সাহিত্য
ভাষার কথা
ভারতবর্ষ
সমাজ
বিচিত্র

অনু-হিন্দুস্থান

অনু-হিন্দুস্থান
[কোনো পারিবারিক সমিতিতে পঠিত]

হে সমিতির কুমারগণ, আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস যে হিন্দুস্থানের বাইরে হিন্দুর আর স্থান নেই। এ বিশ্বাস সর্বসাধারণ। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই ধারণা যে, হিন্দুধর্ম ও হিন্দুজাতি আছে শুধু জিয়োগ্রাফিতে—যাকে বলে ভারতবর্ষ তারই চতুঃসীমার মধ্যে।

আমরা সকলেই দেখতে পাই, ভারতবর্ষের পশ্চিমে রয়েছে মুসলমান, উত্তরেও তাই, পূর্বে বৌদ্ধ, আর দক্ষিণে সমুদ্র। আর সমুদ্রের ওপারে যদি কোনো দেশ থাকে তো সে দেশে হিন্দুজাত কখনো যায় নি; আর যদি কখনো গিয়ে থাকে তো তখনই তাদের হিন্দুত্ব মারা গিয়েছে। কেননা একালে হিন্দুজাতির সমুদ্রযাত্রার অর্থ তার গঙ্গাযাত্রা।

এ ধারণা শিক্ষিতলোকসামান্য হলেও, অশিক্ষিত ধারণা। ইংরেজি শিক্ষার চশমা পরলে আমাদের বর্তমান জাতীয় দৈন্য ও হীনতা সম্বন্ধে আমাদের চোখ যেমন ফোটে, আমাদের জাতীয় পূর্বগৌরব ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে আমরা তেমনি অন্ধ হই। আমাদের নতুন শিক্ষা এসেছে পশ্চিম থেকে। এর ফলে আমরা পূর্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ–পূর্বকাল সম্বন্ধেও, পূর্বদিক সম্বন্ধেও। ভারতবর্ষের পূর্বকালের হিস্টরির সঙ্গে আমাদের যদি কিছুমাত্র পরিচয় থাকত তা হলে আমরা জানতুম যে, ভারতবর্ষের পূর্বের অনেক দেশেও অনেককাল ধরে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু,জাতি রাজত্ব করেছে। আজকাল অনেকে যাকে ভারতবর্ষের অতীত বলে চালিয়ে দিতে চান, তা কোনো দেশেরই অতীত নয়, ভারতবর্ষের তো নয়ই। বেশির ভাগ লোকের মতে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ যেমন ইউরোপের বর্তমান, জনকতক লোকের মতে ভারতবর্ষের অতীতও তেমনি ইউরোপের বর্তমান। আমাদের কল্পনার দৌড়ও বিলেত পর্যন্ত।

আমাদের শাস্ত্রকাররা বলেন লোকের নাম থেকে দেশের নাম হয়, দেশের নাম থেকে লোকের নাম হয় না। যথা, আর্যরা বাস করতেন বলেই আধখানা ভারতবর্ষের নাম হয়েছিল আর্যবর্ত; আর আর্যরা যদি অপর কোনো দেশে গিয়ে বাস করেন, তা হলে সে দেশের নামও হবে আর্যাবর্ত। এই হিসেবে ভারতবর্ষ ও চীনের ভিতর যে-সব দেশ আছে, সে-সব ভূভাগকে উপ-হিন্দুস্থান বলা অন্যায় নয়। যাক সেসব পরোনো কথা। তোমরা শুনে আশ্চর্য হবে যে, আজও এশিয়ার এক কোণে এমন একটি দেশ আছে, যেখানকার ষোলো-আনা অধিবাসী আজও হিন্দু। সেই দেশটির সঙ্গে তোমাদের চেনাপরিচয় করিয়ে দিতে চাই। সে পরিচয় করিয়ে দিতে বেশিক্ষণ লাগবে না। মাপে ও ম্যাপে ভারতবর্ষ যেমন বড়ো, সে দেশটি তেমনি ছোটো। ভারতবর্ষের তুলনায় সেটি তালের তুলনায় তিল যদ্রুপ, তদ্রুপ। এমন-কি, মানচিত্রেও সে দেশটি হঠাৎ কারো চোখে পড়ে না; অনেক খুঁজেপেতে সেটিকে বার করতে হয়। সেকালের উপ-হিন্দুস্থানের দক্ষিণে ম্যাপের গায়ে যে কতকগুলো কালির ছিটেফোঁটা দেখা যায়, তারই এক বিন্দু হচ্ছে এই বর্তমান অন-হিন্দুস্থান।

ও দেশের হিস্টরি তোমরা না জান, তার নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। এর নাম বলিদ্বীপ এবং এটি হচ্ছে যবদ্বীপ থেকে ভাঙা এক টুকরো খণ্ডদ্বীপ। ম্যাপে দেখতে পাওয়া যায় যে, জাভা সমুদ্রের মধ্যে পশ্চিমে মাথা করে পুর্বে পা ছড়িয়ে অনন্তশয্যায় শুয়ে রয়েছে; আর তার পায়ের গোঁড়ায় পুটলি পাকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে–বলি। এ দুটি দ্বীপকে যদি খাড়া করে তোলা যায়—অর্থাৎ তাদের মাথা যদি পশ্চিম থেকে উত্তরে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, আর পা পর্ব থেকে দক্ষিণে–তা হলে ভারতবর্ষের নীচে লঙ্কা যেমন দেখায়, জাভার নীচে বলিও তেমনি দেখাবে। এ কথাটা এখানে বলে রাখছি এইজন্যে যে, সিংহলের পূর্ব-ইতিহাস যেমন ভারতবর্ষের পূর্ব-ইতিহাসের একটা ছেঁড়াপাতা মাত্র, বলির ইতিহাসও তেমনি জাভার ইতিহাসের একটি ছিন্নপত্র।

জাভা ও বলির মধ্যে যে সমুদ্রের ব্যবধান আছে, সে অতি সামান্য। সে শাখাসমুদ্রটুকু মাইল দেড়েকের বেশি চওড়া নয়, অর্থাৎ চাঁদপুরের নীচে মেঘনার তুল্য। বলিদ্বীপ কতটা লম্বা আর কতটা চওড়া তা শুনলে তোমরা হাসবে। বলি দৈঘ্যে ৯৩ মাইল ও প্রস্থে মোটে ৫০ মাইল; তাও আবার সমস্তটা সমতলভূমি নয়। এই ছোট্ট দেশের মধ্যে বহুসংখ্যক হ্রদ আছে, আর সে-সব হ্রদ এত গভীর যে, তাদের অতলস্পর্শী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তার উপর একটি একটানা পর্বতশ্রেণীর দ্বারা দেশটি দু ভাগে বিভক্ত। দেশ ছোটো, কিন্তু তার পর্বত যেমন লম্বা তেমনি উঁচু; অর্থাৎ ও হচ্ছে একরকম বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। সে পর্বতের উচ্চতা কোথায়ও সাড়ে তিন হাজার ফুটের কম নয়, কোথাও-বা তা দশ হাজার ফট পর্যন্ত মাথা তুলেছে। এ পর্বত বলিদেশকে উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথে ভাগ করেছে–ভারতবর্ষের নকলে।

তোমরা হয়তো মনে ভাববে যে এই দেশেরই ইংরেজি নাম হচ্ছে লিলিপুট, কিন্তু তা নয়। গালিভার লিলিপুট-দেশের লোকের যে বর্ণনা করেছেন, তার সঙ্গে বলির অধিবাসীর চেহারার কোনো মিল নেই। এরা আকারে জাভার লোকের চেয়ে ঢের বেশি দীর্ঘাকৃতি ও বলিষ্ঠ। দেশ ছোটো হলে সেখানকার মানুষ যে বড়ো হয়, তা অন্যত্রও দেখা যায়। ইউরোপের ভিতর ইংলণ্ড সবচেয়ে ছোটো দেশ; কিন্তু এ দেশের মতো বড়োলোক ও-ভূভাগে অন্য কুত্রাপি মেলে না। অপর পক্ষে, অতি ক্ষুদ্র লোকের সাক্ষাৎ শুধু মহাদেশেই মেলে। বামনের জাত শুধু আফ্রিকাতেই আছে। গালিভার বলিদ্বীপে না গেলেও সিন্ধুবাদ যে সে দেশে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ, যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার কাঁধে ভর করেছিলেন, তিনি ছিলেন বলীয়ান।

বলির লোক শুধু বলিষ্ঠ নয়, অত্যন্ত কমিষ্ঠ। চাষবাসে তারা অতিশয় দক্ষ। তারা হাল-চালনা ছাড়া হাতের আরো অনেক কাজ করে। তারা চমৎকার কাপড় বোনে ও চমৎকার অস্ত্র বানায়। তাদের তুল্য তাঁতি ও কামার জাভায় পাওয়া যায় না। অন্ন বস্ত্র ও অস্ত্রের সংস্থান যে দেশে আছে, সে দেশে একালের আদর্শ সভ্যতার কোন উপকরণ নেই? আর শৌখিন অশনসনের ব্যবস্থাতেও বলি বঞ্চিত নয়। সে দেশে কফি জন্মায় আর তামাক জন্মায়। আর এ দুই তারা পান করে; একটা তাতিয়ে জল করে, আর-একটা পুড়িয়ে ধোঁয়া করে—যেমন আমরা করি। বলির লোক রেশমের কাপড়ও বোনে আর তা রঙাবার জন্য নীলের চাষও করে। সোনা দিয়ে তারা গহনা গড়ায় ও জরি বানায়। গহনা গড়তে ও জরির কাজ করতে তারা অদ্বিতীয় ওস্তাদ।

বলির ভাষা জাভার ভাষারই অনুরূপ। তবে ইতালির ভাষার সঙ্গে ফরাসি ভাষার যে প্রভেদ, যবীয় ভাষার সঙ্গে বলীয় ভাষার সেই প্রভেদ। এ দেশের সাহিত্যের ভাষার নাম ‘কবি’, ‘সাধু’ নয়। পাঁচশো বৎসর পূর্বে জাভার সাহিত্য কবি-ভাষাতেই লেখা হত। এ ভাষার অনেক শব্দ সংস্কৃত। এ যুগে জাভার লোক তাদের সাহিত্যের ভাষা বড়ো-একটা বুঝতে পারে না—কিন্তু বলির লোকের কাছে কবি মৃত নয়। চারশো বৎসর আগে জাভার লোক সব মুসলমান হয়ে যায়। সম্ভবত সেইজন্য তারা তাদের পূর্ব কবি-ভাষা ভুলে গিয়েছে; আর বলির লোক আজও হিন্দু, রয়েছে বলে কবির পঠনপাঠন সে দেশে আজও চলছে।

জাভার যথার্থ নাম যে যবদ্বীপ, তা তোমরা সবাই জান। সংস্কৃত যব শব্দের অন্তস্থ য আরবদেশের মুসলমানদের মুখে বর্গীয় জ-এ ও ব ভ-এ পরিণত হয়ে তদুপরি অকার আকার হয়ে জাভা রূপ ধারণ করেছে।

এই সংস্কৃত নাম থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, পুরাকালে ও-দ্বীপের নামকরণ করেছিল হিন্দুরা। এখন তোমরা জিজ্ঞাসা করতে পার, কবে হিন্দুরা এ দ্বীপ আবিষ্কার করে। এর উত্তর দেওয়া অসম্ভব। তবে যেকালে এ দেশে রামায়ণ লেখা হয়, সেকালে যবদ্বীপ যে হিন্দুদের কাছে উক্ত নামেই পরিচিত ছিল তার প্রমাণ রামায়ণেই আছে। আর সে বড়ো কম দিনের কথা নয়। তোমরা সবাই জান যে, রামায়ণ রাম জন্মাবার ষাট হাজার বৎসর আগে লেখা হয়েছিল; আর রাম জন্মেছিলেন ত্রেতা যুগে।

শ্রীমৎ হনুমানকে যখন দেশদেশান্তরে সীতাকে অন্বেষণ করতে আদেশ দেওয়া হয়, তখন তাকে বলা হয়—

গিরিভির্যে চ গম্যন্তে প্লবনেন প্লবেন চ।
রত্নবন্তং যবদ্বীপং সপ্তরাজ্যোপশোভিতম।।
সুবৰ্ণরূপ্যকং চৈব সুবর্ণাকরমণ্ডিতম।
যবদ্বীপমতিক্রম্য শিশিরো নাম পর্বতঃ।
দিবং স্পৃশতি শৃঙ্গেন দেবদানবসেবিতঃ।

এ যবদ্বীপ যে বর্তমান জাভা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা সেখানে যেতে হত প্লবনেন প্লবেন চ-অর্থাৎ হয় লাফিয়ে, নয় সাঁতরে, নয় ভেলায় চড়ে। কিষ্কিন্ধ্যা থেকে লঙ্কায় এক লম্ফে যাওয়া সোজা, কারণ এক লম্ফে তা যাওয়া যায়। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে বলি যেতে হলে অসম্ভব হাই জাম্প ও লং জাম্প একসঙ্গে দুই চাই। আর বঙ্গ-উপসাগর তো ইংলিশ চ্যানেল নয় যে, সাঁতরে পার হওয়া যায়। সুতরাং ও দেশে ভেলায় চড়েই যেতে হত। যবদ্বীপ রত্নবন্ত ও সোনারূপোর দেশ আর সোনার খনিতে মণ্ডিত। কোনো কোনো ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেন, এ দেশ জাভা নয়, সুমাত্রা। কেননা সোনার খনি জাভায় নেই ও কোনো কালে ছিল না–ছিল ও আছে শুধু সুমাত্রায়। অপর আর-এক দল বলেন যে, যবদ্বীপ জাভাই, সুমাত্রা নয়। কিন্তু আসল কথা এই যে, সেকালে হিন্দুদের কাছে জাভা ও সুমাত্রা উভয় দ্বীপই যবদ্বীপ বলে পরিচিত ছিল। সুমাত্রা পরে স্বর্ণদ্বীপ সুবর্ণদ্বীপ প্রভৃতি নাম ধারণ করে। সুমাত্রা নাম পুরোনো নয়। স্বর্ণদ্বীপে সমুদ্র বলে একটি নগর ছিল। সেই সমুদ্রই আরবি জবানে রুপান্তরিত হয়ে সুমাত্রা হয়েছে, এবং এই নতুন নামেই ও-দ্বীপ ইউরোপীয়দের কাছে পরিচিত, আর একালের জিয়োগ্রাফিতে প্রসিদ্ধ।

ইউরোপীয় পণ্ডিতরা বলেন যে, প্রাচীন হিন্দুদের ভূগোলের জ্ঞানের দৌড় ঐ যবদ্বীপ পর্যন্ত ছিল। তার পূর্বে যে আর-কোনো দেশ আছে, তা তাঁরা জানতেন না। তাই তাঁরা যবদ্বীপ অতিক্রম করে যে শিশির-পর্বতের উল্লেখ করেছেন, সে পর্বত তাঁদের ষোলো-আনা মনগড়া। আমি প্রথমত ইউরোপীয় নই, দ্বিতীয়ত পণ্ডিত নই; সুতরাং তাঁদের কথা আমি নতমস্তকে মেনে নিতে বাধ্য নই।

যবদ্বীপ অতিক্রম করে যে দ্বীপটি পাওয়া যায়, তার নাম বলিদ্বীপ; এবং তার অন্তরে যে পর্বত আছে, সে পর্বতকে শিশির বলা ছেরেফ কবিকল্পনা নয়। কেননা যার এক-একটি শৃঙ্গ দশ হাজার ফটের চেয়েও উঁচু, সে পর্বতকে কিছুতেই গ্রীষ্মপর্বত বলা যায় না, যদি কিছু বলতে হয় তো শিশির বলাই সংগত। শুনতে পাই উক্ত দ্বীপপুঞ্জ চিরবসন্তের দেশ। সুতরাং সে দেশের পাহাড়ে শীত হবারই কথা। আর সে পর্বত দেবদানব-সেবিত বলবার অর্থ সেখানে মানুষের বসতি নেই। হনুমানকে সীতার খোঁজে আরো অনেক স্থানে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে-সব দেশ যে রূপকথার দেশ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে দেশে মানুষের কান হাতির কানের মতো বড়ো, ও যে দেশে মানুষের কান উটের কানের মতো ছোটো, আর যে দেশে মানুষের পা দুটো নয়, একটা মাত্র, অথচ সেই এক পায়ে তারা খুব ফুর্তি করে চলে, সে-সব দেশেও হনুমানকে ভ্রাম্যমাণ হবার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ-সব দেশের কোনো নাম বলা হয় নি। এর থেকেই স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, যে-সব দেশের নাম হিন্দুরা জানত না, সেই-সব দেশ সম্বন্ধে তাদের কল্পনা খেলত। যে দেশের নাম তারা জানত, সে দেশের রূপও তারা চিনত।

সে যাই হোক, বলিদ্বীপের নাম যখন সংস্কৃত, তখন সে নামকরণ যে হিন্দুরাই করেছিলেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। আর খৃস্টজন্মের পূর্বেও যে হিন্দুরা বলিদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, তারও কিছু কিঞ্চিৎ প্রমাণ আছে।

এই দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ-স্থাপন হিন্দুজাতির ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। সে ইতিহাস আমি আজ তোমাদের শোনাব না; কারণ সে মস্ত লম্বা ইতিহাস। হিন্দু জাতির মহা গৌরবের কথা এই যে, হিন্দুরা এই দ্বীপবাসী অসভ্য জাতদের সভ্য করে তুলেছিলেন। এ দেশের লোক পূর্বে যে কিরকম যোর অসভ্য ও ভীষণপ্রকৃতির লোক ছিল, তা রামায়ণে দ্বীপবাসীদের বর্ণনা থেকেই অনুমান করা যায়। তারা ছিল ‘আমমীনাশনাঃ’ অর্থাৎ তারা কাঁচা মাছ খেত। তাতে কিছু যায় আসে না; কেননা সুসভ্য জাপানিরা আজও তাই খায়। বাল্মীকি শুনেছিলেন যে, তারা ‘অন্তর্জলচরা ঘোরা নরব্যাঘ্রাঃ’। নরশার্দূল অবশ্য আমরা বীরপুরুষদেরই বলি, কিন্তু নরব্যাঘ্র বলতে বীরপুরুষ বোঝায় না, বোঝায় সেই জাতীয় পুরুষদের, যারা ‘অক্ষয়া বলবন্ত পুরুষা পুরুষাদকা’–ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যানিবলস। এই হেমাঙ্গ কিরাতের দল ছিল সব ক্যালিবনের দাদা ক্যানিবল।

শ্রীবিজয়রাজ্যের অর্থাৎ সুমাত্রার ইতিহাস-লেখক জনৈক ফরাসি পণ্ডিত বলেছেন যে আমরা পুরোনো দলিলপত্র থেকে প্রমাণ পেয়েছি যে, ভারত-মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ পুরাকালে এক নব সভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। যেমন কম্বোজের (ক্যাম্বোডিয়া) ও চম্পার (আনাম-কোচিনচায়না) তেমনি এ দেশেরও Alma Mater ভারতবর্ষ বহুকাল পূর্বে তার দেবতা, তার শিল্পকলা, তার ভাষা, তার সাহিত্য, সংক্ষেপে তার সভ্যতার সকল মহামূল্য উপকরণ এই দ্বীপবাসীদের সানন্দে দান করেছিল, এবং সহস্র বৎসরের অধিককাল ধরে এই দ্বীপবাসীরা সমগ্র হিন্দু-সভ্যতা ভক্তিভরে শিক্ষা ও আয়ত্ত করে তাদের হিন্দুগুরুদের গৌরবান্বিত করেছিল।

একটি সভ্য জাতি একটি অসভ্য জাতিকে নিজের ধর্ম আর্ট ও সাহিত্যের চেয়ে বড়ো আর কোন মহামুল্য বস্তু দান করতে পারে!

প্রসিদ্ধ চীন-পরিব্রাজক ই-চিং খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে স্বদেশে ফেরবার পথে সুমাত্রার অন্তর্গত শ্রীবিজয়রাজ্যে কিছুকাল বাস করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখে গিয়েছেন যে—

শ্রীবিজয়ের বৌদ্ধ-পণ্ডিতরা ভারতবর্ষের মধ্যদেশের পণ্ডিতদের মত সমগ্ৰ সংস্কৃত শাস্ত্র চর্চা করেন, ও তাঁদের ক্রিয়াকলাপ আচার-বিচার মধ্যদেশের ক্রিয়াকলাপ আচার-বিচারের সম্পূর্ণ অনুরূপ। সুতরাং ভবিষ্যতে চীন-পরিব্রাজকরা যেন প্রথমে শ্রীবিজয়ে এসে সংস্কৃত শিক্ষা করেন পরে ভারতবর্ষে যান।

আমরা যেমন আগে গোলদিঘির পণ্ডিতদের কাছে ইংরেজি শিক্ষা করে পরে বিলেত যাই।

ই-চিংয়ের পরামর্শ অনুসারে তাঁর পরবর্তী বহু চীনদেশীয় পরিব্রাজক সংস্কৃত সাহিত্য শিক্ষা করবার জন্য যবদ্বীপ ও শ্রীবিজয়ে গিয়েছিলেন। এখানে একটি কথা বলে রাখি। যবদ্বীপে প্রথমত হিন্দুধর্ম প্রচলিত ছিল, পরে সে দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। কিন্তু যবদ্বীপে এ দুই ধর্ম পৃথক ছিল না, দুয়ে মিলে একই ধর্ম হয়। বুদ্ধ সে দেশে শিববুদ্ধ নামেই পরিচিত। এ দেশে বুদ্ধদেব বিষ্ণর অবতার হিসেবেই গণ্য; কিন্তু সে দেশে শিবে ও বুদ্ধে সমান হয়ে গিয়েছিল। সেকালে হিন্দুরা যে অপর দেশের লোককে সভ্য করেছিল, এ কথা বিশ্বাস করা দূরে থাক, এ যুগের আমরা তা কল্পনাও করতে পারি নে; কারণ এখন অপর দেশের লোক আমাদের সভ্য করছে, আর তাদের সভ্যতা আমরা সকল তনু মন ধন দিয়ে মুখস্থ করতে এতই ব্যস্ত যে, ভারতবর্ষ যে এককালে সভ্য ছিল সে কথা আমাদের মনে স্থান পায় না, পায় শুধু মুখে।

সুতরাং ভারতবর্ষের কোন প্রদেশের লোক যবদ্বীপে গিয়ে বসতি করে, এ প্রশ্ন তোমাদের মনে উদয় হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রমাণের চেয়ে অনুমানের উপর বেশি নির্ভর করতে হয়; অর্থাৎ অন্ধকারে ঢিল মারতে হয়। ঐতিহাসিকরা সে ঢিল দেদার মেরেছেন, কিন্তু তার একটাও যে ঠিক লোকের গায়ে গিয়ে পড়েছে, এমন কথা জোর করে বলা যায় না।

তবে এটুকু ভরসা করে বলা যায় যে, তারা আর যে জাতই হোক, মাদ্রাজি নয়। যে উত্তরাপথের লোক দক্ষিণাপথকে সভ্য করেছে, খুব সম্ভবত তারাই ঐ দ্বীপবাসীদেরও সভ্য করেছে। যবদ্বীপে যে মহাভারতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তা উত্তরাপথে যে মহাভারত প্রচলিত ছিল, তারই অনুবাদ।

কোথায় ভারতবর্ষের উত্তরাপথ আর কোথায় মহাসাগর, সুতরাং তাঁরা কোন বন্দর থেকে মহাসমুদ্রে অবতরণ করলেন? খুব সম্ভবত তাঁরা মসলিপত্তনে গিয়ে জাহাজে চড়েছিলেন। আর গুজরাটের Broach নগর থেকে মসলিপত্তন পর্যন্ত যে একটি স্থলপথ ছিল, তারও প্রমাণ আছে। সুতরাং এরূপ অনুমান করা অসংগত নয় যে, আর্যাবর্তের আর্যরাই এই সভ্যতা-প্রচারকার্যে ব্রতী হয়েছিলেন। মন, বলেছেন যে, আর্যদের আচারই একমাত্র সাধু আচার, অতএব তা ‘শিক্ষেরন, পৃথিব্যাং সর্বমানবাঃ’। এ কথার ভিতর মস্ত একটা গর্ব আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে উদারতা আর মহত্ত্ব। দক্ষিণাপথের তামিলরাও সুমাত্রা জয় করতে গিয়েছিল, কিন্তু সে বহুকাল পরে—খৃস্টীয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে। তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল শ্রীবিজয়রাজ্য বিজয় করে তাকে শ্রীভ্রষ্ট করা। বলিদ্বীপের কথা বলতে গিয়ে যবদ্বীপের বিষয় দু কথা বলোম এইজন্য যে, সেকালের যবদ্বীপের হিন্দুধর্ম একালে বলিদ্বীপে মজুত রয়েছে।

রামায়ণের যুগে যবদ্বীপ সপ্তরাজ্যে উপশোভিত ছিল; কিন্তু খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে সে দেশে তিনটি মাত্র রাজ্য ছিল। খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে যবদ্বীপের হিন্দুরাজ্যের যখন ধংস হয় ও সে দেশের লোকে মুসলমানধর্ম অবলম্বন করে, তখন এক দল লোক স্বধর্ম রক্ষা করবার জন্য যবদ্বীপ থেকে পালিয়ে বলিদ্বীপে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদেরই বংশধরেরা এখন বলির অধিবাসী। আর এই ক্ষুদ্র দ্বীপবাসীরাই আজ পর্যন্ত তাদের স্বধর্ম ও স্বরাজ্য দুই রক্ষা করে আসছে। হিন্দু হলেই পরাধীন হতে হবে, বিধির যে এমন-কোনো নিয়ম নেই, তার তিলমাত্র প্রমাণ ঐ দেশেই আছে। বলিদ্বীপ স্বাধীন, কিন্তু যে হিসাবে জাপান স্বাধীন সে হিসাবে নয়; যে হিসাবে নেপাল স্বাধীন সেই হিসাবে, এবং একই কারণে হিন্দুস্থানের ইতিহাসের ধারা এই যে, সে দেশ প্রথমে মুসলমানের অধীন হয়, ও পরে খৃস্টানের। নেপাল ও বলি আগে মুসলমানের অধীন হয় নি, কাজেই তা আজ খৃস্টানের অধীন হয় নি।

বলিদ্বীপ একরত্তি দেশ হলেও কোনো একটি রাজার রাজ্য নয়, এই একশো মাইল লম্বা ও পঞ্চাশ মাইল চওড়া দেশ অট রাজ্যে উপশোভিত। আর এই আটটি ভাগের আটটি পৃথক রাজা আছে। এর থেকেই বুঝতে পারছ, এ দেশে যা আছে তা পুরোমাত্রায় হিন্দুরাজ্য। ভারতবর্ষও হিন্দুযুগে হাজার পৃথক রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ দেশে যে দু জন একচ্ছত্র রাজত্ব করে গিয়েছেন, তাঁরা হিন্দু নন। অশোক ছিলেন বৌদ্ধ, আর আকবর মোগল। এক রাজ্যের প্রজা না হলে এক দেশের লোক যে এক নেশন হতে পারে না, এ হচ্ছে ইউরোপের হাল মত। হিন্দুরা প্রাচীন যুগে যদি এক নেশন হয়ে থাকে তো সে এক ধর্মের বন্ধনে। অষ্ট রাজ্যে বিভক্ত হলেও বলির অধিবাসীরা এক নেশন—এক ধর্মাবলম্বী বলে। ইউরোপে একালে নেশন গড়ে রাজায়; আর এ দেশে সেকালে গড়ত দেবতায়। পশ্চিমের সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে রাজনীতি, আর পূর্বের সবচেয়ে বড়ো কথা ছিল ধর্মনীতি।

যেমন রাজ্যের ব্যবস্থায়, তেমনি সমাজেও তারা পুরো হিন্দু। তারা এক জাতি হলেও পাঁচ জাতে বিভক্ত। এ পাঁচ জাত হচ্ছে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ও চণ্ডাল। এ পাঁচ জাত পরস্পর বিবাহাদি করে না। পূর্বে অসবর্ণ বিবাহের শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। গীতায় ভয় দেখিয়েছে যে, এ করলে ও হবে, ও হলে তা হবে, আর তা হলেই হবে বর্ণসংকর, তার পরেই প্রলয়। বলির হিন্দুসমাজ বোধ হয় গীতার মতেই চলে। আর প্রাণদণ্ডটাও বোধ হয় দেওয়া হত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় অনুসারে। যদি কোনো ঘাতক কারো প্রাণ বধ করতে ইতস্তত করত তা হলে তাকে সম্ভবত বলা হত–

ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বা উত্তিষ্ঠ পরন্তপঃ।

আমরা সকলেই যখন ব্রহ্ম তখন কে কাকে মারে, আর কেই-বা মরে। কিন্তু এতটা নির্জলা হিঁদুয়ানি এ যুগে চলে না। কারণ এ যুগের লোকের যখন-তখন মরতে ঘোর আপত্তি আছে, কিন্তু যাকে-তাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তাই এখন নিয়ম হয়েছে যে, অসবর্ণ বিবাহ করলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যার বর্ণ নিম্ন, অপর পক্ষও সেই বর্ণভূত হয়ে যাবে। অর্থাৎ জাতিভেদের কাঠামো বজায় থাকবে, কিন্তু লোকের এক বর্ণ ত্যাগ করে আর-এক বর্ণে ভর্তি হবার স্বাধীনতাও থাকবে। স্কুলের ছেলেরা যেমন পড়া মুখস্থ না দিতে পারলে উপরের ক্লাস থেকে নীচের ক্লাসে নেমে যায়, বলির লোকেরাও তেমনি অসবর্ণ বিবাহের ফলে উলটো প্রমোশন পায়।

কিছুদিন পূর্বে বলিদ্বীপে সতীদাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন সে প্রথা উঠে গিয়েছে। এখন সতী যায় শুধু রাজার ঝি-বৌরা। এর কারণ বোধ হয় রাজারা অবলাদের আঁচল না ধরে স্বর্গেও যেতে পারে না। সে যাই হোক, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বেন্টিক সাহেব এ দেশে না এলেও এতদিনে হিন্দুসমাজে সতীদাহ প্রথা উঠে যেত, ছেরেপ কালের গুণে।

বিবাহের পর আসে অবশ্য আহারের কথা। বলীয়ানরা কি খায় তা জানি নে, কিন্তু তারা গো-মাংস ভক্ষণ করে না, এমন-কি, বলিদ্বীপে গোহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা কিন্তু শুয়োর নিত্য খায়, তবে তাতে তাদের হিন্দুত্ব নষ্ট হয় না। সে দেশে সকল বরাহই বন্যবরাহ, কারণ দেশটাই হচ্ছে বুনো দেশ।

তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় দু কথায় দিই। ভারতবর্ষের সব দেবতা বলিবীপে গিয়ে জুটেছেন। এমন-কি, কার্তিক সমুদ্রলঙ্ঘন করেছেন ময়ুরে চড়ে, আর গণেশ ইঁদুরে চড়ে। ইঁদুর যে পিঁপড়ের মতো চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে, তা বোধ হয় তোমরা সবাই জান, কারণ ছেলেরা চিরকালই মেয়েদের কাছে শুনে আসছে যে, পিঁপড়ে খেলে সাঁতার শেখা যায়।

কিন্তু সেখানকার মহাদেব হচ্ছেন কাল, আর মহাদেবী দুর্গা। বলিদ্বীপের দুর্গাপূজা নৈমিত্তিক নয়, নিত্য। বলিদ্বীপের অধিবাসীরা বৌদ্ধও নয়, বৈষ্ণবও নয়। ওসব ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের প্রধান ব্যাবসা-অস্ত্রের ব্যাবসা—যে মারা যায়। আর বাকি থাকে শুধু বস্ত্রের ব্যাবসা। একমাত্র বস্ত্রের সাহায্যে স্বরাজ হয়তো লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু রক্ষা করা যায় না।

বলিদ্বীপের অধিবাসীদের আচার-ব্যবহার, দেবদেবতার সংক্ষেপে যে পরিচয় দিলাম, তার থেকেই বুঝতে পারছ তারা যে হিন্দু, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। এমন-কি, যে-সব ইউরোপীয়ের সে দেশের সঙ্গে পরিচয় আছে, তাঁরা বলেন যে তাদের যদি কেউ অহিন্দু বলে, তা হলে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে।

বলিদ্বীপে যখন ব্রাহ্মণ আছে, তখন সে দেশে নিশ্চয় পণ্ডিতও আছে। এই পণ্ডিতদের নাম পেদণ্ড। বলির পণ্ডিতরা সংস্কৃত পণ্ডিতের অপভ্রংশ না হয়ে কি করে যে ইংরেজি pedantএর অপভ্রংশ হল, সে রহস্য আমি উদঘাটিত করতে পারি নে। তবে নামে বড়ো কিছু আসে যায় না। আমাদের দেশের পাণ্ডা, বিলেতের পেডাণ্ট ও বলির পেদণ্ড, সবাই একজাত; তিনজনই সমান মূর্খ। কৃত্তিবাসের রামায়ণে হনুমানকে বলা হয়েছে যে–

সর্বশাস্ত্র পড়ে বেটা হলি হতমূর্খ।

ইউরোপের পণ্ডিতেরা সর্বশাস্ত্র পড়ে পেডাণ্ট হয়, বলিদ্বীপের পণ্ডিতরা কোনো শাস্ত্র না পড়েই পেদণ্ড হয়; পূর্ব পশ্চিমের ভিতর এই যা প্রভেদ। আমরা পূর্ব, সুতরাং ‘অন্ত’ হবার চাইতে ‘অণ্ড’ হবার দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি।

এই কারণে আমার বলিদ্বীপে যাবার ভয়ংকর লোভ হয়, উক্ত দ্বীপে পেদণ্ডদের সঙ্গে শালোচনা করবার জন্য। এ দেশের পেদণ্ডদের কাছে শাস্যালোচনা ঢের শুনেছি, কিন্তু বলিদ্বীপের পেদণ্ডদের কাছে অনেক নূতন কথা শুনতে পাব বলে আশা আছে। সম্ভবত সে সবই পুরোনো কথা, কিন্তু এত পুরোনো যে, আমার কাছে তা সম্পূর্ণ নন বলে মনে হবে।

দুঃখের বিষয়, বলিদ্বীপে যাবার বল এ বয়েসে আমার আর নেই। কারণ সে দেশে যেতে হয় প্লবেন প্লবনেন চ। আশা করি, তোমরা যখন মানুষ হবে, তখন তোমরা কেউ কেউ ও-দেশে একবার হাওয়া বদলাতে যাবে, বিদেশে হিন্দু-সভ্যতার নয়, হিন্দু-অসভ্যতার নিদর্শন দেখতে। আমরা বিলেতি পলিটিকাল সভ্যতা যেরূপ তেড়ে মুখস্থ করছি, তাতে আশা করতে পারি যে তোমরা যখন বড়ো হবে, তখন এ দেশের শিক্ষিত লোক এই স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, হিন্দু-সভ্যতা অতি মারাত্মক অসভ্যতা। আর পূর্বে যে তা সংক্রামক ছিল, তার পরিচয় ঐ-সব দেশেই পাবে। ভবিষ্যতে তোমাদের হিন্দুধর্মের প্রতি যদি কিছুমাত্র মায়া নাও থাকে, তবু এথনলজির উপর মায়া তত বাড়বে। আর বলিদ্বীপের পেদণ্ডদের কাছে ও-বিজ্ঞানের সরু মোটা অনেক তত্ত্ব উদ্ধার করতে পারবে। পৃথিবীতে অসভ্য লোক না থাকলে এথনলজি অ্যানগ্রপলজি প্রভৃতি বিজ্ঞানের জন্ম হত না; যেমন পৃথিবীতে রোগ না থাকলে চিকিৎসাবিজ্ঞান জন্মাত না। সুতরাং আশা করি, আর কোনো কারণে না হোক, বিজ্ঞানের খাতিরেও বলীয়ানরা আর কিছুদিন তাদের অসভ্যতা রক্ষা করে বেঁচে থাকবে। তবে তাদের পাশে রয়েছে ওলন্দাজরা। তারা ইতিমধ্যে তাদের সভ্য না করে তোলে। আর ওলন্দাজি সভ্যতা আত্মসাৎ করতে পারলেই তার আমাদেরই মতো সভ্য হয়ে উঠবে। ইংরেজি সভ্যতার সঙ্গে ওলন্দাজি সভ্যতার শুধু সেইটুকু প্রভেদ, হুইসকি ও জিনএর ভিতর যে প্রভেদ। আসলে ওই এক। ও-দুয়ের নেশাই সমান ধরে। আর তার ফলে কারো দুর্বল দেহকে সবল করে না, শুধু সকলের সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে।

সে যাই হোক, এই ক্ষুদ্র দ্বীপ সম্বন্ধে তোমাদের কাছে এতক্ষণ ধরে যে বক্তৃতা করলাম, তার উদ্দেশ্য তোমাদের দ্বীপান্তর-গমনের প্রবৃত্তি উদ্রেক করা নয়, আমাদের পূর্ব-ইতিহাস সম্বন্ধে তোমাদের কৌতূহল উদ্রেক করা। নিজের দেশের অতীত সম্বন্ধে অজ্ঞ হওয়ায় কোনো লাভ নেই, কারণ যার অতীত অন্ধকার তার ভবিষ্যতও তাই-অর্থাৎ সেই জাতের, যার অতীত বলে একটা কাল ছিল।

বৈশাখ ১৩৩৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *