ভাঙাতরীর সেই গান আজও গেয়ে চলেছি – দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

ভাঙাতরীর সেই গান আজও গেয়ে চলেছি – দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

জীবনের অনেকদিন পেরিয়ে গেলে যা হয়, কোনও একটা বিশেষ দিনকে আর স্মৃতিতে ধরে রাখা যায় না। সুধীনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটাও তাই আজ আর ঠিক মনে পড়ছে না। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকেই হবে। গ্রামোফোন কোম্পানিতে গেছি। গমনের উদ্দেশ্য পুজোর গান। কোন গান, কে লিখেছেন, কে সুর দেবেন কিছুই জানি না। শিল্পী হিসেবে আমারও তখন পথচলা শুরুর দিন। সুতরাং উদ্বেগ যথেষ্টই ছিল।

এইচ এম ভি-র অফিস তখন ছিল ৩এ নলিনী সরকার স্ট্রিটে। অনেক শিল্পীর ভিড় সেখানে। যেন গানের বাজার। মন দিয়ে, বুঝে গান পছন্দ করতে হবে। শিল্পীদের রিহার্সাল রুমের যিনি রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন, তাঁর নাম ছিল ক্ষিতীশ বসু। অভিজ্ঞ সঙ্গীতরসিক মানুষ। তিনি হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন— ‘দ্বিজেনবাবু, একজন লন্ডন থেকে এসেছেন, ওয়েস্টার্ন মিউজিকে সুপণ্ডিত, তারও চেয়ে বড় কথা উনি একজন ভাল সুরকার। তা আপনি ওঁর কয়েকটা গান শুনুন না! পছন্দ হলে পুজোর গানও হতে পারে।’ আমি রাজি হতেই ক্ষিতীশবাবু তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলেন। অল্প বয়স, গায়ের রঙ কালো, ছিপছিপে চেহারা, চোখে চশমা, প্যান্ট-শার্ট পরা। আমি বললাম— ‘তা হলে চলুন ঘরে গিয়ে বসে আপনার গান শুনি।’ শান্ত মানুষটিও মাথা নেড়ে গানের ঘরে পৌঁছলেন। গান শুরু হওয়ার আগে আমি বললাম— ‘শুনলাম আপনি দীর্ঘদিন লন্ডনে ছিলেন…’, তিনি অবাক হয়ে বললেন— ‘কে বলল? কথাটা তো ঠিক নয়।’ — ‘এই যে ক্ষিতীশবাবু বললেন’, সামান্য হেসে তিনি বললেন— ‘আপনি ভুল শুনেছেন, ‘লন্ডন স্কুল অফ মিউজিক’ থেকে আমার ওয়েস্টার্ন মিউজিক শিক্ষার একটা ডিগ্রি আছে, তার বেশি কিছু নয়।’ এবার হাসির পালা আমার, বললাম— ‘যাক ওটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, আপনার তৈরি গানগুলো শুনি, বুঝতেই পারছেন পুজোর গান নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি…’।

তা খুবই সহজভঙ্গিতে সুধীন আমাকে পরপর কয়েকটা গান শোনাল। একটা গান খুব পছন্দ হতে পরপর তিনবার শুনলাম, সেই গানটিই হল— ‘ভাঙাতরীর শুধু এ গান’। আমাদেরই আর এক বন্ধু ভাস্কর বসুর লেখা। একটা গান তো হল, আর একটা? তখন তো সেই ছোট থালার মতো রেকর্ড, দুই পিঠে দুটো গান। ততক্ষণে সুধীন আমার সঙ্গে কথাবার্তায় একটু সহজ হয়ে গেছে। মনে আছে দ্বিতীয় গানটা পছন্দের আগে সুধীন বলেছিল— ‘এই গানটা… আমার খুব ইচ্ছে আপনিই এই গানটা গাইবেন, ধরে নিন এটা আপনি আমারই ইচ্ছেয় গাইছেন।’ গানটা গাইল— ‘এই ছায়া ঘেরা কালো রাতে’। গানটা শুনেই আমিও বললাম— ‘ব্যস, done!’

আগেই লিখেছি, গানের তথ্য, সন-তারিখ এখন আর সেইভাবে মনে থাকে না। দুটো মত আছে, প্রথম মতে আমার রেকর্ডটাই সুধীনের পুজোর গানে প্রথম সুর দেওয়া। আবার পরে শুনেছিলাম, ভাঙাতরী সুরে ভাসিয়ে দেওয়ার আগেই সুধীন নাকি বেচু দত্তের গাওয়া একটা গানেরও সুরকার ছিল।

দুই

গভীর বন্ধুত্বের সেই শুরু। চিরকাল যা বলে এসেছি, আজও তা-ই লিখছি। মানুষ হিসেবে সুধীনের কোনও তুলনা ছিল না। ভদ্র, বিনয়ী, শান্তশিষ্ট, খুবই কম কথা বলত। ওর কথা ছিল ওর সুরে। ওয়েস্টার্ন মিউজিকে সত্যিই পণ্ডিত ছিল। একই সঙ্গে আমাদের দেশজ ফোক ও শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সম্পর্কে ওর পরিষ্কার ধ্যান-ধারণা ছিল।

পাঠকদের মনে হতেই পারে যে, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল বলে হয়ত বেশি প্রশংসা করে ফেলছি। যদি কেউ এমন ভাবেন তাঁকে আমি উল্টে প্রশ্ন করতে চাই। যিনি দক্ষতার সঙ্গে ম্যান্ডোলিন, পিকলু, স্প্যানিশ গিটার, পিয়ানো, এস্রাজ বাজাতে পারেন, গান লিখতে পারেন, অসাধারণ সুরও করতে পারেন, তাঁকে কী বলা যায়? কত রকম যন্ত্রই যে সে বাজাতে পারত! এখনও মনে আছে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে সুধীন আমার গানের সঙ্গে ম্যান্ডোলিন বাজিয়েছিল। অনেক, অনেকদিন আমরা একসঙ্গে আড্ডার আনন্দে কাটিয়েছি।

আমাদের একটা আড্ডা গোষ্ঠী ছিল। তার প্রধান পান্ডা ছিল জহুরী ‘বি সরকার’ কোম্পানির কর্ণধার বীরেশ্বর সরকার। ওর একটা বিশাল হাডসন গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতে আমরা চার-পাঁচজন মিলে মাঝে মাঝেই এদিক-ওদিক বেড়াতে চলে যেতাম। মনে আছে একবার আমরা বেনারস পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। সেই সব উল্লাসযাত্রায় সব সময় বীরেশ্বর নিজেই গাড়ি চালাত। রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই ওভারটেক করছে, গাড়ির স্পিড কখনও আশি, কখনও একশো। কয়েকবার ধাক্কা মারতে মারতে বেঁচে গিয়েছিল। আমার ফাংশন আছে, কী করে যাব, নেতা বীরেশ্বর ঠিক করে ফেলল— ‘ঠিক আছে তোকে প্লেনে ফেরত পাঠাব, এখন তো চল।’ একই সঙ্গে ফিরেছিল সুধীনও।

গানের কথায় ফিরে আসি। ১৯৫৪-তে ‘ভাঙাতরীর শুধু এ গান’ প্রকাশিত হওয়ার পর শিল্পী হিসেবে যেন আমার কদর অনেকখানি বেড়ে গেল। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই গানটা গাইতে হচ্ছে। অথচ আমি আজও মনে করি ভাঙাতরী-কে অমর করে রেখেছে ভাস্করের লেখা আর সুধীনের সুর, আমার ভূমিকা সেখানে ততটা উজ্জ্বল নয়। তার আগে আমি জনপ্রিয় গান যে গাইনি তা নয়, যেমন সলিলের কথা ও সুরে ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’ গেয়েছিলাম ১৯৫২-তে, সেটাও খুবই হিট হয়েছিল। কিন্তু ‘ভাঙাতরী’ আর ‘ছায়া ঘেরা কালো রাতে’-র সাফল্যের নিরিখে আমাকে একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। তারপরেও সুধীনের সুরে আরও কিছু গান গেয়েছি কিন্তু ভাঙাতরী-কে কোনও গান অতিক্রম করতে পারেনি।

তিন

কত শ্রোতাকে যে গানটা কাঁদিয়েছে! মনে পড়ছে ইংল্যান্ডে গিয়েছি গান করতে, প্রবাসী বাঙালি ডাক্তারদের আমন্ত্রণে। সেই অনুষ্ঠানের জায়গা ঠিক মনে পড়ছে না। তবে লন্ডনে নয়, সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে, ওদের কান্ট্রি-সাইডে। দিনের বেলা অনুষ্ঠান। হলভর্তি শ্রোতা। কয়েকটি গানের পরে অনিবার্য অনুরোধে ‘ভাঙাতরীর শুধু এ গান’ গাইতে হল। গানটা শেষ হওয়ার পর দেখি একজন মহিলা উঠে দাঁড়ালেন, তিনিও ডাক্তার, চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি জানালেন তিনি কিছু বলতে চান। তিনি এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন— ‘আমি ছোটবেলা থেকেই দ্বিজেনদার গানের ভক্ত। বিশেষ করে ওঁর ‘ভাঙাতরীর শুধু এ গান’ আমাকে বারবার কাঁদায়। এই মুহূর্তে ওঁকে দেওয়ার মতো কিছু নেই, আমি আমার গলার এই হারটাই কেবল ওঁকে দিতে পারি।’ সকলেই প্রবল জোরে হাততালি দিলেন। আমি মাইকে বললাম— ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। সেই সফরে আমার স্ত্রীও সঙ্গে গিয়েছিলেন। তাঁর দিকে হাত তুলে দেখাতে সেই ভদ্রমহিলা ইঙ্গিতটা বুঝে আমার স্ত্রীকেই হারটা পরিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা সুন্দরী ছিলেন বলে সুদৃশ্য হারটা তাঁকে চমৎকার মানিয়েছিল। কোন গান যে কার হৃদয়ের কোথায় লেগে যায় তা নিয়ে বোধহয় কিছুই বলা যায় না। সুর নিয়েই তো সুরকারদের কারবার। সলিলের সঙ্গেও সুধীনের গভীর অন্তরঙ্গতা ছিল। স্বভাবের যদিও তেমন মিল ছিল না। সলিল স্বাভাবিক নেতা, জাঁকিয়ে চলা আর কথা বলা তার অভ্যেস আর সুধীন চুপচাপ, অন্তর্মুখী মানুষ। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা অন্যস্তরের অন্তরঙ্গতা ছিল। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বম্বেতে সলিলের সুরের ছবি ‘মধুমতী’ হবে। সলিল সরাসরি সুধীনকে বলল— ‘দ্যাখ তোর ওই ‘ছায়া ঘেরা কালো রাতে’র সুরটা আমি নেব।’ বন্ধু সুধীনের আপত্তি ছিল না। সলিল গানটার লয়টা একটু বাড়িয়ে, দু-একটা জায়গায় সামান্য পাল্টে তৈরি করল ‘সুহানা সফর ইয়ে মৌসম হাসিন’। যেহেতু গানটা আমি আগে রেকর্ড করেছিলাম, সেজন্য আমিই গাইব বলে ঠিক হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আপত্তি ছিল ছবির নায়ক দিলীপকুমারের। তাঁর পছন্দের শিল্পী মুকেশকে দিয়েই শেষ পর্যন্ত গানটা গাওয়াতে হয়েছিল সলিলকে। কিন্তু গানটা যে প্রবলভাবে হিট হয়েছিল তা নিয়ে আজও কোনও সন্দেহ নেই।

চার

সেই সময়ে বন্ধুত্ব ছিল অনেকের সঙ্গেই। কিন্তু সত্যি বললে বলতে হয় প্রাণের বন্ধু ছিল তিনজন— নচি (নচিকেতা), সলিল আর সুধীন। সুধীন একেবারে অকালে চলে যাওয়াতে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। ওর ব্যক্তিগত স্মৃতি, ওর তৈরি সুর নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হল। ভোলার কোনও প্রশ্ন নেই। বোধহয় মৃত্যু অবধি সেইসব স্মৃতি আমাকে ঘিরে থাকবে, ঘুরে বেড়াবে ওর তৈরি সুর। সুধীনের সুরে বৈচিত্র্যের অভাব ছিল না। সেই পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়ে সে বাংলা গানের অনেক শিল্পীকে দিয়ে তার গান গাইয়েছিল। সেগুলোও শ্রোতাদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। কয়েকটা গান তো আলাদা করে মনে আছে। তবে সবার আগে যে গানটা মনে পড়ে, সেটি হল প্রতিমার গাওয়া ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’। একে বাংলা সাহিত্যের একজন নামী কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা, তার ওপর প্রতিমার অত ভাল গাওয়া। কিন্তু গানটার সবটা ধরে রেখেছে সুধীনের দেওয়া মর্মস্পর্শী সুর। গানটা হলেই আমি তো মনের চোখের সামনে একের পর একটা দৃশ্য দেখতে পাই।সারা জীবন এত গান তো গাইলাম কিন্তু কোনও গান ভাঙাতরী-কে অতিক্রম করেছে বলে মনে করি না। সঞ্চারীতে যখন বলেছি— ‘আমি তো এই, তুমি সুদূর/আমি চরণ কোথা নূপুর/একা তরী গেল ভেসে/কোথা বলো কোন দেশে/যা ছিল প্রেম সবই দিলেম/শুধু এ গান শুধু এ প্রাণ’ তখন শ্রোতাদের সঙ্গে সেই কথা ও সুর আমার হৃদয় গভীরভাবে স্পর্শ করে। সুধীনকে ভুলতে পারি না, ভারাক্রান্ত মনে আজও সেই গানের ভাঙাতরী বেয়ে চলেছি। মৃত্যু অবধি সেই তরী বাইতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *