বর্তমান বঙ্গসাহিত্য
অনেকে বলে থাকেন যে, আমাদের সাহিত্যের সত্যযুগ ঊনবিংশ শতাব্দীর সঙ্গেই এ দেশ থেকে অন্তর্ধান হয়েছে। এখন ঘোর কলি, কেননা এ যুগে সাহিত্যের যে একটিমাত্র পদ অবশিষ্ট আছে সে হচ্ছে সমালোচনা এবং আমাদের যতকিছু লাফা-ঝাঁপি সে-সব ঐ এক পায়ের উপর, তারপর ভবিষ্যতে যখন উক্ত পদের আস্ফালন বন্ধ হবে, তখন মন্বন্তর। এ-সব কথা শুনে আমি হতাশ হয়ে পড়ি নে, কেননা অতীতের চাইতে ভবিষ্যতের প্রতি আমার ভক্তি ও ভালোবাসা দুইই বেশি আছে। আমরা ইভলিউশন-পন্থী; সুতরাং আমাদের সত্যযুগ পিছনে পড়ে নেই, সুমুখে গড়ে উঠছে। আমাদের কল্পিত ধরার স্বর্গ অতীতের ভুঁই ফুঁড়ে উঠবে না, বর্তমানের ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং আমাদের কাছে অতীতের অপেক্ষা বর্তমান ঢের বেশি মূল্যবান। অতীতের সাহায্যে আমরা বড়োজোর বর্তমানের ব্যাখ্যা করতে পারি, তাও আবার আংশিক ভাবে, কিন্তু বর্তমানের সাহায্যে আমরা ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারি। আবিষ্কার করার চাইতে নির্মাণ করা যে-পরিমাণে শ্রেষ্ঠ অতীতের জ্ঞানের চাইতে বর্তমানের জ্ঞান লাভ করা সেই পরিমাণে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, মানুষ বর্তমানকেই সবচাইতে কম চেনে এবং কম জানে। এ পৃথিবীতে যা চিরপরিচিত তাই সবচেয়ে অপরিচিত। যা চব্বিশ ঘণ্টা আমাদের চোখের সুমুখে থাকে, তার দিকে আমরা বড়ো-একটা দৃষ্টিপাত করি নে। ঐ কারণেই বর্তমানের চেহারা আমাদের চোখে পড়ে না এবং তার রূপ আমাদের মনে ধরে না। তা ছাড়া বর্তমান একটি প্রবাহ, দিনের পর দিন হচ্ছে কালের ঢেউয়ের পরে ঢেউ, সুতরাং এ বর্তমানের ইয়ত্তা করতে হলে কালের ঢেউ গুনতে হয়। অপরপক্ষে অতীত হচ্ছে একটি জমাট নিরেট জড় পদার্থ, তার চারিদিকে ভক্তিভরে প্রদক্ষিণ করা যায়। সুতরাং অতীতের গুণকীর্তন করা নেহাত সহজ, বিশেষত চোখ বুজে। আর-এক কথা, স্বদেশের অতীত হচ্ছে প্রতি জাতির পৈতৃক স্থাবর সম্পত্তি এবং তা সমাজের ভোগ-দখলের বিষয়, অতএব তার প্রতি সাংসারিক মনের টানও বেশি মানও বেশি। বর্তমানের দুর্ভাগ্য এই যে, তা অস্থাবর। এবং তার যা ভোগ সে শুধু কর্মভোগ। এই কারণে বর্তমানকে ছোঁয়া যায়, ধরা যায় না। বর্তমান সাহিত্য হচ্ছে বর্তমানেরই একটি অঙ্গ, কাজেই বর্তমান সাহিত্যিকরা গেঁয়ো যোগীর ন্যায় সমাজের কাছে ভক্তি পাওয়া দূরে থাক্, ভিখও পান না। অথচ এই উপেক্ষিত বর্তমানই যখন আমাদের অদূর-ভবিষ্যতের নির্ভরস্থল, তখন এ যুগের সাহিত্যের যথাসম্ভব পরিচয় নেবার চেষ্টা করাটা আবশ্যক। চেষ্টা করলে হয়তো এর ভিতর থেকেও একটা আশার চেহারা বার করা যেতে পারে।
আমাদের পক্ষে নবসাহিত্যের নিন্দা করা যেমন সহজ, প্রশংসা করা তেমনি কঠিন। কেননা খ্যাতনামা লেখকদের বিচার করবার অধিকার যেখানে কারো নেই, সেখানে অখ্যাতনামা লেখকদের উপরে জজ্ হয়ে বসবার অধিকার সকলেরই আছে। জন্মাবধি উঠতে বসতে খেতে শুতে যে বস্তুর সুখ্যাতি শুনে আসছি, সে বস্তু যে মহার্ঘ এ বিশ্বাস অজ্ঞাতসারে আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়। গুরুজনদের তৈরি মত আমরা বিনা বাক্যে মেনে নিই, কেননা তা মেনে নেবার ভিতর মনের কোনো খাটুনি নেই। যদি আমরাই চিন্তামার্গে ক্লেশ করব, তা হলে গুরুর দরকার কি। আর যদি আমরাই পূজা করব তা হলে পুরোহিতের দরকার কি। কেননা গুরুপুরোহিতেরা সমাজের হাতে-গড়া, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক labour-saving machines। নবসাহিত্যের দুর্ভাগ্যই এই যে, তা অতীতের ডিপ্লোমা নিয়ে আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয় না; এ সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হলে নিজের অনুভূতি দিয়ে তা যাচাই করতে হয়, নিজের বুদ্ধি দিয়ে তা পরীক্ষা করতে হয়। আমরা ক’জনে সে পরিশ্রমটুকু করতে রাজি? সুতরাং নবসাহিত্যের প্রশংসার চাইতে নিন্দাই যে বেশির ভাগ শোনা যায়, তাতে আশ্চর্য হবার কোনো কারণ নেই। এই-সকল নিন্দাবাদের বিচারসূত্রেই আমরা প্রকারান্তরে নবসাহিত্যের গুণাগুণের বিচার করতে চাই।
নবসাহিত্যের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, তা অপর্যাপ্ত ও সস্ত্যা, বিশেষত্বহীন ও প্রতিভাহীন, চুটকি ও নকল। আমি একে একে এই-সকল অভিযোগের উত্তর দিতে চেষ্টা করব।
নবসাহিত্যের পরিমাণ যে অপর্যাপ্ত তা অস্বীকার করবার জো নেই। বর্তমানে এত নিত্যনূতন পুস্তক এবং পুস্তিকা, পত্র এবং পত্রিকা ভূমিষ্ঠ হচ্ছে যে, এ যুগের তুলনায় বঙ্গদর্শনের যুগের বঙ্গসরস্বতীকে বন্ধ্যা বললেও অত্যুক্তি হয় না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের নামে এই অপবাদ ছিল যে, বাঙালি রসনাসর্বস্ব, বিংশ শতাব্দীতে আমরা যদি কিছু হই তো রচনাসর্বস্ব। এমন-কি, এই নব-যুগধর্মের শাসনে গত যুগের অনেক পাকা বক্তারা কেঁচে আবার লেখক হয়ে উঠছেন নইলে যে তাঁদের গাদে পড়ে থাকতে হয়।
এক কথায়, আজকের দিনে বাংলার সাহিত্যসমাজ লোকে লোকারণ্য; এবং এ জনতার মধ্যে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই আছেন। বঙ্গসাহিত্যের মন্দিরে বঙ্গমহিলারা যে শুধু প্রবেশ লাভ করেছেন তা নয়, অনেকখানি জায়গা জুড়ে বসেছেন। বসেছেন বলা বোধ হয় ঠিক হল না, কারণ এ স্থলে এঁরা বসে নেই, পুরুষদের সঙ্গে সমানে পা ফেলে চলছেন। ইংরেজি রাজনীতির ভাষায় যাকে বলে peaceful penetration, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে স্ত্রীজাতি আমাদের সাহিত্যরাজ্য ধীরে ধীরে এতটা দখল করে নিচ্ছেন যে, আমার সময়ে সময়ে আশঙ্কা হয় যে, এ রাজ্য হয়তো ক্রমে নারীরাজ্য হয়ে উঠবে। এ আশঙ্কা যে নিতান্ত অমূলক নয়, তার প্রমাণ গত মাসের ‘ভারতবর্ষে’র প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। সাহিত্যসমাজের এই পরদাপার্টিতে অন্তত চল্লিশ জন ভদ্রমহিলা যোগদান করেছিলেন। যে দেশে স্ত্রীশিক্ষা নেই, সে দেশে স্ত্রীসাহিত্যের এতটা প্রসার ও পসার বৃদ্ধির ভিতর কি একটু রহস্য নেই? এতেই কি প্ৰমাণ হ্য় না যে, এই নবসাহিত্যের মূলে এমন-একটি অজ্ঞাত অবাধ্য এবং অদম্য শক্তি নিহিত রয়েছে, যার স্ফূর্তি কোনোরূপ বাহ্য ঘটনার অধীন নয়? বালিকাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয় স্থলেই নবসাহিত্য যে সমভাবে ও সমতেজে অঙ্কুরিত ও বর্ধিত হচ্ছে, এর থেকে বোঝা উচিত যে, আমাদের জাতীয় মন কোনো নৈসর্গিক কারণে সহসা অসম্ভব রকম উর্বর হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আশার বীজ বপন করাই সংগত, নিরাশার নয়ন-আসার নয়।
এ স্থলে নিজের কৈফিয়তস্বরূপে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক। কেউ মনে করবেন না যে, আমি লেখিকাদের উপর কোনোরূপ কটাক্ষ করে এ-সব কথা বলছি। কেননা তাঁদের রচিত সাহিত্যে এক স্বাক্ষর ব্যতীত স্ত্রীহস্তের অপর কোনো চিহ্ন নেই। ও-সব লেখা শ্রী-স্বাক্ষরিত হলে তার থেকে ‘মতী’-ভ্রংশতার পরিচয় কেউ পেতেন না। এ দেশে স্ত্রী-পুরুষের যে কোনো প্রভেদ আছে তা বঙ্গসাহিত্য থেকে ধরবার জো নেই।
এত বেশি লোক যে এত বেশি লেখা লিখছে, তাতে আনন্দিত হবার অপর কারণও আছে। এই অজস্র রচনা এই সত্যের পরিচয় দেয় যে, বাঙালি জাতি এ যুগে আত্মপ্রকাশের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। যদি কেউ এ স্থলে এ কথা বলেন যে, বাঙালির রচনা যে পরিমাণে প্রকাশিত হচ্ছে সে-পরিমাণে কিছুই প্রকাশ করছে না, তার উত্তরে আমি বলব যে, বাঙালির জাতীয় আত্মা আজও গড়ে ওঠে নি এবং সে আত্মা গড়ে তোলবার পক্ষে সাহিত্য একমাত্র না হলেও একটি প্রধান উপায়। মানুষের দেহ যেমন দৈহিক ক্রিয়াগুলির চর্চার সাহায্যে গড়ে ওঠে, মানুষের মনও তেমনি মানসিক ক্রিয়ার সাহায্যে গড়ে ওঠে। জাতীয় আত্মা আবিষ্কার করবার বস্তু নয়, নির্মাণ করবার বস্তু। আত্মাকে প্রকাশ করবার উদ্যম এবং প্রযত্ন থেকেই আত্মার আবির্ভাব হয়, কেননা সৃষ্টি বহির্মুখী। অবশ্য আমি তাই বলে এ দাবি করি নে যে, আজকাল যত কথা ছাপায় উঠছে তার সকল কথাই জাতীয় মনের উপর ছাপ রেখে যাবে। ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’—ভারতচন্দ্রের এ উক্তি ব্যক্তির পক্ষে যেমন সত্য, জাতির পক্ষে তেমনি সত্য। সুতরাং বাঙালি জাতি যে অনেক বাক্য বৃথা ব্যয় করছেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে কথা বলবার কোনো আবশ্যকতা ছিল না সে কথা বলা হয়েছে বলেই যে তা টিকে যাবে, এমন ভয় পাবার কোনো কারণ নেই 1 সাহিত্যজগৎও যোগ্যতরের উদ্বর্তনের নিয়মের অধীন। কালের নির্মম কবলে পড়ে যা ক্ষীণজীবী তা অচিরে বিনাশ-প্রাপ্ত হবেই হবে। তবে বহু লোকে বহু কথা বললে অনেক সত্য কথা উক্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। নানা মুনির নানা মত থাকাটা দুঃখের বিষয় নয়, নানা মুনির মতের ঐক্যটাই সাহিত্যসমাজে আসল দুঃখের বিষয়। কেননা সে মত যদি ভুল হয় তা হলে সাহিত্যের ষোলো- কড়াই কানা হয়ে যায়। এবং মুনিদের যে মতিভ্রম হয় এ কথা সংস্কৃতেও লেখা আছে। এ যুগের বঙ্গসরস্বতী বহুভাষী হলেও যে বহুরূপী নন এ তো প্রত্যক্ষ সত্য। তবে আমাদের সাহিত্যের সুর যে একঘেয়ে তার কারণ আমাদের জীবন বৈচিত্র্যহীন, এবং এই বৈচিত্র্যহীনতার চর্চা আমরা একটা জাতীয় আর্ট করে তুলেছি। উদাহরণস্বরূপে দেখানো যেতে পারে যে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা এই যে, নানা যন্ত্র এক সুরে বেঁধে তাতে এক সুর বাজালেই ঐকতান হয়। আর্ট-জগতে এই অদ্বৈতবাদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে বঙ্গসাহিত্য মুক্তিলাভ করবে না, এবং যতদিন এ দেশে আবার নূতন চৈতন্যের আবির্ভাব না হবে ততদিন আমরা এক কথাই একশো বার বলব, কেননা সে কথা বলার ভিতরেও মন নেই, শোনার ভিতরেও মন নেই। তাই বলে আমাদের সকল লেখাপড়া একেবারেই অনর্থক নয়। আমরা আর-কিছু করি আর না করি ভাবী গুণীর জন্য আসর জাগিয়ে রাখছি। পাঠকসমাজকে ঘুমিয়ে পড়তে না দেওয়াটাও একটা কম কাজ নয়।
আমরা সদলবলে সাহিত্য তৈরি করি আর না করি, সদলবলে পাঠক তৈরি করছি।
পূর্বে যা বলা গেল, তা অবশ্য সকলের সমান মনঃপূত হবে না, কিন্তু এ কথা আপনারা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে, যে ক্ষেত্রে লেখকের সংখ্যা অগণ্য, সে ক্ষেত্রে কোনো লেখক- এরণ্ড সাহিত্য-দ্রুম স্বরূপে গ্রাহ্য হবেন না। এ বড়ো কম লাভের কথা নয়। হাজার অপ্রিয় হলেও এ কথা সম্পূর্ণ সত্য যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যের কোনো কোনো এরণ্ড এমন মহাবোধিবৃক্ষত্ব লাভ করেছিলেন যে, অদ্যাবধি বঙ্গসাহিত্যের পুরোনো পাণ্ডারা তাঁদের গায়ে সিঁদুর লেপে অপরকে পূজা করতে বলেন। অমুকে কি লিখেছেন কেউ না জানলেও তিনি যে একজন বড়ো লেখক তা সকলেই জানেন, এমন প্রথিতযশা প্রবীণ সাহিত্যিকের দৃষ্টান্ত বঙ্গদেশে বিরল নয়।
এ সাহিত্যের বিরুদ্ধে চুটকিত্বের যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে, সে অপবাদের সত্যাসত্য একটু পরীক্ষা করে দেখা দরকার। ছোটো গল্প, খণ্ড কবিতা, সংক্ষিপ্ত সমালোচনা এবং প্রক্ষিপ্ত দর্শনই এ সাহিত্যের প্রধান সম্বল। সমালোচকদের মতে এই কৃশতাই হচ্ছে এ সাহিত্যের দুর্বলতার লক্ষণ। বিংশ শতাব্দীতে যে কোনো নূতন মেঘনাদবধ, বৃত্রসংহার কিংবা শকুন্তলাতত্ত্ব লেখা হয় নি, এ কথা সত্য। এ যুগের কবিদের বাহু যে আজানুলম্বিত নয়, তার জন্য আমাদের লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই। বধ এবং সংহার ছাড়া কাব্যের যে অপর কোনো কর্তব্য নেই, এ কথা একালে মানা কঠিন। আর যদি এ কথা সত্য হয় যে, মার্কা ব্যাপার না থাকলে কাব্য মহাকাব্য হয় না তা হলে বলতে হয় যে, সাহিত্যজগতের এমন কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম নেই যার দরুন যুগে যুগে সকলকে শুধু মহাকাব্যই লিখতে হবে। প্যারাডাইস লস্ট-এর পরে ইংরেজি ভাষায় আর দ্বিতীয় মহাকাব্য লেখা হয় নি, এবং ফরাসি ভাষায় ও-শ্রেণীর কাব্য কস্মিনকালেও রচিত হয় নি, তাই বলে ফরাসি সাহিত্য এবং মিল্টনের পরবর্তী ইংরেজি সাহিত্যের যে কোনোরূপ গৌরব নেই, এ কথা বলবার দুঃসাহস কোনো পাশ্চাত্য সমালোচক তাঁদের রক্তমাংসের শরীরে ধারণ করেন না।
তার পর আমরা যে শকুন্তলার চাইতে দ্বিগুণ বড়ো শকুন্তলাতত্ত্ব রচনা করি নে, তার জন্য আমাদের কাছে পাঠকসমাজের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। তত্ত্ব হচ্ছে বস্তুর সার, অতএব সংক্ষিপ্ত। এ বিশ্বটি এত বিরাট যে, তাকে সচরাচর অনন্ত ও অসীম বলা হয়ে থাকে, অথচ তাত্ত্বিকেরা বিশ্বতত্ত্ব দু-চারটি ক্ষীণ সূত্রেই আবদ্ধ করে থাকেন। সুতরাং আমরা কোনো সৃষ্ট পদার্থের বিষয় দুশো হাত তত্ত্বজাল বুনতে সাহসী হই নে, অন্তত কোনো কাব্যরত্নকে সে জালে জড়াতে চাই নে। কাব্যের আগুনের পরিচয় দেবার জন্য তাকে সমালোচনার ছাইচাপা দেওয়াটা সুবিবেচনার কার্য নয়, কেননা সে গুণের পরিচায়ক হচ্ছে অনুভূতি।
এ যুগের রচনার নাতিদীর্ঘতা এই সত্যেরই প্রমাণ দেয় যে, একালের লেখকেরা পাঠকদের মান্য করতে শিখেছেন। হিন্দুস্থানিরা বলেন যে, ‘আক্কেলিকো ইসারা বাস্’। যাঁদের শ্রোতার আক্কেলের উপর কোনো আস্থা নেই, তাঁরাই একটুখানি কথাকে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে অনেকখানি করে তুলতে ব্যস্ত।
সমালোচকদের মতে বর্তমানের আর-একটি অপরাধ এই যে, এ যুগে এমন কোনো লেখক জন্মগ্রহণ করেন নি, যাঁর প্রতিভায় দেশ উজ্জ্বল করে রেখেছে। এ আমাদের দুর্ভাগ্য, দোষ নয়; প্রতিভার জন্মের রহস্য কোনো দার্শনিক কি বৈজ্ঞানিক অদ্যাবধি উদ্ঘাটন করতে পারেন নি। তবে এটুকু আমরা জানি যে, প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থার আনুকূল্য চাই। এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে স্বীকার করতেই হবে যে, নূতন সাহিত্য গড়বার যে সুযোগ গত শতাব্দীর লেখকেরা পেয়েছিলেন, সে সুযোগ আমরা অনেকটা হারিয়েছি।
গত যুগের লেখকেরা সবাই প্রধান না হোন, সবাই স্বাধীন ছিলেন। তৎপূর্ব-যুগের বঙ্গসাহিত্যের চাপের ভিতর থেকে তাঁদের তেড়ে-ফুঁড়ে বেরতে হয় নি। একটি সম্পূর্ণ নূতন এবং প্রভূত ঐশ্বর্য ও অপূর্ব সৌন্দর্যশালী সাহিত্যের সংস্পর্শেই ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গসাহিত্য জন্মলাভ করে। সে সাহিত্যের উপর প্রাক্-ব্রিটিশ যুগের বঙ্গসাহিত্যের কোনোরূপ প্রভুত্ব ছিল না। অন্নদামঙ্গলের ভাষা ও ছন্দের কোনোরূপ খাতির রাখলে মাইকেল মেঘনাদবধ রচনা করতেন না, এবং বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়কাহিনীর কোনোরূপ খাতির রাখলে বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী রচনা করতেন না। মিল্টন এবং স্কট যাঁদের গুরু, তাঁদের কাছে ভারতচন্দ্রের ঘেঁষবার অধিকার ছিল না।
কিন্তু আজকের দিনে ইংরেজি সাহিত্য আমাদের কাছে এতটা পরিচিত এবং গা-সওয়া হয়ে এসেছে যে, তার থেকে আমরা আর বিশেষ কোনো নূতন উদ্দীপনা কিংবা উত্তেজনা লাভ করি নে। আমাদের মনে ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম পরিচয়ের চমক ভেঙেছে, কিন্তু বিশেষ পরিচয়ের প্রভাব স্থান পায় নি। সুতরাং আমরা গত যুগের সাহিত্যেরই জের টেনে আসছি। আমাদের পক্ষে তাই নতুন কিছু করা একরকম অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রতিভাশালী লেখকের সাক্ষাৎ আমরা সেই যুগে পাই, যে যুগে একটা নূতন এবং প্রবল ভাবের প্রবাহ হয় ভিতর থেকে ওঠে নয় বাইরে থেকে আসে। গত যুগে যে ভাবের জোয়ার বাইরে থেকে এসেছিল, এ যুগে তার তোড় এত কমে এসেছে যে, ভাটা শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। এদিকে ভিতর থেকেও একটা নূতন কোনো ভাবের উৎস খুলে যায় নি। বরং সমাজের মনের টান আজ পুরাতনের দিকে, এও তো ভাবের প্রবাহের ভাটার অন্যতম লক্ষণ। এই ভাটার মুখে নতুন কিছু করতে হলে কালের স্রোতে উজান বইতে হয়। তা করা সহজ নয়। এ অবস্থায় যা করা সহজ তা হচ্ছে সনাতন জ্যাঠামি। সুতরাং নবসাহিত্যকে বিশেষত্বহীন এবং প্রতিভাহীন বলায় সহৃদয়তার পরিচয় দেওয়া হয় না। আরো বিপদের কথা এই যে, আমরা উভয়সংকটে পড়েছি। কেননা যদি আমরা গত শতাব্দীর সাহিত্যের অনুসরণ করি, তা হলে সমালোচকদের মতে আমরা নকল সাহিত্য রচনা করি। আর যদি অনুকরণ না করি, তা হলে পূর্বোক্ত মতে আমরা কাব্যের উচ্চ আদর্শ থেকে ভ্রষ্ট হই। অথচ আসল ঘটনা এই যে, নবযুগ কতক অংশে পূর্ব যুগের অধীন এবং কতক অংশে স্বাধীন। এই কারণে নবীন সাহিত্যিকেরা গত যুগের সাহিত্যের কোনো কোনো অংশের অনুকরণ করতে অক্ষম এবং কোনো কোনো অংশের অনুসরণ করতে বাধ্য। একালে যে মেঘনাদবধ কিংবা দুর্গেশনন্দিনীর অনুকরণে গদ্য এবং পদ্য কাব্য রচিত হয় না, তার কারণ বাঙালি জাতির মনের কলে স্কট মিল্টন মিল্ ও কঁৎ-এর চাবির দম ফুরিয়ে এসেছে। অপরপক্ষে বর্তমান কাব্যসাহিত্যের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যে অতিবিস্তৃত এবং অপ্রতিহত, তা অস্বীকার করবার জোও নেই, প্রয়োজনও নেই। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বর্তমান কাব্যসাহিত্যের একমাত্র আদর্শ বলে যে সে-সাহিত্যের কোনো মূল্য কিম্বা মর্যাদা নেই এ কথা বলায় শুধু স্থূলদর্শিতার পরিচয় দেওয়া হয়। সুতরাং নবসাহিত্যকে নকল সাহিত্য বলার কি সার্থকতা আছে, তাও একটু পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
সাধারণত লোকের বিশ্বাস যে, পরের লেখার অনুকরণ কিম্বা অনুসরণ করে সাহিত্য রচনা করা যায় না। এ কথাটা ষোলো-আনা সত্য নয়। ও উপায়ে অবশ্য কালিদাস হওয়া যায় না, কিন্তু শ্রীহর্ষ হওয়া যায়। রত্নাবলী মালবিকাগ্নিমিত্রের ছাঁচে ঢালা, অথচ সংস্কৃত সাহিত্যের একখানি উপাদেয় নাটক। পৃথিবীর মহাপ্রাণ কবিদের স্পর্শে বহু লেখক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন, এবং এই কারণেই তাঁদের অবলম্বন করেই সাহিত্যের নানা স্কুল গড়ে ওঠে। ফরাসি এবং জর্মান সাহিত্যে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্যেটের আনুগত্য স্বীকার করাতে শিলারের প্রতিভার হ্রাস হয় নি। ভিক্টর হিউগোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুসে (Musset) অ-কবির দেশে গিয়ে পড়েন নি। এবং ফ্লোবেয়রের কাছে শিক্ষানবিশি করার দরুন গী দ্য মোপাসাঁর গল্প সাহিত্য-সমাজে উপেক্ষিত হয় নি। প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যেও এরূপ ঘটনার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। যাকে আমরা বৈষ্ণব কবিতা বলি, তা চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলীর অনুকরণেই রচিত হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে জ্ঞানদাস গোবিন্দদাস লোচনদাস অনন্তদাসের রচনার যে কোনো মূল্য নেই, এ কথা কোনো সমালোচক সজ্ঞানে বলতে পারবেন না। আর যদি এ কথা সত্য হয় যে, পর-সাহিত্যের অনুকরণে সাহিত্য গঠিত হয় না, তা হলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় সাহিত্য রচিত হয় নি, কেননা গত শতাব্দীর মধ্যযুগের গল্প এবং উপন্যাস, কাব্য এবং মহাকাব্য, সবই যে-সাহিত্যের অনুকরণে রচিত হয়েছিল, সে-সাহিত্য আমাদের নিতান্তই পর; তা অপর দেশের অপর জাতের অপর ভাষায় লিখিত। এ সত্ত্বেও আমরা গত যুগের এই আহেলা বিলাতি সাহিত্যকে বাংলা সাহিত্য বলে আদর করি। তার কারণ এই যে, যে সাহিত্য উপর-সাহিত্য, তা অপরই হোক আর আপনই হোক, মানবমনের উপর তার প্রভাব অনিবার্য।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে এবং অনুসরণে যে কাব্যসাহিত্য রচিত হয়েছে, তা নকল সাহিত্য বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
এই নবকবিদের রচনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রথমেই নজরে পড়ে যে, এ-সকল রচনা ভাষার পারিপাট্যে এবং আকারের পরিচ্ছিন্নতায় পূর্বযুগের কবিতার অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ। যেমন কেবলমাত্র মনের আনন্দে গান গাইলে তা সংগীত হয় না, তেমনি কেবলমাত্র মনের আবেগে স্বচ্ছন্দে লিখে গেলেও তা কবিতা হয় না। মনের ভাবকে ব্যক্ত করবার ক্ষমতার নামই রচনাশক্তি। মনের ভাবকে গড়ে না তুলতে পারলে তা মূর্তিধারণ করে না, আর যার মূর্তি নেই তা অপরের দৃষ্টির বিষয়ীভূত হতে পারে না। কবিতা শব্দকায়। ছন্দমিল ইত্যাদির গুণেই সে কায়ার রূপ ফুটে ওঠে। মনোভাবকে তার অনুরূপ দেহ দিতে হলে শব্দজ্ঞান থাকা চাই, ছন্দমিলের কান থাকা চাই। এ জ্ঞান লাভ করবার জন্য সাধনা চাই, কেননা সাধনা ব্যতীত কোনো আর্টে কৃতিত্ব লাভ করা যায় না। নবকবিরা যে সে-সাধনা করে থাকেন তার কারণ এ ধারণা তাঁদের হৃদয়ঙ্গম হয়েছে যে, লেখা জিনিসটে একটা আর্ট। নবীন কবিদের রচনার সহিত হেমচন্দ্রের ‘কবিতাবলী’ কিংবা নবীনচন্দ্রের ‘অবকাশরঞ্জিনী’র তুলনা করলে নবযুগের কবিতা পূর্বযুগের কবিতার অপেক্ষা আর্ট-অংশে যে কত শ্রেষ্ঠ তা স্পষ্টই প্রতীয়মান হবে। শব্দের সম্পদে এবং সৌন্দর্যে, গঠনের সৌষ্ঠবে এবং সুষমায়, ছন্দে ও মিলে, তালে ও মানে এ শ্রেণীর কবিতা সাহিত্যের ইভলিউশনের এক ধাপ উপরে উঠে গেছে। এ স্থলে হয়তো পূর্বপক্ষ এই আপত্তি উত্থাপন করবেন যে, ভাবের অভাব থেকেই ভাষার এই-সব কারিগরি জন্মলাভ করে। যে কবিতার দেহের সৌন্দর্য নেই, তার যে আত্মার ঐশ্বর্য আছে, এ কথা আমি স্বীকার করতে পারি নে। এলোমেলো ঢিলেঢালা ভাষার অন্তরে ভাবের দিব্যমূর্তি দেখবার মতো অন্তর্দৃষ্টি আমার নেই। প্রচ্ছন্ন মূর্তি ও পরিচ্ছিন্ন মূর্তি এক রূপ নয়। ভাব যে কাব্যের আত্মা এবং ভাষা তার দেহ, এ কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু কাব্যের দেহ থেকে আত্মা পৃথক্ করা অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোথায় দেহের শেষ হয় এবং আত্মার সূত্রপাত হয়, সে সন্ধান কোনো দার্শনিকের জানা নেই। যাঁর রসজ্ঞান আছে তাঁর কাছে এ-সব তর্কের কোনো মূল্য নেই। কবিতা-রচনার আর্ট নবীন কবিদের অনেকটা করায়ত্ত হয়েছে, এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে তাঁদের লজ্জা পাবার কোনো কারণ নেই। ভারতচন্দ্র মালিনীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে-–
আছিল বিস্তর ঠাউ প্রথম বয়েসে।
এবে বুড়া তবু কিছু গুঁড়া আছে শেষে।
স্বয়ং ভারতচন্দ্রের কবিতার যদি ঠাউ বাদ দেওয়া যায়, তা হলে যে গুঁড়া অবশিষ্ট থাকে তাতে ফোঁটা দেওয়াও চলে না, কেননা সে গুঁড়া চন্দনের নয়। অথচ ভারতচন্দ্র যে কবি, সে বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নবীন কবিদের যে ভাবসম্পদ নেই, এ কথা বলায়, আমার বিশ্বাস, কেবলমাত্র অন্যমনস্কতার পরিচয় দেওয়া হয়। মহাকবি ভাস বলেছেন যে, পৃথিবীতে ভালো কাজ করবার লোক সুলভ, চেনবার লোকই দুর্লভ।
মহাকাব্যের দিন যে চলে গেছে, তার প্রমাণ বর্তমান ইউরোপেও পাওয়া যায়। সে দেশে কবিতা আজও লেখা হয়ে থাকে, কিন্তু হাতে-বহরে সে সবই ছোটো। ফরাসিদেশের বিখ্যাত লেখক আঁদ্রে জীদ্ বলেন যে, গীতাঞ্জলি মুষ্টিমেয় না হলে বর্তমান ইউরোপ তা করজোড়ে গ্রহণ করত না। তাঁর ধারণা ছিল যে, ভারতবর্ষে রামায়ণ-মহাভারতের চাইতে ছোটো কিছু লেখা হয় নি এবং হতে পারে না। এ কথা অবশ্য সত্য নয়। সংস্কৃত সাহিত্যে যেমন এক দিকে রামায়ণ- মহাভারত আছে, অপরদিকে তেমনি দু-লাইন চার-লাইন কবিতারও ছড়াছড়ি। ভারতবর্ষে পূর্বে যা ছিল না, সে হচ্ছে এ দুয়ের মাঝামাঝি কোনো পদার্থ। একালে আমরা যে ব্যাস-বাল্মীকির অনুকরণ না করে অমরু-ভর্তৃহরির অনুসরণ করি, সে যুগধর্মের প্রভাবে। যে কারণে ইউরোপে আর মহাকাব্য লেখা হয় না সেই একই কারণে এ দেশেও মহাকাব্য লেখা স্থগিত রয়েছে। এ যুগের কবিতা হচ্ছে হৃদয়ের স্বগতোক্তি, সুতরাং সে উক্তি একটি দীর্ঘনিশ্বাসের চাইতে দীর্ঘ হতে পারে না। কিন্তু একালে গল্প আমরা গদ্যে বলি, কেননা আমরা আবিষ্কার করেছি যে, দুনিয়ার কথা দুনিয়ার লোকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য গদ্যের পথই প্রশস্ত। সুতরাং গল্পের উত্তরোত্তর দেহ সংকুচিত হওয়াটা ক্রমোন্নতির লক্ষণ নয়। ইউরোপে আজও গদ্যে এমন-এমন নভেল লেখা হয়ে থাকে, যা আকারে মহাভারতের সমান না হলেও রামায়ণের তুল্যমূল্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ নভেলিস্ট টলস্টয়ের এক-একখানি নভেল এক-একখানি মহাকাব্যবিশেষ। ও দেশের গদ্যসাহিত্যে যেমন এক দিকে ব্যাস-বাল্মীকি আছে, অপরদিকে তেমনি অমরু-ভর্তৃহরির ও অভাব নেই। যে ক্ষেত্রে হাজার হাজার পাতার দু-চারটি গল্প জন্মলাভ করছে, সেই ক্ষেত্রেই আবার দু-পাতা চার-পাতার হাজার হাজার গল্প জন্মলাভ করছে—এতেই পরিচয় দেয় যে, ইউরোপের মনের ক্ষেত্র কত সরস কত সতেজ কত উর্বর। সুতরাং আমাদের নব গদ্যসাহিত্যে যে ছোটোগল্প ছাড়া আর কিছু গজায় না তাতে অবশ্য এ সাহিত্যের দৈন্যেরই পরিচয় দেয়। কিন্তু এ দীনতা ইউরোপীয় সাহিত্যের তুলনায় যতটা ধরা পড়ে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গসাহিত্যের তুলনায় ততটা নয়। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে গত যুগের গল্পসাহিত্যে সঞ্জীবচন্দ্রের কণ্ঠমালা এবং তারক গাঙ্গুলির স্বর্ণলতা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ যুগের গল্প-লেখকেরা যে সাধারণত ছোটোগল্প রচনার পক্ষপাতী তার কারণ এই যে, আমাদের জীবন ও মন এতই বৈচিত্র্যহীন এবং সে মনে ও সে জীবনে ঘটনা এত অল্পই ঘটে, এবং যা ঘটে তাও এতটা বিশেষত্বহীন যে, তার থেকে কোনো বিরাট কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করা যায় না। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে অ্যানা-ক্যারেনিনা কিংবা লে মিজারেবল্ গড়তে বসায় বাচালতার পরিচয় দেওয়া হয়, প্রতিভার নয়।
এ সমাজে যা পাওয়া যায়, এবং সম্ভবত প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, সে হচ্ছে ছোটোগল্পের খোরাক। আমাদের জীবনের রঙ্গভূমি যতই সংকীর্ণ হোক-না কেন, তারই মধ্যে হাসিকান্নার অভিনয় নিত্য চলছে, কেননা আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব খর্ব করেও নিজেদের মানুষ ছাড়া অপর কোনো শ্রেণীর জীবে পরিণত করতে পারি নি। ভয়-আশা উদ্যম-নৈরাশ্য ভক্তি-ঘৃণা মমতা- নিষ্ঠুরতা ভালোবাসা-দ্বেষহিংসা বীরত্ব-কাপুরুষতা, এক কথায় যা নিয়ে এই মানবজীবন, তা মিনিয়েচারে এ সমাজে সবই মেলে। সুতরাং যখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের গল্পসাহিত্যের এই নূতন পথটি খুলে দিলেন তখন আমরা দলে দলে সোৎসাহে সেই পথে এসে পড়লুম। এ অবশ্য আপসোসের কথা নয়। এবং এর জন্যও দুঃখ করবার দরকার নেই যে, এ পথে এখন এমন বহু লোক দেখা যায়, যাদের কাজ হচ্ছে শুধু সে পথের ভিড় বাড়ানো। কি ধর্মে, কি সাহিত্যে, কোনো মহাজন কর্তৃক একটি নূতন পন্থা অবলম্বিত হলে সেখানে চিরদিনই এমনি জনসমাগম হয়ে থাকে, তার মধ্যে দু-চারজন শুধু এগিয়ে যান। এর থেকে এ প্রমাণ হয় না যে, সে পথ বিপথ; কিন্তু এই প্রমাণ হয় যে, বেশির ভাগ লোক দিগ্ বিদিকজ্ঞানশূন্য। Many are called but few are chosen, বাইবেলের এ কথা হচ্ছে এ সম্বন্ধে শেষ কথা। এ যুগে কোনো অসাধারণ প্রতিভাশালী উপন্যাসকার না থাকলেও এমন অনেক গল্প লেখা হয়ে থাকে যা গত শতাব্দীর কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখকের কলম হতে বেরত না। সুতরাং নবসাহিত্যে যদি chosen few থাকেন, তা হলে আমাদের ভগ্নোদ্যম হবার কারণ নেই।
কার্তিক ১৩২২