‘এ পারে আমি ও পারে তুমি মধ্যে বয় উজান’ – অরুণকুমার বসু

‘এ পারে আমি ও পারে তুমি মধ্যে বয় উজান’ – অরুণকুমার বসু

সুধীন দাশগুপ্ত। ছাব্বিশ বছর পেরিয়ে গেছে মানুষটা চলে যাওয়ার পর। স্মৃতি অনেকটাই পুরনো সিন্দুকের মতো। লোহায় মরচের ক্ষত। দেওয়াল রঙচটা। চাবিও বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। ভেতরের মুদ্রাগুলো ঠান্ডা বিবর্ণ। অস্পষ্ট অক্ষরগুলো পড়া যাবে কি?

এই মানুষটির সঙ্গে গীতিরচনার কবিতাচর্চার যে যোগ আমার তৈরি হয়েছিল, সেও প্রায় ষাট বছরের পুরনো বট। পঞ্চাশের দশকে ভাস্কর বসু ছদ্মনামে ‘গীতিকার’ হওয়ার দুরাশার হাওয়া লেগেছিল গায়ে। তাই বলে, রাশি রাশি গান লিখে খাতা ভরাতে পারিনি। নির্বিচারে সুরকারদের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করিনি। শুধু নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, মৃণাল চক্রবর্তী, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র— এইরকম ক’জনের বৃত্তেই আটকে ছিলাম বছর কয়েক। পরে সম্পর্ক গাঢ়তর হয়েছে, কিন্তু গীতিকার হয়ে টিকে থাকার পাখি অপচেষ্টার খাঁচা খুলে উড়ে গেছে। এঁদের মধ্যে মৃণাল ছাড়া সবাই আজ ছবি হয়ে গেছেন। বৃত্তি আর প্রবৃত্তির স্বাদ বদল করতে করতে আমিও একটা সৃষ্টি-বিরল, মাস্টারি নামক পড়ো-জমির মালিক হয়ে ক্যালেন্ডার পালটে পালটে চলে এসেছি। কড়াভর্তি টলটলে ডাল রাঁধুনির অসাবধানে যেমন পোড়া ডালের বড়া হয়ে যায়, আমার কবিতা ও গান তেমনি গদ্য আর বক্তৃতার শক্ত বড়ার পিণ্ডিতে পরিণত হয়েছে। আর ঘরানার বাইরে চলে আসার খেসারত দিতে দিতে সংস্কৃতির দুনিয়ায় কবে থেকেই হয়ে গেছি ভিসাহীন ভিনদেশি। সে-সব দিনের জ্বলজ্বলে মুখের ছবিগুলো ধূসর-ধুলোট হয়ে গেছে। নিজেরই লেখা পঞ্চান্ন বছরেরও বেশি পুরনো সেই-এক গানের বাণী নতুন অর্থ নিয়ে কানে বাজে:

ভাঙা তরীর শুধু এ গান—
কী আছে আর প্রাণের দান!
যা ছিল প্রেম সবই দিলেম,
শুধু এ গান, শুধু এ প্রাণ।

আজ দেখি সময়ের ভগ্নতরীর জোড়-খোলা পাটাতনে আমি একা। এ গানের সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত কোথায় আজ?

আমি তো এই তুমি সুদূর
আমি চরণ কোথা নূপুর
একা তরী গেল ভেসে
কোথা বলো কোন দেশে?

সলিল চৌধুরির হাত ধরে নলিন সরকার স্ট্রিটে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে যাতায়াত করি। সুধীন দাশগুপ্তও করতেন। সেখান থেকেই রাখিবন্ধন। আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের আই এ ক্লাসের ছাত্র বোধহয় তখন। থাকি বেলেঘাটায়। সুধীনদা থাকতেন সিঁথির ভেতরে ডি গুপ্ত লেনে। পঞ্চাশের দশকের সেই প্রথম প্রহরে পুব থেকে উত্তরে ‘কত আশা, কত ভালোবাসা’। কত যাতায়াতের পৌষফাগুন আমাদের দু’জনকে ক্রমশ বড় গাছের ওপরের ডালে তুলে দিয়েছে। অবশ্যই দুজনের গুণপনার তুলনাসূত্রে এই উক্তি নয়। অভিজ্ঞতার দেওয়ালে ঠোক্কর খেতে খেতে বড় হওয়া, ভাঙা ডাল ধরতে ধরতে মগডালে ওঠা। অন্তত আমার ক্ষেত্রে। গান লেখার নেশা আমার খুব-একটা তীব্র ছিল না। কিন্তু সুধীন দাশগুপ্তের পাশে-বসে তাঁর মোটা-মোটা পুরুষ্ট আঙুলে হারমোনিয়ামে স্বরতরঙ্গ বিস্তার, কর্ডের খেলা, অজস্র বিদেশি গান শোনার অভিজ্ঞতা আমার নির্জন মনের সৈকতে কথা-গাঁথার কাঁপন জাগাত। হয়ত এমনি করেই আমার কিছু গান-লেখা ও সুধীনদা-র সুর-দেওয়া হয়ে-উঠত। সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীত-জীবনের সেটাই আদি কাণ্ড, ‘পায়ে-চলার পথের হল শুরু’। এখানে বলা ভাল যে, ‘কত আশা কত ভালোবাসা’ এটি সুধীন দাশগুপ্তের সুরে রেকর্ড করা বোধহয় প্রথম গান, গেয়েছিলেন সেকালের জনপ্রিয় কিন্তু প্রায় বসে-পড়া শিল্পী বেচু দত্ত। আর ‘পায়ে চলা পথের হল শুরু’ এটিও সেই প্রথম কি দ্বিতীয় রেকর্ড সুধীনদার সুরে, বোধহয় সুধীন দাশগুপ্তই লিখেছিলেন, গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। সুধীনদার সিঁথির বাসায় দোতলার ঘরটায় মনে হচ্ছে কোনও টেবিল-চেয়ার-খাট ছিল না। শতরঞ্চির ওপর হারমোনিয়াম, দেওয়ালের কাছে থরে থরে ইংরেজি-গানের লংপ্লে রেকর্ড। সেদিন এক ছুটির সকালে সুধীনদা আমাকে দিয়ে একটি ছন্দময়, নতুন ধরনের স্ক্যানশনে, রিদমিক এই গানটি তৈরি করলেন:

রূপকাঠি গাঁয়ে শ্যামলী মেয়েটি
পথ চলে,
নদী ছলছল হাওয়া ঝিরঝির
কথা বলে।
রাঙা পথে ওই হাটে যায় কারা
বেলা গেল
কাজল মেয়ে গো ভরা ঘট নিয়ে
ঘরে চলো।
নয়নে হাসির ফোয়ারা চমক
দীপ জ্বলে।

বোধহয় পরে কোনও এক সময়ে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় গানটি রেকর্ডে গেয়েছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানির দোতলার পুবদিকের ঘরে একবার সলিল চৌধুরি আর সুধীন দাশগুপ্ত টানা দু’ঘণ্টা গল্পে আর গানে মেতেছিলেন। অনেকেই জানেন না, সেইদিন গানের জগতে এক অবাক কিংবা সবাক কাণ্ড ঘটেছিল। সলিল চৌধুরি বসে বসে একটি গান লিখে দিলেন, সুধীন দাশগুপ্ত সেটি সুর করলেন। গানটি হল:

চম্পা আমার ওগো শোনো
পারুল কুমার ডাকে তোমায়
ঘুমায়ো না জাগো।

তার কত বছর পরে সলিল চৌধুরি রচনা করেছিলেন, ও সাত ভাই চম্পা জাগো জাগো রে। আর সুধীনদাও লিখেছিলেন, স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে আকাশ যে ওই রাঙল রে।… চম্পা জাগো জাগো রে। সলিল চৌধুরি লিখছেন, সুধীন দাশগুপ্ত সুর করছেন, এই ব্যতিক্রম ঘটনার সাক্ষী হিসেবে সেদিন সেই ঘরে আর কেউ ছিলেন কিনা মনে নেই। তবে সেদিন এই ‘রূপকাঠি গাঁয়ে শ্যামলী মেয়েটি’ গানখানি সুধীনদার কণ্ঠে শুনে সলিলদা আমাকে তারিফ করে বলেছিলেন, গানের সেকেন্ড হাফটা তো দারুণ লিখেছিস। সেটি ছিল এইরকম, যতদূর স্মরণে আছে:

রূপকাঠি গাঁয়ে যদি কোনোদিন
পথ ভুলে
ওই রাঙা পথে যদি যাও তুমি
আঁখি তুলে
যেখানে আকাশ ধরা দিল এই
ধরাতলে
রূপকাঠি গাঁয়ে শ্যামলী মেয়েটি
পথ চলে।
কত যুগ আমি খুঁজেছি তোমায়
কত নিশি
কত না জনম কত না মরণে
গেল মিশি।
যদি কোনোদিন দেখা মেলে তার
ছায়াতলে
আমাকে সেদিন দিও সে গাঁয়ের
পথ বলে।

শহরে জন্মে বড়-হয়ে-ওঠা আমার গ্রামের কল্পনা অভিজ্ঞতাহীন রোমান্টিক ওই ‘রূপকাঠি’ গাঁয়ের ইস্টিশনেই থেমে গেছে। গাঁয়ে ঢোকার জন্য কোনও অভিজ্ঞতার সাইকেল রিকশা খোঁজা হয়নি। দেশভাগের কঠিন রক্তাক্ত ইতিহাস আর গ্রাম-ছাড়ার করুণ আর্তনাদ ফোটাবার জন্যে ছড়ার ভাঙাচোরা চরণ নিয়ে একটা গান লিখে দিয়েছিলাম সুধীনদা-র খাতায়। একদিন সেটাতে ভারি কান্নাভেজা সুর বসিয়ে দিয়েছিলেন সুধীনদা, আর তেমনি ক্রন্দনমধুর কণ্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়— কী জানি আজ কারও মনে আছে কি নেই:

এ পারে গঙ্গা ও পারে গঙ্গা
মধ্যিখানে চর
সোনার বরণ বধূ এসে
প্রদীপখানি ভাসিয়ে দিল
স্রোতে থরথর ।।
কোন অতীতের কালো বুকে
মনে তো আর নাই
সেই মেয়েটির হারানো মুখ
খুঁজে তো না পাই
সেই বধূটির সুখে ছাওয়া
একটুখানি ঘর
ভেসে গেল অথৈ গাঙে
স্রোতে থরথর।

সুধীন দাশগুপ্ত বাংলা একটা যুগের যে একজন শ্রেষ্ঠ সুরকার তাই নয়, তিনি নিজেও অনেক অসাধারণ গান লিখেছেন। গীতিকার হিসেবে সুধীন দাশগুপ্তের তেমন আলোচনা হয়নি, মূল্যায়ন তো দূরের কথা। এর অনেক কারণ ছিল কিংবা আছে। আমরা যারা সুরকারদের জন্যে গান লিখে বেড়াতাম, আমাদের নিজেদের কথা আমরাই প্রচার করতাম। সুধীনদা সব ব্যাপারেই ছিলেন উত্তেজনাহীন ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। তাই তাঁর নিজের পক্ষে সুরের বা গীতিরচনার আত্মপ্রসাদ ঘোষণা করার মানুষ তিনি কখনই ছিলেন না। সলিল চৌধুরি স্বয়ং গীতিকার ও সুরকার। অসংখ্য স্বরচিত গানে তিনি নিজের সেই আত্মপরিচয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন। তাই সলিল চৌধুরির গানের পাশে ‘কথা ও সুর সলিল চৌধুরি’ এই অবধারিত পরিচিতির সঙ্গে জিজ্ঞাসুর চোখ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই কোনও গানের রেকর্ডে কথাও সুধীন দাশগুপ্তের, এমন জানাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। সুধীনদা এমন কাণ্ড করতেন মাঝে মাঝে। যদি নিয়মিত করতেন, তা হলে তাঁর এই গীতিকবি-অভিধাটি আমাদের চোখে বসে যেত। অনেক কাল পরে সুধীনদার নিজের লেখা গানগুলিকে পাশাপাশি দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি তাঁর উপলব্ধির নিজস্বতায়। ভাষা ও শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর অধিকারের প্রামাণিকতায়। আজ সুরকার-সত্তার সঙ্গে ‘গীতিকার সুধীন দাশগুপ্ত’ এই সত্তার ঔজ্জ্বল্যে ও স্বাতন্ত্র্যে আমরা গর্বিত হই, লজ্জিতও হই। মনে হয়, জীবিতকালে তাঁর এই গুণকে তেমন যেন স্বীকৃতি দিইনি! সুধীনদার স্বরচিত কিংবা অন্য কারও লেখা দুর্ভিক্ষের ওপর গান ‘মেলো নয়ন মেলো রে, রাত পোহায়ে গেল রে’ শুনে আমার চোখে জল এসেছিল। সে গান আজও অপ্রকাশিত। তা সে যাই হোক, সে সব আপাতত আমি টেনে আনছি না। শুধু এই স্বল্প পরিসরে, বলতে ইচ্ছে করছে যে ভাল লিরিকের ওপর বাংলা গানকে দাঁড় করার আন্দোলনে সুধীন দাশগুপ্ত ছিলেন সে-সময়ের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তাই পঞ্চাশের দশকে গান রচনার জন্যে কবিত্ব, শব্দঝঙ্কার, ছন্দের স্পন্দন, আর ধ্বনিসুষমা রক্ষার জন্যে কত যত্ন ছিল আমাদের। সুধীন দাশগুপ্ত হারমোনিয়ামে সুরের ঢেউ তুলছেন, আমি তাঁর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে লিখে ফেললাম একদিন এই গানটি, যা নিছক সুরে-বসানো কবিত্ব-বর্জিত অর্থহীন কথার রাশি নয়, সুখপাঠ্য কবিতাও হতে পারে:

বিদেশিনী কাদের রানী
পালকি চড়ে চলেছে
সোনামুখে রোদ লেগে তার
মুক্তো ঝরে পড়েছে।
তাই না দেখে ঘরের থেকে
কাঁদল সখী বকুলফুল
কূল গেল কূল গেল
ফুটল না যৌবনের ফুল
বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না
লাজশরমে কত বার
কলঙ্কিনী কালনাগিনী
হল যে তার গলার হার।

গানটি আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ডে ক্যাসেটে তাঁর সেদিনের নরম স্নিগ্ধকণ্ঠে অপরূপ সৌন্দর্যে ধরা আছে। ঠিক এমনি ধরনের ছড়াময় লিরিক, ঈষৎ গ্রাম্য শ্যামল শোভা-মাখানো, বাঙালি ঘরের বিয়ের পর কন্যা-বিদায়ের চিরন্তন ছবিটিও আমার কথায় আর সুধীন দাশগুপ্তের সম্পূর্ণ স্বদেশীয় সুরে কী আশ্চর্য অনবদ্য গান হয়ে আছে শ্রোতার কানে। গীতা দত্তের অমলিন কণ্ঠে বাঁধা এর প্রতিটি উচ্চারণ:

উঠো উঠো মা গৌরী
হিমানি আর নাই
সোনামতী রাঙা রোদে
গাঙসিনানে যাই।
গৌরী গৌরী ফিরে চাও,
ঘাটে এল সপ্ত নাও।।
হলুদবরণ গৌরী যাবে
বরণদোলায় চড়ে
সিঁদুরে চন্দনে মুখে
রাঙা রোদ পড়ে।
কত বহুড়ি কত ঝিউড়ি
শঙ্খ বাজালো
গৌরী যাবে অনেক দূরে
আকাশ করে আলো।
গৌরী গৌরী ফিরে চাও
ঘাটে এল সপ্ত নাও।

এই পর্যন্ত লেখার পর সুধীনদা বললেন, মায়ের মুখে কিছু কথাটথা বসাও। আমি লিখলাম:

এত কালের মাটি তোমায়
অন্ন দিল তুলে,
তারে তুমি মনে রেখো,
যেয়ো না মা ভুলে।
নদী তোমায় জল দিল
তরু দিল ছায়া,
আমি দিলাম স্নেহ যখন
ছিলে অসহায়া।
পোড়া আঁখি জলে ভাসে,
হাসি টানি মুখে,
লক্ষ্মী হয়ে থেকো যেন
সবার সম্মুখে।

আনন্দে সুধীনদা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, দারুণ।

আরও মনে পড়ছে, সুধীনদার নিজের লেখা একটি গানের কথা বদলে আমি লিখে দিয়েছিলাম:

এই ছায়াবীথি তলে
ফাগুন নামে না আর
এখানে শ্রাবণের যত ব্যথা
সে যে আমার ওগো সে যে আমার।

লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে পড়ল, সুধীন দাশগুপ্ত কৈশোর-যৌবনে পাহাড়ি দার্জিলিং কালিম্পং কার্শিয়াঙে কাটিয়েছিলেন বলে বহু নেপালি ছন্দপ্রধান গান তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। এমনি একটি নেপালি সুর (আপুভনে থাং নে মেরে ছোড়ি মাং নে) ভেঙে আমাকে দিয়ে তিনি একটি গান বানিয়েছিলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে। আমার নিজেরই ভাল করে মনে নেই সে কথাগুলো, সম্ভবত আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ডে গেয়েছিলেন:

পৌষালি সন্ধ্যার ঘুম ঘুম তন্দ্রা
মৌমাছি গুনগুন গুনগুন ফিরে যায়,
মল্লিকা ঘুমায় রে।
আহা তার অঙ্গে কি শিশিরের কান্না
ওগো সূর্য ঝরাও তুমি হীরে মোতি পান্না
ওই বুঝি শুকতারা দীপটি নেভায়।
মল্লিকা ঘুমায় রে।

এমনি সুরভাঙার খেলা সুধীনদা অনেক করেছেন। যেমন একটি ইংরেজি পপ গান আমাকে প্রায়ই শোনাতেন সুধীনদা:

I come from Alabama
with a Banzo on my knee
I’m going to Luisiana
my Susana for to see.
O Susana O don’t you cry for me
For I’m going to Luisiana
my Susana for to see.

আমার আর সুধীনদার প্রতিযোগিতা শুরু হল, কে আগে এর বাংলা ভার্সান করতে পারে। সুধীনদারই জিত। তৈরি হল:

ওই মেঘে মেঘে ছেয়ে এল আঁধার গগনে
ওই মাটির স্বপন ভাসাতে আজ ব্যথার প্লাবনে।
সূর্য কোথা যাও
কেন গো লুকাও
সূর্যমুখী ডাকে তোমায় দাও গো সাড়া দাও

কথাগুলো বোধহয় এরকমই। কে অস্বীকার করবে, অল্প সময়ের মধ্যে গানটি গায়ত্রী বসুর গলায় কী দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল!

‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’ আমার রচনায় সুধীন দাশগুপ্তের আশ্চর্য সুরারোপে আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরময় দরদিয়া কণ্ঠে একালের অনবদ্য একটি সৃষ্টির মর্যাদা পেয়েছে। উৎপলা সেনের কেয়াতলার বাসায় এক সন্ধ্যায় আমি দিনের উঞ্ছবৃত্তি শেষ করে কাগজ নিয়ে বসেছি। পাশে সতীনাথ, সুধীন দাশগুপ্ত হারমোনিয়াম ধরেছেন। রেকর্ডিং ডেট ঠিক হয়ে গেছে। এখনই গান চাই: তাড়াতাড়ি লেখা বেরোল

সোনার হাতে সোনার কাঁকন
কে কার অহঙ্কার,
কে জানে তার এরূপ দিল
সে কোন মণিকার।

সতীনাথের রাগপ্রধান গানের মেজাজ রেখে দু’লাইন সুর বসাতেই সতীনাথ আহাহা আহাহা করে চোখ বুজে বারবার গাইতে লাগলেন। ওই দেখে আমার কলম তো প্রায় স্তব্ধ। সতীনাথদা তাড়া দিয়ে বললেন, থামলি কেন, লেখ। আবার কলম এগোতে লাগল, আর সুধীনদা সুর বসাচ্ছেন, সতীনাথদা বাঃ বাঃ আহাহা করে চলছেন। হঠাৎ সতীনাথদা নিজে থেকেই বলে উঠলেন, ভাস্কর, কে কার অহঙ্কার না বলে কে কার অলঙ্কার বললে হয় না’? উৎপলাদি চা আনছিলেন। বললেন, আমি তো অলঙ্কারই শুনছি। বাঃ, এটাই তো মানাবে ভাল। সুতরাং হাতে অলঙ্কার গেঁথে গেল, আমার মৌখিক আপত্তি টিকল না, বলা গেল না যে ‘সোনার হাতে সোনার চুড়ি কে কার অলঙ্কার’ এই বাক্যটি বাংলা কোনও কাব্যালঙ্কারশাস্ত্র শেখানোর বইতে ‘সন্দেহ’ নামক এক অলঙ্কারের নমুনা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। তাতে সতীনাথদা-র তো বয়েই গেল। হইহই করে রেকর্ড তো বেরোল। সেই রেকর্ডেরই উলটো পিঠে সুধীনদা-র নিজের লেখা ও সুরের দারুণ গান ছিল

এল বরষা যে সহসা মনে আজ
রিমঝিমঝিম রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই।

সে বছর তো গানের বাজারে সতীনাথদা-র গান আজকের ভাষায় ‘সুপারহিট’। এদিকে বছর না ঘুরতেই কোনও এক মক্কেলহীন বেকার উকিল কোনও এক সম্ভাব্য খদ্দের পাকড়ে, দিল রেকর্ড কোম্পানির নামে স্বত্বহানির মামলা ঠুকে। কোম্পানির জাঁদরেল কোনও সেনসাহেব আমাকে ভয় দেখিয়ে বললেন, ‘এ কেস আপনার ঘাড়ে চাপানো হবে! আপনি সামলাবেন।’ কপিরাইট কী জিনিস তাই জানি না তখন। ভীরুপায়ে অতুলচন্দ্র গুপ্ত, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র প্রমুখ আইনজ্ঞ কাদের কাদের কাছে পরামর্শ নিতে গিয়েছিলাম মনে নেই। তবে, তাঁরা সবাই শুনে হাসাহাসি করেছিলেন, সে কথা স্পষ্ট মনে আছে। বলেছিলেন, ‘আরে দুর! এটা দাঁড়ায় নাকি? চুড়িকে কাঁকন বললে সোনাটা বেশি লাগে বটে, তবে সেটা ফাঁপা। তাতে চুড়িটাই ভাঙে, স্বত্ব ভাঙে না!’ আমার তখন অপরিণত বয়স, তার ওপর বোধবুদ্ধির কাছে ভয়-দেখানো সেই উকিলের দুঃস্বপ্ন চলতেই লাগল। নির্বিকার সুধীনদা হাসেন মিটিমিটি, সতীনাথদা হাসেন হো-হো করে। কোম্পানির সর্বময় বড়কর্তা মিস্টার চ্যাটার্জি বোধহয়, শেষে দেখি একদিন আলিপুর কোর্টে স্বয়ং এসে কোম্পানির অ্যাটর্নি ঘোষসাহেবের মাধ্যমে শুঁটকি চেহারার সেই উকিলবাবুকে ধমকে জানালেন, ‘এসব উটকো ঝামেলা দেখার সময় এত বড় কোম্পানির নেই। আর চললেও, আপনি কি দশ বছরেও এর হিল্লে করতে পারবেন? এখন বলুন, আপনার কত চাই?’ হতভম্ব উকিলমশাই একখানা একশো টাকার করকরে নোট পেয়ে আশাতীত সৌভাগ্যে লম্বা-লম্বা ঠ্যাং দিয়ে তখনই হাওয়া! বলা বাহুল্য, মুহূর্তে মামলা শেষ। সেই লোভী উকিলবাবু পার্টিকে হয়তো কিছু দু-দশ টাকা গছিয়ে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘আর-একটু চেপে ধরলে কোম্পানিকে একেবারে ফতুর করে দিতুম। হেঁ হেঁ।’

আজ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পরে এসব মনে পড়লে হাসি পায়। কোথায় গেল স্বত্বভঙ্গের মামলা, তার নামে দু-পয়সা কামানো? হায়, কোথায় সেই কালো-কোট শকুনবুদ্ধি উকিল! আজও জেগে আছে, সেই আশ্চর্যকণ্ঠ সতীনাথের গাওয়া সুধীন দাশগুপ্তের অপূর্ব সুরে সৃষ্টি— ‘কে জানে তার এরূপ দিল সে কোন মণিকার!’

এই গানের গল্পটা এখানে শেষ হলে ভাল হত। তবু বাকি থাকে দু-চার কথা। কয়েক বছর আগে গান-মেলা-থেকে কেনা গ্রামোফোন কোম্পানির একটা সতীনাথের গানের ক্যাসেটে দেখলাম, ছাপানো আছে, ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন।’ গীতিকারের নাম গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, ভাস্কর বসু নয়। এই হল, একালের সেই গ্রামোফোন কোম্পানি! তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার গীতিকার? সে খবরটাও রাখেন না!’

সুধীন দাশগুপ্তের খাতার ভেতর এলোমেলো ছেঁড়া পাতায় যে আমার কত গান ছিল, হারিয়ে গেছে। অবশ্য রেকর্ডে রয়ে গেছে ‘হিংসুটে দৈত্য’ আর ‘আলাদিন আলাদিন’ এই দুটো শিশু গীতিনাট্য। ‘হিংসুটে দৈত্য’ ছোটদের এই গীতিনাট্য পালাটিকে ঘিরে সুধীনদার সঙ্গে আমার নিবিড় নৈকট্যের অনেকগুলি দিন স্মৃতিঘন হয়ে আছে। তখন আমি গীতিকার হওয়ার চেনা পথ দিয়ে হাঁটা তো ছেড়েই দিয়েছি। অধ্যাপনার ফোলানো-বুক আর দোলানো-ব্যাগ আমার শূন্যগর্ভ আত্মম্ভরিতাকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস থেকে উৎখাত করে এনে ফেলেছে ক্লাসের বাগাড়ম্বরে, আর প্রবন্ধ লেখার বাসনমাজা কাজে। গ্রামোফোন কোম্পানি আমাকে আর সুধীনদাকে ছোটদের জন্যে গীতিনাট্য লেখার দায়িত্ব তো দিল। কিন্তু কী লিখি, কী নিয়ে লিখি, এই সব ভাবনার ডিমে তা-দেওয়ার দুরবস্থা চলছে। হঠাৎ একদিন কালীঘাট পার্কের ধারে একটা গলির নোংরা ফুটপাথে কয়েকটা বারো-চোদ্দো বছর বয়সের ছেলের বিচ্ছিরি মুখে বলতে শুনলাম, রোজ রোজ ফুটপাথে খেলতে ভাল লাগে না। বলা ভাল, কালীঘাট পার্ক তখন আর পার্ক নেই, পাতাল রেলের প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্বে ইট-পাথর লোহা-লক্কড়ের স্তূপে সেটি অট্টালিকা ভাঙা ভগ্নস্তূপের মতো। সবুজের অভিযান সেখানে নিষিদ্ধ। কথাগুলো মনে ঘোরাফেরা করতে করতে এসে গেল অস্কার ওয়াইল্ডের ‘শেলফিস জায়ান্ট’ গল্পের কথা। সুধীনদার প্রসন্ন অনুমোদন আর আমার লেখার পাশাপাশি চলছিল সুধীনদার নানা পরিকল্পনা। আমাকে বলতেন, জীবজন্তু চরিত্র বানাতে, তা হলে তাদের কণ্ঠে তিনি জীবজন্তুর উচ্চারণের ধ্বনি কৃত্রিমভাবে ফোটাবেন। আমাদের দুজনের সেই ইচ্ছে একটু একটু করে কেমন চমৎকার অসাধারণ সৃষ্টি হয়ে উঠেছে, যাঁরা এ রেকর্ড শুনেছেন তাঁরা জানেন। ছোটদের কাছে এর আশ্চর্য চমক আর বিস্ময় এখনও অনিঃশেষ। আজও নানা ছোটদের প্রতিষ্ঠান এই রেকর্ড বাজিয়ে হিংসুটে দৈত্য মঞ্চে অভিনয় করে। এই সমস্ত কাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন শিল্পী অংশুমান রায়, যিনি তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে এই রেকর্ডে দৈত্যের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সুধীনদার অকৃত্রিম ভক্ত-অনুরাগী, আমার এই বন্ধুর জন্যেও আমার মন আজও গভীর অভিমানে টনটন করে। কেন এত অকালে ও আত্মঘাতী হল?

একটা সুর-করা গানের সামান্য মনে পড়ছে:

আমি আকাশ খুঁজে মরি
তুমি মাটির পানে চাও,
আমি যে সূর্য পেতে চাই—
তুমি প্রদীপটি জ্বালাও।
আশা ছলনা কেন গেল না,
আজও গেল না।

আমার সে আকাশ তো কবেই হারিয়ে গেছে। সূর্য পাওয়ার দুরাশায় মাটির প্রদীপটিও নিভে গেল। সঙ্গীত-জীবনের সেই সূচনাপর্বে রচিত সুধীন দাশগুপ্তের একটি প্রায়-ভুলে-যাওয়া গানের কথা মনে পড়ছে:

কেন আকাশ হতে আজ নিশীথে
তারা ঝরে যায়
এই পৃথিবীর বুকের পরে
বলো কী ব্যথায়,
তারা ঝরে যায়।

অরূপ ভট্টাচার্যের লেখা, সম্ভবত বাগেশ্রীতে বাঁধা গানটি বেচু দত্তকে দিয়ে রেকর্ড করানো হয়েছিল। সেই শিল্পীর তখন কণ্ঠসম্পদও নেই, বয়সে রোগে শরীরও জীর্ণ। তবু কী দরদ দিয়ে গেয়েছিলেন। যেন তাঁর নিজেরই জীবনের কথা, এই ভেবে গাইতে গাইতে তাঁর চোখ দিয়ে দেখেছি জল গড়াত। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে আমরা যারা আছি, আমাদের অবস্থাও সেই ‘তারা ঝরে যায়’। তাই এখন ঝরা তারা, মরা ফুল, শুকনো পাতা, রুক্ষ বাতাস চারপাশে ঝিমঝিম করে। ‘যা ছিল প্রেম সবই দিলেম’‘শুধু এ গান, শুধু এ প্রাণ’ নিয়ে সুধীন দাশগুপ্তের স্মৃতির তলায় বসে থাকা। আবছা ছবিখানা চোখে ভাসছে। আমার গানের কাগজখানা হারমোনিয়ামের ওপর চাপা-দেওয়া। মোটা-মোটা আঙুলে সুধীনদা সুর বসাচ্ছেন:

এ পারে গঙ্গা ও পারে গঙ্গা কেন ব্যবধান
এ পারে আমি ও পারে তুমি, মধ্যে বয় উজান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *