ইসলাম ও বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়
হিন্দু আর মুসলমান একই পিণ্ডের দড়ি
কেহ বলে আল্লা রসুল কেহ বলে হরি
—মুসলমান পল্লিকবি
সব ঘটে একৈ আত্মা ক্যা হিন্দু মুসলমান
—দাদু
বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলনের পুরোধা হিন্দুপ্রধান উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণি, নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই নবজাগৃতি আন্দোলন সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারাবাহিক আন্দোলন। নতুন যুগের পাশ্চাত্য ভাবধারার ঘাতপ্রতিঘাতে বাংলায় তথা সারা ভারতে এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগৃতির সূচনা হয়। কিন্তু নবজাগৃতির পথপ্রদর্শক যাঁরা তাঁদের মধ্যে অনেকেই নতুন যুগের হিন্দু ধনিক, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী বলে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ অলিগলিতে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি, সংস্কৃতিসমন্বয়ের প্রশস্ত পথেই পরিচালিত হয়েছে। বাংলার সেই সংস্কৃতিসমন্বয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যই নবযুগে নতুন করে আবিষ্কার করা হয়েছিল। ভারতের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারার সঙ্গে বাংলা দেশ বিচ্ছিন্ন নয়, যদিও সেই সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বাংলার একটা ঐতিহাসিক বিশিষ্টতা আছে। বাংলার নবজাগৃতির নায়ক যাঁরা তাঁরা নতুন যুগের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে ভারতের তমসাবৃত প্রাচীন যুগের সংস্কৃতি—সম্পদের ভিতর থেকে সমন্বয়ের একটা ‘আদর্শ’ বা ‘মডেল’ খুঁজে বার করেছিলেন মাত্র। ইউরোপের নবজাগৃতির ইতিহাসেও প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার ঐশ্বর্যের মধ্যে এই ‘মডেল’ সন্ধানের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাচীন যুগ বা মধ্যযুগের ভারতের সংস্কৃতিসমন্বয়ের প্রচেষ্টা যুগে যুগে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। মানসলোকের ভাবসমন্বয় বিশাল জনসমুদ্রের বুকে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, কারণ ঊর্ধ্বলোকের সেই ভাবসমন্বয়ের তলায় কোনও সুদৃশ্য অর্থনৈতিক বনিয়াদ ছিল না। বৌদ্ধ যুগ থেকে মুসলমান যুগ পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। তাই সংস্কৃতিসমন্বয়ের ফলে উপরতলার ভাষা শিল্পকলা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি হয়েছে, নতুন দর্শনের বিকাশ হয়েছে, নীতি আচার—ব্যবহার আইনকানুনেরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এসবই হল ‘সুপার—স্ট্রাকচার’ বা উপরের তলার সময়োপযোগী পরিবর্তন, নিচের তলার বা বনিয়াদের কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়। জনমনের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা কামনা বেদনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে এই অবাস্তব আধ্যাত্মিক ভাবসমন্বয়ের মধ্যে। বুদ্ধ রামানন্দ কবীর দাদু চৈতন্য সকলে গণচেতনাকেই প্রকাশ করেছেন, কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি, সমাজের স্তরে স্তরে তার নৈতিক শক্তি সঞ্চারিত হয়নি, চেতনার নতুন আবর্ত বা আলোড়নও সৃষ্টি হয়নি। সেই ভাবসমন্বয়ের মর্মান্তিক বিকৃতি ও অবনতি ঘটেছে, প্রকৃতির মতন অর্থনীতির নির্মম প্রতিশোধের আগুনে সমস্ত সংস্কৃতি—সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জরাগ্রস্ত জীর্ণ সমাজ সেই ভগ্নস্তূপের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হয়ে পিশাচবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। ‘মহাপাতক’ জনগণ সাধকদের আদর্শ উপলব্ধি করেনি, সমাজ ঘুমিয়েছে, তলার মাটির শীতল নিষ্ক্রিয়তায় সাধারণ মানুষও ঘুমিয়েছে।
ঘুম ভাঙা ও ভাঙানোর পালা শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। আর্য—অনার্য সংস্কৃতিসমন্বয়ের ফলে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু—সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পর ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সমন্বয় হল হিন্দু—মুসলমান সভ্যতা—সংস্কৃতির। এই হিন্দু—মুসলমানের নতুন ভারত—সংস্কৃতিকে আঘাত করল ব্রিটিশ যুগে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সমন্বয়ের বিশিষ্টতা থাকলেও বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে এই তিনটি ঐতিহাসিক সমন্বয়ই দেখা যায়। প্রায় দশ শতাব্দী ধরে ভারতে হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতিসমন্বয়ের যে ধারা চলে আসছিল তার সঙ্গে এসে মিশল নতুন ধনতান্ত্রিক যুগের পাশ্চাত্য ভাবধারা। এ দেশে ইসলামধর্ম ও সভ্যতা বাস্তবিকই ‘মুজর্মুঅ অল—বহরৈন’ অর্থাৎ ‘দুইটি সাগরের সম্মিলনে’ পরিণত হয়েছিল। পাশ্চাত্য ভাবধারা এসে তার সঙ্গে মিলিত হবার পর হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতির যুক্তবেণি ত্রিবেণিসংগমে পরিণত হল। বাংলার তথা সারা ভারতের নবজাগৃতির জনকতুল্য রামমোহন, তাই উপনিষদ, কোরান শরিফ ও বাইবেল হাতে করে এই ত্রিবেণিতে অবতীর্ণ হলেন, হিন্দু পণ্ডিত, জবরদস্ত মৌলবি ও পাদরি সাহেব বলে তিনি পরিচিত হলেন।
আর্য—অনার্য সংস্কৃতিসমন্বয়ের পর বিশুদ্ধ আর্য—সংস্কৃতি বা অনার্য—সংস্কৃতির সমস্যা কেনোদিন ভারত বা বাংলায় দেখা যায়নি, আর্য ও অনার্য দুই জাতি কি না সে প্রশ্নও কোনওদিন ওঠেনি। কিন্তু হিন্দু—মুসলমানের সার্থক সংস্কৃতিসমন্বয় সত্ত্বেও দুই জাতির ও দুই সংস্কৃতির সমস্যা ভারতের যুক্তবেণি তোলপাড় করেছে, আজও করছে। বাংলার সংস্কৃতিক্ষেত্রে এই সমস্যার গুরুত্ব আজ অত্যন্ত বেশি। জাতিতত্ত্বের দিক থেকে আজ জানা প্রয়োজন ভারতের মুসলমান কারা, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের স্বতন্ত্র কোনও জাতিগত বৈশিষ্ট্য আছে কি না এবং থাকলেও কতটুকু আছে। সংস্কৃতির দিক থেকেও হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ইতিহাস জানা দরকার, বিশেষ করে বাংলায় যে সমন্বয়কে ‘মুজমুঅ’ অল—বহরৈন’ বলা হয়। ভারতের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থেকেও বাংলার বিশিষ্টতা কোথায় তা না জানলে এই সমস্যা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। নতুন যুগের সামাজিক নবজাগৃতি ও সাংস্কৃতিক ত্রিবেণিসংগমের এই পশ্চাদভূমির গুরুত্ব অস্বীকার করার অর্থ হল বাস্তব ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং কোনও সমাজবিজ্ঞানীর তা করা উচিত নয়।
মানবপন্থী বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়
কবি রবীন্দ্রনাথ ও জ্ঞানী ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে একবার ‘ভারতের বৈশিষ্ট্যের’ কথা ওঠে। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করেন : ”আপনার মতে ভারতের বৈশিষ্ট্য কি?” রবীন্দ্রনাথ বলেন :
”বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্যের যোগসৃষ্টি ও ঐক্যের যোগসাধনাই ভারতের বিশেষ ধর্ম। আমার ‘ভারতের ইতিহাসের ধারা’তে আমি একথা ভাল করেই বলেছি। ভারতের উঁচু নিচু বহু ধর্ম ও সংস্কৃতিই পাশাপাশি রয়েছে। কেউ কাউকে নিঃশেষ করতে চায়নি। এইটি আর কোথাও কি দেখা যায়? আর সব দেশেই প্রবল ধর্ম ও সংস্কৃতি দুর্বলকে পিষে মেরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ভারতে কিন্তু সেটি কখনই ঘটেনি। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে সুরসঙ্গতির (harmonyর) সাধনাই হল ভারতের বিশেষ সাধনা। নানা বিরোধের মধ্যে সমন্বয়—সাধনই ভারতের ব্রত। যে—সব সাধক এই সাধনাতে সিদ্ধিলাভ করেছেন তাঁরাই আমাদের দেশের মহাপুরুষ। তাঁদের নামই আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।”
ভারতের পরই বাংলা দেশের বিশেষত্বের কথা উঠল। কবি বললেন :
”নদীর পলিমাটিতে তৈরী এই বাংলাদেশ। এখানে ভূমি উর্বর। বীজ মাত্রই এখানে সজীব সফল হয়ে ওঠে। তাই এখানে প্রাণধর্মের একটি বিশেষ দাবি আছে। পলিমাটির দেশ বলেই এখানকার ভূমি কঠিন নয়। তাই পুরাতন মন্দির প্রাসাদ প্রভৃতির গুরুভার এখানে সয় না। সেই সব গুরুভার এখানে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়। বাংলাদেশে তাই তীর্থ প্রভৃতি বেশি নেই। পুরাতনের ঐশ্বর্য তার খুবই কম…পুরাতনের মৃত পাষাণভার এখানে না সইলেও জীবনের দাবি দাওয়া এখানে পুরোপুরি সফল হবে। …প্রাণের নামে মানবতার নামে দাবি করলে এখানে সাড়া মিলবে। জীবন্ত ক্ষেত্রে জীবনের দাবিই চলে। কিন্তু তাই বলে এদেশের সাধনাকে পুরাকালের পাথরের জগদ্দল চাপে কঠিন ও ভারগ্রস্ত করে রাখলে তো চলবে না। মন্দিরের প্রাসাদের পাষাণভারে বাংলাদেশের উর্বর বিস্তারটিকে ঢেকে ফেলে জীবনের সেই দায়িত্বকে এড়াতে চাইলে আমরা হব ধর্মভ্রষ্ট।”১
ভারতের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারার সঙ্গে বাংলার অবিচ্ছিন্নতা ও বিশিষ্টতা এইখানে। গঙ্গা ও সাগরের সংগম ঘটেছে এই দেশে, গঙ্গাসাগর বাংলাদেশেই। গঙ্গা এখানে সারা উত্তর ভারতের আশিস বহন করে আনছে। বাংলার তলায় সমুদ্র। সারা দক্ষিণ ভারতের সম্পদ বহন করে আনছে সমুদ্র। উত্তরের আর্য আর দক্ষিণের দ্রাবিড় সংস্কৃতির মিলন হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাংলা দেশে কত বিভিন্ন জাতির মানুষের যে মিলন ঘটেছে তা বলে শেষ করা যায় না। এখানে অনার্য—আর্য ভোট কিরাত প্রভৃতি মঙ্গোলিয়ান জাতি মিলেছে। মণিপুর দিয়ে শানবাসী চীনেরা এসেছে। গারো খাসিয়া কাছাড়ি কোচ সাঁওতাল ভিল কোল প্রভৃতি জাতি—উপজাতি এখানে রয়েছে। দ্রাবিড়দের তো এ দেশ একটা প্রধান বাসস্থান। সমুদ্রপথে আরবরা এসেছে, পতুর্গিজ ডাচ ফরাসি ইংরেজরা এসেছে। বহু মানবজাতির মিলনভূমি হয়েছে বাংলা দেশ। বাংলার মাটি উর্বর পলিমাটি। মিলনের ফলে তাই সোনার ফসল ফলেছে এখানে। বহু বিচিত্র মানবজাতির মিলনতীর্থ বাংলার সংস্কৃতিক্ষেত্রের সোনার ফসল হল মানবতাধর্ম। এই মানবতাবোধেই বাংলার বিশিষ্টতা। বাংলা দেশ তাই দেবভূমি নয়, মানবভূমি। বাংলা জানে মানুষকে, দেবতাকেও সে চেনে মানুষের আলোকে, মানুষের মতন আপনার জন করে। মানবপন্থী বাংলার চিরদিনের পুরস্কার তাই শাস্ত্রপন্থী ভারতের শাসানি। তীর্থযাত্রা ছাড়া এ দেশে এলে তাই প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। বাংলাদেশ মগধাদি প্রদেশের সঙ্গে যখন একান্ন পরিবারভুক্ত ছিল তখনই তার কাছাকাছি জৈন—বৌদ্ধাদি যাগযজ্ঞবিরোধী মতের প্রবর্তন হয়। বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতির মত এ দেশে ও তার আশপাশে চিরদিনই প্রবল ছিল। বাংলা ও মগধ যাগযজ্ঞ শাস্ত্রসাধন বা ব্রাহ্মণ প্রাধান্যের পক্ষপাতী ছিল না বলেই বোধহয় ঐতরেয় আরণ্যকে বাঙালি ও মগধবাসীকে ‘পাখি’ বলে নিন্দা করা হয়েছে।
মানবতা এবং উর্বর সমতলভূমির বিস্তারের মতন উদারতাই শুধু বাংলার বিশিষ্টতা নয়। ভারতের এক সীমায় বাংলার স্থান। উত্তর ভারতের শাস্ত্রের কচকচানিতে বাংলা যেমন অতিরিক্ত উৎসাহ বোধ করেনি, দক্ষিণ ভারতের প্রেমভক্তির আবেগবন্যায়ও গা ভাসিয়ে দেয়নি। উত্তর ভারতের সংযম শৃঙ্খলা সংহতি এবং দক্ষিণ ভারতের ভাবাবেগ সমীকৃত করে বাংলা গ্রহণ করেছে। একপ্রান্তে থাকার জন্য তার বিচারবুদ্ধি ও বিশ্লেষণশক্তিরও আশ্চর্য বিকাশ হয়েছে। বেদ—বেদাঙ্গ সাংখ্যদর্শন হেতুশাস্ত্র ও ন্যায়বৈশেষিক প্রভৃতি যুক্তিবাদে বাংলার দান সামান্য তো নয়ই, অনেক ক্ষেত্রে বাংলাই ভারতের পথপ্রদর্শক। কিন্তু বাংলার প্রকৃতির মতন, বাংলার নদনদীর নিত্য ভাঙাগড়ার মতন, বাংলার কালবৈশাখী আর বর্ষার মতন ভাঙনের ও ধ্বংসের বিশিষ্টতাও বাংলার আছে। গ্রহণের আবেগ ও আগ্রহ যেমন তার প্রবল, সমীকৃত করার বিচারবুদ্ধি যেমন তার অসাধারণ, তেমনি চূড়ান্ত ভাবাতিশয্যে অথবা অর্থহীন যুক্তিবাদের চোরাগলিতে তাকে বর্জন ও বিকৃত করার প্রবৃত্তিও তার কম নয়। মহাযানী বৌদ্ধ, বজ্রযানী শৈব এবং শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত মানবীয় বৈষ্ণবধর্মের শোচনীয় বিকৃতি ও পরিণতি তার প্রমাণ। সতেজ ও সজীব করে তোলা যেমন বাংলার প্রাণধর্ম, তেমনি পচিয়ে—খসিয়ে—গলিয়ে নিস্তেজ নির্জীব করে ফেলাও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আত্মহত্যা ও অপমৃত্যুর ঝোঁক তার যেমন প্রবল, আত্মচেতনা ও পুনরুজ্জীবনের আগ্রহও তেমনি তার উদ্দাম। এই হল বাংলার বিশিষ্টতা—বাংলার মানুষের, বাংলার সমাজের, বাংলার সংস্কৃতির।
বাংলার হিন্দু—মুসলমান দুই জাতি?
বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়ের এই বিশিষ্টতার দৃষ্টি দিয়ে হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতির ‘মুজমূ’অ অল—বহরৈন’—এর বা যুক্তবেণির বিচার করা উচিত। কিন্তু সংস্কৃতির মিলনের কথা বলার আগে হিন্দু—মুসলমানের জাতিগত মিলনের কথা বলা প্রয়োজন। এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে বিদেশি মুসলমান, অর্থাৎ আরবি পারসিক তুরকি ইরানি আফগান মুসলমানদের বংশধর যে নেই তা নয়, আছেন, কিন্তু তাঁদের প্রাধান্য বা কৌলীন্য সর্বত্র বজায় আছে কি না সন্দেহ। আরব তুরস্ক পারস্য প্রভৃতির দেশ থেকে বাণিজ্য করার জন্য এ দেশে মুসলমান বণিকরা এসেছিলেন, ইসলামধর্ম প্রচারের জন্য মুসলমান সাধকরাও এসেছিলেন। চেঙ্গিস খাঁ—র অত্যাচারে আরব ইরান তুরকিস্তান খোরাসান ইরাক আজারবৈজান খারেজম রুম প্রভৃতি স্থান থেকে অনেক মুসলমান ভারতে পালিয়ে আসেন, খোঁড়া তৈমুরের সঙ্গে লুঠতরাজ করতেও আসেন অনেকে। দিল্লিতে সেই সময় তাঁদেরই বাসস্থানের জন্য অনেক স্বতন্ত্র মহল্লা তৈরি করা হয়, যেমন আব্বাছি মহল্লা, খারজমি মহল্লা, দেলেমি মহল্লা, গোরি মহল্লা, চঙ্গেজি মহল্লা, রুমি মহল্লা, সমরকন্দি মহল্লা, কাশগরি মহল্লা ইত্যাদি।২ নবাব বাদশাহদের আমলা—অমাত্যদের মধ্যেও অধিকাংশই বিদেশি মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের মুসলমানরা আরবি পারসিক ইরানি তুরকি আফগানদের বংশধর নন। উত্তর—পশ্চিম সীমান্তের পথে যেসব আক্রমণকারী বা আশ্রয়প্রার্থী বিদেশি মুসলমান উত্তর ভারতে এসেছিলেন, সমুদ্রপথে যেসব বিদেশি মুসলমান বণিক ও সাধক মুসলমান অভিযানের বহু পূর্বে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন, হিন্দুদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রক্তের সংমিশ্রণের জন্য তাঁদের পক্ষে কুলমর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তাঁদের বংশধরদের দেহে হিন্দুর রক্ত মিলেমিশে রয়েছে। কিন্তু তাঁদের সংখ্যাও ভারতে নগণ্য বলা চলে। ভারতের মুসলমানদের পূর্বপুরুষ অধিকাংশই ভারতের হিন্দু ও নানা জাতি—উপজাতি। অধিকাংশের মধ্যে কোনও বিদেশি মুসলমানের রক্তের সংমিশ্রণ পর্যন্ত হয়নি। তাই দিল্লি—আগ্রার মতন মুসলমান যুগের রাজধানী ও প্রধান নগরগুলিতে অথবা তার আশপাশে মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ সেখানে জাঠ ও রাজপুতদের মতন শক্তিশালী হিন্দু জাতির প্রবল প্রতিরোধের মুখে দাঁড়াতে হয়েছিল মুসলমান যোদ্ধাদের। সেখানকার হিন্দুসমাজের রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে যে কঠোরতা ও দৃঢ়তা তখনও ছিল তাকে উপেক্ষা করে বা পরাজিত করে হিন্দুসাধারণকে ধর্মান্তরিত করাও সম্ভব হয়নি ইসলামের পক্ষে। বাংলায় ব্রাহ্মণ প্রাধান্য অন্তঃসারশূন্য ছিল বলে উত্তর বিহারে মুসলমান প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পুরাতন মুসলিম শাসনকেন্দ্র দক্ষিণ বিহার পাটনা বা মুঙ্গেরে হয়নি। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ মুসলমানই ধর্মান্তরিত আদিম সভ্য অনুন্নত জাতির লোক। অর্থাৎ সারা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে বিদেশি মুসলমানদের বংশধরদের অস্তিত্ব বিশেষ নেই, যাঁরা আছেন তাঁরা হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে খাঁটিত্ব হারিয়েছেন। ভারতের অধিকাংশ মুসলমান, বিশেষ করে বাংলার ও দক্ষিণ ভারতের মুসলমানরা, জাতির দিক থেকে বিচার করলে, মূলত হিন্দু জাতি বললেও ভুল হয় না।৩
বাংলার মুসলমানদের কুলমর্যাদা সম্বন্ধে বিশেষভাবে এ উক্তি প্রযোজ্য। কারণ দুই জাতিতত্ত্ব এবং দুই সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য যাঁরা দাবি করেন তাঁরা এই মুসলমানি কৌলীন্য সম্বন্ধে নিশ্চয়ই সচেতন। তা ছাড়া ভারতের মুসলমানদের মধ্যে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মুসলমানই বাংলাদেশের। ১৮৯১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে দেখা যায়, সারা বাংলার মুসলমান সংখ্যা ২৩,৬৫৮,৩৪৭, তার মধ্যে খাস বাংলায় ১৯,৫৭৭,৪৮১, বিহারে ৩,৫০৪,৪৮৭, উড়িষ্যায় ৯২,৪৬৮ এবং ছোটনাগপুরে ২,৫৭৮০৯। ভারতে মোট মুসলমানের সংখ্যা তখন ছিল ৫ কোটি, তার মধ্যে বাংলা বিহার উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরেই প্রায় অর্ধেক এবং খাস বাংলায় প্রায় এক—তৃতীয়াংশ।৪ সারা ভারতের মুসলমানের সংখ্যাবৃদ্ধির অনুপাতে বাংলার মুসলমানেরও সংখ্যা বেড়েছে। তাই বাংলার মুসলমানদের তথাকথিত স্বতন্ত্র কুলমর্যাদা সম্বন্ধে আলোচনার প্রয়োজন আছে, কারণ তার উপর বাংলার অর্থনীতি রাজনীতি সমাজ ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
‘তারিখ—এ—ফেরেশতা’র মতে হিঃ ৬০০ বা ইং ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের তৎকালের শাসনকর্তা কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে বখতিয়ার খিলজি বাংলা দেশ জয় করেন। এই সময় থেকে শুরু করে ইংরেজদের বাংলায় দেওয়ানি গ্রহণের সময় পর্যন্ত প্রায় ৫৬২ বছর, এ দেশ মুসলমানদের অধীন ছিল। এর মধ্যে দিল্লিতে নানা বংশের উত্থান—পতন হয়েছে। বখতিয়ার যখন বাংলা জয় করেন তখন দিল্লিতে গৌরি বংশের আধিপত্য। ১২৮৮ সালে খিলজিবংশ সিংহাসন পান। তুঘলক বংশ পরে তাঁদের সিংহাসনচ্যুত করেন। তারপর সৈয়দ বংশ ও মোগল বংশ ভারতের রাজদণ্ড ধারণ করেন। এই সময়ের মধ্যে ৭৬ জন শাসনকর্তা, স্বাধীন বাদশাহ বা নাজেম ক্রমান্বয়ে বাংলা শাসন করেন। এঁদের মধ্যে ১৬ জন গোরি ও খিলজি সম্রাটদের নিযুক্ত। শের শাহের সময় যাঁরা বাংলা শাসন করেছিলেন তাঁদের নিয়ে ২৬ জন স্বাধীন বাদশাহ ছিলেন। বাকি ৩৪ জন মোগল বাদশাহের নিযুক্ত নাজিম। এই ৭৬ জনের মধ্যে রাজা গণেশ, জালালুদ্দিন, আহম্মদ শাহ, রাজা তোডরমল্ল ও মানসিংহ ছাড়া আর সকলেই আফগান মোগল ইরানি ছিলেন। নবাব নাজিমরা বিদেশি মুসলমান ছিলেন বলে অভিজাত বংশের অনেক মুসলমান আফগানিস্তান তুরকিস্তান ইরান আরব প্রভৃতি দেশ থেকে, এমনকী ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকেও এখানে আসেন। এঁদের অনেককেই জায়গির, আলতামগা, মদদেমাশ (কেবল ধর্মগুরু, সৈয়দ বা উচ্চবংশের মুসলমানদের দেওয়া হত), আয়মা (মোল্লা, মুফতি ও সৈয়দদের দেওয়া হত), মাশকান (ঘরবাড়ি তৈরির জন্য দেওয়া হত), খানকা, ফকিরান, নজর—এ দরগাহ, তাজিয়াদারি, মিলক (সম্মানিত পদস্থ মুসলমানদের দেওয়া হত), খয়রাতি ইত্যাদি নিষ্কর জমি দিয়ে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করে দিতেন নবাবরা।৫ কিন্তু এসব ঘটনা সত্য বলে স্বীকার করেও বলতে হয়, বাংলার মুসলমানরা বিদেশি মুসলমানদের বংশধর নন। বিদেশি মুসলমানরা বাংলা দেশে এসে মুসলমানদের বংশবৃদ্ধি করেননি।
বিভার্লি সাহেব ১৮৭২ সালের সেন্সাস রিপোর্টে লিখেছেন :
‘মুসলমানেরা যখন বাংলা আক্রমণ করেন তখন এ দেশের হিন্দুধর্ম অত্যন্ত শিথিল ও দুর্বল ছিল। জনসাধারণের মধ্যে ভক্তিশ্রদ্ধার বিশেষ কোনও আধিক্য ছিল না। উচ্চবর্ণের লোকেরা নিম্নবর্ণের লোকদের উপর অন্যায়—অত্যাচার করত। নিম্নবর্ণের লোকদের গোলামে পরিণত করা হয়েছিল বলা চলে। এই সময় মুসলমানরা কোরান আর তরবারি নিয়ে বাংলায় অভিযান করেন এবং বেশ বোঝা যায়, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে তাঁদের বিশেষ নির্যাতন পর্যন্ত করতে হয়নি। বিহারে মুসলমানধর্মের প্রসার বন্ধ হয়েছিল হিন্দুধর্মের প্রতিরোধের জোরে, কিন্তু বাংলায় সে প্রতিরোধের শক্তি ছিল না। এ কথা প্রমাণের জন্য বেশি যুক্তিতর্কের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে বাংলার মুসলমানদের চেহারার সাদৃশ্য দেখলেই তা বোঝা যায়। শুধু গঠনসাদৃশ্য নয়, আচার—ব্যবহারের সাদৃশ্যের মধ্যেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একজন চণ্ডাল, রাজবংশী ও বাঙালি মুসলমান পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখলে তাদের পার্থক্য বোঝা রীতিমতো কঠিন হয়ে ওঠে।’৬
* হান্টার সাহেব (১৮৭০—৭১ সাল) ঢাকার মুসলমানদের সম্বন্ধে লিখেছেন,
অধিকাংশ মুসলমানই শেখ সম্প্রদায়ভুক্ত, সৈয়দ পাঠান ও মোগলদের বংশধর নেই বললেই হয়।৭ মুর্শিদাবাদের বিদেশি বনেদি মুসলমানের বংশধররা অনেকেই ইংরেজ অধিকারের পরে বাংলা দেশ ছেড়ে দিল্লিতে, কেউ কেউ পারস্যেও চলে যান।৮
১৮৭২ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ে ৫৭% আর হিন্দুদের ২৪% এবং তার প্রধান কারণ হল মুসলমানদের সামাজিক বিধিনিষেধের শিথিলতা ও প্রজননশক্তির সদব্যবহার (যেমন বিধবাদের পুনর্বিবাহ ইত্যাদি)।৯ ১৯০১ সালে নোয়াখালির ৮৬৬,২৯০ মুসলমানের মধ্যে ৮৬০,৫৮০ জন ‘শেখ’ বলে পরিচয় দেন, আর বাকি সংখ্যার মধ্যে ১০০০ জন পাঠান এবং ১৩০০ জন সৈয়দ বলেন। সৈয়দ ও পাঠান বলে যাঁরা পরিচয় দেন তাঁদের চেহারায় বিদেশি ছাপ কিছু আছে অবশ্য, কিন্তু অধিকাংশ শেখ সম্প্রদায়ের মুসলমান নোয়াখালি জেলার অনুন্নত হিন্দুজাতি থেকে ধর্মান্তরিত, এমনকী কায়স্থদের মধ্যেও মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন এরকম অনেককে দেখা যায়। নোয়াখালি জেলার মুসলমানদের মধ্যে আজও চন্দ পাল দত্ত ইত্যাদি উপাধির চলন আছে।১০ মল্লিক পাঠান ও সৈয়দ বংশের মুসলমান হাওড়া জেলায় বেশি নেই, অধিকাংশ মুসলমানই শেখ সম্প্রদায়ভুক্ত। এই শেখরা নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকেই ধর্মান্তরিত এবং এত গরিব যে অভিজাত আশরাফদের সমপর্যায়ে ওঠার সাধ্য নেই তাদের।১১ হুগলি একসময় মুসলমান বাদশাহদের শাসনকেন্দ্র ছিল এবং অনেক বিদেশি মুসলমান তাঁদের সঙ্গে এই জেলায় এসেছিলেন। হুগলি পাণ্ডুয়া বলাগড় ধনেখালি চণ্ডীতলা প্রভৃতি থানার মধ্যে আজও এইসব মুসলমান আয়মাদারদের বংশধর দু—চার ঘর আছেন। কিন্তু হুগলি জেলায় অধিকাংশ মুসলমানই শেখ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাঁরাই শতকরা ৮৮ জন। এই শেখরা নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছেন সমাজের (মুসলমান) কাছে মর্যাদালাভের আশায়।১২
এইভাবে বাংলার প্রত্যেক জেলার মুসলমানদের পরিচয় নিলে দেখা যাবে, নৃতত্ত্ব—জাতিতত্ত্ব কোনওকিছুর বিচারে তাঁদের আরবি ইরানি তুর্কি আফগানদের বংশধর বলা যায় না। তাঁরা অধিকাংশই অবজ্ঞাত উপেক্ষিত অস্পৃশ্য ও অশিক্ষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরই বংশধর। বাংলার মুসলমানরা মনেপ্রাণে তো নিশ্চয়, রক্তসম্পর্কেও খাঁটি বাঙালি। বাঙালি হিন্দুদের যেমন বিশুদ্ধ আর্যদের বংশধর হিসেবে ভাবা ভুল, তেমনি বাঙালি মুসলমানদেরও বিশুদ্ধ আরবি তুরকি ইরানিদের বংশধর মনে ভাবা ভুল। বহু প্রাগার্য জাতি—উপজাতির সঙ্গে আর্যদের সংমিশ্রণের ফলে যেমন ভারতের হিন্দুদের মতন বাঙালি হিন্দুদেরও উৎপত্তি, তেমনি নানা বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে বিদেশি মুসলমানদের মিশ্রণের ফলে ভারতের ও বাংলার ‘আশরাফ’ বা অভিজাত মুসলমানদের উৎপত্তি। কিন্তু অভিজাত মুসলমানদের সংখ্যা এত অল্প যে বাংলার বা ভারতের মুসলমানদের মিশ্রিত জাতি বলাও ঠিক নয়। ‘আতরাফ’ বা অনভিজাত মুসলমানদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হিন্দুদেরই বংশধর। এ কথা আজ নৃতত্ত্ববিদ জাতিতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা সকলেই স্বীকার করেন।
সৈয়দ কাজি মুফতি খোনকার মির চৌধুরি তালুকদার ইত্যাদি উপাধিধারী মুসলমান যাঁরা আছেন তাঁদের বনেদি বিদেশি মুসলমানদের বংশধর মনে করার কোনও কারণ নেই। এইসব উপাধির মধ্যে তাঁদের কুলমর্যাদা যত নেই তার চাইতে অনেক বেশি আছে তাঁদের বংশগত পেশার পরিচয়। কুলমর্যাদা অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে রক্তের মিশ্রণের ফলে বহুদিন নষ্ট হয়ে গেছে, পেশাগত পরিচয়টুকু আজও রয়েছে। নবাব—বাদশাহদের রাজত্বকালে যাঁরা রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকতেন তাঁরা ‘মির’, যাঁরা দিগ্বিজয় করতে বেরুতেন তাঁরা ‘পাশা’ ও ‘বে’, যাঁরা বিচারক তাঁরা ‘কাজি’, যাঁরা লোককে ইসলামধর্মে দীক্ষা দিতেন তাঁরা ‘খোনকার’, যাঁরা শাস্ত্রানুশীলনে নিযুক্ত থেকে ফতোয়া দিতেন তাঁরা ‘মুফতি’, আর ‘চৌধুরি’ ‘তালুকদারেরা’ হলেন বাদশাহদের নিযুক্ত রাজস্ব আদায়কারী। উপাধিগুলি বৃত্তিপরিচয়, বংশপরিচয় নয়। বংশগৌরব একদিন যেটুকু ছিল আজ তা—ও নেই, আজ সেই পুরাতন যুগের বৃত্তি গৌরবটুকুই সম্বল আছে মাত্র। যাঁরা ‘আতরাফ’ বা অনভিজাত ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের মুসলমান তাঁদের মধ্যে সর্দার শেখ মণ্ডল খাঁ পাড় ধাবক দফাদার মালী শিকদার বিশ্বাস প্রভৃতি যেসব পদবি দেখা যায় তা—ও আসলে বৃত্তিপরিচায়ক, এখন অবশ্য বংশের পরিচয়ও দিচ্ছে। মুটেমজুর—লোকজন খাটিয়ে যারা খেত তারা ‘সর্দার’ ব্যাবসাবাণিজ্যে লিপ্ত থাকত যারা তারা ‘শেখ’, ডাক বহন করত যারা তারা ‘ধাবক’, নদনদীর কূলে বাস করে চাষ করত যারা তারা ‘পাড়’, যারা ভূস্বামীদের অধীন জোতজমা রাখত তারা ‘জোতদার’, যারা বাগান রক্ষা করত তারা ‘মালী’, ‘বিশ্বাস’দের কোথাও ‘মোমিন’ কোথাও ‘জোলা’ বলত, কাপড় বোনাই ছিল তাদের পেশা, মৎস্যজীবীদের বলত ‘নিকারি’ বা ‘মহালদার’, বাদ্য—বাদকদের বলত ‘বাজাদার’, পালকি বইত যারা তাদের বলত ‘কাহার’, কাপড় ধুত যারা তারা ‘ধুবি’, যারা খেউড়ি করত তারা ‘হাজম’ ইত্যাদি। এসব পদবি শুধু মুসলমানদেরই একচেটে নয়, হিন্দুদেরও আছে। বাংলা দেশের গ্রামের অধিকাংশ মুসলমান মেয়ের আজও বোরখা পরেন না। তা ছাড়া, গ্রামের মুসলমানদের নাম দেখে বোঝা যায়, আরব পারস্য তুরস্ক থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের এ দেশে আমদানি হয়নি। যেমন ধোনা মোনা সোনা ফটিক ঝড়ু মাদার সদো মধ্যে শশী গগন হারান পরান পচু প্রভৃতি নাম হিন্দুর কি মুসলমানের বোঝার উপায় নেই।১৩ এরপর বাংলার মুসলমানদের ইসলামধর্মের ভিত্তিতে জাতি স্বাতন্ত্র্যের দাবি বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্মত মনে হয় কি? হিন্দু—মুসলমানের আদবকায়দা আচার—ব্যবহার থেকেও বোঝা যায়, এ দেশের সাধারণ প্রাকৃত লোকেরাই মুসলমান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। তাদের মধ্যে বহু পুরাতন সব সংস্কার আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে। হুসেনি ব্রাহ্মণ, মালকানা রাজপুত, গুজরাতের পিরানপন্থী বা কাকাপন্থী, মধ্যপ্রদেশের পিরজাদা, বাংলা দেশের নট, পটুয়া প্রভৃতি দল ঠিক হিন্দু কি মুসলমান সহজে বলা যায় না।১৪ দক্ষিণ ভারতের মুসলমানদের আচার—ব্যবহার রীতিনীতির সঙ্গে আরব—পারস্যের মুসলমানি আচারের কোনও সাদৃশ্য নেই। দক্ষিণ ভারতের মুসলমানদের উৎসব বিবাহাচার মৃতাচার ইত্যাদির মধ্যে সেখানকার আদিম অনুন্নত জাতি—উপজাতির আচার—সংস্কার আজও মিলেমিশে রয়েছে। উত্তর ভারতেরও দেখা যায়, রাজপুত, জাঠ প্রভৃতি জাতির মধ্যে যারা ইসলামধর্মে দীক্ষা নিয়েছে তাদের বিবাহ—উৎসবাদির অনুষ্ঠান, উত্তরাধিকারের আইনকানুন আজও হিন্দুদের মতনই রয়েছে, তার উপর ইসলামের বিশেষ কোনও প্রভাব পড়েনি।১৫ এমনকী উত্তর—পশ্চিম সীমান্তে ও বেলুচিস্তানে, যেখানে হিন্দুদের প্রভাব একেবারেই নেই বললেই হয়, সেখানেও ইসলামের পক্ষে আদিম সংস্কার থেকে মুসলমানদের মুক্ত করা সম্ভবপর হয়নি।১৬ বিহারের হিন্দু কূর্মী চাষিরা মুসলমানদের মহরম উৎসবে যোগ দেয়, রমজানের উপবাস করে।১৭ বাংলার মুসলমানরা গ্রামে হিন্দুদের দুর্গোৎসবে যোগ দেয়, হিন্দুরাও মুসলমানদের ইদ—মহরমে আনন্দ করে। ওলাওঠা, বসন্ত ইত্যাদি ব্যাধির মড়কের সময় হিন্দুদের মতন বাংলার মুসলমানরাও শীতলা ও রক্ষাকালী পূজা করে।১৮ বাংলার ‘সত্যপির’ হিন্দু—মুসলমানের মিশ্রদেবতা। ‘সত্যপির’—এর মতন ‘মানিকপীর’—এর ও ‘কালুগাজি’ও হিন্দু—মুসলমানের উপাস্য মিশ্রদেবতা।১৯ এক মাদ্রাজ অঞ্চল ছাড়া, ভারতের সর্বত্র সত্যনারায়ণের পূজা ও কথা হয়। সত্যনারায়ণ ব্রতের বিবরণ স্কন্দপুরাণে আছে। নারদঋষি মর্তলোকের দুঃখকষ্ট দেখে বিষ্ণুলোকে গিয়ে নারায়ণকে দুঃখ নিবারণের উপায় জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে নারায়ণ বললেন, সত্যনারায়ণের পূজা ও ব্রত ভিন্ন দুঃখমোচনের কোনো উপায় নেই। তারপর তিনি নারদকে কয়েকটি আখ্যায়িকা শোনালেন। যেখানে সত্যনারায়ণের কথা হয় সেখানেই স্কন্দপুরাণের এই কয়টি অধ্যায় পড়ে ব্যাখ্যা করা হয়। বাংলা দেশে সত্যনারায়ণের পুঁথি অনেকে লিখেছেন, পুরাণের মূল বর্ণনাও অনুসরণ করেছেন। কিন্তু পুরাণে দরিদ্র দুঃখী ব্রাহ্মণের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে ভগবান বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে দেখা দেন, আর বাংলার সত্যপিরের পুঁথিতে ভগবান মুসলমান ফকিরের বেশে ব্রাহ্মণের দৃষ্টিগোচর হন।২০ পুরাণের হিন্দু দেবতা সত্যনারায়ণ বাংলার হিন্দু—মুসলমানের মিশ্রদেবতা সত্যপির হয়ে এলেন। রামেশ্বর ভট্টাচার্য লিখেছেন :
অতঃপর বন্দিব রহিম রাম রূপ
… ….. …. …
রাম রহিম দোয় নাম ধরে এক নাথ
… ….. …. …
মক্কায় রহিম আমি অযোধ্যায় রাম
ধর্মসমন্বয়ের কাজ শুরু হয়ে গেল। জাতিগত মিলন, আচার—ব্যবহার রীতিনীতি সংস্কার উৎসব—অনুষ্ঠানের মেলামেশার ভিতর দিয়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে মুসলমান পির ও ফকিররা হিন্দু—মুসলমানের ধর্মসমন্বয়ের জন্য মিশ্রদেবতার কল্পনা করলেন, কল্পনাকে কাব্যে রূপ দিলেন, সত্যপির মানিকপুর কালুগাজির সৃষ্টি হল।* ধর্ম—সমন্বয়ের ভিতর দিয়ে বৃহত্তর সংস্কৃতিসমন্বয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতির যুক্তবেণি সমন্বয়ের সাগরে মিলিত হল।
হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতির যুক্তবেণির মিলন
আগে বলেছি, আর্য—অনার্য সংস্কৃতিসমন্বয়ের পর, অর্থাৎ হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু—সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠার পর, হিন্দু—মুসলমানের সংঘাত এবং হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতিসমন্বয় হল ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় যুগান্তকারী ঘটনা। শক হূন যবচী প্রভৃতি জাতির সংঘাতে ভারত—সংস্কৃতির মহাসাগর উদবেল হয়ে ওঠেনি। উৎকট ‘কেডফাইসের পরমমাহেশ্বরপ্রাপ্তি’র মতন সব সভ্যতার উদ্ভটত্ব ও বিশেষত্ব ভারত মহাসাগরের বুকে মিলিয়ে গেছে। বহু জাতি—উপজাতির বিচিত্র ধারায় পরিপুষ্ট হয়ে হিন্দু সভ্যতার চরম বিকাশ হয় গুপ্ত যুগে, সুসংহত ব্রাহ্মণ্যবাদ ‘ত্রিমূর্তি’ ও ‘মহাভারত’—এর মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে।২১ তারপরেই শুরু হয় ক্রমাবনতির যুগ, ভাঙন ও বিরোধের যুগ। ব্রাহ্মণ্যবাদের হিমালয় শৃঙ্গ থেকে হিন্দু সভ্যতার ধারা প্রচণ্ড বেগে নেমে এসে প্রাণের বার্তা নিয়ে চারিদিকে আর ছুটে গেল না, শাস্ত্রে বিধিনিষেধ কুসংস্কার বর্ণবিদ্বেষ অনাচার আর ব্যভিচারের খানাডোবা জলাজঙ্গলে তার গতি রুদ্ধ হয়ে গেল, জাতি ও সভ্যতার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে এল। এই সময় ইসলাম তার নবীন উদ্যম, নবীন আদর্শ ও বিজয়ী ধর্মের প্রেরণা নিয়ে এ দেশে এল।
সপ্তম শতাব্দীর শেষদিক থেকেই আরবরা মালাবার উপকূলে বাণিজ্যের জন্য আনাগোনা শুরু করে। ভারতের পশ্চিম উপকূলে এই সময় থেকে আরবি পারসি বণিকরা বসবাসও আরম্ভ করেন। শুধু বাণিজ্য করেই তাঁরা স্বদেশে ফিরে যেতেন না। এ দেশের মেয়েদের বিবাহ করে এখানেই তাঁরা ঘরসংসার স্থাপন করতেন।২২ এ দেশের রাজরাজড়ারা তাঁদের বাধা দিতেন না, ভূমিদান করে, মসজিদ তৈরি করে দিয়ে তাঁদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য উৎসাহ দিতেন। মুসলমান বণিকদের সঙ্গে ইসলামধর্ম প্রচারেরর জন্য আসতেন মুসলমান সাধকরা। জৈনদের পুরাতন প্রবন্ধগ্রন্থে২৩ দেখা যায় দেবী অনুপমা চুরাশিটি মসজিদ মুসলমান ভক্তদের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, মুসলমান বণিক ও সাধকদের জন্য হিন্দু রাজাদের ভূমিদানের কথা যে সত্য তার প্রমাণ প্রাচীন সব শিলালেখে পাওয়া গেছে। নবম শতাব্দীর মধ্যে মুসলমান বণিক ও সাধকরা সারা পশ্চিম উপকূলে ছড়িয়ে পড়েন এবং তাঁদের সংখ্যাও যথেষ্ট বাড়ে। হিন্দুসমাজের উপর তাঁরা তখন থেকেই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছেন। আরবি ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার ঘুরিয়ে উত্তর—পশ্চিমের পথে ভারতে অভিযান করার অনেক আগে সমুদ্রপথে দক্ষিণ ভারতের খিড়কি দরজা দিয়ে একেবারে অন্দরমহলে প্রবেশ করেছিল ‘ইসলাম’। তখন ‘ইসলাম’ দিগবিজয়ী, প্রচণ্ড তার শক্তি, তার উদ্দামতা, তার আবেগ, তার আত্মবিশ্বাস। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের অভ্যুদয়ের পর থেকেই ভারতে ইসলামের যোগাযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। সিরিয়ার লাঞ্ছিত বিতাড়িত খ্রিস্টানদের মতন পলাতক হয়ে মুসলমানরা এ দেশে আসেননি। তাঁরা এসেছিলেন বিজয়ী বীরের মতন, বিশ্বমানবকে নবীন ‘ইসলাম’ উদাত্ত কণ্ঠে জীবনের বাণী শোনাতে পারে এই দৃঢ়বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে। হতাশ উদাসীন কাপুরুষের মতন তাঁরা আসেননি, তাঁরা এসেছিলেন সদ্যোজাত ‘ইসলাম’—এর বিশ্বমানবতার কাকলি শোনাতে, নবীন আদর্শে ও প্রেরণায় উদবুদ্ধ হয়ে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘাতপ্রতিঘাতে দক্ষিণ ভারত তখন বিক্ষুব্ধ। নব্য হিন্দুধর্ম তখন বিলীয়মান জৈনধর্মের ধ্বংসাবশেষ ও আবর্জনাস্তূপ থেকে মানুষ ও সমাজকে মুক্ত করে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য উদ্যোগী। এই সময় ইসলামি আদর্শের ঢেউ এসে লাগল সমাজের বুকে, মানুষের মনে। বিক্ষুব্ধ সমাজ, বিভ্রান্ত মানুষ তখন নতুন জীবনমন্ত্র উচ্চারণের জন্য উদগ্রীব, নতুন প্রাণবন্ত ধর্মের জন্য, আদর্শের জন্য তারা চারদিকে সকাতরে চেয়ে আছে ইসলামের বাণী ‘কানান্না সো উস্মাতান ওয়াহেদাতান’ (কোরান), ‘সমগ্র মানবমণ্ডলী একজাতি’, মুসলমান সাধকদের কণ্ঠ থেকে তাদের কানে পৌঁছোল। কানে কেন, মর্মে পর্যন্ত গিয়ে বিঁধল সেই বাণী, সমগ্র অন্তরাত্মাকে নাড়া দিল। নাড়া তো দেবেই। বুদ্ধের বাণী কি একদিন সারা ভারত তথা সারা এশিয়ার মনকে নাড়া দেয়নি? শুধু ভারত নয়, এশিয়া একদিন সাড়া দিয়েছিল বুদ্ধের বাণী শুনে। জেরুজালেমের যিশুর বাণী কি একদিন সারা ইউরোপের, বিশ্বমানবের অন্তরে ধ্বনিত হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছিল। বুদ্ধ ও যিশুর শিষ্যরা যখন ধর্মভ্রষ্ট নীতিভ্রষ্ট দিগ্ভ্রষ্ট, তখন মহম্মদ এলেন ‘ইসলাম’—এর বাণী নিয়ে। বুদ্ধ আর যিশুর মর্মবাণী আত্মসাৎ করে মহম্মদ ‘ইসলামের বাণী’ নতুন করে শোনালেন মানুষকে। তাই বিশ্বমানব আবার নতুন করে ইসলামের আহ্বানে সাড়া দিল। নীতিভ্রষ্ট আদর্শভ্রষ্ট ভারতের নিস্তেজ মানুষও যে সাড়া দেবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে? দক্ষিণ ভারত ইসলামের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। ইসলামের বাণী, ইসলামের আদর্শ সমুদ্রপথে প্রথমে পৌঁছোল দক্ষিণ ভারতে। তাই বোধ হয়, অষ্টম শতাব্দীর পর থেকেই ভারতের সংস্কৃতির ইতিহাসে এক নতুন পরিবর্তনের সূচনা হয়। হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যসৌধ যখন ধূলিসাৎ হয়ে গেল তখন অসংখ্য খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত হয়ে আত্মঘাতী হানাহানির এক প্রায়ান্ধকার যুগে উত্তর ভারতের সমন্বয়ের সাধনা, তার পুরাতন ঐতিহ্য—গৌরব সব ডুবে গেল। দেখা গেল, দক্ষিণ ভারত নতুন যুগের ভারত—সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক হয়ে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে। ভারতের সংস্কৃতিসমন্বয়ের বিশিষ্টতার ইতিহাসে এটা একটা লক্ষ করবার বিষয়। এতদিন পর্যন্ত ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতিসমন্বয়ের পুরোভাগে ছিল উত্তর ভারত, আর্যাবর্ত, কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর পর থেকেই ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতিসমন্বয়ের নতুন ধারার প্রবর্তক হল দক্ষিণ ভারত, দাক্ষিণাত্য। শংকরাচার্য রামানুজ বল্লভাচার্য নিম্বাদিত্য সকলেই দক্ষিণ ভারতের। একেশ্বরবাদ ভক্তিবাদ বৈষ্ণবধর্ম ও শৈবধর্মের জন্ম হল দ্রাবিড় দেশে। নবীন ইসলামধর্মের সঙ্গে নব্য হিন্দুধর্মের ঘাতপ্রতিঘাতের ফলেই দক্ষিণ ভারতে এই নতুন ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারা প্রবর্তিত হয়েছে। ভারতের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ইতিহাসে দক্ষিণ ভারত তখন পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছে।২৪
শংকরদর্শনে ইসলামের প্রভাব কতখানি আছে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। শংকরাচার্য যখন জন্মেছিলেন তখন দক্ষিণ ভারতে নব্যহিন্দুধর্ম আর ইসলামধর্মের মধ্যে ঘাতপ্রতিঘাত চলছিল। আরব পারস্য থেকে মুসলমান বণিকদের জাহাজ সমুদ্রপথে তখন দক্ষিণ ভারতের উপকূলে বন্দরে নিয়মিতভাবে ভিড়ছে এবং মুসলমান সাধকরাও তখন নতুন উদ্যমে ইসলামের বাণী প্রচার করতে শুরু করেছেন। দক্ষিণভারতের দু—একজন রাজা পর্যন্ত যে ইসলামধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন তা থেকেই বোঝা যায়, ইসলাম তখন হিন্দুসমাজের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতের শংকরাচার্য এই সময় জন্মালেন এবং দেখলেন, জীর্ণ জরাগ্রস্ত হিন্দুধর্ম ও মৃতপ্রায় হিন্দুসমাজকে যদি রক্ষা করতে হয়, যদি তার অসাড় নিস্পন্দ বুকে আবার প্রাণের স্পন্দন জাগাতে হয়, তাহলে দেবতাবহুল সম্প্রদায়বহুল জাতি—উপজাতিবহুল এই দেশকে একধর্ম একদেবতাপাশে দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে, মানবদেবতার মিথ্যা পূজা বন্ধ করতে হবে। শংকর কোনও সংস্কার, কোনও শাস্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। ইসলামের একদেবতা একধর্মের বিপুল বন্যার মুখে দাঁড়িয়ে শংকর আপসহীন ‘অদ্বৈতবাদ’ প্রচার করেছেন।২৫ ইসলামের সাধক ঘোষণা করলেন : ‘লা হু মা ফিচ্ছামাওয়াতে ওয়া মা ফিল আরদে’, ‘আকাশ পৃথিবী যা কিছু সবই আল্লার’—’অমা—হা—জেহিল হায্যাতোদ দুনয়্যা—ইল্লা লাহ বোঙ অ লায়েব’, ‘এই পার্থিব জীবন অর্থহীন ক্রীড়াকৌতুক ভিন্ন আর কিছু নয়’।২৬ শংকরাচার্য বললেন, এক ব্রহ্মই আছেন, দ্বিতীয় কেউ নেই। জগৎপ্রপঞ্চ কিছুই সত্য নয়, সব মিথ্যা।২৭ বেদ—উপনিষদাদি থেকে শংকরাচার্য এই সত্যই প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হন। শাস্ত্রপন্থী বিধিনিষেধ—আচারসর্বস্ব দেবতাবহুল পৌরোহিত্য—প্রধান যাগযজ্ঞ ভারাক্রান্ত স্বেচ্ছাচারী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এ যেন এক সম্পূর্ণ নতুন বিদ্রোহ। ঠিক বুদ্ধের বিদ্রোহও নয়, কারণ বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরাই একমাত্র উপাস্য দেবতা বানিয়েছিলেন। শংকরাচার্যর আপসহীন ‘অদ্বৈতবাদ’ মনে হয় যেন নবীন আরবি ইসলামের একেশ্বরবাদের ভারতীয় রূপ। বেদ—উপনিষদ তার উৎস হলেও ইসলামের প্রভাবেই যে সেই উৎস—সন্ধানের প্রেরণা এসেছে এবং সেই ‘অদ্বৈতবাদ’—এর পুনরুজ্জীবন সম্ভবপর হয়েছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই।
শংকরাচার্যর পরে রামানুজ বিষ্ণুস্বামী মাধবাচার্য ও নিম্বার্কের দর্শনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে দেখা যায়। রামানুজ—দর্শনে দেবতা ও মানুষের মধ্যে প্রেম ও ভক্তির সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের জন্য দেবতা ও ধর্মের বাণীও শোনা যায়।২৮ দেবতা আর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে বিষ্ণুস্বামী নিম্বার্কের আধ্যাত্মিক আলোচনা পড়লে নাজজাম আশআরী গিজালী প্রমুখ মুসলমান সাধকদের বিতর্কের কথা মনে পড়ে।২৯ ইসলামধর্মের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শংকরাচার্যর ‘কেবলাদ্বৈতবাদ’ থেকে রামানুজের ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ ও নিম্বার্কের ‘দ্বৈতঅদ্বৈতবাদের’ প্রগতির ধারা বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয়। শংকরের মতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’, রামানুজ ও নিম্বার্কের মতে ব্রহ্ম তো সত্য নিশ্চয়ই, কিন্তু জীব ও জগৎ ব্রহ্মের মতনই সমান সত্য। বৈষ্ণব বৈদান্তিক রামানুজ ও নিম্বার্কের সঙ্গে শংকরের মূলগত প্রভেদ আছে, কিন্তু রামানুজ ও নিম্বার্কের মধ্যে ব্রহ্ম জীব জগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে সাধারণভাবে বিশেষ প্রভেদ নেই। রামানুজের মতে বিষ্ণু, নিম্বার্কের মতে কৃষ্ণই ব্রহ্ম। এঁদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল ব্রহ্মের সঙ্গে জীবজগতের সম্পর্ক নিয়ে শংকর বলেন ব্রহ্ম ও জীবজগৎ অভিন্ন, রামানুজ বলেন স্বরূপ অভিন্ন হলেও ধর্মত ভিন্ন, নিম্বার্ক বলেন স্বরূপত ও ধর্মত উভয়ই ভিন্ন ভিন্ন।৩০ শংকর থেকে নিম্বার্ক পর্যন্ত প্রগতির ধারা হল শুদ্ধ ‘জ্ঞানবাদ’ থেকে ‘ভক্তিবাদ’—এর ক্রমপরিণতির ধারা। শংকরের জ্ঞানবাদ বা মায়াবাদ নৈরাশ্যবাদ বা নিষ্ক্রিয়তাবাদের নামান্তর নয়। শংকরের মতে ব্যাবহারিক স্তর অপারমার্থিক হলেও অপ্রয়োজনীয় নয়। ব্যাবহারিক স্তর কর্ম ও ভক্তির ভিতর দিয়েই জীব সর্বোচ্চ স্তরে ওঠে। শংকরের শুদ্ধ জ্ঞানবাদ ও কঠোর কেবলাদ্বৈতবাদকে একেশ্বরবাদী ইসলামের সঙ্গে ভারতের হিন্দুধর্মের প্রাথমিক পর্যায়ের নির্মম গৌরবের উত্তরাধিকার শংকর বহন করছেন। দক্ষিণ ভারতে তখন নব্যহিন্দুধর্ম জৈন—বৌদ্ধধর্মের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সুতরাং শংকরের ‘কেবলাদ্বৈতবাদ’ হল ইসলামের সাধকদের প্রথম আদর্শ—অভিযানের বিরুদ্ধে বেদ—উপনিষদের মূল থেকে গেঁথে তোলা ইস্পাতের তৈরি প্রতিরোধ—প্রাচীর। তাই শংকর নির্মম নিষ্ঠুর নীরস বিশুদ্ধ জ্ঞানবাদী, তাই তাঁর দুর্ভেদ্য ‘কেবলাদ্বৈতবাদ’। কিন্তু রামানুজ ও নিম্বার্কের সময় ইসলামের সাধকরা খিড়কি দরজা দিয়ে শুধু যে হিন্দুসমাজের ভিতরের উঠোনে পা দিয়েছেন তা নয়, একেবারে অন্দরমহলে পর্যন্ত প্রবেশ করে সেখানে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছেন। তাই কঠোর ‘কৈবলাদ্বৈতবাদ’ থেকে ধীরে ধীরে কঠোর মধুর ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ ও ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন হল। বিশুদ্ধ জ্ঞানবাদের সঙ্গে ভক্তিবাদ মিশিয়ে নীরসকে একটু সরস করতে হল। জনমনকে স্পর্শ করার প্রয়োজন। যাঁরা অনুভব করলেন, স্পর্শ না করে যাঁদের উপায় ছিল না, তাঁরা ক্রমে ভক্তি ও প্রেমের দিকে এগিয়ে গেলেন। ‘একমাত্র ব্রহ্মই সত্য’—দৃপ্তকণ্ঠে শংকরের মতন এই বাণী ঘোষণা করে ধর্মভ্রষ্ট নীতিভ্রষ্ট কুসংস্কারগ্রস্ত শাস্ত্রসর্বস্ব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের চেতনা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন হয়নি তাঁদের। সে কর্তব্য শংকরই অনেকটা পালন করে গেছেন। তাঁদের কর্তব্য হল সুপ্ত গণচেতনাকে উদবুদ্ধ করা, বিভ্রান্ত জনমনকে সচেতন করা, নিস্পন্দ সমাজের বুকে স্পন্দন জাগিয়ে তোলা। তাই ব্রহ্মই একমাত্র সত্য বলে শুধু তিরস্কার করলেই চলবে না, বলতে হবে জীব ও জগৎ ব্রহ্মের মতনই সমান সত্য। বলতে হবে, জ্ঞান ও দর্শনবিচার নয় কেবল, ভক্তি ও প্রেম হল সাধনার পথ। তবেই জনমন সহজে সাড়া দেবে। সুপ্ত গণচেতনা জেগে উঠবে। ইসলামের আত্মনিবেদন, ইসলামের প্রেম, ইসলামের সমানাধিকার ও সাম্যের বাণী, ইসলামের গণতন্ত্রের আদর্শ মুসলমান সাধকরা সহজ ভাষায় সোজাসুজি যখন এ দেশে প্রচার করছেন, রামানুজ ও নিম্বার্ক তখন শংকরের শুদ্ধজ্ঞানের স্তর থেকে শ্রদ্ধা—ভক্তি—প্রীতির স্তরে নেমে এলেন। দু—জনেই ভক্তির পথের পথিক, কিন্তু রামানুজের ভক্তি শ্রদ্ধাপ্রধান, সেখানে উপাস্য—উপাসকের মধ্যে গুরুশিষ্য রাজা—প্রজার সম্পর্ক থাকে, আর নিম্বার্কের ভক্তি মাধুর্যপ্রধান—প্রেমপ্রধান, সেখানে উপাস্য—উপাসকের মিলনের পথ স্বামী—স্ত্রী—র পথ, প্রেমিক—প্রেমিকার পথ, সখা—সখীর পথ। বেশ পরিষ্কার বোঝা যায় যেন দর্শন জ্ঞানের শিখর থেকে নেমে শ্রদ্ধাভক্তির গিরিগহ্বর ভেদ করে প্রেম—প্রীতি—ভাবাবেগের প্রচণ্ড ঝরনাধারা হিন্দু—মুসলিম সংস্কৃতিসমন্বয়ের মহাসমুদ্রে মিলিত হতে চলেছে।*
এতদিন যা মুসলমান সাধকদের ধর্মপ্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে বিজয়ী রাজশক্তির ছায়াতলে তা আরও সক্রিয় হয়ে উঠল। পাঞ্জাব থেকে আসাম, কাশ্মীর থেকে বিন্ধ্যাচল পর্যন্ত দুর্ধর্ষ মুসলিম সেনাবাহিনী অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলল। মনে হল যেন হিন্দু পণ্ডিত ও পুরোহিতদের প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়ে তো যাবেই, হিন্দু সভ্যতা ও হিন্দু—সংস্কৃতির বনিয়াদ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির বনিয়াদ কাঁচা নয়, বহু শতাব্দী ধরে বহু জাতি—উপজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের ফলে তার বনিয়াদ তৈরি হয়েছে। আরবি ঘোড়া ও তলোয়ারের এমন শক্তি নিশ্চয়ই নেই যে সেই বনিয়াদ ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে। ধ্বংস যে কিছুই হয়নি তা নয়। অনেক মন্দির, অনেক শিল্পকলা স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শন ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু তার চাইতে বেশি ধ্বংস হয়েছে হিন্দু সভ্যতার আগাছা, হিন্দু সংস্কৃতির আবর্জনা। তাতে হিন্দু—সংস্কৃতির বনিয়াদ ধ্বংস হয়নি। তার দ্বিতীয় কারণ হল, কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই তার দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ—প্রাচীর দক্ষিণ ভারতে গড়ে উঠেছিল। শংকর রামানুজ নিম্বার্ক প্রমুখ হিন্দু সাধক—দার্শনিকরা মুসলমান সাধকদের বাণী সমীকৃত করে হিন্দু—সংস্কৃতির নতুন সমন্বয়ের বনিয়াদ পাকা করে তৈরি করেছিলেন। হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতিসমন্বয়ের কাজ আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, এখন তার বিস্তার প্রয়োজন, অর্থাৎ আরও ব্যাপক ও গভীর আত্তীকরণ প্রয়োজন।
হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতিসমন্বয়ের কাজ আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে শুরু হল মুসলিম অভিযানের পর থেকে। মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠার পরে শুধু যে অত্যাচার আর লুঠতরাজই চলল তা নয়। মুসলমান শাসনকর্তারা এ দেশে বসবাস ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন অনুভব করলেন। আর্যরাই একদিন এ দেশের অসুর—দানব—যক্ষ—রক্ষ—পিশাচের উপর, অর্থাৎ এ দেশের প্রাগার্য জনসাধারণের উপর কম অত্যাচার করেছিলেন নাকি? তপঃক্লিষ্ট আর্য মুনিদের আশ্রমে ভারতের গণদেবতা শিব বারবার হানা দিয়েছেন। মুনিপত্নীরা সর্বাঙ্গসুন্দর যুবক শিবকে নগ্নবেশে দেখে সভ্যতার সব সীমা লঙ্ঘন করেছেন। মুনিরা ক্রোধে ও ক্ষোভে ‘কাষ্ঠপাষাণপাণয়ঃ’, অর্থাৎ কাঠ—পাথর নিয়ে মার—মার করে তাড়া করেছেন শিবকে। সকলে মিলে শিবের অঙ্গচ্ছেদ করে দিতেও কুণ্ঠিত হননি। কিন্তু তাতে কী হবে? শিব যে এ দেশের গণদেবতা। নারীবেশধারী বিষ্ণুকে নিয়ে মনোরম বেশে পরম সুন্দর দিগম্বর শিব নিশ্চিন্তে মুনিদের দেবদারু বনে বিচরণ করতে থাকেন। মুনিকুমার ও মুনিপত্নীরা তা—ই দেখে কামার্ত হয়ে নির্লজ্জ আচরণ করেন। মুনিরা কত শাপ দেন, লাঠিসোঁটা নিয়ে কতবার তাড়া করেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হয় না।৩১ মুনিকুমার ও মুনিপত্নীদের দাবিই মেনে নিতে হয়। কারা এই মুনিকুমার ও মুনিপত্নী? মুনিপত্নীরা এ দেশের মেয়ে, অনার্য পিশাচ দানব রাক্ষসদেরই মেয়ে। আর্য মুনিরা এ দেশে এসে তাদেরই বিবাহ করে ঘরসংসার পেতেছিলেন। মুনিকুমাররা এ দেশে মেয়েদেরই গর্ভজাত সন্তান, আর্য—অনার্যের নতুন সমন্বয়ের ফল তারা। সুতরাং শেষ পর্যন্ত তাদের দাবিও মেনে নিতে হল। গণদেবতাকে গ্রহণ করতেই হল। শিবলিঙ্গ পূজা প্রবর্তিত হল। বিঘ্ননাশক গণদেবতার পূজা প্রতিষ্ঠিত হল। হোমাগ্নির পাশে শালগ্রাম শিলা স্থান পেল। আর্য—অনার্যের সংস্কৃতিসমন্বয়ে হিন্দু—সংস্কৃতির বিকাশ হল। ঠিক তেমনি, মুসলমান শাসকরা এ দেশে এসে অত্যাচার ও লুঠতরাজ কম করেননি, জনসাধারণের প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের আগুনও তাঁদের বিরুদ্ধে বহুবার জ্বলে উঠেছে। কিন্তু তাঁদের এ দেশেই বসবাস করতে হয়েছে, এ দেশের আপনার জন হতে হয়েছে। এ দেশের হিন্দু মেয়েদের তাঁরা বিবাহ করেছেন, তাঁদের আরবি আফগান পারসি রক্তের সঙ্গে হিন্দুর রক্ত মিশে গেছে। অসংখ্য অনুন্নত নিম্নবর্ণের লোক যারা এ দেশে ইসলামধর্মের দীক্ষা নিয়েছে তারাও আরব—পারস্যের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে আনেনি, এ দেশের সংস্কৃতিকেই বহন করে নিয়ে গিয়ে ইসলামের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। মুসলমান সাধকরাও আগে থেকে এই মেলানো—মেশানোর কাজ শুরু করেছিলেন। সুতরাং সংঘর্ষের পথে নয়, বিভেদ—বিরোধের পথে নয়, সমন্বয়ের মহাসাগর অভিমুখে হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতির যুক্তবেণি প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়েছে।
মহাসাগরের বুকে মিলিত করা পণ্ডিত বা দার্শনিকদের দ্বারা সম্ভব হল না। তাঁরা শুধু দূর থেকে মিলনের পথটি দেখিয়ে দিলেন। নিজেদের শাস্ত্র ও ধর্মের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তাঁরা কেউ উদ্দাম বেগে এগিয়ে যেতে পারলেন না। দুই কূল ভাসিয়ে উদ্দাম জোয়ার এল যখন তখন বাদশাহের বেশে বিজয়ী ইসলাম এসে বসল ভারতের সিংহাসনে। সেতু রচনা করার কাজে এগিয়ে এলেন যাঁরা তাঁরা অধিকাংশই নিরক্ষর দীন দরিদ্র নীচকুলজাত। দু—একজন ব্রাহ্মণ বা পণ্ডিত যে তাঁদের মধ্যে ছিলেন না তা নয়। রামানন্দ নিজে ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভারমুক্ত হয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। রামানন্দ বাহ্য আচার ছাড়লেন, সংস্কৃত ছেড়ে চলতি ভাষায় উপদেশ দিলেন। যে ভক্তিবাদের জন্ম দ্রাবিড়ে রামানন্দ তাকে উত্তর ভারতে নিয়ে এলেন।
ভক্তি দ্রাবিড় উপজী লায়ে রামানন্দ।
প্রগট কিয়ো কবীরনে সপ্তদ্বীপ নৌ খণ্ড।
রামানন্দর প্রধান দ্বাদশ শিষ্যের মধ্যে রবিদাস মুচি, কবীর জোলা, সোনা নাপিত, ধন্না জাঠ, পীপা রাজপুত। তা ছাড়া নামদেব দরজি, সদনা কসাই। সুন্দরদাস বৈশ্য, দাদূ ও রজ্জবের জন্ম মুসলমান ধুনুরির বংশে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের শাস্ত্রের সীমানা ছাড়িয়ে এই মুচি জোলা নাপিত দরজি কসাই ধুনুরিরা এগিয়ে এলেন ভক্তির পথে মহামিলনের উদ্দেশ্যে। কবীর বললেন :
জৌর খুদাই মসীত বসন হৈঁ ঔর মুলিক কিস কেরা।
তীরথ মূরতি রাম নিবাসা দুহুঁ মৈ কিনহূঁ ন হেরা।।
পূরিব নিশা হরী কা বাসা পছিম অলহ মুকামা।
দিল হী খোজি দিলৈ দিল ভীতরি ইঁহা রাম রহিমানা।।
‘খোদা যদি মসজিদেই বাস করেন তবে আর সব মুলুক কার? তীর্থের মূর্তিতেই যদি রামের বাস হয় তাহলে এই দ্বৈতভাবের মধ্যে সত্য কোথায়? হায়! পুবে হরির বাস আর পশ্চিমে আল্লার মোকাম! আরে খুঁজে দেখ নিজের হৃদয়ের মধ্যে, সেখানেই রাম রহিমান।’
হিন্দু মুয়ে রামকহি মুসলমান খুদাই।
কহৈ কবীর সো জীবতা দুহ মৈঁ কদে ন জাই।।
‘হিন্দু মরে রাম রাম করে, মুসলমান মরে খোদা খোদা করে, কিন্তু কবীর বলেন, এসব ভেদবুদ্ধির মধ্যে যে না পড়ল সে—ই তো বাঁচল।’ মিলন কি সহজে হয়? কবীর বলছেন :
কিতনো মনাউঁ পাঁব্ পড়ি, কিতনোউঁ রোয়,
হিন্দু পূজৈ দেবতা, তুর্ক ন কাহূ হোয়।
‘কত মিনতি করলাম পায়ে ধরে, কত মিনতি করলাম কেঁদে, কিন্তু হিন্দু তার দেবদেবীকেই পূজা করে চলল, আর মুসলমানও কারও আপন হল না।’ তাই কবীর বারবার মিনতি করে বলছেন :
হিন্দু তুর্কহি মিলিকে মানহুঁ বচন হমার।
‘হিন্দু—মুসলমান উভয়ে মিলে আমার কথা শোনো।’ দক্ষিণ ভারত থেকে রামানন্দ উত্তর ভারতে ভক্তির যে ভাবধারা নিয়ে এলেন, কবীর তাকে ছড়িয়ে দিলেন চারিদিকে। দাদূ—রজ্জব সকলে সেই পথ ধরেই এগিয়ে চললেন। দাদূ বললেন :
অলহ রাম ছুটা ভ্রম মোরা
হিন্দু তুরক ভেদ কুছ নাহি।
‘আল্লা আর রামের ভুল আমার ভেঙেছে, হিন্দু আর মুসলমানে কোনও ভেদ নেই।’
হিংদু লাগৈ দেহুরৈ, মুসলমান মসীতি।
‘হিন্দু লেগে রইল তার দেবালয়ে, আর মুসলমান লেগে রইল তার মসজিদে’। দাদূ তাই বললেন :
না হম হিংদু হৌহিংগে, না হম মুসলমান।
‘না হব আমি হিন্দু, না হব মুসলমান।’
কবীর—দাদূর এরকম অজস্র বাণী উদ্ধৃত করা যায়।৩২ সব বাণীরই মূলসুর হল জাতিসাম্য, সাম্প্রদায়িক একতা আর অদ্বৈতবাদ। কবীর কোনো জাতবিচার মানতেন না। তিনি বললেন, ‘ওহে পাঁড়ে (ব্রাহ্মণ), কী মিথ্যা ছোতবিচার করো! ছোঁয়াছুঁয়ি থেকেই তো এসংসারের সব কিছুর উৎপত্তি। তোমাতে—আমাতে রক্তে আর দুধে কোনও ভেদ আছে কি? তবে তুমিই বা কীসে ব্রাহ্মণ হলে, আর আমিই বা কীসে শূদ্র হলাম? ছুত ছুত করেই যদি জন্মালে তাহলে অশুচি গর্ভবাসের পথে কেনই বা এলে তুমি ব্রাহ্মণ?’ দাদূও বললেন, ‘হিন্দু—মুসলমানে কোনও ভেদ নেই। সেই একই প্রাণ, একই দেহ, একই রক্তমাংস, একই চোখ—নাক, সেই একই কানে শব্দ বাজে, একই জিবে মিষ্টি রস লাগে, সেই একই ক্ষুধায় সবাই ব্যাকুল হয়, একই ভাবে সবাই জাগে…অথচ কী যে তামাশা, তাতেও এত ভেদাভেদ।’
কবীর—দাদূ রজ্জবের ধারায় আরও অনেক হিন্দু—মুসলমান সাধক ও সুফি এই ধর্মসমন্বয়ের বাণী, জাতিসাম্য ও সাম্প্রদায়িক একতার বাণী প্রচার করেছেন। একদেবতার কাছে আবেগময় আত্মসমর্পণের ভাব তাঁদের ধর্মের মধ্যেও ফুটে উঠেছে। সুফিরা তো সমাজধর্মত্যাগী, তাঁদের পথ প্রেমের পথ। প্রেমসমাধিকেই সুফিরা বলেন ‘ফানা’। এই ‘ফানা’র ভিতর দিয়েই জীবসত্তা ডুবে গিয়ে দেবতার প্রেমসত্তার সঙ্গে লীন হয়ে যায়। সিন্ধুদেশের সুফি শাহ ইনায়ৎ ও শাহ লতিফ সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ভ্রাতৃত্বের উপদেশ দিয়ে গেলেন। শাহ লতিফ পীঠস্থান ‘ভিটে’ আজও সকলে তীর্থযাত্রায় যান। দিল্লির বাবরি সুফী, তাঁর শিষ্য বীরু হিন্দু, তাঁর শিষ্য য়ারী শাহ সুফি। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। এঁদের ধারাতে কেশবদাস, বুল্লা, গুলাল সাহেব প্রভৃতির পরে জগজীবন ‘সৎনামী’ সাধনা প্রবর্তন করেন। তার মধ্যে হিন্দু—মুসলমানে কোনও ভেদ নেই। মুসলমান গুরুর শিষ্য ব্রাহ্মণ ভীখা, ভীখার শিষ্য গোবিন্দ এবং তাঁর শিষ্য পলটু সাহেব। পলটু সাহেব বলেন, ‘ভগবান কোন জাতের, কোন—সম্প্রদায়ের বিশেষ সম্পত্তি নন। জাত পঙক্তির ক্ষুদ্র পরিচয় ছাড়ো।’
এ দেশের মুসলমান সাধক ও সুফিরাই যে শুধু হিন্দু সাধকদের সঙ্গে একসুরে সাম্প্রদায়িক একতা ভ্রাতৃত্ব প্রেম ও একদেবতার বাণী প্রচার করেছেন তা নয়। আগেই বলেছি, প্রায় অষ্টম শতাব্দী থেকেই মুসলমান সাধকরা আরব ও পারস্য থেকে দক্ষিণ ভারতে এসে ইসলামধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। তাঁদের ধর্মপ্রচারের মধ্যেও সেদিন সমন্বয়েরসুর ফুটে উঠেছিল। শুধু দক্ষিণ ভারতে নয়, উত্তর ভারতেও আরব পারস্য থেকে মুসলমান সাধকরা ধর্মপ্রচারের জন্য এসেছিলেন। মুসলিম অভিযানের আগেই তাঁরা এসেছিলেন, কেউ কেউ অভিযানে পরোক্ষে সাহায্যও করেছিলেন। কিন্তু সকলেই তো করেননি। উত্তর ভারতে মুসলমান সাধকদের বাদশা হলেন খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী*। পারস্যের কাছে শিসস্তান বা চিশস্তান অনেক পুরোনো শহর। অনেক মুসলমান সাধক এখানে জন্মেছেন। তাঁরা সকলে চিশত দরবেশ নামে পরিচিত। মঈনউদ্দীন জন্মেছিলেন ১১৪২ সালের কাছাকাছি। প্রায় চল্লিশজন শিষ্যসহ তিনি দিল্লিতে আসেন। দিল্লির যে অশ্বত্থ গাছের তলায় খাজা সাহেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে দ্বিপ্রহরের নামাজ পড়েছিলেন, আজও নাকি সেখানে সেই গাছের তলায় কালো পাথরের উপর তাঁর পায়ের চিহ্ন আঁকা আছে। তারপর মঈনউদ্দীন সাহেব আজমীড় যান। সেখানেই তিনি সারাজীবন সাধনা করে দেহত্যাগ করেন। আজও আজমীড় শরিফে মঈনউদ্দীনের সমাধিসৌধ দেশ—বিদেশের সকল মানুষের, হিন্দু—মুসলমানের তীর্থস্থান। খাজা সাহেবের অসংখ্য শিষ্য বা ‘মুরিদ’ ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শোনা যায় ১২০ জন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন আর ৬৫ জন আল্লার প্রিয় সাধক হন। এই সাধকদের মধ্যে খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী অন্যতম। শাহ নিজামউদ্দীন আওলিয়া চিশতী ও হজরত সেলিম শাহ চিশতী তাঁর শিষ্য। শাহ নিজামউদ্দীন আওলিয়া ও কুতুবউদ্দীন বখতিয়ারের সমাধি দিল্লিতে এবং হজরত সেলিম শাহ চিশতীর সমাধি ফতেপুরসিক্রিতে আজও হাজার হাজার হিন্দু—মুসলমানের সমাগম হয়।৩৩ ভারতের আদি সুফি সাধক মখদুম সৈয়দ আলি অল হুজবেরীর সমাধিস্থান লাহোরের ভাটি দরবাজারের কাছে। এঁদের সকলের সাধনার ধারা একরকম এবং এঁরা অনেকেই কবীরের আগেই এই ভাবধারা প্রচার করেছিলেন। খাজা মঈনউদ্দীন চিশতীর কোনও শিষ্যের একটি গান এখানে উদ্ধৃত করছি :
খাজা নাম মধুর—পিয়রে মনুয়া দুনিয়াদারী সব ঝুটা,
এই দুনিয় দারী সব ঝুটারে মনুয়া—দুনিয়াদারী সব ঝুটা।
খোদা নামছে ধনু বনা’য়ে মহাম্মদ নামছে বাঁশী,
ফাতেমা নামছে অসি বনা’য়ে কাট মায়ার ফাঁসী।
রে মনুয়া! দুনিয়াদারী সব ঝুটা
রে মনুয়া! দুনিয়াদারী সব ঝুটা
আলী নামছে কিস্তী বনা’য়ে, হাছান নামছে পাল,
হোছেন নামছে হাল বনা’য়ে দরিয়া পারহো চ’ল।
রে মনুয়া! দুনিয়াদারী সব ঝুটা
লোহা কাঁসাকো সোনা বনাদে সাফাকর দেতা হায় জঙ্ক
গরীব নেওয়াজে জান সঁফিয়ে মিটা দেলকো রঞ্জ।
রে মনুয়া! দুনিয়াদারী সব ঝুটা
রে মনুয়া! দুনিয়াদারী সব ঝুটা।
উত্তর ভারতের মুসলমান সাধকদের ভাবধারা কবীর—দাদূকে কম অনুপ্রাণিত করেনি। দ্রাবিড় দেশ থেকে রামানন্দ যে ভক্তি ও প্রেমের ভাবধারা উত্তর ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন, কবীর তাকেই প্রচার করেছিলেন। কিন্তু উত্তর ভারতের চিশতী দরবেশদের ভাবধারাও তাঁর উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল বলে মনে হয়। হিন্দু—মুসলমানের ভাবসমন্বয়ে তাঁদের দানও কম নয়।
মানসলোকের এই হিন্দু—মুসলমান ভাবসমন্বয় স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে ও চিত্রকলায় ফুটে উঠল। মুসলমান শিল্পীরা পারস্যের ‘শৈলী’ এ দেশে যে নিয়ে আসেননি তা নয়। কিন্তু হিন্দু—বৌদ্ধ শিল্পীদের প্রতিভার কথা আবুল ফজলও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি।৩৪ বিজাপুর দিল্লি ফতেপুরসিক্রি আহমেদাবাদে যেসব মসজিদ গড়ে উঠল তার মধ্যে হিন্দু শিল্পীদের হাতের ও মনের স্পর্শ এত স্পষ্ট যে তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সূক্ষ্ম কারুকাজ—করা আর আধ্যাত্মিক ভাবমণ্ডিত এইসব মসজিদের কাছে আরব তুরস্ক মিশর স্পেনের মসজিদ ম্লান হয়ে যায়।৩৫ মোগল ও রাজপুত চিত্রকলাও ঠিক সে যুগের স্থাপত্যের মতন হিন্দু—মুসলমান উভয়েরই। মধ্য এশিয়া ও পারস্যের চিত্রকলার প্রভাব এর মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠলেও, মোগল বাদশাহ ও নবাবদের রাজদরবারে, অথবা রাজপুতানা তাঞ্জোরের হিন্দু রাজাদের প্রাসাদে যে নতুন চিত্রকলার বিকাশ হল তা কোনও বিদেশি শিল্প বা শিল্পীর হুবহু নকল নয়। তার মধ্যে এ দেশের হিন্দু—মুসলমান শিল্পীর হাতের ও মনের ছাপ রইল, নিজের বিশিষ্টতায় সে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই চিত্রকলাকে আমরা ‘হিন্দু—মুসলিম চিত্রকলা’ বলতে পারি।৩৬ ভাবরাজ্যে জোলা নাপিত কসাই ধুনুরিদের প্রাধান্যের যুগে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সংস্কৃত ভাষার সমাদর যে কমে যাবে, তার গোঁড়ামি যে ভেঙে যাবে তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রাকৃত মনের ভাবপ্রকাশের জন্য সকলের বোধগম্য সহজ প্রাঞ্জল ভাষার প্রয়োজন। সংস্কৃত অথবা আরবি—ফারসির সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে ভাষাকে আর বন্দি করে রাখা চলল না। যুগের তাগিদে, জনমনের ব্যাকুলতায় সংস্কৃত—আরবি—ফারসির আভিজাত্য ভেঙে গেল, হিন্দি—উর্দু—বাংলা ভাষার জন্ম হল। বাদশাহদের মনোরঞ্জন করার জন্য দরবারকবি ও পণ্ডিতরা এসব ভাষা সৃষ্টি করেননি।৩৭ যিনি যত বড় দুর্ধর্ষ শাসক হন না কেন, ভাষা কখনো কোনও দেশের শাসকের ফরমায়েশমতন সৃষ্ট হয় না। ভাষা বহতা নদীর মতন। জোর করে দুর্বোধ্যতার গিরিকন্দরে ব্যাকরণবিধির শিলা—উপশিলা বুকে চেপে রেখে তার গতি চিরদিন রোধ করে রাখা যায় না। সুপ্ত গণচেতনা যখন জাগে, যুগের দাবি যখন আসে, জনমন যখন জাতির ভাবধারা সংস্কৃতি সম্পদ গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তখনই ভাষা সেই সংকীর্ণতা গোঁড়ামির অবরোধ ভেঙে কুলকুল করে বইতে থাকে। ভাষা হয় প্রাকৃতজনের, প্রাকৃত মনের ভাষা। বাদশাহরা হয়তো শাস্ত্র পুরাণ অনুবাদে কেউ কেউ উৎসাহ দিয়েছেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতই হন আর আরবি—ফারসির মৌলবিই হন, হিন্দি—উর্দু—বাংলা ভাষা সৃষ্টি করতে যাঁরা সাহায্য করেছেন তাঁরা বাদশাহ—রাজরাজড়ার ইচ্ছায় করেননি, জনমনের তাগিদে, যুগের দাবিতে আবেগে করেছেন। হিন্দু—মুসলমান প্রাকৃতজনের ভাবসমন্বয় ভাষার মধ্যে ফুটে উঠেছে।
এইভাবে ভারতের হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতির যুক্তবেণির মিলন হল সমন্বয়ের মহাসাগর। ব্রাহ্মণ্যবাদের জড়তা, গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডূকবৃত্তিতে আঘাত লাগল। ভারতের সাধনা উত্তুঙ্গ জ্ঞানমার্গ থেকে, বহুদেবতার কোলাহলমুখর স্বর্গলোক থেকে নানা সুরে অদ্বৈতবাদের একতারা বাজিয়ে নেমে এল নিচে, ভক্তির ও প্রেমের, সাম্যের ও ঐক্যের গণমানসসমুদ্রে মিশে গেল। সাধনায় একমাত্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশানুক্রমিক অধিকার রইল না, জোলা নাপিত কসাই হিন্দু—মুসলমান সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। ইসলামও তার শরিয়তি চৌহদ্দি ছাড়িয়ে হিন্দু—সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবিত উদার ভাবধারার সঙ্গে মিশে গেল। চিশতী দরবেশ, মুসলমান সাধক ও সুফিরা ইসলামকে ভারতীয় রূপ দিলেন। মুসলমান মৌলবি পণ্ডিতরাই যে ইসলামধর্মের সাধনায় প্রবৃত্ত হলেন তা নয়, সমান ধুনুরি কসাই সকলেই নতুন হিন্দু—মুসলমান ধর্মসমন্বয়ের পথে এগিয়ে এলেন। সংস্কৃত—আরবি—ফারসি থেকে সহজ সরল প্রাকৃতজনের হিন্দি—বাংলা—উর্দু ভাষার সৃষ্টি হল। স্থাপত্যে—শিল্পকলায় হিন্দু—বৌদ্ধ—পারসি—আরবি ভাব ও শৈলীর সমন্বয় হল। ভারত—সংস্কৃতির নতুন যে বনিয়াদ গড়ে উঠল তা হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতির বনিয়াদ। সমন্বয়ের ধারা তার অবিচ্ছিন্ন রইল, কিন্তু সেই ধারা পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ হল।
ভারতের এই হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়েও বাংলা তার নিজের বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাংলার এই বিশিষ্টতার কথা আগে বলেছি। বাংলা দেশ মানবপন্থী, শাস্ত্রপন্থী নয়। বাংলার দেবতারাও সাধারণ মানুষের মতন সুখে—দুঃখে হাসেন—কাঁদেন, প্রেমে উতলা হন। দুই পাড় ভেঙে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখানকার নদনদীর ধর্ম। প্রকৃতি এখানে অকৃপণ, বর্ষণকাতর এখানকার পলিমাটি উর্বর। তাই বাংলার ধর্ম, বাংলার সংস্কৃতি দুই পাড় ভেঙে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাংলার মিলন শুধু বুদ্ধির মিলন নয়, বাংলার সমন্বয় শুধু আদর্শের সমন্বয় নয়, আবেগের সমন্বয়। বাংলার মহাযান বৌদ্ধমত, বজ্রযান শৈবমত সব এই আবেগের জোয়ারে ভেসে গেছে। বাংলার বৈষ্ণবধর্মও কোনও বন্ধন, কোনও বিধিনিষেধ মানেনি।
বাংলায় শ্রীচৈতন্য যখন জন্মালেন৩৮ তখন বিজয়ী মুসলমান রাজশক্তি দেশের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, নব্যন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের পণ্ডিতেরা তাঁর সামনে বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু করেছেন। তখন বৌদ্ধধর্মের অবসান ও অবনতির যুগ। বিকৃত তান্ত্রিকতা ও সহজিয়া মতের পাঁকের মধ্যে তখন মহাযানের মহান আদর্শ ডুবে গেছে। ভাবাবেগের আতিশয্যে তখন আদর্শের বাঁধ ভেঙে ব্যভিচার ও দুর্নীতির বন্যা নেমেছে দেশে। বাংলার প্রকৃতির বিশেষত্ব তখন আদর্শ—বিকৃতির মধ্যে ফুটে উঠেছে। বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা হয় নালন্দার বিহারের মতন অন্যান্য বিহারের ধ্বংসের সময় নিহত হয়েছেন মুসলমানদের তরবারির আঘাতে, আর না হয় পুঁথিপত্র নিয়ে নেপালে পালিয়ে গেছেন। স্মার্ত পণ্ডিতরা নব্যব্রাহ্মণ্যধর্মের কঠোর চৌহদ্দির মধ্যে শিথিল সমাজকে আবার শক্ত করে বাঁধতে চাইলেন। তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি—পাণ্ডিত্যের কাছে সকলেই সসম্ভ্রমে মাথা হেঁট করল, কিন্তু দূর থেকে ভয়ে ভয়ে। স্মার্ত রঘুনন্দনের রক্তচক্ষু কপালেই উঠে রইল, নতুন মুসলমান রাজশক্তির বিরুদ্ধে যেন ক্রোধোদ্দীপ্ত নব্যব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিমূর্তি তিনি। বিভ্রান্ত বিপর্যস্ত জনসাধারণের প্রতি কোনও মমত্ববোধ, কোনও দরদ ছিল না পণ্ডিতদের। শাস্ত্র আর নীতির সূত্র দিয়ে তারা সব বিচার করেছিলেন। বাংলার জনসাধারণ কেন দলে দলে ইসলামধর্মে দীক্ষা নিচ্ছিল, কোথায় তাদের বেদনা, কোথায় সমাজের গলদ তা তাঁদের বিচার করার অবকাশ হয়নি। তাঁরা দেখেছেন কেবল ইসলামের তরবারি আর বল্লম, জনসাধারণের মনোবিকার আর দুর্নীতিপরায়ণতা। তাই শিখা আর পইতা নিয়ে তাঁরা কঠোর কণ্ঠে শাস্ত্রের নীতিসূত্র আবৃত্তি করেছিলেন, জনসাধারণ দূর থেকে শ্রদ্ধা আর প্রণাম জানিয়ে সরে গিয়েছিল। এই অবস্থার মধ্যে শ্রীচৈতন্য জন্মালেন। শাস্ত্রপন্থী স্মার্তপণ্ডিতদের সংকীর্ণ অলিগলিতে নয়, মানবপন্থী বাংলার উদার আকাশের তলায়, প্রেম ও ভাবাবেগের প্রশস্ত পথের উপর শ্রীচৈতন্য এসে দাঁড়ালেন ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে।
শংকর রামানুজ নিম্বার্ক মধ্ব বল্লভ প্রমুখ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যকারদের মধ্যেকার সম্প্রদায়ভুক্ত চৈতন্য ছিলেন তা নিয়ে এখানে আলোচনার কোনও প্রয়োজন নেই।৩৯ এখানে তা গৌণ। আগেই বলেছি, শংকর থেকে নিম্বার্ক পর্যন্ত জ্ঞানবাদ থেকে ভক্তিবাদের ক্রমপরিণতি লক্ষ করা যায়। নিম্বার্কের ভক্তিবাদ বিশেষ করে আবেগপ্রধান ও প্রেমপ্রধান। শ্রীচৈতন্য কোনো বিশেষ সম্প্রদায়—ভুক্ত না হলেও, ভক্তিবাদের এই আবেগপ্রধান প্রেমপ্রধান ধারার বিকাশই যে তাঁর বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে, অর্থাৎ বাংলার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে হয়েছে তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। শ্রীচৈতন্য তো শুধু নবদ্বীপেই বন্দি হয়ে ছিলেন না। সারা ভারত তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, নানা প্রদেশের বৈষ্ণব ও শৈব সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন। নানা ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল এ কথা যদি না—ও মেনে নেওয়া যায়, তাহলেও সংস্কৃত আরবি ফারসি হিন্দি ওড়িয়া মৈথিল তামিল তেলুগু মালয়লম প্রভৃতি ভাষায় তাঁর চলনসই জ্ঞান ছিল বলে মনে হয়।
এদেশে ভ্রমি দীর্ঘকাল,
সকলের ভাষা বুকে শচীর দুলাল।
—গোবিন্দদাস
সুতরাং চৈতন্যকে বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ভুক্ত না করেও বলা যায়, তাঁর মধ্যে আবেগপ্রধান, প্রেমপ্রধান ভক্তিবাদই মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই ভক্তিবাদের মধ্যে শ্রীচৈতন্য বাংলার বিশিষ্টতা দান করেছেন। যা ছিল আবেগপ্রধান তা বাংলার শ্রীচৈতন্যর কাছে আবেগসর্বস্ব হয়েছে, যা ছিল প্রেমপ্রধান তা প্রেমময় প্রেমসর্বস্ব হয়েছে।
সংস্কৃতিসমন্বয়ের যুগসাধক শ্রীচৈতন্য বুঝলেন, শাস্ত্রের বাঁধাধরা পথে বাংলার জনমনের মোড় ফেরানো যাবে না, যায়নি কোনওদিন। মানবপন্থী বাংলার চিরদিনের পথ মানবতার পথ, উদারতার পথ, প্রেমের পথ। তাই ইসলামের বাইরের রণমূর্তি, উদ্যত তলোয়ার—বল্লম দেখে তিনি ভয় পেলেন না। বাংলার প্রাকৃতজনের ধর্মান্তরকে তিনি কেবল নীতিভ্রষ্ট নিরক্ষর অজ্ঞ জনসাধারণের মনোবিকার বলে রক্তচক্ষু ললাটে তুললেন না। তিনি বুঝেছিলেন, ইসলামের আবেদন কোথায়, কোথায় তার অন্তর্নিহিত শক্তি। রাজশক্তি যতই উগ্র অত্যাচারী হোক—না কেন, শুধু তার প্রতাপেই কোনও জাতিকে এমন বিপুল বেগে নতুন ধর্মের পথে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। আরবের অসংখ্য জাতি—উপজাতি ইসলামধর্মের পাশে শুধু তলোয়ারের ঝলকানি দেখে সংঘবদ্ধ হয়নি। বাইরের কোনও দেশেই ইসলামের প্রভাব বিস্তার কেবল ঘোড়া আর তলোয়ারের জোরে সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও ধর্মের বিস্তার কেবল হানাহানির পথে হয়নি, না বৌদ্ধধর্মের, না খ্রিস্টধর্মের, না ইসলামের। মানবধর্মই সব ধর্মের আদি রূপ, জনমানসের অভিব্যক্তিই তার প্রথম প্রকাশ, প্রাকৃতজনের কামনা—বেদনাই তার মধ্যে রূপায়িত। তাই প্রাচীন যুগে ও মধ্যযুগে, কামনা—বাসনা পরিতৃপ্তির অন্য সব পথ যখন বন্ধ তখন মানবধর্মের মধ্যেই জনমনের চাহিদা চরিতার্থ হয়েছে। তারপর সেকালের শ্রেণিসমাজের অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি ঘটেছে, মানবধর্ম হয়েছে শাসক ও তার পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির শাসন—শোষণের হাতিয়ার, ভিক্ষু—ভিক্ষুণীর ধর্ম, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত—পুরোহিতের ধর্ম, মোল্লা, মৌলবির ধর্ম; কিন্তু কোনও ধর্মেরই আসল আদিরূপ তা নয়, তার বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক পরিণতি মাত্র। সকল ধর্মের ক্ষেত্রে যা সত্য, ইসলামধর্মের ক্ষেত্রে তা মিথ্যা নয়। ইসলাম যখন এ দেশে এসেছিল তখন শুধু ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে তলোয়ার ঘুরিয়ে আসেনি, মুসলমান সাধকরাও ইসলামের বাণী প্রচার করতে করতে এসেছিলেন। সারা ভারতের মতন বাংলা দেশেও মুসলমান সুফি সাধক পির ফকিরের অভাব ছিল না। হিন্দুর বিশুদ্ধ দেবতারা পর্যন্ত মুসলমান পির ফকিরদের চেষ্টায় বাংলার হিন্দু—মুসলমানের মিশ্রদেবতা সত্যপির মানিকপির কালুগাজি রূপে দেখা দিয়েছিলেন। বাংলার উত্তাল জনসমুদ্রের দিকে চেয়ে শ্রীচৈতন্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন, জাতিবিদ্বেষ—বর্ণবিদ্বেষ জর্জর শাস্ত্রপীড়িত আচারক্লিষ্ট বাংলাদেশে এই তরঙ্গবিক্ষোভ স্বাভাবিক। ইসলামের সাম্য ও ঐক্যের বাণী বোধহয় তাঁর মতন করে আর কেউ আত্মসাৎ করেননি, ভারত—পন্থরাও না। কারণ এমন তরঙ্গবিক্ষোভ আর কোথাও সৃষ্টি হয়নি, এমন করে দুই পাড়—ভাঙা ভাঙনের বন্যা আর কোথাও আসেনি। এ হল বাংলারই বৈশিষ্ট্য। কবীর—দাদূ তো শুধু মিনতি করে বড়জোর পায়ে ধরে বলেছিলেন, ‘হিন্দু—মুসলমান! আমাদের বচন মানো।’ কিন্তু বাংলার শ্রীচৈতন্য শুধু মিনতি করেই ক্ষান্ত হননি, সাম্য, মৈত্রী আর একতার ‘বাণী’ রচনা করাই যথেষ্ট মনে করেননি। তিনি গান গেয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সঙ্গে পল্লিপ্রান্তরে বাংলার প্রাকৃতজনও গান গেয়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের চরম অধঃপতন, ইসলামধর্মের আন্তরিক আবেদন, নব্যরাজধর্ম ও হিন্দুধর্ম উভয়েরই রক্তচক্ষুর সামনে শ্রীচৈতন্য নতুন সুরে, অভিনব ভঙ্গিতে গান গেয়ে উঠলেন। শুধু ‘যবন হরিদাস’ তো দেশে শান্তি আনতে পারবেন না, কারণ সমাজে জগাই—মাধাইয়েরও যে অন্ত ছিল না।
ব্রাহ্মণ হইয়া মদ্য গোমাংস ভক্ষণ,
ডাকা চুরি গৃহদাহ করে অনুক্ষণ।
—চৈতন্য ভাগবত
ব্রাহ্মণ্যধর্মের চরম অবনতির মূর্তিমান প্রতীক জনার্দন—নন্দন জগাই আর রঘুনাথ—নন্দন মাধাই। জগাই—মাধাইয়ের মুক্তির মধ্যে শ্রীচৈতন্যর শক্তিই প্রকাশ পেয়েছে, আর সেই শক্তির চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছে যবন হরিদাসের ধর্মান্তরের মধ্যে। সেদিনের বাংলার সমাজের প্রতিচ্ছবি জগাই—মাধাই, আর ‘যবন হরিদাস’ শ্রীচৈতন্যর নতুন আদর্শ সমাজের মানুষ।
ইসলামি আদর্শের বিপুল বন্যা এবং মুসলমান রাজশক্তির প্রবল প্রতাপের বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্য কী নিয়ে সংগ্রাম করেছিলেন? কী তাঁর হাতিয়ার? তিনি ইসলাম—বিরোধী ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হননি, তাই শাস্ত্র তাঁর হাতিয়ার নয়। প্রতিপক্ষের পণ্ডিতদের সঙ্গে কোনও ধর্মসমস্যা সমাধান করার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্যও তিনি উদগ্রীব ছিলেন না। সব ধর্মই ‘মানবধর্মরূপে’ শ্রেষ্ঠ ধর্ম। সেই মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ধর্মরক্ষা হবে, মানবতার পথেই ধর্ম বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। এই মানবধর্ম প্রচারের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার শ্রীচৈতন্য আবিষ্কার করলেন জনসংগীত, সংঘসংগীত বা সংকীর্তনের মধ্যে। ‘আবিষ্কার’ করলেন বললে কোনও ভুল হয় না; কারণ যা বিস্মৃতির অন্ধকারে, জাতীয় অবনতির পাঁকের মধ্যে হারিয়ে যায়, ডুবে যায়, তাকে জাতিরপুনরুজ্জীবনের জন্য আবিষ্কারই করতে হয়। শ্রীমদভাগবতে কীর্তনগানের কথা থাকেলও,৪০ শ্রীচৈতন্যই তাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। শুধু আবিষ্কার নয়, চৈতন্য তাকে রূপান্তরিত করেছিলেন। ভাগবতের কীর্তন আর শ্রীচৈতন্য—প্রবর্তিত বাংলার বৈষ্ণবদের সংকীর্তন এক নয়। এই সংকীর্তনই হল শ্রীচৈতন্যর শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। কেন?
মানুষের বাসনা কামনা আবেগ আকুলতা প্রকাশের আদি অকৃত্রিম বাহন ভাষা নয়, সাহিত্য নয়, অঙ্গভঙ্গি ও নৃত্য এবং সুর ও সংগীত। এখনও তাই নৃত্য—সংগীতের আবেদন জনমনের কাছে সবচেয়ে বেশি। শ্রীচৈতন্যর ভাবাবেগপ্রধান সংঘনৃত্য ও সংঘসংগীত বা সংকীর্তন তাই শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার এবং অভিনব টেকনিক। সমস্ত সমাজকে, সমস্ত মানুষকে সংঘবদ্ধভাবে জাগাতে হলে এই জনসংগীতের ভিতর দিয়েই জাগাতে হবে। তাই যে সংকীর্তন শুনে নবদ্বীপের ভট্টাচার্যরা হল্লা—চিৎকার বলে বিদ্রুপ করেছেন, নবাব কাজিয়া হুমকি দিয়েছেন, সেই সংকীর্তন শুনে তাঁদের কুলাঙ্গার বংশধররা আবার মানুষ হয়েছে, কাজিরা নিজেরাই তাতে যোগ দিয়েছেন। কীর্তন তো শ্রীবাসের আঙিনায় আবদ্ধ করে রাখার জন্য শ্রীচৈতন্য আবিষ্কার করেননি। সংকীর্তন তিনি সৃষ্টি করেছিলেন সকলের জন্য, জনসাধারণের জন্য, গণমানসকে নতুন ভাবাদর্শের পথে পরিচালিত করার জন্য। তাই কীর্তন শ্রীবাসের আঙিনা থেকে নগরের রাজপথে এসে ‘নগরকীর্তন’ হল। হাজার হাজার নর—নারী, হিন্দু—মুসলমান সেই নগরকীর্তনে যোগ দিল। জনসমুদ্র সুরের তরঙ্গে, নৃত্যের আবর্তে উদবেল হয়ে উঠল। কাজিগাজি, বামুন পণ্ডিতেরা তৃণখণ্ডের মতন সেই তরঙ্গের তলায় তলিয়ে গেলেন। না—যাওয়াই আশ্চর্য, কারণ এত প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতিয়ার নিয়ে তো এর আগে আর কেউ আসেননি। মানবতার বাণীর ভিতর দিয়ে এই সংকীর্তনের মধ্যেই বাংলার শ্রীচৈতন্য বাংলার বিশিষ্টতাকে রূপ দিয়েছেন।
কবীর—দাদূর বাণী আর শ্রীচৈতন্যর বাণীর মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। কবীর দাদূ কেন, বৈদিক ঋষিদের বাণী, মহাবীর বুদ্ধের বাণী, ভাগবতের বাণী অথবা মহম্মদের বাণী আর শ্রীচৈতন্যর বাণীর মধ্যেও কোনও প্রভেদ নেই। প্রভেদ আছে সেই বাণী উচ্চাণের মধ্যে। বাণী উপলব্ধির পার্থক্যের জন্যই বাণী—প্রকাশের ভঙ্গির এই প্রভেদ। বাংলার এই ভঙ্গিটাই একেবারে নিজস্ব, অভিনব। দেবতার সঙ্গে এমন মানবীয় আত্মীয়তার সম্বন্ধ আর কারও নেই, তাই বাঙালি বৌদ্ধরা দোহা রচনা করেছেন, আর শ্রীচৈতন্য সৃষ্টি করেছেন সংকীর্তন। যেখানে আবেগ ও আত্মীয়তা এত গভীর, এত নিবিড়, এত মানবীয় যেখানে সংগীত আর কাব্যই তো শ্রেষ্ঠ ভাবপ্রকাশের বাহন। তাই বাংলার বৈষ্ণব সংগীত—সাহিত্যে চণ্ডীদাস আর শাক্ত সংগীত—সাহিত্যে ‘প্রসাদি সুর’ ও গানের স্রষ্টা রামপ্রসাদের আবির্ভাব হয়েছে। বাংলার ঘরছাড়া বাউলরাও বাংলার ঘরের মানুষ।
বাংলার হিন্দু—মুসলমানের ভাবসমন্বয় এত গভীর, এই আবেগপ্রধান বলেই এখানে বৈষ্ণবদের নানা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। সহজিয়া বৈষ্ণবরা হিন্দু—মুসলমান সকল জাতির জন্যই দ্বার উন্মুক্ত রেখেছিলেন। ঢাকার পঞ্চু ফকিরের শত শত শিষ্য হিন্দু, কৃষ্ণনগরের সাহেব—ধনী সম্প্রদায়ের গুরু মুসলমান, হজরতি সম্প্রদায়ের নেতা হজরতের বাস বাঁশবেড়ে। এরকম আরও অনেক সম্প্রদায় আছে, যেমন পাগল নাথী ও গোবরা সম্প্রদায়, দু—জনেই মুসলমান, বাবা আউলের সম্প্রদায়, রামবল্লভী সম্প্রদায় ইত্যাদি।৪১ বর্ণ জাতি সম্প্রদায় কোনও কিছুই এঁরা মানেন না। চৈতন্য প্রবর্তিত ধারায় কতকটা বাউলদের মতন এঁরা আজও গান গেয়ে বেড়ান—
বন্দি ঠাকুর জগন্নাথ।
ভেদ নাই, বিচার নাই, বাজারে বিকায় ভাত।
চণ্ডালেতে রাঁধে ভাত ব্রাহ্মণেতে খায়।
এমন সুধন্য দেশ জাত নাহি যায়।
ভাত লইয়া তারা মুণ্ডে মুছে হাত।
সে কারণে রাইখাছে নাম ঠাকুর জগন্নাথ।
বাংলার স্থাপত্য ও শিল্পকলার মধ্যেও হিন্দু—মুসলমানের সমন্বয়ের ভাব ফুটে উঠেছে। বাংলার ‘বারদুয়ারি ঘর’, ‘আটচালা’, ‘দোচালা’ ঘর নবাবরা ধ্বংস করলেও আবার তা তৈরি করেছেন। গৌড়ের ‘সোনা মসজিদ’ এখনও বারদুয়ারি মসজিদ নামে পরিচিত। হিন্দুদের মন্দির ভেঙে যেসব মসজিদ তাঁরা গড়েছিলেন তার মধ্যেও হিন্দু শিল্পীর কারিগরই বেশি। রাজশাহির ‘বাঘার মসজিদ’, গৌড়ের ‘হুসেন শাহের মসজিদ’, ‘কদম শরিফ’, ‘নোটন মসজিদ’, সবই হিন্দু মন্দিরের কারুকাজ ও ভাবৈশ্বর্যমণ্ডিত। গম্বুজ মিনার আর মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ আরবি লিপি ছাড়া বিদেশি প্রভাব তার মধ্যে বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু সে যা—ই হোক, হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতিসমন্বয়ে মধ্যযুগের বাংলার বিশিষ্ট দান এসব নয়। মধ্যযুগের বাংলার বিশিষ্ট দান হল চৈতন্য—প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম; সংকীর্তন গান, পদাবলি সাহিত্য এবং বাংলার হিন্দু—মুসলমান পল্লিকবির অপূর্ব লোকসংগীত বাউলগান আর বাংলার মিশ্রদেবতা সত্যপির মানিকপির কালুগাজি ইত্যাদি। বাংলার মতন কেউ বোধহয় মুসলমানদের এত আপনার করে গ্রহণ করতে পারেনি। বাংলার মুসলমানরা এই বাংলারই প্রাকৃতজন, ঘরের মানুষ। বাংলার মুসলমান মা—বোন—স্ত্রী একেবারে খাঁটি বাংলারই ঘরের মেয়ে। তাঁদেরই সন্তানরা তো বাংলার মুসলমান। তাই বাংলার হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতিসমন্বয় শুধু সাধকদের ভাবলোকে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভাবলোকেও সেই সমন্বয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব মানবধর্ম, সংগীত সংকীর্তন গান গাথা কাব্যের ঝরনাধারা, অভিনব সব মিশ্রদেবতা—লোকদেবতা। অর সমাজে, অর্থাৎ বাস্তব জগতে ঘরের কোণেও তার প্রভাব পড়েছে। বেশভূষায়, আচার—ব্যবহারে, ভাবভঙ্গিতে বাংলার হিন্দু—মুসলমানকে যেমন এক পরিবারের মানুষ বলে মনে হয়, সেরকম ভারতের আর কোথাও হয় না।
সেকাল আর একালে সংস্কৃতিসমন্বয়ের পার্থক্য
ভারতে হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারা, এবং সেই ধারায় বাংলার বিশিষ্ট দান কী, সে সম্বন্ধে আলোচনা করা হল। এখন প্রশ্ন হল, সেকাল অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্যযুগের এই ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতিসমন্বয়ের সঙ্গে একালের পার্থক্য কোথায়? আগেই বলেছি, বাংলায় তথা সারা ভারতে সংস্কৃতিসমন্বয়ের তিনটি যুগ দেখা যায়। প্রথম যুগ আর্য—অনার্য সংস্কৃতিসমন্বয়ের যুগ; দ্বিতীয় যুগ হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতিসমন্বয়ের যুগ; তৃতীয় যুগকে আমরা বর্তমান যুগ বলতে পারি, ভারত—ইউরোপ প্রাচ্য—পাশ্চাত্য সংস্কৃতিসমন্বয়ের যুগ, নবজাগৃতির যুগ। পুরাতন যুগের সমন্বয়ের ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য সমীকৃত করে নতুন যুগের সমন্বয়ের ধারা প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু নবযুগের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ধারা নতুন; প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধারার সঙ্গে তার পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য কোথায় এবং কেনই বা এই পার্থক্য?
বেদে মানুষের সুখসম্পদ, শান্তি—মৈত্রীর কথা অনেক পাওয়া যায়, ঋগবেদে তো এইসব কথারই ছড়াছড়ি। উপনিষদেও বড় বড় কথার অন্ত নেই। মৈত্রেয়োপনিষৎ তো বর্ণাশ্রম ধর্ম এবং বাহ্য ও বিগ্রহ পূজাচারের রীতিমতো বিরোধিতা করেছেন। বর্ণাশ্রম আচারযুক্ত বিমূঢ়রাই কর্মানুসারে ফল পেয়ে থাকে, আর বর্ণাদি ধর্ম ত্যাগ করে মানুষ সানন্দে তৃপ্ত হতে পারে। মণি মাটি পাথর লোহার বিগ্রহের পুজোয় মানুষের জন্ম ও ভোগ বিড়ম্বিত হয়, আর সাধক যিনি তিনি বাহ্যাচার ছেড়ে নিজের অন্তরে অর্চনা করেন। এসব উপনিষদেরই কথা।৪৫ মহাবীর ও বুদ্ধের অহিংসা সাম্য মৈত্রীর বাণী সকলেই জানেন। ভাগবতরা ধর্মে সকলেরই সমান অধিকার স্বীকার করেছেন। শুধু ধর্ম নয়, সমাজ ও অর্থনীতিক্ষেত্রেও ভাগবতরা খুব উদার। সকলকে সমানভাবে অন্ন ভাগ করে দেবার কথা তাঁরা বলেছেন। শুধু তা—ই নয়, তাঁদের মতে প্রয়োজনমতন ক্ষুধার অন্ন পাবার অধিকার সকলের আছে এবং ছলে—বলে যে বেশি অন্ন অধিকার করে, ক্ষুধার অন্ন যে কেড়ে নেয় সে চোর, তাকে দণ্ড দেওয়া উচিত।৪৬ মধ্যযুগের হিন্দু—মুসলমান সাধকরা সকলেই ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে এই একই কথা বলেছেন, কেবল যুগের উপযোগী করে তাকে প্রকাশ করেছেন মাত্র। কিন্তু মাটির রসে পরিপুষ্ট হয়ে এসব উদার বাণী, মহান আদর্শ সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেনি। পণ্ডিত, পুরোহিত, ভিক্ষু—ভিক্ষুণী, ব্যভিচারী তন্ত্রবিলাসী, আচার ও জাতসর্বস্ব বোষ্টম—বোষ্টমিতে সমাজ ভরে গেছে। কোনও আদর্শের মহত্ত্ব, কোন বাণীর উদারতা সমাজকে উন্নত করতে পারেনি। বৈদিক ঋষি থেকে জৈন বৌদ্ধ ভাগবত শৈব বৈষ্ণব সাধকরা পর্যন্ত সকলে যুগে যুগে একই উদার বাণী যেমন ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে প্রচার করেছেন, তেমনি সমাজও বারবার ঘুরপাক খেয়ে সেই একই দুর্নীতি ব্যভিচার ও ভেদবৈষম্যের পাঁকের মধ্যে ডুবে গেছে। যুগসংকটের সময় যুগসাধকদের কণ্ঠে নিপীড়িত মূক জনসাধারণের অচরিতার্থ আশা—আকাঙ্ক্ষা, কামনা বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। কার্ল মার্কস তাই ‘ধর্ম’ সম্বন্ধে বলেছেন : ‘Religion is the sigh of the oppressed creature, the sentiment of a heartless world, the soul of soulless conditions.’ কিন্তু সে কণ্ঠ ও দীর্ঘশ্বাস আবার রুদ্ধ হয়ে গেছে অচল অটল শ্রেণিসম্প্রদায়—বর্ণ—বিভক্ত সমাজের জগদ্দলের চাপে। বাংলার শ্রীচৈতন্য, যিনি বাংলার নদনদীর বন্যার মতন ভাবের বন্যায় অনাচার ব্যভিচার ধর্মবিদ্বেষ সব ধুয়ে—মুছে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাঁর সংকীর্তন—নগরকীর্তনের মতন অভিনব হাতিয়ার মধ্যযুগের কোনও সাধকই আবিষ্কার করতে পারেননি, তিনিও প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে, সমাজের মূল কাঠামোকে সোজাসুজি আঘাত করার সাহস পাননি। শুধু সাহস পাননি বললেও বোধহয় ভুল হবে/ অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে তিনি বর্ণাচারপীড়িত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনও চাননি। নব্য হিন্দুধর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া হয়তো তাঁর উপায় ছিল না। ঢাল—তলোয়ার না নিয়ে নিধিরাম সর্দারের মতন তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদ—বিরোধী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারেন না। তাঁর একমাত্র তলোয়ার ভাবাবেগের তলোয়ার, একমাত্র হাতিয়ার তাই সংঘসংগীত নৃত্য। তাঁর সংগ্রামক্ষেত্র ভাবলোক, মর্তলোক নয়। সমাজ তো অচল অটল স্থিতিশীল, কূপমণ্ডূকবৃত্তি তার স্বধর্ম। সমাজের এই অচলায়তনকে চূর্ণ করার শক্তি শ্রীচৈতন্য কোথায় পাবেন? তাঁর আগে ভারতের বা বাংলার কোনও সমন্বয়সাধক পারেননি। পারেননি বলেই একই উদার বাণী, একই মহান আদর্শ তাঁরা বারবার ঘোষণা করেছেন। কেন করেছেন? কারণ সমাজের বুকের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদ—বর্ণাশ্রমধর্ম ও শ্রেণিবৈষম্যের জগদ্দল চেপে থাকলেও সমাজের তলার মানুষগুলো তার চাপে একেবারে মরে যায়নি। তারা বেঁচে ছিল। বেঁচে ছিল দেশের চাষি কারিগর নাপিত জোলা কসাই কামার ছুতোর ধুনুরিরা। তাদের ইচ্ছা—আকাঙ্ক্ষা—আশা—আদর্শও মরে যায়নি। তাদেরই অতৃপ্ত আশা—আদর্শ, তাদেরই কামনা—বেদনা যুগসাধকরা প্রকাশ করেছেন, বারবার করেছেন যুগসংকটের সময়। কিন্তু সমাজব্যবস্থাকে কেউ সোজাসুজি আঘাত করেননি, অর্থাৎ সামাজিক আন্দোলন কেউ করেননি। করার শক্তি ছিল না তাঁদের, হাতিয়ার ছিল না, কারও না। কী সেই শক্তি, সেই হাতিয়ার।
সেই শক্তি সামাজিক শক্তি, সেই হাতিয়ার অর্থনৈতিক হাতিয়ার। কোনও সাধক, কোনও মহাপুরুষের সাধ্য নেই সেই শক্তি, সেই হাতিয়ার ছাড়া সমাজের ও মানুষের উন্নতিসাধন করা। কথাটা হয়তো আধ্যাত্মিক ভাবশূন্য অতিবাস্তব বলে মনে হবে। মানসলোকের আদর্শ বা নীতি যতই আধ্যাত্মিক ভাবমণ্ডিত হোক—না কেন, তার মূল হল সমাজের মাটিতে। অর্থনৈতিক বনিয়াদের উপর মানসিক ও সাংস্কৃতিক সৌধ গড়ে ওঠে। শাখাপ্রশাখা নিয়ে গাছ অনেক সুন্দর, তার চেয়ে আরও সুন্দর সেই গাছের ফুল ও ফল। কিন্তু গাছে ফুল—ফলের সমস্ত সৌন্দর্যের উৎস মাটির তলায়, মাটির রসে আর শিকড়ে, তা অস্বীকার করা যায় না। ফুলের সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে তার উৎসকে অস্বীকার করা অজ্ঞতা, সংস্কার ও গোঁড়ামি ছাড়া আর কিছু নয়। বিশুদ্ধ সৌন্দর্যতত্ত্ববিদদের মনোমৈথুন কল্পনার ব্যভিচার মাত্র, সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসের সঙ্গে তার কোনও সংযোগ নেই। ভারতে আধ্যাত্মিক ভাবধারার তাই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি হয়েছে এবং যুগে যুগে যুগসাধকদের আবির্ভাবের ফলে তাই ভারতের সমাজব্যবস্থার কোনও উন্নতি, কোনও পরিবর্তন হয়নি। মুসলমান যুগের নবাব—বাদশাহরা, সাধক সুফি দরবেশরা পির ফকিররা সেই মানসলোকের ভাব—সমন্বয়কেই সমৃদ্ধ করেছেন মাত্র, সমাজব্যবস্থার কোন পরিবর্তন তাঁরা করতে পারেননি। ভারতের সেই ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ ছোট ছোট গ্রাম ও গ্রাম্য সমাজ সকলরকম পরিবর্তনের পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়েছে ভারতের সুপ্রাচীন জাতিবর্ণ বিভাগ প্রথা।
ব্রিটিশ যুগে এই অচল আত্মকেন্দ্রিক গ্রাম্য সমাজব্যবস্থা ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামোর ধ্বংসের কাহিনি বর্ণনা প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস তাই বলেছেন :৪৭
আপাতনির্দোষ শান্তশিষ্ট এই অসংখ্য ছোট ছোট সমাজকেন্দ্রকে যখন তছনছ করে দেওয়া হল তখন দুঃখ—দুর্দশার অকূল সমুদ্রে তারা ভেসে গেল। তাদের সনাতন সভ্যতা, বংশানুক্রমিক পেশা, কিছুরই যেন আর অস্তিত্ব রইল না। এসব দেখলে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি যে—কোনও মানুষের মন ঘৃণায় ভরে উঠবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এ কথা আমাদের ভুললে চলবে না যে এই নির্বিকার গ্রাম্য সমাজকেন্দ্রগুলিই যুগ যুগ ধরে প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের বনিয়াদ ছিল। এই গ্রাম্য সমাজের সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে মনের কোনও প্রসার সম্ভব হয়নি। কুসংস্কারের বদ্ধকূপে মানুষের মন ছিল নিষ্ক্রিয় হয়ে, প্রচলিত প্রথার দাস হয়ে। কোনও ঐশ্বর্য, কোনও ঐতিহাসিক প্রেরণা তাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি।
কী আধ্যাত্মিক, কী সামাজিক, এই হল ভারতের ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। বাংলার শ্রীচৈতন্যর ট্র্যাজেডির এই হল মূল কারণ, চৈতন্যপূর্ব যুগের সাধক ও সমন্বয় গুরুদেরও (Heroes of Synthesis) একই ট্র্যাজেডির এই একই পরিণতি। এ দেশে ব্রিটিশ যুগ তাই পরিবর্তনের যুগ। মার্কস তাই ব্রিটিশের উদ্দেশ্য ‘vilest’ এবং ব্রিটিশ পদ্ধতিকে ‘swinish’ ও ‘stupid’ বলেও প্রশ্ন করেছেন, এ দেশে সমাজবিপ্লব ভিন্ন কি মানুষের মুক্তি সম্ভব? তা যদি না হয় তাহলে ইংল্যান্ড যত অপরাধই করুক—না কেন, সজাগ না হয়েও, এ দেশে নতুন সমাজগতি সঞ্চার করে সে ইতিহাসে প্রতিনিধির কাজই করেছে।৪৮
নবযুগের বাংলার তথা সারা ভারতের সামাজিক জাগৃতি ও সংস্কৃতিসমন্বয় তাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ গভীর, তার পার্থক্য মূলগত। বাংলার চৈতন্য আর বাংলার রামমোহন—বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে মূলগত ব্যবধান আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলমান চিশতী দরবেশ, সুফি সাধক, পির ফকির, দাদু বা দারাশিকোর সঙ্গে সৈয়দ আহমদ, আমির আলির পার্থক্যও মূলগত নয় কি?
এতদিন মানুষের মন ছিল কুসংস্কারের বদ্ধকূপে নিষ্ক্রিয় নিস্পন্দ হয়ে, প্রচলিত প্রথার দাস হয়ে। খরস্রোতা নদীর মতন যে সমাজ প্রবহমান নয়, তার বুকে মানুষের মন যুক্তিবুদ্ধির পাল তুলে দিয়ে অভিযান করতে পারে না। কূপমণ্ডূকবৃত্তিই হয় তার স্বভাবধর্ম। এ দেশের সেই স্থিতিশীল সমাজের বুকে তরঙ্গবিক্ষোভ সৃষ্টি করেছে ইংরেজ শাসকরা। পাশ্চাত্য ভাবধারার আঘাতে যেমন নতুন ভাবাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সেই ভাবাবর্তের স্বাভাবিক ভাবসমন্বয়ের পরিণতির জন্য নতুন অর্থনৈতিক শক্তি অন্তত খানিকটা সক্রিয় হয়েছে সমাজের মূলে। তাই বৃহত্তর ভাবসমন্বয়ের পথ এ যুগেই প্রশস্ত হয়েছে, আগেকার যুগে হয়েও হয়নি, কারণ নবযুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানসলোকের ভাবসমৃদ্ধির জন্য যে অনুকূল বাস্তব অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে তা আগেকার যুগের অচল অটল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা করতে পারেনি। মধ্যযুগে কবীর দাদূ শ্রীচৈতন্য প্রমুখ সাধকদের ভাবসমন্বয়ের মহান আদর্শ বাইরের সমাজে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, এ যুগের সংস্কৃতিসমন্বয়ের আদর্শ রূপান্তরিত হয়ে সার্থকতার দিগন্তবিস্তৃত পথে জয়যাত্রা করবে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও হিন্দু—মুসলমানের সংস্কৃতির দুটি স্বতন্ত্র ধারার একটি আর্যাবর্তে, আর—একটি আরব দেশে গিয়ে শেষ হবে না। তেমনি ভারত—সংস্কৃতির ভিতরের শাঁসটুকু ফেলে রেখে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির খোলসটিও ইংরেজদের সঙ্গে ইউরোপ যাত্রা করবে না। এ যুগের পরিবর্তন অর্থনৈতিক বলেই, এবং সে পরিবর্তন অত্যন্ত বাস্তব সত্য বলেই, এ যুগের নবজাগৃতির ভাবসমন্বয়ের ধারার ক্রমপরিণতি সম্ভাবনা বেশি।
এ যুগে প্রথম শুরু হল মানসলোক আর মর্তলোকের সমন্বয়। নতুন উন্নত অর্থনৈতিক শক্তি ও বৈজ্ঞানিক ভাবধারার আঘাতে অচল অটল সনাতন সমাজব্যবস্থার ভিত পর্যন্ত ভেঙে গেল। যন্ত্র এল সক্রিয়তা ও সচলতার বাণী নিয়ে, বিজ্ঞান এল সংস্কারমুক্তির বাণী নিয়ে। সনাতন ভাবধারার চক্রবৎ পরিবর্তনের পালা শেষ হয়ে গেল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমন্বয়সাধকদের বাণী, উদার আদর্শ এই প্রথম নেমে এল মানসলোক থেকে মাটিতে। সমাজ ও মানুষের সামনে এই প্রথম ইতিহাসের সমস্ত রুদ্ধ দ্বার একে একে খুলতে লাগল, আঁকাবাঁকা পথ তার এগিয়ে গেল মানবমুক্তি সমাজতন্ত্র ও সাম্যের দিগন্ত পর্যন্ত। এগিয়ে চলাই হল এ যুগের মূলমন্ত্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মসমাজ, তত্ত্ববোধিনী সভা, ইয়াং বেঙ্গল আন্দোলন, জাতীয় কংগ্রেসের ভিতর দিয়ে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর, ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর ক্ষেত্রে নবজাগৃতির ধারা নব নব রূপে এগিয়ে চলল সমাজতন্ত্র—সাম্যবাদের দিকে। পিছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনও পথ নেই, কারণ পিছনে ফিরে গিয়ে ডানা গুটিয়ে বসে থাকার সেই শান্তির নীড়, সেই আত্মকেন্দ্রিক গ্রাম্য সমাজ ভেঙে গেছে। আর্য—সংস্কৃতি হিন্দু—সংস্কৃতি ইসলামি সংস্কৃতি যত বিশুদ্ধ হোক—না কেন, তার পুনঃপরিবর্তন আর সম্ভব নয়। নতুন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিভেদ আছে, শ্রেণিবিরোধ আছে। তারই ফাটল দিয়ে রক্ষণশীলতা—সাম্প্রদায়িকতা উঁকিঝুঁকি দেবে, মধ্যে মধ্যে তার আস্ফালনও শোনা যাবে কিন্তু ইতিহাসের মোড় ফিরবে না আর পিছনে। চলন্ত ইতিহাসের চাকার তলায় সব রক্ষণশীলতা দীনতা নীচতা সাম্প্রদায়িকতা চূর্ণ হয়ে যাবে। নবযুগের সামাজিক নবজাগৃতির ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বিশিষ্টতা এইখানে এবং তার স্বরূপ এইজন্যই বৈপ্লবিক।
………
* গ্রন্থকারের ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ (১৯৫৭ এবং পরিবর্ধিত সংস্করণ ১৯৭৭—৭৯) গ্রন্থে লোকায়ত স্তরে হিন্দু—মুসলমান সংস্কৃতিসমন্বয়ের গ্রামভিত্তিক বিবরণ অনেক দেওয়া হয়েছে। (১৯৭৮)
* তাঁরা চাঁদ বলেন, নবম শতাব্দীর পর থেকে দক্ষিণ ভারতের ভাবধারার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন একেশ্বরবাদ, ‘প্রগতি’ বা দেবতার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, গুরুভক্তি জাতিসাম্য এবং পূজাচার—বিরোধিতা। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে ইসলামের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। দক্ষিণ ভারতের ‘লিঙ্গায়েত’ সম্প্রদায় সম্বন্ধে তারা চাঁদ বলেছেন, ইসলামের প্রচণ্ড প্রভাব ভিন্ন ‘লিঙ্গায়েত’ বা বীরশৈবদের উদ্ভব হতে পারে না। কানাড়ি ও তেলুগুদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৩৫ জন (বেলগাঁও বিজাপুর ও ধারওয়াড় জেলার), মহিশূর ও কোলচ্ছব রাজ্যে শতকরা প্রায় ১০ জন এই বীরশৈব সম্প্রদায়ভুক্ত। ‘লিঙ্গায়েত’ বা বীরশৈবদের উগ্র ও উদার জীবনদর্শনের মধ্যে ইসলামের প্রভাব এত প্রবল যে তা স্বীকার না করে উপায় নেই। (Tara chand : Influenced of Islam on Indian Culture : 110-128) (১৯৪৮)
* মঈনউদ্দিন চিশতী (১১৪৩—১২৩৬) পারস্যের মুসলমান ছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে বসবাস শুরু করেন। সুন্নি মুসলমান ধারার প্রবর্তক। ২০০৮ সালে ‘যোধা আকবর’ চলচ্চিত্রে এ.আর.রহমান ‘খাজা মেরে খাজা’ গানটি তাঁকে মনে করেই রচনা করেছেন।
* There is no evidence that Chaitanya, ever wanted to interfere actively with the established social order, with the time-honoured Varnasrama Dharma; …what he wanted was not social, but religious freedom and fellowship… one need not emphasise only some of the anti-caste inclinations of Chaitanaya’s religious (and never social) attitude and unnescessarily make him out to be (in the light of modern ideas) a great social reformer, which he never pretended to be. —Dr. S. K. De : Early History of the Vaisnava Faith and Movement in Bengal : 81-82 (1945)
***
ইসলাম ও বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়
১. ক্ষিতিমোহন সেন : ভারতের সংস্কৃতি, ৫—৬
২. খোন্দকার ফজলে রব্বি খাঁ : হাকিকতে মুসলমানানে বাঙ্গালা আব্দুল হামিদ খাঁ : বাঙ্গালার মুসলমানদের আদিবৃত্তান্ত (১৮৯৯ অনুবাদ)
৩. Jafar Sharif: Qanum-i-Islam
Eng. Trans. By G. A. Herklots : Islam in India (1921), ৩—৭
৪. Census Report (1891)
৫. হাকিকতে মুসলমানানে (অনুবাদ), ৬৬
৬. Census Report (Bengal 1872), ১৩২, ৩৮৮
৭. Hunter : Statistical A. C. of Bengal (Vol. 5), ৫৮
৮. Hunter : Statistical A. C. of Bengal (Vol. 9), ৬০
৯. East Bengal Dist. Gaztt. (Dacca), ৬২—৬২
১০. East Bengal & Assam Dist. Gaztt. (Noakhali), ৩৯
১১. Bengal Dist, Gaztt. (Howrah), ৩৮
১২. Bengal Dist. Gaztt. (Hoogly), ৯৮
১৩. মৌলবী খোন্দকার আব্দুল মজিদ : মোসলেম সমাজতত্ত্ব
১৪. ক্ষিতিমোহন সেন : ভারতের সংস্কৃতি, ৩২
১৫. Islam in India, ৭
১৬. Census Report (Beluchisthan, 1901), ৩৯
১৭. Risley : Tribes & Castes of C. P., ii, ২৮৮
১৮. Islam in India, ৮—৯
১৯. দীনেশচন্দ্র সেন : বৃহৎ বঙ্গ (২য়), ৯৭৮
২০. সত্যপীরের কথা : (রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য বিরচিত, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্পাদিত), ১১
২১. Tarachand : Influence of Islam on Indian Culture (1936), ১১০—১১২
২২. Rowlandson : Tuhfat-ul-Mujahidin (ভূমিকা)
Francis Day : The Land of the Perumals, ৩৬৫
Sturrock : Kanara, Madras Dist. Manuals, ১৮০
২৩. ক্ষিতিমোহন সেন : ভারতের সংস্কৃতি, ৩১
২৪. Tarachand : ওই, ৪৩—৮৪
২৫. Tarachand : ওই
২৬. মোহাম্মদ নকীব উদ্দীন খাঁ : কোরআন শরীফ (মূল আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও তফছীরসহ বাংলা অনুবাদ)
২৭. মাধবাচার্য্য : সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ (জয়নরায়ণ তর্কপঞ্চাননের বাংলা অনুবাদ)
২৮. সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ (রামানুজ দর্শন)
২৯. Tarachand : ওই
৩০. রমা চৌধুরী : বেদান্ত দর্শন
৩১. বামপুরাণ, ৫৩, ৫৯—৬৯, ৭১
কূর্ম্মপুরাণ, ৩৭, ২২
স্কন্দপুরাণ (মাহেশ্বর খণ্ড, ৬)
লিঙ্গপুরাণ (পূর্বভাগ, ৩৭)
বায়ুপুরাণ (পূর্বভাগ, ৫৫)
(পুরাণগুলির বঙ্গবাসী সংস্করণ দ্রষ্টব্য)
৩২. চন্দ্রিকাপ্রসাদ ত্রিপাঠী : স্বামী দাদূ দয়াল কী বাণী
কবীর গ্রন্থাবলী (নাগরী প্রচারিণী)
ক্ষিতিমোহন সেন : দাদূ
৩৩. এম. আহম্মদ : খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী
এম. আহম্মদ : মহিউদ্দীন হজরত বড়পীর আবদুল কাদের
এম. আহম্মদ : কাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া
৩৪. Ain-i-Akbari (Eng. Trans by Blochman), Vol. I, ১০৭
৩৫. Havell : Handbook of Indian Art, ১১৩—১৩৭
৩৬. Tarachand : ওই ১৩৪—১৪০
৩৭. Tarachand : ওই
৩৮. Dr. S. K. De : Early History of Vaisnava Faith & Movement in Bengal, ১অ, ২০
৩৯. Dr. S. K. De : ওই
দীনেশচন্দ্র সেন : বৃহৎ বঙ্গ (২য়)
৪০. Dr. S. K. De : ওই, ৩৩৫ (২ নং পাদটীকা)
৪১. বৃহৎ বঙ্গ (২য়), ৮৯২—৮৯৩
৪২. পূর্ব্ববঙ্গগীতিকা (IV, 2) ৩৪১—৩৪২
৪৩. পূর্ব্ববঙ্গগীতিকা (II, 2) ৩২৫
৪৪. পূর্ব্ববঙ্গগীতিকা (III, 2) ৩৯০
৪৫. F. Otto Schrader : Minor Upanishads (Vol. I)
৪৬. শ্রীমদ্ভাগবত ৭, ১৪, ৮
S. C. Roy : The Bhagavad-Gita & Its Background (I)
৪৭. Marx : Future Results of British ‘Rule in India’
৪৮. Marx : ওই