‘আমি তো গেয়েছি সেই গান…’ – সুবীর সেন

‘আমি তো গেয়েছি সেই গান…’ – সুবীর সেন

নিজের জীবনে জড়ানো কোনও ঘটনা আবার নতুন করে মনে করতে গেলে আনন্দ ও দুঃখ একই সঙ্গে জেগে ওঠে যেন। তবে শেষ পর্যন্ত যে খারাপ লাগে তা বোধহয় বলা যায় না। সুধীনদা অর্থাৎ সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গে ঠিক কবে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল সেই তারিখটা আজ আর মনে নেই। মনে নেই বলেই যে-কোনও একটা তারিখ উল্লেখ করতে চাই না। তবে সেটা নিশ্চিতভাবে ১৯৫৪-র শেষদিকেই হবে। সুধীনদা তখন থাকতেন উত্তর কলকাতার একপ্রান্তে, সিঁথি অঞ্চলে। ঠিকানাটা ভোলা সম্ভব নয় বলে মনে আছে— ১৯ডি গুপ্ত লেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি বললে হয়ত কোনও পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে পারে নতুন গাইয়ে হিসেবে রেকর্ড করা বা অনুষ্ঠানে গাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘটনাটা কিন্তু তেমন কিছু ছিল না। কী ছিল তা একটু বোধহয় বুঝিয়ে বলতে হবে, কারণ সেটা ঘটনাটা ছিল আগাগোড়া বিপজ্জনক।

আমি গিয়েছিলাম এইচ এম ভি আয়োজিত এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় মোট ১৪০০ প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম হয়ে। গ্রামোফোন কোম্পানি সেই কম্পিটিশনটা করেছিল নতুন শিল্পী খুঁজে বার করার জন্য। ঘোষণা ছিল যে সেই শিল্পী-প্রতিযোগিতায় সেরা হবেন তাঁকে এইচ এম ভি থেকে রেকর্ড করার সুযোগ দেওয়া হবে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর কোম্পানি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাল— ‘রেকর্ড হবে, তুমি তোমার নিজের পছন্দের গান বেছে নাও।’ কথাটা এখনও শুনতে যত সহজ, আমার পক্ষে তখন সেটা ততটাই কঠিন। আমি আসামের ছেলে। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমরা। তার আগে গৌহাটি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত। ১৯৫১-তে কলকাতায় এসে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, সেখান থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করা। মাত্র কয়েক বছরে তখনও কলকাতার পথ-ঘাট, গানের লোকজনের সঙ্গে তেমন পরিচয় হয়নি। এক্কেবারে নতুন ছেলেকে কে গান দেবেন? সুরকার-গীতিকারদের মধ্যে অনেকেরই নাম শুনেছি, কিন্তু সাহস করে যেতে পারছি না। সহায় নেই, সম্বলও তেমন নেই। সম্বল বলতে এইচ এম ভি-র প্রতিযোগিতা জেতা।

লেখার শুরুতেই বারবার এইচ এম ভি-র সেই প্রতিযোগিতাটার কথা বলছি তাতে কেউ কেউ কৌতুক অনুভব করতে পারেন, কিন্তু আমার কাছে ভয়ের সাগর পাড়ি দেওয়ার সেটাই একমাত্র তরী। আর সত্যি বললে, সেই কাণ্ডটার মধ্যে কৌতুকও ছিল প্রচুর। এইচ এম ভি আর মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার— দুই সংস্থা মিলে কম্পিটিশনটা অ্যারেঞ্জ করেছিল। তখন মেট্রো সিনেমার ম্যানেজার ছিলেন হাফিজি, সম্ভবত পার্সি ছিলেন তিনি। কিন্তু বাংলা বুঝতেন এবং একই সঙ্গে সঙ্গীতরসিকও ছিলেন। প্রতিযোগিতার নাম ছিল— ‘কেরেজু কম্পিটিশন ফর নিউ ট্যালেন্টস’, কেরেজু একজন ক্লাসিক্যাল সিঙ্গার ছিলেন, তাঁর নামেই প্রতিযোগিতাটা। মেট্রো সিনেমায় যাচ্ছি আর খালি গলায় গান শোনাচ্ছি। যারা বাতিল হয়ে যাচ্ছে তাদের বলা হচ্ছে— ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যান আপনি।’ যাদের বারবার দেখা হচ্ছে তাদের বলা হচ্ছে— কাল আবার আসুন। পরপর তিনদিন গেলাম, গানও গাইছি রোজ। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। চতুর্থদিন যাওয়ার পর আমাকে বলা হল— ‘তোমাকে আমরা চিঠি লিখে জানাব।’ বাড়িতে এসে শুকনো মুখে জোর করে হাসার চেষ্টা করে চিঠি দেওয়ার খবরটা জানালাম। আমার মুখে সেই কথা শুনে দাদা এবং আমার বন্ধুদের মুখে সে কী হাসি! দাদা বলল— ‘তার মানে তুই ডিগবাজি খেয়েছিস, চিঠি আর আসবে না।’ কিন্তু হাসি-ঠাট্টার কয়েকদিন পেরিয়ে একদিন সত্যি চিঠি এসে হাজির। তাতে লেখা— ‘এবার আমাদের প্রতিযোগিতার ফাইনাল হবে। আমরা শেষ পর্যন্ত যে তিনজন শিল্পীকে বেছেছি তার মধ্যে তুমিও একজন। তিনজনের গান শুনেই আমরা একজনকে বেছে নেব।’

প্রবল উদ্বেগ নিয়ে সেই ফাইনালের দিন ‘মেট্রো’তে গেলাম। আমাদের শেষ তিনজনের মধ্যে ছিল দু’জন ছেলে, একজন মেয়ে। মেয়েটির নাম এখন আর মনে নেই, ছেলেটির নাম ছিল নির্মল হালদার। সে সাজুগুজু করে, নিজের তবলিয়া ও নিজস্ব হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছিল। সেই প্রথমে গাইল, ভালই হয়েছিল, প্রবল হাততালি হলে। দ্বিতীয় শিল্পী সেই মেয়েটি। তার সঙ্গেও নিজস্ব হারমোনিয়াম, তবলিয়া ছিল। সেও দিব্যি গাইল। আমার সঙ্গে কিছুই নেই। স্টেজে একটা হারমোনিয়াম ছিল, কিন্তু তার অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। কিন্তু আমার তো কোনও উপায় নেই। সেটাই ডালাটালা খুলে গাইবার জন্য তৈরি হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। এইচ এম ভি-র ম্যানেজার আমার অবস্থা দেখে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তোমার তবলিয়া নেই?’ আমি সবিনয়ে বললাম— ‘না।’ তখন তিনিই এইচ এম ভি-র বেতনভুক তবলিয়াকে ডাকলেন। তা তিনি এলেন, বিশাল লম্বা চেহারা, নাম— প্রেমসুখ। আমি তাঁকে অনুরোধ করতেই তিনি বললেন— ‘আমি তো বাজাবার জন্যই এসেছি ।’ রীতিমতো নার্ভাস হয়ে তাঁকে আবার বললাম— ‘দেখুন আমি তো আপনার সঙ্গে কখনও গাইনি, আর যে গানটি গাইব তার দু-তিন লাইন শুনে যদি আপনি বাজাতে শুরু করেন…’, তিনি আমাকে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বললেন— ‘সেটা ঠিক আছে, আরে বাবা সে আমিই তো সব আর্টিস্টদের সঙ্গে রেকর্ডিং-এর সময় বাজাই।’ রীতিমতো নার্ভাস হয়ে গাইতে শুরু করলাম। সেই গানটা ভোলার নয় বলেই ভুলিনি। আমার গুরু অনুপম ঘটকের সুর দেওয়া গান— ‘সারা রাত জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ’, গানটা রেকর্ড করেছিলেন শচীন গুপ্ত। দু-তিন লাইন গাইবার পরে দেখলাম শ্রোতাদের মধ্যে একটু অন্য ধরনের চাঞ্চল্য শুরু হল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমিই বিজয়ী হলাম। সেই চিঠিও এল। এইচ এম ভি-র ইতিহাসে প্রথম নবীন শিল্পী হয়েও কোম্পানির সঙ্গে আমার তিন বছরের চুক্তি হল। এবং আমার বিপদ বাড়ল।

কোম্পানির কর্তা পি কে সেন আমাকে ডেকে বললেন— ‘তোমার প্রথম রেকর্ড হবে, সেজন্য তোমার সঙ্গীতজীবন শুরু করার জন্য তোমার নিজস্ব পছন্দ কিন্তু খুবই জরুরি কথা। সুর, কথা, তোমার গলা এবং গাওয়ার স্টাইলের সঙ্গে মানাবে এমন গানই তোমাকে বুঝে বাছতে হবে। এই কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার।’ সবই ভাল ভাল কথা, কিন্তু আমি তো সত্যিই অসহায়। তখন তো আমার এত কিছু বোঝার কথা নয়। মনে মনে নিজেকে বললাম— আমি আর কী বুঝব! তা ছাড়া কলকাতায় এসেছি মাত্র কয়েক বছর। গীতিকার-সুরকার হিসেবে কাউকেই তো তেমন করে চিনি না, যে তাঁর কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করা যায়। সসম্মানে বাড়ি ফিরে শুধুই ভাবছি। অনেকের গানই রেডিওতে, রেকর্ডে শুনি। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানও শুনি। তাঁর কয়েকটা বিখ্যাত গানের সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত। সুরের প্রশংসা ছাড়া কয়েকজনের কাছে একথাও শুনলাম তিনি নাকি মানুষও ভাল। শেষ পর্যন্ত কপাল ঠুকে চলে গেলাম সিঁথির সেই ডি গুপ্ত লেনে।

দুই

ভদ্রলোককে দেখেই কেমন একটা ভরসা পেলাম। শান্ত প্রকৃতির, কথা বলেন খুবই কম। কোথাও আমার হয়ে কিছু বলার কেউ ছিল না এই পরিস্থিতিই বোধহয় আমাকে একটু সাহসী করেছিল। পরিচয় দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে বললাম— ‘আমার প্রথম রেকর্ডিং তো, আমাকে একটা ভাল গান দিন।’ উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাল গান?’ তারপর কয়েক মিনিট পরে উনি নিজেই আমাকে যে গানটা দিলেন, সেটা ছিল— ‘নীল আকাশের ওই কোলে, কান্নাহাসির ঢেউ দোলে।’ গানটা ভাল, কিন্তু আমার যেন ঠিক পছন্দ হল না (পরে গানটা শ্যামলদা গেয়েছিলেন), কিন্তু ওঁর মুখের ওপর কী করে বলি, একটু সময় নিয়ে বললাম— ‘আর একটা গান যদি শোনান।’ তখন উনি গাইলেন— ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্নরঙিন।’ গানটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বললাম— ‘আমি এইটা গাইব।’ সুধীনদা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বেশ দ্বিধার সঙ্গে বললেন— ‘এইটা? এটা তো মানে আর একজনকে দেওয়ার কথা আছে…’। আমি বললাম— ‘তাহলে আমি গাইব না। আমার কোনও গান দরকার নেই।’ উনি তখন কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন— ‘আচ্ছা তুমি গানটা গাও তো দেখি।’ আমার অভিমান ওঁকে ছুঁয়েছিল কিনা জানি না। উনি আমার গাওয়া শুনে বললেন— ‘ঠিক আছে, গানটা তুমিই গাইবে।’ বলার পর উনি নিজের হাতে গানটা লিখেও দিলেন।

গানটার রেকর্ড হয়ে প্রকাশিত হওয়ার পর বহু গুণিজন অনেক কথা বলেছিলেন। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম, যখন জেনেছিলাম দিল্লিতে একটা স্কুলে গানটা ছাত্রছাত্রীদের প্রার্থনাসঙ্গীত হিসেবে গাওয়ানো হয়। একজন সঙ্গীতরসিক অভিভাবক দিল্লিতে তাঁর ছেলেমেয়ের স্কুলে গানটা শুনে সেখান থেকে ফোন করেছিলেন।

সেই শুরু। তারপর তো সুধীনদার সুরে বেশ কিছু গান করেছি এবং প্রতিটি গানই অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে। একজন শিল্পীর সঙ্গে সুরকার, সঙ্গীত পরিচালকের নির্ভুল বোঝাপড়া একটা সার্থক গানের ক্ষেত্রে খুব জরুরি কথা। কথাটা নতুন নয়, সকলেই নিশ্চয় সেটা বোঝেন। সুধীনদার কথা এই প্রসঙ্গে লিখতে শুরু করলে কোথায় গিয়ে থামা যাবে তা জানি না। আগেই বলেছি, মানুষ সুধীনদার কোনও তুলনা আমি আজও খুঁজে পাইনি। এত ভদ্র, বিনয়ী এবং উনি জীবনে কাউকে কোনও কঠোর বা রুচিহীন কথা বলেছেন— এমন ঘটনা আমি ভাবতেই পারি না। যোগ্যতার প্রশ্নে বলি, জীবনের অনেকটা পথ তো আমিও পেরিয়ে এলাম, গান-বাজনার এমন নলেজেবল মানুষও আমি দুটো দেখিনি। অথচ কথা বলতেন খুবই কম। মাঝে মাঝে শুধু হাসতেন।

তিন

স্মৃতির টেপরেকর্ডারে আবার একটু রিওয়াইন্ড করি। ‘ওই উজ্জ্বল দিন’ নিয়ে যখন এইচ এম ভি-তে গেলাম, তখন কোম্পানির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পি কে সেন গানটা শুনে বললেন— ‘বাঃ, এটা বেশ ভাল নির্বাচন হয়েছে, গানটার একটা চমৎকার মানে আছে, সুরটাও চমৎকার!’ পি কে সেন গানটা বুঝতেন। বাংলা গানের সেই আমলের শিল্পী-গীতিকার-সুরকাররা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন পি কে সেনের সময়টাই ছিল এইচ এম ভি-র সেরা সফল সময়। রেকর্ডের উল্টোদিকে ছিল ‘স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে আকাশ যে ওই’। সুর ও ছন্দের মজা ছিল সে গানেও।

আমাদের সমাজে কম জেনে বেশি বলার অভ্যাস আছে। অভ্যাসটা ভাল নয়। সুধীনদা বোম্বেতে গিয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার জন্য। ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফেরেননি। সুধীন দাশগুপ্ত সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা জানেন বলে প্রচার করতে পারেন, নিজের লেখাতেই বলতে হচ্ছে আমি বোধহয় একটু বেশিই জানি। কারণ একসঙ্গেই থাকতাম কিনা! স্থান— তারদেও সোনাওয়ালা বিল্ডিংস। তখন গণেশ বসাক নামে একজন আর্ট ডিরেক্টর সেখানে থাকতেন। গণেশবাবু খুব একটা অখ্যাত মানুষ নন, কারণ তিনি আর কে ফিল্মস-এর সঙ্গে কাজ করতেন। আমি আর সুধীনদা তাঁর ওখানেই থাকতাম। তখনও বোম্বেতে তীব্র বাসস্থান সমস্যা ছিল। সুধীনদা বোম্বে গিয়েছিলেন গুরু দত্তর আমন্ত্রণে।

প্রবাসে একসঙ্গে থাকার অনেক অর্থ থাকে। যাঁদের সেই অভিজ্ঞতা আছে তাঁরাই তা জানেন। কবে ছবি হবে তার ঠিক নেই। দিব্যি মাইনে পাচ্ছেন। খাওয়া-থাকা-ইচ্ছেমতো বেড়ানোর কোনও অসুবিধে নেই— এমন পরিস্থিতিতে খুশি হয়ে দিনরাত্রি কাটানোর মানুষ ছিলেন না সুধীনদা। রোজই নিজের মতো গান তৈরির কাজ করতেন, কিন্তু সেই ভাবনার বাস্তবিক ফল না দেখতে পেলে কোনও ক্রিয়েটিভ পার্সোনালিটির পক্ষে ভাল লাগার কথা নয়। সুধীনদারও লাগেনি, তাই তিনি কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। মুখে ঘোষণা করেননি, কিন্তু মনে মনে তিনি নিশ্চিত জানতেন যে বাংলা গানে তাঁর অনেক কিছু করার আছে। ইতিহাস আজ তাঁর সেই আত্মবিশ্বাসের সাক্ষী। বাংলা বেসিক-রেকর্ডের বা বাংলা সিনেমার হিট গানগুলোর তালিকা এই লেখায় উল্লেখ করাটা আমার কাজ নয়, রসিক শ্রোতারা সবই জানেন। আমার প্রশ্ন— দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বোম্বেতে বসে থেকেই দিন কাটালে এই গানগুলো আমরা কার কাছ থেকে পেতাম?

দুজনকেই কাছ থেকে দেখেছি তাই বলতে পারি সলিল চৌধুরি ও সুধীন দাশগুপ্তর মতো সর্বাঙ্গীন যোগ্যতা নিয়ে বাংলা গান তৈরির জগতে খুব বেশি মানুষ আসেননি। আমি তো ওঁদের দুজনের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য দেখি না। দুজনেই অসংখ্য যন্ত্র একেবারে পেশাদারি দক্ষতায় বাজাতেন। কে কী বাজাতে পারতেন তা কে বলতে পারবেন তা আমি জানি না। সলিলদা সেতার বাজাচ্ছেন— এমন দৃশ্য আমি দেখিনি, ঠিক তেমনই সুধীনদা আড়বাঁশি বাজাচ্ছেন, সেই দৃশ্যও আমি দেখিনি। দুজনেই লোকসঙ্গীত, উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্যসঙ্গীতে কর্তৃত্ব করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। সুরসৃষ্টিতে বৈচিত্র্য দেখানো বোধহয় সেইজন্যই ওঁদের পক্ষে সহজ হয়েছিল।

সুধীনদা কেন আরও অনেক গান লেখেননি তা আমি জানি না। অথচ লিখলেই যে চমৎকার লিখতে পারতেন তার পরিচয় তো সকলেই জেনে গেছেন। আশা ভোঁসলেকে দিয়ে যে গানটা গাইয়েছিলেন সেই গানটার সুরের সঙ্গে সঙ্গে কথাও (‘আকাশে আজ রঙের খেলা’) কি সুন্দর নয়? সারাদিন নিজের মনে থাকতেন। গলাটা একটু চাপা ছিল। গান নিয়েই থাকা এবং গুনগুন করে গান গাওয়া ছিল ওঁর অভ্যাস। গিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম— ‘সুধীনদা, নতুন কোনও গান লিখেছেন?’ উত্তর আসত— ‘না।’ ‘নতুন কোনও সুর করেছেন?’ জবাব আসত— ‘হ্যাঁ।’ তারপর অনুরোধ করলে সেই সুরটাও শোনাতেন।

চার

জীবনে অনেক জনপ্রিয় গান করেছি কিন্তু যে গানে আমার পরিচয় কথা-সুরে বাঁধা হয়ে গেছে সেটা অবশ্যই ‘এত সুর আর এত গান’। তখন সুধীনদা ও আমি একইসঙ্গে বোম্বেতে থাকি। একদিন সকালবেলা হঠাৎ সুধীনদা একটু গলা চড়িয়ে আমাকে ডাকলেন— ‘অ্যাই সুবীর, এদিকে এসো। একটা গান লিখেছি— এত সুর আর এত গান যদি কোনওদিন থেমে যায়/ সেইদিন তুমিও তো ওগো জানি ভুলে যাবে যে আমায়।’ চিরকালই কম কথা বলতেন। গানটা পড়ে শোনাবার পর বললেন— ‘এই গানটা তুমিই গাইবে।’ গানের কথাটা শুনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বললাম— ‘সুরটা?’ সুধীনদা বললেন, ভাবছি। ওঁর সুর ভাবতে ও তৈরি করতে বেশি সময় লাগত না। এখন আর নির্দিষ্ট করে মনে নেই, বোধহয় পরের দিনই সুরটা আমাকে শুনিয়েছিলেন। তখন আমারও নানা ধরনের গান, সুর শোনার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে। মূল সুরটা ছিল একটা ইংরেজি গানের সুর। অ্যাকোর্ডিয়ানে সেই সুরটা আমিও শুনেছিলাম। কিন্তু সেই সুরটাকে বাংলা লিরিকে ফেলে সুধীনদা যা তৈরি করলেন, তা আমি চিন্তাই করিনি। সহজ অথচ মর্মস্পর্শী।

গানটার রেকর্ডিং হবে। কলকাতায় এলাম সেই জন্যই। গানটা শুনলেন গ্রামোফোন কোম্পানির পি কে সেন। শুনে একটু সময় নিয়ে বললেন— ‘বাঃ, সুবীর ভাল করে গেয়ো। এই গান শুধু জনপ্রিয় নয়, অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ তাঁর কথা যে মিথ্যে হয়নি, তার সাক্ষী বাংলা গানের শ্রোতারা। পি কে সেন যে গানটা বুঝতেন বা একটা গানের ভাগ্য-ভবিষ্যৎ বুঝতে পারতেন তার আরও উদাহরণ আছে। প্রসঙ্গের টানে কথাটা এসে গেল বলেই বলছি। গীতিকার অমিয় দাশগুপ্ত একবার একটা গান লিখে পি কে সেনকে শোনালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন— ‘অমিয়, তুমি এই গানটার কাব্যরূপটাকে যদি প্রাণবন্ত চেহারায় চাও তাহলে এটা সুবীর ছাড়া কাউকে দিও না।’ সেই গানটায় (‘তুমি বলেছিলে কোনও মনের মুক্তো…’) চমৎকার সুরও দিয়েছিলেন অভিজিৎদা (অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)।‘এত সুর আর এত গান’-এর উল্টো দিকের গানটাও ছন্দে-কথায় মজাদার ছিল। শুধু রোমান্টিক নয়, জীবনের একটা অন্যরকম দেখা। লিখেছিলেন অনল চট্টোপাধ্যায়। সুর অবশ্যই সুধীনদার। একটা রেকর্ডের দুটো গানের মেজাজ ও চরিত্র আলাদা, কিন্তু দুটো গানই আলাদা করে জনপ্রিয় হয়েছিল। সুধীনদার সুরে জীবনে যত গান গেয়েছি তার প্রত্যেকটিতেই একটা আলাদা মেজাজ, প্রাণ খুঁজে পেয়েছি। এবং কী আশ্চর্য, শ্রোতারাও গানগুলো সেইভাবে শুনেছেন, অনুষ্ঠানে গাইতে গেলে গাইবার জন্য অনুরোধ করে গেছেন। বস্তুত সুরকার সুধীনদাকে আমি জীবনে বারবারই ফিরে পেয়েছি, সুতরাং কখনও হারাইনি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি গীতিকার সুনীলবরণের লেখা দুটো গানের সুর করে দিয়েছিলেন সুধীনদা (‘আকাশ যেখানে গল্প বলে’/ ‘কী ভালো লাগলো চোখে’), সেই দুটো গানে সুরের চলনও ছিল ভারি সুন্দর। সব সময়েই যে নিজের প্রয়োজনে যেতাম তা নয়, সুধীনদা নতুন কী সুর করছেন তা শোনার জন্যও বহুদিন ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। গিয়ে কত সুর আর কত গান শুনেছি তার হিসেব রাখিনি। যেমন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন, তেমনই গানপাগল। তখন ভাবতাম ভদ্রলোকের রক্তেই বোধহয় গান, আজ কতদিন পরে সেই একই কথা মনে হয়। অস্তিত্বে, প্রাণস্পন্দনে গান নিয়েই বেঁচেছিলেন, সাহচর্যে ধন্য হয়েছি মনে মনে ভেবে গেছি চিরকাল— আমি তো গেয়েছি সেই গান…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *