শেষ উপহার – ৮

একদিন লতিফা বানু শাফিয়া বানুর সঙ্গে গল্প করতে করতে এক সময় বললেন, বুবু, এবার আমি শিহাবের বিয়ে দিতে চাই তুমি কি বল?

শাফিয়া বেগম বললেন, ছেলে উপযুক্ত হয়েছে, বিয়ে তো দিতে হবেই। তা কোনো পাত্রী দেখেছ নাকি?

না দেখিনি। এবারে ওকে বিয়ের কথা বলতে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে বলল। আর বলবে নাই বা কেন? আমি তো ওকে শুধু পেটে ধরেছি, তুমি ও দুলাভাই সাহায্য না করলে ওকে কি আমি এত শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারতাম?

শাফিয়া বেগম বললেন, ভাবি, আমি একটা আবদার করব রাখতে হবে?

ওমা, তোমার আবদার রাখব না তো কার রাখব? আর আবদারই বা করবে কেন, হুকুম করেই দেখ না, রাখি কি না।

আমি শিহাবের হাতে জাকিয়াকে দিতে চাই। তুমি তো জান, জাকিয়া বোবা হলেও সব দিক দিয়ে অত্যন্ত ভালো।

লতিফা বানু চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে গেলেন। শিহাবের প্রতি বুবুর এত লক্ষ্য দেখে অনেক আগেই এরকম কিছু একটা অনুমান করেছিলেন। কিন্তু বোবা মেয়ের সঙ্গে শিহাবের বিয়ে দিতে চাইবে, এটা আশা করেন নি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বললেন, দেখ বুবু, জাকিয়াকে নিয়ে আমিও অনেক চিন্তা করেছি। এতে আমার কোনো অমত নেই। শিহাবের মতামত নিয়ে তোমাকে জানাব।

জাকিয়ার সঙ্গে শিহাবের বিয়ের প্রস্তাব দিতে ননদ মনে আঘাত পেয়েছেন শাফিয়া বেগম বুঝতে পেরে বললেন, ভাবি, তুমি আমাদেরকে ভুল বুঝ না। আমরা জাকিয়ার বিয়ের জন্য বহু চেষ্টা করেছি; কিন্তু সফল হতে পারিনি। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে বলে থেমে গেলেন।

লতিফা বানু বললেন, জাকিয়া শুধু তোমাদের মেয়ে নয় আমারও। তোমাদের মনের অবস্থা আমি বুঝি। শিহাব খুব বুঝদার ছেলে। আমি বললে না করতে পারবে না।

কিন্তু ভাবি, ও যদি বুঝতে পারে আমি প্রস্তাব দিয়েছি, তা হলে মনে খবু কষ্ট পাবে। ভাববে, জাকিয়াকে গতাব বলে আমরা ওকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছি।

সে কথা আমিও জানি। ও সব নিয়ে তুমি ভেবো না। দুলাভাই ব্যাপারটা জানে?

জানে। তোমার দুলাভাই বলছিল, শিহাব বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপর একটা থিসিস লিখেছে। সেটা সাবমিট করার জন্য খুব শিঘ্রী লন্ডন যাবে। আমাদের ইচ্ছা তার আগে বিয়েটা হয়ে গেলে জাকিয়া সঙ্গে যেত।

ঠিক আছে, আমি আজ কালের মধ্যে শিহাবের মতামত জানাব।

সেদিন রাতে লতিফা বানু শিহাবকে বললেন, তোর ফুপুর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করলাম; সেও চায় এবার তুই বিয়ে কর।

বিয়ের কথা শুনে শিহাব চুপসে গেল। কোনো কথা না বলে মুখ নিচু করে বসে রইল।

লতিফা বানু দেখেও না দেখার ভান করে বললেন, অনেক আগে থেকে আমি তোর জন্য মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি।

এই কথা শুনেও শিহাব কিছু বলল না।

কিরে, ওরকম চুপচাপ রয়েছিস যে? কি করবো?

কি করবি মানে, তোর কি কিছু বলার নেই?

আমি আর কি বলব, যা বলার তুমিইতো বলছ।

আমি জাকিয়াকে বৌ করতে চাই।

সেদিন মমতাজের কথায় শিহাব যা আঘাত পেয়েছিল, ঘায়ের কথা শুনে আরো বেশি আঘাত পেল। সেদিনের পর থেকে মমতাজ তার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করে না। ভাবল, এটা মায়ের কথা, না মমতাজ কথাটা মাকে দিয়ে বলাল। তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। মা যাতে চোখের পানি দেখতে না পায়, সেজন্য মাথা নিচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

লতিফা বানু ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তাকে চলে যেতে দেখে বললেন, কোথায় যাচ্ছিস, তোর মতামত বলবি না?

শিহাব কিন্তু দাঁড়াল না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে একটা খালি রিক্সা থামিয়ে উঠে বসল। তখন তার মনে ভীষণ ঝড় বইছে। কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে পারল না। সবাই যেন তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ মনে হল, ফুপুও কি তা হলে এটাই চান? ফুপা-ফুপুর সঙ্গে আলাপ করেই যখন আম্মা কথাটা বলল তখন নিশ্চয় তারাও তাই চান।

রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, সাহেব কোথায় যাবেন?

শিহাব বলল, কোনো পার্কে চল।

রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে বলল, এত রাতে পার্কে যাবেন সাহেব? দিনকাল ভালো নয়।

ঠিক আছে, ঘন্টা খানেক রাস্তায় রাস্তায় চালাও।

ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর লতিফাবানুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। মনকে খুব শক্ত করে ছেলেকে কথাটা বলেছেন। কিন্তু এখন আর সামলাতে পারলেন না। কেউ দেখে ফেলতে পারে ভেবে রাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারপর আল্লাহর কাছে সবর করার ক্ষমতা চেয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় বসে রইলেন।

শিহাব প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর ফিরে মাকে তার রুমে বসে থাকতে দেখে বলল, তুমি এখনও বসে রয়েছ আম্মা?

হ্যাঁ, তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুই কিছু না বলে চলে গেলি যে? আয় আমার কাছে এসে বস।

শিহাব মায়ের পাশে বসে মাথা নিচু করে রইল।

লতিফাবানু ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি তোর মনের অবস্থা বুঝি বাবা। কিন্তু তুই চিন্তা করে দেখ, তোর ফুপা-ফুপু জাকিয়ার বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেও দিতে পারেনি। আমি তা জেনে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই কি চাস, জাকিয়ার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক? তোর ফুপা-ফুপু আমাদের জন্য কি না করেছে, তাদের সাহায্যেই তুই আজ এত বড় হয়েছিস। তাদের কথা চিন্তা করবি না? তুই যদি জাকিয়াকে বিয়ে করিস, তা হলে তারা কত খুশি হবে জানিস?

শিহাব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে আম্মা, আমি আগেও কোনোদিন তোমার কথার অবাধ্য হইনি, আজও হব না। তুমি যা ভালো বুঝো কর।

লতিফা বানু আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, এটাই আমি তোর কাছে আশা করেছিলাম। দোয়া করছি, “আল্লাহ তোকে সুখী করবে।”

শিহাব বলল, তোমাকে জানান হয়নি, কিছু দিনের মধ্যে আমি বিলেত যাব। তুমি দো’য়া করো আম্মা, আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছি, তা যেন আল্লাহ পুরণ করেন।

লতিফা বানু বললেন, নিশ্চয়ই করব বাবা, আল্লাহ তোর মনস্কামনা পুরণ করুক। আমার ইচ্ছা এর মধ্যে জাকিয়ার সঙ্গে তোর বিয়ের কাজটা মিটে যাক। ওকে সঙ্গে নিয়ে তুই বিলেত যাবি।

শিহাব এটাই চাচ্ছিল, বলল, তাই হবে আম্মা। তুমি ফুপা-ফুপুকে সে কথা জানিয়ে দাও।

এক সপ্তাহের মধ্যে জাকিয়ার সঙ্গে শিহাবের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের কিছুদিন পর শিহাব জাকিয়াকে নিয়ে বিলেত চলে গেল।

বিয়ের দিন ও তার পরের দু’দিন মমতাজ সব কিছুতে অংশ গ্রহণ করলেও শিহাবের কাছে একাকি দেখা করেনি। এমন কি বিলেত যাওয়ার সময়ও না। তবে সবার সঙ্গে সেও এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল।

বিয়েতে মমতাজের বান্ধবী রোজিনা ও তার ভাই হান্নান এবং তাদের বাড়ির সবাই এসেছিল। রোজিনা মমতাজের মন খারাপ দেখে ও তার কার্য্যকলাপ দেখে শুনে খুব অবাক হয়ে একসময় জিজ্ঞেস করল, কিরে, তোর আপার বিয়ে, কোথায় তুই আনন্দ ফুর্তি করবি, তা না করে মুখ গোমড়া করে রয়েছিস কেন?

মমতাজ বলল, কয়েকদিন থেকে শরীর খারাপ, তাই আর কি?

একদিন মমতাজ বাবাকে বলল, আমি মাস্টার্সে এ্যাডমিশন নেব।

জলিল সাহেব বললেন, কিন্তু মা এবার আমরা তোর বিয়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করছি।

মমতাজ বলল, আমি এখন বিয়ে করব না। মাষ্টার্স করার পর যা করার করো। শাফিয়া বেগম বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছেন, মমতাজ খুব চুপ চাপ হয়ে গেছে। একা একা কি যেন চিন্তা করে। জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দেয় না। জাকিয়ার বিয়ের পর সেটা আরও বেড়েছে। ওনার প্রায় মনে হয়, মমতাজ কি শিহাবকে ভালবাসত? এখন তার কথা শুনে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ও যখন পড়তে চাচ্ছে পড়ুক। বিয়ে বললেই তো আর এক্ষুনি হয়ে যাচ্ছে না। ছেলে দেখতেও সময় লাগবে। তারপর মেয়েকে বললেন, তুই সময় মতো এ্যাডমিশান নিস।

শিহাব বিলেতে গিয়ে আর ফিরে এল না। সেখানে চাকরি নিয়ে থেকে গেল। দেশে ফিরে এলে ঐ বাড়িতেই থাকতে হবে। শ্বশুরের বীজনেস দেখাশোনা করতে হবে, মমতাজকে দেখলে মন খারাপ হবে। হয়তো এক সময় ব্যাপারটা জানাজানিও হবে, সে সব সহ্য করে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। তাই অনেক ভেবে চিন্তে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মায়ের কথা ভেবে মাঝে মাঝে খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। মাকে নিয়মিত টাকা পাঠায়। মা দেশে যাওয়ার কথা চিঠিতে লিখলে তার উত্তরে ক্ষমা চেয়ে অপারগতা জানায়।

লতিফা বানু বুঝতে পারেন, ছেলে কেন দেশে আসতে চায় না। ওনার কেবলই মনে হয়, আমার কারণেই ছেলে দেশছাড়া হয়ে গেল। চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে তার সহিসালামতের জন্যে দো’য়া করেন।

শিহাব ফিরে না এসে সেখানে চাকরি করছে জেনে জালাল সাহেব চিন্তিত হলেন। একদিন স্ত্রীকে সে কথা বলে জিজ্ঞেস করলেন, শিহাবের ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পেরেছ?

শাফিয়া বেগম বললেন, মনে হয় শিহাব জাকিয়াকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। তার মায়ের কথায় এবং আমাদের মনে কষ্ট হবে ভেবে করেছে।

তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু দেশে আসবে না কেন?

সে কথা আমিও অনেক ভেবেছি; কিন্তু কারণটা বুঝতে পারিনি।

জালাল সাহেব দেশে ফিরে আসার জন্য শিহাবকে অনেক চিঠি দিলেন। শিহার ওনাকেও মায়ের মতো মাফ চেয়ে অপারগতা জানিয়ে উত্তর দিল। জাকিয়া শিহাবকে পেয়ে খুব সুখি এবং স্বামীকে সুখি করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে।

শিহাব তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হলেও তার মনে এতটুকু শান্তি নেই। জাকিয়ার দিকে তাকালেই শুধু মমতাজের কথা মনে পড়ে। তখন আর তাকিয়ে থাকতে পারে না।

জাকিয়া স্বামীর কাছ থেকে সব কিছু পেলেও ভালবাসা পেল না। তার মনে হয়, সে তাকে ভালবাসে না, শুধু কর্তব্য পালন করে। আরো মনে হয়, শিহাব কি মমতাজকে ভালবাসতো? তাই আমাকে বিয়ে করেও ভালবাসতে পারেনি? তা হলে আমি কি ভুল করলাম? কিন্তু শিহাব করল কেন? এর কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে তকদীরের কথা চিন্তা করে আল্লাহর কাছে সবর করার ক্ষমতা চেয়ে দিন কাটাতে লাগল।

বিয়ের এক বছর পর তাদের একটা পুত্র সন্তান হল। শিহাব তার নাম রাখল জহির উদ্দিন ওরফে জহির। জহির যখন তিন বছরের তখন জাকিয়া আবার গর্ভবতী হল এবং মৃত সন্তান প্রসব করার সময় সেও মারা গেল।

জাকিয়া মারা যাওয়ার পর শিহাব জহিরকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ল। তিন বছরের ছেলে মায়ের জন্যে সারাদিন কান্নাকাটি করে। শেষে তাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন মহিলা গভর্নর্স রাখল। কিন্তু সেও জহিরকে সামলাতে পারল না। শিহাব জহিরকে নিয়ে কি করবে না করবে চিন্তা করতে করতে দু’তিন মাস কেটে গেল। জাকিয়ার মৃত্যুর সংবাদ শ্বশুর বাড়িতে না জানালেও মাকে জানিয়েছিল।

লতিফা বানু চিঠি পেয়ে ছেলেকে ফিরে আসার কথা বলে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু শিহাব মন স্থির করতে পারেনি বলে মায়ের সে চিঠির উত্তর এতদিন দেয়নি। কিন্তু আজ যখন আতিয়ার চিঠি পেয়ে জানতে পারল, মা খুব অসুস্থ, তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, চিঠি পাওয়া মাত্র চলে এস তখন চিন্তা করল, দেশে গিয়ে মাকে এখানে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাবে। মা এখানে থাকলে জহির দাদিকে পেয়ে মায়ের অভাব কিছু ভুলতে পারবে। এসব চিন্তা করে দেশে ফিরার সিদ্ধান্ত নিল।

প্রস্তুতি নিতে নিতে প্রায় একমাস সময় লাগল। দেশে ফিরে শিহাব শ্বশুর বাড়িতে না উঠে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা দিল।

আতিয়া চিঠি দেয়ার তিন সপ্তাহ পরে লতিফাবানু মারা গেছেন। আতিয়া স্বামী ও ছেলেমেয়েসহ মায়ের কাছে ছিল, মায়ের চল্লিশা করার জন্য রয়েছে।

শিহাব বাড়িতে পৌঁছাতে আতিয়া ভাইয়া বলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর একসপ্তাহ আগে এলে আম্মা তোমাকে দেখে মরতে পারত। তোমাকে দেখার জন্য আম্মা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল।

মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে শিহাবের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে আতিয়াকে প্রবোধ দিয়ে বলল, কেঁদে আর কি করবি, সবর কর। একদিন সবাইকেই মউতের পেয়ালা চিখতে হবে। তারপর মায়ের চল্লিশা করার মনস্থ করে থেকে গেল। একদিন আতিয়া ও তার স্বামীকে বলল, আমি জহিরকে তোমাদের কাছে রেখে যেতে চাই। তোমরা ওকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করবে। আমি টাকা পয়সা পাঠাব।

স্বামী কিছু বলার আগে আতিয়া বলল, টাকা পয়সার কথা বলছ কেন? ওসবের দরকার নেই। আমরা জহিরকে মানুষ করব। একটা কথা বলব ভাইয়া?

বল কি বলবি?

তুমি আর বিলেতে না গিয়ে থেকে যাও।

শিহাব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না রে, তা হয় না। আমাকে যেতেই হবে।

আতিয়া আর কিছু বলল না। এরপর জহিরকে কাছে টানার চেষ্টা করল। কিন্তু জহির আতিয়ার ধারে কাছে যেতে চাইল না। তবু সে হাল ছাড়ল না। মায়ের চল্লিশা করা পর্যন্ত আতিয়া জহিরকে বশ মানাতে না পেরে একদিন ভাইয়াকে বলল, জহির তো আমাকে একদম পছন্দ করে না, এখন কি করবে? আমি আবার বলছি, তুমি থেকে যাও।

শিহাব বলল, থাকা সম্ভব হলে নিশ্চয় থাকতাম। ভাবদি, লন্ডন যাওয়ার পথে ওকে ওর নানা-নানির কাছে রেখে যাব।

আতিয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুমি যখন থাকবেই না তখন সেটাই ভালো হবে।

কয়েকদিন পর শিহাব ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা রওয়ানা দিল।

.

মমতাজের সঙ্গে তার বান্ধবী রোজিনাও মাষ্টার্সে এ্যাডমিশন নিয়েছিল। দু’বছরের মাথায় রোজিনার বিয়ের কাবিন হয়ে রয়েছে, তার ভাইয়ার জন্য বিয়েটা হয় নাই। হান্নান কিছুতেই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।

রোজিনা জানে মমতাজের জন্য ভাইয়া বিয়ে করছে না। তাই একদিন মমতাজকে বলল, তোকে একটা কথা বলব, সত্যি উত্তর দিবি তো?

তোর কাছে মিথ্যে বলতে যাব কেন? কি বলবি বল?

তুই আমার ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিলি কেন?

মমতাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তখন আমি একজনকে ভালবাসতাম।

এখন বাসিস না?

বাসি।

তা হলে?

ভালবাসলেও বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।

তা সেও কি তোকে ভালবাসে।

বাসে, তবে আমি তার কাছ থেকে সরে এসেছি।

কেন?

সে কথা বলতে পারব না।

সে কি অন্য মেয়েকে ভালবেসেছে?

না।

তা হলে?

আমি আমার নিজের স্বার্থে সরে এসেছি।

সে কিছু বলেনি?

বলার সুযোগ তাকে দিই নি।

একটা কথা বলব রাখবি?

রাখার হলে নিশ্চয় রাখব।

ভাইয়া আজও তোর অপেক্ষায় বিয়ে করেনি। তুই ধর্মের দিকে ঝুকে পড়েছিস জেনে সেও ধর্মের অনেক কিছু মেনে চলে। মা-বাবা এত মেয়ে দেখছে, কাউকে তার পছন্দ হয়নি। আমি তো জানি, তোকে ভাইয়া ভীষণ ভালবাসে, তুই রাজি হয়ে যা।

আমি একজনকে ভালবাসতাম, একথা জানার পরও তোর ভাইয়া কী আমাকে আগের মতো ভালবাসবে?

প্রেম ভালবাসা প্রায় সবাইয়ের জীবনেই আসে। তাদের সবার কি বিয়ে হয়? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভাইয়া সব কিছু জানার পরও তোকে আগের মতো ভালবাসবে। তুই ইচ্ছা করলে ভাইয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে পারিস।

ঠিক আছে, কয়েকদিন চিন্তা করে তোকে জানাব। এখন বল দেখি, তোকে তোর বর উঠাচ্ছে না কেন?

ওরা তো অনেক আগেই উঠিয়ে নিত। মা-বাবা দিচ্ছে না। তাদের ইচ্ছা, ভাইয়ার বিয়ের পর আমাকে উঠিয়ে দেবে। এদিকে ভাইয়া তোকে ছাড়া বিয়েই

করতে চাচ্ছে না।

আচ্ছা, তোর মা-বাবা কী কথাটা জানে?

না। শুধু আমি জানি। আমি মা-বাবাকে প্রস্তাব দেয়ার কথা বলতে চেয়েছিলাম। ভাইয়া নিষেধ করে বলল, খবরদার, মমতাজ যদি রাজি না হয়, তা হলে মা-বাবা অপমানিত হবে;

মমতাজ কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।

কিরে কিছু বলছিস না যে?

কি আর বলব? বললাম না, কয়েকদিন চিন্তা করে বলব।

সেদিন রোজিনা বাসায় ফিরে ভাইয়াকে বলল, তুমি মমতাজের জন্য যে অপেক্ষা করছ তা আমি জানি। সে কেন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সে কথা কি তুমি জান?

হান্নান বলল, না তুই জেনে থাকলে বল।

মমতাজ একটা ছেলেকে ভালবাসত। ছেলেটাও মমতাজকে ভালবাসত। ছেলেটার কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও মমতাজ তার কাছ থেকে সরে এসেছে।

কেন সরে এল জিজ্ঞেস করিসনি?

করেছি, বলল নিজের স্বার্থে।

ছেলেটা তাকে সহজে ছেড়ে দিল?

সে কথাও জিজ্ঞেস করেছি। বলল, বলতে পারব না। আচ্ছা ভাইয়া, এসব শোনার পরও কি তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও।

কেন চাইব না? ওর যদি বিয়ের পর স্বামী মারা যেত বা ছেড়ে দিত, তা হলেও ওকে বিয়ে করতাম। তুই আমার ছোট বোন। আমি যে ওকে কত ভালবাসি তা তোকে বোঝাতে পারব না।

তা আমি বুঝি ভাইয়া। আল্লাহ হয়তো এতদিনে তোমার ইচ্ছা পুরণ করবে।

কি করে বুঝলি?

আজ মমতাজের সঙ্গে আলাপ করতে করতে এক সময় যখন বললাম, তুই ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিলি কেন? ভাইয়া এখনও তোর অপেক্ষায় রয়েছে। তখন ঐসব বলে বলল, এসব জানার পরেও কি তোর ভাইয়া আগের মতো আমাকে ভালবাসবে?

হান্নান অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল, সত্যি বলছিস, মমতাজ এই কথা বলেছে?

হ্যাঁ ভাইয়া, সত্যি বলছি।

তুই কিছু বলিসনি?

বলেছি। আমি তোমার মনের কথা জানি, তাই তোমার হয়ে নিশ্চয়তাও দিয়েছি।

শুনে কি বলল?

কয়েকদিন পরে জানাবে বলেছে।

তোকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।

শুধু ধন্যবাদ, আর কিছু দেবে না?

নিশ্চয় দেব, তুই যা চাইবি তাই দেব।

ঠিক আছে, আগে তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর চাইব।

.

ডায়রিয়া হয়েছিল বলে রোজিনা কয়েকদিন ভার্সিটি যায় নি। আজ কিছুটা সুস্থ। বেলা দশটার দিকে শিঙ্গি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে শুয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল।

এমন সময় মমতাজ রুমে ঢুকে বলল, কিরে তোর কি হয়েছে? অসময়ে শুয়ে রয়েছিস কেন? ক’দিন ভার্সিটিতেও যাসনি। তোদের ফোন কি খারাপ? রিং করলে গোঁ গোঁ শব্দ হয়?

রোজিনা ম্লান হেসে বলল, তুই এসেই যে রকম উকিলি জেরা করতে আরম্ভ করেছিস, কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছি না। আয় বোস?

মমতাজ তার পাশে বসে কপালে হাত রেখে বলল, কি হয়েছে বলবি তো?

ডায়রিয়া হয়েছিল, তাই ভার্সিটি যাইনি। আর আমাদের দুটো ফোনই কয়েকদিন থেকে ডেড।

এখন কেমন আছিস?

ভালো, তা তুই কেমন আছিস?

ভালো, হ্যাঁ রে, তোর বর দেখতে এসেছিল?

ভাইয়া বাইরে থেকে ফোনে জানিয়েছিল। রোজ দু’বার আসে। এই তো আধ ঘন্টা আগে চলে গেল। বিকেলে আবার আসবে। তোর খবর কি বল।

আমার আবার কি খবর?

অত ন্যাকামী করিস না। ভাইয়া ঘরে আছে, ইচ্ছা করলে তার সঙ্গে আলাপ করতে পারিস।

তুই কিন্তু বাড়াবাড়ী করছিস, আমি তোর খোঁজ নিতে এসেছি।

সেটাও ঠিক; তবে সেই সঙ্গে মানে “এক ডিলে দুই পাখি মারা” আর কি?

দেব এক থাপ্পড় বলে মমতাজ হাত তুলল।

আরে সত্যি সত্যি মারবি নাকি? এমনি ডায়রিয়া হয়ে শরীরের যা অবস্থা, তোর থাপ্পড় খেলে নির্ঘাত হার্টফেল করব।

মমতাজ হাতটা নামিয়ে নিয়ে বলল, তোর ভাইয়া ডিউটিতে যায়নি?

রাত তিনটে পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটারে ছিল। চারটের সময় এসে ফজরের নামায পড়ে ঘুমিয়েছে। একটু আগে উঠেছে। এতক্ষণে হয়তো রাথরুম সেরে নাস্তা খাচ্ছে। যা না ভাইয়ার সঙ্গে তুইও নাস্তা খাবি।

মমতাজ বড় বোনের সুখের জন্য নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিয়ে অনেক দিন মানসিক যন্ত্রনায় ভুগেছে। তকদীরের কথা চিন্তা করে আস্তে আস্তে সয়ে গেছে। মা বাবা পাত্রের সন্ধান করছে জেনে প্রথম দিকে বাধা দিলেও পরে আর দেয়নি। রোজিনা যখন তার ভাইয়ার কথা বলে তখন তিন চার বছর আগের হান্নান ভাইয়ের চিঠির কথা মনে পড়েছিল। চিন্তা করেছিল, হান্নান ভাই ডাক্তার হলেও খুব সরল। আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। আমাকে ভালবাসে বলে আজও বিয়ে করেনি। আমার সব কিছু জেনেও যদি আমাকে ভালবাসে, তা হলে দাম্পত্য জীবন সুখের হতে পারে। এই সব চিন্তা করে তাকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। একবার ভেবেছিল, রোজিনাকে কথাটা জানাবে। আবার ভাবল, সরাসরি হান্নান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে, তাই আজ এসেছে। রোজিনা তাকে হান্নান ভাইয়ের কাছে যেতে বলায় বলল, ঠিক আছে যাচ্ছি।

রোজিনা বলল, হ্যাঁ তাই যা, ফলাফল শোনার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

মমতাজ যেতে যেতে বলল, ফলাফল শোনাতে বয়েই গেছে।

হান্নান নাস্তা খেয়ে ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য জামা কাপড় পরে তৈরি হয়েছে, এমন সময় মমতাজকে দরজার পর্দা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হল। সালাম দিয়ে বলল, তুমি?

মমতাজ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি। এসে অসুবিধা করলাম না তো?

অসুবিধা কিসের? এস ভিতরে এসে বস।

মমতাজ ভিতরে ঢুকে বসে বলল, আপনি বোধ হয় ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন?

তাতে কি হয়েছে? এক আধ ঘন্টা লেট হলে কোনো অসুবিধা হবে না। কেমন আছ বল।

ভালো, আপনি?

আমিও ভালো।

দু’একটা প্রশ্ন করব?

কর।

রোজিনার মুখে শুনলাম, আপনি আমার জন্য বিয়ে করেননি, কথাটা কি সত্য?

সত্য।

আগে আপনাকে কেন প্রত্যাখান করেছিলাম, তা রোজিনার কাছে নিশ্চয় শুনেছেন?

শুনেছি।

এখনও কি আপনি আগের সিদ্ধান্তে অটল আছেন?

আছি।

আমি আগে ধর্ম-কর্ম তেমন মেনে চলতাম না। যাকে ভালবেসেছিলাম, সে খুব ধার্মিক। তার সংস্পর্শে এসে আমি ধর্মের দিকে ঝুকে পড়েছি। আপনি ধর্মকে কি নজরে দেখেন?

একজন মুসলমান যে নজরে দেখে।

আজকাল প্রকৃত মুসলমান খুব কম। সাধারণ মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমান কাকে বলে জানে না। জানলে মুসলমানদের এত দুর্দশা হত না।

হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক। বর্তমানে সারা দুনিয়াতে প্রকৃত মুসলমানের সংখ্যা খুব কম। মুসলমানেরা আজ নিজের পরিচয় না জেনে পথহারা পথিকের মতো হয়ে বিজাতীয়দের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছে। তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে. নিজেদের ইসলামের ঐতিহ্যের কথা ভুলে গেছে। পাশ্চাত্যের আপাত-মুধর সভ্যতার দিকে ঝুকে পড়ে ইসলামের উপর কুঠারাঘাত করছে।

আপনার কথা শুনে খুশি হলাম।

এবার আমি দু’একটি প্রশ্ন করি?

করুন।

তার আগে একটা অনুরোধ, আমাকে তুমি করে বলবে।

মমতাজ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, বেশ তাই হবে। এবার বলুন সরি, বল, কি তোমার প্রশ্ন।

তার আর দরকার নেই।

মানে?

যা জানার জানা হয়ে গেছে।

মমতাজ মৃদু হেসে বলল, তাই?

হান্নানও মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই?

এমন সময় রোজিনা এসে দরজার পর্দা ফাঁক করে বলল, মে আই কাম ইন ব্রাদার এন্ড ভাবি?

হান্নান বলল, তুই দিন দিন ভীষণ ডেপোঁ হয়ে যাচ্ছিস।

রোজিনা বলল, উহু হল না। বেচেলারই ডেপোঁ হয়। আমি তো ব্যাচেলার নই।

মমতাজ বলল, তোর কিন্তু বেচেলারিটা এখনও কাটেনি। তা ছাড়া বড়দের কথায় ফুট কাটলে ডেপোমী করাই হয়। তোর ভাইয়া ঠিক কথাই বলেছে।

মমতাজ ভাইয়াকে তুমি করে বলছে শুনে রোজিনা যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, ডেপোঁ নামে যখন আখ্যায়িত হয়েই গেলাম তখন মা-বাবাকে তোমাদের শুভস্য শীঘ্রম করতে বলিগে যাই। কথা শেষ করে চলে গেল।

রোজিনা চলে যাওয়ার পর একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এক সময় মমতাজ ভিজে গলায় বলল, যেদিন তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, সেদিন তুমি যা চেয়েছিলে আজ আমি তাই চাইতে এসেছি। তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে? কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিল।

হান্নান এগিয়ে এসে তার চিবুক ধরে মুখটা তুলে বলল, হাতের কাছে পেয়ে কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারে?

ততক্ষণে মমতাজের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

সারাজীবনের স্বপ্নকে

হান্নান চিবুক ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাকে ছুঁয়ে অন্যায় করে ফেললাম। সে জন্যে তোমার কাছে ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছি।

মমতাজ চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আমাকে ছুয়ে অন্যায় করেছ, অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছ; কিন্তু আমি তোমাকে এতদিন কষ্ট দিয়ে যে অন্যায় করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। তবু ক্ষমা চাইছি।

এটা তুমি ঠিক অন্যায় করেছ কি না জানি না, তবে এতদিন তোমার সমস্ত দোষ ত্রুটি আমি ক্ষমার চোখে দেখেছি এবং ভবিষ্যতেও দেখব ইনশাআল্লাহ।

মমতাজ বুঝতে পারল, হান্নান তাকে কী দারুণ ভালবাসে। ভিজে গলাতেই বলল, ইনশাআল্লাহ আমিও সর্বদা তোমাকে সুখী করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।

আলহামদুলিল্লাহ বলে হান্নান বলল, সেই আল্লাহপাকের লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি এতদিনে আমার মনস্কামনা পূর্ণ করাতে যাচ্ছেন।

এমন সময় দরজার বাইরে থেকে কাজের মেয়ের গলা শোনা গেল, আম্মা আপাকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকছেন।

হান্নান কাজের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি যাও, তোমার আপা যাচ্ছে। তারপর মমতাজের দিকে তাকিয়ে বলল, যাও, মা নাস্তা খেতে ডাকছে।

মমতাজ ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল।

.

শিহাব যেদিন লন্ডনের পথে ঢাকা রওয়ানা হল, সেদিন মমতাজের সঙ্গে হান্নানের বিয়ে। জালাল সাহেব নিজের বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন করেছেন। ফুল বাগানের পাশে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সেখানে শামিয়ানা খাটিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

শিহাব যখন শ্বশুর বাড়ির গেটে এসে পৌঁছাল তখন বিয়ে পড়ান হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া করে বরযাত্রীদের প্রায় সকলেই চলে গেছেন। যারা আছেন, তারা বরকনে নিয়ে যাবেন।

দারোয়ান অনেক দিন থেকে এখানে আছে। এ বাড়ির অনেক কিছু জানে। এমন কি শিহাব ও মমতাজের ভালবাসার কথাও জানে। শিহাবকে দেখে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, বড় আপা কোথায়?

শিহাব বলল, তোমার বড় আপাকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। তারপর জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে অনুষ্ঠান কিসের?

দারোয়ান “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন” পড়ে বলল, আজ ছোট আপার বিয়ে। তারপর ঘুমন্ত জহিরকে কোলে নিয়ে আদর দিয়ে বলল, নিশ্চয় আপনাদের ছেলে?

মমতাজের বিয়ের কথা শুনে শিহাব বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করল। সেই সাথে মাথাটাও ঝিম ঝিম করে উঠল। দারোয়ানের কথার উত্তর দিতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এক সময় চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলে দু’হাতে মাথা ধরে দারোয়ানের টুলে বসে পড়ল।

দারোয়ান তার অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল, বড় দুলাভাই, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে, ভিতরে চলুন না?

শিহাব সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে রুমালে চোখ মুছে বলল, না, তেমন কিছু না। তারপর একটা চিঠি লিখে খামের ভিতরে ঢুকিয়ে তার হাতে দিয়ে বলল, এই চিঠিটা ও জহিরকে তোমার ছোট আপার কাছে দিয়ে এস, অন্য কাউকে দেবে না।

দারোয়ান ব্যথীত হৃদয়ে বলল, আপনি যাবেন না?

না, তুমি দিয়েই ফিরে আসবে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে না।

দারোয়ান খুব অবাক হয়ে ভারাক্রান্ত মনে বাড়ির ভিতর চলে গেল।

সে চলে যেতে শিহাব এয়ারপোর্টের পথে রওয়ানা দিল।

বাড়ির ভিতরে একটা রুমে মমতাজের পাশে হান্নানকে বসিয়ে লৌকিকতা চলছে। সেখানে মেয়েদের ভীড়। বর কনেকে সরবত খাওয়াবে বলে রোজিনা, সরবতের গ্লাস নিয়ে আসছিল। এমন সময় দারোয়ানকে একটা ঘুমন্ত বাচ্চাকে বুকে করে আসতে দেখে বলল, তুমি এখানে এসেছ কেন? বাচ্চাটাই বা কার?

দারোয়ান তার কথায় কর্ণপাত না করে বর কনের কাছে গিয়ে মমতাজের কোলে জহিরকে দিয়ে চিঠিটা তার হাতে দিল।

মমতাজ প্রথমে খুব অবাক হল। তারপর রেগে গিয়ে বলল, এ কার বাচ্চা? আমার কোলে দিলে কেন? আর চিঠিটাই বা কার?

দারোয়ান মমতাজের কথারও উত্তর দিল না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দেখল, বড় দুলাভাই নেই। সে এতক্ষণ অনেক কষ্টে সামলে থাকতে পারলেও এখন আর পারল না। টুলে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বিড় বিড় করে বলল, আল্লাহগো, তোমার কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য।

দারোয়ান কোনো কথা না বলে চলে যেতে মমতাজ আরো রেগে গিয়ে রোজিনাকে দেখে বলল, দারোয়ানের স্পর্ধা দেখলি?

রোজিনা বলল, তোর এখন উত্তেজিত হওয়া উচিত না। আমিও তাকে তোর মতো একই প্রশ্ন করেছিলাম, কোনো উত্তর দেয়নি। যাকগে, দারোয়ানের বিচার পরে হবে, চিঠিতে কি লেখা আছে পড়।

মমতাজ খামের উপরে “শেষ উপহার” লেখা দেখে খুব অবাক হল। তারপর রোজিনার হাতে দিয়ে বলল, তুই জোরে জোরে পড়।

রোজিনা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল-

মমতাজ,

আল্লাহপাকের দরবারে সর্বান্তকরণে দো’য়া করি, তিনি যেন তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখ-শান্তিতে ভরিয়ে দেন। এই শুভলগ্নে যে কথা জানান উচিত নয় জেনেও কর্তব্যের খাতিরে তা জানাতে বাধ্য হলাম। সে জন্যে ক্ষমা চাইছি।

ভেবেছিলাম, কোনো দিন দেশে ফিরব না। কিন্তু আল্লাহপাকের ইচ্ছার উপর কারো হাত নেই। তাই মায়ের অসুখের খবর পেয়ে মাস দেড়েক আগে দেশে ফিরে জানতে পারলাম, মাত্র সাত দিন আগে মা ইহজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছেন। তারপর মায়ের চল্লিশা সেরে আমাদের নয়নমনি জহিরকে আমার ছোটবোন আতিয়ার কাছে রেখে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম; কিন্তু জহির (যে তোমার কোলে রয়েছে) তার কাছে থাকতে না চেয়ে ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। তাই চিন্তা করলাম, ও যদি ওর নানা- নানির কাছে থাকতে চায়, তা হলে রেখে যাব, নচেৎ ফুপা-ফুপুর সঙ্গে দেখা করে ওকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাব। কিন্তু তোমাদের বাড়ির গেটে এসে দারোয়ানের কাছে শুনলাম, আজ তোমার বিয়ে। তাই আর ভিতরে না গিয়ে চিঠিটা লিখলাম দারোয়ানের টুলে বসে।

অনেক বছর আগে তোমার জন্মদিনের উৎসবের শেষে আমি তোমাকে প্রথম উপহার দিয়েছিলাম একটা গোলাপের তোড়া। তার কয়েক বছর পর দ্বিতীয় উপহার দিয়েছিলাম তোমার গালে চড়। সে সময় উক্তি ছিল তোমার, কোটি টাকার মূল্য তার। আজ সেই তারিখ, যেই তারিখে আগের দুটো উপহার পেয়েছিলে তুমি। এই শুভ দিনে কি দেব তোমায়, ভেবে না পেয়ে “শেষ উপহার” দিলাম তোমার কোলে শ্রেষ্ট সম্পদ আমার। বাকি খবর দারোয়ানের কাছে জেনে নিও। তুমি যখন এই চিঠি পড়বে তখন আমি অনেক দূরে এয়ারপোর্টের পথে।

ইতি-

শিহাব।

1 Comment
Collapse Comments

কাহিনী টা কি বাস্তব!
সত্যি হৃদয় নিংড়ানো একটা কাহিনী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *