শেষ উপহার – ৩

এ বছর ফার্স্ট হয়ে মমতাজ ক্লাশ টেনে উঠল। রেজাল্টের দিন মা-বাবাকে বলল, আমি বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে একটা পার্টি দিতে চাই।

জালাল সাহেব বললেন, বেশ তো, সামনের শুক্রবারে ব্যবস্থা করা যাবে। এর মধ্যে তুই বান্ধবীদের নিমন্ত্রণ করে ফেল।

মমতাজ বলল, ঠিক আছে তাই করব।

শাফিয়া বেগম বললেন, সামনের বৃহস্পতিবারে শিহাব দেশে যাবে। ও ফিরে এলে করলে হত না?

মমতাজ বলল, তা হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। শিহাব ভাই না থাকলেই বা কি? আর থাকলেই বা কি? তিনি তো আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চান না।

শাফিয়া বেগম বললেন, সব ছেলে কি সমান হয়? ও লাজুক ধরণের ছেলে। তোকে তো কতবার বলেছি ওকে আমাদের সোসাইটির মতো তৈরি করে নিতে। তা ছাড়া শিহাবের কাছে পড়ে তুই এত ভালো রেজাল্ট করলি, তাকে বাদ দিয়ে পার্টি করবি এ কেমন কথা?

আমি তাকে থাকতে নিষেধ করছি নাকি?

তা করিস নি, তবে তার থাকাটাকে তুই গুরুত্ব দিচ্ছিস না।

মমতাজ রেগে উঠে বলল, মা, তুমি শুধু তোমার ভাইপোর পক্ষ নিয়ে কথা বল। আমি বুঝি তোমার কেউ নই? শিহাব ভাই আসার পর থেকে তুমি আমাকে প্রায়ই রাগারাগি কর। তার কথাগুলো কান্নার মতো শোনাল।

শাফিয়া বেগম মমতাজের পাশে বসেছিলেন। মেয়ের কথাশুনে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই হলি আমার সব থেকে প্রিয়। তাই তো তোর ভুল ত্রুটি সংশোধন করার জন্য যা কিছু বলার দরকার বলি। আর তুই কিনা আমাকে ভুল বুঝলি। তারপর তার দু’গালে চুমো খেয়ে বললেন, যা কিছু বলি তোর ভালোর জন্যই বলি। জাকিয়ার জন্য আমরা খুব চিন্তিত। তুই আমাদের একমাত্র আশা ভরসা। তাই তোকে মনের মতো শিক্ষা দিয়ে মানুষ করছি। শিহাব গরিব ভাইয়ের এতিম ছেলে। তাকে স্নেহ করলে আল্লাহ খুশি হবেন, তাই করি। ঠিক আছে, আমি তাকে দু’দিন পরে না হয় যেতে বলব।

সেই দিনই শাফিয়া বেগম শিহাবকে পার্টির কথা বলে শনিবার দেশে যাওয়ার কথা বললেন।

শিহাব বলল, ফুপু বেয়াদবি নেবেন না, আমাকে বৃহস্পতি বারেই যেতে হবে। কয়েকদিন আগে আমি চিঠি দিয়ে মাকে জানিয়েছি। ঐদিন না গেলে মা ও আতিয়া ভীষণ চিন্তা করবে। আপনি তো আমার স্বভাব জানেন, আমি ওসব পছন্দ করি না। প্রায় এক বছর আম্মাকে ও আতিয়াকে দেখিনি। তা ছাড়া কলেজ মাত্র এক সপ্তাহ বন্ধ। শনিবার গেলে বাড়িতে মাত্র দু’দিন থাকতে পারব। আম্মা অত তাড়াতাড়ি আসতে দেবে না। দেরি করে ফিরলে কলেজ কামাই হবে। আপনি ফুপাকে বলবেন, তিনি যেন কিছু মনে না করেন।

শাফিয়া বেগম কোনো প্রতিউত্তর করতে পারলেন না। নিরবে ফিরে এসে কথাটা স্বামীকে জানালেন।

জালাল সাহেব বললেন, শিহাব না থাকলে কি আর করা যাবে। এখন মমতাজকে কিছু বলার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করলে যা হোক কিছু বলে ম্যানেজ করা যাবে।

শিহাবকে মমতাজ ঠিক পছন্দ না করলেও মাঝে মাঝে হঠাৎ করে যখন তার কথা মনে পড়ে তখন ভাবে, ছেলেটা সব দিক থেকে খুব ভালো; কিন্তু বড় সেকেলে ও আনকালচার্ড। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে থাকে। এই বয়সে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়ে। খেলাধুলা করা তো দূরের কথা, কারো সঙ্গে মিশতেই চায় না। কুরআন হাদিসও পড়ে। সারাদিন রুমের মধ্যে থাকে। অথচ স্বাস্থ্য কি সুন্দর। বেশি খাওয়া দাওয়াও করে না। ভেবে রাখল, আজ পড়বার সময় তাকে জিজ্ঞেস করবে, কি করে তার স্বাস্থ্য এত ভালো।

ঐদিন পড়ান হয়ে যেতে মমতাজ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা শিহাব ভাই, আপনি তো কোথাও বেড়াতে যান না, খেলাধুলাও করেন না, তবু কি করে আপনার স্বাস্থ্য এত ভালো? আর এত যে পড়েন, আপনার মাথা ব্যথা করে না?

শিহাব মৃদু হেসে বলল, যার মাথা আছে তার ব্যথা থাকবেই। তবে কম আর বেশি। আর স্বাস্থ্যের কথা যে বললে সেটা নির্ভর করে নিজের উপর। বেড়ান বা খেলা ধুলা করা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকার একথা সবাই জানে। আমি সারাদিন ঘরে থাকলেও প্রতিদিন ফজরের নামায পড়ে একঘন্টা দৌড়াই। তারপর বাসায় ফিরে কাঁচা বাদাম ও কাঁচা ছোলা ভিজান খেয়ে পড়তে বসি।

মমতাজ খুব অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? সত্যি বলছেন?

শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন? তা ছাড়া মিথ্যা বলা হারাম।

হারাম শব্দের অর্থ কি?

আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে যা করতে বা বলতে নিষেধ করেছেন তাকে হারাম বলে।

আচ্ছা, মানুষ বলে আল্লাহ নাকি এই পৃথিবী ও নভোমন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তিনি কোথায় থাকেন? কি খান? তাঁর নাকি অসীম ক্ষমতা, যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। কথাগুলো একটু বুঝিয়ে বলবেন?

হঠাৎ আল্লাহকে জানার ইচ্ছা হল কেন?

মমতাজ আজু তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিল। বান্ধবীটা তখন কুরআনের গল্প নামে একটা বই পড়ছিল। সেটার দুটো গল্প পড়ে মমতাজের আল্লাহর সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন জেগেছে, তাই শিহাব যখন মিথ্যা বলতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন বলল তখন তার সে কথা মনে পড়তে আল্লাহর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছে। শিহাবের পাল্টা প্রশ্ন শুনে রেগে গেল। বলল, আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই, তার কারণ জানতে চান, এটা আপনার বদ অভ্যাস। আমার প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে বলবেন, না জানা থাকলে বলবেন, জানি না।

শিহাব বলল, অনেকের অনেক রকম দোষ থাকে। আমারও হয় তো আছে। যাকগে; আমি আমার প্রশ্ন উইথড্র করে নিচ্ছি। এবার তোমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি।

“আল্লাহ হচ্ছেন, এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর সমতুল্য আর কেউ নেই। তিনি এই পৃথিবী ও আকাশ মন্ডলী এবং এতদউভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুর স্রষ্ঠা। তাঁর জ্ঞান এত অসীম যে, পৃথিবী ও আকাশমন্ডলীর সবকিছুই সেই জ্ঞানের মধ্যে বেষ্টিত। এতদউভয়ের মধ্যে যা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে তা তাঁরই ঈশারায়। তিনি সর্বশক্তিমান মহান প্রভু। তাঁর শক্তি ও জ্ঞানের কাছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের শক্তি ও জ্ঞান একটা অনুপরমানুর কোটি কোটি ভাগের একভাগও নয়। তিনি এমন শক্তির অধিকারী যে, যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করার মনস্থ করেন তখন শুধু বলেন হও, তখনই হয়ে যায়। আর তিনি এতদউভয়ের মধ্যে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে মানব জাতি শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু জানেন। তিনি সয়ম্ভূ, তাঁর কোন স্ত্রী নেই, সন্তান সন্ততিও নেই। আর আল্লাহ আরশে আজিমের উপর উপবেশন করে আছেন। তাঁর ক্ষুধা নেই, নিদ্ৰা নেই। তিনি কখনো পেরেশান হন না।

আল্লাহকে জানতে হলে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে হবে। তা ছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় বই পুস্তক পড়তে হবে। আমার কাছে কিছু ধর্মীয় বই আছে। সেগুলো অবসর সময়ে পড়তে পার।

মমতাজ বলল, পাঠ্য বই পড়েই শেষ করতে পারি না, ঐসব পড়ব কখন?

ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়, ইংরেজিতে একটা কথা আছে “হয়্যার দেয়ার ইজ এ উইল; দেয়ার ইজ এ ওয়ে”

কথাটা অবশ্য আমিও জানি, ঠিক আছে, পড়ার চেষ্ঠা করব।

বৃহস্পতিবারে শিহাব যখন দেশের বাড়িতে রওয়ানা দেয় তখন মমতাজ মার্কেটে গিয়েছিল। ফিরে এসে সে কথা জেনে রেগে গিয়ে মাকে বলল, তুমি শিহাব ভাইকে কিছু বলনি?

শাফিয়া বেগম বললেন, বলেছিলাম, তারপর শিহাব যা বলেছিল বললেন।

মমতাজ রাগের সঙ্গে বলল, তোমার ভাইপো গরিব ছেলে হলে কি হবে, ভীষণ একরোখা আর অহঙ্কারী। দু’দিন পরে গেলে কি হত?

তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? প্রায় একবছর হল দেশে যায় নি, এক সপ্তাহ ছুটি। দু’দিন পরে গেলে ক’দিন আর দেশে থাকবে? ও ওর বাপের মতো একরোখা হয়েছে ঠিক, কিন্তু তুই যে বললি অহঙ্কারী তা ঠিক নয়।

তুমি ভাইপোর হয়ে কথা বলবে তা জানতাম। যাকগে, গেছে ভালই হয়েছে। যে রকম ধার্মিক আর লাজুক, থাকলেও হয়তো পার্টিতে আসত না।

আর কিছু বললে মেয়ে আরো রেগে যাবে ভেবে শাফিয়া বেগম চুপ করে রইলেন।

.

শিহাব বাড়িতে এসে মাকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছ আম্মা? লতিফা বানু সালামের উত্তর দিয়ে ছেলের মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন। তারপর বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি বাবা, তুই কেমন আছিস বল।

আমিও আল্লাহর রহমতে ও তোমার দোয়ার বরকতে ভালো আছি। জান আম্মা, ফুপা ফুপু আমাকে নিজের ছেলেরমতো স্নেহ করেন। ওনারা খুব বড়লোক দু’টো গাড়ি। আচ্ছা আম্মা, ওনাদের বড় মেয়ে জাকিয়া বোবা, সে কথা তুমি জান?

হ্যাঁ বাবা জানি। অনেক বছর আগে একবার তোর ফুপা ফুপু মেয়েদের নিয়ে এসেছিল, তখন থেকে জানি। জাকিয়া ও মমতাজের কথা তোর মনে নেই?

মনে থাকবে না কেন, তবে জাকিয়া যে বোবা তা জানতাম না। তারপর বলল, আতিয়া বুঝি স্কুলে গেছে?

হ্যাঁ।

রেজাল্ট কেমন করেছে?

ভালো, ফার্স্ট হয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ। জান আম্মা, মমতাজও এবছর ফাষ্ট হয়ে টেনে উঠেছে। আতিয়ার পড়া বন্ধ করো না। এস.এস.সি. পাশ করুক, তারপর কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করব।

যা আল্লাহর মর্জি তাই হবে। এখন তুই জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি তোর জন্য নাস্তা নিয়ে আসি।

শিহাবের নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে, এমন সময় আতিয়া স্কুল থেকে ফিরে ভাইয়াকে দেখে আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে সালাম দিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, কেমন আছো ভাইয়া?

শিহাব সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, ভালো। তারপর বলল, কিরে, তুই পরীক্ষার রেজাল্টের কথা চিঠি দিয়ে জানালি না কেন?

আতিয়া কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, তোমাকে আর কখনো চিঠি দেব না।

কেন?

আতিয়া কদমবুসি করে বলল, চিঠি দিলে তুমি বাড়িতে আসতে চাও না। আজ এক বছর পর এলে। তুমি আমাদেরকে একদম ভুলে গেছ। কথা বলতে বলতে আতিয়ার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

শিহাব ছোট বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, আরে পাগলী, ঘন ঘন এলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না? তারপর তাকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এসে একটা কলম তার হাতে দিয়ে বলল, এটা জাকিয়া মানে ফুপুর বড় মেয়ে তোকে দিয়েছে। তুই তো তাকে দেখিসনি। নিশ্চয়ই মায়ের কাছে শুনেছিস, সে বোবা?

বাঃ খুব সুন্দর কলম তো? আচ্ছা ভাইয়া, যারা বোবা হয়, তারা নাকি কানেও শুনতে পায় না?

শিহাব দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে রেখে বলল, হ্যাঁ তাই।

তুমি চিঠিতে লিখেছিলে, বড় আপা ছোট আপা দু’জনকেই পড়াও। বড় আপা বোবা ও কানে কালা, তাকে পড়াও কি করে?

যারা বোবা ও কালা তারা খুব চালাক হয়। ঈশারায় কথাবার্তা বলে। আর আমি তাকে পড়াবার সময় লিখে দিই। এখন বই খাতা রেখে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খা, আমি একটু ঘুরে আসি। কথা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর লতিফা বানু ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই তোর ফুপার অসিফে চাকরি করিস?

শিহাব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, না।

তা হলে তোর ফুপু যে আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিল, তুই তাদের কাছে চাকরি করিস। তাই প্রতি মাসে দুই হাজার করে টাকা পাঠায়।

চাকরি ঠিক করি নি; তবে জাকিয়া ও মমতাজকে পড়াই। আমি ফুপুকে চাকরির কথা বলতে বললেন, “চাকরি করলে তোমার লেখাপড়া ভালো হবে না। জাকিয়া ও মমতাজকে যে মাষ্টার পড়াত তাকে আমরা তিন হাজার টাকা দিতাম। এখন তুমি পড়াচ্ছ; সেই টাকা তুমি পাবে। তা থেকে তোমার মাকে দুই হাজার পাঠাই। আর বাকিটা তোমার পড়াশোনার ব্যাপারে খরচ হয়। “

তাই বল, আমি মনে করেছিলাম তুই চাকরি করিস। যাক, এটাও তো চাকরির মতো। তোর ফুপা ফুপু খুব ভালো। ওদের মন যুগিয়ে চলার চেষ্ঠা করবি বাবা।

এক সপ্তাহ বাড়িতে থেকে শিহাব ঢাকা ফিরে এল।

রাতে পড়তে এসে মমতাজ বলল, মা আপনাকে দু’দিন পর যেতে বলল, আর আপনি কিনা তার কথা না রেখে চলে গেলেন; এটা কি ঠিক করেছেন?

শিহাব বলল, না, ঠিক করিনি; তবে যাওয়ার কারণটা বলে ওনার পারমিশন নিয়েই গেছি।

কোনো কিছুতেই আপনি হার স্বীকার করেন না। আচ্ছা, আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে আপনার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছেলে আছে?

শিহাব মৃদু হেসে বলল, আমি বুদ্ধিমান একথা শুধু তোমার মুখেই শুনি। ভালো রেজাল্ট করলে কেউ বুদ্ধিমান হয় না। এখন ওসব কথা রেখে বই বের কর।

পরের দিন সকালে মমতাজের অন্তরঙ্গ বান্ধবী রোজিনা ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাসায় এল। সে ও মমতাজ ক্লাস এইট পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছে। রোজিনার বাবা আসফাক সাহেব মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসার ছিলেন। বছর দুই হল লন্ডনে চাকরি পেয়ে স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে গেছেন। তিন চার দিন হল সবাইকে নিয়ে এক মাসের ছুটিতে এসেছেন।

রোজিনাকে দেখে মমতাজ আনন্দে টগবগিয়ে উঠে বলল, কিরে, কবে দেশে এলি?

রোজিনা বলল, তিন চার দিন হল এসেছি। তা তুই কেমন আছিস?

ভালো। তুই?

আমিও ভালো। তারপর তার ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, হান্নান ভাই, কেমন আছেন।

হান্নান অনেকবার ছোট বোনকে এখানে পৌঁছে দিতে এসেছে। এবাড়ির সবার সঙ্গে পরিচয়ও আছে। দু’বছর আগের মমতাজ এখন খুব লাবন্যময়ী হয়েছে। এতক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই কথা ভাবছিল। মমতাজের কথার জওয়াবে বলল, ভালো।

এমন সময় শাফিয়া বেগম সেখানে এসে বললেন, ওমা, তোমরা কখন এলে?

রোজিনা বলল, একটু আগে এসেছি। আপনি কেমন আছেন খালাআম্মা?

ভালো আছি মা; তা তোমরা দেশে কবে এসেছ?

তিন চার দিন হল এসেছি।

শাফিয়া বেগম বললেন, তোমরা গল্প কর, আমি চা নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কথা শেষ করে তিনি চলে গেলেন।

নাস্তা খাওয়ার সময় বারান্দা দিয়ে বই খাতা হাতে একটা সুদর্শন যুবককে যেতে দেখে রোজিনা বেশ অবাক হলেও কিছু জিজ্ঞেস করল না।

চা খেতে খেতে মমতাজ হান্নানকে বলল, অনেক দিন পর রোজিনা এসেছে, ওকে এখন যেতে দিচ্ছি না।

হান্নান বলল, ঠিক আছে, রোজিনা থাকুক। আমি একটু নিউমার্কেটে যাব। ফেরার পথে ওকে নিয়ে যাব। তারপর চা খেয়ে নিউমার্কেটে চলে গেল।

মমতাজ রোজিনাকে নিয়ে নিজের রুমে এসে গল্প করতে লাগল।

রোজিনা একসময় বলল, একটা ছেলেকে বারান্দা দিয়ে ভিতরে আসতে দেখলাম, কেরে ছেলেটা?

মমতাজ বলল, মামাতো ভাই, এখানে থেকে লেখাপড়া করছে।

তাই নাকি? কিসে পড়ছে?

ভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সাইন্সে অনার্স করছে।

ছেলেটা কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। দেখিস, শেষে তুই না আবার প্রেমে পড়ে যাস।

আরে দূর, দেখতে সুন্দর হলে কি হবে, একদম সেকেলে। যাকে বলে পাড়াগাঁয়ের আনকালচার্ড ছেলে। মেয়েদের দিকে তাকিয়েও দেখে না।

তুই তো তার আত্মীয়, তোর দিকেও তাকায় না?

তাকায়, তবে ভালোভাবে না। আমি আর জাকিয়া আপা ওর কাছে পড়ি। পড়াবার সময় ছাড়া আমাদের সঙ্গে মেলামেশা পর্যন্ত করে না। যাকে বলে গ্রামের লাজুক ও ধার্মিক ছেলে।

ভার্সিটিতে পড়ছে যখন, তখন কালচার্ড হতে বেশি দিন লাগবে না।

তোর কথা ঠিক নয়। এক বছর হয়ে গেল এখানে এসেছে, একটুও বদলায় নি।

তাই নাকি? তা হলে তো তার সঙ্গে আলাপ করতে হয়।

আলাপ করার দরকার নেই। আমাদের সমাজের সঙ্গে একদম বেমানান। তা ছাড়া যেমন গোঁড়া তেমনি অহঙ্কারী।

চলতো দেখি কতটা বেমানান?

মমতাজ তাকে নিয়ে শিহাবের রুমের দরজার কাছে এসে বলল, শিহাব ভাই আসতে পারি?

শিহাব তখন পড়ছিল, বলল, এস।

মমতাজ পর্দা ঠেলে রোজিনাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, আমার বান্ধবী রোজিনা। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে।

শিহাব দাঁড়িয়ে রোজিনাকে সালাম দিয়ে বলল, বসুন।

এরুমেও বসার জন্য সোফা আছে। রোজিনা সালামের উত্তর দিয়ে মমতাজের হাত ধরে পাশাপাশি বসল।

তারপর রুমের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শিহাবের দিকে তাকিয়ে তাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে বুঝতে পারল, মমতাজের কথাই ঠিক। বলল, আপনি পড়ছিলেন মনে হচ্ছে?

শিহাব অস্ফুট স্বরে মাথা নিচু করেই বলল, হ্যাঁ।

এখন তো খেলাধুলা বা বেড়ানর সময়, পড়ছিলেন কেন?

শিহাব কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

রোজিনা বলল, কিছু বলছেন না কেন? আর মাথা নিচু করেই বা আছেন কেন?

দেখুন, কিছু মনে করবেন না, আমি পাড়াগাঁয়ের ছেলে, আপনাদের এই উঁচু সমাজের সঙ্গে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছি না।

কেন? শুনলাম আপনি একবছর এই সমাজে রয়েছেন, এতদিনে তো খাপ খাইয়ে নেয়ার কথা। আমি মমতাজের বান্ধবী, আমার দিকে তাকাতে আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন? লজ্জা তো মেয়েদের ব্যাপার। আপনি ছেলে, আপনার তো লজ্জা থাকা উচিত নয়।

আপনার কথা কিছুটা ঠিক হলেও পুরোটা নয়। লজ্জা সবারই থাকা উচিত।

তাই বলে মেয়েদের দিকে তাকাবেন না, এটা আবার কি রকম লজ্জা?

আমি কিন্তু লজ্জার কারণে মেয়েদের দিকে তাকাই না, এটা ঠিক নয়।

তা হলে?

কারণটা আপনাদের না শোনাই উচিত।

রোজিনা অবাক হয়ে বলল, উচিত নয় কেন আপনাকে বলতে হবে।

উচিত ঠিক নয়, মানে শুনে আপনারা মাইন্ড করবেন।

তবু আমরা শুনতে চাই।

আমাদের নবী (দঃ) বলেছেন, মেয়েরা বড় হয়ে গেলে তারা যেন একটা চাদর দিয়ে মাথা ও বুক ঢেকে রাখে। আজকাল মেয়েরা তা করে না। তাই তাদের দিকে কোনো মুসলমান পুরুষের তাকানো ইসলামে নিষেধ।

কথাটা শুনে মমতাজ ও রোজিনা লজ্জা পেল। কারণ তারা কখনও চাদর বা ওড়না ব্যবহার করে না। এখনও তাদের গায়ে ওড়না বা চাদর নেই। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রোজিনা বলল, আপনি কি মা বোনের দিকেও তাকিয়ে দেখেন না।

গ্রাম দেশে তো মেয়েরা শাড়ী ব্যবহার করে। তারা শাড়ীর আঁচল গায়ে মাথায় দেয়। আর বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় শাড়ীর উপর অবশ্যই চাদর বা বোরখা ব্যবহার করে। তবে ইসলামে যাদের সঙ্গে বিয়ে হারাম, তাদের মুখের দিকে তাকান নিষেধ নয়।

আপনি স্কুল কলেজে পড়েছেন, এখন ভার্সিটিতে পড়ছেন। সবখানেই তো আমাদের মতো মেয়েরা পড়াশোনা করছে। কখনও কি তাদের দিকে তাকান নি?

ইচ্ছা করে কিংবা বিনা প্রয়োজনে কোনো মেয়ের দিকে কখনও তাকাইনি।

স্ট্রেঞ্জ? আচ্ছা, আপনি কি ইসলামের সব আইন মেনে চলেন?

যতটুকু জানি মেনে চলার চেষ্টা করি।

রোজিনা মমতাজকে ঈশারা করে দাঁড়িয়ে উঠে শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বলল, এখন আসি। এতক্ষণ কথা বলে আপনার পড়ার ক্ষতি করলাম। সেজন্য কিছু মনে করবেন না। তারপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

বাইরে এসে রোজিনা বলল, তোর শিহাব ভাই আনকালচার্ড ও গোঁড়া হলেও তুই যে বললি অহঙ্কারী তা ঠিক নয়।

এত অল্প সময়ের মধ্যে তুই চিনতে পারিস নি। কোনো কিছুতেই ও হার মানতে চায় না।

তুই হার মানাতে পারিস না, তাই ওকে অহঙ্কারী বলছিস। আসলে ছেলেটা খুব ইনটেলিজেন্ট।

ইনটেলিজেন্ট মানে, ভীষণ ইনটেলিজেন্ট। ওয়ান ক্লাস থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ক্লাশেই সেকেন্ড হয়নি। ওর কাছে পড়ে আমিও এবছর ফার্স্ট হয়েছি।

রোজিনা খুব অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? তা হলে তো খুব জিনিয়াস ছেলে। আর একদিন আলাপ করতে হবে। তোকে একটা কথা বলছি, তুই ওর কাছে পড়তে যাওয়ার সময় গায়ে ওড়না দিয়ে যাবি।

মমতাজ খবু অবাক হয়ে বলল, কেন?

তুই এত অবাক হচ্ছিস কেন? যে যেমন তার সঙ্গে সেই রকমভাবে মেলামেশা করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। তা হ্যাঁরে, তোর আপাকে দেখছি না যে?

তুই তো জানিস সে বড় একটা কারো সামনে আসে না। হয়তো কিচেনে মাকে সাহায্য করছে।

আর পড়াশোনা করে নি? তুই তো চিঠিতে লিখেছিলি; এস.এস.সি. পাশ করেছে।

আমার সঙ্গে শিহাব ভাইয়ের কাছে পড়ে এইচ.এস.সি. পরীক্ষা দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে।

কথা বলতে বলতে ড্রইংরুমে এসে রোজিনা বলল, জাকিয়া আপাকে ডাক, তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।

মমতাজ একজন কাজের মেয়েকে বলল, আপাকে ডেকে দাওতো।

একটু পরে জাকিয়া এলে তাকে রোজিনা বলল, ভালো আছ আপা?

জাকিয়া মাথা নেড়ে ঈশারায় হ্যাঁ বলল। তারপর ঈশারা করেই ভালো আছ কিনা জিজ্ঞেস করল।

রোজিনা বলল, হ্যাঁ ভালো আছি।

এমন সময় হান্নান ফিরে এসে রোজিনাকে বলল, তোদের আলাপ শেষ হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে, চল এবার ফিরি। তারপর মমতাজকে তাদের বাসায় যেতে বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *