ব্যর্থ কাম
খুব ‘মহাভারত’ পড়েন ধরণীবাবু।
আগে পড়তেন কাহিনির টানে, এখন পড়েন জীবনের অন্তগূঢ় রহস্যের উত্তর খোঁজার বাসনায়।
ধরণীবাবুর পুরো নাম ধরণীপ্রসাদ চক্রবর্তী। এখন তেষট্টি। চাকরি করতেন একটা বেসরকারি ব্যাংকে, অ্যাকাউন্টস সেকশনের প্রধান ছিলেন। পঞ্চান্নতে চাকরি ছাড়েন। মানে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। হিসেবের গোলমালের কারণে সাসপেন্ড হবার আগেই চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন চক্রবর্তীবাবু।
অব্যাহতি নেওয়ার আগে সেলিম সাহেবকে ফাঁসিয়ে যান। সেলিম জাহিদকে দীর্ঘ চার বছর ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অপরাধে জেল খাটতে হয়েছে। সেলিম জাহিদ ধরণীবাবুর অধস্তন কর্মকর্তা ছিলেন না। ছিলেন ওই ব্যাংকের ম্যানেজার। তারপরও চক্রবর্তীবাবুর মারপ্যাচে কুপোকাত হয়েছিলেন সেলিম জাহিদ। জাহিদ সাহেব জেলে গেলে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়েছিলেন ধরণীবাবু। তদন্ত কমিটি সন্দেহের তর্জনী তাঁর দিকেও উঁচিয়ে ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে জাহিদ সাহেব শাস্তি পেলেও ধরণীবাবু জানতেন, তাড়াতাড়ি বিদায় না নিলে অধিকতর তদন্তে, যদি হয় কখনও, তাঁকেও ফেঁসে যেতে হবে। জাহিদ সাহেবের সইটা তো তিনিই জাল করিয়েছিলেন।
নন্দনকানন গোলাপ সিংহ লেনে বাড়ি তাঁর। চাকরি থাকতে থাকতেই বাড়ির ফাউন্ডেশনটা দিয়েছিলেন, চাকরি ছাড়ার পর কমপ্লিট করেছেন। টাইলস মোড়ানো ঝকঝকে আলিশান তেতলা বাড়ি। প্রতিবেশী আর পরিচিতরা চোখ ঠাটিয়েছিল। এতটাকা পেলেন কোথায় ধরণীবাবু! চাকরি থাকলে না হয় একটা কথা ছিল! বউও তো কোনো চাকরিবাকরি করেন না, গুপ্তধন পেয়েছেন নাকি?
গুপ্তধন পেয়েছিলেন বইকি ধরণীবাবু!
ম্যানেজার সেলিম জাহিদ সহজ সরল মানুষ ছিলেন। ধরণীবাবুকে বড় বিশ্বাস করতেন তিনি! আর তাঁর সইটাও ছিল সোজা, ব্যাংকের চেকে, কাগজপত্রে ‘সে জাহিদ’ লিখতেন শুধু। সাধারণত ঊর্ধ্বতন পদের কর্মকর্তারা নিজেদের সই-স্বাক্ষর প্যাচালো করেন। অন্যরা যাতে স্বাক্ষর জাল করতে না পারে। সেলিম সাহেব তা করেননি।
প্রথম দিকে ধরণীবাবু একবার বলেছিলেন, ‘একটা কথা বলি স্যার, আপনার স্বাক্ষরটা বড়ই সোজা। যেকোনো সময় বিপদে পড়তে পারেন।’
সন্দিগ্ধ চোখে সেলিম জাহিদ ধরণীবাবুর দিকে তাকিয়ে থেকেছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফিক করে হেসে দিয়েছিলেন। ফিক করে মেয়েরা হাসে, পুরুষেরা নয়। সেলিম সাহেব ফিক করে হেসেছিলেন। কারণ তাঁর মধ্যে মেয়েলিভাবটা একটু বেশি। মেয়েদের মতো বোকাসোকাও ছিলেন তিনি। নইলে কেন ধরণীবাবুর আগাম সতর্কবাণী থেকে কোনো শিক্ষা নেননি? ধরণীবাবুর কথা থেকে তিনি যদি শিক্ষা নিতেন, স্বাক্ষরটা যদি জটিল করতেন, তাহলে তাঁকে জেলও খাটতে হতো না আর ধরণীবাবুর অর্থনৈতিক অবস্থা এরকম বিস্ময়করভাবে পরিবর্তিতও হতো না।
সেদিন ধরণীবাবুর কথা শুনে সেলিম জাহিদ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘অ্যাকাউন্টেন্ট-ক্যাশিয়ারের কারণেই ম্যানেজাররা বিপদে পড়ে, হিসাবশাখার প্রধান অসৎ হলে ম্যানেজারের বারোটা বাজে। আপনি একজন সৎলোক ধরণীবাবু। আপনি থাকতে আমি বিপদে পড়ব কেন?
সেদিন আর কথা বাড়াননি ধরণীবাবু। ‘তা তো বটেই, তা তো বটেই, বলতে বলতে সেলিম জাহিদের সামনে থেকে উঠে গিয়েছিলেন।
আনোয়ারার তৈলারদ্বীপ গ্রাম থেকে খালি হাতেই চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন ধরণীবাবু। সম্বল শুধু বিকম পাসের সার্টিফিকেটটা আর ‘চক্রবর্তী’ পদবিটা। বাপ নিখিল চক্রবর্তী ছিলেন পূজারি বামুন। এ-বাড়ি ও-বাড়ি, এ-মন্দির ও-মন্দিরে পুজো-আচ্চা করে সংসার চালাতেন। স্থাবর সম্পত্তি বলতে ওই বসতভিটেটাই। একটা মেয়ে ছিল নিখিলবাবুর, পাশের গাঁয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলেটাকে বিকম পাস করিয়েছিলেন কষ্টেসৃষ্টে। তারপর টুপ করে মারা গিয়েছিলেন। আগেই বউটার স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটেছিল।
ধরণীবাবু একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলেন। গ্রামের বুড়ো হেডমাস্টারের পরামর্শে শহরে চলে এসেছিলেন। ব্যাংকের চাকরিটাও পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর একটা দুইটা পদ পেরিয়ে অ্যাকাউন্টেন্টের পদে থিতু হয়েছিলেন। বিয়ে করবার বছরকয়েক পরে বউ পরামর্শ দিয়েছিলেন—গাঁয়ের ভিটেটা রেখে লাভ কী? বেচে দিয়ে কিছু ক্যাশ টাকা হাতে নাও।
ধরণীবাবু বলেছিলেন, ‘বলো কী তুমি! জন্মভিটে বলে কথা! মা-বাবার গন্ধ আছে না ওই ভিটেয়!’
ধরণীবাবুর স্ত্রী বড় ঠান্ডামাথার মহিলা। বুদ্ধিও রাখেন বেশ।
বলেছিলেন, ‘তুমি তো আর তৈলারদ্বীপ ফিরে যাচ্ছো না। শহরেই তো থাকবে। শহরের মাটি এত মিঠা যে বুড়ো বয়সেও ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না। তাছাড়া…।’ বলে থেমেছিলেন বউটি।
ধরণীবাবু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলেন স্ত্রীর দিকে। বলেছিলেন, ‘তাছাড়া?’
‘তোমার জেঠাতো ভাইয়েরা মাস্তান টাইপের। গ্রামেই থাকে। প্রভাব প্রতিপত্তি তোমার চেয়ে বেশি। এক ফাঁকে তোমার পৈতৃক ভিটেটাই দখল করে বসবে।’ স্ত্রী বলেছিলেন।
‘ধূর, কী যে বলো না তুমি!’
‘মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাটি ভেবে দেখো তুমি। আমাদের ছেলেটি এখনও বালক। যদি ভিটেটা দখলই করে ফেলে ওরা, করবেটা কী তুমি? কী করতে পারবে?’ ধীরে ধীরে বলেছিলেন বউটি।
চুপ মেরে গিয়েছিলেন ধরণীবাবু। বউ তো ঠিকই বলছেন! জেঠাতো ভাইয়েরা তিন ভাই। উনি তো একা! তাছাড়া ওরা মাস্তান ধরনের। ওদের সঙ্গে পেরে উঠবেন কেন তিনি? তাহলে এখন কী করা উচিত তাঁর?
বউটি যেন তাঁর মনের কথা বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘শোন, আমি একটি জায়গা দেখেছি। তিন কাঠার। গোলাপ সিংহ লেনে। ওপারে চলে যাবে ওরা। বলছে, উচিত দাম পেলে বিক্রি করে দেবে।’
আর দোনামনা করেননি ধরণীবাবু। জন্মভিটেটা বিক্রি করে দিয়ে গোলাপ সিংহ লেনের জায়গাটি কিনে নিয়েছিলেন। ম্যানেজারের স্বাক্ষর জাল করে মেরে দেওয়া টাকা দিয়ে ওই জায়গায় তেতলাটি তুলেছিলেন।
দোতলার পশ্চিমের ফ্ল্যাটে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকেন ধরণীবাবু। অন্য পাঁচটা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছেন। ওই ভাড়ার টাকায় তার সংসার চলে স্বচ্ছন্দে। ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন, বুয়েট থেকে। ঢাকার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরিও পেয়ে গেছে সুলাল। গেল বছর জাঁকজমকে বিয়ে করিয়েছেন ছেলেকে। বউ নিয়ে সুলাল ঢাকাতেই থাকে। পুজো-উৎসবে বাপের বাড়িতে দু’চারদিন সপরিবারে থেকে যায় সুলাল।
ব্যাংকের চাকরির পর আর কোনো চাকরি করেননি ধরণীবাবু। হাতে অঢেল টাকা। চাকরির দরকার কী? বছর দুই ঘর তৈরিতে গেল।
থিতু হবার পর বউ বলল, ‘চাকরির দরকার নেই আর। ভাড়ার টাকা তো কম না! তাছাড়া ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ও বেরিয়ে এলে টাকা খরচের কোনো পথই থাকবে না আমাদের। এখন থেকে খাবেদাবে আর আমাকে দেখবে।’
‘মানে!’
‘বুড়ো খোকা, বুঝছ না কী বলছি?’ বুকের আঁচলটা আলগা করে সুদেষ্ণা বলেছিলেন।
এতক্ষণে বুঝতে পেরেছিলেন বউয়ের কথার মানে। চেয়ার ছেড়ে সুদেষ্ণাকে পেছন থেকে জাপটে ধরেছিলেন।
সুদেষ্ণা গলায় রস ছড়িয়ে বলেছিলেন, ‘পেছনে কেন, সামনে জড়াও।’
সেদিন থেকে ধরণী-সুদেষ্ণার দাম্পত্যজীবনের চেহারাটাই পাল্টে গিয়েছিল। জড়াজড়ি, চুমোচুমি, ভালোবাসাবাসি।
পাল্টাবেও না কেন? সুদেষ্ণা তো আর দেখতে মলয়া-স্বপ্না-রত্নার মতো নারী নন! আধুনিক কালের মানুষেরা খাসা বা বিন্দাস শব্দ যেজন্য ব্যবহার করে, সুদেষ্ণা ছিলেন সেরকমই। ছিলেন বলছি কেন, এই তিপ্পান্ন বছর বয়সেও তাঁর দিক থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। একবার তাকানোর পর ঘুরে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করে। পাঁচ ফুট সাড়ে চারের সুদেষ্ণা। কালো নন। আবার ফরসা বললে উপহাস বোঝাবে। কালো আর গৌরবর্ণের মাঝামাঝি গায়ের রং। কোমর ছাড়ানো চুল। এই তিপ্পান্নতেও একটা চুল পাকেনি। তবে আগে যেরকম ঝাঁকড়া ছিল, এখন সেরকম নেই। চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে এই যা। শরীরের গাঁথুনি ভালো। স্তনযুগল এখনও ঈর্ষণীয়ভাবে পুরুষ্টু, উন্নত
সুদেষ্ণার শরীর নিয়ে ধরণীবাবুর দিন কাটে, রাত কাটে। সুদেষ্ণাও ধরণীবাবুকে উসকান। একে তো খালি ফ্ল্যাট, তার ওপর সুদেষ্ণার লোভনীয় শরীর! রসেবশে কাটতে থাকে ধরণীবাবুর জীবন।
ষাট পেরোনোর পর ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকলেন ধরণীবাবু। পাশের গলির শ্যামকালী মন্দিরে যাতায়াত শুরু করলেন তিনি। মাঝেমধ্যে দু’একটা ধর্মসভায় বক্তৃতাও দিতে শুরু করলেন। বক্তৃতা দিতে গিয়ে বুঝলেন, ধর্মগ্রন্থ আর শাস্ত্রাদি ভালো করে পাঠ না করলে বক্তৃতা ঠিকঠাকমতো জমবে না। তিনি ‘গীতা’, ‘রামায়ণ’, ‘পুরাণ’–এসব পড়া শুরু করলেন। বেশি করে পড়তে লাগলেন ‘মহাভারত’।
পড়তে পড়তে তাঁর ঘোর লেগে গেল। আরে! মানবজীবনের সব কথাবার্তা তো ‘মহাভারতে’ সন্নিবেশিত! প্রেম-অপ্রেম-পরকীয়া-উল্লাস-ক্ষরণ-হত্যা-গুপ্তহত্যা সবই তো আছে এই গ্রন্থে! মানুষের বহির্জীবনের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্গত-জীবনের কথা লিখতেও তো ভোলেননি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস!
ধরণীবাবু ‘মহাভারত’ পড়েন আর ভাবেন। ভাবেন আর মানুষকে বোঝান। এখন শ্যামকালী মন্দিরে, সপ্তাহে অন্তত একটি সন্ধ্যায়, কথা বলতে হয় তাঁকে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ভক্তরা একত্রিত হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। ওইদিন মন্দিরের পুরোহিত শ্রীনিত্যানন্দ ভট্টাচার্যও ধর্মকথা শোনান শ্রোতাদের। কিন্তু তাঁর বক্তৃতা শ্লোকসমাকীর্ণ, নীরস। পুরোহিতের বক্তৃতা শুনতে শুনতে উসখুস করতে থাকে শ্রোতারা। বারবার ধরণীবাবুর দিকে তাকায়। কখন ভট্টাচার্য মশাইয়ের বক্তৃতা শেষ হবে, কখন ধরণীবাবু বক্তৃতা দেওয়া শুরু করবেন—এই আশায় থাকে।
ধরণীবাবু বক্তৃতা দিতে শুরু করলে হাততালি পড়ে, শেষ হলে আরও জোরে। বক্তৃতায় কী এমন বক্তব্য থাকে যে, মানুষেরা তাঁর কথা শুনবার জন্য পাগলপ্রায়? ভাবেন ধরণীবাবু। তিনি ধর্মকে যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবজগতে এনে দাঁড় করান, পুরাণকাহিনিকে মানবকাহিনির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে একটা স্বস্তিকর বিশ্বাসের জগৎ তৈরি করে দেন শ্রোতাদের সামনে। শ্রোতারা তখন ভাবতে বসেন—সত্যিই তো, ধর্ম তো কোনো অধরা কল্পলোকের বস্তু নয়, যাকে নিছক পুরাণকাহিনি বলে এতদিন উড়িয়ে দিয়েছে, তা তো এই গার্হস্থ্যজীবনের চৌহদ্দিতে সংঘটিত হয়ে চলেছে অবিরাম!
গত পরশু সন্ধেয় ধরণীপ্রসাদ চক্রবর্তী বক্তৃতা দিলেন পাণ্ডু আর তাঁর দুই স্ত্রীকে নিয়ে। দুই যুবতি স্ত্রী কুন্তী আর মাদ্রীকে নিয়ে পাণ্ডু বনবাসে গেছেন। অরণ্যচারী মানুষ যে রকম কৃচ্ছ্রসাধন করে, যেরকম শরীর-সংযমী হয়, ওরা কিন্তু সেরকম কিছু করেননি। বরং মৃগয়ায় গেলে মানুষ যেরকম আনন্দ ফুর্তি করে, তাঁরা তা-ই করেছেন অরণ্যমধ্যে।
হস্তিনাপুরে দুই স্ত্রীকে নিয়ে আরাম-আয়াসে দিন কাটছিল পাণ্ডুর। বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ! অন্ধত্বের কারণে বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েও রাজ্যচালানোর অধিকার পাননি তিনি। দেশ শাসনের অধিকার পেয়েছিলেন অনুজ পাণ্ডু। রাজা হবার অস্বস্তি তাঁকে পেয়ে বসেছিল। একদিন সব ছেড়েছুড়ে বনে যাওয়া মনস্থ করলেন পাণ্ডু। রাজ্যশাসনের যে অস্বস্তি, তা থেকে মুক্তি নিয়ে সস্ত্রীক বনে চলে গেলেন পাণ্ডু। অরণ্যবাসের একদিন পাণ্ডু মৃগয়ায় গেলেন। বধ করলেন এক হরিণীকে। হরিণ মূর্তি ধারণ করলেন। কিমিন্দম মুনি হরিণরূপ ধারণ করে বনের হরিণীকে সংগম করছিলেন। মানুষীতে অরুচি ধরে গিয়েছিল বোধহয় ঋষি কিমিন্দমের! তাই তাঁর হরিণীতে উপগত হওয়া। পাণ্ডু তো আর মুনির বিচিত্র-বিদঘুটে রুচির কথা জানেন না! ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মৃগয়া। সেই ধর্মই পালন করেছেন পাণ্ডু।
কিন্তু সংগমে ব্যর্থ মুনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, ‘হে পাণ্ডু, তুমি স্ত্রীতে উপগত হতে পারবে না আর কোনোদিন। তোমার বাসনা জাগবে স্ত্রীসংগমের কিন্তু ওই ইচ্ছের বশবর্তী হয়ে স্ত্রীসংগমে রত হলে তোমার মৃত্যু হবে। এই আমার অভিশাপ।’
‘ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মৃগয়া, আপনি যে হরিণরূপ ধারণ করে মানবেতর প্রাণীতে কামের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছেন, তা তো আমার জানার কথা নয়! আপনি আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন মুনিবর।’ এরকম নানা যুক্তি দেখিয়ে ক্ষমা চাইলেন পাণ্ডু কিমিন্দম মুনির কাছে।
কিন্তু মুনির এককথা—আজ থেকে তুমি অভিশপ্ত পাণ্ডু। কোনো নারীতে উপগত হয়েছ তো মরেছ!
অরণ্যগৃহে ফিরে প্রিয়তমা স্ত্রী কুন্তীকেই শুধু অভিশাপের কথাটা বললেন। কুন্তী নিজে সাবধান হলেন, মাদ্রীকেও সাবধান করলেন।
পাণ্ডু স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আদর করেন, উপগত হবার প্রস্তুতিপর্ব সমাপন করেন। কিন্তু স্ত্রীসংগমের চরম তৃপ্তি লাভ করতে পারেন না। কিমিন্দমের অভিশাপের কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যান তিনি। সংগমেচ্ছা নিমিষেই উধাও হয়ে যায় তাঁর মন থেকে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ব্ৰিতাপন্ন মন নিয়ে পাশ ফিরে শোন পাণ্ডু। স্ত্রীরা অস্বস্তিময় শরীর নিয়ে শয্যা থেকে উঠে যান।
.
সেদিন শ্যামাকালী মন্দিরের বক্ততা শেষে বাড়ি ফিরে ‘মহাভারত’ নিয়ে বসেন ধরণীবাবু। পুনরায় পড়তে থাকেন পাণ্ডু-কুন্তী-মাদ্রীর অংশটি। এই কাহিনি পড়তে পড়তে নিজের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকেন ধরণীপ্রসাদ চক্রবর্তী।
গত মাসছয়েক ধরে তিনিও যেন পাণ্ডুর মতন হয়ে গেছেন। তবে পাণ্ডু আর তাঁর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। পাণ্ডুর মধ্যে উত্তেজনা আছে, কিন্তু স্ত্রীসংগমে অভিশপ্ত। ধরণীবাবুকে কেউ অভিশাপ দেয়নি, তারপরও ইদানীং তিনি সুদেষ্ণাসংগমে ব্যর্থ। সুদেষ্ণা পাশে শুয়ে থাকেন, শরীরের কাপড়চোপড় আলুথালু করে রাখেন। যে স্তনযুগলে তিনি বিয়ে-পরবর্তী দিন থেকে আসক্ত, সেই পুরুষ্টু স্তন দুটো এখন আর তাঁকে আকুল করে না। তাঁর সকল শারীরিক উত্তেজনা মরে গেছে যেন! আগে সময়ে অসময়ে সুদেষ্ণার শরীর নিয়ে খেলা করতেন ধরণীপ্রসাদ, এখন মোটেই ইচ্ছে করে না এসব করতে। ভেতরের সকল কাম সমাধিপ্রাপ্ত হয়ে গেছে যেন!
একদিন লজ্জা ত্যাগ করে সুদেষ্ণা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার! আমার দিকে তাকাও না যে, আগের মতো!’
‘পারি না।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর ধরণীবাবুর।
‘মানে!’ অবাক চোখে মৃদু কণ্ঠে বলেন সুদেষ্ণা।
‘এখনও তোমাকে আগের মতো পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু নেওয়ার যে শক্তি, তা আমার ফুরিয়ে গেছে! আমি পাণ্ডুর মতো অভিশপ্ত নই, কিন্তু কী এক অলক্ষিত দৈব-অভিশাপে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে রে সুদেষ্ণা!’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন ধরণীপ্রসাদ চক্রবর্তী।