প্রত্নতত্ত্বের পারশ্য-উপন্যাস
ভারতবর্ষের যে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সেবিষয়ে বিদেশীর দল ও স্বদেশীর দল উভয়েই একমত। আমাদের মধ্যে দুই শ্রেণীর লোক আছেন, যাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কারবার করেন : এক, যাঁরা রাজ্যের সংস্কার চান; আর-এক, যাঁরা সমাজের সংস্কার চান। বর্তমানকে ভবিষ্যতে পরিণত করতে হলে তার সংস্কার অর্থাৎ পরিবর্তন করা আবশ্যক। এই নিয়েই তো যত গোল। যা আছে তার বদল করা যে রাজ্যশাসনের পক্ষে ক্ষতিকর, এই হচ্ছে রাজ্যশাসকদের মত; আর যা আছে তার বদল করা যে সমাজশাসনের পক্ষে ক্ষতিকর, এই হচ্ছে সমাজশাসিতদের মত। অতএব দেখা গেল যে, ভারতবর্ষের যে ভবিষ্যৎ নেই এবং থাকা উচিত নয়–এ সত্য ইংরেজি ও সংস্কৃত উভয় শাস্ত্রমতেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।
২.
ভবিষ্যৎ না থাক, গতকল্য পর্যন্ত ভারতবর্ষের অতীত বলে একটা পদার্থ ছিল; শুধু ছিল বলে ছিল না আমাদের দেহের উপর, আমাদের মনের উপর তা একদম চেপে বসে ছিল। কিন্তু আজ শুনছি, সে অতীত ভারতবর্ষের নয়, অপর দেশের। একথা শুনে আমরা সাহিত্যিকের দল বিশেষ ভীত হয়ে পড়েছি। কেননা, এতদিন আমরা এই অতীতের কালিতে কলম ডুবিয়ে বর্তমান সাহিত্য রচনা করছিলাম। এই অতীত নিয়ে, আমাদের ভিতর যাঁর অন্তরে বীররস আছে তিনি বাহ্বাস্ফোটন করতেন, যাঁর অন্তরে করণরস আছে তিনি ক্রন্দন করতেন, যাঁর অন্তরে হাস্যরস আছে তিনি পরিহাস করতেন, যাঁর অন্তরে শান্তরস আছে তিনি বৈরাগ্য প্রচার করতেন, আর যাঁর অন্তরে বীভৎসরস আছে তিনি কেলেংকারি করতেন। কিন্তু অতঃপর এই যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে, ভারতবর্ষের অতীত আমাদের পৈতৃক ধন নয়, কিন্তু তা পরের তাহলে সে ধন নিয়ে সাহিত্যের বাজারে আমাদের আর পোন্দারি করা চলবে না। এককথায়, ইতিহাসের পক্ষে যা পোেষ-মাস, সাহিত্যের পক্ষে তা সর্বনাশ।
৩.
আমাদের এতকালের অতীত যে রাতারাতি হস্তান্তরিত হয়ে গেল, সেও আমাদের অতিবুদ্ধির দোষে। এ অতীত যতদিন সাহিত্যের অধিকারে ছিল, ততদিন কেউ তা আমাদের হাত ছাড়িয়ে নিতে পারে নি। কিন্তু সাহিত্যকে উচ্ছেদ করে বিজ্ঞান অতীতকে দখল করতে যাওয়াতেই আমরা ঐ অমূল্য বস্তু হারাতে বসেছি। সকলেই জানেন যে, ভারতবর্ষের অতীত থাকলেও তার ইতিহাস ছিল না। কাজেই এই অতীতের শাদা কাগজের উপর আমরা এতদিন স্বেচ্ছায় এবং স্বচ্ছন্দচিত্তে আমাদের মনোমত ইতিহাস লিখে যাচ্ছিলম। ইতিমধ্যে বাংলায় একদল বৈজ্ঞানিক জন্মগ্রহণ করে সে ইতিহাসকে উপন্যাস বলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে এমন ইতিহাস রচনা করতে কৃতসংকল্প হলেন, যার ভিতর রসের লেশমাত্র থাকবে না থাকবে শুধু বহুতলতা। এরা আহেলা বিলেতি শিক্ষার মোহে একথা ভুলে গেলেন যে, অতীতে হিন্দুর প্রতিভা ইতিহাসে নয় পরাণে, বিজ্ঞানে নয় দর্শনে, ফুটে উঠেছিল। অতীতের মর্মগ্রহণ করে তার চর্ম গ্রহণ করতে যাওয়াতেই সে দেশত্যাগী হতে বাধ্য হল। এতে তাঁদের কোনো ক্ষতি নেই, মধ্যে থেকে সাহিত্য শুধু দেউলে হয়ে গেল। বিজ্ঞানের প্রদীপ যে সাহিত্যের লালবাতি— একথা কে না জানে।
৪.
আমরা সাহিত্যিকের দল অতীতকে আকাশ হিসেবে দেখতুম, অর্থাৎ আমাদের কাছে ও-বস্তু ছিল একটি অখণ্ড মহাশূন্য। সুতরাং সেই আকাশে আমরা কল্পনার সাহায্যে এমন-সব গিরি-পরী নির্মাণ করে চলেছিলুম, যার ত্রিসীমানার ভিতর বিজ্ঞানের গোলাগুলি পৌঁছয় না। বাংলার নবীন প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এ কার্যটি অকার্য বলেই স্থির হল; কেননা, বৈজ্ঞানিক-মতে ইতিহাস গড়বার জিনিসও নয়, পড়বার জিনিসও নয়— শুধু ঢোঁড়বার জিনিস। সুতরাং ও-জিনিসের অন্বেষণ পায়ের নীচে করতে হবে–মাথার উপরে নয়। যাঁরা আবিষ্কার করতে চান, তাঁদের কর্মক্ষেত্র ভূলোক, দ্যুলোক নয়; কেননা, আকাশদেশ তো স্বতঃআবিষ্কৃত।
এই কারণে, সক্রেটিস যেমন দর্শনকে আকাশ থেকে নামিয়ে মাটির উপরে এনে ফেলেছিলেন, আমাদের বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকেরাও তেমনি ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আকাশ থেকে পেড়ে মাটির নীচে পুতে ফেলেছেন।
৫.
এ দলের মতে ভারতবর্ষের অতীত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হলেও পঞ্চভূতে মিশিয়ে যায় নি; কেননা, কাল অতীতের অগ্নিসৎকার করে না, শুধু তার গোর দেয়। এককথায়, অতীতের আত্মা স্বর্গে গমন করলেও তার দেহ পাতালে প্রবেশ করে। তাই ভারতবর্ষ ইতিহাসের মহাশ্মশান নয়, মহাগোরস্থান। অতএব ভারতবর্ষের কবর খুঁড়ে তার ইতিহাস বার করতে হবে এই জ্ঞান হওয়ামাত্র আমাদের দেশের যত বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকে কোদাল পাড়তে শর করলেন এই আশায় যে, এদেশের উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে, যেখানেই কোদাল মারা যাবে সেখানেই, লস্তসভ্যতার গুপ্তধন বেরিয়ে পড়বে। আর সে ধনে আমরা এমনি ধনী হয়ে উঠব যে, মনোজগতে খোরপোশের জন্য আমাদের আর চাষ-আবাদ করতে হবে না।
এই খোঁড়াখুঁড়ির ফলে, সোনা না হোক তামা বেরিয়েছে, হীরে না থাক পাথর বেরিয়েছে। কিন্তু এ যে-সে তামা যে-সে পাথর নয়— সব হরফ-কাটা। এইসব মদ্রাঙ্কিত তাম্রফলকের বিশেষ-কিছু, মূল্য নেই, তা পয়সারই মত শস্তা। একালেও আমরা শিল কুটি, কিন্তু সেই কোটা-শিল পড়া যায় না; কেননা, তার অক্ষর সব রেখাক্ষর। কিন্তু অতীতের এই ক্ষোদিত পাষাণের কথা স্বতন্ত্র। বিদ্যা বলেছিলেন–
‘শিলা জলে ভেসে যায়, বানরে সংগীত গায়,
দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’
কিন্তু আজকাল যদি কেউ বলেন যে–
‘কপি জলে ভেসে যায়, পাষাণে সংগীত গায়,
দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’
তাহলে তিনি অবিদ্যারই পরিচয় দেবেন। কেননা, আজকাল পাষাণের সংগীতে দেশ মাতিয়ে তুলেছে। অতীত আজ তার পাষাণ-বদনে তারস্বরে আত্মপরিচয় দিচ্ছে। কাগজের কথায় আমরা আর কান দিই নে। রামায়ণমহাভারত এখন উপন্যাস হয়ে পড়েছে, এবং ইতিহাস এখন বন্ধের শরণ গ্রহণ করেছে। তার কারণ, আমরা মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছি যে, যাকে আমরা হিসভ্যতা বলি সেটি একটি অর্বাচীন পদার্থ বৌদ্ধসভ্যতার পাকা বনিয়াদের উপরেই তা প্রতিষ্ঠিত। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বনিম্নস্তরে যা পাওয়া যায়, সে হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। ফলে, আমরা হিন্দু হলেও বৌদ্ধধর্ম নিয়েই গৌরব করছিলাম। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, পাটলিপুত্রই হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের কেন্দ্রস্থল একাধারে জন্মভূমি এবং পীঠস্থান।
৬.
কথাসরিৎসাগরের প্রসাদে পাটলিপুত্রের জন্মকথা আমরা সকলেই জানতুম। এবং আমরা, কাব্যরসের রসিকেরা, সেই জন্মবত্তান্তই সাদরে গ্রাহ্য করে নিয়েছিলুম; কেননা, সেকথায় বস্তুতন্ত্রতা না থাকলেও রস আছে, তাও আবার একটি নয়, তিন-তিনটি–মধুর বীর এবং অদ্ভুত রস। পত্রকর্তৃক পাটলিহরণের বত্তান্ত, কৃষ্ণকর্তৃক রক্মিণীহরণ এবং অর্জনকর্তৃক সুভদ্রাহরণের চাইতেও অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কৃষ্ণ প্রভৃতি রথে চড়ে স্থূলপথে পলায়ন করেছিলেন, কিন্তু পত্র পাটলিকে ক্রোড়স্থ ক’রে মায়া-পাকায় ভর দিয়ে নভেমার্গে উড্ডীন হয়েছিলেন। কৃষ্ণার্জন স্ব স্ব নগরীতে প্রস্থান করেছিলেন; পত্র কিন্তু তাঁর মায়া-যঠির সাহায্যে যে-পরী আকাশে নির্মাণ করেছিলেন সেই পুরী ভূমিষ্ঠ হয়ে পাটলিপুত্র নাম ধারণ করে। বৈজ্ঞানিকেরা কিন্তু যাদতে বিশ্বাস করেন না। সুতরাং বৈজ্ঞানিক মতে পাটলিপুত্রকে খনন করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়েছিল, এবং সে কর্তব্যও সম্প্রতি কার্যে পরিণত করা হয়েছে। খোঁড়া-জিনিসটের ভিতর একটা বিপদ আছে, কেননা, কোনো-কোনো স্থলে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোয়। এক্ষেত্রে হয়েছেও তাই।
ডক্টর স্পূনার নামক জনৈক প্রত্নতত্ত্বের কর্তাব্যক্তি এই ভূমধ্য-রাজধানী খনন করে আবিষ্কার করেছেন যে, এদেশের মাটি খুড়লে দেখা যায় যে তার নীচে ভারতবর্ষ নেই, আছে শুধু পারশ্য। Palimpsest-নামক একপ্রকার প্রাচীন পথি পাওয়া যায়, যার উপরে এক ভাষায় লেখা থাকে আর নীচে আরএক ভাষায়। বলা বাহুল্য, উপরে যা লেখা থাকে তা জাল, আর নীচে যা লেখা থাকে তাই আসল। ডক্টর স্পূনারের দিব্যদৃষ্টিতে এতকাল পরে ধরা পড়েছে যে, আমরা যাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলি, সে হচ্ছে একটি বিরাট palimpsest; তার উপরে পালি কিংবা সংস্কৃতভাষায় যা লেখা আছে তা জাল, আর তার নীচে যা লেখা আছে তাই আসল। সে লেখা অবশ্য ফারসি; কেননা, আমরা কেউ তা পড়তে পারি নে। ডক্টর স্পূনারের কথা বৈজ্ঞানিকেরা মেনে না নিন, মান্য করতে বাধ্য; কেননা, সেকালের কাব্যের যাদুঘর হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু একালের যাদুঘরের কাব্যকে তা করা চলে না।
ডক্টর স্পূনার তাঁর নব-মত প্রতিষ্ঠা করবার জন্য নানা প্রমাণ, নানা অনুমান, নানা দর্শন, নানা নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। এসকলের মূল্য যে কি, তা নির্ণয় করা আমার সাধ্যের অতীত। এই পর্যন্ত বলতে পারি যে, তিনি এমন-একটি যুক্তি বাদ দিয়েছেন, যার আর কোনো খণ্ডন নেই। স্পূনার সাহেবের মতে যার নাম অসর তারই নাম দানব, এবং যার নাম দানব তারই নাম শক, এবং যার নাম শক তারই নাম পার্শি। একথা যদি সত্য হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, এদেশের মাটি খুঁড়লে পাশি-শহর বেরিয়ে পড়তে বাধ্য। দানবপরী যে পাতালে অর্থাৎ মাটির নীচে অবস্থিত, একথা তো হিন্দুর সর্বশাস্ত্রসম্মত।
৭.
অতএব দাঁড়াল এই যে, আমাদের ভবিষ্যৎও নেই অতীতও নেই। এক বাকি থাকল বর্তমান। সুতরাং বঙ্গসাহিত্যকে এখন থেকে এই বর্তমান নিয়েই কারবার করতে হবে। এ অবশ্য মহা মুশকিলের কথা। বই পড়ে বই লেখা এক, আর নিজে বিশ্বসংসার দেখেশুনে লেখা আর। একাজ করতে হলে চোখকান খুলে রাখতে হবে, মনকে খাটাতে হবে; এককথায় সচেতন হতে হবে। তার পর এত কষ্ট স্বীকার করে যে সাহিত্য গড়তে হবে, সে সাহিত্য সকলে সহজে গ্রাহ্য করবেন না। মানুষে বর্তমানকেই সবচাইতে অগ্রাহ্য করে। যাঁদের চোখকান বোজা আর মন পঙ্গু, তাঁরা এই নবসাহিত্যকে নবীন বলে নিন্দা করবেন। তবে এর মধ্যে আরামের কথা এই যে, বর্তমানের কোনো ইতিহাস নেই, সুতরাং এখন হতে বঙ্গসরস্বতীর ঘাড় থেকে ভূত নেমে যাবে।
আষাঢ় ১৩২৩