শিবা – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
এক
কলকাতার উত্তর শহরতলিতে বি টি রোড বা দমদম রোড বাদ দিলে আর যে কয়টি চওড়া রাস্তা আছে, যেমন বরাহনগরের গোপাল লাল ঠাকুর রোড বা কাশী দত্ত রোড, সিঁথির কালীচরণ ঘোষ রোড—এদের থেকে মাত্র কয়েক গজ সঙ্কীর্ণ এই দেবদাস পাঠক রোড বি টি রোড থেকে বেরিয়ে পুবদিকে চলে গেছে ক্রমশ সরু হতে হতে। দু—ধারে কাঁচা ড্রেন, থকথকে পাঁক। ড্রেনের উপর কাঠের খুঁটিতে ভর দিয়ে নানাবিধ দোকান। একতলা কয়েকটা বাড়ির সামনের দিকেও আছে দোকান—দর্জির, মিষ্টির, ওষুধের, স্টেশনারির, জামা—কাপড়ের। ড্রেনকে পিছনে রেখে রাস্তায় বসে কাঁচা—বাজার। সারি দিয়ে অপেক্ষা করে সাইকেল রিক্সা। কাঁচা—রাস্তাটার বেশির ভাগই গর্তে ভরা এবং খোয়া ছড়ানো। খোয়াগুলোর তিন—চতুর্থাংশ মাটির নীচে, শুধু মাথাগুলি, পথিকদের পায়ে ঠোক্কর এবং সাইকেল রিক্সায় টায়ার ফুটো করে দেবার জন্যই যেন অপেক্ষা করে থাকে। বি টি রোডের মোড় থেকে দুশ গজ পর্যন্ত দেবদাস পাঠক রোডে ভীড় থাকে রাত নটা পর্যন্ত। তারপর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিত হয়ে আসে আলো এবং কলরব।
এই রাস্তাতেই একটু ভিতর দিকে বটকেষ্টর চায়ের দোকানে কাজ করে শিবা। আর একটু এগলে রাস্তাটা যেখানে ইংরাজি ‘এস’—এর মতো এবং বছর ষাটেকের পুরনো একটি তেঁতুলগাছ অন্ধকার নিয়ে অপেক্ষমান, তাই সামনেই ভবানী স্যারের বাসাবাড়ি। এই চায়ের দোকানেই সে রাত্রে ঘুমোয় টেবল জোড়া দিয়ে। ভোরে উনুন ধরায় এবং রাত এগারোটায় দোকান বন্ধের আগে পর্যন্ত সারাদিন উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে শচীনকাকু, গ্লাসে, কাপে বা ভাঁড়ে ধূমায়মান যে তরল পদার্থটি তৈরি করে ঢেলে দেয় তা টেবিলে খদ্দেরদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তার কাজ। টোস্ট, ওমলেট, বিস্কুট এবং বিকেল থেকে আলুর দম সরবরাহও তার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। তার আর একটি কাজ, দেবদাস পাঠক রোডের দোকানে দোকানে চা দিয়ে আসা, প্রধানত গ্রেট বেঙ্গল অটো—রিপেয়ারিং গ্যারেজ এবং ভবানী স্যারের কোচিং ক্লাসে। চায়ের দোকান থেকে দুটোই প্রায় চল্লিশ গজ দূরে। কিন্তু দুদিকে।
ওর পুরো নাম শিবাজী আদিত্য। জিজ্ঞাসা করলে বলে শিবা আইচ। যতীন্দ্রকিশোর হাইস্কুলে দু—বছর আগে ক্লাস সেভেনের ‘সি’ সেকশনের খাতায় প্রথম চার মাস পর্যন্ত ওর নাম লেখা ছিল। নাম কাটা গেছে মাইনে দিতে না পারায়। শচীন ওরই পাড়ার লোক, বাবার বন্ধু ছিল। এই চায়ের দোকানের কাজটি শচীনই করিয়ে দিয়েছে। বেতন কুড়ি টাকা, অবশ্য দু—বেলা ভাত পায়। রাত্রে সে বাড়িই ফিরে যেত মা আর দাদার কাছে। মাস ছয়েক আর যাচ্ছে না। এখন সে যায় মাইনে পেলে দাদার হাতে টাকাটা দিতে। নিতু অর্থাৎ নেতাজি, তখন ওর হাতে দুটো টাকা তুলে দিয়ে শুধু বলে, ‘দরকার হলে খরচ করিস।’ ওদের বাবা ৪২—এ জেল খেটেছিলেন। ছেলেদের নামকরণ এখনো তাঁর জ্বলন্ত দেশানুরাগের সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রায় ভিখারি অবস্থায় যক্ষ্মায় মারা যান চারটি শিশুপুত্র ও বৌকে রেখে।
কাজ করার সময় শিবাকে চোখ এবং কান দুটোই সজাগ রাখতে হয়। সামনের দর্জির দোকান এবং ডাক্তারখানা থেকে প্রায়ই হাঁক আসে চায়ের বরাদ্দ নিয়ে। বুক—সমান উঁচু টেবিলে মৌরির বাটি আর একটা খাতা নিয়ে বসে থাকে বটকেষ্ট। কোথায় কটা চা যাচ্ছে দেখে আর খাতায় টোকে। চা দিয়ে আসতে দেরি হলে খদ্দেরেরও আগে বটকেষ্টই ব্যস্ত হয়ে ওঠে : ”অ শিবা আধ ঘণ্টা আগে যে দুটো চা পাঠাতে বলেছে ডাক্তারবাবু।” বটকেষ্টর আধ ঘণ্টা হল তিন মিনিট।
শিবাকে নজর রাখতে হয় ভবানী স্যারের কোচিং—এর দরজার দিকে। আধ ঘণ্টা অন্তর উনি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ডান হাতটা শুধু তুলবেন—যেভাবে আম্পায়াররা আউটের সঙ্কেত জানায়। যতক্ষণ না শিবা হাত তুলে সেই সঙ্কেত গ্রহণ করছে ততক্ষণ উনি হাত নামাবেন না। কোচিং—এর পিছনের ঘরে আছে সুপ্রভা, ওঁর স্ত্রী। মাঝে দরজা নেই। কোচিং ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের গলি দিয়ে পিছনে যেতে হয়। এই দম্পতি নিঃসন্তান। সুপ্রভা যতটা কৃপণ তার থেকেও বেশি দজ্জাল কিনা, সেটা চায়ের দোকানে নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে বিতর্কের অন্যতম বিষয়। সারাদিন স্বামীর জন্য তার বরাদ্দ তিন কাপ চা। ভবানী স্যার নীরবে স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে চলেছেন, দিনে ও রাতে বার দশেক হাত তুলে।
শান্ত নির্বিরোধী গম্ভীর মানুষ। চেহারা শীর্ণ এবং ছোটখাটো। মাথায় টাক। কাচের গ্লাসের তলার মতো পুরু চশমার লেন্সটি। চশমা ছাড়া প্রায় অন্ধ। খদ্দর ছাড়া পরেন না। যখন হাঁটেন মিলিটারির মতো থুতনি তুলে, সটান দেহে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সকাল সন্ধ্যায় সাত—আটটি ছেলে এবং একটি মেয়ে পড়তে আসে। দেয়ালে ঝোলানো একটা বোর্ড অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দেবার জন্য। তার উপর বিবেকানন্দের ছবি। ছাত্ররা বসে মেঝের শতরঞ্জে। পঁচিশ বছর তিনি যতীন্দ্রকিশোর হাইস্কুলে নাইন ও টেন—এর অঙ্কের শিক্ষক। প্রয়োজনে ভূগোল এবং ইংরাজি গ্রামার পড়ান। শিবা ওর কাছে স্কুলে কখনো পড়ে নি। উনিও জানেন না শিবা তাঁর স্কুলেরই ছাত্র ছিল।
হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা চলছে। সিট পড়েছে যতীন্দ্রকিশোরে। আজ কোনো পরীক্ষা নেই, আগামীকাল ইংরাজি। গত দিন অঙ্ক পরীক্ষায় একটা গোলমাল হয়েছে। দোকানে চা খেতে আসা দুটি ছেলের কথা শিবা ভাসা ভাসা শুনেছে—একতলায় পরীক্ষা ঘরের জানালা দিয়ে সাদা খাতা পাচার হয়ে বেরিয়ে যায়। খাতাটা উত্তরে ভরা হয়ে যখন জানালা দিয়ে ঢুকছিল তখন স্কুলেরই একজন শিক্ষক—গার্ড সেটা ধরে ফেলেন। কিছুতেই তিনি ছেলেটাকে ছাড়তে রাজি হন নি। কয়েকটি ছেলে স্কুলে ঢুকে শাসিয়েছে হেডমাস্টারকে। বোমা মেরে স্কুল বন্ধ করে দেবে আর সেই গার্ডেরও হাত ভেঙে দেবে যদি তাদের কাজে বাগড়া দেয়।
সন্ধ্যায় শিবা যথারীতি সঙ্কেত পেয়ে চা দিতে যায়। তাকে দেখেই ভবানী স্যার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললেন, ”একটু মুশকিল হয়ে গেছে শিবা।”
ধক করে ওঠে শিবার বুক। তাহলে কি ভবানী স্যারই স্কুলে গণ্ডগোল পাকিয়েছেন? সে ত দেখেছে, কত ছেলে স্যারের হাত—পা ধরেছে অঙ্কে পাশ করিয়ে দেবার জন্য। উনি আধটা নম্বর বাড়িয়েও পাশ করান নি। অসম্ভব কড়া আর অসম্ভব ধৈর্য পরিশ্রমে ছেলেদের অঙ্ক বোঝান। কোনোদিন কামাই করেন নি, এক মিনিটও দেরি করেন না ক্লাসে ঢুকতে।
”কিসের মুশকিল! হাত ভেঙে দেবে বলেছে?”
শোনা—মাত্র ভবানী স্যারের চোখ জোড়া পুরু লেন্সের ওপারে তীক্ষ্ন হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। সেকেন্ড চারেক মৃদু হেসে নিয়ে বললেন, ”নাহ ওটা কোনো ব্যাপার নয়। ভয়ের কাছে মাথা নুইয়ে হামাগুড়ি দেওয়ার কথা আমি কোনোদিনই চিন্তায় রাখি নি। আসলে ভেতর থেকে বোধ হয় কিছু একটা আঁচ পেয়েছে। কেউ বোধ হয় বলে দিয়েছে।”
‘কিন্তু আমি ত, স্যার সাবধানেই দি।’
‘না না, তোমায় আমি কিছু বলছি না। তবে পারিবারিক সম্প্রীতিটা ত বজায় রাখা উচিত, সর্বাগ্রে উচিত। আমার মনে হয় এই নিয়ে হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, তখন কি বলব বল ত?’
শিবা এ রকম সমস্যার সামনে কখনো পড়ে নি। পারিবারিক সম্প্রীতি ব্যাপারটা যে কি, তাও জানে না। ইতস্তত করে বলল, ‘শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল তাই দু—চার কাপ খেয়েছি, এই রকম একটা কিছু—।’
‘না না, শরীর খারাপের অজুহাত একদম নয়। শরীর খারাপ হওয়াটাই লজ্জার ব্যাপার। শিক্ষিত মানুষের শরীর কেন খারাপ হবে, অ্যাঁ? যারা লেখাপড়া শিখেছে, তাদের অবশ্যই জানা উচিত শরীর কিভাবে ফাংশন করে। শরীরই ত মানুষের একমাত্র নিজস্ব, সব থেকে দুর্লভ সম্পদ, তাই না? শরীরকে ভাল করে জানলে সেটা খারাপ হবে কেন? তোমার যে এত ভাল স্বাস্থ্য, তুমি যত্ন নাও বলেই ত?’
শিবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিল। শেষ কথাটিতে হেসে ফেলল।
‘আমি আর কি যত্ন করব। দিনে একবেলা ভাত—ডাল, আর রাতে রুটি—ঘ্যাঁট। তাও পেটভরে পাই না।’
‘ওহ, তাই বুঝি।’ অপ্রতিভ হয়ে ভবানী স্যার পিছন ফিরে ঘরের দিকে তাকালেন। ছাত্ররা মাথা নিচু করে অঙ্ক কষে যাচ্ছে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তাহলে কি বলা যায়?’
‘বলুন বাজিতে জিতেছি তাই বটকেষ্ট চা খাওয়াল।’
‘বটকেষ্ট কি সেরকম লোক?’
‘না হলেই—বা। দোকানে খদ্দেররা কতরকম ব্যাপারেই ত বাজি ধরে। এক ঘণ্টার মধ্যে কোনো রিক্সার টায়ার পাংচার হবে কি হবে না—দু—কাপ চা তাই নিয়ে বাজি ধরা হয়ে গেল কালকেই ত?’
‘আমি কি নিয়ে বাজি ধরব?’
শিবা বিন্দুমাত্র ভাবল না। বলল, ‘কদিন আগেই দশ কাপ বাজি ধরা হয়েছিল—কত রাউন্ডে ক্লে নক আউট করবে লিস্টনকে। কেউ বলল চার, কেউ সাত, কেউ বলল তেরো। সবাইকে বোকা বানিয়ে প্রথম রাউন্ডেই করল নক আউট। আপনি বলেছিলেন, প্রথম রাউন্ড, তাই বাজি জিতেছেন।’
‘ক্লে! সে আবার কে?’
‘ওয়ার্লডের চ্যাম্পিয়ন।’
‘কিসের?’
‘বক্সিং—এ।’
‘নক আউট কি জিনিস?’
‘ঘুসি মেরে শুইয়ে দেওয়া।’
‘বিশ্রী ব্যাপার। ঘুসোঘুসি আমি একদমই পছন্দ করি না। এর উপর বাজি ধরা কি উচিত?’
ভবানী স্যার পিছন ফিরে তাকালেন, কয়েকজন ছাত্র দরজার দিকে তাকিয়ে এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে শিবার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পরে এই নিয়ে কথা হবে।’
‘স্যার একটা কথা বলব?’ অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই শিবা বলল, ‘যদি আপনি হাত ভেঙে দেবার কথা শুনে ভয় না পান, তাহলে এটাতেই বা পাচ্ছেন কেন?’
ভবানী স্যার হেসে ফেললেন।
‘ওটাকে আমি ন্যায়ের পক্ষে তাই, আর এটাতে আমি কারচুপি করছি, মিথ্যার পথ নিয়েছি—তাই। ন্যায়—অন্যায় মানুষমাত্রেই করে, না হলে ত দেবতা হয়ে যেত। তবে দুটোর মধ্যে ডিগ্রির তফাত রাখতে হয়। আমি চাই ন্যায়ের ডিগ্রি মানে মাত্রাটা বেশি রাখতে, এই আর কি।’
গ্লাসটা নিয়ে দোকানে আসতেই খিঁচিয়ে উঠল বটকেষ্ট।
‘অ্যাতক্ষণ কি তুইও মাস্টারের কাছে অঙ্ক পড়ছিলি নাকি। খদ্দের এসে কি বসে থাকবে তোর জন্য? তিন কাপ চেয়ে গেছে গ্যারেজে। বাইরে গেলে আর ফেরার নাম করে না। নিজে হাতে চা দেব বলে কি লোক রেখেছি?’
বটকেষ্ট গজগজ করে যাচ্ছে। শিবার চোখ তখন টেবিলে বসা দুটি লোকের দিকে। বি টি রোডের ওপারে দুই বাস স্টপ দূরে মিলনপল্লীতে থাকে ওরা। শিবা ওদের একজনকে শুধু জানে, সাধন। সবাই ডাকে সাধু। দলবল নিয়ে ছিনতাই ওর পেশা। বোমা, ছোরা, পাইপগান, জামা—প্যান্ট খোলা ও পরার মতো স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে। কন্ট্রাক্ট নিয়ে দাঙ্গা বাধায়, ভাড়াটে তোলে, পরীক্ষায় টোকার ব্যবস্থা করে দেয়।
নির্মম নিষ্ঠুর ওর আচরণ। ওকে দেখলেই গৃহস্থরা সিঁটিয়ে তফাতে সরে যায়। সাধু রেস্তোরাঁয় খাবে, লন্ড্রিতে কাপড় কাচাবে, রিক্সায় চড়বে, দোকান থেকে সিগারেট নেবে বিনা পয়সায়। একবার প্রতিবাদ করেছিল রিক্সাওয়ালা রাধেশ্যাম। রাস্তার উপরই বহুলোকের সামনে সাধুর দলের ছেলেরা রিক্সার একটি চাকা খুলে নিয়ে যায়। বাধা দিতে কেউই এগিয়ে আসে নি। না দেখার ভান করে তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে অনাবশ্যক কাজে। কেউ কেউ রাধেশ্যামের বোকামির জন্য ক্ষুব্ধও হয়। পনেরো টাকা জরিমানা দিয়ে রাধেশ্যাম চাকাটি ফেরত পায়। সেজন্য সাতদিন সে পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করেছে, আর সেই কটা দিন তার আধপেটার সংসারটিকে সিকিপেটা থাকতে হয়েছে।
সাধুর কালীপুজোয় প্রত্যেক গৃহস্থ, দোকানি, ফেরিওয়ালা, ব্যবসায়ীর জন্য চাঁদা ধরা আছে। বিনা প্রতিবাদে তারা চাঁদা দিয়ে দেয়। একশ টাকা লিখে বিলটা ওরা সামনে ছুঁড়ে দিতেই মিষ্টির দোকানের তারাদাস বিনীত আপত্তি করেছিল। তাকে দেড়শ টাকা খরচ করে ভাঙা শো—কেসের কাচ বদলাতে হয়। রাস্তার বাজারে ডিম নিয়ে বসে বৃদ্ধ গায়েবুল্লা। তার বরাদ্দ দু—টাকা চাঁদা সে দিতে পারে নি। সাধুর ছেলেরা গুটি দশেক ডিম ঝুড়ি থেকে তুলে নেয়। হাত জোড় করে গায়েবুল্লা উঠে দাঁড়াতেই সাধুর হাতের মোটা বেতের ব্যাটনটি খট করে বৃদ্ধের মুখের ওপর পড়ে। মুখ চেপে গায়েবুল্লা যখন বসে পড়ছে, সাধু ধীরকণ্ঠে তার ছেলেদের একজনকে নির্দেশ দেয়, ‘রোজ দুটো ডিম এর কাছ থেকে নিবি, একবছর।’ গায়েবুল্লা সেদিনের পর থেকেই ডান চোখে ঝাপসা দেখছে। সম্ভবত কানা হয়ে যাবে।
শুধু শিবা কেন, এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই এইসব কাহিনী শুনেছে। দিনে দিনে সেগুলি ভয়ের দ্বারা রঞ্জিত হয়ে অতিকায় বীভৎস রূপ নিলেও ঘটনাগুলি অনেকটাই সত্য। সেই ভয়ঙ্কর সাধু এখন দোকানে বসে চা খাচ্ছে। টেবলের উপর তার নিত্য সাথী ব্যাটনটি। সাধু রীতিমতো বেঁটে, সাড়ে পাঁচ ফুটেরও নীচে। কলেজে পড়েছে। ছাত্রনেতা হয়েছিল। একসময় ও বডিবিল্ডার হবার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করে তাল তাল পেশী সংগ্রহ করেছিল। অজগরের মতো পেশীগুলো ওর সারা দেহকে জড়িয়ে সব সময়ই যেন ফুঁসছে। ওর প্রতিটি গতিবিধির সঙ্গে সেগুলো নাড়াচাড়া করে। তাকিয়ে মুগ্ধ হতে হবেই। সাধুর গায়ের রং বাদামি, মাথার চুল ঝাঁকড়া সেকেলে ডাকাতদের মতো বাবরি করা। সব থেকে বেমানান ওর মুখটি। গ্রীক দেবতার মতো মুখের ছাঁচ। নিষ্পাপ শিশুর মতো সরল শান্ত, চাহনি। সাধু কখনো হাসে না এবং ওর ডান পা জন্ম থেকেই একটু ছোট। দোকানে যে কজন খদ্দের এই সময় নিয়মিত আড্ডা দেয়, তারা নিঃসাড়ে উঠে গেছে। বটকেষ্ট অত্যধিক ভয় পাওয়ার জন্যই বোধ হয় অত্যধিক স্বাভাবিক হবার চেষ্টায়, অর্থাৎ খাতা খুলে ঘাড় নিচু করে যোগ—বিয়োগে ব্যস্ত। সামনের দোকানগুলো থেকে জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে রয়েছে। সাধু এই পাড়ায় আগে কখনো আসে নি। তাই আতঙ্কে ছমছম করছে দেবদাস পাঠক রোড। শিবার বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠল ড্রাম পেটানোর মতো শব্দ।
বটকেষ্ট যখন খিঁচিয়ে বলে, ‘মাস্টারের কাছে পড়ছিলি নাকি?’ তখন ঘাড় ফিরিয়ে শিবার দিকে তাকায়। শিবা চোখ সরিয়ে শচীনের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘গ্যারেজের চা দাও।’
সাধু আঙুল নেড়ে তাকে ডাকল, ‘অ্যাই শুনে যা।’
শিবা ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু।
‘শুনতে পাস নি নাকি?’ কোমরে চওড়া বেল্ট, লম্বা, শীর্ণকায় সাধুর সঙ্গীটি বিরক্ত হয়ে বলে। শিবা তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে।
‘মাস্টারটা কোথায় থাকে রে।’
খাতা থেকে মুখ তুলে বটকেষ্টই জবাব দিল, ‘এই ত একটুখানি গিয়ে ডাইনে তেঁতুল গাছ, লালবাড়ি। রাস্তার ওপরেই ঘর। দেখলেই বুঝতে পারবেন।’
‘এখন ঘরে কে আছে?’
শিবাকে জিজ্ঞাসা করেছে। কিন্তু সে জবাব দেবার আগেই বটকেষ্ট আবার বলল, ‘কেউ না, কেউ না। শুধু কতকগুলো ছাত্র—ছাত্রী ছাড়া কেউ না। ওরে শিবা গ্যারেজে অনেকক্ষণ আগে চা চেয়ে গেছে।’
তিনটে গ্লাসকে চারটে আঙুলের ডগা দিয়ে ধরে শিবা বেরিয়ে গেল। গ্রেট বেঙ্গল অটো—রিপেয়ারিং গ্যারেজের মেকানিক শ্রীকান্ত দাস ব্যাটারির খোলের উপর বসে একটা মোটরের পিছনের চাকায় ব্রেক শু্য লাগানোর তদারক করছে। গ্যারেজ মালিক দুর্লভ চক্রবর্তী আর একজন নীল গেঞ্জিপরা মাঝারি আকৃতির কুচকুচে কালো ছিপছিপে মাঝবয়সী লোক তার পাশে দাঁড়িয়ে। দড়িতে ঝোলানো একশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে, চাকার পাশে। নিশ্চয়ই জরুরি কাজ নয়ত গ্যারেজ সন্ধ্যার পর খোলা থাকে না। দুর্লভ একটি গ্লাস তার পাশের লোকটিকে দেবার জন্য শিবাকে ইশারা করল। শ্রীকান্ত গ্লাস হাতে নিয়েই বিরক্ত স্বরে বলল, ‘অ্যাতক্ষণ পরে ঠান্ডা চা। যা গরম করে নিয়ায়।’
যে লোকটি ব্রেক শু্য নিয়ে ব্যস্ত, সেও বলল, ‘আমারটাও নিয়ে যা।’
শিবা গ্লাস দুটি নিয়ে দোকানে ফিরে এসে দেখল সাধু এবং তার সঙ্গীটি নেই। কি যেন তার মনে হল, ভবানী স্যারের কোচিং—এর দিকে তাকিয়ে রাস্তায় বা দরজার সামনে কাউকে সে দেখতে পেল না। তাহলে ওরা গেল কোথায়? কোচিং—এর ভিতর ঢুকেছে। কিন্তু শচীন বা বটকেষ্টর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করতে ভরসা পেল না।
চা আবার গরম করে গ্যারেজে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় শিবার মনে হল কোচিংটা একবার ঘুরে দেখে আসা যাক।
দরজার পাশে ঘরটার দক্ষিণে পাকা নর্দমার ধারে জানালাটায় শিবা এসে দাঁড়াল। জানালার একটা পাল্লা এমনভাবে ভেজানো যে এখান থেকে ঘরের একটা কোণ শুধু দেখা যায়। সেটা খুলে দিতে তার সাহস হল না। সে দেখতে পেল পাঁচজন ছাত্র দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের শরীর কাঠের মতো নিস্পন্দ। কেউ নড়ছে না, শুধু সামনে তাকিয়ে। চোখের পাতা নড়ছে না। ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটিও। পেন্সিল দাঁতে কামড়াচ্ছে, মুখের চামড়ার নীচে রক্ত নেই, শরীরটা থর থর করছে।
ভয় ভয় ভয়। প্রত্যেকের চোখের মধ্যে যেন একটা করে জুজু ঢুকে রয়েছে। শিবা ওদের কারুরই নাম জানে না। এই মুহূর্তে তার মনে হল, সে শ্মশানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘরের আর এক কোণে, জানালার পাশেই সে একটি কণ্ঠস্বর শুনল, ধীর মৃদু স্বরের।
‘যদি হাতটা ভেঙে দি।’
শান্ত, স্বাভাবিক, উচ্চচারণ একটু টেনে টেনে। শিবার মনে হল সাধুর গলা।
‘কি, কথা নেই কেন মুখে? হাতটা যদি মুচড়ে ভেঙে দি তাহলে অঙ্ক কষাবেন কি করে?’
‘বাঁ হাত দিয়ে।’
‘ওরে বাপ্পস! দেবু শুনলি?’
বাঁ হাতটাও তাহলে ভেঙে দাও, গুরু।’
‘ভাঙাভাঙির দরকার হবে না। শুনুন পরীক্ষার কটা দিন আপনি স্কুলে যাবেন না। চুপটি করে এই ঘরে যত খুশি অঙ্ক কষান, কিন্তু স্কুলে যাবেন না।’
‘তার মানে অন্যায়ের কাছে আমাকে মাথা নোয়াতে হবে, অধর্ম আমাকে মেনে নিতে হবে?’
ভবানী স্যারের গলা, গম্ভীর অনুত্তেজিত, অদ্ভুত রকমের কঠিন। শিবার হাত—পা শক্ত হয়ে উঠল উত্তেজনায়। পাঁচটি ছেলে আর একটি মেয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে।
‘অত শত জানি না। মোট কথা যা বললুম তাই করবেন। বাড়ির বাইরে যাবেন না। পরীক্ষা হয়ে গেলে চুটিয়ে তখন মাস্টারি করবেন। কাল আপনি তিনটে ছেলের ক্ষতি করতে গেছলেন, অবশ্য ম্যানেজ করে নিয়েছি।’
‘আমি সত্যিই দুঃখিত যে ওদের ক্ষতি করতে পারি নি। একটা কথা শুনে রাখ, হাতই ভাঙো আর পা—ই ভাঙো, অন্যায়ের প্রশ্রয় আমি দেব না। আমার হাতের থেকেও বড় ব্যাপার এই ছেলেদের চরিত্র, তাদের ভবিষ্যৎ। সেটা আমাকে বাঁচাতেই হবে। এভাবে পরীক্ষায় পাশ করেও, জীবনের পরীক্ষায় ত এরা বরাবরই ফেল করবে। ঘুণ ধরে ঝাঁঝরা হওয়া মানুষ, কি পরিবারের কি সমাজের কোনো দায়িত্বই নিতে পারবে না, ভেঙে পড়বেই।’
‘এসব আদর্শ—ফাদর্শর কথা থাক। পাস করলে চাকরি জুটবে, পরিবারকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচাতে পারবে। এটাই সব থেকে জরুরি।’
‘না না পারবে না। মানুষ শুধু খাওয়া—পরাতেই বাঁচে না। তার আত্মা আছে।’
‘গুরু, কথাবার্তা একটু কি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘থাম। আমাকে আত্মা দেখাচ্ছে। আমারও ত তাহলে আত্মা আছে, কী জবাব দিন?’
সাধু বুকে হাত দিয়ে এক পা পিছিয়ে দাঁড়াতেই শিবা ওকে দেখতে পেল। সাধুর সুন্দর মুখের পেশিগুলো কোঁকড়ানো, চোখ দুটো জ্বলজ্বলে, দেহটা ঈষৎ ঝোঁকানো। বাঁ হাতের ব্যাটনটা দিয়ে সে সামনে কাউকে খোঁচা মারল।
‘আমারও তাহলে আত্মা আছে। আমি বলছি আছে। এই ছেলেগুলোরও আছে। দেখবেন?’
সাধু তালুর উলটো পিঠ দিয়ে হঠাৎ একটি ছাত্রের গালে চড় মারল। ছেলেটি ‘আঃ’ শব্দ করেই গাল চেপে ধরে ফ্যালফ্যালিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে একটা আঘাত পাবে। হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে খোলা দরজা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে গেল। সাধু হাসতে শুরু করল।
‘ওর আত্মা বলল, পালাও। তাই পালিয়ে গেল।’
সাধু আর একটি ছেলের সামনে দাঁড়াল। ডান হাতটা ধীরে ধীরে তুলতে শুরু করতেই, দু—হাতে মুখ ঢেকে ছেলেটি ফুঁপিয়ে উঠল।
‘এর আত্মা বলছে কাঁদো।’
সাধু ফিরে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণের দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘এই হচ্ছে আত্মা। শরীরের জন্যই আত্মা। এই এলাকার সব আত্মা সুখের জন্য, সুবিধার জন্য আমাকে তোয়াজ করে, ভয় পায়, পায়ে এসে পড়ে।’ তারপর দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে চারটি ছেলে ও মেয়েটিকে মৃদুস্বরে বলল, ‘বাড়ি যাও।’
মেঝে থেকে বই—খাতা তুলে নিয়ে ওরা কাঠের পুতুলের মতই, ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেই হন হন করে এগিয়ে গেল বি টি রোডের দিকে। ওদের মধ্যে মেয়েটিই একবার থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকিয়েছিল মাত্র।
সাধু পা পা এগিয়ে গেল ঘরের কোণের দিকে। সারা মুখ হাসিতে ভরা। হাসলে ওকে দেবতার মতো দেখায়।
‘আমার আত্মা বলছে রোজগার করে বাঁচতে হবে, আপনার আত্মা বলছে হাত দুটো আস্ত রাখতে হবে। দুটোই সম্ভব। ঠিক কিনা?’
চায়ের দোকান থেকে বটকেষ্টর চীৎকার শিবা শুনতে পাচ্ছে। তার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু এখানে ঘরের মধ্যে যে অসম্ভব একটা ব্যাপার ঘটে চলেছে, সেটা ফেলে যাওয়ার সাধ্যিও তার নেই। বটকেষ্ট চীৎকার করতে থাকুক। জানালার কিনারে চোখ রেখে শিবা ঘরের অপর কোণটি দেখার চেষ্টা করল।
ছোটখাটো রোগা ভবানী স্যার ডান হাতটা বাড়িয়ে, মুখে পাতলা হাসি। পুরু লেন্সটায় ইলেকট্রিক আলো, বরফ কুচির উপর সূর্যরশ্মির মতো ঝকঝক করছে।
‘হাত আমার দরকার নেই, এটা তুমি নিতে পার কিন্তু স্কুলে আমি যাবই।’
‘যাবেনই।’
‘হ্যাঁ।’
কোনো দ্বিধা নেই একফোঁটা শব্দটিতে। স্বচ্ছ স্বাভাবিক অনুত্তেজিত। বাড়ানো হাতটা আর একটু তুলে বিবেকানন্দর ছবিটার দিকে নিবদ্ধ করলেন।
‘ওই মানুষটি একটা কথা বলেছেন।’
সাধু চোখ তুলল ছবির দিকে।
‘বলেছেন, সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’
হাতটা নামিয়ে ভবানী স্যার হাসলেন।
‘পরীক্ষার কটা দিন আমি স্কুলে যাব। অন্যায় হচ্ছে দেখলে বাধা দেব।’
সাধু এক পা এগিয়ে ভবানী স্যারের ডান হাতটা মুঠোয় ধরল। শিবা দেখল, সাধুর হাতটার যাবতীয় পেশী দপ করে লাফিয়েই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। স্যারের মুখের হাসিটা ক্রমশ মিলিয়ে যন্ত্রণার কুঞ্চন একবার ফুটে উঠেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। সাধু স্থির দৃষ্টিতে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে, শরীরের সব রক্ত মুখে জমা হয়ে টকটকে দেখাচ্ছে। কপালে বিন্দু—বিন্দু ঘাম। চোয়াল এবং সারা বাহুর পেশীগুলো কঠিন থেকে আরো কঠিন হয়ে উঠছে।
ভবানী স্যারের মাথাটি এবার ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকে পড়ছে। ঠোঁট দুটি ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। শরীরটা থরথর কাঁপতে কাঁপতে কুঁজো হয়ে গেল।
‘আহ, আহ…..আমি নুইব না, নুইব না। ওহ…ওঃ।’
এরপর শিবা নিজেও জানে না কখন সে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাধু দ্রুত মুখটা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। তখনো মুঠোর মধ্যে ভবানী স্যারের কব্জিটা ধরা।
‘ছেড়ে দাও স্যারকে।’
‘তুই কে রে?’
শিবার ঘাড়ের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে! একটা বাঘ যেন তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরটা চাটছে। আর ক্রমশ সে নিজেই বাঘ হয়ে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে গরগর করছে খ্যাপানো রাগ। দমকে দমকে সেই রাগটা তাকে ফুলিয়ে, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দিল। দ্রুত এগিয়ে সে সাধুর ঘাড়টা পাঁচ আঙুলে চেপে ধরেই টান দিয়ে ঘুরিয়ে দিল। সাধু কোনোক্রমে টাল সামলাল। ওর সঙ্গী দেবুর হাতে ততক্ষণে একটা ছোরা ঝলসে উঠেছে। বাঁ হাত দিয়ে ডান কব্জিটা ধরে স্যার উবু বসে পড়ছেন।
ছোরা ধরা হাতটা সাপের ফণার মতো দোলাতে দোলাতে দেবু এক—পা দু—পা এগল। শিবা একদৃষ্টে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। এক—পা দু—পা পিছিয়ে গিয়ে শিবা দেয়ালে বাধা পেল। আর তার পিছু হটার উপায় নেই। ডাইনে দেওয়াল। বাঁয়ে খোলা দরজা। ছুটে পালানো যায়। পালাবে? তার মাথার মধ্যে শুধু একটা কথাই ঝিমঝিম করে বাজছে—’বাঁচতে হবে, বাঁচতে হবে।’ এবং হঠাৎ ওর মনে হল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে বাঁচা যাবে না, কিছু একটা করতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মন থেকে একটা সংকেত বিদ্যুৎগতিতে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ‘বাঁচব, বাঁচব, বাঁচতে হবেই।’
এইবার সে পরিষ্কার দেখতে পেল ছোরাটা তার তলপেট লক্ষ্য করে আসছে। ছ—ইঞ্চি একটা শীতল ইস্পাতের ফলা এগিয়ে আসছে, আসছে, আসছে—এক সেকেন্ডও নয়, সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় নিল এক গজ বাতাস কেটে ছোরাটা এগিয়ে আসতে। শিবা এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় নিল না ছোরাটার পথ থেকে একবিঘৎ সরে যেতে।
ঝোঁক সামলাতে না পেরে বেটাল দেবুর মুখটা শিবার কাঁধের কাছে এগিয়ে এল। তখুনি শিবার স্নায়ুকেন্দ্র থেকে একটা খবর ওর বাঁ হাতে পৌঁছে গেল—মারো। দেবুর বুক আর পেট ওর বাঁ হাতের সব থেকে কাছের বস্তু, মাত্র এক ফুট দূরে। কনুইটা সামান্য পিছনে টেনে প্রায় এক হাত দূরত্ব তৈরি করে নিয়ে পলকে সে দেবুর পেট লক্ষ্য করে বাঁ হাতের মুঠোটাকে স্প্রিং—এর মতো ছেড়ে দিল।
‘ঢপ’। একটা শব্দ। প্রায় একই সময়ে শিবার ডান হাতের মুঠো নীচে থেকে উপরে উঠল দেবুর থুতনি লক্ষ্য করে।
মেঝে থেকে আধ হাত শূন্যে উঠে দেবু দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়ল। তারপর দেয়ালে পিঠ লাগানো অবস্থায় খালি বস্তার মতো ঝরে পড়ল মেঝেয়। ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে।
অবাক হয়ে সাধু এতক্ষণ দেখছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাণ্ডটা ঘটেছে। এইবার সে দু—হাত ছড়িয়ে একটা খ্যাপা গোরিলার মতো এগিয়ে গেল শিবার দিকে। এক—পা পিছিয়ে গিয়ে সরে যাবার জন্য শিবা জলপোকার মতো নড়াচড়া করল ডাইনে—বাঁয়ে। ঘরে আর জায়গা নেই। সাধুর হাত দুটো থামের মতো উঁচু হয়ে সজোরে নেমে এল শিবার দুই কাঁধের দিকে। সে বিদ্যুৎগতিতে হাঁটু ভেঙে শরীরটা নিচু করে ধাক্কাটা কমিয়ে নিল এবং একই ঝোঁকে পাশে সরে গেল। তার বাঁ কাঁধটা এড়াতে পারে নি সাধুর ডান হাতের হাতুড়ি। অসাড় হয়ে আসছে। সাধু আবার জোড়া হাত তুলেছে।
‘মারো’। —নিমেষে সঙ্কেতটা ওর ডান হাতে পৌঁছানো মাত্র ঘুসিটা বেরিয়ে এসে সাধুর বাঁ কানের নীচে চোয়ালে আঘাত করল। পাটকাঠি ভাঙার মতো মড়াৎ একটা শব্দ হল। সাধুর চোখ দুটো কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে হয়তো বিস্ময়ে কিংবা আঘাতের ধাক্কায়। তার উত্তোলিত হাতদুটো আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল। পাঁজরের দু—ধারে দু—হাতে পরপর দুটো ঘুসি শিবা বসিয়ে দিয়েছে। ‘ঢপ….ঢপ’ দুটো শব্দ হল। সাধু দু—হাতে বুকের দু—পাশ চেপে ধরল। হাঁটু দুটো থরথর কাঁপছে। ধীরে ধীরে হাঁটু দুমড়ে সে বসে পড়ল।
শিবার মাথার মধ্যে এখন কিছু নেই। একদম খালি। বাতাস ছাড়া ভারী আর কোনো জিনিস নেই। ঘরের মেঝেয় তিনটি দেহ। ভবানী স্যার কুঁজো হয়ে বসে, দেবু দেয়ালে ঠেস দিয়ে নেতিয়ে আছে ; সাধু মেঝেয় দু—হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ঘরের এক কোণে ছোরা, অন্য দিকে ব্যাটনটা পড়ে। শিবা বুঝতেই পারছে না গত দু—মিনিটের মধ্যে প্রায় নিঃশব্দে এখানে কি ঘটে গেল! কি ভাবে ঘটল, কে ঘটাল, কেন ঘটাল? তার শূন্য মাথার মধ্যে এখন শুধু সোঁ সোঁ বাতাসের শব্দ।
‘হারামজাদা, কখন থেকে ডেকে ডেকে মরছি আর তুই—।’
চেঁচাতে চেঁচাতে বটকেষ্ট রাস্তা থেকে এগিয়ে আসছিল। ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে চোখ পড়তেই চমকে তার জিভটা অবশ হয়ে গেল। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে অবশেষে শিবার ভয়ঙ্কর মুখ ও ভঙ্গিটা অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বটকেষ্ট এক—পা এক—পা করে পিছিয়ে গিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘এসব কি! য়্যাঁ, এমন কাণ্ড হল কি করে….য়্যাঁ কে করল রে শিবা, তুই?’
শিবা কথা না বলে দুটো হাত মুঠো করে চোখ ঢাকল শুধু। বটকেষ্টর চোয়াল তার ফলে বিস্ময়ে দু—ইঞ্চি ঝুলে পড়ল এবং দেবদাস পাঠক রোডকে সন্ত্রস্ত করে তারপর চীৎকার করল—’সব্বোনাশ হয়েছে গো। এবার আমরা মারা পড়ব, আর আমাদের রক্ষে নেই। শিবাটা সব্বোনাশ করেছে।’
এতক্ষণ যে চাপা কৌতূহল আর উত্তেজনাটা আশপাশের দোকানে, রাস্তায় বসা ফিরিওয়ালা, রিক্সাওয়ালাদের মধ্যে থম থম করছিল, নিমেষে তা খান খান হয়ে গেল। ছুটতে ছুটতে ওরা এল ভবানী স্যারের কোচিং—এর দরজায়। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন সুপ্রভা—স্যারের স্ত্রী। রান্না করতে করতে তিনি কয়েক মিনিটের ব্যাপারটার কিছুই টের পান নি।
‘কি হল বটকেষ্ট, চেঁচাচ্চেচা কেন গো?’
‘বটদা কিসের, সব্বোনাশ?’
‘বটুবাবু কে মারা গেল?’
‘ওগো আমি কোথায় যাব গো।’
সব শেষে হাউ হাউ করে উঠলেন সুপ্রভা। জোড়া জোড়া চোখ ঘরের মধ্যে অবিশ্বাস্য দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে। সাধু উঠে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত বাঁ কানের নীচে চোয়ালের উপর বুলিয়ে সে কাতরে উঠল। বিড়বিড় করে গালাগাল দিয়ে এগিয়ে এসে পা দিয়ে দেবুর মাথায় ঠোক্কর দিল। মাথাটা নড় নড় করল কাঁদিতে ঝোলা ডাবের মতো।
কে একজন ফিসফিস করল, ‘দুটোকে দেখছি মেরে পাট করে দিয়েছে।’
‘শিবা!’
‘শিবা করেছে?’
‘আমাদের শিবা?’
‘হ্যাঁ গো চায়ের দোকানের শিবা।’
সব চোখ শিবার উপর এসে পড়ল। এখনো একটু কুঁজো ওর কাঁধ দুটো। হাত দুটো মুঠো করা। ওৎ পাতা বাঘের মতো শিবা লক্ষ্য করে যাচ্ছে সাধুকে।
দু—হাতে দেবুকে বসিয়ে সাধু কথা বলতে গিয়ে ”উঃ” বলে গাল চেপে ধরল। তারপর ইশারায় জানাল, সাইকেল রিক্সা চাই।
ভিড়ের মধ্য দিয়ে রাধেশ্যাম এগিয়ে এল। বোতাম ছেঁড়া শার্টের ফাঁকে জিরজিরে বুকটা চিতিয়ে তুলে ধরে দুটো হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চীৎকার করল, ‘ভগমান আছে অহনো, ভগমান আছে অহনো, দীন—দুঃখীর ডাকে অহনো সাড়া দেন। আমার পোলাপানগুলার সেই শুকনো মুখে, অহন আমি হাসি দেইখত্যাছি। শিবা রে, ভগমান তোর রূপ লইয়্যা দেখা দিছে রে।’
বলতে বলতে রাধেশ্যামের গালের কুঞ্চিত শুকনো চামড়ার উপর দিয়ে জল ঝরতে শুরু করল। ঢ্যাঙা, লিকলিকে, বছর ষোল বয়সী ননী রাধেশ্যামের হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল, ‘বাবা তুমি যাও। রিক্সায় আমি এই দুটারে পৌঁছায়ে দেব।’ তারপর সে আরও ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘দুটারে রিক্সায় বসায়ে সোজা রিক্সাটারে বনোয়ারির গর্তের মধ্যে নিয়ে ফ্যালাবো।’ বনোয়ারি সাউয়ের তেরটি গরু—মোষের খাটালের গায়ে চার হাত গভীর ডোবার মতো একটি গর্ত আছে। সেখানে গোবর জমানো হয় মাসে একদিন বিক্রির জন্য।
ইতিমধ্যে ভবানী স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। সুপ্রভা তার দুটো কাঁধ ধরে বারবার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে চলেছেন—’হয়েছে কি, বল না? ঘরে এসব কি কাণ্ড? কি হয়েছে?’
ভবানী স্যার ডানহাতটা তুলতে গিয়েও পারলেন না। তারপর মৃদু হেসে সাধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বোধ হয় ভেঙেছে। কিন্তু একটা জিনিস তুমি বোধ হয় স্বীকার করবে, আমার আত্মা মোটেই বলে নি হাতটাকে আস্ত রাখার জন্য তোমার কাছে নত হতে। সে বলেছিল যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠতে। আমি তা পেরেছি।’ বলতে বলতে ওর সারা মুখ হাসিতে ভরে গেল।
সাধু কিছুক্ষণ স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগতেই চার পাঁচজন দরজা জুড়ে দাঁড়াল।
‘আজ তোমার গুণ্ডামি চিরকালের মতো ঘোচাব’, একজন বলল মেঝে থেকে ব্যাটনটা তুলে নিয়ে।
‘অনেক উৎপাত সহ্য করেছে এলাকার মানুষ। এবার পিটিয়ে লাস করব।’
কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসেছে দেবু। সাধু ওর দিকে একবার তাকিয়ে, হাতজোড় করে কি বলতে গিয়ে চোয়ালে হাত দিয়ে কাতরে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে ঠোঁটজোড়া অল্প ফাঁক করে, চোয়াল যতটা সম্ভব কম নাড়িয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘এ পাড়ায় আর কখনো আসব না। এ পাড়ার লোকের সঙ্গে কোনোদিন আর হুজ্জত হবে না।’
তখনো কেউ বুঝতে পারে নি সাধুর চোয়াল ভেঙে গেছে।
ভীড় ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল শিবা। কোনো নিরালা জায়গায় গিয়ে সে এখন চুপ করে বসে থাকতে চায়। কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না, দুটো ভয়ঙ্কর লোককে সে মাত্র কয়েকটা ঘুসিতেই ধ্বংস করে ফেলল কিভাবে! কি করে সে ঘুসিগুলো চালাল! কোনোদিন ত ঘুসি মারতে শেখে নি। কোনোদিন সে মারপিট করে নি। সাধুর কথাবার্তা, স্যারের হাত মুচড়ে ধরা, এসব হয়তো তাকে উত্তেজিত করেছিল। তার থেকেও বেশি, স্যারের অবিচল ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আর ‘নুইব না…নুইব না’ শব্দগুলো তাকে যেন অন্য এক জগতের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে নিয়ে গেছল। সেখানে গিয়ে সে জানতে পারে তার মধ্যে সাহস আছে, তার দেহে শক্তি আছে। কাউকে সে ভয় পায় না, কেননা হারাবার মতো তার কিছুই নেই, একমাত্র নিজের প্রাণটা ছাড়া।
শিবার পিঠে কে টোকা দিল। সে চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল গ্যারেজে দুর্লভ চক্রবর্তীর পাশে নীল গেঞ্জি—পরা যার হাতে চায়ের গ্লাস তুলে দিয়েছিল, সেই লোকটি। ‘ইউ হ্যাভ এ বিউটিফুল লেফট হুক। কোন ক্লাবের ছেলে আছ? কে তোমার ট্রেনার?’
শিবা তেঁতুল গাছের নীচে দেবদাস পাঠক রোডের টিমটিমে ইলেকট্রিক বাতির আলোয় অবাক হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কথার টান অবাঙালির মতো, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে ওর কথাগুলোর কোনো মাথামুণ্ডুও সে বুঝতে পারছে না। ইংরেজিতে কি বলল? বিউটিফুল লেফট হুক কি জিনিস?
শিবা মাথা নাড়াল।
‘কখনো রিং—এ নামো নি?’
অসহায়ের মতো শিবা এধার—ওধার তাকাল। রিং কি জিনিস?
‘যখন লেফট হুকটা মারলে আমি এখান দিয়ে তখন যাচ্ছিলাম। টেরিবল। এ ডেডলি জেম অফ এ পাঞ্চ। কতদিন ট্রেনিং করছ?’
ট্রেনিং! এটা অবশ্য শিবার শোনা কথা। পাড়ায় যারা ফুটবল খেলে তাদের মুখে এই শব্দটা অনেকবার শুনেছে।
‘কিসের ট্রেনিং?’ শিবার পালটা প্রশ্ন।
‘বক্সিং? ইউ মাস্ট বী এ বক্সার। তুমি বক্সিং কর?’
‘না।’
‘মাই গড!’
লোকটি কয়েক সেকেন্ড শিবার মুখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার নাম ফ্র্যাঙ্ক গোমস। তোমাদের এই দুর্লভ আমার দোস্ত। আমি একজন বক্সিং ট্রেনার, একসময় মিলিটারিতে ছিলুম, রেলে ছিলুম। রিটায়ার করে পুরনো মোটর কেনাবেচার ব্যবসা করি। আমার চেনা জিমন্যাসিয়াম আছে লালবাগানে। তুমি এস, আমি তোমাকে শেখাব।’
শিবা ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ল।
‘দুর্লভ আমার জিম কোথায় জানে। চলে এস। পয়সা লাগবে না।’
গোমস চলে যাবার জন্য দু—পা এগিয়ে আবার দাঁড়াল।
‘তোমার নাম কি?’
‘শ্রী শিবাজী আইচ।’
‘বয়স কত?’
‘সতের।’
‘হোয়াট? ওনলি সেভেনটিন!’
‘হ্যাঁ।’
ফ্র্যাঙ্ক কাছে এসে তীক্ষ্ন চোখে শিবার দিকে তাকাল।
‘তুমি বড় আছ, স্ট্রং আছ, ফাস্ট আছ। কারেজিয়াস আছ। ভাল ফাইটার হবে। ইউ আর এ বিগ বয়….ভেরি ভেরি বিগ। তোমায় দেখলে মনেই হয় না সতের, বাট আই বিলিভ ইটস সো।’
গভীর রাতে চায়ের দোকানের বেঞ্চে শুয়ে বিনিদ্র শিবার চোখের উপর এলোমেলো হয়ে যখন সন্ধ্যার ঘটনাগুলো ভেসে উঠছিল তখন মনে পড়ল ওই কালো—সাহেবটার কথা : তোমায় দেখলে মনেই হয় না সতের। আশ্চর্য। সবাই এইভাবেই বলে। যে তার বয়স শোনে অবিশ্বাস করে। প্রথম সে যেদিন জানতে পারে তার বয়স আর শরীরের মধ্যে বিস্তর গরমিল সেই দিনটার কথা কোনোদিনই সে ভুলতে পারবে না।
বহুদিন তার মনে পড়েছে মায়ের তখনকার দু—চোখের চাহনিটা। আজ এই গভীর রাতে আবার সেই দিনটা হানা দিল তার স্মৃতিতে।
সন্তর্পণে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বাইরের দালানের দিকে একবার তাকিয়েই, মা সেদিন ফিসফিস করে বলেছিল : ”শিবা হাত বাড়া।”
রান্নাঘরের জানালাটা উনুনের ঠিক পিছনে। জানালার বাইরেই আবর্জনার স্তূপ আর কাঁচা নর্দমা। শিবা সেখানে দাঁড়িয়েছিল চুপিসাড়ে দেওয়াল ঘেঁষে। মুখুজ্জেবাবুদের বিরাট পুরানো বাড়ি। এখানে তার মা রাঁধুনির কাজ করে। সামনে ফটক। পাঁচিলে ঘেরা বাগান, ঝোপ—ঝাড়ে ভরা। পাঁচিলের অধিকাংশই ধসে পড়েছে। তাতে সুবিধাই হয়েছে শিবার। ফটক দিয়ে ঢুকলে কারুর চোখে পড়ে যেতে পারে। বাগানের পিছনের দিকে রান্নাঘরের কাছাকাছি পাঁচিলের একটা ভাঙা জায়গা সে বেছে নিয়েছে। প্রতিদিন এই সময়ে সে পাঁচিল টপকে ঢোকে। নর্দমা আর দেয়ালের মাঝে এক বিঘৎ প্যাচপ্যাচে কাদা জায়গা। সেখানে পা জোড়া করে জানালাটার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কোনো কোনোদিন আধ ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যদি রান্নাঘরে বাড়ির গিন্নিমা কিংবা চাকর হরিহর হাজির থাকে। কাদায় পায়ের আঙুল ডুবিয়ে কাঠের মতন যখন সে অপেক্ষা করে তখন রান্নাঘর থেকে চমৎকার গন্ধ ভেসে আসে।
মায়ের রান্না সত্যিই দারুণ। গন্ধটা বুকের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। খালি পেটে মোচড় দিয়ে একটা ব্যথা তৈরি হয়। বুক থেকে গন্ধটা পেটের দিকে নামাবার জন্য সে বারবার ঢোঁক গেলে আর বড় বড় নিঃশ্বাস নেয়। কোনো কোনোদিন সে ফুটন্ত ঝোল বা ডালের বগবগ শব্দও পায়। বিরাট কড়া, আঠার জনের রান্না হয় ওটায়। মা নামাতে পারে না, হরিহর কড়া নামিয়ে দেয়। যখন ফোটে গন্ধটা ভসভসিয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। একটা বড় থালা দিয়ে কড়াইটা যখন মা চাপা দিয়ে দেয়, গন্ধটা কমে যায়। অনেকদিন ওর মনে হয়েছে, মাকে বারণ করে দেবে কড়াইটা ঢেকে না দিতে। লজ্জায় বলতে পারে নি। শব্দ শুনে সে বলে দিতে পারে এখন অম্বল, ঝোল, না ডাল, কি রান্না হচ্ছে।
এই সময় সে মনে মনে দেখতে পায় বাবুদের বাড়ির ছেলেরা সার দিয়ে বসে খাচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে তারই সমবয়সী রঞ্জু। লাল একটি চামড়ার বইয়ের ব্যাগ নিয়ে সাইকেল রিক্সায় হরিহরের পাশে বসে স্কুলে যায়। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা মোজা সবই ধবধবে—ওর গায়ের রঙের মতো। রঞ্জুকে দেখে তার গর্ব হয়। মা ওদের বাড়িতেই ত কাজ করে। সে রিক্সার কাছাকাছি এসে তাকিয়ে থাকে। রঞ্জু কিন্তু তাকে চেনে না। সেই রঞ্জু মায়ের তৈরি রান্না খাচ্ছে। ভাত দিয়ে ডাল মেখে এক একটা গ্রাস মুখে দিচ্ছে। চিবোচ্ছে আর হয়তো মাথা নাড়ছে। ভাত খাবার সময় আনন্দ হবেই। তারপর একটুখানি বেগুন কিংবা আলু ভাজা মুখে দিল। তারপর মাছের ঝোল। তাতে কাঁচকলা, আলু, বেগুন এইসব। ভাবতে ভাবতে ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। কি সুন্দর দেখতে লাগে কেউ যখন পেট ভরে ভাত খায়।
কাঠের মতো জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সে ভাবে। রঞ্জুর ভাত খাওয়ার আনন্দকে নিজের আনন্দ করে নেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আবার গুলিয়ে ওঠে পাকস্থলীটা। মুখে জল জমে। সাবধানে মুখ থেকে ফেলে দেয় যাতে শব্দ না হয়। তারপর কান খাড়া করে থাকে, কখন মা ফিসফিসিয়ে বলবে, শিবু হাত বাড়া। সে তখন দ্রুত জানালার সামনে এসে হাত পাতবে। কাগজে কি শালপাতায় মোড়া একটা দলা চটপট তার হাতের উপরে এসে যাবে। বিদ্যুৎবেগে সে জানালা থেকে সরে গিয়ে পাঁচিল টপকে ছুটবে বাড়ির দিকে। দলাটা থেকে গরম ভাপ তখন তার হাত বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সে পথে কোথাও দাঁড়ায় না। দিলু আর নিলু ঘরের কাছাকাছিই এতক্ষণ অপেক্ষা করছে। তাকে দেখে হয়তো একজন চেঁচিয়ে উঠবে ‘মেজদা এসে গেছে।’ ঘরের মধ্যে ওরা তাকে ঘিরে উবু হয়ে বসবে। ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকবে তার হাতের দলাটার ওপর। ম্যাজিসিয়ান যেন টুপির মধ্য থেকে অবাক করা কিছু বার করছে এমন ভঙ্গিতে সে শালপাতা কিংবা কাগজের মোড়কটা খুলবে। একটু ভাত, লাল শাকের চচ্চচড়ি, বা চাপধরা সেদ্ধ ডাল—কিছু একটা বেরিয়ে আসে। দিলু বা নিলু, কেউ একজন, আওয়াজ করবে: ‘ই—ই—ই—ই’।
‘শিবা আছিস?’
চটকা ভেঙে সে তাড়াতাড়ি জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদিন।
একটা ঠোঙার মতো জিনিস জানালার গরাদের মধ্যে দিয়ে মা এগিয়ে দেয়। সেটা হাতে নিতে নিতেই সে দেখতে পেয়েছিল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গিন্নিমা একদৃষ্টে তাকিয়ে। তার বুকটা কেঁপে ওঠে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাতে যাবে, আচমকা চুলের মুঠি ধরে হরিহর ‘অ্যাই’ বলে উঠল। এতক্ষণ নিশ্চয় ঘাপটি দিয়ে অপেক্ষা করছিল।
চুলের মুঠি ধরে হরিহর টানতে টানতে তাকে যখন ভিতরে আনল, তখন বাড়ির মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। ও দেখতে পেল গিন্নিমার পা জড়িয়ে ধরে মা কি একটা বলার চেষ্টা করছে। গিন্নিমা মাথা নাড়ছে। গিন্নিমা মাথা নাড়ছে। শুধু শুনতে পেল, ‘এগার বছর বয়স, বল কি, মনে হয় ষোল—সতের।’
‘না মা সত্যি বলছি। ওকে মারবেন না, বাচ্চচা ছেলে। আমারই দোষ, আমিই চুরি করে ওকে দিয়েছি, ওর কোনো দোষ নেই মা। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা মা। মাথার ঠিক থাকে না ছেলেগুলোর উপোসী মুখের দিকে তাকালে।’
এই সময় সে মায়ের চোখ দুটি দেখতে পেয়েছিল। ভয়, অসম্ভব রকমের একটা ভয় সেই চোখে। চাকরিটা চলে যাবে? ষোল বছরের বড়ছেলে নিতুর পঞ্চান্ন টাকার লোহার কারখানার চাকরির উপর পাঁচজনের সংসার ভর দিয়ে থাকা মানে একবেলা দু—মুঠো ভাতও নয়। হয়তো সেইজন্যই এই ভয়। কিংবা হয়তো এগার বছরের ছেলে হরিহরের হাতে মার খাবে বা তাকে পুলিশে দেবে, সেই জন্যও।
সে তার জীবনের প্রথম ভয়কে সেইদিনই দেখেছিল মা—র চোখে। তখন বয়স এগার। এবং প্রথম সে শুনল, তার শরীরের আকারটি বড়, অন্তত পাঁচটি বছরকে টপকে তার শরীর এগিয়ে রয়েছে। মায়ের সেই চাহনি হিমধরা একজোড়া লোহার শিকের মতো তার বুকে গেঁথে যায়। বুক থেকে সেটা আরো গভীরে, শিরা—উপশিরা দিয়ে তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। হরিহর একটা প্রচণ্ড থাপ্পড়ে তাকে যখন উঠোনে ফেলে দিয়েছিল, সে টের পায় নি। অসাড় হয়ে গেছল সর্বাঙ্গ। সে তখনই জেনে যায়, ভয় একটা অদ্ভুত জিনিস। ভয়ের মধ্যে ডুবে থাকার সময় খুব জোরে আঘাত এলে শরীর তা নিঃশব্দে নিয়ে নেয়।
এর কিছুদিন পরই বিয়েবাড়ির বাসি খাবার খেয়েছিল ওরা তিনজন। সকালে চাকরে ফেলে দিচ্ছিল। শিবাই চেয়ে এনেছিল, দিলু—নিলুকেও সে ভাগ দেয়। দুপুরে ওদের ভেদবমি শুরু হতেই সে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছল। কাউকে বলতে পারে নি, পচা বাসি খাবার তারই আনা। ভয়ে। ওরা মারা গেল রাত্রে, বিনা চিকিৎসায়। কলেরাকে তার শরীর হজম করে নিয়েছিল।
তাহলে কি আজ সাধু আর দেবু আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল?
অনেকক্ষণ ছটফট করে শিবা উঠে বসল। ভ্যাপসা গুমোট গরম শুধু উনুনটার জন্যই নয়। তার মনের মধ্যে উত্তাপ। একটা অসম্ভব কাণ্ড সে করে ফেলেছে। জনে জনে তাকে বাহবা দিয়ে পিঠ চাপড়ে গেছে। একজন তাকে গেঞ্জি কিনে দেবে বলল, দর্জির দোকান বলল প্যান্ট বানিয়ে দেবে, ডাক্তারখানা বলল, ‘কাঁধে ব্যথা হলে আসিস,’ বটকেষ্ট বলল : ‘একটা ডিম সেদ্ধ করে খা,’ আর রাধেশ্যাম বলল, ‘ভগবান’! সারা, ব্যাপারটাই এখন তার কাছে অবাস্তব অসম্ভব অলীক মনে হচ্ছে।
ভবানী স্যারের সঙ্গে তারপর আর দেখা হয় নি। হাসপাতালে ওকে নিয়ে গেছে কব্জিটা দেখাবার জন্য, সম্ভবত ভেঙেছে। হঠাৎ শির শির করে উঠল শিবার সারা শরীর। সে কি পারবে ঐভাবে হাতটা তুলে বলতে : ভাঙো, হাত আমার দরকার নেই, এটা তুমি নিতে পার কিন্তু আমি স্কুলে যাবই।
শিবার ঘাড়ের কাছেই রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল। মনের মধ্যে গুরগুর করে জমে উঠল অদ্ভুত একটা ভয়। অসম্ভব একটা সাহস চোখ মেলে দেখার ভয়। তার অভিজ্ঞতা বোধ—বুদ্ধি—অনুভূতির বাইরে থেকে আসা একটি শক্তি তাকে গ্রাস করেছে, সেটাই ভয় পাইয়ে তাকে মরীয়া করে দিয়েছিল। মায়ের ভীত চোখের চাহনি তৈরি করে দিয়েছিল তার শরীরকে মার নেবার জন্য, ভবানী স্যারের শান্ত সাহস তাকে এগিয়ে দেয় মার দেবার জন্য।
দুই
কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো মোটা ভারী পাশ বালিশের খোলের মতো থলিটা আকারে প্রায় একটা পাঁচ—ছ—বছরের ছেলে। একটি যুবক হাঁফাচ্ছে আর ফোঁস ফোঁস নিশ্বাসের শব্দের সঙ্গে থলিটায় ঘুসি মেরে চলেছে। শব্দ হচ্ছে ”ঢপ…ঢপ…ঢপ।” একটি ছেলে দু—হাতে থলিটা ধরে রেখেছে যাতে না দোলে।
শিবা অবাক চোখে কিছুক্ষণ দেখে অবশেষে এগিয়ে এল। আকারে ঘরটা বটকেষ্টর দোকানের সমানই। মেঝে সিমেন্টের, উপরে অ্যাসবেস্টসের চাল। চারধারে পাকা দেয়াল, তাতে কয়েকটা জানালা। ঘরটার মধ্যে ঢুকবে কিনা, ইতঃস্তত করে শেষ পর্যন্ত কৌতূহলই শিবাকে ঠেলে দিল। দরজা থেকে সে দু—পা ভিতরে এসে দাঁড়াল এবং তখনই তার সারা দেহ অযথা একবার কেঁপে উঠল বিদ্যুতের ধাক্কা লাগার মতো।
তেলো হাঁড়ির মতো একটা রবারের বলে অনবরত দু—হাতে ঘুসি মেরে চলেছে একজন। বলটা শূন্যে রয়েছে উপরে—নীচে দু—দিকে স্প্রিংয়ের টানে। ঘুসি খেয়ে বলটা পিছিয়ে গিয়ে ছিটকে ফিরে আসতেই আবার ঘুসি। শিবা অবাক হয়ে যাচ্ছে। দু—হাতে কি চটপট ঘুসি চালাতে হচ্ছে বলটাকে ব্যস্ত রাখতে! থলিতে ঘুসি মারছিল যে যুবকটি সে হাঁফাতে হাঁফাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বাইরের বাতাস নেবার জন্য।
ঘরের একদিকের দেয়ালে চার হাত লম্বা, তিন হাত চওড়া একটা আয়না। সারা ঘরটাই তাতে ধরা পড়ছে। তার সামনে বছর পঁচিশের এক যুবক, একাকী লড়াই করছে নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে। ঘুসি মারছে, ঘুসি কাটাচ্ছে, নেচে নেচে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ মাথা নামিয়ে ডুব দিচ্ছে, পিছনে হেলছে, পাশে কাত হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ তার দিকে ঘুসি ছুঁড়ছে আর সে ঘুসিগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে অসম্ভব দ্রুততায়। সঙ্গে সঙ্গে পালটা ঘুসিও ছুঁড়ছে। বাঁ হাতটা মুখ আড়াল করে তুলে ধরা। মাঝে মাঝে সেটা ছোবল দিচ্ছে, হঠাৎ ডান হাতটা প্রচণ্ড থাবার মতো সোজা এগিয়ে বাতাসে গর্ত করে কারুর মুখে গিয়ে পৌঁছচ্ছে। শিবা অবাক হয়ে দেখছিল অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে এই একাকী লড়াই। দেখতে দেখতে বুঁদ হয়ে কখন যেন এগিয়ে এসেছে। কখন যেন তারও মুঠো শক্ত হয়ে উঠেছে, শরীরটা দুলতে শুরু করেছে, মাথা ঝাঁকানি দিচ্ছে, আপনা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, পিছনে এক পা সরে যাচ্ছে ঘুসি কাটাতে।
”অ্যাই এখানে কি কচ্ছিস, ভাগ।”
রুক্ষ কর্কশ কণ্ঠস্বরে চমকে শিবা পিছনে তাকিয়ে বুঝল তাকেই বলা হয়েছে। কুঁকড়ে গিয়ে সে দরজা ছেড়ে পাশে সরে দাঁড়াল। বলেছে যে, সে দরদর ঘাম নিয়ে বাইরে থেকে এল। শিবা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছে, এখানে সকলেই ঘামছে, সকলেই হাঁফাচ্ছে।
লোকটির বয়স ত্রিশের উপরে। ভারী কাঠামো, থ্যাবড়া মোটা নাক, মুখটা চৌকো। চোখ জোড়া কুতকুতে। ভ্রূতে চুল প্রায় নেইই, মাথায় কদম ছাঁট। দু—হাতের তালু ও আঙুলে জড়ানো কাপড়ের পাড় খুলতে খুলতে চেঁচিয়ে বলল, ”দূর দূর, একটাও ছেলে নেই যার সঙ্গে স্পার করা যায়। পাঞ্চের জোর নেই ডিফেন্স করতে পারে না। বল ত কান্তি আজকালকার ছেলেগুলোর হয়েছে কি? পাঞ্চ নিতেও পারে না, দিতেও পারে না। তড়িৎ না ফড়িৎ কি যেন নাম ছেলেটার, স্রেফ চোখ উলটে শুয়ে পড়ল একটা জ্যাব ছোঁয়াবা মাত্র।”
রবারের বলে যে ঘুসি মেরে যাচ্ছে, সে এসব কথায় কান না দিয়ে সমানে নিজের কাজ করে যেতে লাগল। যে ছেলেটি থলি ধরে ছিল, ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। যে আয়নার সামনে একাকী লড়ে যাচ্ছে সে থুতনিটা বুকের দিকে চেপে পরপর দু—বার বাঁ হাতটা ছুঁড়ে বলল, ”যা বলেছ বেচুদা।”
বেচু তখন প্রবল বিরক্তি নিয়ে গজ গজ করে যাচ্ছে, ”কিসসু হবে না। পুতু পুতু করে পাঞ্চ, এতে আমার হবেটা কী। বারবার বলছি মার, আমাকে মার, মুখটা ওপেন করে দিচ্ছি তবুও পারে না হিট করতে।”
কান্তি তার অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে রেহাই দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ”তিন রাউন্ড দাঁড়াতেই সব জিভ বেরিয়ে যায় এখানকার ছেলেদের। খাটে না, খাটে না, সব ফাঁকিবাজি। মহাদেবদার ক্লাবে বরং দু—চারটে ছেলে আছে, ওয়েল্টার এমন কি মিডলও পাবে। তোমার মতো লাইট হেভির স্পার করতে কোনো অসুবিধে হবে না।”
”কান্তি তুই একটা পাঁঠা। ওয়েট থাকলেই কি ভেবেছিস বক্সার হওয়া যায়? তাহলে ত আমাদের কারখানার দারোয়ান শিউভজন ইন্ডিয়ার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত। টেকনিক, স্পিড, সুইফটনেস এসবের আর দরকারই হত না।”
”না না, সেকথা আমি বলছি না।” কান্তি কাঁচুমাচু হয়ে গেল। টুলে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বেচু পা ছড়াল। কান্তি শশব্যস্তে বলল, ”বেচুদা জল খাবে?”
”দে।” চোখ বুজল বেচু। কি যেন ভাবছে। এক সময় চোখ খুলল। ”মহাদেবদার ওখানেই চলে যাব। মুশকিল হল সময় পাওয়া নিয়ে। এখানটা কাছে হয়, কারখানা থেকে ফেরার পথে নেমে প্র্যাকটিস করে যেতে পারি। এই সুবিধেটা তাহলে থাকবে না।”
”গোমসের ট্রেনিংটাও পাবে না।” জলের গ্লাস সামনে ধরে কান্তি বলল।
এক চুমুকে গ্লাস খালি করে বেচু মুখ বেঁকিয়ে বলল, ”রাখ তোর গোমস। ওই ট্যাসটা আমায় শেখাবে কি আর? এগার বছর হয়ে গেল আমার। ইন্ডিয়ার ফ্লাই ওয়েট রানার্স হয়েছি আট বছর আগে। ও ব্যাটা কখনো ন্যাশনালের ফাইনালে উঠেছে?”
”ওদের সময়ে ত ন্যাশনালই হয় নি।”
”তাই বলেছে বুঝি? পঞ্চাশ সালে ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে প্রথম ন্যাশনাল হয়েছিল। বোম্বের পিটার প্রিন্সের হাতে গোমস কি মারটা যে খেয়েছিল মহাদেবদার কাছে সে গপ্পো শুনিস। নক আউট হয়েছিল। তারপর আর ন্যাশনালে নামে নি। অ্যাকের নম্বরের গুলবাজ, খালি বড় বড় কথা আর—” বেচুর চোখ পড়ল শিবার উপর। ”তখন থেকে দেখছি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাই শুনছিস। তুই মেম্বার?”
শিব গ্রোগ্রাসে গিলছিল শুধু কথাই নয়, সারা পরিবেশটাকেও। এটা তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক নতুন জগৎ। এখানকার ঘাম আর ভারী নিশ্বাস জড়ানো গন্ধটা তার চায়ের দোকানের গন্ধের থেকে আলাদা। এখানকার শরীরগুলো নড়াচড়া করছে ক্ষিপ্র, জোরালো, উদ্ধত ভঙ্গিতে। দিনের পর দিন চায়ের দোকানে সে দেখেছে অলস, মন্থর, কুঁজো, হয়ে বসা দেহ। এখানকার কথাবার্তায় যেসব শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে তা আগে কখনো শোনে নি। চায়ের দোকানে একবারই সে ‘নক আউট’ কথাটা শুনেছে যখন বাজি ধরা হয়েছিল ক্লে—র সঙ্গে লিস্টনের লড়াই নিয়ে। আর একবার ‘নক আউট’ কথাটা তার মনে এসেছিল যখন সাধুকে উবু হয়ে মেঝেয় দু—হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে দেখে। সেই মুহূর্তে ‘নক আউট’ জিনিসটার অর্থ সে খুঁজে পায়। বেচুর কর্কশ, তাচ্ছিল্যকারী ভঙ্গিটা পর্যন্ত তার কাছে অপরিচিত, আগে কখনো দেখে নি।
”কিরে, তোকে ত কখনো দেখি নি।” কান্তি এগিয়ে এসে শিবার আপাদমস্তক দেখল।
”আমাকে আসতে বলেছিল।”
”কে, গোমস নিশ্চয়।”
শিবা মাথাটা হেলালো।
”বুঝলে বেচুদা, এই নিয়ে এক ডজন হল দু—মাসে। আঁদাড়—পাঁদাড় থেকে ধরে আনে, একদিন বড় জোর দু—দিন তারপর আর আসে না।”
বেচুর ঠোঁটে পাতলা একটা বিদ্রূপ ফুটে উঠল। ”বক্সিংটাকে খুব সোজা জিনিস ভাবে। পাড়ায় মাস্তানি করবে বলে শিখতে আসে আর কি। তুই কি করিস?”
”চায়ের দোকানে কাজ করি।”
বেচু আর কান্তির মধ্যে চোখাচোখি হল। দুজনেই নিঃশব্দে হাসল।
”কখনো লড়েছিস?” কান্তি বলল।
”না।”
”ঘুসি খেয়েছিস কখনো?” বেচু বলল।
”না।”
বেচু চোখের ইসারা করল কান্তিকে। সে এগিয়ে গেল শিবার দিকে।
”বক্সিং শিখতে এসেছিস, তাই ত?”
”হ্যাঁ।”
”শিখতে গেলে প্রথমেই ঘুসি হজম করতে হয় কি করে তার ট্রেনিং নিতে হয়।”
কান্তি আর এক পা এগিয়ে শিবার এক হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল। পিট পিট করে শিবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। শিবা আড়চোখে দেখল বেচুর মুখ হাসিতে ভরে গিয়ে বুলডগের মতো দেখাচ্ছে।
”এটা কি বল ত?”
কান্তি বাঁ হাতের গ্লাভস তুলে ধরল শিবার মুখের কাছে।
”ঘুসি।”
”বাঃ, তুই ত জানিস দেখছি। এটা এবার তোকে হজম করতে হবে।”
বলার সঙ্গে সঙ্গেই ‘ঢপ’ শব্দ হল। ডান পাঁজরে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে পড়ার আগেই শিবার চোখের সামনে যাবতীয় বস্তু কালো হয়ে গেল। নিঃশ্বাস নেবার জন্য হাঁ করেও বাতাস টানতে পারল না, বুকে তীক্ষ্ন ব্যথা বোধ করল। মাথার মধ্যেটা এলোমেলো হতে লাগল। ভোমরা ডাকার মতো একটা গুঞ্জন সে শুনতে পাচ্ছে।
‘ঢপ।’
শিবার মাথাটা ঝাঁকুনি দিয়ে উপর দিকে উঠল। কষ্ট নেই, যন্ত্রণা নেই। শুধু অসাড় হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার সাধুকে মনে পড়ল। সাধুর মুখ, অবাক হওয়া চাহনি, জমাট হয়ে যাওয়া ভঙ্গি। সাবানের বুদবুদের মতো তার চোখের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে সাধু।
‘ঢপ।’
দেয়ালে ছিটকে পড়ল শিবা এবং ঠেস দিয়ে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে থেকে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল।
‘আর নয়, আর নয়।’
বেচুর কথাগুলো সে শুনতে পেল না।
‘দেখো, কাল থেকে আর আসবে না, আজই পালাবে।’
সত্যিই শিবা পালাচ্ছে। মরীয়া হয়ে ভয়ে পালাচ্ছে। আধ জাগরণ আধো স্বপ্নের মতো তখন তার অবস্থা। তার মনে হল, পালাতে পালাতে সে একটা বাড়িতে ঢুকল। সারা বাড়িটা ভোমরার ডাকে ভরে রয়েছে। সামনেই একটা ঘর, আপনা থেকেই তার দরজাটা খুলে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে দপদপ করছে গাঢ় হলুদ আর সবুজ আলো। বামনাকৃতি কতকগুলো লোক বেলুন ফুলিয়ে যাচ্ছে। তাদের চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে বোধ হয়। একটা বিরাট ঘুসি ফোলানো বেলুনগুলোকে ফাটিয়ে দিচ্ছে। দেয়ালে পেরেকে ঝুলছে বিবেকানন্দের ছবি আর একটা রামদা, সেটা থেকে টপ টপ রক্ত পড়ছে। দেয়াল ঘেঁষে সার দিয়ে বসা কয়েকজন ন্যাড়া মাথা লোক একঘেয়ে সুরে মন্ত্র পড়ে চলেছে। তার মধ্যে রয়েছে বটকেষ্টও।
এসব কি! স্বপ্ন দেখছি? শিবা মাথা ঝাঁকাল। হাসার চেষ্টা করল। ভোমরার ডাকটা বন্ধ হয়ে গেল মাথার মধ্যে।
‘এবার তুই বাইরে গিয়ে বাঁ দিকে যাবি। ওখানে রিং—এর পাশে একটা বুড়ো লোককে দেখবি বেঞ্চিতে বসে আছে, নাম আশ্চর্যদা। এই লালবাগান জিমন্যাসিয়ামের সেক্রেটারি। তাকে গিয়ে বলবি কান্তি সরকার আশীর্বাদ করে দিয়েছে এবার আমি বক্সিং শিখব।’
খিক খিক করে হাসির শব্দে শিবা তাকাল বেচুর দিকে।
‘কান্তি তুই বেশ রগড় করতে পারিস ত।’
বুকের দু—পাশটা টিপটিপ করছে শিবার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিদঘুটে কয়েকটা দৃশ্য সিনেমার মতো চোখে ভেসে উঠছিল। তার প্রতিক্রিয়া তখনো স্নায়ুতে ছড়িয়ে। বেচুর কথাগুলো শুনে হঠাৎ গরম হয়ে উঠল শরীর। যখন ঘর থেকে সে বেরিয়ে এল তার মধ্যে তার প্রবল বিতৃষ্ণা আর রাগ। মাথার মধ্যে এলোমেলো ভাবটা আর নেই। সে বাঁ দিকে এগিয়ে ঘরটার পিছনেই একটা সিমেন্টের চৌকো বেদী দেখতে পেল। প্রায় তিন হাত উঁচু। বেদীটা আকারে একটা বড় ঘরের মেঝের সমান। চার কোণে চারটি খুঁটি। মোটা তিনটি দড়ি বেদীটা ঘিরে খুঁটির মধ্য দিয়ে টানা রয়েছে। শিবার মনে হল এটাই সম্ভবত রিং।
পাঁচটি ছেলে তার উপরে। তাদের মধ্যে একজন দড়ি নিয়ে স্কিপ করছে। দড়িটা এত দ্রুত ঘুরছে যে দেখা প্রায় যাচ্ছেই না। একপায়ে লাফাচ্ছে, দুটো পা পাশে পাশে পরপর তুলে দুলেদুলে লাফাচ্ছে, একটার পর আর একটা পা সামনে তুলে লাফাচ্ছে। কত বিচিত্র ভাবে স্কিপ করে যাচ্ছে! শিবা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। অন্য ছেলেরা খালিহাতে ব্যায়াম করে যাচ্ছে। কেউ কেউ ঘুসি পাকিয়ে শুধু সামনে দু—পা এগচ্ছে আর সমানভাবে দু—পা পিছচ্ছে কলের পুতুলের মতো। ঘুসি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাক দিয়ে রিং—এর মধ্যে ছোট্ট জায়গাটাতেই একজন দৌড়চ্ছে। তাকে লক্ষ করতে করতে শিবা আর একটা জিনিস দেখতে পেল।
রিং—এর পিছনে ছাঁচা বাঁশের প্রায় ছ—ফুট উঁচু বেড়া। ওধারে আর একটি ক্লাব। জমিতে দাঁড়ালে দু—ধারের কেউ কাউকে দেখতে পায় না। হঠাৎ শিবা দেখল একটি মেয়ে বেড়ার ওধারে কিছু একটার উপর উঠে দাঁড়াল। মেয়েটির কোমর পর্যন্ত সে দেখতে পাচ্ছে। দেহের সঙ্গে সেঁটে থাকা টকটকে লালজামা, ‘ভি’ গলা, কনুই ও কব্জির মাঝামাঝি নেমেছে জামাটার হাতাদুটো। শিবা মুখটি দেখতে পাচ্ছে না। ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুল ফিতে দিয়ে বাঁধা।
ডানার মতো দুটো হাত ছড়িয়ে মেয়েটি সন্তর্পণে এগল, যেন সরু কিছুর উপর দিয়ে ব্যালান্স করে যাচ্ছে। ছ—সাত পা গিয়েই ঘুরে দাঁড়াল। শিবা তখন ওর মুখটি দেখতে পেল। এই বার দুটি হাত মাথার উপর তুলে মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে ঝাঁপ দিল দেহটিকে চাকার মতো ঘুরিয়ে। কোমর থেকে মাথা অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গেই কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অনাবৃত নিটোল একজোড়া পা আকাশমুখো হল। একটু কেঁপে স্থির হয়ে জোড়া হল পা দুটি। তারপরই অদৃশ্য এবং ভুস করে পানকৌড়ির মতো আবার কোমর থেকে মাথা। দু—পাশে ডানার মতো হাত। এক—পা, দু—পা, তিন—পা গিয়ে দ্রুত পাক খেয়ে ঘুরেই টলমল করে, নৌকা থেকে প্রতিমার জলে বিসর্জনের মতো পড়ে গেল। মুখটি শিবার চেনা—চেনা মনে হল।
”ওদিকে কি দেখছ?”
শিবা চমকে লজ্জা পেয়ে পিছনে তাকাল।
”এখানে কেউ আশেপাশে তাকায় না। এটা ঘাম আর রক্ত ঝরিয়ে সাধনার জায়গা।”
লোকটির কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ বা রুক্ষতা নেই। ঈষৎ ক্লান্ত, কিছুটা নিস্পৃহ গলার স্বর।
তাড়াতাড়ি শিবা বলল, ”আশ্চর্যদার সঙ্গে দেখা করব।”
”আমিই আশ্চর্য ঘটক।”
”গোমস আমাকে আসতে বলেছে।”
”ওহ।”
মাত্র এইটুকু বলেই আশ্চর্য ঘটক একবার দৃষ্টিটা তীক্ষ্ন করে শিবার দিকে তাকাল। শিবাও তাকাল। মিশমিশে কালো বিরাট একটা কাঠামো। একটু কুঁজো, অনেকটা যেন ভল্লুকের মতো। সাদা ধুতি ও সাদা শার্ট। চিবুকে ও ঘাড়ে দু—থাক চর্বি। চোখদুটি আয়ত এবং কোমল।
‘গোমসের আজ আসার দিন নয়, পরশু আসবে। তুমি বরং লক্ষ করে যাও আজ এরা কি করছে। কাল একটা স্কিপিং রোপ নিয়ে এস। আর কেডস, গেঞ্চি, হাফ প্যান্ট চাই।’
শিবা মাথা হেলিয়ে জানাল সে রাজি।
‘তোমার নাম? কি পড়?’
‘আমি পড়ি না, চায়ের দোকানে কাজ করি। শিবা, শিবাজী আইচ আমার নাম।’
‘বাড়িতে কে আছে?’
‘মা আর দাদা। আর কেউ নেই।’
‘তুমি এখন লক্ষ কর, এদের দ্যাখ।’
আশ্চর্য ঘটক রিং—এর দিকে এগিয়ে গেল। শিবা কৌতূহলভরে দেখে যাচ্ছে, যা কিছু তার চোখে পড়ছে। বক্সিং তার কাছে অদ্ভুত নতুন এক অভিজ্ঞতা। রাস্তার মারামারি সে দূর থেকে দেখেছে, সেখানে যেভাবে ঘুসোঘুসি হয়, তা থেকে এখানকার ঘুসিগুলোর কোনোই মিল নেই। ঘুসি মারাও কি শিখতে হয়!
একটি ছেলে স্কিপিং শেষ করে হাঁফাচ্ছে। একটু ইতস্তত করে শিবা তার কাছে গিয়ে দড়িটা চাইল। ছেলেটি ছুঁড়ে দিল দড়িটা। একটু সরে এসে দড়ি নিয়ে লাফাতেই পায়ে জড়িয়ে গেল। চট করে সে চারধারে তাকাল, কেউ তার আনাড়িপনা দেখেছে কিনা এবং নিজের অজান্তেই বেড়ার ওধারেও চোখটা একবার ঘুরে এল। কেউ তাকে লক্ষ করছে না। আশ্বস্ত হল ভেবে, এখানে সত্যিই কেউ আশেপাশে তাকায় না। ঘাম আর রক্ত ঝরিয়ে সাধনার জায়গা।
হঠাৎ শিবার মনে পড়ল তার ছুটি মাত্র দু—ঘণ্টার জন্য। বটকেষ্ট ব্যাজার মুখ করে বলেছিল, ‘সন্ধের খদ্দেররা আসার আগেই ফেরা চাই কিন্তু নয়ত আধবেলার মাইনে কাটব।’
স্কিপিং দড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে, শিবা লালবাগান পার্কের লোহার গেট পেরিয়ে বেরনো মাত্র দেখল ঝালমুড়ি কিনছে মেয়েটি আরো দু—জনের সঙ্গে। এইবার সে চিনতে পারল। ভবানী স্যারের কোচিংয়ে—সাধু যখন ‘আত্মা আত্মা’ বলছিল তখন অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এও ঢোঁক গিলছিল। ভবানী স্যারের ডান হাত এখন প্লাস্টারে মোড়া। হাতের হাড়ে চিড় খেয়েছে। এখন স্কুল ছুটি, রোজ সন্ধ্যাবেলা কোচিং ঘরে একা শুয়ে থাকেন, বই পড়েন, বাঁ হাত দিয়ে মাঝে মাঝে অঙ্ক কষেন বোর্ডে। চা আর দিতে বলেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে একবার শিবা জিজ্ঞাসা করেছিল—’কেউ আর পড়তে আসে না।’
‘না। হয়তো ভয় পেয়েছে। পাবারই ত কথা।’
‘আপনাকে চা দিয়ে যাব?’
‘না। ছাত্র—ছাত্রী নেই, একটু অসুবিধায় আছি।’
শিবা বুঝে যায়, ভবানী স্যারের চা খাবার পয়সার টানাটানি পড়েছে। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে বিশ্রী লেগেছিল। কোচিংটা বোধ হয় বন্ধই হয়ে গেল। এখন মেয়েটিকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘তুমি ভবানী স্যারের কোচিং—এ পড়তে যেতে না?’
শিবার শস্তার জামা আর প্যান্ট এবং চটির দিকে এক নজর তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ। কেন, কি দরকার?’
‘আর যাও না কেন? স্যার একা বসে থাকেন, কেউই যায় না।’
‘বাব্বা, কে যাবে ওখানে যা গুণ্ডাদের জায়গা।’
মেয়েরা মুড়ির ঠোঙা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। শিবার তখন ইচ্ছে করছে বলে, গুণ্ডারা আমার হাতে মার খেয়ে আর ওপাড়ায় আসবে না প্রতিজ্ঞা করে গেছে। আর আসেও নি। দেবদাস পাঠক রোডে আর কোনো অশান্তি হয় নি।
মেয়েটি বাস স্টপে দাঁড়াল। অন্য দু—জন বিদায় জানিয়ে চলে গেল। শিবাও বাসে উঠবে।
‘তুমি যা ভেবেছ তা নয়’, শিবা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল। ‘গুণ্ডারা আর আসে নি, আসবেও না।’
‘কেন?’
‘বেদম ঘুসি খেয়ে ওদের লীডারের চোয়াল ভেঙে গেছে আর একজন যে ছিল, তারও পাঁজরের হাড়ে এমন ব্যথা যে এখনো রাস্তায় বেরতে পারে না।’
‘কে মারল!’
শিবা নিজের নামটা বলতে গিয়ে হঠাৎ লজ্জার বঙ্গোপসাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল। নিজের মুখে নিজের বীরত্বের কথা বলা তার মনে হল, খুব বাজে খুব নিচু ধরনের ব্যাপার। যারা ফাঁপা তারাই এটা করে। তার করা উচিত নয়। তাছাড়া ভাবতে পারে মিথ্যে বড়াই করছি।
আমতা আমতা করে শিবা বলল, ‘ওখানকারই একটা ছেলে মেরেছে। তারপর লোকজন এসে ওদের ঘিরে ফেলে। সাধু যার হাতে ব্যাটন ছিল, সে যখন কথা দিল আর সে পাড়ার লোকদের সঙ্গে হুজ্জুতি করবে না, ও পাড়াতেও আসবে না, তখন ছাড়া পায়। এখন আমাদের রাস্তা আগের মতই শান্ত। তুমি নির্ভয়ে যেতে পার। ভবানী স্যারের মতো অমন অঙ্ক শেখাবার লোক আর পাবে কোথায়?’
‘তুমি ওর কাছে অঙ্ক শেখ? কোথায় পড় কলেজে?’
উৎসাহের যে তুবড়িটা তার মধ্যে ফুলকি ছিটাচ্ছিল সেটা নিভে গিয়ে শিবা এবার কুঁকড়ে গেল। লেখাপড়ার কথায় ত বটেই তাছাড়া, তাকে দেখে কলেজ পড়ুয়া ভেবেছে অর্থাৎ বড় শরীর নিয়ে তার যে সঙ্কোচ সেজন্যও। মাথা নেড়ে সে বলল, ‘না, আমি পড়ি না।’
তারপর ভাবল, চায়ের দোকানের কুড়ি টাকা মাইনের বয় এটা বলার দরকার আছে কি? মেয়েটির চেহারা এবং ব্লাউজ—স্কার্ট—জুতো ইত্যাদির উপর চোখ বুলিয়ে তার মনে হল, নিশ্চয়ই ভাল বাড়িতে থাকে, ভাল খায়। হাত—পা মচমচে শক্ত কিন্তু গোলগাল নয়, পাকা সোনা রঙের চামড়া তেলতেলা, হাড়গুলো চওড়া। বাড়িতে নিশ্চয় মা আছে বাবা আছে, দেখার লোক আছে। শাসন পায় যত্নও পায়। পড়াশুনার দিকেও বাড়ির লোকের নজর, নয়ত কোচিংয়ে দেবে কেন! হাতে একটি ঘড়িও। কালো ব্যান্ডটা বেশ দেখাচ্ছে ওর চওড়া কব্জিতে। শিবা কয়েক মুহূর্ত বিষণ্ণ বোধ করল। এর কোনটাই সে আজও জীবনে পায় নি। একা একাই তাঁকে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে।
পর পর দুটো বাস এল। মেয়েটি উঠল না। শিবাও উঠল না। দুটো বাসই অন্য পথে যাবে।
‘তুমি পড়তে যেও।’ এইটুকুর বেশি আর কিছু সে বলতে পারল না।
এবার তাদের বাস এল মেয়েটি উঠল। শিবাও উঠল। বাসে ভীড় রয়েছে। পাঞ্জাবী কন্ডাক্টর যখন পয়সা চাইল, শিবা আধুলি দিল।
‘দোঠো?’
থতমত খেয়ে শিবা অস্ফুটে বলল, ‘হ্যাঁ’। তার হাতে কন্ডাক্টর কত পয়সা আর কটা টিকিট গুঁজে দিল সে তাকিয়ে দেখল না। শুধু একটা ভয় হঠাৎ তাকে আচ্ছন্ন করল। এটা কি ঠিক হল? ওর টিকিট কাটা ওকে না জানিয়ে, উচিত হল কি? একদমই আলাপ নেই। এটা অসভ্যতাও ভাবতে পারে। যদি কিছু মনে করে! শিবা দেখল মেয়েটি ভীড় ঠেলে লেডিজ সিটের দিকে এগিয়ে গেছে। উপরে তোলা সুঠাম একটি হাত রড ধরে রয়েছে। হাতটার দিকে তাকিয়ে আবার তার মনে হল, ভাল খায়, যত্নও পায়। এর কোনোটাই সে পায় নি। সে বাস থেকে নেমে পড়ল আর তখনই মনে হল, ওর নামটাও জানি না।
‘এই যে ওস্তাদ। চললা কোথায়?’
এতক্ষণ একমনে হন হন করে শিবা হাঁটছিল। থমকে পাশে তাকাল। রাধেশ্যামের ছেলে ননী, বাবার সাইকেল রিক্সাটা চালিয়ে তার পাশে পাশে চলেছে। রিক্সাটা খালি।
‘দোকান যাবি ত? উঠে পড়। আমিও ওদিকে যাচ্ছি। আধ ঘণ্টা এখানে খাড়া রইলাম প্যাসেঞ্জার নেই।’
মিনিট দশেক হাঁটলে দেবদাস পাঠক রোডের মোড়। শিবা উঠে পড়ল লাফিয়ে।
‘তোর যা চেহারা, দেখলে কেউ রিক্সায় উঠবে না।’
মুশকিলটা ত এইখানেই। লোকে ভাবে মোটা চেহারা হলেই গায়ে বুঝি বেশি জোর। গণেশ সাহার পুরো ফ্যামিলি, ইয়া ইয়া দু—জন আর চারটে ছানা, দেড় মাইল টেনে নিয়ে গেছি আজ দুপুরে, একবারও থামি নাই। তা ওস্তাদ গেছিলি কোথা?’
‘ওস্তাদ, ওস্তাদ কচ্ছিস কেন?’
‘ওরে ব্বাপ, সেদিন যা খেল দেখালি। এক এক ঘুসোয়—’
‘এবার তাহলে আর একটা ঘুসি মারব—’
ননী প্যাডেল করা থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখল তার পিঠের উপর শিবার মুঠো উচানো।
‘মরে যাব রে শিবা, এই দুবলা শরীরে হজম করতে পারব না।’
‘তাহলে মনে থাকে যেন। ওস্তাদ—মাস্তান, গুরু—ফুরু ডাকলেই—’। ননীর পিঠে আলতো কিল পড়ল।
‘বললি না ত কোথা থেকে আসছিস।’
‘লালবাগান গেছলুম।’ একটু থেমে শিবা বলল, ‘আমি বক্সিং শিখব।’
‘কি শিখবি।’
‘বক্সিং। কাকে বলে জানিস?’
‘জানি না! ‘দিল কা দোস্তে’ ধর্মেন্দ্র আর বিনোদ যা ফাইট দেখিয়েছে না। ঠাঁই—ঠাঁই—ঠাঁই, ধর্মেন্দ্র উলটে পড়ল আবার তড়াক করে উঠল, আবার ঠাঁই—ঠাঁই, আবার পড়ল আবার উঠে—তিনবার দেখেছি শুধু ওই ফাইটটার জন্য, দেখবি আজ? তাহলে আবার যাব।’
‘না।’
‘না কেন? ফাইটিং পিকচার না দেখলে বক্সিং শিখবি কি করে। তুই একটা হাড়—কেপ্পন, সিনেমাও দেখিস না।’
‘দাদাকে টাকা দিতে হয়। ওমাসে এই চটিটা কিনেছি এখনো দু—টাকা ধার রয়েছে। এবার কিনতে হবে গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট, কেডস। শিখতে গেলে এসব লাগবে, কিন্তু কোথা থেকে যে পাই—এই এই এখানে রাখ।’
দেবদাস পাঠক রোডের মোড় দেখা যাচ্ছে। ননী ব্রেক কষতেই শিবা লাফিয়ে নেমে পড়ল।
‘সেদিন তোরে যে কত লোক কত জিনিস দেবে কইল। অনেক দিন ত হল, এবার চায়া নে।’
‘যাঃ, চাওয়া যায় নাকি।’
‘লজ্জার কি আছে? এই তোর এক রোগ, মেয়েমানষির মতো লজ্জা। অত লজ্জা করলি—’
ননী থেমে গেল। শিবার দু—চোখে ধক ধক চাহনি।
‘আমি কি ভিখারি? আমার ইজ্জৎ নেই? ওরা দেবে বলেছে ত বলেছে, যদি না দেয় ত নাই দিল, তাই বলে চাইতে যাব!’
‘কি জানি, কারে যে তুই ইজ্জৎ বলিস বুঝি না। বাপ উদ্বাস্তু হয়ে আসছে, আমি জন্মাইছি এখানে, জন্ম থেকেই দেখতিছি হাঁড়িতে ভাত নাই, ইজ্জতের কথাটা ভাবার সময় পাই নাই, বাঁচার কথাটাই শুধু ভেবে গেছি। আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়।’
ননীর সরু সরু দুটো পা ঝপঝপ ওঠানামা করল প্যাডেল চেপে। রিক্সাটা স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত শিবা তাকিয়ে ছিল।
যথারীতি বটকেষ্ট দাঁত খিঁচিয়ে বলল ‘অ্যাই যে, বাবু সন্ধে কাবার করে তবে এলেন। বলি, শচীন চা করবে না খদ্দের অ্যাটেন করবে?’
শিবা কথায় কান না দিয়ে শুধু বলল, ‘মাইনেটা আজ রাতে বাড়িতে দিয়ে আসব, ঠিক করে রাখবেন।’
‘তার মানে নটার সময় ছুটি চাই?’
‘হ্যাঁ। আর এবার থেকে বিকেলেও দু—ঘণ্টা ছুটি চাই। বক্সিং শিখতে যাব।’
অবিশ্বাস এবং বিস্ময়, একসঙ্গে চটকে কেউ যেন বটকেষ্টর মুখে মাখিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে বলল, ‘কি শিখবি বললি? বক্সিং!’
‘হ্যাঁ। লালবাগানে একটা ক্লাবে।’
‘তারজন্য দু—ঘণ্টা করে রোজ ছুটি দিতে হবে?’
বটকেষ্ট হেসে উঠল। দু—জনে কেউ আর এই নিয়ে কথা বলল না।
.
রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা, যখন নিচু টালির চালের ঘরটার সামনে শিবা এসে দাঁড়াল। জমি থেকে এক বিঘৎ উঁচু দু—গজ চওড়া দাওয়া, ডান দিকে রান্নার জায়গা আর পিছনে একখানি ঘর। পাশে এবং পেছনেও এই রকম এক ঘর বা দু—ঘরের বাড়ি। মাঝ দিয়ে গেছে একটা সরু গলি, খোলা নর্দমা। কোনো কোনো বাড়ির চালে দেখা যাবে বিছিয়ে আছে কুমড়ো বা লাউ গাছের পাতা। শিবাদের পিছনে শচীনের ঘর। কিছু দূরে গ্রেট বেঙ্গলের শ্রীকান্ত দাসের। কেরোসিন তেল বাঁচাবার জন্য এখানে হারিকেন বা লম্ফ রাত আটটার মধ্যেই নিভে যায় কিন্তু তখনই সবাই ঘুমোবার জন্য শুয়ে পড়ে না।
অন্ধকারের মধ্যেই পাশের বাড়ির দাওয়া থেকে কে বলে উঠল, ‘কে রে, শিবা নাকি?’
শিবা এগিয়ে গেল সেদিকে। ওটা প্রতিবেশী শক্তি দাসের ঘর, দাওয়ায় তিন—চারজন বসে, তার মধ্যে নিতুও রয়েছে। দু—জনে একই কারখানায় কাজ করে। শক্তিই নিতুকে কাজটা করিয়ে দেয়। শিবার বাবা মারা যাবার পর শক্তি দাসই বস্তুত তাদের অভিভাবকের মতো। বছর পঁয়ত্রিশের, তেজী, রগচটা কিন্তু আমুদে লোক। ওর স্ত্রী সাগর ঠান্ডা, জেদী, স্বল্পবাক। এরা নিঃসন্তান।
‘শুনলাম তুই নাকি সাধুটাকে পিটিয়ে তক্তা করে ছেড়েছিস! আয়, আয়, বোস এখানে।’
দাওয়া থেকে দুটি লোক উঠে দাঁড়াল।
‘তাহলে আমরা আসি। এই কথাই তাহলে রইল।’
‘চল তোমাদের এগিয়ে দি। শিবা তুই বোস, আমি আসছি।’
শক্তি দাস লোক দুটিকে নিয়ে এগিয়ে গেল। নিতু বলল, ‘মায়ের হাঁপানি শুরু হয়েছে। শুয়ে আছে। দেখে আয় একবার।’
শিবা তাদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। ভিতরে অন্ধকার। অদ্ভুত একটা আওয়াজ আসছে ঘরের মধ্য থেকে। হাঁপানির টানের সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ফুসফুসে টেনে নেবার জন্য মরীয়া চেষ্টা আর তাই তৈরি হওয়া মর্মভেদী কাতরানি। শিবার পাকস্থলী হঠাৎ গুলিয়ে উঠল। ঘরে না ঢুকে সে অস্ফুটে দুবার ‘মা…মা’ বলল। কেউ সাড়া দিল না।
কাঁধে কে হাত রেখেছে। শিবা চমকে ঘুরে দাঁড়াল। নিতু নিঃসাড়ে ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘ভিতরে যাবি না?’
‘আমার ভাল লাগে না। যন্ত্রণা, কাতরানি সহ্য করতে পারি না।’
শিবা তার মাইনের টাকা দাদাকে দেবার জন্য এগিয়ে ধরল। সে ভেবে রেখেছিল বলবে; এবার পুরো টাকাটাই রাখব। কতকগুলো জিনিস কিনতে হবে বক্সিং শেখার জন্য। আমার খুব টাকার দরকার।
কিন্তু সে এই কথাগুলোর একটিও এখন বলতে পারল না। ঘরের মধ্য থেকে যে আওয়াজ আসছে সেটা দমচাপা হতাশ অনুভব ছড়িয়ে দিচ্ছে তার শরীরের মধ্যে, এই শব্দটার জন্যই সে বাড়িতে আসতে চায় না। শ্বাসের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও হাঁপিয়ে ওঠে। তখন সে ভাবে মায়ের এত কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার দরকার কী? তার পরই মনের মধ্যে একটা গলা ফিসফিস করে ওঠে: শিবা হাত বাড়া।
‘আমাদের কারখানায় কিছু লোক ছাঁটাই হতে পারে শোনা যাচ্ছে। তখন আন্দোলন, ধর্মঘট, লক—আউট—এসব হবে। তোর রোজগারই তখন কিন্তু সম্বল হবে। তুই এবার রোজগার বাড়াবার চেষ্টা কর।’
‘করব।’
শুধু এই কথাটি কোনোক্রমে বলেই শিবা দাদার পাশ কাটিয়ে অন্ধকারে নেমে এল।
রাত্রে দোকানে শুয়ে আকাশ—পাতাল ভাবতে ভাবতে যখন ঘুমিয়ে পড়ছে, তখন সে এইটুকুই মাত্র বুঝতে পারে: কি করে রোজগার বাড়াব আমি তা জানি না। আমার বিদ্যে নেই, টাকা নেই, বুদ্ধি নেই। আমার বয়স মাত্র সতের। আমার আছে শুধু শরীর আর দু—হাতে দুটো ঘুসি। এই ঘুসি দুটোই শুধু আমাকে পথ তৈরি করে দিতে পারে।
বটকেষ্ট রাজি নয় তাকে প্রতিদিন দু—ঘণ্টার জন্য ছেড়ে দিতে। তার সাফ কথা। ‘তাহলে কাজ ছেড়ে দাও যদি ঘুসির কায়দা শিখতে চাও।’ সঙ্গে সঙ্গে দাদার কথাটা তখন শিবার মনে পড়ে। তোর রোজগারই তখন কিন্তু সম্বল হবে।
তাছাড়াও কেডস, হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি, এই জিনিসগুলো না হলে ট্রেনিং করবেই বা কি করে। অন্তত পনের টাকা চাই। আর চাই এমন একটা কাজ যেখানে বিকেলে ছুটি হয়ে যায়। শিবা দু—দিন ধরে এই নিয়ে ভাবল এবং হাল ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধান্তে এল, বক্সার হওয়া তার পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
এই সিদ্ধান্তের পরের দিনই দুপুরে ননী একগাল হেসে তাকে বাইরে থেকে ইশারায় ডাকল। দোকানে খদ্দের নেই। শিবা বেরিয়ে আসতেই ননী একটা ছোট্ট পুঁটলি তার হাতে তুলে দিল।
‘কি এটা!’
‘খুলে দেখই না।’
সাদা হাতকাটা গেঞ্জি, কালো হাফপ্যান্ট, আর নীল রঙের একজোড়া কেডস। এগুলো মোড়া একটা খয়েরি তোয়ালেতে। শিবার দুটো হাত কেঁপে উঠল। অস্ফুটে চাপা গলায় সে বলল, ‘এসব কার, এসব কে দিল?’
‘কে আবার দেবে, আমরাই। রিক্সাওয়ালারা, সবজিওয়ালারা, বিড়ির দোকান—এই এরাই চাঁদা দিল। আমাদের জন্য একজন ফাইটার দরকার তাই দিল।’
ননী হাসছে। আর শিবার চোখের সামনে ওই হাসিটা এক হাজার সূর্যের আলো নিয়ে ঝলসাতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠল মনের মধ্যে—’আমি হব।’
.
তিন
”ঢপ…ঢপ…ঢপ।”
দু—সেকেন্ড পরে আবার। ‘ঢপ…ঢপ।’
পাঁচ মিনিট ধরে নাগাড়ে শব্দগুলো হতে হতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
ঘরটার আলো নেভানো। এত রাত্রে অর্থাৎ দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট এখন, ইলেকট্রিক খরচ করে মাত্র একজনকে ট্রেনিং—এর সুযোগ দেবার জন্য অর্থ ব্যয়ের সামর্থ বা ইচ্ছা এই জিমন্যাসিয়ামের নেই। ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় একটা বাল্ব জ্বলছে। সেখানে একটা নড়বড়ে টেবল ঘিরে চেয়ারে কয়েকজন প্রবীণ সদস্য পৃথিবীর তাবৎ ভাল—মন্দ সুখ—দুঃখ নিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও আলোচনায় ব্যস্ত। আশ্চর্য ঘটক খাতা, বিলবই, নানাবিধ ফর্ম এবং চিঠি নিয়ে টেবলে ঝুঁকে রয়েছে। কিছুদিন পরই শুরু হচ্ছে লালবাগান জিমন্যাসিয়াম পরিচালিত হলধর বর্ধন স্মৃতি বক্সিং টুর্নামেন্ট। তারই ব্যবস্থায় আশ্চর্য ঘটক এবং কয়েকজন ব্যস্ত।
‘অন্ধকারে হেভিব্যাগে কে ট্রেনিং করছে গো!’ একজন জানতে চাইল।
‘গোমসের ছেলে।’ আশ্চর্য মুখ না ফিরিয়েই বলল।
‘এত রাতে!’
‘সময় করে উঠতে পারে না।’
‘মনে হচ্ছে ডেডিকেটেড, আগে ত একে দেখি নি।’
‘এতদিন সন্ধেবেলায়ই আসত, ছিল চায়ের দোকানে, চাকরিটা বদলে এখন একটা মোটর সারাবার কারখানায় কাজ নিয়েছে ট্রেনিং—এর সুবিধের জন্য। আপনি নোটনদা আজ বেশিক্ষণ রয়েছেন তাই ওকে দেখলেন নয়ত আমরা চলে যাবার পরও শিবা থাকে।’
‘শিবা নাম?’
‘হ্যাঁ। গোমস এবার ওকে নিয়ে পড়েছে।’
‘গোমস একটা খ্যাপা। এই নিয়ে কটাকে ধরে আনল বলত।’
আর একজন বলল ডিবে থেকে নস্যি বার করতে করতে।
‘বেঙ্গল থেকে বহু বছর বক্সার ওঠে নি।’ চাপা স্বরে খেদ শোনা গেল।
‘বড় কষ্ট করতে হয় ওঠার জন্য। শেষ পর্যন্ত বাঙালিরা আর টিকে থাকতে পারে না। আদত জিনিস ঘুসির জোর, সেটাই এখানকার বাঙালি ছেলেদের নেই।’ বলতে বলতে নোটনদা উঠলেন বাড়ি যাবার জন্য।
ঠিক এই সময়ই জিমন্যাসিয়াম ঘরের দরজার কাছ থেকে ফিসফিস স্বর শোনা গেল : ‘আশ্চোয্যোদা।’
আশ্চর্য ঘটক মুখ তুলে তাকাল।
‘একবার আসবেন।’
একটু অবাক হয়েই উঠে গেল ঘরটার মধ্যে। ঘরের আলো জ্বলল এবং আধ মিনিটের মধ্যে আশ্চর্য উত্তেজিত ভাবে বেরিয়ে এসে, ক্লাব গেটের কাছে পৌঁছনো নোটনদার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল: ‘নোটনদা, নোটনদা এক মিনিট একটু এদিকে আসুন।’
ভ্রূ কুঁচকে নোটনদা ঘুরে দাঁড়ালেন। ‘রাত হল, দেরি হয়ে যাবে। ব্যাপার কী?’
‘হোক দেরি, এক মিনিট।’
অনিচ্ছুক নোটনদা এবং কৌতূহলী বাকিরা জিমন্যাসিয়াম ঘরে ঢুকল। এক কোণে যেন চোর দায়ে ধরা পড়েছে এমন মুখ করে শিবা দাঁড়িয়ে। ওরা সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে আশ্চর্যের দিকে তাকাল।
‘কি ব্যাপার আশ্চয্য?’
আশ্চর্য আঙুল তুলে কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো হেভি পাঞ্চিং ব্যাগটাকে দেখাল। ক্যানভাসের খোলের মধ্যে বালি ভরা ব্যাগটা নিথর হয়ে ঝুলে রয়েছে। আশ্চর্য এগিয়ে এসে ব্যাগের একটা জায়গায় দুটো আঙুল ঢুকিয়ে দিতেই ঝরঝরিয়ে বালি বেরিয়ে মেঝেয় পড়ল।
‘ফেটে গেছে!’ একজন বলল।
আশ্চর্য আঙুল তুলে শিবাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওর কাজ।’
‘কি কাণ্ড, ফাটিয়ে দিয়েছে!’ নোটনদর সঙ্গে আর সবাই এগিয়ে এসে ব্যাগটিকে তন্নতন্ন পরীক্ষা করে বিস্ময়ে মাথা নাড়ল।
‘ব্যাগের কাপড়টা ত দেখছি পুরনো নয়।’
‘এ যে গোলে শট মেরে জাল ছিঁড়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার হল। এসব ত শুধু শুনেছি মাত্র, চোখে কখনো দেখি নি।’
‘ভাল করে দেখ ত ছেঁড়াটেড়া আগে ছিল কিনা।’
‘ছোঁড়াটা লোহা দিয়ে খুঁচিয়ে ফাটিয়ে রেখে তারপর বাহাদুরি নিচ্ছে না ত!’ একজন সন্দেহ জানাল নিচু গলায়।
‘না না ওসব আমি করি নি।’
শিবা ব্যাকুল হয়ে উঠল নিজেকে নিরপরাধ প্রতিপন্ন করতে।
‘আমি শুধু পাঞ্চ করে গেছি, আর কিছু করি নি।’
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরই শিবা করুণ সুরে বলল, ‘আশ্চোয্যোদা, ও—মাসে আমি নতুন ব্যাগ করিয়ে দেব, মাইনে পেলেই। ইচ্ছে করে কিন্তু আমি ফাটাই নি।”
‘হারামজাদা, ইচ্ছে করে কি কেউ ঘুসি মেরে এ ব্যাগ ফাটাতে পারে?’
বলতে বলতেই আশ্চর্য তার ভল্লুকের থাবার মতো তালুতে শিবাকে আঁকড়ে বিরাট দেহের মধ্যে টেনে নিল। ফিসফিস করে বলল, ‘তোকে হলধর টুর্নামেন্টে নামাব। চালিয়ে যা, চালিয়ে যা। যত ব্যাগ ফাটাতে চাস ফাটিয়ে যা।’
শিবা যখন দেবদাস পাঠক রোডের মোড়ে বাস থেকে নামল তখন জায়গাটা নির্জন। সব দোকানই বন্ধ, শুধু বটকেষ্টর চায়ের দোকান ছাড়া। শিবার জায়গায় পচা নামে একটা বাচ্চচা ছেলে কাজ করছে। দুটো রিক্সা খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে। রাধেশ্যাম ওকে দেখে রিক্সার সিট থেকে নেমে এসে বলল, ”শচীনের ছেলের জ্বর তাড়াতাড়ি চইল্যা গেল। এইটা তোমার জন্য দিয়া গ্যাছে।”
একটা সিদ্ধ ডিম। তাড়াতাড়ি সেটা পকেটে রেখে শিবা বলল, ‘ননী কোথায়?’
‘গেছে কোন এক বৌভাতের বাড়িতে জলটল তোলনের কাম লয়্যা।’
শিবা গ্রেট বেঙ্গল অটো রিপেয়ারিং—এর টিনের দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। ছোট একটা আঙিনা পাঁচিল ঘেরা। একটা পুরনো মোটর গাড়ি, তারপাশে কতকগুলো খালি মোবিলের টিন, গ্রিজের ড্রাম। দুটো আড়াআড়ি বাঁশে ঝুলছে কপিকল আর শিকল। তালাবন্ধ একটা ছোট্ট টিনের ঘর, তারমধ্যে আছে অ্যাসিটিলিন—ব্লোয়ার, রং—স্প্রেয়ার, সিলিন্ডার, পেট্রলের টিন, পেইন্টসের কৌটো, স্পেয়ার পার্টস আর কাজের যন্ত্রপাতি। এই ঘরের চাবি দুর্লভের কাছে। সে আসবে সকাল সাতটা নাগাদ, শ্রীকান্তরা আসার আগেই শিবাকে নিয়ে গ্রেট বেঙ্গলে কাজের লোক এখন পাঁচজন। একটা—দুটো মোটর গাড়ি গ্যারেজে সব সময়ই থাকে। তারই মধ্যে শিবার রাতের ঘুম সারা হয়ে যায়।
একটা অ্যাম্বাসাডর রং পালটাবার জন্য গতকালই এসেছে। গ্যারেজের দরজাটা ভেজিয়ে শিবা গাড়িটার সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের সীটে বসে রইল কিছুক্ষণ। দুটো হাতের আঙুলের উপরের চামড়া জ্বালা করছে, ছাল উঠেছে কয়েক জায়গায়। আঙুলের গাঁটগুলোয় ব্যথা, মুড়লেই টাটিয়ে উঠছে।
সে সিদ্ধ ডিমটার খোসা ছাড়াতে শুরু করল। সারাদিনে দু—বেলায় দুটো ডিম শচীনকাকু সরাতে পারে বটকেষ্টর শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে। ব্যাপারটা হয় এইভাবে—অ্যালুমিনিয়ামের মগে একটি ডিম ভেঙে ফাটিয়ে তার সবটাই ওমলেট করার জন্য সসপ্যানে শচীন ঢালে না। প্রায় এক—পঞ্চমাংশ মগেই রেখে দেয়, খদ্দেররা সেটা টের পায় না। পাঁচটি ডিমে ছটি খদ্দেরকে তা থেকে ওমলেট করে দেওয়া যায়। একটি ডিম বাঁচে এবং শচীনের কাছ থেকে সেটি লুকিয়ে নিয়ে আসে ননী কিংবা শচীনই, এক সময় রিক্সাওয়ালাদের কাউকে দিয়ে আসে।
রাত্রে ট্রেনিং করে আসার পর শিবার অসম্ভব খিদে পায়। তখন ইচ্ছে করে তার আস্ত আস্ত গাড়িগুলো, পেট্রল গ্রীজ, প্লায়ার ব্রেঞ্চ, সিলিন্ডার গপগপ খেয়ে নিতে। পঁয়তাল্লিশ টাকা মাইনের চাকরিতে তার দুবেলার খিদে মেটে না। বাড়িতে এখন আর সে টাকা দেয় না। একদিন নিতু এসেছিল গ্যারেজে। শিবা তখন একটা মোটরের বনেট থেকে চেঁছে রং তুলছিল।
‘তুই এবার যাস নি বাড়িতে?’
শিবা জবাব না দিয়ে গভীর মনোযোগে কাজে ব্যস্ত থাকে। কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ্য করে নিতু বলে: ‘তুই আর টাকা দিবি না?’
শিবা ইতস্তত করে বলে : ‘আমার এখন টাকা লাগবে। আমি বক্সিং শিখছি….এই কটা টাকা বাড়িতে দিলে খাব কি?’
‘তুই বাড়িতেও যাস না আর।’
শিবা জবাব দেয় না।
‘তুই কি আমাদের ত্যাগ করলি?’
শিবা চুপ করে থাকে।
‘আমাদের ইউনিয়নের দাবির অনেকগুলো মালিক মেনে নিয়েছে, কিন্তু দু—তিনটে মানতে রাজি হয় নি। এবার ধর্মঘট হয় নি, হয়তো হবে কোনো এক সময়। তখন আমার রোজগার থাকবে না, তোকেই তখন…।’
‘বললুম ত’, অধৈর্য হয়ে গলা চড়িয়ে শিবা বলেছিল। ‘আমার খাওয়ার জন্য টাকা দরকার…আমার এখন খিদে পায়, খিদে পায়।’
কয়েক সেকেন্ড মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে নিতু বিমর্ষ মুখে চলে গেছল। শিবার কাছে তখন একুশ টাকা রয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় শ্রীকান্তের হাত দিয়ে সব টাকা সে বাড়িতে পাঠিয়েছিল। পরদিন শ্রীকান্ত দশ টাকা ফেরত এনে বলে: ‘নিতু তোকে দিল।’ পরের মাসের মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত শিবা জলমাখা ছাতু খেয়ে কাটায়।
ডিমটা খেতে খেতে শিবা ভাবছিল এখন সে কি খাবে? ডিমটা তার খিদেকে তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কৌটোয় ছাতু আর ছোলা ভিজানো আছে। এর সঙ্গে পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা যদি—শিবার মুখে লালা জমে উঠল।
গাড়ি থেকে নামতেই দেখল একটা ছায়া দরজা খুলে ঢুকল।
‘কে?’
‘আমি রে, আলোটা জ্বাল।’
শিবা সুইচের কাছে যেতে যেতে বলল, ‘বৌভাতের খ্যাঁট কেমন হল, সাঁটিয়েছিস খুব?’
চল্লিশ ওয়াটের বাল্বটা জ্বেলে শিবা দেখল, পকেট থেকে ননী কি যেন বার করায় ব্যস্ত।
‘নে ধর।’
এক তাড়া লুচি। অন্য পকেট থেকে বার করল চটকানো কয়েকটা বেগুনভাজা, মিহিদানায় মাখামাখি। অবশেষে দুটো মাছের টুকরো।
‘এর বেশি আর পারলাম না। ভাবলাম সন্দেশও হাতাব, তা একটা বাবু এমন নজর রাখতে শুরু করল—খা, খায়্যা নে, হাঁদার মতো দেখতিছিস কী?’
লুচিগুলো বিছিয়ে তার উপর মিহিদানা রাখতে রাখতে ননী বলে চলল, ‘প্যান্টটা রসে ভিজে গেছে, তোর এখানে জল আছে?’
টিনের ঘরের পিছনে বড় ড্রামে জল রাখা আছে। প্যান্টের বোতাম খুলতে খুলতে ননী আড়ালে চলে গেল।
শিবার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ঝুঁকে মাছের গন্ধটা নিল বুক ভরে। লুচিগুলোয় আলতো আঙুল বোলাল, ঠোঁট দুটো বেগুন ভাজায় ঠেকিয়ে, চাটল। যেন এক তোড়া গোলাপ সে পেয়েছে।
‘বুঝলি শিবা’, চেঁচিয়ে ননী কথা বলে চলল। ‘ভাবলাম বাড়িতেই নিয়া যাই। তারপর ভাবলাম ধুর, এই কটা ত জিনিস আর অতগুলো পেট, এক একজনের ভাগে কিসুই পড়বে না, তার থেকে বরং একজনই পেট ভর্যা খাক।’
শিবার মুখের মধ্যে তখন লুচি আর বেগুন ভাজা। সে শুধু মাথাটা নাড়িয়ে ননীর এই বিজ্ঞ সিদ্ধান্তের প্রতি অনুমোদন জানাল। কথা বলার মতো অবস্থা মুখের মধ্যে তৈরি হতেই সে বলল, ‘এই বিয়েবাড়ির খাবার খেয়ে আমার ছোট ভাই দুটো মরেছে। তুই বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে ভালই করেছিস।’
ভিজে প্যান্ট পরে ননী আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।
‘বুঝলি, তোর এখন খুব খাওয়া দরকার। না খেলি গায়ে জোর হয় না।’
‘আজ একটা ব্যাপার হয়েছে রে।’ শিবা মুখের মধ্যে একটা লুচি গুঁজে চোখ বুজে চিবোতে লাগল। ননী এক দৃষ্টে ওর খাওয়া দেখছে।
‘আজ ঘুসি মেরে হেভি ব্যাগটা ফাটিয়ে দিয়েছি।’
‘আরি সাবাস!’
‘হলধর টুর্নামেন্টে আশ্চোয্যোদা আমায় নামাবে।’
‘আরিঃ ববাস!’
‘আমাকে আরো ট্রেনিং করতে হবে, আরো খাটতে হবে, জোর বাড়াতে হবে।’
‘নিশ্চয়। এক কাজ করলি হয়, এখানেই বস্তা ঝুলায়ে তুই ঘুসি মারার কাজ করতি পারিস। সে আমি বস্তা আর বালি ম্যানেজ করে ফ্যালব।’
‘ট্রেনারের কাছে ট্রেনিং করতে হয়। চোখের সামনে করলে, ভুল ধরিয়ে দেয়, নতুন নতুন কায়দা দেখিয়ে দেয়।’
‘তুই বিকালে শিখে আসবি আর রাতে এখানে করবি। কালাসাহেবটা ত তোর মালিকের বন্ধু। ও কয়ে দিলে মালিক তোরে ছুটি দেবে বিকালেই।’
ফ্রাঙ্ক গোমসই এই চাকরিটা শিবাকে করিয়ে দিয়েছে। প্রথম লালবাগান জিমন্যাসিয়াম থেকে ফিরে সে ফাঁপরে পড়েছিল। চায়ের দোকান না ছাড়লে, তার পক্ষে ট্রেনিং করতে যাওয়ার উপায় নেই। চুপিচুপি সে শ্রীকান্ত দাসকে বলেছিল: ‘তোমাদের গ্যারেজে একটা কাজ দাও না শ্রীকান্তদা।’ শ্রীকান্ত বলেছিল দুর্লভ চক্রবর্তীকে: ‘রাতে একজনের গ্যারেজে থাকা দরকার। ছেলেটার সাহস আছে গায়ে জোর আছে, পাহারাও দেবে দিনের বেলাতেও কাজ করবে। বিশ্বাসী ছেলে আমার বাড়ির কাছেই ওর দাদা—মা থাকে, ভাল পরিবার।’
দুর্লভ সব শুনে বলেছিল ‘দেখি।’
এর দু—দিন পরেই গোমস আসে গ্রেট বেঙ্গলে। প্রথমেই সে খোঁজ নেয় শিবার তারপর নিজেই চলে আসে বটকেষ্টর দোকানে।
‘হ্যাললো তুমি ত গেলে না!’
দু—মিনিট পর সে শিবাকে টানতে টানতে আনে দুর্লভের সামনে।
‘এ ব্রিলিয়ান্ট ফাইটার, দুর্লভ। যদি আমার কাছ থেকে ফারদার কোনো কাজ চাও তাহলে একে কাম দাও। দারুণ জিনিস আছে এই ছেলেটার মধ্যে।’
পরদিন সকালেই শিবা কর্মস্থান বদল করে।
‘গোমস বললে হয়তো ছুটি দেবে।’
‘ব্যস। এবার বস্তা—টস্তা আমি ম্যানেজ করবখন। মন দিয়া তুই শুধু ঘুসি চালায়ে যা। আর শোন’, ননী গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এই মোটর গাড়ির কাজে কিন্তু বেশি খাটাখাটনির মধ্যে যাবি না।’
‘ফাঁকি দোব?’
‘হ্যাঁ। ঘুসির জন্য শরীরে শক্তি চাই। মোটরের পিছনে তা খরচ করিস না। যত পারবি কম খাটবি, বুঝলি?’
ননী চলে যাবার পর শিবা কয়েকটা লুচি আর মিহিদানা কাগজে মুড়ে রেখে, গ্যারেজের দরজায় তালা দিয়ে শুয়ে পড়ল মোটরের পিছনের সিটে। দু—মিনিটের মধ্যেই ঘুম তাকে জড়িয়ে ধরল।
সূর্য ওঠার আগেই শিবা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তখন কাকের ডাক, দু—চারটে লরি বা মোটর ভ্যানের ছুটে যাওয়া এবং কিছু পথিক তাদের শব্দ ও গতি দ্বারা এই আবছা পৃথিবীকে জীইয়ে রাখে। আজও সে রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করল। গোমস তাকে বলেছে : রিং—এ তোমার ডিফেন্স নির্ভর করবে পায়ের জোরের উপর। তোমাকে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে লড়তে হবে, অপোনেন্টের ঘুসির আওতার বাইরে লাফিয়ে সরে যেতে হবে। এজন্য ফুটওয়ার্ক দরকার। তোমাকে দম তৈরি করতে হবে। দৌড়ে দৌড়ে পায়ের জোর বাড়াতে হবে। রাস্তায়ই ক্লান্ত হতে হবে, তাহলে দেখবে রিং—এ যত শক্ত লড়াই হোক তার ক্লান্তি তুমি সয়ে যাচ্ছ। প্রতিদিন দৌড় বাড়াবে। কলজে টনটন করতে শুরু করবে। যখন এটা শুরু হবে তখন নিজেকে ঠেলে দেবে সেই যন্ত্রণার মধ্যে। ছুটতে থাকবে যন্ত্রণাকে হটাতে হটাতে। এই যন্ত্রণা জমা থাকবে তোমার শরীরে। যখন অন্যে তোমাকে মারবে, তোমার শরীর সেই মারের যন্ত্রণা দিব্যি হজম করে নেবে।
শিবা ছোটে আর গোমসের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করে। ফুটওয়ার্ক, ক্লান্তি, যন্ত্রণা—শব্দগুলোকে আলাদা করলে তার অর্থ সে বুঝতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে করে গোমস আধা হিন্দি, কিছু ইংরাজি আর বাকিটা বাংলায় মিশিয়ে যা বলেছিল শিবা তার অর্থ না বুঝলেও অন্তর্নিহিত ভাবটুকু মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছে। একবার গোমস বলে : ‘ইউ মাস্ট লার্ন টু হিট উইদাউট গেটিং হিট।’ কথাটার অর্থ সে বুঝতে পারে নি। গোমস পরে যখন তাকে রিং—এ তুলে আর একটি ছেলের সঙ্গে লড়তে দেয়, তখন বারবার বলতে থাকে ‘ইয়েস—ইয়েস দ্যাটস দ্য রাইট ওয়ে…’ শিবা পরে ভেবে দেখে যখন সে জ্যাব করেই নিমেষে পিছনে মাথাটা হেলিয়ে পালটা ঘুসি এড়াচ্ছিল তখনই গোমস ইয়েস ইয়েস বলে উঠছিল। ‘ঘুসি চালাতে দেবে। তোমার অপোনেন্ট বহুত ঘুসি চালাক, চালাতে চালাতে সে টায়ার্ড হয়ে যাবে। তুমি টোপ দাও… ওর হিটিং রেঞ্জের মধ্যে মাথা আনো, ও ঘুসি চালাবে, কুইক তুমি পিছনে তলিয়ে যাবে, ইউ লীন ব্যাক…তারপর ডাইনে কি বাঁয়ে চট করে সরে গিয়ে আবার জ্যাব কর, আবার জ্যাব…মাথা আনো হিটিং রেঞ্জে। ও আবার হিট করবে, তুমি মাথা পিছে হেলিয়ে দেবে…ওর ঘুসি আবার ফসকাবে। শুধু বাতাসে ঘুসি মেরে মেরে তোমার অপোনেন্টের স্ট্রেংথ বার হয়ে যাবে। সবার আগে তৈরি কর ডিফেন্স, কনসেনট্রেট অন টাইমিং অ্যান্ড মোশনস। ঘুসি থেকে সরে যাওয়া শিখতে হবে অনবরত প্র্যাকটিশ করে করে। তুমি কুইক আছ, অ্যান্ড ইউ গট দ্য ট্যালেন্ট।’
ট্যালেন্ট কাকে বলে? শিবা ডানলপ ব্রিজের পাশ থেকে বেঁকে দক্ষিণেশ্বরের দিকে ছুটতে ছুটতে ভেবে যায় ট্যালেন্ট কি—ক্রস, আপারকাট, জ্যাব বা হুকের মতো কোনো ঘুসির নাম?
যখন সে বিরাট খিদে নিয়ে গ্রেট বেঙ্গলে ফিরে এল তখন দেবদাস পাঠক রোডের উপর বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠছে। রাতে রেখে দেওয়া লুচি—মিহিদানার কথা মনে পড়ল। সেগুলো বার করে খেতে গিয়েই সে থমকে গেল। বাসি! এক মুহূর্ত ভেবে, গ্যারেজের বাইরে গিয়ে সে লুচি আর মিহিদানা ফেলে দিল।
.
জিমন্যাসিয়াম ঘরের মধ্যে দেয়াল ঘেঁষে বেঞ্চ। তিনটি ছেলে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে বসে আছে। তাদের পাশে একটা টুলে বসে শিবা। দরদর ঘামছে। কাঁধ দুটি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। সামনের ছেলে তিনটির দিকে আড় চোখে সে বারবার তাকাচ্ছে। আর মনে পড়ছে ভবানী স্যারের ঘরে ঠিক এইভাবেই সামনে তাকিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটা ছেলে। সেদিন তখন শিবার মনে হয়েছিল শ্মশানের দিকে সে তাকিয়ে। প্রত্যেকের চোখে একটা করে লাস।
ঘরের একদিকে হালকা ব্যায়ামে ব্যস্ত দু—জন। আয়নার সামনে একজন স্যাডো বক্স করে যাচ্ছে। বাইরে থেকে প্রচণ্ড দমকে হল্লার মতো একটা আওয়াজ উঠল। তার মধ্য থেকে বুদবুদের মতো দু—চারটে শব্দ ঘরের মধ্যে ভেসে এসে ফেটে পড়ল : ‘মার…মার…রক্ত বার করে দে…রক্ত চাই।’
হলধর বর্ধন বক্সিং টুর্নামেন্টের আজ প্রথম দিন। এখন ফ্লাই ওয়েটের প্রথম রাউন্ডের লড়াই চলছে। শিবা লাইট ওয়েটে লড়বে, কে তার প্রতিপক্ষ এখনো সে জানে না। নিজের ওজনের সঙ্গে আন্দাজ মিলিয়ে তার মনে হচ্ছে যে স্যাডো বক্স করে চলেছে বোধ হয় সেই। শিবা একদৃষ্টে তাকে লক্ষ করতে লাগল। হঠাৎ শিবার চোখ আয়নার দিকে পড়তেই দেখতে পেল ছেলেটি দু—হাত নামিয়ে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে, তারই মতো লক্ষ করছে তাকেই। কিছুক্ষণ পরস্পরের চোখের দিকে দু—জনে তাকিয়ে রইল।
‘মার মার—সাবাস, শুইয়ে দে—শুইয়ে দে।’
শিবার বুকের মধ্যে ধুকধুক শব্দটা জোর হয়ে উঠল। দু—পাশে তাকিয়ে সে এমন কোনো বস্তু দেখতে পেল না যা তাকে এই মুহূর্তে ভরসা দিতে পারে। গোমস এখন রিং—এর পাশে জাজ হয়ে বসে আছে। ওকে কাছে পেলে সে জিজ্ঞাসা করত ‘আমি কি করব এখন?’
লাউডস্পীকারে ফেদার ওয়েটের লড়াইয়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। একজন ব্যস্ত হয়ে বাইরে থেকে ঢুকল।
”কই কই, আরে এখনো তোরা এখানে বসে? ওয়ার্ম—আপও করিস নি! আয় আয়, আর করবার সময় নেই।”
বেঞ্চ থেকে দুটি ছেলে কলের পুতুলের মতো উঠে বেরিয়ে গেল। ওদের গেঞ্জিতে ছাপা ক্লাবের নাম দেখে শিবা জানল ওরা একই ক্লাবের ছেলে। তার সঙ্গে লড়াই পড়েছে, মহাদেব দাসের ইস্ট ক্যালকাটা ফিজিক্যাল কালচার অ্যাসোসিয়েশন অর্থাৎ সংক্ষেপে যা ই সি পি সি এ তারই একজনের সঙ্গে। নাম সুনীল বেরা।
দুটি লোকের সঙ্গে কান্তি ঘরে এল। তিনজনে এগিয়ে গেল, সুনীল বেরা যদি ওর নাম হয় তাহলে সুনীল বেরার দিকে। ওরা নিচু গলায় কি বলাবলি করল। কান্তি তাকাল শিবার দিকে। ওরাও তখন তাকাল। তারপর কান্তি মুচকি হাসল এবং একটু উঁচুস্বরে বলল, ‘হেভি ব্যাগ ফাটিয়েছে, আজ তোকে ফুটো করে দেবে।’
শিবা মুখ ঘুরিয়ে নিল। ভিতরে ভিতরে সে দমে যাচ্ছে। বেঞ্চে এখনো যে ছেলেটি বসে তার মুখে কৌতূহলের আভাস। শিবা আবার মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল।
‘পারবি ত শিবা একে ফুটো করে দিতে?’
শিবা চট করে তাকাল। সুনীল বেরার মুখ গম্ভীর। বুশশার্ট প্যান্ট পরা একটি ছেলে ঢুকল। বাঁ চোখের নীচেটা ফুলে উঠে চোখটা প্রায় ঢেকে গেছে। রগের কাছে প্লাস্টারে আঁটা তুলো। ওদের মধ্যে একজন ওকে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, ‘তোকে আর সুনীলের সেকেন্ড হতে হবে না, বিপ্লব হবে।’
ছেলেটি বেরিয়ে গেল। শিবার মনে এল তার উচিত একটু স্যাডো করে নেওয়া। কিন্তু এদের সামনে সে ক্রমশই আড়ষ্ট হয়ে আসছে। মনের মধ্যে একটা কেমন হীনবোধ কাঁধ দুটোকে চেপে তাকে বেঁটে করে দিতে চাইছে। ঘরটা থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে তখন শুনল কান্তি ওদের বলছে, ‘শুধু পাঞ্চের যা একটু জোর, একদম কাঁচা, ইজি তুই পয়েন্ট তুলে নিতে পারবি, টেকনিকের বালাই নেই।’
বাইরে এসে শিবা রিংটাকে দেখার চেষ্টা করল। শুধু রেফারি আর দু—জন বক্সারের মাথা, কাঁধ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রচুর ভীড়। বিশিষ্ট দর্শকরা রিং—এর ধারে চেয়ারে বসে, তার পিছনে লোকেরা দাঁড়িয়ে। তাদেরও পিছনে, বাঁশের কাঠামোর উপর গ্যালারিতে দর্শক। হাজার তিনেক মানুষ দেখছে, তাদের মধ্যে অর্ধেকই চিৎকার করছে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো।
সে পায়ে পায়ে সরে গেলে যেদিকে লালবাগান পার্কের মটুকনাথ মালির ঘর। এদিকটা অন্ধকার। শিবা মিনিট দুই স্যাডো বক্সিং—এর পরই ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করল। চুপ করে সে দাঁড়িয়ে রইল আলো—উদ্ভাসিত রিং আর ভীড়ের দিকে তাকিয়ে। গল গল ঘাম হচ্ছে। তোয়ালের জন্য সে ঘরের দিকে এগবে, এমন সময় পিছনে গলা শুনল মটুকনাথের।
‘তোমার লড়াই হয়ে গেছে?’
‘না, এবার হবে।’
‘ডর লাগছে?’
শিবা কথা বলল না।
‘যাকে তুমি ডর করবে, তার সামনে জলদি জলদি গিয়ে দাঁড়াও। ডর থেকে দূরে সরে থেক না, তাহলে আরো বেশি ডর লাগবে।’
ঢং করে একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বিকট একটা চীৎকার উঠল রিং—এর দিক থেকে। লড়াইটা শেষ হল। শিবা দ্রুত পায়ে ড্রেসিং ঘরের দিকে চলে গেল।
যখন তার নাম ডাকা হল, যখন সে সিঁড়ি দিয়ে রিং—এ উঠছে, তখন তার স্নায়ুগুলো পাকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে, যাবতীয় অনুভূতি ভোঁতা হয়ে অসাড়। সে কিছু জানতে, দেখতে, বুঝতে পারছে না। একবার তার মনে হল, দূরে গ্যালারি থেকে ‘ওস্তাদ’ বলে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। বোধ হয় হয় ননী। বলেছিল দেখতে আসবে। কাঁধের তোয়ালেটা কে যেন টেনে নিল। ক্লাবের তরফ থেকে অনিমেষ রয়েছে তার সেকেন্ডে। অনিমেষ তার গ্লাভসের লেস বেঁধে দিয়েছে, কোমরে বেঁধে দিয়েছে সবুজ রিবন, উৎসাহ দিয়ে অনেক কিছু বলেছে। কিন্তু শিবার কানে কিছুই ঢোকে নি।
রিং—এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রেফারি যখন হাত নেড়ে দু—জনকে ডাকল শিবা দম নেওয়া পুতুলের মতো এগিয়ে গেল। এখন সে একটা ব্যাপারই শুধু চাইছে, এই অসাড় অনুভূতিটা কেটে যাক তার স্নায়ু থেকে। যেভাবেই হোক তাকে প্রখর জ্যান্ত হতে হবে। তার সামনে সুনীল বেরা। তার কোমরে লাল রিবন বাঁধা, বুকে ইংরেজি অক্ষরে ‘ই সি পি সি এ’ লেখা গেঞ্জিতে। ওকে মেরে শুইয়ে দিতে হবে।
‘তোমরা দু—জনেই নিশ্চয় রুলস জান। যখন বলব ‘ব্রেক’ দু—জনেই এক পা পিছিয়ে যাবে, তার মধ্যে ঘুসি চালাবে না… পিছিয়ে গিয়ে তারপর আবার শুরু করবে। নো হিটিং বিলো দ্য বেল্ট। কিডনি পাঞ্চ…কোমরের পিছন দিকে এইখানে কিংবা র্যাবিট পাঞ্চ…ঘাড়ের পিছনে এই জায়গায়—একদম করবে না। যখন ‘স্টপ’ বলব থেমে যাবে, যখন ‘বক্স’ বলব লড়াই শুরু করবে। পরিচ্ছন্ন ভাবে লড়বে… গুড, ক্লিন, স্পোর্টসম্যান ফাইট।’
রেফারির নির্দেশনামা শিবার কানে একরাশ মাছির মতো ভনভনিয়েই উড়ে চলে গেল। সে তাকিয়ে সুনীলের চোখের দিকে। ধীরে ধীরে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মেরে শুইয়ে দিতে হবে—এই একটাই তার চিন্তা। তিন রাউন্ডের লড়াই, প্রতি রাউন্ড তিন মিনিটের—প্রতি সেকেন্ডে একটা করে ঘুসি মারা যায় বলেছিল গোমস। অসম্ভব। পরপর দ্রুত পাঁচটা ঘুসি চালালেই হাঁপিয়ে জিভ বেরিয়ে যায়। কোথায় গোমস?
নিজের কর্নারে শিবা দাঁড়িয়ে রিং—এর দিকে পিঠ ফিরিয়ে। ঠিক একইভাবে সুনীলও দাঁড়িয়ে তার কর্নারে, শরীরটা ঝাঁকাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আলোর ঝাপটা লাগা আধো—অন্ধকার গ্যালারিতে সার দিয়ে আবছা আবছা মুখ। রিং—এর ধারে গোমস বসে। টেবিলে কাগজ—পেন্সিল। গোমসের মুখ পাথরের মতো। কোনো রকম ইঙ্গিতের আঁচড়টুকুও নেই। রিং—এর কাছে বসা দর্শকদের মধ্য থেকে একজন পাশের লোককে বলল, ‘ইঁদুর, বেড়াল, শেয়ালের পর এবার দুটো মোষ উঠেছে।’
‘ঢং।’
টাইম—কীপারের ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল দু—জন।
‘বক্স।’
রেফারি দুহাত নেড়ে দুজনকে রিং—এর মাঝে আসতে সঙ্কেত জানাল।
মেরে শুইয়ে দেব, শুধু এই একটি নির্দেশ শিবার মাথা থেকে নেমে এল পা পর্যন্ত। দুটো গ্লাভস মুখের সামনে ধরে একটা বুনো শুয়োরের মতো সে সোজা তেড়ে গেল থুতনিটা বুকের দিকে চেপে ধরে।
তিন মিনিট পর প্রথম রাউন্ড শেষ হবার ঘণ্টা পড়তে বিভ্রান্ত, ঘোরলাগা চোখে শিবা ফিরে এল নিজের কর্নারে। হাপরের মতো বুকটা ওঠানামা করছে। ততক্ষণে অনিমেষ লাফ দিয়ে রিং—এর মধ্যে উঠে এসেছে একটা টুল নিয়ে। শিবাকে টুলে বসিয়ে দিয়ে সে হাঁটু ভেঙে কুঁজো হয়ে শিবার পা—দুটো তুলে নিয়ে নিজের ঊরুর উপর রাখল। লজ্জায় পা টেনে নিচ্ছিল সে কিন্তু অনিমেষ প্রায় ধমকে উঠল, ‘রাখ।’ বালিশের মতো পুরু কর্নার প্যাডিংটায় হেলান দিয়ে শিবা চোখ বুজল।
অনিমেষ তোয়ালে দিয়ে তার হাত, মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতা শিবার জীবনে এই প্রথম। কেউ তার গায়ে এত নরমভাবে কখনো হাত দেয় নি আর এতগুলো ঘুসিও সে মুখে আর শরীরে এত কম সময়ে পায় নি।
‘হয়েছে কি তোর, এত মার খাচ্ছিস কেন? এত তাড়াহুড়ো কচ্ছিস কেন, আরো দু—রাউন্ড লড়তে হবে খেয়াল নেই? জল খা।’
অনিমেষ জলের বোতলটা দিতেই শিবা তিন—চার ঢোঁক জল খেল। তোয়ালেটাকে ভাঁজ করে পাখার মতো নেড়ে অনিমেষ তাকে হাওয়া দিয়ে চলেছে।
‘বোকার মতো শুধু অ্যাটাকই করে যাচ্ছিস। ও কত সুইফট সরে গিয়ে হিট করছে! এলোপাথাড়ি রাইট ক্রস আর চালাস নি। তোর মুখ খোলা পাচ্ছে আর মেরেই সরে যাচ্ছে। ডিফেন্স ঠিক রাখ।’
দুটি রাউন্ডের মাঝে এক মিনিটের ইন্টারভ্যাল। এই সময়ের মধ্যেই শিবার সেকেন্ড অনিমেষ ঝড়ের বেগে কথার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করে চলল। অপর কোণেও একই দৃশ্য। শিবা এখনো বুঝতে পারছে না কি তার ভুল হচ্ছে।
‘ঢং।’
দ্বিতীয় রাউন্ড শুরুর ঘণ্টা পড়ল। হঠাৎ দর্শকদের একটা উৎকট বীভৎস ধ্বনি তাকে ঘিরে পাকিয়ে উঠল।
‘হিট হিট…নক আউট চাই, নক আউট চাই…।’
শিবা এবারও তেড়ে গেল বুনো শুয়োরের মতো। নক আউট। নক আউট। তার মাথার মধ্যে একটিই কথা, নক আউট।
তিন মিনিট পর, ঘণ্টা বাজতেই শিবা ফিরে এল তার কর্নারে। দ্বিতীয় রাউন্ডে একবার মাত্র সে একটা লেফট হুক সুনীলের ডান পাঁজরে বসাতে পেরেছে। ঘুসিটা খেয়েই সুনীল ছিটকে পিছিয়ে যায় চোখে বিস্ময় নিয়ে। যন্ত্রণায় শরীরটা একবার কুঁকড়ে গিয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। শিবা যতবার তেড়ে যায়, সে ঘুরে ঘুরে এড়িয়ে রাউন্ডটা শেষ করে।
‘দড়িতে চেপে ধর। ইন ফাইটিং—এ যেতে চাচ্ছে না—কর্নারে নিয়ে যা। আজেবাজে চালাচ্ছিস তুই, দম ধরে রাখ।’ অনিমেষ তার বুদ্ধি অনুযায়ী পরামর্শ দিল। শিবা চোখ বুজে হাঁফাচ্ছে। চোখ খুলে দেখল তার বিপরীত কর্নারে সুনীল টুলে বসে, দু—হাত, দু—পাশে দড়ির উপর ছড়ানো। রিং—এর বাইরে থেকে কান্তি তাকে কি সব বলে যাচ্ছে।
‘ঢং।’
শিবা রিং—এর মাঝে পৌঁছে সুনীলের মুখোমুখি হবার সঙ্গে সঙ্গেই অতর্কিতে লেফট—রাইট কম্বিনেশন পাঞ্চিং—এর সামনে থ হয়ে গেল। দুটোই তার মাথায় আঘাত করেছে। প্রতিপক্ষ হঠাৎ এইভাবে মারমুখী হবে, সে ভাবে নি। তার মাথার মধ্যে গুনগুন করে উঠল ভোমরা। সেই সময়ই একটা ক্রশ এগিয়ে এল তার চোয়ালে এবং ছিটকে পড়ার মুহূর্তে সে দেখল একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। দপদপ করছে গাঢ় হলুদ আর সবুজ আলো।
রিং—এর মেঝেয় হামা দেবার মতো অবস্থায় হাত ও পায়ে ভর দিয়ে শিবা মাথা ঝাঁকাল। চারিদিক সে ঝাপসা দেখছে। গ্যালারি থেকে ছিটকে আসছে উল্লাস ‘আরো, আরো।’ বক্সিং—এর দর্শকদের মতো নিষ্ঠুর পাগল এবং রক্তপিপাসু পৃথিবীতে কোনো খেলায় নেই।
‘…সেভেন….এইট…’
রেফারি গুণে চলেছে। দশ হলে নক আউট। শিবা উঠে দাঁড়াল। মাথার মধ্যে ভোমরা ডাকটা বন্ধ করে দিতে হবে। সুনীল আবার তেড়ে আসছে, শিবা পিছিয়ে এল। মাথার মধ্যে যে জট পাকিয়ে গেছে সেটা খুলতে হবে।
শিবা সরে যেতে লাগল সুনীলের নাগালের বাইরে।
‘পালাচ্ছে, পালাচ্ছে—ব্যাটাকে ধর। মুখ ফাটিয়ে দে।—কিল, কিল হিম।’
শিবার মাথার মধ্যে শব্দগুলো গোলার মতো ঢুকে, গুম গুম আওয়াজে ফেটে জট খুলে দিচ্ছে, চোখের সামনে থেকে কুয়াশা সরিয়ে দিচ্ছে। তার চেতনায় এখন একটিই কথা : আত্মরক্ষা, বাঁচতে হবে।
‘হেভি ব্যাগ ফাটিয়ে দিয়েছে বলে গুজব রটিয়েছে। বোগাস, মিথ্যুক।’
কে বলল? কান্তি না বেচু? সুনীলের জ্যাব থেকে মুখ সরিয়ে নিতে নিতে শিবা রিং—এর আর এককোণে হটে এল। কে বলল কথাটা? সুনীল এগিয়ে এসেছে। তার কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত ফণার মতো দুলছে। দু—হাত তুলে মুখটা আড়াল করে শিবা পরপর ঘুসি নিতে লাগল হাতে, পাঁজরে। তারপর সে সুনীলের গলা প্রায় জড়িয়ে ধরল। একটা আপার কাট তলা থেকে তার থুতনি লক্ষ করে উঠে এল। তেমন জোর নেই পাঞ্চটায়। দু—জনের হাত যেন জট পাকিয়ে জড়াজড়ি করছে।
‘ব্রেক।’
রেফারি চেঁচিয়ে হুকুম দিতেই দু—জনে এক—পা পিছিয়ে গেল। আর তখনি রাউন্ড এবং লড়াই শেষের ঘণ্টা বাজল।
জাজেদের কাছ থেকে রেফারি স্কোর লেখা কাগজ সংগ্রহ করে যাচ্ছে। দুই বক্সার নিজেদের কর্নারে অপেক্ষমাণ ফল ঘোষণার জন্য। শিবা মুখ তুলে গ্যালারির দিকে তাকাল। সবাই জানে ফল কি হবে, শিবাও জানে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠোঁট টিপে সে সামাল দিচ্ছে। রেফারি হাত নেড়ে দু—জনকে ডাকল।
‘উইনার সুনীল বেরা।’
রেফারি বাঁ হাতে উঁচু করে তুলে ধরল সুনীলের ডান হাত। রেফারির ডান হাতে ধরা শিবার বাঁ হাত। সেটা উঠল না। আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিল শিবা। সুনীল এগিয়ে এসে দু—হাত বাড়াল, শিবাও দু—হাত বাড়াল। হ্যান্ডশেক করে সুনীল ওর পিঠে গ্লাভসের চাপড় দিল। শিবার মনে হল তপ্ত চাটু তার পিঠে কেউ ছোঁয়াল।
রিং থেকে নামার সময় শিবা শুনতে পেল—শিস দেওয়ার আওয়াজ। ওরা হয়তো ই সি পি সি এ—র ছেলে। ”বলহরি হরিবোল”—চীৎকার করল একজন।
ড্রেসিংরুমে যাবার পথটা জুড়ে লোকেরা দাঁড়িয়ে। ভীড় কেটে কিভাবে যাবে। পথ খুঁজতে গিয়েই চোখে পড়ল বিশিষ্ট দর্শকদের মধ্যে চেয়ারে বসে রয়েছে সাধু, একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। এক চিলতে হাসি যেন সাধুর ঠোঁটজোড়াকে বেকিয়ে রেখেছে। শিবা মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
এখান থেকে এখুনি তাকে পালাতে হবে।
.
গ্যারেজে মোটরের চালে শিবা চীৎ হয়ে শুয়ে। প্রায় আধঘণ্টা এইভাবে সে আকাশের দিকে মুখ করে, ঝকঝকে কালো পাথরের গায়ে শাদা চূণের হাজার হাজার ফোঁটার মতন, তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে। একটু আগেই তার দু—চোখের কোণ বেয়ে জল নেমেছিল। এত নিঃসঙ্গ, একা সে জীবনে বোধ করে নি। তার বারবার মনে পড়েছে, মা, দাদা, ছোট দুটো মরা ভাই, প্রতিবেশী শক্তিমামা, সাগরমামী, শচীনকাকুদের কথা, ওর এখন ইচ্ছে করছে বক্সিং ছেড়ে, এই গ্যারেজের কাজ ছেড়ে ফিরে যায় বাড়িতে, আবার বটকেষ্টর দোকানে।
‘ক্যাঁচ’ শব্দ হল গ্যারেজের দরজা খোলার।
একটা ছায়া ভিতরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। শিবাকে খুঁজছে।
‘এখানে।’
ছায়াটা এগিয়ে এসে গাড়ির পাশে দাঁড়াল। ননী।
‘তোরে দেখলাম বাসে উঠছিস, ডাকলাম না।’
‘তুই গেছলি।’
ননী জবাব দিল না। হাতটা তুলে বাড়িয়ে দিল শিবার দিকে। হাতে একটা সিদ্ধ ডিম।
‘খিদে নেই।’
‘শচীনকাকু কয়েছিল ফিরে এসে তারে জানাতে।’
‘জানিয়েছিস।’
‘হ্যাঁ।’
ডিমের খোসা ছাড়িয়ে ননী আধখানা কামড়ে নিয়ে, বাকি আধখানা শিবার হাতে দিল। কিছুক্ষণ চীৎ হয়ে নিথর থেকে, স্প্রিং—এর মতো ছিটকে সে উঠে বসল। পাঁচিলের উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল ডিমের টুকরোটা। তারপর দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল মোটরের চালে।
‘আমি ছেড়ে দেব বক্সিং।’
‘সেই ভাল। তাই—ই বরং ভাল। তোর দ্বারা ফাইট চলবে না। ফাইটার অন্য ধাতুতে গড়া হয়।’
‘কি ধাতু?’
‘তা জানি না। তবে ঘটিবাটি থালার ধাতু নয়। এ হচ্ছে মনের ধাতু। স্বামী বিবেকানন্দর ছবিটা দেখেছিস স্যারের ঘরে? চোখ দিয়া যেন আগুন ঠিকরায়।’
শিবার মনের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা ঝলসে উঠল এই মুহূর্তে : আমি নুইব না, নুইব না। ধীরে ধীরে শিবার শিরা—উপশিরায় তপ্ত জোয়ার ফুলে ফুলে উঠতে শুরু করল। কিছু একটা করার প্রবল তাড়না তার শরীরকে গ্রাস করছে। সাধুর বাঁকা ঠোঁট আর চাহনিটা দপ দপ করে উঠল চোখের উপর। কানের কাছে কারা যেন কথা কইছে। বোগাস: বোগাস।
মোটরের চাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে শিবা ছুটে গেল গ্যারেজের অন্ধকার একটা কোণে। দু—হাতে প্রায় একমণ ওজনের বালিভর্তি হেভি ব্যাগটা বয়ে আনল সে কপিকলটার কাছে। দড়িটা কলে লাগিয়ে টান দিয়ে ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে বাঁশের সঙ্গে দড়িটা বেঁধে নিল।
‘আয় ননী, আমাকে হেল্প কর। ব্যাগটা দুলিয়ে ছুঁড়ে দে আমার দিকে। এইভাবে।’
বলতে বলতেই শিবা ঝোলানো ব্যাগটা দু—হাতে ঠেলে দুলিয়ে দিল। দুলে পিছনে গিয়ে সামনে এগিয়ে আসছে ব্যাগটা, শিবা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই ব্যাগটা তার পেটের উপর আছড়ে পড়ল।
‘এবার তুই এভাবে দুলিয়ে যা।’
তিন মিনিট পরেই শিবা হাঁফাতে হাঁফাতে বসে পড়ল। তার বুক, পেট, মুখ যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে। কলজে নিংড়ে বেরিয়ে গেছে যাবতীয় বাতাস। গোঙানির মতো শব্দ করতে করতে সে মুখ তুলে বাতাস গিলছে।
‘হয়ে গেল? এইটুকু ট্রেনিং করেই হয়ে গেল? এতেই তুই ফাইটার হবি? ওঠ ওঠ।’
হঠাৎ ননী, তার সরু দুটি পায়ের অন্যতম, ডান পা দিয়ে শিবার পিঠে লাথি কষাল।
‘লজ্জা করে না তোর? হাজার লোকের চোখের সামনে মার খেয়ে এলি, লজ্জা করে না।’
আবার সে লাথি কষাল শিবার পিঠে। প্রথমটিতে শিবা চমকে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়েছিল। বিশ্বাস করতে পারছিল না ননী এমন এক দুঃসাহসিক কাণ্ড করতে পারে, দ্বিতীয়টিতে সে খেপে গিয়ে লাফিয়ে উঠে ননীর জামাটা মুঠোয় ধরে তাকে ঝাঁকাতে শুরু করল।
‘ব্যাপার কিরে, তোর সাহস ত কম নয়! পা—টা যদি ভেঙে দিই।’
‘গায়ে জোর বেশি তোর, ভাঙতে ত পারবিই। কিন্তু আজকের লজ্জা কি তাতে ভাঙবে?’
হঠাৎ শিবার মনে হল, সে যেন সাধু আর ননী যেন ভবানী স্যার। সাধুর মতোই তার মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে—পা—টা যদি ভেঙে দিই।
‘শচীনকাকুকে কওয়া মাত্র ওর মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাল অনেকেই জিগাবে, শিবা জিতছে ত?’
‘আমি কি করব’, শিবা চাপাস্বরে ভাঙা গলায় বলল। ‘মানুষ মাত্রেই হারে।’
‘মানুষ জেতেও। তার জন্য মনের জোর চাই।’
শিবা আবার চলে গেল অন্ধকার কোণটায়। ফিরে এল একজোড়া ছেঁড়া গ্লাভস নিয়ে। আশ্চর্য ঘটকের দেওয়া উপহার।
‘পর তুই।’
‘কেন?’
‘বলছি যা তাই কর।’
ননী গ্লাভস জোড়া মুঠোয় গলাল। মোটরের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শিবা বলল, ‘এবার আমায় মার। কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত যেখানে খুশি পাঞ্চ করে যা, যত জোরে পারিস।’
ননী কয়েক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘রাগ করেছিস আমার ‘পর?’
‘রাগ—ফাগ করলে এতক্ষণে তুই ছাতু হয়ে যেতিস। ক্লে যেভাবে ট্রেনিং করে আমিও সেভাবে করব, মার আমাকে।’
‘ক্লে আবার কে?’
‘একটা মানুষ, নে মার।’
ননী দু—হাতে এলোপাতাড়ি ঘুসি চালাচ্ছে। বনেটে হেলান দিয়ে দু—হাত মুখের কাছে তুলে, শিবা অন্ধকারে নিছকই আন্দাজে, হাতের উপর, মাথায় এবং পেটে ঘুসি দিতে লাগল। গোটা পনেরো ঘুসি বসাবার পর ননী হাঁফিয়ে উঠে থেমে পড়ল। গা ঝাড়া দিয়ে শিবা সিধে হয়ে দাঁড়াল। ঘুসিগুলো অত্যন্ত হালকা, নিতে কোনো অসুবিধা হয় নি। ননী তা বুঝতে পেরে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘রিক্সা চালাই, হাতের থেকে তাই পায়েই জোরটা বেশি। বক্সিং যদি পা দিয়ে লড়া হয়, তোরে প্রথম রাউন্ডেই নক আউট করব।’
চারদিন পর সন্ধ্যায় লালবাগানে রিং—এর ধারে শিবার কাঁধে হাত রেখে গোমস বলল, ‘জীবনের প্রথম ফাইট তুমি হেরেছ। হার কাকে বলে না জানলে, জিত কাকে বলে জানা হয় না। ইটস অ্যান এডুকেশন। শিক্ষা যদি নিতে পার তাহলে বড় হতে পারবে। শিবা এই কথাটা জেনে রাখ, চ্যাম্পিয়ন জিমে তৈরি হয় না। চ্যাম্পিয়ন তৈরি হয় তাদের ভিতরের, একেবারে ভিতরের জিনিস থেকে, সামথিং দে হ্যাভ ডীপ ইনসাইড দেম। —সেটা হল ইচ্ছা, একটা খোয়াব একটা ভিসন। মনের মধ্যে এটা না থাকলে, কেউ বড় হতে পারে না শিবা। আর চাই স্ট্যামিনা, ফাস্ট হতে হবে, স্কিল থাকা চাই আর চাই মনের জোর যাকে বলে উইল। স্কিলের থেকেও স্ট্রংগার হবে উইল। তুমি দেখবে, অনেক ফাইটার হারে তার থেকেও লেস স্কিলফুল অপোনেন্টের কাছে। কেন? ওই উইলের কমতি থাকে বলে। তুমি সেদিন প্রথমেই মার খেয়ে বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলেছিলে। মাথার মধ্যে গোলমাল হয়ে যায়। তোমার স্কিল, স্ট্রেংথ, স্ট্যামিনা বেশি থাকা সত্ত্বেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে লড়তে পার নি। তোমার ইচ্ছাটা খারাপ পথে চলে গেছল, শর্ট কাটে লড়াই জেতার কথা ভেবেছিলে। তুমি অপোনেন্টকে মাপিয়ে নাও নি, জানতে চেষ্টা কর নি তার ক্ষমতা কত, তার গলদ কোথায়। ফাইটারস আর ডিসকভারারস। তারা নিজেদেরও ডিসকভার করে। একটা কথা মনে রেখ, কি করতে হবে, কিভাবে ফাইট করবে এটা বাইরে থেকে কেউ বলিয়ে দিতে পারে না। তোমাকে নিজে সেটা ঠিক করে নিতে হবে। এজন্য তোমার মাথা, বুদ্ধি, মন এসব তৈরি করতে হবে। সবার আগে চাই ইচ্ছা…ডিজায়ার।
ধীরে ধীরে গোমস কথাগুলো বলে গেল। কখনো মাটির দিকে কখনো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শিবা শুনল। সন্ধ্যার ধূসর আকাশ থেকে রাত্রি ঝরে পড়ছে। গোমস ক্রমশ আবছা হয়ে উঠছে। কিন্তু ওর ভারী মৃদু কণ্ঠস্বর শিবার মনের মধ্যে তরঙ্গহীন ভোরের গঙ্গার মতো শান্ত অথচ গভীর অনুভব তৈরি করে দিচ্ছে। তার মনে হচ্ছে যেন রেল লাইনের মাঝ দিয়ে বা বালি ব্রিজের উপর দিয়ে সে ছুটছে। টাটকা ভোরের বাতাস ফুসফুস টেনে নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে শিরায় শিরায়। ভোরের আলোর মতো তাজা হয়ে উঠছে ক্লান্ত দেহটা, সেই সঙ্গে তার মনও।
‘ভাল কথা চিন্তা করবে, ভাল লোকের বন্ধু হবে। সিনসিয়ার আদমি, অনেস্ট আদমি এদের কাছাকাছি থাক তাদের দেখে তুমি ইনস্পিরেশন পাবে। ভাল বড় আদমি মানে সাধু প্রফেট কি রিচম্যান নয়, গরিব কমনম্যান যার সিনসিয়ারলি কাজ করে, অনেস্টলি চেষ্টা করে নিজের জন্য, বালবাচ্চচার জন্য। শিবা, একটা জিনিস লক্ষ্য করবে, একটা প্লেয়ার টুর্নামেন্টে ইনডিভিজুয়ালি যা খেলে তার থেকে অনেক বেশি জোর দিয়ে খেলে যখন দেশের হয়ে রিপ্রেজেন্ট করে। কেন? তখন তার ইনস্পিরেশন থাকে দেশ আর পিপল। তুমিও লড়বে যখন তোমার নিজের পিপলের কথা তোমার মনের মধ্যে থাকবে।’
রাতে ফিরে এসে শিবা মোটরের চালে চীৎ হয়ে অনেকক্ষণ ভাবে গোমসের কথাগুলো। গ্যারেজের দরজা খোলার শব্দ শুনে সে তড়াক করে লাফিয়ে নেমেই বলল, ‘জানিস ননী, আর দু—মাস পরই বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নের লড়াই হবে। আমি নামব, গোমস বলেছে।’
‘তাহলে বস্তাটাকে ঝোলা, কাম শুরু কর আর এই আপেলটা ধর। বিকালে এক প্যাসেঞ্জার রিক্সা থেকে নামবার সময় থলি ধরতে দিছিল। একটা ম্যানেজ করে রাখছি।’
আপেলে কামড় দেবার আগে শিবা বলল, ‘হ্যাঁরে পিপল মানে জানিস?’
.
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার জন্য শিবার মোট সময় লাগল, প্রথম লড়াইয়ে এক মিনিট, পরের লড়াইয়ে ২০ সেকেন্ড। ডান হাতের দুটি কঠিন পাঞ্চ তাকে দুটি নক আউট এনে দিয়ে বক্সার মহলে সাড়া ফেলে দেয়। চ্যাম্পিয়নশিপ চলছে বৌবাজারে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের এস ও পি সি রিংয়ে। এবার শিবা ছাড়া আর কেউ নক—আউট করে ফাইনালে উঠতে পারে নি। ফাইনালে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সুনীল বেরা। চ্যাম্পিয়নশিপে এখন যাবতীয় চোখ লাইট ওয়েট ফাইনালের দিকে। এস ও পি সি থেকে উপচে ধর্মতলা স্ট্রিটের ফুটপাত গড়িয়ে ট্রাম লাইন পর্যন্ত ভীড়।
ওদের চোখাচোখি হল রিং—এর মাঝে হ্যান্ডশেকের সময়। নিথর অথচ কঠিন দু—জোড়া চাউনির সংঘর্ষ থেকে ফুলকি ছিটকাল। চীৎকার ভেসে এল গ্যালারি থেকে: ‘নক আউট…নক আউট চাই।’
রেফারির প্রথা মাফিক নির্দেশ বিতরণের পর ওরা দু—জন নিজেদের কর্নারে ফিরে এল। শিবা আলতো চোখ বোলাল রিং—এর ধারে বসা বিশিষ্ট দর্শকদের উপর। গোমস ও আশ্চর্য ঘটক দাঁড়িয়ে তার কাছেই। হেসে মাথা নাড়ল গোমস। শিবাও মাথা নাড়ল। না, সে আগের মতো তেড়ে যাবে না। রিং—এর ধার ঘেঁষে অনিমেষ। এবারও তার সেকেন্ড। অনিমেষের পাশে উবু হয়ে বসে ননী। ফিসফিসিয়ে সে বলল, ‘ওস্তাদ…পিপল তোর কাছেই আছে।’
হাসতে গিয়ে শিবার চোখ আটকে গেল একজোড়া চোখে। টকটকে ফর্সা, ধুতি—পাঞ্জাবি পরা, সোনার ফ্রেমের চশমা চোখে আঁটা লোকটির পিছনে তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিয়ে চেয়ারে বসে রয়েছে সাধু। ঝুঁকে সে সামনের ফর্সা লোকটিকে কিছু কথা বলে আবার তাকাল। ঠোঁটে যেন এক চিলতে হাসি।
‘ঢং।’
শিবা এগল। সতর্ক, ধীর গতি। কাছাকাছি এসে ঘুরতে শুরু করল। আগে আসুক সুনীল, ঘুসি বাড়াক। শিবা একটু এগিয়ে ঘুসির পাল্লার মধ্যে মুখটা আনল। একটা লেফট জ্যাব তার মুখের দিকে এগিয়ে এল। শিবা পিছনে হেলে মুখটা সরিয়ে নিল অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। জ্যাব করতে সুনীল একটু ঝুঁকে পড়েছিল, ডান হাতটা সরে গেছে মুখটাকে খুলে দিয়ে। প্রচণ্ড একটা লেফট—হুক ওর মুখে বসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মুখটা একটু পাল্লার বাইরে রয়েছে, পাঞ্চের পিছনে জোর দেওয়া যাবে না। আর একটু কাছের থেকে, আর একটু এগিয়ে বাগের মধ্যে আনার পর বসাতে হবে। অযথা ঘুসি নষ্ট করতে শিবা রাজি নয়।
পরপর দুটো জ্যাব ছুঁড়েই সে পিছিয়ে গেল। সুনীল এগচ্ছে। শিবাও এগল। চোখে চোখ দু—জনেরই। শিবার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এবার সুনীল কি করবে। শিবা বাঁ হাতের ছোট্ট একটা আঘাত দিল মাথায়। দর্শকদের মর্মর গুঞ্জনটা জোর হয়ে উঠল। সুনীল সবেগে ডান হাত চালাল পাঁজর লক্ষ্য করে। শিবার কনুই চকিতে আটকে দিল। মুখটা তার খোলা। সুনীল বাঁ হাতের ঘুসি মুখ লক্ষ্য করে চালাতেই শিবা হেলে গিয়ে মুখ সরিয়েই দেখল, ঘুসির ঝোঁকে সুনীল মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলেছে। মুখের সামনে গার্ড নেই। বিদ্যুৎ গতিতে শিবার লেফট হুক সুনীলের চোয়ালে গিয়ে পড়ল। তারপরই ডান হাতের সোজা ঘুসিটা।
উত্তাল চীৎকারের মধ্যে শোনা গেল না সুনীলের পতন শব্দ। চীৎ হয়ে নিঃসাড়ে সে পড়ে রইল। রেফারি হাত নেড়ে শিবাকে নির্দেশ দিল কাছের কর্নারটিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে। শিবা কর্নারে চলে যাবার পর রেফারি গুণতে শুরু করল হাতটাকে উপর—নীচ করাতে করাতে : ‘ওয়ান…টু…থ্রি’ এবং ‘টেন’ বলার পরও সুনীল একইভাবে মেঝেয় পড়ে আছে দেখে শিবাকে ডাকল রিং—এর মাঝে আসার জন্য।
শিবার বাঁ হাত রেফারি উপরে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ননী তড়াক করে লাফিয়ে দড়ি রিং—এর মধ্যে শিবাকে পিছন থেকে জড়িয়ে পিঠে মুখ ঘষতে শুরু করল।
‘ওস্তাদ ওস্তাদ।’ ফিসফিসিয়ে ননী বলল, ‘তোরে রিক্সায় বসায়ে প্রোসেশান করে ঘোরাব। আজ তুই বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন।’
সুনীলকে তিন—চারজনে ধরাধরি করে রিং থেকে বার করে নিয়ে গেল। শিবা নামতেই আশ্চর্য ঘটকের বিরাট থাবা তাকে টেনে নিল বুকের মধ্যে।
‘এভাবে প্রত্যেকটা খেলায় নক আউট আমি দেখি নি রে কখনো। লালবাগানের ইজ্জত বাড়িয়ে দিলি।’
শিবা ঝুঁকে তাকে প্রণাম করে উঠতেই শুনল গোমস বলছে: ‘ঘোটোক তোমাকে বলেছিলাম যা এবার তা মিলিয়ে নাও। ঝুটা কি সাচ্চচা আমি ঠিক চিনতে পারি কিনা।’
শিবা তাকেও প্রণাম করতে যেতেই গোমস হাত দুটি ধরে ফেলে শুধু বলল, ‘আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড টু—ডে। এবার হার্ড ট্রেনিং ন্যাশনালের জন্য।’
‘সে আমি আইজ রাত থেকেই শুরু করাব।’ ননী বলল আশ্চর্যের বিরাট দেহের পিছন থেকে।
ড্রেসিং রুমে সুনীল বেঞ্চে বসে আছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। শরীর ক্লান্ত অবসন্ন। শিবা গিয়ে তার হাত দুটি ধরে ঝাঁকাল। নিরাসক্ত চোখে সুনীল তাকাল। ফিকে হাসল। লালবাগানের কয়েকটি ছেলে শিবাকে ঘিরে রয়েছে। তাদের সরিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কান্তি এল। বলল, ‘কনগ্র্যাচুলেশন নতুন করে আর কি জানাব। জানতুমই তুই নক আউট করবি। যা পাঞ্চের জোর, সুনীলের মুখটা আস্ত রয়েছে কি করে ভেবে পাচ্ছি না।’
মিনিট পাঁচেক পর, যখন লাইট—ওয়েল্টার ফাইনাল চলছে, এক শীর্ণকায় প্রৌঢ় শিবার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলবেন গোরাবাবু, একবার বাইরে আসবে?’
‘কে গোরাবাবু!’ শিবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল!
‘উনি খেলাধুলোর একজন বড় পেট্রন। অনেক ক্লাব ওর টাকায় বেঁচে আছে। তোমার লড়াই ওর ভাল লেগেছে, তাই একটু কথা বলবেন।’ একটু থেমে লোকটি যোগ করল, ‘মস্ত ব্যবসায়ী কারখানা আছে দু—তিনটে।’
খালি গায়ে তোয়ালেটা জড়িয়ে শিবা বেরিয়ে এসে যাকে দেখল, তাকেই সে দেখেছে পিছনে মুখ ফিরিয়ে সাধুর সঙ্গে কথা বলতে। ফর্সা রং ধুতি—পাঞ্জাবি, সোনার ফ্রেমের চশমা, মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা।
‘বেশ লড়েছ।’ গোরাবাবু মিহিস্বরে, মৃদু ধীর ভঙ্গিতে বললেন এবং শিবার পিঠে চাপড় দিলেন। ‘কোথায় থাক, কি কর।’
‘বনহুগলির কাছে থাকি। মোটর সারাইয়ের গ্যারেজে কাজ করি, থাকিও সেখানে।’
‘কে আছে তোমার?’
‘কেউ নেই।’ বলেই শিবার মনে হল, একথা কেন বললাম? মা, দাদা, এরা ত আছে! তাহলে হঠাৎ মুখ দিয়ে কেন বেরিয়ে এল ‘কেউ নেই।’
‘পড়াশুনো কতদূর করেছ?’
‘ক্লাস সেভেন পর্যন্ত।’
‘কাজ করবে? না না, তোমার বক্সিং—এর ক্ষতি হয় এমন কিছু কাজ নয়। আমার বাড়িতেই থাকবে। খাওয়াও আমার, মাইনেও দেব।’
শিবা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঢোঁক গিলে বলল, ‘কি কাজ?’
‘সামান্যই কাজ। তুমি এসো না আমার বাড়ি তখন বলব আর এই নাও।’
গোরাবাবু একটি একশো টাকার নোট এগিয়ে ধরলেন ‘আজকের নক আউটের পুরস্কার। ধরো।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিবা হাত বাড়িয়ে নোটটা নিল। গোরাবাবু নাম ঠিকানা লেখা কার্ডটা দিলেন। যাবার সময় আবার বললেন ‘খুব খাটুনির কাজ নয়। গ্যারেজে আর কতদিন বাস করবে। এবার ভাল খাওয়া—দাওয়া, থাকা তোমার দরকার।’
কথাটা রাত্রেও তার মনের মধ্যে দপদপ করে উঠল রাস্তার সিগন্যাল আলোর মতো। চিরকাল কি সে মোটর গাড়ির মধ্যে রাত কাটাবে? দুপুরের দিকে একবার একটুখানির জন্য তার ঘুম পায় সকালে দৌড়ের পরিশ্রমের মাশুল দিতে। কিন্তু ঘুমোতে পারে না, ঘুমোবার জায়গা নেই। বিছানায় শুতে কেমন লাগে তা সে জানেই না প্রায়। বাড়িতে ময়লা ছেঁড়া কাঁথায় শুত। তোষকে কখনো শোয় নি। চীৎ হয়ে তারা—ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিবার মনে হল এই একটা সুযোগ এসেছে জীবনটাকে বদলে নেবার। এটা তার ছাড়া উচিত হবে না। তাকে উঠতে হবে, অনেক উপরে উঠতে হবে। গোমস বলেছিল খোয়াব দেখতে হবে। এবার সে খোয়াব দেখবে আর সেজন্য যে সুযোগই পাবে কাজে লাগাবে। দোনামনা করলে চলবে না। দু—বেলা নিশ্চিন্তে খাওয়ার ভাবনা থেকে আগে রেহাই চাই।
একশো টাকার নোটটা পকেট থেকে বার করে সে অন্ধকারে চোখের সামনে ধরল। ননীর সঙ্গে ফেরার সময় সে বলেছিল ‘বুঝলি ননী, একটা ফিস্টি করা যাবে। যারা যারা চাঁদা দিয়ে আমায় সাহায্য করেছে তাদের সবাইকে পেটপুরে খাওয়াব।’ কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের প্রতি বিরক্ত হল। কি দরকার ছিল কথাটা বলার? টাকাটা ত তার নিজের জন্য দরকার। ভাল প্যান্ট, শার্ট, জুতো কিনতে হবে। নানান জায়গায় টুর্নামেন্ট যেতে হবে, নানান দেশের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। এবার ন্যাশনাল বোম্বাইয়ে। তার ভাল পোশাক চাই। কি দরকার ছিল ফিস্টি দেবার কথাটা বলার! না, এই টাকা খরচ করব না।
সিদ্ধান্তে পৌঁছে শিবা পাশ ফিরে ঘুমোবার উদ্যোগ করল এবং ঘুম যখন ক্রমশ তার দু—চোখের পাতা জুড়ে নেমে আসছে, সারাদিনের উত্তেজনায় ছিলে—টানা ধনুকের মতো টানটান স্নায়ুগুলো শিথিল হয়ে আসছে তখন কতকগুলো আবছা মূর্তি তার চোখে ভেসে উঠতে লাগল। সে দেখল ভবানী স্যারকে: ‘আমি নুইব না নুইব না।’ সাধুর দু—হাতের পেশীগুলো দপদপ করে ফুলে উঠছে। রাধেশ্যামের ছেঁড়া জামার ফাঁকে জিরজিরে বুক : ‘শিবা ভগমান তোর রূপ লইয়্যা দেখা দিছেরে।’ গোমস বলছে: ‘ইউ আর এ বিগ বয়।’ দাদা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল: ‘তোর রোজগারই তখন কিন্তু সম্বল হবে।…এবার ধর্মঘট হয়তো হবে কোনো এক সময়। তখন আমার রোজগার থাকবে না, তোকেই—’ ননী হাসছে: ‘…এই এরাই চাঁদা দিল। আমাদের জন্য একজন ফাইটার দরকার তাই দিল।’ ‘বাবুদের বাড়ির দালানে রঞ্জু বসে ভাত খাচ্ছে। তারিয়ে তারিয়ে চিবোচ্ছে। চিতায় শুয়ে দুটো ভাই চোখ মেলে তাকিয়ে তার দিকে। হঠাৎ ফিসফিস হল তার বুকের মধ্যে।
‘শিবা হাত বাড়া।’
ঘুমের মধ্যে শিবা ছটফটিয়ে উঠে এপাশ—ওপাশ করতে লাগল।
.
চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি, সার্টিফিকেট আর ‘বেস্ট বক্সার’ মেডেলটা কোথায় রাখবে? বাড়িতে ছাড়া শিবার আর জায়গা নেই। ভোরবেলাতেই সে ওগুলো নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। মাঝখানে শক্তি দাসের সঙ্গে দেখা। সঙ্গে তিনজন লোক। ব্যস্ত হয়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। শিবাকে দেখেই সে থমকে দাঁড়াল।
‘কাল রাতে তোর জন্য তোর মামী বসেছিল। আমরা ভাবলুম তুই আসবি, কি পেলি—টেলি দেখাবি। ঘুসোঘুসির ব্যাপার কিছুই বুঝি না, তবে কাপ মেডেল পেলে আনন্দ হয়।’
‘না, মানে, কাল এতরাত হয়ে গেল ফিরতে—’ শিবা লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে লাগল।
‘এইসব পেয়েছিস বুঝি।’ শক্তি ট্রফিটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে পাশের লোকটিকে বলল, ‘আমাদের নীতুর ভাই গো। দারুণ জোর ঘুসিতে। বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন। এক এক ঘুসিতেই কাত করে দেয়।’
‘ওকে নিয়ে চল না শক্তিদা। এ রকম দু—একজন দরকার হবে।’ চাপাস্বরে একজন বলল।
শক্তি মুহূর্তের জন্য ভাবল।
‘শিবা, তুই বোধ হয় জানিস না আজ এগারো দিন আমাদের কারখানায় ধর্মঘট চলছে। এই এগারো দিন নীতু কারখানার গেটেই পড়ে আছে আরো অনেকের সঙ্গে। ধর্মঘট ভাঙার জন্য মালিক সবরকম চেষ্টাই করেছে। এবার গুণ্ডা লাগিয়েছে। কাল রাতে কয়েকটা ছেলে এসে শাসিয়ে গেছে ছোরা দেখিয়ে। আজও আসবে। আমাদের দিকে যদি দু—একজন তাগড়াই কেউ থাকে তাহলে ভাল হয়…মানে আমাদের মনোবল তাহলে বাড়বে। আসলে মারপিট ত আমরা জানি না, পারবোও না। সেই গুণ্ডা লীডারের চোয়াল ভেঙে দেওয়ার পর তোর নাম অনেকেই জেনে গেছে। তুই যাবি? তাহলে অনেকটা ভরসা পাওয়া যাবে।’
‘ওদের গুণ্ডারাও চট করে ঝামেলা করতে সাহস পাবে না।’ শক্তির এক সঙ্গী বলল।
‘তোর যদি অসুবিধে থাকে তাহলে—’
‘না না অসুবিধে কি আর। আজ আমি ঠিক করেছি ছুটিই নেব।’
‘তোর ভয়ের কিছু নেই। যদি তেমন মারাত্মক কিছু হতে পারে দেখিস তাহলে তুই, চলে আসিস।’
শোনামাত্রই এক ঝলক রক্ত শিবার মাথায় উঠে এল। ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল তার সর্বাঙ্গ।
‘শক্তিমামা আমি ভীতু নই। আমি ফাইটার—পালাতে জানি না। চল তোমাদের সঙ্গে যাব।’
মিনিট পনেরো পর, পীচের রাস্তা থেকে ওরা কাঁচা রাস্তায় নামল। লরি চলাচলে রাস্তার দুই কিনারা বরাবর গর্ত। দু—ধারে গাছ, ঝোপ, কাঁচা বাড়ি। একটা চালায় চা—সিগারেটের দোকান, ভাঙা ইটের পাঁজা জরাজীর্ণ শিবমন্দির পার হয়ে একটা মোড় ঘুরেই কারখানার পাঁচিল। গ্যারেজের মতোই এর গেটটা করোগেট টিনের। লরি ঢোকার মতো চওড়া। তার পাশে বাঁশের কাঠামোয় খাড়া করা অস্থায়ী চটের চালা, তাতে ঝুলছে লাল সালুতে সাদা অক্ষরে লেখা: ”জি এস ইঞ্জিনিয়ারিং শ্রমিক ইউনিয়ন”, পাঁচিলের গায়ে হাতে লেখা কয়েকটি পোস্টার সাঁটা।
শিবারা মোড় ঘুরে দূর থেকেই দেখল একটা গোলমালের মতো কিছু ঘটছে।
তিনটি লোক চিৎকার করে গালাগাল দিয়ে চলেছে। একজনের হাতে সাইকেলের চেন। সেটা সে ঘোরাচ্ছে। শিবা দেখল, তার দাদা এবং আরো জনা ছয়েক জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। দু—হাত বাড়িয়ে নীতু কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একজন এগিয়ে এসে তাকে চড় মারল।
তাই দেখেই বিকট চিৎকার করে শিবা ছুটল ওদের দিকে। তিনজনই ঘুরে দাঁড়াল।
‘শিবা এগস না।’ নীতু চেঁচিয়ে উঠল।
ততক্ষণে শিবা এসে পড়েছে। চেনটা বাতাসে চাবুকের মতো ঝলসে উঠে ওর বাহুর উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একজনের হাতে ছুরি বেরিয়ে এল। কিন্তু শিবা খ্যাপামোষের মতো এগিয়ে আসছে লোহার চাবুকের মার অগ্রাহ্য করে। গুণ্ডা তিনজন পিছিয়ে গেল কয়েক পা। দু—হাত মুঠো করে বাড়িয়ে শিবা কুঁজো হয়ে ওদের পাক দিয়ে ঘুরতে শুরু করল।
চেন ধরা হাতটা উঠল। মাথার উপর বনবন ঘোরাচ্ছে। সুযোগ খুঁজছে সপাৎ করে বসাবার জন্য। লোহার চেন মাথায় বা হাড়ের উপর সজোরে পড়লে ফাটিয়ে দেবে। শিবার যেন চেনাচেনা লাগছে মুখ তিনটি। সাধুর দলের ওরা। ওই লম্বাটে মুখ, বড় জুলফি—ওই বড় দাঁত, দাড়ি, এরাই ত ঘনশ্যামের রিকশার চাকা খুলে নিয়ে গেছল। ওই মাঝের জন ছোরাটাকে সামনে বাড়িয়ে এধার—ওধার তাকাচ্ছে আর চিৎকার করছে—’এইবার, এইবার তোকে পেয়েছি রে, আজ তোর জান লেবো। কে বাঁচায় তোকে আজ দেখব।’ এটাই ত সেই দেবু! শিবা এতক্ষণে চিনতে পেরেছে।
‘হিসস।’
চেনটা শিবার চুল ছুঁয়ে পাখার ব্লেডের মতো ঘুরে গেল। বসে না পড়লে তার কানে এসে লাগত।
‘শিবা তুই চলে যা।’ নীতু চেঁচিয়ে বলল।
‘আমি ফাইটার, আমি পালাতে জানি না।’
‘হিসস।’
লোহার চেনটা এবার নেমে এল শিবার ডান পাঁজর লক্ষ্য করে। বিদ্যুৎ গতিতে শিবা বাঁ হাত বাড়াল। চেনটা কনুই স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই সে মুঠোয় জড়িয়ে নিয়ে হ্যাঁচকা টান দিল। লোকটার মুঠোয়ও চেনটা জড়ানো, তাই টান লাগতেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। একটা ভয়ঙ্কর রাইট হুক দিয়ে শিবা তাকে সিধে করে দিল।
‘বাপস।’
মুখে হাত দিয়ে সে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল।
চেনটা এখন শিবার হাতে। ঘোরাতে ঘোরাতে সে এগল। ওরা তিনজনই বিপদ বুঝে পিছোচ্ছে। পিছনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ওরা চোখাচোখি করল। চেনওয়ালার ঠোঁট ফেটে কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে। থুথু ফেলল। রক্তের সঙ্গে একটা দাঁতও পড়ল। দূরে দু—তিনজন পথচারী দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে। শক্তির হাতে শিবার ট্রফি, মেডেল আর সার্টিফিকেট। তার পাশে নীতু এবং বাকিরা। তাদের সকলের চোখ বিস্ময়ে, ভয়ে বিস্ফারিত। শিবার সাহায্যের জন্য যে এগিয়ে আসবে সেই বোধটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
‘প্রত্যেকটার দাঁত খুলে নেব। দেবু এইবার দেখব তোমার ছোরার কত ধার। মনে আছে সেদিনের ঘুসির কথা।’
শিবা চেনটাকে বাতাসে ক্রস চিহ্নের মতো ঘোরাচ্ছে আর এগচ্ছে। ওরাও পিছোচ্ছে।
‘মনে আছে সেদিনের কথা। আজ কিন্তু আমার পাঞ্চে আরো বেশি জোর। যে হাতে তুমি চড় মেরেছ ওই হাত আমি ভাঙব।’
ঠিক এই সময়ই দূর থেকে একটি লোক হাত নেড়ে ইশারা করতেই দেবু এবং তার দুই সঙ্গী পিছন ফিরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল এবং মোড় ঘুরে অদৃশ্য হল। সকলে তাকিয়ে রইল ওদের পালানোর দিকে।
লোকটি এগিয়ে আসছে। শিবা চিনতে পারল। কাল এই লোকটিই তাকে ডেকে নিয়ে গেছল গোরাবাবুর সঙ্গে কথা বলাতে।
শক্তি ফিসফিস করে কাকে বলল, ‘লোকটা মনে হচ্ছে যেন প্রিয় হালদার। মালিকের সঙ্গে সঙ্গে থাকে।’
প্রিয় হালদারই প্রৌঢ়ের নাম। সে ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে শিবাকে ডাকল। শিবা এগিয়ে গেল। তখনো চেনটা তার হাতে।
‘তুমি এখানে কি করছ শিবাজী? গুণ্ডাদের সঙ্গে মারপিট? লোকে শুনলে বলবে কি! কালই যে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সে কিনা মাস্তানী করছে?’
‘মাস্তানী আমি করি নি। মাস্তানদের ঠাণ্ডা করছিলুম। ওরা এসেছিল এইসব লোকেদের মারতে।’
‘তাই বুঝি? ওদিকে গোরাবাবু ত তোমার জন্য ভেবে অস্থির। চলো চলো একবার দেখা করে আসবে চলো, উনি গাড়িতে বসে আছেন। সকালে এদিকেই আমরা এসেছিলুম। হঠাৎ খবর এল তোমায় নাকি গুণ্ডারা ধরেছে। পুলিশে খবর দিয়েই উনি চলে এসেছেন। চলো চলো, তাছাড়া চাকরি তুমি করবে কিনা সেটাও উনি জানতে চান। কালই বোম্বাই রওনা হচ্ছেন।’
প্রিয় হালদার কথা বলতে বলতে শিবার কাঁধ ধরে প্রায় টানতে টানতেই ওকে নিয়ে এগল।
‘একি তোমার কনুইয়ে কালসিটে! ইনজুরি হলে যে চিরকালের মতো বক্সিংই খতম হয়ে যাবে, এটা বোঝ না?’
দু—একবার শিবা মুখ ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়েছিল। তারপর হাত তুলে নীতু এবং শক্তিদের ইসারায় জানাল, সে এখুনি আসছে। ওরা কঠিন মুখে তখন ওর দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু শিবা আর আসে নি।
.
মোটরে অপেক্ষা করছিলেন গোরাচাঁদ সেন অর্থাৎ গোরাবাবু। প্রিয় হালদার প্রায় ঠেলেই শিবাকে গাড়িতে তোলে। গোরাবাবু মিষ্টি হেসে উদ্বিগ্নস্বরে বলেন, ‘যাক খুব রক্ষে পেয়েছ।’ এই বলে তিনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মাথাটা হেলান। গাড়িটা তখনই স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করে। শিবা পলকের জন্য দেখতে পায় দূরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে সাধু সিগারেট খাচ্ছে।
ওরা সোজা এসে হাজির হয় আহিরীটোলায়, গঙ্গার কাছাকাছি গোরাবাবুর বাড়িতে। বিরাট সেকেলে বাড়ি। পিছন দিকে পাঁচিলঘেরা কিছুটা জমি, তার একদিকে বড় বড় কাঠের দরজাওলা গুদামঘর। একটা খালি লরি দাঁড়িয়ে। পাঁচিলের একপ্রান্তে দরজা, তারপাশে ছোট ছোট কয়েকটা ঘর। তারই একটায় শিবাকে থাকতে দেওয়া হল।
গাড়িতে ওরা বিশেষ কথা বলে নি। শুধু শিবা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কোথায় যাচ্ছি।’ প্রিয় হালদার জবাব দেয় ‘গোরাবাবুর বাড়িতে। ওখানেই থাকবে।’ গাড়ি পৌঁছতেই গোরাবাবু নেমে, সাদা মার্বেলের চওড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাড়ির মধ্যে চলে যান। প্রিয় হালদার পাশের সরু গলি দিয়ে শিবাকে বাড়ির পিছনে এই ঘরটায় আনে।
‘এখানে থাকবে। বিছানা—বালিশ সবই আছে। খাওয়ার ব্যবস্থাটা বাড়ির মধ্যে। রাঁধুনি পঞ্চাননই বলে দেবে কখন ভাত কখন জলখাবার পাওয়া যাবে।’
‘আমি এখানে কি করব?’ শিবা অস্বস্তিভরে জিজ্ঞাসা করেছিল।
‘তোমার একটা কাজ, এই গুদামে মাল যখন আসবে আর বাইরে যাবে তখন নজর রাখা। খুব দামি দামি জিনিস এখানে আছে। চুরিটুরি হতে পারে ত। তাছাড়া মাঝে মাঝে লরিতে মালের সঙ্গেও যেতে হতে পারে, ডেলিভারি দিতে বা নিতে। কিন্তু এসবের থেকেও আর একটা বড় ব্যাপার আছে।’
প্রিয় হালদার সিগারেট ধরিয়ে তক্তপোশটায় বসে শিবাকেও বসতে ইসারা করল।
একটা অল ইন্ডিয়া বক্সিং টুর্নামেন্ট হবার কথা চলছে। ঠিক টুর্নামেন্ট নয়, এগজিবিসন ফাইটই বলা উচিত। ইন্ডিয়ার সেরা কজন থাকবে, বার্মা, সিলোন, তাইল্যান্ড থেকেও বক্সার আসবে। ফাইটগুলো হবে বড় বড় শহরে। অনেক টাকার ব্যাপার। বোম্বাইয়ের বেহরাম মিস্ত্রি, পাঞ্জাবের আজাইব সিং আর গোরাবাবু, এই তিনজনেই টাকা ঢালছে। তোমার লড়াই দেখে গোরাবাবু এত ইমপ্রেসড যে, ঠিক করেছেন এই এগজিবিসনগুলোয় তোমায় নামাবেন। বেঙ্গলের আরো দু—একটা ছেলের দিকেও অবশ্য ওর নজর আছে। তা আমিই ওকে বললাম, শিবাজী ছেলেটা যা লড়ছে ওর জন্যই লোকে দেখতে আসবে। তোমার দুটো নক আউটের পর ফাইনালে হেভি বেটিং হয়েছিল, চার একের দর ছিল ফার্স্ট রাউন্ড নক আউটের উপর। যাকগে এসব কথা, এবার থেকে তুমি এখানেই থাকবে।’
‘আমার কোনো জামাকাপড় নেই। গ্যারেজে আমার মাল রয়ে গেছে।’
‘কি মাল?’
‘গ্লাভস, হেভি ব্যাগ, স্কিপিং দড়ি, কেডস, তোয়ালে, একটা প্যান্ট, একটা—’
প্রিয় হালদার হাত তুলে থামতে ইসারা করল।
‘ওর কোনোটার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। দু—দিনের মধ্যে সব এখানেই পেয়ে যাবে। শোনো শিবাজী তোমাকে এবার বড় হবার কথা ভাবতে হবে। তারজন্য খাওয়া চাই, বিশ্রাম চাই, ট্রেনিং চাই। তুমি কি এগুলো পাবে এখন যে জীবনে আছ? কত টাকা মাইনে পাও, য়্যাঁ কত পাও? জানি জানি সবই জানি। হাড়ভাঙা কাজ করতে হয়, বিশ্রাম পাও না, রাতে থাক ওই মোটর গ্যারেজেই। রুটি, ছোলা খেয়েই কাটাও, পাও পঁয়তাল্লিশ।’
‘আপনি জানলেন কি করে?’
প্রিয় হালাদার রহস্যময় হাসি তৃপ্তি সহকারে হাসল।
‘বললুম ত, সব খবর নিয়ে তবেই না গোরাবাবু তোমাকে চ্যুজ করেছেন।
‘সাধু বলেছে।’
‘চেনো নাকি ওকে?’
‘ও আমাকে চেনে, আমি ওকে চিনি না।’
‘বটে। তুমি বুঝলে কি করে যে সাধুই বলেছে?’
‘গোরাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি কাল। আজও ওকে দেখেছি মোটর থেকে। ও আমাদের ওদিকেই থাকে।’
প্রিয় হালদার একটু গম্ভীর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ শিবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘সাধু লোকটা খুব ভাল নয়। বুঝলে। জানি তুমি ওর চোয়াল ভেঙেছিলে, গোরাবাবুর কাছে সে খবরও আছে। আসলে ওনার একটা ব্যবসা আছে তাতে সাধুর হেল্প দরকার হয়। সেইজন্যই তুমি ওদের একসঙ্গে দেখে থাকবে, নয়তো গোরাবাবু ওকে দু—চক্ষে দেখতে পারে না। তুমিই বল, সাধুকে তুমি কি টলারেট করবে? গুণ্ডা, বদমাস, ওয়াগান ব্রেকার, সমাজের শত্রু ওই লোকটা।’
‘ওর পার্টির দেবু নামে একজন আজ আমার দাদাকে চড় মেরেছে। আমি ছিঁড়ে খাব ওকে।’
শিবা হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে উঠল একটু কুঁজো হয়ে। ঘাড়ে রোঁয়া দেখা দিয়েছে। চোখ জ্বলজ্বলে।
প্রিয় হালদার আবার কিছুক্ষণ শিবার দিকে তাকিয়ে থেকে সিগারেটটা দরজা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বলল, ‘তোমার ওপর সাধুর রাগ আছে, বুঝলে রাগ আছে। থাকারই কথা। তা থাকুক। ওতে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই, তুমি গোরাবাবুর আশ্রয়ে এখন। তোমার কোনো অভাব এবার থেকে থাকবে না, বুঝলে, টপ ক্লাসে উঠতে গেলে টপ ভাবে থাকতে হয়। তুমি শুধু এবার নিজের উন্নতির কথাই ভাব। এই এগজিবিসন ফাইটগুলোর জন্য অনেক টাকা ঢালা হবে। এতে ভাল মতো লড়লে ইন্ডিয়া ফেমাস হয়ে যাবে।’ প্রিয় হালদার মুখটা শিবার দিকে এগিয়ে গাঢ় রহস্যময় স্বরে বলল, ‘এত কষ্ট করে ঘুসি খাবে কেন, কি জন্য? কিছু ত তার বদলে পাওয়াও চাই, কেমন কিনা? পাবে পাবে, টাকা একটা মস্ত জিনিস, তাই দিয়ে সুখ, আরাম কেনা যায়। তুমি কি এসব চাও না?
শিবা যন্ত্রের মতো মাথা হেলাল।
‘ঠিক আছে, চলো এবার পঞ্চাননকে চিনিয়ে দিই।’
পাথর বাঁধানো সরু পথ ধরে ওরা পিছনের ছোট একটা দরজা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। সামনেই রান্নাঘর।
‘পঞ্চানন….পঞ্চা….।’
প্রিয় হালদার হাঁক দিতেই বেঁটে, কালো, হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি, একটি লোক ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
‘একে দেখে নাও, শিবাজীবাবু এর নাম! এখানে থাকবে আজ থেকে, খাবেও।’
হাত জোড় করে পঞ্চানন বিনীত নমস্কার জানাতেই শিবা তটস্থ হয়ে কুঁকড়ে গেল। জীবনে এই প্রথম সে নমস্কার পেল।
‘বাবু কি এখন ভাত খাবেন?’
‘বাবু’ সম্বোধন পাওয়াও শিবার জীবনে প্রথম। শুনতে তার ভালই লাগল। বেশ ভাল লাগল। নিজেকে সে চা—এর দোকানের বা গ্যারেজের শিবার থেকে আলাদা, অন্য এক মানুষ হিসাবে দেখতে পেল। তার মনে হল, দুটো পায়ে ভর দিয়ে এখন সে দাঁড়িয়ে, একটা কিছু অর্জন করেছে যা ট্রফি জেতার থেকে আলাদা। কিছু পেতে পারে, পাওয়া উচিত, পাওনা হয়েছে—এমন এক ধারণা এই প্রথম তার মনের মধ্যে উঁকি দিল। নমস্কার এবং বাবু শব্দটিকে সে ভালবাসল। মান চাই। ভাল পোশাক, খাদ্য আর আবাস তার দরকার। গোমস কি একেই খোয়াব বলেছিল?
খেতে বসে যখন একটি ঝি তার সামনে থালা রেখে গেল, শিবার নিশ্বাস তখন আটকে এল এত ভাতের দিকে তাকিয়ে। এত! জীবনে সে এত ভাত একসঙ্গে পায় নি। ধবধবে যুঁই ফুলের একটি স্তূপ। আলতো হাত বোলাল ভাতের উপর। ভাঙতে মায়া হচ্ছে। ভাতের পাশে চাকা চাকা আলু ভাজা, শাক, পটল—কুমড়োর তরকারি। পঞ্চাননের সহকারী ডালের ডেকচি নিয়ে অপেক্ষমাণ।
প্রথম গ্রাসটি মুখে দিয়েই শিবার শরীর চিনচিন করে উঠল। মনে পড়ে যাচ্ছে রঞ্জুর কথা। তখন সে ভাবত, এইভাবে দালানে বসে রঞ্জু মুখে দিচ্ছে তার মায়ের রান্না, দারুণ রান্না, অদ্ভুত স্বাদ। সে মনে মনে ভাবত রঞ্জু চোখ বুজে চিবোচ্ছে আর মাথা নাড়ছে তৃপ্তিতে। আর আজ সে নিজে খেতে বসেছে ওই রকম একটা বড় বাড়ির দালানে। ওই রকম একটা রান্না ঘরের সামনে বাবু হয়ে বসে।
‘বাবু ডাল দেব আর?’
‘দাও। আর কি আছে?’
‘রুই মাছের ঝোল, পেঁপের চাটনি। দুধ খাবেন কি?’
‘হ্যাঁ খাব।’
খাওয়ার পরে এসে শিবা দেখে একটি চাকর বিছানা পাতছে গম্ভীর মুখে। ঠিক এই রকমই গোঁফওয়ালা টাক মাথা একজন বটকেষ্টর দোকানে একদিন তাকে খিঁচিয়েছিল চা—এ পিঁপড়ে ভাসছিল বলে। শিবা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘অ্যায় খাবার জল নিয়ায়।’
লোকটা শুনেও শুনল না। শিবা অপ্রতিভ বোধ করল। নিজের অল্পদামি, ময়লা প্যান্ট শার্ট, চটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ভাবল, এগুলো ছাড়তে হবে। গ্যারেজের শিবার পরিচয়ের ছাপ এতে লেগে আছে। চাকরটার চোখে তা ধরা পড়ছে।
‘জল বাইরের টিউকলে। ওবেলা কুঁজো দিয়ে যাব।’ বলেই লোকটি বেরিয়ে গেল।
শিবা চুলে হাত বোলাল। চিরুনী আর আয়না চাই। গায়ে ঘেমো গন্ধ বেরোচ্ছে। চান করা দরকার। সাবান আর গামছা চাই। পকেটে হাত দিতেই গোরাবাবুর দেওয়া একশো টাকা নোটটার ছোঁয়া পেল। বিছানায় চীৎ হয়ে শুয়ে সে ভাবল, প্যান্ট শার্ট জুতোও চাই, সেজন্য টাকাও চাই।
পাশ ফিরেই ‘আহহ’ বলে আরামে কাতরে উঠল। এত নরম কোনো জিনিসের উপর সে মাথা আর শরীর রাখে নি। এত পেট ভরেও জীবনে সে খায় নি। কান্তি যেমন বিরাট ঘেরের বেলবটম পরে তেমনি একটা প্যান্ট আর লাল নাইলন গেঞ্জি কেনার কথা ভাবতে ভাবতে সে গভীর ঘুমের মধ্যে ডুবে গেল।
.
চারদিন পর বিকেলে শিবা বাস থেকে নামল দেবদাস পাঠক রোডের মোড়ে।
স্ট্যান্ডে দুটিমাত্র রিক্সা। ননী নেই। শিবা গ্রেট বেঙ্গলের দিকে এগোল। দূর থেকেই সে দেখতে পেল শ্রীকান্ত দাসের হাতে একটি ডিস্ট্রিবিউটার ক্যাপ। তারপাশে একটি ফিয়াট এবং ধুতি—পাঞ্জাবি—পরা একটি লোক সম্ভবত মোটরের মালিক ক্যাপটা তুলে ধরে সে লোকটিকে কি বোঝাচ্ছে। শিবা গ্যারেজে ঢুকল ধীর পায়ে।
শ্রীকান্তের চোখ তার উপর পড়তেই ভ্রূ কোঁচকাল। শিবাকে উপেক্ষা করে সে মোটরের দিকে ঝুঁকে ক্যাপটা লাগাতে শুরু করল। মিনিট তিনেক পর শ্রীকান্ত সিধে হয়ে গম্ভীরস্বরে বলল, ‘এখানে কি মনে করে?’
শিবা অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। দ্বিধাভরে সে বলল, ‘একটা কাজ পেয়েছি—।’
‘ভাল। তোর যা জিনিসপত্তর আছে এখুনি নিয়ে যা।’
শিবা ইতস্তত করে চালাঘরটার দিকে এগোল। দুর্লভ চক্রবর্তী চেয়ারে বসে এক পাঞ্জাবীর সঙ্গে কথা বলছিল। শিবা ঢুকতেই বলল, ‘কি রে, ব্যাপার কি?’ চারদিন ছিলিস কোথায়?
‘একটা ভাল কাজ পেয়ে গেছি।’
‘সে ত চেহারা দেখেই মালুম হচ্ছে।’
দুর্লভ তার চাহনি শিবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বার দুয়েক ওঠানামা করাল। লাল নাইলনের গেঞ্জি ঘিয়ে রঙের টেরিকট বেলবটস ও চপ্পলসমেত শিবা বোকার মতো হেসে মাথা চুলকোতে লাগল।
‘ভালই দিয়েছে। জি এস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক দেখছি খারাপ লোক নন। তা এখানে কি জন্য, এই কদিনের পাওনা টাকাটার জন্য? আজ হবে না দিন কতক পরে আসিস।’
দুর্লভ আবার কথা শুরু করল পাঞ্জাবী লোকটির সঙ্গে। শিবা ঘরের কোণ থেকে তার প্যান্ট, শার্ট, আশ্চর্য ঘটকের দেওয়া গ্লাভসটা নিয়ে বেরিয়ে এল। শ্রীকান্ত দাস বিড়ি ধরিয়ে একটি অল্পবয়সী ছেলেকে বলল, ‘চট করে একটা চা দিতে বলে আয়।’
শিবার মনে পড়ল, শ্রীকান্ত ঠিক এইভাবে পাঁচ—ছদিন আগে তাকেও হুকুম করেছে। ছেলেটা নতুন, বোধ হয় তার জায়গায় বহাল হয়েছে। গ্যারেজের পরিমল শিরিষ কাগজ দিয়ে কি একটা ঘষছে, ফিয়াটের মালিক নিবিষ্ট হয়ে তাই দেখছে। পল্টু গিয়ারবক্সের পিনিয়ন পেট্রল দিয়ে সাফ করায় ব্যস্ত। সন্তাোষের দুটো পা একটা অ্যাম্বাসাডারের তলা থেকে বেরিয়ে।
‘হেভিব্যাগটা পরে নিয়ে যাব।’
‘পরে কেন, এখনি নিয়ে যা। ওই ত পড়ে রয়েছে।’
শিবা তাকিয়ে দেখল ব্যাগের কাপড়টাই শুধু পড়ে আছে, ভিতরে বালি নেই।
‘কে করল।’
‘ননী।’
‘কেন?’
শিবা দ্রুত এগিয়ে ব্যাগটা তুলল। কয়েকটা গর্ত কাপড়ে। সে শ্রীকান্তর দিকে তাকাল।
‘ননী এই স্ক্রু—ডাইভারটা দিয়ে করছে। ওর কাছেই সব শুনলাম।’
‘কি শুনলে?’ হঠাৎ শিবার বুক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। এদের ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা যেন কেমন!
‘তুই নিজের দাদাকেও গুণ্ডাদের হাতে ফেলে দিয়ে পালাবি, এটা কেউ ভাবতে পারে নি।’
‘কি হয়েছে! কি হয়েছে দাদার?’
‘হাসপাতালে এখন। তিনটে পাঁজর ভেঙেছে। তোদের পাশের ঘরের শক্তি দাসের মাথা ফেটেছে, ডান হাতটাও গ্যাছে। তুই থাকলে এসব হত না। তুই মালিকের লোকের সঙ্গে চলে গেলি, তারপরই গুণ্ডারা ফিরে এসে মিনিট তিন চারের মধ্যেই যা করার করে দেয়। কেন, তুই এসব জানিস না?’
‘না।’
শিবা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
‘আমি জানতুম না গোরাবাবুই মালিক।’
‘তাই নাকি, কিছুই জানতিস না!’ শ্রীকান্তর বিড়িটা নিভে গেছে। আবার ধরাল। ‘ধর্মঘট ভেঙে গেছে, নতুন লোক নিয়ে কারখানাও খুলেছে। ওরা সব বরখাস্ত। এখন মানুষকটা পরিবার নিয়ে কি যে খাবে!’
‘আমি কি করব? আমি কি ধর্মঘট করতে বলেছি?’
‘না বলিস নি। তুই শুধু বলেছিলি, আমি ফাইটার আমি পালাতে জানি না। তারপর শেয়ালের মতো পালালি, এইসব জামাপ্যান্ট পরার লোভে।’
বিড়িটা ফেলে দিয়ে শ্রীকান্ত হাঁক দিল, ‘কিরে পল্টু, সারাটা দুপুর ত কাবার করলি পিনিয়ানকটা—’ বলতে বলতে সে এগিয়ে গেল শিবাকে ফেলে রেখে।
চিড়বিড় করে উঠল শিবার মাথাটা শ্রীকান্তর কথা শুনে।
‘আমি পালিয়েছি একথা কে বলেছে? কে রটিয়েছে?’
শিবা প্রায় চীৎকার করে, দু—হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শ্রীকান্তর দিকে এগোল। ঘর থেকে দুর্লভ বেরিয়ে এল। হাতে একটা স্প্যানার নিয়ে পরিমল লক্ষ করতে লাগল শিবাকে। দরকার হলেই ছুঁড়বে এমন ভঙ্গিতে একটা পিনিয়ন মুঠোয় ধরে পল্টু তাকিয়ে রইল।
‘সবাই বলেছে, এ তল্লাটের সবাই জানে।’ অবিচলিত স্বরে শ্রীকান্ত বলল, ‘তারা যে মিথ্যা বলে নি, সেটা তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কাল তোর দাদা হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। তাকে গিয়ে জিগ্যেস কর।’
‘দাদা বলেছে? একথা দাদা বলেছে? বেশ তাই যাচ্ছি।’
শিবা প্রায় ছুটেই বেরল গ্যারেজ থেকে। মাথা নিচু করে হনহনিয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা হল। দূর থেকেই সে দেখতে পেল তাদের ঘরের দরজাটা খোলা। সামান্য ইতঃস্তত করে ভিতরে ঢুকে, তক্তপোশে সাদা প্লাস্টারে বুকমোড়া নীতুকে শুয়ে থাকতে দেখে একটু থতিয়ে গেল। ঘরে আর কেউ নেই। নীতু খোলা জানলা দিয়ে বাইরে আনমনা তাকিয়েছিল। শিবার পায়ের শব্দে ঘাড় ফেরাতে গিয়ে যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করল। শিবার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে অস্ফুটে বলল, ‘আয়, বোস।’
এগিয়ে এসে মুখটা ঝুঁকিয়ে শিবা বলল, ‘এরকম যে কিছু হবে, আমি জানতুম না। সত্যি বলছি দাদা, বিশ্বাস কর, আমি একদম বুঝতে পারি নি।’
নীতুর ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল কিছু একটা বলতে চেয়ে। শব্দ হল না। যন্ত্রণায় মুখটা বেঁকে গেল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মৃদুস্বরে সে বলল, ‘জানি, আমি কিছু মনে করি নি।’
স্বস্তিতে এবং মন থেকে বোঝা নেমে হালকা হওয়ার সুখে শিবার মুখ যখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই দরজার বাইরে চীৎকার শোনা গেল তার মায়ের : ‘বেরো, বেরো! কি কত্তে এসেছিস এ বাড়িতে, মজা দেখতে?’
শিবা তাকিয়ে দেখল তার মায়ের পিছনে শক্তি দাসের বৌ সাগর মামীও। মুখটা থমথমে, চাহনিতে চাপা ঘৃণা। হালকাবোধ করার অনুভবটা শিবার মন থেকে মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়ে গনগনে একটা রাগ তাকে এবার গ্রাস করল।
‘দরকার নেই অমন ছেলের। একফোঁটা উবকার কত্তে পারে না, পারে বেইমানি কত্তে।’
‘কিসের বেইমানি করেছি। গুণ্ডা ঠেকাবার দায় আমার নয়। আমি ধর্মঘট করতে বলি নি। ওখানে আমার যাবার কথা নয়। এসব করতে গেলে হাঙ্গামা হবে, এটা বুঝেশুনেই ত ওরা নেমেছে তবে সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপানো কেন? আমারও জীবন আছে, সেটা ত কেউ কোনোদিন দেখে নি? দেখতে আসবেও না। নিজেকেই নিজে দেখতে হবে, বড় হতে হবে। সবাই বড় হতে চায়, সেজন্য যে পথই খোলা পাব সেই পথেই আমি যাব।’
‘মনুষ্যত্ব বলে একটা জিনিস আছে।’ সাগর মামী তীক্ষ্নকণ্ঠে বলল, ‘যারা তোর দাদাকে মারতে এল, তাদের সঙ্গেই তুই চলে গেলি? এই কি বড় হবার পথ। এমন পথে ত কুকুরে যায়।’
রাগে অন্ধ হয়ে শিবা কিছু একটা করার জন্য অবশেষে দরজার পাল্লায় একটা ঘুসি বসাল। পাতলা কাঠের পাল্লাটা ফেটে গেল। পাগলের মতো সে এধার—ওধার তাকাল রাগটা বার করে দেবার উপায় খুঁজতে। দুটি স্ত্রীলোক আর চোট খাওয়া একটি পুরুষ ছাড়া কাছাকাছি আর সবই নিষ্প্রাণ বস্তু।
হাঁফাতে হাঁফাতে শিবা বলল, ‘বেশ আমি কুকুরই। এবার থেকে কুকুরদের সঙ্গেই থাকব।’
আর কোনো কথা বলার বা শোনার জন্য সে অপেক্ষা করে নি। বটকেষ্টর দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় শচীন তাকে ডাকল।
‘ওরে তোর জন্য ননী রেখে গেছে এটা।’
শচীন দোকানের পিছনের তাক থেকে একটা কাগজে মোড়া বস্তু আনল। কাগজটা খুলতেই বেরল তার ট্রফি, মেডেল, সার্টিফিকেট। আর একটা কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা: সাবাস ফাইটার। এবার পাবি সোনার বকলেস।
কাগজটা মুঠোয় পিষে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শিবা তিক্ত স্বরে বলল, ‘আসব, হ্যাঁ সোনার বকলস পরেই আসব। সেদিন সবাই এসে আমার পা চাটবে।’
চার
বিকেলে ঘুম ভাঙার পর বিছানা ছেলে শিবা ওঠে নি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে প্রায় আধঘণ্টা। নিম গাছের কিছু পাতা, আকাশের একটা টুকরো আর গুদাম ঘরের কার্নিশের খানিকটা ছাড়া আর কিছু জানালা দিয়ে দেখা যায় না। ভীমরুলের মতো শব্দ করে টেবিলে ফ্যানটা ঘুরছে তবুও ঘামে সপসপ করছে তার বুক—পিঠ। এইমাত্র সে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছে?
ফ্যানের হাওয়ায় টেবলের উপর কয়েকটা পত্রিকার পাতা খড়খড় শব্দে ওলটাচ্ছে। ওগুলো ইংরাজি বাংলা ফিল্মের পত্রিকা। শিবা পড়ে না, শুধু ছবি দেখে। পড়ার ব্যাপারে তার অসুবিধা হয়, বিরক্তও লাগে। কথা বলার মতো তার কেউ নেই। কোনো বন্ধুও নেই। অথচ অঢেল তার সময় যখন কাজ থাকে না। কাজ খুবই সামান্য। যে রাতে লরিতে মাল আসে তাকে জেগে থাকতে হয়। গুদামে তোলার সময় হাত লাগাতে হয়। তাছাড়া মাল যখন বাইরে যায় ড্রাইভার সুরজ সিংয়ের সঙ্গে তাকে থাকতে হয়। পথে পুলিশের সঙ্গে যাবতীয় বন্দোবস্তের ব্যাপারটা সুরজই করে।
শিবার কাজ ওর উপর নজর রাখা। প্রিয় হালদার বলেছিল, ”বিশ্বাস করতে নেই কাউকে এসব কারবারে।” তাছাড়া পথে যদি হামলা হয় লরির উপর, তা সামলাবার ভারও শিবার।
হামলা হয়েছিল বেবি ফুড আর বনস্পতির টিন কৃষ্ণনগরে পৌঁছে দিতে যাবার সময়। কল্যাণীর কাছাকাছি লাঠি হাতে একদল ভিজিলেন্স পার্টির ছেলে লরি থামিয়ে বলেছিল, সার্চ করবে। লঙ্কা—হলুদ—ডালের বস্তার আড়ালে অন্য কিছু আছে কিনা দেখবে। বাজারে তখন গুঁড়ো দুধ পাওয়া যাচ্ছিল না। শিবা তাদের সঙ্গে তর্ক করতে করতে আচমকা রড হাতে লাফিয়ে নেমে লরির সামনে দাঁড়ানো দু—জনের উপর চালিয়ে দেয়। এরপর নির্বিঘ্নে মাল পৌঁছে দিয়ে অন্যপথে ওরা ফিরে আসে। গোরাবাবু শুনে খুশি হয়েছিলেন। শান্ত, মৃদু স্বরে বলেছিলেন, ‘লরি থেকে নামার দরকার কী? সামনে আটকে দাঁড়ালে চালিয়ে চলে যাবে।’
তিনি আরো খুশি এবং নিশ্চিত হয়েছিলেন যেদিন শিবার জন্য সাধু থমকে হাত নামিয়ে নেয়। শিবা সেই রাতেই প্রথম এখানে সাধুকে দেখল। লরিতে এসেছিল তামার তার। অন্ধকারে সাধু দেখতে পায় নি শিবাকে। লরি থেকে নেমেই সে একধারে দাঁড়ানো গোরাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। শুধু তামাই নয়, ছিল কিছু ইস্পাতের চাদরও। শিবা একাই সব জিনিস গুদামে তুলে দিয়ে দরজায় চারটে তালা এঁটে দেখে গোরাবাবু বা সাধু নেই। সুরজ জানাল, ওরা বাড়ির ভিতরে গেছে। নিয়ম, কাজ হয়ে গেলেই চাবি গোরাবাবুর হাতে জমা দিতে হবে।
একতলায় বৈঠকখানার পিছনের ঘরটায় টেবল—ল্যাম্প জ্বলছিল। গোরাবাবু চেয়ারে বসে। সাধু টেবলের ওধার থেকে ঝুঁকে কথা বলছে চাপা উত্তেজিত স্বরে। সেই সময় শিবা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
‘যা কথা হয়েছিল তাই দিতে হবে। রেট বেড়েছে, খরচ বেড়েছে, আপনাকেও বাড়াতে হবে।’
‘এবারে এই নাও। পরে দেখা যাবে।’
‘আগেরবারও ত এই কথাই বলেছিলেন।’
‘গোলমাল করো না, যা দিচ্ছি নাও। নয়ত—’
‘নয়ত কি! আপনার হাতে মিনিস্টার আছে, এম এল এ আছে, পুলিশ আছে তাই ত?’
‘সাধু বেশি বাড় বেড়ো না, যা দিচ্ছি নাও।’
সাধু হঠাৎ দু—হাত বাড়িয়ে গোরাবাবুর দুটো বাহু ধরে তাকে টেনে তুলল। ফ্যাকাসে হয়ে গেল গোরাবাবুর মুখ।
‘একি একি, গায়ে হাত!’
‘যা কথা হয়েছিল সেই রেট চাই।’
এই বলে সাধু প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকাতে লাগল। ঠিক তখনই তার কাঁধে হাত রাখল শিবা। সাধু তখন মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
‘ছেড়ে দাও।’
কিছুক্ষণ শিবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সাধু আস্তে—আস্তে হাত নামিয়ে ছেড়ে দিল গোরাবাবুকে। চোখ দুটো বিষাক্ত চাহনিতে সরু করে তারপর বলল, ‘আবার তুই, এখানেও। ….তোলা রইল। একদিন শোধ দিতে হবে তোকে।’
সাধু হাত বাড়াতেই গোরাবাবু ড্রয়ার থেকে নোটের গোছা বার করে তুলে দিল। সাধু সেগুলো গুনল এবং একটিও কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গোরাবাবুর মুখ এবার হাসিতে ভরে উঠতে শুরু করল। শিবা চাবির তোড়া টেবলে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন তাকে ডেকে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে বাড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘ইউ আর এ ভেরি ভেরি গুড বয়।’
শুনে খুশি হয়েছিল। সেই রাতে বহুক্ষণ ঘড়িটা হাতে পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছিল। বিছানায় শুয়ে হাতটা কানে ঠেকিয়ে টিকটিক আওয়াজ শুনতে শুনতেই তার মনে পড়ে ভবানী স্যারকে। আশ্চর্য, সেদিনও ঠিক এইভাবেই সাধুর কাঁধে হাত রেখে সে বলেছিল, ছেড়ে দাও। গোরাবাবু ‘গুড বয়’ বলায় যতটা ঝলমলে লাগছিল ধীরে ধীরে সেটা মলিন হয়ে গেল। একই ভঙ্গিতে কাঁধে হাত দিয়ে একই কথা সে বলেছে। দু—বারই সে রক্ষা করেছে দুটো লোককে কিন্তু কি যেন একটা তফাত রয়ে যাচ্ছে। দুটো লোকের মধ্যে আকাশ—পাতাল তফাত। সেদিনের মতো নিজেকে তার বিরাট মনে হচ্ছে না। শিবা ঘড়িটা আঁকড়ে ধরে সেই রাতে শুধু ভবানী স্যারের কথাই ভেবেছিল। ইতিমধ্যেই সে জেনে গেছে গোরাবাবুর নানান ধরনের ব্যবসার মধ্যে ট্রেনের ওয়াগন ভেঙে লুট করা মাল কেনা এবং বিক্রি, চোরাচালানী, কালোবাজারী ব্যবসাও আছে।
.
হাত বাড়িয়ে টেবল থেকে ঘড়িটা তুলে শিবা সময় দেখল। সিনেমায় যাবার সময় আর নেই। বিকেলের চা দিয়ে যাবার সময় পার হয়ে গেছে অথচ দেয় নি। বিরক্ত হয়ে সে উঠে বসল। ভিজে গামছায় গা মুছে বাইরে এল।
আকাশের দিকে মুখ তুলে সে তাকাল। আকাশটার ফিকে নীল রঙের উপর হলুদ আলো পড়েছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গুদামের পিছনেই রেল লাইন। কিছুক্ষণ ধরে একটা ইঞ্জিন মালগাড়ি শান্টিং করে যাচ্ছে। যখন রাতে করে শিবা ঘুমোতে পারে না। স্টিমারের ভোঁ শুনলে তার অস্বস্তি হয়। তখন আরো বেশি করে সে নিঃসঙ্গ বোধ করে।
নিম গাছের নিচু ডাল থেকে লোহার শিকল ঝুলছে, ডগায় একটা আংটা। হেভি পাঞ্চিং ব্যাগটা ওই আংটা থেকে ঝোলে। ব্যাগটা ঘরের মধ্যে এক কোণে পড়ে রয়েছে। প্র্যাকটিস করতে তার ইচ্ছে করে না। গত দু—মাসে দু—তিনবার মাত্র ব্যাগটা ঝুলিয়েছিল। গোটা কুড়ি ঘুসি মেরেই বিরক্ত বোধ করে। তিন মাস সে দৌড়য় নি। গঙ্গার ধার দিয়ে উত্তরে বাগবাজারের খালের মুখ নয়ত দক্ষিণে হাওড়া ব্রিজের তলা পর্যন্ত গিয়ে আবার ছুটে ফিরে আসত। দিন তিনেক আগে স্কিপ করেছিল। অল্পক্ষণেই হাঁফিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। শ্যাডো প্র্যাকটিশ করতেও আর ভাল লাগে না।
শিবা দু—আঙুলে চিমটের মতো ধরে পেটের মাংস টানল। ঢিলে হয়ে গেছে পেশী। শরীর বেশ ভারী লাগে। সে ঠিক করল ওজন কমাতে হবে, খাওয়াও কমাতে হবে। আটমাস আগে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ফিরে আর শরীরের দিকে নজর দেয় নি, এবার দিতে হবে। আর দু—মাস পরেই কলকাতায় অল ইন্ডিয়া ইনভিটেশন টুর্নামেন্ট। শিবার মুখটা ধীরে ধীরে বিকৃত হাসিতে ভরে উঠল। সে যে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হতে পারে নি, একথাটা তার মনেই থাকে না। মনে করা দরকার, মাঝে মাঝে দরকার।
বোম্বাইয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আগের দিন সে আর সুনীল বেরা ওজন দেবার জন্য ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে যায়। অন্যান্য রাজ্যের বক্সাররাও এসেছে। সুনীল একজনকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘চিনে রাখ, জব্বলপুরের রোজারিও, এখন ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন। লড়তে হবে ওর সঙ্গে।’ শিবা দেখল তামাটে ছিপছিপে লম্বা একটা লোক গটগট করে বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু পিঠটুকু সে দেখতে পেল।
ব্রেবোর্ন থেকে বেরিয়ে চার্চগেট স্টেশনের সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওরা সময় কাটাচ্ছিল। সুনীল আগে বোম্বাই এসেছে, সে বাড়িগুলো এবং রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছিল শিবাকে।
‘এই যে ইলেকট্রিক ট্রেন এখান থেকে দু—তিন মিনিট অন্তর ছাড়ছে চলে যাচ্ছে সোজা উত্তরে বোম্বাই শহরের মাঝখান দিয়ে বরিভলি। রাতে দু—তিন ঘণ্টা বাদে সারাক্ষণই ট্রেন চলে। এখানকার লোক তাই বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারে তাই কাজও বেশিক্ষণ করতে পারে, পয়সাও বেশি কামায়। রাস্তা দেখছিস কত চওড়া আর পরিষ্কার, গাড়িগুলো স্পীডে চলেছে, ট্র্যাফিক জ্যাম নেই।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শিবা বলেছিল, ‘কলকাতার থেকে সভ্য শহর।’
ওরা হাঁটতে যাবে এমন সময় একটা পোস্টার চোখে পড়ল সুনীলের। পড়ে বলল, ‘ক্রিকেট খেলা হচ্ছে মেয়েদের, বেঙ্গল খেলছে রাজস্থানের সঙ্গে। চল দেখে আসি।’
এই খেলাটি শিবা একদমই বোঝে না এবং পছন্দও করে না। সুনীলই তাকে টেনে আনল স্টেশনের পাশের রাস্তা দিয়ে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। দর্শক খুবই কম। সুনীলই টিকিটের পয়সা দিল। গ্যালারিতে শিবা বিরক্ত হয়েই বসেছিল। বেঙ্গল ফিল্ড করছে। একবার বল তাদের দিকে বাউন্ডারি হল এবং যে মেয়েটি বল কুড়োতে ছুটে এল, তাকে দেখেই শিবা চিনল এবং অবাক হল। ভবানী সান্যালের কোচিংয়ের সেই মেয়েটি যে জিমন্যাস্টিকও করে। নামটা জানে না। ও ক্রিকেট খেলছে কেন? তাহলে জিমন্যাস্টিক করা কি ছেড়ে দিয়েছে? শিবা এর পর মন দিয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখে হাই তুলে সুনীলকে বলল, ‘চল চল বিচ্ছিরি লাগছে। কি যে ভাল লাগে তোদের এই ঠুকুস ঠুকুস খেলা। ওঠ খিদে পেয়েছে, ভেলপুরি খাব।’
‘তোর বড্ড খাই—খাই। অত খেলে আনফিট হয়ে যাবি।’
শিবাকে গুম হয়ে যেতে দেখে সে আবার বলল, ‘বোস না খেলা ত শেষ হয়ে এল। বেঙ্গল আর দুটো উইকেট পেলেই জিতবে।’
‘হ্যাঁরে এদের খেলার পোস্টার দিয়েছে, আমাদের দেয় নি?’
‘কাপড়ে লিখে টাঙিয়েছে স্টেশনের সামনেই, চোখে পড়ে নি তোর?’
‘মেয়েরাও কি বক্সিং করে?’
‘না।’
খেলা শেষ হল। বেঙ্গল জিতেছে ৩২ রানে। সাদা—প্যান্টে পরা মেয়েরা মাঠ থেকে বেরিয়ে প্যাভিলিয়নে গেল। ওরা দু—জন মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগোল চৌপট্টির দিকে ভেলপুরি খাবার জন্য।
জায়গাটায় মেলার মতো ভীড়। আরব সমুদ্রের কোলে হাঁসুলির মতো মালাবার পয়েন্ট থেকে নরিম্যান পয়েন্ট পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকৃতি উপকূল। চওড়া বেলাভূমি। সেখানে বেড়াতে আসা মানুষ গিজগিজ করছে। দু—পাশে তাকালে প্রকাণ্ড উঁচু বাড়িগুলো বুঝিয়ে দেয় এই শহর স্পর্ধা দেখাতে পারে সুন্দরভাবে। ভেলপুরি, আলুমটর, পিঁয়াজি, আইসক্রীম—যা দেখল শিবা তাই কিনে খেল।
সাবধান করে সুনীল বলল, ‘অত খাস নি ওয়েট বেড়ে যাবে।’
‘ট্রেনিং করে কমিয়ে নেব।’
তারপর শিবা গুটিগুটি জলের দিকে এগিয়ে যায়, সমুদ্রের জলের স্বাদ কেমন পরখ করার ইচ্ছায়। ফিরে আসছে যখন, দূর থেকেই দেখল সুনীল কথা বলছে সেই লোকটির সঙ্গে, যার জামায় লাল—সাদা ফুলের ছাপ, চার ইঞ্চি চওড়া বেল্ট, কব্জির উপর উল্কি, ছিপছিপে লম্বা, যার নাম রোজারিও। সঙ্গে একটি বাচ্চচা ছেলে বছর ছয়—সাত বয়সের আর স্কার্ট—ব্লাউজ পরা এক মহিলা। শিবা মনে মনে কুঁকড়ে ভীড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়ার কথা ভাবল। যার সঙ্গে দু—তিন দিনের মধ্যেই রিং—এ লড়তে হতে পারে, তার সঙ্গে সে কথা বলতে চায় না।
‘এই শিবা।’ সুনীল চীৎকার করে ডাকতেই শিবা ঘুরে দাঁড়াল।
‘এদিকে আয় আলাপ করিয়ে দি।’
শিবা কাছে আসতেই রোজারিও হাত বাড়িয়ে দিল। কুণ্ঠিতভাবে শিবাও হাত বাড়াল।
‘বেরা ওয়াজ জাস্ট টেলিং মী অ্যাবাউট ইউ। হাম তো রিটায়ার করনেওয়ালা বুঢঢা হ্যায়। তুমহারা পাঞ্চ বহত জোরদার হ্যায়, হাম বেরাসে শূনা। তো থোড়া আস্তে সে হামকো হিট করো; হাম মর যায়গা তো মেরা ইয়ে বিবি ঔর বাচ্চচাকো কৌন দেখেগা।’ এই বলে রোজারিও হো হো করে হাসল।
শিবা অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘নেহি নেহি, হামতো আপনার কাছ থেকে শিখেগা।’
‘কেয়া শিখেগা?’
শিবা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রোজারিওর মুখের হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। শান্ত ধীর স্বরে বলল, ‘হাম বহত সাল বক্সিং মে হ্যায়, শূনকে রাখো, নেভার শ্যেক হ্যান্ডস উইথ অ্যান অপোনেন্ট আনটিল ইউ হ্যাভ হুইপড হিম। জিতনে কা আগে অপোনেন্ট কা সাথ কভি হ্যান্ডশ্যেক না করো।’
‘আপ হি তো কিয়া, আপ হি তো হাত পহেলা মিলায়া।’ সুনীল বলল।
‘দেখো, হাম অপোনেন্টকো হেট করতা। উই ফাইট, বাট ডিপ ইন আওয়ার মাইন্ড উই ডু নট রিয়েলি হেট। হাম মনমে হেট বানাতা, ঘৃণা তৈয়ার করতা। মনমে অপোনেন্টকো খারাপি দুষমন বানাকে হাম অ্যাটাক করতা।’
শিবা কথাগুলো বোঝবার চেষ্টা করছিল যখন, তার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো রোজারিওর ছেলেটি তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে এক বেলুনওয়ালার দিকে। শিবা ঝুঁকে বলল, ‘খোকা বেলুন নেবে?’ ছেলেটি লজ্জা পেয়ে তার মায়ের দিকে সরে গেল। শিবা ওর হাত টেনে নিয়ে গেল বেলুনওয়ালার কাছে। দুটো বেলুন কিনে ওর হাতে দিল। খুশিতে ঝকঝক করে উঠল চোখদুটো। হাসিতে ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁট।
‘কি নাম তোমার, নাম কেয়া?’
‘নীল….নীল রোজারিও।’ বলেই ছেলেটি ছুটে তার মায়ের কাছে গেল।
নীল! শিবার মনে পড়ল ছোট ভাই নীলুকে। অনেকটা এই বয়সেই মারা গেছে।
‘আচ্ছা, থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য বেলুনস। হামকো আভিতো যানে হোগা। ইয়ে মেরা লাস্ট ন্যাশানালস হ্যায়। ওহি লিয়ে নীল ঔর উসকো মাম্মিকো লে আয়া। পাপ্পা ক্যায়সা ফাইটার হ্যায় নীল আপনে আঁখোসে দেখেগা, উনকো ইয়ে লাস্ট চান্স।’
যাবার আগে ছেলেটি হাত নাড়ল। শিবাও হাত নাড়ল।
‘ছেলেটা বেশ, নারে?’
সুনীল জবাব দিল না।
‘কি বলল বলত হ্যান্ডশেক করা নিয়ে?’ শিবা জিজ্ঞাসা করল।
‘বলল মনে মনে রাগ ঘেন্না তৈরি করে অপোনেন্টকে মারবার জন্য। কিন্তু ওটা বানানো ব্যাপার, আসলে মনের মধ্যে সত্যি সত্যি কাউকে ঘেন্না করে না।’
‘ধ্যেৎ এসব বানিয়ে তবে কিনা লড়তে হবে, জিততে হবে? কেন, এমনি কি জেতা যায় না? যখন হারবার ভয় পেয়ে বসে তখনই এসব করতে হয়।’
শিবা কথাটা শেষ করল, আর তখনি দেখল সাদা প্যান্ট ও শার্ট পরা চারটি মেয়ে ভেলপুরির দোকানের দিকে এগোচ্ছে।
‘ওদের একজনকে আমি চিনি।’
সুনীল অবিশ্বাসভরে তার দিকে তাকাল। তাই দেখে শিবা হাসল। সুনীল বলল, ‘ওরা বেঙ্গল টিমের মেয়ে।’
শিবা এগিয়ে গেল।
‘তুমি ভবানী স্যারের কোচিংয়ে পড়তে না? লালবাগানে জিমন্যাসটিকও করতে।’
মেয়েটি অবাক হয়ে গেল। তারপর চিনতে পারল। শিবার আপাদমস্তক দেখল।
‘হ্যাঁ।’
‘আর পড়তে যাও নি কেন? বলেছিলুম ত গুণ্ডার ভয় নেই।’
কথাটা এড়িয়ে মেয়েটি বলল, ‘আপনি এখানে?’
‘আমাদের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ হচ্ছে।
‘কিসের?’
‘বস্কিং—এর ।’
‘অ।’
‘তোমাদেরও তো হচ্ছে। আজ দেখলুম বসে বসে।’
‘আমরা সেমিফাইনালে উঠলাম।’
‘আমাদেরটা দেখবে না? সামনেই ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে হবে।’
‘বক্সিং বিশ্রী ব্যাপার। দেখলেই কেমন যেন মাথা ঘোরে, খালি ঘুসি মারা, মুখ ফটিয়ে দেওয়া।’
‘আমার কিন্তু বেশ লাগে।’ আর একটি মেয়ে উৎসাহ ভরে চটপট বলল, ‘কবে হবে আপনাদের, দেখতে যাব।’
‘কাল আরম্ভ, ফাইনাল রোববার।’
হঠাৎ মেয়েরা আড়ষ্ট হয়ে ভেলপুরি দোকানের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। কারণ খুঁজতে গিয়ে শিবা দেখল শীর্ণ লম্বা এক মহিলা তার দিকে কটমট চোখ রেখে মেয়েদের দিকে এগোচ্ছে।
‘এত দেরি হচ্ছে কেন তোমাদের, সব সময় সব জায়গায় আড্ডা না দিলেই নয়? গাড়ি কতক্ষণ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবে?’
শিবা পায়ে পায়ে তখন পিছোতে শুরু করে দিয়েছে।
প্রথম লড়াই ছিল দিল্লির অরুণকুমারের সঙ্গে। শিবা অপেক্ষা করছিল ড্রেসিংরুমের বেঞ্চে। এমন সময় পাকাচুলভরা মাথা, ঘাড়ে—গর্দানে, বেঁটে একটি লোক শিবার পিছন থেকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে ‘ইউ আর শিবাজী আইচ?’
শিবা লাফিয়ে উঠেছিল ভয় পেয়ে। লোকটার কণ্ঠ নাকিসুরের। শিবা ঘাড় নাড়তেই বলল, ‘আই অ্যাম বেহরাম মিস্ত্রি।’
নামটা শিবা যেন শুনেছে। প্রিয় হালদার বলেছিল, গোরাবাবুর সঙ্গে এই লোকটা আর এক পাঞ্জাবী মিলে অল ইন্ডিয়া টুর্নামেন্ট করবে।
‘ফার্স্ট রাউন্ডমে নক আউট করো, ইনাম মিলেগা হান্ড্রেড রূপীজ। ইয়ে অরুণকুমার কুছ নেহি। কেয়া সেকেগা?’
শিবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। যন্ত্রের মতো শুধু মাথাটা হেলাল।
‘গোরা টেলেক্স ভেজা, তুম বহুত ফাস্ট ঔর হার্ড হিটার বক্সার। তুমহারা পর উইনকা দর আজ ক্যালকাটামে চার—এক, ফাস্ট রাউন্ড নক আউটকা দর আট—এক। বোম্বাইমে তিন—এক, দিল্লিমেভি তিন—এক।’ মিস্ত্রি ওর কাঁধ চাপড়ে আর একবার বলে, ‘শও রূপেয়া।
ঘরের আর একদিকে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকা অরুণকুমারের দিকে তাকিয়ে শিবা আবার মাথা হেলাল। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না। তবু এটুকু সে জেনে গেছে, তাকে ফার্স্ট রাউন্ডে জিততে হবে নক আউট করে যদি একশো টাকা পেতে হয়।
রিং—এ দু—মিনিটের মধ্যেই শিবা একশো টাকা জিতে নিল। অরুণকুমার শুরুতেই এগিয়ে এসে দুটো লেফট জ্যাব ছোঁড়া। শিবা অবহেলায় মুখটা পিছিয়ে নেয়। আবার জ্যাব করতেই শিবার বাঁ হাত পলকে অরুণকুমারের মাথায় এবং সেটা অনুসরণ করে চোয়ালে ডান হাতে সোজা একটা। কাঠের মতো হয়ে গিয়ে ওর হাঁটু দুটো কেঁপে উঠল। টলতে টলতে সে পিছিয়ে গেল আর শিবা এগোতে লাগল। ওর চোখ দেখে শিবা বুঝে গেল, লড়াইয়ের ইচ্ছা শেষ হয়ে গেছে। এবার শুধু খুশিমতো হাত বাড়িয়ে ওকে মারা। কর্নারে নিয়ে গিয়ে শিবা দ্রুত ডান—বাঁ কম্বিনেশন চালাতেই অরুণকুমার পড়ে গেল।
প্রায় হাজার চারেক লোক চীৎকার করে শিবাকে তারিফ জানায়। ফোটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ মুহুর্মুহু ঝলসে ওঠে। রেফারি যখন অরুণকুমারের উপর এক দুই গুণে যাচ্ছে শিবা তখন চোখ বোলায় দর্শকদের উপর। ব্রেবোর্ন মাঠের একবারে ইস্ট স্ট্যান্ড ঘেঁষে রিং। এত লোক সে আগে দেখে নি। ওদের চীৎকার তার ভাল লাগছে। নক আউটই ওদের ভাল লাগে। যত মারবে ততই ওরা ভালবাসবে। শিবা ভালবাসা চায়। একা নিঃসঙ্গ জীবনকে ভরাবার জন্য এই চীৎকার তার দরকার।
পরদিন দ্বিতীয় লড়াই রেলওয়েজের মার্টিনের সঙ্গে। গত দিনের মতো বেহরাম এসে বলল, ‘আজ ভি শও রূপেয়া। ফার্স্ট রাউন্ডমেই খতম করো।’
শিবা তাই করল। মার্টিন অতি সাবধানী হয়ে অপেক্ষা করছিল শিবার আক্রমণের জন্য। শিবা মুখের সামনে গার্ড না রেখে দু—হাত নামিয়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে ওকে পাক দিয়ে ঘুরতে থাকে। দর্শকরা হৈ হৈ করে ওঠে মজা পেয়ে। বিদ্রূপ করে তারা মার্টিনকে কুকুরের ডাক দিতে শুরু করে। তখন মেজাজ খারাপ করে মার্টিন তেড়ে এসে শিবার পাঁজরে বাঁ হাতের ঘুসি চালায়। ডান হাতে ঘুসিটা রুখে দিয়েই শিবার লেফট হুক এবং আপার কাট ঝলসে ওঠে। ক্যানভাসের নীচের তক্তাটা কেঁপে ওঠে মার্টিনের পড়ার ধাক্কায় আর শিবার কানের পর্দা ফেটে যাবার উপক্রম হয় চীৎকারের শব্দে। আবার ফার্স্ট রাউন্ড নক আউট।
এই রাতেই শিবা আবার রিং—এ এল সেমি—ফাইনালে সারভিসেসের শ্যামবাহাদুরের সঙ্গে লড়তে। এখনো পর্যন্ত তার গায়ে একটাও ঘুসি লাগে নি। আর এক দিক থেকে উঠেছে রোজারিও আর রবিশেখর। দুটো লড়াই পুরো তিন রাউন্ড পর্যন্ত লড়ে জিততে হয়েছে রোজারিওকে। সকলেই ধরে রেখেছিল ফাইনালে তার সঙ্গে শ্যামবাহাদুরের লড়াই হবে। কিন্তু এখন অন্য গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
শিবা ড্রেসিংরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল রোজারিওর লড়াই। রবিশেখরকে নাস্তানাবুদ করছে। সুনীলও তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে। প্রথম দিনেই সুনীল এই রবিশেখরের কাছে হেরেছে। সেকেন্ড রাউন্ডে রেফারি লড়াই থামিয়ে দেয়। সুনীলের তখন ভ্রূ কেটে রক্তে মুখ ভেসে যাচ্ছিল। মিস্ত্রি শিবাকে ডান হাতের পাঞ্জা তুলে দূর থেকে দেখাল। শিবা বুঝতে পারল না। সুনীলকে বলল, ‘শুনে আয় ত।’
ফিরে এসে সুনীল বলল, ‘পাঁচশ যদি ফার্স্ট রাউন্ডে নক আউট করতে পারিস।’
শিবা ফার্স্ট রাউন্ডেই নক আউট করেছিল। এবং চ্যাম্পিয়নশিপে এই প্রথম সে ঘুসি খেল। শ্যামবাহাদুরের একটা রাইট সুইং, সঙ্গে একটা লেফট হুকও পাঠিয়েছিল। শিবা সাইড—স্টেপ করে বাঁদিকে সরে গিয়েও দেখতে পায় নেপালির মুখের সামনে ডান হাতের গার্ড নামানো। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চোয়াল লক্ষ্য করে শিবার লেফট হুক বেরিয়ে এল। ডান হাতে মারল বুকে, পাঁজরের মাঝখানে। শ্যামবাহাদুর ঝুঁকে পড়তেই তার মুখে শিবার ডান—বাঁ, ডান—বাঁ এবং আপার কাট ঝড় তুলে দিল। শান্ত এবং ক্লান্তভাবে শ্যামবাহাদুর আস্তে আস্তে উবু হয়ে লুটিয়ে পড়ল ক্যানভাসে।
রিং থেকে নামামাত্র কারা তাকে কাঁধে তুলে ড্রেসিংরুমে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন তার মনে হচ্ছিল যা কিছু দেখছে শুনছে, সবই কেমন অবাস্তব। চায়ের দোকানের শিবা ব্রেবোর্নকে কাঁপিয়ে এখন ‘শিবাজী শিবাজী’ ধ্বনিতে নায়কের মর্যাদা পাচ্ছে। শিবা বিশ্বাস করতে পারছে না।
.
পরদিন কলকাতা থেকে গোরাবাবু প্লেনে উড়ে এলেন। খবর দিতেই বিকেলে তার হোটেলে শিবা দেখা করতে এল সুনীলকে নিয়ে। গোরাবাবু সুনীলকে ঘরের বাইরে কিছুক্ষণের জন্য পাঠিয়ে শিবাকে বললেন, ‘এই ফাইনালটা নিয়ে হেভি বেটিং হচ্ছে শিবা। হাজার হাজার টাকার ব্যাপার। আমারও অনেক টাকা এতে রয়েছে। তুমি ফার্স্ট—রাউন্ড নক আউট পারবে? এই নিয়েই বেটিং, দরটা বেশি তোমারই বিরুদ্ধেই।’
‘আমি পারব না ধরে নিয়েছে?’ ঔদ্ধত্য এবং নিজের উপর প্রবল আস্থা শিবার স্বরে ফুটে উঠল।
‘হ্যাঁ। বারবার তিনবার যা পেরেছ চতুর্থবার তা হবে না, এটাই সবাই ধরে নিচ্ছে।’
‘তাহলে আমি ফার্স্ট রাউন্ডেই করব।’
‘কিসের জোরে একথা বলছ?’
‘রোজারিও বুড়ো হয়ে গেছে। গায়ের জোর কমে গেছে, আমার থেকে স্লো, দমেও পারবে না।’
‘পাঁকাল মাছের মতন পিছল, শেয়ালের মতো ধূর্ত। কিভাবে লড়াইগুলো পয়েন্টে জিতেছে লক্ষ করেছ?’
‘করেছি। সব জারিজুরি ভেঙে যাবে এই লেফট হুক যখন ওর চোয়ালে পড়বে।’ বলতে বলতে শিবা বাঁ হাতের মুঠো বাতাসের মধ্যে দ্রুত চালাল।
‘রোজারিও কিন্তু বেহরামের লোক। আমার পার্টনার হলেও ওকে আমি বিশ্বাস করি না। ও চাইবে আপসেট ঘটিয়ে দাঁও মারতে। তোমাকে কিছু খেতে দিলে খাবে না, জলও না। বাইরে থেকে জল নিয়ে যাবে ফ্লাস্কে। মনে রেখো তোমার উপর অনেক টাকা আমি ধরেছি।’
শিবার ঠোঁট তাচ্ছিল্যে একটু বেঁকে গেল। চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ফার্স্ট রাউন্ড নক আউট চতুর্থ বারও হবে জেনে রেখে দিন।’
কিন্তু শিবা একটা জিনিস জানত না রোজারিওর বৌ ও ছেলে রিং—এর ধারে বসবে। ছেলে একবার অন্তত বাবাকে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে লড়তে দেখুক, বাবার বলদৃপ্ত তেজী ছবিটি ওর মনে গেঁথে যাক, এটাই রোজারিওর ইচ্ছা।
ফাইনালের দিন অন্যান্য ওয়েটের লড়াইগুলোর দিকে দর্শকরা ভ্রূক্ষেপ করল না। তারা প্রায় সাত—আট হাজার। প্রথম রাউন্ডেই নক আউট করার ভেল্কি দেখতে তারা এসেছে। তিনবার ঘটিয়েছে যে, সে চতুর্থবারও ঘটাবে না কেন? বোম্বাইয়ের বক্সিং পাগলরা অপেক্ষা করছে আর একবার ভেল্কি দেখার জন্য।
তাই শিবা রিং—এ উঠতেই রকেটের মতো একটা উল্লাস, হুশশ করে আকাশে উঠে গেল। ডান হাত তুলে শিবা চারধারে তাকিয়ে মাথা নোয়াল। এইসব আদবকায়দা সে এখানে এসে দেখে শিখেছে। পিঠের তোয়ালেটা সুনীলকে দিয়ে সে রিং—এর ধারে বসা মানুষদের উপর চোখ বোলাতেই দেখতে পেল রোজারিওর ছেলে নীল তার দিকে তাকিয়ে। বড়বড় দুটো চোখে বিস্ময়, সারল্য এবং ভয়ও। চোখাচোখি হতেই নীল হাত নাড়ল। শিবা পারল না। হাত তুলতে গিয়ে তার মনে হল, কে যেন চেপে ধরেছে।
হঠাৎই তার মনে হল এখন তার দরকার ঘৃণা—হেট রোজারিওকে হেট। নয়ত সে লড়তে পারবে না। ভিতর থেকে একটা জোর তাকে চাগিয়ে তুলতে হবেই। হাতটাকে যে শক্তি চেপে ধরেছে, সেটাকে গুঁড়িয়ে দিতে এখন একটা আক্রোশ দরকার। কোথা থেকে সে পাবে। রোজারিওকে সে প্রায় চেনেই না, কিভাবে সে ঘৃণা তৈরি করবে? লোকটাকে যতটুকু দেখেছে মোটামুটি ভালই লেগেছে। শিবা স্যাডো করার জন্য কয়েকবার শরীরটা নাড়িয়ে ঘুসি চালাল আর নিজের উপর রেগে উঠল এই ভেবে—কেন বেলুন কিনে দিতে গেলাম। কেন ওকে নীলু মনে হল। বক্সিং—এ স্নেহ মমতা অচল এটা বুঝতে পারলুম না।
রোজারিও রিং—এ উঠতেই, শিবা লক্ষ করল, নীল একইভাবে হাত নাড়ল। হাসিতে ঝকঝক করে উঠল রোজারিওর মুখ, সেও হাত তুলল। শিবার মনে হল, তার জন্য কেউ নেই! কলকাতা হলে নিশ্চয় ননী থাকত! ননী! ননী! ননী! ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল শিবার মাথার মধ্যে একটা রাগ। এই ননীই বলেছে : ”সাবাস ফাইটার। এবার পাবি সোনার বকলেস।”
হ্যাঁ, সোনার বকলেসই গলায় নেব। স্যাডো করতে করতে শিবা অযথা দুটো কঠিন ঘুসি শূন্যে গেঁথে দিল। এখন ডিসেম্বর, কলকাতায় লোকে সোয়েটার পরছে। কিন্তু সমুদ্রের ধারে এখানে প্যাচ প্যাচে ঘাম। শিবাও ঘামছে উত্তেজনায় আর অন্ধ রাগে। সাগর মামীর কথাটা তার মনে পড়ল।
‘এই কি বড় হবার পথ। এমন পথে ত কুকুরে যায়।’
‘হ্যাঁ আমি কুকুরই। কুকুর, কুকুর।’ শিবা গজরাতে শুরু করল মনে মনে। তোমাদের সবাইকে দেখাব আমি ফাইটার কিনা। সোনার বকলস পরেই যাব তোমাদের কাছে। সেদিন সবাই এসে আমার পা চাটবে।
রেফারি যথারীতি নিয়মকানুন আউড়ে গেল। শিবার কানে কিছুই ঢুকল না। সে তখন মাথা নিচু করে রাগে ফুলে ফুলে উঠছে। রাগ তাদেরই বিরুদ্ধে যারা তার কাছের মানুষ ছিল। যারা দিনরাত কষ্টের মধ্যে আধপেটা খেয়েও তাদের পরিবেশের মধ্যে শিবাকে ধারণ করে রেখেছিল। যারা রক্তের মধ্যে লড়াই করার প্রবল ইচ্ছা জীইয়ে রেখে সেটা প্রবাহিত করে দিয়েছিল শিবার রক্তে, যার জোরে সে রিং—এ উঠে শক্তিমান হয়ে উঠত। সেই রক্তধারার বিরুদ্ধে এখন তার রক্তের মধ্যে চীৎকার উঠছে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই শিবা ও রোজারিও মুখোমুখি হল।
প্রথমেই শিবার মনে হল, রোজারিওর মুখে সে তার বাঁ হাত পৌঁছে দিতে পারবে, শুধু সোজা ঘুসিই নয় লেফট হুকও। দ্রুত কয়েকটা স্ট্রেট লেফট দিয়ে রোজারিওর স্পিড পরীক্ষা করে বুঝল দূরপাল্লা থেকে ও দ্রুত ঘুসি পাঠাতে পারে না কিন্তু নড়াচড়ায় দ্রুত। কুকুর যেমন গা থেকে জল ঝেড়ে ফেলে সেইভাবেই ঘুসি ঝেড়ে ফেলতে পারে। তবে শিবার মনে হচ্ছে, তার বাঁ হাত থেকে এড়িয়ে যাবার সাধ্য রোজারিওর কমই। ফার্স্ট রাউন্ডে ফেলে দিতে হলে ওকে বাঁ হাতের পাল্লার মধ্যে কাছে টেনে আনতে হবে কিংবা এগোতে হবে। ফার্স্ট রাউন্ডে ওকে চাই—ই। গোরাবাবুর কাছে সে বড়মুখ করে বলেছে—করব।
রোজারিও দূরে দূরে ঘুরছে। হয়তো জেনে গেছে শিবার মনের কথা। শিবা এগোল। রিংটাকে আড়াআড়ি কেটে এগোতে এগোতে সে রোজরিওকে কর্নারে নিয়ে যাচ্ছে। দর্শকরা বুঝতে পেরেছে খতম করার জন্য শিবা এবার একটা কিছু করবে। তারা প্রায় একসঙ্গেই চীৎকার করে উঠল : ‘কীল, কীল, কীল।’
শিবার লেফট হুক তৈরি হয়ে ওঠার আগেই রোজারিও এগিয়ে এসে জড়াজড়ি করে ফেলল। শিবার গলায় ওর ডান হাত। জোরে হাত চালাবার পথ বন্ধ। ব্যর্থ ঘুসি রোজারিওর বগলের নীচে মারতে মারতে শিবা ঠেলে সরাতে চাইল। কিন্তু রোজারিও ছাড়ছে না।
‘ব্রেক।’ রেফারি হুকুম দিল।
পিছিয়ে যেতে গিয়ে শিবার ডান পা সামান্য পিছলে গেল। অতি সামান্য এবং শিবার চোখ পলকের জন্য ক্যানভাসের দিকে নেমেছিল। তখনি ঠিক কানের উপর রোজারিওর রাইট সুইংটা এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একটা স্ট্রেট লেফট। শিবা দড়াম করে ক্যানভাসের উপর পড়ল।
মাথার মধ্যে ভোমরার ডাক শুরু হয়েছে। ঘরের দরজা খুলছে…গাঢ় হলুদ আর সবুজ আলো দপ দপাচ্ছে। শিবা এই জাগরণ, আধ—স্বপ্ন অবস্থাটা জানে। ভোমরা ডাকের মতো মাথার ঝিমঝিমানিটা বন্ধ করে দিতে পারলে ঘরের মধ্যে ঢুকেও সে বেরিয়ে আসতে পারবে। মাথা ঝাঁকাল সে। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসল। এলোমেলো বোধটা ঠিক হয়ে আসছে। দেখতে পাচ্ছে রোজারিওকে দূরে কর্নারে দাঁড়িয়ে।
‘সেভেন….এইট….’
উঠে দাঁড়াল শিবা। তিন মিনিটের অনেকখানি চলে গেছে। আর নয়, আর নয়, এবার ওকে মেরে শুইয়ে দিতে হবে, শুইয়ে দিতে হবে। মনে মনে শিবা গর্জে উঠে তেড়ে গেল। চারদিকে ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়েছে গর্জন। নক আউট চাই! নক আউট!
শিবার মুখে জ্যাব পড়ল। পেটে একটা ডান হাতের। সে কিছুই অনুভব করল না। রোজারিওর ঘুসিতে জোর নেই। শিবা খুঁজছে, বাঁ হাতের পাল্লায় রোজারিওকে পেতে। পেয়েও গেল। লেফট হুকের সঙ্গে সঙ্গে নাকের নীচে ছুঁড়ে দিল স্ট্রেট রাইট।
পড়ে গেছে রোজারিও। গলগল রক্ত ঝরছে নাক থেকে। বাজ পড়ার মতো একসঙ্গে কয়েক হাজার কণ্ঠের উল্লাস কাঁপিয়ে তুলল স্টেডিয়ামকে। যা চাইছিল ওরা তা পেয়েছে।
‘পাপ্পা….পাপ্পা।’
একটা কচি গলা ডেকে উঠল। ছোট্ট ফোঁপানি উঠল।
‘পাপপা। পাপ….পা।’
রোজারিওর ক্যানভাস থেকে মুখ তুলল। দু—হাতে ভর দিয়ে দেহের উপরিভাগ তুলে তাকাল যেদিক থেকে ডাকটা আসছে। দু—চোখে ঠিকরে উঠল দুর্দমনীয় জেদ আর ইচ্ছা, যন্ত্রণায় গালের পেশীগুলো দুমড়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে সে দেখতে চাইছে তার রক্তমাংসের প্রতিচ্ছবিকে যার সামনে সে নায়ক হয়ে বিরাজ করতে চায়।
‘ফাইভ…সিক্স…’
‘পাপ্পা গেট আপ।’
রোজারিওর মাথাটা অল্প অল্প নড়ে উঠল। টপ টপ রক্ত থুতনি বেয়ে গেঞ্জির উপর পড়ছে। বিড়বিড় করে কিছু বলল। তারপর শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে যখন উঠে দাঁড়াল রেফারি তখন ”টেন” উচ্চচারণ করছে।
কর্নার থেকে শিবা দ্রুত এগিয়ে আসছে। রোজারিও মুখের সামনে দু—হাতের গার্ড রেখে টলতে টলতে পিছিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই ঘণ্টা পড়ল প্রথম রাউন্ড শেষ হবার। শিবা বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে রইল রোজারিওর দিকে। সাদা গেঞ্জিটা লাল হয়ে গেছে। গালে, কাঁধে রক্তের ছোপ। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সম্মোহিতের মতো শিবা সিং—এর বাইরে তাকাল। নীল বড় বড় চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে। এক হাতে আঁকড়ে রয়েছে তার মায়ের বাহু।
অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা আর দুঃখ শিবার মনের মধ্যে ছেয়ে আসছে। ধীরে ধীরে সে নিজের কর্নারে ফিরে এল। অবসাদে তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। আবছা একটা স্মৃতি, একটা চেহারা, টুকরো কথা ক্রমশ এগিয়ে আসছে রেলগাড়ির মতো গমগম শব্দ তুলে।
শিবার মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে সুনীল ঝড়ের মতো নির্দেশ উপদেশ ধমক, অনুরোধ দিয়ে চলল। কিছুই ঢুকল না তার কানে। অপর কর্নারে টুলে বসা রোজারিওর দিকে তাকিয়ে সে। এবং এই সময়েই তার মাথার মধ্যে স্মৃতির রেলগাড়িটা এসে পৌঁছল। তার থেকে নেমে এল ভবানী স্যার আর সাধু। এগিয়ে এসে সাধু ভবানী স্যারের ডান হাতটা মুঠোয় ধরল। সাধুর হাতের পেশীগুলো দপ করে লাফিয়ে উঠেই পাথরের মতো স্থির হয়ে রইল। স্যারের মুখে যন্ত্রণার কুঞ্চন একবার ফুটে উঠেই মিলিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক হল। সাধুর ফর্সা মুখ টকটকে দেখাচ্ছে, কপালে বিনবিনে ঘাম, চোয়াল শক্ত হচ্ছে।
‘শিবা তুই ভুল করছিস।’ সুনীল বলে যাচ্ছে। ‘নক আউট করার জন্য চেষ্টা করিস নি, পারবি না। রোজারিও পয়েন্ট তুলে নিচ্ছে। তুই বাজে লড়ছিস?’
ফ্যাল ফ্যাল করে শিবা তাকিয়ে রইল সুনীলের মুখের দিকে। তার ওই ঘুসি খেয়েও রোজারিও উঠে দাঁড়াল। তিনটে নক আউট এই ঘুসিতেই হয়েছে অথচ ও উঠে দাঁড়াল! কিসের জোরে উঠল! তার চোখের সামনে ভাসছে ভবানী স্যার। মাথাটি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, শরীরটা আস্তে আস্তে কুঁজো হয়ে এল ভবানী স্যারের—’আমি নুইব না, নুইব না।’
শিবার বুক থরথর করে কাঁপতে লাগল। রোজারিও নুয়ে পড়ল না। কি অসম্ভব ক্ষমতায় সে উঠে দাঁড়াল। এই ক্ষমতা পেল কোথা থেকে? রোজারিও এখন ভবানী স্যার হয়ে গেছে, শিবা শিউরে উঠে ভাবল, তাহলে এখন আমি কি সাধু হয়েছি? সেদিন শিবা নামে একজন সাধুকে ঘাড় ধরে টেনে ঘুরিয়ে দিয়ে বলেছিল—
‘পাপ্পা কাম অন……ফাইট?’
শিবার স্মৃতির রেলগাড়ি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তার মাথা থেকে বেরিয়ে রওনা হয়ে গেল। ঘণ্টা পড়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হবে। মাথাটা এখন গ্রামের স্টেশনের নির্জন প্ল্যাটফর্মের মতো ফাঁকা। রোজারিও উঠে এগিয়ে আসছে। সেদিন সাধুর চোয়াল ভেঙে শাস্তি দিয়েছিল একজন। সে কোথায় এখন? যখন রোজারিওর মুখোমুখি হল শিবা, তখন তার মনের গভীরে শুঁয়োপোকার মতো একটা ভয় নড়ে বেড়াতে শুরু করেছে। অসহায় বোধ করে সে দু—পাশে দ্রুত তাকিয়ে নিল। চীৎকার উঠল ‘কীল, কীল। শিবাজী কীল।’
সে এখন কোথায়?
শিবা একটা জ্যাব ছুঁড়েই পাশে সরে গেল। রোজারিওর চোখের দিকে তাকিয়ে পুরু চশমার কাচ দেখতে পেল সে। বিদ্যুতের তীব্র আলো পড়ে বরফ কুচির উপর সূর্যরশ্মির মতো ঝকমক করছে। শিবার চোখ ধাঁধিয়ে আসছে। সে শুধুই ঘুরতে শুরু করল রিং—এর ভিতর রোজারিওকে দূরে রেখে।
‘কাম অন শিবাজী….নক হিম, নক হিম আউট।’
রোজারিওর দুটো হাত সাপের ফণার মতো এক একবার এসে ছোবল দিয়ে যাচ্ছে শিবার মুখে, বুকে কাঁধে। দর্শকরা এবার শিবাকে দুয়ো দিতে শুরু করল। তারা মার দেখতে চায়, রোজারিও মারছে।
দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ হতেই শিবা নিজের কর্নারে এসে দু—হাতে মুখ ঢেকে বসল।
‘ফেক, ফেক নকলি হ্যায়, শিবাজী ইজ এ চিট।’
চীৎকার। সাত—আট হাজার দর্শক খেপে গেছে। সুনীল জল এগিয়ে দিল। সে খেল না। তোয়ালে দিয়ে হাওয়া করে যাচ্ছে, কথা না বলে। শিবা বুঝে গেছে সে হারছে এবং হারবে। মনের মধ্যে অবসন্নতা, শরীরও অবসন্ন লাগছে। নিজের উপর আর আস্থা নেই। যতবার সে রোজারিওর দিকে তাকিয়ে রক্তে ভেজা গেঞ্জি, ফুলে ওঠা নাক, তাকে বিষণ্ণ করেছে। প্রতিবারই তার মনে হয়েছে, এই লোকটা আজ হারবে না। ঠিক করেই রিং—এ নেমেছে। গোমস বলেছিল, চ্যাম্পিয়ন তৈরি হয় তাদের ভিতরের, একেবারে ভিতরের জিনিস থেকে—সেটা হল ইচ্ছা,….মনের জোর যাকে বলে উইল। রোজারিওর ইচ্ছা : ছেলের সামনে উজ্জ্বল বীর হবে। ছেলের মনে বাবার এই ছবি চিরকালের জন্য আঁকা থাকুক।
শিবা মাথা নাড়ল। সে কারুর জন্য ছবি আঁকতে চায় না। তার কোনো ইচ্ছা নেই, শুধু কিছু টাকা রোজগার করা ছাড়া। মনের জোর না থাকলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না।
শিবা চ্যাম্পিয়ন হতে পারে নি। তৃতীয় রাউন্ড ছিল দ্বিতীয়বারেই পুনরাবৃত্তি। পয়েন্টে সে হেরে যায়। ধিক্কার আর দুয়ো শুনতে শুনতে সে রিং থেকে নামে। ড্রেসিংরুমে যাবার সময় দেখতে পায় বেঙ্গল ক্রিকেট টিমের তিনটি মেয়ে। তাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। সুনীল বলল, ‘গোরাবাবু আজই তোকে দেখা করতে বলেছে।’
.
ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামের লাগোয়াই অ্যাসটরিয়া হোটেল। দর্শকরা চলে যাবার পর স্টেডিয়াম ফাঁকা হয়ে যেতে শিবা ড্রেসিং রুম থেকে বেরোয়। মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে সে হোটেলে এল। সঙ্গে সুনীল। চারতলায় লিফট থেকে বেরিয়ে ৪১২ নম্বর ঘরের সামনে ইতস্তত করে টোকা দিল। দরজা খুললেন গোরাবাবু স্বয়ং।
”এসো।”
ওরা দুজনে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করলেন। থমথমে মুখ।
”কাল কি বলেছিলে আমায়?”
শিবা মাথা নিচু করে রইল।
”আমার কত টাকা ক্ষতি করেছ তা জান? অপদার্থ হাম্বাগ কোথাকার। খেতে পাচ্ছিলে না, মাথার উপর একটা চালা পর্যন্ত ছিল না, তুলে এনে খাইয়েছি, ঘর দিয়েছি, টাকা দিয়েছি আর তার বদলে পেলাম লোকসান আর ক্ষতি। ইডিয়ট, অশিক্ষিত শুধু বুকনিসর্বস্ব।”
রাগে কাঁপছিলেন গোরাবাবু। হঠাৎ দু—পা এগিয়ে এসে শিবার গালে ঠাস করে চড় কষালেন। হতভম্ব চোখে শিবা তাকিয়ে রইল।
”সব জারিজুরি ভেঙে যাবে এই লেফট হুক চোয়ালে পড়লে।” গোরাবাবু বিদ্রূপে ভেংচে উঠলেন। ‘কোথায় সেই লেফট হুক? পাঁঠার মতো শুধু বড়াই, ফার্স্ট রাউন্ডে জিতবই। থার্ড ক্লাস বক্সার একটা, শুধু গায়ের জোর ভাঙিয়ে বরাত জোরে নক আউটগুলো করে ধরাকে সরা দেখা! লাথি মেরে বিদায় করব। কথা শুনে বিশ্বাস করে এখন লোকসান হল তেরো হাজার টাকা। পারবে, পারবে এই টাকা ফিরিয়ে দিতে?’
মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়ে শিবাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। গোরাবাবু যদি তাড়িয়ে দেয় তাহলে সে যাবে কোথায়?
‘মনে রেখো এই লোকসান উশুল করে দিতে হবে। ইনভিটেশন টুর্নামেন্ট কলকাতায় হবে ঠিক হয়েছে। অনেক বড় টাকার খেলা। এই রোজারিও সঙ্গেই তোমায় লড়তে হবে। যদি আবার আমায় ডোবাও তাহলে চিরতরে যাতে তোমার বক্সিং ঘুচে যায় সে ব্যবস্থা আমি করব। যাও।’
গোরাবাবু আঙুল দিয়ে দরজা দেখালেন। নিঃশব্দে ওরা দু—জন বেরিয়ে এল। রাস্তায় পা দিয়েই শিবা জিজ্ঞাসা করল সুনীলকে, ‘আমি পারলুম না কেন বল ত?’
‘তোকে দেখে মনে হচ্ছিল তোর মন যেন লড়াইয়ে নেই, অন্য কোথাও।’
.
বহুদিন আগে বোম্বাইয়ে রাস্তায় সুনীলের বলা কথাকটি এই বিকেলে মনে পড়ল।
অন্য কোথাও! কোথায় ছিল মন?
জুতোর ফিতে বাঁধার জন্য ঝুঁকতেই শিবার স্ফীত পেটে চাপ পড়ল। বিড়বিড় করল : ট্রেনিং শুরু করতে হবে কাল থেকেই।
ঘর থেকে বেরিয়ে অন্যমনস্কের মতো দরজায় তালা দিল। মালগাড়ি শান্টিংয়ের শব্দ বন্ধ হয়েছে। আকাশের হালকা হলুদ রং বদলে শ্লেট রং ধরেছে। নিমগাছে অজস্র কিচিরমিচির চলেছে। এই রকম সময়ে সে বড় একা বোধ করে এখন একবার ই সি পি সি এ—তে যেতে পারলে ভাল হত। ওখানে সুনীল আছে। ওর সঙ্গে তিন রাউন্ড স্পার করে এলে কেমন হয়। তারপরই সে হতাশভাবে মাথা নাড়ল। শরীরটাকে তৈরি না করে স্পার করার মানে হয় না। তাছাড়া মহাদেবদার ওখানে এখন সুনীল থাকবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। বঙ্গবাসীতে রাতে বি কম পড়ে। ছেলেটা ভাল, প্রচুর সাহায্য করেছে বেঙ্গল চ্যামপিয়নশিপে তার হাতে মার খাওয়ার পরও।
শিবা হাঁটতে হাঁটতে, আহিরিটোলা থেকে বেরিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। একটা ৩২ নম্বর বাস তার সামনে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর—’শ্যামবাজার, বরাহনগর, দক্ষিণেশ্বর’ বলে চীৎকার করতেই, কিছু না ভেবেই সে ছুটে গিয়ে উঠল। মনটা কোথায় ছিল, এবার যেন সে তার হদিশ পাচ্ছে।
শ্যামবাজারে সে বাস বদল করল। ড্রাইভারের পিছনে দাঁড়াবার জায়গা পেল। পিঠের উপর ভীড়ের চাপ। মুখ নিচু করে সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। দেবদাস পাঠক রোডের দিকে যত এগোচ্ছে তার বুকে ধুকপুকানি ততই বাড়ছে। ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর একটা প্রশ্ন তার মনে বারবার জেগে উঠতে লাগল : কেন যাব? শেষবার বলে এসেছে—’আসব, হ্যাঁ সোনার বকলস পরেই আসব। সেদিন সবাই এসে আমার পা চাটবে।’ নিশ্চয় ওরা সেকথা মনে রেখেছে। ওখানে গেলে সবাই তাকিয়ে থাকবে কিন্তু কেউ কথা বলবে না। কেউ অবাক চোখে, কেউ বিদ্রূপভরা চোখে। কিন্তু ওদের সকলের অন্তরেই ত থাকবে একই জিনিস—ঘৃণা। হেট।
দেবদাস পাঠক রোডের মোড়ে বাস থামতেই শিবা জানালা দিয়ে তাকাল। জায়গাটা ঠিক একই রকম রয়েছে। মোড়ে বসে আছে ফল নিয়ে আজম, হাওয়াই চটি নিয়ে শামুয়া, সকালের বাসি কাগজ সাজিয়ে রতনের বাবা। ঠেলাগাড়িতে প্লাস্টিকের জিনিস নিয়ে লোকটা যার নাম সে জানে না। স্ট্যান্ডে দুটো রিক্সা। সিটের উপর বসে আছে কালু আর বড়ভোলা। চায়ের গ্লাস হাতে পচা দর্জির দোকানে ঢুকল। গ্রেট বেঙ্গলের সন্তাোষ আর পল্টু, ওদের পিঠটুকু মাত্র সে দেখতে পেল। সন্তাোষ ছুটছে আর রেঞ্চ হাতে পল্টু তাড়া করেছে। প্রায়ই খুনসুটি বাধে ওদের মধ্যে। ননীটা কোথায়? উলটোদিক থেকে দক্ষিণমুখো একটা বাস থেমে গিয়ে শিবার দৃষ্টি আড়াল করল।
তার বাসটা স্টার্ট নিয়েছে। এখানে বাস প্রায় অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। শিবা নামল না, নামতে সাহস হল না। দেবদাস পাঠক রোড ছাড়িয়ে বাস এগোল, শিবা কিন্তু জানালা দিয়ে তাকিয়েই আছে। লোভীর মতো, যতটুকু দেখা যায় এই অঞ্চলটা, চোখ দিয়ে চেটেপুটে নিতে লাগল।
রাস্তার আধখানা খুঁড়ে পাইপ বসানো হচ্ছে। বাকি আধখানা দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে। দু—দিকেই সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। হর্নের আওয়াজ আর চীৎকার চলেছে। শিবা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল এই গোলমালের কারণ একটা রিক্সা।
বিরাট তিনটে বস্তা, দুটো পাদানিতে একটা সিটে বসানো। রিক্সার একটা চাকা পড়েছে গর্তে। রিক্সাওয়ালা সিটে কুঁজো হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে পায়ের। তার জামায় বোতাম নেই। জিরজিরে বুকের পাঁজরগুলো যেন ফেটে পড়বে। ঘাড়ে গর্ত হয়ে কণ্ঠার হাড় ঠেলে বেরোচ্ছে। রস বার করে নেওয়া আখের ছিবড়ের মতো শুকনো পা দুটোয় যতটুকু পেশী আছে, দড়ির মতো তা পাকিয়ে উঠেছে। রিক্সাটা বিন্দুমাত্রও নড়ছে না।
‘আরে নেমে গিয়ে পিছন থেকে ঠ্যাল না।’
বাস ড্রাইভারের চীৎকার শুনে রিক্সাওয়ালা মুখ তুলল। ননীর বাবা রাধেশ্যাম!
শিবা প্রায় লাফ দিয়ে বাস থেকে নামল। রাধেশ্যাম রিক্সা থেকে নামার আগেই সে রিক্সার পিছনে গিয়ে দু—হাত লাগিয়েছে, সামনে ঝুঁকে মুখটা রাস্তার দিকে নিচু করে। একটা চাকা গর্তে আটকে গেছে। ঠেললেও ওঠে না। অমানুষিক শক্তিতে শিবা চাকাটা টেনে তুলে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিতেই রিক্সাটা এগিয়ে গেল। শিবা মুখ তুলতেই অবাক রাধেশ্যামের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল মাত্র। তারপরই প্যাডেল করতে করতে সে রিক্সা নিয়ে চলে গেল।
বোধ হয় চিনতে পারে নি। না পারুক, শিবার মন ঝলমল করে উঠল খুশিতে। তার হাতে কাদা, হাঁটুর কাছে এবং জুতোয়ও কাদা। সপ্রশংস চোখে বাসযাত্রীরা তার দিকে তাকিয়ে। সে হাত নেড়ে অপেক্ষমাণ বাস ড্রাইভারকে চলে যাবার ইঙ্গিত করে দক্ষিণমুখো বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। উত্তরে আর তার যাবার দরকার নেই। কিছু একটা করতে পেরেছে, এখন এটাই তাকে ভীষণ উত্তেজিত করে তুলেছে। এই রাধেশ্যামই একদিন তাকে ‘ভগমান’ বলেছিল। হয়তো ও জানে না, আজ শিবাই তার রিক্সাকে টেনে তুলেছে। কোনোদিনই জানবে না। না জানুক, শিবা খুশিতে ঝরঝরে বোধ করল।
রাত্রে শিবাকে ডেকে পাঠালেন গোরাবাবু।
‘টুর্নামেন্টটার ডেট এগিয়ে আনতে হল, এশিয়ান গেমস ট্রায়ালের আগেই করার জন্য। তুমি তৈরি আছ ত?’
‘হ্যাঁ।’ শিবা বেশ উৎসাহভরেই বলল। যদিও সে জানে লড়াইয়ের জন্য তার শরীর একদমই অপ্রস্তুত।
‘রোজারিওর সঙ্গেই লড়তে হবে। ওর কাছে হারের শোধ নেবে বলে তুমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—এইভাবে পাবলিসিটি করা হবে। ফার্স্ট রাউন্ডেই নক আউট করবে বলেছ, এই কথাটাও থাকবে। ক্যাসিয়াস ক্লে—র কায়দায় আর কি। সে যেমন আগেই বলে, কত রাউন্ডে নক আউট করবে, সেই রকমই খবরের কাগজে বলা হবে। পোস্টারও দেওয়া হবে। পারবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার অনেক টাকা লোকসান করেছ, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘অবশ্য টাকায় নক আউটটা ম্যানেজ করতে পারি। কিন্তু বেহরাম সেজন্য অনেক টাকা চাইবে। তার থেকে তুমি যদি করেই ফেলতে পার তাহলে ও পথে যাব না, দরকারই হবে না। অনেক টাকা ধরব তোমার উপর, পারবে?’
‘হ্যাঁ। ফার্স্ট রাউন্ডেই করব।’
পাঁচ
ফার্স্ট রাউন্ডেই শিবা নক আউট হয়েছিল। টিনের চালার ইনডোর স্টেডিয়ামে রিং তৈরি করে, তার চারদিকে গ্যালারি বসিয়ে টিন দিয়ে ঘিরে, প্রথম অল ইন্ডিয়া ইনভিটেশন বক্সিং টুর্নামেন্ট শুরুর সাতদিন আগে থেকেই প্রচার হয়েছিল দারুণ লড়াই হবে শিবাজী আইচের সঙ্গে ফ্রান্সিস রোজারিওর। প্রেস কনফারেন্স, পোস্টার, হ্যান্ডবিল, ব্যানার হোর্ডিং ইত্যাদি সব মিলিয়ে ফ্রি স্টাইল কুস্তিতে দারা সিং—কে যেমন তুলে ধরা হয়, তেমনি ভাবেই এই লড়াইটাকে চাঞ্চল্যকর উত্তেজক করে তোলা হয়েছিল প্রচার মারফৎ।
শিবা একমাস ধরে ট্রেনিং করেছে ই সি পি সি এ রিং—এ। গোরাবাবুর সঙ্গে লালবাগান জিমন্যাসিয়ামের বহু ব্যাপারেই বনিবনা নেই। তাই ওখানে তিনি শিবাকে যেতে দেন না। আশ্চর্য ঘটক বা গোমসের সঙ্গে শিবার সম্পর্ক ছেদ হয়ে গেছে গোরাবাবুর বাড়িতে এসে ওঠার পর থেকেই। গত একমাস সে নিয়মিত স্পার করেছে সুনীলের সঙ্গে; ভোরে দৌড়েছে গঙ্গার ধার দিয়ে; স্কিপ করেছে; হেভিব্যাগে ঘুসি মেরে মেরে আঙুলের গাঁটে কড়া তৈরি করে ফেলেছে। সে নিশ্চিত ছিল ফাইনালে হারের শোধ তুলে নেবে।
লড়াইয়ের আগে সে ত্রিপল ঘিরে বানানো ড্রেসিংরুমের এককোণে বেঞ্চে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। ত্রিপলের ওধারে দশহাত দূরেই আর একটি ড্রেসিংরুমে রোজারিও। তাদের লড়াই ছিল সবার শেষে। আগের লড়াইয়ের বক্সাররা তৈরি হচ্ছে রিং—এ যাবার জন্য। ছোট্ট জায়গাটায় ভীড় ছিল। সেই সময় কান্তি সরকার এসেছিল।
‘কিরে, এভাবে শুয়ে কেন, একটু ফ্রি হ্যান্ড কর, স্যাডো কর।’
‘করছি।’ শিবা পাশ ফিরে বলল। কান্তিকে দেখে সে একটু অবাক হল, ভালও লাগল। লালবাগানেই তার বক্সার জীবনের জন্ম, প্রথম ঘুসি খাওয়ার অভিজ্ঞতা এই কান্তিরই হাতে। যদিও এই লোকটিকে সে মনের গভীরে ঘৃণা করে তবু লালবাগানের মানুষ কাছে পেয়ে তার বুকে তিরতির আবেগ বইতে শুরু করে।
‘তোর কথা আশ্চর্যদা, গোমস প্রায়ই বলে। শিবা বড় হয়ে একদম ভুলে গেছে আমাদের।’
শুনে কলকল করে উঠল শিবার বুকের মধ্যে, একটু অভিমানও হল।
‘বারে, ওরা ত কেউ আমার খোঁজ নেয় নি! বোম্বাইয়ে গোমস যদি রিং—এর পাশে থাকত আমি হারতুম না। কিছুতেই না।’
‘খোঁজ নেয় নি কিরে? বোম্বাইয়ে দু—দিনে তিনটে নক আউট করলি, সেই দু—দিন লালবাগানে আশ্চর্যদা শুধু গল্পই করেছে শিবার হেভিব্যাগ ফাটানোর। গোমস কেক কিনে এনে বিলিয়েছে। এই দ্যাখ না আজ সকালে গোমস চারটে কমলালেবু দিয়ে বলল, আমার গুড উইশ জানিও আর লড়াইয়ের আগে খেতে বলো। এনার্জি দেবে, স্ট্যামিনা পাবে।’
কান্তি সরকার হাতের কাগজের মোড়ক থেকে প্লাস্টিকের টিফিন কৌটো বার করল।
‘একেবারে ছাড়িয়েই এনেছি।’ এই বলে সে এগিয়ে ধরল কৌটোটা। শিবা একমুঠো কমলার কোয়া তুলে নিয়ে মুখে পুরল। গোমসের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চোখে জল এসে গেছে।
‘গোমস বলেছে আজ ফার্স্ট রাউন্ড নক আউট হবেই।’
‘সত্যি?’
‘সত্যি। ওর দারুণ বিশ্বাস তোর উপর। বলেছে, শিবার স্পিডের কাছে দাঁড়াবার মতো কেউ এখন ইন্ডিয়ায় নেই। অমন পাঞ্চের জোরও কারুর নেই।’
কান্তি কৌটোটা এগিয়ে ধরল আবার। শিবা আরো কয়েকটা কোয়া তুলে মুখে পুরল। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ঠিক তখনই ড্রেসিংরুমের বাইরে যাবার পর্দা তুলে দাঁড়াল সাধু। শিবা তাকাল। সাধুর মুখ ধীরে ধীরে হাসিতে ভরে উঠল। ও নাকি কখনো হাসে না, তাই শিবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পর্দাটা ফেলে দিয়ে সাধু চলে গেল।
‘ব্যাটা এখানে কেন? সুবিধের ব্যাপার নয়। দাঁড়া আমি দেখে আসছি।’ বলতে বলতে কান্তি সরকার উঠল এবং যাবার সময় অন্যমনস্কের মতো টিফিন কৌটোটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেল।
অদ্ভুত এক অজানা ভয়ে শিবা অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করে। সাধু হাসল কেন? বাইরে তখন তুমুল চীৎকার। ব্যান্টাম ওয়েটের একটা লড়াই চলেছে। সুনীল বাইরে রয়েছে লড়াই দেখতে।
শিবা ড্রেসিংরুমের পর্দা তুলে রিং—এর দিকে তাকাল। গুমোট ভ্যাপসা পরিবেশ। রিং—এ দু জন বক্সার ঘামছে। একজন জ্যাব করছে, প্রদীপ শিখার মতো হাতটা দপদপাচ্ছে আর অন্যজন পতঙ্গের মতো জ্যাবের আওতায় আসছে আর পিছিয়ে যাচ্ছে। একজন ভারী মন্থর অন্যজন চটপটে। শিবা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একবার ঝাপসা দেখল যেন। চোখে ঘাম গড়িয়ে পড়েছে কি? দু—হাতে চোখ কচলাল। মাথার মধ্যে একবার ঝিমঝিম করে উঠল। তাড়াতাড়ি সে ড্রেসিংরুমে ঢুকে জাগ থেকে জল নিয়ে চোখে ঝাপটা দিল। বার কয়েক চোখের পাতা পিট পিট করে নিয়ে দূরে একটা লোকের দিকে তাকাল। পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু এক একবার অসাড় হয়ে আসছে মাথার মধ্যে। ঝিমধরা ভাব মাথা থেকে শরীর বেয়ে নীচে নামছে।
সুনীল এল। শিবা তাকাল তার মুখের দিকে। মনে হল একবার যেন মুখটাকে সে ঝাপসা দেখল।
‘সুনীল, কেমন যেন লাগছে রে। শরীরটা অবশ মনে হচ্ছে।’
‘নার্ভাস হোস নি শিবা, এখন নার্ভাস হলে বিপদ।’
‘না না, নার্ভাস হই নি। মাথার মধ্যে কি রকম যেন—ঠিক বোঝাতে পাচ্ছি না তোকে।’
শিবার আঙুলে ব্যান্ডেজ জড়াতে শুরু করেছে সুনীল। কথা বলল না। ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন গোরাবাবু সঙ্গে প্রিয় হালদার।
‘সব ঠিকঠাক আছে ত?’
সুনীল ঘাড় নাড়ল। গোরাবাবু হাত রাখলেন শিবার কাঁধে।
‘ফার্স্ট রাউন্ডেই।’
কাঁধে কয়েকটা চাপড় দিলেন। শিবা একদৃষ্টে তাকিয়ে ব্যান্ডেজ জড়ানোর কাজ দেখছে।
‘শিবা করতে পারলে অনেক টাকা তুমি পাবে। অভাব থাকবে না। খাওয়া পরার যা কষ্ট পেয়েছ মনে আছে ত?’
শিবা মুখ তুলল না। প্রিয় হালদার ফিসফিস করে গোরাবাবুর কানে কি বলল। তিনি মাথা নাড়লেন, তারপর ঝুঁকে শিবার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘অনেক টাকা আমার গেছে এবার যেন না যায়, তাহলে কিন্তু তোমার কেরিয়ার আজই খতম হবে।’
শিবা যখন মুখ তুলল, গোরাবাবুরা তখন ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে গেছে। তার হাঁটু দুটো আলগা লাগছে, কাঁধ থেকে হাত দুটো খুলে পড়বে মনে হচ্ছে। এ রকম কেন হচ্ছে? মরীয়া হয়ে সে মনে মনে ব্যাপারটা বুঝতে চাইল না। যদি না পারি তাহলে কেরিয়ার খতম! পারব না কেন? কিন্তু শরীরটা এ রকম করছে কেন? চোখে ঠিক দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেরিয়ার খতম হলে কোথায় যাব, কি খাব, কোথায় থাকব?
‘সুনীল আমার শরীরে কিছু একটা হয়েছে। জোর নেই মাথা ঝিমঝিম করছে।’
শিবা দু—হাতে জড়িয়ে ধরল সুনীলের হাত। চোখে জল এসে গেছে।
‘আমি পারব না রে।’
‘কিছু খেয়েছিস?’
‘না। শুধু কয়েকটা কমলার কোয়া, কান্তিদার হাত দিয়ে গোমস পাঠিয়েছিল।’
‘কখন, কখন?’
‘খানিকটা আগে।’
বজ্রাহতের মতো সুনীল তাকিয়ে রইল শিবার মুখের দিকে। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘আর কিছু করার নেই।’
সত্যিই কিছু করার ছিল না রোজারিওর। শিবা কুঁজো হয়ে যথারীতি বুনো মোষের মতো এগিয়ে গেছল তার দিকে।
এত দূর থেকে সে প্রথম জ্যাবটা পাঠাল যে পৌঁছলই না। রোজারিও অবাক হয়ে যায়। তীক্ষ্ন চোখে লক্ষ্য করে তার মনে হয় শিবা দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে। সে এগিয়ে আসে। পরপর দুটো রাইট—লেফট শিবার কাঁধে আর রগের কাছে মারে। ঘুসি খেয়ে পিছিয়ে গিয়েই আবার এগিয়ে এসে শিবা লেফট হুক চালায় এবং রোজারিওর মুখের এক বিঘৎ সামনে দিয়ে ঘুসিটা বাতাস কেটে বেরিয়ে যায়।
এরপর শিবার এক হাতের মধ্যে এসে রোজারিও প্রথমে দুই পাঁজরের মাঝে বুকে, তারপর থুতনিতে আপার কাট বসায়। কাটা কলাগাছের মতো শিবা দড়াম করে পড়ে যায়। ততক্ষণে গ্যালারিতে দর্শকদের মধ্যে চীৎকার শুরু হয়ে গেছে। কাঠের টুকরো, জুতো, আইসক্রীমের কৌটো, এমনকি ইঁটও পড়তে শুরু করেছে রিং—এর মধ্যে।
‘সাজানো…..সাজানো লড়াই।’
‘পয়সা ফেরত চাই।’
দর্শক গ্যালারি থেকে নেমে আসার উপক্রম করছে। প্রচণ্ড লড়াই দেখার জন্য এসে তারা দেখল এক মিনিটেরও কমে নক আউট হল তাদের নায়ক। রেফারির দশ গোনা শেষ হবার পরও শিবা ওঠে নি। রিং—এর মধ্যে সুনীল লাফিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আরো লোক উঠে, সুনীলকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে শিবাকে তুলে নিয়ে গেল রিং থেকে। লোকগুলি যেন তৈরি হয়েই ছিল এরকম কিছু ঘটবে।
শিবাকে সঙ্গে নিয়ে ওই লোকগুলো ট্যাক্সিতে গোরাবাবুর বাড়ি পৌঁছল। তার মাথার মধ্যে ঝিলিক দিচ্ছে তীক্ষ্ন যন্ত্রণা, সারা শরীরে আলস্য, পায়ে জোর নেই দাঁড়াবার। ড্রেসিংরুমে আধঘণ্টা নিস্পন্দ শুয়েছিল সে সংজ্ঞাহীনের মতো।
তাকে নিয়ে লোকগুলি ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। কাউকেই সে চেনে না। ওদের রুক্ষ চেহারা, কর্কশ কণ্ঠস্বর, অমার্জিত ভাবভঙ্গি দেখে শিবার শরীর ছমছম করল। ভিতরের বৈঠকখানা ঘরের দরজা ভেজানো। একজন ভিতরে ঢুকে গেল। তারপরই দরজার দুটো পাল্লা খুলে দাঁড়াল সাধু।
টেবল ল্যাম্পের চাপা আলোয় ঘরটা অন্ধকার। সাধুর কাঁধের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে গোরাবাবু চেয়ারে বসে। হঠাৎ শিবার দুটি বাহু পাশের দুটি লোক আঁকড়ে ধরল। ছাড়িয়ে নেবার জন্য হাত ঝাঁকতে গিয়ে শিবা বুঝতে পারল, বৃথা চেষ্টা। তার দেহে কোনো জোর নেই।
‘তোকে একদিন না একদিন পাব, আমি জানতুম।’
ঠান্ডা গলায় মৃদু স্বরে সাধু বলল, ইশারা করতেই লোক দুটো শিবাকে ঠেলে দিল ঘরের মধ্যে। টাল সামলে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তার কাঁধের উপর হাতুড়ির মতো পড়ল সাধুর জোড়া মুষ্ঠি। যন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ করে শিবা নিচু হতেই, সাধু ডান পা তুলে লাথি কষাল তার পেটে। পিছন দিকে হেলে পড়ে যাচ্ছিল। ওরা তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।
‘সাধু একদম খতম করো না।’
ঘাড় ফিরিয়ে সাধু পিছনে গোরাবাবুর দিকে তাকাল। চোখে হিংস্র বীভৎস চাহনি।
‘বয়স অল্প, পৃথিবীর অনেক কিছুই এখনো ত দেখে নি। দেখুক, শুনুক, বুঝুক। সেজন্য একটা সুযোগ না দিলে অন্যায় করা হবে।’ বলতে বলতে গোরাবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আবার সাধু এগিয়ে এসে শিবার সামনে দাঁড়াল। মুখোমুখি, এক হাত দূরে। দু—জনে একদৃষ্টে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে প্রায় এক মিনিট। দু—হাতে সাধু ধরল শিবার দুই বাহু। সাপের মতো হিসহিস করছে সাধুর নিঃশ্বাসের শব্দ।
‘আমার চোয়ালের কথা মনে আছে? আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কেউ আজ পর্যন্ত দেখায় নি। তুই এখনো বেঁচে আছিস এটাই আশ্চর্য ব্যাপার।’
শিবার মনে হল দুটো সাঁড়াশি তার বাহু চেপে ধরেছে। মাথার মধ্যে ঘূর্ণিটা সমানে চলেছে। পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে সাধুর ডান হাতের বাইসেপস শক্ত হচ্ছে। ঘুসি মারার আগে এই রকম হয়। কিছু করার নেই।
দক্ষতা নেই কিন্তু জোর আছে ঘুসিটায়। শিবার কানের পাশে যেন বোমা ফাটল। মাথাটা হেলে পড়ল। মাথার মধ্যে ভোমরা ডেকে উঠল। সাধু বাঁ হাতে ঘুসি চালাল। শিবার মুখ ঘুরে গেল।
হেভিব্যাগে পাঞ্চ করার মতো দুহাতে সাধু ঘুসি মেরে যেতে লাগল তার সারা শরীরে। পিছন থেকে ওরা তাকে ধরে আছে। কখন সে জ্ঞান হারাল শিবা তা জানে না।
কখন সে জ্ঞান ফিরে পেল তাও শিবা জানে না। গাঢ় অন্ধকার। বহু দূরে ট্রাক চলার শব্দ আর হর্ন শোনা যাচ্ছে। তাকে কোথাও ফেলে দিয়ে গেছে। নরম মাটি, ঘাস, গাছপালার গন্ধ। শিবা ওঠার চেষ্টা করে পারল না। শরীরে কোনো অনুভূতি নেই শুধু ভোঁতা একটা যন্ত্রণা ছাড়া। হামা দিয়ে সে কয়েক হাত এগোল। অন্ধকার অন্ধকার চারিদিকে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে নোনতা স্বাদ পেল। সামনের দুটো দাঁত বোধ হয় নেই, ফাঁকা লাগছে। মাথা ঘুরে সে আবার শুয়ে পড়ল। দপদপ করছে আলো, গাঢ় হলুদ আর সবুজ। …দেয়ালে ঝুলছে বিবেকানন্দ আর রামদা, টপটপ রক্ত ঝরছে রামদা থেকে। ….একঘেয়ে সুরে মন্ত্র পড়ছে ন্যাড়ামাথা লোকেরা, তাদের মধ্যে বটকেষ্ট। ভোমরা ডাকটা ক্রমশ বাড়ছে।
আমি কি নক আউট হয়ে গেছি? শিবা ওঠার চেষ্টা করল। রোজারিও উঠেছিল। রোজারিও মুখ তুলে বারবার রিং—এর পাশে তাকাচ্ছিল। কি অদ্ভুত ওর চোখ! ক্ষীণভাবে শিবার কানে ডাক এল : ”পা…প…পা। পা…প….পা।” ছেলের সামনে রোজারিও বীর হতে চায়।
বীর হতে চায়।
শিবা চাড় দিয়ে হাঁটুর উপর বসেই আবার গড়িয়ে পড়ল। যন্ত্রণা এবার সারা শরীরে ঢেউয়ের মতো আছড়াচ্ছে। বুকে ব্যথা, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু রোজারিও বীর হতে চায়। কেন আমিও হব না? হব, হব।
দু—হাতে চাড় দিয়ে শিবা অদ্ভুত এক চীৎকার করে উঠে দাঁড়াল। ঝাপসা দেখছে, হাঁটু থরথর করে কাঁপছে। হাঁ করে বাতাস গিলে খেতে লাগল। অন্ধকার, অন্ধকার চারদিক। দূর থেকে ট্রাকের শব্দ আসছে, হেডলাইটের আলো ক্ষীণ স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। দু—হাত পাশে ছড়িয়ে মুখটা আকাশের দিকে তুলে শিবা দুলতে লাগল।
‘আমি হাত বাড়াব; বল বল আমায় হাত বাড়াতে বল মা।’
তারপর বুনো খ্যাপা হাতির মতো শিবা টলতে টলতে এগোল ঝোপঝাড় মাড়িয়ে, গাছে ধাক্কা খেতে খেতে। নালায় আছড়ে পড়ল, অসমান জমিতে ঠোক্কর খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
‘গেট আপ পাপ্পা। গেট আপ শিবা, কাম—অন শিবা।’ বিড়বিড় করতে করতে শিবা এগোল। অন্ধের মতো দু—হাত বাড়িয়ে। একটা জায়গায় পৌঁছে সে বুঝল এটা বড় রাস্তা। দূর থেকে আলো আর এঞ্জিনের শব্দ এগিয়ে আসছে। শিবা দাঁড়িয়ে রইল হাত তুলে।
পরপর চারটে ট্রাক চলে গেল ওর হাতকে ভ্রূক্ষেপ না করে। মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়; বুকে, পিঠে আর তলপেটের উপর যেন পাহাড় থেকে অবিরাম পাথরের চাঙড় ভেঙে ভেঙে পড়ছে। শিবা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে টলছে। জামাটা ফালা ফালা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুক। বিড়বিড় করে যাচ্ছে সে : ‘গোমস গোমস এবার আমি কি করব? কি বলছ তুমি? রানিং ইজ দি সোর্স অফ স্ট্যামিনা…বাংলামে বোলিয়ে; স্ট্যামিনা, রিজার্ভ ট্যাঙ্ক…দৌড় দৌড়, রোড ওয়ার্ক কর। ঠিক।’
হঠাৎ শিবা দৌড়তে শুরু করল পিচের রাস্তার ধারে মাটির উপর দিয়ে। অন্ধকার ঠেলে ঠেলে। এলোমেলো পা ফেলে সে ছুটছে। মাঝে মাঝে ট্রাকের আলো তাকে ঝলসে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। শিবা ভ্রূক্ষেপ করল না।
‘রোড ওয়ার্ক, এখন আমার ট্রেনিং চলছে। হট যাও, হট যাও, শিবাজী আইচ এখন দৌড়চ্ছে। ধাক্কা লাগলে তোমরা চুরমার হয়ে যাবে। এখন আমি স্বপ্ন দেখছি, খোয়াব, ভিশ্যন! ইয়েস গোমস ইয়েস…লড়াইয়ের হারজিত হয় জিমে, রাস্তায়। এই যন্ত্রণা জমা থাকবে শরীরের ভেতরে…জমা থাকবে ট্যাঙ্কে।’
আধঘণ্টা পর শিবা হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তার ধারে, নালায়। দেহের সহ্য করার সাধ্যের বাইরে চলে গিয়ে সে দৌড়াচ্ছিল। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা অসাধ্য কাজ। কিন্তু শিবা তখন সাধারণের ঊর্ধ্বে উঠে গেছল। নালায় সামান্য জল ছিল। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে জলের কাছে এনে কয়েক ঢোঁক জল খেয়েই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
দেবদাস পাঠক রোডের মোড়ে ভোরবেলায় আনাজপাতি নিয়ে যারা বসে তারাই প্রথম দেখতে পায়। মুখটা দেখতে পায় নি। রক্তাক্ত দেহ, ছেঁড়া জামা দেখে ভেবেছিল খুন করে ফেলে যাওয়া লাস। ভয়ে কাছে আসে নি। ভীড় জমে গেছল। চিনতে পারে প্রথম বটকেষ্ট। দোকান খোলার জন্য সে যাচ্ছিল। তারপর আসেন ভবানী স্যার। রিক্সাওয়ালারাই শিবাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
দু—দিন পর বিকেলে শিবা হাসপাতালের বেড থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। তখন অন্যান্য রুগিদের বেডের কাছে ভীড়। আত্মীয়—স্বজন, বন্ধুবান্ধব দেখতে এসেছে। তার বেডের পাশে কেউ নেই। উদাস চোখে সে তাকিয়ে। আজ দুপুর থেকে সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে, মানুষ চিনতে পারছে।
হঠাৎ তার মাথার দিকের বারান্দায় কণ্ঠস্বর শুনল : ”না গো ওদিকটা নয়, এই দরজাটা দিয়ে, আমি বলছি।”
শিবা টের পেল ঘরের মধ্যে কারা ঢুকল। ঘাড় ঘোরাবার ক্ষমতা তার নেই। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত প্লাস্টারে মোড়া। মমির মতো তাকে দেখাচ্ছে। চোখের মণি যতদূর সম্ভব ঘুরিয়ে সে দেখল তার মাথার কাছে মা আর সাগর মামী।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে দেখতে পেল দাদাকে, তার পিছনে শ্রীকান্ত দাস। সবাই তার দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে। কেউ কথা বলছে না। শিবার চাহনি সবার মুখের উপর দিয়ে বারবার ঘুরতে লাগল।
‘ডাক্তার বলেছেন একদম নড়াচড়া নয়। পাঁচহপ্তা পর প্লাস্টার খোলা হবে।’ নিতুর গলা।
‘ডাক্তার বলেছে, কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় শরীরে এমন আঘাত নিয়ে অতটা ছুটে যাওয়া। মাংস একেবারে থেঁতো হয়ে গেছে।’ শ্রীকান্ত দাসের গলা।
পিছনের বারান্দায় আবার কণ্ঠস্বর। ওরা মুখ ফিরিয়ে তাকাল এবং সরে গেল নবাগতদের জায়গা করে দেবার জন্য।
ভবানী স্যার আর শচীন কাকু।
‘কথা বলা ত সম্ভব নয়, পরেই নয় বলব।’ ভবানী স্যার হাসলেন। ‘মনের জোর এবার তোমায় সারিয়ে তুলবে।’
ইতিমধ্যে শচীন জামার পকেট থেকে একটা জিনিস বার করে ফেলেছে। খোসা ছড়ানো একটা সিদ্ধ ডিম।
‘ওমা খাবে কি করে! ওর কি চিবিয়ে কিছু খাবার ক্ষমতা আছে?’ সাগর মামীর কথায় শচীন অপ্রতিভ হয়ে ডিমটা তাড়াতাড়ি পকেটে রাখল।
সবার অলক্ষেই প্রায় ননী কখন যেন ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘ডিমটারে কি করবেন? আমারে দিয়া দেন, খিদে লাগছে।’
হাত বাড়িয়ে ননী এগিয়ে এল, শচীন তাড়াতাড়ি ওর হাতে ডিমটা তুলে দিল। সেটা হাতে নিয়ে ননী কামড় দিতে গিয়ে দিল না। ফিরিয়ে দিল শচীনকে।
‘নাহ, একসাথেই খাব। ওস্তাদরে আগে ফিট কইর্যা তুলি। ওরে কবে বাড়ি নিয়া যেতে হবে?’
‘ডাক্তার ত বললেন দিন দশেকের আগে নয়।’ নিতু উদ্বিগ্নস্বরে বলল।
‘অঃ, ফিট হইতে আরও মাস দুয়েক। অ কিসু না। তারপর আবার—’ ননী ডান হাত মুখের কাছে ধরে বাঁ হাতে দু—তিনটে জ্যাব ছুঁড়ল। ‘তোর থলিমলি, দড়িদড়া সব তদ্দিনে রেডি হইয়া যাইব। বুঝলেন স্যার, শিবা বড়া জবরদস্ত আদমি। ধর্মেন্দর কা মাফিক বহুত বড়া ফাইটার হ্যায়।’
শিবা একদৃষ্টে তাকিয়ে ননীর মুখের দিকে। তার মনে হচ্ছে ননীর চোখে জল, সকলের চোখে জল। কোথায় যেন একটা নাড়ির বাঁধন রয়েছে এদের সঙ্গে তার। চোখের জলের সঙ্গে সঙ্গে নাড়ির মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে আসছে তার মনে, তার চেতনায়। সে যেন নতুন করে জন্মাচ্ছে। এইবার তার কান্না পাচ্ছে। শিশুকে যখন মাতৃজঠর থেকে বার করা হয় তখন সে কেঁদে ওঠে। শিবা সেইভাবে কেঁদে উঠতে চায় এখন। এখন তার মনে হচ্ছে এদের ভালবাসাই ছিল তার ক্ষমতা, শক্তি। নিজেকে তার নতুন মনে হচ্ছে।
‘শিবা আমার ছোট থেকেই বাড়ন্ত।’ প্লাস্টারের বাইরে যতটুকু শরীর, তাতে হাত বুলোচ্ছে মা। ‘ওকে বড় ভেবে সবাই বড়দের মতো ব্যবহার করেছে। ওর শিশুমনের কথা কেউ ভাবে নি।’
শিবার প্লাস্টারে মোড়া শরীরের মধ্যে তখন একটা কান্না গোমরাচ্ছে। চোখবন্ধ করল। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চোখের কোল বেয়ে জল নামল।
‘ব্যথা করছে, যন্ত্রণা হচ্ছে শিবা?’ সাগর মামী ঝুঁকে পড়েছে। শিবা চোখ খুলল না। সে তখন মনে মনে বলছে, তোমাদের সবার পা আমার মুখের কাছে আনো আমি চাটব।