দূর দিগন্তে অন্ধকার

দূর দিগন্তে অন্ধকার

এক.

বৈকুণ্ঠ।

এখানে দুঃখ-অপমান-নিরাশা-প্ররোচনা-লালসা-রিরংসার বড় অভাব। এখানে যা আছে, তা শুধু ভালোবাসাবাসি, শুধু সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য।

বৈকুণ্ঠে কারও প্রতি কারও পক্ষপাতিত্ব নেই, নেই আবার ঔদাসীন্যও। সবাই সবাইকে ভালোবাসে, আবার সবাই সবার প্রতি নির্মোহ। এখানে কারও প্রতি কারও হিংসা নেই, নেই কোনো বিতৃষ্ণাও। ক্রোধ বৈকুণ্ঠ থেকে চিরতরে নির্বাসিত। এখানকার অধিবাসীদের লোভ-ভোগেচ্ছা একেবারেই নির্বাপিত। বৈকুণ্ঠে নেই কোনো হানাহানি, নেই নারী বা ভূমির অধিকার পাওয়ার জন্য হিংস্রতা। এখানে কেউ কারও একার নয়, সবাই সবাকার। এখানে দ্রৌপদী দুর্যোধনের পাশ ঘেঁষে বসে খোশগল্পে মাতোয়ারা হন, শকুন্তলা দুষ্মন্তকে এড়িয়ে যুধিষ্ঠিরের কোলে মাথা রেখে বিশ্রাম নেন। শূর্পণখা লক্ষ্মণকে বগলদাবা করে নির্জন অরণ্যের দিকে এগিয়ে যায়। ভীম রাধার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করেন। এখানে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধিকা উতলা হন না। চিরকুমার যে ভীষ্ম, অপ্সরী মেনকার দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকেন, কখন মেনকা চোখে ঝিলিক তুলে মুচকি একটু হাসে! ধনুর্ধর দ্রোণাচার্য তীর-তলোয়ার ছেড়ে সুরাপাত্র হাতে দিন কাটান।

বৈকুণ্ঠে অশান্তি নেই, বৈকুণ্ঠে চিরকালীন বসন্ত। এখানকার মানুষগুলোর মনে কোনো আগল নেই। সত্য কথা দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করে বসেন এঁরা।

দুই.

দশরথ অযোধ্যার রাজা। সুজলা-সুফলা তাঁর দেশ। ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। কোনো কিছুরই খামতি নেই রাজা দশরথের। তাঁর পত্নীর সংখ্যা সাড়ে তিনশো। তাঁদের মধ্যে রানিই তিনজন— কৌশল্যা, কৈকেয়ী এবং সুমিত্রা। প্রধান মহিষী কৌশল্যা। কৈকেয়ী তাঁর রূপ-যৌবন-ছলাকলার কারণে দশরথের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের নিয়ে দশরথের সুখের জীবন, কিন্তু স্বস্তির নয়। অস্বস্তির কারণ, রাজা দশরথ অপুত্রক। ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে’ ভার্যা বলে শাস্ত্রে যে একখানা কথা আছে, তা মেনে সাড়ে তিনশো পত্নী সংগ্রহ করেও রাজা দশরথ পুত্রের মুখ দেখলেন না। কুলগুরু পরামর্শ দিলেন পুত্রেষ্টিযজ্ঞ করতে। এই যজ্ঞ কোনো এক খ্যাতিমান ঋষির পৌরহিত্যে সুসম্পন্ন করতে পারলে রানিদের গর্ভে পুত্র জন্মাবে।

দশরথ কুলগুরুর কথা মানলেন। পুত্রেষ্টিযজ্ঞের আয়োজন করলেন। ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গকে আনা হলো যজ্ঞের পৌরহিত্য করতে। যজ্ঞশেষে ঋষ্যশৃঙ্গ রানিদের পায়েস দিলেন, সাদা পায়েস, ভক্ষণ করতে। তিন রানি ভাগ করে ওই পায়েস উপভোগ করলেন। পুত্রসন্তান হলো তিন রানির— কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত আর সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। জমজ ওরা।

কালে কালে বড় হলো ছেলেরা। রাজা দশরথ বুড়ো হলেন। বড় ছেলে রামচন্দ্রকে যুবরাজ নির্বাচন করতে চাইলেন দশরথ। বাধ সাধলেন কৈকেয়ী।

বললেন, ‘রামের চেয়ে আমার ছেলে ভরত উপযুক্ত। অযোধ্যার যুবরাজ হয়ে ভবিষ্যতে অযোধ্যা-অধিপতি হবার সকল গুণ ভরতের আছে। সুতরাং রামকে বাদ দিয়ে ভরতকেই যুবরাজ করুন মহারাজ।’

দশরথ দোনামনা করলে অতীতের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলেন কৈকেয়ী।

দশরথ একসময় কৈকেয়ীর মনোবাঞ্ছাপূরণের অঙ্গীকার করেছিলেন।

দশরথ বাধ্য হলেন কৈকেয়ীর কথা শুনতে। দশরথ শুধু ভরতকে যুবরাজ করে রেহাই পেলেন না, রামচন্দ্রকে চৌদ্দ বছরের বনবাসে পাঠাতে বাধ্য হলেন।

স্ত্রী সীতা আর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা লক্ষ্মণকে নিয়ে রাম বনবাসে গেলেন। পঞ্চবটী বনে পর্ণকুটির তৈরি করে তিনজনে বসবাস শুরু করলেন।

রামচন্দ্ররা আর্য, পঞ্চবটী অঞ্চলটা অনার্য-শাসিত। ওই রাজ্যের রাজা কপিরাজ বালী। বালীর রাজধানীর নাম কিষ্কিন্ধ্যা। তার স্ত্রীর নাম তারা। সুগ্রীব বালীর সহোদর। এরা অনার্য। আর্য রামদের চোখে এই কালাকোলা মানুষগুলো মানুষ নয়, বানর। রামের মধ্যে এই অনার্য-অঞ্চলে আর্যশাসন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জাগল। সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন রাম আর লক্ষ্মণ। একদিন সেই সুযোগ এসে গেল।

চৌদ্দ বছরের বনবাসকালের তেরো বছর পার হয়ে গেছে। রামরা যখন বনবাসে আসেন, তখন তাঁরা যুবক-যুবতি। সন্তানধারণের উপযুক্ত বয়স সীতার। অরণ্যমধ্যে সুখের দাম্পত্যজীবন কাটলেও সীতার গর্ভে সন্তান আসে না।

কিষ্কিন্ধ্যার পশ্চিমে সমুদ্রের মাঝখানে স্বর্ণলঙ্কা। স্বর্ণলঙ্কার নৃপতি রাবণ। রাবণের বোন শূর্পণখা একদিন অরণ্যভ্রমণে এসে লক্ষ্মণকে দেখে কামাতুর হয়। লক্ষ্মণ শূর্পণখার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু তা-ই নয়, শূর্পণখার প্রেমনিবেদনের অপরাধে তার নাক-কান কেটে নেন লক্ষ্মণ। বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাবণ সীতাকে অপহরণ করে। রাম- লক্ষ্মণ সীতা উদ্ধারে বদ্ধপরিকর হন। কিন্তু কী প্রকারে সীতা করবেন তাঁরা! তার জন্য চাই বাহুবল। রাবণ মহাবলবান নৃপতি। তার সামরিক শক্তি প্রবল। তাকে পরাজিত করতে হলে অন্য একটা পরাশক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে হবে। শক্তিতে রাবণের উপযুক্ত প্রতিপক্ষ বানররাজ বালী। কিন্তু বালী আর্যের পক্ষে দাঁড়াবে কেন? কেন তারই মতো অন্য এক অনার্যরাজার ক্ষতি করবে? বুঝতে পেরে রাম বালীর ভাই সুগ্রীবকে কাছে টানলেন। সুগ্রীবের প্ররোচনায় নিরাপরাধী বালীকে হত্যা করলেন। তারাকে বিধবা করলেন রাম, অঙ্গদকে করলেন পিতৃহারা। সুগ্রীব বানররাজ্যের রাজা হলো। সুগ্রীব বউদি তারাকে ভোগদখলে নিল। এবং লঙ্কাভিযানে রামকে সসৈন্যে সহযোগিতা করল সুগ্রীব।

লঙ্কায় গিয়েও বিশ্বাসঘাতক জুটে গেল। রাবণের সহোদর বিভীষণ এসে জুটল রামচন্দ্রশিবিরে। বিভীষণ সুগ্রীবের ওপিঠ। সুগ্রীবের মতো বিভীষণও সিংহাসনলোভী। রাবণ বেঁচে থাকতে সেই লোভ সফলতা পাবে না। তাই সীতা প্রত্যার্পণের অছিলা তুলে রামের দলে এসে ভিড়ল বিভীষণ। মূলত বিভীষণের প্ররোচনা-প্রণোদনায় সহোদর কুম্ভকর্ণ নিহত হলো, ভ্রাতুষ্পুত্র মেঘনাদকে হত্যা করা হলো। রাবণের একলক্ষপুত্র আর সোয়ালক্ষ নাতি রামপক্ষের হাতে নিহত হলো। শেষ পর্যন্ত রাবণকেও প্রাণ দিতে হলো রামের হাতে। অনার্যরাজ্য লঙ্কা আর্যরাজপুত্র রামের শাসনাধীনে চলে এলো।

রামচন্দ্র তখন শ্রীলঙ্কার বেলাভূমিতে সীতার জন্য অপেক্ষা করছেন। অশোকবন থেকে মুক্তি পেয়ে বেলাভূমি বেয়ে রামের দিকে এগিয়ে আসছেন সীতা। হাঁটার ভঙ্গি দেখে রামের মনে হলো— সীতা গর্ভবতী, রাবণকর্তৃক অপবিত্র হয়েছেন সীতা। অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করা হলো। পরীক্ষায় উতরে গেলেন সীতা। আপাতত রামের সন্দেহদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেলেন সীতা, কিন্তু অযোধ্যায় ফিরে প্রজাদের খরতর বাক্যবান থেকে রেহাই পেলেন না। রাবণকে সীতার সঙ্গে জড়িয়ে নানারকম কুৎসা রটনা করতে থাকল প্রজারা। স্ত্রীর চেয়ে প্রজাদের বেশি মূল্য দিলেন অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র। ছলনার আশ্রয় নিয়ে লক্ষ্মণের মাধ্যমে গর্ভবতী সীতাকে অরণ্যে নির্বাসনে পাঠালেন রাম। সেখানে সীতার লব ও কুশ নামে দুজন সন্তান জন্মাল।

এদিকে রামরাজা অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করলেন। বাল্মীকির প্রণোদনায় রাম সীতাকে অযোধ্যায় নিয়ে এলেন। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানে সীতাকে যথাযথ মর্যাদা দিলেন না রামচন্দ্র।

অপমানে জর্জরিত সীতা পৃথিবীকে অনুরোধ করলেন বিদীর্ণ হতো। পৃথিবী বিদীর্ণ হলো। সীতা ভূমধ্যে অন্তর্হিত হলেন।

আরও কিছু বছর রাজত্ব করে রামচন্দ্র দেহত্যাগ করলেন।

এরপর বহু বহু শতাব্দী কেটে গেল।

এখন রামায়ণযুগের এবং মহাভারতকালের সবাই বৈকুণ্ঠবাসী।

তিন.

বিশাল উদ্যান। কী নেই এই উদ্যানে? পারিজাত থেকে সকল ধরনের ফুল, নানা জাতের বৃক্ষ, ঝরনা, উদ্যানের মাঝখান দিয়ে বাঁকা-সোজা হাঁটাপথ, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বৃক্ষছায়ায় মনোরম বাঁধানো আসন, খোলা বাগানে অলসভাবে সময় কাটানোর নরম ঘাসবিছানো স্থান— সবই আছে এই স্বৰ্গ- উদ্যানে। এই উদ্যানে খ্যাত-অখ্যাতরা বিকেলটা কাটান। ইন্দ্র, অর্জুন, একলব্য, কচ, উর্বশী, কর্ণ, কংস, কুন্তী, গঙ্গা, গান্ধারী, দময়ন্তী, দুর্যোধন, সীতা, মন্দোদরী, দ্রৌপদী, বিভীষণ, বালী, তারা, মনসা, মহাদেব, বাল্মীকি, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র এঁরা সবাই ওই স্বর্গ-উদ্যানে ঘুরে বেড়ান। কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে টুক টুক করে হাঁটেন, কেউ-বা একস্থানে দাঁড়িয়ে ব্যায়ামের নানারকম কসরত করেন।

আজ উদ্যানটা জমে উঠেছে। নারদ বীণা বাজিয়ে পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। চোখ খোলা তাঁর। যদি কারও সঙ্গে কারও ঝগড়াটা লাগিয়ে দেওয়া যায়! অন্যদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করতে না পারলে তিনি যে সুখ পান না! কোনো রূপসীকে মনে লাগে কিনা, খুঁজে ফিরছেন ইন্দ্ৰ। মনসা সর্পহাতে মহাদেবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্বর্গে এসে নতুন একধরনের সর্পের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। মহাদেবকে তা না দেখিয়ে যে স্বস্তি নেই মনসার! ধৃতরাষ্ট্র কুম্ভকর্ণের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে মেতেছেন।

ওই, একটু ওদিকে বৃত্তাকার একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বোঝা গেল, নারীরা কানামাছি খেলছেন। চারদিকে সীতা, তারা, মন্দোদরী, রাধা, দময়ন্তী আর মাঝখানে চোখবাঁধা যুধিষ্ঠির। সীতার ওড়না দিয়ে যুধিষ্ঠিরের দু’চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যুধিষ্ঠির দু’হাত প্রসারিত করে নারীদের কোনো একজনকে ধরতে চাইছেন। কিন্তু নারীদের ছোঁয়া কি অত সহজ! তাঁরা এই ধরা দেন তো এই দূরে চলে যান! সীতাদের হাতে পড়ে যুধিষ্ঠিরের নাস্তানাবুদ হবার উপক্রম। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি মোটেই বিরক্ত নন, বরং উল্লসিত, উদ্বেলিত। যে দ্রৌপদীনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির, সেই যুধিষ্ঠির আজ পরনারী সংস্পর্শে আনন্দে আকুল। খেলার একপর্যায়ে যুধিষ্ঠির সীতাকে ধরে ফেলেন। ধরেই বুকের একেবারে গভীরে টেনে নেন।

ওই সময় পাশ দিয়ে রামচন্দ্র যাচ্ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে তাঁর ভেতরটা রি রি করে উঠল। তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ছিঃ ছিঃ, ছিঃ!’

চট করে চোখের বাঁধন খুলে ফেললেন যুধিষ্ঠির। অবাক চোখে রামচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

তৎক্ষণাৎ রামের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সীতা। তাঁর চোখেমুখে ঘৃণা আর ক্রোধের মেশামেশি। সীতা নিজেকে সংযত করতে চাইলেন। ভাবলেন, স্বর্গে তো কারও মনে ক্রোধ বা ঘৃণার উদ্রেক হবার কথা নয়! তাহলে রামের জন্য তাঁর মনে ক্রোধ-ঘৃণার ঝড় কেন? ভেবে কূল পান না সীতা!

রামকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করেন, ‘এই ছিঃ ছিঃ কেন? কার জন্য?’

‘এই ধিক্কার তোমার জন্য। পরপুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে লজ্জা করছে না তোমার?’ রামের কণ্ঠস্বর উষ্মায় ভরা।

হি হি করে হেসে উঠলেন সীতা। বললেন, ‘পরপুরুষ! এখানে পরপুরুষ দেখলে কোথায় তুমি! এখানে তো সবাই আপনপুরুষ। সবাই সবার এখানে!’

‘মানে!’ অবাক চোখে বলেন রাম।

সীতা বলেন, ‘ওই দেখ, দ্রৌপদী কংসের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে হেসে কুটিকুটি। আর তোমার প্রিয়তম ভাই লক্ষ্মণকে দেখ, স্ত্রী ঊর্মিলাকে বাদ দিয়ে শূর্পণখাকে বুকে জড়িয়ে কোন দিকে যাচ্ছে! আরও দেখবে, দেখ ভীষ্মমাতা চিরযৌবনা গঙ্গা ব্যাধপুত্র একলব্যের সঙ্গে কী করছেন! ওঁদের দেখে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না এই বৈকুণ্ঠে কেউ কারও একার নন?’

‘ও হ্যাঁ আরেকটি কথা, এই পরপুরুষ-সংসর্গের অভিযোগ তুমি আগেও একবার আমার বিরুদ্ধে করেছিলে।’ রূঢ় কণ্ঠে কথা শেষ করলেন সীতা।

রামচন্দ্র বললেন, ‘আগেও একবার করেছিলাম!’

‘মনে নেই তোমার, না মনে না-থাকার ভান করছ?’ বললেন সীতা।

‘কখন করেছিলাম এই অভিযোগ? কোথায়?’ জানতে চান রাম।

সীতা বললেন, ‘রাবণের কারাস্থান অশোকবন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্বর্ণলঙ্কার বেলাভূমি বেয়ে যখন আমি প্রবল আবেগে কাঁপতে কাঁপতে তোমার দিকে এগিয়ে আসছিলাম, তুমি তখন আমার দিকে তর্জনী বাড়িয়ে বলেছিলে, আর এগিয়ো না। তুমি কলঙ্কিতা, রাবণ তোমাকে অপবিত্রা করেছে। কী, বলো নি?’

রাম আমতা আমতা করে বললেন, ‘বলেছিলাম, তবে তা দশজনের কুৎসা থেকে তোমাকে বাঁচাবার জন্য।’

‘মিথ্যে! মিথ্যে বলছ তুমি রাম!’ রোষে ফেটে পড়লেন সীতা। ‘দশজনের কুকথা থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য নয়, বরং তোমার মনের মধ্যে যে সন্দেহ মাথা কুরে মরছিল, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার জন্য।’

রাম এবার মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘বালির ওপর দিয়ে তোমার হেঁটে আসার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হয়েছে, তুমি গর্ভবতী। প্রকৃতপক্ষে তা-ই ছিলে তুমি। তুমি তো বেশ কিছুকাল আমার সংস্পর্শে ছিলে না! তাহলে তোমার পেটে সন্তান এলো কোত্থেকে?”

সীতা বললেন, ‘যেদিন আমায় রাবণ অপহরণ করল, তার একমাস আগে থেকে আমার মাসিক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি সময় ও সুযোগ খুঁজছিলাম তোমাকে বলব বলে। কিন্তু তা হলো না। আমি মায়াহরিণের ফাঁদে পড়লাম, তোমরা দুইভাই সোনার হরিণের পেছনে ছুটলে।’ থামলেন সীতা। তাঁর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

সীতা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করলে তুমি! গনগনে আগুনের মধ্যদিয়ে হাঁটালে তুমি আমায়! কেন? আমি সতী কিনা তা পরখ করার জন্য। পা দুটো আমার পুড়ে গেল! দুর্বিষহ যন্ত্রণাকে বুকের তলায় চেপে আমি তোমার কাছে হেঁটে এলাম। কী করলে তুমি তখন? এমন একটা ভাব করলে, যেন অগ্নিপরীক্ষা কিছুই না! অপহরিত নারীর এরকম শাস্তি পাওয়া উচিত! এই অপহরণের জন্য আমি দায়ী ছিলাম কি? না তোমরা দুই ভাইয়ের নিষ্ঠুর আচরণ দায়ী ছিল? একজন তরুণী অন্য এক তরুণের কাছে প্রেমনিবেদন করতেই পারে! শূর্পণখাও লক্ষ্মণের কাছে প্রেমনিবেদন করেছিল। প্রেমনিবেদন কি অপরাধ? অন্যের চোখে অপরাধ না হলেও তোমরা দুই ভাইয়ের বিচারে অপরাধ ছিল। তাই তো তোমার প্ররোচনায় আমারই চোখের সামনে লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক-কান কেটে নিল!’

একটু ফাঁক পেয়ে রামচন্দ্র বললেন, ‘আমি একপত্নীনিষ্ঠ ছিলাম, লক্ষ্মণও তা-ই। তাই অনার্যকন্যার ওই অসভ্য আচরণ আমরা সহ্য করিনি।’

‘হাসালে তুমি আমায় রাম! একপত্নীনিষ্ঠ! তোমরা! যাদের পিতা একপত্নীতে তৃপ্ত নন, তাদের আবার পত্নীনিষ্ঠতা! তুমি সুযোগ পাওনি বলে বহুচারী হতে পারো নি। সুযোগ পেলে ঠিকই বাপের মতো হতে।’

রাম ক্রোধে জ্বলে উঠলেন, ‘তুমি ন্যায়-অন্যায় বিস্মৃত হচ্ছো সীতা।’

এবার সীতাকে বাম হাত দিয়ে সরিয়ে রামের সামনে এগিয়ে এলো তারা। ঘৃণা মেশানো গলায় বলল, ‘চিনতে পারছেন আমায়, রামচন্দ্র! শুনেছি মর্ত্যে আপনি নাকি অবতারের স্বীকৃতি পেয়েছেন! রামাবতার! দশ অবতারের একজন! ত্রেতাযুগের মহান পুরুষ! পরশুরামের পরেই নাকি আপনার স্থান! তা জিজ্ঞেস করি, কোন ন্যায়ধর্ম পালনের ফলে আপনি যুগাবতার রূপে নির্ণিত হলেন! আপনিই তো ঋষি শম্বুককে হত্যা করেছিলেন! তখন তো আপনি অযোধ্যার রাজা! রাজধর্ম তো প্রজাপালন! কিন্তু আপনি কী করলেন, ব্রাহ্মণদের উসকানিতে শূদ্র ঋষি শম্বুককে হত্যা করলেন! ঋষি শম্বুকের অপরাধ কী ছিল?’

রাম দ্রুত বলে উঠলেন, ‘শূদ্র হয়ে আর্য-শাস্ত্র পাঠ করছিল। তপস্যা করছিল আর্যঋষিদের মতন। শূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণের মতো আচরণ করা তার অধিকারে ছিল না।’

‘মানে আপনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদে বিশ্বাসী। ছোট জাতের লোক হয়ে শম্বুক কেন বামুনের মতো পঠন-পাঠন-ধ্যান করবেন? তা-ই তো তাঁকে হত্যা করলেন আপনি? বুকে হাত দিয়ে বলুন, শম্বুককে হত্যা করে ন্যায় কাজ করেছেন আপনি?’

তারার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না রাম। মাথা নিচু করে রাখলেন। তারা বলল, ‘আমার বিশ্বাস, আপনি আমাকে চিনতে পারেননি।’

রামচন্দ্র ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়লেন।

বিষণ্ণ কণ্ঠে তারা বলল, ‘আমি বালীর স্ত্রী।’

তার পর কণ্ঠে শ্লেষ মিশিয়ে বলল,’ ভুল বললাম, আমি সুগ্রীবের জোর করে বিয়েকরা বউ।

‘জোর করে বিয়েকরা বউ!’ রাম বললেন।

‘লোকে তো তা-ই বলে!’ বলে অনেকক্ষণ চুপ থাকল তারা।

তারপর সজল চোখে বলল, ‘অন্যায়ভাবে আমার স্বামী বালীকে হত্যা করলেন আপনি! নিরস্ত্র বালীকে আত্মরক্ষার সুযোগ না দিয়ে আড়াল থেকে কাপুরুষের মতো তীরাঘাতে হত্যা করে আপনি ন্যায় কাজ করেছেন? বলুন। মাথা হেঁট করে আছেন কেন? সেই কাপুরুষ রাম আজ সীতাকে শেখাচ্ছেন ন্যায়-অন্যায়ের মানে! ধিক আপনাকে, ধিক্কার জানাই আর্যসমাজের সেই বিধানকে, যে-বিধান অনার্যদের রাক্ষস আর বানর হিসেবে চিহ্নিত করেছে!’

বালীর কথা মনে পড়ে গেল শ্রীরামচন্দ্রের। বালী ছিল কপিরাজ। তার রাজধানীর নাম ছিল কিষ্কিন্ধ্যা। কিষ্কিন্ধ্যা নয়নশোভিত রাজ্য। বানরাধিপতি বালী প্রজারঞ্জক। বালী অসাধারণ শক্তিশালী ছিল। এমন যে বাহুবলী রাবণ, তার চেয়েও অধিক বলশালী ছিল বালী। রাবণ আর বালীর মধ্যে গভীর সখ্য ছিল। বালীর সহোদর সুগ্রীব ছিল সিংহাসনলোভী। দাদাকে সরিয়ে কিষ্কিন্ধ্যার ক্ষমতাদখলে সাগ্রহী ছিল সুগ্রীব। কিন্তু বালীর কৌশল আর শক্তির সঙ্গে পেড়ে উঠত না সুগ্রীব। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে? একটা সময়ে সুগ্রীবের হাতে সুযোগ এসে গেল।

রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা তখন অপহরিত। পাগলের মতো সীতাকে খুঁজে ফিরছেন রাম আর লক্ষ্মণ। পাহাড়-সমতল-নদী উপত্যকা-অরণ্য-লোকালয় কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না দুই ভাইয়ের অনুসন্ধান থেকে। বড় ভাই বালীকে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়ে সুগ্রীব। কিষ্কিন্ধ্যা থেকে বিতাড়িত সুগ্রীব তখন গহিন অরণ্যে লুকিয়ে আছে। ওখানেই সুগ্রীবের সঙ্গে রামের দেখা। সুগ্রীবের কাছ থেকে রাম সম্যক জানতে পারলেন, লঙ্কাধিপতি রাবণই সীতাকে হরণ করেছে। এবং সুগ্রীব সীতা-উদ্ধারে রামকে সাহায্য করবে, যদি রাম বালীকে হত্যা করে তাকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বানিয়ে দেন।

এককথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন রাম। ভাবেননি, যে-বালীকে হত্যা করতে বলছে সুগ্রীব, তার তেমন কোনো অপরাধ আছে কিনা? বালী হত্যাযোগ্য কিনা? একজন নিরপরাধীকে হত্যা করলে রামের কোনো অন্যায় হবে কিনা? এর কোনোটাই ভাবেননি রামচন্দ্র। শুধু সীতা-উদ্ধারের বাহানা দিয়ে অনার্যভূমি শ্রীলঙ্কা দখল করার উদ্দেশে বালীহত্যার মতো নিষ্ঠুর আর অন্যায় কাজ করতে সম্মত হয়ে গিয়েছিলেন রামচন্দ্র। সম্মত হয়েই ক্ষান্ত হননি রামচন্দ্র, সুগ্রীবের সঙ্গে যুদ্ধরত বালীকে অন্তরাল থেকে তীক্ষ্ণ শরাঘাতে বধ করেন। সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করে দেন রামচন্দ্র। সুগ্রীব জোর করে বউদি তারাকে তার অঙ্কশায়িনী করে। তারা সহজে কি রাজি হয়! রামের প্ররোচনায় সুগ্রীব তারাপুত্র অঙ্গদকে হত্যা করবার হুমকি দেয়। পুত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা তার সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে সুগ্রীবের শয্যাসঙ্গিনী হয়। এরপর তারা যতদিন জীবিত ছিল, আত্মশোচনায় বিদীর্ণ ছিল।

তাই আজ রামকে বৈকুণ্ঠধামে বাগে পেয়ে ছাড়বে কেন তারা?

রামচন্দ্র ম্যাড়মেড়ে গলায় বলেন, ‘তুমি আমায় ভুল বোঝ না তারা। সেদিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে দিশা হারিয়েছিলাম আমি। ভালো আর মন্দের বিচার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল আমার। সুগ্রীবের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।’

গর্জে উঠল তারা, ‘রাখুন আপনার ভাওতাবাজি। বিভ্রান্তি! পরিস্থিতির চাপ, দিশেহারা ভাব— এসব বলে আমাকে স্তোক দেবেন না। আপনি অত্যন্ত ধূর্ত রামচন্দ্র। আপনি জানতেন, আপনি আমার স্বামী বালীর সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চাইলে, বালী কিছুতেই রাজি হতো না। কারণ সে সুগ্রীবের মতো বিশ্বাসঘাতক ছিল না, ছিল না ভোঁতাবুদ্ধির। বালী অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিল। আপনার কথা শুনে সে ঠিকই ধরে ফেলত, সীতা-উদ্ধারের ব্যাপারটা আপনারই সাজানো নাটক। সীতা-উদ্ধারের নাম করে বানর নামের অনার্যদের সহায়তায় রাক্ষস নামের আরেক অনার্যদের দেশ দখল করতে চাইছেন। সুগ্রীবের আহম্মকিতে তো কিস্কিন্ধ্যাতে আর্যশাসন প্রতিষ্ঠা করেছেনই, আপনার লক্ষ্য তখন রাক্ষসরাজ রাবণশাসিত শ্রীলঙ্কা দখল। আপনার এই অপকর্ম কিছুতেই মেনে নিত না বালী। সেটা সঠিকভাবেই জানতেন আপনি। তা-ই আমার নিরপরাধী স্বামীকে হত্যা করলেন আপনি!” দম ফুরিয়ে এলো তারার। চুপ মেরে গেল সে।

রাম কিছু একটা বলতে চাইলেন। কিন্তু তারার যুক্তির সামনে পড়ে তাঁর মুখের রা বন্ধ হয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো উপায় থাকল না।

সীতা বললেন, ‘তুমি আমার চোখ খুলে দিলে তারা! আমি তো এতদিন ভেবে এসেছি, আমার প্রিয়তম স্বামী রাবণের হাত থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য প্রাণপাত যুদ্ধ করেছে! আজকে তোমার কথা শুনে এবং রামের নিরুত্তর থাকা দেখে আমি সব বুঝতে পারলাম। হাঃ স্বামী! হাঃ রামচন্দ্র!’

রামচন্দ্র বলে উঠলেন, ‘চুপ থাকো সীতা। তুমি ওরকম করে বলো না। তুমি অন্তত আমাকে ভুল বোঝ না। আমি তোমাকে ভালোবাসি সীতা, সত্যিই ভালোবাসি।’

‘থুঃ দিই তোমার সেই ভালোবাসার মুখে। এখন বুঝতে পারছি, তোমার সেই দিনের ভালোবাসা কত মেকি ছিল! আচ্ছা তুমি বলো, জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে এনে তুমি আমাকে অযোধ্যায় নিয়ে এলে। এরপর একবারও কি তুমি আমার পায়ের তলাগুলো দেখতে চেয়েছো, একবারও কি জিজ্ঞেস করেছো, দগ্ধ পা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো সীতা? একটি বারের জন্যও শুধাও নি তুমি আমায়, আমার দুর্মর যন্ত্রণার কথা শুনতে চাও নি। আচ্ছা, একবারও কি রাজবদ্যিকে বলেছো আমার চিকিৎসা করতে?’ বলে গেলেন সীতা।

রামচন্দ্র বললেন, ‘অযোধ্যায় ফিরেই আমি রাজকার্যে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রাজ্যের চারদিকে বিশৃঙ্খলা তখন। কোনো কোনো করদরাজা বিদ্রোহও করে বসেছে। তাদের দমন করতে আমার অনেকটা সময় কেটে গেছে।’

‘যখন আমাকে দেখার সময় হলো, ততদিনে কান ভারী হয়ে গেছে তোমার। প্রজারা ধুয়ো তুলেছে আমি অসতী, আমার পেটে যে সন্তান, তা রাবণের। শুধু প্রজারা তো নয়, কয়েকজন মন্ত্রীও তোমাকে ভুল বোঝাতে শুরু করল! আমার সান্নিধ্য তখন তোমার কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। আমি তো তখন গর্ভবতী! গর্ভবতী নারী তো স্বামীর চাহিদা পূরণ করতে পারে না! তাই সেই সময় তুমি আমার সান্নিধ্য একেবারেই এড়িয়ে চলতে। প্রজারা তোমাকে বোকা বানাতে সক্ষম হলো। নিজেকে প্রজাদের কাছে আরও প্রিয় করে তুলবার জন্য আমার প্রতি অবিচার করলে তুমি! বনবাসে পাঠালে!’

‘আর বলো না সীতা! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে!’ মৃদু কণ্ঠে বললেন রামচন্দ্র

সীতা উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, ‘লজ্জার কথা এত মিউ মিউ করে বলছো কেন?’

তারপর গলাকে আরও চড়িয়ে সঙ্গিনীদের উদ্দেশ করে সীতা বললেন, ‘শোনো তোমরা, রামের নাকি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে! সেদিন, যেদিন তুমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে লক্ষ্মণকে দিয়ে গর্ভবতী আমাকে নির্বান্ধব অরণ্যে নির্বাসনে দিলে, তোমার এই মাথাটা কোথায় ছিল রামচন্দ্র? থুঃ লক্ষ্মণের মুখে, আমি নাকি তার মায়ের সমান! এই মায়ের সমান অসহায় বউদিটিকে বনে ফেলে রেখে রাজধানীতে চলে আসতে একবারের জন্যও বুক কাঁপেনি লক্ষ্মণের। ভ্রাতৃ-আজ্ঞা পালন করেছে লক্ষ্মণ! আসলে কী জানো, তোমরা পুরুষেরা সবাই নারীনির্যাতনকারী। সেই নারী স্ত্রী হোক বা জননী, ভগিনী হোক বা মাসি, পিতামহী হোম বা মাতামহী, নারীনির্যাতনের বেলায় তোমরা সবাই এককাট্টা। কেউ রেহাই পায় না তোমাদের হাত থেকে।

সীতার কথা শুনে অন্য নারীরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘তুমি যথার্থ বলেছো সীতা। আমরাও তো পৃথিবীতে জীবন কাটিয়ে এসেছি। এটা ঠিক, আমরা সকলে একসমাজের মানুষ ছিলাম না, তারপরও বললে ভুল হবে না, সব পুরুষ নিপীড়িক। নারীদের ওপর জুলুমবাজি করতে কোনো পুরুষই বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।’

রামচন্দ্র আর কী বললেন! চোরা চোখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাতে থাকলেন। মন্দোদরী দেখতে পেল তা।

সরোষে মন্দোদরী বলল, ‘আরে রামচন্দ্রজী, কার দিকে অমন চোরাচোখে তাকাচ্ছেন? উনিও কি আপনার চেয়ে কম যান? উনি তো আপনার চেয়ে একশো গুণ বাড়া! আপনি তো বউকে নির্বাসনে পাঠিয়ে ক্ষান্তি দিয়েছিলেন, আর যুধিষ্ঠিরবাবু, তিনি তো মহাজুয়াড়ি! জুয়ার নেশায় বউ দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন! কী, ঠিক না ধৰ্মপুত্ৰ যুধিষ্ঠির?’

যুধিষ্ঠির একপা দুইপা করে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

সূর্যের আলো নিভে আসতে শুরু করেছে তখন। দূর দিগন্তে অন্ধকার নেমে গেছে।

রামচন্দ্র সেই অন্ধকারের দিকে ধীর পায়ে এগোতে থাকলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *