একটি সুরেলা উজ্জ্বল নক্ষত্র – জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

একটি সুরেলা উজ্জ্বল নক্ষত্র – জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়

‘নীল, নীল—
সবুজের ছোঁয়া কিনা তা বুঝি না
ফিকে গাঢ় হরেক রকম কম বেশি নীল—
তার মাঝে শূন্যের আনমনা হাসির সামিল
কটা গাংচিল।’

প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত রচনা ‘সাগর থেকে ফেরা’। —সুধীন দাশগুপ্তর সুরে কবিতাটি দিব্যি গান হয়ে গেল। আর সেই গান সুধীনদারই নেতৃত্বে আমরা গোটা চল্লিশ ছেলেমেয়ে সমবেতকণ্ঠে গাইব রনজি স্টেডিয়ামে ‘যুব উৎসবের’ অনুষ্ঠানে। সময়টা ষাটের দশকের গোড়ার দিক। গানটিকে ‘ভয়েস হারমনি’, ‘হামিং’ এসব দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছেন সুধীনদা। রিহার্সালও করিয়েছেন দিন সাত-আট।

ঘোষণা হয়ে গেল। আমরা মঞ্চে উঠে সার দিয়ে দাঁড়ালাম। যন্ত্রীরাও রেডি। সুধীনদা আমাদের সঙ্গেই দাঁড়িয়েছেন। সামনে টেবিলে হারমোনিয়াম। আঙুলের ইশারায় ‘ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর’… এ কী হল!

প্রথম লাইনটি তো তালছাড়া শুরু করতে হবে! অথচ সবাই চুপ! তাড়াতাড়ি সুধীনদা মাইকটায় মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে গাইলেন— ‘নীল…’। আমরা যেন সংবিত ফিরে পেয়ে গেয়ে উঠলাম, —নীল, নীল…।

ছি, ছি— কী কাণ্ড! এতদিন দু’ঘণ্টা-আড়াই ঘণ্টা রিহার্সাল করে এই…? সুধীনদার কাছে মুখ দেখাব কী করে? যাই হোক, আর কোনও ভুল হয়নি এই যা রক্ষে। আরও দু-তিনটি গান ছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ঠিকানা’ কবিতাটিও ছিল। বলাই বাহুল্য, সুধীনদারই সুরে। পরে সলিল চৌধুরির সুরে গানটি রেকর্ড করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

আমাদের অনুষ্ঠান শেষে চুপচাপ নেমে এলাম মঞ্চ থেকে। কারও মুখে কথা নেই। সুধীনদা নামলেন শেষে। আর নেমেই আমাদের দিকে চেয়ে একটু জোরেই হেসে উঠলেন— অনেক কোরাস গান করেছি, কিন্তু এরকম ‘কোরাস’ ভুল… এই প্রথম শুনলাম।

যাক, সুধীনদার ওই হাসিটুকু আমাদের সব অস্বস্তি যেন মুছে দিয়ে গেল। সেই অদ্ভুত সমবেত ভুলের কথা মনে পড়লে আজও কেমন একটা অস্বস্তি লাগে।

ঠিক এমনই একটি অনুষ্ঠানে সুধীনদার সঙ্গে আলাপ। তখন ‘বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন’-এর অনুষ্ঠান হত মধ্য কলকাতায়, মার্কাস স্কোয়্যারে। সেখানেই নিজের গান হয়ে যাওয়ার পর এদিক-ওদিক ঘুরছি আমরা ক’জন— আমি, অশোক (রায়), সুকুমারদা (মিত্র), আরও দু-তিনজন। হঠাৎ অশোক বলল— এই, সুধীনদা!

—কই! কোথায়?

—ওই তো, বসে আছেন।

সেদিকে সবাই এগোলাম। দেখি হাত দুটো পিছনে ভর দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। দুধসাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আমাদের দেখতে পেরেই সোজা হয়ে বসলেন— আরে একবারে সদলবলে!

—সুধীনদা, এ জটিল, জটিলেশ্বর।

তাকালেন আমার দিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে পা ছুঁতে যেতেই বাধা দিলেন— আরে, আরে, ওসব না। —হ্যাঁ নাম শুনেছি বই-কি! নামগান সব শুনেছি। ‘নামগান’ কথাটা এমনভাবে বললেন যে আমরা একটু হেসে উঠলাম।

—আসুন না আমার ওখানে একদিন। খুব দূর নয়। সাউথ সিঁথি। এরা জানে।

সুকুমারদা ওঁর বন্ধু। আপত্তি করলেন— আরে, ওকে আপনি-আজ্ঞে করছিস কেন? ও আমাদের চেয়ে ছোট তো!

আমিও বলে উঠলাম— হ্যাঁ, সুধীনদা। আমাকে ‘তুমি’ই বলবেন। একুট হাসলেন। আমি ততক্ষণে ভাবছি আমার সৌভাগ্যের কথা। প্রথম আলাপেই আমাকে বাড়ি যেতে বলছেন! আমি ভেতর থেকে উৎসাহ পেয়ে বললাম— আমি কিন্তু আপনাকে আগেই দেখেছি সুধীনদা। সতীনাথদার বাড়িতে। আপনি পুজোর গান তোলাতে গিয়েছিলেন। উচ্ছ্বাসে এতগুলো কথা বলে ফেলে একটু লজ্জাই পেয়েছিলাম— মনে আছে।

সেই শুরু। তারপরের রবিবার থেকেই চল সাউথ সিঁথি— ডি গুপ্ত লেন। নিয়মিতদের মধ্যে ছিলাম অশোক, আমি (আমরা দুজন একসঙ্গেই ছিলাম হ্যারিসন রোডের ‘নিক্কো বোর্ডিং’-এ) আর দিনেন (চৌধুরি)। এ ছাড়া ছিল দেবদুলাল (বন্দ্যোপাধ্যায়), আশিসতরু (মুখোপাধ্যায়) আর সুনীলবরণ ও প্রশান্ত (চৌধুরি)। অশোক, প্রশান্ত পরে ফিল্মে সঙ্গীত পরিচালনায় সুধীনদার সহকারী হয়েছিল। আর সহকারী ছিল সুধীনদার সহোদর ভাই পলু (পরিমল দাশগুপ্ত)। ফিল্মের সঙ্গীত পরিচালনার কথায় পরে আসা যাবে, একটু বিস্তার নিয়ে। তবে একটা কথা বলে নিই, একটা সময় গেছে যখন একটার পর একটা ছবিতে সুধীনদার সঙ্গীত পরিচালনার যেন নতুন নতুন রূপ দেখেছি। প্রত্যেকটিতেই যেন কিছু ভিন্ন ধরনের গান খুঁজে পেয়েছি।

এখানে একটি নিবেদন— কোনও বড়সড় ব্যক্তিত্ব বা প্রতিভার কর্মকাণ্ড নিয়ে বলার সময় ক্রমানুসারকে খুব বেশি প্রাধান্য দিতে গেলে কেমন একটা ‘বিবরণ বিবরণ’ হয়ে যায় ব্যাপারটা। তবু যতটা পারি, গোড়ার দিক থেকেই এগোবার চেষ্টা করছি।

আলাপের পর প্রথম রবিবারেই তো অশোক আর দিনেনের সঙ্গে হাজির হলাম। দোতলায় গানের ঘর। সুধীনদা হারমোনিয়ামে বসে কিছু কাজ করছিলেন। বসতে বললেন। আর বসেই— এতক্ষণ আসতে আসতে যা ভাবছিলাম, তাই ফস করে বলে বসলাম— সুধীনদা, ডাকহরকরার গান একটু শুনব।

একটু হেসে তাকালেন। হারমোনিয়ামে হাত রাখলেন।

‘মনরে আমার, শুনলি না বারণ—
সোনার হরিণ ধরতে গেলি
ঘরে হলো সীতাহরণ।’

এতদিন পরে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না বোধহয়, সেদিন কী অদ্ভুত এক অনুভূতি! একটু চেরা আওয়াজ, অল্প একটু নাকের প্রভাবও আছে। আমি যেন গানটার মধ্যে হারিয়ে গেলাম। আমার খুবই প্রিয় গান, অনেকবার শোনা; নিজে গাইবার চেষ্টাও করেছি কতবার। কিন্তু এবার মনে হল, গানটির আসল চেহারা যে এমন, ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে পারিনি। ছবিতে শ্রদ্ধেয় শিল্পী মান্না দে-র গলায় যন্ত্রানুষঙ্গের সঙ্গে ছবির সিচুয়েশনে গানটি শুনেছি। কিন্তু ঘরে বসে শুধু হারমোনিয়ামে, সেই অনবদ্য গায়কী, গানের কথা বলার ওই ভঙ্গি, লয়ের সুন্দর অনায়াস ব্যবহার— সব মিলে গানটির যেন একেবারে অন্য চেহারা! বলাই বাহুল্য, ছবিতে মান্না দে অসাধারণ গেয়েছিলেন গানটি। কিন্তু, আমি আসলে যেটা বলতে চাইছি, তা হল— একই গানকে যে অন্য কায়দায় এত সুন্দরভাবে উপস্থিত করা যায়, সে ধারণা আমার সেদিনের আগে একেবারেই ছিল না। বেশ মনে আছে, অন্তত পরের চার-পাঁচদিন মনের মধ্যে ওই গান গাওয়ার ভঙ্গি বারবার ঘোরাফেরা করেছে। সত্যি বলতে কি, সেদিনই আমি একরকম স্থির করে ফেলি এই মানুষটির গানের সঙ্গে আমাকে একটু বেশি ঘনিষ্ঠভাবে থাকতে হবে।

এখানে আর একটি কথা। আমি এর আগে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বেশ কিছুকাল গান শিখেছি। এমন সময় গেছে, যখন শুধু ওঁরই গান গেয়েছি। কাজেই ওঁর গানের স্টাইল আমার মধ্যে বেশ ভালভাবেই সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটু অনুকরণের প্রবৃত্তিও যে ছিল না, এমন নয়। অনেকদিন যাবৎ একজনের গানই শুধু গাইতে থাকলে এমনটা হতেই পারে।

একথাগুলো এই জন্যেই বলা যে, অমন একটা শিকড়গাড়া প্রভাব নিয়েও সুধীনদার ওই একেবারে ভিন্ন ধরনের সুর, আলাদা গায়নভঙ্গি কত সহজে এবং কত অল্প সময়ে আমাকে একেবারে অন্যদিকে, অন্যভাবে, সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবাতে শিখিয়েছিল— এই ব্যাপারটা আমি বারবার বুঝতে চেয়েছি, নানাভাবে মনে মনে ব্যাখ্যাও খুঁজেছি। আজও ঠিক বুঝি না।

যা-ই হোক, সেই থেকে রবিবার বিকেলটা— নিতান্ত অসুবিধা ছাড়া— সোজা সাউথ সিঁথি। প্রতি রবিবারেই নতুন কিছু পেয়ে আমার ঝুলি-ভরার শুরু। একদিন গিয়ে দেখি, সুধীনদা সুর করছেন। ইশারায় আমাদের বসতে বললেন। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে বললেন— শোনো তো সঞ্চারীটা।

গাইলেন—

‘কলম’ ঘিরে ছায়ার মত সঙ্গিনীরা আসে—
কাব্য করে সঙ্গী খুঁজে মেলাই
সঙ্গহীনা, সর্বহীনা, মৃত্যুহীনার পাশে।’

মনে পড়ল— গত সপ্তাহে যে গানটির সুর শুনিয়েছিলেন, সেই ‘চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে’— তারই সঞ্চারী।

শুনিয়ে যেই আমার দিকে তাকিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে— খুব ভাল! দারুণ!

—নাঃ, তোমাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। তোমার তো সবই দারুণ!� বলে অন্যদের দিকে হাসলেন।

গানটি সুধীনদারই লেখা। রেকর্ডে মান্না দে-র গাওয়া এ গানটি অবশ্য অনেকেরই শোনা আছে; তবু পুরো গানটিই লিখে দিচ্ছি। কেননা, আমার বিশ্বাস, যাঁরা সুধীনদার গান লেখা সম্বন্ধে খুব ওয়াকিফহাল নন, তাঁরা সহজেই বুঝে নেবেন; গীতরচনাতেও কত অনায়াস, কত কাব্যিক, কত নবতর ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত।

চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে
সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে
আকাশ করে ছাতটাকে, বাড়াই যদি হাতটাকে
মুঠোয় ধরি দিনের সূর্য তারার রাতটাকে—
বিশ্বরূপের দৃশ্য দেখাই চোখের অবিশ্বাস্যকে ।।
কলম ঘিরে ছায়ার মত সঙ্গীনীরা আসে—
কাব্য করে সঙ্গী খুঁজে মেলাই
সঙ্গহীনা, সর্বহীনা, মৃত্যুহীনার পাশে।
আমার মনের দরজাতে খিল দিয়ে মন আটকাতে
সঙ্গিনী কেউ আসেনি তো প্রেমের প্রদীপ হাতে
কবে যে তার পড়বে মনে আমার মত নিঃস্বকে ।।

ছোট্ট আপন ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে গোটা বিশ্বকে দেখতে পাওয়ার কী অনুভব! মনের মধ্যে সূর্যতারার দিনরাতকে সীমাবদ্ধ করার চেতনার কী অভিনব প্রকাশভঙ্গি! আমার বিশ্বাস, শুধু কবিতা হিসেবেই রচনাটিকে ওপরের সারিতে রাখা যায়।

আরেকটি রচনা:

‘এক ঝাঁক পাখিদের মত কিছু রোদ্দুর
বাধা ভেঙে জানলার শার্সি-সমুদ্দুর
 এলো আঁধারের শত্তুর।’

এই ‘শার্সিসমুদ্দুর’ কথাটা একটা বাঁধভাঙা আলোর ছবি এঁকে দিয়ে যায়। একটি শব্দে এক পরিপূর্ণ আবহের সৃষ্টি হয়েছে। আবার গানটির সঞ্চারীর লাইন দুটি—

‘পায়ে পায়ে সন্ধ্যার ক্লান্তি নিয়ে
যারা যায় ফিরে ঘরে শহরে নগরে
পায় কি মনে সূর্যের গতিবেগ
অস্তরাগের ছোঁয়া অন্তরে।’

‘বন্ধ ঘরের কোণ ছাড়িয়ে’ এসে যে মানুষেরা সূর্যের সঙ্গে সারাদিন থেকে সন্ধ্যার ক্লান্তি পায়ে পায়ে নিয়ে ফিরল, তারা কি ‘সূর্যের গতিবেগ’ মনে মাখতে পারল বা ‘অস্তরাগের ছোঁয়া’য় অন্তর স্নিগ্ধতর হল! — এই যে রাস্তায় পা বাড়ানো মানুষের মনের অন্ধকার আলোর ছোঁয়ায় কতটা ঘুচল— এমন ভাবনা, এমন স্নিগ্ধতার চিত্রকল্প খুব বেশি মেলে না।

সুধীনদা আরও অনেক গান লিখলে আমার এমন অনেক ভাবনার সন্ধান পেতাম। মূলত সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তের কথা বলতে বসে আগেই তাঁর গীতরচনার বিষয়ে এত কথা বলা এই কারণে যে, তাঁর এই লিরিক ভাবনা তাঁর সুরকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ফিল্মে, ফিল্মের বাইরে অনেক গীতিকারের গানে সুর দিয়েছেন। তাই অন্যান্য গীতিকারের রচনাতে আপন কবিসত্তার কারণে, লিরিক অনুযায়ী যথাযথ সুরে সাজানোর ধ্যানকে যুক্ত করে এত রসোত্তীর্ণ এবং জনপ্রিয় গান উপহার দিতে পেরেছেন।

আসলে কোন গান শ্রোতাদের মন জয় করবে, আর কোন গান পড়ে মার খাবে, এ ভবিষ্যদ্বাণী দুনিয়ার কারও পক্ষে করাই অসম্ভব। তাই মনে হয় খুব জনপ্রিয় সুরের স্রষ্টাদের একটি বাড়তি ‘ইন্দ্রিয়’ থাকে। জনমানসের পছন্দ-অপছন্দের অন্দরমহলের কিছু খবর এই স্রষ্টাদের ধ্যানে ধরা পড়ে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা সুরকারদের গোষ্ঠীতে সুধীনদার আসনটিও যে এমন পাকাপোক্ত— তার অন্তরালেও নিশ্চয়ই এমন একটি বাড়তি মুন্সিয়ানা রয়ে গেছে।

সুধীনদা ছিলেন, যাকে বলে— একজন টোটাল মিউজিসিয়ান। কথা অনুযায়ী সুরের সন্ধান, সঙ্গীতানুষঙ্গের পরিমিত ও যথাযথ প্রয়োগের যে দৃষ্টান্ত উনি রেখেছেন, তার তুলনা মেলা ভার।

প্রথমেই আসি ‘ডাকহরকরা’ ছবির গানের কথায়। শুধু একতারা সহযোগে গাওয়া— ‘মনরে আমার শুনলি না বারণ/ সোনার হরিণ ধরতে গেলি, ঘরে হলো সীতাহরণ’ বা ‘ওগো তোমার শেষবিচারের আশায় আমি বসে আছি’— তারাশঙ্করের অনবদ্য রচনায় যে অন্তর্মুখীনতা, যে আত্মনিবেদনের সুর, তার গভীরে প্রবেশ করতে না পারলে এমন সুরারোপ সম্ভব নয়। লোকগীতির আশ্রয় নিয়ে ছবির কাহিনী ও চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে দার্শনিক অভিব্যক্তির এই রচনাগুলিতে এমন সহজিয়া সুরের গান বাঁধা অবশ্যই বিশাল কোনও সঙ্গীতমনস্কতারই স্বাক্ষর।

এই ছবির গানের প্রসঙ্গে একটি সার্থক Combination-এর কথা মনে আসে। তারাশঙ্কর/সুধীন দাশগুপ্ত/ মান্না দে— রচনা, সুরসংযোজনা এবং গায়ন— তিন যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে! একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করা যায় না। এরকম Combination হাজারে একটা মেলে। আমার ধারণা, শিল্পগত উৎকর্ষের নিদর্শন আর কোনও ছবিতে এমন করে পাইনি। সুধীনদা বহু ছবিতেই মূল চরিত্রের গানগুলি মান্না দে-কে দিয়ে গাইয়েছেন— একথা মনে রেখেই বলছি। ‘ডাকহরকরা’ ছবিতে সঙ্গীতানুষঙ্গের কী অনাড়ম্বর অথচ অব্যর্থ প্রয়োগ! ওই ছবিতেই ‘লাল পাগুড়ি দিয়ে মাথে/ রাজা হলে মথুরাতে’ গানটিতে সুরারোপে, ছন্দের ব্যবহারে সুধীনদা যেন অন্য মানুষ। আগের দুটি গানের সঙ্গে একই রচয়িতার, একই গায়কের গাওয়া গানের একেবারেই ভিন্নতর স্বাদ! প্রসঙ্গত, মান্না দে-র গাওয়া এই গানটির চলচ্চিত্রায়নে বড় সুন্দরভাবে নৃত্যের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ।

আবার ওই ছবিরই দ্রুতলয়ের হালকা চালের গানে সুরারোপ ও যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবহারের আকাশ-পাতাল তফাত। গান দুটি— ‘কাঁচের চুড়ির ছটা ছোঁয়াবাজির ছলনা’ (গীতা দত্তের গাওয়া) এবং ‘চোখে ছটা লাগিল তোর আয়নাবসা চুড়িতে’ (শ্যামল মিত্র)। ছবির বিভিন্ন অংশের আবহটিকে সাজানোর জন্যে ঠিক যে ধরনের গান প্রয়োজন, তারই নমুনা মেলে গান দুটিতে। সত্যি বলতে কি ‘ডাকহরকরা’ ছবিতে গীতরচনা, সুর, গায়ন, আবহ, সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় তো নিশ্চয়ই— সব যেন একই ঠিকানায় এসে হাজির হয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত চিত্র জগতে খুব কমই আছে।

সুধীনদার সুরে সাধারণত দুটি ধারার আশ্রয় লক্ষ্য করা যায়— লোকসঙ্গীত ও পাশ্চাত্যসঙ্গীতের সুর। কিন্তু কোথাও তাদের প্রভাব প্রকট নয়; প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। লোকসঙ্গীতের একটি উদাহরণ তো ওই ‘ডাকহরকরা’� আর একটিতেও লোকসুরের ব্যবহার রয়েছে; ছবিটির নাম ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’। অনুপকুমার অভিনীত ‘বলরাম’ চরিত্রটির মুখে নানা ধরনের লোকসুর শোনা গেছে। সেই সুরের আবহ ছবিটির গতিতে সাহায্য করেছে, সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলিকেও অর্থবহ করেছে।

সুধীনদার সুরের একটি পরিচিত স্টাইল ছন্দ নিয়ে খেলা। গানের শুরুতেই ছন্দবৈচিত্র্য। ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবিতে ‘আরো দূরে চলো যাই’ অংশের পরের লাইনেই কথা যেন ছন্দকে দ্বিগুণ করে নিয়েছে— ‘মন নিয়ে কাছাকাছি, তুমি আছ আমি আছি’— আবার ‘পাশাপাশি’ কথাটি আগের ছন্দ ফিরিয়ে দিয়েছে। আরও অনেক ছবির গানে ছন্দের এই খেলা দেখা যায়।

‘অভিশপ্ত চম্বল’ ছবিতে সুধীনদার গীতরচনা ও সুরকৃতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ছবির গল্পের পটভূমির সঙ্গে পরিপূর্ণ সঙ্গতি রাখার জন্যে রচনাগুলিতে বাংলার সঙ্গে হিন্দি, উর্দু শব্দের মিশ্রণে বড় মানানসই এক আবহের সৃষ্টি হয়েছে। ‘ঝুম ঝুমকে নাচোরে’, ‘কেন ডাকো ইশারায়’, ‘চোরি চোরি সাঁবরিয়া’ বা ‘সৈঁয়া যা রে যা’, ‘… প্যার করেছি, মরেছি’— গীতরচনায় ভাষার এই নবতর ব্যবহার এবং তার সঙ্গে সেইরকম Regional সুরের ছোঁয়া এবং অবশ্যই যন্ত্রসঙ্গীতের যথাযথ ব্যবহার গানগুলিকে সত্যিই সুখশ্রাব্য করে তুলেছে, রসোত্তীর্ণ করেছে তো বটেই, তা ছাড়াও ছবির গানের যেটি সবচেয়ে বড় কাজ— ছবিটিতে কাহিনীর উপযোগী আবহাওয়ার সৃষ্টি করা, কাহিনীটিকে সহজভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা— সব কাজ সাফল্যের সঙ্গে সুসম্পন্ন করা গেছে।

একটু শ্লেষমাখা মজার গানকে একেবারে নিজস্ব স্টাইলের সুর ও ছন্দে মুড়ে অনেক ছবির গান করেছেন সুধীনদা। একটি গান— ‘লাগ, লাগ, লাগ লাগ ভেলকির খেলা/ পারো যদি লুটে নাও সব এইবেলা/ কেউ রাজা কেউ চোর কেউ ডিমওয়ালা’—। ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবির এই গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এ গান সম্পর্কে আরেকটি কথা— মহানায়ক উত্তমকুমারের লিপে সুধীনদার সুরে মান্না দে-র গাওয়া এই প্রথম ছবির গান। এরকম মজার গান, একটু পাশ্চাত্য সুর মাখা। আরেকটি পাচ্ছি ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে— ‘জীবনে কী পাবো না, ভুলেছি সে ভাবনা/ সামনে যা দেখি, জানি না সেকি আসল কি নকল সোনা’। গানটি সুপারহিট হয়েছিল।

সুধীনদা তখন ‘ছদ্মবেশী’ ছবিটির সঙ্গীত পরিচালনা করছেন। এই গল্পটি অনেকদিন আগে একবার চিত্রায়িত হয়েছিল। ‘ছো, ছো, ছো, ছো, ক্যা শরমকী বাত/ ভদ্দর ঘরকা লেড়কি ভাগে ডেরাইভারকে সাথ’— এই গানটি ছবিতে তখনকার সর্বজনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতা রঞ্জিত রায় নিজের গলায় গেয়েছিলেন এবং অভিনয়ও করেছিলেন। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল গানটি।

তা, সুধীনদা এই গানটির সুর করছেন, সেই সময় আমরা তিনমূর্তি হাজির। হঠাৎ সুধীনদা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন— আচ্ছা জটিল, তুমি আগে যে ‘ছদ্মবেশী’ ছবি হয়েছিল, দেখেছিলে?

বললাম— হ্যাঁ।

—আচ্ছা ‘ছো, ছো, ক্যা শরমকী বাত’ গানটার কী সুর ছিল, মনে আছে?

খালি গলাতেই গুণগুণ করে দুলাইন গেয়ে দিলাম। এইবার সুধীনদা হারমোনিয়াম-সহ নিজের সুরে ওই গানটি শোনালেন। আমি তো অবাক! আগের সুরের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। কোনও রকমেই নয়। আমি লাইন দুটির স্বরলিপি লিখে তফাতটা বোঝাবার একটু চেষ্টা করছি।

আগের সুরটি ছিল—

স স গ র। গ ম প প। প প ধপ ম। গ — — গ
ভদ দর ঘর কা। লেড় কি ভা গে। ডেরা ই ভার কে/ সা ০ ০ থ

আর সুধীনদা করলেন—

ম জ্ঞ ম প। ম জ্ঞ ম প। জ্ঞ ম জ্ঞ র। স — — স
ভদ দর ঘর কা। লেড় কি ভা গে। ডেরা ই ভার কে। সা ০ ০ থ

যাঁরা পরের ‘ছদ্মবেশী’ ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে সুধীনদার সুরটিও কী অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিল। সুধীনদার সুরে গানটি গেয়েছিলেন অনুপ ঘোষাল। প্রসঙ্গত এইরকম মজার গান সুধীনদা আরও অনেক ছবিতে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’ (মান্না দে) গানটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

ছবির গানের জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার করলে সুধীনদাকে একেবারে সামনের সারিতে রাখতেই হবে। একথা অবশ্য আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, আজকের টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আসরে বা বাংলা চিত্রগীতির আলোচনাশীর্ষক অনুষ্ঠানে গাওয়া সুধীনদার প্রচুর গানই তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।

‘এক যে ছিলো বাঘ’ ছবিতে শীর্ষ গানটি সুধীনদা এক শিশুশিল্পীকে দিয়ে গাইয়েছিলেন। চৈতি রায়। চৈতির বয়স তখন সাত বছর। ভারী সুন্দর লেগেছিল গানটি। এখানে আবার একটি কথা বলার আছে। ছোটদের গলার গান তৈরি করার সময় একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখতেই হয়— কত সহজে গানটি গাওয়া যায়। তবেই তো সেটি ‘ছোটদের গান’ হয়ে ওঠে। এই ব্যাপারেও সুধীনদা সিদ্ধহস্ত। সত্যি বলতে কি ছোটদের গানের সুরারোপের বিষয়টি আমরা অনেকেই তাঁর কাছে রীতিমতো পাঠ নিয়ে শিখতে পারতাম। দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, কী ছবিতে, কী ছবির বাইরে, ছোটদের গানে কিন্তু আজ আমরা সেই সহজিয়া সুরটা একেবারেই আনতে পারছি না। বিশেষ করে কোনও কোনও ছবিতে শিশুশিল্পীর লিপে আমরা যে সব গান রাখছি, তা শিশুদের ক্ষেত্রে শুধু দুঃসাধ্যই নয়, বেমানানও বটে।

সুধীনদার সঙ্গীতরচনায় পাশ্চাত্যসঙ্গীতের প্রভাবের কথা আগেই বলেছি। কিন্তু সে প্রভাবের কারণে বাংলা গানের নিজস্বতা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি তাঁর গানে। বরং পাশ্চাত্যসঙ্গীতের স্বরপ্রয়োগ এবং ছন্দের বৈশিষ্ট্য গানকে উপভোগ্য করে তুলেছে। লোকসুর বা পাশ্চাত্য সুরের আশ্রয় সম্পর্কে সুধীনদা এমনই সচেতন যে কখনও অনুকরণ না হয়ে প্রভাবের সার্থক প্রয়োগ হতে পেরেছে। অন্যান্য বহু গুণের সঙ্গে এই বিশেষ সচেতনতাও তাঁকে সফলতম সঙ্গীতস্রষ্টাদের একজন হতে সাহায্য করেছে। পাশ্চাত্য সুর বা ছন্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানা দেখতে পাই শ্যামল মিত্রকে দিয়ে গাওয়ানো ‘ভীরু ভীরু চোখে চেয়ে চলে গেলে’ গানটিতে।

ফিল্মে আবহসঙ্গীতরচনার ক্ষেত্রেও সুধীনদার বৈশিষ্ট্য মনে রাখার মতো। ‘হেডমাস্টার’ ছবিতে গল্পটির অন্তর্নিহিত ভাবটিকে সাঙ্গীতিকভাবে চিহ্নিত করার মানসে সুধীনদা শুধু একটি সমবেতকণ্ঠের হামিংকে ব্যবহার করে যে আবহের সৃষ্টি করেছিলেন, তা এককথায় অভাবনীয়। ছবিটা দেখার আগে বুঝতেও পারিনি যে, হামিংটির জন্যে এত রিহার্সাল। এত সময় নিয়ে, এত গুরুত্ব দিয়ে— এর কারণটা কী? ছবি দেখতে বসে বুঝলাম ওই হামিংটুকুই বিশেষ বিশেষ জায়গায় বারবার ফিরে ফিরে আসছে এবং একটা অদ্ভুত সঙ্গীতের সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবার। আসলে ওই হামিংটিই ছবির মিউজিকের মুখ্য অংশ— থিম মিউজিক। এখানেই খুঁজে বেড়াতে হবে সুধীনদার সেন্স অফ পারফেকশনের ঠিকানা।

প্রসঙ্গত, এই ‘হেডমাস্টার’ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেববর্মণ মন্তব্য করেছিলেন— সুধীন যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছে ছবিটায়, তার প্রত্যেকটি অংশ থেকে ভাল গান তৈরি করা যায়।

পারফেকশনের ব্যাপারে তিনি যে কী পরিমাণ সচেতন ছিলেন, তার একটি নমুনা পেয়েছিলাম একটি খাতা দেখে। একটি এক্সারসাইজ বুকে লিখছিলেন সুধীনদা। কৌতূহলবশত একটু কাছে গিয়ে বসলাম। দেখি, যে সিচুয়েশনে যাঁর লিপে গানটি হবে, সব কিছু বিস্তারিতভাবে লিখে জায়গামতো গানের প্রথম লাইনটি লিখে নিচ্ছেন। সেদিন আরেকবার বুঝেছিলাম মানুষটির কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। কোনও সৃষ্টিধর্মী কাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার জন্যে যে নিজের মধ্যে কত রকমের আয়োজন, কী অপরিসীম নিষ্ঠার প্রয়োজন, তা একজন সার্থক স্রষ্টার একটু কাছাকাছি না গেলে কিছুতেই বোঝা যায় না।

বাংলা ছবি ছাড়াও সুধীনদা অসমিয়া ছবিরও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। একটির কথা আমার খুব বেশি করেই মনে আছে, কেননা ওই ছবির একটি ডুয়েট গান আমাকে আর সুজাতাকে (সরকার) দিয়ে প্লেব্যাক করিয়েছিলেন। ছবির নাম ‘অরণ্য’। মনে পড়ছে, গান রেকর্ডিং উপলক্ষে কয়েকজন অসমিয়া ভদ্রলোক স্টুডিওতে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এসে আমাদের অসমিয়া উচ্চারণ ঠিক করে দিচ্ছিলেন। অবশ্য গান তোলানোর সময় সুধীনদা গানটির সিচুয়েশন বেশ বিস্তারিতভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তাই গাইতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু সব ভাষারই উচ্চারণের একটি বিশেষ accent থাকে তো! সেটাই দেখানো হচ্ছিল আমাদের। কিন্তু এ প্রসঙ্গে যে কথাটা মনে রাখার মতো তা হল— ওই অসমিয়া ভদ্রলোকেরা আমাদের কাছে আসার আগে প্রত্যেকবার সুধীনদার অনুমতি নিচ্ছেন। এই ব্যাপারটি আমার খুবই ভাল লেগেছিল। সুধীনদার সঙ্গে যে কয়েকবার ফিল্মের রেকর্ডিং স্টুডিওতে গেছি, সব সময়ই দেখেছি কাজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডাইরেক্টর, রেকর্ডিস্ট, যন্ত্রীরা— সকলেরই চোখে সুধীনদা সম্বন্ধে একটা প্রীতিমাখানো সমীহের দৃষ্টি!

হিন্দি ছবির বিষয়ে সংবাদ— বিখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা গুরু দত্ত সুধীনদার সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে সুধীনদাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন বোম্বাই (মুম্বই)। দু’বছরের চুক্তিও হল। চুক্তি বলে চুক্তি। ‘এক্সক্লুসিভ’! অর্থাৎ, গুরু দত্তর ছবি ছাড়া আর কোথাও কোনও কাজ করা যাবে না এই দু’বছর! শুনেছি গুরু দত্ত মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত ‘মুডি’। অত বড় একজন চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলাও বিলক্ষণ অস্বস্তিকর। কিন্তু বাধ্য হয়েই বলতে হয়, যে মানুষটিকে এক্সক্লুসিভ করে নিয়ে এলাম, তাঁর বিষয়ে দু’বছরের মধ্যে কিছুই ভাবা হল না! ফলম ফলে ফলাঃ— সুধীনদার দুটি বছর জলে গেল! এবার ফিল্মের বাইরে, অর্থাৎ বেসিক রেকর্ডের কথা। এক্ষেত্রেও সুধীন দাশগুপ্ত প্রকৃত অর্থেই সফল। তাঁর সুরে গানের রেকর্ডের সিংহভাগই রসোত্তীর্ণ তো বটেই, ব্যবসায়িক দিক থেকেও সাফল্য পেয়েছে প্রচুর।

সেই সময়ের জনপ্রিয় গায়ক-গায়িকার প্রায় সকলেরই রেকর্ডের গানে সুর দিয়েছেন সুধীনদা। আর তার মধ্যে হিট গানের সংখ্যাও প্রচুর। তাঁর সুরে জনপ্রিয় গানের রেকর্ডের অধিকাংশের কথা বলতে গেলেও এ প্রবন্ধ দীর্ঘ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবু অন্তত কিছু গানের উল্লেখ না করলে বোঝানো যাবে না যে বাংলা গানের একটি বিশেষ যুগের যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে কী গীতরচনায়, কী সুর সংযোজনায়, বা অর্কেস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে সুধীন দাশগুপ্তের আসন কতটা ওপরের সারিতে।

ছবি বা ছবির বাইরে সুধীনদার পরিচালনায় মান্না দে-র গানের রেকর্ডের কথা আগেই বলেছি। নিবন্ধের প্রথমেই প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত ‘সাগর থেকে ফেরা’র গীতিরূপটি রেকর্ডে অপূর্ব গেয়েছিলেন বিরল প্রতিভার শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯৬৪)। ১৯৫৭-তে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য স্ট্যান্ডার্ড প্লেতে সুধীনদার সুরে গাওয়া ‘এই ঝিরঝির বাতাসে কি গান ভেসে আসে’/ ‘গান গেয়ে ফিরে গেছি’— দুটি গানই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। একইভাবে একই রেকর্ডের দুটি গানই— ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’/ ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই’ লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। গান দুটি ১৯৫৬-তে গেয়েছিলেন দরদী শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তারও আগে ১৯৫৪-তে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড করা দুটি গানই— ‘ভাঙ্গা তরীর শুধু এ গান’ (ভাস্কর বসু)/ ‘এই ছায়া-ঘেরা কালো রাতে’ বাংলা গানের ক্ষেত্রে দুটি সুন্দর উপহার।

আরও অনেক জনপ্রিয় গানের রেকর্ডের মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করি। প্রথমেই বলি, আশা ভোঁসলের দুটি অসাধারণ জনপ্রিয় গানের কথা। ‘আকাশে আজ রঙের খেলা, মনে মেঘের মেলা’/ ‘নাচ ময়ূরী নাচরে’— গান দুটি সুধীনদার সুরকৃতি, আশাজির অনবদ্য গায়কী, যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবহার, ছন্দ সব মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি! শ্যামল মিত্রের ‘নাম রেখেছি বনলতা’/ ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে’ এ দুটি গান যে কতদূর জনপ্রিয় হয়েছিল, তা অনেকেই জানেন। এ ছাড়া মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে, আকাশে তারাদের ঐ মিছিলে’ বা সুবীর সেনের কণ্ঠে ‘এত সুর এত গান’ সুর রচনার প্রচলিত ধারার সঙ্গে সুধীনদার আপন বৈশিষ্ট্যের সংযোজনের দৃষ্টান্ত। আরও দুটি প্রকৃতই মিষ্টি গান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে— ‘কৃষ্ণচূড়া, আগুন তুমি’ (বটকৃষ্ণ দে) এবং ‘কাজল কাজল কুমকুম’ (মিল্টু ঘোষ)। গান দুটির শিল্পী গীতা দত্ত।

প্রায় কুড়ি বছর যাবৎ বাংলা গানকে নতুন কথা, সুর, ছন্দ, যন্ত্রসঙ্গীতের যথার্থ ব্যবহার এসব দিয়ে সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন সুধীন দাশগুপ্ত।

সুধীনদার আর একটি মনে রাখার মতো কাজ— নাট্যগীতির সুর রচনা। ছোটদের জন্যে লেখা নাট্যগীতি। একটি ‘ছোটদের রামায়ণ’। এটির গীতিনাট্যরূপ লিখেছিলেন স্বনামখ্যাত ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কীভাবে সুধীনদা সুভাষদার মতো এক ‘বাউণ্ডুলে’কে (সুভাষদার নিজের ভাষায়) প্রায় ‘ভুলিয়ে ভালিয়ে’ নিজের নতুন ফ্ল্যাট দেখাবার কথা বলে নিয়ে গিয়ে প্রায় ঘরবন্দী করে ওই গীতিনাট্যটি লিখিয়ে নিয়েছিলেন, সে বৃত্তান্ত সুভাষদা নিজেই লিখে গেছেন। যে ক’দিন রেকর্ডিং চলেছিল, রোজই সুভাষদা হাজির থেকেছেন এইচ এম ভি-র রেকর্ডিং রুমে। সারাক্ষণ!

যাঁরা গীতিনাট্যে সুর করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, কীভাবে নাটকটির প্রতি অঙ্গে সুরের বৈচিত্র্য বিষয়ে কতটা সতর্ক থাকতে হয়।

দীর্ঘ একটি কাব্যনাটকে সুর বসাবার সময় একটু সতর্কতার অভাবে একঘেয়েমির আশঙ্কা থাকে। সত্যি বলতে কি, একটি পুরো গীতিনাট্যকে সার্থক সঙ্গীতে সাজাতে গেলে— সুর, ছন্দ, তাল— সব কিছুতেই একটা বৈচিত্র্য সৃষ্টি করার দক্ষতার বড়ই প্রয়োজন। সুধীনদা খুব সহজ করে সে জিনিসটি বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন দু-তিনটি গীতিনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করে। হ্যাঁ, সেই সঙ্গে বহু নামীদামি গায়ক-গায়িকার পাশাপাশি অনামী অথচ সম্ভাবনাময় গাইয়েদের পাদপ্রদীপের আলোয় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, অনেক শিল্পীই সুধীনদার সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে পরবর্তীকালে পরিচিতি বা সুখ্যাতির মুখ দেখতে পেতেন কিনা সন্দেহ। আমাকে তো সুধীনদা যাকে বলে ‘হাত ধরে’ নিয়ে গিয়ে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডে গান গাইয়েছিলেন।

সুধীনদার সঙ্গীত পরিচালনায় দ্বিতীয় গীতিনাট্য ‘হিংসুটে দৈত্য’। ভাস্কর বসুর রচনা। বিখ্যাত কাহিনী ‘দ্য সেলফিশ জায়েন্ট’ অবলম্বনে। এই দ্বিতীয়টির বেলায় একটি প্রকৃত দুরূহ কাজ বড় মজার, বড় হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন সুধীনদা। কাজটি হল শিশুশিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো। শুধু ‘দৈত্যের’ ভূমিকায় অংশুমান রায় ছাড়া বাকি সব চরিত্রেই ছিল বিভিন্ন বয়সের শিশুশিল্পীরা। এই অংশুমানের কথা উঠতে আর এক কথা মনে পড়ে গেল। ছোটদের রামায়ণে অংশুমানের অভিনয়ের চরিত্র ছিল ‘হনুমান’, আবার ‘হিংসুটে দৈত্যে’, ‘দৈত্য’— অর্থাৎ নাটকের ‘অমানবিক’ চরিত্রগুলোতেই ছিল অংশুমানের যাকে বলে ‘মৌরসী পাট্টা’। ওকে এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ওর সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক (নাকি পৌরাণিক) হাসিটা হেসে উঠত। যাই হোক বড় ভাল গেয়েছিল অংশুমান গীতিনাট্যের অংশগুলি। আর একটি কথা, এই গীতিনাট্যের সময় সুধীনদা একটি জিনিস আরেকবার প্রমাণ করলেন ছোটদের গানের সুর করার জন্যে একটু ‘বড়’ সুরকারের প্রয়োজন। আরও একটি কথা, দুটি গীতিনাট্যেরই কথোপকথনের (বলা বাহুল্য সুরেই) প্রত্যেকটি লাইন নিজের খাতায় নোটেশন করেছিলেন। এর জন্যে কী পরিমাণ ধৈর্যের প্রয়োজন— তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বড়মাপের শিল্পীকে Methodial হতেই হয়।

সুধীনদার গান শুনতে শুনতে একটি দিকে বোধহয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। সুধীনদা অনেক কবি-সাহিত্যিকের রচনায় সুর দিয়েছিলেন। তারাশঙ্কর, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘থৈ থৈ শাওন এলো ঐ’ (১৯৫৭) রেকর্ডে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সুন্দর গান হয়েছিল। এখানে আবার একটি প্রসঙ্গ এসে পড়ছেই। ওই Combination-এর কথা। তারাশঙ্কর, সুধীনদা ও সন্ধ্যাদির জুটিতে এক কথায় অপূর্ব গান হয়েছিল ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলিতে/ আমি পথের মাঝে পথ হারালেম ব্রজে চলিতে/ কোন মহাজন পারে বলিতে’ (১৯৫৯)। মনে হয় তারাশঙ্করের একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকের রচনায় বিশেষ করে শব্দ ব্যবহারের বিষয়টা সুধীনদা যেন আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতি এইসব… কী বলব…— ‘দলছাড়া গান’। কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচির ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ/ মাগো আমার শোলোক বলার কাজলাদিদি কই’— ১৯৫৫ সালে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপূর্ব কণ্ঠে এই মন-কেমন-করা গানটি কখনও ভোলা যায় কি? এ প্রসঙ্গে প্রতিমাদির অনন্যসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ এবং গায়কীর সাবলীলতার কথাও অবশ্যই বলতে হবে।

গোড়াতেই বলেছি, গোড়ার কথা সব সময় গোড়ায় বলা হয়ে ওঠে না। তাই এবার একটু পিছিয়ে গিয়েই কথা বলতে হবে। কথাটা চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে। প্রচলিত বিভিন্ন শিল্পধারায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওই সময় এল ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’। গান, নাটক সবেতেই যেন নতুন জোয়ার নিয়েই এল। বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরি, সুধীন দাশগুপ্ত, পরেশ ধর— এমনই বেশ কিছু বিরল প্রতিভার ব্যক্তিত্বকে উপহার দিল গণনাট্য সঙ্ঘ। গানের কথায় চিরাচরিত নরনারীর প্রেম বা ওই ধরনেরই কিছু— এসব ছাড়াও যে গানে কত কিছু উপজীব্য থাকতে পারে, সেকথা এর আগে অজানাই ছিল। এঁরা নিয়ে এলেন সমকালীনতা। কৃষক, শ্রমিক, মাঝিমাল্লা। দীনদরিদ্র, অবহেলিত— সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, স্বপ্নের কথা— সব কত সহজে গানের কথা হয়ে গেল। প্রেমও বাকি রইল না তো বটেই; বরং প্রেম বিষয়টির এক নবতর অনুভবের সন্ধান পাওয়া গেল এঁদের রচনায়, সুরে।

গণনাট্যের সমবেত সঙ্গীতের অনুষ্ঠান যেন জাদুবলে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গেল। এর স্রষ্টা শিল্পীরা বিভিন্ন অঞ্চলে সঙ্গীতগোষ্ঠী, নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে মানুষকে শোনাতে লাগলেন মানুষের গান, মানুষের কথা নিয়ে নাটক। সেদিনের ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘শান্ত নদীটি’— এসব গান তো লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাট্য আন্দোলনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

উত্তর কলকাতার আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সঙ্গীত পরিচালনা ও নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুধীনদা অন্যতম। সুধীনদার সুরে ওই সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমার এ গান ছড়িয়ে দেব প্রান্তর থেকে প্রান্তরে’ (রচনা— দিলীপ সেনগুপ্ত), ‘মানবো না, কোনো কথা মানবো না’ (স্বরচিত)। ‘ঐ উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্নরঙ্গীন’— গানটি সুবীর সেনের কণ্ঠে খুবই জনপ্রিয় একটি গান।

গণনাট্যের প্রসঙ্গে কিছু গানের কথা বিশেষভাবে বলা এই জন্যে যে সেই সময়ের ওই গণসঙ্গীতের কথা ও সুরের ধারা, সমবেত গানে ‘ভয়েস হার্মনি’, ‘হামিং’ ইত্যাদি ব্যবহারের বিষয়টা কিন্তু আমরা পরবর্তীকালে সুধীনদার Lyric বা Composition-এ দেখতে পাই। স্বরের প্রয়োগ, Orchestration, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ওই Choral Expression, ওই Progressive approach-এর ছোঁয়া পাই। — ‘এক ঝাঁক পাখিদের মত কিছু রোদ্দুর’, ‘আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা’ (সুভাষদা), ‘আকাশে তাকালাম’ (সুভাষদা) ইত্যাদি।

সুধীন দাশগুপ্তের মতো এত বড়মাপের সঙ্গীতব্যক্তিত্বকে প্রথম আলাপের দিন থেকে শেষ দেখা পর্যন্ত মানুষ হিসেবে যেমনভাবে দেখতে পেয়েছি, সে বিষয়ে অল্প কিছু কথা এবার বলি। প্রথমেই তাঁর বাকসংযমের কথা বলতে হয়। এই দুনিয়ায় যখন আজ কথা বলার লোকেরই ভিড়— শোনার লোক যখন খুঁজে বেড়াতে হয়— তখন অন্যের কথার মাঝে একটি কথাও না উচ্চারণ করে একনাগাড়ে কারও অনর্গল কথা শুনে যাওয়ার মতো ধৈর্য সুধীনদা কোথা থেকে পেয়েছিলেন জানি না। কোনও বিরক্তি নেই, দিব্যি মুখে মিটিমিটি হাসিটি নিয়ে নিবিষ্টচিত্তে শুনেই চলেছেন সুধীনদা। আমরা যারা আশপাশে থাকতাম, রীতিমতো অবাক তো হতামই, মাঝে মাঝে এও মনে হত বক্তাটিকে কোনও কৌশলে থামানো যায় না? কিন্তু সুধীনদা নির্বিকার। একটা কথা অবশ্য কিছুদিন পরে বুঝেছিলাম কম কথা বলা এই মানুষটি যখন যেটুকু কথা বলেন, তা একটা আলাদা গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। কেন না বেশি কথা বলা লোকের অনেক কথাই লোকে বাদ দিয়ে শোনে।

এসব কথা মানে কিন্তু মোটেই এই নয় যে, সুধীনদা মানুষটি ‘গোমড়ামুখো’ ছিলেন। বাড়িতে বা কাজের অবসরে সুধীনদা একেবারে অন্য মানুষ। নকল গাম্ভীর্য মিশিয়ে অনেক মজার কথা বলতেন— তারপর থাকতে না পেরে নিজেই হো হো করে হেসে উঠতেন।

বড় শৌখিন মানুষ ছিলেন সুধীনদা। সব সময় ধোপদুরস্ত পায়জামা আর পাঞ্জাবি (কখনও গরদ বা তসরের)। পান-জরদার অভ্যাস ছিল। ঝকঝকে পানের ডিবে, চকচকে পিকদান। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো। সব কিছুতেই সাফসুতরো। কেমন একটা বনেদি ভাব। সুধীনদাকে কখনও দেখিনি, বাড়িতেও এলোমেলো হয়ে যাওয়া পোশাক পরে আছেন।

সুধীনদা ছিলেন খুবই ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। ধীর, স্থির। বিচলিত হতে দেখিইনি। রেকর্ডিংয়ে দেখেছি স্টুডিয়োয় কারও কোনও ভুল হলে যখন ‘কাট’ হত, তখন রেকর্ডিং রুম থেকে সুধীনদা বেরিয়ে স্টুডিওতে আসতেন এমনই ধীরপদে, যেন বেড়াতে বেরিয়েছেন। আবার ভুল ঠিক করে দিয়ে ফিরে যেতেন ওই একই গতিতে। তাড়াহুড়োটা জানতেনই না। সুধীনদার এই ধীর, স্থিরভাবের কথা বলতে গিয়ে একেবারে বিপরীতভাবের একজনের কথা বলতে হয়। সলিলদা। বিরাট সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরি। সুধীনদা যদি স্নিগ্ধ বাতাস, সলিলদা ঝড়! সলিলদাকে এক জায়গায় স্থির বসে থাকতে দেখেছে, এমন লোক খুব কমই আছে। কিন্তু হাবভাবে এমন বৈপরীত্য সত্ত্বেও দুজন প্রকৃত ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। দুই প্রকৃতির হলেও সঙ্গীতসূত্রে দুজনে বড় কাছাকাছি।

সলিলদার ‘পাগল হাওয়া’ (১৯৬৪) গানটি আমি রেকর্ড করার পরে গানটা সুধীনদাকে শোনাচ্ছিলাম। গানটিতে একটি লাইন আছে ‘সুরভি লুটের খেলায়’ শুনে সুধীনদা বললেন— ‘লুট কথাটা সলিল চমৎকার ব্যবহার করেছে, না?’

সলিলদার সুরে কবি বিমল ঘোষের ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’র musical arrangement ছিল সুধীনদার। আবার সলিলদার কাছে গান তুলতে গেছি; সলিলদা একটা গান করতে বললেন। গাইলাম, ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’। একটু আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘সুধীনের গান না?’ আমি হ্যাঁ বলে মুখের দিকে তাকাতেই দেখি নীরব তারিফের ছোঁয়া। একটা যেন appreciation দৃষ্টিতে উজ্জ্বল। আজ মনে হয়, এ শুধুই বন্ধুত্ব নয়। এক স্রষ্টার প্রতি অন্য স্রষ্টার স্বীকৃতি।

আমার কথাটি এবার ফুরিয়ে এল। তাই বলে নিই— সুধীনদার মতো ধীর, স্থির মানুষটির এমন তাড়াহুড়ো করে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়াটা আমাদের কারও মোটেই পছন্দ হয়নি। সেদিন কাছাকাছি মফসসলে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম আমরা কজন। কলকাতায় ফিরেই শুনলাম, সুরের আকাশ থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হারিয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *