সংযোজন : ১৯৭০

বাংলার নবজাগরণ – সমীক্ষা ও সমালোচনা

সমাজের মতো সামাজিক ইতিহাসের সমীক্ষাও গতিশীল। পরিবর্তনশীল অর্থে গতিশীল। সমীক্ষার বিভিন্ন পর্বে ইতিহাসের গতিশক্তির উৎস—সন্ধানী দৃষ্টি যত গভীরে প্রসারিত হতে থাকে, ক্রমে তত সমাজের আলো—অন্ধকারের কানাচ ও কক্ষগুলি গোচরে আসে, তত তার কাজ চালানো রং—ঝালাইয়ের জোড়াতালিগুলি ধরা পড়ে, পলেস্তারার ফাঁক দিয়ে রংচটা ফাটলগুলি উঁকি মারে এবং আমাদের অনেক মনগড়া ও বই—পড়া ভাবপ্রতিমার সম্মোহনী রূপ তার ভিতরের ও পিছনের বাঁশ—খড়ের কঙ্কালটির রূঢ় প্রকাশে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলার নবজাগরণের যে ভাবপ্রতিমা, উনিশ শতকের পশ্চাৎপটে, নানা রঙের প্রলেপ দিয়ে আমরা নির্মাণ করেছি, তার অনেক আজ সামাজিক গতির তরঙ্গে ধুয়ে—মুছে মাটি হয়ে গিয়েছে, অনেক রঙের বাহ্য ঔজ্জ্বল্য ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। তার কারণ, প্রলেপগুলি বেশির ভাগই কাঁচা রঙের। তা থেকে বোঝা যায়, আমাদের ইতিহাসের ধারা বিশ্লেষণে, বিশেষ করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারা, মূলে কোথাও গলদ আছে, ভয়ংকর একটা ফাঁক ও ফাঁকি আছে, যে ফাঁক ও ফাঁকি কেবল তারিখ ও তথ্যের সমারোহে পূরণ করা যায় না। কারণ প্রাণহীন নিরেট তথ্য, মহাফেজখানা বা গ্রন্থাগার যেখান থেকেই আবিষ্কৃত হোক, ঐতিহাসিক ও অনুসন্ধানীর হাতে তা খেলার পুতুল মাত্র। তিনি তাঁর দৃষ্টি, বুদ্ধি ও বিচারভঙ্গি অনুযায়ী সেগুলি নির্বাচন করেন, সাজিয়ে—গুছিয়ে সামনে উপস্থিত করেন এবং তার ভিতর দিয়ে ইতিহাসের পালাগান শোনান। সেটা কেবল তথ্যের পুতুলনাচের ইতিকথা, সমাজের ও মানুষের ইতিকথা নয়। একই তথ্যের কত বিচিত্র প্রকাশ ও ব্যাখ্যা আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে সাময়িকপত্রে দেখতে পাই। কাজেই কেবল তথ্য নয়, তথ্যান্তর্গত সত্যটিকে বুঝতে হলে ইতিহাসের গতিরোধ তো বটেই, সেই গতির ছন্দ ও তাল—মাত্রা সম্বন্ধেও বোধ সজাগ থাকা প্রয়োজন। এই বোধ থাকলে ঐতিহাসিক তথ্যবিচার বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে, ইতিহাস বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, এবং তা যদি হয় তাহলে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিভেদরেখা লুপ্ত হয়ে যায়। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের এই মিলনসীমান্তে দাঁড়িয়ে আজ আমরা উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের গতিধারা বিচার—বিশ্লেষণ করব এবং চেষ্টা করব তার অসংগতি ও অপূর্ণতার কারণগুলি নির্দেশ করতে।

পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের অর্থ ও গুরুত্বের দিক থেকে আমাদের ঐতিহাসিকরা সাধারণত উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বিচার করে থাকেন। ইতিহাসে কখনো দেখা যায় না যে দুই দেশের বা দুই পরিবেশের এক ধরনের ঘটনার মধ্যে ঠিক একই কারণের সমাবেশ অথবা একই প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। কিন্তু কারণ ও তার ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, কতকগুলি মৌল বিষয়ের বা ঘটনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সাদৃশ্যের জন্য আমরা ‘রেনেসাঁস’—এর মতো ঐতিহাসিক শব্দ ব্যবহার করতে পারি। ইতিহাসের দিক থেকে ‘রেনেসাঁস’ কথার ‘typological’ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য কী? জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আলফ্রেদ ফন মার্টিন তাঁর Sociology of the Renaissance গ্রন্থে রেনেসাঁসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্দেশ করে বলেছেন—‘the typological importance of the Renaissance is that it marks the first cultural and social breach between the Middle Ages and modern times : it is a typical early stage of modern age.’ মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিচ্ছেদ ঘটে রেনেসাঁসের যুগে এবং সেইদিক থেকে রেনেসাঁসকে আধুনিক যুগের প্রথম উদয়পর্ব বলা যায়। যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রার পথে কখনো অতীত যুগের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামাজিক সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ ঘটে না, বিচ্ছেদের শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে—সমাজের মূল গঠনবিন্যাসের পরিবর্তনের ফলে। এই মূল গঠনবিন্যাস অর্থনৈতিক, যার ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সমাজের গোষ্ঠীবিন্যাস ও শ্রেণিবিন্যাস গড়ে ওঠে এবং তার উপর ভিত্তি করে সমাজের ধ্যানধারণা ভালোমন্দ বিচারবোধ সব কিছুর বিকাশ হয়। মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি যদি বিশেষ পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেই পুরাতন ভিত্তির উপরে গঠিত সামাজিক সংস্থা বা ইনস্টিটিউশনগুলির অথবা সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণাগুলির স্থায়ী পরিবর্তন হয় না, বহিরাগত ভাবসংঘাতের ফলে একটি সঞ্চরণশীল পরিবর্তন হতে পারে মাত্র। এইদিক থেকে বিচার করলে, typologically উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক আলোড়নকে ‘রেনেসাঁস’ বললে ভুল হয় না, কিন্তু বৈদেশিক শাসনাধীনে সংঘটিত এই জারজ রেনেসাঁস—এর সঙ্গে পাশ্চাত্য রেনেসাঁস—এর প্রকৃতিগত বৈসাদৃশ্য তো আছেই, উপরন্তু তার বাস্তব পশ্চাদভূমি না—থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত তার সামাজিক ফলাফলও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষময় হয়েছে। ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের ঐতিহাসিক লক্ষণগুলি বিচার করে বাংলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে আমরা তার অসংগতি ও অসম্পূর্ণতা আরও ভালো করে বুঝতে পারব।

মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের যে সামাজিক ‘breach’ বা বিচ্ছেদ রেনেসাঁসের অন্যতম ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য বলে আগে উল্লেখ করেছি, তার প্রথম প্রকাশ হবে সামাজিক অঙ্গবিন্যাসের (social structure—এর) পরিবর্তনে। মধ্যযুগের সমাজ ছিল একটা ‘rigidly graduated system’ এবং সেই কঠোর প্রায়—অচল স্তরবিন্যস্ত সমাজের চেহারা ছিল পিরামিডের মতো, অপরিবর্তনীয়—‘pyramid of Estates’—এর পাশে অচল—অনড় ‘pyramid of values’। অর্থাৎ স্থাবর ধনসম্পত্তির পিরামিডের পাশে স্থাবর ভালোমন্দ বোধ ও অটল ধ্যানধারণার পিরামিড—যেমন ‘base’ বা বনিয়াদ, তেমনি তার উপরের ‘superstructure’ বা সৌধ। ধনতন্ত্রের উন্মেষপর্বে, রেনেসাঁসের যুগে, এই পিরামিডে আঘাত হানল প্রথমত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতি, দ্বিতীয়ত নবযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যমান সচল ‘টাকা’ (money)। আঘাতের ফলে মধ্যযুগের সামাজিক পিরামিডে ভাঙন ধরল, অচল স্তরিত সামজের ভিতর দেখা গেল নতুন এক সচল স্তরায়ণ (flexible social stratification) আরম্ভ হয়েছে সমাজে। সমাজের মানুষকে স্তরিত করার শক্তি হল অবাধ প্রতিযোগিতায় অর্জিত টাকার। টাকা সচল গতিশীল, কাজেই সামাজিক স্তরগুলিও, গতিশীল, rigid বা অচল নয়। আগে সমাজে কোনও ঊর্ধ্বাধঃ গতি (vertical mobility) ছিল না, এখন সেই গতি সঞ্চারিত হল অবাধগতি টাকার দৌলতে এবং টাকা সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যমানে পরিণত হওয়ার ফলে—সামাজিক মর্যাদার মান, প্রভাব—প্রতিপত্তির মান। ইতালীয় রেনেসাঁসের কালে সমাজের এই গতিশীলতা দেখে আক্ষেপ করে Aeneas Sylvius বলেছিলেন : ‘Italy… has lost all stability… a servant may easily become a King’ এবং Lujo Brentano দুঃখ করে বলেছিলেন যে টাকার জোরে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য অত্যধিক বাড়ছে। শুধু তা—ই নয়, তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দেখে যে ‘Cash payments are now the tie between people’ ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে কার্ল মার্কস ‘cash nexus’ বলেছিলেন, তার প্রায় চারশো বছর আগে ব্রেনতানো এবং আরও অনেকে সেই ‘cash tie’—এর চেহারা দেখে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

বাণিজ্যের স্বাধীনতা ও টাকার সচলতার দিক থেকে বিচার করলে ব্রিটিশ আমলে বাংলা দেশে, প্রধানত নতুন মহানগর কলকাতা কেন্দ্রে, আঠারো শতক থেকে এই ধরনের পরিবেশ রচিত হয়েছিল। কলকাতা শহরে যে নতুন নাগরিক অভিজাত ধনিকগোষ্ঠী (urban aristocracy) গড়ে উঠেছিল, তার পরিবার—প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অধিকাংশেরই টাকার ধান্দায় নগরে আগমন এবং যে—কোনও কৌশলে যে—কোনও গম্য—অগম্য পথে—বিপথে—কুপথে টাকার সন্ধানে বেপরোয়া অভিযান আঠারো শতকের বিভিন্ন পর্বে আরম্ভ হয়েছিল। বাণিজ্যের স্বাধীনতা ছিল ইংরেজদের, এ দেশীয় বা বাঙালিদের সম্পূর্ণ নয়। করিতকর্মা বাঙালিদের স্বাধীনতা ছিল ইংরেজদের অধীনে ও সাহচর্যে যে—কোনও কর্মে নিযুক্ত হবার, অবশ্য কোনও আধ্যাত্মিক কর্মে নয়, অর্থকরী কর্মে। আর—একটি স্বাধীনতাও তাঁরা এই সময় প্রদর্শন করেছিলেন, সেটি হল মধ্যযুগীয় কুলবৃত্তিগত বন্ধন ছিন্ন করে যে—কোনও অর্থকরী কর্ম করার স্বাধীনতা। ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ বণিকদের মধ্যে অনেকেই কুলবৃত্তি ও কুলমর্যাদা ত্যাগ করে, নতুন টাকার মর্যাদায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ইতালির সমাজ প্রসঙ্গে সিলভিয়াসের কথার—‘servants may easily become a King’—প্রায় প্রতিধ্বনি করেছেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে :

ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার কর্মকার চর্মকার চটকার মঠকার বেতনোপভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের খাটের ঘাটের মঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচুরি পোদ্দারী করিয়া অথবা অগম্যাগমন মিথ্যাবচন পরকীয় রমণী সংগঠনকামী ভাঁড়ামি রাস্তাবন্ধ দাস্য দৌত্য গীতবাদ্যতৎপর হইয়া কিম্বা পৌরোহিত্য ভিক্ষাপত্র গুরুশিষ্যভাবে কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন…অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন।

ভবানীচরণ অর্থনীতিবিদ না হলেও এখানে একটি বিরামচিহ্নহীন বাক্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আঠারো শতক ও উনিশ শতকের প্রায় প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের মর্ম প্রকাশ করেছেন। ভবানীচরণের কথা যে কতখানি সত্য তা কলকাতার প্রাচীন ধনিক পরিবারগুলির আদিপুরুষদের কর্মজীবনের কাহিনি বিচার করলে বোঝা যায়। আঠারো শতকে কলকাতার বহিরাঙ্গিক বিন্যাস অনেকটা মধ্যযুগীয় নগর ও গণ্ডগ্রামের মতো ছিল—বিভিন্ন কুলবৃত্তিজীবীদের বাস ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিক পুরোনো নামগুলি থেকে তা বোঝা যায়, যেমন কুমোরটুলি কলুটোলা জেলিয়াটোলা ডোমটুলি গোয়ালটুলি পটুয়াটোলা শাঁখারিটোলা ইত্যাদি। এই মধ্যযুগীয় নাগরিক পরিবেশে শোভাবাজারের দেব পরিবার, সিমলের দে—সরকার পরিবার, জোড়াসাঁকো পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার, মল্লিক পরিবার এবং আরও অনেক প্রাচীন ব্রাহ্মণ—কায়স্থ—বণিক পরিবার, যাঁরা সে সময় কলকাতার নতুন ধনিকসমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির ধারক—বাহক হয়ে আবির্ভূূত হয়েছিলেন। কবিগান তরজাগান আখড়াইগান পাঁচালি কথকতা ইত্যাদির সঙ্গে ঘোড়দৌড়, বুলবুলির লড়াই, পোষা বাঁদরের বিয়ে, মাতৃ—পিতৃশ্রাদ্ধ, পুত্রকন্যার বিবাহ, সাহেবদের খানাপিনা, গঙ্গার ঘাটনির্মাণ, দেবালয় নির্মাণ, তীর্থস্থানে ধর্মশালা নির্মাণ প্রভৃতির কল্যাণে বাঙালি Comprador—শ্রেণির নব্যধনিকরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। আঠারো শতকের মাত্র দশ—বারোজন কলকাতার বিখ্যত বাঙালি ধনিক পরিবারের চিত্র ভোগবিলাসের (যাকে conspicuous consumption বলা হয়) ব্যয়ের পরিমাণ যদি হিসেব করা যায়, তাহলে মোট অঙ্ক অন্তত কয়েক কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এই মূলধন জমা করা থাকলে উনিশ শতকে এই সমস্ত পরিবারের বংশধররা স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যক্ষেত্রে উদযোগী হয়ে অন্তত কিছুটা অগ্রসর হতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি।

তার উপর আঠারো শতকের শেষে, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে যখন নতুন জমিদারশ্রেণিতে রূপান্তরিত হবার পথ নব্যধনিকদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন তাঁরা ভোগবিলাসের পর উদবৃত্ত টাকা প্রধানত জমিদারি কিনতে ব্যয় করেন। কার্ল মার্কস তাঁর Notes on Indian History গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল প্রসঙ্গে লিখেছেন : ‘greater part of the province’s landholdings fell rapidly into the hands of a few city-capitalists who had spare capital and readily invested it in land.’ স্বাধীন শিল্প—বাণিজ্যক্ষেত্রে যাঁরা কিছুটা সেই সময় উদযোগী হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামদুলাল দে ও দ্বারকানাথ ঠাকুর, কিন্তু উভয়েই শেষ পর্যন্ত বিশাল স্থাবর সম্পত্তির মালিকে পরিণত হন। শহর থেকে উপার্জিত অর্থে আরও কতজন যে খুদে—মাঝারি জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীতে পরিণত হয়েছিলেন তার ঠিক নেই। ১৮৭২—৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারির সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লক্ষের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারির সংখ্যা পাঁচশোর কিছু বেশি, বিশ হাজার থেকে পাঁচশো একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারি প্রায় ষোলো হাজার, এবং পাঁচশো একর ও তার কম ছোট জমিদারির সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার—পত্তনিদার—জোতদারদের গোমস্তা নায়েব তহশিলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যদের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে উনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজে কমপক্ষে সাত—আট লক্ষ লোকের এমন একটি ‘শ্রেণি’ (সামাজিক ‘স্তরায়ন’) তৈরি হয়েছে, যে শ্রেণি ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভস্বরূপ। অবশ্য সামাজিক শ্রেণি হিসেবে বলতে গেলে ‘একটি’ শ্রেণি বলা যায় না, দুটি শ্রেণি বলতে হয়—একটি নতুন জমিদারশ্রেণি, আর—একটি নতুন মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণি। নামে দুই শ্রেণি হলেও, কাজ ও স্বার্থের দিক থেকে এদের চিন্তাভাবনা ও আচরণ একশ্রেণির মতো।

এর পাশে নাগরিক সমাজে, যেমন কলকাতা শহরে, ব্রিটিশ শাসকরা তাঁদের বিশ্বাসভাজন আরও দুটি শ্রেণি তৈরি করেছিলেন—একটি নতুন নাগরিক ধনিকশ্রেণি, আর—একটি নতুন নাগরিক মধ্যশ্রেণি। এই মধ্যশ্রেণির মধ্যে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার, দালাল প্রভৃতির সংখ্যা অনেক, বাকি নানা রকমের চাকরিজীবী। নাগরিক মধ্যশ্রেণির একটি বিশেষ স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজি শিক্ষিত এলিটশ্রেণি। ব্রিটিশ আমলে বাঙালি সমাজের এই নতুন শ্রেণিরূপায়ণ নিশ্চয় একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং আগেকার পিরামিডের মতো স্তরিত সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। আগে বলেছি, নবযুগের নতুন শ্রেণিবিন্যাস অচল নয়, সচল ঊর্ধ্বাধঃ গতিশীল, এবং সেই গতির প্রধান চালিকাশক্তি ‘টাকা’। টাকা সচল, শ্রেণিও তার ছন্দে সচল। বাঙালি সমাজে আঠারো—উনিশ শতকে এ সত্যও নির্মম বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার জন্যই কি তাকে ‘রেনেসাঁস’ বলা যায়? বিশেষ করে যে সমাজে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, আধুনিক ধনতন্ত্রের ‘typical early stage’—এর কোনও আভাস পাওয়া যায় না? বিশেষ করে শ্রমশিল্পের বিস্তারে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা—আবিষ্কারের অগ্রগতিতে? যে সমাজে কোনও ‘entrepreneur’—এর সুদূর পদধ্বনিও শোনা যায় না অর্থনীতিক্ষেত্রে? কেবল টাকার ধান্দা, টাকা সম্পর্কে মুনাফালোভী মনোভাব যদি typical early stage of capitalism হয় (অবশ্য এটা capitalist mentality নিশ্চয়) তাহলে বাংলা দেশে উনিশ শতকে নিশ্চয় তার বিকাশ হয়েছিল বলতে হয়, এবং সেটা যে রেনেসাঁসের যুগের একটা ঐতিহাসিক লক্ষণ তা—ও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমরা জানি প্রকৃত ‘রেনেসাঁস’ তা নয়।

আরও আশ্চর্য হতে হয় এই কথা ভেবে যে ইয়োরোপীয় ‘রেনেসাঁস’—এর ঐতিহাসিক পথে আমাদের দেশে প্রকৃত নবজাগরণের যাঁরা অগ্রদূত হতে পারতেন, ব্রিটিশ আমলের নতুন সামাজিক প্রতিবেশে সেই বাঙালি বণিকশ্রেণি (merchants) আদৌ সচল ও সজাগ হলেন না। কেন হলেন না, সেপ্রশ্নের উত্তর দেওয়ার একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে বাংলার, তথা ভারতের সমাজেতিহাসের অনুসন্ধানীদের। দুঃখের বিষয়, গতানুগতিক ইতিহাসের পাতায় বহুজনচর্বিত পর্বতপ্রমাণ তথ্যস্তূপের মধ্যেও এরকম কোনও প্রশ্নেরই আভাস পাওয়া যায় না, উত্তর তো দূরের কথা। প্রাচীন হিন্দু যুগ থেকে মধ্যযুগ ও আধুনিক ব্রিটিশ শাসনের যুগ পর্যন্ত বাংলা দেশের (এবং ভারতবর্ষের) বণিকজাতি বংশধর পরম্পরায় দেশ—বিদেশে বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। মনসামঙ্গল প্রভৃতি মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে বাঙালি বণিকদের সমৃদ্ধির বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ধনপতি সদাগর আমি বসি হে উজনী, গন্ধবণিক জাত বিদিত অবনী’। ধনপতি সদাগরের পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে ‘সাত শত বেনে আইসে ধনপতি ধাম’—তাঁদের মধ্যে চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরও ছিলেন। এরকম আরও অনেক বিবরণ থেকে বাংলাদেশের গন্ধবণিক তাম্বূলীবণিক সুবর্ণবণিক প্রভৃতি বণিকজাতির বাণিজ্যলব্ধ ধনৈশ্বর্যের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে এ কথা অন্তত ভাবা যেতে পারে যে এ দেশে Mercantile Capitalism—এর বিকাশ স্বচ্ছন্দে হতে পারত এবং তার ক্রমিক পরিণতি, ঐতিহাসিক অবস্থার আনুকূল্যে, ইউরোপের মতো Industrial Capitalism-এ হওয়াও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তা হল না কেন? তা ছাড়া, যে ভারতবর্ষে প্রাচীন হিন্দু যুগ থেকে বিজ্ঞান (Science) অনুশীলনের (গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন প্রভৃতি) ধারা বেশ পরিস্ফুট ছিল (মধ্যযুগে অবশ্য শীর্ণ হয়েছিল), সেই দেশে সর্বত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেল কেন, তা—ও ভাবা দরকার। যদি ‘মার্কান্টাইল ক্যাপিটালিজম’—এর স্বাভাবিক বিকাশ হত এ দেশে এবং তার পরিণতি হত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম’—এ তাহলে বিজ্ঞান অনুশীলনের ধারা অনেক বেশি পরিপুষ্ট হত এবং তার প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হত না। তা যদি হত, তাহলে ইউরোপের মতো কি আমাদের দেশেও ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের সামাজিক সাংস্কৃতিক লক্ষণ স্বভাবতঃই দেখা দিত না? উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ প্রসঙ্গে এরকম কতকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনও চেষ্টাই আজ পর্যন্ত হয়নি এবং তা না—হবার ফলে নবজাগরণ বিষয়ে সমস্ত আলোচনা ও গবেষণা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলতে হয়। আমরা শুধু গতানুগতিক ইতিহাসচর্চার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বাইরের খোলটির গায়ে আঁচড় কেটেছি, অনেক হিজিবিজি আঁচড়, কিন্তু ভিতরের বস্তুটিকে সন্ধান করিনি। বাস্তব সমাজ, বাস্তব জীবনের কথা ভুলে গিয়ে আমরা শুধু দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের মানসলোকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান দর্শনের বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়ার বিচার—বিশ্লেষণ করেছি, অথচ দেশের বাকি পঁচানব্বুইজন মানুষের মনের সুদূর প্রান্তে পর্যন্ত তার কোনও স্পর্শ লাগল কি না, অথব আদৌ লাগতে পারে এরকম কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি না, সে বিষয় চিন্তা করার অবকাশ পাইনি।

আমাদের প্রশ্ন, কেন এ দেশের বণিকশ্রেণি আধুনিক ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার বিকাশে সহায় হলেন না, কেন ধনপতি সদাগররা এ যুগের কোটিপতি ক্যাপিটালিস্ট হতে পারলেন না? এ প্রশ্নের সদুত্তরের জন্য নতুন দৃষ্টিতে পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যানুশীলন প্রয়োজন। আপাতত আমাদের মনে হয়, বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজে, বিশেষ করে বাঙালি সমাজে বণিকশ্রেণির প্রতি সামাজিক উপেক্ষা ও অবজ্ঞাই হল এই স্বাভাবিক ঐতিহাসিক গতি ব্যাহত হবার অন্যতম কারণ। এদিক থেকে চীনের সমাজের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় সমাজের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। জোসেফ নিডহাম চৈনিক সমাজের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন—‘The despising of the merchant was a very old characteristic in Chinese thought…’ আমাদের দেশেও এ কথা সত্য। কিন্তু চৈনিক সমাজে জাতিবর্ণভেদ (caste) বলে কিছু ছিল না, বর্ণবৈষম্য ভারতীয় বৈশিষ্ট্য। এই বর্ণবৈষম্যজনিত সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা আমাদের দেশে বণিকশ্রেণিকে শক্তিশালী আধুনিক পুঁজিপতি শ্রেণিতে পরিণত হতে দেয়নি, উদ্যম উদযোগ ও অর্থনৈতিক অভিযানের দুঃসাহসিক পথ থেকে তাদের উৎখাত করেছে। যে কর্ম ও কৃতিত্বের জন্য কোনও সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লভ্য নয়, তা করার জন্য কোনও প্রেরণা এ দেশের বণিকরা পাননি। কাজেই এ দেশের বাণিজ্যলব্ধ মূলধনের ঐতিহাসিক বিকাশ হয়নি আধুনিক শিল্পগত মূলধনে, এবং তা না—হওয়ার ফলে যেমন বিজ্ঞানচর্চার ধারাবাহিক অবনতি হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থার দীর্ঘস্থিতি ও গতানুগতিকতা এ দেশের মানুষকে কর্মবিমুখ ও আলস্যের উপাসক করেছে, এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছে ধর্মচর্চার চূড়ান্ত বিকৃতিতে, নৈষ্কর্ম্যের সাধনায়।

ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের দেশের পুরাতন সমাজব্যবস্থা অনেক কিছু ওলটপালট করেছেন বটে, কিন্তু তার মূল গড়নটিকে অর্থাৎ বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিকে একেবাবেই আঘাত করতে পারেননি। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্যরা টাকার ধান্দায় খানিকটা ব্যাবসাবাণিজ্যের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের কাছেও বাণিজ্যলব্ধ টাকার আকর্ষণের চাইতে শিক্ষা ও চাকুরিলব্ধ টাকার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি, সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে। আর তার চাইতেও বড় সত্য হল, বাঙালি বণিকরা (গন্ধবণিক, তাম্বূলীবণিক প্রভৃতি) ব্রিটিশ আমলে কেউ আধুনিক শিল্পপতি হবার জন্য উদযোগী হলেন না, তাঁদের বংশগত বাণিজ্যের গণ্ডির মধ্যে বন্দি হয়ে রইলেন। এমনকী ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হবার পরেও আজও তাঁদের মধ্যে সেরকম কোনও উদ্যোগের লক্ষণ দেখা যায় না, তার কারণ সমাজের মূল বর্ণভিত্তিক গড়ন আজও অটুট আছে, বদলায়নি এবং সেই সমাজবিন্যাসে বণিকরা নিম্নস্তরের উপেক্ষার পাত্র হয়ে আছেন।

এ কথা সহজ সত্য যে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আমাদের দেশে ধনতান্ত্রিক বিকাশের পথ আদৌ সহজগম্য ছিল না এবং পদে পদে তার বাধা ছিল অনেক। কিন্তু বাংলার অর্থনীতিক্ষেত্রে, অন্তত শিল্প—বাণিজ্যের মধ্যবর্তী স্তরে যেটুকু সক্রিয় হওয়ার সুযোগ ছিল, যথেষ্ট মূলধন সঞ্চয় করা সত্ত্বেও বাঙালিরা তা হননি, নিষ্ক্রিয়তার প্রতিমূর্তিরূপে গ্রামের জমিদারি, শহরের গৃহসম্পত্তি, কোম্পানির কাগজ, স্বর্ণপিণ্ড ইত্যাদিতে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ আয়ের সুযোগ খুঁজেছেন, আর যাঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত মধ্যশ্রেণি, তাঁরা চাকরি, বিশেষ করে সরকারি চাকরিকেই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেছেন। ছেলে দারোগা হোক, ডেপুটি হোক, সরকারি কেরানি হোক, নিদেনপক্ষে জমিদারের গোমস্তা বা নায়েব হোক, এই ছিল বাঙালি মায়েদের প্রার্থনা দেবতার কাছে, এবং বিবাহের বাজারে এইসব পাত্রের মূল্য ছিল অত্যধিক, যেমন বর্তমানে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামক জীবদের। পরিবার থেকে সমাজ পর্যন্ত এমনই একটা পরিবেশ রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যে বাঙালি মন ‘achievement-oriented’ বা ব্যক্তিকৃতিমুখী হয়ে গড়ে উঠবার সুযোগ পায়নি তার মধ্যে, ‘slavery-oriented’ বা দাসত্বভাবাপন্ন হয়ে গড়ে উঠেছে। এই দাসত্বপ্রবণ দারোগা—কেরানি—গোমস্তানির্ভর, গ্রাম্য নব্য জমিদার—পত্তনিদার ও নাগরিক নব্যধনিক খুদে ব্যবসায়ী—মুখাপেক্ষী যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ, দেশের বড়জোর শতকরা দশজনের গণ্ডি পর্যন্ত যার আলোক বিচ্ছুরিত, বাকি নব্বুইজনের সুবিস্তীর্ণ রাজ্যে শুধু অজ্ঞান ও সুপ্তির ঘোর অন্ধকার, সেই নবজাগরণের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে মনে হয়।

ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকের মধ্যেই আমাদের দেশে রেলপথ, পোস্ট আফিস, টেলিগ্রাফ, পাটকল, কাপড়ের কল এবং অন্যান্য কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে, তার জন্য যথেষ্ট মূলধন, উদ্যম ও সুদক্ষ কারিগরির প্রয়োজন হয়েছে, কিন্তু বিদেশির শাসন—শোষণাধীনে থাকার ফলে স্বভাবতই সেগুলি enclave-এর (আংক্লাভ) রূপ নিয়েছে যে ‘আংক্লাভ’গুলি ‘cut out and isolated from the surrounding economy, but tied to the economy of the home country.’ গুনার মিরডাল তাঁর Economic Theory and Underdeveloped Regions গ্রন্থে এবং পরবর্তী Asian Drama গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। মিরডাল নতুন কথা কিছু বলেননি, বৈজ্ঞানিক, অর্থনীতিবিদ, বিশেষ করে মার্কসবাদীরা, এ কথা অনেক আগেই বলেছেন। রেলওয়ে, তৎসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ারিং—শিল্প, পাটকল, প্ল্যান্টেশন সবই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো গড়ে উঠেছে এ দেশে, পরিপার্শ্বের দেশীয় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন, বিদেশি শাসকদের নিজেদের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমাদের দেশের, অন্তত বাংলা দেশের surrounding economy-র সামন্ততান্ত্রিক রূপের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, বরং ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থে নবরূপে তাকে রূপায়িত করা হয়েছিল। পরিপার্শ্বের এই সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন যে নতুন অর্থনীতির বিকাশ বাংলা দেশে হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ ইংল্যান্ডের দেশীয় অর্থনীতির স্বার্থে, মূলধন উদ্যম কারিগরি সবই প্রায় ইংল্যান্ডের। আমাদের দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল ‘plentiful labour supply and low wages’—এর দিক থেকে, অর্থাৎ যথাসম্ভব অল্প মজুরিতে প্রচুর পরিমাণে মজুর সরবরাহের দিক থেকে। তা—ই আমরা করেছি, মূলধন উদ্যম কারিগরি—কুশলতা কিছুই নিজেরা তেমন নিয়োগ বা প্রয়োগ করতে পারিনি।

ব্রিটিশের প্রধান লক্ষ্য ছিল, নিরাপদ—নিশ্চিন্ত শাসন—শোষণের উদ্দেশ্যে এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতি (social stability) যে—কোনও উপায়ে বজায় রাখা। ‘সামাজিক স্থিতি’ কথাটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশের সমাজের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তিতে অথবা সামাজিক অঙ্গবিন্যাসে এমন কোনও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটাতে চাননি, যাতে সামাজিক স্থিতি নষ্ট হতে পারে। আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের অভ্যুদয় হলে যে সামাজিক সচলতা ও পরিবর্তনের সূচনা হত, তার মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নির্বিঘ্নে শোষণ—শাসনের সুবিধা হত না। দেশি—বিদেশি লুণ্ঠনস্বার্থে সংঘাত হত। কাজেই তাঁদের কোনও স্বার্থ ছিল না রেনেসাঁসের অর্থনৈতিক ভিত্তি এ দেশে গড়ে তোলার। তাঁরা এমনভাবে সমাজের শ্রেণিবিন্যাসটিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যাতে তার অতীতের সামন্ততান্ত্রিক বনেদটি মূলত বজায় থাকে। যেমন আমরা আগে বলেছি—গ্রাম্য সমাজে নতুন জমিদারশ্রেণি, বৃহৎ একটি জমিদারিনির্ভর মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণি, এবং নাগরিক সমাজে নতুন অর্বাচীন অভিজাত—ধনিকশ্রেণি, খুদেব্যবসায়ী দোকানদার চাকরিজীবী প্রভৃতিদের নিয়ে বড় একটি নাগরিক মধ্যশ্রেণি এবং তার মধ্যে সোনার চাঁদের মতো একদল ইংরেজি শিক্ষিত ‘elite’। সাম্রাজ্যবাদীর অধীন দেশে, যেমন আমাদের বাংলাদেশে, এই শিক্ষিত ‘এলিট’ গোষ্ঠী সম্বন্ধে জ্যঁ পল সার্ত্র যে উক্তি করেছেন তা নির্মম হলেও সত্য :

‘The European elite undertook to manufacture a native elite. They picked out promising adolescents : they branded them, as with a redhot iron, with the principles of western culture; they stuffed their mouths full with high sounding phrases, grand glutinous words that stuck to the teeth…These walking lies had nothing left to say to their brothers they only echoed.’ (Preface, Fanon Franty: The Wretched of the Earth).

বাংলা দেশের পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষিত ‘এলিট’ প্রসঙ্গেও সার্ত্রর এই উক্তি প্রযোজ্য। পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে এই এলিটের কথা আসবে।

যে ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গড়নের পরিবর্তন ব্রিটিশ আমলে দেখা গেল, তাতে সমাজের যে ‘institutional power-structures’, যেমন আমাদের জাতিবর্ণভেদ, ধর্মসম্প্রদায়ের বৈষম্য ইত্যাদি—তার কোনও উন্নতিশীল পরিবর্তন কিছু হল না । যে—কোনও সমাজের স্থায়িত্ব ও শক্তির প্রধান উৎস হল institutions এবং আমাদের দেশের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের power-structure যে সমস্ত ইনস্টিটিউশনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তার মধ্যে অন্যতম হল যৌথ পরিবার (joint family), জাতিভেদপ্রথা (caste system), বিবাহপ্রথা, ধর্ম ইত্যাদি। উনিশ শতকের সমাজসংস্কারকদের যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (গাছের গোড়ায় জল দিয়ে ডাল কাটার মতো) এবং সংস্কার আন্দোলন মধ্যে মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, শেষ পর্যন্ত পূর্বোক্ত কোনও সামাজিক ইনস্টিটিউশনের পরিবর্তন হয়নি, এমনকী উনিশ শতকের শেষ পর্বে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের সদলবলে ও সশব্দে বাংলার নবজাগরণের রঙ্গমঞ্চ দখল করা থেকে বোঝা যায় যে এগুলির দৃঢ় ভিত্তিতে কোনও আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি। লাগবার কথা নয়, কারণ মূল অর্থনৈতিক গড়নের পরিবর্তন ছাড়া সমাজের institutional power structure—এর কোনও পরিবর্তন হতে পারে না, বাংলা দেশেও সেই কারণে হয়নি। এবং তা হয়নি বলেই বাংলা দেশের রেনেসাঁস—আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অনেক বাষ্প বিদ্যুৎ ও বুদবুদ উদগার করে কোনওরকমে নিবু—নিবু সলতেটি জ্বালিয়ে রেখেছিল মাত্র। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অনেকাংশে ব্যর্থতা ও ট্র্যাজিক পরিণতি, অসংগতি ও অসম্পূর্ণতার এইটাই প্রধান কারণ বলে মনে হয়। জাতিভেদপ্রথা, ধর্মসম্প্রদায়—বৈষম্য ইত্যাদি ‘hardened institutions of inequality’ যেমন দেশের ভিতরের উন্নত ভাবাদর্শের সম্প্রসারণে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি উন্নত ও অগ্রগামী দেশ থেকে আগত কোনও উন্নতিশীল শক্তির বিস্তারকেও সংকুচিত করতে পারে। ‘If they hamper the spread effects within those countries, they inhibit at the same time, the spread of expansionary momentum form the advanced countries abroad’ (Myrdal). এই কারণে মধ্যযুগে যেমন রামানন্দ কবীর দাদূ নানক নামদেব প্রমুখ সাধক—সংস্কারকদের জাতিবৈষম্য ও ধর্মভেদের বিরুদ্ধে সমস্ত আবেদন—আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে, অর্থাৎ তাঁদের ভাবাদর্শের কোনও প্রসার হয়নি, তেমনি উনিশ শতকে বাংলা দেশে রামমোহন বিদ্যাসাগর ইয়াং বেঙ্গল দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ সংস্কারকদের পাশ্চাত্য ভাবসংঘাতজাত উন্নতিশীল সংস্কার—আদর্শের বিস্তারও অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। নতুন ভাবাদর্শের ‘spread effect’ যেমন ব্যাহত হয়ছে, তেমনি উনিশ শতকে পাশ্চাত্ত্য ভাবসংঘাতের ‘expansionary momentum’—ও ‘inhibited’ হয়েছে, পুরাতন institutional power structure—এর প্রতিঘাতে। তাই দেখা যায়, বাংলার নবজাগরণ মূলত নগরকেন্দ্রিক পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষিত মুষ্টিমেয় এলিটের মস্তিষ্কের আন্দোলন, দেশের মানুষের আন্দোলন নয়। আমাদের দেশের মতো ঐতিহ্যানুগামী সমাজে (tradition-bound society) পুরাতন সামাজিক ইনস্টিটিউশনের শক্তি যে কত সংহত ও সুদৃঢ়, তা ব্রিটিশ শাসনমুক্তির প্রায় পঁচিশ বছর পরেও, আধুনিক যন্ত্রোন্নত শিল্পায়নের সামাজিক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও, আজও আমরা ধর্মবৈষম্য—জাতিভেদ প্রভৃতির সদম্ভ আত্মপ্রকাশে বুঝতে পারছি। কাজেই উনিশ শতকে এই সমস্ত ইনস্টিটিউশনের লৌহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে বাংলার নবজাগরণের আদর্শ কীভাবে খণ্ডিত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

অনুমান না করে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। ‘ধর্ম’ যখন সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন, বিশেষ করে আমাদের মতো ঐতিহ্যমুখী (‘tradition- oriented’) সমাজে তখন ধর্মসংস্কারের কথাই প্রথম বলি। অজস্র ধর্মীয় কুসংস্কার, আচার—বিচার, বাহ্য অনুষ্ঠান, পৌত্তলিকতা ও বহুদেবতাবাদ, হিন্দুধর্ম, হিন্দুসমাজ মানসলোক আচ্ছন্ন করে ফেলেছে দেখে রামমোহন গভীর বেদনাবোধ করেছিলেন এবং পাশাপাশি খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারও মিশনারিদের মধ্যে লক্ষ করেছিলেন। হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজের সংকট তিনি তাঁর দূরদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন বলেই প্রাচীন উপনিষদ ও তন্ত্রশাস্ত্র থেকে বাহ্যানুষ্ঠানবর্জিত একেশ্বর ব্রহ্মের উপাসনা প্রবর্তন ও প্রচার করে এই কথাই বলতে বা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন যে হিন্দুধর্মের উৎসমুখে সন্ধান করলে সেখানেও সহজ সরল অকৃত্রিম একদেবতা নিরাকার ব্রহ্মের স্বরূপ ছাড়া অন্য কিছু উপলব্ধি করা যায় না। তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ স্থাপন করেছিলেন হিন্দুধর্মের এই প্রকৃত রূপ, শুধু খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছে নয়, সমগ্র দেশবাসীর কাছে উদঘাটিত করার জন্য। যুগে যুগে ঐতিহাসিক সংকটকালে শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকদের পথই অনুগমন করেছিলেন রামমোহন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল—যদিও সেই ব্যর্থতা বিদেশে তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য তিনি নিজে বিশেষ অনুভব করেননি। দুটি কারণে ব্যর্থ হয়েছিল, প্রথম কারণ, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনাগৃহের ভিতরের স্থাপত্য থেকে আরম্ভ করে সাপ্তাহিক উপাসনা, উপাসনা—পদ্ধতি প্রভৃতি সব কিছুর উপর খ্রিস্টান গির্জা ও ধর্মের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। দেবদেবীর দেবালয় যে দেশের গ্রামে গ্রামে, গৃহে গৃহে যেখানে গৃহদেবতা অতিদরিদ্রের অতিসরল অনাড়ম্বর পদ্ধতিতে উপাস্য, সেখানে দেবতা ও তাঁর উপাসনার প্রতি এই ‘intellectual’ বা বুদ্ধিযুক্তিসর্বস্ব মনোভঙ্গি কখনোই সমাজে সাধারণ জনগ্রাহ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় কারণ, এরই অনুসিদ্ধান্ত—গজদন্তমিনার বা প্রাসাদশীর্ষ থেকে কেবল নিরপেক্ষ বুদ্ধি ও যুক্তির সুতীক্ষ্ম বাণ নিক্ষেপ করে, অথবা বিমূর্ত মানবতাবোধসম্ভূত হৃদয়াবেগের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে কোনও জনসমাজে কখনো ধর্মসংস্কার করা যায় না। তা যদি করা যেত তাহলে রাজপুত্র গৌতম বুদ্ধ থেকে কবীর দাদূ নানক শ্রীচৈতন্য সকলেই হিন্দুসমাজের ও হিন্দুধর্মের কাঠামো পালটে ফেলতে পারতেন। তা যদি করা যেত, তাহলে বিংশ শতাব্দীর প্রায় চতুর্থ পাদে পৌঁছেও আমরা হিন্দুধর্মের এরকম মধ্যযুগীয় উৎকট স্বরূপপ্রকাশে স্তম্ভিত হতাম না।

রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ তাঁর ব্যক্তিত্বমুগ্ধ কয়েকজন সহগামীর সংকীর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নব্যধনিক জমিদার ও শহরের নতুন রাজা—মহারাজা। যেমন টাকির জমিদার, তেলিনিপাড়ার জমিদার, ভূকৈলাস—খিদিরপুরের রাজা প্রভৃতি। এঁদের পক্ষে ব্রহ্মোপসনার মর্ম বোঝা দূরে থাক, হিন্দুধর্ম ও সমাজের সংস্থানিক গঠনে আঘাত করা প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের শ্রেণিস্বার্থ ও স্থিতস্বার্থের বিরোধী ছিল। তাই রামমোহনের অনুপস্থিতিতে ও অবর্তমানে তাঁরা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে প্রায় গোঁড়া হিন্দু হয়ে ওঠেন। দ্বারকানাথের বদান্যতায় ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব বজায় থাকে বটে, কিন্তু তার আদর্শ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক দীক্ষার ব্যবস্থা করে এবং নিজে দীক্ষা নিয়ে ১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ‘ব্রাহ্মসমাজ’ থেকে ‘ব্রাহ্মধর্ম’—এর রূপ দেন। তিনি বলেন, ‘পূর্বে ব্রাহ্মসমাজ ছিল, এখন ব্রাহ্মধর্ম হইল।’ কিন্তু হিন্দুধর্মেরই বিশাল পরিধির মধ্যে যখন নতুন ‘ব্রাহ্মধর্ম’ হল তখন চিরাগত নীতি অনুযায়ী অন্যান্য বন্ধু উপাসক সম্প্রদায়ের মতো ব্রাহ্মণের আর—একটি সম্প্রদায়রূপে হিন্দুসমাজ ধীরে ধীরে নির্বিবাদে আত্মসাৎ করে নিল। তারপর শুধু অতিনির্দিষ্ট সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে ‘peaceful coexistence’ ছাড়া তার আর কিছুই করণীয় রইল না।

উনিশ শতকের ছয় ও সাতের দশকে, এ কথা ঠিক যে কেশবচন্দ্র সেন বলিষ্ঠ প্রগতিশীল আদর্শে—যেমন স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতি—ব্রাহ্মসমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন—কিন্তু যে বিস্তৃত চোরাবালির ভূমি আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, অবশেষে কেশবচন্দ্র নিজেই তাতে প্রোথিত হলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন ইনস্টিটিউশন গুরুবাদ অবতারবাদ তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এই সময় আদি ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনও ‘Brahmoism is Hinduism’ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং তার অন্যতম প্রবক্তা হন রাজনারায়ণ বসু। ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ ও নীতির এই করুণ পরিণতির পর উনিশ শতকের চতুর্থ পাদে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের বিজয় অভিযান স্বাভাবিক। প্রধানত শহরবাসী শিক্ষিত এলিটের ideological আন্দোলন—যার ‘spread effect’ ও ‘expansionary momentum’ প্রায় ছিল না বলা চলে, তা আতশবাজির মতো চমক সৃষ্টি করতে পারে—যেমন প্রায় বছর দশেকের জন্য উনিশ শতকের তিনের দশকে করেছিলেন ডিরোজিয়ান ইয়াং বেঙ্গল দল—কিন্তু তার স্থায়ী দান বিশেষ থাকে না। কতকগুলি প্রগতিশীল ‘values’ ও ‘ideas’—এর যে ‘সেডিমেন্ট’ বা তলানি পড়ে থাকে সমাজমনের উচ্চস্তরে, পরে নতুন অবস্থান্তরে নতুন নিরিখে তার পূনর্মূল্যায়ন হয়। যেমন বর্তমানে হচ্ছে। সে যা—ই হোক, উনিশ শতকের ধর্মসংস্কার প্রসঙ্গে আরও একটু বলা যায় যে এই যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরাও ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের প্রতিপাদ্য ছিল এই যে প্রাচীন হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সমাজ—রাষ্ট্রের মধ্যে আধুনিক যুগের সমস্ত প্রগতিশীল ভাবাদর্শ নিহিত আছে—সাম্য গণতন্ত্র স্ত্রীশিক্ষা স্বাধীনতা, পুরুষ—নারীর সামাজিক সমান অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি—তার জন্য নতুন কোনও আদর্শ বাইরে থেকে আমদানি করা অর্থহীন। উনিশ শতকের প্রথম পর্বের ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’—যাঁরা প্রাচীন সংস্কৃতবিদ্যা শিক্ষার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন—এবং শেষ পর্বের ‘রিভাইভালিস্ট’দের মনোভঙ্গি ও যুক্তির মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নেই। উভয়েরই বক্তব্য হল সবই প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে ও হিন্দুধর্মে আছে, গীতায় সাম্যবাদ পর্যন্ত। এইটাই হল সবচেয়ে মারাত্মক বিপজ্জনক চিন্তাধারা, যার প্রভাব থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের অনেক ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী, সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতা মুক্ত হতে পারেননি। আমাদের দেশের এই চিন্তাধারা ও ধারণা সম্বন্ধে মিরডাল তাঁর Asian Drama গ্রন্থে সুন্দর একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘this may be good tactics, but it is bad sociology’। বাস্তবিকই তা—ই। দেশের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনসমাজকে বিভ্রান্ত করার দিক থেকে এবং তাদের অসাড় নিস্পন্দ করে রাখার দিক থেকে এ কৌশল খুব ভালো কিন্তু সামাজিক বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে সনাতন হিন্দুধর্মের মতো একটি অটল ‘ইনস্টিটিউশন’ কতকগুলি সামাজিক ইনস্টিটিউশনের শক্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সব কয়টি হল জাতিভেদ বর্ণবৈষম্য গুরুবাদ প্রভৃতি সামাজিক অসাম্য এবং মূল অর্থনৈতিক অসাম্যের ‘hardened institutions of inequality’। কাজেই সবই যে বেদ—উপনিষদ—গীতায় আছে, সনাতন হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃত শাস্ত্রে আছে, এ কথা বলা ‘good tactics’, কিন্তু ‘bad sociology’, এই চিন্তাধারা আজও আমাদের সমাজে বেশ সক্রিয় থাকার ফলে এবং যন্ত্রোন্নয়ন—শিল্পোন্নয়নের সংঘাতে সামন্ততান্ত্রিক ভিত্তির শিথিলতার মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্য—বৈষম্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, বর্তমানে তাই দেখা যায় ধর্মের পুরাতন institutional power-structures যেন ক্রমে আরও শক্তিশালী হচ্ছে—গুরুবাদ পৌত্তলিকতা অবতারবাদ জাতিভেদ ধর্মানুষ্ঠান অত্যধিক মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে—বিশেষ করে বাংলা দেশের শহরে—নগরে ও তার উপকণ্ঠে। শুধু এই বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের একটি চমৎকার ক্ষেত্র হতে পারে, অত্যন্ত interesting—কেবল মধ্যবিত্তদের নানা রকমের নৈরাশ্য ও ব্যর্থতা বিচারের দিক থেকে নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাশ্চাত্যবিদ্যার পলেস্তারার উপর প্রাচীন ধর্মীয় ইনস্টিটিউশনের আঘাত লাগলে কীভাবে যে তা এখনও সহজে খসে যেতে পারে সেইদিক থেকে, এবং millenarianism বা স্বপ্নস্বর্গ কামনা ও পরিত্রাতা messiah—র প্রভাব যে মধ্যবিত্তের মানসস্তরের কত গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে, সেই বিষয় অনুশীলনের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম বিশেষ ঘটেনি। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন বোধহয় উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় সমাজসংস্কার আন্দোলন, যা শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রাম্য সমাজে পর্যন্ত খানিকটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, এবং বাংলা দেশ ছাড়িয়ে সর্বভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হবার পর উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মাত্র বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশই বিদ্যাসাগরের নিজের উদ্যম ও অর্থব্যয়ে অথবা তাঁর একান্ত ভক্তদের প্রচেষ্টায়। তা—ও দেখা গেছে, বিধবাবিবাহ যাঁরা করতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সাময়িক অর্থলোভে শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, কোনও আদর্শপ্রীতির জন্য বিবাহ করেননি। বিদ্যাসাগর নিজেও তা বুঝতে পেরে শেষজীবনে হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন। বিধবাবিবাহ হিন্দুসমাজ গ্রহণ তো করেইনি, শিক্ষিত উচ্চসমাজের যাঁরা আদর্শের দিক থেকে একদা তা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেননি। বিধবাবিবাহের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামাজিক প্রথা, যেমন নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা, যৌথ পরিবার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি—যেমন ছিল, ঠিক তেমনি রেখে শুধু প্রথা হিসেবে বিধবাবিবাহ সমাজে প্রচলিত হতে পারে না। আর যে প্রথাগুলির কথা উল্লেখ করলাম সেগুলিও সমাজের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তির আধুনিক রূপান্তর ছাড়া পরিবর্তিত হতে পারে না। তাই বিধবাবিবাহ ব্যর্থ হয়েছে, নারীর পরাধীনতা, যৌথ পরিবার সবই বজায় থেকেছে এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিবারণের জন্য শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই কোনও আইন পাশ করতে চাননি। বঙ্কিমচন্দ্রর মতো পাশ্চাত্যবিদ্যায় শিক্ষিতশ্রেষ্ঠও আইন প্রয়োগ করে এই ধরনের সমাজসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। শিক্ষিত বাঙালি এলিটের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয় গণ্য হতে পারেন এবং সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও শিক্ষিত এলিটের মন যে চিরায়ত সামাজিক প্রথা ও ইনস্টিটিউশনের কত দূর আবদ্ধ হয়ে ছিল, তা এই দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়।

ইয়োরোপিয়ান এলিটের আদর্শপুষ্ট হয়ে এ দেশের শিক্ষিত এলিট গড়ে উঠেছিল। এই আদর্শের বীজ থেকে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর থেকে গাছফল ফুল হবার মতো দেশের মানুষের মনের মাটি তৈরি হয়নি, তার কারণ তার উপযুক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ রচিত হয়নি। তার উপর এই শিক্ষিত এলিটশ্রেণির সামাজিক উৎপত্তি বাংলার নবজাগরণের প্রবাহকে কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে নিয়ন্ত্রিত করেছে। প্রধানত হিন্দুসমাজের উচ্চস্তর থেকে, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের ধনিক ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের স্তর থেকে আধুনিক বাঙালি এলিটের উদ্ভব হয়েছে। এককথায়, উনিশ শতকের বাঙালি এলিটকে উচ্চবর্ণের সংগতিপন্ন হিন্দু মধ্যবিত্ত ‘এলিট’ বলা যায়। তার ফলে এই এলিটগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন হিন্দুসমাজ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। প্রায় উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলা দেশে শিক্ষিত মুসলমান এলিটগোষ্ঠীর বিকাশ হয়নি বলা চলে। ব্রিটিশের ক্রমবর্ধমান প্রশাসনযন্ত্রের—নানা শ্রেণির চালক ও কর্মচারী সরবরাহের জন্য যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা হিন্দুরাই বেশি আয়ত্ত করেছিলেন বলে এই স্তরের চাকরিজীবীদের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। ধনিক ও মধ্যবিত্তের স্তরে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের বিচ্ছেদ তো হয়েছিলই, শিক্ষিত এলিটের স্তরেও হয়েছিল। এই কারণে বাংলাদেশে যে সামাজিক রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ট্র্যাজিডি ঘটেছে, তা—ও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। যদি ঐতিহাসিক সত্য বিকৃত না করে বাংলাদেশ থেকে আধুনিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত রচনা করতে হয় তাহলে তা মূলত হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এইভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজ উনিশ শতকের শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে, পরবর্তীকালে নতুন উদীয়মান বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত এলিটশ্রেণি স্বভাবতই অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে জাতীয় আন্দোলনের ধারার সঙ্গে একাত্মীয়তা স্থাপন করতে পারেননি। তার আগেই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সামাজিক দূরত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল খণ্ডিত বাংলা দেশ এবং খণ্ডিত ভারত।

উনিশ শতকের নবজাগরণের অনুপ্রেরণার মূলে যে প্রগতির ধ্যানধারণা—‘idea of progress’—সক্রিয় ছিল, তারই বা স্বরূপ কী? ফরাসি বিপ্লব ও ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, বাষ্পীয় শক্তি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ইলেকট্রিসিটি, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রচালিত শিল্পোৎপাদনের প্রসার ইত্যাদির জন্য যে বাস্তব সামাজিক পরিবেশ ইংল্যান্ডে গড়ে উঠেছিল, পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক দার্শনিক মনীষী ও শিল্পী—কবিদের প্রগতির চিন্তাধারায় তারই প্রতিফলন হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ‘material progress’—এর উপর ‘idea of progress’ রচিত হয়েছিল। তার চারিদিকে ছিল মানুষের দুঃসাহসিক অভিযান ও অগ্রগতি—অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে। যদিও এই উন্নতি ও প্রগতি প্রধান বর্ধিষ্ণু বুর্জোয়াশ্রেণি ও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য নির্ধারিত, তাহলেও তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। রেলপথ ও রেলগাড়ির গতির মতো প্রগতির ধারণাও হল সরল ও যান্ত্রিক। কবি টেনিসন যখন লিভারপুল থেকে ম্যাঞ্চেস্টারের রেলপথে প্রথম যাত্রা করেন, তখন ১৮৩০ সালে, তিনি লেখেন :

Let the great world spin forever down the ringing grooves of change.

১৮৫১ সালে লন্ডনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে বাস্তব অগ্রগতির নিদর্শন সকলকে দেখানো হয়েছিল। Edinburgh Review (October 1851) তখন প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য জানিয়ে লেখেন যে এই বিরাট মেলার লক্ষ্য হল ‘to seize the living scroll of human progress, inscribed with every successive conquest of man’s intellect.’ ইংল্যান্ডের বাস্তব পরিবেশ থেকে উদ্ভূত এই প্রগতির ধ্যানধারণা ইংরেজ শাসক ও এলিটগোষ্ঠী আমাদের দেশের এলিটগোষ্ঠীর মস্তিষ্কে রোপণ করেছিলেন, সম্পূর্ণ অবাস্তব পরিবেশে। ভৌগোলিক ও সামাজিক নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তার ফলে বাংলা দেশে কিছুটা আদর্শগত আলোড়ন হয়েছিল এবং যতটা হয়েছিল সেই অনুপাতে সামাজিক সুফল ফলেনি। পুরাতন মধ্যযুগীয় সামাজিক ইনস্টিটিউশনের লৌহপ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে প্রগতির ভাবধারা প্রতিক্রিয়ার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর প্রায় চতুর্থ পাদে পৌঁছেও আমরা তাই আজ বাংলার সমাজে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার বিচিত্র সহাবস্থান দেখতে পাই—ধর্মীয় গুরুবাদ থেকে রাজনৈতিক মার্কসবাদ, সর্বক্ষেত্রে। জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সেই উনিশ শতকীয় সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত মানস আজও আমাদের বুদ্ধি—চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাংলা দেশে তাই আজ অলিগলিতে, পাড়ায় পাড়ায় ধর্মীয় গুরু, Messiah ও অবতারের প্রাদুর্ভাব, প্রত্যেক মধ্যবিত্ত—নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অন্তত একজন করে তরুণ আধুনিক কবি ও কমিউনিস্টের আবির্ভাব, প্রত্যেক অঞ্চলে মহকুমায় ও থানায় একটি করে মার্কসবাদী ও সোশ্যালিস্ট দল—একজন ব্যক্তি বা ‘গুরু’কেন্দ্রিক—প্রত্যেক মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক মার্কসবাদী—শুধু বিশেষত্ব এই যে তিনি কমিউনিস্ট—বিরোধী, বিশেষ করে যে কমিউনিস্টরা বড্ড বেশি masses—এর মুখ চেয়ে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে এবং বিশিষ্ট সভ্য ভদ্রলোকের মতো পার্লিয়ামেন্টারি কায়দায় মার্কসবাদী আন্দোলনের কথা বলে না, আধুনিক শিক্ষায়তনের পাশাপাশি পেশাদার অ্যাস্ট্রলজারের চেম্বার, ভিড়ের চাপ দু—জায়গাতেই সমান, কোনওরকম লিখতে—পড়তে শিখেছেন এরকম বাঙালির মধ্যে অন্তত শতকরা কুড়িজন ‘ক্রিয়েটিভ’ সাহিত্যিক অর্থাৎ অরিজিন্যাল গল্প—উপন্যাস—কবিতা লেখেন এবং তাঁদের সৃজনী প্রতিভার স্ফুরণ অশিক্ষিত অমার্জিত শিল্পপরায়ণতার (‘genitality’) মধ্যে ফ্রয়েডিয়ান অর্থে eroticism-এ নয়, কিঞ্চিৎ অর্থের মালিক এরকম বহু বাঙালি নামে গালভরা ‘ব্যবসায়ী’ আসলে নেপোশ্রেণির নিকৃষ্ট দালাল এবং অবাঙালি মোনোপলিস্ট পুঁজিপতির আজ্ঞাবহ মাল—যোগানদার দাসানুদাস—এ রকম সব বিচিত্র সামাজিক উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত অদ্ভুত মধ্যবিত্ত হবুচন্দ্রর রাজ্য বাংলা দেশের মতো দেশ আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এ অনেকটা আমাদের উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত এলিটগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত নবজাগরণের উত্তরাধিকার, কেবল আকারে ও বিকারে অনেক পরিবর্ধিত। কার্ল মার্কসের ‘alienation’ এবং এমিল ডুর্কহাইমের ‘anomie’—র সামাজিক অনুসন্ধানের আদর্শ ক্ষেত্র আজ বাংলা দেশ। কিন্তু সেটা আলোচনার যোগ্য বিষয়, আপাতত আমাদের আলোচনা নয়।* আমাদের কথা হল, বাংলা দেশের বিশাল বর্ধিষ্ণু জনসমাজে কিছুদিন আগে পর্যন্ত যারা মার্কসের ভাষায় ‘submen’ ছিল, অর্থাৎ যারা তাদের শক্তি ও শোষিত সত্তা সম্বন্ধে সচেতন ছিল না, তারা আজ তাদের ‘sub-humanity’ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠেছে এবং সেই মানবেতর অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। প্রাথমিক রাষ্ট্রিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে এই বিদ্রোহ তাদের সার্থক হলে, ভবিষ্যতে তারা আমাদের লিখিত ইতিহাস—সাহিত্য—সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন করবে এবং তখন অনেক অধুনা প্রচলিত মূল্যায়নের মানদণ্ড আবর্জনাস্তূপে নিক্ষিপ্ত হবে। বইপত্র তো হবেই। তখন অনেক রূঢ় মানসিক আঘাতের হাত থেকেও আমরা নিষ্কৃতি পাব না। বিশিষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরা হয়তো তখন বর্তমানের ক্লাব হোটেল আড্ডাখানা ও ‘সুইট হোম’ ছেড়ে অরণ্যবাসী হতে চাইবেন। কিন্তু বর্তমানের মিলেনারিয়ানিজম, অ্যানোমি, অ্যালিয়েনেশন ও মার্কসইজম—এর সমন্বয়, উনিশ শতকের ‘ব্রাহ্মইজম’ ও ‘হিন্দুইজম’—এর মতো অথবা ইয়াং বেঙ্গলের ‘রেডিক্যালিজম’ ও আশি—নব্বুইয়ের দশকের হিন্দু ‘রিভাইভ্যালিজম’—এর সমন্বয়ের মতো, অরণ্যেও সম্ভব হবে না, অন্তত বাংলা দেশের সীমাবদ্ধ জনারণ্যে তো নয়ই।

…………

* আমার নতুন বই ‘মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’—এর মধ্যে এ বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। (১৯৭৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *