শেষ উপহার – ১

শিহাব ভাই আপনি এত চুপচাপ থাকেন কেন? বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে কথাই বলেন না। তাদের দিকে তাকিয়েও দেখেন না।

শিহাবকে নিয়ে মমতাজ আজ চন্দ্রিমা পার্কে বেড়াতে এসেছে। তারা পার্কের সবুজ নরম দূর্বা ঘাসের উপর পাশাপাশি বসেছে। মমতাজের শরীর থেকে কড়া সেন্টের গন্ধ শিহাবের নাকে এসে লাগছে। মমতাজ ক্লাশ নইনে পড়ে। পনের ষোল বছরের সুরূপা তরুণী হলে কি হবে এরই মধ্যে শরীরে যৌবন এসে গেছে। তার উপর স্যালওয়ার কামীজ পরলেও ওড়না ব্যবহার করে না।

লাজুক ও ধার্মিক শিহাব তার দিকে তাকাতে পারছে না। বাসায় যখন মমতাজ তাকে বেড়াতে আসার কথা বলে তখন তার পোশাক দেখে রাজি হয় নি। শেষে ফুপু যখন বললেন, আজ ওর বন্ধুরা কেউ আসেনি, তাই তোমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। তা ছাড়া তোমারও ঢাকা শহর দেখা উচিত। আজ দু তিন মাস হল এসেছ। কলেজে যাওয়া ছাড়া কোথাও বের হও না। সব সময় ঘরের মধ্যে বই নিয়ে বসে থাক। এতে স্বাস্থ্য ও মন দুটোই খারাপ হবে। প্রতিদিন কিছু সময় অন্ততঃ বাইরে ঘুরে বেড়ান দরকার। অসুখ বিসুখ হলে তখন তোমার মা আমাকে দুষবে। তারপর মেয়েকে বললেন, তোরা খেলাধুলা করার সময় বা বেড়াতে যাওয়ার সময় প্রতিদিন ওকেও সঙ্গে নিবি।

মায়ের কথা শুনে মমতাজ হেসে উঠে বলল, তোমার ভাইপো যা লাজুক, আমার বন্ধুদের সঙ্গে গেলে লজ্জায় হয়তো হার্টফেল করবে। ছেলেরা যে এত. লাজুক হয়, তা শিহাব ভাইকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। মা-মেয়ের কথা শুনে শিহাব আর না করতে পারেনি।

শিহাব কিছু বলছে না দেখে মমতাজ আবার বলল, কি হল শিহাব ভাই, কিছু বলছেন না কেন?

শিহাব এতক্ষণ মা ও বোনের কথা চিন্তা করছিল। সে এখানে রাজপুত্রের মতো আদর যত্নে রয়েছে। কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করছে। ফুপা-ফুপু নিজের ছেলের মতো স্নেহ করছেন, সমস্ত খরচ দিচ্ছেন। আর ওদিকে মা ও আতিয়া কোনো দিন এক বেলা আবার কোনো দিন উপোষ করে দিন কাটাচ্ছে। অভাবের জন্য হয়তো আতিয়ার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এ সব কথা ভাবতে ভাবতে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। মমতাজের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, কি যেন বলছিলেন?

আবার আপনি করে বলছেন? কতবার বলেছি না তুমি করে বলবেন?

আপনি বললেতো হবে না, আমার মনকে বলতে হবে।

আপনার মন বলছে না কেন?

সেটা মনের ব্যাপার, আমি বলব কি করে?

মমতাজ হেসে উঠে বলল, মন আর মানুষ আবার ভিন্ন বুঝি? আমি তো জানি দু’টোই এক।

আপনার কথা ঠিক। আমারটা হয়তো ব্যতিক্রম।

আচ্ছা, আপনিতো বেশ কথা বলতে পারেন, তবু চুপচাপ থাকেন কেন?

প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা কি ঠিক? বেশি কথা বললে লোকে বকমবাজ বলবে।

মমতাজ আবার হেসে উঠে বলল, বকমবাজ আবার কি জিনিস?

শিহাব মৃদু হেসে বলল, বকমবাজ বোঝেন না, এটা বিশ্বাস করি না। নিশ্চয় কৌতুক করছেন?

সত্যি শিহাব ভাই, কথাটার অর্থ আমি বুঝিনি।

বুঝেছেন ঠিকই, তবু জানতে চেয়ে আমাকে কথা বলাতে চাচ্ছেন। শহরের ছেলে মেয়েরা ভীষণ চালাক।

আপনি তো দেখছি তাদের চেয়ে বেশি চালাক।

কি করে?

কেন, চালাকের চালাকি তারাই ধরতে পারে, যারা বেশি চালাক।

কিন্তু আপনি তো আরো বেশি চালাক। ভাবতে খুব অবাক লাগছে, এই বয়সে এত চালাক হলেন কি করে।

থাক, অত আর গুণাগুণ করতে হবে না। এবার বলুন, আপনি মেয়েদেরকে এত এ্যাভয়েড করে চলেন কেন?

এই সব জানার জন্য কি নিয়ে এসেছেন? ফুপু তো বললেন, বেড়াবার কথা। বেড়ান নাকি স্বাস্থ্যের জন্য উপকার। বসে বসে গল্প করলে বেড়ানোর উপকার হবে কি করে? তার চেয়ে চলুন হাঁটি।

মমতাজ বলল, তাই চলুন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, যা জিঞ্জেস করলাম উত্তর দিলেন না যে?

এ্যাভয়েড না করে চলে উপায় নেই বলে।

ঠিক বুঝলাম না।

না বুঝলে আমিও বুঝাতে পারব না।

তা হলে কথাটা বললেন কেন?

আপনি তো দারুন মেয়ে?

দারুন মেয়ে মানে?

মানে, আপনি ভীষন উল্টো পাল্টা কথা বলেন।

তা হলে সোজা কথা বলি, আমি তো আপনার ফুপাতো বোন, আমাকেও কেন এড়িয়ে চলেন? আমার প্রতি ভালো করে তাকিয়েও দেখেন না? আর সব সময় চুপ করে থাকেন। মনে হয় যেন কিছু চিন্তা করেন।

শিহাব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব, তবে তার আগে আপনি বলুন, এসব কথা জানতে চাচ্ছেন কেন?

মা-একদিন বলল, আপনি পাড়াগাঁয়ের ছেলে। শহরে নতুন এসেছেন। আপনার দিকে যেন লক্ষ্য রাখি। তাই আর কি।

আপনি কি আমাদের বাড়ির সব খবর জানেন?

সব জানি না, মায়ের মুখে কিছু কিছু শুনেছি।

কি কি শুনেছেন?

মামা, মানে আপনার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। আপনি কৃষি কাজ করে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন। আপনাদের সংসার তেমন স্বচ্ছল নয়। আর আপনি খুব ভালো ছাত্র।

আমি এসেছি প্রায় তিন মাস। ফুপু নিশ্চয়ই আসার পরপর এসব কথা বলেছিলেন। এত দিন পরে সেসব হঠাৎ আজ মনে পড়ল বুঝি?

প্রথম যে দিন শিহাব এল, সে দিন মা বাবা যখন তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় তখন মমতাজ মনে করেছিল পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের বোকা ছেলে। তাই মামাতো ভাই হলেও তাকে ঠিক গ্রহণ করতে পারে নি। দেখা সাক্ষাৎ হলে এড়িয়ে চলতো। দু’দিন পর মা যখন বলল, শিহাব এখানে থেকে লেখাপড়া করবে এবং তোকে ও জাকিয়াকে পড়াবে তখন ঘৃণায় মমতাজের মন কুচকে গিয়েছিল। বলেছিল, আমি ওর কাছে পড়ব না।

শাফিয়া বেগম বললেন, কেন?

তোমার ঐ অজ পাড়াগাঁয়ের ভাইপোর কাছে পড়লে বন্ধু বান্ধবীদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তা ছাড়া ও আনকালচার্ড। আমার প্রেসটিজে বাধবে।

শাফিয়া বেগম বললেন, ছি মা, এমন কথা বলতে নেই। হাজার হোক তোর মামাতো ভাই। পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা একটু আনকালচার্ড হয়ই। এখানে কিছু দিন থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। তুই ওকে আমাদের সোসাটির মতো তৈরি করে নির্বি। আর শোন, ওর সঙ্গে যেন কোনো খারাপ ব্যবহার করিস না। পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের ছেলে হলে কি হবে, লেখাপড়ায় খুব ভালো। কোনো বছর ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি। এরপর মমতাজ ও জাকিয়া প্রতিদিন রাতে তার কাছে পড়ে।

কয়েকদিন পড়েই মমতাজ বুঝতে পারল মায়ের কথাই ঠিক। সব বিষয়েই শিহাব ভাই জুয়েল। পাড়াগাঁয়েও যে এত ভালো ছাত্র থাকতে পারে ভেবে খুব অবাক হল। তারপর ধীরে ধীরে তার প্রতি মমতাজের মন গলতে শুরু করলেও মেলামেশা করতে রুচিতে বাধতো। তাই শুধু পড়ার সময় ছাড়া তার সঙ্গে কথাবার্তা বলত না। তাদের বাড়ি কলাবাগানে। সে লালমাটিয়া গার্লস স্কুলে পড়ে। হাই সোসাইটির অনেক ছেলে মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। প্রতিদিন বিকেলে তারা গাড়িতে করে আসে। মমতাজদের বাড়ির সামনে অনেকখানি ফাঁকা জমিতে টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা আছে। সেখানে বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে মমতাজ খেলাধুলা করে। কোনো দিন দলবেঁধে বেড়াতে যায়।

শিহাব ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রথম দিন কলেজ থেকে ফেরার সময় তাদের দিকে একবার মাত্র তাকিয়ে দেখেছিল। তারপর আর কোনোদিন তাকায় নি। গেট দিয়ে ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। তারপর জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে জানালার ধারে দাড়িয়ে তাদের খেলা দেখে। আয়া নাম নিয়ে এলে খেয়ে পড়তে বসে।

শিহাব পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের পরিশ্রমী ছেলে হলেও যেমন চালাক তেমনি মেধাবী। আর যেমন দেখতে তেমনি স্বাস্থ্য।

ফুপুর বাড়িতে এসে দু’এক দিনের মধ্যে সবাইয়ের কাজ কর্ম ও স্বভাব চরিত্র বুঝে ফেলেছে। তার ফুপা সারাদিন ব্যবসা নিয়ে এবং ফুপু মহিলা সমিতি নিয়ে বক্ত থাকেন। মমতাজ স্কুল আর বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে থাকে। বাড়িতে সব সময় দুজন কাজের মেয়ে ও দু’জন কাজের লোক থাকে। আর থাকে মমতাজের বড় বোন জাকিয়া সুলতানা। তাকে সবাই জাকিয়া বলে ডাকে।

জাকিয়া জালাল সাহেব ও শাফিয়া বেগমের প্রথম সন্তান। জন্ম থেকেই সে বোবা। জালাল সাহেব তাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে অনেক দিন চিকিৎসা করিয়েছেন বাকশক্তি আনার জন্য, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। জাকিয়া অত্যন্ত সুন্দরী। এরকম সন্দুরী মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম জন্মায়। জাকিয়া বোবা স্কুল থেকে এস.এস.সি. পাশ করেছে। তারপর এইচ.এস.সি. পরীক্ষা দেবে বলে বাড়িতেই পড়ছে। মমতাজ জাকিয়ার চেয়ে দু’বছরের ছোট। মমতাজ সন্দরী; কিন্তু জাকিয়ার তুলনায় কিছুই না। মমতাজ বড় বোনকে রূপের জন্য হিংসা করে। প্রথম দিন জাকিয়াকে দেখে শিহাব খুব অবাক হয়ে ভেবেছিল, কোনো মানবী কি এত রূপসী হতে পারে? তারপর যখন জানতে পারল বোবা তখন কেন জানি তার মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবল, আল্লাহপাকের কি মহিমা, জাকিয়াকে সৌন্দর্যের রানী করে গড়লেও তাকে বাকশক্তি দেননি। তখন থেকেই তার প্রতি শিহাবের মনে একটা মমতাবোধ জেগে উঠে।

জাকিয়া মাঝে মাঝে শিহাবকে খাওয়ায়। অবশ্য কাজের মেয়ে সব কিছু নিয়ে আসে, সে শুধু শিহাবের সামনে বসে এটা সেটা পাতে তুলে দেয়। তাকে দেখলেই শিহাবের মন ব্যথায় ভরে উঠে। শিহাব ডাইনিং টেবিলে সবার সঙ্গে খায় না, নিজের রুমে খায়।

প্রথম যেদিন শাফিয়া বেগম ভাইপোকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এলেন, সেদিন শিহাব বলেছিল, সবার সঙ্গে খেতে আমার খুব লজ্জা করবে।

শাফিয়া বেগম তখন ভেবেছিলেন, পাড়াগাঁয়ের লাজুক ছেলে, কয়েকদিন যাক তারপর ঠিক হয়ে যাবে। তাই কিছু না বলে আয়ার হাতে তার রুমে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

শিহাব খুব লাজুক ঠিক কথা, কিন্তু ঐ কারণে শুধু যে খেতে গেল না, তা নয়। সে ধর্মের সব আইন মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্ঠা করে। চেয়ার টেবিলে খেলে সুন্নত আদায় হবে না, তাই গেল না। নিজের রুমের মেঝের কার্পেটের উপর ঝাড়ন বিছিয়ে আজও খায়।

জাকিয়া বেশ কয়েকবার ঈশারায় তাকে চেয়ার টেবিলে খেতে বলেছে; শিহাব ও তাকে ঈশারা করে সুন্নত পালনের কথা বুঝিয়েছে।

মমতাজ ভীষন চঞ্চল ও খুব প্রগলভ। আর নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী মনে করে।

তার উপর জালাল সাহেব ও শাফিয়া বেগম ছোট মেয়েকেই বেশি স্নেহ করেন। এই সমস্ত কারণে মমতাজ বেশ অহঙ্কারীও। তাই শিহাবকে মোটেই পছন্দ করে না। আজ নিরূপায় হয়ে শিহাবকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে এসে তাকে যাতা প্রশ্ন করে জব্দ করতে চায়। কিন্তু শিহাবের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছে। তাই শিহাব যখন বলল, তিন মাস পর বুঝি মায়ের আদেশ মনে পড়ল তখন বেশ রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করল, ছেলেটা তো দেখছি আমার থেকে বেশি চালাক। কি বলবে ভাবতে লাগল।

শিহাব বলল, কিছু বলছেন না যে?

মমতাজ রাগের সঙ্গে বলল, আপনি নিজেকে কি ভাবেন বলুন তো?

শিহাব ম্লান হেসে বলল, কি আর ভাববো, গরিব ঘরের একটা দুঃখী ছেলে। যে অন্যের আশ্রয়ে তাদেরই সাহায্যে লেখাপড়া করছে।

মমতাজ গরম মেজাজেই বলল, তা হলে আপনার এত অহঙ্কার কেন? ভালো ছাত্র, সুন্দর স্বাস্থ্য আর বুদ্ধিমান বলেই কি আপনি অহঙ্কারী?

শিহাব বলল, অহঙ্কার কোনো মানুষেরই থাকা উচিত নয়। আজাজিল আল্লাহর ইবাদত করে ফেরেশতাদের সর্দার হয়েছিল। কিন্তু একমাত্র অহঙ্কারের কারণে শয়তান হয়ে গেল। অহঙ্কার আল্লাহপাকের খাস সিফত। কোনো মানুষ অহঙ্করী হলে আল্লাহ তার দিক থেকে রহমতের দৃষ্টি সরিয়ে দেন। অচিরে তার অহঙ্কার চুর্ণ করে দেন। আপনি যে ভাবে প্রশ্ন করেছেন, সে ভাবেই আমি উত্তর দিয়েছি। এতে অহঙ্কার কোথায় দেখলেন? তা ছাড়া আমি তো আপনাদের দয়ায় মানুষ হচ্ছি, অহঙ্কার করব কি নিয়ে? তবু যদি আমার কথায় অহঙ্কার প্রকাশ হয়েথাকে, তা হলে মাফ চাইছি। আসলে কি জানেন, আপনাদের এই উঁচু সমাজকে আমি খুব ভয় পাই। তাইতো সবাইয়ের কাছ থেকে আড়ালে থাকি। সেটাকেই আপনি এড়িয়ে চলা ও অহঙ্কার ভেবেছেন।

কেন, ভয় পান কেন?

সে সব শুনলে আপনি আরো রেগে যাবেন। তা ছাড়া মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে, এবার বাসায় ফিরি চলুন।

তবু না শুনে ফিরব না।

শিহাব মৃদু হেসে বলল, আপনি যেমন রাগি তেমনি জিদ্দি। ঠিক আছে বলছি।

মমতাজ এই কথায় খুব রেগে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কি বললেন? আমি খুব রাগি আর জিদ্দি? জানেন, মা বাবাকে বলে আজই আপনাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি?

শিহাব ম্লান মুখে বলল, তা পারেন; তবে যা সত্য তাই বলেছি। রাগ পড়ে গেলে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন।

মমতাজ বলল, ঠিক আছে, বাসায় চলুন তারপর টের পাবেন।

বাসার কাছে এসে শিহাব ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামার পর মসজিদে নামায পড়তে গেল।

ঐ দিন রাতে মমতাজ পড়তে না গিয়ে মা বাবাকে বলল, আমি আর শিহাব ভাইয়ের কাছে পড়বো না। অন্য একজন মাষ্টার রাখার ব্যবস্থা কর। তাকে তাড়িয়ে দেয়ার কথাটা ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারল না।

স্ত্রী কিছু বলার আগে জালাল সাহেব বললেন, তুই বললে একজন কেন, চার পাঁচজন মাষ্টার রাখব; কিন্তু শিহাবের মতো কি তারা পড়াবে?

নাই পড়াক, তবু আমি শিহাব ভাইয়ের কাছে পড়বো না। তারপর মাকে বলল, বলেছিলাম না, তোমার ভাইপো পাড়াগাঁয়ের আনকালচার্ড ছেলে; তার সঙ্গে বেড়াতে যাব না। তুমিই তো জোর করে পাঠালে। আর কোনো দিন যদি বেড়াতে যাই, তা হলে আমার নাম মমতাজ নয়। আমাকে রাগি জিদ্দি মেয়ে এবং আরো অনেক কিছু বলে অপমান করেছে। তোমরা যদি তাকে কিছু না বল, তা হলে আমিই যা বলার বলব। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে চোখ রগড়াতে লাগল।

স্বামী কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে শাফিয়া বেগম ঈশারা করে থামিয়ে দিয়ে মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, তুই কাঁদছিস কেন? চুপ কর, আমি এক্ষুনি শিহাবকে শাসন করছি। কথা শেষ করে শিহাবের কাছে গিয়ে বললেন, মমতাজ খুব সেন্টিমেন্টাল মেয়ে, ওকে রাগি জিদ্দি বলা তোমার ঠিক হয়নি। ও তো কেঁদে কেঁদে বলছে, তোমার কাছে আর পড়বে না। যাই হোক, ওর সামনে তোমাকে আমি মিছি মিছি রাগারাগি করব, তুমি মন খারাপ করার ভান করবে। কয়েকদিন যাক, রাগ পড়ে গেলে ঠিকই পড়তে আসবে। তুমি ওর উপর কোনো সময়েই রাগ করবে না। এখন এস আমার সঙ্গে তারপর তার একটা হাত ধরে ফিরে এসে বললেন, তোমার এত বড় সাহস, আমাদের মেয়েকে তুমি যা তা বলে অপমান করো? আমরা তোমাকে খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি, লেখাপড়া করাচ্ছি আর তুমি কিনা আমাদের মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কর। প্রথমবারের মতো মাফ করে দিলাম। আবার যদি কোনো দিন কর, তা হলে ঘাড় ধরে বের করে দেব।

শিহাব কাঁদ কাঁদ স্বরে ফুপুর পায়ে হাত দিয়ে বলল, আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে আপনারা মাফ করে দিন ফুপু। আর কখনও এমন হবে না।

জালাল সাহেব ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে হাসি চেপে রেখে গম্ভীরস্বরে বললেন, হ্যাঁ, কথাটা মনে রাখবে। এখানে থেকে লেখাপড়া করতে হলে মমতাজের সঙ্গে আর কোনো দিন কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করবে না। এবার তুমি যাও।

শিহাব কান্নার অভিনয় করে চোখ রগড়াতে রগড়াতে চলে গেল।

শাফিয়া বেগম মেয়েকে বললেন, এরপরও যদি তোকে কিছু বলে, তা হলে তক্ষুনি ওকে তাড়িয়ে দেব। যা মা পড়তে যা।

শিহাবকে যখন শাফিয়া বেগম ডেকে নিয়ে আসতে যান তখন জাকিয়া সেখানে পড়তে এসেছিল। যারা বোবা হয় তারা কানেও শুনতে পায় না। কিন্তু জাকিয়া খুব বুদ্ধিমতী। কেউ কিছু বললে, তার ঠোঁঠ নাড়া দেখে বুঝতে পারে সে কি বলছে। তাই মা শিহাবকে যা কিছু বলেছে সব কিছু বুঝতে পেরেছে। তারা চলে যাওয়ার পর সে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখে পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। শিহাবকে আসতে দেখে ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। শিহাব আসার পর হাসি মুখে ঈশারা করে বলল, মমতাজ খুব রাগি। তার উপর যেন মনে কষ্ট না নেয়।

শিহাবও হাসি মুখে ঈশারা করে বলল, সে কিছু মনে করেনি।

এত কিছুর পরও মমতাজ দু’দিন শিহাবের কাছে পড়তে এল না। তৃতীয় দিনে মুখ ভার করে পড়তে এল।

শিহাব তার মুখের অবস্থা দেখে বলল, আমি যে অন্যায় করেছিলাম সে জন্য ফুপু আমাকে কত বকলেন। আমি ক্ষমা চাইলাম; তুব আপনি আমার উপর রাগ করে রয়েছেন। ক্ষমা প্রার্থীকে ক্ষমা করাই তো উচিত।

মমতাজ গলা ভার করে বলল, উচিত অনুচিত শেখাবার জন্য মা-বাবা এখানে আপনাকে রাখেননি, যে কাজের জন্য রেখেছেন, সেটাই করবেন। তারপর ইংরেজী বইটা খুলে এগিয়ে দিয়ে বলল, পড়াটা বুঝিয়ে দিন!

শিহাব বলল, আগে বলুন ক্ষমা করেছেন।

ক্ষমা না করলে ঐ দিনই আপনাকে বিদায় করে দেয়া হত। তবে পরবর্তিতে অন্যায় করলে ক্ষমা পাবেন না।

ঠিক আছে, কথাটা ইনশাআল্লাহ মনে রাখবো। তারপর পড়া বুঝিয়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *