উচ্ছিষ্ট
আমি কে, জিজ্ঞেস করছেন?
হ্যাঁ, বলুন তো আপনি কে?
আমি মন্দোদরী। মন্দোদরী আমার নাম।
কোন মন্দোদরী বলুন তো!
এককথায় তো আমার পরিচয় দেওয়া যাবে না।
তাহলে! তাহলে না হয় দু-চার কথায় বলুন।
আমার পরিচয় তো অনেকগুলো।
অনেকগুলো!
হ্যাঁ, অনেক পরিচয়ের মধ্যে তিনটি পরিচয়ের কথা বলতে পারি।
তা-ই বলুন। ওই তিনটি পরিচয়ের কথাই বলুন।
আমার প্রথম পরিচয় আমি লঙ্কাধিপতি রাবণের প্রধান মহিষী।
প্রধান মহিষী কেন? একমাত্র নন কেন?
রাজা রাবণ তো বহুভোগী! যেখানে যে-নারীটি চোখে লেগেছে, ধরে নিয়ে এসেছে। রক্ষিতাশালায় রেখেছে। রাজ্যলোলুপতার সঙ্গে নারীলোভও তার চরিত্রের প্রধান অনুষঙ্গ।
আপনাকেও তেমন করে ধরে এনেছেন বুঝি? জোর খাটিয়ে?
না, আমার বেলায় সেরকম কিছু হয়নি। আমার বাবাই রাবণের হাতে তুলে দিয়েছে আমায়।
সে কেমন! খোলসা করবেন একটু?
বলছি। আপনি তো জানেন, জগৎ-সংসারের মানুষদের সুর আর অসুর—এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সুর মানে দেবতা, অসুর মানে দানব। দেবতারা ভালো, সৎ, সত্যবাদী। অসুররা খারাপ, মিথ্যেবাদী। এই যে সৎ-অসতের কথা বললাম, তা নির্ধারণ করেছে কারা জানেন? ওই দেবতারাই। সুরদের হাত দিয়েই তো শাস্ত্র-শ্লোক—এসব লিখিত হয়েছে।
তাই নাকি!
মুনিঋষি, আর্য, বাল্মীকি—এঁরা তো দেবতা সমর্থনকারী।
আপনি প্রশ্নোত্তর থেকে সরে গেছেন।
সরে যাইনি। বিস্তারিত করতে গিয়ে কথার পিঠে কথা এসেছে।
তারপর?
অসুররাই-বা কম যাবে কেন? সুররা রাজধানী বানাল তো, অসুররাও বানাল। সুরদের আবাস স্বর্গে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর অসুরদের জন্ম- বেড়ে ওঠা এই মর্ত্য্যধামে। তাই তাদের রাজধানী-রাজপ্রাসাদ এই ধরাধামে। সুরদের শ্রেষ্ঠ শিল্পী বিশ্বকর্মা। স্থাপত্যশিল্পী তিনি। ভবন-উদ্যান প্রভৃতির নির্মাতা।
এরকম খ্যাতিমান শিল্পী অসুরদের ছিল না বুঝি?
থাকবে না কেন? অবশ্যই ছিল। সেটাই বলতে চাইছি আপনাকে।
বলুন।
অসুররা পিছিয়ে থাকবে কেন? তাদের মধ্য থেকে তৈরি হলো একজন জাতশিল্পী।
তৈরি হলেন! নাম কী তাঁর?
ময়দানব। ইনি স্বর্গশিল্পী বিশ্বকর্মার মতো দক্ষ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রেয়তরও।
ওঁর গুণাবলি?
বলে শেষ করা যাবে না। দু-চারটি বলছি। ময়দানব বহু বছর সাধনা করেছেন। শুক্রাচার্যকে তুষ্ট করেছেন। শুক্রাচার্য দানবদের কুলপুরোহিত। বহু গুণান্বিত। শিল্পবিদ্যা তাঁর অধিগত। ময়দানবের ওপর খুশি হয়ে শুক্রাচার্য তাঁর সকল জ্ঞান ময়দানবকে দান করেন। ময়দানব অসুরদের জন্য সুশোভন অরণ্য ও হিরন্ময় প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
আচ্ছা, আপনি প্রথম থেকেই ময়দানব সম্পর্কে বিস্তৃত বলতে চাইছেন! কেন?
কারণ তিনি আমার পিতা।
ময়দানব আপনার পিতা! ত্রিভুবন বিখ্যাত শিল্পীর কন্যা আপনি!
আমি হেমার কন্যা।
হেমা কে?
হেমা আমার মা। আমার মা অপ্সরা ছিল। সীমাহীন রূপবতী ছিল মা।
তাঁর রূপেরই বোধহয় যথার্থ প্রতিফলন হয়েছে আপনার মধ্যে!
তা তো আমি বুঝি না। তবে মায়ের রূপে মুগ্ধ হয়েই বাবা মাকে বিয়ে করেছিল।
আর রাবণ মুগ্ধ হয়ে আপনাকে?
কালক্রমে আমি যুবতী হলাম। ও হ্যাঁ, আমরা থাকতাম কিন্তু ঈর্ষাজাগানিয়া প্রাসাদে। হীরক, বৈদুর্য, ইন্দ্রনীলখচিত স্বর্ণময় এক প্রাসাদ বানিয়েছিল বাবা। অরণ্যভ্রমণের খুব ঝোঁক ছিল বাবার। একদিন বাবা আমাকে নিয়ে বনে ভ্রমণ করতে বেরিয়েছে। ওই অরণ্যেই রাবণের সঙ্গে বাবার দেখা।
রাবণেরও বুঝি অরণ্যভ্রমণের শখ ছিল?
মৃগয়ার শখ ছিল। সেদিন রাবণ মৃগয়ার উদ্দেশ্যেই ওই বনে গিয়েছিল।
আপনাকে দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি?
বাবা মুগ্ধ হলো রাবণকে দেখে। রাবণের দিব্য দেহকান্তি, তার কথাবার্তার ধরন, তার বিনয়—এসবে আত্মহারা হলো বাবা।
মানে বিহ্বল হলেন?
বিহ্বলতা বাবাকে দুর্বল করল। নিজের ব্যক্তিত্বের কথা ভুলে গেল বাবা।
তাতে কী হলো?
নিজস্বতা ভুলে বাবা নিয়মবহির্ভূত এক কাজ করে বসল।
নিয়মবহির্ভূত!
পুরুষেরাই নারীর পাণিপ্রার্থনা করবে, এটাই প্রথা।
আপনার বাবা বুঝি প্রথা ভাঙলেন?
প্রথা ভেঙে বাবা বলল, যুবক, তোমাতে মুগ্ধ আমি। তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?
রাবণ কী করলেন?
ও তো কামুক! বাবা তো আর জানত না তার কামুকতার কথা! আমিও না। বাবার কথা শুনে রাবণ এককথায় রাজি হয়ে গেল। তবে বিয়ে দেওয়ার আগে বাবা একটা শপথ রাবণের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল।
কী শপথ?
আমাকে রাজপ্রাসাদের প্রধান মহিষী করতে হবে।
রাবণ তো তাই-ই করেছিলেন?
হ্যাঁ, করেছিল। প্রধান রানি হয়েছিলাম বটে, কিন্তু রাবণের নারীলিপ্সা বন্ধ করতে পারিনি।
তার জন্যই তো সীতাহরণ?
সে কথায় পরে আসছি। তার আগে আমার দ্বিতীয় পরিচয়ের কথা শুনুন।
বলুন।
আমার দ্বিতীয় পরিচয়, আমি বিভীষণের এঁটো-স্ত্রী।
এঁটো-স্ত্রী মানে!
এঁটো মানে তো জানেন। উচ্ছিষ্ট, ভুক্তাবশিষ্ট। ঝুটা খাদ্যও বলতে পারেন।
নিজের সম্পর্কে এভাবে বলছেন কেন? আপনি এঁটো-স্ত্রী হতে যাবেন কেন? তাও বিভীষণের!
রাবণের স্ত্রী ছিলাম, প্রধান রানি; স্বর্ণলঙ্কার প্রধান মহিষী। আমার চারদিকে তখন ঐশ্বর্য। রামের ওই এক কথাতেই আমি উচ্ছিষ্ট হয়ে গেলাম।
বুঝিয়ে বলবেন? এখানে রাম এলেন কোথা থেকে!
তার আগে বিভীষণ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে না আপনার?
করছে তো, ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।
বিভীষণ রাবণের সহোদর। রাবণের পিতার নাম বিশ্রবা। মা নিকষা। আমার শাশুড়ির গর্ভে তিন পুত্র, এক কন্যা জন্মাল। রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ। কন্যার নাম শূর্পণখা। কুম্ভকর্ণ অলস প্রকৃতির, কিন্তু অমিত শক্তিধর। তার মধ্যে কোনো সৃজনক্ষমতা ছিল না। খেত আর ঘুমাত। আর বড়দা রাবণের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। শূর্পণখার মধ্যে একটা আয় আয় ভাব ছিল। দাদার গুণ পেয়েছিল সে। দাদা যেমন নতুন নতুন নারীর, শূর্পণখাও তেমনি নতুন নতুন পুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে চাইত। এ জন্য রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে ঝঞ্ঝাট, সীতাহরণ। সে পরের কথা, আগে বিভীষণের কথা শুনুন।
আপনি একটু থামুন। দম নিন। আপনাকে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে! একটু স্থির হয়ে না হয় বলুন! অনেকক্ষণ কথা বলেছেন আপনি।
আপনারা মীরজাফরকে প্রাণ খুলে গালি দেন, বিভীষণকে কুর্নিশ করেন। বলেন, বিভীষণের মতো মানুষ হয় না। বিভীষণ না হলে শ্রীলঙ্কা রামের পদানত হতো না। লঙ্কাকাণ্ডও সংঘটিত হতো না। আর হতো না সীতা উদ্ধার।
কথাটা তো মিথ্যে নয়! বিভীষণের জন্যই তো রাবণবধ, লঙ্কাজয়।
অথচ এই একমেবাদ্বিতীয়ম বিভীষণের জন্য আপনারা বলেন, ঘরশত্রু বিভীষণ, বেইমান বিভীষণ, ঘর জ্বালানি পর ভুলানি বিভীষণ, বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ। নয় কি?
হ্যাঁ, এটা তো অস্বীকার করার নয়। বিভীষণই তো পরোক্ষভাবে লঙ্কাকে তছনছ করেছে
মানে নিজের মাতৃভূমির ধ্বংসকে অনিবার্য করে তুলেছে এই বিভীষণ। সে তো ভীষণ নয় শুধু, বি-ভীষণ। বিশেষভাবে ভয়ংকর। তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই লঙ্কা তার শ্রী হারিয়েছে, হারিয়েছে স্বাধীনতা। যুগে যুগে তা-ই হয়ে আসছে—বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বীরত্বের পরাজয় ঘটে আসছে। মহাভারতের দিকে তাকান। ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য কি যথাযথভাবে কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন? করেননি! পাণ্ডবদের বিপক্ষে লড়াকু মেজাজ নিয়ে অস্ত্র তোলেননি তাঁরা। তাঁদের মনোভাব ছিল আত্মসমর্পণের। এটা একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। খুব বেশি দূরে যাওয়ার তো দরকার নেই। নিজের দেশের দিকে তাকান না! খন্দকার মোশতাক যদি হারামিপনা না করত, না হতো বিশ্বাসহন্তা, শেখ মুজিব নামের মহিরুহের কি পতন হতো? আপনাদের দেশে এতগুলো আগাছার জন্ম হতো?
ঠিকই বলেছেন আপনি, বিশ্বাসঘাতকেরাই যুগে যুগে ভালোত্বের অবসান ঘটিয়েছে, মহৎ পুরুষদের পতনের পশ্চাতে কলকাঠি নেড়েছে তো তারাই!
আস্ত একটা খলচরিত্র এই বিভীষণ। আর আপনাদের ওই বাল্মীকি, রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি বিভীষণকে বলেছেন ধর্মানুরাগী। আসলে বাল্মীকির পক্ষপাতিত্ব ছিল বিভীষণের প্রতি। তাই তো এত বড় একজন বিশ্বাসহন্তাকে খলনায়ক না বলে ধর্মানুরাগী বলে চালিয়ে দিয়েছেন! বিভীষণের ছিল প্রচণ্ড রাজ্যলোভ। কিন্তু রাবণের সঙ্গে সে শক্তিতে পেরে উঠছিল না। সে জানত, শক্তি দিয়ে কখনো রাবণকে কুপোকাৎ করতে পারবে না। করলে করতে হবে কূটবুদ্ধি দিয়ে। এই সময় বোনের প্ররোচনায় খুব বড় একটা ভুল করে বসল রাবণ, সীতাকে লুণ্ঠন করল। রাবণের এই দুর্বুদ্ধিটাকে কাজে লাগাল বিভীষণ। রামের সঙ্গে গিয়ে ভিড়ল।
সরাসরিই কি রাম-লক্ষ্মণের দলে গেল বিভীষণ? যাওয়ার আগে কোনো পটভূমি তৈরি করল না?
ও তো ভীষণ ধুরন্ধর! ক্ষুরধার বুদ্ধি তার। ধুম করে তো আর রামের শিবিরে যোগ দেওয়া যায় না! রাম তখন বানরবাহিনী নিয়ে লঙ্কার চারদিক ঘিরে ফেলেছে। রাজ্যলোভ তখন বিভীষণের মনে লকলকিয়ে উঠল। হঠাৎ ভালো মানুষ সেজে বসল সে। দাদার কাছে গিয়ে নীতিকথা শোনাতে শুরু করল। বলল, সীতা পরস্ত্রী। তাকে হরণ করে পাপ করেছ তুমি দাদা। সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দাও। নইলে সবংশে রাম তোমায় নিধন করবে। একবারও বলল না বিভীষণ, তাড়কাসহ হাজার হাজার অনার্যকে যে রামরা নিধন করেছে, তার বিহিত কী হবে? রাবণ তো এমনিতেই মাথাগরম মানুষ, বিভীষণের এরকম ভালোমানুষ সাজার মধ্যে কিসের যেন গন্ধ পেল! আচমকা ভাইকে লাথি মেরে বসে রাবণ!
সুযোগ পেয়ে গেল বিভীষণ। মনে মনে যা কামনা করছিল, তাই তো করে বসলেন রাবণ!
আপনি ঠিকই ধরেছেন। বিভীষণকে পদাঘাত করে ক্ষান্ত হলো না রাবণ, লঙ্কা থেকে বের করে দিল। চারজন অনুগতকে নিয়ে বিভীষণ রামের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। রাম তো বিভীষণকে পেয়ে হাতে স্বৰ্গ পেল! বিভীষণ রামের পদে মাথা ঠেকিয়ে বলল, এখন আমার রাজ্যলাভ আপনার হাতে। আপনার কৃপায় এই শ্রীলঙ্কা এবং আরও অনেক কিছু পেতে পারি আমি। রাম বলল, বিনিময়ে কী পাব আমি? বিভীষণ বলল, আনুগত্য। অনার্য হত্যায় আপনাকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করব আমি। লঙ্কাধ্বংসে সহযোগিতা করব। সুগ্রীব বলল, রেখে দিন বিভীষণকে, আপনার পায়ের কাছে আশ্রয় দিন 1
এই সুগ্রীব কে?
আরেক বিভীষণ, আরেক প্রতারক, আরেক বিশ্বাসঘাতী!
সুগ্রীবের পরিচয় দিতে গিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন আপনি I উত্তেজিত হব না! খন্দকার মোশতাকের নাম শুনে আপনি উত্তেজিত হন না? গালি দিতে ইচ্ছে করে না আপনার?
এ্যাঁ হ্যাঁ, করে তো!
মীরজাফর-খন্দকার মোশতাকদের নামান্তর হলো এই বিভীষণ, এই সুগ্রীব।
একটু খুলে বলুন তো! ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোলাটে মনে হচ্ছে!
ঘোলাটেই তো। বিশ্বাসঘাতকের কথা বলতে গিয়ে আপনারা মীরজাফর-মোশতাক-বিভীষণের কথা বলেন, কিন্তু সুগ্রীবের নাম উচ্চারণ করেন না কেউ।
দেখছি সুগ্রীবকে আপনি বেশ অপছন্দ করেন! বিশ্বাসঘাতকও বলছেন তাকে। কিন্তু কেন বুঝতে পারছি না।
শ্রীলঙ্কা ঘিরে এই যে সমুদ্র, তার পূর্বপাড়ে বানররাজ্য। বানররাজ্যের রাজধানী কিষ্কিন্ধ্যা। বালী ছিল বানরসাম্রাজ্যের অধিপতি। বালীর স্ত্রী তারা, পুত্র অঙ্গদ এবং ছোট ভাইয়ের নাম সুগ্রীব। বালী ছিল মহাশক্তিশালী। এই যে আমি রাবণ রাবণ করছি, রাবণও বালীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছে। শক্তিপরীক্ষায়, রাবণকে নাকাল হতে হয়েছে বালীর হাতে। পরে অবশ্য বালীর সঙ্গে রাবণের বন্ধুত্ব হয়। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সুগ্রীবের কথা বলি। সুগ্রীব সুবিধাবাদী। বিভীষণের মতো রাজ্যলোভী। কিন্তু সুবিধা করতে পারছিল না তেমন। একদিন সুযোগ এসে গেল সুগ্রীবের হাতে।
কী সুযোগ?
মায়াবী নামের একজনের সঙ্গে বালীর সংঘর্ষ বাধে এক রাতে। বালী মায়াবীকে তাড়িয়ে এক পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়। সঙ্গে ভাই সুগ্রীব। মায়াবী হঠাৎ এক গুহায় ঢুকে পড়ে। পশ্চাৎ পশ্চাৎ বালীও ঢুকে যায়। ঢুকবার আগে সুগ্রীবকে বলে, তুমি এই গুহামুখে পাহারায় থেকো। আমার না-ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। বালী গুহায় ঢুকে গেলে বিশাল একটা পাথরখণ্ড দিয়ে গুহামুখটি বন্ধ করে দেয় সুগ্রীব।
কেন, কেন বন্ধ করে দেয়!
বালী যাতে আর কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরতে না পারে।
ফিরতে না পারলে কী হবে!
সুগ্রীব কপিরাজ হবে। কিষ্কিন্ধ্যা দখল করবে। তারাকে শয্যাসঙ্গিনী করবে।
এসব কী বলছেন আপনি!
যা সত্যি, তাই বলছি। কিন্তু সুগ্রীবের বাসনা পূরণ হয়নি। বাহুবলে পাথরটা সরিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে এসেছে বালী। তার হাতে মায়াবীর রক্ত, মনে পাহাড়সমান ক্রোধ। সুগ্রীবকে লাঞ্ছিত করে বানররাজ্যের ওপারে পাঠিয়ে দিল বালী।
তারপর?
সীতাকে হারিয়ে রাম তখন পাগলপ্রায়। লক্ষ্মণের কোনো আশ্বাসেই শান্ত হচ্ছে না রাম। ওই সময় গভীর অরণ্যমধ্যে সুগ্রীবকে পেয়ে গেল রাম। সুগ্রীবের প্ররোচনায় রাম নিরপরাধ বালীকে হত্যা করল। সুগ্রীবকে বানররাজ বলে ঘোষণা করল। এইটুকু পর্যন্ত না হয় মেনে নেওয়া যায়…।
কোনটা মেনে নেওয়া যায় না?
এই রাম রানি তারাকে বাধ্য করল সুগ্রীবের অঙ্কশায়িনী হতে।
রানি তারা কী করল?
বেচারি কী আর করবে! প্রথম দিকে তীব্র প্রতিবাদ করল তারা। রাম, ধর্মরাজ নাকি সে, সেই রাম বলল, যদি তুমি সুগ্রীবকে স্বামী হিসেবে মেনে
না নাও, তাহলে বালীর যে দশা হয়েছে, তোমার একমাত্র পুত্র অঙ্গদেরও সেই দশা হবে।
মানে!
অঙ্গদকে হত্যা করার হুমকি দিল রাম। স্বামী হারিয়ে দিশেহারা তারা। পুত্র হারাতে চাইল না। রামের কথা মেনে নিল। এখন বলুন, বিভীষণের চেয়ে সুগ্রীব কম কিসে?
রাম তো বিভীষণকে চরণে ঠাঁই দিলেন, মানে প্রতিপক্ষের বড় একটা শক্তিকে নিজের দলে পেয়ে গেলেন রাম। বিভীষণকে দিয়ে কী স্বার্থ উদ্ধার করলেন তিনি?
রাম মহাবিচক্ষণ। বিভীষণের কাছ থেকে স্বর্ণলঙ্কার অন্ধিসন্ধি জেনে নিল। হনুমানকে পাঠিয়ে লঙ্কায় আগুন লাগাল।
তার আগেই তো সীতাকে এনে অশোকবনে রেখেছেন রাবণ? কী ব্যাপার, অশোকবন আর সীতার কথা শুনে এরকম বিষণ্ন হয়ে গেলেন কেন আপনি?
বলছি, সীতাকে যেই গোধূলিতে অপহরণ করে আনল রাবণ, সেই সন্ধ্যায় বা রাতে সীতাকে অশোকবনে পাঠায়নি।
পাঠাননি! তাহলে কোথায় রাখলেন?
রাজপ্রাসাদে, রাবণের শয্যাকক্ষে।
মানে! কী বলছেন আপনি এসব!
যা সত্যি, তাই বলছি। আমি তো প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
প্রত্যক্ষ সাক্ষী!
হ্যাঁ। সীতাকে রাজপ্রাসাদে ঢুকিয়ে দাস-দাসী-প্রহরী-সৈন্য-দেহরক্ষী- সবাইকে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যেতে নির্দেশ দিল রাবণ।
আপনি!
আমাকেও রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করতে বলল রাবণ। বলল, আজ অন্য কোথাও গিয়ে থাকো তুমি। আজ রাতটা আমার আর সীতার।
আপনি কী করলেন?
রাবণ যেমন নারীলোভী, তেমনি দুর্দান্ত ক্রোধী। ক্রোধানলে যেকোনো জনকে, সে যতই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হোক না কেন, ভস্ম করে দিতে পারে রাবণ। ওই সময় রাবণের চেহারা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ছেড়ে গেলাম রাজপ্রাসাদ।
পরদিন?
পরদিন ফিরে এসেছিলাম। সীতা তখন অশোকবনে। বিপর্যস্ত বিপন্ন সীতা তখন মুহ্যমান। এই পাপের ফল পেতে হলো রাবণকে।
সে কেমন?
বিভীষণের কূটবুদ্ধির মারপ্যাচে লঙ্কার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ল রাবণের শক্তিমত্তার সকল তথ্য রামকে জানিয়ে দিল বিভীষণ। ঘোরতর যুদ্ধে হাজার-লক্ষ অনার্য সৈন্য নিহত হলো রামপক্ষের হাতে। বিভীষণের জ্ঞাতিবিরোধিতার কারণে রাবণ নিহত হলো। বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকল না তার। রাবণের মৃত্যুবাণের সন্ধান দিয়েছিল এই বিভীষণই।
তারপর?
লঙ্কাকে ছারখার করতে পারায়, সীতাকে উদ্ধার করতে পারায় রাম বিভীষণকে উপহার দিল 1
কী উপহার?
লঙ্কার শাসনভার আর আমাকে বিভীষণের হাতে তুলে দিল রাম। বিভীষণ কী করল?
ধর্মানুরাগী বিভীষণ, হ্যাঁ রামের কাছে, মানে মহাকবি বাল্মীকির কাছে বিভীষণ তো তখন মস্তবড় ধর্মানুরাগী, তো সেই বিভীষণ তড়িঘড়ি করে লঙ্কার সিংহাসনে চড়ে বসল। আর…।
আর?
আমাকে বিয়ে করার ঘোষণা দিয়ে বসল। রাম লঙ্কা ত্যাগ করার আগেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইল বিভীষণ।
আচ্ছা, বিভীষণের স্ত্রী-পুত্র ছিল না?
ছিল তো! তার স্ত্রী সরমা, পুত্র তরণীসেন। এই তরণীসেন রাবণের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে রামের হাতে নিহত হয়েছে।
বউ থাকা সত্ত্বেও আপনাকে বিয়ে করল বিভীষণ?
করবে না! নারীলোলুপতা যে ওদের বংশধারায়! নারীভোগের ব্যাপারে রাবণ-বিভীষণে কোনো তফাত নেই। কষ্ট তো শুধু নারীজাতিরই! যেমন সীতা, যেমন তারা, যেমন আমি!
বিয়ের আগে আপনি কোনো বাধা দিলেন না?
আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি। প্রাসাদশীর্ষ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার আগে এক প্রহরী দেখে ফেলেছিল আমায়। আমার মরণ হয়নি। বিভীষণ আমাকে বিয়ে করেই ছাড়ল।
অ…।
এখন আপনিই বলুন আমি বিভীষণের উচ্ছিষ্ট-স্ত্রী কি না? আমার জীবন-যৌবন তো রাবণে সমর্পিত ছিল! তার ভোগ্যা ছিলাম আমি। একজনের ভোগ্যা অন্যজনের কাছে উচ্ছিষ্ট নয় কি!
আপনার তিনটা পরিচয়ের কথা বলেছিলেন আপনি। দুটো জানলাম, তৃতীয়টি?
তার আগে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি আমার নামটা খেয়াল করেছেন?
হ্যাঁ, করেছি তো! মন্দোদরী।
মানে?
বুঝলাম না আপনার কথা!
মন্দোদরীর মানেটা কী? বলতে পারলেন না তো! বলছি। মন্দোদরী’তে দুটো শব্দ—মন্দ আর উদরী। মন্দ মানে কী?
মন্দ অর্থ খারাপ।
আর উদর অর্থ?
পেট, জঠর, গর্ভ।
তাহলে মন্দোদরী মানে কী দাঁড়ায়?
যার জঠর খারাপ। যার গর্ভ কুৎসিত।
ঠিক তাই। এত এত নাম থাকতে বাল্মীকি আমার নাম দিলেন মন্দোদরী। মানে আমার পেটে যারা জন্মাবে, তারা সবাই মন্দ। এই তো মানে হয় আমার নামের!
হ্যাঁ, ঠিক তাই তো!
অথচ দেখুন, আমি পেটে ধরেছি মেঘনাদকে। ইন্দ্রজিৎ আমার মেঘনাদের আরেকটা নাম। রাম-লক্ষ্মণের রক্ত জল করে ছেড়েছে যে ইন্দ্রজিৎ, সে আমার সন্তান, গর্ভজাত পুত্রসন্তান।
ঠিকই তো বলেছেন আপনি!
যদি ঠিক বলে থাকি, তাহলে আমার এরকম বিশ্রী নাম কেন? বাল্মীকি ছিলেন আর্য, ঋষি। আর্য যখন কলম ধরেছেন, তাঁর হাতে অনার্যদের সুশোভন নাম হবে কেন? আমার নামের কথা না হয় বাদই দেন, বিভীষণের নামের মধ্যে না হয় যথার্থতা আছে, কিন্তু কুম্ভকর্ণ বা শূর্পণখার নামের মধ্যে? কী ভাবছেন?
না, আপনার কথা শুনে ভাবছি…
কুম্ভ মানে কলস। কুম্ভকর্ণ মানে কলসের মতো কান যার। শূৰ্প অর্থ কুলা। যার নখ কুলার মতো, সেই শূর্পণখা। বাল্মীকি রাবণের ভাইবোনের নাম দিলেন এরকম। বিকৃত নাম। এ শুধু নাম তো নয়, দেহগঠনেরও বিবরণ। এ নাম আপত্তিকর। অথচ দেখুন, নিজের প্রিয় চরিত্রগুলোর নাম দিলেন সুগ্রীব, রাম, দশরথ, সীতা, লক্ষ্মণ!
আচ্ছা, বিভীষণ না হয় নিজ স্বার্থোদ্ধারের জন্য সীতাকে ফিরিয়ে দিতে বলেছিল রাবণকে, আপনি বলেননি?
সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার আমি রাবণকে অনুরোধ করেছি। রাবণ কর্ণপাত করেনি। সীতাকে ফিরিয়ে না দেওয়ার ফলে আমাকেও বারবার বানরের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। আপনাদের বাঙালি কবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে লিখেছেন—বানররা আমাকে রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে বের করে আমার পোশাক পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছে। এরকম অপমান তো আমায় রাবণের কারণেই পেতে হলো!
তার পরও রাবণের বোধোদয় হয়নি?
রাবণের কারণেই আমাকে আমার সেরা পুত্রটিকে হারাতে হলো। ইন্দ্রজিৎ আমার গর্ব। আমার মরুজীবনে মরূদ্যান ছিল সে। সে বীর ছিল। বাপের হয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপী মেঘনাদকে কব্জা করা সম্ভব ছিল না রাম-লক্ষ্মণের পক্ষে। দুই ভাইকে নাগপাশ বাণে আবদ্ধ করে সৈকতে শুইয়ে রেখেছিল।
আপনার এই পুত্র দিয়েই তো রাবণ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতেন!
সহজেই জয়ী হতে পারত রাবণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেঘনাদকে যুদ্ধ করতে দেওয়া হয়নি।
সে কেমন? কে যুদ্ধ করতে দেয়নি!
মোট তিন দিন যুদ্ধ করেছিল মেঘনাদ। দুই দিন যুদ্ধক্ষেত্রে, একদিন নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে। প্রথম দুদিন সশস্ত্র থাকলেও শেষদিন পুত্র আমার নিরস্ত্র ছিল।
নিরস্ত্র ছিলেন! নিরস্ত্র হয়ে কি যুদ্ধ করা যায়?
প্রথম দিন রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে মেঘনাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। মেঘনাদের অস্ত্রাঘাতে রাম-লক্ষ্মণ মৃতপ্রায়। পুত্রটি বড় বীর ছিল সত্যি, কিন্তু বাস্তবজ্ঞান ছিল না তার। পরাস্ত রাম-লক্ষ্মণকে চিরতরে শেষ করে না দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে চলে এলো।
তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধি কি কম ছিল?
নিশ্চয়ই। নইলে কেন সে দ্বিতীয় দিনও একই কাজ করবে!
বুঝতে পারলাম না।
আপনিই বলুন ঋণ, অগ্নি, ব্যাধি—এসবের শেষ রাখতে আছে?
না। এদের শেষ রাখতে নেই। এদের নির্মূলেই মঙ্গল।
তেমনি করে শত্রুরও শেষ রাখতে নেই। শত্রুর মৃত্যুও নিশ্চিত করতে হয়। মেঘনাদ কী করেছে জানেন?
কী করেছেন?
যুদ্ধে রাম-লক্ষ্মণ-সুগ্রীব-বিভীষণকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে হত্যা করেনি। মুমূর্ষু অবস্থায় ওদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে চলে এসেছে এবং এতেই কাল হয়েছে। যে বিরাট ভুল মেঘনাদ করেছে, নিজের জীবন দিয়ে সেই ভুলের মাশুল গুনেছে মেঘনাদ।
জীবন দিয়ে!
হ্যাঁ। মেঘনাদ আমার, নিজের জীবনের বিনিময়ে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। বারবার পরাজিত হবার পর কৃতঘ্ন বিভীষণ রামকে বুদ্ধি দিল—মেঘনাদকে যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে না। তাকে বাগে আনতে হবে নিকুম্ভিলা মন্দিরে, যখন সেখানে মেঘনাদ যজ্ঞে মগ্ন থাকবে।
মন্দিরে পুজো দিতেন নাকি মেঘনাদ?
কেন, অবিশ্বাস হয় আপনার?
না, বলছিলাম কী, সব পুজোআচ্চা তো আর্যদের জন্য!
মিথ্যে মিথ্যে। অনার্যরা কি ঈশ্বর মানে না? তাদের কি দেবদেবী নেই? তাদের কি পাপপুণ্যবোধ নেই?
বলছিলাম, অনার্যদের তো আর্যশাস্ত্রে বারবার ছোট করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওরা রাক্ষস, ওরা কীট, ওরা পক্ষী!
এসব ওই আর্যশাস্ত্রকারদের চালাকি। আমাদের দমিয়ে রাখার ফন্দি। তাই তো আজও এই বিশ্বে অনার্যরা ইতর ছোটলোক বলে পরিচিত হয়ে আসছে। আসলে অনার্যরা সর্বার্থে আর্যদের সমকক্ষ ছিল। কিন্তু নানা ফন্দিফিকির করে ওদের সংস্কৃতিকে উদ্ভাসিত হতে দেয়নি ওই রামরা, ওই বাল্মীকিরা।
আপনি বেশ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেছেন!
মেঘনাদ প্রতিসকালে নিকুম্ভিলা মন্দিরে পুজো দিত। যুদ্ধ শুরু করার আগে একবার নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে যেত। পুজো শেষে মেঘনাদ হয়ে উঠত দুর্জয়। বিভীষণ জানত এটা। তাই চোরের মতো এক সকালে লক্ষ্মণ-সুগ্রীব- হনুমানকে সঙ্গে নিয়ে বিভীষণ নিকুম্ভিলা মন্দিরে উপস্থিত হলো। আহ, পুত্ৰ মেঘনাদ! পুত্র আমার সেসময় পুজোয় মগ্ন ছিল! চোখ বুজে ঘণ্টি বাজিয়ে পুজো করছিল মেঘনাদ!
তারপর! তারপর কী হলো?
পেছন থেকে আক্রমণ করে বসল লক্ষ্মণ। নিরস্ত্র মেঘনাদ প্রাণপণ যুঝে গেছে। কিন্তু সশস্ত্র শত্রুদের সঙ্গে কতক্ষণ আর টিকে থাকা যায়? অস্ত্রের এক আঘাতে লক্ষ্মণ মেঘনাদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। হোঃ হোঃ হোঃ! পুত্র, পুত্র মেঘনাদ রে!
আপনি ব্যাকুল হবেন না মন্দোদরী দেবী। ধৈর্য ধরুন।
ধৈর্য তো ধরে আছি আমি। নইলে পুত্রহন্তা, স্বামীঘাতক বিভীষণের সঙ্গে ঘর করি!
এটাকে বোধহয় নিয়তি বলে।
নিয়তি! নিয়তি আবার কী! নিয়তির সকল দণ্ড কি শুধু অনার্যের ওপর নেমে আসতে বলেছে! নিয়তির অভিশাপ কি শুধু তারার জন্য, শুধু আমার জন্য? রাবণের জন্য, কুম্ভকর্ণের জন্য? রামের জন্য নয়, লক্ষ্মণের জন্য নয়? কিছু বলছেন না যে! চুপ করে আছেন কেন?
আমি আর কী বলব বলুন!
আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। আমার সকল কথা আপনি শুনলেন। এখন বলুন—আমি কে, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি কী বলব? বলব—আমি নারীভোগী, সীতা লুণ্ঠনকারী, স্বাধীনতাকামী রাবণের স্ত্রী? বলব—আমি কৃতঘ্ন, কুলাঙ্গার, জ্ঞাতিদ্রোহী বিভীষণের উচ্ছিষ্ট বউ মন্দোদরী? নাকি বলব—ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত শ্রীলঙ্কার মহাবীর মেঘনাদের জননী আমি? কোন পরিচয়টা আমার জন্য শ্লাঘার, বলতে পারেন?
এতক্ষণ যে শ্রোতাটি মন্দোদরীর সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নিয়েছেন, মন্দোদরীর শেষ প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করলেন তিনি।