উক্ত রাজাগণের সার্বভৌম সাম্রাজ্যলাভ ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করেন, কিন্তু আমরা তা পারি নে। কারণ উক্ত ব্রাহ্মণের মতে ঐন্দ্রমহাভিষেকের বলেই প্রাচীন রাজারা ঐ ইন্দ্রবাঞ্ছিত পদ লাভ করেছিলেন। মন্ত্রবলে এবং যজ্ঞফলে তাদৃশ বিশ্বাস না থাকার দরুন আমরা উক্ত রাজযজমানদের ঐরূপ আত্যন্তিক অভ্যুদয় এবং রাজপুরোহিতদের তদনুরূপ দক্ষিণালাভের ইতিহাসে যথেষ্ট আস্থা স্থাপন করতে পারি নে। রাধাকুমুদবাবু নামের ফর্দের পাশাপাশি যদি দানের ফর্দটি তুলে দিতেন, তা হলে পাঠকমাত্রেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কথা কতদূর প্রামাণিক তা সহজেই বুঝতে পারতেন। ঐন্দ্রমহাভিষেক উপলক্ষে দান করা হত–

বদ্ধ শতকোটি গাভীর মধ্যে প্রতিদিন মাধ্যন্দিন সবনে দুই দুই সহস্র। আটাশি হাজার পুষ্ঠবাহনযোগ্য শ্বেত অশ্ব। এদেশ ওদেশ হইতে আনীত নিষ্ককণ্ঠী আঢ্য দুহিতার মধ্যে দশ সহস্র।

এরূপ দানের দাতা দুর্লভ হলেও গ্রহীতা আরো বেশি দুর্লভ। এত গোরু, এত ঘোড়া এত বনিতা রাখি কোথায় আর খাওয়াই কি, এ প্রশ্ন বোধ হয় দরিদ্র ব্রাহ্মণের মনে উদিত হত। ব্রাহ্মণগ্রন্থ এই সত্যেরই পরিচয় দেয় যে, সে যুগে এমন বহু ক্ষত্রিয় ছিলেন যাঁদের নিজেদের কোষবৃদ্ধি এবং অধিকারবৃদ্ধির প্রতি লোভ ছিল, এবং তাঁরা ব্রাহ্মণদের তন্তরমন্তরজাদুতে বিশ্বাস করতেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যে সাম্রাজ্যের উল্লেখ আছে তা বিয়ের বাহুবল বুদ্ধিবল ও চরিত্রবল দ্বারা নয়, ব্রাহ্মণের মন্ত্রবলের দ্বারা লাভ করবার বস্তু। কারণ শত্রুনাশের জন্য তাঁদের যুদ্ধ করা আবশ্যক হত না, ব্ৰহ্ম-পরিমর-কর্ম প্রভৃতি অভিচারের দ্বারাই সে কামনা সিদ্ধ হত। এই অতীত সাহিত্যের ভিত্তির উপর যদি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তা হলে আমাদের মনোজগতের গন্ধর্বপুরী চিরকাল আকাশেই ঝলবে।

আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার নূতন মদ নিত্যই সংস্কৃত সাহিত্যের পুরোনো বোতলে ঢালছি। আমরা স্পেন্সরের বিলেতি মদ শংকরের বোতলে ঢালি Comte কঁতের ফরাসি মদ মনুর বোতলে ঢালি, এবং তাই যুগসঞ্চিত সোমরস বলে পান করে তৃপ্তিও লাভ করি মোহও প্রাপ্ত হই। কিন্তু এই ঢালাঢলি এবং ঢলাঢলিরও একটা সীমা আছে। বিস্‌মার্কের জর্মান মদ ব্রাহ্মণের যজ্ঞের চমসে ঢালতে গেলে আমরা সে সীমা পেরিয়ে যাই। ও-হাতায় এ-জিনিস কিছুতেই ধরবে না। ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে আমরা ব্রাহ্মণসাহিত্যের আধিদৈবিক ব্যাপার -সকলের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করতে পারি, এবং চাই কি তাতে কৃতকার্যও হতে পারি; কিন্তু শুধু ইংরেজি শিক্ষা নয় তদুপরি ইংরেজি ভাষার সাহায্যেও তার ‘আধিরাষ্ট্রিক’ ব্যাখ্যা করতে পারি নে।

 

৫.

এতদিন প্রাচীন ভারতের নাম উল্লেখ করবামাত্রই বর্ণাশ্রমধর্ম, ধ্যান-ধারণা নিদিধ্যাসন–এই-সকল কথাই আমাদের স্মরণপথে উদিত হত, এবং বঙ্গ সাহিত্যে তারই গুণকীর্তন করে আমরা যশ ও খ্যাতি লাভ করতুম। ইমপরিয়লিজম নামক আহেলবিলাতি পদার্থ পুরাকালে এদেশে ছিল, এরূপ কথা পূর্বে কেউ বললে তার উপর আমরা খড়্গহস্ত হয়ে উঠতুম, কেননা ওরূপ কথা আমাদের দেশভক্তিতে আঘাত করত। বৈরাগ্যের দেশ ঐহিক ঐশ্বর্যের স্পর্শে কলুষিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ যে নবদেশভক্তি ঐ ইমপীরিয়লিজমের উপর এত ঝুকেছে, তার একমাত্র কারণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আবিষ্কার। উক্ত গ্রন্থ থেকেই আমরা এই জ্ঞান লাভ করেছি যে, ইউরোপীয় রাজনীতির যা শেষ কথা ভারতবর্ষের রাজনীতির তাই প্রথম কথা। এই সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করে আমাদের চোখ এতই ঝলসে গেছে যে, আমরা সকল তন্ত্রে সকল মাত্রে ঐ সাম্রাজ্যেরই প্রতিরূপ দেখছি। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমাদের চোখ যখন আবার প্রকৃতিস্থ হবে তখন আমরা এই প্রাচীন ইমপীরিয়লিজমকেও খুঁটিয়ে দেখতে পারব এবং কৌটিল্যকেও জেরা করতে শিখব। ইতিমধ্যে এই কথাটি আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, চন্দ্রগুপ্ত রাজনীতির ক্ষেত্রে যে মহাভারত রচনা করেছিলেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র শুধু তারই ভাষ্য। যে মনোভাবের উপর সে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে মনোভাব বৈদিক নয়, সম্ভব আর্যও নয়। মন, প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় যে, উক্ত অর্থশাস্ত্রকারের মানসিক প্রকৃতি এবং ধর্মশাস্ত্রকারদের প্রকৃতি এক নয়। সে পার্থক্য যে কোথায় ও কতখানি তা আমি একটিমাত্র উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়ে দেব।

সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম শব্দের অর্থ law, এবং শাস্ত্রকারদের মতে ল-এর মূল হচ্ছে বেদ স্মৃতি সদাচার ও আত্মতুষ্টি। রাজশাসন অর্থাৎ লেজিসলেশন যে ধর্মের মূল হতে পারে, এ কথা ধর্মশাস্ত্রে স্বীকৃত হয় নি। রাজা ধর্মের রক্ষক, স্রষ্টা নন। অপর পক্ষে কৌটিল্যের মতে রাজশাসন সকল ধর্মের উপরে। এ কথা বৈদিক ব্রাহ্মণ কখনোই মেনে নেন নি, কেননা তাঁদের মতে ধর্মের মূল হচ্ছে বেদ; অতএব ধর্ম অপৌরুষেয়। তার পরে আসে স্মৃতি, অর্থাৎ আর্যঋষিদের স্মৃতি; তার পর সদাচার, অর্থাৎ আর্যদের কুলাচার; তার পর আত্মতুষ্টি, অর্থাৎ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের আত্মতুষ্টি। এক কথায় ধর্মশাস্ত্রের মতে ‘পারম্পর্ষক্রমাগত’ আর্য-আচারই একমাত্র এবং সমগ্র ল। যাঁরা এরূপ মনোভাব পোষণ করতেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং চাণক্য কর্তৃক ব্যাখ্যাত রাজনীতি কখনোই স্বচ্ছন্দমনে গ্রাহ্য করতেন না। সম্ভবত এই কারণেই চাণক্য নিজে ব্রাহ্মণ হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে হিংসা প্রতিহিংসা ক্রোধ দ্বেষ ক্রূরতা ও কুটিলতার অবতার-স্বরূপ বর্ণিত হয়েছেন, এবং একই কারণে ব্রাহ্মণসমাজে তাঁর অনাদৃত গ্রন্থ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম এবং সেইসঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সকল কারণ আমরা অবগত নই। যখন সে ইতিহাস আবিষ্কৃত হবে, তখন সম্ভবত আমরা দেখতে পাব যে, এ ধংসব্যাপারে বৈদিক ব্রাহ্মণের যথেষ্ট হাত ছিল।

এ কথা বোধ হয় নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, ভারতবাসী আর্যদের কৃতিত্ব সাম্রাজ্যগঠনে নয়, সমাজগঠনে; এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় শিল্পে-বাণিজ্যে নয়, চিন্তার রাজ্যে। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে ‘পৃথিবীর সর্বমানব’কে আর্য-আচার শিক্ষা দেওয়া এবং সেই আচারের সাহায্যে সমগ্র ভারতবাসীকে একসমাজভুক্ত করাই ছিল তাঁদের জীবনের ব্রত। তার ফলে, হিন্দুসমাজের যা-কিছু গঠন আছে তা আর্যদের গুণে, এবং যা-কিছু জড়তা আছে তাও তাঁদের দোষে। এই বিরাট সমাজের ভিতর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও প্রভুত্ব রক্ষা করবার জন্য তাঁরা যে দুর্গ গঠন করেছিলেন, তাই আজ আমাদের কারাগার হয়েছে। দর্শনে বিজ্ঞানে কাব্যে অলংকারে অভিধানে ব্যাকরণে তাঁদের অপূর্ব কীর্তি, যে ভাষার তুলনা জগতে নেই সেই সংস্কৃত ভাষায়, অক্ষয় হয়ে রয়েছে। এ দেশের প্রাচীন আর্যেরা যে সাম্রাজ্যের চাইতে সমাজকে, এবং সমাজের চাইতেও মানুষের আত্মাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, তার জন্য সমাজের লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই; কারণ বর্তমানে ইউরোপের মনেও এ ধারণা হয়েছে যে, political problemsএর অপেক্ষা social problemsএর মূল্য কিছু কম নয়। এবং শাসনযন্ত্রের চাইতে মানুষের মুল্য ঢের বেশি।

আষাঢ় ১৩২১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *