সহোদর

সহোদর

‘কী পেলে যুধিষ্ঠির?’

‘বুঝতে পারলাম না মা।’

‘যুদ্ধশেষে কী পেলে তুমি?’

‘জয় পেয়েছি মা। অন্যায়কে নির্মূল করতে পেরেছি।’

‘এই জয়ে কি সুখ আছে? আনন্দিত হয়েছ?’

‘কোন জয়ে আনন্দোল্লাস থাকে না মা?’

‘যে জয়ে আত্মীয়ের রক্ত মিশে থাকে না। তোমাদের এই জয়ে আত্মীয়-পরমাত্মীয়ের রক্ত লেগে আছে।’

‘দুর্যোধনদের যদি জয় হতো, সেই জয় আমাদের মৃতদেহের বিনিময়ে

হতো।’

‘তাদের বিজয় এত অগণন নিকটজনের রক্তে স্নাত হতো না।’

‘তারা দুরাচারী মা। অন্যায়কারী তারা। হেন দুষ্কর্ম নেই, যা দুর্যোধন- দুঃশাসনরা করেনি।’

‘কারা বেশি দুষ্কৃতকারী? তোমরা না কুরুরা?’

‘ওরা মা, ওরাই দুষ্কৃতকারী।’

‘মিথ্যে। মিথ্যেবাদী তুমি যুধিষ্ঠির! আর তোমার নিকটে ওই যে কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছে উদাসীন ভঙ্গিতে, ও হলো সকল দুষ্কর্মের প্রণোদনাকারী।’

‘তুমি ঠিক বলছ না মা। কৃষ্ণ আমাদের সুহৃদ, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। কৃষ্ণ, আমি, আমার চার ভাই মিলে অন্যায়কে ঝেঁটিয়ে ভারতবর্ষ থেকে দূর করেছি।’

‘অজুর্নের কথা বলতে চাইছ তুমি নিশ্চয়ই। ওকে তো ভুবনখ্যাত ধনুর্ধর বলো তোমরা, তাই না?’

‘এটা আজ জগৎ-স্বীকৃত সত্য মা।’

‘সেই জগৎ-স্বীকৃত অর্জুন কী করেছে? দ্রোণাচার্যকে হত্যা করিয়েছে।’ তারপর অর্জুনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কুন্তী বললেন, “শিক্ষাগুরু তো পিতার সমান, তাই-না অর্জুন? সেই পিতৃসম দ্রোণাচার্যকে মিথ্যে সংবাদে হতমান করেছ, বাণে বাণে জর্জরিত করেছ। হতমান, নিরস্ত্র গুরুর মুণ্ডচ্ছেদের জন্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে লেলিয়ে দিয়েছ। দাওনি অর্জুন? মাথা নিচু করছ কেন? ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজঃ’ বলাওনি?”

‘উনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মা। আমরা নিরুপায় ছিলাম। তাঁকে নিধন করার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’ ইতস্তত কণ্ঠে বলল অর্জুন।

‘তাই বলে ছলনায় হত্যা করা! যে আচার্যের পায়ের কাছে বসে অস্ত্রবিদ্যা শিখলে, তাঁর মাথা কেটে নিলে? ছিঃ! কোন সুনীতির বলে এই দুষ্কর্ম করলে তোমরা? আর কর্ণ! কর্ণকে কী নিমর্মভাবে হত্যা করলে তোমরা, যুধিষ্ঠির! অর্জুন, কী করলে তুমি! কৃষ্ণের প্ররোচনায় মহাবীর কর্ণকে কী বীভৎসভাবে হত্যা করলে অর্জুন! ও মা গো…!’ হুড়মুড় করে মাটিতে ভেঙে পড়লেন কুন্তী। তাঁর দুচোখ থেকে অবিরত অশ্রু গড়াতে লাগল।

.

আঠারো দিনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আঠারো অক্ষৌহিণী যোদ্ধার রক্তে কুরুক্ষেত্রের প্রতি ইঞ্চি ভূমি ভিজে গেছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, শল্য, দুর্যোধনের নিরানব্বই জন ভাই, কুরুপক্ষের সব রথী, মহারথীরা যুদ্ধভূমিতে শয্যাগ্রহণ করেছেন। পাণ্ডবপক্ষেও কি হতাহতের সংখ্যা কম? যুধিষ্ঠিরদের শ্বশুর দ্রুপদ, শ্যালক ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীমপুত্র ঘটোৎকচ, পঞ্চপাণ্ডবের পঞ্চপুত্র, কতজনের নাম করা যায়, সবাই নিহত হয়েছেন জীবননাশী এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। পাণ্ডবদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে অভিমন্যুর নিধনে। হস্তিনাপুরে বা হস্তিনাপুরের বাইরের দেশের এমন কেউ নেই, যাঁদের একজনও আত্মীয়স্বজন মারা যাননি।

একই কুরুরাজপ্রাসাদের সন্তান এই কৌরব আর পাণ্ডবরা। ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু দুই ভাই। ধৃতরাষ্ট্র বড় আর পাণ্ডু ছোট। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। তারপরও অনুজ পাণ্ডুর সিংহাসন-উদাসীনতার কারণে হস্তিনাপুরের ভারপ্রাপ্ত রাজা হয়েছেন তিনি। কুন্তী ও মাদ্রী নামের দুই স্ত্রীকে নিয়ে নগরে-অরণ্যে আনন্দের দিনরাত্রি পার করছেন পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে এক কন্যা আর শতপুত্রের জন্ম হয়েছে, দৈবচক্রে পাঁচপুত্রের পিতা হয়েছেন পাণ্ডু। কালক্রমে অভিশপ্ত পাণ্ডু স্ত্রীসংসর্গ করতে গিয়ে মারা গেছেন। মাদ্রী তাঁর সঙ্গে জীবন্ত চিতায় উঠেছেন। নকুল ও সহদেব নামের দুই সতীনপুত্রকে মাতৃবাৎসল্যে লালন করলেন কুন্তী। পঞ্চপাণ্ডব আর শতভ্রাতা আচার্য দ্রোণের পাঠশালায় অস্ত্রবিদ্যার পাঠ নিল। এইটুকু পর্যন্ত জীবন চলল সহজ সরল পথে।

পরিস্থিতি সংকটাপন্ন হলো, যখন জ্যেষ্ঠ রাজপুত্রের যুবরাজ হিসেবে বরিত হবার সময়কাল উপস্থিত হলো। যুবরাজই দেশের পরবর্তীকালের নৃপতি। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রপুত্র; সহোদরদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। ধৃতরাষ্ট্রের অব্যবহিত পরে যুবরাজ হবার অধিকার তারই। এরকমই দাবি তার, সমর্থনও তার পক্ষের রাজন্যদের। যুধিষ্ঠির কুরু-পাণ্ডব—সব ভাইয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে বড় ভাইয়ের রাজা হবার অধিকার। যেমন হয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডুর অনাগ্রহের কারণে রাজ্যশাসক তিনিই হয়েছেন। এদেশের সিংহাসনে যুধিষ্ঠিরের অধিকার সর্বাগ্রে গণ্য। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের দরবারে যুধিষ্ঠিরদের দাবি অগ্রাহ্য হলো। নামকাওয়াস্তে রাজ্য ভাগ করে দিলেন ধৃতরাষ্ট্র। বললেন— হস্তিনাপুরের সিংহাসনে তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের অধিকার নেই। সেই অধিকার দুর্যোধনের। তবে তোমাদের বঞ্চিত করব না আমি। এই বলে রাজ্যের নিষ্ফলা যে ভূমি, সেই ইন্দ্রপ্রস্থের অধিকার দিলেন পাণ্ডুপুত্রদের। পাণ্ডবরা সেখানে গিয়ে রাজ্যপাট গুছিয়ে নিল। অভাবিত ঐশ্বর্যে নতুন রাজধানীকে সজ্জিত করল। রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থের জৌলুস হস্তিনাপুরকে হার মানাল। ক্রোধে আর হিংসায় জ্বলে উঠল দুর্যোধন। হস্তিনাপুরের প্রাচীন বৈভবকে ম্লান করবে ইন্দ্রপ্রস্থ? কখনোই নয়। সকল ক্রোধ গিয়ে পড়ল পঞ্চপাণ্ডবের ওপর। শত্রুকে নির্মূল করতে হবে। জতুগৃহে আগুন জ্বলল। কুন্তী আর তাঁর পাঁচপুত্র কৌশলে পালালেন।

এরপর শুধু হিংসা আর ধ্বংসের কূটজাল বিস্তৃত হয়েছে হস্তিনাপুর থেকে দ্রুপদরাজ্য পর্যন্ত। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন কৃষ্ণ থেকে ভীষ্ম, দ্রুপদ থেকে দ্রোণাচার্য পর্যন্ত। পাঁচ ভাই মিলে দ্রৌপদীকে বিয়ে করেছে। দ্রৌপদী কুরুবংশের ধ্বংসের প্রতীক হয়ে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করেছে। সূতপুত্ৰ কৰ্ণ এসে যুক্ত হয়েছে দুর্যোধনশিবিরে। নৃপতি হয়েও ধৃতরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয়, সকল ক্ষমতার আধার হয়েছে দুর্যোধন। রাজসভার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা দুর্যোধনের কুক্ষিগত হয়েছে। দরবারের ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, বিদুর নির্বাক। ধৃতরাষ্ট্র স্নেহান্ধ। দৈহিক আর মানসিক অন্ধত্ব ধৃতরাষ্ট্রকে একেবারে নিবীর্য করে ছেড়েছে। কর্ণ দুর্যোধনের নিয়ন্ত্রণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। শকুনির কুপরামর্শ দুর্যোধনকে অধিকতর লোভী ও হিংস্র করে তুলেছে।

পাশাখেলার নামে জুয়াখেলার আসর বসেছে। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবকে সেই পাশাক্রীড়ায় আহ্বান জানানো হয়েছে। যুধিষ্ঠির জুয়াসক্ত। শকুনির চালে একে একে রাজ্যপাট, হাতি-ঘোড়া, ধন-ঐশ্বর্য, দাসদাসী, ভীম-অর্জুন- নকুল-সহদেব সবকিছুকে, সবাইকে হারাল। শেষ পর্যন্ত বাজি ধরল দ্রৌপদীকে। এই বাজিতেও হারল যুধিষ্ঠির। দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে হেনস্তা করল দুর্যোধন-দুঃশাসন। তারপর এলো বারো বছরের বনবাস আর একবছর অজ্ঞাতবাসের বাজির পালা। শকুনি দুর্যোধনের হয়ে ঘুঁটির কূটচালে তাও জিতে নিল।

তেরো বছর পার করে যুধিষ্ঠিররা পুনরায় রাজ্যাধিকার চাইলে দুর্যোধনের সাফ উত্তর, ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।’

কৌরব এবং পাণ্ডব—এই দুই শিবিরে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পড়ল। অধিকাংশ রাজ্য যোগ দিল কৌরবপক্ষে। সামান্য সংখ্যক রাজানুগ্রহ নিয়ে পাণ্ডবরা যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন করল। কৌরবপক্ষের এগারো অক্ষৌহিণী আর পাণ্ডবপক্ষের সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

যুদ্ধ হলো, মৃত্যু হলো। কৌরবপক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পাণ্ডবপক্ষে বেঁচে থাকল মুষ্টিমেয় কিছু সৈন্য এবং পঞ্চপাণ্ডব। আর বেঁচে থাকলেন কৃষ্ণ। আর বেঁচে থাকলেন লক্ষ লক্ষ বিধবা নারী। তাঁদের সব হারানোর আর্তনাদে পৃথিবী প্রকম্পিত হতে থাকল।

অগ্রহায়ণের ঘোর অমাবস্যার রাতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হলো। জয়ের আনন্দ নিয়ে যুধিষ্ঠিরাদি ভাইয়েরা মা কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেল। সঙ্গে ভার্যা দ্রৌপদী। সামনে সন্তানদের দেখে কুন্তী জিজ্ঞেস করেছিলেন, যুদ্ধশেষে কী পেলে যুধিষ্ঠির?

মায়ের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বেশটুকু অবাকই হয়েছিল। একী প্রশ্ন মায়ের! মা কী বলতে চাইছে, অনুধাবন করতে পারছে না যুধিষ্ঠির। কুরুক্ষেত্রের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য কে বা কারা দায়ী, সেটা কি মা জানে না? দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় মা-ই তো অঝোর ধারায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল! বারোটি বছর এই জননীই তো তাদের সঙ্গে বনে-অরণ্যে ঘুরে ঘুরে অনাহারে অর্ধাহারে দিন আর রাত কাটিয়েছে! কত শতবার বনের হিংস্র শ্বাপদ যে তাদেরকে আক্রমণে উদ্যত হয়েছে, সেই স্মৃতি কি মা বিস্মৃত হয়ে গেছে? বনবাস শেষে শুধু মাথা গুঁজবার জন্য কৃষ্ণ তাদের হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চেয়েছিলেন। ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’—দুর্যোধনের এই দম্ভোক্তির কথা মার তো এত সহজে ভোলার কথা নয়! তাহলে, তাহলে মায়ের কষ্টটা কোথায়? কোথায়? আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে তাদের বুকের কাছে টেনে নেবে, তা না, কঠিন চোখে জিজ্ঞেস করে বসল—কী পেলে যুধিষ্ঠির? যুদ্ধ তোমাদের কী এনে দিল?

মায়ের এই অভিব্যক্তির কারণ কী? কেনই-বা দোষারোপ করছে কৃষ্ণকে, অর্জুনকে? এঁরা তো যুদ্ধের নিয়ম মেনেই যুদ্ধ করেছেন। নিয়ম মানে অনিয়ম। অনিয়মই তো যুদ্ধের নিয়ম! হ্যাঁ, সে নিজে বিরাট একটা অন্যায় করেছে বটে, পুত্র অশ্বত্থামা নিধনের মিথ্যে সংবাদ দিয়ে গুরু দ্রোণাচার্যকে নিরস্ত্র করেছে। ওই সময় বাণে বাণে ঘনঘোর বাতাবরণের সৃষ্টি করেছে অর্জুন। ফলে ধৃষ্টদ্যুম্ন সহজেই আচার্যের মাথা কেটে নিয়েছে। এই জন্য সে বিবেকদংশনে দংশিত হচ্ছে অবিরত। কুরুরাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা তার অন্য চার ভাইয়ের মতো তাকেও হিংস্র করে তুলেছে। সবকিছু সহ্য করা যায়, দ্রৌপদীর অপমানকে সহ্য করে কী করে? এই জন্যই তো দুঃশাসনের রক্ত পান করেছে ভীম, গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরু ভেঙেছে!

মায়ের করুণ কণ্ঠ যুধিষ্ঠিরের কানে এলো। কুন্তী বলছেন, ‘এই প্রাণঘাতী যুদ্ধ কি এড়ানো যেত না যুধিষ্ঠির?

‘কী করে এড়াব মা? সবকিছু মেনে নেওয়া যায়, দ্রৌপদীর অপমান- লাঞ্ছনাকে কি এড়ানো যায়? নারীর অপমান! ‘

ব্যঙ্গ গলায় হেসে উঠলেন কুন্তী। বললেন, ‘তুমি নারীর লাঞ্ছনার কথা বলছ যুধিষ্ঠির? তোমার কাছে নারীর মূল্যায়ন কতটুকু? ভীষ্মের সঙ্গে তোমার কথোপকথনের কথা কি তুমি ভুলে গেলে?’

বিব্রত কণ্ঠে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল, ‘কোন কথোপকথনের কথা বলছ তুমি মা?’

‘পিতামহ ভীষ্ম সারাজীবন বিয়ে করলেন না। গঙ্গা তাঁকে জন্ম দিয়েই অন্তর্ধান হয়েছিলেন। মা হিসেবে বা স্ত্রী হিসেবে কোনো নারীকে কাছে পাননি তিনি। তাছাড়া সত্যবতীর পিতা দাশরাজার সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ায় নারী-সংসর্গ থেকে নিজেকে সর্বতোভাবে বিরত রাখলেন তিনি। সেই ভীষ্মের কাছে নারীচরিত্রের ব্যাখ্যান চাইলে তুমি! কী বলে চাইলে?’ কথা থামিয়ে পুত্রের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে থাকলেন কুন্তী।

ব্ৰিত চোখে মাথা নিচু করল যুধিষ্ঠির। অন্য ভাইয়েরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। দ্রৌপদী তীক্ষ্ণ চোখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রশ্নসংকুল চোখে কৃষ্ণ তাকিয়ে থাকলেন কুন্তীর দিকে। দূরে দাঁড়ানো অমাত্যরা উৎকর্ণ হয়ে থাকল।

যুধিষ্ঠির ম্লান মুখে মায়ের দিকে একবার তাকাল।

কুন্তী বললেন, ‘তুমি পিতামহ ভীষ্মকে বলেছিলে—নারীরা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করে থাকে। নারীরা কোন পুরুষের প্রতি অনুরক্ত আর কোন পুরুষের প্রতি বিরক্ত, তা বোঝার উপায় নেই। কীভাবে কামিনীদেরকে পরপুরুষ-সংসর্গ থেকে নিবৃত্ত করা যায় বলুন পিতামহ, এই তো জিজ্ঞেস করেছিলে তুমি?’

যুধিষ্ঠির নিরুত্তর। ভাবছে—মা কী করে জানল এসব কথা।

কুন্তী যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘দেখো যুধিষ্ঠির, রাজমাতা আমি। আমারও কিছু সংবাদ-সরবরাহকারী আছে। তোমাকে জিজ্ঞেস করি যুধিষ্ঠির, ক’জন মহিলার সংসর্গে এসেছ তুমি? ক’জন মহিলা তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? তুমি কি দ্রৌপদীর নিরিখে একথা বলেছিলে? দ্রৌপদী কি সেরকম? আর উত্তরে পিতামহ ভীষ্ম কী বলেছিলেন, তা তো তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে?’

দ্রৌপদীর দিকে ম্রিয়মাণ চোখে একবার তাকাল যুধিষ্ঠির। তারপর অসহায় গলায় মাকে বলল, ‘থাক না মা সেসব কথা।’

চড়া গলায় কুন্তী বললেন, ‘থাকবে কেন? আজকে তো চুপ করে থাকার দিন নয়! আজকে তোমাদের প্রাপ্তির দিন, আমার বলার দিন, আর হাহাকারের দিন।

একটু থেমে আবার বললেন কুন্তী, ‘নারী সংসর্গরহিত ভীষ্মদেব সেদিন অতি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন নারীজাতি সম্পর্কে। মনে পড়ে তোমার?’ তারপর ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকালেন কুন্তী। চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। হয়তো পিতামহ ভীষ্মের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন অথবা যুধিষ্ঠিরকে কী বলবেন, তা মনে মনে গুছিয়ে নিলেন।

যুধিষ্ঠিরের চোখে চোখ রেখে বললেন কুন্তী, তাঁর কণ্ঠে গভীর শ্লেষের আভাস, ‘মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্ম বলেছিলেন—নারীচরিত্রের তুলনা চলে শুধু প্রজ্বলিত অগ্নির সঙ্গে, ময়দানবের মায়ার সঙ্গে, ক্ষুরধার সর্পের সঙ্গে। প্রজাপতি স্ত্রীজাতিকে যখন সৃষ্টি করেছেন, সেই থেকে তারা ব্যভিচারী। সুখৈশ্বর্য দিয়েও তাদের সংযত করা যায় না। কূটবাক্য প্রয়োগ, প্রহার, বন্ধন অথবা নানারকম ক্লেশ দিয়েও নারীদের পরকীয়া থেকে বিরত করা যায় না। এই তো বলেছিলেন, পিতামহ ভীষ্ম! তা-ই না যুধিষ্ঠির?’

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন কুন্তী। বললেন, ‘এই তো তুমি, এই-ই তো তোমরা! এই যুধিষ্ঠিরই তো বউকে বাজি ধরতে পারে জুয়াখেলায়! বউকে পণ্যই তো ভাব তুমি! সেই তুমি দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল কারণ বলছ! কতটুকু মূল্য দাও তুমি নারীদের? যাদের মূল্য দাও না মোটেই, তাদের দোহাই দিয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধের আয়োজন করলে।’ অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলেন কুন্তী।

কৃষ্ণ বিব্রত বোধ করতে থাকলেন। কুন্তীকে শান্ত করার জন্য দ্রুত বললেন, ‘এই যুদ্ধ অনিবার্য ছিল রাজমাতা।’

‘অনিবার্য! অনিবার্য ছিল এই যুদ্ধ!’ তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন কুন্তী। তারপর কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে হিংস্র গলায় বললেন, ‘তোমার মতো কূটচারী কৃষ্ণ যাদের সঙ্গী, তাদের কাছে তো এই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবেই।’

‘আপনি আমাকে শুধু শুধু দোষারোপ করছেন রাজমাতা। আমি তো আপনার পুত্রদের ন্যায় আর নীতির পথে চলবার পরামর্শ দিয়েছিমাত্র।’ কৃষ্ণ বললেন।

কুন্তী শক্ত গলায় বললেন, ‘যে নিজে ন্যায়ের পথে চলে না, সে কী করে সুনীতির পথে চলবার পরামর্শ দেয়? গোটাটা জীবন তো অন্যায়ই করে গেছ তুমি কৃষ্ণ।’

বিভ্রান্ত চোখে কৃষ্ণ কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অন্যদিন হলে রূঢ় কণ্ঠে কুন্তীর প্রশ্নের জবাব ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু আজ যে মহান দিন, আজ বিজয়ের দিন! এক মহারক্তসমুদ্র সাঁতরে আজ পাণ্ডবরা বিজয়ের কূলে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ এই স্বস্তির দিনে কঠোর কথায় কুন্তীকে আঘাত দিতে চান না তিনি। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, কেন হঠাৎ রাজমাতা উগ্ররূপ ধারণ করলেন! যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তো তাঁকে জানানো হয়েছে, সেই সময়ে তো প্রীতিভাবই দেখা গেছে তাঁর চোখেমুখে! কিন্তু সেদিনের রাজমাতার সঙ্গে তো আজকের রাজমাতার মিল নেই! যুদ্ধের ভয়ংকরতার জন্য, যুদ্ধের শেষের দিকের সংবাদ অবশ্য তাঁকে দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দ্রোণের নির্দেশে দিন ও রাত্রিব্যাপী যুদ্ধ চলেছে সেসময়। শেষের দিকে এমন কী ঘটনা ঘটল, যার জন্য রাজমাতার মনোবৃত্তিই বদলে গেল! যুদ্ধজয় তো তাঁকে ভীষণভাবে আনন্দিত করার কথা। কিন্তু…।

ভাবনা শেষ করতে পারলেন না কৃষ্ণ। কুন্তীর কথা কানে এলো, ‘তুমি বলছ, আমার সন্তানদের তুমি সৎপথে পরিচালিত করেছ, তাই কি কৃষ্ণ? অর্জুনকে দিয়ে তুমি খাণ্ডবদাহন করালে, হাজার হাজার পশুপাখি হত্যা করালে তুমি অর্জুনকে দিয়ে, এটা কি যথার্থ করেছ তুমি? এত বড় রাজা জরাসন্ধ, তিন অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধীশ্বর, তাকে ব্রহ্মচর্য পালন অবস্থায় হত্যা করালে ভীমার্জুনকে দিয়ে। উপবাসে ক্লিষ্ট, অসহায় জরাসন্ধ কী নিদারুণভাবেই না নিহত হলো! এটা কি? তোমার সৎপথে পরিচালনার উদাহরণ?’

কৃষ্ণ নিম্ন স্বরে বললেন, ‘জরাসন্ধ দুরাত্মা ছিল, হত্যাই তার প্রাপ্য।’

‘ছলনায় হত্যা করিয়েছ তাকে। বীরের মতো যুদ্ধ করার সুযোগ দাওনি জরাসন্ধকে।’ কুন্তী বললেন।

‘ও বড় শক্তিশালী ছিল, ওভাবে তাকে হত্যা না করলে…।’

কৃষ্ণের কথা শেষ করতে দিলেন না কুন্তী। বললেন, ‘ছলনায় হত্যা না করালে জরাসন্ধ অপরাজেয় থাকত, এই তো? আমার দুই পুত্রকে দিয়ে এই মহাবীরকে কূটচালে হত্যা করিয়ে ভীমার্জুনকেই কলঙ্কিত করেছ তুমি। মূলত জরাসন্ধ আর শিশুপাল তোমার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। তোমার মতো কৃষ্ণের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাদের প্রতিরোধ করা। তাই আমার পুত্রদের দিয়ে জরাসন্ধকে নিধন করিয়েছ আর শিশুপালকে হত্যা করেছ তুমি নিজে। দুটো হত্যাই অন্যায় পথে হয়েছে।’

‘ওই সময় যদি ওদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে না দিতাম, তাহলে মাত্র আঠারো দিনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধজয় সম্ভব হতো না। ভীম-অর্জুন-যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ওদের সামনে দাঁড়ানো কঠিন হতো।’ বললেন কৃষ্ণ।

‘কাপুরুষের মতো ওদের সরিয়েছ এই পৃথিবী থেকে। বিচক্ষণ কৃষ্ণের নামের সঙ্গে সঙ্গে কাপুরুষ কৃষ্ণের নামও স্মরণ করবে ভবিষ্যতের পৃথিবী।’

‘আপনি আমায় অভিশাপ দিচ্ছেন রাজমাতা?’

‘অভিশপ্ত হবারই যোগ্য তুমি।’ বলে কুন্তী মৌন হলেন।

অর্জুনের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কৃষ্ণ পাণ্ডবকুলের সুহৃদ। তিনি বিচক্ষণ। বিপুল পরাক্রান্ত সৈন্যবাহিনীর চেয়ে একজন বিচক্ষণ পরামর্শক যে আরও দুর্দান্ত, আরও বেশি পরাক্রমশালী, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ তা প্ৰমাণ করেছেন। কৃষ্ণ না হলে মাত্র সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্যকে পরাজিত করা সম্ভব ছিল না কিছুতেই। কত বড় বড় মহারথী ছিলেন দুর্যোধনদের পক্ষে! ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, একলব্য—এঁরা। কৃষ্ণেরই কূটচালে বড় বড় যোদ্ধাদের মাথা মাটিতে নামাতে পেরেছে সে। এই কৃষ্ণই তো তাকে দু’দুবার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। একবার সুদর্শনচক্র ধারণ করে। আরবার রথচক্রকে মাটিতে দাবিয়ে দিয়ে। নইলে দ্রোণের আর কর্ণের মারণাস্ত্র তার বক্ষকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিত। আজ সেই কৃষ্ণকে দোষারোপ করছে মা! অভিশাপ দিতে চাইছে! যে কোনো মূল্যে মাকে থামাতে হবে।

অর্জুন মাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘মা, তুমি সংযত হও। মিত্র কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়ো না। কৃষ্ণ না হলে এই কুরুক্ষেত্র আমাদেরই রক্তে প্লাবিত হতো। পঞ্চপাণ্ডবের রক্তে ভিজে যেত এই ময়দানের মাটি।’

‘চুপ থাকো তুমি অর্জুন, চুপ থাকো! আমার ভেতরটাকে আর ওলটপালট করে দিয়ো না।’ বলতে বলতে আবার ডুকরে উঠলেন কুন্তী। অনেকক্ষণ কাঁদলেন তিনি। তারপর নিজেকে সংযত কবার চেষ্টা করলেন।

মৃদু কণ্ঠে বলতে থাকলেন, ‘তুমি কৃষ্ণের দোসর অর্জুন। কৃষ্ণের মতো দুরাচারী তুমিও। কৃষ্ণের মতো বহুগামী তুমি। কৃষ্ণের কয়টি বউ জানো? আর তোমার কয়টি? এক দ্রৌপদীতে তুমি তৃপ্ত থাকোনি। যেখানেই গেছ, নারীর প্রতি লুব্ধ হয়ে উঠেছ তুমি। সুভদ্রা, চিত্রাঙ্গদা, উত্তরা। আর কতজনের নাম বলব?’

তারপর হঠাৎ নিজেকে সংযত করলেন কুন্তী। আবেগের বশে ছেলেকে যা বলার নয়, তা বলে ফেলেছেন। আসলে যা তিনি অর্জুনকে বলতে চেয়েছেন, তা বলা হয়নি। তা-ই বলতে হবে তাকে।

কুন্তী এবার করুণ কণ্ঠে হাহাকার করে উঠলেন, ‘তুমি কর্ণকে হত্যা করেছ অর্জুন!’

অর্জুন চমকে মায়ের দিকে তাকাল। বলল, ‘ও তো আমার প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল! আচার্য দ্রোণ তাকে তেমন করে অস্ত্রবিদ্যা দান না করলেও পরশুরামের কল্যাণে কর্ণ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধরে পরিণত হয়েছিল। দুর্যোধনের মিত্র ছিল সে। পাণ্ডবদের মৃত্যুই ছিল তার একমাত্র কাম্য।’

‘মিথ্যে, মিথ্যে অর্জুন। পাণ্ডবদের মৃত্যু তার কাম্য ছিল না। তা যদি হতো যুদ্ধের প্রথম দিকেই তোমাদের সকলের মৃত্যু হতো তার হাতে। ‘

মায়ের কথা শুনে পঞ্চপাণ্ডব চমকে উঠল ভীষণ। মা একী বলছে!

কুন্তী আবার বলতে শুরু করলেন, ‘সেই মহাবীর কর্ণকে তুমি অর্জুন, ওই দুরাচারী কৃষ্ণের প্ররোচনায় অসহায় অবস্থায় হত্যা করলে! তুমি তো নাকি ভুবনখ্যাত বীর, বীর হয়ে তুমি কী নিষ্ঠুরভাবেই না হত্যা করলে কৰ্ণকে!

‘কর্ণ আমাদের শত্রু ছিল মা। মহাবীর ছিল সে। ওভাবে নিধন না করলে, তাকে হত্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। তাই…।’

‘তাই কাপুরুষের মতো নিধন করলে তাকে। কাদাময় নরম মাটিতে রথচক্র দেবে গিয়েছিল তার। কুচক্রী সারথি শল্য ইচ্ছে করে নরম মাটির পথে রথ চালিয়েছিল। শল্য কর্ণের সারথি হলে কী হবে, প্রকৃতপক্ষে ও তো ছিল যুধিষ্ঠিরের পোষ্য। সে একজন মস্তবড় বিশ্বাসঘাতক।

তার পর নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন কুন্তী। বললেন, ‘রথের চাকা মাটি থেকে তুলতে রথ থেকে নেমেছিল কর্ণ। তখন নিরস্ত্র ছিল সে। ওই সময় খড়গাঘাতে মাথা নামালে তার। ও মা গো…!’ বলতে বলতে দুহাতে মুখ ঢাকলেন কুন্তী।

কৃষ্ণ বললেন, ‘ওটাই যুদ্ধনীতি। বেকায়দায় শত্রুকে নিধন করা।’

কুন্তী কান্নাজড়িত গলায় বললেন, ‘ভেবে দেখো কৃষ্ণ, নিহত হবার আগে অর্জুনকেও একই রকম বেকায়দায় পেয়েছিল কর্ণ। মনে পড়ে কি তোমার, জলকাদার ভূমিতে তোমাদের রথও দেবে গিয়েছিল? তোমার তো মনে না পড়ার কথা নয়! গোটা যুদ্ধে তুমিই তো অর্জুনের রথ চালিয়েছ! তখন তোমাদের সামনে সশস্ত্র কর্ণ রথ থামিয়েছিল। তুমি আর অর্জুন, তোমরা দুজনে তখন মাটি থেকে রথের চাকা তুলতে মগ্ন ছিলে। ওই সময় কর্ণ চাইলে একটি মাত্র অস্ত্রের আঘাতে তোমাদের দুজনকে যমালয়ে পাঠাতে পারত। পাঠায়নি। কারণ সে মহাবীর, সিংহ সে। আর তোমরা ছিলে শৃগাল। যে-অবস্থায় তোমাদের অস্ত্রাঘাত করেনি কর্ণ, সেই একই অবস্থায় কৃষ্ণের প্ররোচনায় কর্ণকে হত্যা করলে তুমি অর্জুন!’ অর্জুনের চোখে চোখ রেখে কথা শেষ করলেন কুন্তী। কুন্তী অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।

দ্রৌপদী ধীর পায়ে কুন্তীর দিকে এগিয়ে এলো। বলল, ‘মা, আপনি সংযত হোন। কত যোদ্ধা মারা গেছে এই যুদ্ধে! শুধু তো কর্ণ নন, কর্ণের মতো আরও কত রথী মহারথী নিহত হয়েছেন! অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু, আমার পিতা দ্রুপদ, ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন সবাই নিহত হয়েছেন।’ বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে এলো দ্রৌপদীর।

তারপর নিজেকে সংযত করে দ্রৌপদী আবার বলল, ‘আমার প্রিয়তম পাঁচ পুত্র, অশ্বত্থামারা তাদের হত্যা করেছে…!’ কথা অসমাপ্ত রেখে কুন্তীর পায়ের কাছে ভেঙে পড়ল দ্রৌপদী।

এবার যুধিষ্ঠির আস্তে আস্তে বলল, ‘মা, তুমি এদের জন্য শোক না করে বার বার কর্ণের জন্য শোকাকুল হচ্ছো!’

হাউমাউ করে উঠলেন কুন্তী। দুহাতে বুক চাপড়াতে লাগলেন। হাহাকার করতে করতে বললেন, ‘দ্রৌপদী তার পঞ্চপুত্র হারিয়ে যে বেদনাটা পাচ্ছে, আমি কর্ণকে হারিয়ে সেই কষ্টটাই পাচ্ছি।’

পঞ্চপাণ্ডব সমস্বরে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘মানে!’

‘কর্ণ তোমাদের সহোদর ছিল। আমার কুমারী অবস্থার সন্তান ছিল সে। সে অধিরথপুত্র ছিল না, সে ছিল সূর্যপুত্র।’ আকুলিত গলায় কুন্তী বললেন।

কৃষ্ণ, পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী—সবাই অবাক বিস্ময়ে কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

এই সময় তাঁদের কানে ভেসে এলো কুন্তীর মর্মন্তুদ আর্তনাদ, ‘হা পুত্ৰ, হা কর্ণ! আত্মজ হয়েও মায়ের বাৎসল্য পাওনি তুমি! লোকভয়ে তোমাকে নদীতে বিসর্জন দিয়েছিলাম আমি!’

তারপর পুত্রদের দিকে ফিরে সতেজে বললেন, ‘তোমরা যে ওর সহোদর, সেটা কর্ণ জানত, আমিই জানিয়েছিলাম তাকে, একদিন গোপনে তার সঙ্গে দেখা করে। তাই বাগে পেয়েও তোমাদের হত্যা করেনি কর্ণ। তোমরাই তাকে হত্যা করলে, তুমিই নিরস্ত্র কর্ণকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলে অর্জুন!’ বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন কুন্তী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *