বাংলার নতুন সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস
ইতিহাসের আগেকার যুগগুলিতে প্রায় সর্বত্রই সমাজের মধ্যে একটা অত্যন্ত জটিল স্তরবিন্যাস, সামাজিক পদমর্যাদার স্তরভেদ দেখা যায়। যেমন প্রাচীন রোমের প্যাট্রিসিয়ান নাইট প্লিবিয়ান ক্রীতদাস; মধ্যযুগের সামন্তপ্রভু গিল্ডভুক্ত কারিগর, শিক্ষানবিশ, অর্ধদাস; এইসব শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন উপশ্রেণি।
ফিউডাল সমাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে যে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যেও সেই একই শ্রেণিভেদ ও শ্রেণিবিরোধ রয়েছে। কেবল আগেকার শ্রেণিবিন্যাসের বদলে নতুন শ্রেণিভেদ গড়ে উঠেছে, নতুন পীড়ন ও শোষণের বাস্তব অবস্থা এবং নতুন ধরনের শ্রেণিসংগ্রামের সৃষ্টি হয়েছে।
—মার্কস এঙ্গেলস, ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার’, ১৮৪৮
যন্ত্রযুগের আবির্ভাবে শ্রমশিল্পক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটল তার প্রচণ্ড তরঙ্গাঘাতে মধ্যযুগের সামন্ত সমাজের গড়ন ভেঙে গেল। মধ্যযুগীয় শ্রেণিবিন্যাসেরও রূপান্তর ঘটল। অকস্মাৎ ঘটল না, ধীরেসুস্থে ঘটল। পুরাতন সমাজের গঠন ও শৃঙ্খলা ভেঙে গেল এবং বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে নতুন সমাজশৃঙ্খলা ও শ্রেণিবিন্যাস দেখা দিল। এই নতুন শ্রেণিবিন্যাসের সময় সমাজে বুর্জোয়াশ্রেণি (ধনিকশ্রেণি বা পুঁজিপতি শ্রেণি) মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আবির্ভাব হয়। তার সঙ্গে ‘প্রলেটারিয়েটশ্রেণি’ বা শ্রমজীবী শ্রেণির আবির্ভাবও ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। পূর্বে যে সমাজে ধনিকশ্রেণি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ছিল না তা নয়। কিন্তু সেকালের শ্রেণিগুলির সঙ্গে একালের সমশ্রেণিভুক্তদের যে মৌল পার্থক্য ঘটল সেইটাই যুগান্তকারী। এই মৌলিক পার্থক্যের জন্যই সমাজের রূপ বদলে গেল। মধ্যযুগে সামাজিক শ্রেণিবিচারের সর্বপ্রধান মানদণ্ড ছিল বংশগৌরব বা রক্তের সম্পর্ক। বংশানুক্রমে শ্রেণিমর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকত। সদাগরশ্রেণি কারিগরশ্রেণি অথবা অবস্থাপন্ন কৃষকশ্রেণি ধনসম্পত্তির দিক দিয়ে উচ্চশ্রেণিভুক্ত হবার যোগ্যতা লাভ করলেও তাদের সেই শ্রেণিমর্যাদা দেওয়া হত না। বংশ ও রক্তসম্পর্কের অত্যন্ত ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে মধ্যযুগের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের আভ্যন্তরিক শ্রেণিকাঠামো সেকালের অর্থনৈতিক কাঠামোর মতনই অচল অটল স্থিতিশীল ছিল। একশ্রেণি থেকে আর—একশ্রেণিতে উন্নতির সম্ভাবনা একেবারেই ছিল না বলা চলে। কিন্তু নতুন শ্রমশিল্পের যুগে, ধনতন্ত্রের যুগে, সচল সক্রিয় যন্ত্রযুগে মধ্যযুগের সামাজিক অচলায়তন ভেঙে গেল। সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে ‘সামাজিক গতিশীলতা’ (social mobility) বলেছেন সেই গতিশীলতা সঞ্চারিত হল সমাজে।১ মুদ্রাপ্রধান অর্থনীতি মধ্যযুগের বংশপ্রধান দুর্ভেদ্য শ্রেণিবিচার ভেঙে দিল। স্বাধীন অবাধ বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারবে তাদের নিম্ন থেকে মধ্য এবং মধ্য থেকে উচ্চশ্রেণিতে উন্নতির পথে আর কোনও বাধা থাকবে না। প্রভাব—প্রতিপত্তি ও শ্রেণিমর্যাদার অবাধ অধিকারও সকলের স্বীকৃত হল! বংশগৌরব কৌলিন্য ও রক্তসম্পর্কের আভিজাত্যকে জয় করল সচল সক্রিয় সর্বশক্তিমান মুদ্রা (Money), শেকসপিয়র যাকে তাঁর Timon of Athens-এ ‘thou common whore of mankind’ বলেছেন। শিক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার যখন স্বীকার করা হল তখন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবার অবাধ স্বাধীনতাও সকলে পেল। এইভাবে নতুন যন্ত্রযুগ ও শিল্পবিপ্লবের যুগে, মুদ্রা ও পণ্যের প্রাধান্যের যুগে, শিক্ষার প্রসারের যুগে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার যুগে, সমাজে যে নতুন শ্রেণিবিন্যাস দেখা দিল, সচলতাই হল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে প্রাচীর অবশ্যই রইল, একশ্রেণি থেকে আর—একশ্রেণিতে উন্নতির পথেও যথেষ্ট অন্তরায় থাকল। কিন্তু রক্তসম্পর্ক ও বংশগৌরবের মতন সে প্রাচীর গোড়া থেকেই (পরে হলেও) দুর্ভেদ্য ও দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে ওঠেনি। পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশের ফলে পরবর্তীকালে পুঁজিপতি শ্রেণির মধ্যে যেমন একচেটে পুঁজিপতি (Monopoly Capitalist) ও সাধারণ পুঁজিপতিদের পার্থক্য দেখা দেয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও তেমনি নানারকম স্তরভেদ প্রকট হয়ে ওঠে এবং তার প্রলেটারিয়েট শ্রেণির কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য ও দুঃখ—দুর্দশাও বাড়তে থাকে। সমাজজীবনের গতিশীলতা ক্রমে নষ্ট হয়ে যায়। শ্রেণিকাঠামো ক্রমেই স্থিতিশীল ও দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। এই স্থিতিশীলতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিস্বরূপ সমাজের পুঁজিপতি শ্রেণির উন্মত্ত স্বেচ্ছাচারিতা, সাম্রাজ্যবাদের (Imperialism) দিগবিদিকে অভিযান, মধ্যশ্রেণির আর্থিক সংকট, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সংস্কৃতি সংকট, প্রলেটারিয়েট শ্রেণির সংঘবদ্ধ চেতনা এবং শ্রেণিবিরোধ ও শ্রেণিসংঘর্ষ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে ওঠে। ধনতান্ত্রিক সমাজের ক্রমবিকাশের ধারা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস এই কথাই বলেছেন।২ জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ফ্রিডরিশ জাহন (Freidrich Zahn) ১৯২৫ সালে উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিদের জীবনেতিহাস থেকে শ্রেণিবিন্যাসের ধারা সম্পর্কে গবেষণা করে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ :৩
এখানে দেখা যায়, বড় বড় পুঁজিপতির মধ্যে শতকরা প্রায় ৭০ জন, ধনিক ব্যবসায়ী প্রকাশক ও ব্যাংকারদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৬৭.২ জন এবং জমিদারদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮৫ জন স্বশ্রেণিভুক্ত পিতার পুত্র। যাদের পিতা মধ্য ও নিম্নমধ্যশ্রেণিভুক্ত ছিল তাদের মধ্যে শতকরা ১৫ জন, আর যাদের পিতা উচ্চশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ছিল তাদের মধ্যে ১৩.৯, ১৭.৮ এবং ১৪.৮ জন যথাক্রমে বড় পুঁজিপতি, ধনিক ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও জমিদারশ্রেণিভুক্ত হয়েছে। শ্রেণি—উন্নতিও সামান্য হয়েছে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে কতগুলি বিবাহবন্ধনের জন্য হয়েছে তা বলা কঠিন। কার্ল ম্যানহাইম অবশ্য এই সামাজিক শ্রেণি নির্বাচনের মধ্যে ‘restraining conservative’ এবং ‘dynamic progressive’ এই উভয় নীতিরই প্রভাব স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন যে, “selection by achievement is the dynamic element here”, কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, কৃতকার্যতার জন্য নতুন যুগের সামাজিক বৈশিষ্ট্য যে ক্রিয়াশীলতা তা ক্রমেই মন্থর হয়ে স্থিতিশীল হয়ে আসছে।৪ সামাজিক গতিবিজ্ঞানের (Social Dynamics) নিয়ম অনুযায়ী নতুন যুগে যে নতুন শ্রেণিসমাজের আবির্ভাব হয় তার স্থিতি পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবধান—প্রাচীর আবার দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। সচল সক্রিয় যন্ত্রযুগেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মূলধন ও মুনাফা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হবার ফলে পুঁজিপতি শ্রেণি ক্রমে সংকুচিত হতে থাকে। শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আয়তন বাড়ে, বেকার সমস্যা বাড়ে এবং ‘Proletarianization of the Intelligentsia’ দ্রুত গতিতে কার্যকর হয়। সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকটও এইভাবে দেখা দেয়। উচ্চশ্রেণি যদি ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে তাহলে মধ্যশ্রেণি ও প্রলেটারিয়েট শ্রেণি সম্প্রসারিত হতে বাধ্য, কিন্তু তার জন্য শ্রেণিরূপান্তর ঘটে না, শ্রেণিবিরোধের (class-conflict) তীব্রতার ভিতর দিয়ে সেই রূপান্তরের পথ পরিষ্কার হয় মাত্র। বর্তমান যুগে মজুরশ্রেণির দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশের নিশ্চিত ক্রমাবনতি এবং বিশাল প্রলেটারিয়েট শ্রেণির সংঘবদ্ধ শ্রেণিচেতনা ও শক্তির বিকাশ থেকেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
বাংলার নতুন শ্রেণিবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ধনতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে, অর্থাৎ মার্কসের ভাষায় ‘প্রাথমিক মূলধন সঞ্চয়কালে’ বাংলা দেশেও বুর্জোয়াশ্রেণি, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং প্রলেটারিয়েট শ্রেণির বিকাশ হয়। অর্থনীতিবিদ মরিস ডব বলেছেন :৫
সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা হল, উপনিবেশের সামাজিক শ্রেণিকাঠামো ঠিক সেইভাবে গড়ে তোলা যেভাবে ধনতন্ত্রের প্রাথমিক যুগে অন্য দেশগুলিতে এই শ্রেণিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। শ্রমশিল্পে মূলধন নিয়োগ করার পূর্বে প্রথমে প্রয়োজন গ্রাম্য প্রলেটারিয়েট। শ্রমশিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বণিক মুতসুদ্দি দালাল জমি ব্যবসায়ী থেকে শিল্পোদযোগী পুঁজিপতি পর্যন্ত ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশ হতে থাকে।
ঐতিহাসিক নিয়মে এইভাবেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বাংলা দেশের নতুন সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস শুরু হয়েছে। বণিক মুতসুদ্দি দালাল জমি ব্যবসায়ী থেকে যৎকিঞ্চিৎ শিল্পোদযোগী পুঁজিপতি পর্যন্ত বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণিরও (ঔপনিবেশিক) বিকাশ হয়েছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ও প্রসারের ফলে নতুন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির (elite) আবির্ভাব হয়েছে। গ্রাম থেকে উৎখাত বাংলার কৃষক ও কারিগরেরা হয়েছে (সামান্য সংখ্যায় হলেও) শহরেরর কলকারখানার নতুন প্রলেটারিয়েট শ্রেণি। কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজিপতি শ্রেণির একাধিপত্যের জন্য এবং ঔপনিবেশিক শোষণ নীতির ফলে বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণির স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সংখ্যাবৃদ্ধির অনুপাতে অর্থনৈতিক সুযোগ—সুবিধাও (প্রধানত চাকুরি) বাড়েনি। আর শ্রমশিল্প ও কলকারখানার প্রসার স্বাভাবিকভাবে না হওয়ার ফলে গ্রাম থেকে উৎখাত কৃষক ও কারিগরেরা দলে দলে শহরেও আসেনি, প্রলেটারিয়েট শ্রেণিভুক্তও হয়নি। গ্রামের বোঝা বেড়েছে, কৃষির শোচনীয় অবনতি ঘটেছে এবং নতুন এক নিঃস্ব খেতমজুরশ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর ব্রিটিশ আমলে ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্বভোগী যে নতুন জমিদারশ্রেণি গজিয়ে উঠল, সরকারের নির্দিষ্ট রাজস্ব দেওয়া ভিন্ন যাদের আর কোনও দায়িত্ব বা কর্তব্য রইল না, তাদের ধনসঞ্চয়ের পথ প্রশস্ত হল বটে, কিন্তু মাটির সঙ্গে তাদের আর কোনও সম্পর্ক থাকল না। সুতরাং অপূর্ব আলস্যে বসে বসে ডিম পাড়াই হল তাদের কাজ এবং অত্যাচারী ও উদাসীন মধ্যস্বত্বভোগীতে গ্রাম ছেয়ে গেল। শহরের আড়ষ্ট বুর্জোয়াশ্রেণি, সমস্যাকাতর মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীশ্রেণি এবং প্রলেটারিয়েট শ্রেণির পাশাপাশি গ্রামের নতুন অলস অত্যাচারী জমিদারশ্রেণি, পত্তনিদার গাঁতিদার বর্গাদার ইত্যাদি নিয়ে গ্রাম্য মধ্যশ্রেণি এবং গ্রাম্য প্রলেটারিয়েট বা খেতমজুরশ্রেণি বাংলার সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াল। শহর ও গ্রামের ব্যবধান দূর হল না, বেড়ে গেল। অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংকট ঘনিয়ে এল। এই হল আধুনিক অর্থাৎ উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক অবস্থা।* কিন্তু অন্যান্য দেশের মতন আমাদের বাংলা দেশের তথা সারা ভারতবর্ষের উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণি, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে যে কিঞ্চিৎ গতিশীলতা ও প্রাণশক্তি ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। সেই গতিশীলতা ও প্রাণশক্তির জোরেই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলন উত্থান—পতনের বন্ধুর পথে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে, নতুন মনীষা, গঠনকুশলী সমাজসংস্কার ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যশিল্প প্রতিভার বিকাশ হয়েছে।
বাংলার নতুন জমিদারশ্রেণি
আগে বলেছি পাঠান ও মোগল আমলে বাংলা দেশে চৌধুরি ক্রোরী কানুনগো আমিল শিকদার পাটোয়ারি প্রভৃতি রাজস্ব আদায়কারীরা ক্রমে প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী জমিদার হয়ে ওঠেন। বর্ধমান দিনাজপুর নদিয়া প্রভৃতি প্রাচীন জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠা এইভাবে হয়। মুরশিদকুলি খাঁ ১৭২২ সালে সমগ্র বাংলা দেশকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করে সেগুলিকে ২৫টি জমিদারি ও ১৩টি জায়গিরে বন্দোবস্ত করেন। তাঁর এই ঐতিহাসিক বন্দোবস্তের নাম ‘জমা কামেল তুমারী’। নবাব সুজা খাঁ—র আমলে মুরশিদের নির্দিষ্ট রাজস্বের মধ্যে ৪২,৬২৫ টাকা মাত্র বাদ যায় এবং সুজা খাঁ স্বয়ং ১৯ লক্ষ টাকারও বেশি নতুন আবওয়াব ধার্য করে উক্ত বন্দোবস্ত পাকা করেন। এই জমিদারি বন্দোবস্তই পরবর্তী বন্দোবস্তগুলির, এমনকী দশসালা তথা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিস্বরূপ। কয়েকটি জমিদারি বন্দোবস্তের কথা তাই এখানে বলা প্রয়োজন।
মুরশিদকুলি খাঁ—র বন্দোবস্তে ১৭২২ সালে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের সঙ্গে ৫৭টি পরগনায় ২০,৪৭,৫০৬ টাকা রাজস্ব স্থির হয়। মিরকাসেমের আমলে ‘কর আবওয়াব’ ইত্যাদি নিয়ে এই রাজস্ব হয় ৩২,২৬,৯৩৪ টাকা। মুরশিদের বন্দোবস্তে দিনাজপুরের জমিদারি ৮৯ পরগনায় ৪,৬২,৯৬৪ টাকা রাজস্ব স্থির হয় এবং মিরকাসেমের আমলে রাজস্ব প্রায় চারগুণ বেড়ে ১৮,২০,৭৮০ টাকা হয়। নদিয়ার জমিদারি ৭৩ পরগনায় ৫,৯৪,৮৪৬ টাকা রাজস্ব স্থির হয় এবং মিরকাসেমের আমলে দ্বিগুণ বেড়ে হয় ১০,৯৮,৩৭৯ টাকা। রাজশাহির জমিদার রাজা রামজীবনের সঙ্গে মুরশিদের বন্দোবস্তে ১৩৯ পরগনায় জায়গির বাদে ১৬,৯৬,০৮৭ টাকা জমার ব্যবস্থা হয়। এই সময় মুরশিদাবাদ, ভূষণা ও ঘোড়াঘাট এই তিন চাকলা নিয়ে রাজশাহির জমিদারি বিস্তৃত ছিল। রাণি ভবানীর সময়ে আরও কতকগুলি ছোট—বড় পরগনা এই জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন রাজমহল থেকে বগুড়া পর্যন্ত এই জমিদারির বিস্তৃতি ছিল। মিরকাসেমের বন্দোবস্তে এই রাজস্ব দ্বিগুণ বেড়ে ৩৫,৫৩,৪৮৫ টাকা হয়। পাঠান রাজত্বকালে বীরভূম হিন্দু রাজবংশের অধীনে ছিল। পাঠান—মোগল বিপ্লবের সময় এই হিন্দু রাজাদের কর্মচারী আসদউল্লা ও জোনাদ খাঁ নামে দুই ভাই বীরভূম হস্তগত করেন। জোনাদের পুত্র রণমন্ত খাঁ—র পৌত্র সাধুশীল আসদউল্লার সঙ্গে মুরশিদের বন্দোবস্ত হয়। ২২টি পরগনায় বীরভূম জমিদারির সদর জমা ৩,৬৬,৫০৯ টাকা ধার্য হয়। মিরকাসেমের সময়ে রাজস্ব বেড়ে হয় ১৩,৪২,১৪৩ টাকা। ভবেশ্বর রায় ও তাঁর পুত্র মহাতপ রায় রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মানসিংহকে সাহায্য করে বর্তমান যশোহরের সৈদপুর প্রভৃতির জমিদারি পান। মহাতপের পৌত্র মনোহর রায় ১৬৯৬ সালে ইউসুফপুর প্রভৃতির জমিদারি পেয়ে ‘রাজা’ উপাধি পান। তাঁর পুত্র কৃষ্ণরাম রায়ের সঙ্গে মুরশিদের বন্দোবস্তে ২৩ পরগনায় ১,৮৭,৭৫৪ টাকা জমা ধার্য হয়। এঁদের বংশাবলি চাঁচড়া—যশোহর রাজবংশ বলে পরিচিত। মিরকাসেমের বন্দোবস্তে এই রাজস্ব বেড়ে ৪,১৬,৩১৮ টাকা হয়। চাকলে জাহাঙ্গিরনগর বা ঢাকার সমস্ত খালসা ভূমি এবং ভূষণা ও ঘোড়াঘাটের সামান্য অংশ নিয়ে এই জমিদারি বিস্তৃত ছিল। মুরশিদের বন্দোবস্তে জায়গির বাদ দিয়ে এই বিভাগের ১৫৫ পরগনায় ৮,৯৯,৭৯০ টাকা জমা ধার্য হয়। চাকলে ঘোড়াঘাটের উত্তর ভাগ অর্থাৎ কোচবিহারের দক্ষিণ পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ, সরকার বাজুহার মধ্যস্থিত কুণ্ডী প্রভৃতি পরগনা নিয়ে ‘ফকিরকুণ্ডী’র উৎপত্তি। এই ফকিরকুণ্ডীই পরে রংপুর জেলায় পরিণত হয়। এর মধ্যে অনেক ছোট ছোট তালুকও ছিল। ৯০,৫৪৮ টাকা জায়গির বাদে ২৪৪ পরগনায় এই জমিদারির রাজস্ব ২,৩৯,১২৩ টাকা নির্দিষ্ট হয় এবং মিরকাসেমের আমলে বেড়ে হয় ৬,৩৭,৬৩২ টাকা।৬
বাংলা দেশের প্রাচীন জমিদারবংশগুলির এই হল মোটামুটি পরিচয়। ইংরেজের আমলে দশসালা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এই জমিদারশ্রেণির মৌল রূপান্তর ঘটল এবং নতুন একশ্রেণির জমিদার সৃষ্টি হল। স্থির হল, ১১ ভাগের ১০ ভাগ রাজস্ব পাবেন সরকার আর বাকি ১ ভাগ পাবেন জমিদাররা। সমস্ত অনাবাদি জমিও জমিদারদের দান করে দেওয়া হল। নির্দিষ্ট রাজস্ব যথাসময়ে দেওয়া ছাড়া সরকারের সঙ্গে জমিদারদের আর কোনও সম্পর্ক রইল না। প্রজার মঙ্গল ও আবাদের উন্নতির দায়িত্ব জমিদারের, এ কথা কর্নওয়ালিসের বন্দোবস্তের মধ্যে থাকলেও তা শুধু কাগজপত্তরেই থাকল। আসলে জমিদারেরা ইংরেজের আমলে গোত্রান্তরিত হলেন। তাঁরা আগে ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী, জমিজমার উপর কোনও ব্যক্তিগত মালিকানা তাঁদের ছিল না, যদিও বংশানুক্রমে তাঁদের অধিকার এবং প্রভাব—প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ থাকত। এখন তাঁরা হলেন জমির মালিক, সরকারের দেয় রাজস্ব দেওয়া ভিন্ন তাঁদের আর কোনও দায়িত্ব রইল না। জমিদারি তাঁদের মূলধনে পরিণত হল। আগে দেশীয় প্রথানুসারে খোদকস্ত প্রজাদের বংশানুক্রমে চাষের ও বাসের ভূমির উপর যে অধিকার ছিল তা নতুন ব্যবস্থার ফলে রইল না। জমিদাররা প্রজাদের উচ্ছেদ করা ও খাজনা বৃদ্ধি করার পূর্ণ অধিকার পেলেন। জমির ব্যক্তিগত মালিকানাপ্রথা প্রবর্তনের ফলে জমিদাররা বহু খুদে মালিক সৃষ্টি করলেন। পত্তনিদার দরপত্তনিদার গাঁতিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা বেড়ে গেল। সাইমন কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায়, এক—একটি জেলায় ৫০ জন পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হল।৭ জমিদাররা ধীরে ধীরে দায়িত্বজ্ঞানহীন অলস বিলাসী অত্যাচারী ব্যভিচারী রাজস্বভোগী ধনসঞ্চয়ী মালিকশ্রেণিতে পরিণত হলেন। ইংরেজের শাসন ও শোষণপ্রথার প্রধান স্তম্ভ হলেন এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তোত্তর জমিদারশ্রেণি।
অবশ্য ইংরেজের আমলে বাংলার প্রাচীন জমিদার বংশ অনেক ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭৮৫ সালে কোম্পানির কাছে নদিয়ারাজের খাজনা বাকি পড়ে। কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য একজন ট্রাস্টির হাতে জমিদারি তদারকের ভার দিয়ে রাজাকে ১০০,০০০ টাকা ভাতা দেবার বন্দোবস্ত করেন। ১৮০০ সালের মধ্যে দিনাজপুর রাজবংশের প্রায় সব সম্পত্তি নিলাম হয়ে যায়। ১৭৯৩ সালে বাকি খাজনার দায়ে নাটোরের রাজাকে রাজবাড়িতে বন্দি করা হয়। কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেছেন যে, জমিদারেরা বর্ধিত খাজনা দিতে অক্ষম হন এবং ক্রমশ ঋণের দায়ে জড়িয়ে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান।৮ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনও ১৮৭৭ সালে এক স্মারকলিপিতে এই একই অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন :৯
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার প্রাচীন বনেদি জমিদার বংশগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। এই বন্দোবস্তের ফলে অত্যধিক বর্ধিত নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়ের যে কঠোর ব্যবস্থা করা হয় তারই চাপে পড়ে এই জমিদার বংশগুলি লোপ পায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বাংলার তিন ভাগের এক ভাগই প্রায় জঙ্গল ছিল। প্রজাদের ঋণ দিয়ে অল্প খাজনায় জমি বিলি করে, বাঁধ খাল পথ ঘাট তৈরি করে বাংলার জমিদাররাই এইসব বনজঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপন করেছেন, আবাদের ব্যবস্থা করেছেন। জমিদাররা যে পরিমাণে মূলধন নিযুক্ত করেছিলেন সেই অনুপাতে মুনাফা পাননি।
কিশোরীচাঁদ মিত্রের যুক্তি এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগের সমর্থন ১৮১২ সালের সিলেক্ট কমিটির পঞ্চম রিপোর্টের মধ্যেও পাওয়া যায়।১০ কিন্তু এ যুক্তি হল রাজস্ব আদায়ের অজুহাতে কঠোর প্রজাবিরোধী আইনগুলি (Regulation VII of 1799 ইত্যাদি) প্রণয়ন করার সপক্ষে যুক্তি, সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট জমিদারদের পক্ষ সমর্থন করার কারণও হল তা—ই। কিন্তু জমিদার বংশের ধ্বংসের এইসব যুক্তি সহজেই খণ্ডন করা যায়। উক্ত সিলেক্ট কমিটির রিপোর্টেই যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে এ যুক্তি একেবারেই টেকে না।
বাংলা দেশের বাকি রাজস্বের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই দু—জনের কাছে বাকি : বীরভূম ও রাজশাহির জমিদার। সরকারি রাজস্ব থেকে নিজেদের ব্যভিচার ও বিলাসিতার জন্য প্রচুর অর্থ অপব্যয় করার দরুনই তাঁদের দেয় রাজস্ব তাঁরা দিতে পারেননি এবং তাঁদেরই বংশধরদের নির্দেশে জমিদারি থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
—গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল : ২৭ মার্চ ১৭৯৫
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বর্ধিত রাজস্বের চাপে বনেদি অথবা নতুন জমিদাররা সকলে পথের ভিখারি না হয়ে অনেকে যে ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন তারও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় :
লর্ড কর্ণওয়ালিস যখন বন্দোবস্ত করেন তখন তাঁর হিসাবে দেখা যায়, কোম্পানির জমিদারির তিন ভাগের এক ভাগই জঙ্গল ছিল। এই হিসাব যে নির্ভুল সে সম্বন্ধে কোলব্রুক বলেছেন : ‘বাংলা দেশের জমিজমা সম্বন্ধে দীর্ঘদিন গবেষণা করে আমিও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। বাংলার তিন ভাগের এক ভাগ জমি এই সময় আবাদযোগ্য পতিত জমি ছিল। একেবারেই আবাদযোগ্য নয় এরকম জমির হিসাব এর মধ্যে ধরা হয়নি।’ এই আবাদযোগ্য পতিত জমির সম্পূর্ণটাই জমিদারদের দান করে দেওয়া হয়েছিল।১১
আঠারো বছর হয়ে গেল, জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেখা গেছে, আগে যেসব জমি থেকে জমিদারদের ১০% থেকে ১২% আয় হত, এখন সেই জমি থেকে ৩০%, ৪০%, ৫০% পর্যন্ত আয় হয়।১২
গড়পড়তা হিসাবে দেখা যায়, যেসব জমি থেকে সরকারি রাজস্ব বাবদ জমিদাররা ১০০ টাকা দেন, সেইসব জমি থেকে তাঁরা নিজেরা প্রায় ২০০ টাকা আয় করেন।
—আর. ডি. ম্যাঙ্গলস : ৩১ মার্চ, ১৮৪৮
অধিকাংশ জমিদারই তাঁদের জমিদারি থেকে সরকারি রাজস্বের চাইতে প্রায় ৭৫% বেশি আয় করেন।১৩
—ইন্ডিগো প্লান্টারস অ্যাসোসিয়েশন : ১০ জুন, ১৮৫৬
পতিত জমির আবাদ, মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যাবৃদ্ধি খাজনাবৃদ্ধি এবং আবওয়াবাদি থেকে জমিদারদের প্রভূত ধনসঞ্চয়ের পথ যে প্রশস্ত হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। খাজনা নজর আবওয়াব ইত্যাদি আদায়ের জন্য, জমি দখল ও শস্যাদি লুট করার জন্য জমিদাররা যেভাবে নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তার দু—একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
জমিদারদের (বর্ধমান নদিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলের) দেশের আভ্যন্তরিক শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য থানাদার পাইক ইত্যাদি বহাল করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তার ব্যয়ভার বহনের জন্য সরকার পৃথক ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁদের নির্দিষ্ট জমার হিসাবের মধ্যেই এই খরচ ধরা হয়েছিল। যেসব জমিদারের উপর এই দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁরা তা সাধুভাবে পালন করার প্রয়োজনবোধ করলেন না। পেশাদার ডাকাতদের সাধারণত তাঁরা থানাদার নিযুক্ত করতেন। এই থানাদাররা লুঠতরাজ করার কাজেই তাঁদের সাহায্য করত। গ্রামের প্রজাদের ধনসম্পত্তি রক্ষা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। …বড় বড় ডাকাতের দলগুলির সঙ্গে জমিদারদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সর্বত্র দেখা যায়।১৪
—মিনিটস অব দ্য গভর্নর জেনারেল, ৭ ডিসেম্বর, ১৭৯২
ডাকাতির কমিশনার আমাকে জানালেন যে জমিদারদের লাঠিয়ালরা অধিকাংশই বাঙালি নয়, উত্তর—পশ্চিম ও বিহারের বাছা বাছা ভাড়াটে গুন্ডা। জমিদাররা এইসব বিহারি ও পাঠান লাঠিয়াল বেতন দিয়ে রাখতেন প্রজাদের উপর অত্যাচার করার জন্য।১৫
—ওয়েলবি জ্যাকসনের রিপোর্ট
বকেয়া খাজনার দায়ে প্রজাদের উচ্ছেদ করা জমিদারদের একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি বিশেষভাবে তদন্ত করে দেখেছি, দশজনের মধ্যে প্রায় ন—জন প্রজার ক্ষেত্রে এই বাকি খাজনার অভিযোগ একেবারে মিথ্যা। এই অত্যাচার ও উচ্ছেদের ব্যাপার জমিদারদের জুলুম ছাড়া আর কিছু নয়।
—রংপুরে অস্থায়ী জজ এফ. এ. গ্লোভার, ১৮৫৮
জমিদাররা যেভাবে তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তাতে আইনকানুনের সাহায্যে তাঁদের সংযত করা এখনই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।১৬
—ময়মনসিংহের জজ টেলার, ১৮৫৮
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন জমিদারদের সপক্ষে যেসব যুক্তির অবতারণা করেছেন তা যে সত্য নয় তা পূর্বোদ্ধৃত তথ্যাদি থেকে প্রমাণিত হয়। প্রজাদের বাকি খাজনার দায়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে, থানাদার পাইক লাঠিয়াল পাঠিয়ে লুঠতরাজ করতে যাঁরা দ্বিধাবোধ করতেন না, বাংলা দেশের অধিকাংশ ডাকাতের দলের যাঁরা স্রষ্টা, সর্দার ও পৃষ্ঠপোষক, পুলিশ যাঁদের টাকার গোলাম, তাঁরা যে কর্নওয়ালিসের বন্দোবস্তের ফলে বর্ধিত রাজস্বের চাপে পড়ে নির্বংশ হয়েছেন তা কোনও তথ্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিকই স্বীকার করবেন না। তা—ই যদি হয় তাহলে এ দেশের বেনিয়ান গোমস্তা মুতসুদ্দি প্রভৃতি যাঁরা দালালির গচ্ছিত ধনে এইসব জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হয়েছেন, তাঁরা তা কিনলেনই বা কেন এবং কিনে তা থেকে প্রচুর ধনসঞ্চয় করলেন কী করে? কিশোরীচাঁদ মিত্রর যুক্তিও তাই ধোপে টেকে না। বাংলার বনেদি জমিদার বংশের ধ্বংসের জন্য যাঁরা বিলাপ করেন এবং ‘স্বদেশপ্রীতি’র আতিশয্যে তার জন্য কোম্পানির আমলকে দায়ী করেন, বাংলার নতুন জমিদারশ্রেণিই তাঁদের যুক্তি প্রীতি সহানুভূতি কোনওটাই সমর্থন করবেন না। সেকালের রাজস্ব আদায়কারীরা বনেদি জমিদার হয়েছিলেন, একালের ইংরেজের দালাল—বেনিয়ানরা অনেকে সেইরকম নতুন জমিদার হয়েছেন। সেটা অভিনব ব্যাপার নয়। অভিনব ব্যাপার হল জমিদারদের গোত্রান্তর। গোত্রান্তরিত বনেদি (অথবা নতুন) জমিদারদের মধ্যে যাঁরা সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে, জালজুয়াচুরি করে সম্পত্তি নিলামে তুলে, বেনামিতে কিনে, ব্যভিচার ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, উপস্বত্বভোগীর আধিক্যে যাঁদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা চরম সীমায় পৌঁছেছিল, শাস্ত্রসম্মত ন্যায্য উত্তরাধিকারীর সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে যাঁদের জমিদারি শত টুকরো হয়ে গিয়েছিল, তাঁরাই কেবল ধ্বংস হয়ে গেছেন। ইংরেজের নতুন জমিদারি ব্যবস্থার জন্য অথবা রাজস্বের চাপে তাঁরা যে নির্বংশ হয়ে যাননি তা ইংরেজ রাজত্বকালে নতুন জমিদারশ্রেণির বংশবৃদ্ধি ও প্রভাব বৃদ্ধি থেকে বোঝা যায়।
বাংলার মজুরশ্রেণি
ইংরেজের নতুন জমিদারি ব্যবস্থার ফলে যদি কেউ ধ্বংস হয়ে থাকে তাহলে বাংলার প্রজারা এবং বাংলার কৃষক—কারিগরেরা ধ্বংস হয়েছে। বাংলার প্রজারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়েছে, জমিদারেরা দস্যু ও লাঠিয়ালরা তাদের ঘরবাড়ি খেতখামার জ্বালিয়ে—পুড়িয়ে লুট করে গ্রামছাড়া করেছে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে দেখা যায়, পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী ধরে এইভাবে জমিদাররা যে কৃষকশ্রেণিকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন তারাই পরে শহরের কলকারখানার সর্বস্বান্ত মজুরশ্রেণিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু উৎখাত কৃষকদের সংখ্যানুপাতে দ্রুত কলকারখানা বিকাশ হয়নি, মজুরের চাহিদা বাড়েনি, তাই এই সময় ভবঘুরে ভিখারি ও চোর—ডাকাতের সংখ্যা অসম্ভব বেড়ে গিয়েছিল। কার্ল মার্কস তাই বলেছেন :১৭
They were turned en masse into beggars, robbers, vagabonds, partly from inclinaion, in most cases from stress of circumstances. …The fathers of the present working-class were chastised for their enforced transformation into vagabonds and paupers.
তারা (উৎখাত কৃষকরা) দলে দলে ভিখারি ভবঘুরে দস্যু হল, কতকটা ইচ্ছা করে, কিন্তু সাধারণত অবস্থার চাপে পড়ে। …আজকের মজুরশ্রেণির পূর্বপুরুষদের এইভাবে অবস্থার চাপে পড়ে ভবঘুরে ও ভিখারি হওয়ার জন্য কঠোর শাসন করা হয়েছিল।
Thus were the agricultural people, first forcibly expropriated from the soil, driven from their homes turned into vagabonds, and then whipped, branded, tortured by laws grotesquely terrible, into the discipline necessary for the wage system.
এইভাবে কৃষকরা প্রথমে তাদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত ও বিতাড়িত হয়ে মজুরের দলে পরিণত হল। তারপর কঠোর আইনকানুনের চাবুক মেরে, শাসন করে, নির্যাতন করে তাদের আধুনিক যন্ত্রযুগের মজুরশ্রেণির নিয়মানুগত্য ও শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়া হল।
বাংলাদেশে বা ভারতবর্ষে এইভাবে গ্রাম থেকে উৎখাত সর্বস্বান্ত কৃষক—কারিগরদের কঠোর আইনের চাবুক মেরেও নতুন যুগের মজুরশ্রেণিতে পরিণত করা হয়নি। শ্রমশিল্প ও কলকারখানার প্রসার এ দেশে অত্যন্ত মন্দ গতিতে হয়েছে বলে গ্রামের উৎখাত হওয়া কৃষক—কারিগররা মজুর হয়নি। মজুর যে একেবারেই হয়নি তা নয়। অনেকে পাটের কল, কয়লাখনি ও রেলের মজুর হয়েছে, অনেকে নীলখেত ও চা—বাগানের মজুর হয়েছে। বাংলা বিহার উড়িষ্যা জুড়ে সে সময় জমিদারদের প্রজা—উচ্ছেদ লুঠতরাজ চলছিল। তাই বাংলার কয়লাখনি ও কলকারখানার বিহারি ওড়িয়া সাঁওতালি মজুরেরও অভাব হয়নি।* কর্মক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতার জন্যই বাঙালি মজুরের সংখ্যাবৃদ্ধি যতখানি বাংলাদেশে হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। কলকারখানায় মজুরের কাজের সুযোগও তাদের অনেক কমে গেছে। কর্মবিমুখতার জন্য যে বাংলাদেশের সর্বস্বান্ত উৎখাত কৃষকরা মজুর হয়নি তা সম্পূর্ণ সত্য নয়।**
বাংলাদেশের উৎখাত হওয়া কৃষক ও কারিগরদের সামনে জীবনধারণের দুটি প্রশস্ত পথ খোলা রইল : খেতমজুরি ও চুরি ডাকাতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই এই খেতমজুর ও চোর—ডাকাতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জমিদাররা লাঠিয়াল ডাকাত পাঠিয়ে কৃষকদের উচ্ছেদ করতেন, আর সেই উচ্ছন্ন কৃষকরা মরিয়া হয়ে ডাকাতদের দল গঠন করে লুঠতরাজ করত। এইভাবে লুঠতরাজ দস্যুবৃত্তির দুষ্টচক্রে পড়ে বাংলা দেশে এক মারাত্মক ‘মাৎস্যন্যায়’—এর যুগ এল।১৮ ইংল্যান্ডের মতন এ দেশের এই ভবঘুরেদের ও দস্যুদের আইনের চাবুক মেরে কারখানার মজুর তৈরি করা হল না। চাবুকের চোটে তাদের পিঠ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল, ডান্ডাবেরির চাপে হাতে—পায়ে কড়া পড়ে গেল, কিন্তু কারখানার মজুর হওয়ার সুযোগ হল না সকলের। অধিকাংশই খেতমজুর হয়ে গ্রামেই রইল, শহরের দিকে এল না।
বাংলার নতুন শ্রেণিবিন্যাসের যুগে যাঁরা এইভাবে সমাজটাকে ভেঙেচুরে ফেললেন তাঁরা হলেন ব্রিটিশ পুঁজিপতি সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণি এবং তাঁদেরই প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন বাংলার বনেদি ও নতুন হঠাৎ—জমিদারশ্রেণি। বনেদি জমিদারদের মধ্যে একশ্রেণির জমিদারের বেসামাল হয়ে ভরাডুবি ও নির্বংশ হওয়া বাংলার সামাজিক ইতিহাসে অত্যন্ত নগণ্য ব্যাপার, আদৌ বৃহৎ ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হল, নতুন জমিদারশ্রেণির ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্ব, বহু উপস্বত্বভোগী খুদে জমিদারদের আবির্ভাব, গ্রাম কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে জমিদার ও উপজমিদারদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কচ্ছেদ। জমিদাররা হলেন রাজস্বের কন্ট্র্যাকটর এবং তাঁদের অধীনে থাকলেন অসংখ্য স্তরবিন্যস্ত সাব—কন্ট্র্যাকটর। জমিদাররা গ্রামের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে শহরের অট্টালিকায় এলেন, বুলবুলি হাফ—আখড়াইয়ের দল, শখের যাত্রাপার্টি, কবির লড়াই এবং মদ—মেয়েমানুষের জন্য অনর্গল অর্থব্যয় করতে লাগলেন :
পাড়াগেঁয়ে দুই একজন জমিদার প্রায় বারো মাস এখানেই কাটান…দেখলেই চেনা যায় যে ইনি একজন বনগাঁর শেয়াল রাজা, বুদ্ধিতে কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ—বিদ্যায় মূর্ত্তিমান মা! বিসর্জ্জন, বারোইয়রি, খ্যামটা নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত….
—কালীপ্রসন্ন সিংহ : হুতোম প্যাঁচার নকশা
অনেকে নতুন যুগের শিক্ষা ও শিল্পকলার ‘পেট্রন’ হয়ে ‘সম্ভ্রান্ত’ হবার চেষ্টা করলেন। তাঁদের সঞ্চিত ধন ‘শ্রমশিল্পের মূলধন’—এ পরিণত হল না, কারণ ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা সে সুযোগ তাঁদের দিলেন না। ব্যভিচার—বিলাসিতায় এবং বংশধরদের মামলা—মকদ্দমায় সঞ্চিত ধনক্ষয় হতে থাকল। আরও মর্মান্তিক ব্যাপার হল এই যে গ্রামের নিপীড়িত কৃষক কারিগরশ্রেণির অধিকাংশই সর্বস্বান্ত খেতমজুরশ্রেণি ও চোর—ডাকাতের দলে পরিণত হত এবং সামান্য অংশ শহরের নতুন কলকারখানা, রেল ও কয়লাখনির মজুর হল। গ্রামের খেতমজুর ও শহরের কারখানার মজুর সমাজের তলায় একই স্তরে এসে দাঁড়াল। গ্রামের নতুন পুঁজিপতি শ্রেণি (জমিদারশ্রেণি) এবং শহরের নতুন বুর্জোয়াশ্রেণির স্বার্থ এ দেশে মূলধন সঞ্চয়ের প্রাথমিক যুগে প্রায় অভিন্ন হয়ে গেল।
বাংলার বুর্জোয়াশ্রেণি
বাংলার বুর্জোয়াশ্রেণির ধারাবাহিক ইতিহাস লেখা সহজ নয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে ধীরে ধীরে বাংলার বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশ হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই বিকাশের ধারা রীতিমতো জটিল হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের অধীন উপনিবেশে শ্রমশিল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বণিক মুতসুদ্দি দালাল জমি ব্যবসায়ী থেকে শিল্পোদযোগী পুঁজিপতি পর্যন্ত ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশ হতে থাকে। বাংলা দেশে তথা সারা ভারতবর্ষে ঠিক এই ধারাতেই পুঁজিপতি শ্রেণি বা বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশ হয়েছে।* ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের আওতায় বাংলার বণিক মুতসুদ্দি দালাল ও শিল্পোদযোগী পুঁজিপতিরা ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াশ্রেণিতে পরিণত হন। নতুন যুগের এই বণিক মুতসুদ্দি ও শিল্পোদযোগীদের সঙ্গে আগেকার যুগের নাথজি—শেঠজিদের পার্থক্য আছে। সে বিষয়ে আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। নতুন যুগের শিল্পোদ্যম ও প্রতিযোগিতা বাধাবন্ধনহীন এবং শিল্প—বাণিজ্য হল যন্ত্রযুগের শ্রমশিল্প ও শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যেরই বাণিজ্য। তা ছাড়া নতুন যুগে শিল্পোদযোগীদের সামাজিক—রাষ্ট্রিক প্রাধান্য হল ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের আওতায় পরিপুষ্ট হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বর্ধিষ্ণু বুর্জোয়াশ্রেণির এই উদ্যম এবং তার চেয়েও বেশি আধিপত্য উল্লেখযোগ্য। বাংলার বুর্জোয়াশ্রেণির ক্রমবিকাশের ইতিহাস তাই এ দেশে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের শিল্প—বাণিজ্যক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের সনদ পেয়ে এ দেশে ‘এজেন্সি হাউস’ প্রতিষ্ঠা করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকেই এই এজেন্সি হাউসগুলি প্রধানত কলকাতায় গড়ে ওঠে। ব্যাবসাবাণিজ্য—ব্যাংকিং ইত্যাদি সংক্রান্ত সমস্ত কাজই তখন এই এজেন্সি হাউসগুলি করত। ১৭৯৭ সালের মধ্যেই কলকাতায় প্রায় ১৯টি এজেন্সি হাউস প্রতিষ্ঠিত হয় দেখা যায়।১৯
১৮০৫—০৬ সালেও ১৯টি এজেন্সি হাউসের নাম পাওয়া যায়, তার মধ্যে কয়েকটি নতুন নাম আছে :২০
আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোং টমাস হিগিনস অ্যান্ড কোং
ম্যাকিনটস, ফাল্টন অ্যান্ড কোং আর্কিবল্ড সিম্পসন অ্যান্ড কোং
এলেন ম্যাকলিন জি. ভ্রিগনন অ্যান্ড কোং
১৮০৭ সালে ১৮টি এজেন্সি হাউসের নাম দেখা যায়, তার মধ্যে ‘জোসেফ ব্যারোটা এন্ড কোং’ এবং ‘স্কট উইলসন অ্যান্ড কোং’ নাম দুটি নতুন। ১৮০৮ সালে ১৮টি এবং ১৮১০ সালে ২৭টি এজেন্সি হাউসের নাম পাওয়া যায়। এই নামগুলি পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করলে বোঝা যায়, অনেক কোম্পানির অংশীদারের নাম বদলেছে মাত্র।২১ এজেন্সি হাউসগুলির সাধারণত তিন—চারজন করে অংশীদার থাকত এবং সকলেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী। হাউসগুলির প্রতিষ্ঠার সময় অংশীদারদের নিজেদের কোনও মূলধন ছিল না, কোম্পানির কর্মচারীদের আমানত থেকে মূলধন সংগ্রহ করা হত। কোম্পানির কর্মচারীদের বাৎসরিক সঞ্চয় থেকে আমানত যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেত, এ দেশি ধনিক—বণিকরাও এইসব হাউসে গচ্ছিত রাখতেন।২২ এই এজেন্সি হাউসগুলির উৎপত্তি ও প্রতিপত্তি সম্বন্ধে টমাস ব্র্যাকেন ‘হাউস অফ কমন্সের সিলেক্ট কমিটি’র কাছে বলেন :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন উচ্চপদস্থ সিভিল ও মিলিটারি কর্মচারীরা চাকরি ছেড়ে ক্রমে ব্যাবসাবাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা দেখলেন যে কোম্পানির দাসত্ব করার চাইতে এই বণিগবৃত্তি অবলম্বন করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে তাঁরা টাকা গচ্ছিত পেলেন এবং মূলধন হিসাবে সেই টাকা ব্যাবসায় খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা সঞ্চয় করলেন। এইভাবে তাঁরা এক—একজন বেশ মোটা পুঁজি নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরলেন।২৩
এজেন্সি হাউসগুলি যে লভ্যাংশ দিত তা থেকেই অংশীদারদের মুনাফা সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা হতে পারে :২৪
পামার অ্যান্ড কোং ৩০%
জি. ম্যাকক্লিপ অ্যান্ড কোং ২৬%
আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোং ৬%
ফার্গুসন অ্যান্ড কোং ৩৬।।০%
ম্যাকিনটস অ্যান্ড কোং ১৪%
কলভিন অ্যান্ড কোং ২৪।।০%
এই এজেন্সি হাউসগুলিই যে ইংরেজ বণিকদের প্রাথমিক মূলধন সঞ্চয়ে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই হাউসগুলির মারফত তাঁরা এ দেশে রেশম নীল পাট তুলা ইত্যাদির ব্যাবসা করেছেন, প্রায় ১৮% থেকে ২০% পর্যন্ত সুদে দেশি—বিদেশি ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দিয়েছেন এবং তার ফলই তাঁরা ধীরে ধীরে ‘mercantile leviathans of the East’ হয়েছেন।২৫
১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটে বাণিজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার পর এজেন্সি হাউসগুলি প্রচণ্ড ধাক্কা খায় এবং তার ফলে অনেক হাউস উঠে যায় :
কলিকাতা নগরে অতি বৃহৎ এক বাণিজ্যের কুঠী শ্রীযুত আলেকজান্দ্র কোম্পানির কুঠী বন্ধ হয় এবং তদ্দ্বারা লোকেরদের অপূর্ব ভয় ও ক্লেশ জন্মে।
—সমাচার দর্পণ, ১২ ডিসেম্বর, ১৮৩২
কার্গিসন কোম্পানির কুঠি দেউলিয়া হয়। (সমাচার দর্পণ, ২৫ নভেম্বর ১৮৩৩) পামার কোম্পানি, ফার্গুসন কোম্পানি, আলেকজান্ডার কোম্পানি প্রভৃতি কয়েকটি বড় বড় এজেন্সি হাউস এই সময় দেউলিয়া হয়ে যায়। ক্রফোর্ড বলেছেন, ১৮১৩ সালে কোম্পানির একচেটে বাণিজ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে যখন ইংরেজ বণিকদের অবাধ বাণিজ্যের স্বাধীনতা দেওয়া হল, তখন এজেন্সি হাউসগুলি বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় অনেকেই টিকতে পারল না। নতুন নতুন কোম্পানি ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান এ দেশে গড়ে উঠল।২৬ অর্থাৎ বণিকতন্ত্রের অবসানের পর ধনতন্ত্রের যুগে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা যখন মুনাফার সন্ধানে বহির্মুখী হলেন তখন এ দেশে অনেক বড় বড় ব্রিটিশ কোম্পানি ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। ১৮৫৮ সালে কলকাতার যে কয়েকটি বড় বড় ব্রিটিশ কোম্পানির নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রধান হল :২৭
ব্যালি ব্রাদার্স বেগ ডানলপ অ্যান্ড কোং
ম্যালকম অ্যান্ড কোং মার্টিন পিলারস অ্যান্ড কোং
জে. মরিসন অ্যান্ড কোং টার্নার, ক্যাডোগান অ্যান্ড কোং
জার্ডাইন স্কিনার অ্যান্ড কোং কেলি অ্যান্ড কোং…ইত্যাদি
এই কোম্পানিগুলির প্রতিষ্ঠা ১৮১৩ সালের পরে হয়েছে বলে মনে হয় এবং ‘টার্নার মরিসন’, ‘মার্টিন কোং’ ইত্যাদি নাম দেখে বোঝা যায় পরবর্তীকালে অংশীদার বদল হয়েছে।* বর্তমানের ‘ম্যানেজিং’ এজেন্সি প্রথা এই ধারারই পরিণতি।
এ দেশের উদযোগী ব্যবসায়ীরা প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ‘এজেন্সি হাউস’গুলির দেওয়ানি ও মুতসুদ্দিগিরি করতেন এবং পরবর্তীকালে বড় বড় ব্রিটিশ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের বেনিয়ান ও এজেন্ট নিযুক্ত হতেন। এই দেওয়ানি দালালি বেনিয়ানগিরির ও এজেন্টের কাজে তাঁরা প্রভূত ধনসঞ্চয় করেছেন।
পূর্ব্বে যে সকল দেওয়ান মুৎসুদ্দি লোক ছিলেন তাঁহারা ইংরেজী বিদ্যাভ্যাস করিয়া সাহেব লোকের অভিপ্রায় মত কর্ম্ম সুসম্পন্ন পূর্ব্বক বহু ধনোপার্জ্জন করিয়াছিলেন ইহাতে ইংরেজরা তুষ্ট হইয়া তাঁহাদিগকে নানাপ্রকার মর্য্যাদা প্রদান করিয়োছেন।
—সমাচার চন্দ্রিকা, ২ মে ১৮৩১
তখন নিমক মহলের দেওয়ানী লইলেই লোকে দুই দিনে ধনী হইয়া উঠিত। এই রূপে সহরের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ধনী হইয়াছেন।
—শিবনাথ শাস্ত্রী । রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, ৬৮ পৃঃ
ধন্য ধন্য ধার্ম্মিক ধর্ম্মাবতার ধর্ম্মপ্রবর্ত্তক দুষ্টনিবারক সৎ প্রজাপালন সদ্বিবেচক ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া…বেতনোপভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের খাটের ঘাটের মাঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচুরি পোদ্দারী করিয়া অথবা…কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন বহুতর দিবসাবসানে অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন…
—ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘নববাবুবিলাস’
কোম্পানির বাংলা দখলের কিছু পরে, নন্দকুমারের ফাঁসি হবার কিছু পূর্ব্বে আমাদের বাবুর প্রপিতামহ নিমকের দাওয়ান ছিলেন, সেকালে নিমকীর দাওয়ানিতে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় ছিল; সুতরাং বাবুর প্রপিতামহ পাঁচ বৎসর কর্ম্ম করে মৃত্যুকালে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা রেখে যান—সেই অবধি বাবুরা বনেদী বড় মানুষ হয়ে পড়েন।
—কালীপ্রসন্ন সিংহ : হুতোম প্যাঁচার নকশা
১৮০৫—০৬ সালের কলকাতার ‘বার্ষিক ডিরেক্টরি ও অ্যালম্যানাক’—এ এ দেশীয় বণিক, দালাল ও শ্রফদের একটা নামের তালিকা পাওয়া যায়, তার মধ্যে দালাল ও শ্রফদের নামগুলি এই :
লক্ষ্মীকান্ত বড়াল স্বরূপচাঁদ শীল
দত্তরাম দত্ত জগমোহন শীল
রামমোহন পাল আনন্দমোহন শীল
মথুরামোহন সেন স্বরূপচাঁদ আঢ্য
নিত্যচরণ সেন কানাইলাল বড়াল
রামসুন্দর পাইন সনাতন শীল
এর মধ্যে দেখা যায়, সকলেই প্রায় সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের। ১৮১০ সাল পর্যন্ত এই তালিকার মধ্যে দু—একটি নতুন নাম যুক্ত হওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনও পরিবর্তন দেখা যায় না। এখানে বাংলার বণিকদের মধ্যে সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের উদ্যম বিশেষ লক্ষণীয়। ১৮৫৮ সালে বাঙালি পরিচালিত কয়েকটি বড় বড় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায় :২৮
এছাড়া প্রায় ৬৫ জন বেনিয়ানের নাম পাওয়া যায়, তার মধ্যে বড় বড় কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করছি :
সুবর্ণবণিক সম্প্রদায় ছাড়াও সকল সম্প্রদায়ের বাঙালি যে নিজেরা ব্যবসায়ে উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন তা এইসব নামের তালিকা থেকে বুঝতে পারা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালিদের বিরুদ্ধে শিল্পোদ্যমের অভাব সম্বন্ধে যে অভিযোগ সাধারণত করা হয়ে থাকে তা ভিত্তিহীন। মাড়োয়াড় থেকে এ দেশে এসে জগৎ শেঠ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন এবং তাঁরই অর্থসাহায্যে নবাবরা ও ইংরেজরা অনেক সংকট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সত্য।২৯ কিন্তু বাংলার লক্ষ্মীকান্ত ধর ওরফে নকুড় ধর, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামহরি বিশ্বাস, সুখময় রায়, রামচরণ রায়, রাজা নবকৃষ্ণ প্রমুখ ব্যক্তিদের আর্থিক প্রতিপত্তি ও বাণিজ্যিক উৎসাহ জগৎ শেঠ অমিচাঁদের তুলনায় তাঁদের কালে কম ছিল না।
নকুড় ধর নামেই লক্ষ্মীকান্ত ধর পরিচিত ছিলেন। নকুড় ধরের অর্থসাহায্যের জন্য ইংরেজরা অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। মুর্শিদাবাদের নবাবদের কাছে জগৎ শেঠ যা ছিলেন, ইংরেজদের কাছে রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক যুগে নকুড় ধরও তা—ই ছিলেন। তাঁর কোনও পুত্রসন্তান ছিল না, তাই সে সময় তাঁর বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন তাঁর কন্যার একমাত্র জীবিত পুত্র সুখময় রায়। স্যার ইলাইজা ইম্পের দেওয়ানি করে সুখময় প্রভূত পরিমাণে সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। লর্ড মিন্টোর আমলে তিনি ‘রাজা’ উপাধি পান। সুখময় ‘ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল’—এর একমাত্র বাঙালি ডিরেক্টর ছিলেন। মতিলাল শীল সামান্য বোতল ও কর্কের ব্যাবসা থেকে শুরু করে পরে নানারকম ব্যাবসাবাণিজ্যে প্রচুর ধনসঞ্চয় করেন। তখনকার ৫০—৬০টি বাণিজ্যকুঠির মধ্যে প্রায় ২০টি কুঠির বেনিয়ান ছিলেন মতিলাল। বেনিয়ানগিরি ছাড়াও তিনি জমির ব্যাবসা করতেন। তাঁর মতন প্রতিপত্তিশালী জমির মালিক তখন আর কেউ শহরে ছিলেন কি না সন্দেহ। জমিজমা থেকে মতিলাল মাসিক প্রায় ৩০,০০০ টাকা খাজনা পেতেন। অনেক বিদেশি ‘এজেন্সি হাউস’—এর অংশীদার হয়ে তিনি ব্যবসা করেন, তার মধ্যে ‘ফার্গুসন ব্রাদারস অ্যান্ড কোং’, ‘ওজওয়াড শীল অ্যান্ড কোং’, ‘টলো অ্যান্ড কোং’ ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি আটার কলেরও মালিক ছিলেন মতিলাল এবং এ দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পর্যন্ত বিস্কুট চালান দিতেন। বিশ্বম্ভর সেন মাত্র ৮।১০ নিয়ে ব্যাবসাক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, পরে প্রায় ২০টি বাণিজ্যকুঠির বেনিয়ান হন এবং মৃত্যুকালে ২ লক্ষ পাউন্ড গচ্ছিত রেখে যান।৩০ রাজা নবকৃষ্ণ মিরজাফরের নবাব হবার সময় লর্ড ক্লাইভের দেওয়ানি করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। রামচরণ রায় গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট ও জেনারেল স্মিথের দেওয়ানি করে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হন। বহু বিস্তৃত সমৃদ্ধিশালী ঠাকুর পরিবারের প্রধান শাখার আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুর হুইলার সাহেবের দেওয়ানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। রামদুলাল দে বোধহয় তাঁর সমসাময়িককালে কলিকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন। বাণিজ্যসূত্রেই রামদুলাল ধনী হন। ইনি বহুদিন ফেয়ারলি কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন এবং আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর কারবারও ছিল। ভুলুয়া চট্টগ্রামের লবণের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ানি করে রামহরি বিশ্বাস প্রভূত সম্পত্তি লাভ করেন এবং তাঁরপুত্র প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস ও জগমোহন বিশ্বাস এই সম্পত্তি আরও বৃদ্ধি করেন। গোবিন্দরাম মিত্র কলকাতার জমিদারি কাছারির দেওয়ান ছিলেন এবং ব্যবসায়ে যথেষ্ট বিত্তলাভ করেন। গোকুলচন্দ্র মিত্র রসদের ঠিকাদারি করে সমৃদ্ধিলাভ করেন। পামার কোম্পানির খাজাঞ্চি গঙ্গানারায়ণ সরকার কলকাতার একজন বিশিষ্ট ধনী ছিলেন, কেবল ব্যবসায়ের দ্বারাই তিনি বিত্তলাভ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরীর অবস্থা গোড়াতে মোটেই ভালো ছিল না, কিন্তু পরে লবণের ব্যবসায়ে তিনি অতুল ঐশ্বর্যলাভ করেন। মথুরামোহন সেন শ্রফের ব্যবসায়ে বহু অর্থ উপার্জন করেন। শিবনারায়ণ ঘোষ ও তাঁর দুই ভাই, রামলোচন ঘোষের পুত্রও বিশাল সম্পত্তির মালিক। রামমোহন হেস্টিংসের সরকার ছিলেন। বৈষ্ণবদাস মল্লিক এবং নীলমণি মল্লিক অত্যন্ত ধনী ছিলেন, এঁদের সম্পত্তি রামকৃষ্ণ মল্লিকের ব্যবসায়ে লব্ধ।৩১
মতিলাল শীল, বিশ্বম্ভর সেন, রামদুলাল দে, রাধাকৃষ্ণ বসাক, রামকৃষ্ণ মল্লিক প্রভৃতির মধ্যে যে শিল্পোদ্যোগ দেখা গেছে তা যে নিশ্চয়ই যুগবৈশিষ্ট্য তা স্বীকার করতেই হবে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিচিত্র কর্মজীবনের মধ্যে নতুন যুগের এই সাহস উদ্যম ও তৎপরতা আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।* দ্বারকানাথ ঠাকুর নীল ও রেশমের রপ্তানির কাজ করেন, নিমকের এজেন্ট প্লাউডেন সাহেবের দেওয়ানি পদে প্রতিষ্ঠিত হন। অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর ধনসঞ্চয় করে দ্বারকানাথ স্বাধীন বণিগবৃত্তি অবলম্বন করে ‘টেগোর অ্যান্ড কোং’ নামে এক কোম্পানি স্থাপন করেন এবং ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’—এর প্রধান কর্মকর্তা হন। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পত্রিকায় দ্বারকানাথের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা থেকেই তাঁর কর্মবহুল জীবনের বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে :৩২
স্বাধীন শিল্পোদ্যমের আদর্শ দ্বারকানাথ তাঁর দেশবাসীর কাছে উজ্জ্বল করে তুলে ধরেছিলেন। দ্বারকানাথ তাঁর জমিদারির প্রায় সর্বত্রই নীলের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উদ্যোগী হয়ে বাইরের দেশের মতন এ দেশে তিনি চিনি উৎপাদনের নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। জমিদার, প্লান্টার এবং উদযোগী ব্যবসায়ী হিসাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ প্রতিপত্তি ছিল, কলকাতার প্রত্যেক ধনী ব্যবসায়ী এবং গভর্নমেন্টের নানা বিভাগের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁর এই প্রতিপত্তির জন্যই তিনি ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে তার একমাত্র মালিকও হন।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বাঙালি কমপ্র্যাডোর বুর্জোয়াশ্রেণির যে নিশ্চিন্ত বিকাশ শুরু হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই বিকাশ মন্দগতিতে অসমতল পথে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ প্রথমত, এ দেশে ব্রিটিশের উপনিবেশ, দ্বিতীয়ত, ঊনবিংশ শতাব্দী হল সামন্তযুগ থেকে ধনতান্ত্রিক যুগে পদার্পণের সন্ধিক্ষণের যুগ। উপনিবেশ বলে ব্রিটিশ বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষে এ দেশের বুর্জোয়াশ্রেণিকে স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ দেওয়া কদাচ সম্ভব নয়। স্বার্থসচেতন ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা এ দেশের শিল্পোদযোগী ব্যবসায়ীদের তাই বাণিজ্যের অথবা সেই সঞ্চিত মূলধন শ্রমশিল্পের ক্ষেত্রে নিযুক্ত করার অবাধ স্বাধীনতা দেননি। কিন্তু স্বার্থের খাতিরেই এ দেশের নতুন জমিদারশ্রেণির ও উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির আনুগত্য তাঁদের একান্ত প্রয়োজন ছিল। তাই এ দেশের বণিক ও উদ্যোগী ব্যক্তিদের বাধ্য হয়ে তাঁদের বেনিয়ান মুৎসুদ্দি দেওয়ান এজেন্ট, এমনকী ব্যবসায়ের অংশীদার পর্যন্ত করতে হয়েছে। তেমনি, রাজভক্তির ছায়ায় ভিন্ন এ দেশের বণিকদের প্রাথমিক মূলধন সঞ্চয়ের কোনও সুযোগও ছিল না। তাই এ সময় রাজানুগত্য এ দেশীয় প্রত্যেক প্রভাবশালী ব্যক্তির অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল দেখা যায়। রাজানুগ্রহের ছায়াতলে, ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের পার্শ্বচর ও অনুচর হয়ে এ দেশের বুর্জোয়াশ্রেণির বাল্যকাল কেটেছে।*
সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতান্ত্রিক যুগে পদার্পণের সন্ধিক্ষণকে মার্কস প্রাথমিক মূলধন সঞ্চয়ের যুগ বলেছেন। এ যুগে ধনতান্ত্রিক যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি নিশ্চয়ই সব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে না। সামন্তযুগের উত্তরাধিকার বহন করে, সামন্তযুগের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, সন্ধিক্ষণের যুগের ব্যবসায়ীদের পুরাতন ও নতুন প্রথার ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়েই অগ্রসর হতে হয়। জমিদারি কেনাবেচা করে, ব্যাবসাবাণিজ্য দালালি দেওয়ানি এজেন্সি করে, যেভাবেই ধনসঞ্চয় করা হোক—না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা না—হওয়া পর্যন্ত উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষে সেই সঞ্চিত মূলধন শ্রমশিল্পক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে নিযুক্ত করা সম্ভব নয় এবং তা না করতে পারলে, ধনতান্ত্রিক যুগের পরিপূর্ণ বিকাশও হতে পারে না।৩৩ এদেশের উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির এই চেতনা থেকেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষকালে জাতীয় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, চেতনার তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্দোলনের পর্বান্তর হয় এবং বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগে পরিণতি লাভ করে। যদি বলা যায়, প্রথম যুগের সঞ্চিত মূলধন নিয়োগের পরিপূর্ণ সুযোগ আমাদের দেশে এখন এসেছে, তাহলে বোধহয় ভুল হয় না। এ দেশের ‘মূলধন’ শ্রমশিল্পবিমুখ, এ কথা জোর করে বলার অধিকার এর আগে আমাদের ছিল না। আজ তার শিল্পবিমুখতা ও শিল্প প্রচেষ্টা পরীক্ষা করার সময় এসেছে।
সুতরাং বাংলার বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে নিশ্চিত শুরু হয়েছে বলা যায় এবং সে যুগকে আমরা নিঃসংশয়ে উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির প্রাথমিক মূলধন সঞ্চয়ের যুগ বলতে পারি। শিল্প—বাণিজ্যক্ষেত্রে যেমন যথাসম্ভব যুগোপযোগ উদ্যম সাহস ও কর্মতৎপরতার পরিচয় তাঁরা দিয়েছেন, তেমনি তাঁরা আবার বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগৃতি আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ইতিহাসের ধারা সচল রেখেছেন।
বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি
নতুন খেতমজুরশ্রেণি, জমিদারশ্রেণি, কারখানার মজুরশ্রেণি ও উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির সঙ্গে বাংলার নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আবির্ভাব ঊনবিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে আলোচনা করার আগে সাধারণভাবে এই শ্রেণির সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। এই শ্রেণির কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞার্থ দেওয়া কঠিন। ব্রিটিশ মধ্যশ্রেণির ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে গ্রেটেন সাহেব বলেছেন, সমাজের সেই শ্রেণিকেই আমরা মধ্যশ্রেণি বলতে পারি, মুদ্রাই যাদের জীবনের প্রধান নিয়ামক এবং মুদ্রাই যাদের জীবনের প্রাথমিক উপাদান। এর ভিতর থেকে জমিদার ও কৃষকদের তিনি বাদ দিয়েছেন, কারণ ভূসম্পত্তি ও জমিজমাই তাদের জীবনের প্রধান অবলম্বন, মুদ্রা নয়। ধনিক শিল্পপতি, বণিক, শিক্ষিত চাকুরিজীবী ইত্যাদি যাদের জীবনের সঙ্গে মুদ্রার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, মুদ্রাই যাদের মূলমন্ত্র, যাদের কাছে ন্যায়—অন্যায় প্রভাব—প্রতিপত্তি বিচারের একমাত্র মানদণ্ড মুদ্রা, যাদের জীবনসর্বস্ব মুদ্রা, তারাই হল মধ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।৩৪ গতিশীল মুদ্রা যাদের শ্রেণিমর্যাদা পদমর্যাদা সফলতা—বিফলতা, এমনকী মনুষ্যত্ববোধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে, গ্রেটেন সাহেবের মতে তারাই হল ‘মধ্যশ্রেণি’। আর ‘বুদ্ধিজীবী’ বা ‘ইন্টেলিজেনসিয়া’ বলতে আমরা আজকাল যাদের বুঝি তাদের নামকরণ বোধহয় সর্বপ্রথম জারের রুশিয়াতেই হয়।৩৫ কিন্তু মধ্যবিত্তশ্রেণির সঙ্গে বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে পৃথক করে বিচার করা যুক্তিহীন। সমাজের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদেরই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলা হয়। এই শ্রেণিস্বাতন্ত্র্যের মধ্যে বুদ্ধি ও শিক্ষার অস্বাভাবিক দম্ভ প্রকাশ পায়, যদিও সে দম্ভ ধনতান্ত্রিক সমাজে একেবারেই ফাঁকা। বুদ্ধি শিক্ষা প্রতিভা সবই ধনতান্ত্রিক সমাজে মায়াবিনী মুদ্রার মুখাপেক্ষী এবং সকলেই মুদ্রার একান্ত অনুগত গোলাম। সুতরাং মধ্যশ্রেণির মধ্যে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আর—একটি উপশ্রেণি তৈরি করার কোনও যুক্তি আছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া মুদ্রা যখন নতুন গোত্রান্তরিত জমিদারশ্রেণি, বুর্জোয়াশ্রেণি এমনকী মজুর ও খেতমজুরশ্রেণির জীবনেরও প্রধান অবলম্বন, সর্বক্ষেত্রে মুদ্রাপ্রাধান্য যখন নতুন যুগের বৈশিষ্ট্য, তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে স্বতন্ত্রভাবে মুদ্রার মাপকাঠিতে বিচার করাও অর্থহীন। এখানে আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে একশ্রেণিভুক্ত হিসাবে বিচার করব। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ‘গঠন’ পরিবর্তনশীল। নতুন যুগের সকল শ্রেণির বৈশিষ্ট্য যদিও পরিবর্তনশীলতা, তাহলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য অন্যতম।
নতুন যুগের এই পরিবর্তনশীল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী? ইয়োরোপে যন্ত্রশিল্পের প্রসারের যুগে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে প্রায় প্রত্যেক অর্থনীতিবিদের রচনায় উল্লেখ আছে। এব্রাম কুমব, জন গ্রে, উইলিয়াম টমসন, জন মর্গান, জে. এফ. ব্রে. র্যাভেনস্টোন, টমাস হজস্কিন প্রভৃতি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। হজস্কিন বলেছেন :
‘দাস বা অর্ধদাস যারা তারাও একসময় তাদের দাসত্বশৃঙ্খল ছিন্ন করেছিল…সম্পত্তির উপর তাদের ন্যায্য দাবি তাদের প্রভুরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণিরও বিকাশ হয়েছে, জমিদারশ্রেণির কাছ থেকে তারাও তাদের সম্পত্তির অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সমগ্র ইউরোপব্যাপী বিরাট এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হয়েছে যারা মজুরি ও মুনাফা সংক্রান্ত সব রকমের আইনকানুনের বশ্যতামুক্ত হয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন। তাদের চরিত্রে পুঁজিপতি শ্রেণি ও মজুরশ্রেণির বৈশিষ্ট্যগুলির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ দেখা যায়। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, অত্যন্ত আশার কথা। যন্ত্রের যত উন্নতি ও প্রসার হবে তত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির কদর বাড়বে, সংখ্যাবৃদ্ধি হবে এবং সমাজকে এই মধ্যবিত্তরাই শেষ পর্যন্ত দাসত্ব ও অত্যাচারের কবল থেকে মুক্ত করবে।’
তারপর আরও পরিষ্কার করে হজস্কিন বলেছেন :
মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমনই এক শ্রেণি যারা অল্প মেহনত করে এবং যন্ত্রযুগের প্রসারের তালে তালে যারা এমনই একটা স্থান সমাজে দখল করে নেয় যেখানে তাদের ধনিক ও মজুর দুইই মনে হয়। সাধারণ মজুরশ্রেণির মতন তারা কেনা গোলামি করে না, কিন্তু মেহনত না করেও তাদের নিস্তার নেই। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপরেই আমার আশাভরসা সবচেয়ে বেশি। গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশ্চর্য বিস্তার হয়েছে। নতুন যন্ত্রপাতি ও নতুন বৃত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের আরও দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি হবে এবং গোলাম মজুরশ্রেণি ও সুদখোর মুনাফাখোর নিষ্কর্মা ধনিকশ্রেণির অস্তিত্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সমাজের বুক থেকে মুছে ফেলে দেবে।৩৬
বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির স্বরূপ বিশ্লেষণে হজস্কিন বাস্তব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির পরিচয় দেননি। সেইজন্য মুনাফালোভী পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে অনেক বিষোদগার করেও শেষ পর্যন্ত তিনি হতাশ হয়ে সমাজে উচ্চশ্রেণির অস্তিত্বের আবশ্যকতা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যা—ই হোক, নতুন ধনতান্ত্রিক সমাজ যন্ত্রশিল্পের প্রসারের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ও প্রভাববৃদ্ধির কথা তিনি অনেকটা পরিষ্কার করে বলেছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে হজস্কিন যা বলেছেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রে পুঁজিপতি শ্রেণি ও মজুরশ্রেণির বৈশিষ্ট্যগুলির অদ্ভুত সংমিশ্রণ দেখা যায়। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী চার্লস বুথ লন্ডনের সকল শ্রেণির লোকের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে গবেষণা করে তা প্রমাণ করেছেন :৩৭
আর্থিক দিক দিয়ে বিচার করলে কেরানিদের অবস্থা আর কারিগর ও মজুরদের অবস্থা একই বলা যায়। কেরানিরা বছরে ২৫ পাউন্ড থেকে ১৫০ পাউন্ড পর্যন্ত উপার্জন করে, আর মজুরেরা করে সপ্তাহে ৩০।৪০।৫০।৬০ শিলিং পর্যন্ত।
কিন্তু কেরানি ও মজুরদের আর্থিক অবস্থা এক হলে কী হবে? এহেন কেরানি জীবনেরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বুথ বলেছেন :৩৮
কেরানিরা সকলে মেলামেশা করে কেরানিদের সঙ্গে, আর মজুররা করে মজুরদের সঙ্গে। উভয় শ্রেণির মধ্যে সামাজিক মেলামেশার প্রচলন নেই বললেই হয়। মজুরদের জীবনযাত্রা আর কেরানিদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ পৃথক। কেরানিদের স্ত্রীদের পর্যন্ত মেজাজ অন্যরকম। কেরানিদের চিন্তাধারা আদর্শ সবই স্বতন্ত্র, মজুরদের সঙ্গে মিল নেই কোথাও।
মধ্যবিত্তশ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে হজস্কিনের বিশ্লেষণ এবং বুথের দৃষ্টান্ত সমস্ত দেশের মধ্যবিত্ত জীবনে প্রযোজ্য। কিন্তু তাহলেও ধনতান্ত্রিক যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির প্রধান সহায় ও অনুচর হিসাবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঐতিহাসিক গতিশীল ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। এই কথা মনে রেখে আমরা বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বিকাশের ধারা সম্বন্ধে আলোচনা করব। আগেই বলেছি, এই দুই শ্রেণি—উপশ্রেণির কোনও স্বাতন্ত্র্য আমরা স্বীকার করব না। সাধারণভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিদ্যা—বুদ্ধিজীবী শ্রেণি হিসাবেই এ মধ্যবিত্তদের বিচার করব।
বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আবির্ভাব হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এই শ্রেণির প্রভাব ও সংখ্যাবৃদ্ধি হয় ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে।* ইংরেজ আমলের গোড়া থেকেই আধুনিক শিক্ষার প্রচলন হয়নি, কারণ যতটা শাসকদের প্রয়োজনে এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে, সাধারণের স্বার্থের খাতিরে ততটা হয়নি। প্রথম যুগে ইংরেজ শাসকদের এ দেশীয় পণ্ডিত মুনশি মৌলবিদের প্রয়োজন ছিল শাসনকার্যের সুবিধার জন্য। তাই প্রথম যুগে সামান্য ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনের সঙ্গে তাঁরা এ দেশীয় প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাই চালু রেখেছিলেন।
…কথিত আছে ঢেঁকি—যন্ত্রের বিবরণ কোনো মুৎসুদ্দি ইংরাজী ভাষায় তরজমা করিয়াছিলেন টুমেন ধাপুড় ধুপুড় ওয়ান মেন সেঁকে দেয়, ইত্যাদি হইতে পারে ইংরেজদিগের প্রথমাধিকার সময়ে তদ্ভাষায় বহুতর লোক সুশিক্ষিত হইতে পারেন নাই কিন্তু ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক যে তাঁহারা ক্ষমতাসম্পন্ন লোক ছিলেন এবং কর্ম্ম উত্তমরূপে নির্ব্বাহ করিয়াছেন। অপর তৎপর দ্বিতীয় শ্রেণীতে গণ্য যে সকল মুৎসুদ্দি হইলেন তাঁহারদিগের মধ্যে অনেকেই ইংরাজী বিদ্যায় বিলক্ষণ পারগ ইহা দেশবিখ্যাত আছে… (সমাচার চন্দ্রিকা, ২ মে ১৮৩১)
পরবর্তী যুগে পাশ্চাত্য বিদ্যাশিক্ষার প্রচলন হয়, হাইস্কুল, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, ল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা হয়। তৃতীয় যুগে শিক্ষাব্যবস্থা সর্বসাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। উচ্চসম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারই ছিল প্রথম দুই পর্বে গভর্নমেন্ট ও দেশীয় সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তিদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত এই শিক্ষানীতিই অনুসৃত হয়। তারপর আধুনিক শিক্ষা ও শিক্ষার প্রচলন ধীরে ধীরে হতে থাকে। তাই আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলতে আমরা যাদের বুঝি সেই শ্রেণির বিকাশ হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। হান্টার সাহেবের হিসাবে চব্বিশ পরগনা ও কলকাতায় (১৮৭০—৭৩ সালে) এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের বিকাশ সম্বন্ধে যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা রীতিমতো কৌতূহলোদ্দীপক।৩৯ যেমন :
হান্টার সাহেবের এই গণনার মধ্যে যে যথেষ্ট গলদ আছে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। গলদ থাকাও স্বভাবিক, কারণ সকলের বৃত্তিপরিচয় সঠিকভাবে এর মধ্যে দেওয়া হয়নি। ১৮৭০—৭৩ সালে ব্যারিস্টারের সংখ্যা ২৬ জন হতে পারে, কিন্তু কলেজ বা স্কুল থেকে পাশ করা ডাক্তারের সংখ্যা নিশ্চয়ই ৬৬৭ জন হতে পারে না। এরকম ত্রুটি উক্ত সংখ্যাগণনায় যথেষ্ট আছে (যেমন উকিল অ্যাটর্নি ডাক্তার ইত্যাদির সংখ্যা)। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষক অধ্যাপক কেরানি ইত্যাদির সংখ্যাবৃদ্ধি থেকে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ধারা খানিকটা বোঝা যায়। ১৮৮১ ও ১৮৯১ সালের কলকাতা শহর ও শহরতলির সেন্সাস রিপোর্ট থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশের ধারা সম্বন্ধে আরও স্পষ্ট ধারণা হয় : ৪০
সেন্সাস রিপোর্টে প্রথমে যেভাবে বৃত্তিবিভাগ করা হয়েছে, ‘পরে সেভাবে করা হয়নি। তা না হলেও, হান্টার সাহেবের হিসাব এবং ১৮৮১ ও ১৮৯১ সালের কলকাতা শহর ও শহরতলির সেন্সাস রিপোর্ট থেকে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ধারা সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়। কেরানিদের সংখ্যাবৃদ্ধি যে হারে হয়েছে, বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের অর্থাৎ ব্যারিস্টার উকিল মোক্তার শিক্ষক—অধ্যাপক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদির সংখ্যাবৃদ্ধি সে হারে হয়নি। না—হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ ইংরেজদের শাসনযন্ত্র পরিচালনার জন্য কেরানিদের প্রয়োজন ছিল বেশি। কেরানিদের সঙ্গে খুদে দোকানদার, খুচরো ব্যবসায়ী আর উকিল—মোক্তারদের সংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষক—অধ্যাপকের সংখ্যাও শেষের দিকে কিছু বেড়েছে, কিন্তু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যা বাড়েনি। তার প্রধান কারণ, যন্ত্রশিল্পের প্রসার অত্যন্ত মন্দগতিতে হয়েছে বলে টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বিস্তার হয়নি এবং টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যাও সেইজন্য নগণ্য। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে কেরানিদের সংখ্যাধিক্য ইংরেজ আমলের গোড়া থেকেই দেখা যায় এবং বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সে বৈশিষ্ট্য আজও অনেকটা অক্ষুণ্ণ আছে।
বাঙালি মধ্যবিত্তের হিন্দু প্রাধান্যের কারণ
এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দু প্রাধান্যের কারণ কী? এর উত্তর বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক ইতিহাসের মধ্যেই পাওয়া যায়। সেই ইতিহাস আলোচনা করার আগে হিন্দু মধ্যবিত্তের তুলনায় মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ কীভাবে হয়েছে তা জানা দরকার। হান্টার সাহেবের হিসাবে ১৮৭১ সালে (এপ্রিল মাসে) বাংলা দেশের হিন্দু—মুসলমান সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যা হল :
১৮৯৬ সালে হান্টার সাহেব সরকারি কাজে নিযুক্ত বাংলার হিন্দু—মুসলমান বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের যে হিসাব দিয়েছেন তাতে দেখা যায় :৪১
এই হিসাব থেকে সরকারি কাজে নিযুক্ত বাংলার শিক্ষিত হিন্দু—মুসলমান মধ্যবিত্ত ও বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ১৮৮১ সালের কলকাতার সেন্সাস রিপোর্টের সাধারণ হিসাবেও দেখা যায়, হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা নগণ্য :
বাংলার উচ্চপদস্থ হিন্দু—মুসলমান সরকারি কর্মচারী, ডাক্তার ব্যারিস্টার উকিল মোক্তার শিক্ষক অধ্যাপক ইত্যাদির সংখ্যার যে হিসাব উপরে দেওয়া হল তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, গুরুদায়িত্বপূর্ণ সরকারি বিভাগগুলিতে মুসলমান কর্মচারী তো নেইই, হিন্দুদের সংখ্যাও নগণ্য। এইসব বিভাগের মোট বেতনের চাকরিগুলি ইংরেজদেরই একচেটে। ১৮৭১ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিস ও বিচার বিভাগে একটিও হিন্দু বা মুসলানকে দেখা যায় না এবং সহকারী কমিশনার, গেজেটেড পুলিশ অফিসার এবং ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসা জনশিক্ষা কাস্টমস নৌ জরিপ আফিম ইত্যাদি বিভাগের অফিসারদের মধ্যে প্রায় সকলেই ইংরেজ, দু—চার—দশজন মাত্র হিন্দু। উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসার তখনও যে বিশেষভাবে হয়নি তা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। তা ছাড়া লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ইংরেজদের শাসননীতি ও শিক্ষানীতির বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের শুরুতে পর্যন্ত হয়নি। শিক্ষিত হিন্দুদের প্রতি ইংরেজদের যে বিশেষ কোনও সহানুভূতি বা দরদ ছিল না তা মনে হয় না। এমনকী, উচ্চশিক্ষিত হিন্দুদের রাজানুগত্যের প্রতি ইংরেজদের যথেষ্ট আস্থা ছিল। তা সত্ত্বেও ১৮৭১ সাল পর্যন্ত দেখা যায় ২৬০ জনই ইংরেজ সিভিলিয়ান, বিচার বিভাগের ৪৭ জনই ইংরেজ, ১০০ জন গেজেটেড পুলিশ অফিসারেরর মধ্যে মাত্র ৩ জন হিন্দু। এগুলি তো মোটামুটি শাসন বিভাগ। জনশিক্ষা বিভাগেও দেখা যায়, ৫৩ জন অফিসারের মধ্যে ৩৮ জন ইংরেজ। তারপর হল শোষণ বিভাগ এবং এই বিভাগের মধ্যে কাস্টমস নৌ জরিপ আফিম ইত্যাদি প্রধান। কাস্টমস নৌ জরিপ আফিম ইত্যাদি বিভাগের ৪২২ জন অফিসারের মধ্যে ১০ জন মাত্র হিন্দু এবং বাকি সব ইংরেজ। এ দেশের শিক্ষিত হিন্দু বা মুসলমান কোনও সম্প্রদায়কেই ইংরেজ শাসকরা দায়িত্বশীল কাজকর্মে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন না এবং তাঁদের সমান মর্যাদাও দিতে চাইতেন না। বাংলার হিন্দু ও মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক প্রভাব—প্রতিপত্তি বিচার প্রসঙ্গে আমাদের এই কথা মনে রাখা দরকার।
শিক্ষিত হিন্দু—মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের এই মনোভাবের যে মূলনীতি তার কোনও পরিবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীতে হয়নি, সাময়িক সাম্রাজ্যবাদী কারসাজির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। শাসন ও শোষণের মূলনীতি কার্যকর করার প্রধান সাম্রাজ্যবাদী কূটকৌশল হল, হিন্দু—মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষভাব জাগিয়ে তোলা। কখনো হিন্দু, কখনো মুসলমানের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এ দেশে তাদের শোষণব্যবস্থা কায়েম করেছে। আজ পর্যন্ত আমরা সেই বহু পুরাতন ব্রিটিশ কূটকৌশলের ফাঁদে পা দিয়ে আছি। ১৮২১ সালে একজন ইংরেজ ‘এশিয়াটিক জার্নাল’—এ লিখেছিলেন : ‘Divide et impera should be the motto of our Indian administration’, ‘আমাদের ভারতীয় শাসননীতির প্রধান উদ্দেশ্য হবে বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন করা।’ এই নীতি সমর্থন করে আর—একজন ব্রিটিশ সামরিক অফিসার লিখেছিলেন : ‘বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ না করে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করাই হবে আমাদের প্রধান কর্তব্য।’৪২
ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই কর্তব্য ইংরেজ শাসকরা পালন করেছেন, বাংলার নতুন হিন্দু জমিদারশ্রেণি ও উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির সঙ্গে আপস করে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে সরকারি চাকরির মধ্য—নিম্নস্তরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে সন্তুষ্ট করে। তাই শিক্ষিত হিন্দুরা সিভিলিয়ান বিচারপতি, গেজেটেড পুলিশ অফিসার, গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার বা কাস্টমস অফিসার না হলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর, ছোট আদালতের জজ, মুনসেফ ইত্যাদি হয়েছেন, হিন্দু উকিল মোক্তার কেরানির সংখ্যাও যথেষ্ট বেড়েছে, কিন্তু মুসলমানদের অদৃষ্টে জুটেছে দপ্তরি বেয়ারা পিয়ন ড্রাইভার কোচোয়ান আর লশকরের কাজই বেশি।৪৩ ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ হিন্দুরা যেভাবে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন, মুসলমানরা সেভাবে করেননি। ক্ষমতাচ্যুত মুসলমানসমাজের ইংরেজ—বিদ্বেষ এবং নিজেদের শিক্ষা—সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে গোঁড়ামি ও গর্ববোধ থাকা তখন স্বাভাবিক। বাংলার মুসলমানদের নিজেদের শিক্ষা—সংস্কৃতি সম্বন্ধে এই গোঁড়ামি দম্ভ ও রক্ষণশীলতা এবং স্বাভাবিক ইংরেজ—বিদ্বেষের জন্য সেসময় ইংরেজের শিক্ষাব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থার প্রতি সহযোগিতার মনোভাব তাঁদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায়নি। প্রথম যুগে ইংরেজদের সমস্ত কার্যকলাপ তাঁরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনও তাঁরা সুনজরে দেখেননি। এই অসহযোগিতা ও গোঁড়ামির জন্যই তাঁরা শিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের পিছনে পড়ে গেছেন। কিন্তু মুসলমানদের এই অসহযোগিতা ও গোঁড়ামিই শুধু তাদের অনুন্নতির কারণ নয়। মুসলমানদের হাত থেকে এ দেশের রাজসিংহাসন কেড়ে নিতে হয়েছে বলে প্রথম যুগে ইংরেজ শাসকদেরও মুসলমান—বিদ্বেষ থাকা স্বাভাবিক। ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ গ্রহণের আগ্রহ হিন্দুদের মতন মুসলমানদের ছিল না হয়তো, কিন্তু মুসলমানদের যে কোনও বিষয়ে আগ্রহই ছিল না তা বলা যায় না। মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাব থাকার জন্য ইংরেজ শাসকরাও হিন্দুদের মতন শিক্ষার সুযোগ মুসলমানদের দেননি। মৌলবি আবদুল লতিফ খান বাহাদুর, সৈয়দ আমির হোসেন প্রমুখ বাংলার শিক্ষিত মুসলমান সমাজের মুখপাত্রদের আলোচনা থেকে, বিচারপতি ফিয়ার, রেভারেন্ড লং প্রমুখ বিশিষ্ট ইয়োরোপীয়দের সমালোচনা এবং ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘দ্য বেঙ্গলি’ প্রভৃতি হিন্দুসমাজের প্রধান মুখপত্রগুলির মন্তব্যের মধ্যে মুসলমানদের গোঁড়ামির চাইতেও ইংরেজদের এই মুসলমান—বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে :
বাংলার মুসলমানরা যদি ইংরেজি—শিক্ষিত হতেন তাহলে ভারতীয় রাজনীতির ধারা বদলে যেত এবং ভারতের শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধেও জনমত সজাগ হত।৪৪
—মৌলবী আবদুল লতিফ খান বাহাদুর, ১৮৬৮
ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকে এ দেশের মুসলমান ভদ্রশ্রেণি লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। শিক্ষায় ও সামাজিক সম্মানলাভে তাঁরা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রশ্রেণির অনেক পিছনে পড়ে রয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পশ্চাদগতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিতে বাধ্য।৪৫
—বিচারপতি জে. বি. ফিয়ার
ক্রমবর্ধমান মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার সুবিধার জন্য কলকাতার মুসলমান মহল্লায় একটি কলেজ (বি. এ. ডিগ্রি পর্যন্ত) স্থাপন করা অবিলম্বে প্রয়োজন। প্রেসিডেন্সি কলেজ গভর্নমেন্ট কলেজ হলেও হিন্দু মহল্লায় স্থাপিত এবং মুসলমান মহল্লা থেকে এত দূরে যে ছাত্রদের যাতায়াতের খরচই প্রায় ২০ টাকা পড়ে যায়।৪৬
—সৈয়দ আমির হোসেন, ১৮৮০
ব্যক্তিগত জীবনেও মুসলমানরা হিন্দুদের পিছনে পড়ে আছেন। জমিদারি সম্পত্তি মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলি প্রায় সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং শহরে বহু সম্ভ্রান্ত মুসলমান অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে পড়ে দিন কাটাচ্ছেন। গভর্নমেন্ট অফিসার এবং শিক্ষাবিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা নগণ্য।
—পাইওনিয়ার, ১৭ নভেম্বর, ১৮৮০
মুসলমানদের মধ্যে একসময় যে গোঁড়ামি দেখা গিয়েছিল, এখন আর তা নেই। এখন বাংলার মুসলমানরা উচ্চশিক্ষার জন্য উদগ্রীব এবং সর্বক্ষেত্রে শিক্ষিত হিন্দুশ্রেণির সমকক্ষ হতে তাঁরা চান। লর্ড মেয়ো ও স্যার জর্জ ক্যাম্পবেলের সময় মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা বিশেষ ফলপ্রদ হয়নি। কলকাতা হুগলি ঢাকা চট্টগ্রাম ও রাজশাহির মাদ্রাসাগুলিতে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং আমির হোসেন মুসলমানদের পৃথক কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে আবেদন করেছেন তা বিশেষভাবে বিবেচ্য বলে মনে হয়।
—স্টেটসম্যান, ১৪ আগস্ট, ১৮৮০
গভর্নমেন্ট সত্যই যদি মুসলমান সমাজের মঙ্গল কামনা করেন এবং বর্তমানের নিম্নতম সামাজিক স্তর থেকে তাদের উদ্ধার করে উন্নত করতে চান, তাহলে উচ্চশিক্ষার আগ্রহ যাঁদের আছে তাঁদের এখনই শিক্ষার সুযোগ দেওয়া তাঁদের কর্তব্য। প্রাচ্য শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোক না পেলে মুসলমানদের সামাজিক প্রগতির কোনও সম্ভাবনা নেই।
—হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ১৬ আগস্ট, ১৮৮০
হোসেন সাহেবের প্রস্তাব সহৃদয় দেশবাসী সকলেই সমর্থন করবেন। আমরা আশা করি, স্যার অ্যাশলি ইডেন মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতির জন্য এই প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন।
—দ্য বেঙ্গলি, ২১ আগস্ট, ১৮৮০
জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ এবং শোচনীয় সামাজিক দুরবস্থার দিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এ দেশের মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছেন। একসময় যাঁরা এত বড় একটা রাজ্য শাসন করেছেন, আজ তাঁদের বংশধররা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছেন। …বাংলা দেশের কোনও গভর্নমেন্ট অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী বিশেষ দেখা যায় না, কিন্তু মুসলমান দপ্তরি আর পিয়নে সব অফিস ভরে গেছে।…
সংস্কৃতচর্চার জন্য ইউরোপ থকে বড় বড় অধ্যাপক ও পণ্ডিত এ দেশে আমদানি করা হয়েছে। বেনারসের জন্য গ্রিফিথস, ব্যালান্টাইন ও হল সাহেবকে আনা হয়েছে, কলকাতার জন্য উইলসন, কাউয়েল ও মার্শালকেও আমরা এনেছি। সংস্কৃতচর্চায় আমাদের অসীম উৎসাহ দেখা যায়। ইংরেজি শিক্ষার জন্য ইউরোপীয় অধ্যাপকদেরও আমরা দেশে আমদানি করেছি। কিন্তু আরবি—ফারসির জন্য আমরা কিছুই করিনি, যদিও ভাষাবিদ্যা এবং এ দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে গবেষণা করার জন্য আমাদের উচিত ছিল আরবি—ফারসিচর্চার ব্যবস্থা করা।৪৭
—রেভারেন্ড জে. লং. ২১ জানুয়ারি, ১৮৬৯
সমসাময়িককালের হিন্দু—মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত ব্যক্তিদের মতামত এবং বিখ্যাত মুখপত্রগুলির মন্তব্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি উচ্চশিক্ষার আগ্রহ হিন্দুদের মতন না থাকলেও, একেবারেই যে ছিল না এ কথা মিথ্যা। রেভারেন্ড লঙের আলোচনা এবং ‘স্টেটসম্যান’—এর মন্তব্য থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। প্রথম যুগে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের নীতি মুসলমান—বিদ্বেষ এবং হিন্দু—পক্ষপাতিত্বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাই হিন্দুরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন এবং ইংরেজদের অধীনে কিছু কিছু মোটা বেতনের সরকারি চাকরিও পেয়েছেন। মুসলমানরা সেরকম সুযোগ বা উৎসাহ পাননি, নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে মিথ্যা অহংকার তাঁদের ছিল। ইংরেজরা সেই গোঁড়ামি ও অহংকারের প্রশ্রয় দিয়েছে। তার প্রধান কারণ আগেই বলেছি, মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের অধিকার ও বিদ্বেষভাব প্রথম যুগে বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিল। ইংরেজদের নতুন জমিদারি ব্যবস্থার ফলে শুধু যে মুসলমান জমিদার—জায়গিরদারেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন তা নয়। বাংলার যে কৃষক—প্রজারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হল তাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। বাংলার প্রত্যেক জেলায় এই উৎখাত নিঃস্ব প্রজাদের ধূমায়িত বিক্ষোভ দস্যুবৃত্তি ও কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময় এল ওয়াহাবি আন্দোলনের ঢেউ। ধর্মান্দোলনের ঢেউ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলমান অভিজাত শ্রেণির প্রতিহিংসা—প্রবৃত্তি ও ইংরেজ—বিদ্বেষের এই সম্মিলিত প্রকাশকে ব্রিটিশ শাসকরা ব্রিটিশ—বিরোধী ‘জিহাদ’ বলে প্রচার করলেন।৪৮ লর্ড এলেনবুরো পরিষ্কার বললেন : ‘ইংরেজদের প্রতি মুসলমানদের একটা জন্মগত বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’৪৯ এই ‘দৃঢ় বিশ্বাস’ থেকেই যে ব্রিটিশ শাসকরা প্রথম যুগে যৎসামান্য হিন্দুপ্রীতি এবং গভীর মুসলমান—বিদ্বেষ দেখিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সাম্রাজ্যবাদের সনাতন ‘বিভেদনীতির’ এ হল একটা সাময়িক কৌশল মাত্র। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রধানত ব্রিটিশ কূটকৌশলের জন্য এবং আংশিকভাবে মুসলমান সমাজের আত্মাভিমান অসহযোগিতা ও গোঁড়ামির ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণি ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার বুর্জোয়াশ্রেণি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি আজও তাই হিন্দুপ্রধান। তাই হিন্দুপ্রধান বাঙালি বুর্জোয়াশ্রেণি ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিই বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত, এবং তা প্রধানত হিন্দুসমাজের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত।
অতএব যেহেতু লোকেরদিগের যখন, এ প্রকার শ্রেণীবদ্ধ হইল তখন স্বাধীনতাও অদূরে সেই শ্রেণী প্রাপ্ত হইবেক। ইহার অধিক দৃষ্টান্ত কি দিব ইংলণ্ডের পূর্ব বৃত্তান্ত দেখিলেই প্রত্যক্ষ হইবেক।
—বঙ্গদূত, ১৩ জুন ১৮২৯
ব্রাহ্মসমাজ, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ভিতর দিয়ে ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল এবং বোঝা গেল ‘বঙ্গদূত’—এর ভবিষ্যদবাণী সার্থক হবে একদিন। ব্রিটিশ শাসকদের নীতিরও পরিবর্তন হল। বাংলার হিন্দুপ্রধান শিক্ষিত ধনিক, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রভাব—প্রতিপত্তি সম্বন্ধে তাঁরা বিশেষভাবে সজাগ হলেন। ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গ বিভাগ’—এর সিদ্ধান্তের মধ্যে তাঁদের হিন্দুবিদ্বেষ ও মুসলমানপ্রীতি প্রকাশ পেল। সাময়িক কৌশলের পরিবর্তন হল। ‘স্টেটসম্যান’ পরিষ্কার লিখলেন : ‘পূর্ববাংলায় মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য না করলে, জাগ্রত ও শিক্ষিত হিন্দুসমাজের ক্রমবর্ধমান প্রভাবপ্রতিপত্তি খর্ব করা সম্ভব নয়।’৫০ সুতরাং ব্রিটিশ বিভেদনীতির মুসলমান—বিদ্বেষ ও হিন্দুপ্রীতির যুগে সমাজের সর্বক্ষেত্রে যে হিন্দুদের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হবে তাতে বিস্ময়ের কোনও কারণ নেই।
বাংলার নতুন বুর্জোয়াশ্রেণি ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দু প্রাধান্য এবং জাতীয় নবজাগৃতি আন্দোলনে হিন্দুদের নেতৃত্বের দ্বিতীয় কারণ হল : মুসলমানরা রাজ্য হারিয়েছিলেন, হিন্দুরা হারিয়েছিলেন সর্বস্ব। মুসলমানরা সবেমাত্র ক্ষমতাচ্যুত, অর্ধশতাব্দীর বেশি নয়, আর হিন্দুরা ক্ষমতাচ্যুত কয়েকশত বৎসর। উচ্চশ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে মুসলমান শাসকশ্রেণির প্রতি বিদ্বেষ ও বৈরীভাব থাকা তাই ইংরেজ রাজত্বের প্রথম যুগে অস্বাভাবিক নয়। ইংরেজদের সহায়তায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য সেই কারণেও হিন্দুরা তৎপর হতে পারেন। তা ছাড়া হিন্দু—সংস্কৃতির বিরাট ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য কয়েক শতাব্দীব্যাপী যুগসংকটের গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। দর্শনে বিজ্ঞানে শিল্প—সাহিত্যে হিন্দুর মনীষা ও প্রতিভার যে আশ্চর্য বিকাশ হয়েছিল একদিন, তারই শোচনীয় অবনতির দুর্দিনে মুসলমানরা এ দেশে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুসলমান যুগে হিন্দুদের হারানো প্রতিভা ও মনীষা, সেই লুপ্ত শক্তি ও ক্ষুরধার বুদ্ধির পুনর্বিকাশ ও পুনরুজ্জীবন হয়নি। মুসলমান যুগে হিন্দু—মুসলিম সংস্কৃতির যে সমন্বয় ঘটেছিল তা হল মানসলোকের ভাবসমন্বয় মাত্র।* এই ভাবসমন্বয় ভারতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে সত্য, কিন্তু তার ফলে কোনও সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। মধ্যে মধ্যে ভাবজাগৃতির এক—একটা ঢেউ এসেছে মাত্র (যেমন বাংলার শ্রীচৈতন্যর বৈষ্ণবধর্ম ও আদর্শের ঐতিহাসিক আন্দোলন), কিন্তু সেই ঢেউয়ের আঘাতে সমাজের ভিত কেঁপে ওঠেনি। তার প্রধান কারণ হল, সমাজের অর্থনৈতিক ও সংস্থানিক (Institutional Structure) ভিত্তির মুসলমান যুগে কোনও পরিবর্তন হয়নি। মূলের সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন মুসলমান যুগে হয়নি বলে মানসলোকের ভাবজাগৃতির ধারা মধ্যে মধ্যে তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মতন উত্তাল হয়ে উঠে, ঘূর্ণি ও বুদবুদের সৃষ্টি করে আবার মিলিয়ে গেছে। জরাগ্রস্ত সমাজ ধীরে ধীরে স্থিতি অবনতির পথে এগিয়ে গেছে। ইংরেজের আমলে অর্থনৈতিক আলোড়নের জন্যই সামাজিক ও নৈতিক পরিবর্তন কিছুটা সম্ভব হয়েছে। নতুন যুগের নতুন অর্থনৈতিক সামাজিক ও নৈতিক আদর্শের সংঘাতের ফলেই জাতীয় নবজাগৃতির সূচনা হয়েছে এ দেশে। সেইজন্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগৃতির আন্দোলনের পুরোগামী শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বাংলার উদীয়মান হিন্দুপ্রধান বুর্জোয়াশ্রেণি। একটা হিন্দুপ্রধান ভাবধারা সেই কারণেই কখনো ক্ষীণ কখনো প্রবলবেগে, বাংলার নবজাগৃতি আন্দোলনের ভিতর দিয়ে অন্তঃসলিলার মতন প্রবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু তাহলেও সেই জাগৃতি জোয়ারের তরঙ্গশীর্ষ যে গতানুগতিক সংকীর্ণতা দীনতা ও সাম্প্রদায়িকতাবোধের ঊর্ধ্বে সর্বজনীন যুগাদর্শের মধ্যে, নবরূপান্তরিত জাতীয় ভাবধারার মধ্যে খানিকটা পরিব্যাপ্ত হতে চেয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। বাঙালির নবজাগৃতি তাই সমগ্র ভারতের নবজাগৃতির প্রেরণা সঞ্চার করেছে, যদিও প্রকৃত নবজাগৃতির উদ্দেশ্য সার্থক হয়নি।
……….
* গ্রন্থকারের ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’ (১৯৬৯) দ্রষ্টব্য। (১৯৭৮)
* বাংলাদেশে অবাঙালি মজুরের, বিশেষ করে বিহারি ওড়িয়া সাঁওতালি মজুরের আবির্ভাব এই সময় থেকেই হয়। তারপর থেকে এই অবাঙালি মজুরদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাংলা দেশে আরও বাড়তে থাকে, কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে শ্রমশিল্পের প্রসার বিহার—উড়িষ্যায় বিশেষ হয়নি, যা হয়েছিল বাংলা দেশে। (১৯৪৮)
** এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য নয় যে বাংলার কারিগর—কারুশিল্পীরা, যেমন কর্মকার কংসকার প্রভৃতি, ‘নবশাখ’ পর্যায়ভুক্ত বলে গ্রাম্য সমাজের মর্যাদা তাদের ক্ষুণ্ণ হয়নি এবং তা হয়নি বলে কারখানার মজুরজীবনের অথবা শহুরে সমাজের আকর্ষণ তাদের কাছে বাড়েনি। বরং বাংলার মাটি সুজলা সুফলা বলে, গ্রাম্য জীবনে দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ সাধারণ দরিদ্র চাষিরাও তেমন অনুভব করেনি। এমনকী ২৪—পরগনা হাওড়া হুগলি প্রভৃতি অঞ্চল থেকেও যে সমস্ত বাঙালি কৃষক—কারুজীবী শিল্প কারখানার মজুর হয়েছে; তারাও এক—পা গ্রামে রেখে আর—এক—পা কারখানার দিকে বাড়িয়েছে, অর্থাৎ পুরো proletarianized হয়নি। আজকের দিনেও তা দেখা যায়। (১৯৭৮)
* অনেক লেখকের রচনার মধ্যে এ দেশের বনেদি জমিদার বংশগুলি এবং শেঠজি নাথজিদের প্রভাব—প্রতিপত্তি ধ্বংস হবার জন্য বিলাপের সুর ফুটে ওঠে। আমাদের দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, এ—ও অনেকে মনে করেন। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে শেঠজি নাথজিদের প্রভাব—প্রতিপত্তি এবং কয়েকটি নগরের সমৃদ্ধি যদি শ্রমবিপ্লবের পটভূমিকা তৈরি করে থাকে তাহলে বলতে হয় বৌদ্ধ যুগ থেকেই ভারতবর্ষে এই পটভূমিকা তৈরি হয়েছিল। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির যে অগ্রগতি শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজন তা ভারতবর্ষে বাদশাহি যুগে হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না। তা ছাড়া শ্রেষ্ঠী বণিক শেঠদের প্রভূত ধনসম্পদের প্রতিপত্তি আর স্বাধিকারজনিত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিপত্তি এক নয়। ভারতবর্ষে শেঠ ও বণিকদের (মধ্যযুগে বা মোগল যুগে) কোনওদিন সামাজিক বা রাষ্ট্রিক প্রতিপত্তি ছিল না, অথচ এই প্রতিষ্ঠাই শিল্পবিপ্লব যুগের অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা। ব্রিটিশ যুগে ভারতীয় বণিকদের এই প্রতিপত্তির সুযোগ সামান্য হলেও সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা সোৎসাহে যন্ত্রপাতি আমদানি করেননি এবং কলকারখানার প্রসারেও উৎসাহ দেননি, এ কথা অত্যন্ত সহজ সত্য কথা। সাম্রাজ্যবাদের নীতিই হল তা—ই। কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে এবং শোষণের ঐতিহাসিক তাগিদে এ দেশে যেটুকু যন্ত্রপাতি এনেছেন, কলকারখানা, রেলপথ ইত্যাদি তৈরি করেছেন, তার ফলে, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে, তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও, এ দেশে খানিকটা শিল্পায়নের সূচনা হয়েছে। তার মধ্যেই এ দেশের বুর্জোয়াশ্রেণির ধীরে ধীরে বিকাশ হয়েছে। (১৯৪৮)
* এ কথা কতটা সত্য তা বলা কঠিন, তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বাংলার ও কলকাতার ‘Directory’ ও ‘Almanack’—গুলি অনুসন্ধান করে যা পাওয়া গেছে তা থেকে এ দেশের ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির গোড়ায় ইতিহাস সম্বন্ধে এইরকম ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক। এখনও যেসব কোম্পানি এ দেশে আছে তাদের প্রচারিত ইতিহাস নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ কোম্পানির গোড়াপত্তন থেকে আজ পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য ধারাবাহিক ইতিহাস লেখার মতো নথিপত্র পাওয়া যায় না। চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। তাঁরা বলেন, নথিপত্র নাকি বিলেতে আছে। (১৯৪৮)
* দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামদুলাল দে—র বাণিজ্যকর্মের বিস্তারিত বিবরণের জন্য গ্রন্থকারের ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’ (১৯৬৯) গ্রন্থের ‘বাঙালির শিল্পোদ্যম’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য। (১৯৭৮)
* কেবল বাঙালি কমপ্র্যাডোর বুর্জোয়াশ্রেণিই যে ইংরেজ রাজভক্ত ছিলেন তা নয়, নতুন ইংরেজি—শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিও (elite) তা—ই ছিলেন। জাতীয় বিদ্রোহের (সিপাহি বিদ্রোহ ১৮৫৭) প্রতি বাঙালি নব্যবণিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনোভাব থেকে তা বোঝা যায়। ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছোট—অংশীদার হবার জন্য তাঁরা যে আন্দোলন করেছেন, তা—ও রাজানুগত্যের বৃহত্তর গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। (১৯৭৮)
* গ্রন্থকারের ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’ (১৯৬৯) এবং ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ (২য় সংস্করণ ১৯৭৮) দ্রষ্টব্য।
(ক) ২৬০ জনই ইংরেজ
(খ) ৪৭ জনই ইংরেজ
(গ) মোট ৩০ জনের মধ্যে বাকি ২৬ জন ইংরেজ
(ঘ) মোট ১০৯ জনের মধ্যে বাকি ১০৬ জন ইংরেজ
(ঙ) মোট ১৭৩ জনের মধ্যে বাকি ১৫৪ জন ইংরেজ
(চ) মোট ১৫৮ জনের মধ্যে বাকি ৮৯ জন ইংরেজ
(ছ) মোট ৫৩ জনের মধ্যে বাকি ৩৮ জন ইংরেজ
(জ) মোট ৮২২ জনের মধ্যে বাকি ৪১২ জন ইংরেজ
* পরবর্তী অধ্যায়ে ইসলাম ও বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়ের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। (১৯৪৮)
***
বাংলার নতুন সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস
১. P. Sorokin : Social Mobility
Von Martin : Sociology of Renaissance
২. Marx : Capital (Vol. I), ২৬, ২৭, ২৯, ৩১অ
৩. Karl Mannheim : Man & Society, ৯০টী
৪. Mannheim : ওই ৯০
৫. Dobb : Political Economy & Capitalism, ২৪৮
৬. তারিখ বাঙ্গালা (গ্লাডউইনের অনুবাদ, ১৭৭৮)
Journal, Asiatic Society, 1875, ৩ নং
Proceedings, As, Soc. January, 1893
অক্ষয়কুমার মৈত্রর : সিরাজউদ্দৌলা
নিখিলনাথ রায় : মুর্শিদাবাদ কাহিনী
কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙ্গলার ইতিহাস (নবাবী আমল)
৭. Simon Commission Report (Vol. I), ৩৪০
৮. Calcutta Review (1872-1873)
৯. H. Bury : Zamindary Settlement of Bengal (Vol. II) ৩৯
১০. Bury : ওই, ৪৪
১১. Revenue Selections (Vol. I) ৪৬
১২. Revenue Selections (Vol. I) ১৭২
১৩. Bury : (Vol. I) ওই, ১৫২
১৪. Bury : ওই ২৬১
১৫. Bury : ওই ২৭১
১৬. Bury : ওই ২৭৫
১৭. Marx : Capital (Vol. I, Modern Lib, ed), ৮০৬—৮০৮
১৮. Bury : ওই ২৭০—২৭১
১৯. Henry M’Kenly : The Bengal Directory & Almanack (1797), ৮৩
২০. Calcutta Annual Directory & Almanack (1805 & 1806), ১২৬
২১. Cal. A. D. & Kalender (1807, 1808, 1810)
২২. Crawford : Sketch of Commercial Resources etc. (Lond. 1837) ৬২—৭০
২৩. Bracken’s Evidence, Select Committee, (1832)
২৪. Calcutta Review (Jan-June 1847), ১৬৩—১৬৯
২৫. Rau : Organised Banking (1800-1857), ৬৫
২৬. Crawford : ওই
২৭. The Bengal Directory & Annual Register for 1858, ২৩—২৪
২৮. ওই
২৯. Gulam Hussein : Seir Mutaqherin (Eng. Trans : Cambary ed. 1902), Vol. II, ৪৫৭—৪৫৮
Long : Selections, ৪৬ নং
৩০. Pramathanath Mullick : History of the Vaisyas of Bengal : APP. (A)
৩১. সুরেন্দ্রনাথ সেন : ‘ভারতবর্ষ’ (শ্রাবণ, ১৩৪৭)
৩২. Fisher’s Colonial Magazine (1842), ৩৯৪—৩৯৫
৩৩. Dobb : Studies, ৫অ
Marx : Capital (Vol. I) ২৬, ২৭অ
৩৪. R. H. Gretton : The English Middle Class (1917), ভূমিকা
৩৫. Mannheim : ওই, ৮২টী
৩৬. W. Stark : The Ideal Foundations of Economic Thought, ৯৯
৩৭. Charles Booth : Life and Labour (2nd Series, Vol. III), ২৪১
৩৮. Booth : ওই ২৭৭—২৭৮
৩৯. Hunter : Statistical Account of Bengal (Vol. I)
৪০. Census Report (Cal. 1871, 1881, 1901)
৪১. Hunter : Indian Mussalmans (Cal. ed.) সংখ্যাগুলি এই গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
৪২. Leonard Schiff : The Present Condition of India, ১৬৬
৪৩. Hunter : Indian Mussalmans (Cal. ed.) ১৬২ Census Report (Cal. 1881)
৪৪. A Luteef : ‘A Paper on Mohamedan Education in Bengal’
(এই প্রবন্ধটি ১৮৬৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘Bengal Social Science Association’-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে পঠিত।)
৪৫. উক্ত প্রবন্ধের আলোচনা প্রসঙ্গে জাস্টিস ফিয়ারের মন্তব্য।
৪৬. Sayed Ameer Hossain : Mahamedan Education in Bengal (1880)
৪৭. Rev. J. Long: The Social Condition of the Muhammadans of Bengal and the Remedies (1869)
১৮৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি ‘Bengal Social Science Association’-এর অধিবেশনে পঠিত। ‘Transactions of Bengal Soc. Sc. Assoc.’ দ্রষ্টব্য।
৪৮. F. W. Thomas : The Mutual Influence of Muhammadans and Hindus (1892) ১০৬
K. B. Krishna : The Problem of Minorities (1939)
Hunter : Indian Mussalmans
৪৯. Shelvankar : Problem of India, ২২
৫০. Shelvankar : ওই, ২২