শেষ উপহার – ৬

শিহাব ও মমতাজের ভালবাসার কথা কেউ জানতে না পারলেও জাকিয়ার মনে সন্দেহ এনে দিয়েছে। জাকিয়া বোবা হলেও খুব বদ্ধিমতী। মাঝে মাঝে মমতাজকে শিহাবের রুমে তার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতে দেখে এবং তাদের দু’জনকে বেড়াতে যেতে দেখে প্রথম প্রথম কিছু মনে না করলেও ইদানিং মমতাজের পরিবর্তন দেখে তার মনে সন্দেহ হয়েছে। কিন্তু সাহস করে মমতাজ বা শিহাবকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

জাকিয়া শিহাবকে প্রথম দেখার পর থেকে তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে। বোবা ও কালা মেয়েকে বাবার টাকার লোভে কেউ বিয়ে করলেও সেই স্বামী যে কোনোদিন তাকে ভালবাসবে না, তা জাকিয়া জানে। এর মধ্যে মা-বাবা যে তার বিয়ের সম্বন্ধ দেখছে তাও জানে। কয়েকটা পাত্র ও পাত্র পক্ষের লোকেরা এসে তাকে দেখে গেছে। সবকিছু পছন্দ করলেও যখন জানতে পারে, মেয়ে বোবা তখন তারা মন খারাপ করে ফিয়ে যায়। জাকিয়া আরো জানে, কেউ জেনেশুনে তাকে বিয়ে করবে না। তাই শিহাবকে ভালবাসলেও তাকে জানায় নি। নিজেকে ভাগের হাতে ছেড়ে দিয়ে তার খাওয়া-দাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখে। সে যখন রুমে থাকে না তখন তার বিছানাপত্র, কাপড় চোপড় ও বইপত্র গুছিয়ে দেয়। অবশ্য প্রথম থেকেই সে এইসব করে আসছে।

অনেক ভেবে চিন্তে একদিন নিজের মনের কথা জানিয়ে একটা চিঠি লিখে শিহাবের বালিশের নিচে রেখে দিল

শিহাব প্রতিদিন ঘুমাবার সময় নিজের বিছানাপত্র ঝেড়ে ঠিকঠাক করে ঘুমায়। অনেক দিন আগে সে যখন হাদিসে পড়েছিল, “বিছানাপত্র ঝেড়ে ঠিকঠাক করে ঘুমান সুন্নত” তখন থেকে এই সুন্নত মেনে আসছে। আজ বিছানা ঝাড়ার সময় বালিশ সরাতে গিয়ে চিঠির খাম দেখে বেশ অবাক হল। খাম থেকে চিঠি বের করে পড়তে শুরু করল-

শিহাব ভাই,

প্রথমে জানাই শতকোটি সালাম। পরে জানাই যে, তুমি এই চিঠি পড়ে আনন্দিত হবে কিনা জানি না, তবে হয়তো খুব অবাক হবে। যাই হও না কেন, আমার একান্ত অনুবোধ চিঠিটা পুরো পড়বে। এবার আসল কথায় আসি। তোমার আমার বয়স মনে হয় প্রায় সমান। তাই তুমি করেই লিখছি। অন্যায় হলে ক্ষমা করে দিও। আর তুমি করে বলার প্রধান কারণ হল, আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি। আমি বোবা বলে এ পৃথিবীতে মা-বাবা ছাড়া কেউ আমাকে ভালবাসে না। তবে তাদের ভালবাসার মধ্যে করুণা মিশ্রিত আছে তাও আমি জানি। নিখুঁত ভালবাসা আমি কারো কাছ থেকে পাইনি। সেইজন্যে হয়তো আমিও কাউকে ভালবাসতে পারিনি। আত্মিয় অনাত্মিয় যারা আমাদের বাড়িতে আসে, তাদের অনেকে আমার রূপ দেখে পুত্রবধু করেতে চায়। কিন্তু তারা যখন আমার সম্বন্ধে সব কিছু জেনে যায় তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধু আফশোষ করে আর বলে, আল্লাহ মেয়েটাকে রূপ দিলেও বোবা করেছে। মা-বাবা অনেক টাকা পয়সা দিয়ে আমার বিয়ের চেষ্টা করে বিফল হয়েছে। সে সব তারা আমাকে না জানালেও আমি সবকিছু বুঝতে পারি। আমার জন্য মা-বাবা খুব দুশ্চিন্তায় দিন যাপন করছে। তার উপর মমতাজ বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। আমার জন্য তার বিয়ে দিতে পারছে না। তাই মাঝে মাঝে ভাবতাম সুইসাইড করে সবাইকে দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই দেব। এর মধ্যে তুমি বাধা হয়ে দাঁড়ালে। কেন কি জানি তোমার কথা মনে পড়লেই সুইসাইড করার চিন্তাটা দূর হয়ে যায়। মনে হয় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তোমাকেই যেন খুঁজছিলাম। তাই দিনের পর দিন তোমাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললাম। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে চব্বিশ ঘন্টা তুমি আমার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে রয়েছ। জানি না. আমি তোমার মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে পেরেছি কিনা। আমার কিন্তু ময়ে হয়, তুমিই আমার জীবন মরণ। আগে ধর্ম সম্বন্ধে তেমন একটা জ্ঞান ছিল না। যতটুকু জানতাম মেনে চলার চেষ্টা করতাম। তুমি আসার পর তোমার কাছ থেকে ধর্মের বইপত্র নিয়ে পড়ে অনেক কিছু জেনেছি এবং সে সব মেনে চলার চেষ্ঠাও করছি। এই চিঠি পড়ে তুমি আমাকে কী ভাবছ জানি না, তবে যাই ভাব না কেন, চিঠির উত্তর অতি অবশ্যই দিবে। না দিলে যা পরিণতি হবে, তার জন্য তোমাকে মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না ঠিক; কিন্তু আল্লাহর কাছে করতেই হবে।

বেশি কিছু লিখে তোমাকে বিরক্ত করব না। তোমার চিঠি পাব এই আশা নিয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি –
জাকিয়া।

চিঠি পড়ে শিহাব যেন আকাশ থেকে পড়ল। অনেকক্ষণ চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলল। এক সময় সম্বিত ফিরে এলে ভাবল, না-না এ কখনও সম্ভব নয়। আমি মমতাজকে ভালবাসি। সেও আমাকে পাগলের মতো ভালবাসে। তখন তার বিবেক বলে উঠল, কিন্তু জাকিয়ার ভালবাসাকে তুমি উপেক্ষা করবে কি করে? মমতাজের মতো সেও তোমাকে ভালবাসে। তাকে উপেক্ষা করলে তার পরিনতি কি হবে চিন্তা করে দেখ। তা ছাড়া মমতাজের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। সে হয়তো বড় বোনের কথা জানতে পেরে নিজেকে সংযত করতে পারবে। এই সব ভাবতে ভাবতে ঘুমবার কথা ভুলে গেল। রাত তিনটের সময় তাহাজ্জুদের নামায পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করল, “হে রাব্বুল আল আমিন, তুমি সবকিছু জান। তোমার কুদরতী ঈশারাতেই সবকিছু ‘চলছে। তুমি আমাকে এ কেমন পরীক্ষায় ফেললে? আমি যে কিছুতেই ভাবতে পারছি না। যদিও জানি তুমি ভাগ্যে যা লিখে রেখেছে, তা হবেই; তবু আমি এখন কি করব বলে দাও। আমি তোমার উপর নিজেকে সোপর্দ করলাম। আমি কি এখান থেকে চলে যাব না থাকব, তোমার কুদরতী ঈশারায় জানিয়ে দাও। আমি তোমার একজন গোনাহগার বান্দা। আমার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দাও। মৃত্যু পর্যন্ত গোনাহ থেকে আমাকে হেফাজত করো। তোমার নবীপাক (দঃ) এর উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করে ফরিয়াদ করছি, তাঁর ওসিলায় আমার দোয়া কবুল কর। আমিন।”

তারপর ফজর পর্যন্ত কুরআন তেলাওয়াত করে নামায পড়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে কাজের মেয়ে নাফিজা নাস্তা নিয়ে এসে শিহাবকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হল। তাকে কোনোদিন এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে দেখেনি। নাস্তার প্লেট টেবিলের উপর চাপা দিয়ে রেখে ফিরে এসে শাফিয়া বেগমকে বলল, শিহাব বাবাজীর শরীর বোধ হয় খারাপ। সে এখনও ঘুম থেকে উঠে নি।

মমতাজ নাস্তা খেতে এসেছিল। নাফিজার কথা শুনে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি নাস্তা খাও, আমি দেখছি। কথা শেষ করে শিহাবের রুমে এসে দেখল, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মুখটা মলিন। ঘুমাবার আগে যে কেঁদেছে তার চিহ্ন চোখের গোড়ায় রয়েছে। তাকে দেখে মমতাজ চমকে উঠল। ভাবল, ওর কি এমন হল, যে জন্যে কেঁদেছে। মনে হয় সারারাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। হঠাৎ বালিশের পাশে একটা কাগজ দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সেটা নিয়ে চমকে উঠল, আরে, এযে আপার হাতের লেখা। তারপর পড়তে শুরু করল।

চিঠি পড়তে পড়তে মমতাজের খুব রেগে যাওয়ার কথা, কিন্তু তা না হয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। আগে হলে হয়তো আপার বারোটা বাজিয়ে ছাড়তো। কিন্তু এখন তার ধর্মীয় জ্ঞান তাকে অনেক সংযত করেছে। আপার জন্য তার বড় মায়া হল। পড়া শেষ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তার মাথা তখন বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। খাটে শিহাবের পাশে বসে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল। মনকে বোঝাতে লাগল, আপা শিহাব ভাইকে এত ভালবাসে যে, তাকে না পেলে আত্মহত্যা করার ইঙ্গিত দিয়েছে। যখন জানতে পারবে আমি ও শিহাব দু’জন দু’জনকে ভালবাসি তখন নিশ্চয় করেই ফেলবে। ছোট বোন হয় বড় বোনের এতবড় সর্বনাশ করতে পারবে না। তারপর শিহাবের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বিড় বিড় করে বলল, শিহাব ভাই, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপার জন্য নিজের প্রেমকে কুরবানি করব। শিহাবকে নড়ে উঠতে দেখে চিঠিটা রেখে দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে বেসিনে চোখ মুখ ধুয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, শিহাব ভাইয়ের বোধ হয় রাতে ঘুম হয়নি, তাই ঘুমাচ্ছেন।

শাফিয়া বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার থমথমে মুখ দেখে অবাক হলেন। বললেন, ঘুম হয়নি কেন? কোনো অসুখ বিসুখ করেনি তো? তুই তাকে জাগালি না কেন?

জাকিয়াও নাস্তা খাচ্ছিল। তার খাওয়া শেষ হয়েছে। দাঁড়িয়ে ঈশারা করে মাকে বলল, আমি তাকে জাগাতে যাচ্ছি। তারপর সে শিহাবের রুমে চলে গেল।

শাফিয়া বেগম মমতাজকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার বলতো, তোর মুখের অবস্থা ও রকম কেন?

মমতাজ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, মা, তুমি যেন কী? আমার মুখের অবস্থা আবার কি রকম হবে। তারপর নাস্তা না খেয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

শাফিয়া বেগম বললেন, নাস্তা না খেয়ে চলে যাচ্ছিস যে?

আমার শরীরটা আজ ভালো না, নাস্তা খাব না।

শাফিয়া বেগম ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জাকিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

জাকিয়া রুমে ঢুকে শিহাবের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। ভাবল, আমার চিঠি পড়ে নিশ্চয় সারারাত কেঁদেছে। কিন্তু কেন? তা হলে কি আমার চিঠি পড়ে মনে খুব আঘাত পেয়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার মাথা ধরে আস্তে আস্তে নাড়া দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করল।

শিহাবের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাকিয়ে জাকিয়াকে দেখে চমকে উঠল। তারপর হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল।

জাকিয়া তাকে ঈশারা করে নাস্তা খাওয়ার কথা বলে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর চলে এল।

শাফিয়া বেগম তাকে দেখে ঈশারা করে শিহাবের কথা জিজ্ঞেস করলেন।

জাকিয়াও ঈশারা করে বলল, সে উঠেছে।

শিহাব রাথরুমের কাজ সেরে গোসল করে নাস্তা খেয়ে উঠেছে, এমন সময় শাফিয়া বেগম তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি শরীর খারাপ?

শিহাব বলল, না ফুপু, আমার কিছু হয়নি।

তা হলে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলে কেন?

শিহাব একটু চিন্তা করে বলল, রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তাই ফযরের নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

শাফিয়া বেগম তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে অনুমান করতে পারলেন না। বললেন, শরীর খারাপ হলে অবহেলা করা উচিত নয়। আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। কোনো ডাক্তারের কাছে শরীরটা চেক আপ করাও।

শিহাব মৃদু হেসে বলল, আমার কিছু হয়নি ফুপু, আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।

শাফিয়া বেগম আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।

এরপর থেকে মমতাজ শিহাবের কাছে যাতায়াত কমিয়ে দিল। সে যাতে সন্দেহ করতে না পারে সে জন্য মাঝে মধ্যে যায়, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনাও করে। কিন্তু আগের মতো বেশিক্ষণ তার কাছে থাকে না।

এ দিকে জাকিয়া শিহাবকে চিঠি দেয়ার পর উত্তরের আশায় দিন গুণতে লাগল। প্রতিদিনকার মতো তাকে খাওয়াচ্ছে, বিছানাপত্র ও বইপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে; কিন্তু আগের মতো সেও তার কাছে বেশিক্ষণ থাকে না। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর তার ধারণা হল, শিহাব ভাই তাকে পছন্দ করে না। আরো দু’তিন দিন অপেক্ষা করে এক গভীর রাতে শিহাবের দরজার কাছে এস দরজায় টোকা দিল।

শিহাব জেগে ছিল। দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে শুনে ঘড়ি দেখল, বারটা। এত রাতে কে হতে পারে চিন্তা করতে লাগল। মনের ভুল হতে পারে ভেবে ঘুমাবার চেষ্টা করল। একটু পরে আবার শব্দ হতে খাট থেকে নেমে দরজা খুলে জাকিয়াকে দেখে চমকে উঠল।

জাকিয়া তাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিল।

শিহাব ঈশারা করে কাকুতি মিনতি করে বোঝাবার চেষ্টা করল, এত রাতে আসা তার ঠিক হয়নি।

জাকিয়া সেদিকে খেয়াল না করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঈশারা করে তার চিঠির উত্তর দেয়নি কেন জিজ্ঞেস করল।

শিহাব কি করবে না করবে এখনও ভেবে ঠিক করতে পারেনি। একবার ভেবেছিল, মমতাজকে জাকিয়ার চিঠির কথা বলে তার সঙ্গে আলোচনা করবে। কিন্তু বলতে সাহস হয়নি। এখন জাকিয়ার অবস্থা খুব সিরিয়াস বুঝতে পেরে ঈশারায় বোঝাল, তোমাকে ভালবাসি; কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভেবে চিন্তে নিতে হবে। কিছু দিনের মধ্যে সে কথা তোমাকে জানাব। তুমি এখন যাও। কেউ দেখে ফেললে আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তারপর অনেক মিনতি করে তাকে চলে যাওয়ার জন্য বোঝাতে লাগল।

জাকিয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে করুন দৃষ্টিতে এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়েছিল। সেই অবস্থায় নিজের রুমে চলে গেল।

শিহাবের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। দরজা লাগিয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করল, কালকেই ব্যাপারটা মমতাজকে জানিয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। নচেৎ আবার হয়তো কোন দিন জাকিয়া এসে হাজির হবে।

পরপর দু’তিন দিন মমতাজের দেখা না পেয়ে একদিন বিকেলে কাজের মেয়ে নাফিজাকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠাল

মমতাজ এসে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন?

বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করেছি, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ। কারণটা বলবে?

আমিও বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করেছি, আপনার এমন কিছু একটা হয়েছে যা আমাকে বলতে পারছেন না।

হ্যাঁ, তোমার অনুমান ঠিক। সেটা বলার জন্যই তোমাকে ডেকেছি। চল না কোনো পার্কে যাই। বেড়ানোও হবে আর কথাটা বলাও হবে।

মমতাজ এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিল। বলল, বেশ, আমি তৈরি হয়ে আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল।

গাড়িতে উঠে শিহাব বলল, এ সময়ে পার্কে নিরিবিলি জায়গা পাওয়া মুশকিল। তার চেয়ে বোটানিকাল গার্ডেনে যাওয়া যাক।

মমতাজ বলল, সেটাই ভালো।

গার্ডেনে পৌঁছে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দু’জন একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে বেশ কিছুক্ষণ একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

এক সময় দু’জনেরই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।

প্রথমে মমতাজ নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, কি বলবেন বলে নিয়ে এলেন?

শিহাবও নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে পকেট থেকে জাকিয়ার চিঠিটা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, পড়ে দেখ।

মমতাজ চিঠিটার দিকে একবার তাকিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এ চিঠি আমি অনেক আগেই পড়েছি।

শিহাব চমকে উঠে অবাক হয়ে বলল, পড়েছ?

হ্যাঁ পড়েছি। যে দিন আপা আপনাকে চিঠিটা দেয় তার পরেরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে গিয়ে পড়েছি। তখন আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।

তারপরও তুমি এতদিন চুপচাপ রয়েছ?

কি করব তা হলে?

কি করবে মানে? আমাকে কি তুমি অবিশ্বাস কর?

না।

তা হলে চিঠির কথা জেনেও এতদিন কিছু বলোনি কেন? সেদিন থেকে আমি কি যন্ত্রনা নিয়ে যে দিন কাটাচ্ছি, তা কি তুমি জান না?

জানি এবং আমিও সেই যন্ত্রনায় ভুগছি।

যন্ত্রনা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার কোনো চিন্তা ভাবনা করেছ?

করেছি, শুধু এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

কি চিন্তা ভাবনা করেছ বল।

আপনি আমাকে ভুলে যান শিহাব ভাই।

যে শিহাব ধৈর্য্যের প্রতিক, যে কোনো দিন রাগ কি জিনিস জানে না। সেই শিহাব আজ মমতাজের কথা শুনে এত রেগে গেল যে, সামলাতে না পেরে তার গালে সজোরে একটা চড় মেরে গর্জে উঠল, একথা বলতে তোমার মুখে আটকাল না? আল্লাহ না করুক, দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে গেলেও মমতাজ আর শিহাব ছাড়াছাড়ি হতে পারে না। কান্নায় তার গলা বুজে এল।

মমতাজ চিন্তাই করতে পারেনি শিহাব ভাই তাকে মারবেন। যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল, তবু কিছু বলল না, শুধু তার চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আর অবিরল ধারায় চোখের পানি ফেলতে লাগল।

শিহাব সম্বিত ফিরে পেয়ে তার ফর্সা টকটকে গালে পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে মাঠিতে ঘুসি মারতে মারতে বলল, এ আমি কি করলাম, কি করলাম? ঘুঁসির চোটে তার হাতের আঙ্গুল ফেটে রক্ত বেরোতে লাগল।

তাই দেখে মমতাজ তার হাতটা দু’হাতে ধরে ভিজে গলায় বলল, একি করছেন শিহাব ভাই? আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি?

শিহাব হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ছেড়ে দাও মমতাজ, যে হাতে তোমার গালে চড় মেরেছি, সে হাত আমি গুড়ো করে ফেলব।

মমতাজ আরো জোরে হাতটা চেপে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, না শিহাব ভাই না। আপনার হাতের চড় আমার কাছে কোটি টাকার উপহার। সাময়িক কষ্ট পেলেও আমি খুব খুশি হয়েছি। একটা আব্দার আমার রাখবেন?

শিহাব মমতাজের কথা শুনে ভীষণ অবাক হল। চড় খেয়েও যে মমতাজ এই কথা বলবে, তা ভাবতেই পারছে না। কি আব্দার করতে পারে চিন্তা করতে লাগল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মমতাজ মিনতি স্বরে বলল, রাখবেন না শিহাব ভাই?

শিহাব বলল, ইসলামের বাইরে কোনো কিছু না হলে প্রাণের বিনিময়ে হলেও রাখব।

ওয়াদা?

ওয়াদা।

আপনি আপাকে বিয়ে করুন।

শিহাব আবার রেগে উঠে হাত তুলেছিল মারবে বলে; কিন্তু পারল না। হাতটা নামিয়ে নিয়ে মুখ নিচু করে অনেক্ষণ চুপ করে রইল।

মমতাজ অধৈর্য্য স্বরে বলল, হাতটা নামিয়ে নিলেন কেন? আমাকে যত ইচ্ছা মারুন, আমি কোনো প্রতিবাদ করব না। তবু আপাকে বিয়ে করবেন? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মমতাজ আবার বলল, জানেন না, ওয়াদা ভঙ্গ করা শক্ত গোনাহ?

শিহাব এতক্ষণ মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলছিল। এবার চোখ মুছে মুখ তুলে বলল, সে কথা জানি মমতাজ। তবে তুমি বোধ হয় জান না, হায়াৎ মউত, বিয়ে শাদি আল্লাহর হাতে। তিনি যদি জাকিয়াকে আমার স্ত্রী হিসাবে ঠিক করে থাকেন, তা হলে আমি কেন আমার ঘাড় রাজি হবে। তবে তুমি তোমার আপার জন্য যে স্যাকরিফাইস করলে তা বিরল। এখন চল ফেরা যাক।

ফেরার সময় গাড়িতে মমতাজ বলল, আপার চিঠির উত্তর আপনাকে দিতে হবে না। যা বলার আমিই বলব।

শিহাব গাড়ি চালাতে চালাতে শুধু বলল, শুকরিয়া।

পরের দিন এক ফাঁকে মমতাজ জাকিয়াকে ঈশারায় জানাল, শিহাব ভাই তোমাকে খুব ভালবাসেন। মা-বাবাকে বলব তার সঙ্গে তোমার যেন বিয়ে দেয়।

জাকিয়া মমতাজকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

মমতাজের চোখেও পানি এসে গেল। জাকিয়ার পিঠে কিছুক্ষণ হাত বুলাতে বুলাতে নিজেকে সামলাল তারপর আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে ঈশারায় বলল, তুমি কাঁদছ কেন? শিহাব ভাই তোমাকে খুব ভালবাসেন। তুমি দেখো আপা, মা-বাবাকে বলে যেমন করে হোক তোমাদের দু’জনের মনের আশা পূরণ করবই ইনশাআল্লাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *