‘বাংলার নবজাগৃতি’ একটি অতিকথা
আদিম যুগের অতিকথার (Myth) একটা গঠনবিন্যাস (Structure) আছে যা লেভি—স্ত্রাউসের মতো নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টির রঞ্জনরশ্মিতে ধরা পড়ে এবং যার ভিতর থেকে আদিম বর্বর বন্য মানসের (The Savage Mind) আপাত অজ্ঞাত চিন্তাভাবনা কল্পনার বর্ণাঢ্য রূপ রামধনুর মতো চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আধুনিক যুগের অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক যুগের অতিকথাগুলি আত্মগোপন করে থাকে নিরেট সব তথ্যের পাথরচাঁইয়ের তলায় এবং তথ্য মানে রাজরাজড়ার সিংহাসন কাড়াকাড়ির কাহিনি, প্রাসাদচক্রান্ত আর যুদ্ধবিগ্রহের বিবরণ, মুষ্টিমেয় কয়েকজন ওমরাহ—উমেদারের অথবা কালের স্বনামধন্য কয়েকজন ব্যক্তির কীর্তিকলাপ। বলা বাহুল্য, এই ইতিহাস দেশের ইতিহাস নয়, লোকসমাজেরও ইতিহাস নয়। এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত। তদুপরি আমাদের দেশের ঐতিহাসিকরা ইতিহাসচর্চা শিখেছেন ইংরেজদের কাছ থেকে। নৃবিদ্যা, প্রত্নবিদ্যা ইত্যাদির সাহায্যে ভারতের সুদূর অজানা অতীতের ইতিহাস, প্রধানত ইংরেজদের অভিভাবকত্বে, পুনরুদ্ধৃত হয়েছে। এ কথা সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। এদিক থেকে বিদ্যানুরাগী কয়েকজন ইংরেজের কাছে আমরা ঋণী, যেমন কানিংহাম, মার্শাল, বেগলার, হাটন এবং আরও অনেকে। কিন্তু ‘আধুনিক’ যুগের ইতিহাস অনুশীলনের ক্ষেত্রে ইংরেজরা নানাদিক থেকে এ দেশীয় ঐতিহাসিকদের বিচারবুদ্ধিকে ঘোলাটে—ধোঁয়াটে করে দিয়েছেন। ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবীর মতো আমরা ইংরেজদের গুরুগিরি অন্ধের মতো মেনে নিয়েছি। আধুনিক যুগ মানে ইংরেজ শাসকদের যুগ, তাই আধুনিক যুগের ইতিহাসব্যাখ্যায় শাসকরা আমাদের বুঝিয়েছেন যে তাঁরাই আধুনিকতার ভগীরথ এবং আধুনিকতা মানে প্রগতি অগ্রচিন্তা, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্তি, অর্থনৈতিক—রাজনৈতিক অগ্রগতি, যার গাণিতিক যোগফল হল ‘নবজাগৃতি’, যেমন ইয়োরোপের ‘রেনেসাঁস’ সেইরকম। ‘রকম’ দেখে আমরা ধাঁধিয়ে গিয়েছি কিন্তু রকমটা যে ‘কীরকম’ তা আর ভেবে দেখিনি। সাদা (white) ঐতিহাসিকরা বলেছেন, ,অতএব কালা (Back Native) ঐতিহাসিকদের তার পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া কোনও গতি নেই। তাই মনে হয়, আমাদের দেশের আধুনিককালের ব্রাহ্মণোত্তর বুদ্ধিজীবীদের ঠিক অ্যান্টনিও গ্রামসির সংজ্ঞানুসারে ‘Organic’ ও ‘Traditional’ গোষ্ঠীতে দ্বিচিহ্নিত করা যায় না।* ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়রূপে মূলত তাঁদের ‘organic’ বলেই চিহ্নিত করতে হয়, যদিও গ্রামসির ‘traditional’ গোষ্ঠীভুক্ত দু—চারজন ভাসমান স্বনির্ভর বুদ্ধিজীবী ছিলেন না যে তা নয়, কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম, বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে, আমাদের আলোচ্য নয়, আপাতত ইতিহাসের গতিনির্ণয় করাই আমাদের লক্ষ্য।
উল্লেখ্য হল, ইয়োরোপীয় ‘রেনেসাঁস’—এর মডেলটি ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে আমাদের দেশে নির্বিচারে যাঁরা প্রয়োগ করতে অত্যুৎসাহী হয়েছেন তাঁরা একজাতের অভিজাত কলেজে হয়তো শিক্ষালাভ করেছেন (যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজে), পরীক্ষায়—প্রতিযোগিতায় অন্য সকলকে দাবিয়ে টপকে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছেন, অতএব ‘ইতিহাস’ মানে ‘তিনি’ এবং ‘তিনি’ আর ‘ইতিহাস’ অভিন্ন এবং তাঁর মার্কসবাদ ব্যাখ্যানও অভ্রান্ত। এইটাই বিভ্রান্তিকর ট্র্যাজেডি। অর্থাৎ এই মার্কসীয় ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাই নবজাগৃতির প্রত্যয়ের নিমিত্তকারণ। অবশ্য এই ট্র্যাজেডির মূলে আরও একটি বড় কারণ আছে এবং সেটা হল ‘ভারতে ইংরেজ শাসনের ফলাফল’ সম্বন্ধে কার্ল মার্কসের উক্তিগুলি। এরকম একটি উক্তি উদ্ধৃত করে (বাংলা তরজমা) আজ থেকে তিরিশ বছর আগে (তখন আমার নিজের বয়সও তিরিশ) ‘বাংলার নবজাগৃতি’ লেখা আরম্ভ করেছিলাম (প্রথম অধ্যায় ‘নবজাগৃতিকেন্দ্র কলকাতা’ দ্রষ্টব্য)। অনেক বড় পরিকল্পনা ছিল, তিন খণ্ডে এই নবজাগৃতির ইতিহাস রচনা করব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি, কেবল প্রথম খণ্ড ‘পশ্চাদভূমি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫৫ সনে। তারপর ১৩৮৫ সন পর্যন্ত আরও তিরিশ বছর কাটল, ইতিহাসচর্চার আদিগঙ্গা দিয়ে অনেক ঘোলা জল বয়ে গেল দেখলাম। অনেক প্রশ্ন জাগল মনে, অনেক প্রশ্ন। শহর থেকে গ্রামের দিকে তাকাবার ইচ্ছা হল প্রবল। অদম্য ইচ্ছা। শহরে জন্ম, শহরে মানুষ হলেও গ্রামের পথে পা বাড়িয়ে চলতে আরম্ভ করে ক্লান্তি বোধ করিনি কখনো, আজও করি না, বয়স হলেও বাংলার গ্রামের মানুষ, গ্রামের সমাজ, গ্রামের জীবনযাত্রা, গ্রামের সংস্কৃতি স্বচক্ষে দেখতে দেখতে বারংবার মনে হতে লাগল, পণ্ডিতেরা উনিশ শতকে বাংলার যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের কথা বলেন, সেটা কী পদার্থ? কোথায় এবং কেন ‘জাগরণ’ হল? জাগল কারা? কলকাতা শহর যদি ‘নবজাগৃতিকেন্দ্র’ হয়, যদি রেনেসাঁসের সূর্য ‘জ্যোতির কনকপদ্ম’—এর মতো কলকাতার আকাশে উদিত হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতার খুব কাছাকাছি গ্রামেও, দেড়শো বছর পরেও, কেন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার? কেন অতীতের ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে গ্রামের মানুষ আজও গভীর ঘুমে অচৈতন্য? কেন পৌরাণিক যুগের স্বপ্নের ঘোরে আজও তাদের স্বপ্নচারিতা? এরকম অনেক প্রশ্ন। অনেক সংশয়।
কার্ল মার্কস ১৮৫৩ সালে New York Tribune পত্রিকায় ১০ জুন, ২৪ জুন ও ২২ জুলাই তারিখে যথাক্রমে ‘The British rule in India’, ‘The East India Company—Its History and Results’ এবং ‘The Future Results of British Rule in India’ নামে তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। তখন বাংলার ‘নবজাগরণপর্ব’ রামমোহন ও ডিরোজিয়ানদের যুগ অতিক্রম করে বিদ্যাসাগরের যুগে পদার্পণ করেছে। রামমোহনের সঙ্গে কার্ল মার্কসের দেখা হয়নি, মার্কস তখন ছাত্র, যদিও বেন্থাম, উইলবারফোর্স, রবার্ট ওয়েন এবং আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। প্রথম লেখাটি ট্রিবিউনে প্রকাশিত হবার পর (১০ জুন, ১৮৫৩) মার্কস ১৪ জুন তারিখে লন্ডন থেকে এঙ্গেলসকে একটি চিঠিতে লেখেন :১
Your article on Switzerland was of course a direct smack at the leader in the Tribune (against centralisation, etc.) and… I have continued this hidden warfare in a first article on India, in which the destruction of the native industry by England is described as revolutionary. This will be very shocking to them. For the rest the whole rule of Britain in India was swinish, and is to this day. The stationary character of this part of Asia—despite all the aimless movement on the political surface—is fully explained by two mutually dependent circumstances : (1) The public works were the business of the Central Government; (2) besided these the whole empire, not counting the few larger towns, was resolved into villages, which possessed a completely separate organisation and formed a little world in themselves.
These Idyllic republics, which jealously guarded only the boundaries of their village against the neighbouring village, still exist in a fairly perfect form in the North-Western parts of India which have but recently fallen into the English hands. I do not think one could imagine a more solid foundation for the stagnation of Asiatic despotism. And however much the English may have Irelandised the country, the breaking up of those stereotyped primitive forms was the sine qua non (essential condition) of Europeanisation. The tax-gatherer alone was not the man to achieve this. The destruction of their archaic industry was necessary in order to deprive the villages of their self-supporting character.
ট্রিবিউন পত্রিকার তিনটি রচনা এবং এরকম কয়েকটি চিঠি আমাদের দেশের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের নবজাগরণতত্ত্বের সৌধ রচনায় গথিক স্তম্ভের মতো কাজ করেছে, যেহেতু এগুলি কার্ল মার্কস লিখেছেন। এঙ্গেলস যেমন ‘The Class Struggle in france’ (Marx) গ্রন্থের প্রথম পুনর্মুদ্রণে ভূমিকা লিখে (মার্চ ১৮৯৫) শোধনবাদীদের (Revisionist) গুরুর কাজ করেছিলেন অজ্ঞাতসারে২, মার্কসও তেমনি ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল’ সম্বন্ধে এই রচনাগুলি ও চিঠিপত্র লিখে মার্কসবাদের যান্ত্রিক বিকৃতির পথ সুগম করে দিয়েছেন। যেমন রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে অর্থনীতির অর্থাৎ উৎপাদনব্যবস্থা ও উৎপাদক সম্পর্কের রৈখিক সম্পর্ক স্থাপন করে ‘vulgar Marxism’—এর বিকাশ হয়েছে তেমনি। মরিস গদেলিয়ের (Maurice Godelier) বলেছেন :
how are we to conceive the relations between the defermining structure and the dominant one and what determining in economic relations is it that dictates that there shall be dominance by kinship- relations or by politico-religious relations? This question could not be answered, or even asked, by dogmatic Marxism and the other forms of that vulgar materialism to which dogmatic Marxism belongs, even though it denies the affinity. For vulgar materialism the economy, which it reduces to the relations between technology and environment, ‘produces’ the given society, giving rise to it as an epiphenomenon. This means refusing to see the irreducible differences between the levels and structures of social life, the reason for the relative autonomy with which they operate, and reducing all levels to so many functions either apparent or concealed of economic activity.
গদেলিয়ের প্রশ্ন করেছেন এবং খুব সংগত প্রশ্ন :৩
How could this hypothesis be reconciled with the fact for example, that within many primitive societies it is relations of kinship between men that dominate social organization… or that religious relations seem to dominate Indian society, dividing men into a hierarchy of castes in accordance with an ideology of purity and impurity…?
সংগত তো বটেই, খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন গদেলিয়ের এবং এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে তিনি নৃতত্ত্বের অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
I therefore became an anthropologist.
In association with Professor Levi-Strauss, who took a close interest in my project and obtained for me all the facilities I needed in order to carry is out, I therefore undertook to initiate myself into anthropology, while devoting special attention to what is called ‘economic anthropology’, the field that it seemed ought to include the data of my theoretical problems and perhaps the elements of their solution.
সমাজটা হল ‘সমূহ’ বিশেষ এবং সমূহ (aggregates) দু—রকমের হতে পারে। একরকম হল ‘অযুতসিদ্ধাবয়ব সমূহ’ (those of which the parts are in union and fusion, being lost in the whole), আর একরকম হল ‘যুতসিদ্ধাবয়ব সমূহ’ (mechanical aggregates—collocation of distinct and independent parts)। সর্বস্তরের মানবসমাজই অযুতসিদ্ধাবয়ব সমূহ, এবং উপর থেকে যত নিচের স্তরের দিকে নেমে যাওয়া যায় তত দেখা যায় যে তার এই অযান্ত্রিক রূপটা বেশ প্রকট। সেখানে সমাজের ছবিটা তীব্র ফোকাসে খুব পরিষ্কার দেখা যায়। সমাজভিত্তির অর্থনীতি যদি সমাজের উপরতলার একমাত্র নিয়ন্ত্রক হত তাহলে আজকের সমাজের অনেক বিরোধের, অনেক জটিলতার সমাধান সহজেই হয়ে যেত। তা হয়নি।
হয়নি তার কারণ সমাজগড়ন, সমাজমানস এবং মানুষ, কোনটাই ঠিক সরল পাটিগণিতের মতো সহজ নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে দেবতার সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক, সমাজের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক, রাজনীতির সম্পর্ক, সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পকলার সম্পর্ক, কোনওটাই ‘ইউনিলিনিয়ার’ নয়, সরলরেখার মতো সম্পর্ক নয়, দুয়ে—দুয়ে চার নয়। দুয়ে দুয়ে সাড়ে চার বা পাঁচ বলেই সর্বত্র এত প্রকারের অসামঞ্জস্য এবং আপাত বিস্ময়কর ঘটনার এত বৈচিত্র্য। পুথিপুস্তকগত বাস্তবতার সঙ্গে প্রকৃত সামাজিক জীবনের বাস্তবতার পার্থক্য দেখে আমরা পদে পদে অবাক হয়ে যাই। তথাপি পুথিগত বাস্তবতার লেজ ধরে, গোরুর লেজ ধরে অন্ধের নগর দেখার মতো আমরা এগিয়ে চলি, সামাজিক পরিবর্তন—বিবর্তন—বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি, প্রকৃত জীবনসত্য ও সমাজবাস্তবকে এড়িয়ে যাই। আমরা চোখ মেলে দেখি না, মন খুলে বুঝতে চাই না যে সামাজিক চিন্তাভাবনা, সামাজিক ব্যবহার, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, সব কিছুরই বিভিন্ন স্তর (levels) আছে, বিভিন্ন গড়ন (structures) আছে এবং অনেক সময় এক—একটি স্তরে, একই গড়নের চৌহদ্দির মধ্যে এগুলি বেশ স্থায়ীভাবে বিরাজ করে, পরিবর্তনের কোনও ঢেউয়ের আঘাতে বিচলিত হয় না। যেমন আমাদের দেশের জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা। শত শত শতাব্দীর নির্মম কশাঘাত সহ্য করে, শত শত সাধুসন্ত—সংস্কারকের মানবতার উদাত্ত আহ্বান উপেক্ষা করে, শতসহস্র রাষ্ট্রনায়কের জাতিসাম্যের বাণী বিধিনিষেধ আইনকানুন আবর্জনাস্তূপে নিক্ষেপ করে, আজও ১৯৭৮ সালেও যখন দেখা যায় যে সেই জাতিভেদব্যবস্থা হিন্দুসমাজের সবচেয়ে মজবুত ভিত্তিরূপে প্রায় অটুট রয়েছে, অথচ অর্থনীতি—টেকনোলজির অগ্রগতি—উন্নতি অনস্বীকার্য, তখন ভাবতে হয় যে এই ব্যবস্থাটা কী এবং তার অন্তর্নিহিত কোন জাদুবলে তার এই অমর অক্ষয় রূপ আজ প্রকট। গদেলিয়ের ‘Irreducible differences between the levels and structures of social life’ এবং ‘the relative autonomy with which they operate’ বলতে এই মনে হয় বলতে চেয়েছেন। আমাদের দেশের এই স্বয়ংক্রিয় বিভিন্ন সামাজিক স্তর ও গড়ন কীরকম তা না বুঝলে কেন উনিশ শতকে বাংলা দেশে কিঞ্চিৎ নতুন চিন্তাভাবনা অথবা শিক্ষাব্যবস্থার আমদানির ফলে, উপরের সংকীর্ণ স্তরে কিছু সামাজিক আলোড়ন ঘটলেও ইয়োরোপের মতো কোনও রেনেসাঁস হয়নি, তা বুঝতে পারা সম্ভব হবে না।
সমাজবিজ্ঞানীদের মত ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগৃতির লক্ষণগুলি মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের বিচ্ছেদ নবজাগরণের এই লক্ষণগুলির মধ্যে সূচিত হয়। ভন মার্টিন বলেছেন : ৪
the typological importance of the renaissance is that it makes the first cultural and social breach between the Middle Ages and modern times : it is a typical early stage of modern age.
আধুনিক যুগ বলতে এখানে ধনতান্ত্রিক যুগের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং নবজাগরণের অন্যান্য প্রসঙ্গ উত্থাপন ও আলোচনা করার আগে আমাদের প্রথম দেখা উচিত বাংলাদেশের তৎকালের অর্থনৈতিক অবস্থাকে কত দূর পর্যন্ত ধনতন্ত্রের শৈশবকাল বলা যায়। প্রশ্ন হল, ধনতন্ত্রের অর্থনৈতিক লক্ষণগুলি কী কার্ল মার্কস বলেছেন :৫
The producer may become a merchant and capitalist, in opposition to agricultural natural economy and to the guild organized handicrafts of medieval town industry. This is the really revolutionary way. Or the merchant may take possession of production directly.
উৎপাদন বণিক (merchant) হতে পারে অথবা পুঁজিপতিও (capitalist) হতে পারে। যদি তা হয় তাহলে বুঝতে হবে যে কৃষিনির্ভর অকৃত্রিম স্বাভাবিক অর্থনীতি এবং গিল্ড বা সংঘভিত্তিক হস্তশিল্প কেন্দ্র করে মধ্যযুগের যে নগরশিল্প গড়ে ওঠে তারা তার বিরোধী। তার কারণ মধ্যযুগের কৃষক জমিদার কারুশিল্পী প্রত্যেকের আর্থিক স্বার্থের সঙ্গে আধুনিক যুগের বণিক ও পুঁজিপতিদের স্বার্থের বিরোধ ও সংঘাত অনিবার্য। এই বিরোধ ও সংঘাতের ভিতর দিয়ে ইয়োরোপের অনেক দেশে বণিক ও পুঁজিপতিরা মধ্যযুগের নগরগুলি অধিকার করেছে, নগরের সঙ্গে গ্রামের বিচ্ছেদ ও সংঘর্ষ আরম্ভ হয়েছে, ক্রমে জমিদার ও কৃষকরা পরাজিত হয়েছে এবং নগরে নগরে বণিক ও পুঁজিপতিরা শ্রেণিগতভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে। এইভাবে পশ্চিমে ইয়োরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের ধনতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে এবং আধুনিক যুগের আবির্ভাব হয়েছে। আমাদের দেশে, ভারতবর্ষে বা বাংলা দেশে তা হয়নি। তার প্রধান কারণ আমাদের পরাধীনতা। যে বিদেশি শাসকরা আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি অথবা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভবের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা তাদের নিজেদের পুঁজিপতি—সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিরোধী মনে করত। মনে করা স্বাভাবিক। ধনতান্ত্রিক—সাম্রাজ্যবাদী দেশের মধ্যে ইংল্যান্ড সকলের অগ্রণী ও অগ্রজ এবং ইংল্যান্ডের মতো সারা পৃথিবীব্যাপী বিরাট সাম্রাজ্য জয় করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পৃথিবীর আর কোনও দেশ পরবর্তীকালে পারেনি।* তার উপর আমাদের দেশের মতো এরকম প্রাকৃতিক—মানবিক সম্পদের দিক থেকে বিশাল দেশও পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোথাও ছিল না। অতএব এই দেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য এবং মানবিক সম্পদ শোষণ করে নিজেদের দেশের (ইংল্যান্ডের) শ্রমশিল্পের দ্রুত উন্নতি ও জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্য যে অধিকৃত পরাধীন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিপন্থী, তা ব্যাখ্যা করে বলা অনাবশ্যক।
এই ধরনের ঐতিহাসিক অবস্থার মধ্যে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের মতো নতুন কোনও অর্থনৈতিক—সামাজিক অবস্থার উদ্ভব সম্ভব হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আমাদের দেশকে রপ্তানি ও আমদানি উভয়েরই বাজারে (market) পরিণত করাই ছিল ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্য। আমাদের দেশের নানা রকমের কাঁচামাল (raw materials) সস্তায় সংগ্রহ করে স্বদেশে ইংল্যান্ডে পাঠানো এবং সেখানকার কলকারখানায় সেই কাঁচামাল থেকে উৎপন্ন নানা রকমের পণ্যদ্রব্য এ দেশে আমদানি করে চড়া মূল্যে বিক্রয় করা ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যসাধনের পথে তারা আমাদের দেশের নানাবিধ কুটিরশিল্প ও শিল্পীদের যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনি দেশের সাধারণ দরিদ্র জনসাধারণকে নির্মমভাবে শোষণ করেছে এবং এ দেশীয় ব্যাবসাবাণিজ্য ও বণিকশ্রেণিকে উৎখাত করেছে। অতএব মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্র থেকে আধুনিক যুগের ধনতন্ত্রের বিকাশের কোনও ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের উদয় এ দেশে হয়নি এবং তা হয়নি বলেই রেনেসাঁসের কোনও পাশ্চাত্ত্য মডেলের প্রতিষ্ঠা এখানে হয়নি। আগে যে নগর ও ছোট—ছোট নগরশিল্পের কথা বলেছি এবং গিল্ড বা শিল্পী সংঘের কথা, সে সম্বন্ধে আরও একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। গিল্ডের উৎপত্তি প্রসঙ্গে মার্কস বলেছেন : ৬
The necessity for association aganist the organised robbernobility, the need for communal covered markets in an age when the industrialist was at the same time a merchant, the growing competition of the escaped serfs swarming into the rising towns, the feudal structure of the whole country : these combined to bring about the guilds.
এরকম কোনও বাস্তব অর্থনৈতিক অবতার সৃষ্টি হয়নি আমাদের দেশে এবং দস্যুতাপ্রবণ জমিদার—জোতদারের অভাব না থাকলেও, তাদের তাড়নায় এ দেশের কারুশিল্পীদের অথবা ‘serf’—দের নগরের সীমার মধ্যে পালিয়ে এসে আত্মরক্ষার জন্য দলবদ্ধ হতে হয়নি। তার প্রধান কারণ, এ দেশের দৃঢ়মূল বংশগত বৃত্তিভিত্তিক জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা (caste system)। আমাদের দেশে কারুশিল্পের বিশেষ বিকাশ ও বৈচিত্র্যের কারণ সম্বন্ধে মার্কসের এই উক্তি প্রণিধানযোগ্য :
Every workman had to be versed in a whole round of tasks, had to be able to make everything that was to be made with his tools. The limited commerce and the scanty communication between the individual towns– the lack of population and the narrow needs did not allow of a higher division of labour, and therefore every man who wished to become a master had to be proficient in the whole of his craft. Thus there is found with medieval craftsmen an interest in their special work and in proficiency in it, which was capable of rising, to a narrow artistic sense.
Capital in these towns was a natural capital, consisting of a house, the tools of the craft, and the natural, hereditary customers; and not being realisable, on account of the backwardness of commerce and the lack of circulation, it descended from father to son.
মার্কস এইজন্য কারুশিল্পীদের মূলধনকে ‘estate capital’ বলেছেন, কারণ ‘this capital was directly connected with the particular work of the owner, inseparable from it’ এবং ওই মূলধনের সঙ্গে ‘modern capital’—এর পার্থক্য গুণগত, কারণ ‘আধুনিক মূলধন’ ‘can be assessed in money and which may be indifferently invested in this thing or that.’ আমাদের দেশের কারুশিল্পীর জীবিকার জন্য সকলে মধ্যযুগের নগরে এসে মিলিত হয়নি’, অনেকে গ্রামাঞ্চলেই পুরুষানুক্রমে বাস করেছে। তারও প্রধান কারণ বৃত্তিনির্ভর বর্ণবৈষম্য। সকল বৃত্তির সামাজিক মর্যাদা সমান নয় এবং কোনও কারুশিল্পের শৈল্পিক সৌন্দর্য যা—ই হোক—না কেন, তদনুপাতে শিল্পীর মর্যাদা স্বীকৃত হত না। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ডোকরাশিল্পী, চিত্রকর, বেত—বাঁশের শিল্পী প্রভৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পী কাঠখোদাই শিল্পী বা ভাস্করদের পদমর্যাদার পার্থক্য বিরাট।৭ এই বর্ণভেদজনিত সামাজিক মর্যাদার ভিন্নতার জন্যই প্রধানত বিভিন্ন গোষ্ঠীর কারুশিল্পীদের পক্ষে নগরে এসে মিলিত ও সংঘবদ্ধ হওয়া সম্ভব হয়নি। এ দেশের বণিকদের সঙ্গেও (সদাগরশ্রেণি) কারুশিল্পীদের প্রত্যক্ষ কোনও সামাজিক সম্পর্ক ছিল না। তা ছাড়া আমাদের দেশের সদাগররা বর্ণগতভাবে সমাজে উপেক্ষণীয় ছিল এবং এই বিভেদ ব্রিটিশ রাজত্বেও দূর হয়নি। পরে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। এ দেশীয় সদাগররা বর্ণগতভাবে উপেক্ষিত ছিল বলে, আমাদের মধ্যযুগীয় নগরে ধীরে ধীরে ‘burgher class’ এবং তা থেকে আধুনিক ‘bourgeois’ শ্রেণিরও উদ্ভব হয়নি। এদিক থেকে চীনা সমাজের সঙ্গে আমাদের কিছুটা মিল আছে, কিন্তু অন্যদিক থেকে আবার অমিলও আছে অনেক। এই বিষয়েও পরে আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের স্বার্থেই এ দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বিকাশে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। এ কথা আগে বলেছি। অবাধ বাণিজ্যের এবং শিল্পোদ্যমের যেটুকু সুযোগ—সুবিধা হয়েছিল তা গ্রহণ করা এ দেশে সর্বাগ্রে যাদের উচিত ছিল সেই সদাগরশ্রেণি—অর্থাৎ গন্ধবণিক, তাম্বূলীবণিক এবং অন্য বণিকরা, তাঁরা তা করেননি। কেন করেননি, পরে বলছি। উচ্চবর্ণের বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল এবং ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠীর ডিরোজিয়ানদের মধ্যে রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রভৃতি, কিন্তু তাঁরা Comprador শ্রেণির, অর্থাৎ ব্রিটিশের তাঁবেদার ব্যবসায়ী শ্রেণির ভূমিকা ছেড়ে স্বাধীন শিল্পোদযোগীর স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পারেননি।৮ তা ছাড়া, কিছুদিনের মধ্যে দেখা যায় যে তাঁরা ব্রিটিশের তাঁবেদার ব্যবসায়ীর ভূমিকা ছেড়ে ক্রমে নতুন জমিদারশ্রেণির আরামপ্রদ বিলাসী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে।
কর্নওয়ালিসের আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলেও এটা তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, যদিও ইতিহাসে সাধারণত সেই কথা লেখা হয়ে থাকে। কোম্পানির ডিরেক্টররা অনেক আগেই এই জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করেছিলেন। হান্টার বলেছেন : ৯
nothing can be further from the historical truth than the idea that Cornwallis was the originator either of that system or of the Permanent Settlement. What Cornwallis really did was to carry out a predetermined plan of the Court of Directors with a cautious delay…
কর্নওয়ালিস নিজে বেশ বিচক্ষণ শাসক ছিলেন এবং ব্রিটিশের স্বার্থ তিনি বেশ ভালোভাবেই বুঝতেন। তাই এই নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কয়েকদিন আগে তিনি কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে একটি চিঠিতে লেখেন (৬ মার্চ ১৭৯৩) :
The large capitals possessed by many of the natives, which they will have no means of employing…will be applied to the purchase of the landed property as soon as the tenure is declared to be secured.
এ দেশের কিছু লোকের হাতে অনেক মূলধন জমা হয়েছে ‘which they will have no means of employing’—কর্নওয়ালিসের এই কথার গুরুত্ব খুব পরিষ্কার। এরপর কোনও বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না এই কথা বোঝাবার জন্য যে স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যের পথে এ দেশের মূলধন নিয়োজিত হোক, সেটা ব্রিটিশের কাম্য ছিল না। তা না হলে কর্নওয়ালিশ বলতেন না যে জমিদারি কেনা ছাড়া অন্য কোনওভাবে এ দেশীয় মূলধন নিয়োগের উপায় থাকবে না। অতএব আঠারো শতকের Comprador শ্রেণির বাঙালিরা যাঁরা বেনিয়ানি মুতসুদ্দিগিরি দেওয়ানি সরকারি ইত্যাদি কর্ম করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন, তাঁরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে দলে দলে ‘জমিদার’ হতে আরম্ভ করলেন। প্রাচীন বনেদি জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রাজকোষে প্রাপ্য টাকা জমা দিতে অভ্যস্ত নন। তাই নতুন বন্দোবস্তের কড়া আইনের ফলে তাঁদের জমিদারি একে একে নিলামে উঠতে লাগল এবং শহরের মুতসুদ্দি—বেনিয়ানরা নিলাম থেকে সেই জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হতে থাকলেন। হান্টার বলেছেন (পূর্বোক্ত ভূমিকা) :
The mournful story of the ruin of these and other once powerful families under the Sale Law for arrears is shown in detail in…During two years alone. 1796-98, estates bearing a reveneu of Sicca Rs. 5521252, more than a fifth of the whole land tax of the Province, were advertised for sale for arrears… within twenty-two years of the Permanent Settlement, from one-third to one-half of whole landed property in Bengal had been sold on that account. The wave of the Permanent Settlement had, in truth, submerged the ancient houses of Bengal.
হান্টার এ কথা বলার অনেক আগে মার্কস তাঁর ভারতীয় ইতিহাসের খসড়াতে উল্লেখ করেছিলেন : ১০
Results of the ‘Settlement’ : First product of this plunder of ‘communal and private property’ of the ryots : whole series of the local risings of the ryots against the ‘landlords’ [conferred on them], involving : in some cases expulsion of the zemindars and stepping of the East India Co. into their place as owner; in other cases, impoverishment of the zemindars and compulsory or voluntary sale of their estates to pay of the arrears and private debts. Hence greater part off the province’s landholdings fell rapidly into the hands of a few city capitalists who had spare capital and readily invested it in land.
এই নতুন গোত্রান্তরিত জমিদারশ্রেণির চালচলনে আচার—ব্যবহারে পোশাক—পরিচ্ছদে বনেদি জমিদারদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি গোষ্ঠী তো ছিলেনই, গ্রাম ও গ্রামের জমিদারির প্রতি তাঁদের মনোভাব ছিল অন্যরকম। জমিদারিকে তাঁরা যে—কোনও ব্যাবসার মতো মনে করতেন এবং বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কৃষকদের অমানুষিকভাবে শোষণ করে নিজেদের মুনাফার অঙ্ক বৃদ্ধি করতে প্রয়াসী হতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এই যে নতুন সমাজবিন্যাস হল, বাংলার সামাজিক জীবনে তার প্রতিক্রিয়া হল সুদূরপ্রসারী। কর্নওয়ালিস এ দেশের একশ্রেণির লোকের হাতে যে প্রচুর মূলধন সঞ্চিত আছে বলে উল্লেখ করেছেন, সেটা সম্ভব হল কী করে? অর্থাৎ এ দেশের মুতসুদ্দি—বেনিয়ানরা প্রচুর মূলধন সঞ্চয় করলেন কি করে? ‘স্বাভাবিক অর্থনীতি’র (natural economy) পরিবর্তে ‘বিনিময় অর্থনীতি’ (exchange economy) প্রবর্তনের ফলে। ‘The very existence of exchange value is a massive economic fact’ কারণ বিনিময়প্রধান অর্থনীতির জন্য প্রশস্ত সুযোগ হল :১১
to seek riches, not in the absurd form of a heap of perishable gods, but in the very convenient and mobile form of money or claims to money. The possesion of money soon became an end in itself in an exchange economy.১১
এই কারণে এ দেশের comprador-শ্রেণি ব্রিটিশ শাসকদের জুনিয়র অংশীদার হয়ে নানা কৌশলে, আঠারো শতক থেকে উনিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত, প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন এবং তা সঞ্চয়ও করেছিলেন এইজন্য যে ব্যক্তিগত ব্যাপারে সেই টাকা নিয়োগ করার বিশেষ উপায় ছিল না। কর্নওয়ালিশ সেইজন্য প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে নতুন জমিদারিতে এই পুঁজি নিয়োগ করার সুযোগ হবে। তা—ই হল, এই comprador-শ্রেণি হল প্রধানত নতুন জমিদারশ্রেণি। জমিদারিতে ছাড়া বাকি টাকা খরচ হতে থাকল ব্যক্তিগত বিলাসিতায়, দয়াদাক্ষিণ্যে ধর্মকর্মে মামলা—মকদ্দমায় এবং এইরকম আরও অনেক অপচয়কর্মে। বাংলা দেশের যে দেবালয় আমাদের গর্ব করার মতো সাংস্কৃতিক কীর্তি তার অধিকাংশই এই নতুন জমিদারদের অর্থে স্থাপিত। দেবভক্তির জন্য নয়, মনে হয় পাপমুক্তির জন্য তাঁরা দেবালয় প্রতিষ্ঠায় উদযোগী হন। স্থাপত্যের কীর্তি হিসেবে অবশ্যই এগুলি উল্লেখ্য, কিন্তু তার গৌরব সূত্রধর ও অন্যান্য অখ্যাত অজানা কারিগরশিল্পীর প্রাপ্য। এই সমস্ত ব্যক্তিগত বিলাস ও মর্জি চরিতার্থের জন্য অজস্র অর্থব্যয় ছাড়াও কেবল যৌথ সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারার জন্য মামলাতে (অনেক সময় পুরুষানুক্রমে) কত লক্ষ লক্ষ টাকা যে খরচ হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই, আজ পর্যন্ত কেউ তার একটা আনুমানিক হিসেব করার চেষ্টা করেননি। অন্নপ্রাশন বিবাহ শ্রাদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে রাজসূয় যজ্ঞের মতো খরচের কথা উল্লেখ না—করাই ভালো। এই বিচিত্র অপব্যয়ের একটা আনুমানিক হিসাব করাও যদি সম্ভব হত তাহলে দেখা যেত যে সেই অর্থ দিয়ে আমাদের দেশ শিল্পায়নের (industrialisation) পথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত, অবশ্য যদি এ দেশের লোকের শিল্পোদযোগী হবার মতো মনোভাব থাকত এবং শাসকরা সেখানে কোনও অন্তরায় সৃষ্টি না করত।
ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশে তিনটি সামাজিক শ্রেণি তৈরি করেছিলেন নিজেদের প্রশাসনিক ভিত্তিস্তম্ভগুলিকে সুদৃঢ় করার জন্য। শ্রেণিগুলি হল :
ক. নাগরিক comprador-শ্রেণি।
খ আধা—নাগরিক আধা—গ্রাম্য জমিদারশ্রেণি।
গ. গ্রাম্য ও নাগরিক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে নতুন শিক্ষিতরাও আছেন, যাঁদের মেকলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দালালস্বরূপ বলেছেন। এই নতুন শ্রেণিবিন্যাসের ফলে ইংরেজদের পক্ষে বিশাল শাসন—শোষণব্যবস্থা ‘institutionalise’ করা সহজেই সম্ভব হয়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা স্থায়ী বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং সেটা কেবল আর্থিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বা জীবনযাত্রার বিচ্ছেদ নয়, গভীর মানসিক বিচ্ছেদও বটে। সকল শ্রেণির ‘town animal’ (Marx) হিংস্র পশুর মতো তাদের টাকার ক্ষুধা মেটাবার জন্য গ্রামের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে এবং মূলত কৃষকদের শোষণ করেই সেই ক্ষুধা মেটাতে থাকে।
এরকম অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের কোনও ঐতিহাসিক লক্ষণ সন্ধান করা অর্থহীন। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ধনতন্ত্রের সামাজিক—সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদও এই অবস্থায় সম্ভব নয়। সম্ভব যদি না হয় তাহলে সমাজবিজ্ঞানীরা যে নবজাগৃতির (Renaissance) ‘typological importance’-এর কথা ‘first cultural and social breach between the Middle Ages and Modern times’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা এ দেশে হয়নি। অতএব ইয়োরোপীয় মডেলের কোনও আধুনিক নবজাগরণ বাংলা দেশে অথবা বাঙালি সমাজে হয়নি। আমরা ইয়োরোপীয় বিদ্যা ইংরেজের আমলে শিক্ষা করে সব কিছুই সেই বিদ্যার আলোকে দেখতে ও বিচার করতে শিখেছি। তাই সোডার বোতলের উচ্ছ্বসিত বুদবুদের মতো খানিকটা সাময়িক আদর্শগত চিত্তচাঞ্চল্য এ দেশের কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ করে এবং রেলগাড়ির বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শব্দ আর কয়েকটি খুদে কারখানার ভোঁ শুনে আমরা ভেবেছি আমাদের দেশে ইউরোপের মতো রেনেসাঁসের হাওয়া বইছে। আমাদের ভাবনা ভুল, সাদৃশ্যবোধ ভুল। হাওয়া বয়েছিল সমাজের উপরতলার চিলেকোঠার একটি ছোট আধখোলা জানলা দিয়ে। সেই হাওয়া কারও গায়ে লাগেনি, মনে তো নয়ই। নবজাগরণ হয়নি, যা লেখা হয়েছে, এখনও লেখা হয়, তা অতিকথা।
কেন হয়নি তার কারণ আরও তলিয়ে খোঁজ করা দরকার। ব্রিটিশ প্রশাসনের যে তিনটি এ দেশীয় নতুন শ্রেণিস্তম্ভের কথা আগে বলেছি, তার সামাজিক গড়নটা কী জানা উচিত। মুতসুদ্দিগিরি—বেনিয়ানি করে প্রচুর বিত্তসঞ্চয় করেছিলেন কারা? কারা সঞ্চিত অর্থ নিয়োগ করে জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হয়েছিলেন? গ্রাম ও শহরের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল? কারা নতুন পাশ্চাত্যবিদ্যা শিক্ষা করে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণি হয়ে সেকালের ভাষায়, ‘rulers and ruled’-এর মধ্যে ‘interpreters’ হয়েছিলেন? অধিকাংশই হিন্দু এবং হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশই ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—কায়স্থ প্রভৃতির উচ্চবর্ণভুক্ত যাঁরা, তাঁদের নিয়েই প্রধানত এই তিনটি শ্রেণি গঠিত হয়েছিল। মুসলমান এবং অনুচ্চবর্ণ বলে হিন্দুসমাজের যাঁরা উপেক্ষণীয়, তাঁদের সংখ্যা এই তিনটি শ্রেণির মধ্যে খুবই সামান্য। কেন সামান্য? কেন অনুচ্চবর্ণের লোকরা অর্থনীতি রাজনীতি শিক্ষা প্রভৃতি ভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন যুগে স্বাধীনভাবে বিচরণের সুযোগ গ্রহণ করেননি? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে বাংলার, তথা ভারতের, ভুয়ো রেনেসাঁসের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে কেন বাংলার নবজাগৃতি একটি অতিকথা ছাড়া কিছু নয়।
হিন্দুধর্ম চাতুর্বণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং হিন্দুসমাজ ‘বর্ণাশ্রমিকসমাজ’। হিন্দুসমাজের এই ভিত আজ পর্যন্ত কোনও সংস্কারক অথবা কোনও শাসক ভাঙতে পারেননি, বৌদ্ধ জৈন হিন্দু মুসলমান অথবা খ্রিস্টান ইংরেজরা, কেউ না। সংস্কারকদের মানবতার বাণী, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, শিক্ষার অগ্রগতি ইত্যাদির ফোটো তার গায়ে খানিকটা আঁচড় লেগেছে ঠিকই, কিন্তু ভিত্তিতেফাটল ধরেনি। বর্তমান বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকেও বোঝা যায়, এ কথা কতখানি সত্য।
হিন্দু শাস্ত্রকাররা (প্রাচীন ও মধ্যযুগের এলিটশ্রেণি) বলেন যে জন্মের দ্বারাই ‘বর্ণ’ ঠিক হয়, অর্থাৎ কুল জন্মগত। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের পুত্র ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের পুত্র বৈশ্য, শূদ্রের পুত্র শূদ্র, এইটাই হিন্দুসমাজের চিরস্থায়ী জাতিবর্ণগত ব্যবস্থা এবং স্বয়ং ভগবানই এই ব্যবস্থার প্রবর্তক। ভগবান নিজেই বর্ণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে শূদ্র সৃষ্টি করেন :
মুখতঃ সোহসৃজদ্বিপ্রান বাহুভ্যাং ক্ষত্রিরয়াংস্তথা।
বৈশ্যাংশ্চাপ্যুরুতো রাজন্ শূদ্রান্ বৈ পাদস্তথা।
মহাভারত, ভীষ্মপর্ব ৬৭।১৯
মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্রমনিম্নমুখী প্রত্যঙ্গের সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তির সম্পর্ক থেকে বর্ণবিন্যাসের ক্রমও পরিষ্কার বোঝা যায়। জন্মগত কুলের দ্বারা বৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কুলবৃত্তি কদাচ পরিত্যাজ্য নয়। ব্রাহ্মণরা জন্ম থেকেই অন্য বর্ণের গুরু হবার অধিকারী—
ক্ষত্রিয়ঃ শতবর্ষী চ দশবর্ষী দ্বিজোত্তমঃ।
পিতাপুত্রৌ চ বিজ্ঞেয়ৌতয়োর্হি ব্রাহ্মণো গুরুঃ।
অনুশাসনপর্ব ৮।২১
কর্মগত সুফল—কুফলের জন্য ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণত্বলাভ, অথবা বৈশ্য—শূদ্রের ব্রাহ্মণত্বের মর্যাদালাভের অনেক বচন ও দৃষ্টান্ত শাস্ত্রে আছে, কিন্তু সেগুলি জন্মগত বর্ণবিভেদের লৌহবন্ধন শিথিল করার জন্য নয়, অসন্তাষ ও বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে সংযত করার জন্য। সুকর্মের পুরস্কারস্বরূপ সামাজিক পদোন্নতির লোভ দেখিয়ে সমাজব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করাই এইসব শাস্ত্রবচনের উদ্দেশ্য। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়কূলে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর তপস্যার বলে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। একালের হরিজন কুলোদ্ভব কেউ কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে এবং রাজনৈতিক কলাকৌশল আয়ত্ত করে হয়তো ‘মন্ত্রী’ হতে পারেন, কিন্তু তার জন্য সাধারণ হরিজনদের হরিজনত্ব একটুও বদলায় না। সর্পরূপী নহুষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন ‘সত্য সহৃদয়তা দান ক্ষমা তপস্যা দয়া যে ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনিই ব্রাহ্মণ।’ নহুষ বলেন, ‘এসব গুণ তো শূদ্রদের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়।’ যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেন, ‘শূদ্রের জাতিগত গুণ (পরিচর্যাদি) যদি ব্রাহ্মণের দেখা যায়, তাহলে তাকে শূদ্র মনে করব। আর ব্রাহ্মণের গুণ, শম, দম ইত্যাদি যদি শূদ্রে দেখা যায়, তাহলে তাকে ব্রাহ্মণ মনে করব।’ যুধিষ্ঠির সজ্ঞানে এখানে মিথ্যা কথা বলে নহুষকে ধাপ্পা দিয়েছেন। তা ছাড়া যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র হলেও তিনি কাকে কর্মগুণে ব্রাহ্মণ বা শূদ্র মনে করেন তাতে ব্রাহ্মণের বা শূদ্রের অথবা সমাজের কিছু আসে—যায় না। যুগে যুগে কত শত শত যুধিষ্ঠির এসেছেন গিয়েছেন কিন্তু বর্ণভেদের আঁকাবাঁকা পথে হিন্দুসমাজের প্রবাহ তার জন্য খাত বদলায়নি। সেকালে সমাজের যা হোক একটা শাসন ছিল, একালে তা—ও নেই। একালে টাকা যার, সমাজ তার। নিম্নবর্ণের চেয়ে উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে এ কথা অনেক বেশি সত্য। কালের ব্রাহ্মণরা যদি অজস্র অপকর্ম করে অঢেল টাকা উপার্জন করতে পারেন, তাহলে সেই টাকার জোরে তিনি তাঁর ব্রাহ্মণত্ব অনেক বেশি বজায় রাখতে পারেন এবং বর্ণশ্রেষ্ঠরূপে তাঁর দাপট অন্যদের উপর জাহির করতেও পারেন। ব্রিটিশ আমলে হিন্দুসমাজে এই ঘটনাই ঘটেছে। কুলবৃত্তি ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ—ক্ষত্রিয়—বৈশ্যরা কেউ জাতিচ্যুত হননি, বরং প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সমাজে তাঁদের কুলগত আধিপত্য আরও মজবুত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কুলগত বর্ণের সঙ্গে বিত্তগত বর্ণ মিশে এক বিচিত্রবর্ণ সামাজিক প্রতিপত্তির বিকাশ হয়েছে সমাজে ব্রিটিশ আমলে। সমাজের কুলগত—জাতিবর্ণগত গড়নের কোনও পরিবর্তন হয়নি, যেজন্য এ দেশে ‘রেনেসাঁস’ হয়নি।
ভারত ও চীনের সামাজিক সাদৃশ্য এখানে বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। চীনেও ইয়োরোপের মতো ‘রেনেসাঁস’ হয়নি, ভারতেও হয়নি, এবং না—হবার কারণ দুই দেশেই প্রায় একরকম। কিন্তু রেনেসাঁস না—হবার কারণ অনেকটা একরকম হলেও, ভারত ও চীনের মধ্যে সামাজিক বৈসাদৃশ্যও আছে অনেক। যেমন ভারত বহুভাষাভাষী, চীন তা নয়। যেমন চীনের সমাজে ভারতের হিন্দুসমাজের মতো কোনও জাতিবর্ণভেদ নেই, অথচ চীনে একটা বৃত্তিগত সামাজিক মর্যাদাভেদ আছে। এই বৃত্তিগত মর্যাদাভেদের ক্ষেত্রে ভারত—চীনের সাদৃশ্য আছে এবং রেনেসাঁসের যাবতীয় অনুপ্রেরণার অপমৃত্যুও উভয় দেশে এই একই কারণে ঘটেছে। কিন্তু বৃত্তিভেদ জন্মগত ও কুলবর্ণগত হবার জন্য ভারতীয় সমাজে নবজাগরণ ব্যাহত হবার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি।
কেম্ব্রিজের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী চীনবিশারদ অধ্যাপক জোসেফ নিডহাম (Joseph Needham) দীর্ঘকাল চীনের বিজ্ঞান ও টেকনোলজির বিকাশের সঙ্গে চীনা সমাজের গড়নের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং চীনে কেন ইউরোপীয় ধাঁচের রেনেসাঁস হয়নি তার কারণও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রসঙ্গত, ভারতের কথাও তিনি মধ্যে মধ্যে উত্থাপন করেছেন এবং বলেছেন যে ভারতীয় সমাজের বিশিষ্ট গড়ন ও ইতিহাসের মধ্যেই নবজাগৃতির প্রেরণার অভাবের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। নিডহামের চীনা সমাজের ইতিহাস কয়েকটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন
Science and Civilisation in China. 7 Vols, II parts: London
The Grand Titration, Science and Society in East and West, London 1969
Clerks and Craftsmen in China and the West, London 1970.
আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় প্রসঙ্গে নিডহামের এই আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে এখানে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি। নিডহাম বলেছেন :
whoever would explain the failure of Chinese society to develop modern science had better begun by explaining the failure of Chinese society to develop mercantile and then industrial capitalism. Whatever the individual prepossessions Western historians of science, all are necessitated to admit that from the fifteenth century A.D. onwards a complex of changes occurred; the renaissance cannot be thought of without the rise of modern science, and none of them can be thought of without the rise of capitalism, capitalist society and the decline and disappearance of feudalism…The fact is that in the spontaneous autochthonous development of Chinese society no drastic change parallel to the renaissance and the scientific revolution in the West, occurred at all.
The Grand Titration, pp. 39-40
এখানে চীনা সমাজ সম্বন্ধে নিডহাম যা বলেছেন তা ভারতীয় সমাজের ক্ষেত্রেও প্রায় বর্ণে বর্ণে প্রযোজ্য। প্রসঙ্গত, সে কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন :
The bureaucratic-feudal system of traditional China proved to be one of the most stable forms of social order ever developed..it played a leading port in assuring for Chinese culture a continuity…above all, it meant (as in India) that there was no indigenous development of capitalism. The mandarinate system was so successful that it inhibited the rise of the merchants to power in the state; it walled up their guilds in the restricted role of friendly and benefit societies; it nipped capitalist accumulation in the but…
Within the Four Seas, p. 34
এখানে কেবল ‘mandarinate system’-এর বদলে ‘caste system’ কথাটি বসিয়ে ভারতীয় সমাজের ক্ষেত্রেও নিডহামের এই উক্তি প্রয়োগ করা যায়। জাতিভেদের জন্য গিল্ড বা শিল্পীসংঘের বিকাশও ভারতীয় সমাজে খুব সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। কাজেই ‘capital accumulation’ এবং ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ আমাদের দেশে হয়নি। আরও পরিষ্কার করে নিডহাম বলেছেন :
Now if the mandarinate was supreme, if the Civil Service was always the great power, there was a bar to the development of any other group in society, so that the merchants were always kept down and unable to rise to a position of power in the State. They had guilds, it is true, but these were never as important as in Europe. Here we might be putting our finger on the main cause of the failure of Chinese civilisation to develop modern technology, because in Europe (as is universally admitted) the development of technology was closely bound up with the rise of the merchant class to power. It is perhaps a question of who is going to put up the money for scientific discovery—it is not the Emperor, it is not the feudal lords; they fear change rather than welcome it. But when you come to the merchants, they are the people who will finance research in order to develop new forms of production and trade; and such was indeed the fact in European history. Chinese society called ‘bureaucratic feudalism’, and that may go a long way to explain why the Chinese, in spite of their brilliant successes in earlier science and technology, were not able, as their colleagues in Europe were, to break through the bonds of medieval ideas and advance to what we call modern science and technology. I think, one of the great reasons is that China was fundamentally and irrigation-agricultural civilisation as contrasted with the pastoral-navigational civilisation of Europe; with the consequent prevention of the merchants’ rise to power.
Clerks and Craftsmen in China and the West, p. 82
ইয়োরোপে বিজ্ঞান ও টেকনোলজির বিকাশের সঙ্গে বণিকশ্রেণির ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। সামন্তযুগের রাজারা অথবা তাঁদের আশ্রিত অমাত্য—আমলারা বিজ্ঞান—টেকনোলজির উন্নতির ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, যেহেতু বিজ্ঞানের উন্নতি তাঁদের শ্রেণিস্বার্থ বিরোধী। কিন্তু বণিকরা তাঁদের শ্রেণিস্বার্থের জন্য বাণিজ্য ও উৎপাদনের উন্নতি কামনা করতেন এবং সেই কারণে বিজ্ঞানের গবেষণায় উৎসাহ দিতেন। ইয়োরোপীয় সমাজে বিজ্ঞানের চর্চা, টেকনোলজির উন্নতি বণিকদের আর্থিক আনুকূল্যেই সম্ভব হয়েছে। চীনে ও ভারতে তা হয়নি। বণিকশ্রেণি এশিয়ার এই দুই মহাদেশে উৎপাদনরীতির উন্নতির ব্যাপারে আদৌ উৎসাহী ছিলেন না এবং বাণিজ্যের প্রসারেও তাঁরা কোনও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেননি। কারণ চীন ও ভারতের ফিউডালিজমের স্বরূপ এবং সেখানে বণিকশ্রেণির কোনও সামাজিক সম্মান ছিল না, তাঁদের বাণিজ্যকর্মকেও অশ্রদ্ধার চোখে দেখা হত। বণিকরা তাই এই দুই দেশে সামাজিক প্রতিপত্তি অথবা রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব অর্জন করতে পারেননি। নিডহাম বলেছেন, এরকম ঐতিহাসিক অবস্থার প্রধান কারণ হল, চীনের সভ্যতা ‘irrigational-agricultural civilisation’, ইয়োরোপের মতো ‘pastoral navigational’ নয়, তাই বণিকদের প্রাধান্য চীনা সমাজে স্বীকৃত হয়নি। ভারতের ক্ষেত্রেও ঠিক তা—ই হয়েছে। ভারতীয় সভ্যতার বনিয়াদ হল সেচ—কৃষি, তাই বণিকরা শ্রেণিরূপে সমাজে কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। তার উপর ভারতের জাতিবর্ণভেদ—ব্যবস্থার জন্য বণিকরা কোনও সামাজিক মর্যাদা লাভ করেননি, চিরকাল উপেক্ষিত হয়েছেন। চীনের মতো ভারতেও প্রাচীন হিন্দু যুগে বিজ্ঞানের অনুশীলন ও উন্নতি যথেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু ইউরোপের মতো তার স্বাভাবিক ঐতিহাসিক বিকাশ সম্ভব হয়নি বণিকদের ঔদাস্যের জন্য। রেনেসাঁসও এই কারণে হয়নি।
চীনের সমাজগড়নের ভিত্তি কর্মগত স্তরের উপর প্রতিষ্ঠিত, ভারতের মতো জন্মকুলগত স্তরের উপর নয়। চীনের জনগোষ্ঠীর এই স্তরক্রমকে সেইজন্য নিডহাম ‘estates’ বলেছেন, ‘classes’ নয় (‘We need not call them classes’—Needham)। এই সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যেও চীন ও ভারতের সঙ্গে মৌল পার্থক্য আছে। যেমন
চীনের সমাজ
শি Shih—the scholar-gentry
নুং Nung—the farmers
কুং Kung—the artisans
শ্যাং Shang—the merchants
ভারতীয় সমাজ
ব্রাহ্মণ এলিটগোষ্ঠী
ক্ষত্রিয় শাসকগোষ্ঠী, যোদ্ধা
বৈশ্য বণিক—ব্যবসায়ী
শূদ্র কৃষক ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী
এখানে চীনা সমাজ ও ভারতীয় সমাজের স্তরবিন্যাসের সাদৃশ্য—বৈসাদৃশ্য উভয়ই বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। ভারতীয় সমাজে বণিকজনের স্থান নিম্নস্তরে হলেও ‘তৃতীয়’ (‘বৈশ্য’), কিন্তু চীনা সমাজে বণিকরা নিম্নতম চতুর্থ স্তরভুক্ত। স্তরক্রমের মধ্যে একটি ধাপের পার্থক্য তেমন উল্লেখ্য বা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু চীনা সমাজের গড়নের বৈশিষ্ট্য হল, কৃষিজীবীদের স্থান অনেক উচ্চে—দ্বিতীয় স্তরে, বুদ্ধিজীবী—ভদ্রশ্রেণির ঠিক পরে। অথচ ভারতীয় হিন্দুসমাজের কৃষিজীবীরা সর্বনিম্ন চতুর্থ স্তরে ‘শূদ্র’ বলে অভিহিত, যদিও চীনের মতো ভারতের সভ্যতাও কৃষি—সেচভিত্তিক। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের সর্বপ্রধান বৃহত্তম স্তরটি সর্বাধিক অবহেলিত—উপেক্ষিত এবং তাদের কোনও সামাজিক পদমর্যাদা নেই, কিন্তু চীনা সমাজে এই বৃহত্তম জনস্তরের যথেষ্ট পদমর্যাদা আছে এবং সর্বোচ্চ স্তরের বুদ্ধিজীবীদের পরেই তাদের স্থান। এই পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই পার্থক্যের জন্য চীন ও ভারতের রাজনৈতিক—সামাজিক ইতিহাসের পরবর্তী ক্রমবিকাশের মৌল পার্থক্য ঘটেছে। সে কথা পরে উল্লেখ করব।
বণিকজনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বলা যায়, চীনা ও ভারতীয় সমাজের বিকাশের পার্থক্য ঘটেনি। বাঙালি সমাজের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। চীনা সমাজে যেমন, ভারতীয় সমাজেও তেমনি, প্রাচীন যুগের পর, বিজ্ঞান ও টেকনোলজির অগ্রগতি রুদ্ধ হয়েছে প্রধানত একটি কারণে, এবং সেই কারণটি হল বণিকজনের প্রতি সামাজিক অবহেলা। বণিকজনের কোনও মর্যাদা আমাদের সমাজে নেই। প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হলেও বণিকরা বণিক বা বৈশ্য এবং ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়রা ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণরা দরিদ্র হলেও বৈশ্য ও শূদ্রদের সেবার অধিকারী, গুরুগিরির অধিকারী। তাই বৈশ্য বণিকরা সামাজিক ক্রমোন্নতির ব্যাপারে উদাসীন। সমগ্র ভারতের কথা জানি না, কিন্তু বাংলা দেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে অনুসন্ধান করে দেখেছি যে আমাদের দেশের বৈশ্যকুলোদ্ভব বণিকজনেরা উচ্চস্তরের (উচ্চবর্ণের) ব্রাহ্মণ—ক্ষত্রিয়দের ‘style of living’ বা জীবনধারা অনুকরণ করেছেন, তাঁদের মতো বড়—বড় প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা, ঠাকুরবাড়ি, দেবদেবীর মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন। সামাজিক উচ্চমর্যাদালাভের ব্যর্থতাকে এইভাবে তঁরা পূরণ করেছেন মানসিক ক্ষেত্রে। বাংলার বণিকপ্রধান গ্রামে গ্রামে এই দৃশ্য দেখলে বিস্মিত হতে হয়।* মনে হয় যেন একটি ‘archaeological site’—এ উপস্থিত হয়েছি। বাংলার তথা ভারতে বণিকজনরা উৎপাদনরীতির উন্নয়নের জন্য অথবা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য বিজ্ঞান—টেকনোলজির অনুশীলনে কোনও উৎসাহ দেননি। ক্রমে তাঁরা নিজেরা উচ্চবর্ণের মতো সামন্ততন্ত্রেরই পোষকতা করেছেন, নিজেরা জমিদার—জোতদার হয়েছেন এবং জীবনযাত্রার দিক থেকে মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। বাংলা দেশে বা ভারতে সেইজন্য পাশ্চাত্য নবজাগৃতির কোনও লক্ষণ দেখা দেয়নি, দিতে পারে না। যা ঘটেছে সেটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় ‘acculturation’ বা সংস্কৃতি সংঘাতজনিত আদর্শের আদানপ্রদান ও মিশ্রণ বলা যায়। এবং এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও মিশ্রণও সমাজের অতি সংকীর্ণ উচ্চস্তরে উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
যুগ যুগ ধরে সমাজ গড়নের এই জন্মগত জাতিবর্ণভেদের স্তরবিন্যাস অনড় থাকার জন্য প্রত্যেক স্তরে বিভিন্ন বর্ণের জীবনধারা এক অতিবিচিত্র রূপ ধারণ করেছে আমাদের দেশে। প্রত্যেক বর্ণের মধ্যেও এই শ্রেণিভেদ প্রকট হয়েছে। যেমন হরিজনদের বিভিন্ন কুলগত জাতির মধ্যে শ্রেণি রূপায়ণ হয়েছে, বণিক চর্মকার দরিদ্র চর্মকারদের অর্থনৈতিক স্বার্থে এবং জাতের দোহাই দিয়ে শোষণ করছে, তেমনি ব্রাহ্মণ জমিদার নিম্নবর্ণের দরিদ্র কৃষকদের উপর শ্রেণিগত ও বর্ণগতভাবে দ্বিমুখী সাঁড়াশির মতো অত্যাচার শোষণ চালিয়েছে। জাতি (caste) ও শ্রেণি (class) বিচিত্রভাবে সমাজ গড়নের স্তরে স্তরে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। তার ফলে সমাজের স্তরবিন্যাস আরও জটিল হয়েছে এবং সামাজিক বাস্তব রূপও (social reality) অনেক বেশি অস্পষ্ট হয়েছে। জাতিবিরোধ ও শ্রেণিবিরোধ বাস্তবতার স্তরে এমনভাবে মিলেমিশে আছে যে কোনটা কী তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। বর্তমানে তাই ধনতন্ত্র ও টেকনোলজির যথেষ্ট উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে অধিকাংশ শ্রেণিবিরোধ জাতিবর্ণবিরোধ বলে মনে হয় এবং বাইরের প্রতীতি যে বাস্তব সত্য নয় তা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বুঝি না। এইভাবে সমাজের প্রত্যেকটি স্তর একটা স্বয়ংক্রিয় স্থিতি ও গতি লাভ করেছে (‘the relative autonomy with which they operate’—Godelier) যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না এবং আমাদের যান্ত্রিক মার্কসীয় তত্ত্বজ্ঞানও এই স্তরগুলির বাস্তব ধর্ম ভেদ করতে পারে না। আজকের ধনতান্ত্রিক ও টেকনোলজিক্যাল অগ্রগতির দিনেও তাই আমাদের সমাজের শাখাপ্রশাখার সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের উপাদানগুলি লতার মতো জড়িয়ে আছে দেখা যায়, বিশেষ করে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে।
আমাদের দেশের বৃহত্তম জনশ্রেণি কৃষকরা নিম্নতম শূদ্রবর্ণভুক্ত হবার ফলে যে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি ঘটেছে তা আরও শোচনীয়। চীনে কৃষিজীবীরা সমাজের দ্বিতীয় স্তরভুক্ত, উচ্চতম স্তরের পরেই তাদের স্থান, এ কথা আগে বলেছি। সেইজন্য চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টি সহজেই গ্রামভিত্তিক ও কৃষক শ্রেণিনির্ভর হতে পেরেছে, যা ভারতীয় রাজনীতির কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে হয়নি। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন শহরভিত্তিক মধ্যবিত্তনির্ভর হবার জন্য আজ তার এই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে। ভয়াবহ দারিদ্র্য ও শোষণ—পীড়ন সত্ত্বেও দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি আজও তাই শাসক—শোষকশ্রেণির লেজুড় হয়ে নিজেদের সত্তা কোনওরকমে বজায় রেখে চলেছে, এমনকী যাঁরা কমিউনিস্টদের মধ্যে সাচ্চা বিপ্লবী, প্রকৃত ‘মার্কসিস্ট—লেনিনিস্ট’ বলে দাবি করেন তাঁদের মধ্যে অনেকে (সকলে অবশ্যই নন) মধ্যবিত্ত বাবুপ্রধান রাজনীতিতেই মগ্ন, কেবল তত্ত্বকথার বীজকুড়ি কাটছেন, এবং গ্রাম বা কৃষক তাঁদের শহরের কফি হাউসের আড্ডা থেকে অনেক দূরে। বর্তমান বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকে যেমন মার্কসীয় তত্ত্বের বাঁধা সূত্র প্রয়োগ করে, আমাদের হতভাগা দরিদ্র দেশে কেন বিপ্লব (revolution) হয়নি এবং হবার আশু সম্ভাবনা নেই তা ব্যাখ্যা করা যায় না, তেমনি উনিশ শতকের ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগৃতি মার্কস লিখিত ‘ভারতে ইংরেজ শাসনের ফলাফল’ বিষয়ে প্রবন্ধের সাহায্যে ‘ঐতিহাসিক সত্য’ বলে প্রমাণ করা যায় না। বাংলার তথা ভারতের নবজাগৃতি যে একটি অতিকথা (myth), এ সত্য বাস্তব ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে।
………..
* Antonio Gramsci : The Modern Prince & Other Writings, N. Y. 1970—’The Foration of Intellectuals’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১. Marx and Engels : Selected Correspondence : Translated and Edited by Dona Torr : London 1943, Letter No. 24, pp 69-70
২. এই বিষয়ে Luci Colletti লিখিত From Rousseau to Lenin : Studies in Ideology and Society (New Left Books, London 1972) গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
বিনয় ঘোষ : মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ : দ্বিতীয় সংস্করণ, পরিশিষ্ট, ১৯৭৭ পৃষ্ঠা ২২৩—২৬
৩. Maurice Godelier : Rationality and Irrationality in Economics : Monthly Review Press, New York 1972 : Foreword to the English edition 1972—’Functionalism Structuralism and Marxism’
৪. Alfred Von Martin : Sociology of the Renaissance, London 1945, p. 3
৫. Capital, Vol. III : Bottomore and Rubel : Karl Marx, Selected Writings in Sociology and Social Philosophy; London 1961, p. 130
* ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ১৩,৩৫৫,০০০ বর্গমাইল এবং সমস্ত সাম্রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা ৪৯৫,৫০০,০০০—বর্তমান শতাব্দীর চারের দশকে পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যার প্রায় এক—চতুর্থাংশ (J. H. Stembreidge : British Empire, O. U. P.)
৬. মার্কসের উদ্ধৃতি দুটি তাঁর The German Ideology রচনা থেকে গৃহীত। মার্কসের Pre Capitalist Economic Formations (N. Y. 1971) গ্রন্থের সম্পাদক Eric J. Hobsbawm উক্ত গ্রন্থ থেকে প্রয়োজনীয় কিয়দংশ Supplementary Texts of Marx and Engels on Problems of Historical Periodization অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন।
৭ বিনয় ঘোষ : পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি : দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ : প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৭৬, ১৯৭৮ এবং তৃতীয় খণ্ড (১৯৭৯) দ্রষ্টব্য।
৮. বিনয় ঘোষ : বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা।
৯. W. W. Hunter: Bengal M. S. Records 4 Vols. London 1894—Vol. I, Introduction.
১০. Karl Marx : Notes on Indian History (664-1858) : Moscow N. D. এই গ্রন্থের সম্পাদকমণ্ডলী মার্কসের এই ‘নোট’ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, ‘This paragraph has been taken from Marx’s abstract of Kovalevsky’s book. The abstract immediately follows Marx’s chronological notes.’
১১. Paul M. Sweezy et al : The Transition from Feudalism to Capitalism (Reprinted from Science and Society, N. Y. 1950-53)
* এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বণিকপ্রধান গ্রামের বিবরণসহ সবিস্তারে আমি আলোচনা করেছি। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ নতুন পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম (১৯৭৬), দ্বিতীয় (১৯৭৮) এবং তৃতীয় খণ্ড (১৯৭৯) দ্রষ্টব্য।
***
১
1. Bengal Past and Present : ১৯০৭ সাল থেকে।
2. Selections from the Calcutta Gazettes : Vols. I to V; Calcutta 1864-1869
Edited by W. S. Seton Karr & H. D. Sandeman
3. The Proceedings and Transactions of the Bethune Society, Nov. 1859 to April 1869 : Calcutta 1870
4. Transactions of the Bengal Social Science Association, 1869-70-71, Calcutta : 1869-71
5. Selections from the Writings of Hurrish Ch. Mukerji : N. C. Sen Gupta, Calcutta 1910
6. Selections from the Writings of Girish Chander Ghosh : Ed. by M. N. Ghose, Calcutta 1912
7. Selections from Educational Records : Vol. I, 1789-1839, by H. Sharp, Calcutta 1920, Vol. II, 1840-1859 by J. A. Richey, Calcutta 1922
২
8. The Modern History of the Indian Chiefs, Rajas, Zamindars etc., Lokenath Ghose, 2 Vols. Calcutta 1881
9. Memoirs of Maharaja Nubkissen Bahadur : N. N. Ghose, Calcutta 1901
10. Dictionary of Indian Biography : C. E. Buckland, London 1906
11. Bengal under the Lieut-Governors, 2 Vols. : C. E. Buckland, Calcutta 1902
12. The Bengal Obituary, Calcutta 1848
13. Raja Digambar Mitra : Bholanath Chunder, 2 Vols. Calcutta 1893, 1907
14. Speeches of Ram Gopal Ghose
15. A Biographical Sketch of David Hare : P. C. Mitra, Calcutta 1877.
16. Men I Have Seen : Sivanath Sastri, Calcutta 1919
17. Memoirs of William Hickey, 4 Vols. London, Reprint
18. Some Personal Experiences, Bampfylde Fuller, London 1930
19. Speeches by Raja Rajendralal Mitra : J. Mitra, Calcutta 1892
20. A General Biography of Bengal Celebrities : R. G. Sanyal Calcutta 1889
21. The Life and Teachings of Keshub Chunder Sen : P. C. Mozoomdar, 3rd ed., Calcutta 1931
22. Recollections of Alexander Duff : Rev. L. B. Day, London 1879
23. Reminiscences and Anecdotes of Great Men of India : R. G. Sanyal, Calcutta 1894
24. Addresses, Literary and Academic : Sir Asutosh Mookerjee, Calcutta 1915
25. Convocaion Address, 7 Vols., 1858 to 1938, Calcutrta University
26. Speeches by Dr. Rashbehary Ghose, Calcutta 1915
27. Speeches by Sir Stuart Bayley : Ed. by J. Mitter, Calcutta 1888
28. Life of Lal Behari Day : G. Macpherson, Edin. 1900
29. A Nation in Making : Surendranath Banerjee, Oxford
30. Memories : B. C. Pal, Calcutta
31. The Life of Girish Chunder Ghose : Rev. by M. N. Ghose, Calcutta, 1911
32. Life of Colesworthy Grant : P. C. Mitra, Calcutta 1881
33. Eminent Mussalmans : Madras 1905
34. Famous Parsis : Madras 1930
35. Indian Scientists : Madras 1930
36. Twelve Men of Bengal in the 19th Century : F. B. Bradley-Birt, Calcutta 1910
37. Nawab Bahadur Abdul Latif : Papers and Letters with an Autobiographical Account, Calcutta 1915
38. An Indian Journalist : Life, Letters and Correspondences of Sumbhu Chandra Mookerjee : by F. H. Skrine, Calcutta 1895
৩
39. Report on the Village Watch of the Lower Provinces of Bengal : D. J. McNeile, Calcutta 1849
40. Narrative of a Journey etc. : Bishop Heber, 2 Vols., London 1844
41. History of the Brahmo Samaj : 2 Vols.: Sivanath Sastri, Calcutta 1912, 1919.
42. Our Administration of India : H. A. D. Phillips, London 1886
43. A View of the History, Literature and Mythology of the Hindoos: William Ward, 3 Vols., London 1822
44. Sketch on the Religious Sects of the Hindus : H. H. Wilson, London 1861
45. The Domestic Life, Character and Customs of the Natives of India: James Kerr, London 1865
46. The Stranger in India (or Three Years in Calcutta) : G. W. Johnson, 2 Vols., London 1843
47. Journal of a Writer’s Tour in India : Capt. F. Egerton, 2 Vols., London 1852
48. Travels of Hindoo : Bholanauth Chunder, 2 Vols., London 1869
49. India in 1880 : Richard Temple, London 1880
50. Wandering of a Pilgrim etc. : Fanny Parkes, 2 Vols., London 1850
51. Municipal Calcutta : S. W. Goode, London 1916
52. History of Indian Association : J. C. Bagal, Calcutta 1953
53. New India : H. S. J. Cotton, London 1885
54. History of Hooghly College : K. Zachariah, Calcutta 1936
55. India in Bondage : J. T. Southerland, New York 1929
56. India and India Missions : Alexander Duff, Edin 1840
57. A Short History of Calcutta : A. K. Ray (Census 1901) Calcutta 1902
58. The Early Annals of the English in Bengal : C. R. Wilson, 2 Vols., London 1895
59. The Annals of Rural Bengal : W. W. Humter,; London 1868
60. Echoes from Old Calcutta : H. E. Busteed, London 1908
61. Modern Religous Movement in India : J. N. Farquhar, London 1924
62. Prosperous British India : William Digby, London 1901
63. Public Works in India : Lt. Col. A Cotton, London 1854
64. British Social Life in India : D. Kincaid, London 1939
65. The Renaissance in India : T. H. Cousins, Madras 1918
66. The Industrial Arts of India : George C. M. Birdwood, London 1880
67. Indian Unrest : Valentine Chirol, London 1910
68. India : Valentine Chirol, London 1926
69. Letters from India : Vitor Jacquemont, 1828-31, 2 Vols., London 1834
70. History of the Portuguese in Bengal : T. J. A. Compus, Calcutta 1919
—