‘শেষ বিচারের আশায়’ আমার জীবনের হাসি-কান্নার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে – মান্না দে (সাক্ষাৎকার)

‘শেষ বিচারের আশায়’ আমার জীবনের হাসি-কান্নার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে: মান্না দে

 সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গে কবে, কীভাবে আপনার পরিচয় হয়েছিল?

মান্না দে: সে তো বহুকাল আগের ঘটনা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে। এইচ এম ভি-র পুজোর রেকর্ড প্রকাশ উপলক্ষেই পরিচয়। তখন তো পুজোর গানই প্রধান ছিল। শিল্পী ও শ্রোতা— উভয়পক্ষের কাছেই তার একটা অন্য ভ্যালু ছিল। বড় সাইজের রেকর্ড, দুটো মাত্র গান নিয়ে সেই রেকর্ড প্রকাশিত হত। একেবারে দিনক্ষণের হিসেব এখন আর মনে নেই। বাড়িতে এসে সুধীন গানের রিহার্সাল করেছিলেন এবং যথাসময়ে পুজো সংখ্যার গান বেরিয়েছিল। সেই শুরু। সারা বছরে মাত্র দুটো গান। অন্য সময়ে গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্য যে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন হত তা আমি কখনও নিইনি, নেওয়া পছন্দও করতাম না। তাছাড়া তখন বোম্বেতে ব্যস্ত থাকতাম। এইচ এম ভি ডাকলে এসে গান করে চলে যেতাম। এইচ এম ভি-র তরফ থেকেই আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল আমি যেন ওঁর সুরে পুজোর গান করি, করেছিলাম। তখন শুনেছিলাম উনি ভাল সুর করেন, লেখেনও ভাল। সেই থেকে আমাদের পরিচয়।

রেকর্ড প্রকাশের সন-তারিখ অনুযায়ী সুধীনবাবুর সুরে সেই দুটি গান (‘একই অঙ্গে এত রূপ’/’মেঘলা মেয়ে মেঘেরই’) ১৯৫৯-এর পুজোয় বেরিয়েছিল। দুটি গানই তো সুপারহিট হয়েছিল…

মান্না দে: হ্যাঁ, দুটো গানেরই কথা ও সুর ভাল ছিল। আর শিল্পী হিসেবে আমি তো সব গানই আন্তরিক যত্নের সঙ্গে গাইবার চেষ্টা করতাম। সেইভাবে বলতে গেলে শিল্পী হিসেবে আমার প্রস্তুতি, শিক্ষা তেমনই ছিল। আমার কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে আমাকে সেইভাবেই তৈরি করেছেন। তিনি নিজে ধ্রুপদ থেকে কীর্তন পর্যন্ত সব ধরনের গান করতেন, সব গানেই তিনি ছিলেন মাস্টার। সেই শিক্ষা থেকেই সব হয়েছে।

সুধীন দাশগুপ্তর সুরে তো আপনি বাংলা বেসিক রেকর্ডে আরও কয়েকটি অবিস্মরণীয় গান গেয়েছেন…

মান্না দে: সেগুলো কয়েক বছর পরে, ষাটের দশকের শুরুর দিকে।

১৯৬২-র সেই গান দুটোর কথা একটু অন্যরকম ছিল— ‘চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে’ আর ‘একঝাঁক পাখিদের মতো কিছু রোদ্দুর’, সেই গান দুটোও প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল…

রেকর্ড প্রকাশের সন-তারিখ অনুযায়ী সুধীনবাবুর সুরে সেই দুটি গান (‘একই অঙ্গে এত রূপ’/’মেঘলা মেয়ে মেঘেরই’) ১৯৫৯-এর পুজোয় বেরিয়েছিল। দুটি গানই তো সুপারহিট হয়েছিল…

মান্না দে: হ্যাঁ, দুটো গানেরই কথা ও সুর ভাল ছিল। আর শিল্পী হিসেবে আমি তো সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীত পরিচালনায় বাংলা চলচ্চিত্রে আপনার প্রথম গান গাওয়া…

মান্না দে: সেটাও ওই পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়েছিল। ছবির নাম ‘ডাকহরকরা’, মনে আছে গানগুলো লিখেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং।

অনেকে বলেন ক্লাসিক্যাল গানের স্বীকৃত দক্ষতা ছাড়া আপনার গলায় যে ‘ফোক এলিমেন্ট’ আছে তা বাংলা ছায়াছবিতে সুধীন দাশগুপ্ত প্রথম যেভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন তেমনভাবে আর কেউ…

মান্না দে: এইভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক নয়। তুলনা না করাই ভাল। সুধীনের সঙ্গে ‘ডাকহরকরা’-তে কাজ করার আগেও কিন্তু আমি সিনেমায় ফোক অঙ্গের গান করেছি। সলিলের সুরে ‘দো বিঘা জমিন’-এ যে গান গেয়েছিলাম তাতেও কি ফোক এলিমেন্ট ছিল না? আগেই বলেছি, প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে আমি যে-কোনও গানের জন্য প্রস্তুত থেকেছি, যাতে সঙ্গীত পরিচালকরা আমার যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারেন। আমি ‘আও টুইস্ট করেঁ’ যেমন গেয়েছি, তেমনি ‘লাগা চুনেরি মে দাগ’ও গেয়েছি। ভার্সেটাইল সিঙ্গার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।

কিন্তু বাংলা সিনেমায় ‘ডাকহরকরা’র আগে কি আপনাকে দিয়ে…

মান্না দে: সুধীনবাবু অভিজ্ঞ এবং গুণী মানুষ ছিলেন। সুধীনবাবুই বাংলা গানের জগতে প্রথম মানুষ, যিনি আমায় প্রথম থেকেই ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন। ক্লাসিক্যাল থেকে ফোক ও ওয়েস্টার্ন মিউজিকের আঙ্গিকে তৈরি যে-কোনও গান যে-কোনও স্কেলে ফেলে গেয়ে দিতে পারি, গানের সূক্ষ্ম অলঙ্কার নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে পারি তা তিনি বুঝেছিলেন। ‘ডাকহরকরা’ ছবির সব গানেই একটা আলাদা আবেদন আছে। বিশেষ করে ওই ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ একেবারে বুকের ভেতর মোচড় দেওয়া গান।

এই গানটাকে নিয়ে আরও অনেক স্মৃতি আছে। অনুষ্ঠানে গানটা গাইতে শুরু করলে কেঁদে ফেলতেন রাধুবাবু, মানে জাদুকর তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দী। ধরা গলায় বলতেন, ‘গায়েন না, মান্নাদা গায়েন না গানটা। আমি বাজাইতে পারতায়াছি না। এই গানটা শুনলেই যেন ভিতরটা ক্যামন কইরা ওঠে, মান্নাদা, নিজেরে য্যান সামলাইতে পারি না।’ উনি সত্যি সত্যিই তখন রুমাল দিয়ে চোখ মুছতেন। শুনেছি তারাশঙ্করবাবু নিজেও নাকি গানটা বারবার শুনতে চাইতেন। সিনেমায় গানটা প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শান্তিদেব ঘোষের লিপে আছে। ছবিতে উনি একজন বাউল। কিন্তু সুধীনবাবু সুর তৈরির পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গানটা আমিই গাইব। অথচ শান্তিদেব ঘোষেরও ইচ্ছে উনি গানটা গাইবেন। শেষ পর্যন্ত সুধীনবাবু আমাদের দু’জনকে নিয়ে বসেছিলেন। আমায় গাইতে বললে আমি গানটা গাইলাম। তখন শান্তিদেব নিজেই বলে উঠলেন— ‘না, এটা মান্নাবাবুই গাইবেন, উনি সত্যিই ভাল গাইলেন গানটা।’

আপনাদের পরিচয় তো বম্বেতেই হয়েছিল…

মান্না দে: হ্যাঁ, গীতা দত্তই সুধীনের কাজে মুগ্ধ হয়ে বম্বেতে নিয়ে গিয়েছিল। গুরু দত্তের ছবিতে কাজ করার জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সুধীনের বম্বেতে কাজ করার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু সুধীন কলকাতায় ফিরে এসে বোধহয় ভালই করেছিলেন। বাংলা সিনেমার ওঁকে দরকার ছিল। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে সুধীনবাবু নিশ্চয় একজন খুবই সফল সঙ্গীত পরিচালক। ‘ডাকহরকরা’র কথা তো আগেই বললাম। অনেক নতুন ধরনের সুর তৈরিতে উনি অনেক পরীক্ষামূলক কাজও করতেন। আমাকে দিয়েই অনেক নতুন ধরনের গান করিয়েছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই গানগুলো হিট হয়েছে। ‘তিনভুবনের পারে’, ‘প্রথম কদম ফুল’, ‘বসন্তবিলাপ’— এমন অনেক ছবির গান আছে যার বৈচিত্র্য ওঁকে আলাদা করে রেখেছে। অত্যন্ত গুণী মানুষ ছিলেন।

সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও মানুষ সুধীন দাশগুপ্ত সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে আপনি কী বলবেন?

মান্না দে: হি ওয়াজ এ ভেরি ফাইন, পলিশড পার্সন। শিক্ষিত ও বিনয়ী মানুষ ছিলেন। একসময় ওঁর বাড়িতে গিয়েও খাওয়া-দাওয়া করেছি। আড্ডাও জমত খুব। ওর স্ত্রী মঞ্জু— শি ওয়াজ এ সুইট লেডি। ওঁদের বাচ্চাদের সঙ্গেও প্রচুর গল্প হত সেই সময়।

বাংলা গানের ক্ষেত্রে আমার সাফল্যের একটা বড় অংশের কৃতিত্ব নিশ্চয় সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তর প্রাপ্য। বাংলা সিনেমায় আমি অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছি যা সঙ্গীত পরিচালক সুধীনবাবুর তৈরি। সেই তালিকা সত্যিই দীর্ঘ। সুধীন গান লিখতেন, নিজেই সুর দিতেন, ঠিক যেভাবে উনি এক্সপ্রেশন দিতেন তাতে মনে হত যেন আমি চোখের সামনে গানের বক্তব্যটা দেখতে পাচ্ছি। সেইজন্য সুধীনের গান করতে আমার খুব ভাল লাগত।

একটা-দুটো উদাহরণ দেবেন?

মান্না দে: অনেক উদাহরণই দেওয়া যায়। যেমন ধরুন, ‘ছদ্মবেশী’ ছবির গান। ‘আমি কোন পথে যে চলি/কোন কথা যে বলি/ তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরা গলি’— গানটা ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী কতটা উপভোগ্য হয়েছিল তা তো সকলেই জানেন। কিন্তু সুরকার ও শিল্পী হিসেবে আমি গানটায় সুধীনের লেখা এবং সুরের চলনে স্ক্যানিংয়ের বিশেষ প্রশংসা করব। রেকর্ডিংয়ের সময়েই আমি জানতাম— কারও কিছু করার নেই, গানটা যেভাবে লেখা ও সুর দেওয়া হয়েছে তা আমি গাইলেই গানটা হিট হয়ে যাবে। হয়েওছিল তাই। ছবিতে অন্য যে গানটা সেটাও যথেষ্ট মজার ছিল। ‘বাঁচাও কে আছো মরেছি’ শুনে আনন্দ পাননি এমন কেউ আছেন কিনা আমি জানি না।

সুধীনের ছবিগুলোতে গাওয়া গানের লিস্ট খেয়াল করে বলতে গেলে কথা শেষ হবে না। ‘হার মানা হার’ ছবিতে সুধীনের লেখা ও সুর দেওয়া ‘এসেছি, আমি এসেছি’ আর একটা চমৎকার উদাহরণ। আই হ্যাভ অ্যারাইভড, আই হ্যাভ কাম… কী ওয়ান্ডারফুল, মিনিংফুল লেখা ও সুর দেওয়া। তিনি গানের সিচুয়েশন অত ভালভাবে ভাবতে পারতেন, সেই ভাবনাকে সুরে জীবন্ত করে তুলতে পারতেন— এইসব কোয়ালিটি না থাকলে কি কেউ সুধীন দাশগুপ্ত হয়? হি ওয়াজ এ গ্রেট আর্টিস্ট ইনসাইড।

বাংলা সিনেমায় উত্তমকুমারের মুখে আপনার গান গাওয়া— সেই ঘটনাও তো সুধীন দাশগুপ্তের সুরে…

মান্না দে: হ্যাঁ, সেটা শুরু হয়েছিল ‘শঙ্খবেলা’ ছবি থেকে। যতদূর মনে পড়ছে সেটা ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। অনেক অপ্রীতিকর কথা জড়িয়ে আছে ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে গাওয়া নিয়ে। সব বলতে গেলে… কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে। এইসব ক্ষেত্রে বিচিত্র সব কথাবার্তা হয়, হয়েছিল। উত্তমকুমারের মুখে গান গাওয়ার ইচ্ছে খুব স্বাভাবিকভাবে আমারও ছিল। সুধীনবাবুই আমাকে দিয়ে উত্তমকুমারের মুখে দুটো গান গাওয়ার প্রস্তাব বম্বেতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই নানা কথা হয়। কিন্তু আমি জানি আই ওয়াজ নট দি ওনলি আর্টিস্ট কনসিডার্ড ফর দোজ টু সঙস…। বাঙালিদের মধ্যে এই ধরনের আলোচনা হয়, শুধু বাঙালি কেন গোটা ভারতের সব সঙ্গীত পরিচালকের মধ্যেই গায়ক-গায়িকা নির্বাচন নিয়ে নানা স্বার্থগন্ধী কথাবার্তা হয়।

কথাগুলো আমি এইভাবে এইজন্য বলছি যে কলকাতা বা বোম্বে যেখানেই হোক এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাকে চিরকালই ফাইট করতে হয়েছে, সেইজন্যই মনে মনে অনেক বিটারনেস জমেছে। তবে সেইসব যুদ্ধে আমি হেরে গেছি তা বোধহয় সত্যি নয়। সত্যি হলে নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত আমিই গায়ক হিসেবে নির্বাচিত হতাম না। একে নয়, ওকে দিয়ে গাওয়ার ইত্যাদি ধরনের কথাবার্তা সিনেমা জগতেই চালু আছে, চিরকালই ছিল। কত উদাহরণ দেব! ‘বসন্তবাহার’ ছবিতে মিউজিক ডিরেক্টর শঙ্কর-জয়কিষাণ যখন ‘সুর না সাজে, কেয়া গাঁউ ম্যায়, সুর বিনা জীবন শুনা’ তৈরি করল, তখন তার ইচ্ছে গানটা আমিই গাই, কিন্তু অন্যদের অন্য ইচ্ছে। প্রবল মতবিরোধ। কারণ তার আগে রফি একটা বিরাট হিট গান গেয়েছে। তখনকার দিনে হিন্দি সিনেমার একজন টপ হিরো ভারতভূষণের মুখে নৌশাদের সুরে সেই গানটা ছিল ‘মন তড়পত হ্যায় হরি দরশন লিয়ে’, ছবি ‘বৈজুবাওরা’। এখন ঘটনা হচ্ছে ‘বসন্তবাহার’ ছবিটা ছিল ভারতভূষণের দাদা শশীভূষণের। সে শঙ্কর-জয়কিষাণকে বলল ‘না না এই গানটাও মহম্মদ রফিই গাইবে।’ কিন্তু সঙ্গীত পরিচালক একেবারে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়, সে বলল— ‘ইয়ে গানা হাম মান্না ডে সে গাওয়েঙ্গে’, শশীভূষণ বলল, ‘কিঁউ ভাই, ইয়ে গানা মহম্মদ রফি নেহি গা শেকতে?’। জবাবে সুরকার, সঙ্গীত-পরিচালক শঙ্কর, যে গানটা তৈরি করেছিল সে বলেছিল, ‘নেহি গা শেকতে, হাম জিস ঢঙসে চাহতে হেঁ নেহি গা শেকতে।’ তা এমন করে প্রযোজকের মুখের ওপর বলার মতো গাটস কটা লোকের থাকে?

শচীনদা, একবার করেছিলেন এমন কাণ্ড। ‘বাত এক রাত কি’ ছবিতে একটা গান ছিল ‘আরে, কিসনে ছিলমন সে মারা মুঝে’। গানটা তৈরি করার পর শচীনদা বললেন, ‘এ তো মান্নার গান, মান্না গাইবে’। গানটা ছিল জনি ওয়াকারের মুখে, তার মুখে রফির অনেক হিট গান আছে। সে শুনে বলল— ‘ইয়ে ক্যায়সে?’ হামারা গানা তো রফিসাব গাহতে হেঁ, রফিসাব গায়েঙ্গে।’ শচীনদা নির্বিকার। বললেন— ‘রফিসাব গাইবে না, এটা মান্নার গান, মান্নাই গাইবে।’ জনি ওয়াকার কথাটা মানল না, সে ছুটে গেল প্রাোডিউসারের কাছে। প্রাোডিউসার ছিল জ্ঞান মুখার্জির ভাই। সেখানে গিয়ে জনি ওয়াকার বলল— ‘ভাই হামারে ইয়ে গান মান্না দে গানে সে হাম নেহি গায়েঙ্গে, রফিসাব সে গানা গাওয়াও।’ প্রাোডিউসার ছুটে এসে শচীনদাকে বললে—’উনি ওয়াকার এ কী বলছে’। তখন শচীনদা সোজা তার মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘তাহলে এক কাজ করো, তোমার রফি মিয়াঁকে দিয়েই গানটা করাও, আর মিউজিক ডিরেক্টরও অন্য লোককে নিও, আমি করব না এই ছবির সুর।’ শেষ পর্যন্ত কিন্তু গানটা আমিই গেয়েছিলাম।

এত কথা কেন এসে গেল তার নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে। ‘শঙ্খবেলা’ ছবির একটা গান ছিল একেবারে নায়কের গলায় রোমান্টিক গান। ডুয়েট গান। সঙ্গে নায়িকার গলায় গানটি লতাকে দিয়েই গাওয়াতে চান— এমন বলেছিলেন সুধীনবাবু। কিন্তু কাজটা সহজে ঘটেনি। ‘শঙ্খবেলা’ ছবিটার জন্য সুধীন যখন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন বাংলা ছবির অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সুধীনের সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিলেন। একে উত্তমবাবুর মুখে গান, তার ওপর রোমান্টিক গান, কী করে এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন উনি ইত্যাদি ধরনের কথা হয়েছিল। শুনেছিলাম স্বয়ং উত্তমকুমারও নাকি প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ওঁকে বুঝিয়ে বলেছিলেন সুধীন নিজেই। পরে অবশ্য গানের রেকর্ডিং শুনে উনি খুশিই হয়েছিলেন বলে শুনেছি।

তখনকার দিনে বম্বেতে যখন-তখন রেকর্ডিং করানো যেত না। স্টুডিওর ডেট পাওয়া রীতিমতো সমস্যা ছিল। অ্যাডভান্সড বুকিং থাকত। লতাকে গাওয়াতে রাজি করেছিলাম আমিই। গানের রিহার্সাল পর্ব পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, কী করে এবং কেন শেষ পর্যন্ত গান দুটো আমিই গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তা কিন্তু আমি নিজেই জানি না। বোধহয় সুধীনবাবুর নিজের সিদ্ধান্তই বড় ভূমিকা নিয়েছিল।

তবে বিঘ্ন ঘটেছিল অনেক। বহু চেষ্টার পর একটা স্টুডিওর ডেট পাওয়া গেল। কিন্তু সেই দিনই লতার শরীর খারাপ হয়ে পড়ল। আর কোনও ডেট পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই সুধীনের পক্ষে দিনের পর দিন বম্বেতে বসে থাকা সম্ভব নয়। অবশেষে মেহবুব স্টুডিওর সাউন্ড-রেকর্ডিস্ট কৌশিকসাহেব নৌশাদের একটা রেকর্ডিংয়ের দিনের খবর দিলেন। নৌশাদসাহেব খুবই উদার চরিত্রের মানুষ ছিলেন, অন্যের সুবিধা-অসুবিধার কথাও ভাবতেন। ওঁর একটা জরুরি রেকর্ডিং ছিল এবং সেটা শুরুর সময় সকাল ১১টা, জানালেন তার আগে আমাদের রেকর্ডিং শেষ হলে তাঁর আপত্তি নেই। লতাকেও সেই অনুযায়ী স্টুডিওতে আসতে অনুরোধ করলাম। মিউজিশিয়ানরাও আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই যে গানটা আমি আর লতা একটা টেক-এ ও কে করে দিয়েছিলাম।

নৌশাদসাহেব তো গানটা শুনে খুব খুশি, বলেছিলেন— ‘বেহেতরিন গায়া আপনে মান্না দে সাব! অ্যায়সা হিন্দি গানা কিঁউ নেহি হোতে।’

সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে তো আপনি বহুদিন ধরে নানা ধরনের কাজ করেছেন…

মান্না দে: হ্যাঁ, বেসিক রেকর্ড, সিনেমার গান ছাড়া ছোটদের গীতিনাট্যেও গান গেয়েছি। পারস্পরিক সম্মান, শুভেচ্ছার সম্পর্ক ছিল, হি ওয়াজ এ নাইস পার্সন। আবার বলি, বাংলা গানের গায়ক হিসেবে আমার জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে সুধীনের অবদান আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই মনে রেখেছি।

শেষ কথা হিসেবে কিছু বলবেন?

মান্না দে: শেষ কথা হিসেবে আলাদা করে আর কী-ই বা বলব! বলতে গেলে তো সেই ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’-এর কথাই বলতে হয়। আমার কাকা, আমার চিরজীবনের গুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে মারা গিয়েছিলেন ১৯৬২-র নভেম্বরে (২৮ নভেম্বর)। তিনি যখন প্রায় মৃত্যুশয্যায়, তখন তিনি প্রায়ই গানটা শুনতে চাইতেন, বলতেন— ‘মান্নার ওই শেষ বিচারের আশায় গানটা লাগিয়ে দাও তো’। শেষ বিচারের আশাতেই তো আমাদের বসে থাকতে হয়। এই জীবনের পাওনা-দেনা সবই তখন তুচ্ছ। সুধীনবাবুর ‘শেষ বিচারের আশায়’ গানটা আমার জীবনের হাসি-কান্নার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে।

***
শ্রদ্ধেয় মান্না দে-র এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল গত ৮ জুলাই, ২০০৮ শিল্পীর কলকাতার বাড়িতে (৯ মদন ঘোষ লেন, কলকাতা-৭০০০০৬)। আজকাল-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন অলক চট্টোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *