অনার্য অর্জুন

অনার্য অর্জুন

পরলোকে একলব্যের সঙ্গে অর্জুনের হঠাৎ দেখা। তাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়। সেই কথোপকথন এখানে লিপিবদ্ধ হলো।

নমস্কার।

তুমি কি আমাকে চেনো?

না।

তাহলে নমস্কার দিলে যে!

এটাই তো নিয়ম, পরলোকের।

বুঝলাম না। খোলসা করবে?

স্বর্গের এটাই তো প্রথা, ছোটরা বড়োদের শ্রদ্ধাসম্ভাষণ জানাবে।

এই প্রথা কে শেখাল তোমায়?

আপনার তো না জানার কথা নয়! নবাগতদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য এখানে একটা কোচিং সেন্টার আছে। ওই সেন্টারে স্বল্পকালীন মেয়াদে স্বর্গের শিষ্টাচার শেখানো হয়। ওই সেন্টারে আমি ট্রেনিং নিয়েছি।

ও—। তাই বলো। আমিও ওখানকার শিক্ষানবিশ ছিলাম একদা। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, বয়সে তুমি বেশ নবীন

চব্বিশ বছর তিন মাস।

তা তোমার নাম কী?

অর্জুন। অর্জুন আমার নাম।

অর্জুন! কোন অর্জুন! মহাভারতের! না। আমি মহাভারতের অর্জুন নই। তাহলে!

আমি নরসিংদীর ব্রাহ্মণদীর অর্জুন।

তোমার বাবা-মা?

আমার বাবা শ্যামল চট্টোপাধ্যায়। অকালে মারা যায়। আমার ছোটবেলায় মা বিধবা হয়।

ওই অর্জুনের কথিত বাপ পাণ্ডুও অকালে মারা যান। কুন্তী বিধবা হন।

কিছু বললেন? বুঝতে পারছি না।

তোমার বোঝার দরকার নেই। বলো, তোমার মায়ের কথা বলো।

মায়ের নাম অচলা।

তোমার অন্যান্য ভাইবোন?

বোন ছিল না। আমরা পাঁচ ভাই।

পঞ্চপাণ্ডব!

কী বললেন?

ও কিছু না। ভাইদের সম্পর্কে বলো।

আমি তৃতীয়। বড়ো দুই, ছোট দুই।

যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন। তৃতীয় পাণ্ডব তুমি!

না, আমি কোনো তৃতীয় পাণ্ডবটান্ডব নই।

বড়ো দুই ভাই রঞ্জন আর বিনোদ। বিয়ের পর থেকে আলাদা সংসার তাদের। ছোট দুই ভাইকে নিয়ে আমি আর মা।

বড়ো ভাইয়েরা দেখে না তোমাদের?

ওরা আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না। আপন সংসারে মশগুল। ঢাকার শাঁখারি বাজারে দোকান করে।

চলত কী করে তোমাদের? মানে খাওয়া-দাওয়া!

মা বাড়ি বাড়ি ধান ভানত। বাসনকোসন মাজা, কাপড়চোপড় ধোওয়া।

তুমি?

ঘরে ঘরে টিউশনি। ছোট ভাই নকুল-সহদেব ইস্কুলে।

নকুল-সহদেব! আবার বিভ্রান্তি!

ছোট দুজনের একজন নকুল, অন্যজন সহদেব।

নিশ্চয়ই তুমি অর্জুন ছাড়া অন্য কেউ নও। আমার অনুমান মিথ্যে হতে পারে না।

আপনার অনুমান মিথ্যে হবে কেন? আমি তো অৰ্জুনই।

তুমি নরসিংদীর অর্জুন নও। তুমি হস্তিনাপুরের অর্জুন। তিন হাজার বছর পূর্বেকার অর্জুন।

আপনার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। আমি তিন হাজার বছর আগেকার অর্জুন হতে যাব কেন? আমি তো ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের অর্জুন। বাসের ডলায় মারা গিয়ে সদ্য স্বর্গে এসেছি

জন্মান্তর হয়েছে তোমার। মহাভারতের অর্জুন নরসিংদীতে অর্জুন হয়ে জন্মেছ।

কী বলছেন এসব!

তুমি জাতিস্মর নও। জাতিস্মর হলে ফেলে আসা জীবনের সকল কথা মনে পড়ত তোমার।

জাতিস্মর কী, মহাভারতের অর্জুন কে? কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। তোমার ওসব ভাবার দরকার নেই। ভাবনাটা আমার। যা বোঝার তাও বুঝে গেছি আমি।

একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?

করো।

এতক্ষণ ধরে আপনি আমার নাড়িনক্ষত্র বুঝে নিলেন। এই অধম আপনার পরিচয় জানে না। আপনার নামটা কি একটু বলবেন?

আমার নাম? আমি একলব্য।

কোন একলব্য? মহাভারতের?

হ্যাঁ।

ও! আপনার কথাই তাহলে শশধর স্যার বলতেন। কই দেখি দেখি, আপনার ডান হাতটা দেখি!

ডান হাত দেখে কী করবে?

মিলিয়ে নেব।

কী মিলিয়ে নেবে?

শশধর স্যারের কথা।

কী বলতেন তিনি আমাকে, মানে একলব্যকে নিয়ে?

একটু পাগলাধরনের ছিলেন শশধর স্যার। আমাদের ধর্মক্লাস নিতেন। কথায় কথায় মহাভারতকে টেনে আনতেন। হয়তো পড়াচ্ছেন গণেশ বিষয়ে, টেনে আনলেন একলব্যের প্রসঙ্গ। আউলাঝাউলা চুল, আকামানো দাড়ি। দাঁতও সবসময় মাজতেন কি না সন্দেহ!

তা কী বলতেন তিনি একলব্যকে নিয়ে? প্রশ্নটা আগেও করলাম। উত্তর না দিয়ে দিলে শশধর স্যারের বিবরণ!

আপনার প্রসঙ্গ এলেই রেগে যেতেন খুব। চোখ গোল গোল হয়ে যেত তাঁর! চোখের কোনা থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে!

তা এত রাগ তাঁর কার ওপর?

বালকবেলায় তাঁর কথা তো সব বুঝতাম না! আর্য, অনাৰ্য, ব্যাধ—এসব বলতেন। আর জোরসে গালি দিতেন দ্রোণাচার্যকে।

গালি দিতেন!

সে কী গালি! একেবারে মুখ-আলগা গালিগুলো। তিনি যে ক্লাসে পড়াচ্ছেন, ভুলে যেতেন। ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা…।

কী কথা?

বলতে লজ্জা করছে।

সব কথা খুলে না বললে তোমার শশধর স্যারকে বুঝব কী করে? দ্রোণাচার্যের সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনকে খুব গালমন্দ করতেন স্যার। সেই গালি আমার ওপরও কিছুটা বৰ্তাত।

কেন, কেন অর্জুনকে গালমন্দ করতেন?

ওই অর্জুনই নাকি নাটের গুরু। দ্রোণাচার্যকে বকাঝকা করে হয়রান হয়ে একটু থামতেন শশধর স্যার। দম নিতেন। তারপর পেয়ে বসতেন অর্জুনকে। দ্রোণাচার্য নাকি আপনার ক্ষতি করতে চাননি। অর্জুনই নাকি আপনার আঙুল কেটে নেওয়ার জন্য দ্রোণাচার্যকে প্ররোচিত এবং বাধ্য করেছে।

আর কী বলতেন তোমার শশধর স্যার?

অর্জুন নাকি ভীষণ স্বার্থপর শিষ্য ছিল। অস্ত্র-পাঠশালা থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পেছনেও নাকি অর্জুনের ইশারা ছিল!

তারপর?

আপনি যখন নিজ চেষ্টায় ধনুর্ধর হয়ে উঠলেন, অর্জুন সহ্য করতে পারল না। কুকুর দিয়ে ফাঁদ বসিয়ে আপনার কুটিরে দ্রোণাচার্যকে টেনে নিয়ে গেল। কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে অর্জুন নাকি বলেছিল, আপনি তো আমাকে পুত্ৰাধিক ভালোবাসেন, আপনি তো চান আমি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বোত্তম ধনুর্ধর হই। থামিয়ে দিন, একলব্যকে থামিয়ে দিন।

তারপর?

দ্বিধান্বিত ছিলেন দ্রোণাচার্য। কীভাবে থামাবেন তিনি আপনাকে? আপনি তো কোনো দোষ করেননি! ওই সময় নাকি অর্জুন প্রায় গর্জন করে উঠেছিল—আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আপনি কুরুবংশের বাঁধাশিক্ষক। শুধু আর্যদেরই শিক্ষিত করে তোলার কথা আপনার। এই অনার্য একলব্য যদি প্রতাপী ধনুর্ধর হয়ে ওঠে, আর্যদের সমূহ ক্ষতি হবে। আপনি নিশ্চয়ই অনার্য-উত্থান চান না। ধ্বংস করুন, ধ্বংস করুন এই অনার্য ব্যাধ একলব্যকে।

তারপর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন গুরুদেব। তাঁরই মৃন্ময় মূর্তির সামনে আমি অস্ত্রসাধনা করেছি। তাই তিনি আমার গুরুদেব আর আমি তাঁর শিষ্য।

শশধর স্যার বলতেন, ওটাই আপনার সবচাইতে বড়ো দুর্বলতা।

কোনটা?

ওই যে দ্রোণাচার্যের শিষ্যত্ব স্বীকার করা!

করব না! তিনি যে আমার গুরু!

না, তিনি আপনার গুরু ছিলেন না। না শিক্ষাগুরু, না দীক্ষাগুরু। আপনার দুর্বলতা দ্রোণাচার্য বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি…!

আমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙুলটি যাচঞা করেছিলেন।

আর আপনি খচ করে আঙুলটা কেটে রাখলেন গুরুর চরণের কাছে। কী মাথা নিচু করছেন কেন? ভুল করেননি আপনি? শিষ্য না হয়ে গুরুদক্ষিণা দিলেন!

দ্রোণাচার্য চাইলেন যে!

উনি চাইলেন বলে আপনি দিয়ে দিলেন! ওরকম সততাহীন শিক্ষকের অন্যায় চাওয়া পূরণ করলেন আপনি? কী, কিছু বলছেন না যে!

কী বলব আমি! দ্রোণাচার্য ছিলেন আমার ধ্যানজ্ঞান। তিনি আমার স্বর্গ ছিলেন। মাতৃভূমির মতো মর্যাদা দিতাম আমি ওঁকে।

আর ওই মানুষটিই আপনাকে চিরতরে অকেজো করে দিয়ে গেলেন! তিনি জানতেন, তীর চালনার জন্য ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কত জরুরি। আপনাকে প্রাণে মারলেন না তিনি, কিন্তু আপনার স্বপ্ন, আপনার সারাজীবনের বাসনার পরিসমাপ্তি ঘটালেন। পরে তাঁর ওপর রাগ হতো না আপনার?

হতো। সবচাইতে বেশি রাগ হতে অর্জুনের ওপর। প্রতিজ্ঞা করেছি—অর্জুনকে আমি প্রাণে মারব।

মারতে পেরেছিলেন?

না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম আমি।

ওই যুদ্ধ আঠারো দিন চলেছিল। নারী এবং ভূমি নিয়ে কুরু আর

পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ বেধেছিল।

অর্জুনকে মারব বলে কুরুদের দলে ভিড়েছিলাম।

ওই দলে তো দ্রোণাচার্য ছিলেন!

তখন আমার কাছে দ্রোণাচার্য গৌণ। অর্জুনই আমার প্রধান শত্রু।

বাগে পেয়েছিলেন কি অর্জুনকে?

না। অর্জুন কাপুরুষ। আমার সামনে থেকে সে দূরে দূরে থেকেছে। আচমকা আমি তার সামনে উদয় হলে তার সারথি কৃষ্ণ অর্জুনের রথটি পলকে সরিয়ে নিয়েছেন। মারতে পারিনি আমি তাকে।

আপনাকে তো পালাতে হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে!

ঠিক বলেছ তুমি। দুর্যোধনের পতন হলে সসৈন্যে হস্তিনাপুর থেকে সরে এসেছি আমি।

অর্জুন প্রাণে বেঁচে গেছে।

হ্যাঁ, প্রাণে বেঁচে গেছে ওই সময়। কিন্তু আসলেই কি সে বাঁচতে পেরেছে?

বাঁচেনি! বেঁচেছে তো!

বাঁচলে কী তোমার এই দশা হয়!

কোন দশা! ও, আমার ডান হাতের কথা বলছেন?

তোমার ডান হাতটা নেই কেন?

তার আগে বলুন আপনার অন্যান্য বিবরণ। মানে আপনার মা-বাবা, রাজ্য, বড়ো হয়ে ওঠা এসবের কথা বলুন।

আমার বাবা হিরণ্যধনু। অরণ্য মধ্যে বিশাল তাঁর রাজ্য। শবর, ব্যাধরা তাঁর প্রজা। বড়ো ভালোবাসত প্রজারা তাঁকে। আমারও জীবন চলছিল সুখে। দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে ধনুর্বিদ্যা গ্রহণের বাসনা জাগল মনে। ওটাই আমার জীবনের কাল হলো। আঙুল হারালাম। মহাভারতে ব্যাসদেব আমার পরিচয় দিতে গিয়ে শুধু বাপের নামটি লিখেছেন। মায়ের নামটিকে অবহেলা করেছেন। অথচ তিনি নিজে মাকে সম্মান জানিয়ে গেছেন। ধর্ষক পিতা পরাশরকে তাঁর মহাকাব্যে তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু আমার মায়ের পরিচয়ের বেলায় অবহেলার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। আমার মা বিশাখা আমায় ভীষণ ভালোবাসতেন।

এখন বলি আমার কথা, আমার ডান হাত হারানোর কথা।

বলো।

বড়ো দুই ভাই আমাদের অগ্রাহ্য করল। একই ভিটার এধারে-ওধারে থাকি। আমরা কোনো বেলায় খাই, কোনো বেলায় খাবার জোটে না। একদিন মা গঞ্জের বাজার থেকে একটা বাঙ্গি আনল। দুবেলা উপোসি আমরা গোগ্রাসে খেলাম ওই বাঙ্গি। পচা ছিল বোধহয়। মায়ের পেটে সহ্য হলো না। ওই রাতের ভেদবমিতে মারা গেল মা।

মারা গেলেন!

পরদিন সকালে বড়ো ভাই দুজন বউ নিয়ে উঁকি দিতে এসেছিল। মায়াকান্না করল কিছুক্ষণ। উঠানে মানুষের ভিড় বাড়লে সটকে পড়ল।

কেন, সটকে পড়ল কেন?

শ্মশানের খরচ দিতে হয় যদি!

তারপর কী হলো?

পড়শিরা চাঁদা তুলে মায়ের দাহকার্য সারল। নিশ্চয়ই আপনি জিজ্ঞেস করবেন পরে কী হলো?

তাই তো জিজ্ঞেস করব।

ততদিনে আমি এসএসসি পাস করে ফেলেছি।

এসএসসি মানে কী?

ও আপনি বুঝবেন না। পুরানো দিনের মানুষ আপনি। এসএসসি লেখাপড়ার একটা স্তর, প্রাথমিক স্তরও বলতে পারেন। এটা পাস করলে কলেজে ভর্তি হওয়া যায়।

তুমি তোমার দুই ছোট ভাইকে নিয়ে গ্রামে থেকে গেলে!

থেকে যেতাম, যদি খাবার জুটত। গাঁয়ে আমাদের খাবার জুটল না। ভাইদের নিয়ে আমি ঢাকায় চলে গেলাম।

ঢাকা কী?

ঢাকা আমাদের দেশের রাজধানী।

কেন গেলে?

ঢাকায় খাবার জুটবে, এই আশায়। তাছাড়া…।

তাছাড়া কী?

ঢাকা শহরে আমার দূরসম্পর্কের এক পিসি থাকত। ওর কাছে আশ্রয় মিলবে বলে ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলাম।

আশ্রয় জুটেছিল, তোমাদের?

নিতান্ত দরিদ্রঘরে বিয়ে হয়েছিল পিসির। আমাদের আশ্রয় দেওয়ার মতো ক্ষমতা তার ছিল না। একেবারে দূর দূর করেনি আমাদের। সপ্তাহখানেক খেতে থাকতে দিয়েছিল।

তারপর?

পরে কোথায় কোথায় ধরাধরি করে নকুল-সহদেবকে প্রবর্তক অনাথ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল পিসি। আমাকে বলেছিল, তুই বাপ কোনো একটা কামকাজ জোটাতে পারিস কি না দেখ।

জোটাতে পেরেছিলে, কাজ?

ঢাকা একটা নিষ্ঠুর শহর। এই ঢাকা নেয়, দেয় না। শরীরের রক্ত-ঘাম চুষে নেবে, বিনিময়ে আখের ছোবড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

তোমাকেও ছুঁড়ে ফেলেছিল বুঝি!

একেবারে ছুঁড়ে ফেলতে পারেনি। টিউশনি করার অভ্যাস তো আগে থেকেই ছিল! শুরু করলাম টিউশনি। বাসায় বাসায়। পিসিকে খোরাকি দিই, পিসি তার বারান্দার এক কোণে মাথা গোঁজার ঠাঁইটি দিয়েছে আমায়। তার ঘরভর্তি ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনি। এই সময় একটা কাণ্ড করে বসলাম আমি।

কী কাণ্ড করে বসলে?

ঢাকা সিটি কলেজে আইএ-তে ভর্তি হয়ে গেলাম।

মানে আরও বেশি পড়তে চাইলে তুমি।

পিসি বলল, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে চাইলে তোমাকে আরও পড়তে হবে অর্জুন।

ঠিকই বলেছেন তিনি।

আইএ পাস করলাম। বিএ-তে ভর্তি হলাম।

নকুল-সহদেবদের সঙ্গে যোগাযোগ?

সপ্তাহে দুই-তিন দিন তাদের দেখতে যাই আমি। কিছু ফলমূল ও মিষ্টি নিয়ে যাই। তাদের বলি—ভাইয়েরা, আমাদের বড়ো হতে হবে অনেক। তোরা ভালোমতো পড়াশোনা কর। তো একদিন তাদের দেখে পিসির বাসায় ফেরার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটল।

কী দুর্ঘটনা! কোন দুর্ঘটনার কথা বলছ তুমি?

পিসির শরীরটা খারাপের দিকে। পিসি বলেছিল, তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মায়ের বদলে পিসিকে আঁকড়ে ধরেছিলাম আমি। মনটা বড়ো উচাটন ছিল সেইবেলা। লাফিয়ে বাসে উঠেছিলাম ভিড়ের কারণে গাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারিনি। পা-দানিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ডান হাত আর অর্ধেক শরীর বাসের বাইরে ছিল।

তারপর?

আচমকা আমাদের বাসটির গা একেবারে ঘেঁষে আরেকটি বাস এগিয়ে গেল। আমার পাশের সবাই হই চই করে উঠল। ওরা আমার দিকে কী যেন দেখাচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি হঠাৎ ডান দিকে ফিরলাম। দেখি আমার ডান হাতটি নেই। এগিয়ে যাওয়া বাসটির গায়ে লেগে আছে। দরজায় লাগানো কার্টুনের মতো লেপটে আছে।

তারপর!

তারপর আমার কিছুই মনে নেই। হাসপাতালে একবার বুঝি হুঁশ এসেছিল। চারদিকে মানুষজন। তীব্র আলো। আবার চোখ বুজেছিলাম।

তারপর?

তারপর আমার চেতনা ফিরল একদিন। তখন আমি দাঁড়িয়ে। আমার সামনে বিকটাকার একজন মানুষ। আশপাশে গুঞ্জন উঠল—যমরাজ যমরাজ বলে। পরে জানলাম, তিনিই আমাদের পাপ-পুণ্যের বিচারক। পাশের চিত্রগুপ্তের সঙ্গে নিচু স্বরে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, যাও তোমার কোনো পাপ নেই। যমদূতদের ইশারা করে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ওকে স্বর্গে নিয়ে যাও।

তোমাকে দেখে আমি প্রথমে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আঙুল হারিয়ে আমি যে কষ্টটা পেয়েছি, হাত হারিয়ে তুমি আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছ। তারপর তোমার নামটি যখন জানলাম…।

খুশি হলেন। প্রচণ্ড খুশি হলেন। ভাবলেন—আমিই বুঝি মহাভারতের অর্জুন। যে অর্জুন চাতুরির আশ্রয় নিয়ে দ্রোণাচার্যকে দিয়ে আপনার বুড়ো আঙুলটি কেটে নিয়েছিল।

তুমি ঠিকই বলছ ভাই। খুশি হয়েছিলাম খুব। ভেবেছিলাম—আঙুলের পরিবর্তে হাত। বিধাতা গোটা ডান হাতটিই কেড়ে নিয়েছেন তোমার! এতে আমার উল্লসিত হওয়ারই তো কথা! কিন্তু…। কিন্তু পরে যখন বুঝলাম, তুমি কুন্তীপুত্র অর্জুন নও, ভেতরে দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগল আমার।

দেখুন আপনি একটু আগে বিধাতা আমার হাত কেড়ে নিয়েছেন বললেন। এই কথার মধ্যে ভুল আছে।

কী ভুল! বিধাতা নেননি।

না। ঢাকায় বিধাতার কোনো হাত নেই। এখানে যা কিছু কর্ম-অপকর্ম হয়, সবই মানুষের হাত দিয়েই হয়। এই শহরের কোনো বিধাতা নেই। এই শহরে আছে বেপরোয়া কিছু মানুষ। ওরাই ঠিক করে অন্য সাধারণ মানুষের ভাগ্য। কে বাঁচবে, আর কে মরবে, কে ভিখারি হবে, আর কে হবে কোটিপতি, সবই নির্ধারিত হয় ওই সব দুর্দমনীয় মানুষদের দ্বারা। কাকে বেধড়ক পিটাবে আর কাকে মাথায় তুলে নাচবে—ওটা ওদেরই হাতে। এখানে যানচালকরা কোনো শাস্তি পায় না, খুনিরা দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ঋণখেলাপিদের ধনের পাহাড় বড়ো হতে থাকে।

অর্জুন, তোমার অনেক কথাই আমি বুঝতে পারছি না। তবে এইটুকু বুঝেছি, তোমার হত্যাকারী বাসচালকের কোনো শাস্তি হয়নি। ওই গভীর বেদনা নিয়েই তুমি মর্ত্যলোক ছেড়েছ।

শাস্তি হয়নি বললে ভুল হবে। চালকটিকে ধরা হয়েছে। জানি না তার বিচার হবে কি না। বিচার তো হয় না। কালেভদ্রে কারও হলেও অধিকাংশ‍ই ছাড়া কারও পেয়ে যায়। জানি, আমার ঘাতকও ছাড়া পাবে।

ঠিকই বলেছ তুমি, বিচার হবে না। বিচার হয়নি কোনো কালে। আমার কথাই ভাবো, দ্রোণাচার্য আর অর্জুন মিলে এই যে আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা কেড়ে নিল। তার কী বিচার হয়েছে? ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, কুন্তী, দুর্যোধন, ধৃতরাষ্ট্র—এঁরা সবাই শুনেছেন এই অন্যায়ের কথা। কিন্তু তাঁরা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য দেখার মতো নিশ্চুপ থেকেছেন। কেন থেকেছেন জানো?

কেন?

আমি যে অনার্য ব্যাধ!

আমি তো অনার্য ছিলাম না!

ছিলে তো! দরিদ্ররা যে অনার্য ব্যাধেরও অধম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *