ওঁর মতো হৃদয়বান মানুষ আমি দেখিনি – মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্ত
কাজটা কঠিন। যখনই ভেবেছি ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি লিখে রাখব, তখনই সমস্যায় পড়েছি। আমি লেখক নই। সুধীন দাশগুপ্তর স্ত্রী হিসেবে গলা উঁচু করে বলার মতো গানবাজনার মানুষও নই। অনেক কথা আজ ভুলে গেছি, তবু যে-সব কথা কখনও ভোলা যায় না তা যেন সাঁঝপ্রহরের আলোর মতো, মনের মধ্যে কাছে-দূরে জ্বলেই থাকে।
আমার সঙ্গে সুধীন দাশগুপ্তর যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমার বয়েস বেশ কম। অতবড় একজন ব্যক্তিত্বকে জানা বা বোঝার অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি-বিবেচনা আমার ছিল না। কিন্তু কিছুই অসুবিধে হয়নি। সেটা ওঁরই জন্য। খুব সহজ কথায় বলতে গেলে, আচার-ব্যবহার, চিন্তা-ভাবনা, পরিবেশ-পরিস্থিতি সব কিছুর সঙ্গে ঠিক কী করে মানিয়ে নিতে হবে তাঁর শিক্ষা আমি ওঁর কাছেই পেয়েছিলাম।
গানের মানুষের সঙ্গে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মা। আমার মা গানের মানুষ ছিলেন। চমৎকার গান গাইতেন। শচীন দেববর্মণের স্ত্রী মীরা দেববর্মণ আর আমার মা একদা একই প্রতিযোগিতায় গান করেছিলেন। সেই সময় আমার মায়ের নাম ছিল মীরা রায় বা জ্যোৎস্না রায়। মায়ের গানের গলা ছিল চমৎকার। কিন্তু শেষ অবধি মায়ের গায়িকা-জীবন দীর্ঘ হয়নি। সংসার সামলাতে হয়েছে। আমরা জেঠামশাইয়ের কাছে মানুষ হয়েছি। জেঠামশাইয়ের তিন মেয়ে, দুই ছেলে এবং আমরা। সব মিলে আট ভাইবোনের একসঙ্গে বড় হওয়া। মা গান ভালবাসতেন বলে একজন সঙ্গীত-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন।
যেমন হয় আর কি! সুধীন দাশগুপ্ত একজন সঙ্গীত পরিচালক, সিনেমার লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা। সমস্ত দিনের শেষে আর পাঁচজন চাকরিজীবীর মতো বাড়ি ফিরে আসবেন না। এসব নিয়েও আমাদের পরিবারে মৃদু আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্তই ছিল শেষ কথা। সেই বয়সে যে-কোনও মেয়ের পক্ষে যা ভাবা স্বাভাবিক তা-ই ভাবতাম। প্রবল কৌতূহল ছিল সিনেমা সম্পর্কে। তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ওঁরও ছবি বেরোত। অধিকাংশই সিনেমার গান রেকর্ডিংয়ের দৃশ্য অথবা পরিচালক বা নায়ক-নায়িকার সঙ্গে সিনেমার গান নিয়ে কথাবার্তার ছবি। ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় ওঁর ছবিও দেখে ফেলেছিলাম বিয়ের আগে। অনুজ্জ্বল গায়ের রঙ। রোগাটে চেহারা। কিন্তু কোনও অপছন্দের প্রশ্ন তো ছিলই না। বিয়ের পর ওঁর ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা ও আন্তরিকতায় একেবারেই মুগ্ধ হয়েছিলাম।
খুবই কম কথা বলতেন, কিন্তু যা বলতেন, যেভাবে বলতেন, তাতে তাঁর আশ্চর্য বাক-দক্ষতা ও পরিমিতিবোধের পরিচয় থাকত। আমি চিঠি লিখতাম তিন পাতায়, উনি সেই চিঠির বক্তব্যই লিখতেন মাত্র কয়েকটা লাইনে। সব সময় নিজের গান নিয়েই মগ্ন থাকতেন। সুর বা গান তৈরি নিয়েই যে ভাবছেন, তা ওঁর চোখমুখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত। ব্যস্ত, সংসারের কাজে সময় দিতে পারছেন না, কিন্তু তা নিয়ে অভিযোগ করতে পারতাম না কিছুতেই। ইচ্ছে করে সংসারের কাজে অবহেলা করতেন না। যখনই সময় পেতেন পারিবারিক কাজকর্মও করতেন। ছেলেমেয়েদের খবর নিতেন। এমনকি আত্মীয়স্বজনদের খবরও রাখতেন। কখনও কখনও আমরাই ভাগ করে নিতাম যোগাযোগের দায়িত্ব। উনি না পারলে আমি যেতাম। বাড়িতে প্রচুর লোকজনের যাতায়াত ছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই রীতিমতো বিখ্যাত। তাতে আমার কোনও অসুবিধে হত না, তার কারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে আমি চিরকালই পছন্দ করতাম। আজ মনে হয়, ছোটবেলায় যৌথ পরিবারে অনেক ভাইবোনের সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছিলাম বলেই হয়ত এই অভ্যেসটা তৈরি হয়েছিল। আমাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৫৮ সালের ২৮ জুন। বিয়ের আগেই ওঁর সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত-পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া হয়ে গেছে। সুতরাং, বিয়ের পরদিন থেকেই আমাদের সেই সিঁথির ১৯ নম্বর ডি গুপ্ত লেনের বাড়িতে বিখ্যাত মানুষদের আসা-যাওয়া।
বিয়ের আগে আমরা থাকতাম মাত্র দুটো ঘরের একটা বাড়িতে। বিয়ের পরে এসে পড়লাম একটা বড় দোতলা বাড়িতে। পারিবারিক সংস্কৃতি যে আলাদা হয়, তা উনি আমায় প্রায় হাতে ধরে বুঝিয়েছিলেন। বেঁচে থাকতে গেলে অনেক কিছু শিখে নিতে হয়। সেই শিক্ষায় উনি আমায় সাহায্য করেছিলেন। উনি যেমন ভালবাসতেন, তেমন স্নেহও করতেন। যেন আমি সত্যিই অনেক ছোট একটা মেয়ে। ওঁর চরিত্রেই একধরনের যত্ন ছিল। ইংরেজিতে বলতে পারি— truely a caring person. সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তার কারণ, টালিগঞ্জ থেকে সিঁথির দূরত্ব অনেক। স্টুডিওর কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা। সিঁথির বাড়িতে জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল আমাদের। কিন্তু অনেক মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ঘরও ছিল। আমাদের বেডরুমটা ছিল বেশ বড়। আর তারও চেয়ে বড় ছিল ওঁর মিউজিকরুম।
উনি চলে গেছেন ১৯৮২-র ১০ জানুয়ারি, সেরিব্রাল অ্যাটাকে। মাঝখানে এতগুলো বছর চলে গেছে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমার আজও মনে হয় ওঁর মতো আন্তরিক, হৃদয়বান এবং একই সঙ্গে ভদ্র ও বিবেচক মানুষ আমি আর দেখিনি। হয়ত তত বড় কিছু বলার মতো নয়, তবু কথাটা তো সত্যি যে আমিও ছোটবেলায় অল্পবিস্তর গানের চর্চা করেছিলাম। বিয়ের আগে কিছুদিন শ্যামলদার (শ্যামল মিত্র) কাছেও গান শিখেছিলাম। বিয়ের পরেই একদিন উনি আমাকে পরিষ্কার বলে দিলেন— ‘একই বাড়িতে দুটো হারমোনিয়াম থাকা চলে না।’ সেই মুহূর্তে কথাটার মানে ঠিক বুঝিনি। কিন্তু উনি শান্তভাবে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গীত-শিক্ষা যদি কোনওদিন আমার উচ্চাভিলাষের সঙ্গী হয়, তাহলে আমার রেডিওতে গান গাওয়া বা সিনেমায় গান গাওয়া বা রেকর্ড-ক্যাসেট করার প্রশ্নগুলোও উঠবে। কিন্তু যোগ্যতার নির্ভুল বিচারে সঙ্গীত-পরিচালক, সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত হয়ত আমাকে সেই সুযোগ দিতে পারবেন না।
কিন্তু কেন একজন মানুষকে আশ্চর্য হৃদয়বান বলছি তা-ও বোধহয় পাঠকদের জানা প্রয়োজন। আমি যত সাধারণই হই না কেন, আমিও একজন শ্রোতা, গান শোনার কান আছে, পরিবেশ-পরিস্থিতি মূল্যায়নেরও কমবেশি যোগ্যতা আছে তা কিন্তু উনি কখনও অস্বীকার করেননি। বরং উল্টে বহুদিন বহু ছবির কাজের জন্যে যে মিউজিক তৈরি করছেন, তা আমাকে ডেকে শোনাতেন।
সেই মুহূর্তগুলো আজও স্মৃতির মধ্যে জেগে আছে। ডেকে নিয়ে যেতেন ওঁর গানের ঘরে। সিঁথির বাড়িতে বা আমাদের এই ডোভার কোর্ট-এও। সিনেমার গল্পটা বলতেন, দৃশ্যটা বুঝিয়ে দিতেন। তারপরে ব্যাকগ্রাউন্ডে কী মিউজিক বাজানো হবে, সেটা বাজিয়ে শোনাতেন। আমি অবাক হয়ে শুনতাম। কোনওদিন কোনও ছবির মিউজিকই আমার অপছন্দ হয়নি এবং সেটা উনি আমার স্বামী বা উনি স্বয়ং সুধীন দাশগুপ্ত বলেই নয়। এক অর্থে আমার মতো ভাগ্যবান কতজন আছেন? কত গানের সৃষ্টি-মুহূর্তের সাক্ষী আমি, তা তো আমিই জানি। কতরকম যন্ত্রই যে বাজাতে পারতেন! এ কথা আজ আলাদা করে বলার বোধহয় কোনও প্রয়োজনই নেই। সকলেই তা জেনে গেছেন। যখন সেতার বাজাতেন, তখন মনে হত উনি ওই কাজটাই করেন। অর্থাৎ সর্বত্র নিয়মিত সেতারবাদক। আবার যখন একা ঘরে, সামনে একটা গান লেখার কাগজ রয়েছে বা নেই, একমনে পিয়ানো বাজাচ্ছেন তখন মনে হত উনি শুধু ওই কাজটাই করে থাকেন। খেয়াল থাকত না কিছু। কতদিন যে নিঃশব্দে আমি পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি এবং শুনছি তা বুঝতেন অনেক পরে।
বাচ্চাদের ভালবাসতেন খুব। ভাইপো-ভাইঝিরা ওঁর সঙ্গে একেবারে সমবয়সী বন্ধুর মতো ব্যবহার করত। চুল ঘেঁটে দিত, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী মাথা আঁচড়ে দিত, পোশাক-পরিচ্ছদে শৌখিন মানুষটার জামা-কাপড় ধরেও টানাটানি করত। উনি ওদের দুষ্টুমিতে কক্ষনো কিছু বলতেন না, বিরক্তও হতেন না। মজা করে ছড়া লিখতেন বাচ্চাদের জন্য। ওরা ওঁকে বলত ‘ছোটকাকা’ অথবা ‘গানকাকা’। কিন্তু ওরাও বুঝত ছোটকাকা যখন নিজের কাজ করছে, তখন বিরক্ত করতে নেই। আর একটা কথা, একজন মানুষ ঠিক কেমন তা বোঝার জন্যে বোধহয় সবরকম পরিস্থিতিতে তাকে দেখতে হয়। আদ্যপান্ত রুচিবান ও শিল্পিতস্বভাবের মানুষ ছিলেন। সময় পেলে হাতের কাছে থাকা বাঁশের টুকরো, কাঠের টুকরোকে নানারকম চেহারা দিতেন যা দেখে অনেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। বেসিক রেকর্ড বা সিনেমার গান হিট হলেও আলাদা করে কিছু বলতেন না। ভাল না হলে বা জনপ্রিয় না হলেও কিছু বলতেন না। জীবনে কখনও উত্তেজিত হতে দেখিনি। কথাবার্তাও ছোট, চিঠিও ছোট। টেলিফোনে যে-কথা, তা-ও যথারীতি খুবই সংক্ষিপ্ত হত।
আগে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, এমনকি এখনও করেন যে, ঠিক কেমন গান গাইতেন সুধীনদা? আমি বলব, অতুলনীয়। গানের গলাটা একটু চাপা ছিল ঠিকই কিন্তু expression ছিল অসাধারণ। ওঁর বন্ধুদের কেউ কেউ কোনও রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পরে বলতেন, ওই গানটা উনি নিজে গাইলে নাকি অনেক ভাল হত। একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিতে অনেক লোকসঙ্গীত ছিল। গেয়েছিলেন অমর পাল। অমরদা অসাধারণ শিল্পী সকলেই জানেন। কিন্তু গান রেকর্ডিংয়ের পর ছবির পরিচালক দিলীপদা (দিলীপ রায়) আমাদের বাড়িতে এসে বলেছিলেন— সুধীনের গলায় গানগুলো শুনলে মনে হয়, গানগুলো ওই-ই গাইলে ভাল হত, তোমার কী মনে হয় ‘বদ্যিনী’? দিলীপদা আমাকে মজা করে ‘বদ্যিনী’ বলে ডাকেন। সম্পর্কের সহজ হিসেব— বদ্যির বউ বদ্যিনী। ওঁর গান লেখার বৈশিষ্ট্য, সুরের বৈচিত্র্য নিয়ে যা বলার তা তো বিশেষজ্ঞরা লিখবেন বা বলবেন। আমি শুধু একটা কথা বলব, আজকের দিনে বাংলার অনেক প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন ছেলেমেয়ে উপযুক্ত পথ-দেখানো সুরকার বা সঙ্গীত-পরিচালকের সন্ধান পাচ্ছে না। উনি অকালে চলে না গেলে হয়ত তারা উপকৃত হত।
ওঁর স্ত্রী হিসেবে অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যা আমার পক্ষে অকল্পনীয় ছিল। ছবির শুটিং দেখতে যেতাম, অনেক রেকর্ডিংয়েও গেছি। বম্বেতে গেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। অনেক দুর্লভ মুহূর্তের সাক্ষী আমি। মনে পড়ছে ‘শঙ্খবেলা’ ছবির গানের রেকর্ডিংয়ের পর সঙ্গীত-পরিচালক নৌশাদ এসে যখন মান্না দে, লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এবং ওঁর সঙ্গীত-পরিচালনার প্রশংসা করেছিলেন, সেই মুহূর্তে আমার অসম্ভব আনন্দ এবং গর্ব হয়েছিল। ওঁর কোনও প্রতিক্রিয়া অবশ্য বুঝতে পারিনি। বাড়িতে সর্বদা গানের প্রসঙ্গ আলোচনা হত এমন কথা বলতে পারি না। কখনও কখনও যা বলতেন, তা খুবই সংক্ষিপ্ত।
গানের সঙ্গে রান্নার কী সম্পর্ক তা জানি না, বোধহয় কোনও একটা সম্পর্ক আছে। মেজাজ, পরিমাণ, ইচ্ছে— অনেকগুলো বস্তু একসঙ্গে মিশে যায় বোধহয়। শুনেছি, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি ও তাঁর ভাই উস্তাদ বরকত আলি খাঁ— দুজনেই চমৎকার রান্না করতে পারতেন। এবং তাঁদের বাড়িতে কেউ গেলে না-খাইয়ে ছাড়তেন না। সঙ্গীত-পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তও মাঝে মাঝে বাড়িতে রান্না করতেন। নিতান্তই শখের রান্না। কিন্তু সেখানেও ওঁর দক্ষতার পরিচয় থাকত।
নিজের গান নিয়ে একেবারে কখনও চিন্তিত হতেন না, তা বোধহয় সত্যি নয়। মনে পড়ছে একবার পুজোর গানের পরে, তখন আমরা সিঁথির বাড়িতে থাকি, গানটি কেমন জনপ্রিয় হবে তা নিয়ে চিন্তায় আছেন। কিন্তু যা অভ্যেস, কাউকেই মুখে কিছু বলছেন না। দোতলায় সামনের বারান্দায় পায়চারি করছেন। আমি জিজ্ঞেস করছি— বারান্দায় পায়চারি করছ কেন? কোনও উত্তর নেই। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, মুখে মৃদু হাসি। গানের ঘরে ঢুকে বললেন— ‘পাশের বাড়ির বাচ্চাগুলো গানটা গাইছে কিনা শুনছিলাম। রেডিওতে তো পুজোর গান বাজানো শুরু হয়ে গেছে। ওদের পছন্দ না হলে কি ওরা গানগুলো গাইত?’ ঠিক কোন গান প্রসঙ্গে কথাটা বলেছিলেন সেই স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। তবে যতদূর মনে পড়ছে গানটা ছিল শ্যামলদার গাওয়া ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে?’ অন্য গানটা বোধহয় ‘নাম রেখেছি বনলতা…’। ছোটবেলায় খেলাধুলো করতেন— হকি, ব্যাডমিন্টন। ব্যাডমিন্টন খেলায় তো বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। পরিশ্রম করতে পারতেন। একবার কোনও একটা রেকর্ডিংয়ে গিয়ে সারারাত একাসনে একভাবে বসে সেতার বাজিয়েছিলেন। খুব একটা অসুস্থ হতে কখনও দেখিনি। বরং আমি একবার গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলাম উনি চলে যাওয়ার আগে ১৯৮১-তে। ওঁর চলে যাওয়াটা একেবারেই হঠাৎ যাওয়া।
আমাদের দেশে বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে নানাধরনের কথাবার্তা প্রচারিত হয়। কিন্তু খুব কম মানুষই সেইসব প্রচারের সত্যতা নিয়ে মাথা ঘামান। সুধীন দাশগুপ্তকে পছন্দ করতেন না এমন কোনও গানবাজনার মানুষ আমি দেখিনি। জানিও না। হেমন্তদা, মান্নাদার মতো সিনিয়র আর্টিস্টরাও ওঁকে ভালবাসতেন, যথেষ্ট সম্মান করতেন। চিঠিপত্রে-ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ওঁদের। কারও কারও মুখে শুনেছি সলিল চৌধুরির সঙ্গে নাকি ওঁর সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল। আমার অভিজ্ঞতা ঠিক উল্টো। উভয়ে উভয়ের গুণগ্রাহী ছিলেন। গানের সঙ্গে বাজনা, গান লেখা, বেসিক রেকর্ডের গান, সিনেমার সঙ্গীত-পরিচালনা, স্বদেশি উচ্চাঙ্গসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কে জানা এবং তা সার্থকভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা থাকা এমন দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকাই স্বাভাবিক ছিল। কোনও গান বা কোনও ঘটনা নিয়ে ওঁদের মধ্যে কোনও বিতর্ক হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তা যে সম্পর্ক নষ্ট করেছিল— এমন আমি শুনিনি, জানিও না। তাছাড়া দুজনেই আই পি টি এ-র গানের মানুষ। ওঁদের মধ্যে আদর্শ ও সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনারও মিল। ওঁর দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সলিলদার যথেষ্ট আস্থা ছিল। সলিলদার সঙ্গে ওঁর টেলিফোনে ও চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল চিরকালই। কী উদ্দেশ্যে ওঁদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ভাল না থাকার গুজব রটানো হয়েছিল তা আমি তখনও বুঝিনি, আজও বুঝি না।
বিয়ের পরই শুনেছিলাম সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁকে একেবারে সন্তানের মতো স্নেহ করেন। ‘ডাকহরকরা’ ছবির সময় থেকেই এই সম্পর্কের শুরু। একটা মজার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। দুজনে নিউমার্কেটে গিয়েছি, উদ্দেশ্য সোয়েটার কেনা। সেটা কিনে আর কী কেনা যায় তার জন্য এদিক-ওদিক দেখছি। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন— ‘শিগগির চলো।’ আমি অবাক, কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি হাত ধরে আমাকে মার্কেটের বাইরে নিয়ে এসে একটা ট্যাক্সিতে তুললেন। তাড়াহুড়োয় আমার হাতের সোয়েটারটা গেল পড়ে। তাতেও কিন্তু শেষরক্ষা হল না। উনি ট্যাক্সিতে উঠতেই দেখলাম একজন প্রবীণ মানুষ হাতের লাঠি উঁচিয়ে ওঁকে বলছেন— ‘তোর যে আসার কথা ছিল, আসিসনি কেন?’ তিনিই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
উনি চলে যাওয়ার পর ঠিক কীভাবে আমার জীবন কেটেছে তা নিয়ে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আজ আর সে-সব কথা সাতকাহন করে বলতে ইচ্ছে করে না। শুধু বলতে পারি, সুধীন দাশগুপ্তর স্ত্রী হয়েও আমাকে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। ছেলেমেয়ে (সৌম্য ও সাবেরী) ছোট ছিল। তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নও ছিল। যতদিন উনি ছিলেন ওঁর মনের জোর দেখে অবাক হয়ে যেতাম। পাশাপাশি বেঁচে থাকতে থাকতে সেই মানসিক শক্তি আমার মধ্যেও বোধহয় কিছুটা সংক্রামিত হয়েছিল। সঙ্গী ছিল স্মৃতি, ওঁর লেখা সেইসব আশ্চর্য গান আর মনের মধ্যে ওঁর সুরের আসা-যাওয়া।
অসময়ে চলে গেলেও যা দিয়ে গেছেন তা ভুলতে পারি না। পারিবারিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ নিয়েই ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। সঙ্গীত আছে ওদের মধ্যেও। সৌম্য পেশায় আর্কিটেক্ট, বিদেশে থাকে। দক্ষ হাতে গিটার বাজায়। মেয়ে সাবেরী একদা পিয়ানো বাজাত, এখন সে একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার। নিতান্তই ব্যস্ত। বাড়িতে আগের মতো লোকজনের উপস্থিতি নেই ঠিকই, কিন্তু যাঁরা আসেন, তাঁদের সুধীন দাশগুপ্ত সম্পর্কে শ্রদ্ধাসিক্ত আগ্রহ ও ভালবাসা আমাকে বাস্তবে ও মনে মনে ওঁর ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। চিরকালই দেবে।