নবজাগৃতিকেন্দ্র কলকাতা

নবজাগৃতিকেন্দ্র কলকাতা

যেসব জাতি পূর্বে ভারতবর্ষে অভিযান করেছে তাদের মধ্যে ব্রিটিশদের সভ্যতাই ছিল ভারতীয় সভ্যতার চাইতে উন্নত। ব্রিটিশরা ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের ভিত ভেঙে দিয়েছে, শিল্প—বাণিজ্য উচ্ছেদ করেছে এবং ভারতীয় সভ্যতার যা কিছু মহৎ ও গৌরবের বস্তু তা সমস্তই প্রায় ধ্বংস করেছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলি এই ধ্বংসের কাহিনিতে কলঙ্কিত। বিরাট এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নবজাগরণের আলোকরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। তাহলেও, স্বীকার করতেই হবে, ভারতের নবজাগরণ শুরু হয়েছে। কার্ল মার্কস: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল; নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন, ৮ অগস্ট, ১৮৫৩।

বনজঙ্গল—পর্বতগুহা থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে নগর শহর মহানগর, এই হল মানবসমাজের ক্রমোন্নতির ইতিহাস, মানবসভ্যতার ও মানবসংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস। মানুষের অগ্রগতির পদচিহ্ন গুহায় গ্রামে নগরে শহরে মহানগরে আঁকা রয়েছে। গুহা হয়তো আজও আছে, গ্রাম তো নিশ্চয়ই আছে, মধ্যযুগের নগর, বণিকযুগের শহর আর আধুনিক ধনিকযুগের মহানগর সবই আজও পাশাপাশি বিরাজ করছে। কারণ অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রগতি পৃথিবীর সর্বত্র একই গতিতে হয়নি। কিন্তু তবু লক্ষ করলেই দেখা যায়, যুগমাহাত্ম্য সকলের মধ্যে সমানভাবে নেই। গুহা আজ নির্বাসিত, গ্রাম উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত, মধ্যযুগের প্রাকারবেষ্টিত নগর ধ্বংসোন্মুখ, বণিকযুগের শহর রুচিহীনতায় ম্লান, ধনিকযুগের মহানগর এখনও নবযুগের বৈজ্ঞানিক অবদানে মহিমান্বিত। যুগের গতিধারা এর মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন যুগের জীবনধারার প্রধান কেন্দ্রে মানুষের নতুন মানসপ্রকৃতি, নতুন জীবনাদর্শ, নতুন ভাবধারা, নতুন শিল্পকলা সাহিত্য স্থাপত্য নীতিরুচিবোধ আচার—ব্যবহার নিয়ে নতুন সংস্কৃতি পুষ্টিলাভ করে। আমরা যে যুগে বাস করছি সেই বৈজ্ঞানিক যুগ ও শ্রমশিল্প যুগের নতুন জীবনধারার প্রধান কেন্দ্র হল মহানগর। এই মহানগর থেকেই নতুন যুগের নবজাগরণের শুরু। তাই বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে কলকাতার প্রাধান্য ও গুরুত্ব কোনও সমাজবিজ্ঞানীই অস্বীকার করতে পারেন না। কলকাতা মহানগরই বাংলার নতুন জীবনধারার প্রধান কেন্দ্র। তাই কলকাতাই বাংলার নতুন ভাবধারা, নতুন মানসপ্রকৃতি ও নবজাগৃতির উৎস। কলকাতাই বাংলার সংস্কৃতিকেন্দ্র।

মহানগর যেন মহাসমুদ্র। বাইরের নদনদী যেমন শতসহস্র ধারায় প্রবাহিত হয়ে মহাসমুদ্রের বুকে মিলিত হয়, তেমনি বাইরের গ্রাম ও গ্রাম্য সমাজ, বাহির—বিশ্বের লোকজন, তাদের আচার—ব্যবহার, রীতিনীতি, শিক্ষা—সংস্কৃতি, ভালোমন্দ আদর্শ সব এসে মিলিত হয় মহানগরের বুকে। সকলের স্বাতন্ত্র্যের সংঘাতে মহানগরের শান—বাঁধানো বুকও উদ্বেল হয়ে ওঠে। বাজারে, বন্দরে, বাণিজ্যকেন্দ্রে, শিক্ষাকেন্দ্রে, অফিস—আদালতে, ক্লাবে—কাফেতে, ব্যারাকে—রাজপথে এই ঘাতপ্রতিঘাত, এই লেনদেন অবিরাম চলতে থাকে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংঘাত, নানা রকমের উদ্দেশ্য ও অভিসন্ধির খণ্ডযুদ্ধ, নানা উদ্যমের সংঘর্ষ, বিচিত্র ভাবধারার আবর্ত মহানগরের বুকে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই আলোড়ন ও বিক্ষোভ ধীরে ধীরে স্থির ও সংযত হয়ে আসে। উচ্চতর বৃহত্তর ও মহত্তর এক সমন্বয়ের মধ্যে সমস্ত সংঘাত, সমস্ত বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্য, সমস্ত স্বাতন্ত্র্য এক অপূর্ব শান্তগম্ভীর রূপ ধারণ করে। বাইরে সেই রূপের বিকীরণ হয়। নগরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নগরের সংস্কৃতিসম্ভার, নগরের সজীবতা সক্রিয়তা ধীরে ধীরে নগরের উপকণ্ঠে, পরিপার্শ্বে, সারা দেশে প্রভাব বিস্তার করে। ঠিক তেমনি নগরের অর্থনৈতিক অবনতি ও অপচয়, নগরের দুর্নীতি স্থবিরতা ও নিষ্ক্রিয়তা, সারা সমাজদেহকে বিষাক্ত করে তোলে। বড় বড় শান—বাঁধানো রাজপথ ও অ্যাশফল্টের অ্যাভিনিউয়ের উপর দিয়ে যান্ত্রিক যানবাহনের মতন তীব্রবেগে মহানগরের এক প্রান্ত থেকে আর—এক প্রান্ত পর্যন্ত যেমন নতুন ভাবধারা, নতুন আদর্শ, নতুন রুচি ও নীতি চলাফেরা করে, বিদ্যুদবেগে যেমন সকলের মনে সেই ভাবধারা সংক্রমিত হয়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে, সকল রকমের মানসিক ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়াকে মন্থন করে তোলে, তেমনি দুর্নীতি ও ব্যভিচারও মহানগরের বুকে দ্রুতগতিতে ব্যাপক ভয়াল মূর্তি ধারণ করে। সমাজদেহের শিরা—উপশিরা জড়িয়ে থাকে মহানগরে। মানুষ থাকে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে, অথচ প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ও সম্পর্কশূন্য। মহানগরের রাজপথে, ইট—পাথর—লোহায় যেমন মানুষের মহান আদর্শের, জীবনের মহান সত্যের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, তেমনি মহানগরের কদর্যতা তুচ্ছতা ব্যস্ততা হীনতা নীচতা দীনতা সব যেন ইট—পাথরে—লোহার গায়ে একেবারে খোদাই করা থাকে, সহজে মিলিয়ে যায় না। মহানগর তাই নিঃসন্দেহে মানুষের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলেও আজ তার উল্লেখযোগ্য অপকীর্তিও বটে। নতুন যুগের যে—প্রেরণায়, নতুন জীবনধারার যে—তাগিদে আধুনিক মহানগরের উদ্ভব, সেই প্রেরণা ও তাগিদ আজ বিকৃত বিকারগ্রস্ত। আধুনিক মহানগর মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। সর্বজনীনতা ও সহযোগিতার লক্ষ্যভ্রষ্ট মহানগর আজ তাই পৈশাচিক ধনতান্ত্রিক প্রবৃত্তির জঘন্য লীলাকেন্দ্র, উত্তুঙ্গ স্কাইস্ক্রেপারের মতন তার দাম্ভিক স্বার্থপরতা, প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের মতন তার দিগন্তবিস্তৃত লালসা।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মহানগরের কবল থেকে মানুষের মুক্তি নেই। গুহা ছেড়ে গ্রামের দিকে, গ্রাম ছেড়ে নগর শহর ও মহানগরের দিকে মানুষের অগ্রগতি, এবং তার সঙ্গে পা ফেলে মানুষের সমাজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রগতি। সংঘবদ্ধ সম্মিলিত যৌথজীবনের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা, সুখসম্পদ—ঐশ্বর্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ, মানুষের রূপবেদনা শিল্পবোধ এবং মূক মানবতা মুখর হয়ে উঠেছে মহানগরে। মহানগরের মহান জীবনকেন্দ্র থেকে আধুনিক মানুষের তাই কেন্দ্রচ্যুত হবার উপায় নেই। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী লুইস মামফোর্ড তাই বলেছেন : ‘গুহা আর উইঢিবির মতন মহানগরও প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠেছে। কিন্তু মহানগর হল মানুষের সচেতন মনের শিল্পরূপ এবং নগরের সর্বজনীন কাঠামোর মধ্যেই ব্যষ্টির স্বকীয়তা নিয়ে কলাশিল্পের বিকাশ হয়। মানুষের মন মহানগরের ছাঁচেই গড়ে ওঠে, মনের প্রকাশ মহানগরই নিয়ন্ত্রণ করে। ভাষার পরে মহানগরই হল মানুষের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি। সামাজিক বৈচিত্র্য ও জটিলতা এবং উদ্দেশ্যপ্রাধান্য হল মহানগরের বৈশিষ্ট্য। স্বাভাবিক পরিবেশকে মানবিক করে তোলা এবং মানবিক আদর্শের উত্তরাধিকারকে সর্বজনীন করাই হল মহানগরের অন্যতম উদ্দেশ্য।’

মহানগরের এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগুলি মনে রেখে আমরা বাংলাদেশ তথা সারা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মহানগর ‘কলকাতার’ ক্রমবিকাশের কথা বলব। গ্রাম্য জীবন থেকে আধুনিক মহানাগরিক জীবনের বিকাশ হতে কলকাতার প্রায় আড়াই শতাব্দীকাল সময় লেগেছে। এই আড়াই শতাব্দীকালের মধ্যে ব্রিটিশ বণিকের মানদণ্ড ব্রিটিশ ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছে। কবি কিপলিং ‘কলকাতা’ সম্বন্ধে বলেছেন :

Thus from the midday halt of Charnock
grew a city
As the fungus sprouts chaotic from its
bed
So it spread.
Chance-directed, chance-erected, laid and
built
On the silt,
Palace, byre, hovel, poverty and pride
Side by side.

‘কলকাতা’ সম্বন্ধে এ কথা অনেকটা সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়, যেমন কলকাতা সম্বন্ধে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’—

আজব সহর কলকেতা।
রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐক্যতা;
যত বক বিড়ালে ব্রহ্মজ্ঞানী, বদ্মাইসির ফাঁদ পাতা।

একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা না হলেও অনেকটাই মিথ্যা। ‘chance-directed’, ‘chance erected’ কলকাতা নিশ্চয়ই নয় এবং শেওলা বা ব্যাঙের ছাতার মতন কখনোই কলকাতা গজিয়ে ওঠেনি। জোব চার্নক হঠাৎ যাযাবরের মতন ঘুরতে ঘুরতে একদিন বৈঠকখানায় পিপুল গাছের তলায় মধ্যাহ্ন বিশ্রামের জন্য কাতর হয়ে পড়েন। ‘আজব সহর’ কলকাতা ঠিকই, কিন্তু তার জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি মাত্রই ‘বক বিড়াল’ নন, অথবা তার চারদিকে কেবল ‘বদমাইসির ফাঁদ পাতা’ থাকে না। কোনো সমাজবিজ্ঞানীর বা নগরশিল্পীর সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুসারে হয়তো ‘কলকাতা’ আধুনিক মহানগরের রূপ পায়নি। জৈবিক নিয়মেই অনেকটা কলকাতার বৃদ্ধি ও বিকাশ হয়েছে স্বাভাবিকভাবে, বিজ্ঞানীর ও স্থপতির কল্পনার স্পর্শ তার গঠনবিন্যাসে বিশেষ নেই। তবু কলকাতা ‘হঠাৎ—গড়া’ ‘হঠাৎ—গজিয়ে—ওঠা’ মহানগর নয়। সেকালের সমাজব্যবস্থা, সেকালের জীবনধারা, সেকালের ভাবাদর্শ ভেঙেচুরে আত্মবিকাশের বেগে নতুন যুগের প্রচণ্ড তাগিদে জন্মলাভ করেছে কলকাতা মহানগর। কলকাতার বড় বড় রাজপথ আর অট্টালিকার তলায় শুধু সেকালের গোবিন্দপুর কলকাতা আর সুতানুটি গ্রাম তিনটি সমাধিস্থ হয়ে নেই। অনেক গ্রাম, অনেক প্রাচীন নগর কঙ্কালে পরিণত করে কলকাতা পুষ্টিলাভ করেছে। নতুন যুগের জয়যাত্রার পথে সেকালের গ্রাম্য সমাজ, সেকালের নগরশিল্প, সেকালের রীতিনীতি রুচি শিক্ষা—সংস্কৃতির সব ভেঙেচুরে গড়ে উঠেছে কলকাতা আর তার সঙ্গে বিকাশ লাভ করেছে নতুন যুগের সমাজ, নতুন যুগের শ্রমশিল্প, নতুন যুগের জীবনধারা ও ভাবধারা, নতুন যুগের শিক্ষা—সংস্কৃতি। কী গড়ে উঠল বুঝতে হলে কী ভেঙেচুরে গেল আগে তা জানতে হয়। কীভাবে কী অবস্থায় গভীর নিদ্রায় আমরা অচেতন ছিলাম তা না জানলে নবজাগরণের স্বরূপ আমরা উপলব্ধি করব কী করে?

সেকালের গ্রাম্য সমাজের বৈশিষ্ট্য

১৮৫৩ সালের ২ জুন লন্ডন থেকে কার্ল মার্কস একখানা চিঠিতে এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন : ‘…the basic form of all phenomena in the East….is to be found in the fact that no private property in land existed. This is the real key even to the Oriental heaven.’ প্রাচ্য সমাজের সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মূলে হল ভূমির ব্যক্তিগত স্বত্বহীনতা। এমন কি, প্রাচ্য স্বর্গের চাবিকাঠিও হল তা—ই। তুরস্ক পারস্য আরব ও হিন্দুস্থান বা ভারতবর্ষের কথাই মার্কস এখানে বলেছেন। ১৮৫৩ সালের ৬ জুন ম্যাঞ্চেস্টার থেকে এই চিঠির উত্তরে এঙ্গেলস লেখেন : ‘The absence of property in land is indeed the key to the whole of East.’ বাস্তবিকই তা—ই। পাশ্চাত্য সমাজে ভূমিস্বত্ব যেরকম সুনির্দিষ্ট একটা রূপ পেয়েছে, প্রাচ্য সমাজে কোথাও তা পায়নি। ভূমির ব্যক্তিগত স্বত্বপ্রথা যে ভারতবর্ষে বিকাশলাভ করেনি তা নয়। গোষ্ঠীস্বত্ব (Tribal Ownership), সংঘস্বত্ব (Communal Ownership) ও যৌথস্বত্বের (Joint Ownership), পাশাপাশি ব্যক্তিস্বত্ব (Individual Ownership) ভারতবর্ষে বৈদিক যুগ থেকেই ছিল। বৌদ্ধ যুগে এই উভয় স্বত্বপ্রথার উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়েছিল দেখা যায়। বৌদ্ধ—পরবর্তী যুগে সংঘস্বত্ব ও যৌথস্বত্বপ্রথা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসে এবং ব্যক্তিগত স্বত্বপ্রথার উৎকট বিকাশ হতে থাকে। কিন্তু এই ভারতীয় ভূমিস্বত্বের সঙ্গে ইউরোপীয় ভূমিস্বত্বের স্বরূপের মৌল পার্থক্য আছে। এ দেশে ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্ব কোনওদিন বিধিবন্ধনে আবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়নি, দেশীয় প্রথানুসারে স্বত্ব স্বীকৃত হয়েছে মাত্র। ইউরোপের রাজা তাঁর রাজত্বের সর্বময় কর্তা, ভূসম্পত্তি কৃষক কারিগর কর্মচারী সবারই মালিক রাজা। রাজার অধীন ব্যারনরাও খুদে রাজা। রাজা যখন তাঁদের কর্তৃত্ব করার অধিকার দেন তখন তাঁরা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূসম্পত্তি লোকজন সকলের উপর কর্তৃত্ব করার বিধিবদ্ধ অধিকার পান। কর্তৃত্ব সেখানে দখলিস্বত্বেরই নামান্তর মাত্র। ভারতবর্ষে রাজা নিজে ভূমির স্বত্বভোগ করতেন না, তাই তাঁর অধীন সামন্তদের আংশিক বা আঞ্চলিক স্বত্ব দেবার অধিকারও তাঁর ছিল না। রাজা দিতেন রাজস্ব আদায়ের অধিকার, শাসনব্যবস্থা তদারক করার অধিকার। জৈমিনির ‘পূর্ব—মীমাংসা তে বলা হয়েছে : ‘রাজা কোনও ভূমি হস্তান্তর করতে পারেন না, কারণ রাজা ভূমির মালিক নন। মালিক তারা যারা খেটে সেই ভূমি চাষ করে।’ সায়নাচার্য বলেন : ‘রাজার কর্তব্য হল অপরাধীকে দণ্ড দেওয়া, আর নিরপরাধকে আশ্রয় দেওয়া। জমির মালিক রাজা নন, যারা আবাদ করে ফসল ফলায় তারা।’ ভারতবর্ষে তাই রাজায় রাজায় যুদ্ধবিগ্রহের ফলে রাজ্য হস্তান্তরিত হয়েছে মাত্র, ভূমিস্বত্বের রূপ বদলায়নি। বিজয়ী রাজা শুধু রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করেছেন। ভূস্বামীদের ভূমিস্বত্ব অথবা প্রজাদের প্রজাস্বত্ব নিয়ে ভারতবর্ষে যে সামন্তযুগের ইউরোপের মতন হানাহানি বিশেষ হয়নি তার কারণ হল ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের গঠনবৈশিষ্ট্য। সেই খ্রিঃপূঃ ২০০০ বছর আগের বৈদিক যুগ থেকে ব্রিটিশ—পূর্ব মোগল বাদশাহের যুগ পর্যন্ত ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি দেখা যায়। পরিবর্তন যে একেবারেই হয়নি তা নয়, কিন্তু যা হয়েছে তা প্রধানত বাহ্য, মৌল কোনও রূপান্তর ঘটেনি। তার কারণ কী? কী সেই বৈশিষ্ট্য, কোথায় সেই প্রচণ্ড শক্তির কেন্দ্র ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের, যার জন্য যুগে যুগে প্রবল প্রতাপশালী রাজারাজড়া নবাব—বাদশাহের সকল রকমের আঘাত অত্যাচার উৎপীড়ন তার পক্ষে অচল অটলভাবে সহ্য করা সম্ভব হয়েছে? ভারতীয় গ্রাম্যসমাজের আত্মনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা, তার নির্বিকার আত্মকেন্দ্রিকতাই হল তার প্রধান বৈশিষ্ট্য, তার প্রচণ্ড শক্তি। শুধু ভারতবর্ষের নয়, এশিয়াটিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এগুলি। কার্ল মার্কস তাঁর ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে ভারতীয় তথা এশিয়াটিক সমাজের এই বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন :

একই ধরনের সহজ সরল অথনৈতিক উৎপাদন—পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি এই আত্মনির্ভর গ্রাম্য সমাজের বৈশিষ্ট্য। ভেঙে গেলেও এই গ্রাম্য সমাজ আবার ঠিক একই জায়গায় একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এই একঘেয়ে সরলতাই হল এশিয়াটিক সমাজের সুস্থিরতার অন্যতম কারণ। এশিয়াটিক রাজা ও রাজবংশের নিরবচ্ছিন্ন ভাঙাগড়ার মধ্যে এশিয়াটিক সমাজের নিশ্চলতা ও স্থিরতার বৈসাদৃশ্য অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠে। মেঘাচ্ছন্ন রাজনৈতিক আকাশের ঝড়ঝঞ্ঝার নিচে এশিয়াটিক সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো অসাড় অচেতন হয়ে থাকে।

উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র এই গ্রাম্য সমাজের অস্তিত্ব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত একরকম অটুট ছিল। রোজ সাহেব ১৯০১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে লিখেছেন :

পঞ্জাব প্রদেশের প্রত্যেকটি গ্রামের অথনৈতিক আত্মনির্ভরতা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক গ্রামের মধ্যেই তার প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্তর তৈরি হত। ভূসম্পত্তির মালিকদের অধীনে থাকত নানা শ্রেণির কারিগর কারুশিল্পী, নানা রকমের বৃত্তিজীবী। এই বৃত্তিজীবীরাই ক্রমে বিভিন্ন ‘বর্ণে’ রূপ পেয়েছে। এইসব বিভিন্ন বর্ণের লোকেরা স্বাবলম্বী ছিল না, থাকতে পারে না। তাদের স্বাতন্ত্র্য বলেও কিছু ছিল না। এইভাবে প্রত্যেকটি গ্রাম অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর ছিল, বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না।

এইবার দাক্ষিণাত্যের একটি গ্রামের কথা বলছি। গুডউইন সাহেব দাক্ষিণাত্যের গ্রাম্য সমাজের (১৮৪৫) যে নকশা এঁকেছেন তা অতুলনীয়। এখানে তাঁরই একটা নকশার পরিচয় দিচ্ছি। পাতিল কুলকার্নি ছুতার লোহার চম্ভার (চামার) কুম্ভার (কুমোর) নেহায়ি (নাপিত) পুরিত (ধোবা) যোশী (জ্যোতিষী) গুরু সোনার মুহার (চৌকিদার), এই ক—জনকে নিয়েই একটা গ্রাম্য সমাজ গড়ে উঠত। এদের সঙ্গে ভিল কোলি মুলানাও (মৌলানা) ছিল। পাতিল ও কুলকার্নিরা হল ভূস্বামীশ্রেণি, রাজস্ব আদায়ের ও নির্ধারণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হত তাদের ওপর। গ্রামের মধ্যে তাদেরই প্রভাব—প্রতিপত্তি সকলের চাইতে বেশি। ছুতোরেরা কারিগরদের মধ্যে প্রধান, তারা কাঠের হাতিয়ার গড়ত, ঘরবাড়ি নির্মাণ করত, মেরামত করত, গোরুর গাড়ি তৈরি করত। লোহার বা কর্মকার তৈরি করত লোহার যন্ত্রপাতি এবং তা মেরামত করত। চামার তৈরি করত জুতো চাবুক দড়ি ইত্যাদি। এই ছুতোর লোহার ও চামারই ছিল কারিগরদের মধ্যে প্রধান। মজুরি ছাড়াও তারা এইসব ধরনের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেত। চাষিদের জমির একটা অংশে তারা চাষ করার সুযোগ পেত। চাষ অবশ্য তাদের নিজেদের করতে হত না। যারাই চাষ করত, বীজ বুনত, তারা শুধু বীজ দিত আর ফসলটা ভোগ করত। কুমোর মাটির পাত্র তৈরি করত, অন্য কারিগরেরা এইসব পাত্র তাদের প্রয়োজনমতন নিত এবং তার পরিবর্তে কুমোরের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করে দিত। নাপিত সকলের খেউরি করে দিত, পুরিত কাপড়চোপড় ধুয়ে দিত। গুরু আর মৌলানারা পুরোহিতের কাজ করত, মন্দির আর মসজিদ ছিল তাদের কাজের জায়গা। সোনারের কাজ কতকটা সরকারি পোদ্দারের মতন ছিল। ধাতু কষে যাচাই করা, বিবাহের গহনাদি গড়া, এই ছিল সোনারের কাজ। ভিল গ্রামের পাহারাদার। গ্রামের মধ্যে কে আসছে—যাচ্ছে, চুরি—জুয়াচুরি হচ্ছে কি না, রাজকর্মচারীদের আসবাবপত্তর ঠিক আাছে কি না, রাজস্ব সময়মতন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কি না, এইসব তদারক করা হল ভিলের কর্তব্য। ‘কোলি’ বা কুলিদের কাজ হল গ্রামে রাজকর্মচারী বা অন্য মাননীয় অতিথিরা এলে তাদের সেবাযত্ন করা, মালপত্তর বয়ে নিয়ে আসা—যাওয়া। মঙদের কাজ কতকটা চামারদের মতন, দড়ি পাকানো, ঝুড়ি বোনা ইত্যাদি। মুহারের কাজ যে কী তা ঠিক করে বলা কঠিন। মুহারকে গ্রামের সকলের অভিভাবক বলা চলে, সকলের প্রয়োজন অভাব অভিযোগ এবং দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মুহার পরিচিত। তাই কোনও ঝগড়াঝাঁটি নিষ্পত্তির সময় মুহারের সাক্ষ্য একান্ত প্রয়োজন।

১৮৪৫ সালে গুডইন সাহেব দাক্ষিণাত্যের গ্রাম্য সমাজের এই নকশা এঁকেছিলেন। এই নকশা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়, আর্যাবর্ত থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের গঠনবৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না। কৃষক ও কারিগরদের কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি গ্রাম, তারই সংলগ্ন চাষের জমি চারণভূমি। কৃষকেরা জমি চাষ করে ফসল ফলায়, উৎপন্ন ফসলের কিছু অংশ রাজস্ব দেয়, কিছু দেয় গ্রামের কারিগরদের, বাকিটা নিজে ভোগ করে। জমি যতদিন কৃষক আবাদ করে এবং তার নির্দিষ্ট রাজস্ব দেয় ততদিন জমি তার, পুরুষানুক্রমেও তার ভোগ করতে বাধা নেই। কারিগর কারুশিল্পী ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী যারা তারা তাদের নিজেদের কাজ করে, গ্রামবাসীদের প্রয়োজন মেটায় এবং তার পরিবর্তে উৎপন্ন ফসলের একটা অংশ তারা পায়। গ্রামের হাট বা সীমানার বাইরে যাবার তাদের দরকার হত না। পথঘাট যানবাহন যখন একরকম ছিলই না বলা চলে, তখন গ্রামের সঙ্গে গ্রামের অথবা গ্রামের সঙ্গে নগরেরর যোগাযোগ রাখার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হত না। খেয়ে—পরে কাজ করে গ্রামের মধ্যেই বেশ নির্ঝঞ্ঝাটে জীবনের দিনগুলো কেটে যেত। তখন উচ্চাকাঙ্ক্ষা উদ্যম বা কোনওটারই মূল্য ছিল না মানুষের কাছে। তাই পরম নিশ্চিন্তে আমাদের গ্রাম্য সমাজ অচল অটল হিমালয়ের মতন সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা—বিক্ষোভ মাথা পেতে সহ্য করেছে।

দুঃখ—দারিদ্র্য অভাব—অভিযোগ বিক্ষোভ আমাদের এই গ্রাম্য সমাজের নির্বিকার উদাসীনতা যে মধ্যে মধ্যে ভেঙে দেয়নি তা নয়। দুর্ভিক্ষ মহামারি অন্যায়—অত্যাচার অনেকবার হয়তো পাঁচ লক্ষ ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের’ ধ্যানভঙ্গ করেছে। প্রজার মঙ্গলের জন্য রাজা সবসময় তাঁর কর্তব্য পালন করতেন না, রাজস্ব কর—আবওয়াবও নানা উপায়ে বাড়াতেন। শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত বোঝাটা কৃষক ও কারিগরদের পিঠের উপরে পড়ত। গ্রামনি গ্রামিক সমাহর্তা সংবিধাতা প্রধান দেশমুখ্য পাতিল কুলকার্নি ডিহিদার মিরাজদার থানাদার চৌধুরি প্রভৃতি দেশপ্রধানরা সবসময় যে ন্যায়দণ্ড নিয়ে রাজকাজ করতেন তা—ও কল্পনা করবার কোনও কারণ নেই। পাতিল ও কুলকার্নিদের কর্তৃত্বের দাপটে দাক্ষিণাত্যের গ্রাম্য সমাজ যে রীতিমতো বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল তারও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলা দেশেও দেখা যায় যে হিন্দু যুগের সামন্তরাজারা কোনও রাজার অধীনতা স্বীকার করতেন না। তাঁরা একরকম স্বাধীনভাবেই থাকতেন, আর রাজারা ‘নিখিল চক্রতিলক’ রূপে উপরে বিরাজ করতেন। সামন্তরাজাদের নিজেদের সৈন্যসামন্ত, বিচারের আদালত প্রভৃতি ছিল। পাঠান রাজত্বকালে জায়গিরদারেরা দেশের ভিতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। দেশে শাসন ও শান্তিরক্ষার জন্য হিন্দুদের উপরেই তাঁদের নির্ভর করতে হত। সেজন্য পাঠান আমলে হিন্দু ভূস্বামী ও অধিকারীদের যথেষ্ট উল্লেখ দেখা যায়। মোগল অধিকারের ঠিক আগে এই ভূস্বামীরা ‘ভুঁইয়া’ নামে প্রসিদ্ধ হন। এই ভুঁইয়ারাই ‘বারভূঞা বসে আছে বুকে দিয়া ঢাল’ (মানিক গাঙ্গুলি), ‘গজপৃষ্ঠে নৃপতি বেষ্টিত বারভূঞা’ (ঘনরাম)। মোগলেরা এঁদের রাজ্য অধিকার করে নিলেও এঁরা স্বাধীন ছিলেন। ‘সমস্ত পাঠান ও বাঙালিরা ইহাদের অধীনতা স্বীকার করে’। প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়, রামচন্দ্র, ইশা খাঁ প্রমুখ ভুঁইয়ার প্রতাপ—প্রতিপত্তি ‘নিখিল চক্রতিলকের’ রাজকীয় প্রভাবকে ম্লান করে দিত। পাঠান আমলে আদায়কারী চৌধুরী ও ক্রোরীরা বংশানুক্রমে জমিদারে পরিণত হন। যেমন একালের প্রধান জমিদারদের মধ্যে বর্ধমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবু রায় মোগলদের বঙ্গবিজয়ের অব্যবহিত পরে বাংলায় আসেন এবং তাঁর পুত্র বাবু রায় বর্ধমান ও তার পাশাপাশি পরগনার চৌধুরির কাজে নিযুক্ত হন। পরবর্তী বর্ধমান অধিপতিরা ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। দিনাজপুরে আকবর শা—র রাজত্বের শেষ ভাগে বিষ্ণুদত্ত প্রাদেশিক কানুনগো ছিলেন।* শাজাহানের রাজত্বকালে তাঁর পুত্র শ্রীমন্ত ‘চৌধুরি’ দিনাজপুরের জমিদারি পান। শ্রীমন্তর দৌহিত্রের বংশই দিনাজপুরের রাজা হন। কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দও কানুনগো দপ্তরে কাজ করতেন। পরে রাজা মানসিংহর অনুগ্রহে ভবানন্দ উখড়া প্রভৃতি কয়েকটি পরগনার জমিদারি পান। এইভাবে পাঠান ও মোগল রাজত্বকালে বাংলা দেশে চৌধুরি ক্রোরী কানুনগো আমিল শিকদার পাটোয়ারি প্রভৃতি রাজকর্মচারীরা ক্রমে প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী জমিদার হয়ে ওঠেন। দেশীয় প্রথানুসারে পুরুষানুক্রমে রাজস্ব আদায় করার জন্য এইসব রাজকর্মচারী ক্রমে ভূমির মধ্যস্বত্বাধিকারী হয়ে উঠলেও সেকালের জমিদারেরা আজকালকার জমিদারদের মতন ভূমির স্বত্ববিশিষ্ট ভূম্যধিকারী হয়ে ওঠেননি। ভূমির মধ্যস্বত্বাধিকারীদের মতন গ্রাম্য সমাজের প্রজারাও পুরুষানুক্রমে একই স্থানে বসবাস ও চাষবাস করার জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে তার স্বত্ব ভোগ করত। কিন্তু এসবই হল প্রথানুগত্য, বিধিবদ্ধতা এর মধ্যে কোথাও ছিল না।১০

রাজরাজড়া, নবাব—বাদশাহ, জায়গিরদার—ডিহিদার—চাকলাদার—তরফদার চৌধুরি—ক্রোরী—হাজারি, কানুনগো—পাটোয়ারি—আমিল—শিকদার প্রভৃতি যত রকমের প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী স্বত্বভোগীর উদ্ভব হোক—না কেন, বাংলার তথা ভারতের গ্রাম্য সমাজের ভিত তাঁদের দাপটে কেঁপে উঠলেও ভেঙে পড়েনি। ভারতের তথা সারা এশিয়ার গ্রাম্য সমাজের এই হল বৈশিষ্ট্য—’মেঘাচ্ছন্ন রাজনৈতিক আকাশের ঝড়ঝঞ্ঝার নিচে এশিয়াটিক সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো অসাড় অচেতন হয়েছিল’—কার্ল মার্কসের এই কথার গুরুত্ব খুব বেশি। সকলের সব রকমের স্বত্ব—উপস্বত্ব স্বীকার করেও বলা যায়, কারও উপরেই বিধিবদ্ধ দখলিস্বত্ব নেই কারও, যে যার স্বত্ব দেশীয় প্রথানুসারে পুরুষানুক্রমে ভোগ করে মাত্র, রাজা, রাজার, জমিদার জমিদারের, প্রজা প্রজার। উদাসী বৈরাগীর মতন সকলে প্রভুত্ব কর্তৃত্ব উপেক্ষা করেছে এ দেশের আত্মকেন্দ্রিক ধ্যানমগ্ন গ্রাম্য সমাজ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোনও রাজা—বাদশাহ ভূস্বামী তার ধ্যান ভাঙাতে পারেননি।

গ্রাম্য সমাজগুলি ঠিক যেন ছোট ছোট গণরাষ্ট্রের মতন। তাদের যা প্রয়োজন সবই তারা নিজেরাই সরবরাহ করে, বাইরের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে হয় না। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট। রাজ্য ভাঙে—গড়ে, বিপ্লবের পর বিপ্লব আসে, হিন্দু পাঠান মোগল মারাঠা শিখ ইংরেজ সকলের প্রভুত্ব একে একে প্রতিষ্ঠিত হয়, চারিদিকেই পরিবর্তনের স্রোত বয়ে যায়, কিন্তু গ্রাম্য সমাজের কোনও পরিবর্তনই হয় না। ঝড়ঝঞ্ঝা—গৃহযুদ্ধের সময় তারা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। বিজয়ী রাজার সেনাবাহিনী হয়তো গ্রামের পাশ দিয়ে বা উপর দিয়ে অভিযান করে যায়। গ্রাম্য সমাজ তার শস্য সম্পদ গবাদি পশু সব আগলে রেখে দেয়। তা সত্ত্বেও যদি আক্রমণ—অত্যাচার তাদের উপরেই হয় তাহলে এক স্থান থেকে আর—এক স্থানে তারা চলে যায়। তারপর আবার যখন ধীর শান্ত হয়ে আসে চারিদিক, তখন তারা ফিরে আসে স্বস্থানে, এবং সেই স্থানের সেই গ্রাম্য সমাজ গড়ে তোলে। এমনকী একপুরুষ ধরেও যদি কোথাও অশান্তির ঝড় বইতে থাকে তাহলেও তার পরবর্তী বংশধরেরা আবার পরিবেশ শান্ত হলে ফিরে আসে, সেইখানেই আগেকার ভেঙে—যাওয়া গ্রাম্য সমাজ আবার সযত্নে গড়ে তোলে।১১

মেটকাফ সাহেব গ্রাম্য সমাজের এই নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন, কিন্তু হিন্দু পাঠান মোগল মারাঠা শিখের সঙ্গে ইংরেজের নাম উল্লেখ করা মারাত্মক ভুল হয়েছে। তার কারণ কার্ল মার্কসের প্রথম উদ্ধৃতির মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সুন্দর করে বলা হয়েছে : ‘যেসব জাতি পূর্বে ভারতবর্ষে অভিযান করেছে তাদের মধ্যে ব্রিটিশদের সভ্যতাই ছিল ভারতীয় সভ্যতার চাইতে উন্নত। ব্রিটিশরা ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের ভিত ভেঙে দিয়েছে, শিল্পবাণিজ্য উচ্ছেদ করেছে…।’ তা ছাড়া প্রাচীন ইতিহাসে এ দেশে বর্ণকেন্দ্রিক ও বৃত্তিকেন্দ্রিক গ্রামেরও উল্লেখ দেখা যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ বিনয়পিটক ও সূত্তপিটকে একবর্ণবহুল গ্রামের পরিচয় পাওয়া যায়, যেমন ব্রাহ্মণগ্রাম ব্রাহ্মণনিগম ক্ষত্রিয়গ্রাম বৈশ্যগ্রাম ইত্যাদি। একবর্ণবহুল গ্রামের মতন এমন কতকগুলি গ্রামের কথাও জানা যায় যেখানে একবৃত্তির লোকেরা বাস করত, যেমন কুম্ভকারগ্রাম সূত্রধরগ্রাম তন্তুবায়গ্রাম কর্মকারগ্রাম ইত্যাদি। কেন এইভাবে বর্ণকেন্দ্রিক ও বৃত্তিকেন্দ্রিক গ্রাম গড়ে উঠেছে তা—ও ভাবা দরকার। গ্রাম্যসমাজের যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য তা নিশ্চয়ই এই গ্রামগুলির মধ্যে ছিল না। পাশাপাশি সব গ্রাম গড়ে উঠত এবং এইরকম কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি গ্রাম্য সমাজ, অথবা উচ্চবর্ণের সামাজিক উৎপীড়নের ভয়ে, বর্ণবিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ায় এইভাবে বর্ণকেন্দ্রিক ও বৃত্তিকেন্দ্রিক গ্রাম গড়ে ওঠাও আদৌ অস্বাভাবিক নয়।১২

যা—ই হোক—না কেন, গ্রাম্য সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে এবং তার অবনতি ও বিপর্যয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এ দেশে ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত তার প্রধান ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় অক্ষুণ্ণই ছিল। ইংরেজরাই সর্বপ্রথম এই গ্রাম্য সমাজের ভিত পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে। কেন ভেঙেছে এবং কীভাবে ভেঙেছে সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করব। তার আগে সেকালের নগর ও নাগরিক জীবন সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ ইংরেজরা শুধু যে এ দেশের গ্রাম্য সমাজের ভিত ভেঙে দিয়েছে তা নয়, মধ্যযুগের নগর ও নাগরিক জীবনও ধ্বংস করে দিয়েছে।

সেকালের নগর ও নাগরিক জীবন

ভারতীয় নগরগুলির বিকাশের ধারা লক্ষ করলে দেখা যায় যে তীর্থস্থান, রাজদরবারে অথবা বাণিজ্যের বন্দর কেন্দ্র করেই এগুলি গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে প্রথম দুই শ্রেণির নগরই বেশি, বাণিজ্যকেন্দ্র বেশি নয়।১৩ প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে বৌদ্ধ যুগের তক্ষশিলা বারাণসী শ্রাবন্তী উজ্জয়িনী কৌশাম্বী বৈশালী রাজগৃহ প্রভৃতি অনেক সমৃদ্ধ শালী নগরের পরিচয় পাওয়া যায়। বৌদ্ধ যুগ ও হিন্দু যুগের নগরগুলি থেকে আরম্ভ করে আহমেদনগর বিজাপুর গোলকুণ্ডা দিল্লি আগ্রা মুর্শিদাবাদ ঢাকা প্রভৃতি মুসলমান যুগের নগরের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় একই দেখা যায়। মধ্যযুগে ইউরোপের নানা স্থানে যেসব নগর গড়ে উঠেছিল তাদের সঙ্গে ভারতের মধ্যযুগের নগরগুলির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। হিন্দু যুগের নগরের মোটামুটি পরিচয় কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’ পাওয়া যায়। ‘অর্থশাস্ত্র’ দেখা যায় নগরগুলি প্রায়ই পরিখা ও প্রাকারবেষ্টিত। প্রাচীরের মধ্যে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য ছোট ছোট দুর্গ থাকত। প্রাচীর সাধারণত পাথরের তৈরি হত, পাথরের অভাবে কাঠ দিয়েও তৈরি হত। দুর্গের মধ্যে সদাসর্বদা সুসজ্জিত সৈন্য থাকত। লোকজনের আনাগোনার জন্য প্রাচীরের মধ্যে ‘দ্বার’ থাকত, ‘অর্থশাস্ত্র’ এইরকম দ্বাদশটি দ্বারের উল্লেখ আছে। দ্বারগুলির মধ্যে একটিকে ‘মহাদ্বার’ বলা হত, তার একদিকে থাকত মহাদ্বারাধিপের বা নগরপালের কর্মচারী ও রক্ষীদের বাসস্থান, অন্যদিকে থাকত শুল্কাধ্যক্ষের অফিস বা শুল্কশালা। কেউ নগরের মধ্যে প্রবেশ করতে অথবা বেরোতে গেলে নগরপালের কর্মচারীরা তার পরিচয় নিয়ে তবে অনুমতি দিত। আগন্তুকদের ‘মুদ্রা’ বা পাসপোর্ট দেখাতে হত। শুল্কাধ্যক্ষের কর্মচারীরা সকলের মালপত্তর পরীক্ষা করত, নির্দিষ্ট পণ্যের উপর ধার্য শুল্ক না দিয়ে কেউই রেহাই পেত না। নগরপরিকল্পনা সম্বন্ধেও ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে মোটামুটি পরিচয় পাওয়া যায়। নগরেরর ভিতরে পুব থেকে পশ্চিমে তিনটি এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে তিনটি রাজপথ থাকত। এই কয়টি রাজপথ ছাড়া আরও অনেক ছোট ছোট পথ ও অলিগলি থাকত। নগরের ভিতরে এক—এক বর্ণের ও বৃত্তির লোক বাস করত। গন্ধমাল্য ব্যবসায়ী, সূত্র ব্যবসায়ী, ধান্য ব্যবসায়ী, তন্তুবায় চর্মকার কুম্ভকার স্বর্ণকার লৌহকার প্রভৃতি বিভিন্ন বৃত্তিজীবী ও ব্যবসায়ীরা নগরের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বাস করত। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ও দাসদের স্বতন্ত্র বসতির ব্যবস্থা ছিল। নগরের নানা স্থানে মন্দির স্তূপ বিহার উদ্যান পুষ্করিণী ক্রীড়াশৈল ক্রীড়াব্যাপী ফল—ফুল লতাগুল্ম নগরের শ্রীবৃদ্ধিসাধন করত।১৪ ‘অর্থশাস্ত্র’ ছাড়াও ‘মানসার’, ‘শিল্পরত্ন’, ‘শিল্পশাস্ত্র’, ‘শুক্রনীতি’, ‘বাস্তুচন্দ্রিকা’ প্রভৃতি শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে সেকালের নগর পরিকল্পনার বিষয় জানা যায়। নগর, দুর্গ (সুরক্ষিত নগর), রাজধানী, পত্তন (সামুদ্রিক বন্দর), দ্রোণমুখ (নদীমুখের বন্দর), শিবির, স্থানীয় (সীমান্ত নগর), নিগম (শিল্প—বাণিজ্য নগর), শাখানগর (শহরতলি) ইত্যাদি বিভিন্ন নগরের এবং ‘দণ্ডক’ (সোজা দণ্ডের মতন একপথবিশিষ্ট নগর), ‘স্বস্তিকা’ (স্বস্তিকাচিহ্নের মতন নগর), ‘পদ্মক’ (পদ্ম ফুলের মতন নগর), ‘কর্মুক’ (ধনুকের মতন নগর), ‘চতুর্মুখ’ (চারটি মুখ বা দ্বারবিশিষ্ট নগর), ‘প্রস্তর’ (প্রস্তরনির্মিত নগর), ‘সর্বতোভদ্র’ (এগারোটি উত্তরমুখী এবং এগারোটি পূর্বমুখী পথবিশিষ্ট নগর), ‘নন্দাবর্ত’, (উদ্যানপুরী) ইত্যাদি নগরপরিকল্পনার পরিচয় এইসব শিল্পশাস্ত্রে পাওয়া যায়।১৫ হিন্দু যুগের নগরগুলির এই পরিকল্পনা ও বৈশিষ্ট্য মুসলমান যুগের নবাব—বাদশাহরা একেবারে বর্জন করেননি। মুসলমান যুগে নগরের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হলেও নগরপরিকল্পনার বিশেষ কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। হিন্দু যুগের নগর বিহার মন্দির মুসলমান নবাব—বাদশাহরা অনেক ধ্বংস করেছিলেন। তার পরিবর্তে তাঁরা বড় বড় মসজিদ—প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন, নগরেরর প্রাকারগুলোকে আরও মজবুত ও উঁচু করেছিলেন, আর সৈন্য চলাচলের সুবিধার জন্য প্রশস্ত বাদশাহি সরণি তৈরি করেছিলেন।১৬ ভারতীয় ‘স্থাপত্যে’ ইসলামের দান বিশেষ উল্লেখ্য হলেও, মধ্যযুগের ‘নগরপরিকল্পনা’য় মুসলমান যুগের দান খুব বেশি নয়।

মধ্যযুগের নগরপরিকল্পনা সে যুগের অর্থনৈতিক বনিয়াদ, অনুন্নত উৎপাদন—পদ্ধতি এবং সংকীর্ণ জীবনদর্শনের সঙ্গে যে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সে কথা গেডেস, মামফোর্ড প্রমুখ খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানীরা ইউরোপের মধ্যযুগীয় নগরগুলির বিকাশের ধারা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। তাই পৃথিবীর সর্বত্র, কী ইউরোপে, কী এশিয়ায়, মধ্যযুগের নগরগুলির সাদৃশ্য এত বেশি। সেই আত্মরক্ষার উদ্দেশ্য প্রাকার ও দুর্গ গঠন, সেই রাজা—বাদশাহের বিরাট বিরাট কারুকার্য—করা প্রাসাদ অট্টালিকা বিলাসভবন প্রমোদ—উদ্যান, সেই গির্জা—বিহার—মন্দির—মসজিদ, বাণিজ্যকেন্দ্র, টোল—পাঠশালা—মক্তব—মাদ্রাসা, কারুশিল্পীদের কারখানা কারুসংঘ বা গিল্ড প্রভৃতি সমস্ত বৈশিষ্ট্যই এ দেশের প্রাচীন নগরগুলিতে ছিল। নগর প্রাসাদ মন্দির মসজিদ এবং ভোগবিলাসের শৌখিন সামগ্রী উৎপাদনের জন্য, নির্মাণের জন্য কারিগর ও কারুশিল্পীদের নগরে নিয়ে আসাও হত। এইভাবে গ্রাম থেকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগরেরা উজাড় হয়ে যেত। কারুশিল্পীরা নগরে এসে সাধারণত রাজা—বাদশাহ আমলা—অমাত্যবর্গ পারিষদবর্গ প্রভৃতি উচ্চশ্রেণির অভিজাতদের জন্য বিলাসের জিনিস তৈরি করত। রাজা—বাদশাহরা নিজেদের সরকারি কারখানাতে বেতন দিয়েও কারিগর নিযুক্ত করতেন। সূক্ষ্ম কারুকাজ—করা শৌখিন জিনিস কারুশিল্পীরা তৈরি করত। তাদের কারিগরি ও দক্ষতা অসাধারণ ছিল। এ দেশে মুসলমান যুগে কারুশিল্প ও কারিগরি বিদ্যার যথেষ্ট প্রসার ও উন্নতি হয়। কিন্তু কারিগরি সূক্ষ্মতা ও দক্ষতা বলতে উন্নত নির্মাণপদ্ধতি বা হাতিয়ারের ব্যবহার বোঝায় না। কারিগরি বিদ্যা প্রথমে গোষ্ঠী ও সংঘের মধ্যে, পরে বংশের মধ্যে এবং ক্রমে বংশ থেকে সেরা শাগরেদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। উন্নত হাতিয়ারের প্রয়োজন হয়নি, শুধু অসীম অধ্যবসায় এবং অমানুষিক অভিনিবেশের প্রয়োজন হয়েছে। রাজা—বাদশাহের অনুগ্রহের ছায়াতলে, কারখানার বন্দি ঘরে কারুশিল্পীরা দিনের পর দিন শৌখিন জিনিস তৈরি করেছে। তাদের মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে এসেছে এবং মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হয়তো বংশানুক্রমে লব্ধ কারিগরি বিদ্যাও লুপ্ত হয়েছে। উৎপাদনের শক্তি বাড়েনি, উৎপাদনের পদ্ধতি কলাকৌশল ও হাতিয়ারের উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত শুধু সূক্ষ্মতা ও দক্ষতার সংকীর্ণ আনাচকানাচে ঘুরে কারুশিল্প জড়ত্বলাভ করেছে, কারুশিল্পীর অপমৃত্যু ঘটেছে।

দাসযুগ সামন্তযুগ ও বণিকযুগের বিকাশ (ইউরোপে ও ভারতবর্ষে)

এখন সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল কেন ইউরোপের মতন ভারতবর্ষে সামন্তপ্রথার (Feudalism) পরিপূর্ণ বিকাশ হয়নি? ধনবান শ্রেষ্ঠী সদাগর ভারতবর্ষে যথেষ্ট থাকলেও, অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের প্রসার হলেও, কেন এ দেশে ইউরোপের মতন সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসস্তূপ থেকে বণিকতন্ত্রের (Mercantilism) বিকাশ হয়নি এবং সেই বণিকতন্ত্র কেনই বা ধীরে ধীরে ধনিকতন্ত্রের (Capitalism) মধ্যে পরিণতি লাভ করেনি? উত্তর হল, ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের আত্মনির্ভরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা। কিন্তু এই উত্তর সম্পূর্ণ নয়। আদিম গোষ্ঠীসমাজ থেকে গ্রাম্য সমাজের বিকাশ পৃথিবীর অন্যত্রও হয়েছিল, কিন্তু সেই গ্রাম্য সমাজ পরবর্তী যুগে ভেঙে গেছে। ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের এই অচলতার ও আত্মকেন্দ্রিকতার কারণ কী? প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আজ পর্যন্ত যাঁরা গবেষণা করেছেন, শুধু তথ্য সংগ্রহের মধ্যেই তাঁদের গবেষণাপ্রবৃত্তি নিবৃত্ত হয়েছে।১৭ বৈদিক যুগ বৌদ্ধ যুগ ও হিন্দু যুগের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি শিলালিপি ও শাস্ত্রবচনের সাহায্যে বিবৃত করেই তাঁরা ক্ষান্ত হয়েছেন। বিজ্ঞানীর কার্যকরণ—সম্বন্ধের দৃষ্টি নিয়ে কেউ ভারতের প্রাচীন ইতিহাস আলোচনা করেননি। তাই তাঁদের ইতিহাস সৃজনশীল না হয়ে তথ্যবহুল ক্যাটালগ হয়েছে মাত্র। প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তির শতাব্দীব্যাপী জড়তার মূল কারণ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা বর্তমান গ্রন্থের বিষয়—বহির্ভূত। তাহলেও উপরি উক্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন এবং ভারতের অর্থনৈতিক জড়তার মূল কারণ নির্দেশ না করলে ব্রিটিশ যুগে বাংলার তথা সারা ভারতের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এখানে তাই মূল কারণটি শুধু নির্দেশ করার চেষ্টা করব।

মূল কারণ হল টেকনোলজিক্যাল। যুগে যুগে অর্থনৈতিক প্রগতি প্রত্যেক দেশে সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান ও টেকনোলজির ক্রমোন্নতির জন্য। ‘টেকনোলজিক্যাল উন্নতি’র অর্থ হল উৎপাদন—পদ্ধতি ও উৎপাদন—হাতিয়ারের উন্নতি। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে প্রত্নতত্ত্ববিদরা যাকে লৌহযুগ (Iron Age) বলেন সেই লৌহযুগের পর থেকে, অর্থাৎ প্রায় ঐতিহাসিক যুগের গোড়া থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উৎপাদন—পদ্ধতি ও উৎপাদন—হাতিয়ারের বিশেষ কোনও উন্নতি এ দেশে হয়নি। ভারতীয় গ্রাম্য সমাজের জড়তা ও আত্মকেন্দ্রিকতার কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস ঠিক এই কথাই বলতে চেয়েছেন। মার্কস বলেছেন : ‘একই ধরনের সহজ সরল অর্থনৈতিক উৎপাদন—পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি এই আত্মনির্ভর গ্রাম্য সমাজের বৈশিষ্ট্য।’ এখানে বেশ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে টেকনোলজিক্যাল স্থিতি অথবা অবনতিই ভারতে অর্থনৈতিক কাঠামোর জড়ত্বের মূল কারণ। শুধু সামন্তপ্রথা নয়, দাসপ্রথা ও সামন্তপ্রথা কোনওটাই ভারতবর্ষে ইউরোপের মতন পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থারূপে বিকাশ লাভ করেনি। ইউরোপের মতন ভারতবর্ষে সামন্তপ্রথার বিকাশ কেন হয়নি তার কারণ বিশ্লেষণ করে এঙ্গেলস বলেছেন : ‘আমার মনে হয় আরব পারস্য ভারতবর্ষ প্রভৃতি এশিয়াটিক দেশগুলির প্রাকৃতিক পরিবেশই হল প্রধান কারণ। এইসব দেশের মাটির গুণে ঠিক ইউরোপের মতন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বিকাশ এখানে হয়নি দেখা যায়। কৃত্রিম উপায়ে জলসেচনের ব্যবস্থা না করলে এখানে কৃষির অবনতি অবশ্যম্ভাবী, এবং এই জটিল ব্যবস্থার গুরুদায়িত্ব ”কমিউন” বা প্রদেশের পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব। একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে সমর্থ। প্রধানত এই কারণেই প্রাচ্য সমাজে (ভারতবর্ষেও) ইউরোপের মতন সামন্তপ্রথার অথবা ভূমিস্বত্বের বিকাশ হয়নি।১৮ সামন্তপ্রথার বিকাশ তো হয়নি, গ্রিস ও রোমের মতন ভারতবর্ষে দাসপ্রথারও বিকাশ হয়নি অনেকটা এই একই কারণে। এই কারণেই টেকনোলজিক্যাল উন্নতির যে বাস্তব তাগিদ ও উদ্যম তা ভারতবর্ষে দেখা যায়নি। তাই উৎপাদন—পদ্ধতি ও উৎপাদন—হাতিয়ারের কোনও উন্নতি হয়নি। বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়েছে, বিজ্ঞানচর্চার অবনতি হয়েছ। ছদ্মবেশী ধর্মরাজ্যের আওতায় শিথিল দাসপ্রথা ও সামন্তপ্রথা যুগ যুগ ধরে ভারতের মাটিতে তাই পাশাপাশি পুষ্টিলাভ করেছে। এমনকী, ব্রিটিশ যুগের পরিবর্তন সত্ত্বেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

বৈদিক যুগের চাষবাস পশুপালন ও রাজপ্রথার পরে বৌদ্ধ যুগের অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য কি দেখা যায়? রিস ডেভিস বলেছেন : ১৯ ”সমাজের শীর্ষস্থানে ক্ষত্রিয়েরা, অভিজাতরা ছিল। তারপর যাজ্ঞিক পুরোহিতদের বংশধর বলে দাবি করে ব্রাহ্মণেরা ছিল। তার নিচে ছিল কৃষকেরা ও জনসাধারণ। তাদের নিচে ছিল শূদ্ররা। শূদ্রদের নিচেও ”হীন জাতি” বা ছোট জাতি এবং ”হীন সিপ্পানি” বা ছোট কারবারের লোকেরা ছিল।’ এ ছাড়াও ছিল গোলামরা। যারা যুদ্ধে বা লুঠতরাজে ধরা পড়ত, অন্যায়ের জন্য দণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা হারাত, তারা গোলামে পরিণত হত। গোলামরা অধিকাংশই বাড়ির চাকর থাকত, তাদের প্রতি সব সময় খারাপ ব্যবহারও করা হত না। গোলামদের কোনও রকমের স্বাধীনতা ছিল না, তারা ছিল গোরুর মতন, মনিবের করুণাশ্রিত।২০ তা ছাড়া ‘গঙ্গামালা’ জাতকে দেখা যায় যে, দিনমজুরশ্রেণিও ছিল। দিনমজুরেরা মনিবের বাড়িতে খাটত, খেতে পেত, সন্ধ্যার পর নিজেদের বাসায় ফিরে যেত। এখানে গোলামদের চাইতে দিনমজুরদের অবস্থা ভালো ছিল দেখা যায়।

যা—ই হোক, বৌদ্ধ যুগে যে দাসপ্রথা ছিল তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। দাসরা শুধু যে মনিবের বাড়িতে চাকর থাকত তা—ও নয়। খেত—খামারে চাষের জন্য, শিল্পোৎপাদনের কাজের জন্য এবং ব্যক্তিগত সেবাশুশ্রূষার জন্য দাসদের নিযুক্ত করা হত। বৌদ্ধ জাতকে ও ত্রিপিটক গ্রন্থগুলিতে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।২১ কিন্তু তাহলেও বৌদ্ধ যুগে গ্রিস ও রোমের মতন এই দাসপ্রথার ব্যাপক বিকাশের কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। দাসপ্রথার ব্যাপক ও পরিপূর্ণ বিকাশ হয়নি বলেই ভারতবর্ষে আদিম গোষ্ঠীসমাজ আত্মকেন্দ্রিক গ্রাম্য সমাজে পরিণত হয়ে জড়ত্বলাভ করেছে। অনেকে এই কথা শুনে হয়তো বিস্মিত হবেন এবং মানবতার দিক থেকে বিচার করে বলবেন যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দাসপ্রথার ব্যাপক বিকাশ না হওয়াতে ভারতের গৌরববৃদ্ধি হয়েছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস—লেখকদের মধ্যে অনেকে এইদিক থেকে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণ করতে চেয়েছেন।২২ কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা তা কখনোই স্বীকার করবেন না, বিশেষ করে মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানীরা। প্রাচীনকালে ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে দাসপ্রথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতির সহায়তা করে মানবসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে দেখা যায়। এঙ্গেলস ‘দাসপ্রথা’র এই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা ব্যাখ্যা করে বলেছেন :২৩

দাসপ্রথা আবিষ্কৃত হয়েছিল।* আদিম সমাজব্যবস্থার সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে যারা অগ্রসর হচ্ছিল তাদের মধ্যে দাসপ্রথা প্রধান উৎপাদন—পদ্ধতিরূপে গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে আবার এই দাসপ্রথাই তাদের অবনতির কারণ হয়। কৃষি ও শিল্প—বাণিজ্যের মধ্যে শ্রমবিভাগ সর্বপ্রথম দাসপ্রথার জন্যই সম্ভবপর হয় এবং হয় বলেই প্রাচীন সভ্যতারও পূর্ণ বিকাশ হয়। দাসপ্রথার প্রবর্তন না হলে গ্রিক রাষ্ট্র, গ্রিক শিল্পকলা, গ্রিক বিজ্ঞানের বিকাশ হত না। দাসপ্রথা ভিন্ন রোম সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠিত হত না। গ্রিক সভ্যতা ও রোম সাম্রাজ্যের বিকাশ না হলে আধুনিক ইউরোপের জন্ম হত না। …প্রাচীন যুগের এই দাসপ্রথা ভিন্ন আধুনিক যুগের সোশ্যালিজমেরও বিকাশ হত না।

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে নীতি ও মানবতার দিক থেকে অভিযোগ করা খুব সহজ। বর্তমান যুগের বাস্তব পরিবেশ অথবা মানসিক অবস্থার সঙ্গে দাসপ্রথার কোনও কিছু খাপ খায় না। কিন্তু কেবল এই কারণে দাসপ্রথাকে আমরা ঘৃণ্য বলে বর্জন করতে পারি না। দাসপ্রথার উদ্ভব কেন হয়েছিল, কী অবস্থায় হয়েছিল এবং ইতিহাসে তার দানই বা কী তা জানার প্রয়োজন আছে। এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে, যতই অপ্রীতিকর হোক—না কেন, তবু বলতেই হবে যে এককালে, এই দাসপ্রথার প্রবর্তনের জন্যই মানুষের ও ইতিহাসের প্রগতি সম্ভব হয়েছিল। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে পশুত্বের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রধানত পাশবিক উপায়েই সংগ্রাম করতে হয়েছে। ভারতবর্ষ থেকে রুশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে প্রাচীন ‘কমিউন’ বা গোষ্ঠীসমাজের অস্তিত্ব ছিল সেখানেই দেখা গেছে স্বেচ্ছাচারী প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে। যেখানে এই আদিম গোষ্ঠীসমাজ গ্রাম্য সমাজ বিলুপ্ত হয়েছে সেখানেই মানুষের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। দাসপ্রথাই এই গোষ্ঠীসমাজ ধ্বংস করে উৎপাদন—পদ্ধতির উন্নতি সাধন করেছে, উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে।

দাসপ্রথার ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে এঙ্গেলসের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পরে আর কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। কৃষি ও শিল্পবাণিজ্যের মধ্যে সরল ও স্বাভাবিক শ্রমবিভাগ দাসপ্রথার জন্য সম্ভব হয়েছিল বলে প্রাচীনকালে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি, বাণিজ্যের প্রসার ও উন্নতি এবং কলাশিল্প ও বিজ্ঞানের বিকাশ হয়েছিল। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ যুগে শিল্পবাণিজ্য ও কলাশিল্পের বিকাশ হয়েছিল, সাম্রাজ্যও প্রসারিত হয়েছিল, কিন্তু কতটা তা দাসপ্রথার ব্যাপক প্রবর্তনের জন্য, আর কতটা ধর্মরাজতন্ত্রের বদান্যতা এবং কেন্দ্রীয় রাজশক্তির সংহতির জন্য, তা বলা কঠিন। শ্রেষ্ঠী ও বণিকদের প্রাধান্য বৌদ্ধ যুগে নগণ্য ছিল না, ইয়োরোপীয় ‘গিল্ডের’ অনুরূপ কারুশিল্পীসংঘের পরিচয়ও বৌদ্ধ যুগ থেকে পাওয়া যায়২৪, কিন্তু তা সত্ত্বেও সামন্ততন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ অথবা বণিকতন্ত্রের উদ্ভব ভারতবর্ষে সম্ভব হয়নি। ইয়োরোপে যাকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয় সেই অন্ধকার যুগেই ঘোড়ার লোহার খুর ও লাগাম (যার জন্য ঘোড়ার চলার বেগ বহুগুণ বেড়ে যায় এবং স্থলযানবাহন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে), জলচালিত যন্ত্র, বায়ুচালিত যন্ত্র প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই মধ্যযুগে দাসপ্রথার পুনপ্রবর্তন সম্ভব হয়নি।২৫ মধ্যযুগের শেষে বাষ্পীয় শক্তি ও নানা রকমের উৎপাদনযন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং বণিকতন্ত্রের ভিতর দিয়ে আধুনিক ধনতন্ত্রের বিকাশ হয়। ভারতবর্ষে টেকনোলজিক্যাল প্রগতি বা উৎপাদন—পদ্ধতি ও হাতিয়ারের উন্নতি আদৌ হয়নি, যানবাহনব্যবস্থারও কোনও উন্নতি হয়নি। মহাভারতের ‘মনোমারুতগামিনী’, ‘সর্ববাতসহ’, ‘যন্ত্রযুক্তা’ নৌকা নিশ্চয়ই বাষ্পীয় পোত নয় এবং রামায়ণের ‘পুষ্পকযান’ যে কবিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয় তা বলাই বাহুল্য। উৎপাদন—পদ্ধতির সহজ সরল আদিম রূপের পুনরাবৃত্তির জন্য, অর্থাৎ টেকনোলজিক্যাল অনুন্নতি ও বৈজ্ঞানিক অবনতির জন্য, এবং সবার উপরে প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্যের জন্য, ভারতবর্ষে দাসপ্রথা ও সামন্তপ্রথা পাশাপাশি বিরাজ করেছে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। দাস সামন্তশ্রেণি বণিক সকলের উপরে প্রভুত্ব করেছেন রাজা—বাদশাহরা এবং সমস্ত ‘তন্ত্রের’ উপরে স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কখনো ধর্মের সিংহাসনে, কখনো বীরত্বের সিংহাসনে। ইউরোপের মতন নগর ও গ্রামের মধ্যে শ্রমবিভেদের জন্য কোনও বিরোধ ভারতবর্ষে দেখা যায়নি, নগরে বণিকের প্রাধান্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মসমাহিত নির্বিকার উদাসীন, নগর সাধারণত শাসনকেন্দ্র অথবা তীর্থকেন্দ্র, কদাচিৎ বাণিজ্যকেন্দ্র। দাসপ্রথা সামন্তপ্রথা সদাগরিপ্রথা সবই তাই ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় রাজপদপ্রথার কাছে মাথা হেঁট করেছে এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রও নয়, বণিকতন্ত্রও নয়।২৬

ব্রিটিশ যুগের ঘাতপ্রতিঘাত

ব্রিটিশ যুগে সর্বপ্রথম এই স্থবির ও স্থিতিশীল গ্রাম্য সমাজের ভিত পর্যন্ত ভেঙে যায়, কারুশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ভারতের সনাতন অর্থনৈতিক কাঠামো ও সমাজব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যায়। জীর্ণ পুরাতনকে বিদীর্ণ করে প্রচণ্ড গতিশীল নতুন যুগের আবির্ভাব যদি সম্ভব হত তাহলে তাকে ঐতিহাসিক অভিনন্দন জানাতে দ্বিধা হত না। ব্রিটিশ যুগে পুরাতনকে চূর্ণ দীর্ণ ও ধ্বংস করার প্রচণ্ডতা সর্বক্ষেত্রে দেখা গেলেও, নতুন যুগের আবির্ভাবের জন্য গঠন ও নির্মাণের উদযোগ কিন্তু আদৌ দেখা যায়নি। তা না দেখা গেলেও, ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ব্রিটিশদের গঠন ও নির্মাণের কাজ খানিকটা করতে হয়েছে এবং তার জন্যই চারিদিকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও নতুন যুগের পদধ্বনি শোনা গিয়েছে।

বণিকের মানদণ্ড বাস্তবিকই ‘পোহালে শর্বরী’ রাজদণ্ডরূপে দেখা দেয়নি। দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছে। ইংরেজ বণিকরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ঘরে—বাইরে কোথাও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। এই শক্তিশালী পুঁজিপতি হবার চেষ্টাতেই ঘর ছেড়ে তাদের বাইরে যাত্রা করতে হয়েছে। উপনিবেশের গোড়াপত্তন এই অভিযানের পর থেকেই শুরু হয়। ব্রিটিশ বণিকতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাইরের পৃথিবীতে ধনসম্পদ লুটের জন্য ব্রিটিশ বণিকদের অভিযান শুরু হয়। বণিকদের কোম্পানি গঠনও এই সময় আরম্ভ হতে থাকে। ব্রিটিশ বণিকদের মনোভাবের পরিচয় জন হেলস ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর টমাস মান প্রমুখ ইংরেজদের অর্থনৈতিক আলোচনার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।২৭ ১৬২৮ সালে লিখিত এবং ১৬৬৪ সালে প্রকাশিত England’s Treasure by Foreign Trade গ্রন্থে টমাস মান লেখেন :

The ordinary means to increase our wealth and treasure is by Foreign Trade, where in we must ever observe this rule, to sell more to strangers yearly than we consume of theirs in value.২৮ ধনসম্পদ সঞ্চয় করতে হলে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করাই সাধারণ উপায়। কিন্তু এই উপায় সম্বন্ধে সবসময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিদেশিদের জিনিস আমরা যা ব্যবহার করব তার চাইতে বেশি জিনিস আমাদের বিক্রি করতে হবে বিদেশিদের কাছে।

এই উক্তির মধ্যে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বণিকতন্ত্রের খাঁটি বণিকবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ঔপনিবেশিক অভিযান এবং ইংরেজ বণিকদের সেই উদ্দেশ্যে ভারতে আগমন এই নীতির স্বাভাবিক পরিণতি। পোর্তুগিজ ডাচ ফরাসি বণিকদের সঙ্গে ইংরেজ বণিকদের সংগ্রাম করে জয়ী হতে হয়েছে, আরেকদিকে ভারতের কৃষি কুটিরশিল্প অন্তর্বাণিজ্য বহির্বাণিজ্য সমস্ত ধ্বংস করে নিজেদের প্রভাব—প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। কার্ল মার্কস বলেছেন :২৯

ঔপনিবেশিক অভিযানের ফলে বাণিজ্য ও বাষ্পীয় যানের আশ্চর্য বিকাশ হল। বাণিজ্যের সনদ পেল যেসব কোম্পানি তারা বণিকশ্রেণির প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ের কাজে সহায় হল। উপনিবেশগুলি উদীয়মান বণিকদের পণ্যের বাজার তো হলই, সঙ্গে সঙ্গে প্রায় একচেটিয়া বাজারে পরিণত হয়ে দ্রুত মূলধন সঞ্চয়ে তাদের সাহায্য করল। প্রভুত্ব করে, লুঠতরাজ করে, খুনজখম করে, ইউরোপের বাইরে থেকে এইভাবে তারা যে ধনসম্পদ সঞ্চয় করতে আরম্ভ করল, অজস্র ধারায় সেই সম্পদ স্বদেশের ভাণ্ডারে এসে জমা হয়ে রূপান্তরিত হল ‘মূলধনে’।

ইংলণ্ডের বণিকযুগ থেকে ধনিকযুগে পদার্পণের সন্ধিক্ষণে ভারতের দুর্দিন ঘনিয়ে এল। প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী ব্রিটিশ বণিকশ্রেণির প্রতিনিধিরূপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সময় ভারতবর্ষে প্রভুত্ব লুঠতরাজ খুনজখম করে যে ধনসঞ্চয় করল, পরে সেই সঞ্চিত ধন ‘মূলধনে’ পরিণত হয়ে তাদের নিজেদের দেশে ধনতন্ত্রের বিকাশের পথ আরও প্রশস্ত করে দিল। এই লুঠতরাজ—শোষণের কাহিনিতে এ যুগের ভারতীয় ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলি কলঙ্কিত হয়ে আছে। অনেক ইতিহাস—লেখক ও সমসাময়িক প্রত্যক্ষদর্শী এই কাহিনি বর্ণনা করেছেন।৩০ তার পুনরাবৃত্তির কোনও প্রয়োজন নেই এখানে। দু—একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করব, বিশেষ করে বাংলা দেশ সম্বন্ধে, কারণ তা না হলে ভারতের ইতিহাসে ইংল্যান্ডের যে দুটি ভূমিকার কথা (‘double mission’) কার্ল মার্কস বলেছেন—‘destructive’ এবং ‘regenerating’—তার মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না।

অত্যাচার লুঠতরাজ ও শোষণ সম্পর্কে উইলিয়াম বোল্টস লিখেছেন : ‘এই অত্যাচার সর্বক্ষেত্রেই। বেনিয়ান ও গোমস্তাদের সহযোগিতায় ইংরেজরা খুশিমতো স্থির করত কোন ব্যবসায়ী কত দামে কী জিনিস বিক্রি করতে বাধ্য। তাঁতিদের সম্মতির কোনও প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করত না। তাঁতিরা শর্ত পালন না করলে তাদের জিনিস কেড়ে নিয়ে বিক্রি করে টাকা আদায় করা হত। রেশম ব্যবসায়ীদের উপরেও এইরকম অত্যাচার চলত। অত্যাচারের ফলে তারা অসহ্য হয়ে তাদের আঙুল পর্যন্ত কেটে ফেলেছে, যাতে তাদের কাজ করতে আর বাধ্য না হতে হয়।’ এইভাবে গ্রামের তাঁতি কারিগর সব উজাড় হয়ে যায়। টমাস মানের নীতি কার্যক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে। গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট লিখেছেন : ‘ইংরেজ কর্মচারীরা বা গোমস্তারা শুধু যে লোকের ক্ষতি করত তা নয়, সরকারের ক্ষমতা অগ্রাহ্য করে যেখানে নবাবের কর্মচারীরা কিছু বলতে আসত সেখানেই তাদের উপর অত্যাচার করা হত। এইজন্যই মিরকাশিমের সঙ্গে যুদ্ধ হয়।’ ভেরেলস্টের হিসাব অনুসারে ১৭৬৬, ১৭৬৭ ও ১৭৬৮ সালে বাংলা দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৬৩,১১,২৫০ পাউন্ড এবং আমদানি হয়েছে ৬,২৪,৩৭৫ পাউন্ড দামের জিনিস। তার ফলে, ভেরেলস্টের কথায় প্রত্যেকটি ইয়োরোপীয় কোম্পানি এ দেশের টাকায় তাদের বাৎসরিক ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়েছে, কিন্তু তাতে এ দেশের সম্পদ একেবারেই বাড়েনি।৩১ স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ বলেছেন : ‘আমি এসে দেখলাম, কোম্পানির কর্মচারীদের যেসব ইয়োরোপীয় এজেন্ট আছে এবং সেই এজেন্টদের আবার যেসব এ দেশি অনুচর আছে তারা এ দেশে ইংরেজদের সুনাম কলঙ্কিত করবে।’ যে দেওয়ানি পাবার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার প্রকৃত প্রভু হয়ে দাঁড়াল, সেই দেওয়ানি সম্বন্ধে ক্লাইভ বলেছেন : ‘এর ফলে সমস্ত খরচ বাদ দিলেও কোম্পানির খাঁটি মুনাফা হবে অন্তত ১২২ লক্ষ সিক্কা টাকা বা ১৬,৫০,৯০০ পাউন্ড স্টার্লিং।’

এইভাবে ইংরেজ বণিকদের নির্লজ্জ শোষণ ও লুঠতরাজ চলতে লাগল। কারুশিল্প ও কুটিরশিল্প ধ্বংস তো হলই, ভূমিরাজস্ব—ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে বাংলার কৃষকের ও কৃষির চরম অবনতি ঘটল। ১৭৭০—৭১ সালে (১১৭৬ সন) দুর্ভিক্ষ দেখা দিল, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে ইতিহাসে কুখ্যাত। কিন্তু তাতে কোম্পানির আয় কমল না। ১৭৭২ সালে বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস কোর্ট অব ডিরেক্টরসদের লিখলেন : ‘যদিও এই প্রদেশের তিন ভাগের এক ভাগ লোক মরে গেছে এবং চাষবাসের চরম অবনতি হয়েছে, তাহলেও ১৭৭১ সালের নিট আদায় ১৭৬৮ সালেরও বেশি। এ সম্ভব হয়েছে শুধু কড়া তাগিদের ফলে।’ ১৭৭২ সালে ইংরেজ কর্মচারীদের হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়ার সিদ্ধান্ত করা হয় এবং একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড অব রেভিনিউ গঠন করে বিভিন্ন স্থানে কালেক্টর নিয়োগ করা হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসালা বন্দোবস্ত করা হয়। তারপর কর্নওয়ালিস দশসালা বন্দোবস্ত এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার জন্য এ দেশে আসেন। ১৭৮৯ সালে শোর সাহেব তাঁর বিখ্যাত স্মারকলিপি পেশ করেন। তিনি বলেন যে বন্দোবস্ত জমিদারদের সঙ্গেই হওয়া উচিত এবং সরকারি রাজস্ব মোট খাজনার দশ ভাগের নয় ভাগ হোক। ১৭৯১ সালে দশসালা বন্দোবস্তের জন্য নতুন আইন পাশ করা হল। ১৭৯৩ সালের মধ্যে এই বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ হল এবং তাতে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যায় ১৭৯০—৯১ সালে মোট রাজস্বের পরিমাণ হল ২,৬৮,০০,৯৮৯ টাকা। মীরজাফরের রাজত্বের শেষ বছরে (১৭৬৪—৬৫ সালে) মহারাজ নন্দকুমার যে রাজস্ব আদায় করেছিলেন তা এর এক—তৃতীয়াংশ এবং জাফর খাঁ বা সুজা খাঁ—র মোট রাজস্বের পরিমাণ এর অর্ধেকের বেশি ছিল না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যত দূর সম্ভব বেশি হারেই এই বন্দোবস্ত করা হয়েছিল পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হবে বলে। ডিরেক্টররা এই ব্যবস্থা অনুমোদন করলে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ এই বন্দোবস্ত ‘চিরস্থায়ী’ হবে বলে ঘোষণা করেন। রাজস্ব এইভাবে বাড়ানো হলেও কৃষি জলসেচব্যবস্থা অথবা অন্য কোনও জনকল্যাণকর কাজে সেই অনুপাতে তা ব্যয় করা হত না, ১৮৫০—৫১ সালেই দেখা যায় মোট ১,৯৩,০০,০০০ পাউন্ড রাজস্ব আদায় হলেও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতে জনকল্যাণকর কাজে মাত্র ১,৬৬,৩৯০ পাউন্ড অর্থাৎ শতকরা ০.৮ ভাগ ব্যয় করেন। বাংলার তথা ভারতের গ্রাম্য সমাজ এই নতুন রাজস্বব্যবস্থার চাপে ভেঙে পড়ে। এঙ্গেলস তাই মার্কসকে একখানা চিঠিতে লিখেছিলেন :৩২

প্রাচ্য রাষ্ট্রের তিনটি মাত্র বিভাগ উল্লেখযোগ্য : প্রথমটি হল অর্থবিভাগ (দেশের ভিতরে শোষণের সুবিধার জন্য), দ্বিতীয়টি হল যুদ্ধবিভাগ (ঘরে—বাইরে লুঠতরাজের জন্য), আর তৃতীয়টি হল জনকল্যাণকর বিভাগ (উৎপাদনের সুব্যবস্থার জন্য)। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতবর্ষে প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগটি সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিল দেখা যায়, কিন্তু তৃতীয় বিভাগটি তারা বর্জন করে। তার ফলে ভারতের কৃষিব্যবস্থার চরম অবনতি ঘটে।

কৃষির অবনতি হয়, দুর্ভিক্ষে প্রদেশের পর প্রদেশ উজাড় হয়ে যায় এবং বহু যুগের প্রাচীন গ্রাম্য সমাজের আত্মনির্ভরতা ভেঙে যায়। কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশ বণিকরা টমাস মানের অর্থনৈতিক মন্ত্র বর্ণে বর্ণে পালন করে—‘to sell more to strangers yearly than we consume of theirs in value’—এবং তার প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে এ দেশে ইংল্যান্ড থেকে শুধু তুলোর জিনিসের আমদানি ১৭৯৪ সালে মাত্র ১৫৬ পাউন্ড স্টার্লিং থেকে ১৮১৩ সালে ১,৩৮,৮২৪ পাউন্ড স্টার্লিং পর্যন্ত বেড়ে যায়। বাস্তবিক মান সাহেবের ‘Foreign trade’ বা বৈদেশিক বাণিজ্যই যে ধনসম্পদ বৃদ্ধির প্রকৃষ্ট পন্থা তাতে সন্দেহ নেই। সদাগরি অর্থনীতির সাদাসিধা আদর্শ এবং ব্রিটিশ বণিকবুদ্ধি এইভাবে সার্থক হল এ দেশে।

ব্রিটিশ বণিকশ্রেণির মানদণ্ড ব্রিটিশ ধনিকশ্রেণির রাজদণ্ডরূপে দেখা দিল। ব্রিটিশ বণিকদের অত্যাচার লুঠতরাজ শোষণ এবং বিচ্ছিন্ন শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে ব্রিটিশ বণিকশ্রেণির কায়েমি শাসন ও শোষণব্যবস্থায় পরিণত হল। শ্রমশিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution) নামে ঐতিহাসিক টেকনোলজিক্যাল বিপ্লব প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে ইংল্যান্ডে ঘটে গেল। হারগ্রিভস ক্রম্পটন আর্করাইট প্রমুখ প্রতিভাবানেরা নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে বয়ন শিল্পে যুগান্তর আনলেন। জেমস ওয়াট ও অন্য গবেষকদের সাধনায় বাষ্পীয় শক্তি এবং বাষ্পীয় যন্ত্রের বিকাশ হল। বাষ্পীয় শক্তিচালিত যান্ত্রিক হাতুড়ি, মুসেট পদ্ধতি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হল। লোহা—কয়লাকেন্দ্রে বড় বড় কলকারখানা গড়ে উঠল।৩৩ নতুন যুগ এল, বৈপ্লবিক এক নতুন যুগ, শ্রমশিল্প ও বিজ্ঞানের যুগ। ইংল্যান্ডে বণিকযুগের অবসান এবং শ্রমশিল্প যুগের বিকাশ হল। ইংল্যান্ডে শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের ক্রমিক বৃদ্ধির হার থেকে তা বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়।* ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের বুর্জোয়াশ্রেণি তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হল।

ঠিক এই সময় আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে সেখানকার উপনিবেশগুলি ব্রিটিশের হাতছাড়া হয়ে যায়। নেপোলিয়ন ইয়োরোপীয় মহাদেশ থেকে ইংরেজ বণিকদের প্রায় বিতাড়িত করেন। সুতরাং ভারতবর্ষের দিকেই ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের দৃষ্টি পড়ে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার এই সময় কেড়ে নেওয়া হয়। তা না হলে ইংল্যান্ডে শ্রমশিল্পের বিকাশ হয় না, শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের বাজার মেলে না, নতুন বুর্জোয়াশ্রেণির মূলধন নিয়োগ এবং মুনাফা বৃদ্ধিরও সুবিধা হয় না। তাই ১৮১৩ সালে ভারতবর্ষে এবং তার বিশ বছরের মধ্যে চীনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের একচেটে অধিকার লোপ পায়। ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একেবারে তুলে দেওয়া হয় এবং রাজ্যশাসন ও উপনিবেশ—শোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন সম্রাট, অর্থাৎ নতুন যাঁরা রাজা হলেন ইংলন্ডে তাঁরা—ব্রিটিশ ধনিকশ্রেণি।*

ইংল্যান্ডের বাইরে ব্রিটিশ মূলধনের গতি—পরিবর্তনের ধারা থেকে ব্রিটিশ পুঁজিপতিশ্রেণির উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্বার্ট বলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চিনির ব্যাবসা এবং আফ্রিকার দাসব্যাবস্থায় ব্রিটিশ জাতি ধনসঞ্চয় করতে আরম্ভ করে।৩৪ নেপোলিয়নিক যুদ্ধের পর ইয়োরোপের পুনর্গঠনই ছিল ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্দেশ্য। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ইয়োরোপীয় রাষ্ট্রগুলির গর্ভমেন্ট সিকিউরিটিতে প্রায় ৫ কোটি পাউন্ড ব্রিটিশ মূলধন নিযুক্ত হয়। এ ছাড়া লাটিন আমেরিকায় ২ কোটি পাউন্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নালা বন্দর ইত্যাদি নির্মাণের জন্য ৫০—৬০ লক্ষ পাউন্ড ব্রিটিশ মূলধন এই সময়ের মধ্যে নিযুক্ত হয়।৩৫ ১৮৪০ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ মূলধনের প্রবাহ প্রধানত ইউরোপ ও আমেরিকামুখী ছিল। এই সময় রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রচুর ব্রিটিশ মূলধন ফ্রান্স বেলজিয়াম ইতালি অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে নিযুক্ত হয়। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ পাউন্ড এবং ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৩০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের রেলপথ তৈরির লোহার জিনিস ইংল্যান্ড থেকে বাইরে রপ্তানি করা হয়। ১৮৫৭ সালে দেখা যায়, মোট ব্রিটিশ রপ্তানির এক—পঞ্চমাংশ হল লোহা তামা ও টিনের জিনিসপত্তর। ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে প্রধানত ভারতীয় রেলপথ নির্মাণ ও জনকল্যাণকর ব্যবস্থাদির জন্য ব্রিটিশ মূলধন খাটানো হয়। ভারতীয় রেলপথের লোহার জিনিস সব ব্রিটেনই সরবরাহ করে এবং ‘ইন্ডিয়া অফিস’ এই সময় ভারতের রেল কোম্পানিগুলির ‘Fiscal Agent’-এ পরিণত হয়।৩৬ প্রাইস বলেন যে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ মূলধন প্রধানত ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি, জায়গা জমি গৃহসম্পত্তি কেনা ও গুদামঘর তৈরির কাজেই নিযুক্ত ছিল। ১৮৭২ সালের মধ্যে দেখা যায় প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড ব্রিটিশ মূলধন ভারতবর্ষে খাটানো হয়েছে।৩৭

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে টেকনোলজিক্যাল বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের ক্রমিক বৃদ্ধি, পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক, বিশেষ করে মধ্যভাগ থেকে, ব্রিটিশ মূলধনের স্ফীত ও বহির্মুখী গতি, ব্রিটিশ ধনতন্ত্রের বিকাশ ও প্রসার, এই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনার মূলে হল ষোড়শ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীব্যাপী ব্রিটিশ বণিকশ্রেণির বিদেশে প্রাথমিক মূলধন সঞ্চয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই ইতিহাসের মধ্যে ব্রিটিশ বণিকতন্ত্র ও বণিকশ্রেণির অবসান এবং ব্রিটিশ ধনতন্ত্র ও বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে, বিশেষ করে মধ্যভাগে, ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একাধিপত্যের অবসান এবং ব্রিটিশ বুর্জোয়াশ্রেণির প্রভাব বিস্তার এই কারণেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সময় কোম্পানির আমলের ধ্বংস ও লুঠতরাজের কাজ আরও দ্রুতগতিতে সুসম্পন্ন হলেও, নতুন যুগের নির্মাণ ও পুনর্জীবনের কাজও কিছুটা শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় নতুন যুগের নির্মাণ ও নবজাগরণ অত্যন্ত মন্থরগতিতে হলেও নিশ্চিত শুরু হয়, মধ্যভাগ থেকে ভারতের অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার চিহ্নগুলি স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। অবশ্য ‘নবজাগরণ’ প্রধানত পাশ্চাত্য ভাবসংঘাতের আলোড়ন, এবং সেই আলোড়নও প্রধানত নগরকেন্দ্রিক নব্যশিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই গণ্ডিবদ্ধ ছিল।

নতুন যুগের অর্থনৈতিক রূপ

ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের একমাত্র লক্ষ হল ইংল্যান্ডের কলকারখানার প্রসারের জন্য ভারতবর্ষ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা এবং ইংল্যান্ডের যন্ত্রশিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের বাজার গ্রাম থেকে নগর—মহানগর পর্যন্ত গড়ে তোলা। কাঁচামালের উৎপাদনবৃদ্ধি এবং ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য চালানের সুবিধার জন্য যানবাহনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধন, রেলপথ নির্মাণ ইত্যাদি হল ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের প্রধান কাজ। রেলপথ কয়লাখনি পাটকল চা—বাগান কফিবাগান ও নীলখেতেই ব্রিটিশ মূলধন খাটানো হল বেশি। এমন সব ক্ষেত্রে ব্রিটিশ মূলধন খাটানো হল যা আবাদ করলে সোনা ফলবে অর্থাৎ মূলধন তো ফাঁপবেই, উপরন্তু এ দেশের কাঁচামালে ব্রিটেনের কলকারখানারও উন্নতি হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে ভারতবষের্র শ্রমশিল্পে বিপ্লব ঘটল না। ভারতের পুরাতন অর্থনৈতিক কাঠামো লন্ডভন্ড করে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা নতুন যে শক্তি সঞ্চারিত করল তার স্বাভাবিক বিকাশ ও পরিণতির পথে তারাই আবার বাধা সৃষ্টি করল। ভারতের বণিকশ্রেণি, ভারতের ভবিষ্যৎ ধনিকশ্রেণিকে ব্রিটিশ ধনিকরাই সচেতন করল, নতুন ধনতান্ত্রিক যুগের মন্ত্রে তাদের দীক্ষিত করল, পুরাতন প্রাকারবেষ্টিত নগর ও আত্মকেন্দ্রিক গ্রাম্য সমাজের সংকীর্ণ সীমানা থেকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে নতুন যন্ত্রযুগের মুখোমুখি তাদের দাঁড় করিয়ে দিল, তারপর পদে পদে তাদের অগ্রগতি ও আধিপত্য বিস্তারের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করাই হল তাদের অন্যতম লক্ষ। কিন্তু তাহলেও ব্রিটিশ ধনতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য দান হল, প্রাচীন ভারতীয় সামন্তপ্রথার ভিত শিথিল করে দিয়ে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রের নতুন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের অনুকূল বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি করা। মার্কস বলেছেন :৩৮

ব্রিটিশ বুর্জোয়াশ্রেণি যা করতে বাধ্য হবে তাতে জনসাধারণের সামাজিক দুরবস্থার বাস্তব উন্নতি বা মুক্তি সম্ভব হতে পারে না। তার জন্য অর্থনৈতিক উৎপাদনশক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন এবং শুধু বৃদ্ধিও নয়, সেই উৎপাদনশক্তি জনসাধারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাহলেও ব্রিটিশ বুর্জোয়াশ্রেণি যা করতে বাধ্য হবে তাতে আর কিছু না হোক, এই উন্নতি মুক্তি ও শক্তিবৃদ্ধির বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি হবেই। ইতিহাসে কোথাও কি বুর্জোয়াশ্রেণি এর চাইতে বেশি কিছু করতে পেরেছে?…

ব্রিটিশ বুর্জোয়াশ্রেণি ভারতবর্ষে যে নতুন সমাজব্যবস্থার বীজ ছড়িতে দিতে বাধ্য হবে, চারিদিকে তার পরিপূর্ণ প্রকাশ একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন ইংল্যান্ডের মজুরশ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে, অথবা যখন ভারতের জনসাধারণ নিজেরা সংগ্রাম করে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্ত হবে।

নতুন যুগের এই যে ‘material premises’ এবং ‘new elements of society’—র কথা মার্কস বলেছেন তা আরও চমৎকারভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ মালিকশ্রেণির রেলপথ নির্মাণের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে। মার্কস পরিষ্কার করে বলেছেন :৩৯

আমি জানি, ব্রিটিশ মিল—মালিকশ্রেণি (millocracy) ভারতে রেলপথ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে যাতে তাদের কলকারখানার জন্য তুলো ও অন্যান্য কাঁচামাল সরবরাহের সুবিধা হয়। কিন্তু একবার কোনও দেশের মধ্যে যানবাহনব্যবস্থার যদি যন্ত্রদানবের আবির্ভাব হয় এবং সে দেশে লোহা ও কয়লা সম্পদ প্রচুর পরিমাণে মজুত থাকে, তাহলে সাধ্য কার যে তার অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে? বিরাট একটা দেশের ভিতরে যদি স্নায়ুমণ্ডলীর মতন রেলপথ নির্মাণ করা হয় তাহলে বাধ্য হয়ে সেই রেলপথ চালু রাখার প্রয়োজনে সে দেশে যন্ত্রচালিত কলকারখানাও গড়ে তুলতে হবে। তার সঙ্গে অনিবার্য নিয়মে এমন সব কারখানাও গড়ে উঠবে, এমন সব শ্রমশিল্পে যন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করতে হবে, যার সঙ্গে রেলপথের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্কও থাকবে না। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে রেলপথ ভারতীয় শ্রমশিল্প যুগের অগ্রদূত… রেলপথ বিস্তারের জন্য যেসব আধুনিক শ্রমশিল্পের বিকাশ হবে তার আঘাতে ভারতের অগ্রগতির পথের অন্তরায়গুলি একে একে দূর হয়ে যাবে, ভারতের বর্ণ গোঁড়ামি, গ্রাম্য সমাজের জড়তা, কূপমণ্ডূকবৃত্তি সব ভেঙে যাবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কার্ল মার্কস সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়ে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার অগ্রগতির ধারা সম্বন্ধে যে ভবিষ্যদবাণী করে গিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও, একেবারে মিথ্যা হয়নি। নতুন যুগে ভারতের সামাজিক প্রগতির যে ‘বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি’, ‘নতুন উপাদান’ ও ‘নতুন বীজ’ বপনের কথা মার্কস বলেছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তার পরিচয় পাওয়া গেছে।

ব্রিটিশ যুগে বণিকতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের দিকে ভারতের অর্থনৈতিক ঝোঁকের কথা অস্বীকার করা ভুল। নতুন যুগের এই নতুন ঝোঁক, নতুন গতিই হল বৈপ্লবিক৪০। রেলপথ তৈরি হবার পর ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষে আধুনিক কলকারখানার সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলা দেশে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে প্রথম কাগজের কল তৈরি হয়। ১৮২০ সালে রানিগঞ্জে প্রথম কয়লাখনি খোঁড়ার পর প্রায় বিশ বছরের মধ্যে আর কোনও নতুন খনি খোঁড়া হয় না। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলপথ তৈরির সময় থেকে খনির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮৭৯—৮০ সালের মধ্যে রানিগঞ্জে ও তার আশপাশে প্রায় ৫৬টি কয়লাখনিতে কাজ শুরু হয়। ১৮৭২—৭৩ সালে বোম্বাই প্রদেশে ১৮টি এবং বাংলায় ২টি কাপড়ের কল তৈরি হয়। পাটচাষ ও পাটশিল্প বাংলা দেশেরই একচেটিয়া ছিল বলা চলে। ১৮৫৪ সালে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে পাটশিল্প আরম্ভ হয়নি। ওই বৎসরে জনৈক মি. অকল্যান্ড প্রথম পাটের কল নির্মাণ করেন শ্রীরামপুরে। ১৮৮২ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে ২০টি পাটের কল তৈরি হয়, তার মধ্যে ১৮টি হয় বাংলা দেশে এবং এই ১৮টির মধ্যে ১৭টি কলকাতার উপকণ্ঠে। আসামে ১৮৫৬ সালের মধ্যে চা—বাগানের প্রতিষ্ঠা হয়। গুজরাত ও পশ্চিম ভারতে আগে নীলচাষ হত, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে তার অবনতি ঘটে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই নীলচাষের পুনপ্রবর্তন করে বাংলাদেশে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বাংলাদেশে পূর্ণোদ্যমে নীলচাষ আরম্ভ হয় এবং মধ্যভাগে যথেষ্ট পরিমাণে নীল রপ্তানি হতে থাকে। রেলপথ নির্মাণের পর ভারতের সর্বত্র যে আধুনিক কলকারখানা ও খনির প্রসার হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায় :৪১

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কয়লাখনি রেলপথ চা—বাগান পাটকল কাপড়ের কল ইত্যাদি বেশি তৈরি হয় এবং সর্বক্ষেত্রে প্রধানত ব্রিটিশ মূলধনই নিযুক্ত হয়। কিন্তু তাহলেও ভারতবর্ষে যে শ্রমশিল্পের বিকাশ হচ্ছে, বিশেষ করে রেলপথ নির্মাণের পর, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না। এই সময় থেকে ভারতের অর্থনৈতিক গতি বণিকতন্ত্র ও ধনিকতন্ত্রের দিকে বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এই গতি ব্যাহত হয় ব্রিটিশের স্বার্থে এবং তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া ক্রমে নবজাগরণের ব্যর্থতায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

মহানগর অভিমুখে যাত্রা

রেলপথ ও যানবাহনের প্রসারের ফলে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতবর্ষ সংহত ও কেন্দ্রীভূত হয়। শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের প্রতিযোগিতায় কারুশিল্প ও কুটিরশিল্প উৎখাত হয়ে যায়। কারুশিল্পী ও কারিগরদের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, উৎপাদনের যন্ত্রপাতির উপর কর্তৃত্ব বা ব্যক্তিস্বাধীনতা তাদের আর থাকে না, সামান্য পুঁজিতে আর কুলোয় না। তার ফলে তারা বণিক ও ধনিকশ্রেণির অধীনে বেতনভুক মজুরশ্রেণিতে পরিণত হতে থাকে।৪২ এই সঙ্গে গোমস্তা কেরানি ব্যাপারী দালাল প্রভৃতি নিয়ে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয়। শ্রমশিল্প ও যানবাহনকেন্দ্রে নতুন শিল্পনগর গড়ে ওঠে। প্রাচীন মধ্যযুগীয় ‘কোর্ট টাউন—এর’ জাঁকজমক ক্রমে ম্লান হয়ে যায়। শিল্পকেন্দ্রে ও যানবাহনকেন্দ্রে যে নতুন শহর ও মহানগর গড়ে ওঠে সেইদিকেই যাত্রা করতে থাকে নতুন বণিক ও ধনিকশ্রেণি, নতুন মধ্যবিত্ত ও মজুরশ্রেণি। আগ্রা আমেদাবাদ লক্ষ্নৌ ঢাকা মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি মধ্যযুগের নগরগুলির প্রভাব ও আকর্ষণ কমতে থাকে। আমেদাবাদ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :৪৩

আমেদাবাদে এসে এই প্রথম দেখলুম, চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে তার পিছন—ফেরা বড়ো ঘরোয়ানা তার সাবেক দিনগুলো যক্ষের ধনের মতো মাটির নিচে পোঁতা। আমার মনের মধ্যে প্রথম আভাস দিয়েছিল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’—এর গল্পের।

সে আজ কত শত বৎসরের কথা। নহবতখানায় বাজছে রোশনচৌকি দিনরাত্রে অষ্ট প্রহরের রাগিণীতে; রাস্তায় তালে তালে ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে; ঘোড়—সওয়ার তুর্কি ফৌজের চলছে কুচকাওয়াজ, তাদের বর্শার ফলায় রোদ ঝকঝকিয়ে। বাদশাহি দরবারের চারদিকে চলেছে সর্বনেশে কানাকানি ফুসফাস। অন্দরমহলে খোলা তলোয়ার হাতে হাবসি খোজারা পাহারা দিচ্ছে। বেগমদের হামামে ছুটছে গোলাব—জলের ফোয়ারা, উঠছে বাজুবন্ধ—কাঁকনের ঝনঝনানি। আজ স্থির দাঁড়িয়ে শাহিবাগ, ভুলে যাওয়া গল্পের মতো—তার চারদিকে কোথাও নেই সেই রঙ, সেই সব ধ্বনি—শুকনো দিন, রস ফুরিয়ে যাওয়া রাত্রি।

‘পুরোনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে; তার মাথার খুলিটা আছে মুকুট নেই।’ একথা শুধু পুরাতন আমেদাবাদ সম্বন্ধে যেমন সত্য, অন্যান্য মধ্যযুগের ‘কোর্ট—টাউন’ সম্বন্ধেও তেমনি সত্য। নতুন যুগের স্বর্গপুরী হল শিল্পনগর শহর মহানগর। মহানগরেই দেশ—বিদেশের লোকসমাগম হয়, মহানগরেই কাজকর্মের অফুরন্ত সুযোগ পাওয়া যায়, ব্যাবসাবাণিজ্য শিক্ষাদীক্ষা চাকুরি মোসাহেবি সব কিছুর প্রশস্ত ক্ষেত্র মহানগর। তাই মহানগর অভিমুখে ঐশ্বর্য ধনসম্পদ মুনাফাবৃদ্ধির লোভে বণিক ও ধনিরা যাত্রা করে, সুযোগসন্ধানী ভাগ্যান্বেষী মধ্যবিত্তরা ভাগ্যবান হবার আশায় আর হতভাগ্য ভূমিহীন নিঃস্ব কৃষক ও কারিগরেরা দিনমজুরির আশায়, জীবনধারণের তাগিদে ভিড় করে মহানগরে। কলকাতা বোম্বাই মাদ্রাজ করাচি কানপুর জামসেদপুর প্রভৃতি নতুন যুগের শিল্পনগর শহর ও মহানগরের দ্রুত বিকাশ হয়, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে নগরপরিকল্পনারও পরিবর্তন শুরু হয়। এ যুগের রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপন দেওয়ার রীতি যদি বিগত শতাব্দীতেও থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তখন এরকম বিজ্ঞাপন দেশের ভিতরে নানা স্থানে দেখা যেত :৪৪

মহানগরে যাও
মুক্তি পাবে
উন্নতি হবে

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইয়োরোপে যেসব শিল্পনগর গড়ে উঠেছিল সেগুলিকে চার্লস ডিকেন্স তাঁর ‘হার্ড টাইমস’ গ্রন্থে ‘কোক টাউন’ বলে বর্ণনা করেছেন। এঙ্গেলসও এইসব শিল্পনগরের নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন। লুইস মামফোর্ড লিখেছেন :৪৫

১৮২০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে নতুন শক্তি ও সংগতি নিয়ে যেসব শহর গড়ে উঠল সেগুলো ঠিক যেন যুদ্ধক্ষেত্রের মতন। শক্তি ও সংগতি অনুযায়ী তাদের বিকাশ হল। শিল্পপতি ব্যাঙ্কার ও নতুন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবকরাই হলেন নতুন শহরের হর্তাকর্তাবিধাতা। তাঁদেরই তাগিদে ‘কোক টাউন’—এর প্রসার হল। ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি শহরে এই সময় কোক টাউনের বৈশিষ্ট্যগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই যে নতুন নগর পত্তন হল এর রাজনৈতিক স্তম্ভ হল প্রধানত তিনটি। পুরাতন গিল্ডগুলির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন মজুরশ্রেণির জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নষ্ট করা; পণ্যদ্রব্য ও মেহনত বেচাকেনার বাজার তৈরি করা, কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বাইরে উপনিবেশ দখল করা এবং সেখানে উদবৃত্ত পণ্যদ্রব্য বিক্রি করা। নতুন নগরের অর্থনৈতিক স্তম্ভ হল কয়লাখনি লোহা আর স্টিম ইঞ্জিন।

মামফোর্ড যাকে রাজনৈতিক ভিত্তি বলেছেন, সাধারণভাবে সেটাকেই অর্থনৈতিক ভিত্তি বলা যায় এবং তাঁর অর্থনৈতিক ভিত্তি হল টেকনিক্যাল ভিত্তি। এই হল নতুন শ্রমশিল্প যুগের অর্থনৈতিক সংগঠন এবং তারই বহিরঙ্গ হল কোক টাউন; ইউরোপের মতন আমাদের দেশে এইভাবে কোক টাউনের উদ্ভব হয়নি। বণিক ও ধনিকযুগের সন্ধিক্ষণের নগরই এ দেশে গড়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে দেখা যায়, এ দেশের শিল্পনগরগুলি ইয়োরোপীয় কোক টাউনের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক গেডেস যাকে ‘town aggregates’ বা ‘conurbation’ নাম দিয়েছেন, সেরকম ‘শাখানগরসমষ্টি’ মহানগর কেন্দ্র করে এ দেশেও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে দেখা যায়।৪৬ কাঁচা লোহা ও কয়লাখনির কেন্দ্রে গুরুশিল্পের বিকাশ হওয়া স্বাভাবিক এবং তার জন্য বন্দর ও যানবাহনকেন্দ্র কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে বিহারের কয়লাখনি ও খনিজ লোহার কেন্দ্রে জামসেদপুরের মতন ‘coal-lron conurbations’-এর প্রচুর সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু জামসেদপুরেরও প্রধান বন্দর হল কলকাতা। তা ছাড়া রানিগঞ্জ আসানসোল কুলটি বার্নপুর কেন্দ্র করে বাংলা দেশেও শক্তিশালী ‘কনার্বেশনস’—এর সম্ভাবনা দেখা দেয়। কলকাতা থেকে হাওড়া হুগলি বর্ধমান মানভূম সিংভূম পর্যন্ত অত্যন্ত শক্তিশালী জনবহুল কয়লা—লোহা—উপনগরসমষ্টি যে অদূর ভবিষ্যতেই গড়ে উঠবে তা—ও বোঝা যায়।৪৭

বাংলার ঐতিহাসিক ভূমিকা। কলিকাতার প্রাধান্য

নতুন শ্রমশিল্পের যুগে বাংলার ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং বাংলার নতুন রাজধানী কলকাতা মহানগরের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কলকাতার প্রাধান্যের জন্যই বাংলার প্রাধান্য। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কলকাতার দুর্নিবার অগ্রগতি বাংলার অগ্রগতির লক্ষণ বলে গণ্য। নতুন যুগের ঐতিহাসিক নবজাগরণের নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক প্রাধান্য নিঃসন্দেহে কলকাতার, তাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবজাগৃতির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব বাংলার।

উইলিয়াম হান্টার বলেছিলেন : ‘প্রথম থেকে বাংলাই ছিল ভারতের কামধেনু। অন্যান্য প্রদেশ বাংলাদেশ থেকেই অর্থ শোষণ করত।’ মোগলযুগে যা সত্য ছিল, কোম্পানির আমলে বা ব্রিটিশ যুগে তা মিথ্যা হয়নি। ব্রিটিশ বণিক ও ধনিকশ্রেণির ধ্বংসাত্মক ভূমিকা অভিনয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ রঙ্গমঞ্চ ছিল বাংলাদেশ। সুতরাং অন্যদিকে তার গঠন উদ্যমের বিকাশও বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হয়েছে এবং ব্যাপকভাবেই হয়েছে। কলকারখানা কয়লাখনি রেলপথ বন্দর এবং সবার উপরে ‘মহানগর’ গঠনের কাজ বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম শুরু হয়েছে বললে ভুল হয় না। কলকাতা তথা বাংলার অর্থনৈতিক প্রাধান্য অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা চলে। কোম্পানির আমলে প্রথম যুগের ‘মার্কেন্টাইল হাউস’ ও ‘এজেন্সি হাউস’গুলি কলকাতাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় বেশি :৪৮

ব্রিটিশ মার্কেন্টাইল হাউসের সংখ্যা

(১৮৩৭ সাল পর্যন্ত)

কলকাতা : ৬২ সিঙ্গাপুর : ১৫ পেনাঙ : ২

বোম্বাই : ১৭ মাদ্রাজ : ১০ ক্যান্টন : ২১

কোম্পানির আমলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সম্বন্ধে গবেষণা করে রামচন্দ্র রাও যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাতে দেখা যায়, ১৭৭০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে একমাত্র কলকাতাতেই ১১টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকগুলির অন্য কোথাও শাখাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, কলকাতাতেই ব্যাংকিংয়ের সব কাজকর্ম করা হত। এ ছাড়া ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে লন্ডনের ৯টি ব্যাংয়ের শাখা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ৭টি ব্যাংয়ের শাখা (১৮৩৩—৪৬) কলকাতাতে প্রতিষ্ঠিত হয়।৪৯ এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা থেকে কলকাতার তথা বাংলার অর্থনৈতিক প্রাধান্য বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। আজ থেকে নয়, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বাংলার বাইরের অবাঙালিদের এবং ভারতের বাইরের অভারতীয়দের সর্বপ্রধান অর্থনৈতিক কর্মকেন্দ্র হয় কলকাতা।

কলিকাতা ‘fungus’ নয় ‘chance-directed’ ‘chance-erected’—ও নয়। তা যে নয় তা হান্টার সাহেব ব্যাখ্যা করে বলেছেন :৫০

বাণিজ্যে বিরাট কেন্দ্র অনিবার্য ঐতিহাসিক তাগিদে গড়ে ওঠে, কোনও স্বেচ্ছাচারী শাসকের খামখেয়ালে তা গড়ে ওঠে না। এই গড়ে তোলার দায়িত্ব রীতিমতো কঠিন, এত কঠিন যে আমাদের আগে পোর্তুগিজ ডাচ ফরাসি সকলেই ভারতবর্ষে এই দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হয়েছে, একমাত্র আমরা ইংরেজরাই সর্বপ্রথম সফল হয়েছি। আমাদের আগে এই বিশাল ঐশ্বর্যশালী সাম্রাজ্যের শাসকরূপে যেসব জাতির আবির্ভাব হয়েছে তাদের মতো আমরা আসিনি। আমরা হিন্দুদের মতো মন্দির অথবা মুসলমানদের মতো প্রাসাদ মসজিদ আর কবরখানা নির্মাণের দিকে নজর দিইনি, মারাঠাদের মতো দুর্গ কিংবা পোর্তুগিজদের মতো গির্জাও গড়িনি। আমরা এসেছি আধুনিক নগর নির্মাণের জন্য। এ কাজে আমাদের যোগ্যতা ও প্রতিভা যে অতুলনীয় তা আধুনিক শিল্প—বাণিজ্যকেন্দ্রে আমাদের মহানগর নির্মাণের সাফল্যে প্রমাণিত হয়। আমাদের মহানগর নির্মাণের অসাধারণ প্রতিভা ছিল বলেই ভারতবর্ষে নতুন শ্রমশিল্প যুগের সূচনা হয়েছে।

কলকাতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলার তথা ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতির ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। জলাভূমি জঙ্গল ও গ্রাম থেকে কীভাবে কলকাতা ধীরে ধীরে আধুনিক শহর ও মহানগরের রূপ ধারণ করেছে সে কাহিনি বলার কোনও প্রয়োজন নেই এখানে। রেভারেন্ড লং সাহেব বলেন, সে কাহিনি নাকি লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে সযত্নে রক্ষিত প্রায় এক লক্ষ খণ্ড সরকারি নথিপত্তরের মধ্যে সবিস্তারে লেখা আছে।৫১ মানুষের জৈবিক ক্রমবিকাশের কাহিনির মতো কলকাতার ক্রমবিকাশের কাহিনিও সুদীর্ঘ। এখানে তা আলোচনা করা অনাবশ্যক। কলকাতার আধুনিক মহানাগরিক রূপের বিকাশের ধারাই এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।*

নবদ্বীপ অগ্রদ্বীপ চক্রদ্বীপ (চাকদহ) খড়্গদ্বীপ (খড়দহ) আড়িয়াদ্বীপ (আড়িয়াদহ) শৃগালদ্বীপ (শিয়ালদহ) ইত্যাদি নামের শেষে যে ‘দ্বীপ’ এবং ‘দহ’ আছে তা থেকেই বোঝা যায়, চব্বিশ পরগনা খুলনা যশোহর সেকালে (সপ্তম খ্রিস্টাব্দেও) নিচু জলাভূমি ছিল। গঙ্গা পলিমাটি ঢেলে ঢেলে জলাডোবা ভরাট করেছে, নিম্নভূমি উঁচু করেছে, তার ফলে লোকজনের বসবাস বেড়েছে। গ্রাম ও গ্রাম্য সমাজ গড়ে উঠেছে, কলকাতা গোবিন্দপুর সুতানুটি ইত্যাদি। এইসব গ্রামে জেলে কুমোর কলু ছুতোর কাঁসারি শাঁখারি প্রভৃতির কারিগর ও কারুশিল্পীদের বাস ছিল। আজও তার পুরানো স্মৃতি জেলিয়াপাড়া ছুতোরপাড়া কুমোরটুলি কলুটোলা কাঁসারিপাড়া শাঁখারিপাড়া ইত্যাদি নামগুলি বহন করছে। ইংরেজরা আসার আগে, পলাশির যুদ্ধের পরে, কলকাতার অনেক প্রাচীন বনেদি বংশের আদিপুরুষেরা এইসব অঞ্চলে বসবাস আরম্ভ করেন। তার মধ্যে বড়বাজার ও চোরবাগানের বনেদি মল্লিক বংশের প্রতিষ্ঠাতা, রাজা সুখময় রায়, রামদুলাল দে, মতিলাল শীলের পূর্বপুরুষেরা, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, শোভাবাজারেরর দেব পরিবার, বাগবাজারের কালীপ্রসন্ন সিংহ ও গোকুল মিত্রর আদিপুরুষরা অন্যতম।

আমিরাবাদ, কলকাতা প্রভৃতি পরগনার প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী জমিদার তখন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের (মজুমদার, রায়চৌধুরী) বংশধর মনোহর রায়, মনোহর সিংহ। ১৬৯৮ সালে নবাবের কাছ থেকে ফরমান পাবার পর ইংরেজরা এই জমিদারদের কাছ থেকেই এই গ্রামগুলি বাৎসরিক খাজনায় লিজ নেয়।৫২ তারপর জলাজঙ্গল বাগান কেটে ইংরেজদের দুর্গ বসতি অফিস আদালত স্কুল কলেজ গড়ে উঠতে থাকে। লটারি কমিটির টাকায় রাস্তাঘাট ট্যাঙ্ক ইত্যাদি তৈরি হয় এবং তার সঙ্গে দেশের বনেদি জমিদার, ইংরেজদের এ দেশি বেনিয়ান মুৎসদ্দি রাজকর্মচারীরা, ধনী ব্যবসায়ী ও বণিকরা সুতানুটি কলকাতা গোবিন্দপুরে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। রাজা রাজবল্লভ, মহারাজা নন্দকুমারের পুত্র মহারাজা গুরুদাস (সুতানুটি), মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর (শোভাবাজার), অমিচাঁদ (অমিচাঁদের বিখ্যাত বাগান এখনও হালসিবাগান নামে খ্যাত), মহীশূর ও অযোধ্যার নবাব পরিবার (টালিগঞ্জ ও মেটিয়াবুরুজ), আন্দুল রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের বেনিয়ান দেওয়ান রামচরণ, হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর (পাথুরিয়াঘাটা), দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিং এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবু (জোড়াসাঁকো), রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রর পূর্বপুরুষ রাজা পীতাম্বর মিত্র, মুনশি দাসরুদ্দীন (মেছুয়াবাজার), বাবু বৈষ্ণবচরণ শেঠ, গৌরী সেন (‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’) ইত্যাদি ধনিক ব্যবসায়ীরা (বড়বাজার) কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। এঁদের অর্থে ও সামর্থ্যে এবং ইংরেজদের প্রয়োজনে কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নতি হয়। রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর প্রমুখ বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নবযুগপ্রবর্তকদের সকলেরই প্রধান কর্মকেন্দ্র কলকাতা শহর অথবা শহরতলি। ক্লাইভ স্ট্রিট, হেস্টিংস স্ট্রিট, ডালহৌসি স্কোয়্যার, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, ভ্যান্সিটার্ট রো, ওয়েলেসলি স্ট্রিট ইত্যাদির পাশাপাশি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, কেশবচন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ যুগনেতাদের নামের রাস্তাগুলিও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের পরিচয় দিচ্ছে। কলকাতা অবশ্য তখনও এ যুগের মহানগরের কর্মচঞ্চল ব্যস্তবাগীশ মূর্তি ধারণ করেনি।

শহরে ছ্যাকড়াগাড়ি ছুটছে তখন ছড় ছড় করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়—বের—করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে—বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে, কেউ বা পালকি চড়ে, কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা—আঁকা, চামড়ার আধ—ঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর—বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে—চলতি মানুষকে। মেয়েদের বাইরে যাওয়া—আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপ—ধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারী লজ্জা।৫৩

এ হল রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলার’ কলকাতার বর্ণনা, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কলকাতার রূপ। নতুন যুগের প্রতিমূর্তি কলকাতা তখনও পুরোপুরি নয়। কলকাতা তখন যুগসন্ধিক্ষণের কলকাতা।*

নবদ্বীপ—মুরশিদাবাদ থেকে কলকাতা

রাজমহল গৌড় নবদ্বীপ ঢাকা মুরশিদাবাদ কলকাতা—বাংলার রাজধানী। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা যুগসন্ধিক্ষণের কলকাতা, সেকালের ‘মাথার খুলিটা’ তখনও সে বহন করছে, কিন্তু মুকুট পরে আসছে একাল, নতুন বিজ্ঞান আর যন্ত্রের যুগ, তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে চারদিকে। নবদ্বীপ—মুরশিদাবাদ থেকে রেলপথে কলকাতা খুব বেশি দূর নয়, কিন্তু যূগের দূরত্ব অনেক। নবদ্বীপ যদি বাংলার ‘অক্সফোর্ড’ হয় তাহলে ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা নিঃসন্দেহে বাংলার ‘ফ্লোরেন্স’, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণকেন্দ্র। টোল—চতুষ্পাঠীর যুগ, নব্যন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের যুগ, রঘুনাথ শিরোমণি ও স্মার্ত রঘুনন্দনের যুগ অস্তমিত। নতুন বিজ্ঞানের যুগ, বৈজ্ঞানিক জীবনাদর্শ ও সংস্কারমুক্তির যুগ, অবাধ অর্থনৈতিক ও মানসিক মুক্তির যুগ উদীয়মান। ‘ছেলেবেলা’য় রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তা মিথ্যা নয় :৫৪

তখনকার কালের সঙ্গে এখনকার কালের তফাত ঘটেছে একথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই, আজকাল বাড়ির ছাদে না আছে মানুষের আনাগোনা, না আছে ভূতপ্রেতের। …অত্যন্ত বেশি লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে ব্রহ্মদৈত্য দিয়েছে দৌড়। ছাদের কার্নিসে তার আরামে পা রাখবার গুজব উঠে গিয়ে, সেখানে এঁটো আমের আঁঠি নিয়ে কাকেদের চলেছে ছেঁড়াছেঁড়ি।

সেকালের নবদ্বীপের মহিমা বর্ণনা করেছেন বাংলার বৈষ্ণব কবিরা :

নবদ্বীপ হেনগ্রাম ত্রিভুবনে নাই,
যাহে অবতীর্ণ হৈলা চৈতন্য গোঁসাই।

…. …. …..

নবদ্বীপ সম্পত্তি কে বর্ণিতে পারে,
এক গঙ্গা ঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে।
ত্রিবিধ বৈসে এক জাতি লক্ষ লক্ষ,
সরস্বতী দৃষ্টিপাতে সবে মহাদক্ষ।
সবে মহা অধ্যাপক করি গর্ব্ব ধরে,
বালকেও ভট্টাচার্য সনে কক্ষা করে।
নানাদেশ হৈতে লোক নবদ্বীপ যায়,
নবদ্বীপে পড়ি সেই বিদ্যারস পায়।

—চৈতন্য ভাগবত (আদি)

এ যুগের কবিরা অসংখ্য কবিতা লিখবেন কলকাতা মহানগর সম্বন্ধে। তাঁরাও বলবেন ‘কলিকাতা হেন’ মহানগর ভারতবর্ষে নেই, যেখানে রামমোহন দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগর মাইকেল বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ সকলেই অবতীর্ণ হয়েছেন। সেখানে গঙ্গাঘাটে লক্ষ লক্ষ লোক আজও হয়তো স্নান করে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ নানা জাতের লোক সদাগরি অফিসে যায় কেরানিগিরি করতে, হাজার হাজার লোক টাকার জন্য, মুনাফার জন্য ব্যাবসাবাণিজ্য করে, লক্ষ লক্ষ মজুর কারখানায় ছোটে বাঁচার তাগিদে। যেখানে ‘প্রতি ঘরের উপর বিচিত্র কলস’, ‘দিঘি সরোবর কূপ তড়াগ সোপান’ অথবা ‘মাঠ মণ্ডপ সুযন্ত্রিত চত্বর’—এসবের আধিক্য নেই, আছে ইট—পাথরের প্রাসাদ—অট্টালিকা, কলকারখানার ভোঁ, চিমনির ধোঁয়া, যান্ত্রিক ট্রাফিকের শব্দ জনতার উন্মত্ত কল্লোল। যেখানে পণ্ডিত অধ্যাপকের অভাব নেই, কিন্তু ‘তাল পড়ে ঢিপ করল, না ঢিপ করে তাল পড়ল’, ‘পাত্রাধার তৈল, না তৈলাধার পাত্র’—এই তর্কের মীমাংসা করাই চূড়ান্ত বিদ্যাচর্চা নয়। মুকুন্দ পণ্ডিতের চণ্ডীমণ্ডপের ‘বিস্তর পড়ুয়া’র মতন এখানকার স্কুল—কলেজেও পড়ুয়ার অভাব নেই। কিন্তু এ যুগের ‘পড়ুয়াদের’ পাঠ্য বিষয় অনেক বদলে গেছে এবং কলকাতায় তাদের লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে ব্রহ্মদৈত্যও দৌড় দিয়েছে। কলকাতায় নবযুগের বিজ্ঞান এসেছে, যুক্তিবাদ এসেছে। সেকালের নবদ্বীপের ন্যায়শাস্ত্রের কচকচি আর একালের কলকাতার বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের মধ্যে মূলগত পার্থক্য আছে। বেশ বোঝা যায়, যুগান্তরের ঢেউ এসেছে কলকাতায়, সেই ঢেউয়ের বিস্তার যা—ই হোক—না কেন। ছাদের কার্নিসে ব্রহ্মদৈত্য যে আর আরামে পা ঝুলিয়ে রাখতে পারছে না, ভূতপ্রেতের আনাগোনাও যে আর নেই, অত্যন্ত বেশি লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে যে তারা দৌড় দিয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায়, নতুন যুগের নতুন মহানগরে যুগমানসের অভিব্যক্তির সূত্রপাত হয়েছে। বিজ্ঞান ব্যক্তিস্বাধীনতা সংস্কারমুক্তি গণতন্ত্র ও শিক্ষার নতুন ভাবাদর্শের আমদানি হচ্ছে পণ্যদ্রব্য ও কাঁচামালের সঙ্গে কলকাতার বন্দরে। অর্থনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে আদর্শ—সংঘাতও দেখা দিচ্ছে মহানগরে। অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়মে নবযুগের বাংলার নবজাগৃতিকেন্দ্র হচ্ছে কলকাতা। মার্কস—এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার’—এ বলেছেন—

‘বুর্জোয়াশ্রেণি সমস্ত দেশকে নতুন শহরের অধীন করেছে। তারা বড় বড় মহানগর গড়েছে, গ্রামের তুলনায় নগরের লোকসংখ্যা অনেক বাড়িয়েছে। এইভাবে গ্রাম্য জীবনের জড়তা ও নির্বুদ্ধিতা থেকে তারা লোকসংখ্যার বিরাট একটা অংশকে মুক্তি দিয়েছে।’

কলকাতা বোম্বাই মাদ্রাজ মহানগর এবং অন্যান্য শহর ব্রিটিশ ও ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণির তাগিদে তৈরি। গ্রাম্য জীবনের জড়তা ও স্থিতিশীলতা থেকে এ দেশের মানুষকে আংশিক মুক্তিও দিয়েছে এই মহানগরগুলি। তাই বাংলার তথা সারা ভারতের নবজাগৃতিকেন্দ্র কলকাতা মহানগর। নবদ্বীপ ও মুরশিদাবাদ থেকে কলকাতা অনেক দূর। কালিক দূরত্বের কথা বলছি।

…….

* জমিদারি বন্দোবস্তের হিসাবরক্ষার জন্য কানুনগো নিয়োগ করা পাঠান আমলে প্রবর্তিত হয়। মোগল রাজত্বকালে পরগনার নিরিখবন্দি এবং জমিদার ইজারাদারদের কাজকর্ম তদারক করার জন্য পরগনা—কানুনগো থাকতেন। ‘নিরিখবন্দি’ অর্থে গ্রামের বা পরগনার জমির বিঘাপ্রতি ধার্য করের হিসাব—রেজিস্টার বোঝায়। গ্রাম্য পাটোয়ারি এই নিরিখবন্দি অনুসারে কাগজপত্র রাখতেন। নতুন বন্দোবস্ত তাঁর দপ্তরেই খারিজ—দাখিল করে নিতে হত। এই কারণে প্রধান কানুনগো প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এখনও মুর্শিদাবাদের পরপারে প্রধান কানুনগো বংশের বসতবাড়ি আছে। (১৯৪৮)

* ’Slavery was invented’—এঙ্গেলসের এই উক্তির মধ্যে ‘invented’ কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, দাসপ্রথা যে একটি ‘টেকনিক’ বিশেষ, এঙ্গেলস এই কথাই এখানে বলতে চেয়েছেন। উৎপাদনের টেকনিকের উন্নতি না হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হতে পারে না। আদিম গোষ্ঠীসমাজের পরবর্তীকালে দাসপ্রথা উন্নত টেকনিক রূপেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। (১৯৪৮)

* ইংলন্ডে শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার :

১৯১৩ — ১০০

১৭২০—২১ = ২.১ ১৭৪০—৪১= ১.০

১৭৬০—৬১ = ২.৬ ১৭৮০—৮১ = ৮.৫

১৭৯০—৯১ = ৪.৬ ১৮২০—২১ = ১.০

১৮০০—০১ = ৫.৭ ১৮৩০—৩১ = ১৪.৩

১৮১০—১১ = ৭.১ ১৮৪০—৪১ = ১৯.৬

Kuczynski, : A history of Labour Conditions in Great Britain, 1750 to the Present say, 2nd ed. পৃঃ ৩৮

* সংযোজিত অধ্যায় ‘বাংলার নবজাগরণ : সমীক্ষা ও সমালোচনা’ পঠিতব্য।

* চার্লস বুথ, রানট্রি প্রমুখ পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞানীদের মতো এ দেশেও কলকাতা, বোম্বাই প্রভৃতি মহানগরের Social Survey করা বিশেষ প্রয়োজন, কারণ তা না হলে দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলি যথার্থরূপে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। কলকাতার অস্বাভাবিক জনসংহতি এবং অবৈজ্ঞানিক নগর পরিকল্পনর জন্য যে বাসস্থান সংকট ও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে, নানা শ্রেণির (বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির) যে অর্থনৈতিক সংকট গভীর হয়ে উঠেছে, তার সঙ্গে বাংলার জাতীয় জীবনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। (১৯৪৮)

কলকাতা শহরের সার্ভে সম্প্রতি কিছু হয়েছে বটে, কিন্তু এই সমস্যাসংকুল মহানগরের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার বহুমুখী সার্ভে, প্রকৃত সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে, আজও করা হয়নি। অথচ কলকাতার সংকট আজ সর্বভারতীয় সমস্যারূপে প্রকট হয়ে উঠেছে। (১৯৭৮)

* এ বিষয়ে আমি আমার ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’ গ্রন্থে (১৯৬৯) সবিস্তারে আলোচনা করেছি। (১৯৭৮)

***

নবজাগৃতিকেন্দ্র কলকাতা

১. Lewis Mumford : The Culture of Cities, ৫

২. Marx-Engels : Selected Correspondence, ৬৬—৬৭

৩. Rhys Davids : Buddhist India, ৩অ
 U. N. Ghoshal : Agrarian System in Ancient India. ১—৩লে
 Atindranath Bose : Social and Rural Economy of Northern India (Vol. I), ২অ

৪. Rhys Davids ওই

৫. Radhakumud Mookerjee : Indian Land System, ২২—২৪

৬. Capital (Vol. I), ১৪অ, ৪বি

৭. Census Report (1911)

৮. R. N. Gooddine : Village Communities of he Deccan, Baden Powell : Indian Village Community

৯. নিখিলনাথ রায় : প্রতাপাদিত্য

১০. কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় : মধ্যযুগে বাঙ্গলা, ২০০—২০৮

১১. Sir C. T. Metcalf : Minutes of Nov. 7, ১৮৩০

১২. নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় : মৌর্যযুগের ভারতীয় সমাজ, ২৫

১৩. D. R. Gadgil : Industrial Evolution of India, ১০অ, ১৪৪—১৫৮

১৪. নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় : ওই, ৩১—৩৯
 রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৮৪
 Shamasastri : Arthasastra of Kautilya (Text & Trans.)

১৫. B. B. Datta : Town Planning in Ancient India, ৮, ১১অ,
 P. K. Acharyya : Manasara (Trans)

১৬. K. M. Ashraf : Life and Conditions of the People of Hindustan (1200-1500 A.D.) J.A.S.B. (Vol. I, 1935).২৬৫—২৬৮

১৭. Das : Economic History of Ancient India
 N. C. Banerji : Economic Life & Progress in Ancient India (1)
 J. N. Samaddar : Economic Condition of Ancient India
 Prannath : Economic Condition of Ancient India
 Buch : Economic Life in Ancient India

১৮. Selected Correspondence ৬৪—৬৮ (২২ ও ২৩ নং চিঠি)

১৯. Rhys Davids ওই ১২০—১২১

২০. Fick : The Social Organisation in North-East India in Buddha’s Time (trans. by S. K. Maitra), ৩০৬

২১. A. N. Bose : ওই Vol. II, Book VI ১ম ও ২য় অ

২২. “The actual condition and life of this class, though not enviable, was better than that of the slaves of ancient Greece… Unlike those countries again, the number of slaves in India, though large, was a fraction of the labouring class.” (A. N. Bose : Vol. II, ৪২৩)
 এর অর্থ হল, এ দেশে ‘দাসপ্রথা’ একটা বিশেষ অর্থনৈতিক যুগ বা ব্যবস্থারূপে বিকাশলাভ করেনি। সেটা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার জড়তা ও স্থিতিশীলতার পরিচয়, শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় নয়। —লেখক

২৩. Engels : Anti-Duhring (L. W. ed), ২০২—২০৩

২৪. Fick : ওই

২৫. J. B. S. Haldane : Science Advances, ১৮০—১৮১

২৬. K. S. Shelvankar : The Problem of India, ১০৬—১১১

২৭. John Hales : Brief Conciet of English Policy (1549?)
 T. Mun : A Discourse of Trade from England to the East Indias (1621); England’s Treasure by Foreign Trade or the Ballance of our Foreign Trade is the Rule of Our Treasure (১৬২৮ সালে লেখা, ১৬৬৪ সালে প্রকাশিত)

২৮. Mun : England’s Treasure, ২অ

২৯. Capital (Vol. I), Everyman’s ed, ৮৩৫

৩০. H. Verelst : A View of the Rise, Progress and Present State of the English Govt. in Bengal (Lond. 1772)
 R. C. Dutt : Economic History of India (Early British Rule)

৩১. Verelst : ওই

৩২. Selected Correspondence ৬৭ (২৩ নং চিঠি)

৩৩. A Wolf : A History of Science, Technology and Philosophy in the 16th & 17th Centuries (1935)
 Engels : The Condition of the Working-class in England in 1844
 Knowles : Industrial & Commercial Revolutions in Great Britain in 19th Century (1946)

৩৪. Sombart : Quintessence of Capitalism (Eng. Trans, 1915)

৩৫. Jenks : Migration of British Capital, ৬৪

৩৬. Jenks : ওই ২২০
 Dobb : Studies in the Development of Capitalism, ২৯০—২৯১

৩৭. Price : Economic Problems of Europe, ৪১

৩৮. Marx : Future Results of British Rule in India (New York Daily Tribune 1853)

৩৯. Marx : ওই

৪০. P. P. Pillai : Economic Condions in India (2nd Imp. 1928), ৯—১৪

৪১. Gadgil : ওই, ৪৮—৫৪
 Pillai : ওই ৩১—৩২

৪২. Shelvankar : ওই, ১১৯—১২০

৪৩. রবীন্দ্রনাথ : ছেলেবেলা ৫১

৪৪. Leo Huberman : Man’s Worldly Goods, ২৬

৪৫. Mumford : ওই, ১৪৪

৪৬. Patrick Geddes : Cities in Evolution, ৩৪—৩৫

৪৭. T. R. Sharma : Location of Industries In India, ১, ৪, ৫ ও ৬অ

৪৮. J. Crawford : Sketch of the Commercial Resources, Monetary and Mercantile System of British India (London, 1837)

৪৯. B. R. Rau : Organised Banking in the Days of John Company (1800-1857), 53-55

৫০. W. W. Hunter : Our Indian Empire, ৬৫৯—৬৬০

৫১. Long : Peeps into Social Life of Calcutta

৫২. A. K. Roy : Lakshmikanta, ৫৩

৫৩. ছেলেবেলা, ৯

৫৪. ছেলেবেলা, ৩০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *