কুড়োন – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
এই নিয়ে পরপর চারদিন অনিরুদ্ধ শব্দটা শুনল। সে ভারত দলে, বাংলা রাজ্য দলে খেলেছে, ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান ক্লাবে আট বছর আগেও ফুটবল খেলেছে। শব্দটা তার কাছে খুবই পরিচিত। কিন্তু রাত বারোটায় কেন? দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে অবাক হয়ে ভাবল, এত রাতে যে ফুটবলে লাথি মারছে সে পাগল ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
শিমুলহাটিতে পাগল! ফুটবলে শট নেওয়ার মতো পাগল বালিগঞ্জ থেকে ট্রেনে দশ কিলোমিটার দূরে এই আধা—শহুরে শিমুলহাটিতে কে থাকতে পারে? অনিরুদ্ধ মনে মনে চৌধুরিপাড়া, কালীতলা, মণ্ডলদিঘি এলাকার চেনা বাড়িগুলোয় খোঁজাখুঁজি করে কাউকে পেল না। জনাদশেক অল্পবয়সী ছেলে, কালীতলা স্পোর্টিয়ে ফুটবলের ট্রেনিং নেয় বটে, কিন্তু ফুটফুটে জোছনায় মাঝরাতে স্বামী স্বরূপানন্দ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঁচিলঘেরা মাঠে ফুটবল খেলবে, এতটা পাগল তারা নয়।
আগামীকাল পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় মাঠ ভেসে যাচেছ, তা ছাড়া চৌধুরিবাড়ির সদর দেয়ালের ইলেকট্রিক আলো সারারাত জ্বলে। তাতে মাঠের পুবদিকের কিছুটা আলোকিত থাকে। এই আলো আর জ্যোৎস্না মিলিয়ে মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অনিরুদ্ধ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পাঁচিল ঘেঁষে বটগাছটার মগডাল তিনতলা ছাড়িয়ে উঠে রয়েছে দৃষ্টি আড়াল করে। সে বারান্দার এধার থেকে ওধার গেল। মাঠের একটা ফালি দেখতে পেল বটে কিন্তু কোনও জনমানব নেই।
দশ—বারো সেকেন্ড অন্তর শব্দটা হয়েই চলেছে। স্কুলমাঠের দু’দিকে বাড়ি, চৌধুরিদের আর ঘোষেদের। ওরা কি কেউ শুনতে পাচ্ছে না? তা ছাড়া স্কুলের বুড়ো বেয়ারা রাখালদা তো ওই স্কুলবাড়ির পেছনে একটা ছোট্ট ঘরে থাকে, সেও কি কালা হয়ে গেছে? অনিরুদ্ধ শব্দের ধরনটা কান পেতে শুনল। কেউ একজন ফুটবলে শট নিচ্ছে দেয়াল লক্ষ্য করে। ধপাস ধপাস শব্দটা দেয়ালে বল লাগারই, মনে হচ্ছে যেন টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। এত রাতে প্র্যাকটিস! একবার স্কুলমাঠে গিয়ে দেখে এলে কেমন হয়।
অনিরুদ্ধ একতলায় নেমে সদর দরজার খিল খুলতেই দোতলা থেকে তার বিধবা দিদি অমলার গলা শোনা গেল।
”কে রে অনি নাকি? এত রাতে কোথায় বেরোচ্ছিস?”
”অনেকক্ষণ ধরে নাগাড়ে শব্দ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফুটবলে কেউ শট নিচ্ছে। একবার দেখে আসি পাগলটা কে?”
দরজা খুলে অনিরুদ্ধ রাস্তায় বেরোল। বাড়ি থেকে স্কুলের মাঠটা পঞ্চাশ মিটার দূরে। কিন্তু পাঁচিল ঘুরে স্কুলের ফটক দিয়ে মাঠে ঢোকার জন্য হাঁটতে হয় প্রায় তিনশো মিটার।
অনিরুদ্ধ পঁচিশ বছর আগে এই স্কুলমাঠেই প্রথম ফুটবল খেলেছে, তখন সে পড়ত এই স্বামী স্বরূপানন্দ স্কুলে। ইন্টার—ক্লাস খেলা ছিল। ক্লাস সিক্সের সঙ্গে এইটের খেলা। তখন সে সিক্সে পড়ে। ক্লাসের টিমে তার নাম ছিল না। বাড়ির পাশেই মাঠ আর তার নিজের ক্লাসের খেলা, তাই সে মাঠে হাজির হয়েছিল কৌতূহল নিয়ে।
মাঠের ধারে তাদের ক্লাসের ছেলেদের জটলা দেখে সে এগিয়ে যায়। ছেলেরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বারবার তাকাচ্ছে ফটকের দিকে, যেন কারও আসার কথা কিন্তু সে এখনও এসে পৌঁছয়নি।
”নির্মল কি জানে আজ ওর খেলা আছে?”
”নিশ্চয় জানে, আমি নিজে ওকে টিফিনের সময় মনে করিয়ে দিয়েছি।”
”তা হলে! ও তো কথার খেলাপ করার মতো ছেলে নয়, খুব সিরিয়াস। সনৎ, আর ক’মিনিট আছে রে?”
”পাঁচটা বাজতে সাত। ঠিক পাঁচটায় মাঠে না নামলে সার ওয়াকওভার দিয়ে দেবেন। ক্লাস টেনকে, মনে আছে কী করেছিলেন সেদিন? জাস্ট তিন মিনিট টাইম দিয়েছিলেন। ওরা কেতা দেখিয়ে ইচ্ছে করে দেরিতে নামতে গেছল। একেবারে স্ক্র্যাচ।”
নির্মলের বাড়িতে কেউ একজন এখুনি দৌড়ে যা। টিমের গোলকিপার, ও না এলে তো ক্লাস সিক্স ডুবে যাবে। টিমের সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট পজিশান।”
একজন ছুট লাগাল নির্মলের বাড়ির দিকে। ক্লাস এইট মাঠে নেমে গোলে শট নিচ্ছে। গোলকিপার চঞ্চল ফুলহাতা কালো গেঞ্জি পরে দুদিকে দারুণ স্টাইলে ঝাঁপিয়ে খপাখপ বল ধরছে। গেমস টিচার প্রতাপবাবু হাফপ্যান্ট পরে মাঠের সেন্টার সার্কেলে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজিয়ে অপেক্ষা করছেন।
নির্মলের বাড়ি খুব কাছেই, ছুটে গেলে আধমিনিট। ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল।
”ওর বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছেন, তবে চাপা যাননি। নির্মল হাসপাতালে গেছে।”
ছেলেটি শুধু এইটুকু জেনেই ফিরে এসেছে। সর্বনাশ! তাহলে এখন কী হবে?
”ঘনা, তুই এখনি প্রতাপবাবুকে গিয়ে বল দু’মিনিট একস্ট্রা সময় দিন। আমাদের গোলকিপারের বাবা হাসপাতালে, নির্মল সেখানে গেছে। জাস্ট দু’মিনিট টাইম চাই।” টিমের ক্যাপ্টেন শঙ্কর ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে উত্তেজিত চোখে এধার—ওধার তাকাল গোলকিপার খুজতে।
”এই তো অনিরুদ্ধ। বেশ লম্বা, নেমে পড়, নেমে পড়।”
হতচকিত অনিরুদ্ধ দু’পা পিছিয়ে গেল ভয়ে। পেছনে তাকিয়ে দেখে নিল গেটটা কত দূরে। ঘুরে দৌড়তে যাবে, ততক্ষণে তিনজন ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরেছে।
অনিরুদ্ধর গলা দিয়ে দুটো শব্দ বেরোল, ”আমি!”
ধমক দিয়ে শঙ্কর বলল, ”হ্যাঁ তুই। জামাটা খোল, সনৎ তোর জামাটা ওকে পরিয়ে দে। শোন, তুই জীবনে গোলে খেলিসনি আমরা জানি। গোল খেলে আমরা কিছু মনে করব না। যেভাবে পারিস বল আটকাবি আর ওদের যারই পায়ে বল দেখবি তারই পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বি।”
কথা বলতে বলতে শঙ্কর জামাটা টেনে অনিরুদ্ধর মাথা গলিয়ে বার করে নিল। সনৎ তার সাদা টি—শার্টটা অনিরুদ্ধর মাথা গলিয়ে পরাতে পরাতে বলল, ”পা চালাবি, কনুই দিয়ে গুঁতোবি, দেখবি ভয়ে তোর কাছে কেউ আসবে না।”
অনিরুদ্ধ বিব্রত মুখে বলল, ”তখন তো দূর থেকে শট মারবে।”
”নিশ্চয়। দূর থেকেই তো মারবে। ভগবান তা হলে তোকে দুটো লম্বা লম্বা হাত দিয়েছেন কীজন্য? হাতদুটো এবার কাজে লাগা। যা, মাঠে নাম।”
সনৎ পিঠে একটা চড় মেরে ধাক্কা দিল। পুরো সাইজের মাঠ নয়, প্রতি দলে সাতজন। ছয়জনের পিছু নিয়ে অনিরুদ্ধ দক্ষিণ দিকের গোলের দিকে এগিয়ে গেল। মাথায় গুনগুন করছে শঙ্করের উপদেশ: ‘যার পায়ে বল তার পায়ে ঝাঁপ।’
পনেরো—পনেরো তিরিশ মিনিটের ম্যাচ। প্রথম মিনিটেই অনিরুদ্ধ কাজে লাগাল শঙ্করের উপদেশ। বলটা উঁচু হয়ে ডানদিক থেকে এসে পড়ছে পেনাল্টি সীমানার দাগের ওপর। অনিরুদ্ধ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল। ছেলেটি পা দিয়ে বলটা সবেমাত্র চেপে ধরেছে। তখনই অনিরুদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল পায়ের ওপর।
”উহহহ” বলে ছেলেটি পায়ের গোছ দু’হাতে চেপে জমিতে গড়িয়ে পড়ল। বলটা বুকে জড়িয়ে অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়াতেই শঙ্কর ছুটে এসে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ”দারুণ। এইভাবে খেলে যা।”
সেইভাবেই সে খেলে গেল। ক্লাস এইটের দু’জনকে সে শুধু পায়ের ওপর ঝাঁপিয়েই মাঠের বাইরে পাঠাল পায়ে বরফ ঘষার জন্য। মাঠে ফিরে তারা প্রায় দর্শক হয়েই থেকে যায়। প্রতাপবাবু তিনবার ওয়ার্নিং দিলেন অনিরুদ্ধকে। চতুর্থবার দিলেন পেনাল্টি। খেলা শেষ হতে তখন দু’মিনিট বাকি, ফল ০—০।
শঙ্কর এসে কানে কানে বলে গেল, ”আগে দেখে নিবি কোন পায়ে শট নিচ্ছে আর কোন দিকে তাকাচ্ছে, তারপর জয় মা কালী বলে একদিকের পোস্ট লক্ষ্য করে ঝাঁপাবি, এসপার—ওসপার যা হয় হবে।”
অনিরুদ্ধ তাই করল। শটটা যে নিচ্ছে সে কোনদিকে তাকাল আর কোন পায়ে শট নিতে যাচ্ছে, এই দুটো ব্যাপার লক্ষ করে সে ডান দিকে ঝাঁপাল। কী আশ্চর্য, বলটা তার ডানদিকেই জমি ঘেঁষে এল। ডানহাত বাড়িয়ে বলটাকে সে ঠেলে বারপোস্টের পাশ দিয়ে গোল লাইনের বাইরে পাঠাল। কর্নার। নিজের কাজে সে নিজেই অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। পেনাল্টি সেভ করার গৌরবটা সে উপভোগ করেছিল পরের দিন ক্লাসে গিয়ে।
”সত্যি বলছি বিশ্বাস কর, এটাই আমার জীবনে প্রথম গোলকিপিং!” কথাটা অন্তত সাত—আটবার তাকে স্কুলে বলতে হয়েছিল। সে নিজেও অবাক হয়েছিল নিজেকে নিয়ে, এভাবে খেলা সম্ভব হল কী করে! মা—কালীর নাম, শঙ্করের কথামতো তখন নিতে ভুলে গেছল। বুকের মধ্যে শুধু ধড়াস ধড়াস শব্দ। ‘এসপার—ওসপার যা হয় হবে’ শুধু এই কথাগুলোই মাথায় ভোঁ ভোঁ করছিল।
প্রতাপবাবু পরদিন টিচার্স রুমে ডেকে পাঠিয়েছিলেন টিফিনের সময়।
”দারুণ খেলেছ কিন্তু গোলকিপিংয়ের অ আ ক খ—ও তুমি জানো না। স্রেফ সাহস আর অনুমান ক্ষমতার জোরে কাল গোল খাওনি।”
অনিরুদ্ধ জানিয়ে দেয় আগে কখনও ক্রসবারের নীচে সে দাঁড়ায়নি।
”বয়স কত?”
”সাড়ে বারো।”
”হাইট?”
”পাচ ফুট দু’ ইঞ্চি”
”একটা ম্যাচেই তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছ। আরও খ্যাতি কি তুমি পেতে চাও?”
অনিরুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতাপবাবু তীক্ষ্ন চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
”গোলকিপার হওয়ার জন্য যেসব গুণ থাকা দরকার তার প্রথম দুটো তুমি জন্মগত ভাবে পেয়ে গেছ, আর পেয়েছ হাইটটা। বাকিগুলো পেতে হলে পরিশ্রম করে অর্জন করতে হবে। যদি খাটতে চাও তাহলে আমাকে বোলো, তোমাকে কালীতলা স্পোর্টিং ক্লাবের হারাধন দত্তের কাছে নিয়ে যাব। হারাধনের নাম শুনেছ?”
অনিরুদ্ধ অস্ফুটে বলে, ”হ্যাঁ।”
হারাধন দত্তের নাম এ—তল্লাটে কে না শুনেছে? মোহনবাগান, বেঙ্গল, ইন্ডিয়া টিমে খেলেছেন। ভারতজোড়া নাম। বছরকুড়ি আগে খেলা ছেড়েছেন। এখন বাজারে মুদির দোকান, চাষবাস আর পাড়ার ক্লাব নিয়ে থাকেন।
সেইদিনই রাত্রে বাড়িতে খেতে বসে অনিরুদ্ধ বাবাকে বলে, ”আমি গোলকিপার হব। প্রতাপবাবু বলেছেন আমি যদি খাটি তা হলে বড় গোলকিপার হতে পারব।”
অঘোর চক্রবর্তী আঙুলে লেগে—থাকা কুমড়োর ছোঁকা চেটে সাফ করছিলেন। চাটা বন্ধ করে ছেলের দিকে, তারপর ছেলের মা অসীমার দিকে ভ্রূ কোঁচকালেন।
”গোলকিপার হবি কী!” অসীমা অবাক হয়ে বললেন, ”লেখাপড়া করবি না?”
”করব।”
”তা হলে?”
”তা হলে আবার কী? খেলব আর পড়বও।” অনিরুদ্ধ সহজভাবে মায়ের সমস্যাটা মিটিয়ে দিল।
বাবা কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ”ফুটবল প্লেয়াররা তো এখন ভাল চাকরি পায়, রেলে, ব্যাঙ্কে, স্টিলে, এক্সাইজে। সেন্ট্রাল গরমেন্টের অফিসগুলোয় প্লেয়ারদের জন্য অনেক চাকরি আছে। আমাদের রতনবাবুর মেয়ে সাঁতারে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান। পি অ্যান্ড টি—তে চাকরি পেয়েছে, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বিদ্যে। অনি তোকে মাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করতে হবে। ক্লাস ফোর স্টাফ হয়ে যদি ঢুকতে হয় তা হলে গোলকিপার হয়ে কাজ নেই।”
অনিরুদ্ধ বুঝে গেল বাবার আপত্তি নেই তার খেলার ব্যাপারে। খেলে চাকরি পাওয়া যায় এটা বাবা জেনে গেছে। সে গলায় জোর দিয়ে বলল, ”মাধ্যমিক কেন, আমি বি.এ. পাশও করব।”
অঘোর বললেন, ”তা হলে তো খুব ভাল।” এর পর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে,”চাকরির যা বাজার অনি তা হলে গোলকিপারই হোক, দেশে এখন আর গোলকিপার কোথায়? অনি তো এখনই বয়সের তুলনায় লম্বা, আরও লম্বা হবে, থঙ্গরাজের পর তো লম্বা কাউকে পাওয়াই গেল না। যদি মনে করিস বড় হতে পারবি তা হলে মন দিয়ে চালিয়ে যা, দেখছি তো কত বি.এ, এম.এ ফ্যা ফ্যা করে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
শুনতে শুনতে অসীমা মাথা কাত করে স্বামীর কথাগুলোয় সমর্থন জানাতে থাকেন। শুধু একটা চাকরির কথা ভেবেই অনিরুদ্ধর বাবা—মা তার গোলকিপার হওয়াতে রাজি হয়ে গেলেন শুধু একটা শর্তে—”লেখাপড়া জানা ঘরের ছেলে, বি.এ—টা পাশ করতে হবে।”
পরদিনই সে প্রতাপবাবুকে জানিয়ে দেয়, খাটতে রাজি।
”আমি আজ হারাধনের বাড়ি যাব, কথা বলব ওর সঙ্গে।”
প্রতাপবাবু দু’দিন পর অনিরুদ্ধকে বললেন, ”কথা বলেছি। কাল সকালে কালীতলার মাঠে ওদের প্র্যাকটিসের সময় হারাধন থাকবে, তুমি যেয়ো, তোমাকে দেখবে।”
লাল গোলগলা গেঞ্জি, কালো শর্টস, সাদা কেডস পরা হারাধন, গলায় সুতোয় বাঁধা হুইসল ঝুলছে। ছোট্ট একটা ভুঁড়ি, কাঁচাপাকা চুল, বয়স বোঝা যায় না, সম্ভবত পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন—র মধ্যে; মাঠে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন যে কাজটা একঘণ্টা ধরে করান সেই পাসিং আর রিসিভিং প্র্যাকটিস করাচ্ছিলেন। গোলে দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে নানান জায়গা থেকে নেওয়া শট ধরছে। গোলকিপার দু’জনের একজন অনিরুদ্ধর ক্লাসেরই বীরেশ্বরের দাদা ধীরেশ্বর, কলকাতায় কলেজে পড়ে, তাকে চেনে।
অনিরুদ্ধকে দেখে ধীরেশ্বর অবাক হয়ে বলল, ”তুই এখানে!”
”গোলকিপিং শিখব।”
”শিখে কী করবি, এখানে খেলার চান্স পাবি না। আমরা দু’জন রয়েছি, থার্ড গোলকিপার চান্স পায় না খেলার।”
”তা হলে একতায় চেষ্টা করব।” অনিরুদ্ধ দমে গিয়ে শুকনো গলায় বলল, একতা মানে শিমুলহাটি একতা সঙ্ঘ, কালীতলার প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই ক্লাবের মধ্যে আকচাআকচি এই তল্লাটে মুখরোচক আলোচনার বিষয়।
”তুই বরং একতার মাঠে গিয়ে খেলা শেখ।”
ধীরেশ্বর কথা বলছিল ক্রসবারের নীচে দাঁড়িয়ে, গোলে জাল খাটানো নেই। অনিরুদ্ধ কথা বলতে বলতে দেখল একজন পেনাল্টি দাগের কাছ থেকে শট নিতে ছুটে আসছে পেছন ফিরে কথা বলা ধীরেশ্বরকে লক্ষ্য করে। শট নেওয়া বলটা প্রচণ্ড জোরে আসছে ধীরেশ্বরের উচ্চতায়।
অনিরুদ্ধ হুঁশিয়ারি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ”ধীরুদা, বল, বল!”
বলের দিকে না তাকিয়ে ধীরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কুঁজো হয়ে বসে পড়ল। বলটা ওর পিঠের ওপর দিয়ে সোজা এল অনিরুদ্ধর বুকের দিকে। বিদ্যুৎগতিতে সে বুকের সামনে হাত তুলে দুই তালু দিয়ে বলটা ধরে নিল।
মাঝমাঠ থেকে হারাধন দত্ত ব্যাপারটা দেখে ভুরু কোঁচকালেন, একটি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ”সাদা গেঞ্জি পরা ঢ্যাঙা ছেলেটা কে রে?”
”জানি না হারুদা।”
”জিজ্ঞেস কর তো প্রতাপ মাস্টার ওকে পাঠিয়েছে কিনা।”
অনিরুদ্ধ বোকার মতো হেসে বলটা ছুড়ে দিয়েছে ধীরেশ্বরকে। বল ধরে নিয়ে সে বলল, ”এখানে আর দাঁড়াসনি, বেটপকা লেগেটেগে যেতে পারে।”
সেই সময় ছেলেটি এসে অনিরুদ্ধকে বলল, ”তোমাকে কি প্রতাপ মাস্টারমশাই পাঠিয়েছেন?”
”হ্যাঁ।”
”হারুদা তোমায় ডাকছেন।”
হারাধন দত্ত তার আপাদমস্তক দেখে প্রশ্ন করলেন, ”কতদিন গোলে খেলছ।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”একদিন ক্লাসের একটা ম্যাচে।”
ভুরু তুলে হারাধন বিস্ময় চেপে বললেন, ”তা হলে আজ বিকেলে দ্বিতীয় ম্যাচটা খেলবে। পার্টি করে ট্রেনি ছেলেদের মধ্যে ফ্রেন্ডলি খেলা হবে, ঠিক পাঁচটায় হাজির থাকবে। না না, বড়রা খেলবে না।”
সেই ফ্রেন্ডলি ম্যাচটা হারাধন দত্ত লাইনের ধারে চেয়ারে বসে পাথরের মতো চোখ করে দেখলেন, একটিও কথা না বলে, অনিরুদ্ধ দুটো গোল খেয়েছিল। ম্যাচের পর ক্লাবের সহ—সচিব পঞ্চানন ঘোষ অনিরুদ্ধকে ডেকে জানিয়ে দেন, ”কাল থেকে দু’বেলা প্র্যাকটিসে। হারুদা নিজে তোমায় দেখবেন।”
কথাটা শুনে অনিরুদ্ধ খুবই অবাক হয়েছিল। দুটো বাজে গোল খাওয়ার পর সে ধরেই নিয়েছিল হারাধন দত্ত তাকে বাতিল করে দেবেন। তাকে নির্বাচনের কারণটা কী, সেটা জানার জন্য কৌতূহলে ছটফট করে উঠলেও সাহস করে সে পঞ্চাননকে তখন কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারেনি। আজও সে জানে না কী দেখে হারাধন তাকে দু’বেলা আসতে বলেছিলেন।
তারপর পঁচিশ বছর কেটে গেছে, হারাধন দত্ত আজও জীবিত, এখন তাঁর বয়স সাতাত্তর। রোজ মাঠে আসেন, প্রায়ই দেখা হয় তবু অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করতে পারেনি—হারুদা সেদিন কী দেখে আমাকে বেছে নিয়েছিলেন?
পঁচিশ বছরে অনিরুদ্ধ বি.এ পাশ করেছে, কলকাতার বড় ক্লাবে খেলেছে, ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে এখন গড়িয়াহাট শাখায় কাজ করছে। বাড়ি থেকে অফিস দশ কিলোমিটার সে স্কুটারে যাতায়াত করে ইর্স্টান বাইপাস দিয়ে।
.
স্বরূপানন্দ বিদ্যালয়ের লোহার ফটকটা রাত্রে বন্ধ থাকে। খোলা আর বন্ধের দায়িত্ব অনিরুদ্ধর সময় থেকে আজও রাখালের। ফটকের লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে অনিরুদ্ধ মাঠের দিকে তাকাল। দেয়ালে বল লাগার শব্দটা এখনও হয়ে চলেছে। চাঁদের আলোয় সে ছায়ার মতো একটা আকৃতিকে ছোটাছুটি আর দেয়ালে শট নিতে দেখল স্কুলবাড়ির পশ্চিম দিকে যেখানে দুটো জানলার মধ্যে দেয়ালটা প্রায় পনেরো ফুট চওড়া। সে জানে জানলা দুটো হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরের আর টিচার্স রুমের।
কিছুক্ষণ তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে থেকে অনিরুদ্ধ বুঝল খুব অল্পবয়সী, খালি গা একটি ছেলে একা একাই দেয়ালে বল মেরে মেরে টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। মাত্র পাঁচ গজ চওড়া দেয়ালে মারা বলটা ফিরে আসামাত্র কখনও হেড করছে, কখনও ভলি মারছে, কখনও ড্রপ শট নিচ্ছে। দেয়ালে লেগে বলটা সবসময় সোজা ওর কাছে না এসে এদিক—ওদিক চলে যাচ্ছে। ছেলেটা ছুটে গিয়ে প্রতিবারই বলটা ধরে অদৃশ্য কোনও ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য শরীরটাকে ডাইনে—বাঁয়ে দুলিয়ে পায়ে বল নিয়ে অদৃশ্য পাস দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে অনিরুদ্ধ একবার দেখল দেয়ালে লেগে ফিরে আসা উঁচু বলটাকে বাইসাইকেল কিক নেওয়ার চেষ্টা করল, অবশ্য কিকটা ফসকাল। কিন্তু চেষ্টা করেছিল!
”অ্যাই অ্যাই, এত রাতে তুই কে রে?”
অনিরুদ্ধর ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলা কথাটা শোনামাত্র ছেলেটা থমকে দাঁড়াল। ফটকের বাইরে একটা লোকের ছায়া দেখেই বলটা হাতে তুলে ছুট লাগাল স্কুলবাড়ির পেছন দিকে। প্রথম বন্ধনীর মতো দেখতে একতলা স্কুলবাড়িটার আড়ালে ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই অনিরুদ্ধ বুঝল আর ওকে এত রাত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বুঝে গেল ছেলেটা খুব কাছাকাছিই থাকে।
কাল সকালে অফিস যাওয়ার সময় রাখালদাকে ধরে বার করতে হবে, কে এই ছেলেটা যে ঘুমোতে দিচ্ছে না! একটা পাগল ছেলে ধপ ধপাস শব্দ করে চলেছে আর রাখালদা স্কুলের পেছনে একটা ঘরে কি না ঘুমিয়ে আছে! কুম্ভকর্ণেরও তো ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা, ফাঁকিবাজ, একদম ফাঁকিবাজ, ওর এখন রিটায়ার করা উচিত। কয়েকদিন আগে অফিস যাওয়ার সময় রাখালের সঙ্গে তার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। গালে সাতদিনের না কামানো সাদা দাড়ি, নীচের পাটিতে দুটো দাঁত নেই, ময়লা ধুতির ওপর হলুদ ফুলহাতা শার্ট, ধুলোকাদার আস্তরণের নীচে চটির আসল রং বোঝা যায় না। রুগণ বুক ভেতর দিকে ঢুকে গেছে। হাতে ছিল বাজারের থলি।
রাখাল শুধু বেয়ারাই নয়, তার আরও একটা পদ তখন স্কুলে ছিল, স্পোর্টস অ্যাসিস্ট্যান্ট। বাংলায় লেখা হত ক্রীড়া সহায়ক। তবে ছেলেরা বলত, মালি। অন্য কোনও গ্রামের বা শহরের মাঠে খেলা থাকলে জার্সি, বল, গোটা দশেক পাতিলেবু, খাওয়ার জলের বালতি, ফার্স্ট এইড বক্স ইত্যাদি তাকিয়ার খোলের মতো বিশাল একটা ক্যানভাসের থলিতে ভরে রাখাল স্কুল টিমের সঙ্গে যেত।
গত পরশু দিন রাস্তায় রাখালের সঙ্গে দেখা হতেই অনিরুদ্ধ পথ আটকে তার স্কুটারকে দাঁড় করায়।
”কী রাখালদা, আর তো তুমি চিনতেই পারো না।” রাখালকে অপ্রতিভ করার জন্য অনিরুদ্ধ বলেছিল।
স্কুলের প্রাক্তন আর বর্তমান ছাত্ররা ওকে রাখালদা বলে ডাকে। রাখাল স্কুল শুরুর আর ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে। অনিরুদ্ধর বাবা অঘোর যখন এই স্কুলে ক্লাস টেন—এ পড়ত তখন তার সমবয়সী ষোলো বছরের রাখাল কয়াল সুন্দরবনের বরুণহাটি গ্রাম থেকে মাসির সঙ্গে এসে স্বরূপানন্দ স্কুলে চাকরিতে বহাল হয়, মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে। মাসি ছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়ির রাঁধুনি।
বাবার কাছে অনিরুদ্ধ শুনেছে, স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে রাখাল কবাডি আর ফুটবল খেলত। খেলার সময় বোকামি বা কোনওরকম দক্ষতার ঘাটতি দেখলে রাখাল তার দলের ছেলেদের মাথায় চাঁটি মেরেছে। অঘোর স্বীকার করেছিলেন ছেলের কাছে, ‘একটা ওপেন নেট গোল মিস করার পর রাখু আমায় চড় মেরেছিল।’ রাখাল ছিল সমবয়সী ছাত্রদের কাছে ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’, কিন্তু বরুণহাটির পাঠশালায় সে ‘থ্রি ক্লাসের’ বেশি ওঠেনি। যতই তার বয়স বাড়তে লাগল রাখাল ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যেতে থাকে ছাত্রদের থেকে, অবশেষে সে ‘রাখু’ থেকে একসময় হয়ে যায় রাখালদা।’
অনিরুদ্ধর স্কুটারের সামনে থতমত রাখাল ভাঙা দাঁত বার করে সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, ”চিনব না কেন খুব চিনি। তবে তুমি কিনা অনেক বড় হয়ে গেছ, অনেক নাম করেছ, তোমারে ডেকে কথা বলতে এখন লজ্জা করে।”
”লজ্জাটজ্জা থাক। তুমি আছ কেমন?”
”ভাল, ভালই আছি। শুধু মাঝে মাঝে বুকে একটা ব্যথা হয়, হাঁফ ধরে। তুমি একটু ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারো?”
রাখালের কথা শুনে অনিরুদ্ধর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। তার বাবাও ঠিক এই কথাগুলো বার দুয়েক বলেছিলেন, তারপর হঠাৎই একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য ভাত খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়েন, তারপর জ্ঞান আর ফেরেনি। মা অবশ্য মারা যান ক্যান্সারে মাস ছয়েক ভুগে।
”ঠিক আছে রাখালদা আমি দেখব, আমার বন্ধু এক ডাক্তার আছে এন আর এস হাসপাতালে, ওকে দিয়ে তোমায় দেখিয়ে দেব। তুমি এখন স্কুলে করো কী?”
”কী আর করব, সেই ঘণ্টাই পিটিয়ে যাচ্ছি। নতুন একটা ছোকরা এসেছে, নাম ভবা, সে—ই আমার অন্য কাজগুলো করে।”
”খেলাটেলাগুলো কে দেখছে, ভবা?”
রাখাল হেসে মাথা কাত করল।
”চলি রাখালদা, তোমাকে খবর দেব।”
অনিরুদ্ধ স্কুটারে স্টার্ট দিল। রাখাল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ”অনি একটা কথা বলব?”
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
”তোমার ভাগ্নের ছেঁড়া জামাপ্যান্ট যদি থাকে তা হলে একটা দিতে পারো?”
”কার জন্য?” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। সে জানে রাখালের কোনও ছেলেমেয়ে নেই, বউও বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে। একা থাকে স্কুলের পেছনে একটা টালির চালের ঘরে। ঘরের পাশে স্কুলের শৌচাগার। নিজের হাতে রান্না করে খায়।
”আমার ভায়ের নাতিটারে কাছে এনে রাখিছি। তোমার ভাগ্নের বয়সী।”
”দিদিকে বলব অলুর যদি কিছু পুরনো থাকেটাকে, তুমি কালপরশু এসে দিদির সঙ্গে দেখা কোরো।” এই বলে সে স্কুটার চালিয়ে দিল।
.
অনিরুদ্ধ বলেছিল বটে দিদিকে বলব কিন্তু বলতে ভুলে গেছল। এমনকী, ডাক্তারবন্ধুকে সে রাখালের কথা বলেনি। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজার সময় একতলায় দড়িতে শুকোতে দেওয়া অলুর জামা আর হাফপ্যান্ট দেখে তার মনে পড়ল রাখালের কথা। মনে মনে জিভ কেটে তখুনি সে নীচে নেমে এসে দিদি অমলাকে বলল, ”রাখাল কি তোমার কাছে এসে অলুর পুরনো জামা—প্যান্ট চেয়েছে? ওকে আমি তোমার কাছে আসতে বলেছিলুম।”
অমলা অবাক হয়ে বলল, ”কই না তো, রাখাল তো আমার কাছে আসেনি।”
”ওকে দেওয়ার মতো অলুর প্যান্ট—জামা কিছু যদি থাকে তা হলে দাও আমি অফিস যাওয়ার সময় ওকে দিয়ে যাব, আছে কিছু?”
”থাকবে না কেন, এখন তো ছ’মাস অন্তর ওর জুতো—জামা প্যান্ট ছোট হয়ে যাচ্ছে। বাব্বা! লাউডগার মতো তরতর করে লম্বা হচ্ছে ছেলেটা।”
অলু অর্থাৎ অলক দিদির একমাত্র সন্তান, স্বরূপানন্দে ক্লাস এইটে পড়ে, ওর ইচ্ছে মামার মতো গোলকিপার হবে। অনিরুদ্ধ ওকে কালীতলা ক্লাবে তার গুরু সাতাত্তর বছরের হারাধন দত্তের হাতে দিয়ে এসেছে।
অনিরুদ্ধর আধঘণ্টা আগে অমলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে যাবে চারটে স্টেশন পরে দৈজুড়িতে। সেখানে মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে সে সহ—প্রধানশিক্ষিকা। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে অমলা একটা পলিব্যাগ ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, ”রাখালকে এটা দিস, অলুর জামাপ্যান্ট আর একজোড়া কেডসও দিয়ে দিলুম, যদি পায়ে লাগে তো পরবে নয় তো তুলে রাখতে বলিস।”
অনিরুদ্ধ যখন স্কুটার চালিয়ে স্কুলের মাঠে ঢুকল প্রাইমারি সেকশনের ক্লাস তখন চলছে। হেডমাস্টারের ঘরের সামনে দালানে রাখাল কথা বলছিল এক ছাত্রের বাবার সঙ্গে।
”ও রাখালদা, একবার এদিকে এসো।”
রাখাল কাছে আসতে অনিরুদ্ধ পলিব্যাগটা তার হাতে দিয়ে বলল, ”বলেছিলুম দিদির সঙ্গে দেখা করতে, যাওনি। কেন? দিদি এটা তোমাকে দিতে বলল, দ্যাখো কী আছে।”
”যাব কী! তোমার সঙ্গে সেদিন কথা বলার পর ঘরে গিয়ে ভাত চড়াইছি তারপরই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বুকে ব্যথা।” রাখাল এর পর অনিরুদ্ধর কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল, ”বড় সার জানতি পারলে সঙ্গে সঙ্গে বলবে ‘রাখাল এবার কাজ ছাড়ো।’ রিটায়ার করলি খাব কী, এই ঘর ছাড়ি চলি যেতে হবে, যাব কোথায়? আমার তো মরা ভাইয়ের এই নাতিটা ছাড়া কেউ নাই। কুড়োনরে বড় করতি হবে, কোথাও একটা কাজে ঢুকোতি হবে। এখন চাকরি গেলে মুশকিলে পড়ে যাব। তুমি কিন্তু আমার অজ্ঞান হওয়ার কথা কারুরে বোলো না।” রাখাল অনিরুদ্ধর হাত চেপে ধরল।
”না বলব না।” কথাটা বলেই অনিরুদ্ধ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আজই সে দুপুরে তরুণের বাড়িতে ফোন করে রাখালকে দেখাবার ব্যবস্থা করবে। তারা দু’জনে কলেজ ফুটবল টিমে একসঙ্গে খেলেছে। তরুণ ফুটবলারদের চিকিৎসার জন্য ফি নেয় না। রাখাল ফুটবলার না হলেও অনিরুদ্ধর ধারণা তার পাঠানো গরিব মানুষের কাছ থেকে তরুণ টাকা নেবে না। অবশ্য সরকারি হাসপাতালে দেখালে কোনও টাকা লাগে না।
অনিরুদ্ধর কাছ থেকে সব কথা শুনে তরুণ জানাল, কাল তার কার্ডিয়াক বিভাগে আউটডোর ডিউটি রয়েছে, রাখাল যেন সেখানে সকালে এসে টিকিটটা করে নেয়, তারপর সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওর বুক দেখার ব্যবস্থা করে দেবে। সন্ধ্যার মুখে অনিরুদ্ধ ফিরল তার অফিস থেকে। বাড়ি না গিয়ে সে সোজা হাজির হল রাখালের চালা ঘরে। তখন সে হারিকেনের চিমনি সাফ করছিল ন্যাকড়া দিয়ে।
অনিরুদ্ধ কাল তাকে কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ”ভোরবেলাতেই ট্রেনে উঠে শেয়ালদায় চলে যেও। স্টেশনের কাছে এন আর এস হাসপাতাল। চিনতে পারবে তো?”
”আরে, ও হাসপাতালে অনেক বার গেছি। ভাইরে সাপে কাটল তখন তো ওখানেই নিয়া গেছল। কুড়োনের বাপেরে বাঘে ধরল মাছ ধরতি গিয়া। নওবাকি নদীর খাড়িতে জাল পাততি গেছল, লৌকা থেকে বাঘে তারে তুলা নেয়। সঙ্গের তিনটে লোক তাড়া করতি শশধররে ফেইল্যা বাঘ সুশান্তরে তুইল্যা জঙ্গলে ঢুইকা যায়। পত্থমে ক্যানিং তারপর এই শেয়ালদার হাসপাতালে শশধররে নে আইল, চারদিন বেঁচে ছিল, আমি রোজ দেখতে গেছি।”
রাখাল যখন ভাইয়ের জামাই শশধরের মৃত্যু বৃত্তান্ত শোনাচ্ছিল অনিরুদ্ধ তখন দেখছিল টিউবওয়েলে জল খাচ্ছে ছোট্টখাট্ট পাতলা গড়নের একটা ছেলে। গায়ের রং ঘোর কালো, মাসখানেক আগে ন্যাড়া হওয়া মাথায় এখন কদমফুলের মতো চুল। মুখে মাথায় জল থাবড়ে ছেলেটা তাদের দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে হেঁটে স্কুলবাড়ির আড়ালে চলে গেল। গায়ে ঢলঢলে হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা সবুজ রঙের গেঞ্জি। অলুকে এই গেঞ্জিটা সে একসময় পরতে দেখেছে। সে বুঝে গেল এটা দিদিই দিয়েছে রাখালের নাতির জন্য।
”অই হল কুড়োন। বাপরে বাঘে লয়, মারে লয় কুমির। চিংড়ির মীন তুলতে অর মা নদীতে নামছিল দু—তিনজনের সঙ্গে, কুমিরে টাইন্যা লইয়া যায়। আমার ভাই অরে নিয়া আসে তখন চার বছর বয়স, ভাইরেও সাপে কাটল। শেষে অরে আমি এখানে নিয়া আইলাম। এখন বয়স বারো।”
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ”সারাদিন ও করে কী?”
রাখাল মাথা নেড়ে বলল, ”কিসসু করে না, খালি ঘুইরা বেড়ায়।
অনিলের হোটেলে ফাইফরমাশ খাটার কামে দেছিলাম, দুই টাকা রোজ আর খোরাকি। তিনদিন কাম কইরা বলল, আর করব না। অরে ধরছে ফুটবলের ভূতে।”
কথাটা শুনেই অনিরুদ্ধর মনে হল, রাতে ধপধপাস শব্দগুলো তা হলে কুড়োনেরই তৈরি।
অনিরুদ্ধের কৌতূহল বেড়ে গেল, বলল, ”ফুটবলের ভূত ব্যাপারটা কী?”
”ব্যাপার আর কী, সকালে কালীতলার মাঠে গিয়া ছোটদের সঙ্গে খেলতে চাইত। ছেলেরা ওকে তাড়ায়ে দিত, খেলায় নিত না। একদিন একটা বল পায়ে নিয়া তিনটা ছেলেরে কইল আমারে আটকাও তো, ছেলেগুলাকে চারবার কাটায়ে কুড়োন হাসতাছিল, তহনই একজন খুব রাইগা গিয়া অর বুকে ঘুসি মারে, কুড়োনও পালটা মারে। পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করে দীপক। অরে চেনো তো, তোমার ছারকেলাস উঁচুতে পড়ত, এখন কালীতলা কেলাবে ছোটদের খেলা শিখায়, কোচ।”
দীপক কর্মকারকে অনিরুদ্ধ চেনে, পাশের মোচাবেড়িয়ায় বাড়ি। সে যখন ইন্টার—ক্লাস প্রথম ম্যাচে খেলে বিখ্যাত হল, দিপুদা সেই বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়তে যায় কলকাতায়। রাজস্থান, বাটা হয়ে শেষে ইস্টার্ন রেলে খেলেছিল। চাকরি করে শিয়ালদায়, রেলের অফিসে।
”দীপক কুড়োনরে মাঠ থেকা বাইর কইরা দেয় দুইটা থাপ্পড় লাগায়ে। বলে দেয় আর কক্ষনও তার পারমিশান না লইয়া ক্লাবের ছেলেদের সনে যেন না খেলে। তুমি বরং তোমার ভাগ্নারে জিজ্ঞাসা কইরা লইও, সে তখন ওখানে ছিল।”
আর কথা না বাড়িয়ে অনিরুদ্ধ চলে আসে। আসার আগে রাখালকে মনে করিয়ে দিল, ”কাল সকালে ঠিক যেও কিন্তু রাখালদা।” স্কুটারটা মাঠের ওপর দিয়ে চালিয়ে গেটের দিকে যাওয়ার সময় সে দেখল অন্ধকারে স্কুলের লম্বা দালানে পা ঝুলিয়ে একটা ছায়ামূর্তি বসে রয়েছে। অনিরুদ্ধর ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল। তার মনে হল ফুটবলের ভূত ওর ঘাড়ে বসেনি, কুড়োন নিজেই ভূত হয়ে ফুটবলের ঘাড়ে বসেছে।
রাতে অলু আর অনিরুদ্ধ মুখোমুখি টেবলে খেতে বসেছে। একসময় অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ”হ্যাঁ রে অলু, রাখালের নাতি সকালে তোদের সঙ্গে খেলতে যেত এখন আর যায় না, কেন রে?”
অলু অবাক হয়ে বলল, ”তোমায় কে বলল!”
”যেই বলুক, কুড়োনকে দিপুদা চড় মেরে বলেছে আর যেন তোদের সঙ্গে না খেলে?”
”হ্যাঁ। ও আমাদের ভেংচি কেটেছিল। অলু গম্ভীরস্বরে বলল।
”কেন কেটেছিল?”
অলু ইতস্তত করছে দেখে অনিরুদ্ধ বলল, ”তোদের তিনটে ছেলেকে ও চারবার কাটিয়ে বল নিয়ে গিয়ে হেসেছিল। তখন তোদের একজন ওকে ঘুসি মারে, ঠিক কি না?”
”হ্যাঁ। কিন্তু ও হাসল আবার বকও দেখাল। তাই তো রেগে গিয়ে শুভেন্দু ওকে মারল। মামা, কুড়োনও কিন্তু হাত চালিয়েছে। তখনই দীপুদা এসে ওকে চড় মারে।”
”তোদের তিনজনকে চারবার কাটিয়ে যে বল নিয়ে বেরিয়ে গেল সে তো তোদের থেকে ভাল খেলে, তা হলে তো তোদের উচিত ওকে দলে টেনে নেওয়া।”
”রাখালের নাতিকে দলে নেব!” অলু অবাক হয়ে মামার দিকে তাকাল এমনভাবে, যেন এক পাগলকে দেখছে, যে পাঁচ সেকেন্ড আগেও সুস্থ মস্তিষ্কের ছিল।
”ছেঁড়া গেঞ্জি, ময়লা প্যান্ট, খালি পা। কুড়োন আমাদের সঙ্গে খেলবে, বলো কী?”
”ধর তোদের কালীতলার সঙ্গে দুর্গাতলা স্পোর্টিং নামে একটা টিমের খেলা হচ্ছে কোনও টুর্নামেন্টে, দুর্গাতলার হায়ে নেমেছে কুড়োন। ময়লা গেঞ্জি আর ময়লা প্যান্ট পরনে, পায়ে বুটও নেই। তোরা কি বলবি কুড়োন খেললে আমরা খেলব না? তা হলে তো লোকে হাসবে, ছ্যা ছ্যা করবে।”
অমলা এতক্ষণ মামা—ভাগ্নের কথা শুনে যাচ্ছিল, এবার ভর্ৎসনার সুরে ছেলেকে বলল, ”রাখালদার নাতি বলে তোরা ওর সঙ্গে খেলবি না? এরকম মানসিকতা হল কী করে তোর অলু? চারবার যে তিনটে ছেলেকে কাটায় সে তো তোদের থেকে অনেক গুণী। গুণের কদর করতে শেখ, হলেই বা ময়লা ছেঁড়া গেঞ্জি প্যান্ট!”
অনিরুদ্ধ মিটিমিটি হাসছিল দিদির ঝাঁঝালো স্বর শুনে আর অলুর চোখে লজ্জার ছায়া পড়তে দেখে। সে বলল, ”জানো দিদি একবার ইম্ফলে সন্তাোষ ট্রফিতে মণিপুরের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলায় আমাদের স্ট্রাইকার সুধীর মুর্মু হ্যাটট্রিক করার পর খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। বেধড়ক পা চালিয়েছিল মণিপুরের ডিফেন্ডাররা সুধীরের পা লক্ষ্য করে। দু’দিন পরেই ম্যাচ ওড়িশার সঙ্গে। আমাদের গোল দেওয়ার লোক বলতে ওই সুধীর মুর্মু, ঝাড়গ্রামের ছেলে, সাঁওতাল। আমরা তো ঝাঁপিয়ে পড়লুম সুধীরের পায়ের ওপর। আমি ওর পা ধরে বরফ ঘষছি, মালিশ করছি, হাতে মাত্র দুটো দিন, ওকে ফিট করে মাঠে নামাতেই হবে। বেচারা সুধীর খালি বলছে, অনিদা পায়ে হাত দিও না, তুমি বামুনের ছেলে, আমার পাপ হবে। আমি বললুম ধেত্তোরি বামুনের ছেলে, এখন ভুলে যা ওসব! খেলার মাঠে তুই বামুন আর সব সিডিউল ট্রাইব। বেচারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল আমার কথা শুনে।”
অলু চোখ বড় করে মামার কথা শুনছিল। বলল, ”মুর্মু ফিট হল?”
”না পায়ের গোছ ফুলেই রইল। ইঞ্জেকশন দিয়েও ব্যথা কমানো গেল না।”
”ওড়িশার সঙ্গে ম্যাচটার কী হল?”
”টাইব্রেকারে জিতলুম, ফাইভ—ফোরে। একসময় ছিল ফোর—ফোর।”
”লাস্ট শটটা কাদের ছিল?” অলু উৎকণ্ঠিত কৌতূহল নিয়ে বলল।
”ওদের।’ নিস্পৃহ গলায় বলল অনিরুদ্ধ।
”বাইরে মারল?” অলুকে আরও উৎকণ্ঠিত দেখাল।
অনিরুদ্ধ মুখ নামিয়ে রুটি ছেঁড়ায় ব্যস্ত হল। অমলা বলল, ”অনি বলবে কী, আমি বলছি। তোর মামা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে বলটা ধরে নেয়। কাগজে বড় করে হেডিং দিয়েছিল ‘বাংলাকে ফাইনালে তুলল অনিরুদ্ধ’। অলু তুই তখন একমাসের, তোর এসব জানার কথা নয়। হ্যাঁরে অনি তোর কাছে কাগজের কাটিংটা আছে?” ভাইয়ের জন্য গর্বে অমলার চোখমুখ ঝকঝক করে উঠল।
”কাটিং ফাটিং আমি রাখি না। বুড়ো বয়সে বেতো শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিং দেখব আর লোকেদের দেখাব আমি কী ছিলুম। ওসব ব্যাপারে আমি নেই। যদি কিছু খেলে থাকি তা হলে লোকে এমনিই মনে করে রেখে দেবে। দেশের লোকে কপিলদেব, গাওস্করকে মনে করে রেখে দেবে, লিয়েন্ডার পেজকেও মনে রাখবে, আমি তো তেমন কিছু করিনি যে মনে করে রাখবে, তাহলে কাটিং জমিয়ে রেখে লাভ কী?” অনিরুদ্ধ নিচু স্বরে ধীরে ধীরে বলল। এর পর সবাই নীরবে খাওয়া শেষ করল।
রাতে খাওয়ার পর অন্তত আধঘণ্টা ছাদে পায়চারি করে অনিরুদ্ধ। এটা সে ছেলেবেলায় বাবাকে দেখে শেখে। ‘এই পায়চারিটা খুব দরকার। হজম সাহায্য করে স্বাস্থ্যকে। স্বাস্থ্য সাহায্য করে খেলাকে।’ অঘোর ছেলেকে কথাগুলো বলেছিলেন। তারপর থেকেই সে খেলায় সাহায্য করে এমন সবকিছুকেই মেনে চলতে শুরু করে। আর এটা সে অলুর মাথাতেও ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ছাদে পায়চারির সময় অনিরুদ্ধ গোলকিপিংয়ের নানান বিষয় নিয়ে কথা বলে, নিজের অভিজ্ঞতার গল্প ভাগ্নেকে শোনায়। আজ সে অলুকে জিজ্ঞেস করল, ”তোদের তিনটে ছেলেকে কুড়োন কাটালো চারবার, কী করে করল বল তো?”
”প্রথমে দেবুর মুখোমুখি হল, তারপর শরীরটা বাঁয়ে হেলিয়েই ডান দিকে হেলাল, দেবু একটু টলে গেল তখুনি বিদ্যুৎগতিতে কুড়োন শরীরটাকে একটু বাঁ দিকে ফিরিয়ে দেবুকে আড়াল করে ওর বাঁদিক দিয়ে বল পায়ে রেখে চলে গেল, বলটা ডান পায়ে আঠার মতো লেগে ছিল আর একটা ঝলকানির মতো এত ফাস্ট চলে গেল না! দেবু ঘুরতে ঘুরতে কুড়োন তখন শ্যামলকেও কাটিয়ে ফেলেছে, ওইভাবেই আবার জ্যোতিকে। একবার বাঁ দিক দিয়ে আর দু’বার ডান দিক দিয়ে—কী বলব মামা, ওই রোগা কালো ছেলেটা যেন কেউটের মতো তিনটে ছোবল দিয়ে বলটা নিয়ে গেল। আমরা তো থ! দেবুর মুখ থমথমে হয়ে গেল। ও দাঁত চেপে বলল, ‘অ্যাই ব্যাটা আবার কর তো।’ তিনজনেই রেডি হয়ে দাঁড়াল ওকে আটকাবার জন্য। কুড়োন এবার করল কী, প্রথমবার দেবুর বাঁ দিক দিয়ে গেছল এবার গেল ডান দিক দিয়ে একইভাবে, তারপর শ্যামল আর জ্যোতিকে কাটিয়ে আমার সামনে এসে পড়ল।”
”তুই তখন করলি কী?” অনিরুদ্ধ বলল।
”কী আবার করব, দিলুম একটা ডাইভ ওর পা লক্ষ্য করে।”
”ও তখন করল কী?”
”ও যেন জানত আমি কী করব, টুক করে বলটা পায়ে সরিয়েই আলতো করে আমার মাথার ওপর দিয়ে গোলে পাঠিয়ে দিল।” অলুর গলা দিয়ে ঝরে পড়ল একরাশ লজ্জা। অনিরুদ্ধ বুঝে গেল কুড়োনের শুধু অসাধারণ স্কিলই নয়, আছে বুদ্ধি আর ঠান্ডা মাথা, আর এই ছেলেটাকেই দিপুদা কিনা চড় মেরে বার করে দিল!
”অলু, তুই বড় গোলকিপার হতে চাস?”
অবাক হয়ে অলু বলল, ”কে না চায়?”
অনিরুদ্ধ হাঁটা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অলুর দু’কাঁধে হাত রেখে বলল, ”তা হলে কুড়োনের সঙ্গে প্র্যাকটিস কর। কালীতলার মাঠে তো হবে না, অন্য কোথাও। কুড়োন এখন খেলে কোথায়?”
”ঠিক জানি না। খোঁজ নিয়ে বলব তোমায়।”
পরের দিনই অলু খোঁজ নিয়ে তার মামাকে বলল, ”তেলিপাড়ায় ন্যাড়া মন্দিরের পাশে যে পোড়ো জমিটা রয়েছে, কুড়োন সেখানে গিয়ে ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে খেলে। ন্যাড়ামন্দির বালক সঙ্ঘ নামে ওদের একটা ক্লাবও আছে।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”ন্যাড়ামন্দির তো এখান থেকে দেড়—দু’মাইল দূরে! খেলবে বলে কুড়োন রোজ অতদূর যায়!” ফুটবল খেলার জন্য ছেলেটার এই উৎসাহ তাকে আরও কৌতূহলী করে তুলল। সে ঠিক করল স্কুলের হেডমাস্টারমশাইকে বলে সকালে স্কুলের মাঠে ছেলেদের খেলা শেখাবে আর কুড়োনকে ছাত্রদের দলে ভিড়িয়ে নেবে। স্কিল আর টেকনিকের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা এই বয়সেই দরকার।
অনিরুদ্ধ ভারত দলের ক্যাম্পে বিদেশি কোচের প্রশিক্ষণ পেয়েছে। কোচিং সম্পর্কে তার জ্ঞানের পুঁজি সেটাই। তা ছাড়া ক্লাব স্তরের কোচদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছে। সে মনে করে ছোটদের প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার মতো ফুটবল—বিদ্যে তার আছে। খরচ করার মতো টাকাও তার আছে বা জোগাড় করতে পারবে। আসল দরকার নিজের উৎসাহটাকে জিইয়ে রাখা। তার বিশ্বাস, আমাদের মতো ফুটবলে পিছিয়ে থাকা গরিব দেশে, বড় বড় অ্যাকাডেমি করার আগে বেশি দরকার খেলা শেখার ছোট ছোট পাঠশালা। সে পাঠশালাই খুলবে। ফুটবল তাকে নাম যশ অর্থ দিয়েছে। এখন তার কিছুটা সে ফুটবলকে ফিরিয়ে দেবে, এটা তার নৈতিক কর্তব্য।
.
স্কুল থেকে তিন মিনিট হাঁটলে হেডমাস্টার শিবেনবাবুর একতলা ভাড়াবাড়ি। অনিরুদ্ধ স্থির করল রবিবার ওঁর বাড়িতে গিয়েই দেখা করবে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল পর্যায়ের ম্যাচগুলো চারদিন পর শুরু হতে চলেছে। টিভি সেটে ছবি ভাল আসছে না, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো দেখাচ্ছে, বোধ হয় কেবলের তারে গোলমাল। কেবল অপারেটরকে সে বাড়ি থেকে দু’বার ফোন করেছিল, রিং হয়ে গেছে, কেউ ধরেনি। সে বুঝে গেল ফোন খারাপ, ঠিক করল শনিবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় খবর দিয়ে আসবে।
শনিবার বিকেলে অনিরুদ্ধ স্কুটার চালিয়ে কলাইখোলার মোড়ে পৌঁছে ইতস্তত করে ডান দিকে ন্যাড়ামন্দিরের রাস্তাটা ধরল। রাস্তা না বলে এটাকে মাইন বিস্ফোরিত যুদ্ধক্ষেত্র বলাই ভাল। সিটে বসে ঝাঁকুনির দাপটে তার মনে হল বোধ হয় স্কুটার থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। মিনিট দুই পর সে যখন ভাবছে, আর নয় এবার ফিরে যাই, তখনই চোখে পড়ল ভাঙা একটা শিবমন্দির। তার পাশে একটা পোড়ো জমি। দু’দিকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি গোল, ক্রসবার হয়েছে নারকেলদড়ি।
অ্যাশশ্যাওড়া আর ফণিমনসা গাছের ফাঁক দিয়ে অনিরুদ্ধ দেখতে পেল গুটিদশেক ছেলে আদুড় গায়ে একটা লালরঙের বড় রবারের বল নিয়ে খেলছে। কুড়োনকে সে একনজরেই চিনতে পারল তার গায়ের ঢলঢলে সবুজ গেঞ্জি আর পায়ের কেডস দেখে। ওকে মনে হচ্ছে হাঁসের দলে যেন একটা বক। মাঠটা বড় বড় ঘাসে ঢাকা কিন্তু উঁচু—নিচু বেশিরভাগ ছেলেই মাঝমাঠে বল নিয়ে এলোমেলো পা চালাচেছ। বলে পা লাগলে বলটা একজনের গায়ে লেগে ছিটকে আর একজনের কাছে যাচ্ছে। কুড়োন এই গোঁতাগুঁতির বাইরে দাঁড়িয়ে। একবার বলটা ছিটকে তার কাছে এল, কুড়োন বল ধরে গোলকিপারকে দেখল, তারপর প্রায় পনেরো গজ দূর থেকে বলটা আলতো মারলো। দড়ি আর বাঁশের কোণ দিয়ে গোল হয়ে গেল।
.
এইটুকু দেখেই অনিরুদ্ধ স্কুটারে স্টার্ট দিল। তার যা দেখার আর বোঝার, তা হয়ে গেছে। ছেলেটা এখানে খেলে নিজেকে নষ্ট করছে। খানাখন্দ, ঢিবির উপর দিয়ে স্কুটারটা টলতে টলতে চলেছে। সে লক্ষ করেনি শিংওলা একটা গোরু তার সামনে দশহাত দূরে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। পেছনে একটা বাছুর। অনিরুদ্ধ হর্ন বাজাল। টিয়াপাখির কর্কশ ডাকের মতো আওয়াজ শোনায় অনভ্যস্ত গোরুটা চমকে উঠে মাথা নামিয়ে এগিয়ে এল, অনিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি স্কুটারটা ডান দিকে ঘোরাতেই একটা গর্তে পড়ে গেল চাকা। কাত হয়ে সে স্কুটারসমেত গড়িয়ে পড়ল। পাশ দিয়ে চলে গেল গোরুটা।
স্কুটারের তলা থেকে ডান পা টেনে বার করে সে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল হাঁটুতে গোলমাল ঘটে গেছে, যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বছরদশেক আগে ওখানে যে চোটটা পেয়েছিল একটা লাথি খেয়ে, যার জন্য লিগের সাতটা খেলায় মাঠে নামতে পারেনি। দুটো ম্যাচ খেলেই আবার বসে গিয়েছিল সারা সিজনের জন্য, ঠিক সেখানেই চোটটা লাগল। স্কুটারটা তুলে দাঁড় করিয়ে সে স্টার্ট দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসল। কেবল অপারেটরের কাছে যাওয়া এখন শিকেয় তোলা থাক, অলুকে দিয়ে খবর দিলেই হবে, হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেও পরে যাওয়া যাবে। তার আগে এখন বাড়ি ফিরে বরফজল আর গরমজল পরপর হাঁটুতে ঢেলে যন্ত্রণাটা কমাতে হবে, তারপর ডাক্তার দেখানো।
সেই রাত্রেই অলু ডাক্তার ডেকে আনল। সব শুনে এবং হাঁটু পরীক্ষা করে তিনি জানালেন গুরুতর কিছু নয় সাতদিন বিছানায় থাকতে হবে, নড়াচড়া একদম নয়। বাড়িতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ ছিল। তাই দিয়ে হাঁটুটা শক্ত করে জড়িয়ে দিয়ে তিনি একটা মলম লিখে দিলেন, দিনে তিনবার পুরু করে লাগাতে হবে।
ডাক্তারের নির্দেশমতো অনিরুদ্ধ বিছানাবন্দি হল। অলু কেবল অপারেটরকে খবর দিতেই তাদের লোক এসে তার ঠিক করে টিভির ছবি স্পষ্ট করে দেয়। টেবলে রাখা টিভি সেটটা ঘুরিয়ে দিতে হল, কেননা বিছানায় পা ছড়িয়ে বালিশে ঠেশ দিয়ে দেখতে হলে সেইটাকে দরজার দিকে মুখ করে রাখতে হবে।
টেলিফোন করে ম্যানেজারকে অনিরুদ্ধ জানিয়ে দিল তার দুর্ঘটনার ব্যাপারটা। কবে অফিস যেতে পারবে তা এখনই বলতে পারছে না, ডাক্তার অনুমতি দিলেই যাবে। ম্যানেজার রসিক মানুষ, তিনি বললেন, ”বিশ্বকাপে বাহান্নটা ম্যাচ, সবগুলো দেখলে চোখের বারোটা বেজে যাবে।”
শুনে আঁতকে উঠে অনিরুদ্ধ বলে, ”না না স্যার, পায়ের চোটটা কিন্তু সত্যি—সত্যিই। বড়জোর সাতদিন রেস্ট নেব।”
প্রৌঢ় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আহত স্বরে জবাব দিলেন, ”আহহা, আমি কি বলেছি তুমি মিথ্যে মিথ্যে বলছ। এই দ্যাখো না তিনটে ছুটির দরখাস্ত পেলাম, একজনের মায়ের গলব্লাডার অপারেশন হবে, আর একজনের বউয়ের বাচ্চচা হবে, তৃতীয়জনের দেশের বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়েছে, মেরামত করতে যাবে। সবাই ছুটি চেয়েছে যে তারিখগুলোয়, তার মধ্যেই পড়ছে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল—সাতটা খেলা, সবক’টাই স্যাংশন করে দেব।”
শোনামাত্র অনিরুদ্ধ স্থির করল সাতদিনের মধ্যে সে অফিসে যাবে। একটা দিনও কামাই করবে না, ডাক্তারের নির্দেশ কঠোরভাবে মেনে চলবে, কাঠের গুঁড়ির মতো বিছানায় পড়ে থাকবে। সাতদিনও গেল না তিনদিনের মাথায় সে খাট থেকে নেমে ঘরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করল। হাঁটুতে খচখচ করতেই সে হাঁটা থামিয়ে শুয়ে পড়ে। সেইদিনই ছিল বিশ্বকাপের প্রথম খেলা।
রাতের খাওয়া চুকিয়ে অমলা আর অলু টিভির সামনে দেয়াল ঘেঁষে দুটো চেয়ারে বসল, খাটে অনিরুদ্ধ। ওপেনিং সেরিমনি শেষ হতেই অমলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল; স্কুলে যাওয়ার জন্য সাড়ে আটটায় তাকে বেরোতে হয়, তাই ভোরে ঘুম থেকে ওঠার জন্য তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াটা খুব জরুরি। প্রতি রাতে দুটি করে ম্যাচ, দ্বিতীয়টি শেষ হতে হতে রাত আড়াইটে বেজে যাবে, সুতরাং অলু দ্বিতীয় ম্যাচ দেখবে না, পরদিন তার স্কুল আছে। তবে মামাকে ধরে মায়ের কাছ থেকে সে দ্বিতীয় ম্যাচ দেখার জন্য অনুমতি নিয়ে রেখেছে, অবশ্য যদি জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, ইতালি বা হল্যান্ড তাতে খেলে। অনিরুদ্ধ দিদিকে বুঝিয়েছিল এই বলে—”সারা পৃথিবীর ছাঁকা ছাঁকা সেরা প্লেয়াররা খেলতে আসবে। ওদের খেলা দেখাটাও অলুর কাছে শিক্ষার ব্যাপার। তা ছাড়া পৃথিবীর ফুটবল এখন কোন জায়গায় রয়েছে বা পৌঁছতে যাচ্ছে তার আন্দাজ পাবে, কীভাবে খেলাটা হচ্ছে সেটা ওর বোঝা দরকার, শুধু কলকাতা আর শিমুলহাটির ফুটবল দেখে ও তো এক পাও এগোতে পারবে না। দিদি ওকে দেখতে দাও, ক’টা দিন মাত্র তো খেলা হবে, তারপর তো আবার চার বছর বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা করা!” গজগজ করতে করতে অমলা ভাইয়ের কথা মেনে নেয়।
রাতের পর রাত মামা—ভাগ্নের বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ দেখা চলতে লাগল। অনিরুদ্ধ তার প্রতিজ্ঞামতো সাতদিন পরই স্কুটার চালিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে অবাক ম্যানেজারের হাতে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে বলল, ”আমার মা নেই, বিয়েও করিনি, অতএব বউ নেই, দেশেও কোনও বাড়ি নেই, সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন ছুটির জন্য আর দরখাস্ত করব না।”
বিশ্বকাপ একসময় কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছল। এবার আটটা দল নকআউট ম্যাচ খেলবে। অনিরুদ্ধ দাগিয়ে রেখেছে ইউরোপের বাইরের একমাত্র দল ব্রাজিলকে। ওদের খেলা হল্যান্ডের সঙ্গে। ম্যাচটা তাকে মন দিয়ে দেখতে হবে। গত ষোলো বছর ব্রাজিল সেমিফাইনালে ওঠেনি, এবার পারবে কি? যদি পারে তা হলে অলুকে নিক্কো পার্ক দেখিয়ে আনবে। বলা বাহুল্য, অলু তক্ষুনি ব্রাজিলের সমর্থক হয়ে পড়ল।
ব্রাজিল প্রথম আধঘণ্টা চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে অসাধারণ ফুটবল খেলল কিন্তু গোল পেল না। গোল হব হব হলেই অলু বিছানায় ঘুসি মারতে থাকে উত্তেজিত হয়ে, তারপরই মাথায় হাত চেপে ফ্যালফ্যাল করে মামার দিকে তাকায়। অনিরুদ্ধ তার পিঠে হাত রেখে বলে, ”শান্ত হয়ে বোস। গোল ঠিকই হবে।” হলও, তবে সেকেন্ড হাফে, পরপর দুটো গোল দিল ব্রাজিল। অনিরুদ্ধ মুখ টিপে হেসে বলল, ”কী বলেছিলুম, একটা নয় দু—দুটো গোল। তোকে তা হলে নিক্কো পার্কে নিয়ে যেতেই হচ্ছে।” বাজি হারার জন্য তাকে খুশিই মনে হচ্ছে।
কিন্তু খুশির ভাবটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুখ থেকে মুছে গেল যখন হল্যান্ড খেপে উঠে পনেরো মিনিটের মধ্যে গোল দুটো শোধ করে দিল। এর পর হল্যান্ডের পেনাল্টি এরিয়ার প্রায় দশ গজ বাইরে ফ্রিকিক পেল ব্রাজিল। অনিরুদ্ধর মনে হল না এটা ফাউল, রেফারি বাড়াবাড়ি করল। শট নেমে ব্র্যাঙ্কো, সামনে পাঁচজনের দেয়াল। ব্রাজিলের দু’জন সেই দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিরুদ্ধ বলল, ”অলু, গোলকিপারকে দেখ কোথায় দাঁড়াচ্ছে। বল দেখতে পাচ্ছে না, চেঁচিয়ে নিজের প্লেয়ারদের বলছে একটু ফাঁক হয়ে দাঁড়াবার জন্য।”
গোলকিপার দুই পোস্টের মাঝামাঝি জায়গায় কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকে ব্র্যাঙ্কো শট নেবে। সে শট নিল। দেয়ালে একটা ছোট্ট ফাঁক। শটটা বাতাসে বেঁকে সেই ফাঁকের মধ্য দিয়ে গলে গিয়ে আরও বাঁকতে বাঁকতে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকা গোলকিপারকে দাঁড় করিয়ে রেখে দূরের পোস্টে ধাক্কা দিয়ে গোলে ঢুকে গেল। সারা মাঠের মতো ঘরের দু’জনও স্তম্ভিত!
উত্তেজনা চেপে অনিরুদ্ধ প্রথম কথা বলল, ”ওইরকম আউট সুইঙ্গার! গোলকিপারের কিছু করার ছিল না।” দেয়াল—ঘড়ি দেখে বলল, ”আধঘণ্টায় পাঁচটা গোল, খেলা বটে!”
”বাব্বা, কতখানি বেঁকে গেল বলটা!” অলু চোখ প্রায় কপালে তুলে ফেলল।
”দেখলি তো ওয়ার্ল্ড ক্লাস শট কাকে বলে?”
ফ্রিকিকটা রিপ্লেতে তিনবার তিনদিক থেকে দেখাল। ওরা গভীর মনোযোগে যখন দেখছে তখনই বারান্দার বাইরে বটগাছটায় ঝর ঝর ঝর ঝপাত করে শব্দ হল। যেন গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। চমকে উঠে অলু মামার গা ঘেঁষে সরে এল। ওর একটু ভূতের ভয় আছে।
”কী ব্যাপার রে অলু, দ্যাখ তো!”
খাট থেকে ঝুঁকে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অলু বলল, ”ঘুটঘুটে অন্ধকার।”
অনিরুদ্ধ বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলল, ”তোদের টর্চটা নিয়ে আয়। চোরটোর হতে পারে। বটগাছ দিয়ে উঠোনে নামল কিনা দেখি।”
অলু ঘর থেকে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ আনল, সঙ্গে ঘুম থেকে ওঠা অমলা। সে বলল, ”আমার ছোটবেলায় একবার একটা চোর বটগাছ ধরে নেমে উঠোনে লাফিয়ে পড়েছিল। ধরা পড়ে বাবার হাতে বেদম মার খায়।”
অনিরুদ্ধ টর্চ জ্বালিয়ে বটগাছের মগডাল দেখল, তারপর রশ্মিটা নীচের দিকে নামাতে নামাতে থেমে গিয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করল, ”আরে!”
অলু আর অমলাও বলে উঠল ”এ কী!”
দু’হাতে গাছের ডাল ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলছে কুড়োন।
”অ্যাই, তুই এখানে এত রাতে?” অনিরুদ্ধ চেঁচাল।
”নেমে আয়, নেমে আয়।” হাত নেড়ে অমলা বলল।
”কী কত্তে গাছে উঠেছিস?” জানতে চাইল অনিরুদ্ধ।
”খেলা দেখব বোলে।” মিনমিনে অপরাধী গলায় কুড়োন বলল।
”কী বললি? খেলা দেখব বোলে? এইভাবে খেলা দেখা? নাম, নাম, শিগগির নাম।” অনিরুদ্ধ হাসবে না রাগবে ঠিক করতে পারছে না।
পাঁচিল থেকে দু’হাত ওপরে ঝুলছে কুড়োন, অনিরুদ্ধর কথায় ডাল থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে জোড়াপায়ে পাঁচিলে পা ঠেকিয়েই ছ’ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে নামল উঠোনে। অনিরুদ্ধ একতলায় নেমে গিয়ে আলো জ্বালল। কান ধরে কুড়োনকে টেনে নিয়ে দোতলায় এল।
ওকে দেখেই অমলা বলল, ”এই বাঁদর, গাছে ঝুলে ফুটবল খেলা দেখা, তাও মাঝরাত্তিরে! অনি, ওর কানটা ছিঁড়ে দে তো! যদি পড়ে যেতিস তা হলে তো মরে যেতিস, নয়তো হাত—পা ভেঙে চিরকাল নুলো খোঁড়া হয়ে থাকতিস।”
”কার খেলা দেখতে গাছে উঠেছিলি?” অনিরুদ্ধ কৌতূহলী হয়ে জেরা শুরু করল।
চোখ নামিয়ে কুড়োন চুপ।
অনিরুদ্ধ খোলা দরজা দিয়ে ঘরের টিভি সেট আর বটগাছের দিকে তাকিয়ে দূরত্বটা মাপল, প্রায় বারো—চোদ্দো গজ তো হবেই। অত দূর থেকে কি টিভিতে খেলা দেখা যায়?
”বল তো ক’টা গোল হয়েছে?” অনিরুদ্ধ পরীক্ষা করার জন্য বলল।
”পাঁচটা।” কুড়োন কিছুটা ভরসা পেয়ে সহজ গলায় বলল।
”শেষ গোলটা দেখেছিস? বল তো কী করে হল?”
”লোকগুলো লাইন করে দাঁড়াল, তাদের মদ্যি দিয়া শট লইয়া চালায়ে দিল বলটা।” কুড়োনের গলায় উদ্দীপনার ছোঁয়া লাগল।
কী ভেবে অনিরুদ্ধ বলল, ”তুই পারবি অমন শট করতে?”
কুড়োন চুপ করে রইল পাঁচ—ছ’ সেকেন্ড, তারপর বলল, ”শিখিয়ে দিলে পেরাকটিস করব।”
ওরা তিনজন মুখ—চাওয়াচাওয়ি করল। অনিরুদ্ধ আশা করেনি এমন একটা উত্তর পাবে, মনে মনে সে খুশি হল। ছেলেটা ‘পারব না’ বলেনি।
”কবে থেকে গাছে উঠছিস?” অমলা বলল।
”পেরথমদিন থেকে।”
অমলার মুখ থেকে একটা ‘উউউ’—এর মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল বিস্ময় চাপতে গিয়ে, ”কুড়ি—পঁচিশদিন ধরে রোজ গাছে উঠছিস খেলা দেখার জন্য! অনি, এটা তো পাগল।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”খেলা দেখবি তো বললেই পারতিস, অলুকে তো চিনিস, ওকে বললি না কেন খেলা দেখব।”
কুড়োন দু’বার অলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ”ওরা আমায় খেলতে নেয় না, টিভি দেখতে দেবে?”
”হ্যাঁ দেবে।” অনিরুদ্ধ বলল, ”কাল থেকে তুই এই ঘরে বসে খেলা দেখবি, এখন যা। তোর দাদু কেমন আছে?”
”ভালা আছে।”
কুড়োন নীচে নেমে গেল, তার সঙ্গে অলু, সদর দরজায় খিল দেওয়ার জন্য। নামতে নামতে অলু বলল, ”তুই মামাকে বলতে গেলি কেন খেলতে নেয় না? আমি নেওয়া না—নেওয়ার কে? দিপুদা আর দেবুই তো নাটের গুরু।”
ভ্রূ কুঁচকে কুড়োন বলল, ”এখন তো এই কথা বলছ, তখন তো কিছু বলো নাই, পতিবাদ করো নাই।”
”করলে আমাকেও বার করে দিত।”
”দিত তো দিত। খেলতে জানলি তুমি সব কেলাবে চান্স পাবে।” ঠোঁট ওলটাল কুড়োন তাচ্ছিল্যভরে।
অমলা তখন অনিরুদ্ধকে বলছে, ”এরকম পাগল ছেলে আর কাউকে কখনও দেখেছিস?”
মাথা নেড়ে অনিরুদ্ধ বলল, ”না দেখিনি। তবে সুযোগ পেলে এরকম পাগলামি কিন্তু অনেকেই দেখাবে, কুড়োন সুযোগ পেয়েছে তাই দেখাচ্ছে। ওর পাগলামিটাকে এবার ঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে হবে।”
”ছেলেটার আছে কে? মুখখানি বেশ মিষ্টি, দেখলে মায়া হয়।”
”ওর মায়ের জ্যাঠা রাখাল। সে ছাড়া কুড়োনের আর কেউ আছে বলে জানি না। দাদামশাইকে সাপে কেটেছে, বাবাকে বাঘে নিয়ে গেছে, মাকে কুমিরে, ছেলেকে নিয়েছে ফুটবলের ভূতে, ভাবছি এবার ওকে নেব আমি।”
পরদিন থেকে কুড়োন খেলা দেখতে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে সে সহজ হয়ে গেল এই বাড়ির লোকেদের সঙ্গে, অনিরুদ্ধকে সে অলুর মতোই মামা বলে ডাকতে শুরু করল, অমলাকে মাসিমা। দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় টিভি সেটের মুখোমুখি হয়ে খেলা দেখে, খাটে অনিরুদ্ধ আর অলু।
”অলু, গোলকিপারকে দ্যাখ দ্যাখ, গোল খাবে এবার…আহহ বাইরে মারল।” খেলার সঙ্গে অনিরুদ্ধর ব্যাখ্যাও চলে। ”তুই কী করতিস অলু? ওইভাবে গোললাইনে দাঁড়িয়ে থাকতিস ব্যাক পাস করছে দেখে?”
”হ্যাঁ থাকতুম।” বেশ জোর দিয়েই অলু বলল, ”অপোনেন্টের দুটো ফরওয়ার্ড সামনে। ব্যাক পাসটা কে পাবে জানি না। হুড়মুড় করে বেরিয়ে পাসটা ধরে ফেলতে যদি না পারি তা হলে কী হবে? তার থেকে বরং গোলে দাঁড়িয়ে এসপার—ওসপার একটা চেষ্টা করা যায়।”
”এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা, কখন কোথায় বেরোব কি বেরোব না, আমার খুব ভাল ছিল না।” অনিরুদ্ধ স্বীকার করে নিয়ে বলল, ”দু—তিন সেকেন্ডের মধ্যেই তোকে ঠিক করে নিতে হবে কী করব…আরে আরে কী স্পিডের ওপর বলটা না থামিয়েই ঘুরিয়ে পাসটা করে দিল, দেখেছিস কুড়োন?
দেয়ালে ঠেস দেওয়া কুড়োন তখন সিধে হয়ে বসে দু’চোখ দিয়ে সেটটাকে গিলছিল। শুধু বলল, ”হ।”
”পারবি ওভাবে পাস দিতে?”
সেট থেকে চোখ না সরিয়ে কুড়োন বলল, ”পেরাকটিস করতে হবে।”
চব্বিশ বছর পর ফাইনালে উঠল ব্রাজিল, অন্যদিক থেকে ইতালি এবার নিয়ে পঞ্চমবার। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে অনিরুদ্ধ খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়েছে, লক্ষ রেখেছে নামীরা কে কেমন ফর্মে রয়েছে। ইতালির সেরা স্ট্রাইকার রোবার্তো বাজ্জিও প্রথম রাউন্ডে খোঁড়াচ্ছিল, ডান গোড়ালিটা ফুলে রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে সে ঝকমক করে উঠল। নকআউট পর্যায়ের তিনটি ম্যাচে পাঁচটি গোল দিয়ে এই লোকটি ইতালিকে প্রি—কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে টেনে এনেছে ফাইনালে। অনিরুদ্ধ দেখেছে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যাচের শেষ মিনিটে জয়সূচক গোলটি দেওয়ার পর রোবার্তো ক্লান্তিতে টলে পড়ে যাচ্ছিল, দু’হাত তুলে উচ্ছ্বাস জানাবার মতো জোরও ছিল না শরীরে।
ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে অনিরুদ্ধ অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ দুই বালককে বলল, ”বিশ্বকাপ ফুটবল কী জিনিস এই বাজ্জিওকে দেখে বুঝতে পেরেছিস?”
অলু বলল, ”শুধু বাজ্জিও কেন, ওদিকে রোমারিও, সেই বা কম কীসে?”
”ঠিক। সেমিফাইনালে দেখেছিস ডান দিক থেকে আসা ক্রসটায় কীভাবে হেড করে সুইডেনকে গোলটা দিল?”
কুড়োন বলে উঠল, ”দুটো লোকের মদ্যিখান থেকে লাফিয়ে উঠে যে হেডটা করল, সেইটা? খুব বড় পেলেয়ার!”
অনিরুদ্ধ বুঝল, রোমারিওর হেড করার দৃশ্যটা কুড়োনের মনে ছবির মতো ছাপা হয়ে গেছে, যেমন ব্র্যাঙ্কোর ফ্রিকিকের আউট সুইঙ্গারটা। এইসব টুকরো টুকরো স্কিলগুলোই ছেনির মতো ঠুকে ঠুকে মনের মধ্যে খোদাই করে ফুটবলের মূর্তি গড়ে দেয়।
প্রচণ্ড চমক তিনজনের জন্য অপেক্ষা করছিল ফাইনাল ম্যাচের শেষ মুহূর্তে। নব্বই মিনিট খেলায় গোল হল না। অতিরিক্ত সময়ের কুড়ি মিনিটে গোলের এক গজ দূর থেকে রোমারিও যখন পোস্টের বাইরে বল মারল, কুড়োন তখন ঝুঁকে কপাল মেঝেয় ঠুকে বলে উঠল, ”মামা, আমাদের দেবুও তো ওখান থেকে গোল দিয়া দিত। ইসস।” কুড়োনের ধারণা, দেবু আর একটা রামছাগল একই রকম ফুটবল খেলবে।
খেলা গড়াল টাই ব্রেকারে। ব্রাজিলের প্রথম চারটি পেনাল্টি কিকের তিনটিতে গোল হল, একটি বাঁচাল গোলকিপার। ইতালির দুটি কিকে গোল হল, একটি গেল বারের ওপর দিয়ে, চতুর্থটি আটকাল গোলকিপার। ব্রাজিল ৩—২ গোলে এগিয়ে। ইতালির পঞ্চম কিক নেবে বাজ্জিও। অলু আর কুড়োন তো বটেই, অনিরুদ্ধও টানটান হয়ে বসল। কী হয়, কী হয় ভাব, তিনজনের বুকের ধকধকানি ঢাক বাজাচ্ছে। গোল দিলে ৩—৩ হবে, দিতে না পারলে ইতালি ২—৩ হেরে যাবে।
বাজ্জিও কিক নিল। বাঁ দিকের পোস্ট আর ক্রসবারের ওপর দিয়ে বলটা চলে গেল। তিনজন পাথরের মতো বসে রইল। ম্যাচটা এইভাবে শেষ হবে, কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।
অনিরুদ্ধ বলল, ”লাক, ব্যাড লাক। টায়ার্ড শরীর, টায়ার্ড ব্রেন, আগের ম্যাচে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট, তার ওপর শেষ কিক নেওয়ার প্রেসার। এত বছরের এত পরিশ্রম আর বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন একটা বাজে কিকে চুরমার হয়ে গেল, একেই বলে নিয়তি!”
অলু বলল, ”টাইব্রেকারটা অনেকটা লটারির মতো। একটা ভাল টিমও হেরে যেতে পারে, যেমন আজ হল।”
কুড়োন বলল, ”দুই দুইডা প্লান্টি মিস করল তারে ভাল টিম বলব? হ্যাঁ মামা, আপনি বলেন, ভাল টিম?”
অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল। অলু যা বলল তাতে যুক্তি আছে, কুড়োনের কথাও যুক্তিহীন নয়। দু’জনের মাঝামাঝি একটা রাস্তায় সে হাঁটল। ”এবার থেকে তোরা প্লান্টি কিক পেরাকটিস কর। কুড়োন গোল দেবে আর অলু গোল বাঁচাবে।”
.
হেডমাস্টার শিবেনবাবুর ভাড়াবাড়ি স্কুল থেকে হেঁটে মিনিট তিনেক দূরে। আগে ছিলেন কোলাঘাটের একটি স্কুলে। দেড় বছর আগে এসেছেন স্বামী স্বরূপানন্দে। পরিবারবর্গ রয়েছে মেচেদায় পৈতৃক বাড়িতে। শিবেনবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ছিপছিপে গড়ন। অনিরুদ্ধ শুনেছে, খুব ভোরে হাফপ্যান্ট আর কেডস পরে রোজ জগ করেন শিমুলহাটিকে চক্কর দিয়ে। কিন্তু ধবধবে ধুতি—পাঞ্জাবি ছাড়া ওঁকে স্কুলে কেউ দেখেনি। কথা কম বলেন এবং বলেন ধীর গম্ভীর স্বরে। অনিরুদ্ধর সঙ্গে আগের হেডমাস্টারমশাই নারায়ণবাবুর আলাপ ছিল। নিপাট ভালমানুষ, সাতেপাঁচে থাকতেন না। ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেট জেতায় তিনি একদিন স্কুল ছুটি দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে মিছিল করে ‘ক্রীড়াপ্রেমিক’ খেতাব পান। তাঁর সময়েই স্কুলের ফুটবল টিমটা উঠে যায় অর্থের ও উৎসাহের অভাবে।
রবিবার সকাল সাতটায় অনিরুদ্ধ হাজির হল শিবেনবাবুর বাড়ি। একতলা, দু’খানি ঘর। একটা ছোট বারান্দা, সেটাই বসার জায়গা। দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ধুতি আর গেঞ্জিপরা একটি ছেলে। অনিরুদ্ধ একে চেনে না। মনে হল বাড়ির কাজের লোক, বছর কুড়ি বয়স।
”হেডমাস্টারমশাই আছেন?”
”আছেন।”
”বলো—।”
”অনিরুদ্ধ চক্কোত্তি দেখা করতে এসেছেন। আপনাকে চেনে না, এই শিমুলহাটিতে এমন লোক আছে নাকি? বসুন, উনি চান কচ্ছেন, একটু আগে দৌড়ে এলেন।’
”তোমার নাম কী?” অনিরুদ্ধ কৌতূহল বোধ করল ওর কথা শুনে। বলার ধরনে মনে হল মুখ্যু কাজের লোক নয়, লেখাপড়া করেছে।
”ভবতোষ… সবাই ডাকে ভবা বলে। হেডমাস্টারমশাইয়ের বেয়ারা। আমি এখানেই থাকি, সারের সব কাজকম্মো করি।”
ভবা ভেতরে চলে গেল। মিনিট তিনেক পর একটা সাদা কালো চেক লুঙ্গির ওপর খদ্দরের পাঞ্জাবি চাপিয়ে শিবেন ঘোষ বেরিয়ে এলেন। অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বলল, ”আমি আপনার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, নাম—।”
”শুনেছি শুনেছি, ভবা বলেছে। বসুন, চা খাবেন?”
সকালের চা খেয়েই অনিরুদ্ধ বেরিয়েছে। তার মনে হল খাব না বললে উনি ভাবতে পারেন ওজন দেখাচ্ছে।
”হ্যাঁ খাব।”
শিবেনবাবু ভেতরে গেলেন। দু’মিনিট পর ফিরে এসে বসলেন।
”প্রথমেই একটা কথা নিবেদন করি, আপনি নয়—তুমি বলবেন।”
শিবেনবাবু ভ্রূ তুলে কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, ”তাই বলব। বয়সে বড়, তার ওপর হেডমাস্টার; বলো তোমার আগমনের কারণ।”
”এই স্কুলেই আমার গোলকিপিংয়ের হাতেখড়ি। তখন নিয়মিত ইন্টার—ক্লাস ম্যাচ খেলা হত স্কুলমাঠে। গেমস টিচার প্রতাপবাবু টিম করতেন, খেলাতেন। স্কুলের ফুটবল টিম ছিল, আমরা সাবডিভিশনাল, ডিস্ট্রিক্ট স্কুল টুর্নামেন্টে খেলতুম, চ্যাম্পিয়ানও হয়েছি। এই স্কুল থেকেই দু’জন বেঙ্গল টিমে খেলেছি অল ইন্ডিয়া স্কুল চ্যাম্পিয়ানশিপে কুড়ি বছর আগে। এই স্কুলের চারজন কলকাতায় ফার্স্ট ডিভিশনে খেলেছে। ফুটবলের একটা ঐতিহ্য ছিল স্বরূপানন্দ স্কুলের, সেটা এখন আর নেই।”
বলতে বলতে অনিরুদ্ধ লক্ষ করছিল শিবেনবাবুর মুখ, মন দিয়ে শুনছেন আর ভেবে চলেছেন। সে আবার শুরু করল, ”তখনকার মাস্টারমশাইরা রিটায়ার করে গেলেন, কেউ কেউ মারা গেলেন, স্কুল থেকে ফুটবলের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার উৎসাহটাও ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল, এখন একেবারেই চড়া পড়ে গেছে। খেলার স্রোতটা আবার ফিরিয়ে আনা দরকার। এ—ব্যাপারে স্কুল যে সাহায্য আমার কাছে চাইবে তা আমি দেব।”
শিবেনবাবুর মুখের পাতলা হাসিটা এবার মিলিয়ে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ”স্কুলের সমস্যাটা কী জানো, টাকা নেই। বেঞ্চ চেয়ার ভেঙে রয়েছে, দেয়ালের প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে, খাওয়ার জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে গেছে, এর পর খেলার জন্য টাকা দেওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে উঠবে।”
ভবা ট্রে—তে করে দু’কাপ চা নিয়ে এল, সঙ্গে বিস্কুট। নীরবে তারা চায়ে চুমুক দিতে থাকল। অনিরুদ্ধ এইটুকু বুঝেছে, শিবেনবাবু ফুটবলের বিরুদ্ধে নন, বরং পক্ষেই। যদি টাকা থাকত তা হলে এখনই হ্যাঁ বলে দিতেন। খালি কাপ নামিয়ে অনিরুদ্ধ একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে বলল, ”খরচ খুব বেশি নয়। আপাতত দরকার গোটাচারেক বল, একটা মাঠ, যেখানে দু’বেলা প্র্যাকটিস করতে পারবে। স্কুলের মাঠটায় মাটি ফেলে লেভেল করা দরকার, খেলার অযোগ্য হয়ে রয়েছে। গোল পোস্ট, বারও করাতে হবে।”
চিন্তিত মুখে শিবেনবাবু বললেন, ”সকালে প্রাইমারি স্কুল বসে, ক্লাসের গায়েই মাঠ। সকালে তো মাঠে খেলা যাবে না, তা হলে স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য বিকেলে খেলা যাবে।”
এও এক সমস্যা। সকালের প্র্যাকটিসটা খুবই দরকার। স্কুলের মাঠ না হলে অন্য কোনও মাঠে। দুটো মাঠ আছে শিমুলহাটিতে, কালীতলার আর একতার। কালীতলায় সকালে কোচিং করায় দিপুদা, ওরা স্কুলকে মাঠ ছাড়বে না। একতার নাম কা ওয়াস্তে ফুটবল টিম আছে বটে, তবে ওরা জোর দিয়েছে ক্রিকেটে। সকালে মাঠটা পড়েই থাকে। টাকা দিয়ে একতা চালায় দেবেন গায়েন, মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার, মাছের ভেড়ি, আর ধানজমি থেকে আয় ছাড়াও জমি কিনে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি করে বিক্রির ব্যবসাও আছে। টিভি—র আর ওষুধের দোকান দিয়েছে, এখন বিউটি পার্লার খোলার তোড়জোড় করছে। যথেষ্ট ধনী লোক। স্বরূপানন্দ স্কুল ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার। অনিরুদ্ধ মনে মনে ঠিক করে ফেলল, দেবেন গায়েনকে ধরতে হবে একতার মাঠটা পাওয়ার জন্য।
”মাঠ আছে একতা সঙ্ঘের। দেবেন গায়েন পেট্রন ইন চিফ, ওকে একবার বলে দেখতে পারি। স্কুলমাঠে মাটি ফেলার খরচটা যদি উনি দেন, সেজন্য যদি একটু তোয়াজ করে কথা বলতে হয়—।” কথা অসম্পূর্ণ রেখে অনিরুদ্ধ হাসল।
”স্কুলের জন্য প্রাক্তন ছাত্রের কিছু একটা করার ইচ্ছা দেখে খুব ভাল লাগছে। যেচে এভাবে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখিনি। তুমি কাজ শুরু করো, আমি আছি।” শিবেনবাবু গম্ভীরস্বরে বললেন।
অনিরুদ্ধ মনে মনে বলল, স্কুল নয়, আসলে কুড়োনের জন্যই নাড়া খেয়ে উদ্যোগী হয়েছি। ছেলেটাকে তৈরি করে দিতে পারলে কাজের মতো একটা কাজ করা হবে। মুখে সে বলল, ”সার, বহু প্রাক্তন ছাত্র স্কুলের জন্য কিছু একটা করতে পারলে ধন্য বোধ করবে। কেউ যদি উদ্যোগী হয়ে তাদের কাছে সাহায্য চায় তা হলে অবশ্যই তারা হাত বাড়িয়ে দেবে। এই উদ্যোগটাই কেউ নেয়নি এতকাল। স্কুলের ফুটবল টিম আমি করবই। আপনি শুধু দেখুন ছেলেরা যেন নিয়মিত মাঠে আসে, ট্রেনিং কোচিং যা দেওয়ার আমিই দেব।”
শিবেনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনিরুদ্ধ ভাবল, একবার পার্থর কাছে যাই। পার্থ মুখুজ্জে তার সঙ্গেই পড়েছে, একসঙ্গে তারা স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। পার্থ এখন যাদবপুরে ফিজিকস পড়ায়। খেলাধুলো করত না কিন্তু সাহায্য চাইলে নিশ্চয় বিমুখ করবে না। অনিরুদ্ধ হাঁটতে হাঁটতে দেখল বাড়ির লোহার গেটের সামনে একজন বেঁটে, গোলগাল, শ্যামবর্ণ, পাজামা আর প্রায় গোড়ালি ছোঁয়া পাঞ্জাবি পরা লোকের সঙ্গে কথা বলছে ধীরুদা অর্থাৎ তাদের ক্লাসের বীরেশ্বরের দাদা ধীরেশ্বর, যে একদিন অনিরুদ্ধকে কালীতলার মাঠে গোলপোস্টের মাঝে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘শিখে কী করবি…তুই বরং একতার মাঠে গিয়ে খেলা শেখ।’ ধীরেশ্বরকে দেখলেই কথাগুলো তার মনে পড়ে আর মনে মনে হেসে ওঠে।
”এই অনি শোন, শোন, এদিকে আয়।” ধীরেশ্বর মাতব্বরি ঢঙে হাত নেড়ে ডাকল। অনিরুদ্ধ অনিচ্ছুক পায়ে এগিয়ে গেল।
”তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি কপিল ঘোষ আমার বন্ধু, সিরিয়াল ডিরেক্টর, এখন ওর একটা সিরিয়াল চলছে টিভি—তে, আটশো পর্ব পেরিয়ে গেছে, কী যেন নাম?”
ডিরেক্টর বলল, ”সোনার খাঁচা।”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, সোনার খাঁচা। এর পরের সিরিয়ালটা করবে খেলা নিয়ে। গল্পটল্প সব রেডি, কাজও শুরু হয়ে গেছে। একজন ফুটবলারের উত্থান—পতন, আবার উত্থান নিয়ে গল্পটা। কপিল আমার কাছে এসেছে আমার জানা কোনও ছেলেটেলে আছে কিনা খোঁজ নিতে। ভাল কথা কপিল, তোর সঙ্গে এর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। এ হচ্ছে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী, বিখ্যাত গোলকিপার, ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে।”
কপিল ঘোষ যেন বাড়ির উঠোনে মোহর ভর্তি একটা ঘড়া দেখতে পেয়েছে এমন একটা ভাব তার চোখেমুখে ফুটিয়ে বলল, ”আপনিই অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী! কী আশ্চর্য, আপনার অনেক খেলা আমি দেখেছি। বছর দশেক মাঠে যাই না, তখনই শেষ আপনাকে দেখেছি।”
ধীরেশ্বর বলল, ”জানিস কপিল, অনির গোলকিপার হওয়ার পেছনে কিন্তু সবচেয়ে বড় অবদান আমার। কালীতলা স্পোর্টিংয়ে ট্রায়াল দিতে এসে এমন বাজে খেলল অনি যে, ওকে বাদই দিয়ে দেওয়া হয়। ও একতা সঙ্ঘে যাবে বলে ঠিক করল। তখন আমিই হারাধন দত্তকে বলি ছেলেটার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা আছে, রেখে দিন। আমি ওকে তৈরি করে নোব। তখন আমি কালীতলার ফার্স্ট গোলকিপার। অনি হল সেকেন্ড গোলকিপার, সেই ওর শুরু, তারপর তো বিরাট নাম করল।” বলেই ধীরেশ্বর বড়দার মতো অনিরুদ্ধর কাঁধে হাত রেখে একগাল হাসল।
ধীরেশ্বরের কথা শুনে অনিরুদ্ধ অবাক হল না, রাগলও না। সে ওর স্বভাবটা জানে। নিজেকে বড় করে দেখাবার জন্য নির্লজ্জের মতো মিথ্যা বলে যেতে পারে। অনিরুদ্ধ আলতোভাবে কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে দিয়ে সামান্য সরে দাঁড়িয়ে কপিল ঘোষকে জিজ্ঞেস করল, ”কীরকম ছেলে চান, তাকে কী করতে হবে?”
দু’হাত নেড়ে কপিল ঘোষ বলল, ”নায়কের ছোটবেলার খেলার কয়েকটা শট নেব, দশ থেকে চোদ্দ বছর বয়স হলেই হবে, দু—চারটে কথা বলবে আর বল নিয়ে একটু খেলা করবে, ব্যস। তবে খেলাটা দেখে যেন বোঝা যায় ভবিষ্যতে ছেলেটা বড় প্লেয়ার হবে। আর ছেলেটাকে দেখতে যেন একটু ভাল হয়। নায়কের মুখের সঙ্গে মিল থাকলে তো খুবই ভাল।”
অনিরুদ্ধর মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল কুড়োন। সে বলল, ”ছেলে একটা আছে, যেমন চাইছেন তেমনই, দেখতেও ভাল। তবে কথা বললেই মুশকিল, লোকে হেসে ফেলবে, গ্রাম্য উচ্চচারণ।”
কপিল ঘোষ হাতপাখার মতো তালু নেড়ে বলল, ”ও কিছু নয়, ও কিছু নয়, ডাব করে নেব। অন্য একটা ছেলের গলা ওর গলায় বসিয়ে দেব। বয়স কত?”
”বছর চোদ্দ। ছেলেটার খেলা দেখতে হলে তো তা হলে একটা ম্যাচ খেলাতে হবে।”
”তা তো হবেই।” কপিল ঘোষের বলার ধরন দেখে অনিরুদ্ধর মনে হল, ম্যাচের কথাটা বোধ হয় আগে ওর মাথায় ছিল না।
”সেই ম্যাচটা কি আমাকেই অ্যারেঞ্জ করতে হবে? অন্তত গোটা পনেরো—ষোলো ছেলে চাই।”
”করে দিলে তো খুবই ভাল হয়।” কপিল ঘোষের গলায় কৃতজ্ঞ থাকার আগাম প্রতিশ্রুতি ঝরে পড়ল।
অনিরুদ্ধ দ্রুত চিন্তা করে নিল, তাকে এখন টাকার জোগাড় করতে হবে। এই লোকটা বা ওর প্রোডিউসার সিরিয়াল নাম দিয়ে ব্যবসা করে টাকা রোজগার করবে। ওর ব্যবসায় বা টাকা রোজগারে আমি সাহায্য করব কেন? যদি স্কুলের ফুটবলের জন্য টাকা দেয় তা হলে করব, নয়তো নয়।
”দেখুন একটা সাজানো ফুটবল ম্যাচকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা খুব সোজা কাজ নয়। বাংলা সিরিয়ালে আর সিনেমায় তো দেখেছি ফুটবল খেলা দেখে বাড়ির মেয়েরাও হাসে।”
কপিল ঘোষের মুখের হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল, ”কম টাকার মধ্যে সিরিয়াল করতে গেলে হাসির ছবি হবে না তো কী হবে?”
অনিরুদ্ধ এবার স্বর বদলে একটু কঠিন স্বরে বলল, ”লোকে এখন বিশ্বকাপের খেলা দেখছে, ফুটবল খেলাটা সম্পর্কে একটা ধারণা তারা গড়ে তুলছে। তাদের আপনি হাস্যকর ফুটবল দেখিয়ে নিজের নাম খারাপ করবেন কেন?”
নাম খারাপের কথা শুনে কপিল ঘোষের আত্মমর্যাদায় বোধ হয় আঘাত লাগল। টান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ”নাম খারাপের প্রশ্ন উঠছে কেন? ম্যাচটা তো আপনি অ্যারেঞ্জ করবেন। বাস্তবসম্মত হবে বলেই তো আপনাকে পেতে চাই। যেভাবে যা দরকার বলবেন সেইভাবে করব।”
”আপনার গল্পে দরকার একটা ছোটদের ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ, তা হলে ব্যাপারটা জমবে। সাতজন করে দুটো টিম খেলবে, চাঁদোয়ার নীচে ডায়াস, তাতে কাপ শিল্ড সাজানো, সভাপতি, প্রধান অতিথি বসে, ম্যাচ শেষে বিজয়ী নায়ক দু’হাতে ট্রফি তুলে হাসছে, কেমন হবে?” অনিরুদ্ধ এমনভাবে বলল, যেন চোখের সামনে সে ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছে।
কপিল ঘোষ চোখ বুজে দৃশ্যটা কল্পনায় দেখছিল। একগাল হেসে চোখ খুলে বলল, ”ফাইন। তবে চাঁদোয়া আর ডায়াসটা বাদ দিন, খরচ বেড়ে যাবে, আর কাপ শিল্ড টিল্ড জোগাড় করতে হবে। আর কী দরকার?”
ধীরেশ্বর এতক্ষণ মুখ বন্ধ রেখে দু’জনের কথা শুনে যাচ্ছিল। আর থাকতে না পেরে বলল, ”কাপ শিল্ডের কথা ভাবতে হবে না। ধবধবি আর খড়দায় খেলে দুটো কাপ পেয়েছিলুম, তোলা আছে আলমারিতে, ঝেড়ে মুছে নিলে চলে যাবে।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”দুটো টিমের জন্য চোদ্দোটা জার্সি আর বল চাই। মাঠ নয় কালীতলা কি একতার সঙ্গে ব্যবস্থা করে নেব। ছেলেরা নিজেদের বুট পরে খেলবে। একজন রেফারি আর প্রাইজ দেওয়ার জন্য একজন সভাপতি চাই। শুটিং হচ্ছে শুনলে মাঠে দর্শক আপনা থেকেই হয়ে যাবে। আসলে আপনার দরকার তো বাচ্চচা নায়কের কেরামতি দেখানো?”
”হ্যাঁ।” চিন্তিত মুখে কপিল ঘোষ বলল, ”দুটো টিমের জন্য দু’ সেট জার্সি! ওরে বাবা সে তো অনেক খরচ! আচ্ছা, সাদা কি লাল গেঞ্জি পরিয়ে খেলিয়ে দিলে হয় না?”
অনিরুদ্ধ বলল, ”এই তো হাসার মতো কথা বললেন। একই জামা পরে দু’ দল খেললে সব তো গুলিয়ে যাবে।”
”কেন, একদল সাদা, অন্য দল লাল গেঞ্জি পরবে।” ধীরেশ্বর ফোড়ন কাটল।
হাতঘড়ি দেখে কপিল ঘোষ ব্যস্ত হয়ে বলল, ”জরুরি একটা কাজ আছে, আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব। এখন ছেলেটাকে একবার দেখাতে পারেন?”
”এখন!”
অনিরুদ্ধ ফাঁপরে পড়ল। কুড়োন এই মুহূর্তে কোথায় আছে কে জানে! রাখালের কাছে খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে। কপিল ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে সে রাখালের ঘরের দিকে এগোল। স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছেই পরিচিত শব্দটা তার কানে এল, দেয়ালে বল মারার শব্দ। রবিবার স্কুল বন্ধ, তাই একা একা কুড়োনের ‘পেরাকটিস’ চলেছে সকাল থেকেই।
কপিল ঘোষকে নিয়ে অনিরুদ্ধ স্কুলবাড়ির পশ্চিমদিকে এসে কুড়োনকে পেল। সবুজ ঢলঢলে গেঞ্জি আর কেডস পরা কুড়োন এই অসময়ে অনিরুদ্ধ আর একটা লোককে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। তারপরই মুখে ভয় ফুটে উঠল।
নিচু গলায় অনিরুদ্ধ বলল, ”এই ছেলেটার কথাই বলেছিলুম।”
কপিল ঘোষ তীক্ষ্ন চোখে কুড়োনের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা অনুমোদকের ভঙ্গিতে হেলিয়ে বললেন, ”চলবে। খেলে কেমন?”
”আপনি কখনও একটু—আধটু ফুটবল খেলেছেন?”
”ছোটবেলায় পাড়ার গলিতে খেলেছি।”
”আপনার দিকে ও বল নিয়ে এগোবে। যেভাবে পারেন ওকে আটকাবেন, হাত দিয়ে পা দিয়ে যেভাবে হোক।”
কুড়োনকে ডেকে অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল, ”লোকটাকে কাটিয়ে বল নিয়ে বেরোতে পারবি?”
কুড়োন একনজর কপিল ঘোষকে দেখে নিয়ে বলল, ”ওই কুমড়োটারে!” সে আর কিছু বলল না। বলে একটা টোকা দিয়ে এগোল কুঁজো হয়ে দু’ পাশে হাত ছড়ানো কপিল ঘোষের দিকে। তার একগজের মধ্যে এসে কুড়োন শরীরটাকে ডাইনে ঝুঁকিয়েই বাঁয়ে হেলিয়ে আবার ডাইনে ঝোঁকাল। কপিল ঘোষ টলে পড়ে যাচ্ছিল, অনিরুদ্ধ তাকে ধরে নিল। বল পায়ে কপিল ঘোষের বাঁ দিক দিয়ে পেছনে গিয়ে কুড়োন একগাল হাসল।
”ভাগ্যিস ধরলেন”, কপিল ঘোষ শুকনো মুখে হেসে উঠল, ”অনেকদিন খেলি না তো, আচ্ছা আর একবার করুক।”
অনিরুদ্ধ ইশারা করল কুড়োনকে। এবারও একই ব্যাপার ঘটল। ডান দিক দিয়ে যাবার সময় কপিল ঘোষ টলে পড়তে পড়তে হাত দিয়ে কুড়োনকে ধরার চেষ্টা করেও পারল না। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কুড়োন বেরিয়ে গেল।
হতভম্ব কপিল ঘোষ বলল, ”অদ্ভুত তো! আচ্ছা, মারাদোনার মতো বল নাচাতে পারে?”
অনিরুদ্ধ ডাকল কুড়োনকে। ”টিভি—তে সেদিন মারাদোনার যে বলের খেলা দেখাল, সেটা করে দেখাতে পারবি?”
”হ।” কুড়োনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
বলটা নিয়ে সে ডান এবং বাঁ পায়ের পাতার ওপরে নাচাতে নাচাতে তুলে দিল ডান ঊরুর ওপর, তারপর বাঁ উরুতে এইভাবে ডান—বাঁ করতে করতে মাথার ওপর তুলে কপাল দিয়ে বার দশেক নাচিয়ে কপালের ওপরই স্থির করে রেখে তারপর পিঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে দিল। বলটা জমির দিকে নামছে, সে বাঁ পায়ের গোড়ালি দিয়ে টুক করে মাথার ওপর দিয়ে বলটা তুলে সামনের দিকে এনে ডান পা সামনে বাড়িয়ে ধরে নিয়ে পাতার ওপর বলটাকে স্থির করে বসিয়ে রেখে একগাল হাসল।
কপিল ঘোষ দমবন্ধ করে এতক্ষণ দেখছিল, এবার শ্বাস ফেলল, ”অদ্ভুত তো! প্রায় চার মিনিট বলটাকে জমিতে পড়তে দেয়নি। অনিরুদ্ধবাবু ছেলেটাকে আমার চাই।”
”আমাদেরও কিছু চাই। লোহার টিউবের গোলপোস্ট অর ক্রসবার, নম্বর দেওয়া রঙিন গেঞ্জি চোদ্দটা, চারটে বল আর কুড়োনের একজোড়া বুট।”
কপিল ঘোষ ভয়ে ভয়ে বলল, ”কত পড়বে এজন্য?”
”বলতে পারব না লোহার টিউবের দাম না জেনে। তবু আন্দাজে বলছি হাজার কুড়ি টাকা।”
আঁতকে উঠল কপিল ঘোষ। ”ওরে বাবা আমি মরে যাব। লোহার বদলে কাঠের গোলপোস্ট করলে হয় না?”
অনিরুদ্ধ হালকা চালে বলল, ”হবে না কেন, তা হলে কুড়োনের বদলে জুড়োনকে নিয়ে আপনাকে শুটিং করতে হবে। কপিলবাবু, আপনি একটা সাজানো ফাইনাল ম্যাচ পাবেন, আপনাকে নামী অভিনেতা—অভিনেত্রীর জন্য টাকা খরচ করতে হবে না, সেট সাজাবার খরচটাও বেঁচে যাবে, এই সব সুবিধে পেয়েও হাজার কুড়ি শুনে আঁতকে উঠছেন? কুড়োন যা দেখাল তাইতে আপনি অবাক হলেন, আপনার দর্শকরাও অবাক হবে, সেটা কি আপনি চান না? আমি টাকা চাইনি, জিনিস চেয়েছি। তাও নিজের জন্য নয়। যদি রাজি থাকেন তা হলে বলুন নয়তো—”
”না না না, জুড়োন নয়, কুড়োনকেই চাই। হাজার কুড়ির মধ্যেই হবে তো? ঠিক করে বলুন।” কপিল ঘোষ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল।
”আমি আন্দাজে বললুম। বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে, যদি রাজি থাকেন তা হলে তিনদিনের মধ্যে আমাকে জানান। ওই যে দেখছেন বাড়িটা,” অনিরুদ্ধ আঙুল তুলে বটগাছের পেছনের বাড়িটা দেখাল, ”ওটায় আমি থাকি। ছেলে জোগাড় করা, মাঠের ব্যবস্থা করা, সভাপতি, প্রধান অতিথি ঠিক করা, এটা কিন্তু আমি ঠিক করব। এজন্য আপনাকে খরচ করতে হবে না। আর দেখুন ধীরুদা যে বলল দুটো কাপ ওর কাছে আছে, তার হাইট দেখলে আপনার দর্শকরা হাসবে, পাঁচ ইঞ্চি লম্বা! গলির ফুটবলেও ওরকম ট্রফি দেয় না। গুপ্ত ব্রাদার্সকে বলে একটা শিল্ড আর একটা বড় কাপ ধার করে আনব। শুটিংয়ের আগেই গোলপোস্ট, বল আর বুট চাই, নইলে কিন্তু জুড়োন।” অনিরুদ্ধ কঠিন স্বরে জানিয়ে দিল। কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে এইসব লোকেদের আর টিকি দেখা যাবে না, নিজের খেলার অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা জানে।
”আপনার বাড়ি আর অফিসের ফোন নাম্বারটা দিন।” বলে কপিল ঘোষ পকেট থেকে নোটবই বার করল।
দুটো ফোন নম্বর বলে কপিল ঘোষকে ধীরেশ্বরের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অনিরুদ্ধ দেবেন গায়েনের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ির বৈঠকখানায় দেবেন দুটি লোকের সঙ্গে ব্যবসার কথাবার্তা চালাচ্ছিল, দু’জনের বসার ধরনে মনে হল ওরা অনুগ্রহপ্রার্থী। অনিরুদ্ধকে দেখে অবাক হয়ে দেবেন বলল, ”অনিরুদ্ধ! কী সৌভাগ্য! হঠাৎ তুমি?”
”দু—একটা কথা ছিল স্কুলের খেলাধুলোর ব্যাপার নিয়ে। আপনি তো ম্যানেজিং কমিটির একজন প্রভাবশালী মেম্বার। আপনার কথাতেই তো কমিটি চলে, খেলাধুলো ভালবাসেন তাই আপনারই দ্বারস্থ হলুম।” বিনীত ভাবে কথাগুলো বলে অনিরুদ্ধ দেখল, দেবেন গায়েনের মুখচোখ ঝকমক করে উঠল আর বাইরের লোক দুটির বসার ভঙ্গিতে ফুটে উঠল সম্ভ্রম। প্রচুর অর্থ রোজগার করলেও কেউ মান্যগণ্য বা অভিজাত বলে তাকে স্বীকার করে না, এটা দেবেন গায়েন এবং অনিরুদ্ধও জানে।
”তুমি জানলে কেমন করে, আমি খেলাধুলো ভালবাসি?” মিটমিটি হেসে দেবেন গায়েন বুঝিয়ে দিল খেলার প্রসঙ্গে কথা বলতে সে উৎসাহী।
”আপনি পাঁচ মাইল রোড রেসে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউট করেছিলেন, যোগাসন কম্পিটিশনে সংগঠক সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন, এসব কথা লোকে ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি, আর সেজন্যই প্রথমে মনে পড়ল আপনার কথা। স্কুল থেকে ফুটবল খেলা তো উঠে গেছে, মাঠের অবস্থাটা দেখেছেন?”
”দেখব না কেন, খারাপ খুব খারাপ।” দেবেন গায়েন মাথা নাড়ল খেদ জানাতে।
”সামান্য একটু মাটি ফেলে মাঠটা কিন্তু সমান করা যায়।” অনিরুদ্ধ তীক্ষ্ন নজরে লক্ষ করল শ্রোতার মুখ। কোনও ভাবান্তর দেবেন গায়েনের মুখে দেখতে পেল না।
”টিভি সিরিয়ালের ডিরেক্টর কপিল ঘোষ আজ এসেছিল ধীরুদার কাছে, বীরেশ্বর ঘোষকে চেনেন তো?”
”চিনি না? কালীতলা তো ওকে ভাগিয়ে তোমাকে নিল। তারপর এল আমার কাছে, একতায় খেলার জন্য তদ্বির করতে। অবশ্য খেলতে দিয়েছিলুম। তা সেই ডিরেক্টর ওর কাছে কেন?”
”ওর বন্ধু হয়। কপিল ঘোষ সিরিয়াল করবে একজন ফুটবলারকে নায়ক করে। সেই নায়কের ছোটবেলার ভূমিকায় নামাবার জন্য একটা ছেলে খুঁজছে। ধীরুদা ওকে গছিয়ে দিল আমার কাছে। আমি বললুম একটা ফুটবল ফাইনাল দেখান, সেই খেলায় আপনার ছোট নায়ককে খেলান। সে গোল দিয়ে টিমকে জেতাবে। ট্রফি নেবে বিশাল জনতার সামনে অনুষ্ঠানের প্রেসিডেন্টের হাত থেকে। কপিল ঘোষ রাজি হয়ে গেল। ওকে বললুম ফাইনালটা আমাদের এখানেই হোক। প্লেয়ার, প্রেসিডেন্ট, জনতা সবই এখানকার, মাঠটাও হবে এখানকার। উনি বললেন এতসব পাবেন কী করে? আমি বললুম, এই শিমুলহাটিতে এমন একজন লোক আছেন যিনি খেলাধুলো প্রসারের জন্য ইচ্ছে করলেই তুড়ি মেরে সব ব্যবস্থা একঘণ্টায় করে দিতে পারেন, এমনকী, স্কুলের মাঠটা মাটি ফেলে সমানও করে দিতে পারেন।”
দেবেন গায়েন হাসি হাসি মুখে শুনে যাচ্ছিল। এবার ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর হয়ে বলল, ”লোকটা কে, সুরথ নাকি?”
সুরথ চাটুজ্জে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান দেবেন গায়েনের প্রতিপক্ষ দলের নেতা। অনিরুদ্ধ জানে এই দু’জনের মধ্যে রয়েছে প্রবল রেষারেষি। সুরথের আছে দলের জোর, দেবেনের আছে টাকার জোর। কিন্তু অনিরুদ্ধর দরকার এমন টাকার জোরকে, যা দিয়ে সে স্কুলের মাঠ, স্কুল ফুটবল দল এবং কুড়োনকে তৈরি করার কাজ শুরু করতে পারবে।
দেবেন গায়েনের মুখভাবটা দেখে নিয়ে অনিরুদ্ধ বলল, ”আপনি ভাল করে আমার কথাটা বোধ হয় শোনেননি। আমি বললুম এমন একজনের কথা যিনি খেলাধুলা প্রসারের জন্য ইচ্ছে করলেই তুড়ি মেরে…।” অনিরুদ্ধ থেমে গেল।
বাইরের দু’জনের একজন তখন বলল, ”এমন লোক তো একজনই আছে এ তল্লাটে, দেবেনবাবু।” বলেই লোকটি হেঁ হেঁ করে হাসল।
অন্যজন বলল, ”বটেই তো!”
অনিরুদ্ধ মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করল লোক দুটির প্রতি। দেবেনকে ভজাবার কাজটা ওই দু’জন অনেকটা এগিয়ে দিল। খুশিতে আপ্লুত দেবেন বলল, ”বলো আমায় কী করতে হবে।”
”আপনাকে পুরস্কার দিতে হবে।” অনিরুদ্ধ এবার তার ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করল। ”বললুম না টিভি সিরিয়ালে একটা ফাইনাল খেলা হবে, সেই খেলার পর তো পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপার আছে। আপনাকে ছাড়া আর কারুর কথা আমি ভাবতে পারছি না।”
”মানে আমাকে টিভি—তে দেখা যাবে! আমি ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছ না! শুনলে তো তোমরা, অতবড় গোলকিপার বলল আমি ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছে না। তখন কী যেন বললে, স্কুলের মাঠটায় মাটি ফেলতে হবে? কবে দরকার? চন্দনপুরে রাস্তা তৈরির জন্য মাটি কাটার কাজ চলছে, কালই দু’ লরি মাটি স্কুলের মাঠে ফেলিয়ে দেব। তোমার সিরিয়ালের ফুটবল ম্যাচটা কবে? দু’দিন আগে আমায় বোলো, আমি শিমুলহাটির মোড়ে মোড়ে পোস্টার লাগিয়ে দেব। টিভি সিরিয়ালের শুটিং বলে কথা!”
অনিরুদ্ধ এতটা সফল হবে, ভাবেনি। এ তো ট্রাইব্রেকারে তিনটে কিক আটকে দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে গেল। ভরসা পেয়ে এবার সে বলল, ”ম্যাচটা কিন্তু হবে একতার মাঠে, ব্যবস্থাটা আপনাকে করে দিতে হবে।”
”ও নিয়ে ভাবতে হবে না, মাঠ তুমি পেয়ে যাবে। চা খাবে?”
অনিরুদ্ধ না বলতে গিয়েও বলল না। চা খেয়ে বেরিয়ে এসে সে আবার গেল হেডমাস্টার শিবেনবাবুর কাছে। তাকে সে কপিল ঘোষ ও দেবেন গায়েনের সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে, সবিস্তারে জানাল। শুনতে শুনতে শিবেনবাবু খুব হাসলেন। বললেন, ”কুড়োন দেখছি স্কুলের একটা সম্পদ হয়ে উঠল। ওকে ভাঙিয়ে এত যে কিছু করা হতে যাচ্ছে, তা কি ও জানে?”
”কিচ্ছু জানে না আর জানার দরকারও নেই। আপনি এবার স্কুলে একটা নোটিস দিন। স্কুল ফুটবল টিম গড়ার জন্য ট্রায়াল হবে, যারা ট্রায়ালে যোগ দিতে চায় তারা যেন সামনের রবিবার সকাল আটটায় স্কুলের মাঠে হাজির হয়ে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করে। আপনিও সার তখন কিন্তু থাকবেন, তা হলে ব্যাপারটা গুরুত্ব পাবে।”
”অবশ্যই থাকব। চাই কি তোমাকে সাহায্যও করতে পারি ট্রেনিংয়ে।” শিবেনবাবু এর পর হাসতে হাসতে বললেন, ”কলকাতায় এম.এ পড়ার সময় দু’ বছর ফুটবল খেলেছি ফার্স্ট ডিভিশনে চন্দ্র মেমোরিয়ালের হয়ে। তেমন কিছু ছিলাম না, কাগজে কখনও নাম ওঠেনি।”
শুনে অবাক হয়ে গেল অনিরুদ্ধ। এই খবরটা তো তার জানা ছিল না! তার সময়ে ফুটবলার শিক্ষক ছিলেন প্রতাপ চাটুজ্জে, তিনি ডিস্ট্রিক্ট টিমে খেলেছেন, তারপর এই আর একজন শিক্ষককে সে দেখছে।
”আপনি রোজ ভোরে দৌড়তে বেরোন, শরীরটাও রেখেছেন ফুটবলারের মতো, দেখে আমার বোঝা উচিত ছিল একসময় খেলতেন। দেখেছি তো, খেলা ছাড়ার পর বেশিরভাগই আর ডিসিপ্লিনড থাকে না। থলথলে হয়ে যায়।”
শিবেনবাবু নিজের খেলার প্রসঙ্গে না গিয়ে অন্য কথা পাড়লেন।
”ভাবছি ইন্টার—ক্লাস ম্যাচ আবার শুরু করলে কেমন হয়!”
”মনে মনে আমি কিন্তু ওটাই ভেবে রেখেছি। মুশকিল হল, অফিস থেকে ফিরতে ছ’টা—সাড়ে ছ’টা হয়ে যায়। আমার পক্ষে তো ছুটির দিন ছাড়া সাহায্য করা সম্ভব হবে না।”
”ঠিক আছে, আমিই শুরু করে দেব, আগে মাটিটা পড়ুক।”
.
দু’দিন পরই স্কুলমাঠে মাটি পড়ল। দেবেন গায়েন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দু’ লরি মাটি মাঠের উঁচু—নীচু এবং গর্ত হয়ে যাওয়া জায়গাগুলোয় ফেলিয়ে সমানভাবে চারিয়ে দিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির হাতে টানা ভারী রোলার চালিয়ে সমান করে বলে দিল, ”এখন এর ওপর খেলাধুলো দাপাদাপি একদম বন্ধ। এখন আষাঢ় মাসের শেষ, বর্ষার জলে আগে মাটি বসুক ভাল করে, ঘাস গজাক, তারপর পুজোর পর খেলা যা করার করবে। ততদিন স্কুলের ফুটবল হবে একতার মাঠে।” তারপর হেডমাস্টারের ঘরে এসে বলল, ”আপনি ক্লাসে ক্লাসে নোটিস পাঠিয়ে জানিয়ে দিন খেলাধুলো তো দূরের কথা, মাঠে হাঁটাচলাও বন্ধ। মাঠটাকে আমি ইডেনের মাঠ করে ছাড়ব। স্কুলের ছেলেরা চিরকাল মনে রাখবে দেবেন গায়েনকে, খেলাধুলার প্রসারের জন্য একটা আসল কাজ করে দিয়ে গেছে!”
শিবেনবাবু দ্বিধাভরে বললেন, ”একতার মাঠে ফুটবল খেলা হবে কী করে, ওখানে তো ক্রিকেট খেলা হয়!”
দেবেন রেগে উঠে বলল চড়া স্বরে, ”ফুটবলটাকে তুলে দিল এই ক্রিকেট। আরে বাবা, বাঙালির প্রাণের খেলা হল ফুটবল, আর সেই ফুটবলকে গোল্লায় দিয়ে ক্রিকেট নিয়ে নাচানাচি, তাও কিনা একদিনের ক্রিকেট? একসময় একতার ফুটবল টিম ছিল, এখন নেই। তবু ফুটবল টিমটাকে কালীতলা ধরে রেখেছে, সে ওই বুড়ো হারাধন দত্তর জন্য আর দিপুর ট্রেনিং সেন্টারের জন্য। ক্রিকেটে আর টাকা ঢালব না আমি, আবার একতার ফুটবল টিম করব, অনিরুদ্ধ তুমি দায়িত্ব নেবে?”
হঠাৎ তার ঘাড়ে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধটা এসে যাওয়ায় অনিরুদ্ধ বিব্রত হয়ে পড়ল। দেবেন গায়েনকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেওয়ার আছে, তার মধ্যে একটা বড় কাজ তো সত্যি সত্যি করে দিল—স্কুলমাঠটাকে তৈরি করে দেওয়া। এবার ওটার নিয়মিত পরিচর্যা দরকার এবং তা করার সামর্থ্য স্কুলের নেই, ওটা দেবেন গায়েনকে দিয়েই করাতে হবে। তা ছাড়া সিরিয়ালের শুটিংয়ের জন্যও লোকটির সাহায্য দরকার। কুড়োনকে নিয়মিত খেলাতে হবে, সেজন্য একটা ক্লাব চাই। স্কুলে পড়ে না সুতরাং স্কুল টিমে খেলার প্রশ্নই নেই, কালীতলা স্পোর্টিংয়ে দিপুদা যতদিন আছে কুড়োন ওখানে জায়গা পাবে না, ওকে খেলাতে হবে একতা সঙ্ঘে।
অনিরুদ্ধ বলল, ”আপনি পাশে থাকলে যথাসাধ্য আমি করব।”
দেবেন আশ্বস্ত করে বলল, ”ব্যস ব্যস, তা হলেই হবে। আমি একতার জন্য জার্সি করে দেব, মোজা কিনে দেব, তাই পরে ছেলেরা এখানে—ওখানে টুর্নামেন্ট খেলবে, শিমুলহাটির নামটা লোকে জানবে। ক্রিকেট দেখার জন্য মাঠে সারাদিন লোক বসে থাকে না, তাদের কাজকম্মো আছে। ফুটবলই ক্লাবকে পপুলার করে। কালীতলা তো কোথাও খেলতে—টেলতে বিশেষ যায় না, টাকা কোথায় যে যাবে? হেডমাস্টারমশাই, অনিরুদ্ধ, আজ স্বীকার করছি ছেলেবেলায় আমার বিশেষ ইচ্ছে ছিল, জার্নাল সিং—এর মতো দাপুটে প্লেয়ার হব, ঠাণ্ডা করে দেব ফরওয়ার্ডদের, হল না ইচ্ছেপূরণ, সেটা এখন পূরণ করতে চাই।”
অনিরুদ্ধ ক্রমশ আবিষ্কার করছে এই লোকটির চরিত্রের অন্য আর—একটা দিক। মনে মনে সে দেবেনের পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য দুর্বলতাকে নিয়ে মজা পেয়েছে, লোকটিকে এতদিন ভেবেছে মোটা মাথার টাকাসর্বস্ব একটা ব্যবসায়ী। এবার সে সমীহ করতে শুরু করল।
কপিল ঘোষকে তিনদিন সময় দিয়েছিল অনিরুদ্ধ। সাতদিন পর সে অনিরুদ্ধকে তার ব্যাঙ্কের অফিসে টেলিফোন করে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে বলল, ”সোনার খাঁচার শুটিংয়ে খুব ব্যস্ত ছিলুম, সিরিয়ালটা এখন শেষের দিকে। আপনার কথামতো গেঞ্জি, চারটে বল, কুড়োনের বুট হয়ে যাবে। বলছিলুম কী, খেলবে তো স্কুলের ছোট ছোট ছেলে, ওদের তো ছোট গোলপোস্ট আর বার হলেই চলে যাবে, বড় ফুল সাইজ গোলের কি দরকার আছে?”
অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বলল, ”আছে। এখনকার স্কুলের ছেলেদের চেহারা কেমন জানেন কি? তাদের হাইট কত জানেন কি? আমার ভাগ্নে এইটে পড়ে, গোলকিপার হতে চায়। ও লাফিয়ে আট ফুট উঁচু বারে হাত লাগায়। শুনুন কপিলবাবু, গোলপোস্টের সাইজ এক ইঞ্চিও কমানো যাবে না, আট ফুট বাই চব্বিশ ফুট রাখতেই হবে। খরচ বাঁচানোর কথা চিন্তা করলে চলবে না। তা করলে কিন্তু কুড়োনের বদলে জুড়োন!”
”না না না, ফুলসাইজ গোলেই হবে, আপনি মেপে নেবেনে। রবিবার সকালে লোহার টিউব আর বল নিয়ে লোক যাবে। আপনি থাকবেন তো?”
”অবশ্যই থাকব।”
রবিবার সকালে স্কুলমাঠের দু’দিকে গোলপোস্টের মাথায় ক্রসবার বসানোর কাজ ভিড় করে দেখল স্কুলের বহু ছেলের সঙ্গে শিবেনবাবু ও অনিরুদ্ধ। ছেলেরা অবশ্য এসেছিল স্কুল টিম গড়ার জন্য ট্রায়ালের নোটিস পেয়ে। আট থেকে বারো ক্লাস পর্যন্ত ছাত্রদের থেকে এসেছে চল্লিশজন। তাদের মধ্যে রয়েছে কালীতলার দীপকের কাছে কোচিং নিচ্ছে এমন পাঁচজন—শুভেন্দু, দেবু, জ্যোতি, শ্যামল আর অলু।
অনিরুদ্ধ সবাইকেই সোমবার সকাল ছ’টায় একতার মাঠে আসতে বলল। প্রথমে দুটো দলে ভাগ করে তাদের খেলাবে এবং তখনই বুঝে নেবে কাদের বাদ দিয়ে কাদের রাখবে। কুড়িটা ছেলে বেছে নিয়ে সে সকালে প্রাথমিক স্কিলগুলো, যা কলকাতার সুপার ডিভিশনের বেশিরভাগ ফুটবলারের আয়ত্তে ঠিকমতো নেই, সেইগুলোর অনুশীলন করাবে। শিবেনবাবু বলেছেন বিকেলে তিনি দল করে খেলাবেন এবং কীভাবে খেলতে হবে সেটা বলে দেবেন। সকাল—বিকেল দু’ বেলাই কুড়োন থাকবে ছাত্রদের সঙ্গে।
এই শেষের কথাটা শুনে ইলেভেন ক্লাসের শুভেন্দুর মুখ থমথমে হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে পাশে দাঁড়ানো দেবু আর জ্যোতিকে কী যেন বলল। তারপর অনিরুদ্ধকে জানাল, ”আমি সকালে আসতে পারব না, আমায় ট্রেনিং নিতে যেতে হবে দিপুদার কাছে। তা ছাড়া বিকেলে আসতে হলে ওর পারমিশান নিতে হবে।”
একই কথা বলল দেবু জ্যোতি শ্যামল, চুপ করে রইল অলু। অনিরুদ্ধ বলল, ”ঠিক আছে, সকালে দিপুদার কাছেই কোচিং নিও, কিন্তু বিকেলে দল করে খেলাটা হবে স্কুলটিম গড়ার জন্য। এখানে স্কুলের ছাত্র হিসেবে তোমাদের থাকাটা দরকার, বোঝাপড়াটা নয়তো গড়ে উঠবে কী করে?”
দেবু চোখ পিটপিট করে বলল, ”আচ্ছা অনিদা, ট্রেনিং তো হবে স্কুলটিম গড়ার জন্য, তা হলে কুড়োন কেন এতে থাকবে?”
অনিরুদ্ধ তাকাল শিবেনবাবুর দিকে। তিনি একবার ভ্রূ কুঁচকে তারপর মুখে হাসি এনে সহজ গলায় বললেন, ”সবাই তো আর দু’বেলাই আসতে পারবে না, লোক ঠিকই কম পড়বে, তখন ওকে সাহায্যের জন্য দরকার হবে ভেবে আমি রেখেছি। এতে কি তোমার আপত্তি আছে?”
শুনে দেবু ঢোক গিলল। ‘আমি রেখেছি’ শব্দ দুটো যথেষ্ট ভয়ঙ্কর মনে হল তার কাছে। আর ক’মাস পরে টেস্ট পরীক্ষা, আটকে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা ইংরেজি আর লাইফ সায়ান্সে। সে আমতা—আমতা করে বলল, ”না সার, আপত্তি কেন হবে, কুড়োন খেলুক না আমাদের সঙ্গে, ভালই তো খেলে।”
সোমবার ঠিক ছ’টায় একতার মাঠ ভরে গেল ছাত্রদের ভিড়ে। ন’জনের দল করে পনেরো মিনিটের দুটি ম্যাচ খেলা হল। অলু বাদে দিপুদার কোচিংয়ের কেউ আসেনি। অনিরুদ্ধ আর শিবেনবাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করে নেন, ছেলেদের কাছে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা তারা আশা করবেন না শুধু দেখবেন ফুটবল—বোধ কতটা রয়েছে আর শরীরটা কেমন। তাঁরা মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা শুধু দেখে গেলেন। দেখেই বুঝে গেলেন অর্ধেকের বেশিকে বাদ দেওয়া যায়।
কুড়িজনকে শিবেনবাবু বলে দিলেন, ”কাল ভোর পাঁচটায় এই মাঠে আসবে, আমার সঙ্গে তোমরা দৌড়বে, শিমুলহাটি, মোটাবেড়িয়া পেরিয়ে চাঁদা নদীর পোল পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসব। তারপর ব্যায়াম, তারপর বেসিক স্কিলের ট্রেনিং করাবেন অনিদা। সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় বসে যাবে। যারা রেগুলার আসবে না তারা কিন্তু বাদ যাবে।”
যারা বাদ গেল তাদের তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ”তোমরা নিশ্চয় চাও স্কুলের টিমটা ভাল হোক। তোমাদের থেকে ওরা একটু এগিয়ে রয়েছে তাই ওদের আসতে বললুম। ভেবো না তোমরা একেবারে বাদ গেলে, রোজ আসবে, দেখবে, দরকার হলে মাঠেও নামবে। কাল তোমরাও দৌড়তে আসবে, ব্যায়ামও করবে একসঙ্গে, এটায় কিন্তু কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।”
ছাত্রদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কুড়োন সব শুনছিল। অনিরুদ্ধ আর অলু যখন বাড়ি ফিরছে, কুড়োন তাদের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ”মামা, আমারে তো হেডমাস্টারমশায় আসতে কইলেন না!”
”হেডমাস্টারমশাই বললেন না স্কুলের টিম করার জন্য এই ট্রেনিং হবে। স্কুলটিমে তো ছাত্ররাই খেলবে, তুই তো ছাত্র নোস।”
কুড়োনের মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল। মিনিটখানেক পর সে বলল, ”মামা, আমি যদি ছাত্তর হই তাইলে আমারে নেবে?”
”হ্যাঁ নেবে।”
”তাইলে আমারে ছাত্তর কইরা লন।”
এবার অলু বলল, ”তুই ছাত্র হবি কী, অ আ ক খ—ই তো জানিস না।”
গম্ভীর মুখে কুড়োন বলল, ”জানি না তো কী হইছে, পেরাকটিস করলাই তো শিখা লওয়া যায়।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”তা হলে পেরাকটিস শুরু কর।”
আর কথা না বলে কুড়োন পাশের রাস্তা ধরে হনহনিয়ে চলে গেল। মামা—ভাগ্নে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে উঠল।
পরের দিন একঝাঁক ছেলে নিয়ে শিবেনবাবু দৌড় শুরু করলেন। মোচাবেড়িয়া পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ ভাল, তারপরই খানাখন্দ আর ভাঙা ইট রাস্তাটাকে চাঁদানদীর কাঠের পোল পর্যন্ত দৌড়বার পক্ষে যন্ত্রণাকর করে রাখায় ওরা পোল পর্যন্ত গেল না। ফিরে আসার সময় কালীতলার মাঠের পাশ দিয়ে যখন আসছে তখন জনা পনেরো ছেলে কালীতলার মাঠটাকে পাক দিয়ে জগ করছিল। দীপক মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে। স্কুলের অত ছেলেকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল।
দেবু বলল, ”ওদের সঙ্গে দেখছি কুড়োনটাও রয়েছে।”
দীপক চেঁচিয়ে বলল, ”দাঁড়ালি কেন, ছোট ছোট। কুড়ি পাক এখনও হয়নি।”
জ্যোতি চাপা গলায় গজগজ করল, ”কলুর বলদের মতো রোজ মাঠে একঘেয়ে পাক দেওয়া, ভাল্লাগে না।”
ব্যায়াম করার পর অনিরুদ্ধ বল বায়ে রেখে কী ভাবে দৌড়তে হয় দেখাল। সবার থেকে ভালভাবে করে দেখাল কুড়োন। শিবেনবাবু এজন্য সবার সামনে ওকে প্রশংসা করলেন না। শুধু বললেন, ”ঠিক আছে।”
এর পর অনিরুদ্ধ বলল, ”এবার তোমাদের খেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলব—পাসিং আর রিসিভিং। তোমার টিভি—তে নিশ্চয় দেখেছ বড় বড় টিম চমৎকার মুভ করে গোলের দিকে এগোচ্ছে, খুব ভাল জায়গায় দাঁড়ানো প্লেয়ারকে বল দিল কিন্তু এমন বাজে ভাবে যে, সেই প্লেয়ার বলটার নাগাল পেল না, ফলে খেটেখুটে তৈরি করা মুভটাই মাটি হয়ে গেল। আবার উলটোভাবে, কেউ একজন দারুণ সুন্দর একটা পাস দিল, যেটা ধরে গোল করা যায়, কিন্তু পাসটা যাকে দেওয়া হল সে ভাল করে বাগে রাখতে পারল না পা থেকে বেরিয়ে গেল, ফলে একটা গোলের মোক্ষম সুযোগ নষ্ট হল। পাস দেওয়া আর নেওয়া শুনলে মনে হয় খুব সাধারণ ব্যাপার কিন্তু মোটেই তা নয়। পৃথিবীর বড় বড় প্লেয়াররা রোজ এই দুটো প্র্যাকটিস করে শান দিয়ে রাখে।” ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে ফেলল অনিরুদ্ধ। লক্ষ করল ছেলেরা গভীর মনোযোগে শুনল। সে একটি ছেলেকে ডেকে বলল, ”আমি পাস দিচ্ছি, তুমি পা দিয়ে ধরো। সবাই লক্ষ করো।”
এইভাবে শুরু হল স্বামী স্বরূপানন্দ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দল গড়ার কাজ, তাদের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য। অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরে শুনল কপিল ঘোষ ফোন করেছিল এবং ফোন নম্বর দিয়ে বলেছে ন’টার মধ্যে তাকে ফোন করতে। অনিরুদ্ধ তখনই ফোন করল। অন্যপ্রান্তে কপিল ঘোষ বলল, ”আমি রেডি, আপনি কি রেডি? মানে দুটো টিম, প্রাইজ, মাইক, সভাপতি ইত্যাদি আর কুড়োন এই সব।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”সব ঠিক আছে, শুধু চব্বিশ ঘণ্টা আগে বলবেন।”
কপিল ঘোষ বলল, ”সামনের শনিবার দুপুরে শুটিং করব। চারদিন আগে জানালুম। গেঞ্জিগুলো তখনই নিয়ে যাব আর কুড়োনের জন্য বুটও, আপনি চিন্তা করবেন না। কুড়োনের একটা—দুটো ডায়লগ থাকবে, বলতে পারবে তো?”
”হ। পারবে।”
”হ, মানে?” কপিল ঘোষ থমকে গেল।
”হ, মানে হ্যাঁ, এটাই কুড়োনের ডায়লগ।”
টিভি সিরিয়ালের জন্য দুটো টিম করার মতো চোদ্দটা ছেলে স্কুল থেকে পাওয়া যাবে না অনিরুদ্ধ সেটা বুঝে গেছে। তাকে কালীতলা স্পোর্টিংয়ের কাছ থেকে কয়েকজন ফুটবলার চাইতেই হবে। সকালে সে কালীতলার মাঠে গিয়ে দীপকের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।
”দিপুদা, এটা স্কুলকে সাহায্য করার জন্য বলছি।”
”অবশ্যই সাহায্য করব।” দীপক উদার ভঙ্গিতে দু’হাত ছড়িয়ে বলল। সে জানে টিভি মানে তার ট্রেনিং সেন্টারের বিরাট পাবলিসিটি, আরও ছেলে পাওয়া যাবে। তার মানে আরও টাকা। ”তুই চোদ্দটা ছেলেই আমার এখান থেকে নিতে পারিস।”
”না, না, তার দরকার হবে না। এটা তো একটা সাজানো ম্যাচ টিভি শুটিংয়ের জন্য খেলা হবে। তুমি বরং হোম টিমের কোচ হও।” দীপকের মুখ দেখে অনিরুদ্ধ বুঝল খুশি হয়েছে।
”হ্যাঁ রে অনি, তোদের কোচিং তো শুধু স্কুলের ছেলেদের জন্য, তা হলে ওই কুড়োন ছেলেটা কী করে কোচিং নিচ্ছে?”
”ওটা হেডমাস্টারমশাইয়ের নিজস্ব ব্যাপার, স্কুল কর্মচারীর নাতি বলে কুড়োনকে উনি ছাত্রদের সঙ্গে রেখেছেন।”
এর পর অনিরুদ্ধ দেখা করল দেবেন গায়েনের সঙ্গে। মাঠে গণ্যমান্যদের বসার জন্য বাড়ি থেকে তিনি সোফা পাঠাবেন এবং দর্শক জড়ো করার জন্য সাইকেল রিকশায় মাইক দিয়ে প্রচার চালাবেন বলে কথা দিলেন এবং মনে করিয়ে দিলেন ক্যামেরা বসাবার জন্য মাঠের দু’ ধারে আর গোলপোস্টের পেছনে মাচা তৈরি করা দরকার। ইটাখালি স্কুলে পড়ান সি আর এ রেফারি হর্ষ গুহ, তাঁকে খবর দেওয়া হল। গুপ্ত ব্রাদার্স জানাল শিল্ড ও কাপ শুটিংয়ের আগেই পৌঁছে যাবে। অনিরুদ্ধর বড় কাজ এখনও বাকি, খেলোয়াড়দের শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করে রাখা। পরদিন সকালে সে অলু আর কুড়োনকে মাঠের একধারে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে বলল, একটা দল তিন গোলে হারছে তাদের একজনের বদলি প্লেয়ার হয়ে যখন কুড়োন নামবে, তখন খেলা শেষ হতে দশ মিনিট বাকি, তারপর দশ মিনিটে কুড়োন চারটে গোল দিয়ে তার দলকে জেতাবে। এই হল ঘটনা, এরই ওপর ভিত্তি করে খেলাটা হবে। অলুকে বলল, ”তোকে কিন্তু চারটে গোল খেতে হবে।”
শুনেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল অলুর মুখও, ”না মামা, না। অত গোল খেলে স্কুলে আমায় আওয়াজ দেবে।”
কুড়োন সহানুভূতির স্বরে বলল, ”চারটা গোল খাওয়ার মতো গোলকিপার অলু নয়, একটা কমায়ে দেন মামা।”
অলু প্রায় আঁতকে উঠল। ”তিনটে? না না, আমাকে বরং তুমি বাদ দাও।”
অনিরুদ্ধ বোঝাতে লাগল, ”আরে বোকা এটা সাজানো খেলা সবাই তা জানে, এ ম্যাচে গোল খেলে তোর সম্মান নষ্ট হবে না। কত ভাল সৎ লোক সিনেমায় ভিলেনের পার্টে দারুণ অভিনয় করে অ্যাওয়ার্ড পায়। তুইও অভিনয় করে গোল খাবি।”
কুড়োন বলল, ”মামা দুটো প্লান্টি বসায়ে দেন, আমি মারব অলু দুডাই আটকাবে, অর সম্মান তাইলে বাড়বে।”
শেষমেষ স্থির হল অলু চার গোলই খাবে তবে কুড়োনকে সবার কাছে স্বীকার করতে হবে অলু অভিনয় করেছে, নয়তো ওকে গোল দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই।
”হ, ঠিক কথাই তো। অলুরে চাইর গোল মারা কি সোজা কথা, আমার দ্বারা কি সম্বব।”
অনিরুদ্ধর একটা বড় সমস্যা মিটল। সে জানে দু—তিনজনকে কাটানোটা কুড়োনের কাছে জলভাত। সুতরাং আর কাউকে আলগা খেলার জন্য কিছু না বললেও হবে। কপিল ঘোষ ছবি তুলে তার দরকারমতো কাটছাঁট করে সাজিয়ে নেবে। মোদ্দা কথা, এই খেলাটার উদ্দেশ্য হচ্ছে কুড়োনের কেরামতি দেখানো।
”চল, তোরে পেরাকটিস করাই।” অলুর পিঠে ঠেলা দিল কুড়োন।
ছেলেরা গোলে বল মারা, পাসিং ট্র্যাপিং—এ ব্যস্ত ছিল। গোলকিপার গোল ছেড়ে দিল, ছেলেরা সরে এল গোলের সামনে থেকে। অলু গোলে দাঁড়াল, আঠারো গজ দূরে বল বসালো কুড়োন। জোরে শট নিল সোজা অলুকে লক্ষ্য করে, বলটা বুকের কাছে সে ধরল, দুই তালুতে আটকে রইল আঠার মতো। বলটা ফিরিয়ে দিল। কুড়োন এবার ডান পায়ে অলুর পাঁচ হাত বাঁ দিকে জমি ঘেঁষে বল মারল। অলু ঝাঁপিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল বলটা। সাফল্যে উত্তেজিত মুখে সে হাসি নিয়ে বলল, ”ঠিক করে মার।”
এবার কুড়োন ডান পায়ের পাতার বাইরে দিয়ে মারল। গোলের মাঝে দাঁড়ানো অলুর মুখের চার হাত সামনে এসে ডান দিকে বলটা বেঁকে গোলে ঢুকে গেল।
”কী হল! ধরলি না ক্যান, ঠিক কইরা মারা হয় নাই?” নিরীহ মুখে কুড়োন জিজ্ঞেস করল।
অলু মুখ লাল করে ঠোঁট কামড়ে বলল, ”আবার মার।”
সে কুঁজো হয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। এবারের শটটা একই ভাবে এল, তবে বেঁকে গেল অলুর বাঁ দিকে এবং সে অপ্রস্তুত মুখে বলের গোলে ঢোকা দেখল। এক পর কুড়োন বলটা বাঁ পায়ের পাতায় তুলে দু’বার নাচিয়ে মাথার চার হাত ওপরে তুলে দিয়েই চিৎ হয়ে মাটিতে পড়তে পড়তে বাইসাইকল কিক নিল।
বলটা ক্রসবারে লাগল, বল বারে ধাক্কা খেয়ে মাঠে ফিরে আসছে, কুড়োন স্প্রিংয়ের মতো জমি থেকে লাফিয়ে উঠে বলটাকে বুক দিয়ে থামাল। বল জমিতে পড়ার আগেই সে ভলি মারল, অলুর মাথার পাশ দিয়ে বল গোলে ঢুকল।
অনিরুদ্ধ অস্ফুটে ”শাবাশ” বলেই দৌড়ে গেল কুড়োনের কাছে, জড়িয়ে ধরে বলল, ”তুই এসব শিখলি কখন?”
”আপনি য্যামনটা দেখায়ে দিছেন সেইভাবে রোজ বিকালে পেরাকটিস কইরে গেছি দেয়ালে মাইরে মাইরে।”
”দেয়ালে মেরে কেন? মাঠে এসে তো সবার সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারিস।”
”এতগুলান ছেলে, একা একা মারনের জন্যি বলই তো পাওয়া যায় না।”
”বলটা তুই পেলি কোথায়?”
”ভবাদা দেছে। মাস্টারমশায়েদের বসার ঘরে আলমারির মাথা থিকে একদিন পুরনো খাতা নামাইতে গিয়া ভবাদা বলটা পাইছিল।” কথা শেষ করেই কুড়োন ব্যস্ত হয়ে অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ”মামা বাজে কয়ডা?”
ঘড়ি দেখে অনিরুদ্ধ বলল, ”পৌনে সাতটা।”
”ইঃ, লেট হইয়া গেল।” বলেই কুড়োন ছুট দিল।
অনিরুদ্ধ একটু অবাক হল ওকে এভাবে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে দেখে। অলুকে বলল, ”গেল কোথায় বল তো? ও তো সবাই চলে গেলেও একা একা বল নিয়ে ছোটাছুটি করে!” তারপর বলল, ”কুড়োনের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে তোকে কেন বলেছিলাম এবার সেটা বুঝতে পারলি তো? যে গোলগুলো দিল তাতে আমারও অবস্থা তোর মতো হত, তোর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”
অলু শুকনো হেসে বলল, ”আমাকে আর অভিনয় করে গোল খেতে হবে না।”
বিকেলে শিবেনবাবু ম্যাচটা কীভাবে খেলা হবে শুভেন্দু, জ্যোতিদের তা বুঝিয়ে দিলেন। শেষ দশ মিনিটে কুড়োন চারটে গোল দেবে শুনে ওরা চোখ আর ভুরু কোঁচকাল, কিন্তু অলুর মতো আপত্তি তুলল না। শুধু বলল, ”ঠিক আছে।”
শনিবার এসে গেল।
সকাল থেকে শিমুলহাটিতে সাজ—সাজ রব। উৎসাহ বেশি মেয়েদের। টিভি সিরিয়ালে যদি একঝলক নিজের মুখ দেখানো যায় এই আশায় দলে দলে বাচ্চচা—বুড়ো একতা সঙ্ঘের মাঠের দিকে রওনা হল দুপুর হতে—না—হতেই। দুটো মোটরগাড়িতে কপিল ঘোষ কয়েকজন লোক, ক্যামেরা যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির। তারা মাঠ আর মাচাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল। ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে বা বসিয়ে কোথা থেকে এবং কীভাবে ছবি তুলবে, নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করতে লাগল।
টেবলে রাখা গুপ্ত ব্রাদার্সের পাঠানো দুটো ট্রফির সঙ্গে ধীরেশ্বরের দেওয়া ছোট্ট দুটো কাপও। সে নিজে থেকেই পকেটে করে এনেছে। তার পাশে রয়েছে কিছু তোয়ালে আর নাইলনের ব্যাগ। দেবেন গায়েন এগুলো নিজে বুদ্ধি করে বাজার থেকে কিনে আনিয়েছে। অনিরুদ্ধ মাথা চুলকে বলল, ”এসব তো আমার মনে ছিল না।” দেবেন মুচকি হেসে বলল, ”প্রাইজ দিতে কত জায়গায় তো যেতে হয়, দেখেছি তো!”
একতা সঙ্ঘের ক্লাবঘরে ছেলেরা ড্রেস করে মাঠে নেমে গোলে বল মারছে। তখন দেবেন গায়েন ডাকল অনিরুদ্ধকে। ”প্লেয়ারদের ইনট্রোডিউস করাবে না সভাপতির সঙ্গে?”
”নিশ্চয় করাব।” বলেই অনিরুদ্ধ ছুটে গেল কপিল ঘোষের দিকে।
মাঠের মাঝে রেফারি ও লাইন্সম্যানদের সঙ্গে খেলোয়াড়রা লাইন দিয়ে দাঁড়াল। গরদের পাঞ্জাবি আর পাট করা মটকার চাদর কাঁধে রাখা দেবেন গায়েন প্রত্যেকের সঙ্গে শেকহ্যান্ড করল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে।
অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে কপিল ঘোষকে বলল, ”এটা কিন্তু ভাল করে দেখাবেন।”
”হ্যাঁ, পাঁচ সেকেন্ড।”
পুরস্কারের টেবলের পাশে মাইক্রোফোন। তাতে অনিরুদ্ধর লিখে দেওয়া কাগজ দেখে বলে চলেছে ধীরেশ্বর, ”দু’ সপ্তাহব্যাপী স্বরূপানন্দ ফুটবল চ্যালেঞ্জ শিল্ড প্রতিযোগিতার আজ শেষ দিন। ফাইনালে খেলছে শিমুলহাটির বালক সঙ্ঘ—সবুজ গেঞ্জি, আর কলকাতার সেভেন বুলেটস—লাল গেঞ্জি। খেলার পর পুরস্কার বিতরণ করবেন প্রখ্যাত ক্রীড়াপ্রেমী শ্রী দেবেন গায়েন, প্রধান অতিথি অতীত দিনের বিখ্যাত গোলকিপার…।”
সোফায় বসে দেবেন গায়েনের দু’পাশে শিবেনবাবু আর বৃদ্ধ হারাধন দত্ত। ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে মাঠের মধ্যে একজন, আর একজন তিনপায়া স্ট্যান্ডে ক্যামেরা বসিয়ে গোলের পেছনের মাচায়। টস করে কিক—অফ হল। মাঠের মধ্যে যে ক্যামেরাম্যান ছিল সে এইবার মাঠের ধারে সরে এসে ছবি তুলতে লাগল। মাচার লোকটিও ক্যামেরা চালিয়ে দিল। দ্রুত ওঠানামা করতে লাগল বল, চারটে ফাউলও হয়ে গেল এবং প্ল্যানমতো লাল গেঞ্জির দেবু পাঁচ মিনেটেই প্রথম গোলটা তিরিশ গজের উঁচু শটে দিয়ে দিল। গোলকিপার মিলন বারপোস্টে হতাশায় মাথা ঠুকে কিছু দর্শকের সহানুভূতি আদায় করল। জনা চারেকের সঙ্গে দু’ হাত তুলে দেবুর হাই ফাইভ করা ক্যামেরা ধরে রাখল।
দ্বিতীয় গোলটি করল শুভেন্দু পেনাল্টি থেকে। ব্যাক খেলছে যে দু’ হাত দিয়ে বলটা মাথার ওপর ধরে নেয়। কিক নেওয়ার আগে চোখের ইশারায় সে দেখায় ডান দিকে মারব। মিলন বাঁ দিকে ঝাঁপাল। দু’গোলে কলকাতার টিম এগিয়ে যেতে মাঠ জুড়ে উত্তেজনা। বিদ্রূপ আর ধিক্কার বর্ষণ শুরু হল শিমুলহাটির সবুজ গেঞ্জির ওপর।
”পাবলিক রিঅ্যাকশনটা দারুণ হচ্ছে। আমরা কথাবার্তা রেকর্ড করছি।” কপিল ঘোষ পাশে দাঁড়ানো অনিরুদ্ধকে বলল।
”আরও হবে, থার্ড গোলটা খাক।” অনিরুদ্ধ ঠোঁট টিপে বলল। ”ক্লাইম্যাক্সে ধাপে ধাপে উঠতে হবে তো।”
হাফ টাইমে দু’ গোলই রইল। দীপক হাত—পা নেড়ে প্লেয়ারদের নির্দেশ দিচ্ছে, সেটা ক্যামেরা—বন্দি হল। ইতিমধ্যে দু’ দলের একজন করে ইয়োলো কার্ড দেখে ফেলেছে। খেলা আবার শুরু হল।
”কুড়োন কখন নামবে?” কপিল ঘোষ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
”ব্যস্ত হচ্ছেন কেন।” অনিরুদ্ধ ঠাণ্ডা গলায় বলল, ”সাধন এর পর আর একটা ইয়োলো কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরোবে, সবুজ গেঞ্জির একটা ছেলে কমে যাবে। সাপোর্টররা তখন হতাশ হয়ে বলবে, ‘জেতার আর কোনও চান্স নেই। অবধারিত হার।’ ওই কোণে ক্যামেরা নিয়ে এখুনি চলে যান, দেখবেন কয়েকটা ছেলে কপাল চাপড়াবে, হতাশায় মাথা নাড়বে। দেখেননি গায়করা অভিনেতারা হলে লোক রাখে হাততালি দেওয়ার জন্য? সেইরকম আর কি।” অনিরুদ্ধ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্যামেরাকে কোথায় যেতে হবে। কপিল ঘোষ ছুটে গেল সেই দিকে।
তৃতীয় গোলটিও করল শুভেন্দু। বলটা তুলে মেরেছিল শ্যামল, ধরার বদলে মিলন চাপড়ে ফেলল শুভেন্দুর পায়ে, সে শুধু বলটা গোলের মধ্যে ঠেলে দিল। তিন গোলে শিমুলহাটি পিছিয়ে, জেতার আর কোনও আশা নেই।
ক্যামেরা দেবেন গায়েনের মুখের সামনে, পাশে টেপ রেকর্ডার। হাতের ঘড়ি দেখে সে পাশে বসা শিবেনবাবুর দিকে ঝুঁকে বলল, ”আর তো মাত্র বারো মিনিট বাকি। আপনার কি মনে হয়ে শিমুলহাটি পারবে শিল্ড জিততে?”
শিবেনবাবু বললেন, ”দেখুন না এখনও তো বারো মিনিট বাকি রয়েছে, ফুটবলে মিরাকল তো ঘটে থাকে।”
”কাট।” কপিল ঘোষ বলে উঠল।
এর ঠিক দু’ মিনিট পর শিমুলহাটির স্ট্রাইকার বাদল মাঝমাঠে বল ধরে বুলেটসের গোল লক্ষ্য করে দৌড় শুরু করতেই তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল নিমাই। বাদল হুমড়ি খেয়ে পড়ে একটু বেশিই ছটফটাতে লাগল। মাঠের মধ্যে ছুটে এল দীপক ও ক্যামেরাম্যান। দেখা গেল বাদলকে পাঁজাকোলা করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল আর তার বদলে মাঠে নামল কুড়োন।
বাদলকে ফাউল করার জন্য ফ্রিকিক পেয়েছে শিমুলহাটি। কুড়োন পেনাল্টি এলাকার ভেতরে গোল থেকে পনেরো গজ দূরে দাঁড়িয়ে, তার পাশে ও পেছনে দু’জন লাল জার্সি। অরুণের মারা ফ্রি কিকটা উঁচু হয়ে এসে পড়ছে কুড়োনের পাঁচ গজ সামনে, সে ছুটে গিয়ে পড়ন্ত বলটা বুক দিয়ে ধরেই পাশে একটু ঠেলে দিল। তারপর শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে জমির সঙ্গে শরীরটাকে প্রায় সমান্তরাল করে বাঁ পায়ে ভলি মেরেই জমিতে পড়ে গেল। অলুর বাড়ানো হাতের আঙুল ছুঁয়ে বল গোলে ঢুকল।
মাঠের চারধারে শাবাশ জানানো শব্দ উঠল। অনিরুদ্ধ কপিলকে বলল, ”গোলটা অসাধারণ, শটটায় কী কন্ট্রোল ছিল দেখলেন? আর কী বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে গিয়ে মারল!”
কপিল ঘোষ বিজ্ঞের মতো বলল, ”এটাই তো বড় প্লেয়ারের লক্ষণ। এটা আমি দু’বার দেখাব।”
সেন্টার হল। বলটা দুটো পা ঘুরে পেয়ে গেল বাদল। কুড়োনকে সে বাড়িয়ে দিল। বলটা না থামিয়ে সে অরুণকে ঠেলে দিয়েই ফাঁকা জমিতে ছুটে গেল। অরুণ পাসটা দিল কুড়োনের চার হাত সামনে। ছুটতে ছুটতেই সে শট নিল গোল লক্ষ্য করে। বলটা কলার মতো বাঁক নিয়ে বার আর পোস্টের কোণ ছুঁয়ে গোলে ঢুকল। অলু শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
দর্শকরা এবার বুঝেছে সত্যিকারের খেলা তারা দেখছে আর সেটা বুঝে এবার নাড়া খেয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। তিন—দুইটা যে তিন—তিন হয়ে যেতে পারে সেই আশায় তারা ”কুড়োন কুড়োন” বলে মাঠটাকে আকাশে তুলে দিল।
কুড়োন দু’ মিনিট পরই তিন—তিন করে দিল হেডে গোল দিয়ে। অরুণের কর্নার কিকটা রামধনুর মতো বেঁকে গোল এরিয়ায় নেমে আসছে। অলু বেরিয়ে এসে ধরবে কি ধরবে না ইতস্তত করল। কুড়োনের হাতটা ধরে আছে দেবু। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে হেড করতে লাফাল, বলটা মাথায় সবে ছুঁইয়েছে আর তখনই দেবু ওর পেটে ঘুসি মারল। দু’ হাতে পেট চেপে ধরে কুড়োন মাঠে গড়িয়ে পড়ল। ঘটনাটা দর্শকরা দেখতে পায়নি কিন্তু অনিরুদ্ধ আর দীপক ঠিকই দেখেছে।
একটা ভাল নাটক যেমন ধাপে ধাপে উত্তেজনার চুড়োয় ওঠে, কুড়োন মাঠে নামার পর থেকেই খেলাটা নাটকীয় ভাবে জমে উঠল। দীপকের সঙ্গে অনিরুদ্ধও মাঠে ছুটে এসেছে। অনিরুদ্ধ কুড়োনের পেটে মালিশ করতে করতে শুনল দীপক দাঁত কিড়মিড় করে দেবুকে বলছে, ”ফের যদি এইসব করিস তা হলে লাথি মেরে কালীতলা থেকে বার করে দেব। সারাজীবন তপস্যা করেও ওর মতো তো খেলতে পারবি না।” তারপর উদ্বেগ নিয়ে দীপক তাকাল কুড়োনের দিকে। ”খুব লেগেছে? আর একটা, যেমন করে হোক আর একটা, পারবি না?”
কুড়োন গেঞ্জিটা প্যান্টের মধ্যে গুঁজতে গুঁজতে বলল, ”হ। পারব।”
কুড়োনের ‘পারব’ যে কী ব্যাপার সেটা ম্যাচের শেষ মিনিটে দেখা গেল। তার আগে কপিল ঘোষ মরিয়ার মতো অনিরুদ্ধর মুখের কাছে হাত নেড়ে বলল, ”হ্যাঁ মশাই খুব তো টাকা খরচ করিয়ে দিলেন, ম্যাচটা এবার জিতুন।”
অনিরুদ্ধ মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ”এবার দেখুন ওদিকে।”
মাঝমাঠে কুড়োন একজনকে কাটিয়ে আর একজনকে টলিয়ে দিয়ে জমিতে ফেলে, তৃতীয়জনকে পেছনে রেখে শুভেন্দুর সামনে পৌঁছে গেছে। দু’ হাত পাশে ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে শুভেন্দু পা চালাল কুড়োনের গোড়ালি লক্ষ্য করে। চকিতে পা সরিয়ে কুড়োন বল নিয়ে শুভেন্দুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দেবু তেড়ে এল। কুড়োন শরীরটা ডাইনে—বাঁয়ে করে দেবুর দু’ পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে ওর পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে আবার বলটা ধরল।
এবার শুভেন্দু যোগ দিল দেবুর সঙ্গে। কুড়োন সাহায্যকারীর আশায় দু’ ধারে তাকাল। সাত—আট গজ দূরে বাদল।
কবজি তুলে ঘড়ি দেখে দীপক অধৈর্য হয়ে অনিরুদ্ধকে বলল, ”কুড়োনটা করছে কী! আর তো তিরিশ পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড বাকি।”
”শোধ না নিয়ে ছাড়বে না।” অনুত্তেজিত গলায় বলল অনিরুদ্ধ।
বলটা বাদলের দিকে ঠেলেই কুড়োন দু’জনের মাঝ দিয়ে তিরবেগে ছুটে গেল। বাদল না থামিয়েই পাসটা সামনে বাড়িয়ে দিল। চলন্ত বলেই কুড়োন দ্বিতীয় গোলটার মতো শট নিল। অলু পায়ের ওপর ঝাঁপাবার জন্য এগিয়ে এসেছিল। শটটা তার মাথার উপর দিয়ে জালে আটকাল। গোলের বাঁশি বাজিয়ে রেফারি খেলা সমাপ্তির বাঁশিও বাজালেন।
”উফফফ, বুকে হাত দিয়ে দেখুন এখনও ধুকপুক করছে।” কপিল ঘোষ অনিরুদ্ধর হাতটা টেনে নিয়ে বুকে রাখল।
”আপনি যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন তো?”
কপিল ঘোষ শুধু একগাল হাসল। খেলোয়াড়রা বেরিয়ে আসছে। জনতা স্বতস্ফূর্তভাবে কুড়োনকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। ক্যামেরা ছবি তুলছে। মানুষজন ছুটে যাচ্ছে ট্রফি রাখা টেবলের দিকে।
বিজয়ী আর বিজিত দলের অধিনায়কদের হাতে শিল্ড ও কাপ তুলে দেওয়ার পর দেবেন গায়েন যখন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় কুড়োন মণ্ডলের নাম ঘোষণা করল তখন তুমুল হাততালি পড়ল।
কপিল ঘোষ অনিরুদ্ধকে কানে কানে বলল, ”কাপটা মাথার ওপর যখন তুলে ধরবে তখন যেন চোখ দিয়ে জল গড়ায়, এটা তো ওর জীবনের প্রথম প্রাইজ পাওয়া। যান যান, বলুন গিয়ে।”
ভিড় ঠেলে অনিরুদ্ধ যাওয়ার আগেই কুড়োনের হাতে কাপ এবং সেটি সে মাথার ওপর তুলে সবক’টি দাঁত বার করে হাসছে।
”চোখের জলের শটটা নেওয়া হল না। ঠিক আছে, লোকজন চলে গেলে পরে নিয়ে নিচ্ছি।”
কপিল ঘোষ নাছোড়বান্দা, চোখের জল তার চাইই। গল্পে আছে প্রথমবার হাতে ট্রফি পেয়ে বাচ্চচা নায়কের মনে পড়বে তার মৃত ফুটবল গুরুর কথা আর তখনই গাল বেয়ে নেমে আসবে চোখের জল। কিন্তু এই কুড়োন ছেলেটা চোখের জল বার করার বদলে কিনা দাঁত বার করল!
দেবেন গায়েন হাতছানি দিয়ে অনিরুদ্ধকে ডাকল, ”আমার তো একটা বক্তৃতা থাকা দরকার, নয়তো অনুষ্ঠানটা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে না, কী বলো?”
অনিরুদ্ধ দেখল ট্রফি বিতরণ শেষ হতেই লোকজনেরা মাঠ ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে। মাচা থেকে ক্যামেরাম্যান শেষবারের মতো ঘরে ফেরা দর্শকদের শট নিচ্ছে। একদল ছেলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে নাচানাচি করে স্লোগান দিচ্ছে, ”জিতল কে…শিমুলহাটি আবার কে।” ”সেরা প্লেয়ার হল কে…কুড়োন মণ্ডল আবার কে।”
অনিরুদ্ধ চারধার দেখে দেবেন গায়েনকে বলল, ”প্রাইজ দেওয়ার আগে বক্তৃতা দিলে শোনার লোক পাওয়া যেত, এখন তো শোনার লোক বিশেষ নেই।”
দেবেন গায়েনও চারদিক দেখে বলল, ”তা হলে বক্তৃতা থাক। আচ্ছা অনিরুদ্ধ, তোমার ওই ডিরেক্টর বাদাম গাছটার নীচে কুড়োনের সঙ্গে কী কথা বলছে, সঙ্গে ক্যামেরাম্যানও রয়েছে! আলাদা ছবি টবি তুলছে নাকি?”
শিবেনবাবু আগাগোড়া চুপচাপ ছিলেন, এইবার মন্তব্য করলেন, ”প্রথমে ম্যাচটা সাজানো ছিল, পরে কিন্তু সত্যিকারের হয়ে গেল।”
হারাধন দত্ত লাঠি হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ”অনি, যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
”করাই আছে হারুদা।” অনিরুদ্ধ হাতছানি দিয়ে অপেক্ষমাণ সাইকেল রিকশাটাকে কাছে আসতে বলল। তিনি রিকশায় উঠে বসতে প্রণাম করে অনিরুদ্ধ বলল, ”কেমন দেখলেন ছেলেটাকে?”
”তোকে আমি এই ছোট জায়গায় আটকে না রেখে ছেড়ে দিয়েছিলুম, না দিলে তুই বাড়তে পারতিস না। এই ছেলেটাকে এবার ছেড়ে দে, আরও কঠিন জায়গায় গিয়ে ও নিজেকে তুলে ধরুক। শুধু স্কিল দিয়েই বড় হওয়া যায় না, আরও অনেক কিছু জানতে বুঝতে শিখতে হয়।” হারাধন দত্ত থেমে থেমে কথা বলে রিকশাওলাকে তাড়া দিলেন, ”চল রে।”
অনিরুদ্ধ চলে যাওয়া রিকশার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল হারুদার কথাগুলো।
বাদামতলায় কুড়োন বিব্রত মুখে শিল্ডটা মাথার ওপর তুলে ধরে, ক্যামেরার চোখ তার মুখের দিকে তাকিয়ে, কপিল ঘোষ বলে যাচ্ছে, ”বার করো, চোখ দিয়ে জল বার করো। আহহ, এই সামান্য কাজটা তুমি করতে পারছ না।”
ক্যামেরাম্যান বলল, ”কপিলদা, চোখে গ্লিসারিন দিয়ে জল বার করান।”
”গ্লিসারিন দরকার হবে জানলে সঙ্গে করে আনতুম, এখন কোথায় পাই।” কপিল অসহায়ভাবে এপাশ—ওপাশ তাকিয়ে অনিরুদ্ধকে এগিয়ে আসতে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এই যে মশাই, আপনার চেলার চোখ দিয়ে জল বার করান তো, জল আমার চাই। এই চোখের জলের মধ্য দিয়ে নায়কের দুঃখকষ্টের ছেলেবেলাটা বেরিয়ে আসবে দর্শকদের চোখের সামনে।”
অনিরুদ্ধ তাকাল কুড়োনের মুখের দিকে। তার মনে হল, ওর দ্বারা কান্না এখন সম্ভব নয়। তবু কপিল ঘোষকে খুশি করার জন্য বলল, ”কুড়োন পারবি না? দ্যাখ না চেষ্টা করে! মনে—মনে কষ্টের কথা দুঃখের কথা ভাবতে থাক।” এর পর সে কপিল ঘোষকে বলল হালকা অনুযোগের সুরে, ”আপনাকেও বলিহারি যাই, যে কাজটা অভিনেতার করার কথা সেটা কিনা একটা ফুটবলারকে করতে বলছেন? এইটুকু ছেলের পক্ষে কি বলামাত্র চোখের জল বার করা সম্ভব? দুঃখকষ্ট বোঝাতে হয়তো অন্যভাবে করে দেখান।”
আমতা আমতা করে কপিল ঘোষ বলল, ”ঠিক আছে, পরে ওকে স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে গ্লিসারিন দিয়ে টেক করব।” কুড়োনকে আর স্টুডিও নিয়ে যাওয়া হয়নি, কেননা গল্পটার ধাঁচ এর পর বদলে ফেলা হয়। বাতিল হয়ে যায় চোখের জল।
দলবল নিয়ে কপিল ঘোষ চলে যাওয়ার পর অনিরুদ্ধ আর কুড়োন বাড়ির পথ ধরল।
”হ্যাঁ রে কুড়োন, তুই কখনও কেঁদেছিস?”
প্রশ্নটা তাকে অবাক করলেও জবাব দিল সঙ্গে সঙ্গে। ”না মামা কেঁদেছি বলে তো মনে পড়ে না।”
”বাবা মারা যেতে, মা মারা যেতে, দাদু মারা যেতে কাঁদিসনি?”
”আরে তখন তো আমি অ্যাত্তোটুকু, মরা কী জিনিস তাই আমি বুঝি না, কান্না আসবে কী করে।”
”এখন বুঝিস?”
”না। এখন তো কেউ মরে নাই, মরলে বুঝতে পারব।”
অনিরুদ্ধ এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৌতূহল চাপতে না পেরে বলে ফেলল, ”ধর তোর বড়দাদু রাখাল যদি মারা যায় তা হলে কাঁদবি?”
শুনেই কুড়োন থমকে দাঁড়াল। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। কথা না বলে মাথা নিচু করে অনিরুদ্ধর পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
.
সকালের ট্রেনিংয়ের মাঝে কুড়োন বহুদিনই জিজ্ঞেস করে ”মামা বাজে কয়টা?” অনিরুদ্ধ ঘড়ি দেখে যদি বলে ”পৌনে সাতটা”, কুড়োন তখন বলে, ”অহন চলি, দরকার আছে।”
ব্যাপার কী? অনিরুদ্ধ একদিন জিজ্ঞেস করেও ফেলল, ”তুই রোজ রোজ সাতটার আগেই চলে যাস কেন রে? কী এমন দরকার?”
কুড়োন সপ্রতিভভাবে জবাব দেয়, ”ঘরে গিয়া উনান ধরাতে হয়। ডাক্তার কইছে, ঠিক সাড়ে সাতটায় গরমজল দিয়া দাদুরে চান করাতে হবে। তাইতে বুক ভাল থাকবে।”
বুক ভাল থাকার এমন দাওয়াইয়ের কথা অনিরুদ্ধ জীবনে শোনেনি। লোকে কত কী যে বিশ্বাস করে এটাও হয়তো তাই, এই ভেবে সে কুড়োনকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
স্কুলের জন্য একটা ফুটবল টিম মোটামুটি দাঁড় করানো গেছে। এবার টিমটাকে পরীক্ষা করা দরকার। তিনটি রবিবারে স্বরূপানন্দ স্কুল তিনটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলল দুটি ক্লাব ও একটি স্কুলের সঙ্গে। খেলাগুলি হল দু—তিন মাইলের মধ্যে। দলের সঙ্গে গেছল অনিরুদ্ধ এবং একটি খেলায় যান শিবেনবাবুও। কুড়োনকে দলে রাখা হয়নি যেহেতু সে স্কুলছাত্র নয়, তবে দলের সঙ্গে সে গেছে। বহু বছর আগে রাখাল যে কাজটা করত, সেই খেলার বল, বালতি, গ্লাস, মেডিক্যাল বক্স ইত্যাদি বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ কুড়োন যেচে নিয়েছিল। ছেলেরা বাড়ি থেকে ড্রেস করে বেরোত। ওদের সঙ্গেই সে সবুজ গেঞ্জিটা পরে থলিটা পিঠে ঝুলিয়ে বাসে উঠত।
নলপুকুর সবুজসাথীর সঙ্গে ম্যাচটায় তারা দু’ গোলে হারে, কলাইখোলা প্রগতি সঙ্ঘকে তিন—দুই গোলে হারায়, শুধু চাঁদপানা হাই স্কুলের সঙ্গে খেলাটি শেষ মিনিটে ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় দাঁড়ায় একটা পেনাল্টিকে কেন্দ্র করে। ম্যাচ তখন প্রায় শেষ মিনিটে, কোনও গোল হয়নি। বল দুই প্রান্তে দ্রুত যাতায়াত করছে, যে—কোনও সময় যে—কোনও দল গোল খেয়ে যেতে পারে। উত্তেজনায় মাঠভরা দর্শকরা ফুটছে। এমন সময় স্বরূপানন্দর বিরুদ্ধে পেনাল্টি।
পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে বলে দুই পক্ষের খেলোয়াড়রা এলোমেলো শট নিতে নিতে চাঁদপানার একজন গোলে দ্রুত জোরে শট নেয়, দেবু ছিল পোস্ট ঘেঁষে গোললাইনে দাঁড়িয়ে, পা বাড়িয়ে বলটা আটকাতে গিয়ে বল তার কনুইয়ে লেগে ছিটকে গোললাইনের বাইরে যায়। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে পেনাল্টি স্পটের দিকে আঙুল দেখান।
শুরু হয়ে যায় তুলকালাম হট্টগোল। কিছু লোক মাঠে নেমে পড়ে রেফারিকে ঘিরে বলতে থাকে, ‘হ্যান্ডবলটা ইচ্ছে করে করেনি, এটা পেনাল্টি নয়।’ আর—এক দলের দাবি, রেফারি ঠিক কাজ করেছেন। কুড়োন তখন উন্মাদের মতো একটা প্লাস্টিকের গ্লাস হাতে ছুটে গেছল। ভিড়ের মধ্যে গ্লাসটা দিয়ে সে রেফারির কানের পাশে বেশ জোরেই মারে, রেফারি কান চেপে ধরে বসে পড়েন। ঘিরে ধরা জনতা থতমত হয়ে পিছিয়ে আসে। তারা ভাবেনি কেউ রেফারিকে মারবে। সেই ফাঁকে কুড়োন ভিড়ের মধ্য দিয়ে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসে। কেউ তাকে লক্ষ না করলেও শিবেনবাবুর নজর সে এড়াতে পারেনি।
রেফারির কানের পাশটা ফুলে ওঠায় বরফ ঘষা হল, শিবেনবাবু তাঁকে অনুরোধ করলেন পেনাল্টি সিদ্ধান্ত থেকে তিনি যেন সরে না আসেন। অলুকে বললেন গোলে গিয়ে দাঁড়াতে। মাঠের মধ্য থেকে লোকজন বেরিয়ে যেতে চাঁদপানা হাই স্কুলের ব্যাক পেনাল্টি শট নিয়ে গোল দেয়।
শিমুলহাটি ফেরার বাসে সামনের দিকে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিবেনবাবু। পেছনের দিকে ছিল কুড়োন এবং সাত—আটজন ছেলে। কেউই বসার জায়গা পায়নি। বাকি ছেলেরা কাছাকাছি থাকে, তাই বাসে ওঠেনি, হেঁটেই বাড়ি যাবে। বাসে সারাক্ষণ বকবক করে কুড়োন।
”ওটা কিছুতেই প্লান্টি ছিল না, দেবু তো ইচ্ছা করে বল আটকায় নাই, তাইলে কোন আইনে প্লান্টি দিল? এই দেবু কসনা তুই কি ইচ্ছা কইরা বলে হাত দিছিস?”
দেবু জবাব না দিয়ে ফিকে হাসল, শিবেনবাবু কুড়োনকে দেখার চেষ্টা করে ভিড়ের জন্য দেখতে পেলেন না।
কুড়োন কথা বলেই চলেছে। ”রেফারিটা ওইখানকার, চাঁদপানায় বাড়ি। নিঘঘাৎ ঘুস খাইছে।”
শিবেনবাবু গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠলেন, ”কুড়োন এবার চুপ কর।”
এর পর আর কুড়োনের গলা শোনা যায়নি। বাস থেকে নেমে ছেলেরা যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়, কুড়োন থলি—পিঠে শিবেনবাবুকে এড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে স্কুলের দিকে।
”কুড়োন শোন।” থমথমে মুখে শিবেনবাবু ডাকলেন। কুড়োন কাছে এল। ”এবার থেকে স্কুলের খেলা থাকলে তুই সঙ্গে যাবি না। রেফারিকে মারলি কেন? তোর ভাগ্যি ভাল কেউ তোকে গ্লাস দিয়ে মারতে দেখেনি, দেখলে গোটা টিম ওখানে মার খেত, আমিও খেতুম। ছি ছি ছি, স্কুলের বদনাম তো হতই, আমাদের টিমের সঙ্গেও আর কেউ খেলতে চাইত না, শুধু তোর জন্য।”
রাগে কাঁপছিলেন শিবেনবাবু। কুড়োন হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে।
”এরকম একটা অসভ্য ছেলে টিমের সঙ্গে থাকলে সেই টিম কখনও সুনাম পায় না। কেন মারলি রেফারিকে?”
কুড়োন চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলল, ”আমরা হাইরে যাব ভাবতেই মাথাটা কেমন যেন গরম হইয়ে গেল।”
”রেফারিকে মারলে কি জিতে যেতুম?”
কুড়োন চুপ রইল। শিবেনবাবু কয়েক সেকেন্ড উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে বললেন, ”যা বললাম, আর কখনও টিমের সঙ্গে যাবি না।”
কুড়োনের রেফারিকে মারার কথা শিবেনবাবু কাউকে বলেননি, এমনকী অনিরুদ্ধকেও নয়। শুধু ভবতোষকে বলেছেন, ”এবার থেকে তুমি যাবে খেলার থলিটা নিয়ে।”
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সাবডিভিশনাল স্কুল ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশিপে স্বরূপানন্দ স্কুল খেলার জন্য নাম দেবে কিনা শিবেনবাবু জানতে চাইলেন অনিরুদ্ধর কাছে। সকালে ট্রেনিংয়ের পর ওরা বাড়ি ফিরছিল।
অনিরুদ্ধ বলল, ”না সার, স্বরূপানন্দ এখনও চ্যাম্পিয়ানশিপ খেলার মতো তৈরি হয়নি। যে তিনটে ফ্রেন্ডলি খেলল তারা খুব ভাল টিম নয়, আমরা একটামাত্র ম্যাচ জিতেছি, তাও অফসাইড থেকে উইনিং গোলটা দেয় শুভেন্দু। জেলায় অনেক স্কুলটিম আছে যারা আমাদের গোলের মালা পরিয়ে দিতে পারে। সমস্যাটা কী জানেন সার, অনেক স্কুল বাইরের ছেলে খেলায় যাদের বয়স অন্তত কুড়ি বছরের ওপর।”
শিবেনবাবু কৌতূহলী হলেন, ”কীভাবে খেলায়? বাইরের ছেলে মানে তো ছাত্র নয়!”
”হ্যাঁ, ছাত্র নয়। কিন্তু স্কুলের খাতায় ছাত্র হিসাবে নাম লেখানো আছে। থাকে হয়তো স্কুল থেকে দশ—পনেরো মাইল দূরে, কোনওদিন স্কুলেও আসে না কিন্তু খেলে স্কুলের হয়ে। এরা একটু বেশি বয়সীই হয়। এদের সঙ্গে যথার্থ ঠিক বয়সীরা পেরে উঠবে কী করে! তাই বলছিলুম প্রথমেই ধাক্কা খেয়ে বিশ্রী একটা অভিজ্ঞতা পেলে সেটার ফল ভাল নাও হতে পারে, বরং আর একটু তৈরি হয়ে মাঠে নামুক, আরও দু—চারটে ফ্রেন্ডলি খেলুক।”
”আমারও মনে হয়েছে ছেলেরা কাঁচা রয়েছে। তবে জলে ঠেলে না দিলে সাঁতারটা শিখবে কেমন করে, ভয়টা তো প্রথমে ভাঙানো চাই। এই দ্যাখো না কুড়োনকে, ভয়ডর বা জড়তা বলে কিছু নেই, অপোনেন্ট যেই হোক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব, সবসময় ওর এই মনোভাব। এটা একদিক দিয়ে ভাল।”
”ভাল কথা সার, কুড়োন কিন্তু বেশ কিছুদিন সকালে ট্রেনিংয়ে আসছে না! খেলাপাগল ছেলে, কখনও তো কামাই করেনি। অসুখবিসুখ করল কিনা… খোঁজ নিতে হবে।” অনিরুদ্ধকে চিন্তিত দেখাল।
বাড়ি ফেরার জন্য স্কুলের ফটকের সামনে দিয়ে অনিরুদ্ধকে আসতে হয়। প্রতিবারই সে ফটকের গরাদের ফাঁক দিয়ে স্কুল—মাঠটা দেখার জন্য দাঁড়ায়। দেবেন গায়েনের কথাটা এখন মনে পড়ে।—’মাঠটাকে আমি ইডেনের মাঠ করে ছাড়ব।’ মিথ্যে জাঁক করেনি দেবেন গায়েন, সবুজ মখমল যেন বিছিয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির বারান্দা থেকে অনিরুদ্ধ অনেকদিন শুনেছে কেউ মাঠের ধার দিয়ে হাঁটলেও রাখাল চিৎকার করে, ”হেই গোরু মাঠে নামছিস ক্যান, ঘাস খাবি বলে?” বুট পরে ছোটাছুটির ধকল নেওয়ার মতো জোর ঘাসগুলোর এখনও হয়নি, গোড়াগুলো আরও একটু চেপে বসা দরকার।
অনিরুদ্ধ মুগ্ধ হয়ে মাঠটা দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল স্কুলের টানা দাওয়ায় একটা ক্লাসঘরের বাইরে দরজার পাশে কুড়োন বসে। হাতে খাতা আর ডটপেন, পাশে একটা কী দুটো বই। মাথাটা ঝুঁকিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ক্লাসঘরের ভেতরে তাকিয়ে খাতায় কী যেন লিখল। তারপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে আঙুলের কর গুনে বিড়বিড় করে আবার খাতায় লিখে ঝুঁকে ক্লাসঘরের মধ্যে কিছু একটা দেখল আর মুখে হাসি ফুটল।
স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের ক্লাস চলছে। একঝাঁক বোলতার গুনগুনানির মতো শব্দ হয়ে চলেছে। সন্তর্পণে ফটক ঠেলে অনিরুদ্ধ ঢুকল। কিছুটা হেঁটে গিয়ে দাওয়ায় একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে এক চোখ দিয়ে লক্ষ করতে লাগল কুড়োনকে। ঠিক সেই সময় টিচার্স রুম থেকে অল্পবয়সী এক দিদিমণি বেরোলেন। একটি অচেনা লোককে থামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে প্রায় চোরের মতো তাকাতে দেখে তাঁর চোখ কুঁচকে উঠল।
”কে আপনি? এখানে কী করছেন?”
অনিরুদ্ধ থতমত হয়ে বলল, ”ওকে দেখছি।” আঙুল দিয়ে সে দূরে বসা কুড়োনকে দেখিয়ে বলল, ”ওকে চেনেন?”
কুড়োনের দিকে না তাকিয়ে দিদিমণি বললেন, ”কুড়োন, আমরা সবাই ওকে চিনি।”
”ও কী করছে বলুন তো ওখানে বসে?”
”লেখাপড়া করছে।”
কেউ যদি এখন অনিরুদ্ধকে বলে শতাব্দীর সেরা ভারতীয় গোলকিপার তুমি, তা হলে সে এতটা চমকে উঠবে না যতটা চমকাল এখন। কুড়োন এবং লেখাপড়া! সে দুটোকে মেলাতে না পেরে বলল, ”ওখানে বসে কেন?”
”ক্লাসে ছোটদের সঙ্গে বসতে লজ্জা করে বলে বাইরে বসে।”
”ওটা কোন ক্লাস?”
”ক্লাস টু, তবে সামনের মাসেই ওর পরীক্ষা নিয়ে ক্লাস থ্রি—তে তুলে দেওয়া হবে।” দিদিমণির স্বরে চাপা কৌতুক আর গর্ব। ”দারুণ মাথা আর পরিশ্রম করে।”
”এভাবে ইচেছমতো পরীক্ষা নিয়ে কাউকে ক্লাসে তুলে দেওয়া যায়?” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে জানতে চাইল।
”যে ছেলে ক্লাস থ্রি—র যোগ্য, ক্লাস টু—য়ে অযথা তাকে একটা বছর আটকে রেখে লাভ কী? ও তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাক, এটাই আমরা চাই।” দিদিমণি চটি ফটফটিয়ে একটা ঘরে ঢুকে গেলেন।
এইসময় টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাখাল পিরিয়ড শেষ হওয়া জানান দিতে তারে ঝোলানো ঘড়িতে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে একটা ঘা দিল। অনিরুদ্ধ চটপট স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। কুড়োন কেন যে ”মামা বাজে কয়টা?”—জিজ্ঞেস করত, সেই রহস্যটা এখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। যে ছেলে চোদ্দ গজ দূর থেকে টিভি—তে খেলা দেখার জন্য গাছে উঠতে পারে, তার পক্ষে ঘরের দরজায় বসে ব্ল্যাকবোর্ড দেখা বা দিদিমণিদের কথা শোনা তো অতি সামান্য ব্যাপার।
বাড়ি ফিরে অনিরুদ্ধ দিদিকে কুড়োনের লেখাপড়া শেখার অভিনব পদ্ধতির বিবরণ দিয়ে বলল, ”আমার মনে হয় যেদিন হেডমাস্টারমশাই ট্রেনিংয়ের জন্য কুড়িজনের নাম বললেন তাতে কুড়োনের নাম ছিল না। ও পরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন তার নাম নেই, অলু ওকে বলে এটা শুধু স্কুলের ছাত্রদের জন্য তাই তোর নাম নেই। ও বলে আমাকে ছাত্র করে নিন। অলু বলে তুই অ আ ক খ—ই তো জানিস না, ছাত্র হবি কী করে? তাইতে কুড়োন ওর ট্রেডমার্ক উত্তর দিয়েছিল— পেরাকটিস করলাই শিখা লওয়া যায়।
”দিদি, আমার মনে হয় সেই মুহূর্তেই কুড়োন ঠিক করে ছাত্র হবে। নিজের ওপর কী অগাধ বিশ্বাস—প্র্যাকটিস করলেই শিখে নেওয়া যায়। আর সত্যি সত্যিই শিখে নিল! ঠিকমতো শুরু করলে এখন তো ওর অলুর সঙ্গে পড়ার কথা। অবশ্য ওয়ান, টু—র পড়া যদিও সামান্য তা হলেও এই ক’ মাসেই হজম করে এখন থ্রি—তে উঠতে যাচ্ছে। অবাক করার মতো নয়? তার মানে কী প্রচণ্ড খেটেছে ভাবো! মনে হয় কেউ ওকে নিশ্চয় হেলপ করেছে।”
অফিস থেকে ফিরে সকালে চোখ বুলিয়ে যাওয়া খবরের কাগজটা ভাল করে পড়ে অনিরুদ্ধ (অলু পড়ছে তাই সে টিভি চালায় না)। বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বেরোল, উদ্দেশ্য, রাখালের কাছ থেকে কুড়োনের খবর নেওয়া। চৌকিতে শুয়েছিল রাখাল, উঠে বসল অনিরুদ্ধকে দেখে। কোনও ভূমিকা না করে সে জিজ্ঞেস করল, ”কুড়োনকে পড়ায় কে রাখালদা?”
প্রশ্নটা ঠিকমতো বুঝতে পারল না রাখাল। বলল ”পড়ায় কে মানে?”
”কুড়োন সকালে প্রাইমারি স্কুলে পড়ছে এটা তুমি জানো। ওকে তুমিই ভর্তি করিয়েছ, তাই তো?”
”না। আমি করাইনি, প্রথমে আমি তো জানতামই না।”
”তা হলে ও ভর্তি হল কী করে?”
”ভবা অরে ভর্তি করাইছে।”
অনিরুদ্ধর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ঘরে চোখ বুলিয়ে তার চোখে পড়ল মুকুল গণিত, কিশলয় নামে দুটো বই আর দু—তিনটে খাতা টিনের একটা বাক্সের ওপর। অঙ্কের বইটা তুলে নিয়ে খুলে দেখল কে এক অভিজিৎ ঘোষালের নাম লেখা, বইটা পুরনো।
”ভবাই অরে পড়ায়। অর দেশের বাড়ি তো আমাদের গেরামের কাছেই লাইরিপুরে। তালদির হস্টেলে থেইকে মাধ্যমিক পাশ করেছে। অর কথাবার্তার ধরন দেখে বোঝো না লেখাপড়া করা ছেলে, কুড়োনরে ভাইয়ের মতো দেখে। পাইমারির বড়দিরে বলে অই তো কুড়োনরে ভর্তি করাইছে, অই তো পুরানা বই জোগাড় করে দেছে। কুড়োন রোজ সন্ধ্যায় অর কাছে পড়তি যায়, ঘরে এসে অনেক রাইত অবদি পড়ে, দুপুরেও পড়ে। খাতাকলমও ভবা দিচ্ছে।”
অনিরুদ্ধ আর কোনও প্রশ্ন না করে অন্য প্রসঙ্গে এল। ”তোমার বুকের ব্যথাটা এখন কেমন, আর অজ্ঞান—টজ্ঞান হওনি তো? ওষুধ ঠিকমতো খাচ্ছ?”
”ব্যথা তো লাগে নিচু হয়া কিছু তুললে, জোরে হাঁটলি ব্যথা হয়, হাঁপ ধরে। ওষুদ খাওয়া কি সোজা কথা! ডাক্তারবাবু যা লিখা দেছে তাতে তো মাসে দুইশো টাকা করে পড়ে। অত টাকা পাব কোথা? মাসে তাই অর্ধেক দিন খাই।” রাখাল করুণ চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অনিরুদ্ধের বন্ধু তরুণ হাসপাতালে রাখালের ইলেকট্রো কার্ডিওগ্রাম করিয়েছিল। পরে অনিরুদ্ধ তরুণের কাছে জেনে নিয়েছিল, ধমনী দিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত পৌঁছচ্ছে খুবই কম। ফলে রাখালের হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে। বেশি পরিশ্রম যেন না করে। ওষুধ ওকে নিয়মিত আজীবন খেয়ে যেতে হবে।
”রাখালদা তোমার প্রেসক্রিপশনটা আমায় দাও, আমি মাসে মাসে তোমায় কিনে দিয়ে যাব। কিন্তু রোজ তোমায় খেতে হবে।” কথাটা বলে রাখালের বিহ্বল কৃতজ্ঞ দুটি ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ অত্যন্ত তৃপ্ত বোধ করল। তারপর বলল, ”কুড়োনকে বোলো ওর বইখাতা যা লাগবে আমাকে যেন বলে।”
পরের দিনই অনিরুদ্ধ অফিস ফেরত গড়িয়াহাট থেকে রাখালের এক মাসের ওষুধ কিনে হাজির হল রাখালের ঘরে। ধুতি—শার্ট পরা এক অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে রাখাল তখন কথা বলছিল। পলিথিনের ঠোঙায় ভরা ট্যাবলেটের পাতাগুলো রাখালের হাতে দিয়ে বলল, ”সামনের মাসে আবার দিয়ে যাব, মনে করে খাবে কিন্তু!”
”খুব ভাল করলা এগুলো কিনা দিয়া। এই দ্যাখো আমার বড় বোনের নাতি আইছে আমারে নিয়্যা যাইতে, অর বোনের বিয়া। পাশের গেরাম চরখেরিতে ছেলের বাড়ি, ছেলেডা মাছ ধরে; আজ পনেরো—বিশ বছর বোনরে দেখি না, ভাবতাছি এই উপলক্ষে বোনডারে দেখে আসি। যাওয়া কি কম ধকলের ব্যাপার, সকালে বাইরালে সেই বিকালে পৌঁছানো—বাস, লঞ্চ, টেম্পো, তারপর পাঁচ মাইল হাঁটা!”
”ওষুধগুলো সঙ্গে নিয়ে যেও।”
”তা আর বলতে! দশ মাইলের মধ্যে ডাক্তারবদ্যি নাই, ওষুধের দোকান নাই।”
”কুড়োনও সঙ্গে যাচ্ছে?”
”নাঃ।” রাখাল হতাশা মেশানো বিরক্তি নিয়ে বলল। ”ওর নাকি পড়ায় বিঘ্ন হবে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের এটাই তো সুযোগ, তা হতচ্ছাড়ার কাছে পড়াটাই নাকি বড় কাজ। ও নিজে রেঁধেবেড়ে খাবে, বললুম কত করে, শুনলই না।”
অনিরুদ্ধর সঙ্গে রাখালের এটাই শেষ কথাবার্তা। সাতদিনের ছুটির দরখাস্ত ভবাকে দিয়ে লিখিয়ে শুক্রবার সকাল দশটায় হেডমাস্টারমশাইয়ের হাতে সেটা দিয়েই রাখাল তার বোনের নাতির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে রাখাল সাতদিনের ছুটি তিন—চারবারের বেশি নেয়নি। দরখাস্তটা যে মঞ্জুর হয়ে যাবে, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল।
পরদিন শনিবার বিকেলেই রাখালের বোনের সেই নাতি এবং সঙ্গে আর একটি লোক বন্যায় ডোবা একতলা বাড়ির চালে বসে থাকা মানুষের মতো মুখ করে স্কুলে এসে হাজির। ভবা তখন ঘরে ঘরে তালা লাগাচ্ছিল। সেই প্রথম দুঃসংবাদটা শুনল—রাখাল কাল বিকেলেই টেম্পো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মাইল তিনেক যাওয়ার পরই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। মুখে জল দেওয়ার বা কানে হরিনাম জপ করার সুযোগও কেউ পায়নি। ”ডেডবডি এখনও রাখা আছে। কুড়োন গিয়ে মুখে আগুন দিলে তবেই দাহ করা হবে,” বলল সঙ্গের লোকটি।
কুড়োন তখন একতা সঙ্ঘের মাঠে। ভবা ওই দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে আসে।
”জানো মামা, আমরাও শুনলুম ওর সঙ্গে।” অলু সন্ধ্যাবেলায় অনিরুদ্ধকে বলে ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে আসামাত্র। ”ভেবেছিলুম ও কেঁদে উঠবে হাউহাউ করে। কিছুই করল না। মুখখানা কেমন শক্ত হয়ে গেল। শুধু বলল, ‘আমারে কি এখন যাইতে হইব?’ তারপর একটা কথাও না বলে ওদের সঙ্গে চলে গেল।”
শুনে গুম হয়ে অনিরুদ্ধ অনেকক্ষণ শুয়ে রইল, কিছু খেলও না। তার শুধু চোখের সামনে দিয়ে সার বেঁধে চলেছে স্কুলজীবন এবং রাখাল। টুকরো টুকরো ঘটনা আর রাখালের গলার স্বর। এত বছর এখানে রইল অথচ কথার ভাষা আর উচ্চচারণ একদম পালটাল না। স্কুলের সামান্য মাইনেতে নিজেরই দু’ বেলা ভাল করে খাওয়া জোটে না তবু ভাইয়ের নাতিকে কাছে এনে রাখল। তা না হলে কুড়োন কোথায় ভেসে যেত কে জানে! রাখালই ছিল কুড়োনের একমাত্র আশ্রয়, সেই রাখালের মৃত্যুসংবাদ শুনেও কুড়োনের চোখে জল এল না! একবারও মনে এল না এবার ওর কী হবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে!
রাত্রে সে শিবেনবাবুর কাছে গিয়ে কথা বলল। তিনি বললেন, ”ভবা আমায় সবই বলেছে, রাখাল যে ঘরটায় থাকত সেখানেই কুড়োন থাকুক আর রাখাল যে কাজ করত, দুপুরে সেটাই করুক। ওর পড়াটা সকালে যেরকম চলছে চলুক। আপাতত জরুরি ভিত্তিতে ওকে নিয়োগ তো করা যায়, মনে হয় না কমিটি তাতে আপত্তি করবে। ছেলেটাকে তো খেয়েপরে বাঁচতে হবে, তবে ওর ফুটবলে সময় কমে যাবে।”
ফিরে এসে অনিরুদ্ধ দিদিকে জানাল শিবেনবাবুর সঙ্গে যা—যা কথা হয়েছে। শুনে অমলা বলল, ”ছেলেটাকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখ না! নীচে তো ঘর পড়ে রয়েছে, একটা লোক বাড়লে এমন কিছু খরচও বাড়বে না।”
অমলার প্রস্তাবটা অনিরুদ্ধর মনে ধরল। সে ঠিক করল কুড়োন ফিরে এলে তাকে এই বাড়িতে থাকার কথা বলবে। সোমবার স্কুলে হাফছুটি দেওয়া হল, শোকসভাও হল। মাস্টারমশাইদের অনেকেই রাখাল সম্পর্কে দু—চার কথা বললেন। কুড়োন মুখাগ্নি করে রবিবার রাতেই ফিরে এসেছিল। শোকসভায় সে ঘরভর্তি ছাত্রদের পেছনে দাঁড়িয়ে পাথরের মতো মুখ করে বক্তৃতা শুনে যায়।
পরদিন সকালে কুড়োন ছেলেদের সঙ্গে চাঁদানদীর পোল পর্যন্ত ছুটে ফিরে এল একতার মাঠে। অনিরুদ্ধ লক্ষ করল অন্যান্য দিনের মতোই কুড়োন মনপ্রাণ ঢেলে শুটিং ট্র্যাপিং হেডিং করে গেল এমনভাবে, যেন ওর মরণবাঁচন নির্ভর করছে এই প্র্যাকটিসের ওপর। একসময় সে বলল, ”মামা প্ল্যান্টি মারা পেরাকটিস করব। এখন তো খুব ট্রাইবেকার হয়।”
দু’দিন আগে দাদুর মুখে আগুন দিয়ে এসেছে যে, পেনাল্টি কিক নেওয়ার কৌশল শেখার জন্য তার আগ্রহ অনিরুদ্ধের মনের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করল। তার মনে হল, এইটুকু ছেলের পক্ষে খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এই কঠিন হয়ে ওঠাটা। অনিরুদ্ধ সাতটি ছেলেকে দিয়ে পেনাল্টি কিক নেওয়াল, প্রত্যেকে মারল পাঁচটি করে। পালা করে তিনজন গোলে দাঁড়াল। কুড়োনের তিনটে শট বারপোস্ট ঘেঁষে গোলে ঢুকল, বাকি দুটো অলুর কাঁধের পাশ দিয়ে জালে গিয়ে লাগল। পাঁচটাতে গোল পাঁচটাই। ওর মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি।
”কুড়োন, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।” প্র্যাকটিস শেষে অনিরুদ্ধ কুড়োনকে ডাকল।
”কী মামা?”
”তুই এখন থাকবি, খাবি কোথায়?”
”কেন, যেখানে আছি সেখানেই থাকব! দাদুর চাকরিটা পেলি খাওয়াও আমার চলে যাবে।” কুড়োন নিশ্চিতভাবে বলল।
”তুই যদি আমাদের বাড়িতে থাকতে চাস তা হলে থাকতে পারিস, খাওয়াও আমাদের ওখানে।” কথাটা বলে অনিরুদ্ধ ওর মুখভাব লক্ষ করল। কুড়োনের চোখে প্রথমে একটা ঝিলিক দিল, তারপর হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারামুখে।
”না মামা, আমি কোথাও যাব না, ওই ঘরেই থাকব, কোনও অসুবিধা হবে না।”
অনিরুদ্ধ ওর সংক্ষিপ্ত, দৃঢ় গলার স্বরে বুঝে গেল এই ব্যাপারে আর কথা বলে লাভ নেই। তার মনে পড়ল হারুদার কথাটা, ‘এই ছেলেটাকে এবার ছেড়ে দে। আরও কঠিন জায়গায় গিয়ে ও নিজেকে তুলে ধরুক।’
অনিরুদ্ধ শুধু বলল, ”তোর যখন যা দরকার পড়বে আমাকে বলবি।”
”বলব।”
অনিরুদ্ধ ওর চোখে নরম আলো ফুটে উঠতে দেখল। কুড়োন মৃদু চাপা স্বরে বলল, ”মামা রাইগ করলান?”
”না রে, রাগ করব কেন, নিজে নিজে বড় হওয়াই তো আসল বড় হওয়া। খুব চেষ্টা কর, নিশ্চয় বড় হবি।”
.
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে যারা সুদের টাকা দিচ্ছে না তাদের তালিকা তৈরি করছিল অনিরুদ্ধ, এমন সময় নির্মল ঘোষ টেবলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। শান্ত নিরীহ মধ্যবয়সী, কখনও কাজে ফাঁকি দেন না, সহকর্মীদের সবসময় সাহায্য করেন, সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। ঝুঁকে অনিরুদ্ধর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ”একটা অনুরোধ করব, রাখবে?”
অনিরুদ্ধ সিধে হয়ে বসল, ”বলুন নির্মলদা, সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয় রাখব।”
”সাধ্যের মধ্যেই এটা। আমাদের গ্রামে ঠাকুর্দার নামে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় গণপতি চ্যালেঞ্জ শিল্ড আর ঠাকুমার নামে রানার্স কাপ। চল্লিশ বছরের টুর্নামেন্ট। জেলার তা বটেই, কলকাতারও বহু নামকরা প্লেয়াররা খেলে গেছে। এবারও অনেকে খেলেছে। রবিবার পনেরো তারিখে ফাইনাল। এবার তুমি যদি ফাইনালে বিশেষ প্রধান অতিথি হও, তা হলে অর্গানাইজারদের বলে দেব।” নির্মল ঘোষ প্রার্থীর মতো মুখ করে তাকিয়ে রইলেন।
অনিরুদ্ধ ফাঁপরে পড়ল। জীবনে সে দুটি কি তিনটি ফুটবল ফাইনালে পুরস্কার দিয়েছে, দু—তিন মিনিটের বক্তৃতা কোনওক্রমে দিয়েই চেয়ারে বসে পড়েছে। এই একটি জিনিস সে মনেপ্রাণে অপছন্দ করে—বক্তৃতা দেওয়া। খেলোয়াড়রা ক্লান্ত, দর্শকরা যখন উল্লসিত বা বিমর্ষ, তখন বক্তৃতা কারও মাথায় ঢোকে না। কিন্তু উদ্যোক্তারা চান একটা লম্বা বক্তৃতা, যা কেউ শোনে না অন্তত সে নিজে কখনও শুনত না। ফুটবল ম্যাচ দেখতে বা পুরস্কার হাতে তুলে দিতে তার ভালই লাগে, শুধু ওই বক্তৃতাটি ছাড়া।
অনিরুদ্ধকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখে নির্মল ঘোষ বললেন, ”আমাদের চণ্ডীপুরকে খুব ছোট ভেবো না, দুটো ফুটবল টিম শুধু আমাদেরই গ্রামে আছে, আগের বছর সুবোধ ব্যানার্জি, তার আগের বছর কল্যাণ সেন সবাই ওলিম্পিয়ান, তারও আগে কাল্টু ভট্টাচার্য, বিশু গুঁই—রা প্রধান অতিথি হয়ে গেছে। সভাপতি বরাবরই হয়েছে এস ডি ও বা এম এল এ। আজেবাজে লোককে আমরা ডায়াসে তুলি না।”
”বিশেষ প্রধান অতিথি মানে একজন অবিশেষ প্রধান অতিথিও আছেন, তিনি কে?”
”অশোক ভদ্র, সল্ট লেকে সাই—এর ফুটবল কোচ। আমাদের সি এ সি, মানে চণ্ডীপুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের নরেন বেরা নামে একটা ছেলে দারুণ খেলে, ওর খেলা অশোক ভদ্রকে দেখাবার জন্যই ওকে আনা হচ্ছে। পছন্দ হলে সাই—এর স্কুলে নরেনকে নিয়ে নিতে পারে, ওকে চেনো নাকি?”
”না, চিনি না; নির্মলদা, সি এ সি কি ফাইনালে খেলছে? অন্যদিকে কে?”
”সি এ সি—র অপোনেন্ট নারিকুল স্পোর্টিং। ওদের টিমে চারটে ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার আছে। জুনিয়ার বেঙ্গলে খেলেছে। অনিরুদ্ধ তা হলে অর্গানাইজারদের জানিয়ে দিই তুমি আসছ, কার্ডে নামটা ছাপাতে হবে তো। তোমাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে, পৌঁছেও দেবে।”
”নির্মলদা, একটা কথা, বক্তৃতা আমি দিতে পারি না, দেবও না।”
”ও ঠিক আছে, দু—চারটে কথা বললেই হবে। দুপুর একটায় গাড়ি যাবে, তিনটেয় খেলা আরম্ভ।”
অনিরুদ্ধ ঠিক করল, রবিবার অলু আর কুড়োনকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, খেলা দেখা হবে আর বেড়ানোও হবে। আসল গ্রাম দেখার সুযোগ তো ওদের হয় না, তা ছাড়া যাতায়াত মোটরে, স্বচ্ছন্দে যাবে আসবে। ওদের দু’জনকে সে বলে রাখল একটার সময় যেন রেডি হয়ে থাকে। কুড়োনের জামা—জুতোর সমস্যাটা মিটিয়ে দিল অমলা। অলুর হাওয়াই শার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট ফিট করে গেল, জুতোটা কপিল ঘোষের দেওয়া।
একটা—দশে পুরনো একটা অ্যাম্বাসাডার এল। ড্রাইভারের সঙ্গে একটা লোক।
”বাড়ি চিনে বার করতে অসুবিধে হয়নি তো?” মোটরে মিনিট পনেরো যাওয়ার পর অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।
এতক্ষণ চুপ করে থাকা লোকটি একগাল হেসে বিগলিত ভাবে বলল, ”একদম নয়। আপনার বাড়ির কাছের মোড়ে এক দোকানদারকে আপনার নাম বলতেই দেখিয়ে দিল বাড়িটা। আপনার মতো ফেমাস লোকের বাড়ি চিনে বার করা এ আর কী এমন শক্ত! আচ্ছা অনিরুদ্ধদা, আপনি এশিয়ান গেমসে খেলেছেন?”
”না।”
”ওলিম্পিকে খেলেছেন?”
মোটর তখন হাওড়া ব্রিজ দিয়ে গঙ্গা পার হচ্ছে।
”না।”
”তা হলে!” লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এমনভাবে, যেন অনিরুদ্ধ তাকে হাওড়া ব্রিজ থেকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে বলল। ”আপনি ইন্ডিয়া খেলেননি?”
”এশিয়ান গেমস, ওলিম্পিক ছাড়া ভারত কি আর কখনও কারুর সঙ্গে খেলেনি?”
”আচ্ছা অনিরুদ্ধদা, আপনি কি মোহনবাগানের সাপোর্টার?”
”না।”
”ইস্টবেঙ্গলের?”
”না।”
লোকটা এবার গঙ্গায় পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল।
”তা হলে কার সাপোর্টার?”
”ওই দুটো ক্লাবের সাপোর্টার হতেই হবে এমন কোনও কথা আছে কি?”
অনিরুদ্ধর ডান দিকে বসা কুড়োন তখন বলে উঠল, ”উনি স্বামী স্বরূপানন্দ স্কুলটিমের সাপোর্টার।”
”অ।” লোকটা কী বুঝল কে জানে! মাথা কাত করে পেছনে তাকিয়ে বলল, ”আচ্ছা, আপনার ফেভারিট প্লেয়ার কে?”
অনিরুদ্ধর বাঁ দিকে বসা অলু মুখ টিপে বলল, ”কুড়োন মণ্ডল, খুব ফেমাস প্লেয়ার।” একটু থেমে চাপা গলায় বলল, ”হবে।”
কুড়োন হাত বাড়িয়ে অলুর হাঁটুতে চিমটি কাটল।
রবিবার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। ওদের মোটর হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে জি টি রোড ধরে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেল চণ্ডীপুরে। নির্মল ঘোষ ওদের প্রথমে নিয়ে গেলেন নিজেদের পৈতৃক বাড়ির বৈঠকখানায়। ওঁরা এখানকার প্রাচীন ধনী পরিবার। ব্যবসা আছে কলকাতার পোস্তায়, ঢালাই লোহার কারখানা সালকিয়ায়। নির্মল ঘোষ থাকেন টালিগঞ্জে নিজের বাড়িতে।
সাই—এর কোচ অশোক ভদ্র তখনও এসে পৌঁছননি। ওরা অপেক্ষা করতে লাগল। অনুষ্ঠান—প্রধান এস ডি ও ঠিক পৌনে তিনটেয় হাজির হলেন, অবাঙালি তরুণ, বাংলা বলতে পারেন। অলু আর কুড়োন কিছুক্ষণ উসখুস করে গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে তখন জনাপাঁচেক বাইরের লোক। নির্মল ঘোষ সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, তখন ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক মধ্যবয়সী উদ্বিগ্ন মুখে তাঁকে বাইরে ডাকল। মিনিট তিনেক পর তিনি ফিরে এসে অনিরুদ্ধকে চাপা গলায় বললেন, ”একটা বিপদ হয়ে গেছে, নরেনের পা মচকে গেছে আজ সকালে। বেলপাতা পাড়তে গাছে উঠেছিল। পিঁপড়ে কামড়ায় হাতে, জ্বালা করে উঠতেই চুলকোতে গিয়ে ডাল থেকে হাত স্লিপ করে মাটিতে পড়ে যায়, ডান পায়ের গোছটা মচকায়। পাশের বাড়ির ফ্রিজ থেকে সঙ্গে সঙ্গে বরফ এনে লাগায় কিন্তু ফুলে উঠেছে, অল্প অল্প যন্ত্রণাও রয়ে গেছে। কী যে এখন করা যায়! ছেলেটা বলছে বটে, ও কিছু নয় আমি ঠিক খেলে দেব। কী মুশকিলে পড়া গেল বলো তো?”
নির্মল ঘোষ অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলেন অনিরুদ্ধর মুখের দিকে, তাঁর চোখে পরামর্শ পাওয়ার জন্য আবেদন। অনিরুদ্ধ বলল, ”খেলাবেন না নির্মলদা, একদম খেলাবেন না। ও খেলতে তো পারবেই না, তার থেকেও মারাত্মক, এই চোট ওর অনেক ক্ষতি করে দেবে।”
”কিন্তু নরেন নিজে খেলতে চায়। ও জানে অশোক ভদ্র আজ ওর খেলা দেখবে। তা ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই যাকে নরেনের জায়গায় নামানো যায়,” কথাগুলো নির্মল ঘোষ বিপন্ন মুখে বললেন। ”খেলা শুরুর তো সময় হয়ে গেল, চলো এবার মাঠে যাওয়া যাক, আসুন সার।” এস ডি ও—কে নিয়ে তিনি রওনা হলেন, বাড়ি থেকে মাঠ হেঁটে চার মিনিট। মাঠে ওরা সবে পৌঁছেছে তখনই আর একটা অ্যাম্বাসাডার এসে থামল, নামল অশোক ভদ্র। অনিরুদ্ধকে দেখে সে বলল, ”চিনতে পারো?”
অনিরুদ্ধ মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। চিনতে পারছে না বুঝে অশোক বলল, ”রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে ষোলো বছর আগে শিল্ডের ফার্স্ট রাউন্ডে লাল কার্ড দেখেছিলে আমার মুখে ঘুসি মেরে।” বলেই হো হো করে হেসে উঠল সে।
অনিরুদ্ধর মুখে রক্ত ছুটে এল। ঢোক গিলল। তখন সবে নাম করেছে, বড় ক্লাবে অফার আসছে, খেলার মধ্যে কিছু কিছু অভব্যতা করেছে ছোট টিমের সঙ্গে। এবার মনে পড়ল ম্যাচটা ছিল এরিয়ানের সঙ্গে বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টের, সে তখন ছিল এরিয়ানে।
”তোমার এখনও মনে আছে?”
”থাকাই তো উচিত। বড় গোলকিপারের ঘুসি, সেটা কি ভোলা যায়?”
দু’জনে খুব একচোট হেসে এগিয়ে গেল টেবলপাতা মঞ্চের দিকে। মঞ্চের দু’ধারে গণ্যমান্যদের জন্য চেয়ার। অন্য একটা টেবলে ঢাউস একটা শিল্ড, রানার্সের জন্য বড় একটা কাপ, বেস্ট প্লেয়ারের কাপ আর বাইশজন খেলোয়াড়, রেফারি, লাইন্সম্যানদের জন্য তোয়ালে, ওয়াটারবটল, ছোট কিটব্যাগ।প্রাইজের জিনিসগুলো দেখে অনিরুদ্ধ মনে মনে বলল : ”কিছুই বদলায়নি, এইসব জিনিস আমিও পেতাম টুর্নামেন্ট খেলে। এর থেকে বরং প্রত্যেককে ফুটবল আইনের বই একটা করে দিলে ভাল হত। বেশিরভাগ ছেলেই তো আইন না জেনে খেলে।
অনিরুদ্ধর মনে পড়ে গেল একতা সঙ্ঘের মাঠে টিভি শুটিংয়ের জন্য সাজানো ম্যাচটার কথা। প্রায় একই রকম লাগছে। সেই কাপ—শিল্ড, বেস্ট প্লেয়ারের কাপ, প্রাইজ, তোয়ালে, সেই প্রাইজ দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট, চিফ গেস্ট, মাঠ ঘিরে উপচে পড়া ভিড় আর মাইকে ঘোষণা। মাঠের মাঝে সার দিয়ে থাকা দুটো টিমের সঙ্গে পরিচয় আর হ্যান্ডশেক করা। তফাত শুধু সেটা ছিল নকল আর এটা আসল। মাঠ থেকে ফিরে এসে ডায়াসে ওঠার সময় দেখতে পেল সামনেই দুটো স্টিলের চেয়ারে অলু আর কুড়োন পাশাপাশি বসে।
মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় তারা নিজেদের নাম বলছিল। একটি ছেলে হ্যান্ডশেক করে বলল, ”নরেন বেরা।” শুনেই ভ্রূ কুঁচকে অনিরুদ্ধ তার ডান পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। যদি নিজে মনে করে খেলতে পারবে তা হলে খেলুক। নারিকেল স্পোর্টিং নাকি চারজন ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার খেলাচ্ছে! তাদের ট্যাকলিং নরেনকে সামলাতে হবে।
.
খেলা শুরুর তিন মিনিটের মধ্যে নরেন গোল দিল বাঁপায়ের দুর্দান্ত একটা নিচু শটে। নরেনকে পেনাল্টি এলাকার মাথায় রেখে সি এ সি শুরু করে। দু’মিনিটেই নারিকুল প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে সবাই এগিয়ে যায় দু’জনকে ডিফেন্সে রেখে। একটা বল এই সময় ছিটকে আসে নরেনের কাছে। বল নিয়ে গোলের দিকে এগোতে গিয়ে দেখল দু’জন ডিফেন্ডার তার সামনে ও পাশ থেকে ছুটে আসছে। নরেন দেরি না করে পনেরো গজ দূর থেকেই ডান বারপোস্ট ঘেঁষে শট নেয়। ঝাঁপানো গোলকিপারের আঙুলে ছুঁয়ে পোস্টে লেগে বল গোলে ঢোকে।
”খুব প্রম্পট শটটা নিয়েছে, দেরি করলে বলটা পায়ে রাখতে পারত না। ব্রেন কুইক কাজ করেছে।” অশোক ভদ্র ঈষৎ উত্তেজিত স্বরে এস ডি ও—কে নরেনের কৃতিত্বটা ব্যাখ্যা করে দিল। অনিরুদ্ধর ভাল লেগেছে গোল করার ধরনটা।
নারিকুল এবার হঁশিয়ার হয়ে গেল, বিশেষ করে নরেনের পেনাল্টি এলাকায় উঠে থাকাটায় তারা নজর রাখল। বল ধরার জন্য সে একটু দৌড়লেই নারিকুলের স্টপার তেড়ে যাচ্ছে বা বল ধরলেই তাকে কেউ না কেউ ট্যাকল করছে। অনিরুদ্ধ একবার দেখল নরেনকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতেও। উঠে দাঁড়িয়ে সে দু’পা খুঁড়িয়ে হাঁটল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল।
দশ মিনিটের সময় নারিকুল গোলটা শোধ করে দিল। গোলের সামনে এলোমেলো শট হচিছল, একজনের পায়ে লেগে বল আচমকা গোলে ঢুকে গেল। এরপর দ্বিগুণ উৎসাহে নারিকুল কোণঠাসা করে রাখল সি এ সি—কে। খেলার ধরন আর চালচলন দেখে অনিরুদ্ধ আন্দাজ করেছিল কোন চারজন কলকাতা থেকে এসেছে। সেন্টার স্টপার, গোলকিপার, সেন্ট্রাল স্ট্রাইকার আর একজন মিডফিল্ডারকে সে চিহ্নিত করে ফেলল।
হাফটাইমের পাঁচমিনিট আগে কে একজন কোনাকুনি থ্রু বাড়াল ডান দিকের ফাঁকা জায়গায়। নরেনকে প্রায় পনেরো গজ দৌড়ে বলটা ধরতে হবে। ধরে বল নিয়ে আধা—ঘুরলেই সামনে পড়বে লেফট ব্যাক, তার পেছনে গোলকিপার অথবা বল ধরে গোল লাইনের কাছে ব্যাকটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ব্যাক সেন্টার করতে পারে। অনিরুদ্ধ চেয়ারে সিধে হয়ে বসল, এবার নরেনের আসল পরীক্ষা।
থ্রু—টা ধরার জন্য নরেন ঝটকা দিয়ে ছোটা শুরু করল, পাশাপাশি তার সঙ্গে কয়েক গজ ছুটেই লেফটব্যাক পা বাড়িয়ে দিল বলটা সরিয়ে দিতে। ট্যাকলটা পরিচ্ছন্ন ও বিধিসম্মতভাবে হলেও নরেন পায়ে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে মাঠে পড়ে গেল। চিত হয়ে সে এ—পাশ ও—পাশ করে দু’বার গড়াগড়ি দিয়েই ডান পায়ের গোছ চেপে ধরে উঠে বসল। ঘটনাটা পেনাল্টি এলাকার মধ্যে ঘটেছে, কলকাতার রেফারি বাঁশি বাজিয়ে পেনাল্টি স্পটের দিকে আঙুল দেখালেন। মাঠ ঘিরে তুমুল উল্লাস।
অনিরুদ্ধ তাকাল অশোক ভদ্র—র দিকে। সে মাথা নেড়ে বলল, ”ভুল দিল।”
”ভুল কেন?” এস ডি ও ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন অশোক ভদ্রের দিকে, ”মেরে ফেলে দিল এ তো পরিষ্কার পেনাল্টি।”
অনিরুদ্ধ মহকুমা শাসককে বোঝাবার চেষ্টা করে শুধু বলল, ‘ছেলেটা আর মাঠে থাকতে পারবে না।”
পেনাল্টি শটটা নিল নরেনই, অবশ্যই বাঁ পায়ে। বাঁ—দিকের পোস্ট ঘেঁষে নিচু শট। গোলকিপার যেন জানতই, ঝাঁপিয়ে গোললাইনের বাইরে ঠেলে দিল।
”নন—কিকিং ফুটে জোর নেই। উচিত হয়নি শটটা নেওয়া।” অনিরুদ্ধ জানাল অশোক ভদ্রকে।
”ইনজুরিটা কি আগেই ছিল?”
অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল।
লজ্জায় মাথা নামিয়ে নরেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে সাইড লাইনের দিকে চলে গেল। সি এ সি বস্তুত দশ জনে খেলে হাফটাইম পর্যন্ত কয়েকটা মিনিট আটকে রাখল নারিকুলকে।
হাফটাইম হতেই অনিরুদ্ধ ডায়াস থেকে নেমে গিয়ে নির্মল ঘোষের সঙ্গে দেখা করল। অভিযোগের সুরে সে বলল, ”আমি বারণ করেছিলুম ওকে খেলাতে। দেখলেন তো এখন ও মাঠে দাঁড়াতে পারছে না। সাবস্টিটিউট নামান।”
নির্মল ঘোষ পাংশু মুখে বললেন, ”নরেনের জায়গায় নামাবার মতো কোনও ছেলে তো আমাদের নেই। দেখি আমাদের সেক্রেটারি প্রবোধের সঙ্গে কথা বলে।”
খেলোয়াড়রা মাঠের ধারে কেউ বসে কেউ শুয়ে। নির্মল ঘোষ সেই দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধ দেখল তিনি ধুতি শার্ট পরা এক মাঝবয়সীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। বোধহয় ইনিই প্রবোধ। মাথা নেড়ে প্রবোধ কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। অনিরুদ্ধ এগিয়ে গেল।
”আপনাদের কোনও সাবস্টিটিউট প্লেয়ার নেই?” অনিরুদ্ধ যতটা সম্ভব শোভনতা বজায় রেখে ধমকে উঠল।
প্রবোধ বলল, ”আছে গোলকিপার। একজন ফরওয়ার্ড ছিল, মামার বিয়েতে বরযাত্রী গেছে, সকালে ফেরার কথা ছিল, এখনও ফেরেনি। আর একজন রাগ করে মাঠেই আসেনি। তাকে বলেছিলুম পুরো ম্যাচ খেলাতে পারব না, তার প্রেস্টিজে লেগেছে।”
”তা হলে তো আপনাদের দশ জনে খেলতে হবে। খেলা দেখে মনে হচ্ছে আরও গোটা দুই গোল খাবেন।”
”ভাগ্যে থাকলে খাব, কী আর করা যাবে!” প্রবোধ আকাশের দিকে তাকাল।
”একটা কাজ করুন, আমি একটা ছেলে দিচ্ছি তাকে নামান। এমনিই তো দশজন হয়ে গেছেন, একটা প্লেয়ার মাঠে থাকলে লাভ বই ক্ষতি তো হবে না!” অনিরুদ্ধ মরিয়া হয়ে ফাটকা খেলার মতো বলল।
নির্মল ঘোষ অবাক হয়ে বলল, ”কে ছেলে? কোথায়?”
অনিরুদ্ধ পেছন ফিরে দেখল অলুর কোনও কথায় বোধ হয় কুড়োন হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে গেল।
”ওই ছেলেটা। বুট, প্যান্ট লাগবে না শুধু একটা জার্সি দিন।” বলেই কুড়োনের দিকে এগিয়ে গেল।
অনিরুদ্ধকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে কুড়োন অভিমানী গলায় বলল, ”মামা, সকলরে সফট ড্রিঙ্কস দেছে আমাদের দেয় নাই।”
”কুড়োন।” অনিরুদ্ধ কঠিন গম্ভীর স্বরে বলল, ”আমি যা বলব এখন একটিও কথা না বলে তুই তাই করবি। জামা খোল। এরা যে জার্সি দিচ্ছে সেটা পর, পরে মাঠে নাম।”
কুড়োন হকচকিয়ে তাকিয়ে রইল।
অনিরুদ্ধ মৃদু স্বরে প্রবোধকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি জার্সিটা এনে দিন।”
”মামা, আমারে এখন খেলতে বলছেন?”
”বলছি।”
”কী জইন্য?”
”তোর ওপর আমার বিশ্বাসের সম্মান রাখার জন্য। তুই ইচ্ছে করলে ম্যাচটা বার করে আনতে পারবি, এই আমার বিশ্বাস। পারবি?”
”মামা, এমন কথা কেউ আমারে কোনওদিন কয় নাই।”
কুড়োনের গলা ভারী হয়ে এল, চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল, চোখে বিহ্বল চাহনি।
”পারবি?”
”চেষ্টা করব।”
অনিরুদ্ধ প্রায় ছুটে ডায়াসে চেয়ারে এসে বসল। অশোক ভদ্র জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকাল। ”নরেনকে কি ওরা বসাচ্ছে?”
”হ্যাঁ। বসাতে বলে এলুম।”
”কাকে নামাবে?”
”কেউ একজন হবে।” অনিরুদ্ধ গা—ছাড়া উত্তর দিল। দু’দলের খেলোয়াড়রা তখন মাঠে নেমে পড়েছে, দর্শকরা সবই স্থানীয়, তারা দেখল নরেনের বদলে অচেনা একটা কিশোরকে। গুঞ্জন উঠল: ‘এ আবার কে!’ ফল তখন এক—এক।
কিক—অফের সঙ্গে সঙ্গে নারিকুল বল পাঠাল চণ্ডীপুরের ডান কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে। রাইট আউট আগেই দৌড় শুরু করেছিল, বলটা ধরে সে লেফট ব্যাককে কাটিয়েই গোলমুখে উঁচু করে পাঠাল। দ্বিধাগ্রস্ত গোলকিপার কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করে বেরোবার আগেই নারিকুলের স্ট্রাইকারের হেড গোলে ঢুকে গেল। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গোল। তাজ্জব, মাঠে টুঁ শব্দটি নেই। নারিকুল এক গোলে এগিয়ে গিয়ে মাঝমাঠটা দখল করে নিল।
সি এ সি গোলটার ধাক্কা সামলাতে না পেরে এলোমেলো খেলছে। কুড়োন সামনে উঠেছিল। এতক্ষণ একটা বলও পায়নি। এবার সে নেমে এসে পায়ে বল রেখে নিজের টিমকে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করতে লাগল।
”এই ছেলেটাকে শুরু থেকে খেলায়নি কেন!” অশোক ভদ্র মন্তব্য করল। ঝুঁকে ডায়াসের পাশে দাঁড়ানো একজনকে জিজ্ঞেস করল, ”ছেলেটা কে?”
বিব্রত মুখে লোকটি বলল, ”বলতে পারব না। এখানকার কেউ নয়।” বলেই সে পাশের লোককে জিজ্ঞেস করল, ”চেনেন নাকি?” সেই লোকটিও মাথা নাড়ল।
অনিরুদ্ধ একমনে কুড়োনকে দেখে যাচ্ছিল। বল চেয়েও বল পাচ্ছে না, বল দিয়ে বল ফেরত পাচ্ছে না। মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। অবশেষে মাঝমাঠে একটা বল পেয়ে সে সামনে অনেকটা খোলা জমি দেখে বলটা ঠেলে দিয়েই ছুটতে শুরু করল। দু’দিক থেকে দুজন ছুটে এল ওকে বাধা দিতে। একজন বলের দিকে বেপরোয়া পা চালাল পাশ থেকে, কুড়োন টুক করে বলটা সরিয়ে নিয়েই ছুটল, সামনে এসে গেল দ্বিতীয় জন। ছোটার গতি একই রকম রেখে শরীরটা একটু পাশ ফিরিয়ে দ্বিতীয়জনের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়ে তাকে পেছনে ফেলে দিল।
অনিরুদ্ধ সামনে ঝুঁকে টেবল ক্লথ আঁকড়ে ধরে বলে উঠল, ”এবার গোল হবে।”
অশোক ভদ্র আর এস.ডি.ও. তার মুখের দিকে তাকাল।
কুড়োনের সামনে এখন স্টপার। ট্যাকলিংয়ে না গিয়ে স্টপার পিছিয়ে যাচ্ছে, কুড়োনকে কাছে আসতে দিচ্ছে, মোক্ষম সময়ে চূড়ান্তভাবে বাধা দেবে। কুড়োন তার চার হাতের মধ্যে এল, প্রায় মুখোমুখি হয়ে সে শরীরটাকে ডাইনে বাঁয়ে দ্রুত নাড়িয়েই স্টপারের দু’ পায়ের ফাঁক দিয়ে বলটা গলিয়ে দিল।
”আশ্চর্য তো!” এস.ডি.ও.—র মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল কথাটা।
”অবিশ্বাস্য, একদৌড়ে তিনজনকে!” অশোক ভদ্র স্তম্ভিত।
স্টপার ঘুরে গিয়ে কুড়োনকে যখন তাড়া করল তখন সে পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া গোলকিপারের পাশ দিয়ে বলটাকে গোলে ঠেলে দিয়েছে।
সারা মাঠের দর্শকরা হতভম্ব চোখে কুড়োনের কাণ্ড দেখছিল। গোলটা হতেই কয়েকটি ছেলে পাগলের মতো মাঠের মধ্যে ছুটে এসে কুড়োনকে জড়িয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করল।
”গোল হবে তুমি জানলে কী করে?” অশোক ভদ্র কৌতূহল মেটাতে জানতে চাইল।
অনিরুদ্ধ ঠোঁট টিপে রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ”জ্যোতিষবিদ্যা।”
”তা হলে বলো ম্যাচের রেজাল্ট কী হবে?”
”চণ্ডীপুর জিতবে। ওই কুড়োনই জেতাবে।”
”কুড়োন!” অশোক ভদ্র তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধর মুখের দিকে।
”নামটা জানো, তার মানে ওকে চেনো।”
”চিনি।”
খেলা আবার শুরু হয়ে গেছে। ম্যাচের ফল দুই—দুই। মাঠ ঘিরে ঝোড়ো আওয়াজ ওঠে, যখনই কুড়োন বল ছোঁয়। তাকেই শুধু বল দিতে চায় দলের খেলোয়াড়রা। আর নারিকুলিরা সযত্নে চেষ্টা করে যায় বল নিয়ে সে যেন এক পা—ও না এগোতে পারে। নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য কুড়োন অবিরত ঘোরাফেরা করে চলেছে। কিন্তু ছিনে জোঁকের মতো একজন তার সঙ্গে সর্বদা লেগে রয়েছে। চণ্ডীপুরিরা এখন ভীষণ উদ্দীপ্ত হয়ে বাধা দিয়ে চলেছে অবশ্য গোল করার ইচ্ছাটা জাগিয়ে রেখে।
অশোক ভদ্র ঘড়ি দেখে বলল, ”আর চার মিনিট বাকি, মনে হচ্ছে ড্র হবে। তোমার জ্যেতিষবিদ্যা এবার আর কাজ দিল না।”
অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল। ঠিক তখনই একটা বল ধরার জন্য কুড়োন ছুটল। তার সঙ্গে লেগে থাকা খেলোয়াড়টি ওর সঙ্গে ছুটতে গিয়ে যখন বুঝল ওকে আর ধরা যাবে না তখন নিরুপায় হয়ে ট্রিপ করে ফেলে দিল পেনাল্টি এলাকার দু’গজ বাইরে।
অবধারিত ফ্রি—কিক দিলেন রেফারি। অনিরুদ্ধ নড়েচড়ে বসে মনে মনে ভগবানকে ডাকল—কুড়োন যেন ফ্রিকিকটা মারে। ভগবান বোধ হয় প্রার্থনাটা শুনলেন এবং মঞ্জুর করলেন। বসানো বলটা থেকে দশ হাত দূরে চারজন নারিকুলি পাঁচিল দিয়ে দাঁড়াল। চণ্ডীপুরের লেফটব্যাক এসেছে শট নিতে। কুড়োন হাত নেড়ে তাকে সরিয়ে কী যেন বলতে সে চারজনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে পঞ্চমজন হয়ে দাঁড়াল। গোলকিপার ক্রসবারের এধার—ওধার সরে—সরে বলটাকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে আর চেঁচিয়ে পাঁচিলটাকে সাজিয়ে নিচ্ছে।
”মনে আছে কি ওয়ার্ল্ড কাপে ব্র্যাঙ্কোর ফ্রিকিকটা, যাতে ব্রাজিল হারিয়েছিল হল্যান্ডকে?” অনিরুদ্ধ ধীরভাবে বলল। ”এবার পেরাকটিস করা সেই কিকটা দেখবে।”
”হুমম।” অশোক ভদ্র মাঠ থেকে চোখ সরাল না। কুড়োন কিক নিতে যাচ্ছে।
পাঁচ সেকেন্ড পর বলটা উড়ল। পাঁচিলের পঞ্চমজন হঠাৎ বসে পড়ায় যে ফাঁকা জায়গাটা তৈরি হল সেখান দিয়ে উড়ে গিয়ে বলটা অপ্রত্যাশিত বাতাসে বাঁক নিয়ে গোলকিপারের অবাক চোখের সামনে দিয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে গেল, গোলের পেছনের জাল বলটাকে ধরবে বলে যেন অপেক্ষা করছিল। অনিরুদ্ধ মাথা নামিয়ে কপালটা টেবলে দু—তিনবার ঠুকল।
এস.ডি.ও হাতঘড়িটা খুলে টেবলে রেখে বললেন, ”এটা আজ ওকে আমি দেব।”
নির্মল ঘোষ পড়িমরি সিঁড়ি ভেঙে ডায়াসে উঠে অনিরুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলে যেতে লাগলেন, ”তোমার জন্য আমরা জিতব, তুমিই ওকে নামাতে বলেছিলে।”
অশোক ভদ্র শুধু তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধর মুখের দিকে।
মাঠের মধ্য থেকে উন্মত্ত দর্শকদের বার করে দেওয়ার দু’মিনিট পরই রেফারি খেলা—শেষের বাঁশি বাজালেন। এর পর জনতা মাঠে নামল, অনিরুদ্ধ আর কুড়োনকে দেখতে পেল না।
”ছেলেটা এখানে এল কী করে?” অশোক ভদ্র প্রশ্ন করল।
অনিরুদ্ধ বলল, ”আমার সঙ্গে এসেছে। আমাদের ওখানেই থাকে।”
”ওর বাড়িতে কে কে আছে?”
”কেউ নেই, ও একা।”
”তার মানে!”
”বাবা—মা মরে গেছে, ছিল এক দাদামশাই, সেও মরে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই কুড়োন একা। ওর অবলম্বন, আশ্রয় যাই বলো সেটা হল ফুটবল।”
”ভালই হল, ওকে আমি সাই—তে নেব।”
.
মোটরে কলকাতা ফেরার সময় অনিরুদ্ধ চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল মিনিট দশেক। অলু আর কুড়োন নাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছে, কখনও হাসতে হাসতে ওরা নুয়ে পড়ছে। ওদের কোনও কথা তার মাথায় ঢুকছে না। শুধু তার কানে বাজছে অশোক ভদ্রর কথাটা : ”ওকে আমি সাই—তে নেব।” একটা হিরে সে প্রায় কুড়িয়েই পেয়েছিল, অনুজ্জ্বল সাধারণ একটা কাচের ঢেলার মতো, সেটাকে সে যথাসাধ্য পরিষ্কার করে সবে কাটতে শুরু করেছে আর তাইতেই যে আলো ঠিকরে বেরিয়েছে, জহুরি তার বাহার দেখতে পেয়েছে। আরও কেটেকুটে পালিশ করে নিলে ভবিষ্যতে সেই আলো ঝকঝক করে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। এই হিরেটাকে সে কি হাতছাড়া করবে? পৃথিবীতে কত বড় বড় ফুটবলার এসেছে, তাদের প্রথম আবিষ্কারকের নাম কে মনে রেখেছে? কুড়োন মণ্ডল ভারতবিখ্যাত হওয়ার পর সবাই বলবে ও সাই—এর আবিষ্কার। কেউ জানবে না ওকে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সে কীভাবে চেষ্টা করেছে। কাঁটা বেঁধার মতো একটা খচখচানি সে বুকে অনুভব করল।
”আচ্ছা মামা, এই ঘড়িটার দাম কত?”
কুড়োন হাতের মুঠোয় এস.ডি.ও—র দেওয়া ঘড়িটা ধরে রয়েছে।
তুমুল হাততালির মধ্যে ওর হাতে পরিয়ে দিতেই ঘড়িটা কব্জি থেকে নেমে পড়ে যাচ্ছিল, কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল অলু, ঘড়িটা তার হাতে দেয় রাখার জন্য।
”অলু কয় দুই—তিন হাজার টাকা, সত্যি?”
”হতে পারে।” অনিরুদ্ধ আবার বাইরে তাকাল।
”এত দামি ঘড়ি নিয়া আমি কী করব। এটা আপনি নেন।”
অনিরুদ্ধ জবাব দিল না। একটু পরে তার হাতে কঠিন একটা ছোঁয়া পেতেই মুখ ঘুরিয়ে দেখল কুড়োন ঘড়িটা তার হাতে ঠেকিয়ে রয়েছে।
”আমি নেব কেন, তুই খেলে পেয়েছিস, এটা তোর জিনিস।”
”না, এটা আপনার। আপনিই তো শট মারা শিখাইছেন, নয়তো গোলটা দিতা পারতাম কি? আমি তো শুধু পেরাকটিস করা গেছি।”
”আচ্ছা কুড়োন,” অনিরুদ্ধর মুখে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল, ”আচ্ছা কুড়োন, দশ বছর পর তোর এসব কথা মনে থাকবে? কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি তো আমি তোকে শট মারা শিখিয়েছি!”
কুড়োনের ঠোঁটে দেখা দিল ক্ষীণ একটা হাসি, চোখে হালকা অভিমান, ”কী যে কন। দশ বছর কেন, মরণকাল পর্যন্ত বলব কুড়োনরে খেলা শিখাইছে তার মামা।”
”তা হলে দে।” অনিরুদ্ধ কুড়োনের হাত থেকে ঘড়িটা তুলে নিল। ”মামা গুরুজন তার কথা অমান্য করতে নেই।” কুড়োনের শীর্ণ হাতটা টেনে নিয়ে সে ঘড়িটা ওর হাত গলিয়ে ব্যান্ডটা এঁটে দিল। ”তোর মামা এটা তোকে দিল, এটা রেখে দিলে জানব আমাকে তুই মনে করে রাখবি।”
অনিরুদ্ধ এর পর অবাক হয়ে দেখল কুড়োনের চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। আশ্চর্য, কুড়োন কাঁদতেও পারে! তার মনে পড়ল অনেকদিন আগে সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কখনও কেঁদেছিস? জবাব দিয়েছিল, কেঁদেছি বলে তো মনে পড়ে না। বাবা, মা, দাদু, মারা যেতেও কাঁদেনি, বয়স এত কম ছিল যে মরা কী জিনিস তাই বোঝেনি। বলেছিল ‘কান্না আসবে কী করে?’ তখন সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এখন বুঝিস?’ তাইতে কুড়োন উত্তর দেয়, ‘না। এখন তো কেউ মরে নাই, মরলে বুঝতে পারব।’
অনিরুদ্ধ চমকে উঠল, কে এখন মরল যে কুড়োনের চোখে জল এল? ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে—থাকতে তার মনে হল কুড়োন বড় হয়ে উঠছে, ওর অতীত মরে যাচ্ছে, অনিশ্চিত ভাবটা আর মুখে নেই, তার বদলে ফুটে উঠেছে প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস। কুড়োনকে এবার বাইরের জগতে ঠেলে দেওয়ার সময় এসেছে।
হাওড়া ময়দানের পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। অলুর হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে কুড়োন বলল, ”আমার কাছে রাখার জায়গা নাই, এখন এটা তোর কাছে থাক। মাসিমারে দিস, তুলে রাখবে।”
অনিরুদ্ধ বলল, ”অশোকের সঙ্গে কথা হয়েছে, পরশু সকালে তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব, তৈরি থাকিস।”