নবজাগৃতির ভাববিপ্লব

নবজাগৃতির ভাববিপ্লব

ইতিহাসের এগিয়ে চলার ছন্দ ও নিয়ম মার্কসই প্রথম আবিষ্কার করেন। এই নিয়ম অনুসারে, সমস্ত ঐতিহাসিক সংগ্রাম বাইরে থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, ধর্মবিরোধ, দার্শনিক বা আদর্শগত দ্বন্দ্ব বলে মনে হলেও, আসলে তা সমাজের কোনও বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত হয়।
ফ্রিডরিশ এঙ্গেল্স

কয়েকটি সংবাদ পরিবেশন করছি। ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এরকম কয়েকটি সংবাদ যা কেবল সংবাদ নয়। যেমন :

তণ্ডুল সম্পাদক নূতন যন্ত্র। অর্থাৎ ধানভানা কল। —১৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার এগ্রিকলটিউর সোসৈয়িটি অর্থাৎ কৃষি বিদ্যাবিষয়ক সমাজের এক সভা হইয়াছিল। ঐ সভায় ডেভিড স্কাট সাহেব কর্তৃক প্রেরিত কাষ্ঠ নির্ম্মিত ব্রহ্মদেশে ব্যবহৃত তণ্ডুল নিষ্পাদক একপ্রকার যন্ত্র অর্থাৎ যাঁতাকল সকলে দর্শন করিলেন ঐ যন্ত্রে প্রতিদিন কেবল দুই জন লোকে ১০ দশ মোন তণ্ডুল প্রস্তুত করিতে পারে, তাহার একজন কল লাড়ে ইহাতে পরস্পর শ্রান্তিযুক্ত হইলে ঐ কর্ম্মের পরিবর্ত্তন করে। এতদ্দেশে ঢেঁকি যন্ত্রে তিন জন বিনা অর্দ্ধমোনের অধিক তণ্ডুল হওয়া দুষ্কর, আর তাহারা পরিশ্রান্ত হইলেই ঢেঁকি বন্ধ হয়।

(সমাচার দর্পণ, ১১ মার্চ ১৮২৬)

কলিকাতার গঙ্গাতীরস্থ কল। —যে কল কএক মাসাবধি কলিকাতার গঙ্গাতীরের রাস্তার উপর প্রস্তুত হইতেছিল তাহা সম্প্রতি সম্পূর্ণ হইয়াছে এবং কলিকাতাস্থ লোকদিগকে সুজি যোগাইয়া দিতে আরম্ভ করিয়াছে। এই কলের দ্বারা গম পেষা যাইবে ও ধান ভানা যাইবে ও মর্দ্দনের দ্বারা তৈলাদি প্রস্তুত হইবে এবং এই সকল কার্য্যে ত্রিশ অশ্বের বল ধারী বাষ্পের দুইটা যন্ত্রের দ্বারা সম্পন্ন হইবে। এতদ্দেশীয় অনেক লোক এই আশ্চর্য্য বিষয় দর্শনার্থে যাইতেছেন এবং আমরা আপনাদের সকল মিত্রকে এই পরামর্শ দি যে তাঁহারা এই অদ্ভুত যন্ত্র বাষ্পের দ্বারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই হাজার মোন গম পিষিতে পারে তৎস্থানে গমন করিয়া তাহা দর্শন করেন।

(সমাচার দর্পণ, ৮ আগস্ট ১৮২৯)

…এইক্ষণে ইংলণ্ড হইতে সূতা ও নানাবিধ কাপড় যেমন যন্ত্রদ্বারা প্রস্তুত হইয়া আসিয়া থাকে তদ্রূপ এক নূতন যন্ত্র যাহা এইস্থানে স্থাপিত হইল, ইহার দ্বারা সূতা ও কাপড় প্রস্তুত হইবেক এবং বিলাতি বস্ত্র অপেক্ষাও এখানে অল্পমূল্যে পাওয়া যাইবেক আমিও তথায় প্রবেশ করিয়া কল দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম যেহেতুক এমন কল কখন দৃষ্টিগোচর হয় নাই পরন্তু কলিকাতায় আসিয়া সেই কথা সকলকে কহিবাতে শুনিলাম যে ঢাকা শহরেতেও ঐরূপ এক কল প্রস্তুত হইতেছে…পাঠকবর্গের মধ্যে কোন বিজ্ঞ পাঠক মহাশয় যিনি এসকল বিষয় বিলক্ষণ জ্ঞাত আছেন এবং ইঙ্গরেজী উত্তম জানেন ও ইংগ্লণ্ডীয় মহাশয়দিগের সহিত সর্ব্বদা সহবাস আছে তিনি অবশ্যই ইহার যথার্থ প্রকাশ করিবেন যে কলের দ্বারা দেশের মঙ্গল কি অমঙ্গল ও আমার সন্দেহ ভজনকরণে বাধিত করিবেন। —কস্যচিৎ চন্দ্রিকা পাঠকস্য।

(বঙ্গদূত, সমাচার দর্পণ, ৮ মে ১৮৩০)

ক্লাইব স্ট্রীট নামক রাস্তার গড়ে ২৫ ফুট নীচে অথচ টাঁকশালের মেঝের ২৬।।০ ফুট নীচে গঙ্গা হইতে প্রাপ্ত চড়ার উপরে বঙ্গদেশস্থ গৃহাদি নির্ম্মাণের অধ্যক্ষ অথচ তদ্বিষয়জ্ঞ শ্রীযুত কাপ্তান ফর্ব্বস সাহব কর্তৃক ১৮২৪ সালের মার্চ্চ মাসের শেষে ঐ গৃহের ভিত্তি স্থাপিত হয় অতএব উপরিলিখিত ইমারত অপেক্ষা মৃত্তিকার নীচে অধিক ইমারত আছে। ছয় বৎসরে ইহার তাবৎ কর্ম্ম সম্পন্ন হইয়াছে। তাহার মধ্যে বাষ্পীয় পাঁচ কল আছে বিশেষতঃ দুই কল ৪০ অশ্ব ও এক কল ২৪ অশ্ব ও এক কল ২০ অশ্ব এবং এক কল ১৪ অশ্বতুল্য বল এই যন্ত্রের দ্বারা দিবসে সাত ঘণ্টার মধ্যে ৩,০০,০০০খানা রূপা মুদ্রিত হইতে পারে। গত বৎসরের ৩০ আপ্রিল লাগাইদ নূতন টাঁকশালের সমুদয় খরচ ২৪ লক্ষ টাকা হইয়াছে তন্মধ্যে কলেতে ১১ লক্ষ এবং গৃহাদি নির্ম্মাণ বিষয়ে ১৩ লক্ষ। সম্পূর্ণরূপে কল চলিলে প্রতিমাসে ১৮,০০০ টাকা খরচ হয়। —গত জানুআরি মাসের আসিয়াটিক (সোসাইটির) জর্নল হইতে গৃহীত।

(সমাচার দর্পণ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৪)

নূতন মুদ্রাবিষয়ক আইন আগামী মঙ্গলবার ১ সেপ্টেম্বর তারিখ অবধি জারী হইবে। ঐ তারিখের পর ১৮৩৫ সালের ১৭ আকট অর্থাৎ আইনে নির্দ্দিষ্ট মুদ্রা ব্যতিরেকে অন্য কোন প্রকার মুদ্রা কোম্পানি বাহাদুরের অধিকৃত দেশের মধ্যে প্রস্তুত হইবে না। অতএব এইক্ষণে ভারতবর্ষের তাবৎ স্থানের মধ্যে কেবল একই প্রকার মুদ্রা চলন হইবে।

(সমাচার দর্পণ, ২৯ আগস্ট ১৮৩৫)

আমরা অতিশয় আহ্লাদপূর্ব্বক প্রকাশ করিতেছি যে ইংগ্লণ্ডদেশ হইতে বাষ্পের জাহাজ গত কল্য কলিকাতায় পঁহুছিয়াছে। এই জাহাজ তিন মাস বাইশ দিবসে আসিয়াছে কিন্তু এবার প্রথম যাত্রা অতএব বিলম্ব হওয়া আশ্চর্য্য নয় যেহেতুক সকলেই অবগত আছেন যে কোন কর্ম্ম প্রথম করিতে হইলে অবশ্য তাহাতে কিছু বিলম্ব হয়।

(সমাচার দর্পণ, ১০ ডিসেম্বর ১৮২৫)

সংপ্রতি বর্ষাকাল উপস্থিত হইয়াছে বটে কিন্তু কলিকাতা অবধি কাশী পর্যন্ত স্থলপথে গমনে কিছু প্রতিবন্ধক হয় নাই তাহার কারণ এই যে কলিকাতা অবধি কাশী পর্য্যন্ত গমনপথে যত নদী আছে সে সকলের উপর রজ্জুময় সেতু হইয়াছে অতএব গমনের কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক হয় নাই এবং অনায়াসে ডাক গমনাগমন করিতেছে।

(সমাচার দর্পণ, ২৩ জুলাই ১৮২৫)

মোকাম কলিকাতাতে ছকড়া গাড়ির উৎপাতে রাস্তায় চলা ভার…।

(সমাচার দর্পণ, ২৭ এপ্রিল ১৮২২)

গত এক বৎসরের মধ্যে এতদ্দেশে যত পুস্তক ছাপা হইয়াছে তাহার বিশেষ লিখিতে আমরা অতিশয় আনন্দিত হইলাম যেহেতুক এত পুস্তক ছাপা হইয়া সর্ব্বত্র লোকেরদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে এবং তদ্দ্বরা ক্রমে লোকেরদের জ্ঞান ও সভ্যতা বৃদ্ধি হইবেক। যে লোকেরা পুস্তক পাঠের রসাস্বাদন করিবেন তাঁহারা বুঝি বিস্মরণ হইতে পারিবেন না ইহাতে ক্রমে ২ ছাপা কর্ম্মের বাহুল্য ও লোকেরদের জ্ঞানোদয় হইবেক।

(সমাচার দর্পণ, ২২ জানুয়ারি ১৮২৫)

১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি শহরে প্রতিষ্ঠিত মুদ্রাযন্ত্রে নাথানিয়েল ব্রাসি হলহেড প্রণীত ‘A Grammar of the Bengal Language’ ছাপা হয় এবং ইংরেজিতে লেখা এই ব্যাকরণখানিতে দৃষ্টান্তস্বরূপ কৃত্তিবাসি রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত ও ভারতচন্দ্রর বিদ্যাসুন্দর থেকে অংশবিশেষ ছেনিকাটা বাংলা হরফে প্রথম মুদ্রিত হয়। ১৮৫৩ সালে ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি এ দেশে যানবাহনব্যবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে রেলপথ প্রবর্তনের কথা বলেন এবং ১৮৫৭ সালের মধ্যে প্রায় ৩০০ মাইল রেলপথ এ দেশে তৈরি হয়।

প্রাচীন বাংলা সংবাদপত্র থেকে সংকলিত কয়েকটি সংবাদ। সংবাদগুলি সাধারণ সংবাদ নয়, জাতীয় জীবনের সংবাদ। প্রত্যেকটি সংবাদ জাতীয় জীবনের যুগসন্ধিক্ষণের এক—একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবিশেষ। ঘটনাগুলি এই :

এ দেশের ঢেঁকি জাঁতা তাঁত ইত্যাদির বদলে বিদেশ থেকে ধানভাঙা কল, আটাপেষা কল, কাপড়ের কল আমদানি হচ্ছে। কলগুলি বাষ্পীয় শক্তিচালিত। কোনও কলে প্রতিদিনে দশ মন চাল হয়, কোনও কলে দিনে দুহাজার মন গম পিষতে পারা যায়। এ দেশে এসব কলের কাণ্ডকারখানা আগে কেউ দেখেননি, তাই দলে দলে সকলে গঙ্গার তীরে তীর্থযাত্রীর মতন কল দেখতে যাচ্ছেন এবং দেখে আশ্চর্য হচ্ছেন।* শুধু তা—ই নয়, অনেকের মনে প্রশ্ন উঠছে, সন্দেহ জাগছে। কলে কি দেশের মঙ্গল হবে, না অমঙ্গল হবে? সংবাদপত্রে তাঁরা পত্রক্ষেপ করে জানতে চাইছেন, ইংরেজদের ও ইংল্যান্ডের এইসব যন্ত্রপাতির ব্যাপার সম্বন্ধে যাঁরা অভিজ্ঞ ব্যক্তি তাঁরা যেন এই সন্দেহ তাঁদের মন থেকে দূর করেন। কল আসছে, নতুন টাঁকশালও তৈরি হচ্ছে। টাঁকশালে টাকাপয়সা তৈরির যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে। সাত ঘণ্টায় প্রায় তিন লক্ষ টাকা তৈরি করা হবে। কোম্পানির তৈরি এই টাকা ভিন্ন হরেকরকমের টাকাপয়সাও যে আর দেশের মধ্যে চলবে না, সে সংবাদও আমরা পাচ্ছি। বিচিত্র বহুরূপী সব পয়সাকড়ি আর চালু থাকবে না। পয়সার কি আর অন্ত আছে নাকি? পুরানো সিক্কা পাইপয়সা, নতুন ‘বিট’ পাইপয়সা, মাত্রাহীন বাংলার ফারসি ও দেবনাগরী অক্ষরে ছাপা। মহাদেবের বড় ত্রিশূলচিহ্ন—আঁকা পয়সা, ছোট ত্রিশূল—আঁকা ‘গুটলি’ পয়সা, পাটনাই পয়সা। তা ছাড়া ‘কামারিয়া ত্রিশূলি পয়সা’, অর্থাৎ দেশের কামাররা এক ছিলিম তামাক খাওয়ার মতন অত্যন্ত সহজেই যেসব কৃত্রিম পয়সা তৈরি করত। এত রকমের পয়সাকড়ি, সোনা—রুপোর টাকা—আধুলি আর চলবে না। কোম্পানির টাকাপয়সা সকলকে বিতাড়িত করে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। সংবাদগুলির মধ্যে এ দেশের যানবাহনব্যবস্থারও পরিচয় পাওয়া যায়। পাটনা কাশী গয়া বৃন্দাবন প্রয়াগ দিল্লি সর্বত্রই পায়ে—হাঁটা পথেই যাতায়াত করতে হত। পথের মধ্যে নদীর উপর কাঠের আর দড়ির সেতু ছিল। কোম্পানির আমলেও এই ব্যবস্থা বহুদিন চালু ছিল, নতুন পথ আর সেতু তৈরি হয়েছিল, ডাকবাংলো গড়ে উঠেছিল পথের মধ্যে মধ্যে ডাকবাহকদের, ইংরেজ কর্মচারীদের বিশ্রাম নেবার সুবিধার জন্য। জলপথে ছিল নৌকা। কিন্তু ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে বাষ্পীয় জাহাজ প্রথম এসে পৌঁছোল এ দেশে। অবশ্য তিন মাস বাইশ দিনে এল, কিন্তু তাতে কী? দেশের মধ্যে জলপথে বাষ্পীয় নৌকা চলাচল শুরু হল। তারপর ইংরেজদের স্বার্থেই যে এ দেশে রেলপথ তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন তা লর্ড ডালহৌসি বুঝলেন। রেলপথও তৈরি হল। দেশের পণ্ডিতদের যা কিছু পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান তা এতদিন হাতে—লেখা পুঁথির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই জ্ঞান বিতরণ করে নিজেদের জ্ঞানবৃদ্ধি করা এবং সাধারণ লোককে অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে মুক্তি দেবার কোনও প্রবৃত্তি তাঁদের ছিল না, কারণ উপায়ও ছিল না। ইংরেজদের আমলে এ দেশে ছাপাখানা এল, এ দেশের কর্মকারই তখন ছেনিকাটা বাংলা হরফ এবং অন্যান্য হরফ তৈরি করল। চালের বস্তায় গোঁজা পুঁথির গোপন বিদ্যা গ্রন্থাকারে ছাপা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।*

এই যে সব ঘটনা ঘটল, এগুলো আগেকার রাজ্য ভাঙাগড়ার এবং রাজবংশের উত্থান—পতনের গুরুগম্ভীর ঘটনার চেয়ে একদিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধানকল, গমভাঙা কল, পাটকল, কাপড়ের কল, টাকা তৈরির কল, বই ছাপার কল, বাষ্পীয় জাহাজ, রেলপথের বাষ্পীয় ইঞ্জিন—এসব যখন এ দেশে এল তখন সশব্দে তাদের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়নি। আর্য শক হূন পাঠান মোগলের ঘোড়ার মতন শব্দ করে তারা আসেনি, তলোয়ারের ঝনৎকারিও তাদের শোনা যায়নি। তারা নিঃশব্দে এসেছে, হয়তো একটু ধোঁয়া জমেছে এখানকার নির্মল আকাশে, অথবা একটু শব্দও হয়েছে নাটবলটু—শ্যাফট—হুইলের। কিন্তু আগেকার সমস্ত অভিযানের নৃশংসতা এ দেশের বোবা মাটি বুক পেতে সহ্য করেছে। হাজার নৃশংসতা, হাজার অত্যাচারেও এ দেশের ধ্যানমগ্ন সমাজের ধ্যানভঙ্গ হয়নি। ধ্যানভঙ্গ হয়েছে কলের ধোঁয়ায়, যন্ত্রপাতির শব্দে। আরবি ঘোড়া আর তলোয়ার যা পারেনি, সামান্য ধানকল, পাটকল, টাকা—ছাপানো কল, বাষ্পীয় ইঞ্জিন তা—ই পেরেছে। তারা শুধু উপরতলা ধ্বংস করেনি, সমাজের ভিত পর্যন্ত উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। তাই তারা শুধু ধ্বংসের আর্তনাদে আকাশ—বাতাস প্রতিধ্বনিত করে আসেনি, নবজীবনের নবজাগরণের প্রভাতি সুরের রেশ তুলেও এসেছে।*

তাই এ যুগকে আমাদের দেশের ‘রিনেস্যান্সের যুগ’ অর্থাৎ নবজীবন ও নবজাগৃতির যুগ, আধুনিক যুগের শৈশবকাল বলা হয়। ইউরোপের অনুকরণে বলা হয়, কিন্তু আমাদের ইতিহাসের দিক থেকে সম্পূর্ণ সুবিচার করে বলা হয় না।* চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে একদিন ইউরোপে নবযুগ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল উত্তর ইতালিতে, বিশেষ করে ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে। এ দেশে যেসব যন্ত্রদূত এসে বহু শতাব্দীর গাঢ় নিদ্রা থেকে আমাদের হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল, ইয়োরোপে তাদের জন্ম ও বিকাশ হচ্ছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। সামন্ততন্ত্রের জঠরেই তাদের জন্ম এবং সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করেই তাদের বিকাশ হয়েছে। সে কথা পরে বলছি। ইয়োরোপের বহু শতাব্দী ধরে যেসব যন্ত্রদূতের জন্ম ও বৃদ্ধি, ইয়োরোপকেও যারা মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে আধুনিক যুগের আলো—বাতাসের মধ্যে নিয়ে এসেছে, তারাই এ দেশের ঘুম ভাঙিয়েছে। তারা শরীরী ‘যন্ত্রী’, রীতিমতো স্থূল। তারা সূক্ষ্ম অশরীরী ‘আদর্শ’ নয়। তারা ‘টেকনিকস’, ‘ইডিওলজি’ নয়। মূল ‘টেকনোলজি’, ফল—ফুল শাখাপ্রশাখা ‘ইডিওলজি’। ইয়োরোপের নবজাগৃতির ভাববিপ্লব ঘটেছিল টেকনোলজিক্যাল বিপ্লবের জন্য। ইয়োরোপ থেকে টেকনোলজি ও ‘ইডিওলজি’ দুইই এ দেশে আমদানি হয়েছিল। কিন্তু কেবল যদি ‘আদর্শ’ আসত এবং তার সঙ্গে কল যন্ত্রপাতি স্টিম ইঞ্জিন, বাষ্পীয় জাহাজ না আসত, যদি টাকা তৈরির যন্ত্র, ছাপাখানা ও রেলপথ না তৈরি হত, তাহলে আদর্শের সোনার কাঠির স্পর্শেও এ দেশের ঘুমন্ত সমাজের ঘুম ভাঙত না, ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হত আদর্শকে। আদর্শকে এ দেশে বসবাস করতে হয়েছে, সেই বাসের বনিয়াদ তৈরি করেছে উন্নত উৎপাদনের হাতিয়ার, নতুন যন্ত্রপাতি, টেকনিক। কত সাধকের কত আদর্শ ব্যর্থ হয়েছে এ দেশে, জড়তার অতল অন্ধকারে কত মহন আদর্শ ডুবে গেছে তার হিসাব নেই। আদর্শের যে স্বতন্ত্র শক্তি নেই বা প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা নেই তা নয়। মার্কস—এঙ্গেলসও কোনওদিন তা বলেননি। ফল—ফুলের স্বাদ—সৌরভ নিশ্চয়ই আছে, তার ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়াও অস্বীকার করা মূর্খতা। কিন্তু ফল—ফুল শূন্যে ঝোলে না, গাছের ডালে ঝোলে, গাছের শিকড় থাকে মাটির তলায়। এই শিকড়টা হল ‘টেকনিকস’, বিশেষ অর্থনৈতিক উৎপাদন—পদ্ধতি, আর মাটি হল সমাজ। ফল—ফুলের বীজ মাটিতে পড়ে তা থেকে নতুন গাছ গজিয়ে ওঠে, আরও সজীব আরও সতেজ গাছ। তেমনি বিশেষ টেকনোলজির ভিত্তির উপর যে ইডিওলজির বিকাশ হয়। তারই প্রভাবে, ঘাতপ্রতিঘাতে আবার টেকনোলজিরও উন্নতি হয়। শেষকালে টেকনোলজির এই উন্নতি এমনই এক স্তরে পৌঁছোয় যখন পুরাতন খোলস তাকে ছাড়তে হয়, আদর্শ বিপ্লব ভাববিপ্লব ঘটে। এইভাবেই মানুষের উৎপাদন—হাতিয়ারের উন্নতি হয়েছে, উৎপাদন—পদ্ধতির বিকাশ হয়েছে, তারই ছাঁচে—ঢালা সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের রূপ বদলেছে, আদর্শের প্রগতি সম্ভব হয়েছে। এই হল মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস। অন্যান্য সব ইতিহাস হল কাহিনি রূপকথা গালগল্প অথবা ঘটনাসংকলন, ক্যাটালগ ও ক্রনিকল মাত্র।

ছোট ছোট যেসব যন্ত্রপাতির কথা আগে বলেছি তারা কেউ তাই ছোট নয়। ধানকল পাটকল কাপড়কল চেঙ্গিস তৈমুরের চাইতেও শক্তিশালী। প্রেস আর টাইপ আর টাঁকশাল শংকর—রামানুজ—কবীর—দাদূ—নানক—চৈতন্যর ব্যর্থ বাণী ও আদর্শকে রূপান্তরিত করে সার্থক করেছে। রেলপথ ও বাষ্পীয় জাহাজ উত্তর—দক্ষিণ, পুব—পশ্চিম ভারতের ব্যবধান ঘুচিয়েছে, গ্রাম্য আত্মকেন্দ্রিকতা ভেঙেছে। নতুন যুগের চৈতন্যর ভাবাদর্শ ঘণ্টায় অন্তত পঞ্চাশ মাইল বেগে ছুটে যেতে পারে। চৈতন্য যা পারেননি, বাষ্প ও বিজ্ঞান সহজেই সেই জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য সমাজের বুক থেকে বিলুপ্ত করতে পারবে। আর বুদ্ধ—যিশু—মহম্মদ কেউ যা পারেননি, ‘টাকা’ তা—ই পারবে। নবযুগের সুদর্শন চক্র ‘টাকা’ প্রচণ্ড বেগে ঘুরপাক খেতে খেতে সমাজের মধ্যযুগীয় শ্রেণিভেদ বংশগৌরব কৌলীন্যবোধ বর্ণবিভেদ সব ভেঙে চুরমার করে দেবে। সুতরাং ‘সমাচার দর্পণ’—এর সংবাদ সামান্য সংবাদ নয়, প্রত্যেকটি সংবাদ এক—একটি অসামান্য সংবাদ ও ঘটনা।

যন্ত্রযুগের শৈশবকাল

এ দেশে যন্ত্রযুগের শৈশবকালের বৈপ্লবিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে ইয়োরাপের যন্ত্রযুগের শৈশবকাল সম্বন্ধে আলোচনা করা আবশ্যক। বিশদভাবে আলোচনা না করলেও চলবে, কারণ এ বইয়ের বিষয়বস্তু অন্য। তবু যন্ত্রযুগের শৈশবকালে মূল যে কয়েকটি আবিষ্কারের জন্য বিরাট ভাববিপ্লব ঘটা সম্ভব হয়েছে তাদের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এইসব আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঘড়ি, ছাপাখানা, যন্ত্রের তৈরি কাগজ ও কাচ, মানচিত্র ইত্যাদি।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যেই যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি হয় ইয়োরোপে। ইতিমধ্যে অবশ্য গির্জায় ঘণ্টা বাজা শুরু হয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দীর আগে যদিও ঘড়ির ডায়েল কাঁটা ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ড কিছুই হয়নি, তাহলেও গির্জায় নিয়মিত ঘণ্টা বাজে, মহাকালের বুক কাঁপে, গির্জাও কাঁপে। ঘড়ির আগমনি গির্জার ঘণ্টাতেই বেজে উঠল, কিন্তু ঘড়ি এল গির্জার মহাকালের কল্পনা ধূলিসাৎ করতে। আধুনিক ঘড়ি ১৩৪৫ সালের মধ্যে ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ড সময়কে খণ্ড খণ্ড করে, ডায়েলের উপর কাঁটার সাহায্যে সময়ের ক্ষয়ের হিসাব দিয়ে তৈরি হল। এই ছোট্ট ঘড়িটি হল ভবিষ্যতের বিরাট জটিল যুন্ত্রযুগের প্রতিচ্ছবি। এই ঘড়ির ভিতরের কলকব্জার মডেলেই যেন ভবিষ্যতের সমস্ত যন্ত্রপাতি গড়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত সব যন্ত্র যত বিরাট ও জটিল হোক—না কেন, এইসব ঘড়ির ভিতরের যান্ত্রিক রূপের পরিবর্ধিত রূপ ছাড়া তা আর কিছুই নয়। ক্লকমেকার আর কর্মকারদের সহযোগিতায় পৃথিবীর অধিকাংশ যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব হয়ছে, তারাই হল যন্ত্রযুগের প্রথম মেশিনিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার। নানারকমের যন্ত্রপাতির বিচিত্র রূপকল্পনার উৎস হল ঘড়ি। তা ছাড়া যান্ত্রিক ঘড়ি মধ্যযুগের মহাকালের কল্পনাসৌধ সর্বপ্রথম ধূলিসাৎ করে দিল। সনাতন—শাশ্বতের কল্পনা, আদি—অন্তহীন মহাকালের কল্পনা, যার উপর মধ্যযুগের ধর্ম, দেবতা ও ধর্মযাজকের প্রভাব—প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাকে চূর্ণ করল ঘড়ি। সময় কূলকিনারাহীন মহাকাল নয়, শাশ্বত আর সনাতনের সঙ্গে মানুষের জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই—এই হল ঘড়ির বাণী, এ যুগের বাণী। টিকটিক করে, ঢং ঢং করে মহাকালের আকাশস্পর্শী মহীরুহকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে চলল ঘড়ি, এ যুগের নির্মম কাঠুরে। মহাকালের মহাসমুদ্রের বুকে যে মানুষের জীবন ছিল বুদবুদের মতন অর্থহীন, গির্জার গগনচুম্বী গম্বুজের দিকে চেয়ে, মসজিদের মিনার আর মন্দিরের চুড়ো পার হয়ে যে মানুষের দৃষ্টি স্বর্গের অসীম শূন্যতায় ঈশ্বরের সন্ধানে মিশে যেত, সেই মানুষের পায়ের তলায় মাটি হয়ে উঠল সত্য, তার জীবন ও অস্তিত্ব সম্বন্ধে সে হয়ে উঠল সচেতন। দেবতা নয়, সবার উপরে মানুষ সত্য, এ হল যুগের ঘড়ির বাণী। মানুষ শুধু সত্য নয়, তার চব্বিশটা ঘণ্টা সত্য, চৌদ্দশো’ চল্লিশ মিনিট সত্য, ছিয়াশি হাজার চারশো’ সেকেন্ডও সত্য। তেমনি মানবতার বিরাট আদর্শ শুধু সত্য নয়, তার প্রত্যেকটি মানুষও ঠিক তেমনি সত্য। ঘড়ি অবিরাম এই কথা ঘোষণা করে এল। সময়কেও টুকরো টুকরো করে হিসাব করা যায়, হিসাব করতে হবে। ফিউডাল লর্ড, রাজা—মহারাজার মতন বেহিসাবি হয়ে সময়ের অপব্যয় করলে চলবে না। সময়ের মূল্য আছে, টাকার দিক থেকে তো বটেই। ঘড়ি শুধু সমস্ত যন্ত্রের আদর্শ প্রতিচ্ছবি নয়, যন্ত্রযুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অগ্রদূত, বাস্তববাদের অগ্রদূত, সময়ের অর্থমূল্যের অগ্রদূত।

কালের ধারণার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘স্থান’ সম্বন্ধেও ধারণা বদলে গেল। ১৩১৪ সালে* হিয়ারফোর্ড মানচিত্র অথবা ১৩৪৬ সালের আন্দ্রিয়া ব্যাঙ্কার মানচিত্র আজকাল যে—কোনও শিশুও আঁকতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর এই প্রথম মানচিত্রগুলির উত্তর—দক্ষিণ—পূর্ব—পশ্চিমের সুস্পষ্ট দূরত্বরেখা তখন কলম্বাসের মতন অনেক দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল। সমুদ্রের উপকূল ধরে সাবধানে ভয়ে ভয়ে চলার আর প্রয়োজন নেই। মোটামুটি পৃথিবীটাকে চার কোণের সীমারেখায় বেঁধে ফেলা গেছে, স্থানের হিসাব একটা করা গেছে, ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে এখন ভূমণ্ডল বন্দি। সুতরাং অকূল সমুদ্রে নৌকোর পাল তুলে দিয়ে পাড়ি দেওয়া যায় যে—কোনও অজানা রাজ্যে, বিশাল পৃথিবীর যে—কোনও এক ভূখণ্ডে নৌকা ভিড়বেই এইভাবে। ক্লকমেকাররা শাশ্বত সনাতন মহাকালের কল্পনা এবং কার্টোগ্রাফাররা অনন্ত অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কল্পনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এ বিদ্রোহ যন্ত্রযুগের বিদ্রোহ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যেই ভেনিসের মুরানোতে কাচের বিখ্যাত কারখানা তৈরি হয়ে গেল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কাচ নয়, যন্ত্রযুগের কাচ—এ কাচের স্বচ্ছতা, প্রতিফলনশক্তি অনেক বেশি। উত্তল কাচের লেন্সের ভিতর দিয়ে দূরের ছোট জিনিস কাছে এবং কাছের জিনিস আরও কাছে অনেক বড় দেখা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে চশমার প্রচলন হল ইউরোপে। ১৬০৫ সালে ডাচ অপটিশিয়ান জোয়ান লিপপারশাইম প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে গ্যালিলিওর জ্যোতিষী গবেষণার পথ পরিষ্কার করে দিলেন। ১৫৯০ সালে আর—একজন ডাচ অপটিশিয়ান জ্যাকেরিয়াস জ্যানসেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। দু—জনেই অপটিশিয়ান, একজন বৃহত্তর জগৎ ক্ষুদ্রতর করলেন, আর—একজন ক্ষুদ্রতর জগৎ বৃহত্তর করলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কাচের ভিতর দিয়ে নিজের দাঁতের মধ্যে অদ্ভুত সব ক্ষুদ্র দানবকে আবিষ্কার করে ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানী লিউয়েনহুয়েক পৃথিবীর প্রথম ব্যাকটেরিয়োলজিস্ট হলেন। শুধু পৃথিবী নয়, গ্রহ—উপগ্রহের রাজ্য নয়, অদৃশ্য ব্যাকটেরিয়ার রাজ্য পর্যন্ত কাচের ভিতর দিয়ে মানুষের দৃষ্টিগোচর হল। তা ছাড়া চশমার ভিতর দিয়ে বাইরের বাস্তব জগৎটাও অন্যরকম মনে হল। বার্ধক্যের দৃষ্টিক্ষীণতার জন্য আর কিছুই অস্পষ্ট মনে হয় না। বার্ধক্যেও পরলোক—দেবলোকের অস্পষ্ট রহস্যের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হবার প্রয়োজন নেই। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আত্মচেতনা অবসন্ন হবে না। কাচের আরশিও তো এক অদ্ভুত জিনিস। এতদিন নার্সিসাসরা সরোবর ও দিঘির স্বচ্ছ জলে, অথবা অস্বচ্ছ কাচের ভিতরে নিজের যে রূপ দেখেছে তা তো অস্পষ্ট ঝাপসা। নিজের সেই অস্পষ্ট ঝাপসা রূপ দেখেই তো তারা মুগ্ধ হয়েছে এতদিন? আর এখন? বিখ্যাত ভেনিশিয়ান কাচের আরশিতে নিজের মুখ প্রতিফলিত হবে, কত সুন্দর, অদ্ভুত, কত অতুলনীয়ই না মনে হবে সেই মুখ। ভ্রূ চোখ কপাল নাক ঠোঁটের ভিতর দিয়ে প্রতিভার দীপ্তি ফুটে উঠবে, অপরাজেয় আত্মবিশ্বাস ও শক্তির বিদ্যুৎ ঝিলিক দেবে। ভেনিশিয়ান আরশির উপর দিয়ে এই দীপ্তির ঢেউ খেলে যাবে। ঘড়ি এবং ঘড়ির আদলে গড়া যন্ত্রপাতি যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অগ্রদূত হয়, তাহলে ভেনিশিয়ান গ্লাস উগ্র ব্যক্তিসর্বস্বতা ও অহমিকার অগ্রদূত নিশ্চয়ই।

কাগজ, ব্লক প্রিন্টিং ও ছাপার হরফের জন্ম চীনে। তারপর জাপান কোরিয়া তুরস্ক পারস্য ও মিশরেও তার প্রচলন হয়। আরবরাই চীন থেকে কাগজ তৈরির কৌশল ইউরোপে প্রচার করে। ফ্লোরেন্স ও ইতালিতে প্রথমে যন্ত্রে কাগজ তৈরি হয়। জার্মানিতে ছাপার আধুনিক কলাকৌশলের বিকাশ হয় এবং সেখান থেকে ইউরোপে ও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি গুতেনবার্গ ও তাঁর সহকর্মীরা আধুনিক ছাপাখানা ও টাইপ তৈরি করে ফেলেন। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়াতেই জার্মানিতে প্রায় হাজারেরও বেশি সাধারণ ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ভেনিস ফ্লোরেন্স প্যারিস লন্ডন সর্বত্রই এই ছাপাখানা গড়ে ওঠে। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ফলে এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটল। শিক্ষা ও জ্ঞান কারও ব্যক্তিগত বা কুলগত সম্পত্তি আর রইল না। মধ্যযুগের ধর্ম ও কুসংস্কারের ভিত্তি যে অজ্ঞানতা তার প্রথম যান্ত্রিক শত্রু হল প্রিন্টিং প্রেস। শিক্ষার সর্বজনীন গণতান্ত্রিক আদর্শ ছাপাখানাই ঘোষণা করল। কার্টার তাই বলেছেন, পৃথিবীর সমস্ত আবিষ্কারের মধ্যে সব চাইতে ‘cosmopolitan’ ও ‘international’ আবিষ্কার হল প্রিন্টিং প্রেস।

১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যন্ত্রযুগের শৈশবকাল বলা যায়। এই শৈশবকালের মধ্যেই মৌল আবিষ্কারগুলির ব্যাপক প্রসারের ফলে পরে শিল্পবিপ্লব ঘটে। মূল আবিষ্কারের সূত্র ধরে পরে আরও দ্রুতগতিতে অনেক আবিষ্কার হতে থাকে। মানবসভ্যতার এই প্রগতির ধারার যদি একশো বছরের কোনও মানুষের জীবনের তুলনা করা যায় তাহলে বলতে হয়, প্রায় ৮৫ বছর তার কিন্ডারগার্টেনে কেটেছে, ১০ বছর কেটেছে প্রাইমারি স্কুলে, আর বাকি ৫ বছরের মধ্যে সে অতি দ্রুতগতিতে হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষা শেষ করেছে। যন্ত্রযুগের প্রগতিও ঠিক এই ধারাতে হয়েছে। নবম শতাব্দীতে ঘোড়ার লোহার খুর ও আধুনিক সাজসজ্জা আবিষ্কারের পরে অশ্বচালিত উইন্ডমিল, ওয়াটারমিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঘড়ি কম্পাস বারুদ মানচিত্র যান্ত্রিক কাচ দূরবীক্ষণ অণুবীক্ষণ—যন্ত্র প্রিন্টিং প্রেস প্রভৃতির আবিষ্কার হয়েছে ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে। তারপর যান্ত্রিক হাতিয়ার (Mechanised tools), শক্তিসঞ্চারের যন্ত্রপাতি (Transmitting Mechanism) এবং বাষ্পীয় ও বৈদ্যুতিক (ভবিষ্যতে পারমাণবিক) প্রভৃতি শক্তিচালক যন্ত্রের (Motor Mechanism) ক্রমোন্নতির ফলে যন্ত্রযুগের দ্রুত অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।১০ যে—কোনও যন্ত্রকে এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমে হাতিয়ারগুলি যান্ত্রিক রূপ পেল, যেমন ছেনি চিমটে হাতুড়ি র্যাঁদা ইত্যাদি। হাত আগে যে কাজ করত, এখন যান্ত্রিক হাতিয়ার সেই কাজ করে, শুধু যন্ত্রটি চালাতে হয় মানুষকে। মানুষের বদলে মূল চালিকাশক্তি হল ঘোড়া বাষ্প বিদ্যুৎ এবং এই শক্তিকে যন্ত্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নানা রকমের হাতিয়ারের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য প্রয়োজন হল আরও যন্ত্রপাতির। মূল বা প্রধান চালিকাশক্তি, যেমন স্টিম ইঞ্জিন, স্টিম টারবাইন, কেলরিক ইঞ্জিন, ইলেকট্রো—ম্যাগনেটিক মেশিন ইত্যাদি। এই মূলশক্তির বিভিন্ন বাহনযন্ত্র, যেমন ফ্লাই—হুইল শ্যাফট পুলি পিনিয়ান স্ট্র্যাপ গিয়ার ইত্যাদি, তারপর যান্ত্রিক হাতিয়ার, যেমন ছেনি চিমটে র্যাঁদা ইত্যাদি। এই তো আধুনিক যন্ত্র, যত জটিলই তার চেহারা হোক—না কেন, এই হল তার আসল চেহারা।১১ যন্ত্রের এই জটিলতার ক্রমোন্নতির ফলে শিল্পবিপ্লব এবং আধুনিক যুগের পূর্ণবিকাশ সম্ভব হয়েছে।

এই হল ‘Profile of Technics’, যন্ত্রযুগের রেখাচিত্র বা পার্শ্বচিত্র।১২ যন্ত্রযুগের শৈশবকালের মূল আবিষ্কারগুলির সমাবেশ ও প্রভাব চতুর্দশ শতাব্দীর ইতালিতে, বিশেষ করে ফ্লোরেন্স, যেরকম দেখা যায়, ইয়োরোপের আর কোথাও সেরকম দেখা যায় না। আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগ তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে এইখানেই ভূমিষ্ঠ হয় বলা চলে। তাই ইয়োরোপের রিনেস্যান্স বা নবজাগৃতির সূচনা হয় ইতালিতে। কিন্তু ইতালির যান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক ক্রমোন্নতি যখন বন্ধ হয়ে গেল, তার আর্থিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্যও তখন আর বজায় রইল না। ইতালি থেকে জার্মানি হল্যান্ড ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে অর্থনৈতিক কেন্দ্র স্থানান্তরিত হল। ইতালির বণিক ব্যবসায়ী পেরুৎজি, মেডিচির পরিবর্তে জার্মান ধনিক ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার, ফাগার ওয়েলসার হচস্টেটার, হাউগ, ইমহফ প্রভৃতির ধনসম্পত্তি প্রভাব—প্রতিপত্তি অনেক বাড়ল। ধনসম্পত্তির পরিমাণ দেখলেই তা বোঝা যায় :১৩

১৩০০ সাল পেরুৎজি : ৮০০,০০০ ডলার

১৪৪০ সাল মেডিচি : ৭,৫০০,০০০ ডলার

১৫৪৬ সাল ফাগার : ৪০,০০০,০০০ ডলার

ফাগারের যুগে ইতালির ফ্রেস্কোবাল্ডি, গুয়ালতারত্তি, স্ট্রাৎজি প্রমুখ ধনিক ব্যবসায়ীদের প্রভাব যথেষ্ট থাকলেও একাধিপত্য ছিল না। ইতালির অর্থনৈতিক পশ্চাদগতি শুরু হয়েছিল, তাই সাংস্কৃতিক অবনতির পিচ্ছিল পথে প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধকারে ইতালি আবার ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু ইয়োরোপের নবজাগৃতিকেন্দ্র ইতালি অবনতিকেন্দ্রে পরিণত হলেও, ইয়োরোপের জাগৃতিজোয়ারে ভাটা পড়েনি। কারণ ধনতন্ত্রের বিকাশ ইতালিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। পেরুৎজি—মেডিচির পথে ফাগারদের আবির্ভাব হয়েছে, ফাগারদের পথে জাহারফ—ভাইকার—শ্লাইদার—মর্গান—ফোর্ডদের পূর্ণ বিকাশ হয়েছে। যন্ত্র ও বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি হয়েছে, ধনতন্ত্রের বিকাশের পথও প্রশস্ততর হয়েছে। উদযোগ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বাধীন চিন্তা সংস্কার মুক্তি স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের আদর্শ, ধনতন্ত্র ও যন্ত্রযুগের শৈশবকালের নবজাগৃতির মূলমন্ত্র আরও প্রচণ্ড বেগে ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত হয়েছে, ইয়োরোপ এবং সারা পৃথিবীর বুক আলোড়িত করেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের অচল অটল ভিত্তিকে চূর্ণ করে, সনাতন শাশ্বত ধর্ম নীতি ও আদর্শের গম্বুজ ধূলিসাৎ করে নবযুগের অভ্যুদয় বৈপ্লবিক। এই নবজাগৃতি ইয়োরোপের নয় শুধু, মানুষের নবজাগৃতি।

টাকা ধর্ম, টাকা স্বর্গ

যন্ত্রযুগের শৈশবকালের মৌল আবিষ্কারগুলির কথা আগে বলেছি। ঘড়ি শাশ্বত মহাকালের কল্পনা চূর্ণ করে জটিলতম যন্ত্রের প্রতিমূর্তি হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। মানচিত্রকররা অসীম অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে চারদিকের সীমানার মধ্যে বেঁধে ফেলে দিল। অদৃশ্য রহস্যলোক ভেদ করে কাচ ব্যাকটেরিয়া ও গ্রহ—উপগ্রহের রাজ্যে প্রবেশ করল। ভেনিশিয়ান আরশিতে মুখ দেখে মানুষ নিজেকে দেবদেবীর চাইতে বেশি সুন্দর, বেশি শক্তিশালী মনে করল। মধ্যযুগীয় পাণ্ডিত্যের আত্মাভিমান ও সংকীর্ণতা চূর্ণ করে সর্বজনীন শিক্ষা ও জ্ঞানবিস্তারের বাণী নিয়ে এল প্রিন্টিং প্রেস। তারপর বাষ্পীয় শক্তি হাজার হাজার ঘোড়ার শক্তি কেন্দ্রীভূত ও নিয়ন্ত্রিত করে প্রমাণ করে দিল ভগবান সর্বশক্তিমান নয়। সর্বশক্তিমান মানুষ। দূরত্ব জয় করার, ব্যবধান চূর্ণ করার অদম্য ইচ্ছা প্রকাশ পেল শিল্পী ও ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে। লেওনার্দো পঞ্চদশ শতাব্দীতে শুধু যে যন্ত্রবিদ্যার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আভাস দিয়ে গিয়েছিলেন তা নয়, আকাশপথে উড়ে যাওয়ার জন্য এরোপ্লেনও নকশা করেছিলেন। লেওনার্দো কেন, যুগ যুগ ধরে মানুষ এই দূরত্ব জয় করতে চেয়েছে, স্থানকালের ব্যবধান ঘোচাতে চেয়েছে, পাখির মতন ডানা মেলে উড়তে চেয়েছে আকাশে, ক্ষিপ্রগতি হরিণের মতন, ঘোড়ার মতন ছুটতে চেয়েছে মাটিতে। তার ব্যর্থ কল্পনা রূপকথা রচনা করেছে। জিন পরি দৈত্যদানব রাজকুমাররা ডানা মেলে আকাশে উড়েছে, লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটেছে, এক—এক পদক্ষেপে সাত সাত ক্রোশ পথ। রেলপথে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, রাজপথে মোটর, আকাশপথে বিমান মানুষের সেই দূরত্ব—জয়ের বাসনাকে আজ বাস্তবে রূপায়িত করেছে। রেলপথ ও বাষ্পীয় জাহাজ মধ্যযুগের অলিগলির সংকীর্ণতা, মধ্যযুগের আত্মকেন্দ্রিকতা ভেঙে দিয়েছে। ‘মনোমারুতগামিনী’, ‘সর্ববাতসহা যন্ত্রযুক্তা নৌকা’, ‘পুষ্পকযান’ আজ বাস্তব সত্য, মধ্যযুগের ব্যর্থ কামনার প্রতীক নয়। বৃহত্তর ক্ষেত্রে, দেশ—দেশান্তরে বাষ্পীয় ট্রেন যে ব্যবধান ঘুচিয়েছে, শহরে—নগরে মোটর আরও দ্রুতগতিতে তাকে সম্পূর্ণ করেছে। কিন্তু এ হল পরের কথা। নতুন যন্ত্রযুগের সব আবিষ্কারকে ম্লান করে দিয়েছে মুদ্রা। মুদ্রাপ্রধান অর্থনীতিই নবযুগের সমাজের বনিয়াদ। যা কিছু হচ্ছে, যত উদ্যম, যত প্রেরণা গবেষণা আবিষ্কার সবই এই মুদ্রার মোহে। এ মুদ্রা মধ্যযুগের মুদ্রা নয়, রং—বেরঙের বাহারে মুদ্রা নয়, ফিউডাল লর্ড, রাজা—মহারাজার প্রতাপ জাহির করাই তার উদ্দেশ্য নয়। মধ্যযুগের মুদ্রার নড়াচড়ার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না, লর্ডদের মতন মুদ্রাও ছিল আরামপ্রিয় অলস ও বিলাসী। মুদ্রার চাইতে জিনিসপত্তরই নড়েচড়ে বেড়াত বেশি। প্রয়োজনীয় জিনিসের বদলে জিনিস পেলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলত, মুদ্রার প্রয়োজন হত সামান্য। কিন্তু ধনতান্ত্রিক যুগে মুদ্রার রূপান্তর ঘটল। ছোটো ‘চাকতি’ হলে কী হবে? সেই চাকতির ঘুরপাক খাওয়ার (Circulation) যে প্রচণ্ড শক্তি তা আর কোনও মুদ্রার কোনওকালেই ছিল না। সেকালে মুদ্রার আলস্যে দিন কাটানো চলত, দামি কলসি হাঁড়ি সিন্দুকের মধ্যে ডানা গুটিয়ে কুম্ভকর্ণর মতন ঘুম দিলেও তার ক্ষতি ছিল না। কিন্তু একালের মুদ্রার আলস্যে দিন কাটানো চলে না। অলস হয়ে থাকলেই মুদ্রার আর কোনও মূল্য থাকে না। এ যুগের ব্যাংকে গিয়ে মুদ্রা যখন জমা হয় তখন সে ব্যাংকের সিন্দুকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে না। লোহার সিন্দুক ভেদ করে মুদ্রা বাইরের জগতে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ায়, তবেই সে আরও মুদ্রা প্রসব করে, ব্যাংকাররা সুদ দেয়। ধনতান্ত্রিক মুদ্রা তাই সচল সজীব গতিশীল। প্রয়োজনমতন তার গতি কমানো—বাড়ানো যায়, ঠিক যন্ত্রের মতন। তার জন্য অর্থনীতিবিদদের কত ফর্মুলা আছে, যন্ত্রবিদদের যেমন যন্ত্রের গতি নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল আছে। নতুন যন্ত্রযুগের সচলতা সক্রিয়তা ও প্রচণ্ড গতিশীলতার আদর্শ প্রতিমূর্তি হল মুদ্রা, টাকা (সিমেল)।১৪

টাকা ধনতান্ত্রিক যুগের ধর্ম, টাকাই স্বর্গ। সবার উপরে টাকাই সত্য। টাকা শুধু গতিশীল নয়, টাকা সৃষ্টিশীল (Creative)। টাকার গতিশীলতার উপর টাকার সৃষ্টিশীলতা নির্ভর করে। সেকালে ‘সঞ্চিত ধন’ একালের ‘মূলধন—এর’ মতো সৃষ্টিশীল ছিল না। ধনতান্ত্রিক যুগে ‘ক্যাপিটাল’ হল ‘ক্রিয়েটিভ’। বিশাল প্রাসাদ—অট্টালিকা প্রমোদ—উদ্যান আর স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে এ যুগে সঞ্চিত ধনের কবর দেওয়া হয় না। প্রাসাদ—অট্টালিকা যে এ যুগে নেই তা নয়, ধনিক পুঁজিপতিরা যে তা তৈরি করেননি তা—ও নয়। কিন্তু টাকার প্রধান উদ্দেশ্য তা নয়। টাকার প্রধান ও মহান উদ্দেশ্য হল, কারখানা থেকে কারখানায়, শ্রমশিল্প থেকে শ্রমশিল্পে, বাণিজ্যে, ব্যাংক থেকে শত শত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে ঘুরপাক দিয়ে বেড়ানো এবং অনবরত বংশবৃদ্ধি করা। টাকার অভিযানের অন্ত নেই। যত বেশি চলবে, যত বেশি ঘুরবে, তত বেশি টাকার দৃষ্টিশক্তি বাড়বে। নর্তকীর, বাইজির নাচের জন্য সেকালের রাজা—মহারাজারা অনর্গল টাকা খরচ করতেন। একালের পুঁজিপতিদের সেই বেহিসাবী ব্যয়ের প্রয়োজনই নেই। সবই এ যুগে বেচাকেনার পণ্যে পরিণত হয়েছে। টাকা নিজে রূপান্তরিত হয়ে সকলকেই রূপান্তরিত করেছে। মানুষও হয়েছে বেচাকেনার পণ্য, মুনাফার শিকার। মধ্যযুগের নর্তকী প্রমোদকানন ছেড়ে এ যুগের বাণিজ্যকেন্দ্র শহরে বাস করছে, এখন তার দেহ—মন সবই পণ্য, সবই ‘সৃষ্টিশীল মূলধন’। ধনতান্ত্রিক যুগের টাকার প্রজননশক্তি এত প্রচণ্ড, তার সৃষ্টিশক্তি এতই প্রবল যে নারীর প্রজননশক্তিকে ধ্বংস করে তার এক বিরাট অংশকে সে বেচাকেনার পণ্যে পরিণত করেছে।*

কার্ল মার্কস তাই বলেছেন, এ যুগের ঘূর্ণাবর্তে যা পড়বে তা—ই সোনা হবে। সেকালের কোনও মুনিঋষির হাড়ে এরকম ভেলকি খেলত না।১৫ মুদ্রাকে মার্কস ‘radical leveller’ বলেছেন। একদিক থেকে বিচার করলে, মৃত্যুর চাইতেও শক্তিশালী ‘লেভেলার’ টাকাকে নিশ্চয়ই বলা যায়। কিন্তু কোন দিক থেকে? টাকা চূর্ণ করেছে মধ্যযুগের রক্তের দম্ভ, কুলকৌলীন্যের ব্যবধান। যন্ত্রযুগে বংশগৌরব—কুলমর্যাদা কিছু নেই। বংশানুক্রমিক পেশাগত শ্রেণিভেদও টাকা ভেঙে দিয়েছে। তার বদলে টাকা নিজের কৌলীন্য সগৌরবে হাজির করেছে। টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম তো নিশ্চয়ই, তুকতাক ঝাড়ফুঁক স্তোত্রমন্ত্র সবই ‘টাকা টাকা টাকা’। তা ছাড়া টাকাই বংশ, টাকাই গোত্র, টাকাই শ্রেণি। নতুন যে শ্রেণিবিন্যাস হল সমাজে সে হল টাকার বিন্যাস। সবার চাইতে বড় কুলীন টাকা, শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ টাকা। রক্তের প্রবাহের মতন যখন টাকারও বৈশিষ্ট্য হল তার প্রবাহ, তখন ‘রক্ত হল ‘টাকা’, সমাজের শিরা—উপশিরায় টাকারই প্রবাহ ছুটে চলল। ধনতান্ত্রিক সমাজের রক্তপ্রবাহ টাকা।*

টিক—টিক—টক—টক করে ঘড়ি বলল : ‘শাশ্বত মহাকালকে টুকরো টুকরো করে কাটছি। প্রত্যেকটা সেকেন্ড, প্রত্যেকটা মুহূর্ত, প্রত্যেকটা টিকটিকানির মূল্য আছে।’ প্রচণ্ড বেগে ঘুরপাক খেতে খেতে টাকা বলল : ‘টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম, টাকা বংশ, টাকা গোত্র, টাকাই জপতপধ্যান। ঘড়ির টিকটিকানির সঙ্গে টাকা—টাকা করে জপ করো। হিসাব করে প্রতি সেকেন্ডে টাকা পয়সা করো, টাকার গতি বাড়িয়ে দাও। সময়ের যে মূল্য, যে হিসাব, সে হল টাকার মূল্য, টাকার হিসাব।’ মধ্যযুগ ছাড়িয়ে যন্ত্রযুগ ও ধনিকযুগের প্রবেশদ্বারের সামনে বড় বড় হরফে লেখা হল :

T I M E I S M O N E Y

প্রাচীন ও মধ্যযুগের দেবদেবী, স্বর্গ—নরক, জিন পরি দৈত্যদানব ভূতপ্রেত পিশাচদের নিয়ে অনন্ত অসীম রহস্যময় যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, যে শাশ্বত সনাতন মহাকাল, তা যন্ত্রযুগে, ধনতান্ত্রিক যুগে তালগোল পাকিয়ে কুঁচকে এই ছোট্ট ‘টাইম ইজ মানি’ কথাটির মধ্যে নবরূপান্তর লাভ করেছে। এখন আর মিনার গম্বুজ বা অনন্ত আকাশের দিকে চেয়ে ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলতে হবে না, ‘হে ঈশ্বর!’ এখন বলতে হবে, ‘হে হিসাবের খাতা! হে লেজার!’ এখন আর ভক্তি নয়, আবেগের চাপে কাঁপতে কাঁপতে মূর্ছা যাওয়া নয়, ভাবালুতা নয়। এখন জমাখরচের লাভ—লোকসানের কড়ায়—গন্ডায় হিসাব, বিদ্যাবুদ্ধির তীক্ষ্ন বাণবিদ্ধ নির্মম নিষ্ঠুর যুক্তি। আবেগ—ভক্তির স্যাঁতসেঁতে রহস্যলোক পার হয়ে ধনতান্ত্রিক যুগ বুদ্ধি ও যুক্তির বিশাল শুকনো খটখটে প্রান্তরে পা দিয়েছে। ‘সময় আর টাকা’র মতন ‘টাকা আর বুদ্ধি, টাকা আর যুক্তি’ এক হয়ে মিশে গেছে। এই বুদ্ধি ও যুক্তির অভিযান টাকার অভিযানের মতনই যুগান্তকারী।

বুদ্ধি ও যুক্তির অভিযান

এতদিন ‘জিনিয়াস’ বা ‘প্রতিভা’র কোনও বালাই ছিল না। মধ্যযুগের সমাজের মতন পাণ্ডিত্য প্রতিভা সবই অচল অলস ছিল। অধমের অবশ্য তাতে কোনও অধিকার ছিল না, কিন্তু যাঁদের অধিকার ছিল তাঁরা সংঘ কুল শ্রেণি বা ‘গিল্ড’—এর মধ্যে সকলে তা সমানভাবে বণ্টন করে নিতেন। প্রতিভার দীপ্তি নিয়ে হঠাৎ জ্যোতিষ্কের মতন কারও উদয় হত না। যন্ত্রযুগে ঘড়ি যেমন প্রতি সেকেন্ডকেও সশব্দে ঘোষণা করল, টাকা যেমন হল গতিশীল ও সৃষ্টিশীল, তেমনি বিদ্যাবুদ্ধি শিল্পকলা সব কিছুর উপর ‘প্রতিভা’র ছাপ পড়ল। ‘প্রতিভা’ বা ‘জিনিয়াস’ কথার জন্ম হয় বুর্জোয়া যুগে।১৬ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে টাকা যেমন স্রষ্টা, ‘ক্যাপিটাল’ যেমন ‘ক্রিয়েটিভ’, তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকলেই স্রষ্টা, সকলেই ক্রিয়েটিভ’।* কিন্তু ধনতান্ত্রিক যুগের শৈশবকালে এই সৃষ্টিশক্তির চেতনা সুস্থ চেতনা ছিল। কর্মী ও শিল্পীর মধ্যে তখনও ব্যবধানের প্রাচীর ওঠেনি। ধনতান্ত্রিক যুগের যখন বিকার ও সংকট দেখা দিয়েছে, যখন সমস্ত সমাজ ‘পাগলাগারদ’—এ পরিণত হয়েছে, তখন ‘জিনিয়াস’—এর স্বাতন্ত্র্যবোধও উগ্র হয়ে উঠেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘লুনাসি’ হয়েছে ‘জিনিয়াস’—এর নামান্তর, ‘পাগলামি’ ও ‘প্রতিভা’ এক হয়ে মিশে গেছে। কিন্তু মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে ধনতন্ত্র যখন প্রথমে ভূমিষ্ঠ হল, যন্ত্রযুগ ও বৈজ্ঞানিক যুগের যখন আবির্ভাব হল তখন তার সৃষ্টির প্রেরণার প্রাবল্য ছিল, তার বুদ্ধির ও যুক্তির অভিযানের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল। এই বুদ্ধি ও যুক্তির দুঃসাহসিক অভিযানের জন্যই জ্ঞানের রুদ্ধদ্বার খুলে গেছে, বিজ্ঞান ও গতিশীল বাস্তব জীবনদর্শনের উদ্ভব হয়েছে।

ঘড়ি ছাপাখানা কামান বারুদ কম্পাস মানচিত্র যন্ত্র এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করেছে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অপূর্ব কাচের ভিতর দিয়ে দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর দৃষ্টি বহু দূর প্রসারিত হয়েছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ক্ষুদ্রতম রহস্যলোককে অনাবৃত ও আলোকিত করেছে। কলম্বাস অতলান্তিক মহাসাগরে পাড়ি দিয়েছিলেন নির্ভয়ে, তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে নতুন জগৎ, তিনি আবিষ্কার করবেন। বিশ্বের সীমানা তো মানচিত্রেই ধরা পড়েছে। নতুন জগৎ, সোনার জগৎ কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন। ফ্রান্সিস বেকন—ও (১৫৬১—১৬২৬ খ্রিঃ) তাই দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করলেন নতুন জ্ঞানরাজ্যের সন্ধানে। মধ্যযুগের কূলকিনারাহীন অজ্ঞান ও কুসংস্কারের মহাসমুদ্রের উপর দিয়ে বেকন নির্ভয়ে পাড়ি দিলেন যুক্তির নৌকায় বুদ্ধির পাল তুলে দিয়ে। বেকন লিখলেন, ‘Advancement of Learning’ (১৬০৫) ‘New Methodology’ (১৬২০) ‘New Atlantis’ (১৬২৫)। ‘নিউ মেথডলজি’ বেকনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। আশ্চর্য ‘নিউ মেথডলজি’ গ্রন্থের প্রচ্ছদপটের উপর পর্যন্ত জ্ঞানরাজ্যের কলম্বাস বেকনের অনুসন্ধানী মনের ছবিটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। গ্রন্থের প্রচ্ছদপটে পাল তুলে দিয়ে একটি জাহাজ চলেছে, পুরাতন জগতের সীমানা হারকিউলিসের স্তম্ভ দুটি পার হয়ে অতলান্তিক মহাসাগরের দিকে নতুন জ্ঞানজগতের সন্ধানে। পরিষ্কার বোঝা যায়, বেকনের লক্ষ্য হল নতুন জ্ঞানজগতের কলম্বাস হওয়া। এই গ্রন্থের গোড়াতে বেকন নিজেই স্পষ্ট ভাষায় লিখলেন : ‘নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের স্থির বিশ্বাস নিয়ে এবং সেই বিশ্বাসের সমর্থনে তাঁর যুক্তি দিয়ে কলম্বাস যেমন অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে অভিযান করেছিলেন, আমিও সেই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে এইসব বিষয় সম্বন্ধে আমার মতামত ও যুক্তি লিপিবদ্ধ করছি।’

নতুন জ্ঞানজগতের কলম্বাস বেকন বললেন : কুসংস্কারমুক্ত মন নিয়ে নিরপেক্ষ ও একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণই হবে বিজ্ঞানীর প্রথম কর্তব্য। কিন্তু মনের অবস্থা ঠিক ভাঙা আরশির মতন হয়ে আছে। সেখানে যা কিছু প্রতিফলিত হয় তার আসল রূপের বদলে বিকৃত রূপটাই বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেইটাই মনে হয় সত্য। মনের আরশিটা এইভাবে ভেঙে রয়েছে কতকগুলি কুসংস্কারের ভারে। এই কুসংস্কারগুলিকে বেকন ‘idols’ বা ‘ভূত’ বলেছেন।* ভূতগুলির মধ্যে চার শ্রেণির ভূতের দৌরাত্ম্যই মারাত্মক :

চার শ্রেণির ভূতের দৌরাত্ম্য

সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়াতে বেকন ‘নিউ মেথডলজি’ লিখেছিলেন। জানি না, আজ পর্যন্ত আর কেউ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব চিন্তা দৃষ্টি ও যুক্তি সম্বন্ধে আর কিছু নতুন কথা বলতে পেরেছেন কি না। যে চার রকমের সংস্কার বা ভূতের কথা বেকন বলেছেন তাদের কবল থেকে মানুষের মুক্তি কি আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে? হয়নি, কারণ বিজ্ঞানের আলোক আজও অনেক দেশে, অনেক মানুষের মনে পৌঁছোয়নি। দেশ হিসাবে বিচার করলে, জাতের ভূত, গুহার ভূত ও বাজারের ভূতের দৌরাত্ম্য থেকে যারা ভুক্ত হয়েছে, রঙ্গমঞ্চের ভূত হয়তো তাদের স্কন্ধে ভর করে বসে আছে। আর মানুষ হিসাবে ক—জন মানুষ যে এই বৈজ্ঞানিক যুগের দ্বিপ্রহরকালে চার রকমের ভূতের কবল থেকেই মুক্ত হয়েছে, তা বোধহয় গুনে ফেলা যায়। তা যাক। পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ সংকট ও বিকৃতির কথা মনে করে বেকন ‘নিউ মেথডলজি’ লেখেননি। বৈজ্ঞানিক যুগের দিগন্তবিস্তৃত সোনালি ভবিষ্যতের খসড়া করে গেছেন তিনি। বেকনই নতুন বৈজ্ঞানিক জগতের কলাম্বাস। তারপর সেই জগতে অনেকে অনেক মূল্যবান সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন, তাতে বেকনের ‘আবিষ্কারের’ মূল্য কমেনি।

শুধু বৈজ্ঞানিক জগতের সন্ধান দিয়েই বেকন নিশ্চিন্ত হননি, আদর্শ বৈজ্ঞানিক সমাজের চিত্রও তিনি এঁকে গেছেন ‘নিউ অ্যাটলান্টিস’—এর মধ্যে।১৭ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অজানা দ্বীপ বেনসালেমে তিনি নতুন বৈজ্ঞানিক সমাজ কল্পনায় গড়ে তুললেন। বাইরের অসভ্য লোকের সেখানে প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু এই দ্বীপের কর্মীদের বাইরের জগতে তথ্যের সন্ধানে যেতে বাধা নেই। এই দ্বীপে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার বেকন তৈরি করলেন তার নাম ‘সলোমন হাউস’। এই সলোমন হাউসের মধ্যে দুটি সুদীর্ঘ গ্যালারি। সেখানে নতুন জগতের আবিষ্কর্তা কলম্বাস থেকে আরম্ভ করে নানা রকমের যন্ত্র ছাপাখানা কাচ কাগজ ধাতু শিল্পকলা ইত্যাদির আবিষ্কর্তাদের প্রস্তরমূর্তি সাজানো। এ যেন এ যুগের ‘রকফেলার ইনস্টিটিউট’ আর ‘ডয়েটসে মিউজিয়াম’।১৮ বিজ্ঞানের প্রগতির জন্য ব্রিটিশ ও মার্কিন বৈজ্ঞানিক অ্যাসোসিয়েশনগুলি তো অনেকটা এই পরিকল্পনা অনুসারেই গড়ে উঠেছে।১৯ বেকনের আগে ফ্লোরেন্সে অবশ্য ১৪৩৮ সালেই মেডিচি প্রথম নতুন যুগের ‘অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। একমাত্র কেপলার ছাড়া পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর (গোড়ার দিকে) বিজ্ঞানীরা প্রায় সকলেই হয় ইতালিয়ান ছিলেন, না হয় ইতালিতেই শিক্ষা পেয়েছিলেন। ১৬০১ সালে রোমে ‘Accademia dei Lincei’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতালি তখন নতুন ধনতান্ত্রিক যুগ যন্ত্রযুগ ও বৈজ্ঞানিক যুগের কেন্দ্র, নবজাগৃতিকেন্দ্র। কিন্তু আগেই বলেছি, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই ইতালির অর্থনৈতিক প্রাধান্য কমে যায়, পেরুৎজি ও মেডিচিদের বদলে ফাগারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপের অন্যান্য কেন্দ্রে বিজ্ঞান ও ধনতন্ত্রের বিকাশ হতে থাকে। তখনই বেকন এই ‘সলোমন হাউস’—এর পরিকল্পনা করেন। তারপর ১৬৪৫ সালে ইংল্যান্ডে যে ‘অদৃশ্য গোপন কলেজ’ স্থাপিত হয়, তাকেই *‘রয়্যাল সোসাইটি’ নাম দেওয়া হয়েছে পরে। ১৬৩১ সালে প্যারিসের Etienne Pascal—এর Salon—কেই পরে ১৬৬৬ সালে ‘রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ নাম দেওয়া হয়েছে। এইসব সোসাইটি ও অ্যাকাডেমি কি বেকনের ‘সলোমন হাউস’—এর পরিকল্পনা অনুসারেই গড়ে ওঠেনি?২০

শাস্ত্র ধর্ম দেশাচার জনশ্রুতি এবং নানারকমের কুসংস্কারের কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ গবেষণা ও পরীক্ষার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করতে হবে। বেকনের এই পথ ধরেই হবস (Hobbes) ও লক (Locke) আরও অনেক দূর এগিয়ে গেলেন। বেকনের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে লক বাস্তব দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করলেন। লক বললেন, যে জ্ঞান ইন্দ্রিয়গোচর নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, তা সত্য নয়, জ্ঞানই নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে ইন্দ্রিয়ের অগোচর যা তা জানবার শক্তি মানুষের নেই। বস্তুবাদ দৃঢ়পদে বেকন থেকে হবস, হবস থেকে লক পর্যন্ত এগিয়ে গেল। ফ্রান্সে দেকার্ত (Rene Descartes) বস্তুবাদের এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। মধ্যযুগের সমস্ত কুসংস্কার ধর্মবিশ্বাস ও দেশাচারের বিরুদ্ধে দেকার্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং স্বাধীন চিন্তা যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব মুক্তকণ্ঠে প্রচার করলেন। ইংল্যান্ড থেকে বেকনের ভাবধারার সঙ্গে ফ্রান্সের দেকার্তের ভাবধারার মিলনের ফলে ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি বস্তুবাদ’—এর উৎপত্তি হল।২১ তারপর শুরু হল মধ্যযুগের আদর্শবাদের ধ্বংসাবশেষের বিরুদ্ধে শেষ ও চূড়ান্ত সংগ্রাম। ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে ফরাসি এনসাইক্লোপিডিস্টরা এই সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। এঁদের মধ্যে ভলটেয়ার দিদেরো হেলভেটিয়াস দ্য অ্যালেমবার্ট হলবাখ কন্ডোয়াক রুশো ও ভলনির নাম স্মরণীয়। এঁরা এক ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ *গ্রন্থ প্রচার করলেন, দিদেরো ও দ্য অ্যালেমবার্ট সেই গ্রন্থ সম্পাদনা করলেন। কুসংস্কার ও অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে মানুষকে জ্ঞানের আলোক বিতরণ করাই হল এঁদের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য সার্থক হল ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে। মার্কস—এঙ্গেলসও তা স্বীকার করেছেন। এঙ্গেলস বলেছেন, মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে ইতিহাসে কয়েক শতাব্দী ধরে সংগ্রাম চলেছে, তার মধ্যে তিনটি সংগ্রামই প্রধান : জার্মানির প্রোটেস্টান্ট রিফর্মেশন, ১৬৪০ ও ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডের বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লব। এই তিনটি পর্যায়ের সংগ্রামের মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ের সংগ্রাম, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবই সব চাইতে সার্থক বিপ্লব, চূড়ান্ত সংগ্রাম। একমাত্র ফরাসি বিপ্লবেই ধর্মের কোনও মুখোশ পরতে হয়নি বিদ্রোহীদের। পরিষ্কার প্রশস্ত রাজনৈতিক পথের উপর দাঁড়িয়ে, ধর্মের সমস্ত মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে মধ্যযুগের অভিজাত শ্রেণি ও ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে, এবং সেই সংগ্রামে বুর্জোয়াশ্রেণির সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ধনতান্ত্রিক যুগের শৈশবে বুদ্ধি ও যুক্তির যে অভিযান শুরু হয়েছিল তা সার্থক হল তাঁর বয়ঃসন্ধিক্ষণে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণীর মধ্যে।

তার পরের ইতিহাস আলোচনা করার প্রয়োজন নেই এখানে। বাংলার তথা সারা ভারতের নবজাগৃতির উৎস—সন্ধান এখানেই শেষ করা যেতে পারে। অল্প দিনের মধ্যেই ফরাসি বিপ্লবের ‘Liberte, Egalite, Fraternite’—র মহান আদর্শ ‘Infantry, Cavalry, Artillery’—র আদর্শে পরিণত হয়েছে।২২ কারণ ধনতান্ত্রিক যুগের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়াশ্রেণির ভূমিকা বদলেছে। যতদিন বুর্জোয়াশ্রেণির আধিপত্য সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যতদিন তারা শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ হয়নি, ততদিন সমাজের অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে তাদের বিরোধও তীব্রতর হয়নি, স্পষ্টতর হয়নি। তা যখন হল তখন বুর্জোয়াশ্রেণি দেখল, মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যেসব হাতিয়ার নিয়ে তারা সংগ্রাম করেছে সেইসব হাতিয়ার তাদের বিরুদ্ধেই উদ্যত হয়েছে। যে সর্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষা ও স্বাধিকারের আদর্শ তারা প্রচার করেছে, প্রবর্তন করেছে, সেই আদর্শ এখন তাদেরই আধিপত্যকে ধূলিসাৎ করতে চাইছে। তাদের অগ্রগতির ‘মূলমন্ত্র’ যে স্বাধীন চিন্তা যুক্তি বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি, তা—ই এখন ‘সোশ্যালিস্টিক’ হয়ে উঠেছে।২৩ সোশ্যালিজমের বিকাশ হচ্ছে এই স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে, সেই যুক্তি ও বুদ্ধির অবিশ্রান্ত অভিযানের পথে, বিজ্ঞান ও শিক্ষার আলোকে উজ্জ্বলতর হয়ে। তাই তো বুর্জেয়াশ্রেণিকে আবার, মার্কসের ভাষায়, সমাজের ‘all the elements of that vague, dissolute, down-at-heels and out-at-elbows rabble’ দলবদ্ধ করতে হচ্ছে। মধ্যযুগে আবর্জনাস্তূপ ঘেঁটে আবার তাকে ধর্মশাস্ত্র অধ্যাত্মবাদ জাদুমন্ত্র কুসংস্কার জড়তা গোঁড়ামি সংকীর্ণতা স্বেচ্ছাচারিতা, সবই কুড়িয়ে—বাড়িয়ে জড়ো করতে হচ্ছে,২৪ সঙ্গে সঙ্গে ‘লিবার্টি ইকুয়ালিটি ফ্রেটারনিটি’র বদলে ‘ইনফ্যান্ট্রি ক্যাভালরি আর্টিলারি’র মহত্ত্বও প্রচার করতে হচ্ছে, কারণ ‘সোশ্যালিজম’—এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে তাদের। কিন্তু এ হল আধুনিক ইতিহাস, ব্যাধিগ্রস্ত ধনতান্ত্রিক যুগের সংকট এবং সংস্কৃতিসংকটের ইতিহাস। এখানে সেই ইতিহাস আমরা আলোচনা করছি না। নবযুগের নবজাগৃতির মূলমন্ত্র কী তা আমরা আলোচনা করেছি। সেই মূলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েই বাংলার নবজাগৃতি—আন্দোলন ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে।২৫

বাংলার নবজাগৃতির প্রবাহ

‘সমাচার দর্পণ’—এর সংবাদগুলি কেন সাধারণ সংবাদ নয়, জাতীয় সংবাদ, ঐতিহাসিক ঘটনা, তা নিশ্চয়ই এই আলোচনার পরে পরিষ্কার বোঝা যাবে। ধানকল, পাটকল, এক রকমের টাকাপয়সা, ছাপাখানা, বাষ্পীয় জাহাজ, রেলপথ—এগুলি হল। এ দেশের নবজাগৃতির প্রথম দূত। আগে যে ঘড়ি ও ভেনিশিয়ান কাচের কথা বলেছি, যে দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কথা বলেছি, তা—ও নিশ্চয়ই এ দেশে আগে ছিল না। আর্যরা বা মুসলমানরা এই অর্থনৈতিক এজেন্টদের দেশে নিয়ে আসতে পারেননি। এ দেশের মাটিতে এদের উৎপত্তিও হয়নি। ইংরেজরা আসার পরে এই অর্থনৈতিক এজেন্টরা এ দেশে এসেছে। এই অর্থনৈতিক এজেন্টরাই নবজাগৃতির অগ্রদূত। এইসব কলকারখানা, কোম্পানির টাকাপয়সা, বাষ্পীয় জাহাজ, রেলপথ সর্বপ্রথম এ দেশের স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থায় আঘাত করে ভাঙতে আরম্ভ করে। শাশ্বত সনাতন মহাকালের গগনচুম্বী গম্বুজ এই বিপ্লবী অর্থনৈতিক দূতরাই ধুলিসাৎ করেছে। এ দেশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সর্বজনীনতা আত্মবিশ্বাস বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও যুক্তির এরাই আদিগুরু। শাস্ত্র কুসংস্কার দেশাচার ও জনশ্রুতির বিরুদ্ধে এরাই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। রামমোহন, দ্বারকানাথ, ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর নেতৃবৃন্দ, বিদ্যাসাগর, সকলের সংগ্রামের পথ এই বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক এজেন্টরাই পরিষ্কার করে দিয়েছে। কলকারখানা, বাষ্পীয় শক্তি, সচল মুদ্রা এবং প্রিন্টিং প্রেস যদি না থাকত, তাহলে রামমোহন—’ইয়াং বেঙ্গল’—বিদ্যাসাগর সকলের সমস্ত আন্দোলন ও আদর্শবাদ কবীর—দাদূ—চৈতন্যর মতন শূন্যে মিলিয়ে যেত। বলিষ্ঠতা উদারতা প্রগতিশীলতা জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতাবোধ, কোনও কিছুরই বিকাশ হত না এঁদের চরিত্র। তা—ই বলে কলকারখানা বাষ্পীয় শক্তি মুদ্রা ও প্রিন্টিং প্রেসের যান্ত্রিক সৃষ্টি এঁরা নন। যন্ত্র এঁদের চলার পথের আগাছা কেটে সাফ করেছে। নতুন অর্থনৈতিক শক্তি সমাজের জড়তা ও আত্মকেন্দ্রিকতার মূলে আঘাত করেছে। তাই এঁদের চলার বেগ প্রচণ্ড হয়েছে এবং সেই চলার পথে এঁরাও আবার সেই অর্থনৈতিক শক্তির বিকাশের পথ আরও প্রশস্ত করেছেন। এই হল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগৃতির ধারা। বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়ের ঐতিহাসিক বিশিষ্টতার জন্যই এই প্রবাহের বিশেষ জোয়ারভাটা এই বাংলা দেশেই সম্ভব হয়েছে এবং সেই জোয়ারভাটা উত্থান—পতনের তরঙ্গ বিক্ষোভের প্রধান কেন্দ্র হয়েছে কলকাতা মহানগর। কারণ নতুন যুগ নগরকেন্দ্রিক, গ্রামকেন্দ্রিক নয়।

বাংলার নবজাগৃতির প্রথম যুগে অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মধ্যে কোনও বিচ্ছেদ ঘটেনি। এখানেও নবজাগৃতির ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে দেখা যায়। ‘প্রতিভা’র বিকাশ যদিও এ যুগেই সম্ভব হয়েছে, তাহলেও ঐতিহাসিক নিয়মেই নবযুগের গোড়াতে সেই বুদ্ধি ও সৃষ্টির প্রতিভা এবং কর্মীর প্রতিভা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল। বুদ্ধির সঙ্গে কাজের, শিল্পীর সঙ্গে উদযোগী শিল্পপতির ও কর্মীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। শুধু তা—ই নয়, বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ফন মার্টিনের ভাষায় বলা যায়, বাংলার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের ‘entrepeneur’—রা একই ব্যক্তি ছিলেন। ইয়োরোপীয় নবযুগের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলা দেশেও অক্ষুণ্ণ ছিল। আপাতদৃষ্টিতে ‘অদ্ভুত সাদৃশ্য’ বলে মনে হলেও, এ কেবল সাদৃশ্য নয়, অদ্ভুতও নয়, একই ঐতিহাসিক বিশিষ্টতার প্রকাশ মাত্র।

বাংলার নবযুগের সমন্বয়সাধক রামমোহন কেবল সাধক ছিলেন না, ভাবরাজ্যেই তাঁর সমস্ত উদ্যম নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও সংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান কম দুঃসাহসিক নয়। তাঁর সরকারি চাকরি, কোম্পানির কাগজের ব্যাবসা ও তেজারতি কারবার থেকে ধনসঞ্চয়ের স্পৃহা শাস্ত্রপন্থী না হলেও, যুগপন্থী। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রামমোহনের প্রধান সহকর্মী দ্বারকানাথের স্বাধীন ব্যবসাবাণিজ্যের উদ্যম সম্বন্ধে প্রশংসায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও পঞ্চমুখ ছিলেন। সে কথা আগে বলেছি।* ডিরোজিওর শিষ্য ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর নেতাদের মধ্যে রামগোপাল ঘোষ অসাধারণ বাগ্মিতা, বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্যের জন্য অগ্রণী ছিলেন। রামগোপাল ইহুদি ব্যবসায়ী জোসেফের অফিসে কাজ করতেন প্রথমে, পরে কেলসল সাহেবের অংশীদার হয়ে ‘Kelsall Ghosh & Co’ প্রতিষ্ঠা করেন। শেষে ‘R. G. Ghosh & Co’ নামে এক কোম্পানি করে রামগোপাল স্বাধীন ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হন। ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দলের অর্থনৈতিক আদর্শ ছিল ‘অবাধ বাণিজ্যের’ আদর্শ, টিপিক্যাল ‘free enterprise’—এর আদর্শ। সংস্কৃতিক্ষেত্রেও ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দলের দানও যুগান্তকারী। প্যারীচাঁদ মিত্র প্রথমে (১৮৩৯ সালে) ‘কালাচাঁদ শেঠ অ্যান্ড কোম্পানি’তে আমদানি—রপ্তানির কাজ করেন। পরে ১৮৫৫ সালে দুই ছেলেকে নিয়ে ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হন। ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোং লিঃ’, ‘পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোং’, ‘হাওড়া ডকিং কোং লিঃ’ ইত্যাদি বিদেশি কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন প্যারীচাঁদ। তিনি ‘বেঙ্গল টি কোং’ ও ‘ডারাং টি কোং লিঃ’—এরও ডিরেক্টর ছিলেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মতন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও প্যারীচাঁদের অভিযান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৮৩৮ সালে যখন ‘দ্য সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী তার যুগ্ম—সম্পাদক হন। ‘দ্য বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’র (১৮৪৩) সভাপতি ছিলেন জর্জ টমসন, অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ। তিনি গোড়া থেকেই ‘দ্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮৫১), ‘বিটন সোসাইটি’ (১৮৫১), ‘দ্য ক্যালকাটা সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস’ (১৮৬১) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন। বেভারলি সাহেব ও প্যারীচাঁদ ‘দ্য বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন’—এর (১৮৬৭) যুগ্ম—সম্পাদক ছিলেন। ১৮২০ সালে কেরি সাহেব এ দেশের কৃষির উন্নতির জন্য যে ‘এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠা করেন, ১৮৪৮ সালে প্যারীচাঁদ তার সদস্য হন, কৃষি বিষয়ে সোসাইটির জার্নালে অনেক প্রবন্ধ লেখেন এবং অনেক ইংরেজি প্রবন্ধের বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এই হল বাংলার প্রথম সামাজিক উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’—এর লেখক প্যারীচাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। এ ছাড়া শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক উন্নতির জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর ধনিক ব্যবসায়ী শেঠ—শীল—মল্লিকদের দানও কম উল্লেখযোগ্য নয়। কর্মীর উদ্যম, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর প্রতিভার অপূর্ব সংমিশ্রণ এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগৃতির প্রথম যুগে সম্ভব হয়েছিল। এই সংমিশ্রণ, এই সমন্বয় ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক।

বাংলার নবজাগৃতির ধারা বাধাবন্ধনহীন সমতল ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়নি।* কোনও আন্দোলনই তা হয় না। তার উত্থান—পতন আছে, জোয়ারভাটা আছে, ছন্দ ও তরঙ্গ আছে। রামমোহনের যুগ প্রধানত ভাবকেন্দ্রিক সমন্বয়ের যুগ। রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ ও সামাজিক আন্দোলন গৌণ, আদর্শলোকের সংগ্রামের সামান্য বাস্তব রূপ ও পরীক্ষা মাত্র। তাঁর বিশ্বজনীন একেশ্বরবাদ, তাঁর নতুন জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতাবোধের সমন্বয়ের মধ্যেই তাঁর সংগ্রামের সার্থকতা। পাশ্চাত্য ভাবধারাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করে তাকে সমীকৃত করার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা ‘ইয়াং বেঙ্গল’ আন্দোলনের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। শ্রেষ্ঠ জীব বলে দেবতাদের অস্তিত্ব রামমোহন স্বীকার করেছেন, ব্রহ্মের অবতার না স্বীকার করলেও রামকৃষ্ণ ও বুদ্ধকে অবতার বলে মেনেছেন। পুরাণতন্ত্রাদি জাতিভেদ দেশাচার ইত্যাদি তিনি একেবারে বর্জন করতে পারেননি। বেকনের চার শ্রেণির ‘idols’—এর বিরুদ্ধে রামমোহন অভিযান করেছিলেন সত্য, কিন্তু কুসংস্কারের সমস্ত মানসপ্রতিমা ও প্রেতাত্মাকে তিনি ধ্বংস করতে পারেননি। এই ধ্বংসের কাজ প্রধানত ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দলের নেতাদেরই করতে হয়েছে, ফরাসি এনসাইক্লোপিডিস্টদের মতন তাঁরা সমস্ত মিথ্যা ধর্মবিশ্বাস দেশাচার জনশ্রুতি ও কুসংস্কারের বিরূদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। যে নতুন শক্তি রামমোহনের যুগে ‘সঞ্চারিত’ হয়েছিল তাকে আরও গভীর করে ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে সমাজের বুকে ‘সম্প্রসারিত’ করেছিলেন। তাঁরা ইয়োরোপের ‘বাঙালি সংস্করণ’ ছিলেন না। তাঁরা বাংলাদেশেরই মানুষ ছিলেন এবং দেশের মঙ্গলের কথাও ভুলে যাননি। ব্রাহ্মসমাজের পরিণতি অথবা ‘ইয়াং বেঙ্গল’ আন্দোলনের একদেশদর্শিতা ও উগ্রতা পরের কথা, আর—একদিকের কথা। রামমোহনের যুগ থেকে ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর যুগের প্রসারতা ও ব্যাপকতাই এখানে উল্লেখযোগ্য। এই ব্যাপক শক্তিসঞ্চার আলোড়নের ফলেই নবজাগৃতির প্রবাহ উত্তাল তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে এবং পরে সামাজিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রবল গতিশীলতার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে আত্মস্থ হয়েছে। এই ধারাতেই সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে জাতীয়তাবোধ উদবুদ্ধ হয়েছে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং এই ধারাই বিংশ শতাব্দীর বিস্তৃত ক্ষেত্রে জাতীয় আন্দোলনের জোয়ারের সঙ্গে মিশে গেছে। সংস্কৃতিক্ষেত্রেরও এই ধারা রামমোহন দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমার রাজেন্দ্রলাল বিদ্যাসাগর প্যারীচাঁদ মধুসূদন বঙ্কিমচন্দ্র হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র বিহারীলাল রবীন্দ্রনাথের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্র—পরবর্তী যুগে প্রবাহিত হয়েছে। প্রথম যুগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাংলা ছাপার হরফ তৈরি হয়েছে এবং বাংলার গদ্য জন্মগ্রহণ করে হাঁটি—হাঁটি পা—পা করে এগিয়ে গেছে। আগের যুগের সামাজিক জড়তা, স্থিতিশীলতা ও আদিম সরলতার মধ্যে বাংলা গদ্যের বিকাশ সম্ভব হয়নি, হতে পারে না, পৃথিবীর কোনও দেশেই হয়নি, কারণ ভাষা ও জীবন, ভাষা ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক প্রত্যক্ষ ও নিবিড়। তাই সমাজ যখন সচল সক্রিয় ও জটিল হয়ে উঠল, মানুষের জীবনের সামনে বিবিধ সমস্যা দেখা দিল, তখন ভাষাকেও আর অক্ষরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্ত কাব্যের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখা সম্ভব হল না। সমস্ত জটিলতাকে আত্মসাৎ করে বাংলা গদ্যের ধীরে ধীরে বিকাশ হল, সামাজিক নকশা ও উপাখ্যানের ভিতর দিয়ে উপন্যাসেরও জন্ম হল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের পূর্ণ বিকাশ হল।

নবজাগরণের এই ধারার পাশাপাশি আর—একটি ধারাও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে প্রবাহিত হয়েছে। এই ধারাকে আমরা রাধাকান্ত ভূদেব রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দর ধারা বলতে পারি। এই দুই ধারা ঠিক প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দুটি পরস্পর—বিরোধী নির্দিষ্ট ধারা নয়। নবজাগৃতির প্রথম প্রচণ্ড গতিশীলতার যুগে বিরোধ তীব্র উগ্রমূর্তি ধারণ করেনি। প্রগতির সাধারণ ধারাই নতুন—পুরাতনকে সমীকৃত করে নিজস্ব গতিবেগে সমন্বয়ের পথে প্রবাহিত হচ্ছিল। তাই দ্বিতীয় ধারাটি প্রতিক্রিয়াশীলতার বাঁধাধরা খাতে বইতে পারেনি। তাকে শুধু বিরোধিতা (Opposition)—র ধারা বলা যায়। এই ধারার ‘দুর্বলতা’ তার ‘উদারতা’র মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। রাধাকান্ত—ভূদেবের ভিতর দিয়ে এই ধারার চরম প্রকাশ রামকৃষ্ণ—বিবেকানন্দর মধ্যে হয়েছে। রাধাকান্ত—ভূদেবের ধর্মগোঁড়ামি ও সামাজিক উদারতা শেষে রামকৃষ্ণর স্বাভাবিক মানবতাবোধ এবং বিবেকানন্দর ধর্ম ও মানুষ, আশ্রম ও সমাজ, শাস্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। পাশ্চাত্য ভাবধারার নূতনত্ব, তার বিচারবুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করাই এই ধারার বৈশিষ্ট্য। যা কিছু নতুন মহান উদার, তা সব এ দেশেই ছিল। ধর্ম আশ্রম মঠ সবই থাকল, কিন্তু তা—ও যে কত মহান, কত মানবিক, কত উদার, কত গতিশীল, এমনকী কত দূর ‘সমাজতান্ত্রিক’ পর্যন্ত হতে পারে, বিবেকানন্দ তা শুধু এ দেশের লোককেই বললেন না, বিদেশেও প্রচার করতে গেলেন। কিন্তু বিবেকানন্দ ব্যর্থ হলেন। নতুন ভাবধারাকে সমীকৃত করে সমৃদ্ধ হওয়াই ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এবং তাকে আরও গভীরভাবে আবেগভরে আপনার করে নেওয়া বাংলার বিশিষ্টতা। আবেগ নিষ্ঠা বলিষ্ঠতা উদারতা ও গভীর মানবতাবোধের মধ্যে বিবেকানন্দর চরিত্রে বাংলার বিশিষ্টতা ফুটে উঠেছে। বিবেকানন্দ নবযুগের বাংলার শ্রীচৈতন্য, কিন্তু বাংলার নবজাগৃতির যুগ রামমোহন দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমার কেশবচন্দ্রর যুগ, ডিরোজিও টমসন কৃষ্ণমোহন রামগোপাল দক্ষিণারঞ্জনের যুগ, বিদ্যাসাগর—রাজেন্দ্রলালের যুগ, মধুসূদন প্যারীচাঁদ বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের যুগ। শ্রীচৈতন্যর যুগ শেষ হয়েছে। বিবেকানন্দর যুগও শেষ হয়ে গেল। রাধাকান্ত ভূদেব বিবেকানন্দের ধারাই পরবর্তী যুগে পরিপূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীলতার খাতে প্রবাহিত হয়েছে। জাগৃতির ধারা, প্রগতির ধারা যত দ্রুত ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর ক্ষেত্রে, বৃহত্তর সমন্বয়ের পথে এগিয়ে গেছে, রাধাকান্ত ভূদেব বিবেকানন্দর ধারাও তত দ্রুত সংকুচিত হয়েছে, তার উদারতা ও মানবতাবোধ বর্জন করে সংহত প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে সমাজের অর্থনৈতিক রূপও বদলে যাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বুর্জোয়াশ্রেণি শৈশবকালে উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পা দিচ্ছে, নিজের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারতা, মানবতা ও আন্তর্জাতিকতাবোধই আজ সাবালক বুর্জোয়াশ্রেণির কাছে ভীতিপ্রদ ‘সোশ্যালিজম’—এর রূপ ধারণ করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলতা তাই ‘আর্য—সংস্কৃতি’, ‘নব্যহিন্দু ও ইসলামি সংস্কৃতি’ এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে শক্তিশালী ও সংহত হচ্ছে। বিরোধ তীব্রতর হচ্ছে, স্পষ্টতর হচ্ছে। বর্ধিষ্ণু বুজেয়াশ্রেণির শৈশবকালের উদারতা, মানবতা ও স্বাধীনতার বাণী আজ তাই সংকীর্ণতা, বর্বরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার গর্জনে পরিণত হচ্ছে। সংকটের সময় সোশ্যালিজম বিরোধী ধর্মযুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলতার আবর্জনাস্তূপ ঘেঁটে ধর্মশাস্ত্র অহিংসা সাম্প্রদায়িকতা অধ্যাত্মবাদ আত্মা পরমাত্মা প্রভৃতি ভূতপ্রেতদের জড়ো করতেও আজ তাই বুর্জোয়াশ্রেণি পশ্চাদপদ নয়।

কিন্তু জাগৃতি ও প্রগতির ধারা ঐতিহাসিক নিয়মেই বিস্তৃততর ক্ষেত্রে প্রবাহিত হবে। প্রবাহের পথে সংঘাত ও বিরোধ তীব্রতর হবে। হওয়া স্বাভাবিক। রামমোহন ‘সোশ্যালিজম’ সম্বন্ধে রবার্ট ওয়েনের সঙ্গে বিলেতে তর্ক করেছিলেন। ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ’—এর মূলসূত্রগুলি তিনি জানতেন। বেকন, লক, ফরাসি এনসাইক্লোপিডিস্টরা, ফরাসি বিপ্লব, রামমোহনকে, বিশেষ করে নব্যবাংলার নেতাদের উৎসাহিত করেছিল, নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। সেই পথে তাঁরা নির্ভয়ে অভিযান করেছিলেন। তাঁদের অভিযান ব্যর্থ হয়নি। বিংশ শতাব্দীর রুশ বিপ্লব আর—এক যুগান্তরের প্রেরণা দিয়েছে। রবার্ট ওয়েন থেকে মার্কস—এঙ্গেলসের পথে লেনিনের যুগ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে পৃথিবী সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি। বিদেশের কোনও বিপ্লব, কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বান্তঃকরণে অভিনন্দন জানাতে রামমোহনও কুণ্ঠিত হননি। নেপলসবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যর্থতায় রামমোহন শুধু যে বেদনাবোধ করেছিলেন বা ফরাসি জাহাজে স্বাধীনতার নিশান উড়তে দেখে তিনি যে শুধু ‘ধন্য, ধন্য, ফ্রান্স!’ বলে অভিনন্দন জানিয়ে ক্ষান্ত হয়েছিলেন তা নয়। রামমোহন বলেছিলেন : ‘স্বাধীনতার শত্রু আর স্বেচ্ছাচারিতার মিত্র যারা তাদের জয় ইতিহাসে হয়নি কোনওদিন, হবেও না ভবিষ্যতে।’ এ যুগে নির্ভয়ে তাই রুশ বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নকে বাঙালি তথা ভারতবাসী অভিনন্দন জানাবে।* বাংলার নবজাগৃতির এ যুগের উত্তরাধিকারীরা তাই নির্ভীকচিত্তে লেনিন গোর্কি স্টালিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে সমীকৃত করবে। বাংলার জাগৃতিধারা, বাংলার সমাজ—সংস্কৃতি দৃঢ়পদে বলিষ্ঠচিত্তে ‘সোশ্যালিজম’—এর প্রশস্ত পথে বৃহত্তম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।

………..

* উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লোকপ্রিয় স্বভাবকবি রূপচাঁদ পক্ষী লেখেন: ‘পাটের কল আর ময়দার কল, রেড়ির কল, কাপড়ের কল, সুরকির কল, জলতোলা কল, খোয়াভাঙ্গা কল, কলাকৃতি ঐরাবৎ, করে একদিবসে সোজা পথ। কলের খুরে দণ্ডবৎ, জুড়ে গেল গ্রাম নগর।’ —’সঙ্গীত রসকল্লোল’ (১৯৭৮)

* নতুন সংযোজিত ‘বাংলার নবজাগরণ একটি অতিকথা’ দ্রষ্টব্য। (১৯৭৮)

* সূর্যঘড়ির প্রচলন প্রাচীন মিশরে ছিল। ১৩৭১ সালে সময়কে নির্দিষ্ট ঘণ্টার মধ্যে পরিমাপ করার পদ্ধতির প্রচলন করেন। আবুল হাসান ইবন আল সাতির। ১৪৪৬ সালে সূর্যঘড়ির মান উন্নত হয়। গিওভাননি দা দন্দি ১৩৬৪ সালে তাঁর গবেষণাপত্রে প্রথম আধুনিক ঘড়ির প্রসঙ্গ উপস্থিত করেন। আজকের পেন্ডুলাম ঘড়ির উদ্ভাবক ক্রিশ্চিয়ান হুইজেনস (১৬২৯—১৬৯৫)। ১৬৫৬ সালে তাঁর আবিষ্কারই ঘড়ি তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।

* হিয়ারফোর্ড ম্যাপপা মুণ্ডি (Hereford Meppa Mundi) ১৩০০ সালে আঁকা হয়েছিল। মানচিত্রে স্বাক্ষর আছে রিচার্ড অব হ্যালডিংহাম অব ল্যাফোর্ড—এর। ভেলাম—এর (বাছুরের চামড়া) উপর আঁকা আয়তন ১৫৮ × ১৩৩ সেমি. ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ মিউজির্য়াম—এ প্রথম সংরক্ষণ করা হয়। হিয়ারফোর্ড ক্যাথিড্রাল গ্রন্থালয়ে শিকলে বাঁধা অসংখ্য পুঁথির সঙ্গে মানচিত্র রাখা আছে। ভারতে অষ্টম শতাব্দীর পণ্ডিত ভবভূতির আঁকায় ভৌগোলিক অঞ্চলের সন্ধান পাওয়া যায়। একাদশ শতাব্দীর পণ্ডিত ক্ষেমেন্দ্র তাঁর ‘লোকপ্রকাশ’ পুঁথিতে উল্লেখিত দুইটি মানচিত্রের প্রতিলিপি ইতালির লরেঞ্জা পুলে তাঁর প্রকাশনায় উপস্থিত করেছেন।

* সৃষ্টিশীল মূলধন ও টাকার যুগ থেকে ‘সৃষ্টিশীল সাহিত্য—শিল্প’—এর উদ্ভব হল। (১৯৭৮)

* লেখকের ‘মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’ গ্রন্থ (১৯৭৮) দ্রষ্টব্য।

* বুর্জোয়া যুগ বা ধনতান্ত্রিক যুগের শ্রমভেদের ফলে সংস্কৃতিক্ষেত্রেও বিভেদ দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এই বিভেদ প্রকট হয়ে উঠে যে গভীর সংস্কৃতিসংকট সৃষ্টি করেছে, ধনতান্ত্রিক যুগের শৈশবকালে তা করেনি। তখন শিল্পীরা বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, ইঞ্জিনিয়াররাও শিল্পী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমভেদ যেমন প্রকট হয়ে উঠেছে, সংস্কৃতিক্ষেত্রেও ‘ক্রিয়েটিভ’ জিনিয়াসদের কৌলীন্য ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তেমনি বিকট মূর্তি ধারণ করেছে। সাহিত্যক্ষেত্রের যিনি কবি, গল্পলেখক বা ঔপন্যাসিক তিনি ‘ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস’, আর যিনি ঐতিহাসিক, সমালোচক, সমাজবিজ্ঞানী বা গবেষক তিনি ‘প্রোডাক্টিভ লেবারার’। যিনি স্টুডিয়োতে ছবি আঁকেন, পাথরের মূর্তি গড়েন, তিনি ‘জিনিয়াস’, যিনি বাড়িঘর নির্মাণ করেন, নগরপরিকল্পনা করেন, তিনি ‘ফিল্ড লেবারার’। যিনি ল্যাবরেটরিতে বন্দি হয়ে অধীত বিজ্ঞানের গবেষণা করেন, তিনি ‘জিনিয়াস’, যিনি যন্ত্রের নকশা করেন, ইঞ্জিনিয়ার, তিনি ‘মজুর’ মাত্র। এই যে বিকট বৈষম্য, এ হল বিকৃত বুর্জোয়া যুগের দান। কল্পনার ঐশ্বর্য এবং সেই কল্পনাকে রূপ দেবার শক্তি যদি ‘প্রতিভা’র বৈশিষ্ট্য হয় তাহলে কবি বা ঔপন্যাসিকের চেয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীর কল্পনাশক্তি কম নয়, বরং বেশি। ‘ইমেজ’ ও ঘটনাকে কবি ঔপন্যাসিক যেমন চোলাই করে তাকে সাহিত্যিক রূপ দেন, ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীরাও তেমনি প্রচুর উপাদান চোলাই করে তাকে সাহিত্যিক রূপ দেন। যিনি বিরাট একটি নগরের পরিকল্পনা করেন, তিনি স্টুডিয়োবন্দি ভাস্কর বা শিল্পীর চেয়ে কম ‘প্রতিভাশালী’ কীসে? যে মিস্ত্রি একটা নিরেট কাষ্ঠখণ্ড থেকে সুন্দর একটা কাঠের জিনিস তৈরি করেন, তিনি কি শিল্পী নন? যিনি যন্ত্রের ডিজাইন করেন, বিরাট জটিল যন্ত্রের মধ্যে যাঁর সমস্ত কল্পনা মূর্ত হয়ে ওঠে, তিনি ‘বিশুদ্ধ’ বিজ্ঞানীর চেয়ে কম শক্তিশালী কীসে? এই বিভেদ ও বৈষম্য, এই ‘fantastic nonsense’ উদীয়মান গতিশীল বুর্জোয়া যুগের দান নয়, অস্তগামী বিকৃত ধনতান্ত্রিক যুগের দান। একশ্রেণির তথাকথিত মার্কসবাদীদের (লেখকের মতে) মধ্যেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে ‘জিনিয়াস’—এর একাধিপত্য, স্বাতন্ত্র্য ও সংকীর্ণতা সম্পূর্ণ অর্থহীন ‘ননসেন্স’। মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের রচনাবলির নানা স্থানে এই বিভেদের কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এই কথা বলেছেন। মার্কসবাদে যাঁরা বিশ্বাসী নন, তাঁরা এ সম্বন্ধে বিখ্যাত শিল্পী Eric Gill-এর Work & Property এবং Sacred & Secular বই দুখানি পড়তে পারেন। (১৯৪৮)

* Idols—এর বাংলা ‘ভূত’ না হলেও এখানে ‘ভূত’ কথাটা জুতসই বলেই আমি ব্যবহার করেছি। (১৯৪৮)

* রকফেলার ইনস্টিটিউট—এর আগের নাম রকফেলার ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল রিসার্চ (১৯০১—১৯৫৮)। ১৯৬৫ সালে রকফেলার ইউনিভার্সিটি নামে পরিবর্তিত হয়। মূলতঃ চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৭ জন বিজ্ঞানী এই প্রতিষ্ঠান থেকে নোবল পুরস্কার পেয়েছেন।

ডয়েটসে মিউজিয়াম জার্মানির মিউনিখ শহরে ২৮ জুন ১৯০৩ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মিউজিয়াম। ২৮,০০০ বিষয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৫০টি ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা আছে। দর্শকের সংখ্যা প্রতি বছরে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার।

* রয়্যাল সোসাইটি ২৮ নভেম্বর ১৬৬০ সালে স্থাপিত হয়। পৃথিবীর মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। ১৬৪০ সালের পরে রবার্ট বয়েল (১৬২৭—১৬৯১) এবং কিছু দার্শনিক পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে জ্ঞানচর্চার জন্য ‘ইনভিজিবল কলেজ’ নামে কেন্দ্র গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে এরই সূত্র ধরে প্রকৃতি বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য রয়েল সোসাইটি গড়ে ওঠে।

* ভেনিস দিদেরো (১৭১৩—১৭৮৪) ও জাঁ ব্যাপটিস্ট লো রঁদ দ্য অ্যালেমবার্ট ১৭৫১ সালে থেকে ১৭৬৫—র মধ্যে ১৭ খণ্ড পাঠ্য বিষয় ১১ খণ্ড সচিত্র উপস্থাপনা সহ ‘এনসাইক্লোপেদি’ চারজন প্রকাশক সম্মিলিতভাবে প্রকাশ করেন। ১৫০ জন সমকালীন দার্শনিকের প্রবন্ধ পাঠ্য অংশে যুক্ত হয়। তাঁরা ‘এনসাইক্লোপেডিস্ট’ নামে সমাদৃত।

* দ্বিতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য। (১৯৪৮)

* সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য’ গ্রন্থে এই ধারার যে পর্যায়ভাগ করেছেন তা লেখকের মতে বিজ্ঞানসম্মত নয়। তিনি ‘বঙ্কিম—ভূদেব—বিবেকানন্দ’র তৃতীয় যুগকে ‘যথার্থ সাংস্কৃতিক সমন্বয়সাধনের’ যুগ বলেছেন। তা কোনওমতেই বলা যায় না। অরবিন্দ ঘোষ তাঁর ‘The Renaissance in India’ গ্রন্থে এই নবজাগৃতির ধারার যে পর্যায়ভাগ ও বিশ্লেষণ করেছেন তাকে আদর্শবাদীর বিশ্লেষণ বলা যায়। মোহিতলাল মজুমদার তাঁর ‘বাংলার নবযুগ’ গ্রন্থে নবজাগৃতির যে ইতিহাস রচনা করেছেন তার মধ্যে সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টি তো দূরের কথা, আদর্শবাদীর নিষ্ঠা ও উদারতা পর্যন্ত নেই, আছে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক বিকৃতবুদ্ধির ও বিভ্রান্তদৃষ্টির পরিচয়। (১৯৪৮)

* আজ আর এ কথা বোধহয় বলা যায় না, কিন্তু ১৯৪৮ সালে নিশ্চয় বলা যেত। আজ কেন বলা যায় না, সে বিষয়ে আমার ‘মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’ গ্রন্থে (২য় সং, ১৯৭৭) ‘বিপ্লব মহানগর মধ্যবিত্ত মার্কসীয় চিন্তাধারা’ প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। (১৯৭৮)

***

চতুর্থ অধ্যায় – নবজাগৃতির ভাববিপ্লব

১. Narendranath Laha : Promotion of Learning in India by Early European Settlers (upto 1800 A.D.)
 সজনীকান্ত দাস : বাংলা গদ্যের প্রথম যুগ, ২২
 ডা. যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ ক্স বাংলা মুদ্রাঙ্কনের ইতিবৃত্ত ও সমালোচনা (১৮৭২)

২. Hunter : Marquis of Dalhousie (Rulers of India Series), ১৯৩—১৯৪

৩.  ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : সংবাদপত্রে সেকালের কথা (২য়), ৩৩৩—৩৩৪

৪. Mard-Engels Sel. Corr. ২২৭, ২২৮, ২২৯ নং চিঠি

৫. M.E.S.C. ৫৯ নং চিঠি
 Haldane : Science Advances, ১৮১
 Mumford : Technics & Civilisation, ১৪—১৬

৬. Mumford : ওই, ১২৪—১৩০

৭. Carter : The Invention of Printing in China and Its Spread Westward (1931)

৮. Robert Lowie : Culture & Ethnology, ৭৮

৯. S. C. Gilfillan : Sociology of Invention, ১৩৭—১৪০

১০. Marx : Capital (Vol. I), ১৫অ
 আধুনিক যন্ত্রের ক্রমবিকাশের ইতিহাস এত সুন্দরভাবে আর অন্য কোনও গ্রন্থে আলোচনা করা হয়নি।

১১. Marx : Capital (Vol. 1, Modern Lib. ed), ৪০৭

১২. যন্ত্রের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে অনেক ইতিহাস আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :
 Mumford : Techniques & Civilisation
 Usher : A History of Mechanical Inventions
 Thorndike : Science & Thought in the 15th Century
 Wolf : History of Science, Technology and Philosophy in the 16th & 17th Centuries

১৩. Huberman : Man’s Worldly Goods, ৭২—৭৩

১৪. Martin : Sociology of Renaissance, ১৫—১৬

১৫. Marx : Capital (Vol. I, Modern Lib. ed), ১৪৮

১৬. ‘…it was now that it became possible to talk of ‘genius’ as the highest expression of a new consciousness, of its power and freedom which, based entirely upon the personal forces and ability of the individual, become possible only in a bourgeois world’.
 (Martin : Sociology of Renaissance, ২৫—Bold লেখকের)

১৭. F. Bacon : New Atlantis (Works, ed. Basil Montagu)
 : New Organon (Works, ed. J. Spedding, Ellis & Heath)

১৮. Mumford : Techniques and Civilisation, ৫৬—৫৭

১৯. Crowther : Social Relations of Science, ৩৫১

২০. Bernal : Social Functions of Science, ১৯—২১

২১. Engels : Ludwig Feurbach (Martin Lawrence, ed.) APP, ‘C’, ২অ

২২. Marx : The Eighteenth Brumaire (Allen & Unwin), ৬৭

২৩. Marx : ওই, ৭৩—৭৪

২৪. Engels : Anti-Duhring (L. W. ed.), ৩৪৭

২৫. Martin : Sociology of Renaissance, ২১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *