সবুজ পত্রের মুখপত্র
ওঁ প্ৰাণায় স্বাহা
স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাঙালি জাতিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘একটা নতুন কিছু করো।’ সেই পরামর্শ অনুসারেই যে আমরা একখানি নতুন মাসিক পত্র প্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছি, এ কথা বললে সম্পূর্ণ সত্য কথা বলা হবে না। এ পৃথিবীটি যথেষ্ট পুরোনো, সুতরাং তাকে নিয়ে নতুন কিছু করা বড়োই কঠিন, বিশেষত এ দেশে। যদি বহু চেষ্টায় নতুন কিছু করে তোলা যায়, তা হয় জলবায়ুর গুণে দুদিনেই পুরোনো হয়ে যায়, নয় তো পুরাতন এসে তাকে গ্রাস করে ফেলে। এই- সব দেখেশুনে এ দেশে কথায় কিংবা কাজে নতুন কিছু করবার জন্য যে পরিমাণ ভরসা ও সাহস চাই তা যে আমাদের আছে তা বলতে পারি নে।
যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন যে, তবে কি উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য, কি অভাব পূরণ করবার জন্য, এত কাগজ থাকতে আবার একটি নতুন কাগজ বার করছি—তা হলেও আমাদের নিরুত্তর থাকতে হবে; কেননা কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারাটা সাহিত্যসমাজেও ভদ্রতার পরিচায়ক নয়। নিজেকে প্রকাশ করবার পূর্বে নিজের পরিচয় দেওয়াটা—শুধু পরিচয় দেওয়া নয়, নিজের গুণগ্রাম বর্ণনা করাটা— যদিও মাসিক পত্রের পক্ষে একটা সর্বলোকমান্য ‘সাহিত্যিক’ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবুও সে নিয়ম ভঙ্গ করতে আমরা বাধ্য। যে কথা বারো মাসে বারো কিস্তিতে রাখতে হবে, তার যে মাঝে মাঝে খেলাপ হবার সম্ভাবনা নেই—এ জাঁক করবার মতো দুঃসাহস আমাদের নেই। তা ছাড়া স্বদেশের কিংবা স্বজাতির কোনো-একটি অভাব পূরণ করা, কোনো-একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করা সাহিত্যের কাজও নয় ধর্মও নয়; সে হচ্ছে কার্যক্ষেত্রের কথা। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যকে অবলম্বন করাতে মনের ভিতর যে সংকীর্ণতা এসে পড়ে, সাহিত্যের স্ফূর্তির পক্ষে তা অনুকূল নয়। কাজ হচ্ছে দশে মিলে করবার জিনিস। দলবদ্ধ হয়ে আমরা সাহিত্য গড়তে পারি নে, গড়তে পারি শুধু সাহিত্যসম্মিলন। কারণ দশের সাহায্যে ও সাহচর্যে কোনো কাজ উদ্ধার করতে হলে নিজের স্বাতন্ত্র্যটি অনেকটা চেপে দিতে হয়। যদি আমাদের দশজনের মধ্যে মনের চৌদ্দ-আনা মিল থাকে, তা হলে প্রতিজনে বাকি দু-আনা বাদ দিয়ে, একত্র হয়ে সকলের পক্ষে সমান বাঞ্ছিত কোনো ফললাভের জন্য চেষ্টা করতে পারি। এক দেশের এক যুগের এক সমাজের বহু লোকের ভিতর মনের এই চৌদ্দ-আনা মিল থাকলেই সামাজিক কার্য সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়, নচেৎ নয়। কিন্তু সাহিত্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। সুতরাং সাহিত্যের পক্ষে মনের ঐ পড়ে-পাওয়া- চৌদ্দ-আনার চাইতে ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব দু-আনার মূল্য ঢের বেশি। কেননা ঐ দু-আনা হতেই তার সৃষ্টি এবং স্থিতি, বাকি চৌদ্দ-আনায় তার লয়। যার সমাজের সঙ্গে ষোলো-আনা মনের মিল আছে, তার কিছু বক্তব্য নেই। মন পদার্থটি মিলনের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, আর বিরোধের স্পর্শে জেগে ওঠে। এবং মনের এই জাগ্রত ভাব থেকেই সকল কাব্য সকল দর্শন সকল বিজ্ঞানের উৎপত্তি।
এ কথা শুনে অনেকে হয়তো বলবেন যে, যে দেশে এত দিকে এত অভাব সে দেশে যে লেখা তার একটি অভাবও পূরণ না করতে পারে, সে লেখা সাহিত্য নয়—শখ; ও তো কল্পনার আকাশে রঙিন কাগজের ঘুড়ি ওড়ানো, এবং সে ঘুড়ি যত শীঘ্র কাটা পড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় ততই ভালো। অবশ্য ঘুড়ি ওড়াবারও একটা সার্থকতা আছে। ঘুড়ি মানুষকে অন্তত উপরের দিকে চেয়ে দেখতে শেখায়। তবুও এ কথা সত্য যে, মানবজীবনের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই, তা সাহিত্য নয়, তা শুধু বাক্-ছল। জীবন অবলম্বন করেই সাহিত্য জন্ম ও পুষ্টি লাভ করে, কিন্তু সে জীবন মানুষের দৈনিক জীবন নয়। সাহিত্য হাতে-হাতে মানুষের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে দিতে পারে না। কোনো কথায় চিঁড়ে ভেজে না, কিন্তু কোনো-কোনো কথায় মন ভেজে; এবং সেই জাতির কথারই সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে সাহিত্য। শব্দের শক্তি অপরিসীম। রাত্রির অন্ধকারের সঙ্গে মশার গুনগুনানি মানুষকে ঘুম পাড়ায়—অবশ্য যদি মশারির ভিতর শোওয়া যায়; আর দিনের আলোর সঙ্গে কাক-কোকিলের ডাক মানুষকে জাগিয়ে তোলে। প্রাণ পদার্থটির গূঢ় তত্ত্ব আমরা না জানলেও তার প্রধান লক্ষণটি এতই ব্যক্ত এবং এতই স্পষ্ট যে তা সকলেই জানেন। সে হচ্ছে তার জাগ্রত ভাব। অপরদিকে নিদ্ৰা হচ্ছে মৃত্যুর সহোদরা। কথায় হয় আমাদের জাগিয়ে তোলে, নয় ঘুম পাড়িয়ে দেয়—তাই আমরা কথায় মরি কথায় বাঁচি। মন্ত্র সাপকে মুগ্ধ করতে পারে কি না জানি নে, কিন্তু মানুষকে যে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ গোটা ভারতবর্ষ। সংস্কৃত শব্দ যে সংস্কারকে বাধা দিতে পারে তার প্রমাণ বাংলা সাহিত্য। মানুষমাত্রেরই মন কতক সুপ্ত আর কতক জাগ্রত। আমাদের মনের যে অংশটুকু জেগে আছে সেই অংশটুকুকেই আমরা সমগ্র মন বলে ভুল করি—নিদ্রিত অংশটুকুর অস্তিত্ব আমরা মানি নে, কেননা জানি নে। সাহিত্য মানবজীবনের প্রধান সহায়, কারণ তার কাজ হচ্ছে মানুষের মনকে ক্রমান্বয় নিদ্রার অধিকার হতে ছিনিয়ে নিয়ে জাগরুক করে তোলা। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভোরের পাখিরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সবুজ পত্রমণ্ডিত সাহিত্যের নবশাখার উপর এসে অবতীর্ণ হন তা হলে আমরা বাঙালি জাতির সবচেয়ে যে বড়ো অভাব, তা কতকটা দূর করতে পারব। সে অভাব হচ্ছে আমাদের মনের ও চরিত্রের অভাব যে কতটা, তারই জ্ঞান। আমরা যে আমাদের সে অভাব সম্যক্ উপলব্ধি করতে পারি নি তার প্রমাণ এই যে, আমরা নিত্য লেখায় ও বক্তৃতায় দৈন্যকে ঐশ্বর্য বলে, জড়তাকে সাত্ত্বিকতা বলে, আলস্যকে ঔদাস্য বলে, শ্মশানবৈরাগ্যকে ভূমানন্দ বলে, উপবাসকে উৎসব বলে, নিষ্কর্মাকে নিষ্ক্রিয় বলে প্রমাণ করতে চাই। এর কারণও স্পষ্ট। ছল দুর্বলের বল। যে দুর্বল সে অপরকে প্রতারিত করে আত্মরক্ষার জন্য, আর নিজেকে প্রতারিত করে আত্মপ্রসাদের জন্য। আত্মপ্রবঞ্চনার মতো আত্মঘাতী জিনিস আর নেই। সাহিত্য জাতির খোরপোশের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না, কিন্তু তাকে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
আমরা যে দেশের মনকে ঈষৎ জাগিয়ে তুলতে পারব, এত বড়ো স্পর্ধার কথা আমি বলতে পারি নে, কেননা যে সাহিত্যের দ্বারা তা সিদ্ধ হয়, সে সাহিত্য গড়বার জন্য নিজের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়— তার মূলে ভগবানের ইচ্ছা থাকা চাই অর্থাৎ নৈসর্গিকী প্রতিভা থাকা চাই। অথচ ও-ঐশ্বর্য ভিক্ষা করে পাবার জিনিস নয়। তবে বাংলার মন যাতে আর বেশি ঘুমিয়ে না পড়ে, তার চেষ্টা আমাদের আয়ত্তাধীন। মানুষকে ঝাঁকিয়ে দেবার ক্ষমতা অল্পবিস্তর সকলের হাতেই আছে, সে ক্ষমতার প্রয়োগটি কেবল আমাদের প্রবৃত্তিসাপেক্ষ। এবং আমাদের প্রবৃত্তির সহজ গতিটি যে ঐ নিজেকে এবং অপরকে সজাগ করে তোলবার দিকে, তাও অস্বীকার করবার জো নেই; কারণ ইউরোপ আমাদের মনকে নিত্য যে ঝাঁকুনি দিচ্ছে, তাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ইউরোপের সাহিত্য ইউরোপের দর্শন মনের গায়ে হাত বুলোয় না, কিন্তু ধাক্কা মারে। ইউরোপের সভ্যতা অমৃতই হোক মদিরাই হোক আর হলাহলই হোক, তার ধর্মই হচ্ছে মনকে উত্তেজিত করা, স্থির থাকতে দেওয়া নয়। এই ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে, এই ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে, আমরা দেশসুদ্ধ লোক যে দিকে হোক কোনো-একটা দিকে চলবার জন্য এবং অন্যকে চালাবার জন্য আঁকুবাঁকু করছি। কেউ পশ্চিমের দিকে এগোতে চান কেউ পূর্বের দিকে পিছু হটতে চান, কেউ আকাশের উপরে দেবতার আত্মার অনুসন্ধান করছেন কেউ মাটির নীচে দেবতার মূর্তির অনুসন্ধান করছেন। এক কথায়, আমরা উন্নতিশীলই হই আর অবনতিশীলই হই—আমরা সকলেই গতিশীল, কেউ স্থিতিশীল নই। ইউরোপের স্পর্শে আমরা, আর-কিছু না হোক, গতি লাভ করেছি, অর্থাৎ মানসিক ও ব্যবহারিক সকলপ্রকার জড়তার হাত থেকে কথঞ্চিৎ মুক্তি লাভ করেছি। এই মুক্তির ভিতর যে আনন্দ আছে সেই আনন্দ হতেই আমাদের নবসাহিত্যের সৃষ্টি। সুন্দরের আগমনে হীরা মালিনীর ভাঙা মালঞ্চে যেমন ফুল ফুটে উঠেছিল, ইউরোপের আগমনে আমাদের দেশে তেমনি সাহিত্যের ফুল ফুটে উঠেছে। তার ফল কি হবে সে কথা না বলতে পারলেও এই ফুলফোটা যে বন্ধ করা উচিত নয়, এই হচ্ছে আমাদের দৃঢ় ধারণা। সুতরাং যিনি পারেন তাঁকেই আমরা ফুলের চাষ করবার জন্য উৎসাহ দেব।
ইউরোপের কাছে আমরা একটি অপূর্ব জ্ঞান লাভ করেছি। সে হচ্ছে এই যে, ভাবের বীজ যে দেশ থেকেই আনো-না কেন, দেশের মাটিতে তার চাষ করতে হবে। চীনের টবে তোলামাটিতে সে বীজ বপন করা পণ্ডশ্রম মাত্র। আমাদের এই নবশিক্ষাই ভারতবর্ষের অতিবিস্তৃত অতীতের মধ্যে আমাদের এই নবভাবের চর্চার উপযুক্ত ক্ষেত্র চিনে নিতে শিখিয়েছে। ইংরেজি শিক্ষার গুণেই আমরা দেশের লুপ্ত অতীতের পুনরুদ্ধারকল্পে ব্রতী হয়েছি। তাই আমাদের মন একলম্ফে শুধু বঙ্গ- বিহার নয়, সেইসঙ্গে হাজার দেড়েক বৎসর ডিঙিয়ে একেবারে আর্যাবর্তে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এখন আমাদের পূর্ব কবি হচ্ছে কালিদাস, কাশীদাস নয়; দার্শনিক শংকর, গদাধর নয়; শাস্ত্রকার মনু, রঘুনন্দন নয়; আলংকারিক দণ্ডী, বিশ্বনাথ নয়। নব্যন্যায় নব্যদর্শন নব্যস্মৃতি আমাদের কাছে এখন অতিপুরাতন। আর যা কালের হিসাবে অতিপুরাতন, তাই আবার বর্তমানে নতুন রূপ ধারণ করে এসেছে। এর কারণ হচ্ছে ইউরোপের নবীন সাহিত্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্যের আকারগত সাদৃশ্য না থাকলেও অন্তরের মিল আছে। সে হচ্ছে প্রাণের মিল—উভয়ই প্ৰাণবন্ত গাছের গোলাপের সঙ্গে কাগজের গোলাপের সাদৃশ্য থাকলেও জীবিত ও মৃতের ভিতর যে পার্থক্য, উভয়ের মধ্যে সেই পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু স্থলের গোলাপ ও জলের পদ্ম উভয়ে একজাতীয়, কেননা উভয়েই জীবন্ত। সুতরাং আমাদের নবজীবনের নবশিক্ষা, দেশের দিক ও বিদেশের দিক দুই দিক থেকেই আমাদের সহায়। এই নবজীবন যে লেখায় প্রতিফলিত হয় সেই লেখাই কেবল সাহিত্য—বাদবাকি লেখা কাজের নয়, বাজে।
এই সাহিত্যের বহির্ভূত লেখা আমাদের কাগজ থেকে বহির্ভূত করবার একটি সহজ উপায় আবিষ্কার করেছি বলে আমরা এই নতুন পত্র প্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছি। একটা নতুন কিছু করবার জন্য নয়, বাঙালির জীবনে যে নূতনত্ব এসে পড়েছে তাই পরিষ্কার করে প্রকাশ করবার জন্য।
এই নূতন জীবনে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা সাহিত্য যে কেন পুষ্পিত না হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠছে, তার কারণ নির্ণয় করাও কঠিন নয়। কিঞ্চিৎ বাহ্যদৃষ্টি এবং কিঞ্চিৎ অন্তর্দৃষ্টি থাকলেই সে কারণের দুই পিঠই সহজে মানুষের চোখে পড়ে।
সাহিত্য এ দেশে অদ্যাবধি ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গ হয়ে ওঠে নি। তার জন্য দোষী লেখক কি পাঠক, বলা কঠিন। ফলে আমরা হচ্ছি সব সাহিত্যসমাজের শখের কবির দল। অব্যবসায়ীর হাতে পৃথিবীর কোনো কাজই যে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠে না, এ কথা সর্বলোকস্বীকৃত। লেখা আমাদের অধিকাংশ লেখকের পক্ষে কাজও নয় খেলাও নয়, শুধু অকাজ; কারণ খেলার ভিতর যে স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছন্দতা আছে, লেখায় তা নেই; অপরদিকে কাজের ভিতর যে যত্ন ও মন আছে, তাও তাতে নেই। আমাদের রচনার মধ্যে অন্যমনস্কতার পরিচয় পদে পদে পাওয়া যায়; কেননা যে অবসর আমাদের নেই সেই অবসরে আমরা সাহিত্যরচনা করি। আমরা অবলীলাক্রমে সাহিত্য গড়তে চাই বলে আমাদের নৈসর্গিকী প্রতিভার উপর নির্ভর করা ব্যতীত উপায়ান্তর নেই। অথচ এ কথা লেখকমাত্রেরই স্মরণ রাখা উচিত যে, যিনি সরস্বতীর প্রতি অনুগ্রহ করে লেখেন, সরস্বতী চাই-কি তাঁর প্রতি অনুগ্রহ নাও করতে পারেন। এই একটি কারণ যার জন্যে বঙ্গ সাহিত্য পুষ্পিত না হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠছে। ফুলের চাষ করতে হয়, জঙ্গল আপনি হয়। অতিকায় মাসিক পত্রগুলি সংখ্যাপূরণের জন্য এই আগাছার অঙ্গীকার করতে বাধ্য, এবং সেই কারণে আগাছার বৃদ্ধির প্রশ্রয় দিতেও বাধ্য। এই-সব দেখেশুনে ভয়ে সংকুচিত হয়ে আমাদের কাগজ ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছে। এই আকারের তারতম্যে প্রকারেরও কিঞ্চিৎ তারতম্য হওয়া অবশ্যম্ভাবী। আমাদের স্বল্পায়তন পত্রে অনেক লেখা আমরা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হব। স্ত্রীপাঠ্য শিশুপাঠ্য স্কুলপাঠ্য এবং অপাঠ্য প্রবন্ধসকল অনাহূত কিংবা রবাহূত হয়ে আমাদের দ্বারস্থ হলেও আমরা তাদের স্বস্থানে প্রস্থান করতে বলতে পারব। কারণ আমাদের ঘরে স্থানাভাব। এক কথায়, শিক্ষাপ্রদ প্রবন্ধ আমাদের প্রকাশ করতে হবে না। এর লাভ যে কি, তিনিই বুঝতে পারবেন যিনি জানেন যে, যে কথা একশো বার বলা হয়েছে তারই পুনরাবৃত্তি করাই শিক্ষকের ধর্ম ও কর্ম। যে লেখায় লেখকের মনের ছাপ নেই, তা ছাপালে সাহিত্য হয় না।
তার পর, যে জীবনীশক্তির আবির্ভাবের কথা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি, সে শক্তি আমাদের নিজের ভিতর থেকে উদ্বুদ্ধ হয় নি; তা হয় দূর দেশ হতে নয় দূর কাল হতে, অর্থাৎ বাইরে থেকে, এসেছে। সে শক্তি এখনো আমাদের সমাজে ও মনে বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। সে শক্তিকে নিজের আয়ত্তাধীন করতে না পারলে তার সাহায্যে আমরা সাহিত্যে ফুল কিংবা জীবনে ফল পাব না। এই নূতন প্রাণকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করতে হলে প্রথমে তা মনে প্রতিবিম্বিত করা দরকার। অথচ ইউরোপের প্রবল ঝাঁকুনিতে আমাদের অধিকাংশ লোকের মন ঘুলিয়ে গেছে। সেই মনকে স্বচ্ছ করতে না পারলে তাতে কিছুই প্রতিবিম্বিত হবে না। বর্তমানের চঞ্চল এবং বিক্ষিপ্ত মনোভাবসকলকে যদি প্রথমে মনোদর্পণে সংক্ষিপ্ত ও সংহত করে প্রতিবিম্বিত করে নিতে পারি, তবেই তা পরে সাহিত্যদর্পণে প্রতিফলিত হবে। আমরা আশা করি আমাদের এই স্বল্পপরিসর পত্রিকা মনোভাব সংক্ষিপ্ত ও সংহত করবার পক্ষে লেখকদের সাহায্য করবে। সাহিত্য গড়তে কোনো বাইরের নিয়ম চাই নে, চাই শুধু আত্মসংযম। লেখায় সংযত হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে সীমার ভিতর আবদ্ধ হওয়া। আমাদের কাগজে আমরা তাই সেই সীমা নির্দিষ্ট করে দেবার চেষ্টা করব।
আমার শেষ কথা এই যে, যে শিক্ষার গুণে দেশে নূতন প্রাণ এসেছে, মনে সাহিত্য গড়বার প্রবৃত্তি জন্মিয়ে দিয়েছে, সেই শিক্ষার দোষেই সে ইচ্ছা কার্যে পরিণত করবার অনুরূপ ক্ষমতা আমরা পাই নি। আমরা বর্তমান ইউরোপ ও অতীত ভারতবর্ষ, এ উভয়ের দোটানায় পড়ে বাংলা প্রায় ভুলে গেছি। আমরা শিখি ইংরেজি, লিখি বাংলা, মধ্যে থাকে সংস্কৃতের ব্যবধান। ইংরেজি শিক্ষার বীজ অতীত ভারতের ক্ষেত্রে প্রথমে বপন করলেও তার চারা তুলে বাংলার মাটিতে বসাতে হবে, নইলে স্বদেশী সাহিত্যের ফুল ফুটবে না। পশ্চিমের প্রাণবায়ু যে ভাবের বীজ বহন করে আনছে, তা দেশের মাটিতে শিকড় গাড়তে পারছে না বলে হয় শুকিয়ে যাচ্ছে, নয় পরগাছা হচ্ছে। এই কারণেই মেঘনাদবধকাব্য পরগাছার ফুল। ‘অর্কিড’-এর মতো তার আকারের অপূর্বতা এবং বর্ণের গৌরব থাকলেও তার সৌরভ নেই। খাঁটি স্বদেশী বলে অন্নদামঙ্গল স্বল্পপ্রাণ হলেও কাব্য; এবং কোনো দেশেরই নয় বলে বৃত্রসংহার মহাপ্রাণ হলেও মহাকাব্য নয়। ভারতচন্দ্র ভাষার ও ভাবের একতার গুণে সংযমের গুণে তাঁর মনের কথা ফুলের মতো সাকার করে তুলেছেন, এবং সে ফুলে, যতই ক্ষীণ হোক-না কেন, প্রাণও আছে গন্ধও আছে। দেশের অতীত ও বিদেশের বর্তমান, এই দুটি প্রাণশক্তির বিরোধ নয়, মিলনের উপর আমাদের সাহিত্যের ও সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আশা করি বাংলার পতিত জমি সেই মিলনক্ষেত্র হবে। সেই পতিত জমি আবাদ করলেই তাতে যে সাহিত্যের ফুল ফুটে উঠবে, তাই ক্রমে জীবনের ফলে পরিণত হবে। তার জন্য আবশ্যক আর্ট, কারণ প্রাণশক্তি একমাত্র আর্টেরই বাধ্য। আমাদের এই ক্ষুদ্র পত্রিকা, আশা করি, এ বিষয়ে লেখকদের সহায়তা করবে। বড়োকে ছোটোর ভিতর ধরে রাখাই হচ্ছে আর্টের উদ্দেশ্য। ওস্তাদরা বলে থাকেন যে গৌড়সারঙ্গ রাগিণী ছোটো, কিন্তু গাওয়া মুশকিল; ‘ছোটিসে দরওয়াজাকে অন্দর হাতি নিকানা যৈসা মুশকিল ঐসা মুশকিল, দরিয়াকো পাকড়কে কুঁজামে ডানা যৈসা মুশকিল ঐসা মুশকিল।’ অবস্থা গুণে যতই মুশকিল হোক-না কেন, বাঙালি জাতিকে এই গৌড়সারঙ্গই গাইতে চেষ্টা করতে হবে। আমাদের বাংলাঘরের খিড়কিদরজার ভিতর প্রাচীন ভারতবর্ষের হাতি গলাবার চেষ্টা করতে হবে, আমাদের গৌড়ভাষার মৃৎকুম্ভের মধ্যে সাত সমুদ্রকে পাত্রস্থ করতে চেষ্টা করতে হবে। এ সাধনা অবশ্য কঠিন, কিন্তু স্বজাতির মুক্তির জন্য অপর কোনো সহজ সাধনপদ্ধতি আমাদের জানা নেই।
বৈশাখ ১৩২১