২
শিহাবের বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী গ্রামে। বরগুনা লঞ্চঘাট থেকে চার মাইল দক্ষিণে আমতলী। শিহাবের বাবার নাম আব্দুল খাঁন। মায়ের নাম লতিফা বানু। তাদের চার ছেলে, চার মেয়ে। এক বছর ডেঙ্গুজ্বরে গ্রামের বহু লোকজন ও ছেলেমেয়ে মারা যায়। সেই সময় শিহাবের তিন ভাই ও তিন বোন এবং বাবা মারা যায়। তার অনেক আগে দাদা দাদি মারা গেছেন। শিহাবের দাদা হাজী জিন্নাত, আলি খাঁন খুব নাম করা লোক ছিলেন। অবস্থাও খুব ভালো ছিল। ওনার দুই বিয়ে। প্রথম পক্ষের শুধু আব্দুল খান। দ্বিতীয় পক্ষের ছয় ছেলে ছয় মেয়ে। জিন্নাত আলি মারা যাবার পর বিষয় সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায়। এক এক জনে অংশমতো যা পেয়েছে তাতে কারো আর স্বচ্ছলতা নেই। শিহাবের বাবা আব্দুল খাঁন প্রায় দু’বছর অসুখে ভুগে মারা গেছেন। সে সময় জমি বেঁচে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তখন শিহাব ক্লাস নাইনে পড়ত। সে ভাইয়েদের মধ্যে ছোট। বাবা মারা যাবার পর শিহাব লেখাপড়া বন্ধ করল না। সে ফাইভে ও এইটে বৃত্তি পেয়েছিল। ফলে শিক্ষকরা তাকে খুব ভালোবাসতেন। তারা শিহাবের পড়াশোনার ব্যপারে সাহায্য করতেন। তার এক সৎ চাচা ও ফুপু সাহায্য করতেন। লেখাপড়ার খরচের জন্য তার কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু ঘরে সব দিন রান্না হত না। তাই ছুটির দিনে চাষ বাসের কাজ করে সংসার চালাবার জন্য মাকে সাহায্য করত।
লতিফা বানু খুব ধার্মিক মহিলা। ছেলে মেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষ করছেন। নিজে উপোষ থেকে ছেলে মেয়েকে খাওয়ান। ছোট মেয়ে আতিয়া তখন ক্লাস টুয়ে পড়ে। ভাই বোন দু’জনেরই মাথা খুব ভালো। প্রতি বছর ফার্ষ্ট হয়। শত অভাব অনটনের মধ্যেও লতিফা বানু ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করলেন না।
এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে শিহাব আমতলী হাই স্কুল থেকে এস.এস.সিতে কলা বিভাগে প্রথম হয়ে পাশ করল, তারপর সংসারের কথা ভেবে কিছু একটা করার কথা মাকে বলল। লতিফা বানু বললেন, সংসারের কথা তোকে চিত্র করতে হবে না। আল্লাহ কাউকে না খাইয়ে রাখেন না। তুই কলেজে ভর্তি হয়ে আরো লেখাপড়া কর। অনেক লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হলে আমাদের আর দুঃখ থাকবে না। আল্লাহ চিরকাল কারো দুঃখ রাখেন না। তুই কত ভালো রেজাল্ট করেছিস। তোর আব্বা বেঁচে থাকলে কত খুশি হত। আমি দো’য়া করছি, আল্লাহ তোকে খুব বড় করবেন।
শিহাবেরও পড়াশোনা করার ইচ্ছা। সংসারের কথা চিন্তা করে ঐ কথা বলেছিল। মায়ের কথায় আশ্বাস পেয়ে বরগুনা কলেজে ভর্তি হল। সেই সঙ্গে নিজের ও আত্মীয় স্বজনদের চাষ বাসের কাজ করে মাকে সাহায্য করতে লাগল।
দু’বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এইচ.এস.সি.তেও সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান পেয়ে পাশ করল। এ বছর আতিয়াও ফাইভে বৃত্তি পেয়ে পাশ করল।
লতিফা বানুর সঙ্গে সৎ ননদ শাফিয়া বেগমের খুব ভাব ছিল। শাফিয়া বেগমের বিয়ের পরও তা কমেনি। শাফিয়া বেগমের বিয়ে হয়েছে লতিফা বানুর বাপের বাড়ি তালতলী গ্রামের জালাল সাহেবের সঙ্গে। জালাল সাহেব লতিফা বানুর দুর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। সেই জন্যে শাফিয়া বেগমের সঙ্গে লতিফা বানুর সম্পর্ক কোনো দিন ভাটা পড়েনি। শিহাবদের দুর্দিনে শাফিয়া বেগম বাপের বাড়ি এলেই বেশ কিছু টাকা দিয়ে যেতেন। তারপর জালাল সাহেব ঢাকায় ব্যবসা করে গাড়ি বাড়ি করে গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন। ঢাকায় আসার পরও শাফিয়া বেগম প্রত্যেক মাসে কিছু কিছু টাকা লতিফা বানুকে পাঠাতেন। শিহাব যে ভালো ছাত্র শাফিয়া বেগম প্রথম থেকেই জানতেন। শিহাবের এস.এস.সি-র রেজাল্ট খবরের কাগজে ছবিসহ বেরোতে শাফিয়া বেগম কাগজটা স্বামীর হাতে দিয়ে শিহাবের ছবি দেখিয়ে বললেন, দেখতো, ছেলেটাকে চিনতে পার কিনা?
জালাল সাহেব শ্বশুর বাড়িতে খুব কম গেছেন। যখন গেছেন তখন শিহাব ছোট ছিল। তা ছাড়া তাদের বাড়িটা আলাদা। সে বাড়িতে কখনও যান নাই। একবার লতিফা বানু শাফিয়া বেগম ও জালাল সাহেবকে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন। সে অনেক বছর আগের কথা। তাই ছবি দেখে চিনতে পারলেন না। তবে রেজাল্টের খবর ও ঠিকানা পড়ে আনন্দিত হয়ে বললেন, আরে, এ যে তোমার বড় ভাইয়ের ছেলে। তোমার মুখে শুনেছিলাম, তোমার বড় ভাই মারা গেছেন। সংসারে খুব অভাব অনটন; কিন্তু ছেলেটা দারুন রেজাল্ট করেছে।
শাফিয়া বেগম বললেন, হ্যাঁ, ছেলেটা খুব মেধাবী। তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?
জালাল সাহেব হেসে উঠে বললেন, বল কি বলবে মনে করার কি আছে।
টাকা পয়সার জন্য শিহাবের হয়তো লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমি তাকে সাহায্য করতে চাই। অবশ্য তোমাকে না জানিয়ে প্রতি মাসে কিছু কিছু সাহায্য করি।
এটা তো খুব ভালো কথা। টাকা পয়সার জন্য একটা মেধাবী ছাত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাক, তাকি কেউ চায়? তুমি যে ভাবে তাকে সাহায্য করতে চাও করো। টাকা পয়সার জন্য চিন্তা করো না?
শাফিয়া বেগম স্বামীর কথা শুনে খুশি হলেন। চিঠি লিখে লতিফা বনুকে জানালেন, শিহাবকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। ওকে আমি লেখাপড়া করিয়ে বড় করব।
লতিফা বানু চিঠি পেয়ে পড়ার পর ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, তোর ফুপু যে আমাদেরকে সাহায্য করে, তা তো তুই জানিস। এটা সে দিয়েছে, পড়ে দেখ।
শিহাব চিঠি পড়ে বলল, ফুপুর ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না। তুমি তাকে জানিয় দাও। আমি এখানে থেকেই কলেজে পড়ব।
লতিফা বানু বললেন, এখানে তুই ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারবি না। রেজাল্টও ভালো করতে পারবি না। আমার মতে তোর ফুপুর কাছে থেকে লেখাপড়া করাই উচিত।
কিন্তু মা, তুমি শুধু আমার দিকটা দেখবে? তোমার ও আতিয়র কথা ভাববে না? আমি ঢাকায় চলে গেলে সংসার চলবে কি করে? আর রেজাল্টের কথা যে বলছ, ঢাকায় থেকে যা হবে, এখানে থেকেও ইনশাআল্লাহ তাই হবে।
ছেলের কথা শুনে লতিফা বানুর চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বললেন, সে কথা যে আমি ভাবিনি তা নয়। তবু তোর ভবিষ্যৎ ভেবে বলছি। দো’য়া করি, আল্লাহ তোর মনের কামনা পূরণ করুক।
লতিফা বানু চিঠি লিখে ছেলের মতামতের কথা শাফিয়া বেগমকে জানিয়ে ছিলেন।
তারপর এইচ.এস.সি. পরীক্ষার রেজাল্ট আগের মতো হয়েছে দেখে শাফিয়া বেগম স্বামীকে সে কথা জানিয়ে বললেন, শিহাবকে আমাদের কাছে রেখে ভার্সিটিতে পড়াতে চাই। এতে তোমার আপত্তি আছে?
জালাল সাহেব বললেন, আপত্তি থাকবে কেন? বরং খুশি হব। কি জান, ছেলেটাকে দেখতে বড় ইচ্ছা করছে।
শাফিয়া বেগম বললেন, আমারও অনেক দিন থেকে ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। ভাবিকে চিঠি লিখে ওকে পাঠিয়ে দিতে বলি?
তাই দাও।
কিন্তু শিহাব যদি আসতে না চায়? ছেলেটা ওর বাপেরমতো সেন্টিমেন্টাল। বড় ভাই অত দিন অসুখে ভুগল, জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাল, তবু কারো কাছে হাত পাতেনি। ভাবছি চিঠি দেয়ার পর যদি না আসে, তা হলে তোমাতে আমাতে গিয়ে নিয়ে আসব।
আগে চিঠি দাও, কাজ না হলে তখন দেখা যাবে।
শাফিয়া বেগম ভাবিকে চিঠি দিয়ে জানাল। শিহাব যদি না আসে, তা হলে আমরা গিয়ে ওকে নিয়ে আসব।
লতিফা বানু চিঠি পেয়ে এবারও ছেলের হাতে দিলেন।
শিহাব এইচ.এস.সি. পরীক্ষা দিয়ে চিন্তা করছে, রেজাল্ট বের হওয়ার পর ঢাকায় গিয়ে একটা কিছু করবে। আর সেই সঙ্গে পড়াশোনাও করবে। ফুপুর চিঠি পড়ে মাকে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলল, ফুপুদের কাছে থাকলে লেখাপড়া হবে ঠিক, কিন্তু তোমাদের চিন্তায় ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারব না।
লতিফা বানু বললেন, সংসার চালাবার মালিক আল্লাহ। তিনি এতদিন যেভাবে চালিয়েছেন, এখনও সেইভাবেই চালাবেন। আমার মতে তুই তোর ফুপুদের কাছে থেকে লেখাপড়া কর। আমাদের জন্য তোকে চিন্তা করতে হবে না। আল্লাহ যে কোনো ভাবে চালিয়ে দেবেন।
শিহাব চিন্তা করল, ফুপুদের কাছে যাওয়াই ভালো। তাদের কাছে থাকলে খাওয়া ও লেখাপড়ার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। ফুপা-ফুপুকে ধরে কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করে মাসে মাসে টাকা পাঠাবার চেষ্টাও করা যাবে।
ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে লতিফা বানু বললেন, কিরে, কিছু বলছিস না কেন?
শিহাব বলল, হ্যাঁ আম্মা, তাই যাব ভাবছি। লেখাপড়া করার সাথে সাথে ফুপাকে ধরে একটা চাকরির ব্যবস্থা করব। দোয়া কর আম্মা, আল্লাহ যেন আমার আশা পূরণ করেন।
লতিফা বানু বললেন, নিশ্চয়ই করব বাবা, তুই যেন চাকরি করতে গিয়ে আবার পড়ার ক্ষতি না করিস।
না আম্মা, তা করব না। তুমি আতিয়ার দিকে খুব লক্ষ্য রাখবে। ওর পড়াশোনা বন্ধ করো না। তারপর আতিয়াকে বলল, মন দিয় পড়াশোনা করবি। । মায়ের কাছে কাছে থাকবি।
কয়েকদিন পর শিহাব মা-বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হল।
ঢাকা সদরঘাটে লঞ্চ থেকে টার্মিনালে নেমে শিহাব খুব অবাক হল। আগে কোনো দিন ঢাকা আসে নি। একা হলে কি করত ভেবে বেশ ঘাবড়ে গেল। বারেক সোলেমান চাচার সঙ্গে এসেছে। নচেৎ কি যে হত আল্লাই জানেন।
সোলেমানের বাড়িও আমতলীতে। সে অনেক বছর ধরে ঢাকা নিউ মার্কেটের গাউসিয়ায় দর্জির কাজ করছে। শিহাব তার সঙ্গে এসেছে।
সোলেমান তাকে কলা বাগানে ঠিকানামতো পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।
শিহাব গেটে বাধা পেল, দারোয়ান একটা অচেনা ছেলে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কে আপনি? ভিতরে যেতে চাচ্ছেন কেন?
শিহাব তাকে ঠিকানা দেখিয়ে বলল, আমি আমতলী থেকে এসেছি। জালাল সাহেব আমার ফুপা।
দারোয়ান বলল, আপনি একটা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে দিন।
শিহাব লিখে দেয়ার পর বলল, আপনি দাঁড়ান আমি আসছি। তারপর ভিতরে গিয়ে কাজের মেয়ে সমিরণের হাতে দিয়ে বলল, এটা বেগম সাহেবকে দাও।
আজ শুক্রবার সবাই বাসায়। সমীরণ কাগজটা নিয়ে শাফিয়া বেগমকে দিল।
নাম ঠিকানা পড়ে শাফিয়া বেগম খুব আনন্দিত হয়ে সমীরণকে বললেন, যা, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আয়। তারপর স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন, শিহাব এসেছে। ওর মাকে চিঠিতে লিখেছিলাম শিহাব না এলে আমি ও তুমি ওকে আনতে যাব।
জালাল সাহেব আত্মভোলা মানুষ। সংসারের দিকে কোনো খেয়াল রাখেন না। সব সময় ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামান। শিহাবের কথা মনেই নেই। বললেন, শিহাব আবার কে? কোথা থেকে এল?
শাফিয়া বেগম স্বামীর স্বভাব জানেন। বললেন, কি আশ্চর্য? তোমার কি ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই মাথায় থাকে না? শিহাবের কথাও ভুলে গেলে? আমার বড় ভাইয়ের ছেলে শিহাব, যে নাকি এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি. তে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ফার্স্ট হয়েছে। কাগজে যার রেজাল্ট দেখে তুমিই তো আমাকে বললে, তার কথা ভুলে গেলে কি করে?
জালাল সাহেব হেসে উঠে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তা কোথায় সে?
শাফিয়া বেগম বললেন, গেটে আছে, সমীরণকে নিয়ে আসতে পাঠিয়েছি। এস আমরা বারান্দায় যাই।
শাফিয়া বেগম ও জালাল সাহেব বারান্দায় এসেছেন, এমন সময় শিহাব সমীরণের সঙ্গে এসে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
ওনারা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, থাক বাবা থাক। তারপর বসতে বলে নিজেরাও বসলেন।
শিহাব পকেট থেকে মায়ের চিঠিটা বের করে ফুপুকে দিল।
শাফিয়া বেগম সমীরণকে বললেন, ড্রইংরুমের পাশের গেস্ট রুমটা ঠিক ঠাক করে দাও। শিহাব ওখানে থাকবে। তারপর চিঠিটা পড়তে লাগলেন।
শাফিয়া বুবু,
পত্রে আমার দো’য়া নিও। দুলাভাইকেও দিও আর জাকিয়া ও মমতাজকে স্নেহাশীষ দিও। পরে জানই যে, শিহাবকে পাঠালাম, এখন থেকে তোমরাই ওর মা বাবা। ও বড় একরোখা আর স্বাধীনচেতা ছেলে। তবে বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে জানে। খুব ধর্মঘেষা। ওকে ওর মতো চলতে দিও। তবে অন্যায় কিছু করলে মা-বাবার মতো শাসনও করবে। পড়াশোনার সাথে সাথে কিছু একটা করতে চায়। সে ব্যাপারে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে যা করলে ভালো হয় করো। বিশেষ আর কি লিখব। আমি ও আতিয়া ভালো আছি। আল্লাহপাকের দরবারে তোমাদের সার্বিক কুশল কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি-
তোমার ভাবি
লতিফা বানু।
শাফিয়া বেগম চিঠিটা পড়ে স্বামীর হাতে দিলেন।
জালাল সাহেব পড়ে বললেন, ঠিক আছে, ও রাত জেগে জার্নি করে এসেছ, গোসল করে নাস্তা খেয়ে রেষ্ট নিক, পরে আলাপ করা যাবে।
শাফিয়া বেগম জাকিয়া ও মমতাজকে ডেকে শিহাবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শিহাব তাদের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিল।
শাফিয়া বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, লজ্জা করছ কেন? ওরা তোমার ছোট, ওদেরকে আতিয়ার মতো মনে করবে।
মমতাজ বলল, আতিয়া কে মা?
শিহাবের ছোট বোন।
শিহাবের জামা কাপড় ও উসকো খুসকো চুল এবং রাতজাগা চেহারা দেখে মমতাজের গা ঘিন ঘিন করে উঠল। আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল।
জাকিয়া কিন্তু এক দৃষ্টে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল।
শিহাব এখানে আসার পর থেকে ক্রমশ খুব অবাক হচ্ছে। মায়ের কাছে শুনেছে ফুপারা খুব বড়লোক। তারা যখন গ্রামে গেছে তখন দু’একবার তাদেরকে দেখেছেও। তারা খুব বড়লোক শুনে তাদের ধারে কাছে যাইনি। এখন তাদের বাড়ি ঘর, আসবাবপত্র দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না, এখানে থাকবে। এইসব ভাবতে ভাবতে চারপাশে তাকাতে গিয়ে জাকিয়ার দিকে নজর পড়তে দেখল, সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু আগে দু’বোনকেই দেখেছে। তখন ভালো করে লক্ষ্য করেনি। এখন জাকিয়াকে দেখে মনে হল, এত সুন্দরী মেয়ে আগে কখনও দেখেনি। তার দিক থেকে দৃষ্টি সরাতে পারল না।
তাই দেখে শাফিয়া বেগম শিহাবকে বললেন, তুমি বোধ হয় জান না, ও কথা বলতে পারে না।
শিহাব চমকে উঠে বলল, কি বলছেন ফুপু?
শাফিয়া বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ বাবা, ও জন্ম থেকেই বোবা; তবে খুব বুদ্ধিমতী। এবছর এস.এস.সি. পাশ করেছে।
শুনে শিহাব খুব অবাক হয়ে বলল, পড়াশোনা করল কি ভাবে?
এখন সাইন্সের যুগ বাবা। মানুষ কত উন্নতি করেছে। বোবা ও অন্ধদের স্কুল আছে।
আপনারা চিকিৎসা করান নি?
তা আবার করাই নি, তোমার ফুপা ফরেনেও নিয়ে গিয়েছিলেন, কিছুই হয় নি।
এমন সময় সমীরণ এসে বলল, বেগম সাহেব রুম, ঠিক করে দিয়েছি।
শাফিয়া বেগম শিহাবকে বললেন, তুমি এস আমার সাথে। তারপর তাকে নিয়ে তার রুমে এসে বললেন, এটা তোমার রুম। তুমি এখানে থেকে লেখাপড়া করবে। তোমার পড়াশোনার সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব। তারপর এটাচ রাথরুম খুলে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে গোসল করার সব ব্যবস্থা আছে, তুমি গোসল করে নাও। আমি তোমার জন্য নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি, নাস্তা খেয়ে রেষ্ট নাও।
জালাল সাহেবের বাড়িটা তিনতলা। দোতলায় ওনারা থাকেন, তিনতলায় কেউ থাকে না। নিচতলার দুটো রুমে চাকর চাকরানীরা থাকে। বাকি সব রুম তালা দেয়া। মেহমান কুটুম এলে ব্যবহার হয়। বাড়ির সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সেখানে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা। গেটের পাশে দারোয়ান থাকার রুম। অন্য পাশে ফুলের বাগান। একজন মালী সেটা দেখাশোনা করে। ফুলের বাগান ও খেলার মাঠের মাঝখান থেকে কংক্রীটের ঢালাই রাস্তা।
জালাল সাহেব এক্সপোর্ট ইম্পোটের ব্যবসা করেন। ঢাকায় আরো কয়েকটা বাড়ি আছে। দুটো গাড়ি। একটা নিজে ব্যবহার করেন, অন্যটা মেয়েরা।
জাকিয়া বোবা বলে তার কোনো বন্ধু বান্ধবী নেই। সে পড়াশোনা ও সংসারের কাজ করে সময় কাটায়। খেলাধুলা পছন্দ করে না।
শাফিয়া বেগম তাকে মমতাজের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে মেলামেশা ও খেলাধুলা করতে বলেন, কিন্তু জাকিয়ার ওসব ভালো লাগে না। তাই সবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে।
শিহাব এখানে আসার কয়েকদিন পর থেকে দু’বোনকে পড়াচ্ছে। মমতাজকে পড়া বুঝিয়ে দেয়। আর জাকিয়াকে সব কিছু লিখে দিতে হয়।
ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর যত দিন যাচ্ছে, মা বোনের কথা চিন্তা করে শিহাবের মন তত খারাপ হচ্ছে। কিভাবে তাদের সংসার চলছে ভেবে খুব অস্থির হয়ে পড়ল। মাসে দুটো করে মাকে চিঠি দেয়। মা উত্তরে লেখেন, আমাদের জন্য তুই কোনো চিন্তা করবি না। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। সংসার কি ভাবে চলছে লেখেন না।
পড়াশোনা করতে পারলেও ভালোভাবে খেতে পারছে না। খেতে গেলেই মা বোনের ক্ষুধার্ত মুখের ছবি মনের পাতায় ভেসে উঠে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একদিন শাফিয়া বেগম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কোনো অসুখ করেছে? মানে পেটের অসুখ টসুখ?
শিহাব বলল, না ফুপু, ওসব কিছু হয়নি।
তা হলে তুমি খাওয়া দাওয়া একদম করছ না কেন? বেশ রোগা হয়ে গেছ। সব সময় মনমরা হয়ে থাক।
আম্মা ও আতিয়ার জন্য মনটা খারাপ।
তাই যদি হয়, দু’চার দিনের জন্য একবার গিয়ে ওদেরকে দেখে এস।
একটা কথা বলব ফুপু?
বল কি বলবে? তোমাকে তো বলেছি, যা দরকার এতটুকু দ্বিধা না করে আমাকে জানাবে।
আপনি তো আমাদের সংসারের অবস্থা জানেন। ফুপাকে বলে যদি আমার একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতেন, তা হলে প্রতি মাসে আম্মাকে কিছু টাকা পাঠাতে পারতাম। টাকার জন্য আতিয়ার হয়তো লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আম্মাকে সেই রকম বলে এসেছিলাম। আর আম্মাও বোধ হয় আপনাকে চিঠিতে সেরকম লিখেছিলেন।
আমার ভুল হয়ে গেছে তোমাকে আগেই জানানো উচিত ছিল। শোন, তাদের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। জাকিয়া ও মমতাজকে দু’জন মাষ্টার পড়াত। তাদেরকে তিন হাজার টাকা বেতন দিতাম। তুমি আসার পর তাদেরকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। সেই টাকা থেকে তোমার পড়ার খরচ বাদে প্রতি মাসে দু’হাজার টাকা তোমার মাকে মানি অর্ডার করে পাঠাচ্ছি। তোমার চাকরি করার দরকার নেই। জাকিয়া ও মমতাজকে পড়াবার পর চাকরি করলে নিজের পড়া পড়বে কখন? ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা কর। আর একটা কথা, তুমি জাকিয়া ও মমতাজকে আপনি করে বল কেন? ওরা তোমার ছোট বোন, তুমি করে বলবে।
ফুপুর কথা শুনে শিহাবের চোখে পানি এসে গেল। সামলে নিয়ে বলল, আপনাদের ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। এতদিন আম্মা ও আতিয়ার চিন্তায় আমি ভালো করে পড়াশোনা করতে পারিনি। আপনি অনেক বড় চিন্তার হাত থেকে রক্ষা করলেন।
শাফিয়া বেগম ভাইপোর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার মা আমার শুধু ভাবি নয়, তার সঙ্গে আমার আলাদা একটা সম্পর্ক আছে। সে জন্য আমি তোমাকে নিজের ছেলেরমতো মনে করি। তুমি খুব ভালো ছাত্র। তোমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে অনেক বড় করব।
শিহাব ফুপুকে কদমবুসি করে ভিজে গলায় বলল, আপনি দো’য়া করুন, আমি যেন আপনার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারি।
শাফিয়া বেগম বললেন, নিশ্চয়ই দো’য়া করব বাবা নিশ্চয়ই দো’য়া করব। তুমি শুধু আমার মেয়ে দুটোকে নিজের বোন করে নিও। আর মমতাজের কথায় মনে কিছু নিও না। ও একটা জিদ্দি মেয়ে।
শিহাব বলল, না ফুপু, আমি কিছু মনে করব কেন? ও এখন ছোট। জ্ঞান হলে ঠিক হয়ে যাবে। আতিয়াও আমাকে কত জ্বালায়।
.
পার্কে বেড়াতে যাওয়ার পর থেকে মমতাজ শিহাবের কাছে পড়তে এলেও পড়াশোনার ব্যাপার ছাড়া অন্য কোনোরকম কথাবার্তা বলে নি।
শিহাব আসার পর থেকে মমতাজ একদিনও তাকে হাসি খুশি দেখে নি। আজ পড়তে এসে তার প্রফুল্ল মুখ দেখে বেশ অবাক হল। গতকাল হাফইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আগের তুলনায় রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। শিহাবকে সহ্য করতে না পারলেও তার পড়াবার পদ্ধতি খুব পছন্দ করে। তার জন্যেই যে এবারে ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছে তা জানে। তবু গতকাল যখন শিহাবকে রেজাল্ট দেখাল তখন মুখ গোমড়া করে ছিল। আজ শিহাবের প্রফুল্ল মুখ দেখে মমতাজের মনটাও তার প্রতি খুশি হল। বলল, শিহাব ভাই, আজ আপনাকে বেশ অন্য রকম দেখাচ্ছে।
শিহাব বলল, তাই নাকি? তা কি রকম দেখাচ্ছে?
বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে। তেমন কিছু হয়েছে নাকি?
তা বলব না; তবে এটা বলতে পারি, মানুষের মন সব সময় একরকম থাকে না। এবার আমি যদি বলি, এই কয়েকদিন তুমি মুখ গোমড়া করে পড়তে এসেছ, আজ কিন্তু বেশ হাসিখুশি।
শিহাব ভাইকে আজ তুমি করে বলতে শুনে মমতাজ আরো অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার, আজ হঠাৎ তুমি করে বলছেন যে? অথচ আগে কতবার তুমি করে বলার জন্য বলেছি।
এর কারণও বলব না। ঠিক করেছি, এবার থেকে তুমি করেই বলব।
শুনে খুশি হলাম। কারণ বলবেন না কেন?
বললাম তো বলব না; তবু জিজ্ঞেস করছ কেন?
মমতাজ রেগে উঠে গম্ভীরস্বরে বলল, সেদিন কিন্তু মা-বাবার সামনে আপনি বলেছেন, আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না।
তা বলেছি এবং কথামতো কাজও করছি
তা হলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?
এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ব্যক্তিগত ব্যাপরটা কারো কাছে প্ৰকাশ করা বা গোপন রাখার অধিকার প্রত্যেকের আছে। কাউকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে, সে যদি না বলে, তা হলে সেটাতে তার অন্যায় হয় না।
সেখানে জাকিয়াও ছিল। সে এতক্ষণ তাদের দু’জনের মুখের দিক তাকিয়ে আলাপের উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছিল। এবার মমতাজের গায়ে হাত দিয়ে ঈশারা করে বলল, তুই চুপ কর। শিহাব ভাই ঠিক কথা বলেছে।
মমতাজ তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলল, তুই কালা ও বোবা, আমাদের কথার মাঝখানে বাগড়া দিবি না। তারপর বই খাতা নিয়ে চলে গেল।
জাকিয়া শিহাবকে ঈশারা করে বলল, আপনি ওর উপরে রাগ করবেন না। ও একটু রাগি।
মৃদু হেসে শিহাবও ঈশারা করে বলল, মমতাজের উপর সে রাগ করে নি।