নারান

নারান – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।। ১ ।।

চোখের জলের ঝাপটা দিতে দিতেই নারান সিঁড়ির মাথায় দেয়াল ঘড়িটার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

ইসস চারটে বেজে গেছে!

চার লাফে বারোটা সিঁড়ি টপকে উঠে সে হলঘরে এল। ইতস্তত ছড়িয়ে—থাকা টেবিলগুলোয় এক একজন ঘুমোচ্ছে। কেউ লুঙ্গি, কেউ পাজামা, কেউ ধুতি পরে। টেবিলের কাগজপত্র, লেখার প্যাড, দোয়াত—কলম, টেলিপ্রিন্টারের কপিগাঁথা স্পাইক সবই চেয়ারের উপর নামিয়ে রাখা। পাখার হাওয়ায় টেলিপ্রিন্টার রোল থেকে মেঝেয় লতিয়ে নেমে আসা কাগজ উড়ছে। নারান কাগজ ডিঙিয়ে হলঘরের কোণের দিকে গেল। ওখানে কাঠের আলমারির মাথায় তার টিফিন ক্যারিয়ার রাখা থলিটা রয়েছে।

টেবিলে টোলুবাবু বাঁ কাত হয়ে ঘুমোচ্ছেন। এই সপ্তাহে রাতে স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে ওঁরই ডিউটি। রাত দুটোয় এক তলার প্রেস থেকে স্পোর্টস পাতা সাজিয়ে দিয়ে উঠে এসে শুয়েছেন। প্রতি রাতে শোবার আগে টোলুবাবু এক গ্লাস জল আর একটি ওষুধের বড়ি খান। নারান জলভরা গ্লাস তৈরি রাখে। সেটা হাতে নিয়ে মুখে তোলার আগে প্রতি রাতের মতো আজও আক্ষেপ করেছেন, ”কত ভাল ভাল খবর যে ধরানো গেল না।

”কেন, ধরাবার মতো জায়গা কি পাতায়….?”

”আরে না। ওলিম্পিক হচ্ছে হেলসিঙ্কিতে, ইউরোপের একটা দেশে। ওখানকার সঙ্গে কলকাতার সময়ের কত তফাত হয় জানিস?”

”অনাদিবাবু সেদিন বললেন পাঁচঘণ্টারও বেশি।”

”তবেই বোঝ। ইভেন্টগুলো শেষ হবে, রিপোর্ট লিখবে, তারপর পাঠাবে। কলকাতায় সেটা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত বারোটা—একটা। কপিগুলো তর্জমা করবে কে? এগারোটা বাজলেই তো সবাই ট্রাম ধরতে ছুটবে। তারপর অ্যাত অ্যাত কপি আমি…।”

এক চুমুকে গ্লাস খালি করে টোলুবাবু শুয়ে পড়েন। হেলসিঙ্কিটা যে পৃথিবীর কোন দিকে, কোন জায়গায় নারান তা জানে না। তার ধারণা টোলুবাবুও জানেন না। কিন্তু সিনিয়ার সাব—এডিটারকে আভাসে—ইঙ্গিতেও একজন বেয়ারার পক্ষে সেটা জানানো যায় না!

নারান ঘুমন্ত টোলুবাবুর পাশ দিয়ে আলমারির কাছে গেল। হাত তুলে আলমারির মাথা থেকে থলিটা নামাবার সময়, সজোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো ”হ—অ—অ—অ” একটা শব্দ শুনল। মুখ ঘুরিয়ে দেখল টোলুবাবু পিট পিট করে তাকে দেখছেন।

”নারান, তোদের ধান্যকুড়িয়ায় চালতা হয়?”

”ঠিক জানি না। নিশ্চয় কারও বাড়িতে গাছ আছে। কেন, আপনার দরকার?”

”না—হ—হ। ধানের সঙ্গে চালের সম্পর্কটা খুব কাছাকাছি তো তাই ভাবলুম…”

”আপনি ভাবছিলেন! এতক্ষণ তা হলে ঘুমোননি?”

”এল না। মনটা খচখচ করছে। যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে খেলা…কী যে হবে। তোর কি মনে হয় বল তো?”

নারান এক—পা পিছিয়ে মাথা কাত করে ঘড়ি দেখল। চারটে—দশ! বনগাঁ লোকাল শেয়ালদা থেকে ছাড়বে চারটে—চল্লিশে। স্টেশনে কাগজ নিয়ে যাওয়ার ভ্যানটা অফিস গেট থেকে রওনা হওয়ার সময় হয়ে গেছে।

”আমার কিছু মনে হয় না। আমি এখন চলি, নইলে ভ্যানটা পাব না।”

”আরে দাঁড়া দাঁড়া। সারা রাত আমার ঘুম হল না এই চিন্তায়…প্রথম খেলায় তো ওয়ান নিলে তোরা হারিয়েছিলি, এবারও কি তাই করবি?” টোলুবাবু উঠে বসলেন।

নারান বিভ্রান্ত। অবাক হয়ে বলল, ”আজ্ঞে, ওলিম্পিকে তো আমার ইয়ে…আমাদের তো কোনও দল নেই!”

”ওলিম্পিক নিয়ে ভাবার জন্য আমার জেগে থাকার কোনও কারণ থাকতে পারে কি? সারা ভারতের লোক জানে, তুই জানিস হকিতে একটা গোল্ড আমরা পাব। আর কিছু নিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ আছে কি?”

”আপনি ফুটবল টিমের জন্য ভাবছিলেন না? এই যে বললেন যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে…”

”রাখ যুগোশ্লাভিয়া। সুইডেনের এক ক্লাব—টিমের কাছে স্টকহোমে দুই—তিনে, ডেনমার্কের এক ক্লাব—টিমের কাছে কোপেনহেগেন দুই—পাঁচে, হেলসিঙ্কিতে আমেরিকার ওলিম্পিক টিমের কাছে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে এক—তিনে হেরেছে। ভাব একবার, শেষে কি না আমেরিকার কাছে, যারা ফুটবল কী বস্তু জানে না!”

”টোলুবাবু কাগজের ভ্যান ছেড়ে দিলে আমার…”

”তোর কী আবার? ভ্যান চলে গেলে পা তো আছে! আমার ঘুম যে জন্য এল না…হ্যাঁ রে নারান…তোদের এখন সতেরোটা খেলে সাতাশ, আমাদের ষোলোটা খেলে বাইশ। লিগ, ধর পেয়েই গেছিস। এখন তো তোরা একটা ম্যাচ হেরেও যেতে পারিস, কী রে পারিস না?”

এতক্ষণে নারান বুঝতে পারল টোলুবাবুর ঘুম হচ্ছে না কেন। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে মোহনবাগানের রিটার্ন লিগ খেলাটা আর সাত দিন পরেই। আজই মোহনবাগান দ্বিতীয়বার এবছর জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে ড্র করে পয়েন্ট হারিয়েছে। টোলুবাবুর ঘুম ছুটে যাবারই তো কথা।

নারান হালদার যশোরের লোক। আট বছর বয়সে স্কুল মাঠে ফুটবলে পা ছোঁয়াবার দিন থেকেই সে ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। খবরের কাগজ অফিসে তাকে চাকরি করতে হচ্ছে খেলার বিভাগে। মাত্র ছ’মাস হল সে এই বিভাগের বেয়ারার কাজ পেয়েছে। প্রথম দুদিনেই সে বুঝে গিয়েছিল বিভাগের হর্তাকর্তারা প্রায় সবাই মোহনবাগান সাপোর্টার। ওঁর যদি জানতে পারেন সে ইস্টবেঙ্গল ভক্ত তা হলে হয়তো অন্য কোনও ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিতে পারেন। এটা ধরে নিয়েই সে মুখে চাবি দিয়ে কাজ করে। রিপোর্টার, সাব এডিটররা খেলা নিয়ে যখন তর্ক বা আলোচনা করেন সে মন দিয়ে শুধু শোনে। শুনতে তার ভাল লাগে। অনেক কিছু শিখতে, বুঝতে, জানতে পারে খেলা সম্পর্কে। খেলাকে সে ভালবাসে এবং এই বিভাগটিকেও।

”হ্যাঁ রে নারান, কী মনে হচ্ছে তোর?”

”কী আবার মনে হবে, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন তো। এখনও ইস্টবেঙ্গলের অনেক খেলা বাকি, দু’চারটে হেরেও তো যেতে পারে। ….ভেঙ্কটেশ, আমেদ, সালে, চন্দন সিং নেই—”

”সে তো আমাদেরও মান্না, সাত্তার, রুনু নেই। তোদের আপ্পারাও, ধনরাজ, রমন আর ওই পাকিস্তানি ফকরি তো রয়েছে। উহহ, ওলিম্পিকগুলো এমন সময়ে হয় না! কেন যে পুজোর পর করে না! মান্নার জায়গায় এখন শরৎ দাসকে খেলাবার কথা হচ্ছে। চারবছর কোনও ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেনি শরৎ, কী যে অবস্থা!”

”টোলুবাবু চারটে—চল্লিশে…”

”কী বললি? চারটে চল্লিশে?” এক ঝটকায় তাঁর শীর্ণ লম্বা—কাঠামো টেবলে খাড়া হয়ে গেল। ”চল্লিশে চার? …চার দিয়ে চল্লিশ ভাগ…ভাগফল দশ,…তার মানে দশ গোল!” টোলুবাবুর চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা।

”চারটে—চল্লিশে বনগাঁ লোকাল ছাড়বে।”

”নারান, ওটা বনগাঁ নয়, বনগাঁ নয়, ইস্টেবেঙ্গল লোকাল!”

টোলুবাবুর মুখ দেখে নারানের কষ্ট হল। তার থেকে কম করেও পনেরো বছরের বড়, এই সহজ, প্রাণখোলা সাতে—পাঁচে না থাকা মানুষটিকে তার খুব ভাল লাগে। শান্ত টোলুবাবু শুধু অশান্ত হয়ে ওঠেন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের মুখোমুখি হবার দিন যখন এগিয়ে আসে। ওঁর ব্লাডপ্রেসার নাকি খুবই উঁচুর দিকে। এই সময় অফিসের কেউ, ওঁর কানে যাওয়ার দূরত্বে থাকলে মুখ দিয়ে ফুটবল শব্দটি বার করেন না।

”আমি তা হলে এবার যাই টোলুবাবু। জানেনই তো, আমাকে আবার কাগজ বিক্রি করতে বেরোতে হবে। এই ট্রেনটা ফেল করলে…”

”তা হলে দশ ভাগফল?…রেজাল্টটা যখন তোর মুখ থেকেই…।”

নারান দু—তিন পা এগিয়ে গিয়েছিল। হতাশ, ভেঙে পড়া স্বর শুনে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ”আমার মুখ থেকে আবার কখন রেজাল্ট বেরোল! আমি তো ট্রেনের টাইম বললুম।”

”দৈববাণী রে, নারায়ণের দৈববাণী! যা তুই, তোর ট্রেন ছেড়ে দেবে। ধান্যকুড়িয়া, আমি টাইমটেবিলে দেখেছি, দশটা স্টেশন।…এক একটা স্টেশন আর এক একটা গোল।”

”কী আপনি বলছেন? ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান ম্যাচে দশ গোল হয় কখনও? হয়েছে কখনও, না হবে কখনও? আপনি বরং এখন ওলিম্পিকের কথা চিন্তা করুন। সেখানে আমরা দশ গোল খাই কি না।” বলতে বলতে নারান বেরিয়ে গেল।

নীচে এসে দেখল ভ্যানে কাগজ তোলা হচ্ছে। গোবিন্দবাবু দাঁড়িয়ে। নারান তাকে বলল, ”টোলুবাবু দেরি করিয়ে দিলেন…উঠব?”

”আজ আর জায়গা হবে না। কাগজ বেশি ছাপা হয়েছে। হেঁটেই স্টেশন যাও।”

”হেঁটে যাব! ট্রেন পাব কি?”

”তা হলে দৌড়ে যাও।”

নারান গ্যাসের আলো—জ্বলা রাস্তার দু’ধারে তাকাল। বাড়িগুলো আবছা। সরু ফুটপাথে সার দিয়ে ঘুমন্ত মানুষ তাদের সঙ্গে কুকুরও ঘুমোচ্ছে। দূরের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে মাঝে মাঝে ছুটন্ত লরির শব্দ ভেসে আসছে। গোবিন্দবাবু না বলেছেন যখন তখন আর সেটা হ্যাঁ হবে না। এই ভ্যান থেকেই শেয়ালদায় হকারদের কাছে কাগজ বিলি হবে আর মফস্বলের এজেন্টদের জন্য কাগজের প্যাকেট ট্রেনে উঠবে। ধান্যকুড়িয়ার এজেন্ট হরিহর ভট্টাচার্যের জন্য বরাদ্দ একশো কাগজ নিয়ে সেও ট্রেনে উঠবে। যদি এই ট্রেনটা না ধরতে পারে তা হলে এক ঘণ্টা দেরি হয়ে যাবে কাগজ বিলি করতে। ভোরের প্রথম ট্রেন ঘড়ি ঘরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ে।

নারান মালকোঁচা দিয়ে পরা ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত টেনে তুলে কোমরে গুঁজল। জুতো নেই তার পায়ে। চটি ছিঁড়ে যাবার পর, সেটা মুচির কাছে দিতেই সে একবার মাত্র তাকিয়ে বলেছিল, ‘এটা গঙ্গায় দিয়ে এসে একজোড়া নতুন কিনুন। সারাবার মতো জায়গা এতে আর নেই।’

ছুটতে শুরু করল নারান। প্রায় এক মাইল পথ। খোয়ার টুকরো পায়ের তলায় ফুটছে, ছোট গর্তে পড়ে আঙুল আর গোছ ব্যথা পাচ্ছে। সেদিকে নারানের মন দেওয়ার সময় নেই। প্রায় অন্ধকার ট্রামরাস্তা ধরে সে ছুটে চলেছে। ভোরবেলা ব্যায়ামের জন্য যেভাবে দৌড়োনো হয়, নারান সেই বেগে দৌড়চ্ছে না। তারও সাত—আটগুণ জোরে, দেড় হাজার মিটার রেসের প্রতিযোগীদের মতো তার ছোটা। গঙ্গাস্নানের জন্য কিছু মহিলা ও পুরুষকে সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যেতে দেখল। তার শুধু একটাই তখন দুশ্চিন্তা—পুলিশ আর কুকুর। কিন্তু এদের কারও সঙ্গে সারাপথে তার একবারও দেখা হল না। যখন সে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে তখন সে দেখল কাগজের ভ্যানটা তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই সময়ই একটা পেরেক গোড়ালিতে ঢুকে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। পেরেকটা টেনে বার করে সে আবার ছোটা শুরু করল।

নারান হালদারের বয়স বত্রিশ। ছিপছিপে, প্রায় ছ’ফুট। দূরপাল্লার অ্যাথলিটদের মতো পায়ের আঙুল থেকে কপাল পর্যন্ত তার দেহের গড়ন। গায়ের রং বালিমাটির মতো। মুখটি লম্বাটে, গালের হাড় সামান্য উঁচু, চোখ দু’টি তীক্ষ্ন জ্বলজ্বলে। চাহনিতে এমন একটা কাঠিন্য আছে যা থেকে মনে হয় লোকটি জেদি, একগুঁয়ে। হাঁটার ধরনে ব্যস্ততা প্রকাশ পায়। নারান ধৈর্যধারী নয়। চট করে রেগে ওঠে যেমন, জল হয়ে যেতেও বেশি সময় সে নেয় না। পরিশ্রমে কখনও সে কাতর হয় না। এই গুণটি তার জন্মগত।

হাতঘড়ি থাকলে নারান জানতে পারত, সে একমাইল পথ পাঁচ মিনিটেই দৌড়ে এসেছে। অবশ্য সময়টা নিয়ে সে অবাক হত না। এই রকম বেগে সে যখন—তখনই দৌড়তে পারে। স্টেশনে কাগজের ভ্যানটিকে ঘিরে তখন প্রচণ্ড ব্যস্ততা। থাক দিয়ে মাটিতে নামানো রয়েছে কাগজের স্তূপ। কলকাতার এজেন্টরা এখান থেকেই বিলি করে দিচ্ছে হকারদেব। তারা হেঁটে বা সাইকেলে কাগজ নিয়ে ছুটছে চিৎকার করতে করতে। আর বান্ডিল বান্ডিল কাগজ তোলা হয়েছে ট্রেনে। স্টেশনে স্টেশনে স্থানীয় এজেন্টদের লোকের হাতে সেগুলো দেওয়া হবে।

নারান তার এজেন্টের জন্য নির্দিষ্ট কাগজের বান্ডিল ঘাড়ে নিয়ে ট্রেনে উঠল। এঞ্জিনের পিছনের কামরাটা প্রথম থেকেই বেছে নিয়েছে যেহেতু কয়লার গুঁড়ো কম ভিতরে ঢোকে। কিছু লোকও, যারা রোজই এই ট্রেনে যায়, এই কামরায় ওঠে, তারা সবাই পরস্পরকে চেনে। এদের কেউ ফড়িয়া, কেউ ব্যাপারি, দোকানি, কুলি, কম্পাউন্ডার বা সকালের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও। কিন্তু নারানের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা হয়নি শুধু একটা কারণেই। ট্রেনে উঠেই সে বাঙ্কে কাগজ রেখে, তাতে মাথা দিয়ে, লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

আজও সে তাই করল। তবে শোবার আগে কম্পাউন্ডারকে গোড়ালি দেখিয়ে বলল, ”কিছুক্ষণ আগে পেরেক ঢুকে গেছল, এখন একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। রাস্তার পেরেক, কিছু হবে না তো?”

”হতে পারে। পেকে পুঁজ হয়ে গ্রাংগ্রিন হতে পারে। হয়তো পা—টা কেটে বাদও দিতে হতে পারে। কিংবা ধনুষ্টঙ্কার হতে পারে। তাতে আপনি আজই মারা যেতে পারেন।” কম্পাউন্ডার পান মুখে দিয়ে হাতের তেলোয় গুণ্ডি ঢালতে লাগল।

ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল নারানের মুখ। সে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল, ”মরে যেতে পারি?”

”পারেন। রাস্তার পেরেকে মরচে আছে। ওটা মারাত্মক জিনিস। অ্যান্টি—টিটেনাস ইঞ্জেকশন নেওয়া উচিত।”

”কত খরচ পড়বে?”

”টাকা চারেকের মধ্যেই হয়ে যাবে।”

আর কথা না বলে নারান শুয়ে পড়ল। চার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। বউ, দু’টি ছেলেমেয়ে, চারটে গোরু, অথচ মাইনে ষাট টাকা! কাগজ বিলি করার জন্য হরিহর ভটচাজ দেয় তিরিশ টাকা। এই আয়ে চার টাকা দিয়ে ইঞ্জেকশন নেওয়া যায় না।

দমদম থেকে সিঙ্গল লাইন। এক একটা স্টেশনে ডাউন ট্রেনের সঙ্গে ক্রশিংয়ের জন্য কিছুক্ষণ ধরে আপ ট্রেনকে অপেক্ষা করতে হয়। নারান ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছিল। কাঁধে নাড়া খেয়ে চোখ মেলতেই দেখল মাথায় গামছা বাঁধা ভজনরামের মুখ।

”এ্যা নারান, উঠ উঠ…বারাসাত আ গিয়া।”

ভজরাম নেমে গেল। কম্পাউন্ডারও নামতে নামতে বলে গেল, ”সঙ্গে সঙ্গে চুন লাগানো উচিত ছিল। স্টেশনে নেমেই লাগিয়ে নেবেন।”

এখনও আধঘণ্টা বাকি ধান্যকুড়িয়ায় পৌঁছতে। নারান বাঙ্ক থেকে নেমে বেঞ্চে বসল। ট্রেনের শব্দ আর দুলুনিতে আবার তন্দ্রা আসছে। এইরকম সময়ে তার দেশের কথা মনে পড়ে। তার দাদাদের কথা, কাকার কথা; গাছ, দিঘি, খেত চোখে ভেসে উঠে।

নারানের তিন বছর বয়সে বাবা মারা যান। চৈত্রমাসে পাওনা আদায়ে বেরিয়ে, কুড়ি বিঘে জমি বায়না করে দুপুরে তিন ক্রোশ হেঁটে বাড়ি ফিরেই মাথা ঘুরে পড়েন। আর জ্ঞান ফেরেনি। ভীষণ রাগী মানুষ ছিলেন। খাটতেন দৈত্যের মতো। এক সময় তাঁর এক ছটাকও জমি ছিল না, বাড়ি ছিল না। মারা যাবার সময় সত্তর বিঘে জমি, দশটা বলদ, ছ’টা গাই, দই আর দুধের ব্যবসা, পাঁচ বিঘে জমিতে বাড়ি রেখে যান মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই। নারান মায়ের মুখে শুনেছে, বাবা নাকি তেইশ ঘণ্টা খাটতেন, একঘণ্টা ঘুমোতেন! স্বচ্ছলতার মধ্যে সে বড় হয়েছে। ক্লাস টেন—এ পড়ার সময় তার মা মারা গেলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।

দেশভাগের পরই তাদের শিবপোতা গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে নারানও গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসে বসবাসের জন্য জমির খোঁজে। বনগাঁ থেকে ঠাকুরনগর তারপর ধান্যকুড়িয়ায় এসে এক চেনা লোকের সঙ্গে তাদের হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তাদের পাশের গ্রামেরই রতন ঘোষ। এখানে সে রেলের কেবিনম্যানের কাজ করে। রতনের মাধ্যমেই শিবপোতার বারোটি পরিবার ধান্যকুড়িয়ায় আট বিঘা জমি কিনল সাড়ে তিনশো টাকা বিঘেয়। তারপর আবার তারা গোপনে দেশে ফিরে গিয়ে পরিবারের লোকদের নিয়ে আসে। এই আসার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল গ্রামের কয়েকজন মুসলমান।

নারান কিনেছিল দেড় বিঘা। কিছু টাকা, গহনা, তিন বছরের মেয়ে নয়ন আর বউ মহামায়াকে নিয়ে পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে পাঁচ বছর আগে নারান পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে চিরকালের জন্য। থাকার জন্য টালির চালের একটা মাটির ঘর, গোয়াল ঘর আর চারটে গাই কেনার পর হাতে আর টাকা ছিল না। শূন্য হাতে নারান দুধের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু ধান্যকুড়িয়া সাধারণ একটা গ্রাম, লোকসংখ্যা কয়েকশো। দুধ বেচে দিনে এক টাকাও লাভ হয় না। নারানকে তাই চাকরির খোঁজ করতে হয় এবং খবরের কাগজের অফিসে কাজ পেয়ে যায়।

নারান তার ফেলে আসা গ্রাম শিবপোতার কথা যখনই ভাবে বুক ভারী হয়ে যায়। আর এই ভাবনাটা ভোরের ট্রেনেই তার মনে জেগে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য সে পারিপার্শ্বিক ভুলে চলে যায় সীমান্তের ওপারে, আবার এপারে ফিরে আসে ধান্যকুড়িয়ায় ট্রেন থামলে।

ট্রেন থেকে নামার সময় অন্য দিনের মতো আজও সে মনে মনে বলল—পুরনো দিনের কথা ভেবে লাভ নেই। যা ফিরে আসবে না তার জন্য হায় হায় করা বৃথা। বরং আবার কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়ানো যায় সেটাই দেখা উচিত। এজন্য খাটতে হবে। সবাই মিলে, তাকে আর মহামায়াকে, খাটতে হবে।

হরিহর ভট্টাচার্যের বইয়ের দোকানের মধ্যে থাকে সাইকেলটা। খবরের কাগজ অফিস থেকেই এটা কিনে দেওয়া। স্কুলের পাঠ্য বই, খাতা, কাগজ, পেনসিল ইত্যাদি ছাড়াও ছোটখাটো ওষুধ, পাউডার, সাবান, লজেন্স এমন কী পোলট্রির ডিমও দোকানে বিক্রি হয়। একটা পাল্লা খুলে রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হরিহর দাঁতন করছিলেন। নারানকে দেখে বললেন, ”পেছনের চাকায় হাওয়া কম মনে হচ্ছে, একটু হাওয়া দিয়ে নাও। আর ঝাউডাঙার বাদল নস্করের কাগজের ও মাসের দামটা বাকি পড়ে আছে, তাগিদ দিয়ো।”

নারান দোকানে ঢুকে হাতের ছোট থলিটা কাউন্টারের নীচের তাকে রাখল। তারপর দেয়ালে হেলানো সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে পিছনের চাকায় দু’আঙুলে টিপতেই সামান্য বসে গেল। পাম্পার দিয়ে চাকায় হাওয়া ঢুকিয়ে সে সাইকেলটা বার করে আনল। হ্যান্ডলের উপর অর্ধেক আর পিছনের ক্যারিয়ারে অর্ধেক কাগজ সাজিয়ে রাখতে রাখতেই সে রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ”হাবু, চা দে।”

গ্লাসে চা আর এক আনা দামের একটা সুজির বিস্কুট হাবু দিয়ে গেল। দোকানের পাল্লা বন্ধ করে তালা দিয়ে হরিহর বললেন, ”কলকাতা যাব এগারোটার ট্রেনে, টাকাপয়সা ঝণ্টুকে বুঝিয়ে দিয়ো।”

নারান ধীরে ধীরে চিবিয়ে বিস্কুটটা খেল। যতক্ষণ না মুখের মধ্যে গলে যাচ্ছে ততক্ষণ সে কোদাল দিয়ে কাদা ছানার মতো বিস্কুটের টুকরো জিভে নাড়ল। মহামায়ার করে দেওয়া চারখানা মোটা রুটি আর লাউপাতা দিয়ে আলুর ছেঁচকি রাতে অফিসে খেয়েছে। এখন পাঁচটা গ্রামে—শালকোনা, আন্দুলিয়া, ঝাউডাঙা, রঘুরামপুর, তুবড়িয়া—সাইকেল চালিয়ে যেতে হবে। একশো কাগজ দিতে একশোবার নামা আর ওঠা। মোট রাস্তা প্রায় আঠাশ মাইল।

ধান্যকুড়িয়ায় ফেরার সময় সাইকেল চালাতে চালাতে নারানের তখন মনে হয়, একটা রাক্ষস তার পেটটা মুঠোয় ধরে টিপছে আর ছাড়ছে। এক আনার বিস্কুট তখন গলায় উঠে এসে আটকে থাকে। তখন রাস্তার ধারের টিউবওয়েল থেকে সে পেট ভরে জল খেয়ে নেয়। ঝাঁ ঝাঁ রোদে দূরের গাছ আর বাড়ি চোখে তিরতির করে কাঁপে। রাস্তার ভাঙা ইটগুলো মাটি থেকে মাথা তুলে সারাক্ষণই সাইকেলটাকে ঝাঁকি দেয়। লরি আসে, বাস আসে সামনে—পিছন থেকে। গোরুর গাড়ির চাকার গর্ত সামলে রাস্তার ধারে বারবার সরে যাওয়া। ঘণ্টা—পাঁচেক পর, দুপুর দুটো নাগাদ বাড়ি ফেরা। তখন তার পেটভর্তি শুধু টিউবওয়েলের জল!

নারান চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাচের বোয়েমে থাক দিয়ে সাজানো বিস্কুটগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। গুনতে শুরু করল। এক, দুই, তিন…এগারো, বারো….গোনা বন্ধ করল। বিস্কুটগুলো খাওয়ার দুটো উপায় আছে—পয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া, নয়তো ঝপ করে বোয়েমটা তুলে সাইকেল চালিয়ে সরে পড়া।

মাথা নেড়ে নারান হেসে ফেলল, নিজের উদ্ভট চিন্তায়। তার পকেটে একটা সিকি আছে বটে, কিন্তু এটা নিরুপায়। কোনও অবস্থায় পড়লে তবেই খরচ করার জন্য। মরে গেলেও সে এটা দিয়ে বিস্কুট কিনে খাবে না। আর বোয়েম লুঠ করার মতো কাজের প্রবৃত্তি তার রক্তে নেই।

”হ্যাঁ রে হাবু, একটু চুন পাওয়া যাবে?”

হাবু চালার নীচে থেকে গলা বাড়িয়ে ডান দিকে তাকাল। ”রসময়ের দোকান এখনও খোলেনি। কী হবে চুন দিয়ে?”

”পায়ে একটা পেরেক ফুটেছিল সকালে, সামান্য টাটাচ্ছে জায়গাটা।”

”ও অমন একটু—আধটু টাটাবে, কিছু হবে না। রাস্তায় পানের দোকান পাবে, লাগিয়ে নিয়ো।”

কাগজ বিলি করতে করতে নারানের আর মনে ছিল না চুন লাগাবার কথা। ঝাউডাঙার বাদল নস্করের বাড়ির দরজার সামনে সাইকেল থেকে নামার সময় গোড়ালিটা পড়ল একটা ইটের উপর। ব্যথা লাগতেই তার মনে পড়ল, চুন লাগাতে হবে।

বাদল নস্কর চাষের কাজ দেখতে ক্ষেতে গেছে। কাগজের পাওনা টাকা না নিয়ে নারান আজ আর ফিরে যাবে না ঠিক করেছে।

”ক্ষেত কত দূর?” নারান জিজ্ঞেস করল নস্করের ক্লাস এইটে পড়া নাতিকে।

”আধ—মাইলটাক হবে।”

”আমার পায়ে পেরেক ফুটেছে, হাঁটতে পারব না। তুমি গিয়ে বরং খবর দাও কাগজওয়ালা ওমাসের দাম নেবার জন্য বসে আছে। এমাসের আজ একুশ, টাকা না পেলে কাল থেকে আর কাগজ দিতে পারব না।”

”কাগজ দেবেন না? ওলিম্পিক চলছে যে!” ছেলেটির মুখে অসহায় ভাব ফুটে উঠল।

”ওলিম্পিক বলে কি কাগজ ফ্রি হয়ে গেছে? কাগজ তো পয়সা দিয়ে আমাদের কিনে আনতে হয়! দশ পয়সা করে হলে তিরিশ দিনে কত হয়?”

ছেলেটি মনে মনে গুণ—ভাগ—বিয়োগ করে বলল, ”চার টাকা চুয়াল্লিশ পয়সা।”

”যদি ওলিম্পিকের খবর পেতে চাও তা হলে এক্ষুনি গিয়ে দাদুর কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করো।” হাতের কাগজ খুলে সে খেলার পাতাটা ছেলেটির সামনে মেলে ধরল। এতেই কাজ হল। ছুটে চলে যাচ্ছিল তখন নারান আবার ডাকল।

”বাড়িতে পান খায়?”

”হ্যাঁ।”

”একটু চুন এনে দাও তো, গোড়ালিতে লাগাব।”

নারান দরজার সিঁড়ির চওড়া ধাপে বসল। হাতের কাগজটা খুলে চোখ বোলাচ্ছে তখন ছেলেটি ফিরে এল বাড়ির মধ্যে থেকে। আঙুলে কুড়িটা পানে দেবার মতো চুন।

”অত কী হবে।” বলতে বলতে নারান ওর আঙুল থেকে নিজের আঙুলে চুন তুলে নিল। ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। চুন লাগানো গোড়ালি হাঁটুতে তুলে নারান আবার কাগজে চোখ দিল।

একটা খবরে তার চোখ আটকে গেল :

”এমিল জ্যাটোপেকের স্বর্ণ জয়।” ওলিম্পিকের দশ হাজার মিটার দৌড়ে তিনি নতুন রেকর্ড গড়েছেন ২৯ মিঃ ৫৯.৬ সেকেন্ড সময় করে। এর আগে ১৯৪৮—এর লন্ডন ওলিম্পিকেও তিনি স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন নতুন ওলিম্পিক রেকর্ড করে। লন্ডনে তিনি পাঁচ হাজার মিটার দৌড়েও রৌপ্যপদক অর্জন করেছিলেন। ওঁর স্ত্রী ডানা জ্যাটোপেকও এই ওলিম্পিকে জ্যাভেলিন নিক্ষেপ বিভাগে চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন। এমলি জ্যাটোপেকের ১০০ গজ পিছনে থেকে ফ্রান্সের মিমুঁ ১০ হাজার মিটারের রৌপ্যপদক লাভ করেছেন।

খবরটা অসাধারণ বা চমকপ্রদ নয়।

নারান চোখ সরাতে যাচ্ছে পাশের ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচের খবরে। তখন জ্যাটোপেকের একটা কথা তার নজরে এল : ”জয়ের পর এক সাংবাদিক তাঁর কাছে জানতে চান—চার দিন পর পাঁচ হাজার মিটার দৌড়েও তিনি অংশগ্রহণ করবেন, এ কথা কি সত্যি? জবাবে জ্যাটোপেক বলেন, ‘ম্যারাথন প্রতিযোগিতার তো অনেক সময় বাকি। তাই ততক্ষণ বসে না থেকে কিছু একটা তো করতে হবে।’

তারপর আর একটা বাক্য—”জ্যাটোপেক দম্পতির জন্ম একই বছরে একই দিনে, ১৯২২—এর ১৯ সেপ্টেম্বর।

হঠাৎই নারানের শরীরে হালকা শিহরন জাগল। তারও তো জন্ম ১৯ জন্ম সেপ্টেম্বর! তবে জ্যাটোপেকের দু বছর আগে। হোক ন দু বছর আগে কি পরে, তারা তো প্রায় সমবয়সিই! নারানের শরীরে একটা সতেজ ভাব নাড়াচাড়া করে উঠল। কেন যে সে প্রফুল্লতা বোধ করছে তার কোনও কারণ সে বলতে পারবে না। শুধু তার মনে হচ্ছে, তারই সমবয়সি একজন পৃথিবীতে তার বিভাগে সেরা।

আর তার ভাল লেগেছে ওই কথাটাও—”ততক্ষণ বসে না থেকে কিছু একটা তো করতে হবে।” রসিকতা করেই জ্যাটোপেক বলেছেন, কিন্তু নারান এর মধ্যে তার নিজের মনের ছবিটাই যেন ফুটে উঠতে দেখছে। সেও তো কখনও বসে থাকে না। তার বউ মহামায়াও কখনও অলস হয়ে সময় কাটায় না। তারা দুজনেই কিছু না কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এই জ্যাটোপেক লোকটাও তাই করে।

নারান এই মুহূর্তেই দৌড়তে ভালবেসে ফেলল। সাইকেলটার দিকে সে তাকাল। ভাবল, এটাকে বাতিল করে দৌড়ে দৌড়ে পাঁচটা গ্রামে কাগজ বিলি করলে কেমন হয়? তারপরই মনে হল, এক একটা আট পাতার একশো কাগজ বগলে কি মাথায় নিয়ে দৌড়লে কাজটা বোকার মতোই হবে। বিলি করতে করতে একটা একটা করে কাগজ কমে যাবে ঠিকই, কিন্তু সময়ও তো বেশি লাগবে! দেরি হলে খদ্দেররা চটবেই, আর তার কাছ থেকে কাগজ নেওয়াও বন্ধ করে দেবে।

থাক, দৌড়ে আর দরকার নেই, সাইকেলই ভাল! নারান জ্যাটোপেককে মন থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ইংল্যান্ডে ভারতের সঙ্গে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচের খবরে চোখ রাখাল। এই একটা খেলা যার মাথামুণ্ডু সে একদমই বোঝে না, অবশ্য বোঝার কোনও চেষ্টাও করে না। কাজকর্ম ফেলে পাঁচ দিন ধরে মাঠে বসে যারা খেলা দেখে, তারা যে কী ধরনের লোক সেটাও সে বুঝতে পারে না!

অফিসের রবিবাবু তো ক্রিকেটের উপর ভীষণ খাপ্পা। একদিন টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে বলছিলেন, ”পৃথিবীতে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, শক্তিশালী হয়েছে, যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, এরা কেউ ক্রিকেট খেলে না। এটা হচ্ছে রাজারাজড়াদের রোদ পোয়াবার একটা ফিকির। আরে বাবা, আমাদের হল গরিব দেশ। স্বাধীনতা পেয়েছি, এবার দিন—রাত পরিশ্রম করে দেশটাকে দাঁড় করাতে হবে। এখন কি আমাদের সময় নষ্ট করার খেলায় মেতে ওঠা উচিত? আর খেলিও তো আমরা তেমনি! এই দ্যাখো না ট্রুম্যান নামে নতুন এক ছোকরা অ্যায়সা জোরে বল করল যে আমাদের ব্যাটসম্যান ভয়ে পিছু হটে আম্পায়ারের কাছাকাছি চলে গেল।”

রবিবাবু অসহযোগ আন্দোলনে জেল খেটেছেন। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছু পরেন না। কুস্তি, বকসিং, সাঁতার, জিমন্যাসটিকসের ভক্ত। ওঁর কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কীসের যেন জ্বালা আর রাগ বেরিয়ে আসে। টাক মাথাটায় হাত বুলোতে বুলোতে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ”হ্যাঁ রে নারান, যদি দেশটা ভাগ না করা হত, তা হলে তুই এখানকার থেকে ভাল থাকতিস না মন্দ থাকতিস?” নারান কয়েক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিয়েছিল, ”ভাল থাকতুম ঠিকই, তবে সেখানে জীবনটা সাজানো ছিল তো…এখন নতুন করে আবার গড়ে তুলতে হচ্ছে। গড়ার একটা আলাদা সুখ, আলাদা আনন্দ আছে। রবিবার সেটা আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার বউ এটা বোঝে।”

স্টিলফ্রেমের গোল কাচের চশমাটা কপালের উপর তুলে দিয়ে পঞ্চাশ বছর বয়সি রবিবার কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ”তুই দেখছি, আলাদা ধরনের মানুষ! ওপার থেকে যত উদ্বাস্তু এসেছে সবাই বলে কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, আর তাই দুঃখ—কষ্টের মধ্যে কিনা আনন্দ খুঁজে পাস?…আলাদা মানুষ তুই।”

নারান অন্যমনস্ক হয়ে একদৃষ্টে কাগজের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবে যাচ্ছিল রবিবাবুর কথাগুলো। লক্ষ করেনি ছেলেটি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

”দাদু বললেন, ফিরতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে। আপনি কি ততক্ষণ থাকবেন?”

”থাকলে আমার চলবে না। তেরো—চোদ্দো মাইল…আমাকে ফিরতে হবে।”

”কাগজ দেবেন না?” ছেলেটির গলায় হতাশা, মিনতি। নারানের মায়া হল। কাগজটা এগিয়ে ধরে বলল, ”কাল অবশ্যই যেন টাকা পাই।” কাগজটা ব্যগ্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে আবার বলল, ”খেলার খবর পড়তে চাও, কিন্তু কী আছে আমাদের পড়ার জন্য? শুধু তো হকির একটা মেডেল।”

”কেন ফুটবল আছে!”

নারান আর কথা না বলে সাইকেল নিয়ে রাস্তায় উঠে এল। প্যাডেলে পা রেখে সিটে বসার উদ্যোগ করছে, তখন সে ছেলেটিকে আহত স্বরে বলতে শুনল, ”এ কী! দ—অ—শ গোল! …ওম্মা! এক দিনেই দুটো ইনিংস শেষ!”

নারান বুঝতে পারল না, কেন ছেলেটির মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন কলেরার রোগী।

”কী হল?” চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে, নারান সাইকেল হাতে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রইল।

”দশ গোল খেয়েছে ইন্ডিয়া, একটা গোল শুধু শোধ করেছে…যুগোশ্লাভিয়ার কাছে! আর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে খেলার থার্ড দিনে ভারত দু’বার আউট হয়েছে, আটান্ন আর বিরাশি রানে…ইনিংস আর দুশো সাত রানে হেরে গেছে।”

”রাখো ক্রিকেট, বলো ফুটবলের খবরটা।”

”ম্যানেজার এম দত্তরায় খেলার এক ঘণ্টা আগে স্পষ্টই স্বীকার করেন ভারতের পক্ষে জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই…সাতজন খালি পায়ে খেলেছে…ওলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশের এক মাঠে খেলা হয়…আর, খেলা শেষের কয়েক সেকেন্ড আগে কুড়ি গজের শটে আমেদ খাঁ গোল দেয়।”

”দশটা গোল হল কখন?”

”প্রথম মিনিটেই, তারপর তেরো, আঠারো, তেইশ, চুয়াল্লিশ। ফাইভ নিল। তারপর পঞ্চাশ, একষট্টি, তেষট্টি, আটষট্টি, অষ্টআশি!”

”ওরে বাবা, তুমি তো নামতা পড়লে দেখছি! অষ্টাশি মিনিটেও ছাড়েনি! আমাদের টিমে খেলেছে কারা? টিম দিয়েছে?”

”দিয়েছে—বি অ্যান্টনি, আজিজ, মান্না, লতিফ, চন্দন সিং, সম্মুগম, ভেঙ্কটেশ, সাত্তার, মৈনুদ্দিন, আমেদ, জে অ্যান্টনি।”

”কলকাতার প্লেয়ারই তো বেশি।”

এই বলেই নারান সাইকেলে উঠে পড়ল। একটা কথা মনে পড়ায় তার অবাক লাগছে—টোলুবাবু তাকে ভোর রাতে এই খেলার রেজাল্ট সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানাননি। নিশ্চয়ই বেশি রাতে, খেলার বিভাগের সবাই বাড়ি চলে যাবার পরই, খবরটা এসেছিল। আগে এলে তো টেবিলে হইচই পড়ে যেত, সেও জেনে যেত। বেশি রাতে খবর এসেছে, খবরটা টোলুবাবুই তর্জমা করেছেন, তিনিই প্রেসে গিয়ে কাগজের পাতায় খবর বসিয়েছেন। আর আশ্চর্য এটা নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্যও করলেন না! শুধু মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে কী হবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুমোতে পারছেন না! খেলা পাগল কি একেই বলে? শুধুই মোহনবাগান, তার বাইরে পৃথিবীতে আর কিছু নেই! বয়স্ক লোকেরা খেলা নিয়ে কত যে ছেলেমানুষি করেন! হেলসিঙ্কির দশটা গোল হয়তো ওঁর মাথায় ঘুরছে আর আঁতকে উঠছেন। সব কিছুর মধ্যেই উনি দশ গোল দেখতে পাচ্ছেন।

পাগল, দশ গোল বড় ম্যাচে হয় নাকি! নারান চাকরিতে ঢোকার আগে একবার মাত্র ধান্যকুড়িয়া থেকে কলকাতায় এসে ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখেছে। তারপর নাইট ডিউটি করে, কাগজ বেচে, বাড়ি ফিরেই কাস্তে নিয়ে গোরুর জন্য ঘাস কাটতে বসা। তারপর আবার ট্রেন ধরে অফিসে ডিউটি করতে যাওয়া—সময় কোথায় তার মাঠে যাওয়ার? সাইকেল প্যাডেল করতে করতে নারান শূন্য চোখে সামনে তাকিয়ে। তারও ফুটবলার হবার সাধ ছিল। পনেরো বছর আগেও স্বপ্ন দেখত ইস্টবেঙ্গল টিমে খেলার, কিন্তু এখন তার এ সবের জন্য সময় নেই। সংসারটাকে আগে দাঁড় করাতে হবে তারপর খেলাধুলোর কথা ভাবা যাবে।

কিন্তু কবে? বয়স তো আর থমকে থাকবে না, বেড়েই যাবে। বুড়ো বয়সে দাবা আর লুডো ছাড়া আর কী—ই বা খেলবে? অথর্ব শরীরে দৌড়োদৌড়ি করা তো যাবে না! অথর্ব শব্দটা মনের মধ্যে ঢুকে পড়তেই নারানের মাথা গরম হয়ে গেল। সে কী! আমি অথর্ব হব? অসম্ভব…অসম্ভব।

প্রচণ্ড গতিতে তার দুটো পা ওঠা—নামা করতে শুরু করল প্যাডেলে চাপ দিয়ে। চোয়াল শক্ত, হ্যান্ডেল ধরা হাতের পেশি ফুলে উঠেছে। মাথার মধ্যে একটা প্রতিজ্ঞা সাইকেলের চাকার মতো বনবন ঘুরছে—বুড়ো হব না…বুড়ো হব না।

ধান্যকুড়িয়া রেল স্টেশনের পুব দিকে নারানের বাড়ি। সাইকেলটা হরিহর ভটচাযের দোকানে রেখে, নগদ বিক্রির টাকা ওর ছেলে ঝণ্টুকে বুঝিয়ে দিয়ে সে হেঁটে বাড়ি ফেরে। রেললাইন পার হয়ে একটু পা চালিয়ে হাঁটলে মিনিট দশেকের পথ। লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে তার সঙ্গে দেখা হল বিভূতি মুখুজ্জের। হাবড়ায় বাড়ি। এখানে ওঁর জমি জায়গা আছে। ভাগে চাষ করান।

ইনি নারানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ”অন্যের হয়ে কাগজ না বেচে, নিজেই কিনে এনে বেচ না!” নারান বলেছিল, ”কাগজ কিনে আনব যে, তার টাকা কোথায়? কাগজ পিছু তিন টাকা করে সিকিউরিটি—মানি জমা রাখতে হবে। যদি দেড়শো কাগজ আনি তা হলে সাড়ে চারশো টাকা! বাপস! সাড়ে চার টাকা দেবারই ক্ষমতা আমার নেই, আর কিনা…।” বিভূতি মুখুজ্জে বলেছিলেন, ”ফিফটি ফিফটি শেয়ারে ব্যবসা করো। সিকিউরিটি—মানিটা আমি দেব, তুমি কাগজের দামটা দিয়ো।”

কয়েক দিন প্রস্তাবটা নিয়ে সে ভেবেছিল। অফিসের ষাট টাকা আর হরিহর ভটচাযের তিরিশ টাকা, এই নব্বুই টাকা আর দুধ বেচে যে ক’টা টাকা পাওয়া যায়। এই টাকায় তো আর বছরের পর বছর চলা যায় না! খরচ তো বাড়বেই। মহামায়াকে বলা মাত্র সে বলেছিল, ”ভালই তো, আয় বাড়াবার জন্য নিজেই ব্যবসাটা ধরো। আমার কাছে এখনও ভরি—দেড়েক সোনা তো রয়েছে।” নারান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, ”ভারতে এসে চার বছর বেকার ছিলাম। হাতের টাকা সবই গেল ভিটেটা কিনতে আর দু’বেলা খেতে। তোমার সাত ভরি গয়না তিনশো টাকায় বন্ধক রয়েছে। সুদে আসলে কত যে হয়েছে আজও তার হিসেব করিনি। ওই গয়না ছাড়িয়ে না আনা পর্যন্ত আমি আর কিছু নেব না তোমর কাছ থেকে। তাতে যদি ব্যবসা করা না হয় তো হবে না!”

লেভেল ক্রসিংয়ে সে বিভূতি মুখুজ্জেকে বলল, ”টাকা দিয়ে ব্যবসা করার মতো অবস্থা হলে করব। আগে কিছু জমাই তারপর আপনাকে বলব।” দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো অবস্থা তার এখন নয়। শ্রান্তিতে আর খিদেয় শরীর অবসন্ন। এখন বাড়ি ফিরে আবার ঘাস কাটতে বেরোতে হবে।

”নারান, তিরিশ টাকার জন্য এই অমানুষিক পরিশ্রম কত দিন করবে?”

”যত দিন না বেশি টাকার কাজ পাচ্ছি। এই তিরিশ টাকাই বা কে দেয় বলুন? যা পাওয়া যায় তা আর ছাড়ব কেন? আমার মূলধন তো এই শরীরটা, দেদার খরচ করতে পারি!”

নারান বাড়ির দিকে রওনা হল। পিছন থেকে চেঁচিয়ে বিভূতি মুখুজ্জে বললেন, ”মূলধনটা সামলে খরচ করো, অসুখ—বিসুখ বলে একটা কথা আছে।”

ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝকঝক দাঁত দেখিয়ে নারান বলল, ”অসুখ তো একটাই…ক্যানসার। হলে কিছুই করার নেই। তা ছাড়া আর কোনও অসুখ আমায় কাবু করতে পারবে না।”

অহঙ্কার দেখানো হয়ে গেল নাকি? বাড়ি ফিরতে নারান ভাবল, শরীরটা কি ভগবানের দেওয়া জিনিস, না কি মানুষ নিজেই গড়ে তোলে? নিজের ভাবনার জালে নিজেই আটকে পড়ল সে। চিন্তা—ভাবনা করার মতো লোক সে নয়। তবে বেঁচে থাকার জন্য পরিশ্রম আর নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে এসে তার মনে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব প্রশ্ন জেগে ওঠে। অন্যদের ধরাবাঁধা গতানুগতিক নজরের মতো নয়, জীবনটাকে একটু আলাদা ভাবেই সে দেখতে পায়। নারান কখনও দিবাস্বপ্ন দেখে না, তবে মাঝে মাঝে মনের মধ্যে কিছু একটা ঝিলিক দেয়।

বাড়ি ফিরে সে ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘাস কাটতে। আট বছরের মেয়ে নয়ন তার সঙ্গ নিল ছাতা হাতে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে, উবু হয়ে বসে যখন নারান দক্ষ হাতে দ্রুত কাস্তে, চালায়, নয়ন তখন ছাতা ধরে থাকে তার মাথার উপর। এই কাজ করার জন্য কেউ তাকে বলে দেয়নি। বিঘৎ খানেক লম্বা ঘাস। মুঠোয় ধরে সে কাস্তে চালায় আর ঝুড়িতে ছুড়ে দেয়। উবু হয়ে কাটতে কাটতে এগোয় হাঁসের মতো দুলে দুলে আর নয়ন ঝুড়িটা তার পাশে পাশে এগিয়ে দেয়। একটা—দুটো কথা তাদের মধ্যে হয়। যেমন আজ নারান বলল, ”সাতের ঘরের নামতাটা মুখস্থ হয়েছে?”

নয়ন বলল, ”না। গড় গড় করে পারব না।”

নারান বললে, ”কাল মুখস্থ ধরব। ….প্রথম ভাগ?”

নয়ন বলল, ”দিঘঘইকার ধরেছি।”

পাড়ায় একটা মাত্র টিউবওয়েল। সেটা নারানেরই দূরসম্পর্কের এক দাদা শচীন হালদারের বাড়ির সামনে। শচীন তখন খেয়ে উঠে মুখ ধুচ্ছিল। বালতি হাতে নারান অপেক্ষা করছে। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে হল, শচীন যেন ইচ্ছে করেই অযথা সময় নিয়ে হাত ধুচ্ছে, পা ধুচ্ছে, মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে, কুলকুচি করছে। লোকটির সঙ্গে তার সদ্ভাব নেই। তার মাথা গরম হয়ে উঠল।

”কতক্ষণ লাগে হাত মুখ ধুতে? তাড়াতাড়ি করো।” নারান বিরক্ত স্বরে বলল।

”কেন, অত ধমকে কথা বলছিস কেন? ধুতে যতক্ষণ লাগবে ততক্ষণ ধোব। টিউকল কি তোর একার সম্পত্তি?”

”পাবলিকের সম্পত্তি। তাই বলে লোক দাঁড় করিয়ে রেখে…” নারান বালতিটা কলের তলায় বসিয়ে হ্যান্ডেল করল। ”অনেক মুখ ধোয় হয়েছে। এবার আমায় চান করতে দাও।”

”তুই আমাকে জোর করে সরিয়ে দিলি?” আচমকা শচীন চিৎকার করে উঠল। সামনের বাড়ির দাওয়ায় বেরিয়ে এল এক প্রৌঢ়। জানলায় উঁকি দিয়ে মেয়েদের মুখ। এখানে সব বাড়িই একতলা, খড়ের বা টালির চালের। বাড়ির সঙ্গে মাটির উঠোন। ওর চিৎকারে আরও অনেকে বেরিয়ে এল।

নারান কথা না বাড়িয়ে পাম্প করে বালতিতে জল ভরতে লাগল। শচীনের বাড়ি থেকে তখন বেরিয়ে এল তার সেজো ছেলে ভরত।

”কী ভেবেছ কী, য়্যাঁ? তুমি একাই কল দখল করে চান করবে?” ভরত রুক্ষ ভঙ্গিতে বলল।

বাবু হয়ে বসে নারান বালতি থেকে মগে জল তুলে মাথায় ঢালছিল। বলল, ”যা জানিস না, দেখিসনি, তাই নিয়ে ঝগড়া করতে আসিস না। বাড়ি যা।”

”নারানকাকা, তোমার গা—জোয়ারি কিন্তু…”

”এক চড়ে তোর দাঁতের পাটি ফেলে দেব যদি আর একটাও কথা বলিস। পায়ে পা বাধিয়ে তোর বাপই ঝগড়া শুরু করে বাড়ি যা।”

ভরত আরও কিছু কথা বলল অবশ্য গলা নামিয়ে। নারান তাতে কান না দিয়ে বালতিতে জল ভরে বাড়ি ফিরে এল। উঁচু স্বরে গলার আওয়াজ মহামায়া শুনেছে। তাই সে নারানের কাছে কারণ জানতে চাইল।

”কী আবার হবে, শচীনদার যা স্বভাব। আমায় খোঁচা দেবার চেষ্টা করল। অনেক কষ্টে রাগ সামলেছি।”

মহামায়া এই বিষয়ে আর কথা না বলে নারানকে ভাত বেড়ে দিল। সে জানে তার স্বামীর প্রকৃতি। মোটা চালের ভাত, পুকুরের কলমি শাক, ঘরের পিছনে ছাইগাদায় হওয়া মানকচু, বাড়ির উঠোনে মাছায় হাওয়া লাউ। এই সব দিয়েই তৈরি হয়েছে রান্না। নারান পেট ভরে খেয়ে, চাটাইয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। শিবপোতা থেকে আসার সময় সে অ্যালার্ম দেওয়া জাপানি টেবিল ঘড়িটা এনেছিল। বেশ জোরেই সেটা টিক টিক, টিক টিক শব্দ করে। নারান চোখ বুজে শব্দ শোনে, আর অপেক্ষায় থাকে কখন অ্যার্লাম বেজে ওঠে।

আধ ঘণ্টা পরই, চারটের সময় অ্যালার্ম বেজে উঠল, আর নারানও উঠে বসল। তার ছোটখাটো ঘরের কাজ রয়েছে। মহামায়া চার বাড়ি গোরু দুয়ে পাঁচ টাকা মাসে পায়। সে এইবার বেরোবে। গতকাল নারান বাঁশ কেটে রেখেছিল নতুন একটা মাচা তৈরি করবে বলে। কয়েকটা বাঁশ চিরে হাত চারেক লম্বা বাখারি করা। উঠোনের যেখানে মাচা হবে সেইদিকে বাখারিগুলো ছুড়ে দিতে দিতে, হঠাৎ কী যেন মনে পড়ায় মহামায়াকে উদ্দেশ করে নারান বলল, ”স্পোর্টসে বর্শা নিক্ষেপ বলে একটা ব্যাপার আছে। লম্বা সরু লাঠির মতো, বোধহয় লোহা টোহা দিয়ে তৈরি কিংবা অ্যালুমিনির, মুখটা ছুঁচলো। এর একটা কী যেন ইংরিজি নামও আছে। ওলিম্পিকে একটা বউ এই বর্শা ছোড়ার কম্পিটিশনে নাম দিয়েছে। তার বরের নাম জ্যাটোপেক, সে নাম দিয়েছে দৌড়ে। তিন রকম পাল্লার দৌড়ে নামবে। প্রথমটায় কাল জিতে গিয়ে সোনার মেডেল পেয়েছে। এবার দ্বিতীয়টায় দৌড়বে।”

”বউ!” মহামারা হাঁ করে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। ”বউ বর্শা ছুড়বে কী গো? বয়স কত? লজ্জা করবে না?”

”এতে লজ্জা করার কী আছে? কলকাতাতেও তো কত মেয়ে হাফ প্যান্ট পরে দৌড়চ্ছে! জ্যাটোপেক স্বামী—স্ত্রীর জন্ম একই বছরে, একই দিনে। অদ্ভুত না? আরও অদ্ভুত হল, ওরা আমার থেকে ঠিক দু বছরের ছোট, ঠিক দু বছরের…আমাদের তিনজনেরই জন্ম একই তারিখে, উনিশে সেপ্টেম্বর!”

‘আমাদের তিনজন’ বলে নিজেকে ওঁদের সঙ্গে জড়াতে পেরে নারানের চোখে—মুখে চাপা গর্ব যেন ফুটে উঠল। ঠাট্টার সুরেই সে বলল, ”তোমার জন্ম তারিখটাও যদি উনিশে সেপ্টেম্বর হত!”

”তা হলে কী হত? আমি কি তাহলে বর্শা ছুড়তাম ওই বউটার মতো?”

”যদি এ দেশের না হয়ে ও দেশের বউ হতে, আর দুধ দোয়া, ঘুঁটে দেয়ার কাজ যদি না করতে হত তা হলে হয়তো বর্শা ছুড়তে কি হাইজাম্প, লংজাম্প দিতে!”

”সে আবার কী?”

”দেখবে?” বলেই নারান লুঙ্গিটা গুটিয়ে তুলে মালকোচার মতো কোমরের পিছনে গুঁজে, উঠোনের বাইরে রাস্তার কাছাকাছি চলে গেল। তারপর ছুটে এসে একটা লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে প্রায় পনেরো ফুট দূরে উঠোনের উপর জোড় পায়ে নামল।

মাটির উঠোন হলেও জমি সানের মতো শক্ত। নারান কোনওরকমে ‘উইহ’ শব্দটা মুখে চেপে রেখে উঠে দাঁড়াল। পেরেক ফোটার জায়গাটা ঝন ঝন করে উঠেছে তীক্ষ্ন একটা যন্ত্রণায়। কিন্তু সে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ”দেখলে তো? এটা হল লংজাম্প। হনুমান এই লাফ দিয়েই লঙ্কায় গেছল।”

”হাফ প্যান্ট পরে মেয়েমানুষ এইভাবে লাফায়?”

”নিশ্চয়। তুমিও রোজ প্র্যাকটিস করো, পারবে। কত আর বয়স তোমার, পঁচিশ? আর জ্যাটোপেকের বউয়ের বয়স এখন দু মাস কম তিরিশ, তোমার থেকে পাঁচ বছরের বড়! সন্ধের পর, অন্ধকারে তুমি যদি…”

”থামো তো।” মহামায়া ধমক দিয়ে উঠল। ”লোকের সামনে হনুমান হওয়ার জন্য আমি এখন অন্ধকারে লাফ দেওয়া শিখব? ওই সময়টায় ঠোঙা বানালে আমার অনেক লাভ হবে।”

”ঠোঙা?” নারান কৌতূহলী চোখে তাকাল। ”কে ঠোঙা বানাবে?”

”ঘোষেদের বাড়িতে মেয়েরা রাত্তিরে রান্নাবান্না সেরে ঠোঙা বানায়। গোবরডাঙা থেকে পুরনো কাগজ কিনে আনে। একসেরি ঠোঙা বিক্রি করে এক টাকায় পনেরো দিস্তে।”

”দিস্তে মানে কত?”

”বাইশটা।”

নারান মনে মনে অঙ্ক কষে বলল, ”তার মানে এক টাকায় তিনশো তিরিশটা। তা এক টাকার ঠোঙা বানাতে একজনের কত সময় লাগবে জানো? তিনশো তিরিশটা বানাতেই তো সারাদিন লেগে যাবে!”

”তোমার মাথা! কাল রাত্রিরে গিয়ে কিছুক্ষণ তো দেখলাম। কাগজ কেটে, আঠা বানিয়ে, তৈরি হয়ে বসে এক ঘণ্টাতেই একজন প্রায় আট—দশ দিস্তে তৈরি করে ফেলল। হাত চলছিল যেন যন্ত্রের মতো।”

”প্র্যাকটিস করে করে হয়েছে।” নারান অন্যমনস্কের মতো বলল। তার চিন্তা এখন গোড়ালিটা নিয়ে। কম্পাউন্ডার যা বলল তাতে তো এখন তার ভয় ধরে যাচ্ছে। পা ফেললেই খোঁচা লাগার মতো একটা ব্যথা হচ্ছে।

”তা তুমি এবার লাফানোর প্র্যাকটিস করো না! ভালই তো লাফালে। ওই জ্যাটো…কী যেন…পেক না কেক, ওর মতো সোনার মেডেল পেলে তা কোঠাবাড়ি তোলা যাবে।”

কথাগুলো বলেই মহামায়া দুমদুমিয়ে পা ফেলে দুধ দুইতে চলে গেল। ও ফিরে এলে নারান অফিসে যাবে সাড়ে ছ’টার ট্রেন ধরে। মহামায়া যে কথাটা রাগ করে বলে গেল সেটা কিন্তু নারানের মনের কোণে আটক রইল। ”তুমি এবার প্র্যাকটিস করো না!”

দিন—রাত মিলিয়ে মাত্র চার ঘণ্টার জন্য বাড়িতে থাকা। রবিবার তার ছুটির দিন। এই দিনটাতেই সে রাত্রে ঘুমোবার সুযোগ পায়। নয়তো যাতায়াতে ট্রেনেই মোট ঘণ্টা দুই—আড়াই শুধু সে ঘুমোয়।

সাড়ে ছ’টার ট্রেনে, ধান্যকুড়িয়া থেকে উঠেই সে বাঙ্কে শুয়ে পড়ে। শোয়া মাত্রই ঘুম এসে যায়। কিন্তু আজ সে চিত হয়ে শুয়ে জ্যাটোপেকের কথাটা প্রথমে মনে করল। সোনার মেডেল আনার চিন্তা সে কোনওদিনই করবে না। ওসব পনেরো—ষোলো বছর বয়সের ব্যাপার। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো বোকা সে নয়।

বিভূতি মুখুজ্জের কথা—’মূলধনটা সামলে খরচ কোরো’—তাকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে গোড়ালির ব্যথাটার মতো। কিন্তু বিভূতিবাবু ঠিকই তো বলেছেন, শরীরটাকে সে বেশিই খাটাচ্ছে। তবে সংসার চালানো যে কী শক্ত ব্যাপার, এক আনা রোজগার করতে কতটা রক্ত যে জল করতে হয় এটা কি বিভূতিবাবু বোঝেন? মহামায়া বোঝে, এমনকী আট বছরের নয়নও বুঝতে শিখছে। ওরা দু’জনও যথাসাধ্য খাটে। ওরা তার কষ্টটা অনুভব করে। নারান ভরসা পায় তার সংসারের মানুষদের কথা ভেবে।

ট্রেনের দুলুনিতে ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে নারানের চোখে। বড় আরাম লাগছে তার। এই ঘণ্টা দেড়েকের ঘুমটুকুই তার বিলাসিতা। সকালে ট্রেনের ঘুমটা ঠিক এমন জুতসই হয় না। ঘুমের মধ্যেও চিন্তা থাকে, স্টেশন ফেলে যেন চলে না যায়। কিন্তু এখন সে চিন্তাটা নেই। শেয়ালদায় পৌঁছেও ঘুমিয়ে থাকলে কেউ না কেউ তাকে তুলে দেবে।

আজও একজন তাকে ঠেলে তুলে দিল। ”আরে মশাই, আর কত ঘুমোবেন, শ্যালদা থেকে ট্রেন যে ছাড়ার সময় হয়ে গেল!”

ধড়মড়িয়ে উঠে নারান দেখল ট্রেন ভরে গেছে যাত্রীতে। ভিড় ঠেলে সে নামল। প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে দেখল, আটটা—কুড়ি। অনেক সময় আছে এখনও। ডিউটি তো ন’টায় শুরু।

নারান ধীরে ধীরে হাঁটতে পারে না। তাই কুড়ি মিনিটেই অফিসে পৌঁছে গেল। দোতলায় উঠে আসতেই বার্তা বিভাগের বেয়ারা অনিল বলল, ”নারান তাড়াতাড়ি যা, ফুরিয়ে গেল বোধ হয়।”

”কী ফুরোবে?”

”রসগোল্লা! ভারত কুস্তিতে একটা ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছে, রবিবাবু কুড়ি টাকার রসগোল্লা আনিয়ে সারা অফিসকে খাওয়াচ্ছেন। দ্যাখ গিয়ে কিছু আর আছে কি না।”

খেলার বিভাগের টেবলের মাঝে দুটো হাঁড়ি বসানো। রবিবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে। আর বসে আছেন, অনাদিবাবু, মাণ্টাবাবু, শৈলেনবাবু। টোলুবাবুর নাইট ডিউটি, এখনও এসে পৌঁছননি। নারানকে দেখে মাণ্টাবাবু হাঁড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ”দুটো তুলে নে।”

নারান ইতস্তত করে বলল, ”ভারত নাকি কুস্তিতে মেডেল পেয়েছে?”

”পেয়েছে…কম্পোজেও চলে গেছে। প্রথম পাতায় বেরোবে।” মাণ্টাবাবু ঘাড় বেঁকিয়ে কপি অনুবাদ করতে করতে বললেন। ”সিঙ্গল কলাম ছবিও সঙ্গে যাবে।”

নারান তাকাল রবিবাবুর দিকে। টাকে হাত বুলোচ্ছেন, মুখে সাফল্যের চাপা হাসি। যেন ব্রোঞ্জটা উনিই জিতেছেন।

”কী বলেছিলুম রে নারান? গরিব দেশের এটাই হল আসল খেলা! ফুটবল, ক্রিকেট তো কত ঝুড়ি ঝুড়ি সম্মান এনে গর্বে বুক ফুলিয়ে দিচ্ছে, আর দ্যাখ গরিবের খেলাই কিনা শেষ পর্যন্ত মেডেল এনে দিল।”

”সোনারটা যদি হত।”

”রাখ তোর সোনা। মেডেল ইজ মেডেল। যাদব এখন পৃথিবীতে তিন নম্বর লোক। পৃথিবীর জনসংখ্যা কত জানিস?”

”না। কত এখন?”

রবিবাবু অপ্রতিভ হয়ে মাণ্টাবাবুর দিকে তাকালেন, ”মাণ্টা, এখন কত?”

মাণ্টাবাবু মাথা নাড়লেন। আঙুল দিয়ে অনাদিবাবুকে দেখালেন।

”অনাদি, পৃথিবীর জনসংখ্যা কত এখন?”

অনাদি মাস দুয়েক আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান খুলে গাল চুলকোচ্ছিল। প্রশ্ন শুনে বলল, ”পৃথিবীর জনসংখ্যা?…এখন?…তা ধরুন গিয়ে, আড়াইশো কোটির একটু বেশিই হবে।”

”বোঝ তা হলে? যাদবের পজিশানটা কী!”

”রবিদা, আড়াইশো কোটির মধ্যে মেয়েরা আছে, বাচ্চচারা আছে, ওরা কুস্তি করে না, ওদের বাদ দেওয়া উচিত।” মাণ্টাবাবু কপিতে হেডিংয়ের পাশে কত কলমে আর কত পয়েন্টের টাইপে হবে সেটা লিখে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে টেবলে রাখলেন। তা ছাড়া যাদব ব্যান্টমওয়েট, মানে একশো সাড়ে পঁচিশ পাউন্ডের ক্যাটাগরিতে লড়েছে। আপনি শুধু ব্যান্টামদের সংখ্যাটাই ধরে বলুন ওদের মধ্যে তৃতীয়।”

রবিবাবু হঠৎ উত্তেজিত হয়ে টেবলে কিল মেরে বলে উঠলেন, ”এই তোমাদের এক দোষ। কলোনিয়াল শ্লেভারির হ্যাংওভারটা এখনও কাটল না। সবসময় নিজেদের ছোট করে দ্যাখে! আড়াইশো কোটিতে তোমার আপত্তি কেন?”

”না না, আপত্তি করব কেন?” মাণ্টাবাবু কুণ্ঠিত স্বরে কাঁচুমাচু মুখে বললেন। ”কোটি কোটি লোক কুস্তি করে, তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ ব্যান্টম…”

”থামো, বাজে কথা বলো না। কোটি কোটি লোক কুস্তি করলে পৃথিবীর স্বাস্থ্য অন্যরকম হত। গ্যাসট্রিক, ব্লাডপ্রেসার, হার্টের ব্যামো—ট্যামো বলে কিছু থাকতে না। …নারান দুটো তুলে নে।”

”এখন নয়, রাতে রুটির সঙ্গে খাব।”

হাঁড়িতে এখনও কয়েকটা রসগোল্লা ডুবে আছে রসের নীচে। বেশ বড় সাইজই, বোধ হয় দু’আনাওলা। টোলুবাবুর জন্য রেখে দিতে হবে। দুটো হাঁড়িতেও রয়েছে প্রচুর রস।

”এত রস কী হবে, আমি বাড়ি নিয়ে যাব?” নারান কিন্তু কিন্তু করে বলল রবিবাবুকে।

”নিয়ে যা। চিনির রস, খাবি আর ডায়াবিটিসের খপ্পরে পড়বি। তবে তোর হবে না। যারা খাটাখাটনি করে না, গাড়ি চড়ে বেড়ায় এ রোগ তাদের হয়। বুঝলি নারান, পরিশ্রম করবি। এই দ্যাখ, যাদবের বিভাগে সোনা জিতেছে যে জাপানিটা, শোহাচি ইশি তার নাম। এ জুডো লড়ত,…জুডোকা বলে এদের। যুদ্ধে জাপান হেরে গেল।

আমেরিকানরা দখল করল দেশটা আর বন্ধ করে দিল জুডো। ইশি তখন জুডো ছেড়ে শুরু করল কুস্তি। ভাবতে পারিস, একটা খেলা থেকে আর একটা খেলায় যাওয়া কি সোজা ব্যাপার? কী পরিশ্রম, কী মনের জোর থাকলে তবেই এভাবে বদল করে যাওয়া সম্ভব। আর শুধুই কি যাওয়া!…রাশিয়া, ইরান, টার্কি, হাঙ্গারি, জার্মানি, এইরকম কুড়িটা দেশের কুড়িজন ওয়ালর্ড ক্লাস কম্পিটিটরের মধ্যে একেবারে সোনা জিতে নেবার মতো যাওয়া! যুদ্ধের পর জাপানের এটাই প্রথম ওলিম্পিক সোনা…কী নিষ্ঠা, কী চেষ্টা…কপিতে অবশ্য আমি এসবও জুড়ে দিয়েছি।”

”তা হলে যাদবের থার্ড হওয়াটাও খুব বড় ব্যাপার!” নারান অন্তরের গভীর থেকে বলল। শিবপোতার জীবন থেকে ধান্যকুড়িয়ার জীবনে আসার মতোই তার মনে হল, ইশির জুডো থেকে কুস্তিতে আসাটা। এক জমি থেকে গাছ তুলে অন্য ধরনের জমিতে পুঁতে ফল ধরানোর জন্য গাছকেও তো কম চেষ্টা করতে হয় না! শরীরে কষ্ট, মনের কষ্ট ইশিকে যে কতটা সইতে হয়েছে মর্মে মর্মে সে তা অনুভব করতে পারছে।

”নারান কপি জমে গেছে, প্রেসে দিয়ে এসো।” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাণ্টাবাবু বললেন। ”টোলুদা এখনও এলেন না, এ দিকে এত কপি জমি গেছে! …ও অনাদি, একটু হাত চালাও।”

নারান এসে প্রেসে কপি দিয়ে ফিরে আসার সময় সুপারভাইজার সরল ঘোষ বললেন, ”ওপরে যাচ্ছ তো, রিডিংয়ে এই প্রুফটা দিয়ে দিয়ো। আর বলো তাড়াতাড়ি দেখে যেন প্রেসে পাঠিয়ে দেয়।”

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নারান প্রুফটা একবার চোখের সামনে ধরেই থমকে গেল।

”মল্লবীর কে ডি যাদবের কৃতিত্ব

ব্যগ্র দৃষ্টিতে সে বিড় বিড় করে পড়ে গেল খবরটা : ”ভারতীয় ব্যান্টমওয়েট মল্লবীর কে ডি যাদব ফ্রিস্টাইল কুস্তি যুদ্ধে তৃতীয় স্থান অধিকার করিয়া বিশ্ব ওলিম্পিকের ব্রোঞ্জ পদক লাভ করিয়াছেন। কে ডি যাদব সর্বপ্রথম ভারতীয় যিনি বিশ্ব অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত হইলেন। যাদব শেষ লড়াইতে পরাজিত হইয়াছেন সত্য, কিন্তু সারা সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন রাউন্ডের লড়াইতে তিনি ত্রুটিহীন মল্লযুদ্ধের অবতারণা করায় পদক লাভ করিয়াছেন।—পি টি আই”

”এই নারান, রবিবাবু ডাকছেন তোকে।” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অনিল বলে গেল।

রিডিং বিভাগে প্রুফটা দিয়ে সে রবিবাবুর কাছে হাজির হল।

”মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল চ্যারিটি ম্যাচটা দেখতে যাবি? আমার কাছে একটা টিকিট আছে। আমি তো সব খেলা দেখি না।”

”আমি বিকেলে সময় পাব না।” নারান লক্ষ করল টোলুবাবু আসছেন। ”আপনি বরং টোলুবাবুকে দিতে পরেন।

নারানের কথাটা টোলুবাবুর কানে গেল। তিনি হাত নেড়ে বললেন, ”না না না, টিকিটে আমার দরকার নেই।”

মাণ্টাবাবু ফোড়ন কাটলেন, ”রবিদার দেওয়া টিকিট নিয়ে প্রেসের কম্পোজিটার রতন এবারের প্রথম ম্যাচটা দেখেছিল। মোহনবাগান সেজন্যই এক গোলে হেরেছিল। তাই রবিদা ইস্টবেঙ্গলের পয়া লোক। টোলু ও টিকিট নেবে না।”

”দ্যাখো মণ্টা, তুমি বড্ড বাজে কথা বলো। রবিদা মোহনবাগানের অপয়া, এমন কথা কোনওদিন আমি বলিনি। গত তিন বছর ইস্টবেঙ্গল শিল্ড ঘরে তুলল, দু’বার মোহনবাগানকে হারিয়ে। সে তো, ভাল খেলেছে বলেই! তিনবারই রবিদার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে ভাগনেকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেজন্যই যে ইস্টবেঙ্গল জিতেছে…এমন কুসংস্কার আমার নেই। এবার লিগে পাঁচটা ম্যাচে মোহনবাগান এখন পর্যন্ত হেরেছে, তার মধ্যে লাস্ট ছ’টা ম্যাচে তিনটেতে। এই ছ’টা ম্যাচে একটা গোলও করতে পারেনি। ভাবতে পারো মণ্টা?…আরও হারবে, আমি বলছি দেখে নিয়ো ক্যালকাটা গ্যারিসনের কাছেও হারবে, শেষকালে রেলিগেশন ফাইট করতে হবে…তুমি এর পর আর আমাকে বিদ্রূপ কোরো না।”

গলা ধরে এল টোলুবাবুর। ঝপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। চোখ ছল ছল করছে। মাণ্টাবাবু মুচকি হেসে বললেন, ”কপি ধরো টোলুদা, অনেক খবর জমে রয়েছে। এই দ্যাখো, ইন্ডিয়ান ওয়াটারপোলো টিম ষোলো—এক গোলে ইতালির কাছে হেরেছে। ধরো, ধরো।”

”ধরছি। কিন্তু তুমি রবিদা সম্পর্কে আমার যে মিথ্যে ধারণা…রবিদা, রবিদা। দিন আপনার টিকিটটা। আমার যে কুসংস্কার নেই এটা অন্তত প্রমাণ হোক। ওই ভাগনেকেই টিকিটটা দেব।”

রবিবাবু মুখ নামিয়ে কপি লিখছিলেন। মুখ না তুলেই পকেট থেকে টিকিট বার করে এগিয়ে দিলেন। টোলুবাবু সেটা একবার দেখে নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, ”টাকাটা কাল দিয়ে দেব।”

”তা দিয়ো। কিন্তু আজ বোধহয় হকি ফাইনালের রেজাল্ট আসবে। টেলিপ্রিণ্টারের দিকে নজর রেখো।…আর হাঁড়ি থেকে দুটো রসগোল্লা তুলে নাও। যদি বেশি থাকে তা হলে তিনটেও খেতে পারো।”

টোলুবাবু নারানের দিকে তাকালেন। নারান বলল, ”কুস্তিতে ভারত মেডেল জেতার জন্য রসগোল্লা খাওয়াচ্ছেন।”

”রবিদা, হকি ফাইনাল আজ নয় তরশু, ওইদিন জ্যাটোপেকেরও পাঁচ হাজার মিটার আছে।” অনাদি অভিধান সরিয়ে রেখে খবরটা দিয়ে বলল, ”নারান রসগোল্লা একস্ট্রা থাকলে বলো।”

ফাইনাল আজ হচ্ছে না শুনে টোলুবাবুর মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল। রাত্রে প্যাঁচালো ইংরেজি নিয়ে কুস্তি করার ধকল, আজ আর অন্তত নিতে হবে না।

”নারান, একটা রসগোল্লাও আর অনাদিকে দেবে না।” মাণ্টাবাবু নির্দেশ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। থাকেন ব্যান্ডেল, ট্রেন ধরতে হবে। ”কালীঘাট—রাজস্থান ম্যাচ লিখতে দশবার অভিধান কেন যে খুলতে হয়, এটা বুঝিয়ে না বললে ওকে আর রসগোল্লা নয়।”

বিব্রত এবং লজ্জিত মুখে অনাদি বলল, ”গ্রাস কাটিং শট—এর বাংলাটা ঠিকমতো করতে পারছিলুম না বলে একটু খুলে দেখছিলুম।”

”তা ওটার মধ্যে ঘাস টাস কিছু পেলে?” রবিবাবু প্রশ্ন করলেন।

”না।”

”তা হলে বইটা মুড়ে রাখো। এটা ইংরেজদের খেলা। তার রিপোর্টে দু—চারটে ইংরিজি থাকলে লোকের বুঝতে অসুবিধে হবে না। গোলপোস্টের কি কোনও বাংলা তুমি করবে? তেমনি ঘাস ছাঁটাই শট লিখলে জিনিসটা হাস্যকর হবে।”

নারান, দাঁড়িয়ে শুনছিল। ভাবল, ঘাস নিড়নো শট বললেই তো হয়! কিন্তু সাহস করে সে বলতে পারল না। এখানকার বাবুরা লেখাপড়া জানা লোক, যদি চটে যান?

”নারান এবার অনাদিবাবুকে রসগোল্লা, যদি একস্ট্রা থাকে তো দাও।” বলতে বলতে মাণ্টাবাবু রওনা দিলেন।

রাত্রে পাতা সাজিয়ে দিয়ে প্রেস থেকে উপরে উঠে এসে টোলুবাবু পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকালেন ওষুধের বড়ির জন্য। হাতে উঠে এল চ্যারিটি ম্যাচের টিকিটটা। সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি এক টানে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর কুচি কুচি করে টেবলের নীচে ছুড়ে ফেলে পিছন দিকে তাকাতেই দেখলেন নারান ব্যাপারটা আবাক চোখে দেখছে।

”ছিঁড়ে ফেলে দিলেন?”

”দিলুম। রবিদার দেওয়া টিকিট নিয়ে মঠে যেই যাক, মোহনবাগান হারবেই। …এবার আর কেউ যেতে পারবে না। সে পথ মেরে দিলুম। তিনটে টাকা গচ্চচা গেল তো বয়ে গেল! তুই যেন বলে দিসনি। জল দে, ওষুধ খাব।”

”আপনার রসগোল্লা আগে খেয়ে নিন।”

”না না, রবিদার দেওয়া কোনও জিনিস শনিবারের আগে নেওয়া যাবে না। আমার ভাগেরটা তুই খেয়ে নে।…ব্যাপারটা কী জানিস, পয়া—অপয়া বলে একটা কথা আছে। খুব খাঁটি কথা। আমি এটা মানি।…জল দে।”

নারান জলের গ্লাস এনে দিয়ে বলল, ”ইন্ডিয়া দশ গোলে হেরেছে, আপনি সেটা কাল নিজের হাতেই লিখেছেন। অথচ আমায় বললেন, কী যে হবে, যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে খেলা! রেজাল্টটা জেনেও কিন্তু আপনি না—জানার ভান করলেন।”

”আহ নারান, তোকে কী করে যে বোঝাই। টেন টু ওয়ান,…ওয়ানটা হল আমেদের গোল, তার মানে ইস্টবেঙ্গলের গোল, তোর টিমের লোকের দেওয়া গোল!…আমার কী এমন মাথাব্যথা তোকে ওই খেলার রেজাল্ট জানাবার? দশ গোল একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ওলিম্পিক রেকর্ডও হতে পারে। কেন জানি মনে হল, মোহনবাগানও যদি গোল খাওয়ার রেকর্ড শনিবার করে ফেলে! …আর এক গ্লাস দে।”

নারান জল নিয়ে ফিরতেই টোলুবাবু উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন, ”পায়ে কী হয়েছে? খোঁড়াচ্ছিস কেন?”

”কাল ছুটতে ছুটতে শেয়ালদা যাবার সময় একটা পেরেক ফুটেছিল। ব্যথা হয়ে এখন টাটাচ্ছে।”

”গরম জলে কম্প্রেস কর আর বোরিক পাউডার লাগা। অবহেলা করিসনি।”

টোলুবাবু শুয়ে পড়লেন। নারান ঘড়ি দেখল। আর দেড় ঘণ্টা পর অফিস থেকে ভ্যান রওনা হবে কাগজ নিয়ে। আটটা রসগোল্লা রয়ে গেছে। হাঁড়ি থেকে তুলে খেতে গিয়ে নয়ন আর মহামায়ার মুখ তার চোখে ভেসে উঠেছিল। নয়ন কোনওদিনই রসগোল্লা খায়নি। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খাবে ঠিক করে সে আবার রেখে দেয়।

চোখে মুখে জল দিয়ে হাঁড়ি হাতে যখন সে নেমে এল তখন ভ্যানে কাগজ তোলা হচ্ছে। গোবিন্দবাবু তাকে দেখে বললেন, ”একটু দাঁড়াও, আগে কাগজ তোলা হোক।”

নারান অপেক্ষা করতে লাগল। তার জীবনের চব্বিশ ঘণ্টার একটা পরিচ্ছেদ এইভাবেই শেষ হল। এরমধ্যে সে উদ্বেগ, ভয়, খিদে, ক্লান্তি, যন্ত্রণা, রাগ সবকিছুই আস্বাদন করেছে। কিন্তু কোনওটিই তাকে হতাশ করেনি। দমিয়ে দেয়নি। হাঁসের গায়ে লাগা জলের মতো সবই ঝরে গেছে তার মন থেকে, দেহ থেকে। জোলো দুধের থেকে হাঁস যেমন জলটুকু বাদ দিয়ে দুধটুকুই খায়, সেও তেমনই দুঃখ বাদ দিয়ে সুখের কথাটুকুই মনে রাখে। যাদবের কথা, জ্যাটোপেকের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে এখন তার মনে পড়ছে। জাপানি ইশি তাকে বিস্মিত করেছে। টোলুবাবু, রবিবাবুকে তার আরও ভাল লাগছে।

ভ্যানে চড়ে শেয়ালদার দিকে যেতে যেতে খুব যত্নে কোলের উপর রাখা হাঁড়িটা সে মমতা ভরে আঁকড়ে ধরল।

।। ২।।

”ভারত উপর্যুপরি পঞ্চমবার বিশ্ব হকি চ্যাম্পিয়ান
দীর্ঘ চব্বিশ বছর একাদিক্রমে গৌরব অক্ষুণ্ণ
হল্যান্ড ৬—১ গোলে শোচনীয়ভাবে পরাজিত”

নারান প্রথম পাতায় চার কলাম হেডিংয়ের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হালকা গর্ব ছুঁয়ে যাচ্ছে মনকে। কাগজ উলটে খেলার পাতায় খুঁজল আর একটা খবর।

”চেকোশ্লাভাকিয়ার জ্যাটোপেক—দম্পতির রেকর্ড প্রতিষ্ঠা”

সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে নারান হাসল। ওরা তার থেকে মাত্র দু’বছরের ছোট কিন্তু একই দিনে তাদের তিনজনের জন্ম! একই দিনে দু’জনের দুটো সোনার মেডেল! কী অদ্ভুত ভাগ্য ওদের।

সাইকেলে উঠেই সে কাতর একটা শব্দ করল। পেরেক ফোটা গোড়ালি পেকে পুঁজ জমেছে। টোলুবাবু সেদিন বলেছিলেন বটে গরম জলের সেঁক দিয়ে বোরিক পাউডার দিতে। কিন্তু বোরিক আর কেনা হয়নি। মহামায়া গরম জল দিয়ে ধুয়ে, টিপে টিপে পুঁজ বার করে গাঁদাপাতার রস লাগিয়ে, শাড়ির পাড় বেঁধে দিয়েছে।

চাপ পড়লেই যন্ত্রণা হচ্ছে, তাই পায়ের পুরো পাতা প্যাডেলে রাখতে পারছে না। ওই ভাবেই সাইকেল চালিয়ে কাগজ বিলি করতে করতে সে ঝাউডাঙার বাদল নস্করের বাড়ি পৌঁছল।

ছেলেটি অপেক্ষা করছে রাস্তায় কাগজের জন্য। সাইকেল থেকে নেমে শেষ কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নারান বলল, ”আজ খুব ভাল খবর আছে।”

”জানি, ভারত হকিতে সোনা পেয়েছে। কাল রেডিয়োতেই শুনেছি।”

নারান একটু অপ্রতিভ হয়ে গেল। খবরটা প্রথম তার কাছ থেকে শুনে, ছেলেটির মুখে ফুটে—ওঠা খুশির আলো সে দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু সে দমল না। হকি ছাড়া অন্য খবরও তো আছে।

”জ্যাটোপেক আর তার বউ, দু’জনেই সোনা জিতেছে!”

ছেলেটি হকির খবরের মধ্যে ডুবে গেছে। নারানের কথা তার কানে ঢুকল না।

”ভারত হকির সোনার মেডেল জিতবে এটা তো জানা কথাই। কিন্তু স্বামী—স্ত্রীর জেতাটার মতো ঘটনা ক’টা ঘটেছে?”

ছেলেটি মুখ তুলে বলল, ”কে জ্যাটোপেক?”

নারান এবার হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল। ছেলেটা বলে কী।

”এই তো চার দিন আগেই কাগজে নাম বেরোল, দশ হাজার মিটার রেকর্ড করে আবার ওলিম্পিকের মতোই সোনা জিতেছে! তুমি লক্ষ করোনি?”

”রেকর্ড তো রোজ কতই হচ্ছে, কে মনে করে রাখে।”

ছেলেটি বাড়ির ভিতরে চলে গেল। নারান আবার সাইকেলে উঠল। আবার চোদ্দো মাইল চালিয়ে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। গোড়ালির এই যন্ত্রণাটা…একজোড়া চটি কিনতেই হবে। তিন—চার টাকার ধাক্কা। নারান ঠিক করল, সামনের মাসে মাইনে পেলেই কিনে নেবে।

শনিবার শেয়ালদা স্টেশনে নেমেই নারান কয়েকটি ছেলের কথা থেকে বুঝে গেল ইস্টবেঙ্গল জিতেছে।

”কয় গোলে?”

”এক…ফকরি…।”

নারান প্রশ্ন করেনি। অফিসে খেলার বিভাগে থমথমে ভাব। মাণ্টাবাবু একমনে ম্যাচ লিখে যাচ্ছেন। রবিবাবু ওলিম্পিক নিয়ে ব্যস্ত। অনাদি অভিধান আর কপির মধ্যে অবিরত যাতায়াত করছে। রাত ন’টায় এলেন টোলুবাবু। এসেই বললেন, ”মাণ্টা, এটা লিখেছ কি সিজনে এটা সিক্সথ ডিফিট, লাস্ট সাতটা খেলায় একটাও গোল করতে পারেনি।”

”লিখব?”

”অবশ্যই। আর এটাও লিখো, সামনের বছর সেকেন্ড ডিভিশনে খেলতে হবে।”

রবিবাবু মুখ তুলে বললেন, ”টোলু তোমার ব্লাড প্রেসার আছে, একটু ঠাণ্ডা হও।”

”আমি মোটেই গরম হইনি। থার্মোমিটার থাকলে দেখিয়ে দিতাম, টোলু কখনও উত্তেজিত হয় না…নারান জল।”

নারান দ্রুত জল এনে দিল। এক চুমুকে শেষ করে টোলুবাবু বললেন, ”রবিদা যদি সন্দেশ খাওয়ান তাও খেয়ে নেব।”

”নারান, যা তো…” পকেটে হাত ঢোকালেন রবিবাবু।

”আমায় ভয় দেখাচ্ছেন?” টোলুবাবু বেপরোয়া ভাব দেখালেন। ”আমি সাংবাদিক…নিরপেক্ষ। আমার কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই। অ্যাই নারান, আমি সন্দেশ আনাব। আমি সবাইকে খাওয়াব…ইস্টবেঙ্গল জিতেছে, লিগ চ্যাম্পিয়ান হয়েই গেছে ধরে নাও।”

”টোলু, আমার পেটটা আজ সুবিধের নয়।” মাণ্টাবাবু বললেন। ”আমি উপোস দিয়েছি।”

”আমি তো মিষ্টি খাই—ই না।” রবিবাবু বললেন।

অনাদি আমতা আমতা করে বলল, ”টোলুদা, মাঠ থেকে ফেরার সময় আমার শ্যালক এগারোটা রাজভোগ খাইয়েছে, আমি আর…।” ঢোঁক গিলে কথা শেষ করল, ”খেলে বমি করে ফেলব।”

”নারান তুই?…নিশ্চয় তোরও পেট খারাপ।”

”আজ্ঞে,” মাথা চুলকে নারান বলল, ”আমারই তো খাওয়াবার কথা…তাই, আমি আর কোন মুখে খাব বলুন?”

টোলুবাবু গুম হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর রবিবাবু বললেন, ”টোলু, আজ আর তুমি কোনও কপি ধরো না। ভুলটুল হয়ে যেতে পারে।”

শোনামাত্র টেবলের উপর হামলে পড়ে, মাণ্টাবাবুর সামনে রাখা কপিগুলো টেনে আনতে আনতে টোলুবাবু বললেন, ”অনেক হয়েছে, এবার বাড়ি যান…দয়া করে।”

”যাচ্ছি। কাল ম্যারাথন, আমার অফ ডে…জ্যাটোপেক নামবে। যদি জেতে তা হলে একটা হিস্টরিকাল অ্যাচিভমেন্ট হবে। …মোহনবাগানের টানা সাতটা ম্যাচে গোল না করতে পারার মতোই। একটু ভাল করে লিখো।” কথাগুলো মাণ্টাবাবু বলে আর উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করলেন না।

মাঝ রাতে টোলুবাবু যখন প্রেস থেকে উঠে এলেন তখন নারান জিজ্ঞেস করল, ”রবিবাবুর দেওয়া টিকিটটা ছিঁড়ে ফেলে কিছুই তো হল না।”

”কে বলল হল না? মাঠে একটা লোক তো কম হল! হাজার পনেরোর বেশি আজ লোক হয়নি।…এ কী তোর পায়ে ছেঁড়া ন্যাকড়া বাঁধা কেন?”

‘পুঁজ বেরোচ্ছে।”

”সেপটিক হয়ে গেছে তা হলে। কাল অবশ্যই ডাক্তার দেখাবি।”

নারানের মুখ শুকিয়ে গেল। ডাক্তার দেখানো মানে তো চারটে টাকা, তারপর ওষুধের দাম। অন্য কেউ হলে নারান বলত, নিশ্চয় কাল দেখাব। কিন্তু টোলুবাবুকে সে যত দূর বুঝেছে তাতে আসল কথা ওঁকে খুলে বলা যায়। তাই সে বলল, ”ডাক্তার দেখাবার পয়সা কোথায় যে দেখাব? একজোড়া চটিও আমার কাছে বিলাসিতা।”

টোলুবাবু কয়েক সেকেন্ড নারানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে—ধীরে তাঁর চোখ থেকে হতাশা, ক্ষোভ, বিরক্তি সরে গিয়ে ফুটে উঠল মমতা। নরম গলায় বললেন, ”কাল তো তোর ছুটি, তা হলেও বিকেলবেলা চলে আয়। আমি ক্যাম্বেল হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। আমার এক বন্ধুর চেম্বার ওর সামনেই।…না না, পয়সা টয়সার কথা তোকে ভাবতে হবে না।”

পরদিন তিনটে পঞ্চাশের ট্রেনে নারান শেয়ালদায় নেমে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাসপাতলের সামনে এসে দেখল টোলুবাবু দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই ঘড়িবাঁধা হাত চোখের সামনে থেকে নামিয়ে একগাল হেসে বললেন, ”এসেছিস! বাঁচালি।”

”কী বাঁচালাম?”

”মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি এসে যাস তা হলে সামনের বছর লিগটা পাব। তুই চার মিনিট আঠাশ সেকেন্ডের মাথায় এসেছিস। চল।”

ডাক্তারের ঘরের বাইরে নেমপ্লেটে ডিগ্রির বহর দেখে নারান একটু অস্বস্তিতে পড়ল। এত বড় ডাক্তারের কাছে সামান্য একটা পেরেক—ফোটা দেখাতে আসা, তার মনে হল যেন একশো কাগজের একটা বান্ডিল নিয়ে যাওয়ার জন্য গোটা বনগাঁ লোকাল ভাড়া নেওয়ার মতোই।

সাত—আটজন রোগী অপেক্ষা করছে। তাকে বসিয়ে রেখে টোলুদা ডাক্তারের ঘরে ঢুকে গেলেন। মিনিট—তিনেক পর বেরিয়ে এসে বললেন, ”আয়।”

ডাক্তার টোলুবাবুর বয়সিই। গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি, লম্বা চওড়া। কাগজে কিছু লিখছেন, পাশে কম্পাউন্ডার দাঁড়িয়ে।

”হাঁদু, এই হচ্ছে আমার কলিগ নারান হালদার। চট করে ওর গোড়ালিটা একটু দেখে দে।”

ডাক্তার দু—তিনটে প্রশ্ন করলেন, গোড়ালির ক্ষতটা ভ্রূ কুঁচকে কুড়ি—পঁচিশ সেকেন্ড দেখলেন। একটা স্লিপে ঘস ঘস করে লিখে সেটা নারানের হাতে দিয়ে বললেন, ”ইঞ্জেকশনটা আনুন, এক্ষুনি দিতে হবে।” তারপর কম্পাউন্ডারকে বললেন, ”ইঞ্জেকশনটা দিয়ে, ড্রেস করে দাও।”

”সিরিয়াস কিছু কি?” টোলুবাবু উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন। ডাক্তারবাবু উত্তর না দিয়ে তাঁর নাম ছাপা প্যাডে লিখতে শুরু করলেন।

”নাম? বয়স?”

নারান বলল।

”আর একদিন দেরি করলে, ব্যাপারটা সিরিয়াসই হয়ে পড়ত। খাবার জন্য আর লাগাবার জন্য ওষুধ দিচ্ছি।”

টোলুবাবু নারানের হাত থেকে স্লিপটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে বললেন, ”আমি কিনে আনছি।”

কম্পাউন্ডার বলল, ”আপনি পাশের ঘরে আসুন।”

মিনিট—কুড়ি পর ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল ওরা। নারান গোড়ালি তুলে হাঁটছে। ইঞ্জেকশন কেনার টাকা আর কম্পাউন্ডারের ফি টোলুবাবুই দিয়েছেন, তাই সে কৃতজ্ঞতার ভারে বিব্রত।

”ওভাবে হাঁটছিস কেন, পায়ের পাতা ফেলে হাঁট।”

”একটু লাগছে…ব্যান্ডেজটাও নোংরা হবে না।”

”দাঁড়া এখানে।”

টোলুবাবু ওষুধের দোকানটায় ঢুকে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন হাতে ওষুধ, ব্যান্ডেজ আর তুলো নিয়ে।

”ধর এগুলো। ডাক্তারবাবু যেভাবে খেতে, লাগাতে বলে দিলেন, ঠিক ঠিক সেগুলো করবি।”

নারান শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

”দাঁড়িয়ে রইলি কেন, ট্রেন ধরবি তো?”

ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। বউবাজার স্ট্রিট যেখানে শেয়ালদায় পড়েছে সেখানে পৌঁছে টোলুবাবু বললেন, ”বাঁ দিকে চল, দরকার আছে।”

কোলেবাজারের পরই একটা জুতোর দোকান। নারানকে ইশারায় দোকানে ঢুকতে বলে টোলুবাবু ভিতরে ঢুকে গেলেন।

”কেডস দিন তো, আমার নয় ওর পায়ের।”

নতুন সাদা কেডস পায়ে নারান যখন দোকান থেকে বেরিয়ে এল তখন তার আর গুছিয়ে কথা বলার মতো অবস্থা নয়। টোলুবাবুর দুটো হাত ধরে সে কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলে ফেলল, ”আমি মন থেকে বলছি মোহনবাগান সামনের বছর লিগ পাবে, আপনি দেখবেন আমার কথা মিথ্যে হবে না।”

”আরে পাগল ছাড় ওসব কথা, এখন পায়ের কথা ভাব। এই দুটো পায়ের ওপর ভর দিয়ে তুই দাঁড়িয়ে তোর সংসার, বউ—মেয়ে দাঁঢ়িয়ে। এখন কি লিগ—শিল্ডের মতো সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো যায়? …তুই এত পরিশ্রমী, তোকে দেখেও যে আনন্দ হয়! …এখন আমি লিগ জেতার মতোই সুখ পাচ্ছি রে। এবার যা, টুক টুক করে হেঁটে স্টেশনে চলে যা।”

বিভ্রান্ত নারানকে দাঁড় করিয়ে রেখে টোলুবাবু চলে গেলেন। ট্রেনে কয়েকবার সে ভাবল, পরিশ্রম কী এমন জিনিস যে দেখে আনন্দ হয়? তার মাথায় ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না। তবে মহামায়াকে সে সবসময় সংসারের কাজ করতে দেখে, দেখে কেমন যেন এক ধরনের তৃপ্তি সে পায়। টোলুবাবু কি এটার কথাই বললেন? নিজেকে অপচয় না করে ব্যবহার করা এটা তো একটা গুণই! সবারই ইচ্ছে হয় নিজের গুণপনা দেখাতে। নারানের মনে হল, সে যা করে সেটা লোককে দেখাবার মতো কিছু নয়। এমন কিছু একটা করা দরকার যা দেখে সবাই বলবে—হ্যাঁ নারান হালদার একটা লোক বটে!

কিন্তু তার মতো গরিব মানুষ কী আর দেখাতে পারে? নারান নিজেকে প্রশ্নটা করে কোনও উত্তর পেল না।

পরদিন সকালে সে ধান্যকুড়িয়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া কাগজের বান্ডিলটা নিল। কৌতূহল ভরে খেলার পাতাটা খুলে তিন কলাম হেডিংয়ের দিকে তাকিয়েই তার হৃৎপিণ্ড মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।

এমিল জ্যাটোপেকের ওলিম্পিক ইতিহাস নতুন অধ্যায় রচনা ৫০০০ মিটার, ১০,০০০ মিটার ও ম্যারাথন দৌড়ে বিজয়ীর সম্মান লাভ।

তার হাতের কাগজটা থরথর কেঁপে উঠল। গোগ্রাসে খবরের বাকিটা তার চোখ গিলতে শুরু করল। একবার, দুবার, তিনবার সে পড়ল। তারপর সে কাগজের বান্ডিল নিয়ে হরিহর ভট্টাচার্যের দোকানের দিকে ব্যস্ত পায়ে এগোল। পায়ের ব্যথাটা এখন সে একদম টেরই পাচ্ছে না।

ম্যারাথন যে ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচিশ গজ এটা সে জানে। মাণ্টাবাবুই তাকে বলেছিলেন। সে রোজ সাইকেল চালায় আটাশ মাইল। থেমে থেমে, কিন্তু নাইট ডিউটি দিয়ে রাত জাগার পর, খালি পেটে। তা হলেও, নারানের মনে হল, কষ্টটা যে কী ধরনের সেটা সে বোঝে, তবে দুজনের পরিশ্রমের মধ্যে তুলনা করাটা ঠিক হবে না।

বত্রিশটা দেশের ছেষট্টি জন দৌড়েছে। সোজা কথা! এতগুলো লোকের সঙ্গে লড়ে প্রথম হওয়ার জন্য জ্যাটোপেকের একটা লক্ষ্য ছিল। তার কী লক্ষ্য? সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে নারান দু—তিনবার ভাবল—বড় কোনও লক্ষ্য নিয়ে কি সে সাইকেলটা চালাচ্ছে? কাগজ বিলি করাটাকে বড় ধরনের একটা লক্ষ্য হিসাবে কি ধরা যায়?

সাত দিনের মধ্যে তিনটে দূরপাল্লার কম্পিটিশন জেতা, তিনটেতেই ওলিম্পিক রেকর্ড করে! নারানের মনে হল, লোকটা অসুর। একাজ করাটা কোনও দেবতার কর্ম নয়। ভবিষ্যতে আর কেউ সাত দিনের মধ্যে এই তিনটে সোনা জিততে যে পারবে না, নারান এটা সম্পর্কে নিশ্চিত। মানুষের শরীরের ক্ষমতার সীমা যে কত দূর পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তার তো কোনও ঠিক—ঠিকানাই আর রইল না! তবুও তার মনে হচ্ছে, জ্যাটোপেক যে সীমায় নিজেকে টেনে নিয়ে গেছে, সেটাই বোধ হয় শেষ সীমা। লোকটা ম্যারাথন দৌড়ল কিনা এই প্রথমবার! কেউ বিশ্বাস করবে? নারান অবাক থেকেই রঘুরামপুর, তুবুড়িয়া হয়ে ঝাউডাঙায় পৌঁছল।

ছেলেটা প্রতিদিনের মতোই রাস্তায় অপেক্ষা করছে।

”কে জ্যাটোপেক বলেছিলে না? …রোজই তো কত রেকর্ড হচ্ছে? …দ্যাখো, পড়ো!”

ছেলেটির হাতে কাগজটা দিয়ে নারান দাঁড়িয়ে রইল। লক্ষ করতে লাগল ওর মুখভাব। মনে কোনওরকম দাগ কাটছে কি না সে বুঝতে পারছে না।

”এসব রেকর্ড ভেঙে যাবে।” ছেলেটি সাদামাটা স্বরে বলল।

”ভাঙবেই তো। ভাঙার জন্যই তো রেকর্ড! কিন্তু সাত দিনের মধ্যে এই রকম তিনটে কম্পিটিশন জেতা?…এ রেকর্ড কি ভাঙতে পারবে কেউ?”

ছেলেটির উত্তর শোনার জন্য সে আর অপেক্ষা করল না। বাড়িতে ফিরে প্রতিদিনের কাজ, ঘাস কাটা, গোরুদের খেতে দেওয়া ইত্যাদি সেরে সে ভাত খেতে বসল। ল্যাঠা মাছের ঝোল পাতে পড়তেই সে অবাক হয়ে মহামায়ার দিকে তাকাল।

”নয়ন সাঁতরাদের পুকুর থেকে ধরেছে।” মহামায়ার স্বরে চাপা গর্ব।

”নয়ন! ওইটুকু মেয়ে ধরতে পারল?”

”ওইটুকু কী? এই শ্রাবণেই তো সাত পেরোল। টিউকল থেকে কত কলসি জল আনে জানো? উঠোনের ওদিকে জঙ্গলটা তো ওই পরিষ্কার করেছে।”

শুনে ভাল লাগল নারনের। মেয়েটা কাজের হয়েছে। নামতাটা চটপট মুখস্থ করতে পারে। হাতের লেখাটা খুব পরিষ্কার নয়, তবে হয়ে যাবে।

”গরমেন নাকি রেশন দোকান পনেরো টাকা মণে চাল দেবে?” মহামায়া জিজ্ঞেস করল।

”অফিসের তাই তো শুনলাম, কিন্তু এই গ্রামে রেশন দোকান কোথায় যে চাল দেবে?”

”দোকান হলে বাঁচা যায়, চালের যা দাম বাড়ছে দিন দিন।”

”বাড়বে, আরও বাড়বে। লোক বাড়ছে আর চালের দাম বাড়বে না?” শেয়ালদা স্টেশনের অবস্থাটা যদি দেখতে। রোজ রিফিউজি আসছে। প্ল্যাটফর্মে, স্টেশনের ভিতরে, বাইরে আর হাঁটা যায় না। কী দুর্গন্ধ! দু’হাজার, আড়াই হাজার লোক। আমরা তো সেই তুলনায় স্বর্গে বাস করছি।”

খাওয়ার পর সে চাটাইয়ে শরীর এলিয়ে দিল। তারপরই কথাটা হঠাৎ মনে পড়ায় মুখটা পাশে ফিরিয়ে বলল, ”তোমায় সেদিন লোকটার কথা যে বললাম না, সেই জ্যাটোপেক গো!”

মহামায়া খেতে বসছে। ভাতের গ্রাস মুখে ঢুকিয়ে বলল, ”হুঁ, ওর বউ বর্শা ছোড়ে।”

”জ্যাটোপেক ম্যারাথনেও জিতেছে।” নারান কনুইয়ে ভর রেখে শরীরটা তুলল।

”অ।…গরম জলে পা ধোবে কখন, বেরোবার আগে? ….জিতেছে তো কী হয়েছে…রাতে খাবার ওষুধটা রুটির সঙ্গেই রেখে দোব না পকেটে আলাদা নেবে?”

জবাব না দিয়ে নারান শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগল অ্যালার্ম কখন বাজবে।

।। ৩।।

নারানের দিন কাটাতে লাগল একই ভাবে। অফিসে নাইট ডিউটি দিয়েই চলেছে। সকালেও কাগজ বিলি করে বাড়ি ফেরে আঠাশ মাইল সাইকেল চালিয়ে। এই কাজে তার ছুটি নেই। হরিহর ভট্টাচার্য তার মাইনে তিরিশ টাকা থেকে পরের বছরই ষাট টাকা করে দিয়েছে। দুটো গোরু মরে গেছে। সে আর নতুন গোরু কেনেনি। দুধের ব্যবসা আর করবে না, এতে লোকসানই হচ্ছে। নতুন একটা ঘর তোলার জন্য মাটি কোপানো হচ্ছে। আর তাদের একটি ছেলে হয়েছে। এখন তার বয়স তিন। নাম রেখেছে অবনী। মহামায়া আবার সন্তানসম্ভবা।

টোলুবাবুকে নারান বলেছিল, ‘সামনের বছর মোহনবাগান লিগ পাবে।’ কিন্তু পায়নি। তিপান্ন সালে লিগ পরিত্যক্ত হয়। তারপরের বছর লিগ—গোল্ড জিতে মোহনবাগান প্রথম ‘ডাবল’ লাভ করে। নারান গভীর শান্তি পেয়েছিল।

হেলসিঙ্কি ওলিম্পিকসের পর ইতিমধ্যে প্রায় চার বছর কেটে গেছে। ১৯৫৬, জানুয়ারি মাঝামাঝি, খেলার বিভাগে রবিবাবু, মাণ্টাবাবুর মধ্যে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ তার কানে এল জ্যাটাপেক নামটা। টেলিপ্রিন্টার রোল থেকে ছিঁড়ে রাখা খেলার খবরগুলো চিফ সাব—এডিটরের টেবলে আলাদা একটা স্পাইকে গাঁথা থাকে। স্পাইক থেকে কপিগুলো তুলে নিয়ে সে খেলার টেবলে এনে রাখল।

”অ্যালেনবরা কোর্সে দৌড়বে কি না বলতে পারব না, তবে মোহনবাগান স্পোর্টসে যে নামবে, এটা পাক্কা।”

”মান্টা খোঁজ নাও তা হলে! আর কোথাও দৌড়বে কি না, সেটা তো পাবলিককে জানানো উচিত! খবরের জন্য একটু হাঁটাহাটি করো।”

নারান আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, ”রবিবাবু, কে দৌড়বে?”

”জ্যাটোপেক। …এমিল জ্যাটোপেক। সেই যে হেলসিঙ্কি ওলিম্পিকে।…”

”তা জানি, কিন্তু কলকাতায়?” নারান অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

”হ্যাঁ কলকাতায়,” মাণ্টাবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন। ”কেন কলকাতা কি দৌড়বার মতো একটা জায়গা নয়?”

”তা নয়, তবে কিনা অতবড় একটা মানুষ,…কার সঙ্গে দৌড়বে?”

”হাতি, ঘোড়া, উটের সঙ্গে…আবার কার সঙ্গে!” বিরক্ত মাণ্টাবাবু কপি টেনে নিলেন। হাঁটাহাটি করতে বলায় উনি চটেছে।

”হেলথ মিনিস্টার রাজকুমারী অমৃত কাউর খেলাধুলোর উন্নতির জন্য যে স্কিম করেছেন, তাতে পৃথিবীর নামী নামী অ্যাথলিটদের আনা হবে। ভারতের নানান জায়গায় গিয়ে তারা, দৌড় দেখাবে, বক্তৃতা দেবে, ট্রেনিং দেবে। জাটোপেক এসেছে সেইজন্যই। ওর বউও এসেছে।” রবিবাবু অল্পকথায় নারানকে বুঝিয়ে দিলেন।

”আমি ওকে দেখব।” তার মুখ থেকে প্রথমেই এই কথাটা বেরিয়ে এল। তারপর বলল, ”কবে, কোথায় দৌড়বে আমাকে একদিন আগে বলে দেবেন? আমাকে বাড়ি থেকে আসতে হবে তো, সেইমতো ট্রেনে উঠব। আমাদের সিঙ্গেল লাইন, ট্রেন বড় লেট করে। কখন দৌড়বে জানা থাকলে সুবিধে হয়।”

”বলে দেব। তা ছাড়া কাগজেও তো খবর থাকবে।”

শনিবার ২১ জানুয়ারি সারা পশ্চিম বাংলায় হরতাল ডাকা হয়েছে। ভাষার ভিত্তিতে সীমানা পুনর্গঠনের দাবি উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবি মানছে না। তাই ভোর ছ’টা থেকে বিকলে চারটে পর্যন্ত হরতাল। নারানের ভয় হল। ওইদিনই তো জব্বলপুর থেকে ট্রেনে জ্যাটোপেকদের কলকাতায় আসার কথা!

”অনাদিবাবু, ট্রেন তো বন্ধ থাকবে, তা হলে ওরা তো পথেই আটকে থাকবে!”

”শনিবার সেইজন্যই ওরা কলকাতায় আসছে না, রবিবার আসবে। এই তো মাণ্টাদা খবর লিখে রেখে গেছেন। কপিটা প্রেসে দিয়ে এসো।”

প্রেসে দিতে যাবার সময় নারান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে লেখাটা পড়ে নিল। মোহনবাগান স্পোর্টসের খবরের মাঝখানে রয়েছে : আগামী ২৩ জানুয়ারি দ্বিতীয় ও শেষ দিবসে বিশ্ববিখ্যাত দূরপাল্লার দৌড়বীর এমিল জ্যাটোপেক ও মহিলা স্পোর্টসে ডানা জ্যাটোপেক অংশ গ্রহণ করিবেন।

২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন। নারান ক্যালেন্ডারে দেখল দিনটা সোমবার। শনিবার হরতালের দিন কাগজ ছেপে বেরোবে বটে, কিন্তু ট্রেন বন্ধ থাকায় সে কাগজ নিয়ে যেতে পারবে না। কাগজের ভ্যান দমদম পর্যন্ত যাবে। কিন্তু তাতে তার কোনও সুবিধে নেই। ওখান থেকে ধান্যকুড়িয়া ৩০ মাইল। শুক্রবার রাতে ডিউটি করে অফিসেই থেকে গিয়ে একদম শনিবার রাতের ডিউটি সেরে সে বাড়ি ফিরবে।

”সোমবার বিকেল চারটেয়, তাই তো?” এই নিয়ে নারান শনিবার অন্তত চারবার জিজ্ঞেস করল, অনাদি আর টোলুবাবুকে।

”হ্যাঁ, বাবা হ্যাঁ, চারটেয় মোহনবাগান মাঠে। মাঠটা চিনিস তো?” টোলুবাবু পিটপিট করে তাকালেন।

”তা চিনি, একবার ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে গেছলাম। দু’জনের একই মাঠ তো?”

”হুঁ।” টোলুবাবু বিরক্ত ভক্তিতে বললেন, ”জ্যাটোপেক মোহনবাগান মাঠে দৌড়বে।”

সোমবার সকালে কাগজ বিলি করে নারান, অন্যদিনের থেকে আজ বেশি ব্যস্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। ধান্যকুড়িয়া থেকে যখন মাইল চারেক দূরে তখন একটা গোরুর গাড়িতে পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়ে সাইকেলের চাকা গর্তে পড়ে গেল। সাইকেলটা টালমাটাল হয়ে গোরুর গাড়িতে ধাক্কা মারল, আর নারান ছিটকে রাস্তার ধারে পড়ল। চটপট সে উঠে দাঁড়াল আর শিউরে উঠে দেখল, সাইকেলের পিছনের চাকার উপর গোরুর গাড়ির চাকা উঠে গেছে।

নারান চোখ বুজল। একটা চল্লিশের ট্রেন ধরে শেয়ালদায়, তারপর মোহনবাগান মাঠে যাওয়া। এটাই সে ঠিক করে রেখেছে। সব ভেস্তে গেল! এই দুর্ঘটনার জন্য গোরুর গাড়ির কোনও দোষ নেই। গর্তটা গাড়োয়ান তৈরি করে রাখেনি যে ঝগড়া করবে।

”সাইকেলের চাকার যা অবস্থা, তাতে তো আর চালাতে পারবেন না! যাবেন কোথায়?” মাঝবয়সী গাড়োয়ান সহানুভূতি ভরে জানতে চাইল।

”ধান্যকুড়িয়া…তুমি যাবে কোথায়?”

”জবরগঞ্জ। ধান্যকুড়িয়া পথেই পড়বে, উঠে পড়েন।”

সাইকেলের চাকা আর মাডগার্ড দুমড়ে গেছে। কয়েকটা স্পোক ভেঙেছে। সেটাকে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে দিয়ে নারানও উঠে বসল। গাড়িতে আটটা চালের বস্তা।

”আমার কিন্তু কোনও দোষ নেই। আপনিই পড়লেন চাকার সামনে।”

”আরে আমি কি বলছি তুমি দোষী? বরাতে ছিল তাই ঘটে গেল। ….একটু জোরে চালাও, ট্রেন ধরতে হবে।”

রুগণ দুটো বলদ, পাচনের বাড়ি খেয়ে আর গাড়োয়ানের গালি শুনে দৌড়বার চেষ্টা করল। আধমাইল দৌড় দিয়েই হাঁফিয়ে আবার মন্থর হয়ে গেল, গাড়োয়ান আবার নির্দয়ভাবে পাচনটা দিয়ে এমন পেটাতে শুরু করল যে দেখে নারানের মায়া হল।

”থাক আর মেরো না। তুমি হরিহর ভটচাযের বইয়ের দোকান চেনো?”

”না।”

”যাকে বলবে দেখিয়ে দেবে। সেখানে এই সাইকেলটা নামিয়ে দিয়ে। বোলো নারান হালদার এটা পাঠিয়ে দিয়েছে, আজই যেন সরিয়ে রাখা হয়। কী করে এমনটা হল সেটা তুমিই বলে দিয়ো…গাড়ি এভাবে চললে ট্রেনটা পাব না। আমি এই মাঠের মধ্য দিয়ে হিজলতলা হয়ে শটকাটে স্টেশনে যাব।”

চলন্ত গোরুর গাড়ি থেকে নারান লাফ দিয়ে রাস্তায়, তারপর রাস্তা থেকে মাঠে নামল।

”যা বললাম পারবে তো?” ছুটতে শুরু করে নারান চেঁচিয়ে বলল, ”হরিহর ভটচাযের দোকান…সারিয়ে রাখতে বলো…আমার নাম নারান।”

এর পরই তার মনপ্রাণ নিবদ্ধ হল একটা চল্লিশের ট্রেনে। এখন ক’টা বাজে? ঠিক সময়ে স্টেশনে সে পৌঁছতে পারবে তো! একটা, না পৌনে একটা? এখান থেকে কতক্ষণ লাগবে স্টেশনে পৌঁছতে? সময় সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে না পেরে নারান, নিরাপদ হবার জন্য সেরা পন্থাটিই বেছে নিল। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল।

মসৃণ ঘাসের ট্র্যাকে জ্যাটোপেকের পাঁচ হাজার মিটার দৌড় দেখার জন্য নারান আলের উপর দিয়ে, চষা জমি মাড়িয়ে, ভাঙাচোরা রাস্তায় ঠোক্কর খেয়ে প্রায় হাজার মিটার পথ অতিক্রম করে যখন স্টেশনে পৌঁছল শেয়ালদা লোকালের গার্ড তখন হুইসল বাজিয়ে সবুজ পতাকা নাড়ছে।

ট্রেনে উঠে নারান বিজয়ীর মতো হাসল বেঞ্চে বসে থাকা একটি বাচ্চচা ছেলের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটিও হাসল কিছু না বুঝেই। পাশের লোকের হাতে ঘড়ি দেখে নারান জানতে চাইল, ”ক’টা বাজে?”

”পৌনে দুটো।”

”ট্রেন পাঁচ মিনিট লেট!”

মনে মনে সে হিসেব করতে শুরু করল, তিনটে পনেরোয় যদি শেয়ালদা পৌঁছয় তা হলে ট্রামে উঠে ধর্মতলা যেতে দশ মিনিট। আচ্ছা ধরা যাক, বারো মিনিট। তা হলে তিনটে সাতাশ…ধরা যাক, সাড়ে তিনটে! ওখান থেকে হেঁটে মাঠে পৌঁছতে পনেরো মিনিট…ধরা যাক বিশ মিনিটই। তা হলেও হাতে থাকবে দশ মিনিট।

নিশ্চিন্ত হয়ে নারান পিছনের কাঠের দেয়ালে হেলান দিল। এতক্ষণ যে উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা তাকে টানটান করে রেখেছিল সেটা ঝপ করে আলগা হয়ে গেল। সে ক্লান্ত বোধ করতে লাগল। এইবার সে বুঝতে পারল তার খিদে পেয়েছে। পেটটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে, আর সেই সঙ্গে বমির ইচ্ছে গলার দিকে উঠে আসছে।

সে ঢোঁক গিলল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠোঁট চাটল। একদম শুকনো। জলতেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু ট্রেনে জল কোথায়? লোকাল ট্রেনে এসব থাকে না। কারও কাছে কি একটু জল পাওয়া যাবে? সে এধার—ওধার তাকাল। দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রীরা জল নিয়ে ওঠে, লোকালে কে জল বয়ে নিয়ে যাবে!

এখন তার মনে হচ্ছে, বোধ হয় সে মরে যাবে। চোখের উপর ভেসে উঠল মোহনবাগান মাঠ। গ্যালারি উপচে পড়া ভিড়। ”জ্যাটোপেক….জ্যাটোপেক…জ্যাটোপেক” চিৎকার গ্যালারি থেকে গড়িয়ে নামছে। আর জ্যাটোপেক দৌড়ে চলেছে, হাত তুলে মাঝে মাঝে দর্শকদের উদ্দেশে নাড়ছে। …মরে গেলে সে আর ওকে দেখতে পাবে না।

নারানের চোখে জল এসে গেল। আর তখনই কর্কশ শব্দ করে ট্রেনটা, দু’—তিনটে ঝাঁকুনি দিল।

”কী ব্যাপার?” সামনের লোকটিকে সে প্রশ্ন করল ভীত চোখে তাকিয়ে।

”কী জানি! এর আগেও একবার ওরকম করেছিল।”

লোকটার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেই ট্রেনও দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই কারণ জানার জন্য জানলা আর দরজা থেকে মুখ বাড়াল। হঠাৎ মাঝপথে থেমে যাওয়ায় কেউ কেউ ভয় পেল। ডাকাত পড়বে না তো?

”দিনের বেলায় ডাকাত কোথায়?” একজন বলল। ”দেখুন এঞ্জিনের হয়তো কয়লা ফুরিয়ে গেছে!”

অনেকে ট্রেন থেকে নেমে কারণ জানতে গেল ড্রাইভারের কাছে। নারান পাশের লোকের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, ”সাত মিনিট গেল।”

হাতুড়ি মারার শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল, ”ব্রক আটকে গেছে। হাতুড়ি মেরে খোলার চেষ্টা করছে।”

এত দিন ধরে সে ট্রেনে যাতায়াত করছে, এক দিনও ব্রেক আটকাবার ঘটনা ঘটেনি। আর ঠিক আজকেই! নারান ঘড়ির দিকে তাকাল। এগারো মিনিট নষ্ট হল এখানে দাঁড়িয়ে, সে চোখ বন্ধ করল। খিদে আর তেষ্টা ধীরে ধীরে মরে আসছে। শরীরটা অসাড় লাগছে।

ট্রেনের সিটি দেবার শব্দে সে চোখ খুলল। যারা ট্রেন থেকে নেমেছিল, তাড়াহুড়ো করে তারা উঠছে। একটু পরেই ট্রেন চলতে শুরু করল। মন্থর গতিতে, এমন সাবধানে চলেছে যেন সামনেই কোথাও লাইনের ফিশপ্লেট খোলা রয়েছে! এভাবে চললে কতক্ষণে শেয়ালদায় পৌঁছবে? কতক্ষণে সে মাঠের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে চিৎকার করবে—”জ্যাটোপেক…জ্যাটোপেক…।”

শেয়ালদা পর্যন্ত ট্রেনটা ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে এল। নারান প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে দেখল, পৌনে চারটে। আর পনেরো মিনিট পর শুরু হবে দৌড়। ভিড় ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে লোক সরিয়ে সে ছুটল ট্রাম স্টপের দিকে।

নেতাজির জন্মদিন। রাস্তায় আজ লোক বেশি। জাতীয় পতাকা, নেতাজির ছবি আর ব্যান্ড বাজিয়ে শোভাযাত্রা বেরিয়েছে, গন্তব্য বোধ হয় শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। দু’দিকেই সার সার সবুজ রঙের ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়েছে, সেই সঙ্গে বাসও। ট্রামে বসে নারান স্টেশনের মাথায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের কিল বসিয়ে হতাশ স্বরে নিজেকেই বলল, ”ভাগ্য!…কেন যে ভূতে তাড়া করল!”

থেমে থেমে ট্রাম মৌলালি পৌঁছল, ধর্মতলা স্ট্রিট দিয়ে যদিও বা জোরে চলল, আবার আটকে গেল ওয়েলিংটন পার্কের মোড়ে। সভা হবে, তাই শোভাযাত্রা আসছে। হঠাৎ নারানের রোখ চেপে গেল। জ্যাটোপেকের দৌড় সে দেখবেই। এখন থেকে মোহনবাগান মাঠটা কতদূরই বা, সে ছুটেই যাবে।

ট্রাম থেকে নেমে সে ভিড়ের মধ্যে কখনও হনহনিয়ে হেঁটে, কখনও রাস্তায় নেমে দৌড়ে ছুটে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে থমকে দোকানের ঘড়িতে সময় দেখে নিচ্ছে।

….চারটে…চারটে তিন…চারটে সাত…চারটে দশ। এসপ্লানেড, কার্জন পার্ক, তারপর ভবানীপুর মাঠ। নারানের ফুসফুস আর বাতাস টানতে পারছে না। রেড রোড পার হয়ে মহামেডান তাঁবুর কাছে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে চোখে অন্ধকার দেখল। শরীর টলছে। সেই সময় সে শুনল প্রবল এক সমবেত হর্ষধ্বনি আর হাততালি।

নারান ধীরে ধীরে বসে পড়ল, নিশ্চয় দৌড় শেষ হয়ে গেল। দেখা হল না…দেখা হল না…। মাথা নাড়তে নাড়তে সে ঘাসে শুয়ে পড়ল।

”বিশ্ববিখ্যাত অ্যাথলিট, ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এমিল জ্যাটোপক, আপনারা দেখলেন, তিনি প্রথম হলেন। তাঁর সময় হয়েছে পনেরো মিনিট আঠারো সেকেন্ড। দ্বিতীয় হয়েছেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সুনীল বসু। তাঁর সময় হয়েছে : সতেরো মিনিট সতেরো দশমিক…” লাউডস্পিকারে ভেসে আসছে ঘোষকের গলা। নারানের চোখের পাতা বুজে এল।

তার চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে নামল।

।। ৪।।

তারপর দশটা বছর কেটে গেছে।

নারানের এখন আর পাকাপোক্ত নাইটি ডিউটি নেই। নাইট ডিউটি করলে একটাকা পাওয়া যাবে, এই নৈশ ভাতা চালু হতেই দাবি ওঠে, নারান একাই কেন ডিউটি করবে? সবাই যাতে ভাতার টাকা পায় সেজন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য বেয়ারাদেরও এই সুযোগ দিতে হবে। এর ফলে নারানকে টানা আট বছর নাইট ডিউটি করার পর সকালের বা বিকেলের ডিউটি শুরু করতে হল, আর সেই জন্য কাগজ বিলি করার কাজটা তাকে ছাড়তে হয়।

ইতিমধ্যে সংসারে মানুষও বেড়েছে। এখন তার এক মেয়ে নয়ন আর চার ছেলে—অবনী, নবনী, রজনী এবং গৌতম। নয়নের বয়স একুশ, অবুর, তেরো, নবুর নয়, রাজুর সাত আর গৌতমের এক বছর। ঘরও একটা বাড়িয়েছে। মাটির দেয়ালে টালির ছাদ। গোরু বিক্রি করে গোয়ালটা ভেঙে দিয়েছে। নয়ন ক্লাস সেভেন পর্যন্ত স্কুলে পড়ার পর, সংসারের আর ভাইদের দেখাশোনার জন্য স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কেননা মহামায়া তখন উলটোডাঙায় একটা কাঠের খেলনা তৈরির কারখানায় কাজ পেয়েছিল। হপ্তায় আঠারো টাকা মাইনে। মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য মহামায়া টাকা জমাতে শুরু করেছে। সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাত আটটায় ফিরত। অবুর টাইফয়েড হওয়ায় সে কাজটা ছেড়ে দিয়ে ঠোঙা তৈরিতে সময়টা দেয়।

এই দশ বছরে নারানের শারীরিক কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। একই রকম ছিপছিপে রয়েছে, চোদ্দো বছর আগে চাকরিতে ঢোকার সময় যেমনটি ছিল, শরীরে বাড়তি মেদ নেই, চুল একটিও পাকেনি, বয়স ছেচল্লিশ। রাতে স্বামী—স্ত্রী, নয়ন আর অবু, পুরো পরিবারই, ঠোঙা তৈরি করতে বসত। রাত দেড়টা পর্যন্ত তারা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা কাজ করত। ঠোঙা বিক্রি করত একটাকায় বারো দিস্তা।

অফিসে তার কাজের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। তবে রবিবাবু রিটায়ার করেছেন। নতুন দুজন খেলার বিভাগে এসেছেন, শ্যামল কুণ্ডু আর শৈলেন রায়। ওরা অল্পবয়সি, তাকে নারানদা বলে ডাকে। মাণ্টাবাবু টোলুবাবু, অনাদিবাবু একই রকম আছেন, শুধু চুল পাতলা হয়েছে, মুখের চামড়া আলগা হয়েছে, আর প্রত্যেকেই সামান্য মোটা হয়েছেন।

গত দশ বছরে নারানের জীবনে শুধু একটিই ঘটনা ঘটেছে, যেটা তার জীবনে একটা বড় ব্যাপার। ছয় বছর আগে, অফিসের বাৎসরিক স্পোর্টস দেখতে যাওয়া।

ময়দানে তালতলা মাঠে হত অফিসের স্পোর্টস। নারান শুনেছে, নানান বিভাগের নানান বয়সিরা এতে অংশ নেয়। বেয়ারাদের মধ্যে শুধু অনিল আর দিকপতি এতে নামে—তিনপায়ের দৌড়ে আর আধ মাইল ভ্রমণে। কর্মচারীদের ছেলেমেয়ে, বউদের জন্যও ইভেন্ট আছে।

তখন সবে নৈশ ভাতা চালু হয়ে নারানের নাইট ডিউটি বন্ধ হয়েছে। সেদিন রবিবার, ডিউটি ছিল সকাল দশটা—পাঁচটা। নারান স্পোর্টস দেখতে অফিস থেকে মাঠে চলে যায় দুপুরে। মাণ্টাবাবু স্পোর্টস সংগঠনের দায়িত্বে। এন্ট্রি নেওয়া থেকে শুরু করে, ইভেন্টের সূচী তৈরি করা, সভাপতি নির্বাচন থেকে প্রাইজ কেনাকাটার দায়িত্বটাও তাঁর।

শামিয়ানার নীচে বড় একটা টেবলে প্রাইজগুলো সাজানো। দেখেই নারানের মনে পড়ে গেল তার স্কুলের স্পোর্টসের কথা। ছোট ছোট কাপ আর মেডেলে সাজানো টেবলটা যেন দোকানের মতো হয়ে উঠত। দেখলেই লোভ হত, বাড়িতে এসে আলমারিতে সাজাবার। প্রতি বছর দু—তিনটে কাপ বা মেডেল সে জিতত। ক্লাস টেনে পড়ার সময় গো—অ্যাজ—ইউ—লাইকে জেতা কাপটাই ছিল তার জীবনের সব থেকে বড় কাপ। প্রায় এক হাত লম্বা। প্রথম প্রথম সে কাপ—মেডেলগুলো নিয়মিত ঝেড়েমুছে ঝকঝকে করে রাখত। তারপর আর যত্ন করত না। এক সময় রং চটে গিয়ে হলুদ হয়ে গেল। দেশভাগের পর, চলে আসার সময় ওগুলো ফেলে রেখে আসে।

এখন তালতলা মাঠে দাঁড়িয়ে প্রাইজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনের মধ্যে ছাত্রজীবনের চাঞ্চল্য জাগল। প্রাইজ জেতার ইচ্ছেটা আবার নতুন করে তাকে পেয়ে বসল। তবে অফিসের স্পোর্টসে কাপ—মেডেলের থেকে নিত্য ব্যবহারের জিনিসই বেশি। তা হোক, কাপ—মেডেল সাজাবার মতো কাচের আলমারি তার ঘরে নেই, বরং সংসারের প্রয়োজনে লাগার জিনিসই দরকার।

রিটায়ার করে গেলেও রবিবাবু স্পোর্টসের দিন মাঠে আসেন। শামিয়ানার ছায়ায় একটা চেয়ারে বসে অফিসের অ্যাকাউন্টস বিভাগের দুজন প্রবীণ লোকের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। নারান তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

”কী রে নারান, আছিস কেমন? তুই তো একটুও বদলাসনি দেখছি। …পরিশ্রম করাটা তা হলে চালিয়ে যাচ্ছিস?”

”কাগজ তো আর বেচি না, তাই খাটুনিটা কমে গেছে।” নারান চিন্তিত স্বরে বলল, ”তাই ভাবলাম একটু দৌড়োদৌড়ি করা দরকার। আপনি একটু মাণ্টাবাবুকে বলে দেবেন?”

”কেন, কী জন্য?”

”ভাবছিলাম স্পোর্টসে নামব।”

”ভাল কথা। নাম। কোন ইভেন্টে, নামছিস?”

”এখন আর কী করে নামি। পরশু দিনই তো এন্ট্রি নেওয়ার লাস্ট ডে ছিল।”

”আরে এটা ওলিম্পিক না এশিয়ান গেমস যে দেরিতে নাম দেওয়া যাবে না? ডাক মাণ্টাকে…এই যে অ্যাই, মাণ্টা, এদিকে আয়।”

হাতে কাগজপত্র নিয়ে মাণ্টাবাবু তখন মাঠের মাঝ থেকে ফিরছিলেন, রবিবাবুর ডাক শুনে এগিয়ে এলেন।

”আর কী কী ইভেন্ট বাকি রয়েছে?”

”অনেক বাকি আছে। ছোটদের স্পুন রেস, সেলাই রেস, জিলিপি রেস, মহিলাদের ব্যালান্স রেস, ফিফটি মিটার, মিউজিক্যাল…”

”থাক থাক, তুই তো ধ্যারারারা রেকারিং ডেসিমিল চালিয়ে দিলি দেখছি। বড়দের কী কী বাকি?”

”এইট হানড্রেড, ফোর হান্ড্রেড, টু হান্ড্রেড, স্যাক রেস, ওয়াকিং, থ্রিলেগেড রেস, টাগ অব ওয়ার।”

”নারানের নামটা নিয়ে নে। ও নামবে।”

”সে কী! এই লাস্ট মোমেন্টে। আচ্ছা নারান, তুই তো কালকেও আমাকে বলতে পারতিস!” মাণ্টাবাবু বিরক্ত হয়ে হাতের কাগজ উলটে—পালটে দেখলেন। ”একশো মিটার তো এইমাত্র হয়ে গেল, আচ্ছা তা হলে স্যাক রেস আর ওয়াকিংয়ে দিয়ে দিচ্ছি।”

”না না না।” নারান প্রায় আঁতকে উঠল। ”থলের মধ্যে ঢুকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আমি যেতে পারব না। ওসব বাচ্চচাদেরই সাজে।”

”তা হলে ওয়াকিংয়ে নাম।”

”না মাণ্টাবাবু, হাঁটাহাঁটি বুড়োদের মানায়।”

”তুই কি ছোকরা নাকি যে, হাঁটবি না শুধু দৌড়বি?” মাণ্টাবাবু তির্যক স্বরে বলেন।

”আমাকে বরং দৌড়ের ইভেন্টগুলোতে দিন।”

”দৌড়ের।” হাতের কাগজ দেখে চিন্তিতভাবে মাণ্টাবাবু বললেন, ”তা হলে দুশো মিটারে…পারবি তো?”

”আমাকে তিনটেতেই দিন…আটশো, চারশো আর দুশো মিটারে।”

”কী বললি! তিনটেতে? তুই কি জ্যাটোপেক হয়ে গেছিস ভাবছিস?”

নারান মাথা চুলকে বলল, ”একবার চেষ্টা করে দেখিই না।”

”তোর বয়স কত সেটা একবার ভেবে দেখেছিস? পর পর তিনটে রেস!”

”তিনটে রেস জুড়লে কত হবে?” নারান মনে মনে যোগ দিয়ে বলল, ”চোদ্দো শো মিটার। এক মাইলটাক হবে, না তারও বেশি?”

”এক মাইলের একটু কম। না না, অত তুই পারবি না। দৌড়বার অভ্যেস নেই, শেষকালে…”

”মাণ্টা ওকে নামতে দাও।” রবিবাবু এতক্ষণ ওদের কথা শুনে যাচ্ছিলেন, এইবার মুখ খুললেন। ”নারান এক সময় রোজ পঁচিশ—তিরিশ মাইল সাইকেল চালাত। ওর কলজে আর মাসল তৈরি আছে। নামিয়ে দ্যাখোই না!”

”নামাচ্ছি, কিন্তু কিছু হয়ে গেলে আপনি দায়ী হবেন।” মাণ্টাবাবু ব্যাজারমুখে আবার মাঠের ভিতর চলে গেলেন।

”কী রে নারান, তোর জ্যাটোপেক হবার শখটা এবার মিটিয়ে নে। পারবি তো?”

”রবিবাবু, আমি সাত জীবনেও জ্যাটোপেক হতে পারব না। উনি যে কাণ্ড করেছেন, পৃথিবীর সব থেকে বড় জায়গা ওলিম্পিকে করেছেন! কত বড় বড় পাল্লার কম্পিটিশন ছিল সেগুলো! আর তালতলা মাঠে আমি? তুলনা হয়?” নারান হেসে ফেলল। ”তবে একটা মিল ওঁর সঙ্গে আমার আছে, আমাদের জন্ম একই তারিখে।”

”তা হলেই হবে।” রবিবাবু ঠাট্টার সুরে বললেন। ”কাগজ বিলি আর নাইটি ডিউটি করে তুই যা পরিশ্রম করেছিস আমার তো মনে হয় না জ্যাটোপেক প্র্যাকটিসে অত পরিশ্রম করেছে। ঘাবড়াসনি, দুগ্গা বলে নেমে পড়।”

নারান নেমে পড়ল, হাঁটু পর্যন্ত ধুতিটা তুলে কোমরে গুঁজে নিয়ে। প্রথমে চারশো মিটার দৌড়। দুশো মিটারের ট্র্যাক। দু’পাক দৌড়তে হবে। তাকে নিয়ে ছ’জন প্রতিযোগী। স্টাটিং লাইনে মেশিন বিভাগের একজন আর সার্কুলেশন বিভাগের একজনকে দেখে নারানের মনে হল ওরা তার অর্ধেক বয়সি। এই দুজনকেই নজরে রাখতে হবে। এরা একেবারেই তার অজানা। বাকি তিনজনের মধ্যে রয়েছে দরোয়ান রামভরণ, পিওন রাধেশ্যাম আর রিপোর্টার মণিবাবু। এরাও তার থেকে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট। এরা যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এটা সে আন্দাজ করে নিল তাদের পেটের পরিধি থেকে।

স্টার্টার টোলুবাবু। নারানকে দেখে তো তিনি অবাক। ”এত বছর অফিসে স্পোর্টস হচ্ছে, অথচ স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে এই প্রথম তুই চারশো মিটারে নামলি।”

”আমি তো বেয়ারা ডিপার্টমেন্ট থেকে নেমেছি!”

”রাখ তোর বেয়ারা ডিপার্টমেন্ট। তুই আমাদের ডিপার্টমেন্টের লোক। যদি জিততে পারিস, তা হলে…” টোলুবাবু তিন সেকেন্ডের জন্য থমকালেন আর সেই ফাঁকে নারান বলল, ”ডুরান্ড ফাইনালে উঠে মোহনবাগান হারাবে ইস্টবেঙ্গলকে, তাই তো?”

”তোর ওই এক কথা, আগে ওরা উঠুক তো! তুই জিতলেই মোহনবাগান যেন জিতবে! আর তাই ভেবে নিয়ে নিজের টিমকে জেতাতে এখনই যেন হেরে বসিসনি। মনে রাখিস, ডুরান্ডের থেকেও বড় আমাদের ডিপার্টমেন্টের ইজ্জত। দু’ পাক শেষ করতে হবে কিন্তু সবার আগে।”

সবার আগেই সে শেষ করল। তার অর্ধেক বয়সিদের একজন, মেশিন বিভাগের ছেলেটি দ্বিতীয় হল তার পঁচিশ গজ পিছনে থেকে। সার্কুলেশনের ছেলেটি দেড়পাকের পর পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে। মণিবাবু তৃতীয় হলেন রামভরণ আর রাধেশ্যামের সঙ্গে, পরদিন কাগজে বেরিয়েছিল, ‘তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া’।

সার্কুলেশনের ছেলেটি শুরু করেছিল যেভাবে তাতে নারান একটু ভয়ই পায়। পঞ্চাশ মিটার রেসে দৌড়ের মতো গতিতে সবাইকে পিছনে ফেলে ছেলেটি অন্তত কুড়ি মিটার এগিয়ে যায়। মেশিনের ছেলেটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গতি বাড়িয়ে দেয় ওর সঙ্গে থাকার জন্য। নারান একই গতিতে বাকি তিনজনের পাঁচ মিটার সামনে থেকে দৌড়ে চলে। প্রথম পাক শেষ হতেই সে গতি বাড়িয়ে দেয়। দেড় পাকের আগেই দুজনকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে আসে। তখন তার মনে হল, এতক্ষণ সে হেঁটেছে এইবার দৌড়টা শুরু করা যাক। এবং তাই সে করল।

পশমের সুতো বুক দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেই সে ধাক্কা খেল টোলুবাবুর বুকে। নারানকে দু’ হাতে জড়িয়ে, দশ মাইল দৌড় শেষ করার মতো হাঁফাতে হাঁফাতে টোলুবাবু বললেন, ”আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল নারান তোর ছোটা দেখে। চারশো মিটারে এই প্রথম আমরা জিতলাম। আমার মনে হচ্ছে…”

”ডুরান্ড আপনারাই পাচ্ছেন।”

”না না, ওসব ভাবছি না…মনে হচ্ছে, দুশোটাও তুই জিতবি।”

নারান জিতল।

তাকে নিয়ে প্রতিযোগী আটজন। সবাই তার থেকে কমবয়সি। কিন্তু সে চিন্তিত নয়। চারশো মিটার তাকে গরম করে দিয়েছে। এখন সে দৌড়বার মজাটা পেয়ে গেছে। দূরত্বটা ছোট, তাই শুরু থেকেই সে এগিয়ে রইল আর একই গতি বজায় রেখে শেষ করতে তার অসুবিধা হল না। তার মনে হল, জ্যাটোপেককে দেখবে বলে ট্রেন ধরার জন্য যে গতিতে সে দশ বছর আগে দৌড়েছিল তার থেকে অনেক কম জোরেই দৌড়েছে।

”বড্ড ছোট মাপের দৌড়। বুঝলেন টোলুবাবু, খুব একটা আরাম হল না। আটশোটা চার পাকের, ওটা দৌড়লে বোধ হয় সুখ পাব, কী বলেন?”

”জিতলে তো তুই জ্যাটোপেক হয়ে যাবি রে…মানে, অফিসের জ্যাটোপেক!”

”আপনিও ওই নামটা করলেন! আমাকে লজ্জায় ফেলার জন্য দেখছি আপনারা সবাই ষড় করেছেন। নাহ, আটশো মিটার হেরে গিয়ে আমাকে এখন লজ্জা থেকে বাঁচতে হবে।” ক্ষুব্ধ স্বরে নারান বলল।

”প্লিজ, নারান, প্লিজ, তুই হারিসনি, তা হলে ডুরান্ডে সব্বোনাশ হয়ে যাবে।” টোলুবাবু আঁকড়ে ধরলেন নারানের দুই মুঠো।

”তা হলে ওঁর সঙ্গে কখনও আমার নাম একসঙ্গে উচ্চচারণ করবেন না বলুন? …হিমালয়ের সঙ্গে উইঢিপির কোনও তুলনা সম্ভব?”

টোলুবাবু জানালেন তিনি জ্যাটোপেক নাম আর উচ্চচারণ করবেন না। এখন বাচ্চচাদের আর মেয়েদের কয়েকটা ইভেন্ট, তারপর আটশো মিটার। বিশ্রাম দেবার জন্যই এইভাবে ইভেন্ট সাজানো। নারানকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন রবিবাবু।

”এই আটশো মিটারটা জিতলে তুই…”

”দোহাই রবিবাবু, আর আমাকে জ্যাটোপেক বলবেন না।” নারান জোড় হাতে অনুরোধ জানাল।

রবিবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, ”তিনটে ইভেন্ট জিতলেই জ্যাটোপেক হওয়া যায় নাকি? মাথা খারাপ না হলে কেউ তা বলতে পারে? আরে, আমি বলছিলাম কী, এটা জিতলে তুই প্রমাণ করবি, মানুষের যৌবন শুরু হয় চল্লিশ বছর বয়স থেকে…অবশ্য যদি সে অন্য ধাতুতে গড়া হয়!”

”ধাতুটাতু তো বুঝি না…লোহা, অ্যালমুনি ছাড়া আর কোনও ধাতুই আমার ঘরে নেই। …আমি কখনও দিতে হবে, দিতে হবে’ বলে ভিক্ষে করিনি। যতটুকু করেছি নিজের ক্ষমতায় করেছি। সেজন্য পরিশ্রম করেছি…টুকে কি মানে বই মুখস্থ করে পাশ করা হয়তো যায়, কিন্তু রবিবাবু শিক্ষিত হওয়া যায় না।” বলতে বলতে নারান উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। গলার স্বর থর থর কেঁপে উঠল যখন সে বলল, ”দশ বছর আগে জ্যাটোপেককে দেখার জন্য আমি দৌড়েছিলাম ট্রেন ধরতে, দৌড়েছিলাম ট্রেন থেকে নেমেও…দেখা হয়নি। তাইতে কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি! …জ্যাটোপেক আমাকে দৌড় শেখায়নি, আমাকে দৌড়বার জন্য বলেওনি। আমি নিজেই নিজের জন্য দৌড়চ্ছি।”

”বোস, বোস, এখন একটু ঠাণ্ডা হ।” রবিবাবু তাঁর পাশের খালি চেয়ারটা দেখালেন। নারান মাথা নেড়ে ঘাসের উপর বসল।

”একই তারিখে তোদের দুজনের জন্ম, এইটুকুই তো মিল।”

নারান সলজ্জ ভাবে ঘাড় নাড়ল।

”কিন্তু একই রকম বউও কি? জানিস, ওরা দুজন, এমিল আর ডানা, পরস্পরকে প্রেরণা দিত! তা হলে সেই গল্পটা বলি, হেলসিঙ্কিরই ঘটনা। এমিল তাঁর দ্বিতীয় রেস, পাঁচ হাজার মিটারে সোনা জিতলেন। তার কিছু পরেই ডানারও ফাইনাল—জ্যাভোলিনে। স্বামী দ্বিতীয় সোনা জিতেছে শুনে বউ ছুটে এসে মেডেলটা দেখতে চাইল। এমিল ওর হাতে দিলেন। ডানা বলল, ‘দারুণ ব্যাপার। এটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি’ ডানা মেডেল নিয়ে চলে গেল। এর আগের লন্ডন ওলিম্পিকে, তখনও ওদের বিয়ে হয়নি, ডানার পদবি তখন ইনগ্রোভা, জ্যাভেলিনে সেভেন্থ হয়েছিল। ডানা প্রথমবারই যে থ্রো—টা করল তাতেই সোনা, আর ওলিম্পিক রেকর্ড! লন্ডনে যতটা দূরে ছুড়েছিল এখানে তার থেকে সাড়ে পঁয়ত্রিশ ফুট দূরে ছোড়ে।”

”বলেন কী! চার বছরে এত উন্নতি? সা—ড়ে—পঁ—য়—ত্রি—শ ফুট! …খুব প্র্যাকটিস করেছিল।”

”শুধুই কি প্র্যাকটিস? স্বামীর ওই সোনা জেতাও কি শরীরে, মনে প্রেরণা জোগায়নি? মজার ব্যাপার হল, এমিল এটারই ইঙ্গিত দিয়ে ঠাট্টা করে বলল, বউয়ের সোনা জেতায় তারও হাত আছে। ব্যস, শুনেই তো ডানা রেগে উঠল। বলল, প্রেরণা জোগালেই বুঝি অতদূর পর্যন্ত জ্যাভেলিন ছোড়া যায়? কত তো মেয়ে রয়েছে, তাদের প্রেরণা জুগিয়ে দ্যাখো তো একবার, অতদূর পর্যন্ত ছুড়তে পারে কি না?’ নারান বোঝ তা হলে, দু’জনের মধ্যে কতটা মনের মিল থাকলে তবেই এমন ঝগড়া করা যায়। …একজন এমিলকে বলল, ‘দুটো সোনা তো জিতলেন, এবার ম্যারাথনটাও কি জিততে চান?’ এমিল বলল, ‘জ্যাটোপেক পরিবারে স্কোর এখন দুই—এক। ব্যবধানটা এত কাছাকাছি যে, বাড়িতে বোধ হয় খাতিরটা কমেই যাবে। ওটা আর একটু উঁচুতে তোলার জন্য এখন তো ম্যারাথন রেসে আমাকে চেষ্টা করতেই হবে!’ বোঝ নারান!” বলেই রবিবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।

আর তখনই আটশো মিটারের প্রতিযোগীদের স্টাটিং লাইনে আসার জন্য লাউস্পিকারে অনুরোধ জানানো হল। নারান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”বাড়িতে আমার খাতির নেই রবিবাবু। আমার বউ এক একরাতে ঠোঙা বানায় হাজারেরও বেশি আর আমার হয় বড়জোর সাতশো!”

স্টার্টিং লাইনে টোলুবাবু একা দাঁড়িয়ে। নারান বিস্মিত হয়ে বলল, ”আর সব কই?”

”আমিও তো খুঁজছি, গেল কোথায় সবাই?”

ঘোষণা হচ্ছে বার বার : ”আটশো মিটার দৌড়ের প্রতিযোগীরা, আপনারা এক্ষুনি আরম্ভ—সীমায় চলে যান…দেরি করবেন না। পরের ইভেন্টগুলো শুরু করতে তা হলে দেরি হয়ে যাবে। …দিস ইজ লাস্ট কল ফর দ্য…”

মাণ্টাবাবু এলেন হন্তদন্ত হয়ে।

”কেউ নামতে চাইছে না। মণিবাবু বললেন, ওঁকে এখনই একটা প্রেস কনফারেন্সে যেতে হবে, পল্টু বলল, ‘পেট ব্যথা করছে’, সুজয় বলল, ‘মাথা ধরেছে,’ রামভরণ আর বাসুদেবকে খুঁজে পেলুম না, বলাই মিত্তির আর গজুকে হাতে পায়ে ধরে রাজি করিয়েছি তবে ওরা এক পাকের বেশি দৌড়বে না বলেছে…এখন কী করি? ইভেন্টটা ক্যানসেল করে দেব?”

”না, না, করবেন না।” নারান প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ”কেউ না দৌড়লে আমি একাই দৌড়ব।”

”ব্যাপার কী, নামতে চাইছে না কেন?” টোলুবাবু জানতে চাইলেন। নারানের দিকে আঙুল দেখালেন মাণ্টাবাবু।

”আগের দুটো রেসে যেভাবে এগিয়ে থেকে নারান সবাইকে হারাল, তাইতে সবাই মনে করছে তারা বেইজ্জত হয়েছে। একজন বয়স্ক লোকের কাছে এত পিছিয়ে থেকে হার…অফিসে আওয়াজ খাওয়ার কথা ভেবেই ওরা…”

”মাণ্টাবাবু তা হলে আমি নামব না। আপনি ওদের বলুন যে নারান…”

”চঅঅপ।” টোলুবাবুর ধমকে নারান থতমত হল। ”ওদের জন্য তোর হ্যাটট্রিক বন্ধ হবে আমি থাকতে? ফাঁকা মাঠে গোল দিলে সম্মান থাকে না,…অসম্মান নিয়ে জিতবি কেন?…চল, আমি তোর সঙ্গে নামব। স্পোর্টস রিপোর্টিং করি, বুঝলি, স্পোর্টসম্যানশিপ দেখাতে জানি।”

টোলুবাবুকে অনেক বুঝিয়েও নিরস্ত করা গেল না। হার্ট, গ্যাস্ট্রিক, ব্লাডপ্রেশার, স্পন্ডলাইসিসের ভয় দেখানো হল, কিন্তু কিছুই কানে নিলেন না। সাব—এডিটর বলাই মিত্তির আর টেলিফোন অপারেটর গজুর সঙ্গে তিনিও হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে দাঁড়ালেন স্টার্ট নিতে। মাণ্টাবাবু হুইসল দিয়ে শুরু করালেন। সবাই ধীর গতিতে একসঙ্গে ছুটতে লাগল। নারান হুঁশিয়ার হয়ে রয়েছে, বাকি তিনজনের থেকে যেন সে একহাতও এগিয়ে নিয়ে যায়।

চার পাকের দৌড়। দেড় পাকের পরই গজুর মুখ লাল। হাঁপাচ্ছে।

”গজুবাবু চলুন, চলুন।” নারান পিছিয়ে ওর পাশে দৌড়তে দৌড়তে বলল, ”আদ্দেক তো প্রায় হয়ে গেছে, বাকিটাও হয়ে যাবে। আস্তে চলুন, আস্তে।”

টোলুবাবু ঠিক দু’পাকের মাথায় হাঁটতে শুরু করলেন। ”নারান আমি ফিনিশ করবই…একটু মোটা হয়ে গেছি এই যা। বুঝলি, আমি ফিটই আছি…যা যা তুই এগিয়ে যা, বুঝলি, সেই বায়ান্ন সালের মোহনবাগানের মতোই আমার অবস্থা! …জোরে ছোট।”

তৃতীয় পাক শেষ হবার আগেই গজু আর বলাই মিত্তির দাঁড়িয়ে গেলেন। নারান দৌড় শেষ করল রীতিমতো জোরে ছুটেই। টোলুবাবু তখন আড়াই পাকে। গম্ভীর মুখে তিনি, বাজার করে ফেরার গতিতে, ফিনিশিং লাইনের উদ্দেশে হেঁটে চলেছেন।

পরের ইভেন্ট শুরু হবার আগে শ্যামল কুণ্ডু অনুযোগের সুরে টোলুবাবুকে বলল, ”এভাবে হেঁটে হেঁটে ফিনিশ না করলেই পারতেন। আমাদের ডিপার্টমেন্ট নিয়ে সবাই এবার হাসাহাসি করবে।”

”করুক। চ্যাম্পিয়ান হতে পারব না, সেজন্য লিগের বাকি ম্যাচগুলো তাই বলে খেলব না? …তেমন হলে আমি হামাগুড়ি দিয়েও ফিনিশ করতুম। বুঝলে শ্যামল, এককালে কুস্তি শিখেছি গোবরবাবুর আখড়ায়, আমরা হলুম ওল্ড স্কুলের লোক।”

”টোলুবাবু তা হলে কী হল?” নারান প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি কথা পাড়ল। সে জানে গোবর গুহ আর গোষ্ঠ পালের কথা শুরু করলে টোলুবাবু থামতে পারেন না।

”কীসের কী হল?”

”ডুরান্ডের?”

”তোর ওই এক চিন্তা, কই আমার তো হচ্ছে না? আমি তো ধরেই রেখেছি, তুই তিনটেতে জিতলে ডুরান্ড নেবে…।” টোলুবাবু কথা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন।

বয়স্ক মহিলাদের মিউজিক্যাল চেয়ারের পর গো অ্যাজ ইউ লাইক। তারপর পুরস্কার বিতরণ। নারান পেল কেরোসিন স্টোভ, টেবলল্যাম্প, হাওয়া—বালিশ আর তিরিশ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ান হবার জন্য একটা ছোট কাপ। টোলুবাবু দ্বিতীয় হয়ে পেলেন একটা জলের ফ্লাস্ক। সেটা তিনি নারানকে দিয়ে দিলেন।

রবিবাবু পাঁচ টাকার একটা নোট নারানের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ”বাড়ি যাবার সময় রসগোল্লা কিনে নিয়ে যাস।…আজ আমার খুব আনন্দ হল।”

.

ধান্যকুড়িয়ায় নারান ট্রেন থেকে নামল রাত ন’টায়। স্টেশন থেকে বেরিয়েই বাজার। রাস্তার দুধারে নতুন কয়েকটা পাকা দোকান ঘর। ওষুধের দোকান, ডাক্তারখানা, শর্টহ্যান্ড টাইপ শেখার স্কুল, বাড়ি তৈরির মালমশলার দোকানের পর, আশুতোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দোকানের সামনে মুখোমুখি বেঞ্চে বসে পাড়ার কয়েক জন বয়স্ক লোক। ওদের মধ্যে রয়েছে তার জ্ঞাতিদাদা শচীন হালদার, চারু রায়, নন্দ ঘটক, শঙ্কর গারু এবং অপরিচিত একজন।

হাতের প্রাইজগুলো বেঞ্চে নামিয়ে রেখে নারান বলল, ”আশু পাঁচ টাকার রসগোল্লা দাও তো।”

সবাই তাকাল নারানের দিকে। শঙ্কর গারু বলল, ”বাড়িতে কুটুম টুটুম আসবে না কি?”

”না।”

”তবে, একেবারে পাঁচ টাকার রসগোল্লা?”

”পাঁচ টাকার না হলে বাড়ির অতগুলো লোকের মুখে কি আধখানা করে দেব?”

”ব্যাপার কী নারান, বাড়ির লোককে হঠাৎ যে রসগোল্লা খাওয়াচ্ছ?” চারু রায় কৌতূহল দেখাল।

নন্দ ঘটক বলল, ”নারান তোর সঙ্গের ওগুলো কী? কিনলি নাকি?”

ওদের কথার সুরে নারান হালকা ব্যঙ্গের ছোঁয়া পেল। আর মাথাটাও গরম হয়ে উঠল। সে কি এতই গরিব যে রসগোল্লা কিনলে বা হাতে কিছু জিনিস থাকলেই লোকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করবে?

”অফিসে স্পোর্টস ছিল…নেমেছিলাম। জিতে এগুলো পেয়েছি।” তার স্বর ঈষৎ রুক্ষ।

”বাঃ বাঃ, কিন্তু স্পোর্টসে তো কাপ মেডেল দেয়, তুমি তা পাওনি?” চারু রায়ের প্রশ্ন।

”পেয়েছি।” নারান মুখ ফিরিয়ে কথাটা বলেই আশুর দিকে তাকাল। ”চার আনাওলার দেবে। খানিকটা রসও দিয়ো। ….তোমার ওই ভাঁড়ে কুলোবে না। একটা ছোট হাঁড়িতে করে দাও।”

”পেয়েছিস তো একবারটি দেখা। আমাদের এ তল্লাটে তো এখনও পর্যন্ত কলকাতা থেকে কেউ কাপ—মেডেল আনতে পারেনি। এই বয়সে তুই…দেখা দেখা।”

”দেখে চক্ষু সার্থক করি।” নারানের মনে হল, এটা শচীনদার গলা। সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলে না, কিন্তু চিমটি কেটে টিপ্পুনীটা ঠিকই দিয়ে যায়।

”আমার অত সময় নেই দেখাবার।…আশু ওইটুকু রস দিলে? একটা ফাউ দেবে না?”

”ওরে আশু, একটা নয় দুটো দে, আমরা বরং চাঁদা তুলে তোকে দামটা দিয়ে দোব। নারান ধান্যকুড়িয়ার মান বৃদ্ধি করেছে, সোজা ব্যাপার।…কাপ—মেডেল পেয়েছে, তা সেটা নয় নাই দেখাল…মুখে বলেছে তাই যথেষ্ট!”

স্টোভের বাক্সের মধ্যে কাপটা সে রেখেছে। শঙ্কর গারুর কথা শুনে বাক্সর দড়ি খুলে কাপটা নিয়ে এগিয়ে গেল।

”এই দ্যাখো। বিশ্বাস হল?”

সবাই একটু থতমত হল। চারু রায় কাপটা হাতে নিয়ে তালুতে নাচিয়ে ওজন পরীক্ষা করতে করতে বলল, ”ছটাকখানেক হবে, রুপোর না কি রে?”

”ধ্যেত, রুপো না হাতি! কাঁসার ওপর রুপোর জল করা।”

”দাম কত হবে বল তো শচীন?”

”টাকাদেড়েক…সেকেন্ড হ্যান্ড হলে আরও কম।”

”আরে রুপো, কাঁসা, পেতল যাই হোক, একটা কাপ তো বটে! কচ্ছপের সঙ্গে দৌড়ে হোক আর শুঁয়োপোকার সঙ্গে দৌড়েই হোক, নারান জিতে এনেছে তো বটে। …একটা ফ্লাস্কও তো দেখেছি, ওরে বাবা টেবিলল্যাম্পও যে! হাতে ওটা কী রে নারান?”

নারানের মাথার মধ্যে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাগে তার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। সেই সময়ই আশু ডাকল, ”দড়ি বেঁধে দিয়েছি, নিয়ে যাও হাতে ঝুলিয়ে।”

কাপটা চারু রায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে স্টোভের বাক্সের মধ্যে রেখে দড়ি বাঁধল, ফ্লাস্কটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাওয়া—বালিশ বাঁধা ল্যাম্প আর স্টোভের বাক্স একহাতে আর অন্য হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি ঝুলিয়ে সে পা বাড়াল।

ইতিমধ্যে আরও নানা রকম ফুট কাটা চলছিল।

”নারানকে তো একটা সম্বর্ধনা দিতে হয়!”

”অবশ্যই। এতগুলো প্রাইজ জিতে আনল! কত টাকার মাল হবে বল তো?”

”ওকেই জিজ্ঞেস করো না। শেয়ালদা বাজার থেকে গাঁটের পয়সা খরচ করে ওই তো কিনেছে।”

শেষের কথাটা নারানের কানে গেল। সে আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে এসেই, হাতে ঝোলানো রসগোল্লার হাঁড়িটা আধাপাক ঘুরিয়ে, শচীন হালদারের মাথা লক্ষ্য করে বসাল। কিন্তু তার আগেই হাঁড়িটাকে দোলাতে দেখে বিপদের গন্ধ পেয়ে শচীন ”অ্যাই অ্যাই” বলে সামনে বসা শঙ্কর গারুর উপর লাফ দিয়ে পড়েছিল। হাঁড়িটা বেঞ্চের ওপর পড়ে চৌচির হল, ছিটকে গেল রসগোল্লা আর রস।

”মেরেই ফেলব, আজ মেরেই ফেলব।” শচীনের চুলের মুঠি ধরে নারান ঝাঁকাচ্ছে আর চিৎকার করে যাচ্ছে, ”অনেক সহ্য করেছি, এবার শেষ করব।”

আশুতোষ দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে। চারু, নন্দ এবং আরও কয়েকজন নারানকে ধরে টেনে সরিয়ে নিল। দেখতে দেখতে সারা বাজার ভেঙে পড়ল। সবারই মুখে এক কথা, ”কী ব্যাপার? …কী হল নারান হালদারের? …খেপে গেল কেন?”

ডাক্তারখানার সিঁড়ির ধাপে নারানকে বসানো হয়েছে। ছড়ানো ছেটানো প্রাইজগুলো কুড়িয়ে এনে একজন তার পাশে রাখল। একটু দূরে একটা ভিড়ের মধ্য থেকে নন্দ ঘটকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

”পুলিশে দেওয়া দরকার, আমি এক্ষুনি থানায় যাব। খুন তো প্রায় করেই ফেলেছিল। ভাবো তো, অতবড় একটা হাঁড়ি যদি মাথায় পড়ত! আমি টেনে না নিলে শচীনদা তো মরেই যেত।”

নারানের সামনেও একটা ভিড়। মুখ নামিয়ে মাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে। একজন হাত ধরে বলল, ”চলো নারানদা, বাড়ি চলো।…মাথা গরম আর কোরো না!”

”সরে যা সামনে থেকে, একটা হেস্ত না করে…।” বলতে বলতে নারান মুখ তুলেই ঢোঁক গিলল।

”তার আগে আমার মাথা ফাটিয়ে তোমায় হেস্তনেস্ত করার কাজে নামতে হবে।” মহামায়া। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।

”বাড়ি চলো।”

ক্লান্ত, অবসন্ন পায়ে নারান বাড়ি ফিরল। সঙ্গে মহামায়া, নয়ন আর অবু। অন্ধকার উঠোনে গোঁজ হয়ে নারান বসে রইল। সারাদিনের কথা, টুকরো টুকরো ভাবে তার মনের মধ্যে আলোড়ন তুলে যাচ্ছে। আশুর দোকানের সামনে যা ঘটে গেল, সেটা ঘটতই না যদি সে স্পোর্টসে না নামত, যদি সে প্রাইজগুলো না পেত, যদি সে রবিবাবুর দেওয়া টাকায় রসগোল্লা কিনতে না যেত।

কেন যে মাঠে গিয়ে তার শরীর—মন আনচান করে উঠল এই চল্লিশ বছর বয়সেও? নারান খুঁজে পেল না এর উত্তর। প্রাইজ জেতার আনন্দ কষ্ট করে দিল তার চণ্ডালের মতো এই রাগ। নিজেকে সে বশে রাখতে পারে না কেন? তারও উত্তর সে পেল না। মহামায়া গিয়ে যদি তাকে টেনে না আনত, তা হলে সে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাতই। কৃতজ্ঞতায় তার মন আচ্ছন্ন হতে শুরু করল। মহামায়া না থাকলে তার পরিশ্রম কোনও কাজেই লাগত না, এই সংসার গড়ে তোলা, সন্তান পালন করা, এমন শৃঙ্খলার সঙ্গে কিছুই সম্ভব হত না, যদি…

”কে?” নারান উঠে দাঁড়াল। কে যেন অন্ধকার উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে।

”আমি আশু।”

”কী ব্যাপার?”

”এইটে ধরো।” আশু তার হাতের হাঁড়িটা এগিয়ে দিল। হারিকেন নিয়ে মহামায়া ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

”কেন?” নারান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

”ফেলে এসেছিলে তাই দিয়ে গেলাম।”

”কোথায় ফেলে এসেছি? আমি তো হাঁড়ি ভেঙে রসগোল্লা নষ্ট করে দিয়েছি!”

”তা দিয়েছ। এটা হল আমার দেওয়া প্রাইজ। তুমি কলকাতা থেকে কাপ জিতে এনেছ, এতে আমার আনন্দ হচ্ছে। এখানে কেউই তো কখনও কিছু জেতেনি, তুমিই প্রথম, নাও ধরো।”

আশু হাঁড়িটা এমনভাবে বাড়িয়ে ধরল যে, নারান হাতে না নিয়ে পারল না। কুণ্ঠিত স্বরে সে বলল, ”কিন্তু এমন কিছু তো বড় স্পোর্টস এটা নয়…অফিসের, সামান্যই ব্যাপার।”

”হোক সামান্য। সব জিনিসই সামান্য থেকে শুরু হয়, তারপর ধাপে ধাপে বড় হয়।”

”আরে, আমি চল্লিশ বছর বয়সে এখন আর কী বড় হব? এটা দৌড়োদৌড়ির কাজ বুঝলে আশু, বসে বসে সন্দেশ—রসগোল্লা বানানো নয়। ধাপে ধাপে বয়স বাড়বে যেমন, তেমনই ধাপে ধাপে দৌড়ের ক্ষমতাও কমে আসবে। জ্যাটোপেক বায়ান্নর ওলিম্পিক ম্যারথন জিতল, চার বছর পরের ওলিম্পিকে সিক্সথ… ”বলেই সে চুপ করে গেল।

আশু একগাল হেসে মহামায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ”বউঠাকরুন, নারানের সঙ্গে তো কথায় পারব না, খবরের কাগজের অপিসে চাকরি করে, অনেক খবর রাখে। মিষ্টিগুলো খেয়ে বলবেন কেমন লাগল। আচ্ছা, এখন চলি।”

রাতে ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ার পর, মহামায়া বলল, ”ধানের ব্যবসা করব।”

”কীসের?…ধানের ব্যবসা? তুমি?”

”আমি একা কী করে করব? সবাই মিলে করব। উলটোডিঙেতে কাজে যাবার সময় ট্রেনে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, নাম রমা, গুমার দিকে ওর বাড়ি। আজ সকালে বাজারে দেখি ও চালের দোকানে বসে। কথায় কথায় রমা বলল, ধান কিনে এনে, সেদ্দ করে, ধানমিলে ভাঙিয়ে এখন চাল বিক্রি করে। দিনে ছ’সাত মণ চাল তৈরি করে। বাড়িতে চার—পাঁচ জন লোক, সবাই হাত লাগায়। আমার আর কাজ করার মতো লোক কোথায়। অল্প করেই শুরু করে একবার দেখি না।”

”মুখে মুখে ধানের ব্যবসা করা খুব সোজা। ধান কিনে আনা নয় হল; তারপর সেদ্দ করা, শুকোনো, নাড়া দেওয়া, দেশের বাড়িতে দেখেছি তো, মাঝ রাত থেকে উনুনের কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তুষের জ্বাল দেওয়া, তারপর সারাদিন ধানের কাছে বসে থাকা, নাড়া দেওয়া। কম খাটুনি? সে তুমি পারবে না।”

”পারি কি না পারি সেটা পরে দেখা যাবে, আগে কাজে নামি তো। রাম বলেছে, যদি রাজি থাকি তা হলে ও আমায় সব জানিয়ে বুঝিয়ে দেবে।”

মহামায়ার কথা শুনে নারানের মনে পড়ল, বউ সোনা জেতার পর জ্যাটোপেকের কথাটা : বাড়িতে বোধহয় খাতিরটা কমেই যাবে। ওটা আর একটু উঁচুতে তোলার জন্য এখন তো ম্যারাথন রেসে আমাকে চেষ্টা করতেই হবে!

রসিকতা করে বলল, কিন্তু সংসারে এই ধরণের রেষারেষি তো হয়ই। বাবা—ছেলে স্বামী—স্ত্রী সবার সঙ্গে সবার…সংসার গড়ে তুলতে, প্রতিপালনের আর বাড়বাড়ন্তের জন্য কে কতটা সাহায্য দিতে পারে, তাই নিয়ে কম্পিটিশন চলে। মহামায়া কি তাকে পিছনে ফেলে এগোতে চাইছে?

নারানের আর একটা কথা মনে এল। আশুকে সে জ্যাটোপেকের কথা তুলে তখন বলল, বায়ান্নয় ম্যারাথন জিতে কিনা চার বছর পর সিক্সথ! তারপরেই সে চুপ করে গেছল। কথাটা বলেই তখন তার হুঁশ হয়েছিল, আশুর কাছে জ্যাটোপেকও যা আর জিবেগজাও তাই। বলে কোনও লাভ নেই, ওর মাথায় জ্যাটোপেক ঢুকবে না। যদি ঢুকবে বুঝত, তা হলে সে বলত—ছাপান্নর ওলিম্পিক শুরুর দেড় মাস আগে এমিল ট্রেনিং করছিল ডানাকে কাঁধের উপর তুলে। তখনই হার্ণিয়া শুরু হয়। অপারেশন হল। ডাক্তার বলল, দু’ মাস দৌড় বন্ধ রাখতে হবে। রবিবার গল্পটা বলতে বলতে থেমে গিয়ে বলেছিলেন, ”নারান, ওই মানুষটা আলাদা ধরনের। ওকে দমানো যায় না। দু’ মাস বন্ধ রাখার বদলে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পরদিনই আবার ট্রেনিং শুরু করে দিল। ওর সিক্সথ হওয়াটাই তো একটা অলৌকিক ব্যাপার।’

এসব কথা মিষ্টিগুলো আশুকে বলে কোনও লাভ হত না। সংসারটা ঘাড়ে নিয়ে সে এখনও শুধু হাঁটছে, দৌড় দিতে পারছে না। মহামায়া নিজের ঘাড়ে কিছুটা বোঝা তুলে নিতে চাইছে।

”কী হল, চুপ করে রইলে কেন? রমাকে বলেছি তাড়াতাড়িই ওকে জানাব। ও যদি পারে তা হলে আমিও পারব।”

”একটু ভেবে দেখি। পরে তোমায় বলব।”

সাতদিন পর ডুরান্ড ফাইনালে, খেলা দু’দিন ড্র রেখে যুগ্মবিজয়ী হল মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। নারানের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে টোলুবাবু বলেছিলেন, ”তুই এবার থেকে প্রত্যেক বছর স্পোর্টসে নামবি…উফফ, যা ঝামেলার মধ্যে থাকতে হয়? আমি অবশ্য ধরেই নিয়েছিলুম তুই তিনটেতে জিতলে একটা নতুন কিছু ডুরান্ডে এবার হবে। এরা আগে কখনও তো জয়েন্ট উইনার হয়নি।”

রাতে বাড়ি ফিরে নারান বলল, ”তুমি একা করবে কেন, দু’জনে জয়েন্টলিই কাজ করব, তাতে অনেক ঝামেলা কমে যাবে।”

।। ৫।।

অফিসের স্পোর্টসে নারানের প্রথম নামা আর ধান কিনে এনে চাল তৈরির ব্যবসা একই বছরে শুরু হয়েছিল। তারপর ছ’টা বছর কেটে গেছে অর্থাৎ জ্যাটোপেককে দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে তার ব্যর্থ হওয়ার পর দশ বছর! এর মধ্যে মহামায়া বছর তিনেক উলটোডাঙায় এক কাঠের খেলনা তৈরির কারখানায় কাজ করেছে, বাড়িতে ঠোঙা তৈরি করেছে তারপর চাল তৈরির ব্যবসা, যেটা এখনও তারা চালাচ্ছে।

নারানের প্রতিদিনের জীবনযাপন ধারা এখন একটু অন্য রকম। তার অফিসের ডিউটি এখন স্টোর বিভাগে, দিনে দশটা—পাঁচটা। অফিস বাড়ির একদিকে এই স্টোর বিভাগ, খেলার বিভাগ অন্যদিকে, দোতলায়। টোলুবাবু বা মাণ্টাবাবুদের কারও সঙ্গেই আর তার দেখা হয় না। তবে প্রতি বছর স্পোর্টসে মাঠে দেখা হয়।

নারান একশো, দুশো বা চারশো মিটারে এখন প্রথম হতে পারে না। অফিসে অনেক অল্পবয়সি ছেলে এসে গেছে, তাদের সঙ্গে গতিতে তাকে হার মানতেই হয় কিন্তু আটশো মিটারে এবং হাজার মিটার ওয়াকিংয়ে সে অফিসে অপরাজেয়। কিন্তু বুঝতে পারছে আটশো মিটারের চুড়ো থেকে এবার তাকে নেমে আসতে হবে। বয়স এখন ছেচল্লিশ। আর পারা যাচ্ছে না। তবে ওয়াকিংয়ে হাঁটায় অনভ্যস্ত কলকাতার বাবুরা যে আগামী দশ বছর পর্যন্ত তার কাছা ধরতে পারবে না, এটা সে জানে।

রাত দুটোয় সে বিছানা থেকে ওঠে। ধানের কুঁড়ো আর তুষ নিয়ে উঠোনে উনুনটা ধরায়। ধান সেদ্ধ করার লোহার কড়াইটা বিরাট। ব্যাসই প্রায় তিন হাত, গভীরতা দু’হাত। কড়াইয়ে ভাপা হবে চার বস্তা ধান, প্রতি বস্তায় থাকে দেড় মণ।

উনুন ধরানো হলে নারানের সঙ্গে এসে বসে মহামায়া। উনুনে আঁচ দেওয়ার মুখ দুটি। ওরা দু’জন দু’ধারে দুই মুখে বসে প্রথমে সরু কুঁড়ো গর্ত দিয়ে আগুনে ছুড়ে ছুড়ে দিতে থাকে, তারপর মোটা তুষ। অন্ধকার নিস্তব্ধ মাঝ রাতে দু’জনে উনুনের আঁচের দিকে তাকিয়ে অবিরত তুষ ছুড়ে যায়। আগুনের চাপা আভায়, অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে থাকা দুটো মুখের মধ্যে শুধু দু’ জোড়া চোখ মাঝে মাঝে ঝকঝক করে ওঠে যখন তারা মুখ তুলে পরস্পরের দিতে তাকায়। দু—চারটে মাত্র কথা তারা বলে। কাজের কথা।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মহামায়া একবার ওঠে। অবু আর নয়নকে তুলে দেয় ঘুম থেকে। নয়ন সংসারের কাজ শুরু করে, অবু পড়তে বসে। পড়াশুনোয় ওর মাথা ভালই। নারান ওকে গ্র্যাজুয়েট করবেই। রাত দুটো থেকে সাতটা, পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে ভাপের কাজ, উনুনে তুষ ছুড়ে যাওয়া। নারান অফিসে যাওয়ার জন্য আটটার ট্রেন ধরে। এরপর মহামায়া একলা।

গর্তের মধ্যে মাটির ছ’টা নাদা। প্রতিটিতে তিরিশ কলসি জল ধরে। ভাপানো, একসেদ্ধ হওয়া ছ’মণ ধান কড়াই থেকে তুলে জলে ডুবিয়ে রাখার জন্য, সে আর নয়ন নাদায় ফেলে।

অবুর স্কুল প্রায় এক মাইল দূরে জোড়ানিমতলায়। সে খেয়ে বেরিয়ে যায় দশটায়। নবু, রাজু যায় প্রাথমিক স্কুলে। গৌতম হামা ছেড়ে হাঁটতে শিখেছে মাত্র।

নাদা থেকে সেদ্ধ ধান তুলে উঠোনে পাতা চটের ওপর শুকোতে দেওয়ার কাজ মহামায়া একাই করে। ধন ছড়িয়ে দিয়ে আধঘণ্টার মতো বিশ্রাম। তারপর চট করে নাড়া দিয়ে ধানগুলোকে ওলটপালট করা, যাতে রোদের তাপ সমানভাবে পায়। এই সময় সারা দুপুর ধানের সঙ্গে লেগে থেকে অন্তত চার—পাঁচ বার সেই ছ’মণ ধান তাকে চট ধরে উলটাতে হয়। তখন লক্ষ রাখতে হয়, বেশি শুকিয়ে ধানের ওজন যাতে কমে না যায়, তা হলে চালের রং খারাপ হবে, ভাঙাবার সময়ও আস্ত থাকবে না। চালের দাম তাতে নেমে যাবে। আবার কম শুকোলেও চাল ভাঙবে। তাই তীক্ষ্ন নজর রেখে ধানের কাছে মহামায়াকে সারা দুপুর বসে থাকতে হয় ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে। মাঝে মাঝে গোড়ালির চাপে ধান ভেঙে সে দাঁতে কেটে বুঝে নেয় ঠিকমতো শুকোল কি না। ধান বস্তায় ভরার আগে, ঘণ্টা চারেক ছায়ায় ঠাণ্ডা জায়গায় ছড়িয়ে রাখতে হয়।

ততক্ষণে নারান অফিস থেকে ফিরে আসে। কিন্তু এই চার ঘণ্টাও বিশ্রাম পায় না মহামায়া। সকালে ধানভাঙা যে কুঁড়ো, তুষ মিল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছিল, এই সময়টায় কুলো দিয়ে ঝেড়ে সে তাই থেকে খুদ বার করার কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজ শেষ হতে হতে রাত আটটা বেজে যায়। তারপর আবার রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠে উঠোনে উনুনের ধারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে বসা। এইভাবে তার রাত আর দিন কেটেছে গত ছ’বছর। খাটুনি থেকে তার রেহাই নেই। কিন্তু সে কখনও মুখভার করেনি। শরীর আর বইছে না বলে অনুযোগ জানায়নি। সংসারের সুখদুঃখ ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলেছে তার দিন আর রাত।

নাদার জল দুদিন পর পর পালটাতে হয়। ছ’টা নাদায় লাগে একশো আশি কলসি জল। নারান বাড়িতে টিউবওয়েল বসিয়েছে। রাত্রে সে পাম্প করে, মহামায়া কলসিতে জল ভরে, কুড়ি গজ বয়ে নিয়ে গিয়ে নাদায় ঢেলে দিয়ে আসে।

মায়ের কষ্ট দেখে নয়ন এগিয়ে এসেছিল। মহামায়া ধমক দিয়ে বলেছিল, ”গা—হাত পুরুষ মানুষের মতো শক্ত হয়ে যাবে। এসব কাজে তোকে করতে হবে না।” নয়নের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে।

অবুও টিউবওয়েলের হাতল ধরেছিল। নারান তাকে টেনে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ”এখন পড়ার সময়, মন দিয়ে পড়া কর।”

সেদিন ছিল নাদার জল পালটাবার দিন। কলসিতে জল নিয়ে যাবার সময় ছলকে উঠোনের মাটিতে জল পড়ে। ক্রমশ উঠোনটা ভিজে ওঠে, কাদা হয়। তখন পিছল মাটিতে একটু হুঁশ রেখে হাঁটতে হয়।

মহামায়া অন্ধকার উঠোনে টিউবওয়েল থেকে নাদা, যাতায়াত করছিল। সে জানত মাটি পিছল হয়ে উঠেছে। বহুবার এমন পিছল উঠোনে সে জল বয়েছে সাবধানেই পা ফেলছিল। তবু, শ্রান্তিতে কীরকম যেন আলগা হয়ে তার দেহের পেশি কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। সে টাল রাখতে না পেরে পিছলে পড়ে গেল। কলসিটা উঠোনে চৌচির হল আর তার মুখ থেকে ”আহহ”—র মতো একটা শব্দ বেরোল।

ছুটে এল সবাই। ধরাধরি করে তাকে বসানো হল। লজ্জা পেয়ে মহামায়া উঠে দাঁড়াতে গিয়ে, ”উহ” বলে কাতরে উঠেই আবার বসে পড়ল।

”কোথায়?” উদ্বিগ্ন নারান জানতে চাইল ব্যথার জায়গাটা।

”এই ডান হাঁটুতে।”

”ভেঙেছে নাকি?” অবু বলল।

”তুই থাম তো! এরকম অনেকবার পড়েছি…চুন—হলুদ দিলেই সেরে যাবে।” মহামায়া ব্যাপারটাকে সহজ করে তোলার জন্য বলল, ”নয়ন, কলসিটা তো ভাঙল, তুই এবার বালতি করে…”

”না না, যা পিছল হয়ে রয়েছে, আমিই নাদায় জল ঢালছি। তার আগে, নয়ন তুই চুন—হলুদ গরম কর।”

পরদিন সকালেও মহামায়া বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। ধান সেদ্ধর কাজ বন্ধ রইল, কিন্তু শুধু সে দিনের মতোই নয়, বরাবরের জন্যই।

দিন দশেক পর মহামায়া উঠোনে এসে একটা টুলে বসল নয়নের কাঁধে ভর দিয়ে। নারানকে সে ডাক্তার এনে টাকা খরচ করতে দেয়নি। ”এই সামান্য একটা ব্যাপারে আবার ডাক্তার দেখাব কী? ক’দিন গরম তেল মালিশ করলেই দেখবে দৌড়তে পারব।”

দৌড় তো দূরের কথা, একমাস পরও সে ডান হাঁটু পুরোপুরি মুড়তে ব্যথা বোধ করল। উবু হয়ে বা বাবু হয়ে কোনওক্রমে বসতে পারলেও, উঠতে গেলেই তীক্ষ্ন যন্ত্রণা হয়। উঠোনে টুলে বসে সে করুণ চোখে নেভা উনুন আর বিরাট কড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু সাচ্ছল্য এসেছিল সংসারে, তাও চলে গেল। নয়নের বিয়ে দিলেই জমানো টাকা আর থাকবে না। আবার সেই টানাটানির সংসার। এজন্য মহামায়া নিজেকেই দোষ দেয়। কেন সে আছাড় খেল! এটা কি কপালের লিখন! তাকে কি চিরকালই কষ্ট করে যেতে হবে, সুদিনের মুখ কি কখনও দেখতে পাবে না?

ধানের ব্যবসাটা উঠে গেল। মহামায়া হাঁটতে পারছে তবে ধীরে ধীরে। হাঁটু মুড়তে পারছে কিন্তু খচখচ করে। ব্যথাটা ক্রমশ মিলিয়ে গেলেও মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। নারান এই নিয়ে চিন্তিত। ভাল একজন ডাক্তার দিয়ে একবার হাঁটুটা দেখানো উচিত। রেললাইনের ওপারে বিজয় ডাক্তারের কাছে সে মহামায়াকে নিয়ে গেছল। হাঁটু পরীক্ষা করে ডাক্তার এক্স—রে করাতে বলে।

বাড়ি ফেরার সময় মহামায়া আপত্তি জানাল।

”আবার গুচ্ছের টাকা খরচ। ষোলোটা টাকা কম নাকি? ছবি তোলাবার দরকার নেই। ব্যথাটা আগের থেকে অনেক কমে গেছে, আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। অত ব্যস্ত হবার কী আছে!”

”এসব জয়েন্টের ব্যথা অত সহজে যায় না। একটা এক্স—রে করাতে এত আপত্তি কীসের? ট্রেনে বনগাঁ গিয়ে…” নারান তার স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করল।

”ট্রেনে চেপে কেন, আমি হেঁটেই এখন বনগাঁ যেতে পারি। কথাটা তা নয়, …অযথা কেন খরচ করব?”

”এটা অযথা নয়, খুব দরকারি। অফিসে শুনেছি তো, হাঁটুতে, অ্যাঙ্কেলে চোট পেয়ে কত ভাল ফুটবলারের খেলা শেষ হয়ে গেছে।”

”আমি কি ফুটবল খেলতে মাঠে নামব?”

”কেপ্পনি করে চিকিৎসা না করালে হাঁটুতে জল জমবে, বাত হবে, অথর্ব হয়ে যাবে।” শেষের কথাটায় মহামায়া ভয় পেল। বাতের যন্ত্রণা ঠিক আছে, সহ্য করতে পারবে, কিন্তু অথর্ব হওয়াকে সে ঘেন্না করে, তাই ভয়ও পায়।

”ঠিক আছে, কবে যাব?”

বনগাঁ থেকে এক্স—রে করিয়ে এনে নারান খাম হাতেই স্টেশন থেকে বিজয় ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখল তালা ঝুলছে। কী ব্যাপার! পাশের ওষুধের দোকানে শুনল, পাটনায় ডাক্তারবাবুর বড়দার হঠাৎ হার্ট—স্ট্রোক হয়েছে। খবর পেয়েই কাল পাটনা চলে গেছেন। অন্তত সাত দিনের আগে ফিরবেন না।

সোমবার ছিল অফিসের মাইনের তারিখ। সে দিন দুপুরে ক্যাশঘর থেকে মাইনে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সে টোলুবাবুর মুখোমুখি হল।

”আরে নারান, খবর কী তোর? দেখে তো মনে হচ্ছে ভালই আছিস।”

”আপনি কেমন আছেন? একটু শুকনো শুকনো….”

”ভাল আছি, ভাল আছি।” টোলুবাবু মাঝপথে নারানকে থামিয়ে দিলেন। ”শরীর টরির নিয়ে কথা বলে মন খারাপ করে দিসনি। হার্ট, লিভার, কিডনি, প্রেশার, এগুলোকে ভুলে থাকতে দে। আর ক’বছর পরই রিটায়ার করছি…মাঠে যাওয়া বন্ধ করব। খাব—দাব, ঘুমোব আর ছাদে ফুলের বাগান করব। দুটো ছেলে চাকরি করছে…তোর কয় ছেলে?”

”বড় ছেলে তেরো বছরের, বাকি তিনটে ছোট।”

”ওহ, তা হলে তো তোকে এখন অনেকদিন চাকরি করতে হবে। করে যা, করে যা। মাইনেটা নিয়ে আসি।” টোলুবাবু ক্যাশঘরে ঢুকে গেলেন।

মোহনবাগন—ইস্টবেঙ্গল নিয়ে টোলুবাবু একটা কথাও বললেন না। এমনটা তো কখনও হয় না! নারানের অবাক লাগল। অনিলকে দেখে নারান বলল, ”টোলুবাবু কেমন যেন বদলে গেছেন মনে হচ্ছে!”

”তুই জানিস না? ওনার তো দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে। নাইটডিউটি আর করেন না। দুপুরে ডাকের কপি করে বাড়ি চলে যান।”

শুনে নারন আবাক হয়ে গেল। একই অফিসে তারা কাজ করে, অথচ এক তলা আর দোতলার মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই! তিন তলার মানুষদের তো সে চেনেই না! খেলার বিভাগে অনেক দিন যায়নি, নারানের ইচ্ছে হল, আগের মতো টোলুবাবুর সঙ্গে মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কথা বলতে।

”কী রে, এখানে কী মনে করে?” টোলুবাবু চোখ থেকে চশমা নামালেন।

”আপনি চশমা নিলেন কবে?”

”মাস ছয়। বয়স হলে উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু তুই তো একটুও বদলালি না? চোখের দৃষ্টি কেমন?”

”ভালই, তিন হাত দূরের খবরের কাগজ পড়তে পারি।” কথাটা বলেই নারানের মনে হল, এখন এই লোকটির কাছে দৈহিক সুস্থতার কথা না বলাই ভাল। তাই সে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ”আমি ভাল থাকলে কী হবে, বাড়িতে তো অসুখবিসুখ, নিশ্চিন্তে আর আছি কই…বউয়ের হাঁটুতে…”

”কী হল হাঁটুতে?” টোলুবাবু চশমাটা চোখে দিলেন। নারান তখন আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা বলল।

”তা ওকে নিয়ে আয়, আমি ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দিচ্ছি। না না, দেরি করিসনি, কালকেই আন। …মনে আছে তোর, চোদ্দো—পনেরো বছর আগে…”

”চোদ্দো বছর আগে। আপনি দাঁড়িয়েছিলেন ক্যাম্বেল হাসপাতালের…ইয়ে নীলরতন হাসপাতালের সামনে। বলেছিলেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি আমি এসে যাই, তা হলে ধরে নিয়েছিলেন আপনারাই লিগ পাবেন। আমি চার মিনিট আটাশ সেকেন্ডের মধ্যে এসে গেছলাম।”

”আর লিগটা কিনা পেলি তোরা।” টোলুবাবু চোখ পিটপিট করে বললেন। ”পরের বছর হল অ্যাবানডন্ড।”

”কিন্তু তার পরের বছর তো আপনারা ডাবল করলেন।”

”তার দু’বছর পর জ্যাটোপেক এল কলকাতায়, কিন্তু তুই তাকে দেখতে পেলি না।”

”আমার জীবনে, টোলুবাবু, এতবড় একটা দুঃখ আর কখনও পাইনি। ওঁকে দেখার ওই প্রথম আর শেষ সুযোগ আমি হারিয়েছি।”

”তা হলে তুই কাল…না ন কাল নয়, তোর অফ—ডে কবে? রবিবার?”

”হ্যাঁ।”

”তা হলে রবিবার বিকেলে ঠিক পাঁচটায় ওই জায়গায় বউকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়াবি। এক্স—রে প্লেটটাও আনবি। ওই ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যাব। বেশিক্ষণ কিন্তু আমায় দাঁড় করিয়ে রাখিসনি। শরীরটা ক’দিন ধরে ভাল যাচ্ছে না, হার্টটা কেমন যেন ট্রাবল দিচ্ছে।”

নারান চলে আসছিল, টোলুবাবু ডাকলেন।

”নারান শোন, জীবনে কোনটে বড় দুঃখ আর কোনটে ছোট দুঃখ, সে সবের হিসেব কষা ছেড়ে দে। ওতে শুধু সময় নষ্ট আর মন খারাপ করা। দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে, ডাক্তার বলেছে থার্ডটাই আমার ফুলটাইমের হুইসল হবে। আমি এখন আর লিগ, শিল্ড, রোভার্স, ডুরান্ড নিয়ে একদম ভাবি না। এসব এখন তুচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হয়। তোরও জীবনে এমন একদিন আসবে যখন জ্যাটোপেককে তোর আনইম্পর্ট্যান্ট বলে মনে হবে।”

” না না না, এ আপনি কী বলছেন টোলুবাবু।” নারান প্রায় শিউরে উঠল। ”ওঁকে আনইম্পর্ট্যান্ট ভাবব? এমন অধঃপতন আমার যেন না হয়।”

টোলুবাবু ফিকে হাসলেন। নিচু গলায় বললেন, ”না হলেই ভাল। তবে জীবনে বড় বড় সারপ্রাইজগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। কখন, কোথায় যে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কেউ তা জানে না! …তা হলে রোববার দেখা হচ্ছে।”

নারানও জানত না, রবিবারই তার সামনে এসে দাঁড়াবে একটা সারপ্রাইজ।

মহামায়াকে নিয়ে সে বিকেল চারটে—পঁয়ত্রিশে ট্রেন থেকে শেয়ালদায় নামল। হাসপাতালের সামনে পৌঁছতে লাগল চার মিনিট। তারপর অপেক্ষা করতে করতে বাজল পাঁচটা। টোলুবাবু তখনও আসেননি। সাড়ে পাঁচটা। টোলুবাবুর দেখা নেই।

”কী ব্যাপার, ঠিক বুঝতে পারছি না তো!” নারান হতাশ, উদভ্রান্তের মতো মৌলালি থেকে বউবাজার মোড় পর্যন্ত ঘনঘন তাকাতে লাগল।

”পাঁচটা বলেছিলেন না ছ’টা?” মহামায়া সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইল।

”পাঁচটা। আর একটু দেখি। না এলে ডাক্তারের কাছেই সোজা টোলুবাবুর নাম করে চলে যাব, এই তো সামনেই ওঁর চেম্বার।”

ছ’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে নারান আর মহামায়া ডাক্তারের চেম্বারে এল। চোদ্দো বছরে জায়গাটার বিশেষ কিছু বদল ঘটেনি। অপেক্ষার জায়গাটায় রোগীর সংখ্যাটা বেশি। পুরনো দুটো চেয়ারকে নারান চিনতে পারল। নতুন একটা হাতলওলা বেঞ্চ আর ঘরের দরজার ধারে টেবল চেয়ার। একটি অল্পবয়সি রুগণ মেয়ে সেখানে বসে।

”আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে?” মেয়েটি জিজ্ঞেস করল? নারান ফাঁপরে পড়ল। ডাক্তারকে টোলুবাবু বলে রেখেছেন কি না সে জানে না। তবে আগেরবার তো ডাক্তারকে বলা—কওয়া ছিল বলে তার মনে হয়নি। হাঁদু বলে টোলুবাবু ডেকেছিলেন। ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার দরকার হয় না।

”না করা নেই। ডাক্তারবাবুর বন্ধু আমাদের পাঠিয়েছেন।”

”এতে আপনার নাম আর যিনি পাঠিয়েছেন তার নাম লিখে দিন।” স্লিপের ছোট্ট প্যাডটা আর কলম মেয়েটি এগিয়ে দিল।

নিজের নাম লিখে নারান তার দলায় ”টোলুবাবু পাঠাইয়াছেন” লিখে দিল। স্লিপটা নিয়ে পরদা সরিয়ে মেয়েটি ভিতরে গেল। পর্দার দিকে তাকিয়ে নারানের মনে হল, এটা তো আগে ছিল না! বেঞ্চে মহামায়ার পাশে বসা মাত্রই মেয়েটি পরদা সরিয়ে বলল, ”নারানবাবু আসুন।”

মহামায়ার কানের কাছে মুখ এনে নারান ফিসফিস করে বলল, ”টোলুবাবুর নাম লিখে দিয়েছিলাম, তাই সঙ্গে কল এল।”

মহামায়ার সামনে পরদার দিকে তাকিয়েই ছিলেন। তারা দু’জন ঘরে ঢোকা মাত্র বললেন, ”টোল কবে বলেছিল আপনাকে?”

ডাক্তারবাবুর চাহনিতে ও স্বরে এমন কিছু ছিল যেজন্য নারান নমস্কার করতেও ভুলে গেল।

”গত সোমবার, অফিসে কথা হয়েছিল। আমরা একই অফিসে কাজ করি। উনি বলেছিলেন, পাঁচটার সময় হাসপাতালের সামনে অপেক্ষা করবেন। আমাকে নিয়ে উনি আপনার কাছে এসেছিলেন একবার, চোদ্দো বছর আগে। সেদিনও তিনি ওইখানে আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে এবার আর আমার জন্য নয়, আমার স্ত্রীর…”

”বসুন। টোলুর পাঠানো আপনিই বোধহয় শেষ রোগী।”

কথাটা বুঝতে না পেরে নারান হাসল, টোলুবাবু তা হলে এখানে রোগী সাপ্লাই দেন! কিন্তু শেষ রোগী কেন? আর কি কাউকে পাঠাবেন না?

তার চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠতে দেখে ডাক্তারবাবু চোখ নামিয়ে ধীর স্বরে বললেন, ”কী জন্য এসেছেন বলুন।”

উঁচু বেঞ্চে শুইয়ে এবং হাঁটিয়ে মহামায়ার হাঁটু পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু কোনও ওষুধপত্র দিলেন না। শুধু প্রতিদিন কয়েকটা ব্যায়ামের আর টানা আধঘণ্টা হাঁটার নির্দেশ দিয়ে, কী ভাবে হাঁটতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিলেন।

”আমরা ছ’টা পর্যন্ত ওঁর জন্য অপেক্ষা করেছি। যদি উনি এসে পড়েন তা হলে ওঁকে বললেন যে”…নারান থেমে গেল ডাক্তারবাবুর তোলা হাত দেখে।

”টোলু আর আসবে না। এতক্ষণে ওর দাহ হয়ে গেছে।”

নারানের মাথার মধ্যে কথাগুলো অর্থবহ একটা পরিষ্কার আকার নিয়ে ফুটে ওঠা মাত্র সে টেবলের কোনা আঁকড়ে ধরে ঝুঁকে, মুখ থেকে একটা শব্দ বার করল।

”ভোররাতে ঘুমের মধ্যেই…আমিই ওর ডেথ সার্টিফিকেট লিখলাম।”

নারান থরথর কাঁপছে। মহামায়া ওর একটা হাত চেপে ধরল। ডাক্তারবাবু বেল বাজালেন। পরদা সরিয়ে মেয়েটির মুখ উঁকি দিল।

”পাঠিয়ে দাও।”

নারান সম্বিৎ ফিরে পাবার আগেই দু’জন পুরুষ ও মহিলা ঘরে ঢুকল।

”বসুন…বলুন।”

মহামায়াই হাত ধরে টেনে নারানকে বাইরে আনল। বেরিয়ে এসেই সে বলল, ”এভাবে অবাক করে দেবেন ভাবিনি।”

এর পর আর সে একটিও কথা বলেনি। মহামায়া কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে চুপ করে গেছে।

ট্রেনে বসে নারান জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। বাইরে ঘোর অন্ধকার, সিগন্যালের লাল—সবুজ, মাঝে মাঝে বাড়ির আলো, রাস্তার আলো, স্টেশনে থামা, যাত্রীদের ওঠা—নামা, মোটরের হেডলাইট, ব্রিজের উপর ট্রেনের ঝম ঝম শব্দ…তার মনের মধ্যেও চলেছে রেলগাড়ি। …তাতে যাত্রী শুধু টোলুবাবু আর সে। টুকরো—টুকরো কথা, হাসি, রাগ, জল—খাওয়া, শোওয়া, নানানভাবে টোলুবাবুকে তার মনে পড়ছে। এক—একটা বছর যেন এক—একটা স্টেশনের মতো। নারানের মনের রেলগাড়িও থামছে আর ছাড়ছে।

সোমবার শেষবারের মতো দেখা হল। ”আমার জীবনে জ্যাটোপেককে না দেখতে পাওয়ার মতো এত বড় দুঃখ আর কখনও পাইনি।” কথাটা কি সত্যি? নারান মনে মনে প্রশ্ন করল টোলুবাবুকেই।

‘নারান সারপ্রাইজগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। কখন, কোথায় যে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে…।’

টোলুবাবু শেষে আপনিই কিনা এই কাজ করলেন! আপনিই আমার বড় দুঃখ? না কি আরও দুঃখ ঘাপটি দিয়ে রয়েছে? জীবনে তো অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ সইলাম, দেখলামও, কিন্তু এমন করে দেওয়ার মতো তো আগে কখনও পাইনি!

‘নারান জীবনে কোনটে বড় দুঃখ আর কোনটে ছোট দুঃখ, সে সবের হিসেব কষা ছেড়ে দে। ওতে শুধু সময় নষ্ট আর মন খারাপ করা।’

ঠিক বলেছেন টোলুবাবু, আমি আর মন খারাপ করব না। আপনাকে আমি ভুলেই যাব, আপনাকে আমি মন থেকেই মুছে ফেলব। নারান ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। পাশে বসা মহামায়া তার মুঠোয় চেপে ধরল নারানের বাহু।

”ঘুম পাচ্ছে?”

নারান চোখ তুলে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ”হ্যাঁ।”

.

ডাক্তারবাবুর দেখিয়ে দেওয়া ব্যায়াম শুরু করল মহামায়া আর উঠোনে এধার থেকে ওধার আধ ঘণ্টা হাঁটা। কিন্তু কয়েক দিন পরই তার বিরক্তি ধরল, একঘেয়ে লাগল ছোট জায়গায় এইভাবে হাঁটতে।

”উঠোনে আর পারছি না, এবার রাস্তায় হাঁটব।” মহামায়া একদিন নারানকে বলল।

”পাকা রাস্তা তো একটা, বাস আর লরি অবিরাম চলেছে। হাঁটবে কোথায়? ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটলে তো চোট পাবে।”

”তুমি কাগজ বিক্রি করতে সাইকেলে যেতে যে রাস্তায়…”

”ওরে বাবা! সেটা তো আরও বিপজ্জনক! গত চোদ্দো বছরে তাতে দু’বার ইট আর খোয়া পড়েছিল। সেসব কবে উঠে গিয়ে আবার গত্ত বেরিয়ে পড়েছে। তবে পঁয়ত্রিশ নম্বর হাইওয়ের থেকে এক দিক দিয়ে ভাল, গাড়ি কম যায়। ঠিক আছে, কাল থেকে ভোরবেলায় দু’জনে বেরোব। তুমি হাঁটবে, আমি দৌড়ব। প্র্যাকটিসটা রাখা দরকার।”

পরদিন ভোর পাঁচটায় তারা দু’জন বাড়ি থেকে বেরোল। রেললাইন পার হয়ে হরিহর ভটচাযের বন্ধ দোকানের সামনে নারান দাঁড়াল। এখন একশো ষাটটা কাগজ হরিহর নিচ্ছে। বিলি করার জন্য দু’টো ছেলেকে রেখেছে। সেই পাঁচটা গ্রাম—শালকোনা, আন্দুলিয়া, ঝাউডাঙা, রঘুরামপুর, তুবড়িয়ায় সে একাই কাগজ বিলি করত, আর এখন কিনা লাগছে দু’জন। নারান আত্মপ্রসাদ বোধ করল।

ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি। আবছা রাস্তাটার দিকে আঙুল তুলে সে মহামায়াকে বলল, ”এই রাস্তা দিয়ে বছরের পর বছর কাগজ নিয়ে গেছি আর ফিরেছি, প্রায় আটাশ মাইল…রোজ, একদিনও কামাই করার জো ছিল না, তা হলেই লোকে কাগজ পাবে না। চলো, হাঁটো।’

হাঁটতে হাঁটতে নারান বলে যেতে লাগল, জায়গাটায় কী কী বদল ঘটেছে। কোন কোন দোকান আর বাড়িগুলো নতুন হয়েছে। কোথায় একটা সজনে গাছ ছিল, কোন নারকেল গাছটাকে এতটুকু দেখেছে, কোন পুকুরটা ইট—ভাটার জন্য মাটি কাটতে তৈরি হল। ভাগাড় ছিল, শকুনি বসে থাকত, এখন সেখানে ধান চাষ হচ্ছে।

কথা বলতে বলতে নারান তার স্বভাবগত জোরে হাঁটা শুরু করে দিল। মহামায়া বার বার পিছিয়ে পড়ে আর ছুটে নারানের পাশে আসে।

”তুমি ছুটবে বলেছিলে, যাও ছোটো। আমি তোমার সঙ্গে হাঁটতে পারব না।”

”সেই ভাল।”

নারান পা থেকে চচি খুলে দু’হাতে নিল। মহামায়া হাত বাড়িয়ে বলল, ”চটি হাতে ছুটবে কী? আমায় দাও।”

”সেই ভাল। …তোমার তো আধ ঘণ্টা হাঁটার কথা? দশ মিনিট হাঁটা হয়ে গেছে! আরও দশ মিনিট হাঁটবে, তারপর ফিরে আসতে দশ মিনিট। ঠিক এইখানে অপেক্ষা করবে, আমি এখনি ঘুরে আসছি।”

বিবর্ণ, গোড়ালির রবার ক্ষয়ে যাওয়া চটিজোড়া মহামায়ার হাতে দিয়ে, ধুতিটা একটু টেনে তুলে নারান ধীর গতিতে ছুটতে শুরু করল।

মহামায়া সামনে তাকিয়েই হাঁটতে হাঁটতে দেখল নারান ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে ছোট থেকে ছোট হয়ে। গাছপালা বাড়ির আড়ালে এক একবার অদৃশ্য হয়ে আবার বেরিয়ে পড়ছে। রাস্তাটা ডান দিকে ঘুরে ধানখেতের মাঝ দিয়ে শালকোনা গ্রামের দিকে গেছে। নারানকে সে আবার দেখতে পেল একই গতিতে ছুটছে।

পিছনে আকাশটা আলোয় ভরে উঠছে। পাখি উড়ছে। আনাজ নিয়ে গোরুর গাড়ি আসছে ধান্যকুড়িয়ার বাজারে। বাতাসে ভেসে রয়েছে মাটির গন্ধ। চারদিকে থমথমে স্তব্ধতা। মাথার উপর গাছের ডালে শালিক ডেকে উঠতে মহামায়া মুখ তুলে তাকাল আর তখনই একটা ইটের ডগায় হোঁচট খেয়ে সে পড়ি পড়ি হয়ে কোনওক্রমে টাল সামলাল।

তার চটির ফিতে ছিঁড়ে গেছে। এটা পরে আর হাঁটা সম্ভব নয়। দু’হাতে দু’জোড়া চটি নিয়ে মহামায়া আবার হাঁটতে শুরু করেই বুঝল, তার শরীর কষ্ট সহ্য করার যত ঘমতাই রাখুক না কেন, পায়ের তলার চামড়া তত রাখে না। কাঁকর আর ভাঙা ইটের টুকরো মাড়িয়ে হাঁটতে তার কষ্টই হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল নারানের ফিরে আসার জন্য।

মিনিট চল্লিশ পরে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল নারান। মুখে ক্লান্তির চিহ্নমাত্রও নেই। মহামায়া কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, ”শালকোনার বটগাছটা ছুঁয়েই চলে এলাম, দেরি হয়ে গেল…তাড়াতাড়ি চলো, অফিস যেতে হবে…ক’টা বাজল?”

”ঘড়ি কোথায় পাব এই রাস্তার মধ্যে?” বহু কষ্টে ধরে রাখা ধৈর্য মহামায়া আর ধরে রাখতে পারল না।

”টেবিল—ঘড়িটা নিয়ে কাল বেরোব।”

”কাল আর বেরোনো হবে না, এই দ্যাখো।” মহামায়া চটিগুলো হাত থেকে ফেলে দিল। নিজের চটি পায়ে গলিয়ে নারান বলল, ”কী হয়েছে?”

”ছিঁড়ে গেছে। খালি পায়ে এই রাস্তায় আমি হাঁটতে পারব না।”

”কই, আমার তো খালি পায়ে অসুবিধে হল না? কত লোকই তো খালি পায়ে…!”

”যারা পারে পারুক।” মহামায়া ছেঁড়া চটি কুড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল।

”হাঁটার জন্য কেডসই পরা দরকার। অফিস থেকে ফিরে তোমাকে নিয়ে আজই জুতোর দোকানে যাব।”

”হাতের একটা ঘড়িও কেনা দরকার। তা হলে সময়ের হুঁশ রেখে দৌড়তে পারবে।”

”অফিসে কো—অপারেটিভের লোনটা স্যাংশন হলেই কিনব।”

রাতে মহামায়াকে নিয়ে বাজারের একমাত্র জুতোর দোকানটায় নারান যখন পৌঁছল, তখন দোকান বন্ধের জন্য দরজার পাটা লাগানো হচ্ছে। দোকানি খদ্দের হাতছাড়া করতে চায় না। ওদের দুজনকে ভিতরে এনে বসাল।

নারান চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল। তার পাশে বসল মহামায়া, খালি পা কাপড়ে ঢেকে। দোকানি নারানের পায়ের দিকে তাকাল।

”কেডস দিন তো…আমার নয় ওর পায়ের।”

কথাটা বলেই নারানের মাথার মধ্যে ঢং ঢং করে দমকলের গাড়ির মতো ঘণ্টা বেজে উঠল। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। তার মুখ দিয়ে কার গলার স্বর, কার বলা কথা বেরোল!

টোলুবাবু! …চোদ্দো বছর আগে, কোলেবাজারের পাশে জুতোর দোকানে ঢুকেই ঠিক এই কথা বলে উঠেছিলেন। …টোলুবাবু আপনি এখনও বেঁচে আছেন? আমার বুকের মধ্যে আপনি!

…’তুই এত পরিশ্রমী, তোকে দেখেও যে আনন্দ হয়!”

…টোলুবাবু আপনাকে আমি আনন্দে রাখব, যতদিন বাঁচব আপনাকে…।

‘লিগ জেতার মতোই সুখ পাচ্ছি রে।’

টোলুবাবু আপনার মোহনবাগান বছর বছর লিগ পাবে না, কিন্তু আমি আপনাকে সুখ দেব…।

টোলুবাবু, টোলুবাবু, বাস্তু ছেড়ে এসে নতুন বাস্তু বসিয়েছি, আমার পরিশ্রম করার ক্ষমতা আছে, আপনাকে আমি বাঁচিয়ে রাখব, আনন্দ দেব…আপনি দয়া করে আমাকে ছেড়ে যাবেন না, আমি ঠিক সময়েই আপনার কাছে পৌঁছব…চার মিনিট আঠাশ সেকেন্ডেই…

”এ কী! তোমার চোখে জল, কাঁদছ কেন? কী হল? বিড় বিড় করে কীসব বলছ?”

মহামায়া হাত ধরে ঝাঁকাতেই নারান ফ্যালফ্যাল করে দোকানদারের মুখের দিকে তাকাল, তারপর মহামায়ার দিকে। সম্বিৎ ফিরে আসতে, কাঁধের জামায় চোখ ঘষে সে শান্ত স্বরে বলল, ”চোখের জল মানেই কান্না নয়। ছেচল্লিশ বছর বয়সে পুরুষমানুষ কি কাঁদে? …নীল নয়, সাদা রঙের কেডসই আপনি দেখান।”

।। ৬।।

কুড়ি বছর তারপর কেটে গেছে।

উনিশশো ছিয়াশির ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এক সন্ধ্যায় নারান খেলার বিভাগে এল। মাত্র এক মাস আগে রিটায়ার করে সে ছ’মাসের জন্য এক্সেটনশন পেয়েছে।

দোতলা থেকে তিনতলায় উঠে এসেছে সংবাদ বিভাগ, সেই সঙ্গে রিপোর্টিং, প্রুফ রিডিং, টেলেক্স, খেলার বিভাগও। লম্বা হলঘরের এক কোনায়, পুরনো টেবিলটার দু পাশে আগের মতোই চেয়ার পাতা, কিন্তু পুরনো লোকেরা আর কেউ নেই। শৈলেনবাবু আর শ্যামলবাবুর পর আরও তিনজন লোক এসেছে। খুব অল্পবয়সি, নারান তাদের চেনে না।

মাণ্টাবাবু রিটায়ার করেছেন। অফিসের স্পোর্টসের দিন তিনি মাঠে আসেন, তখন দেখা হয়। প্রতিবারই বলেন, ‘তুই আমাকে খুব ঠকান ঠকিয়েছিলি নারান। আটশো, চারশো আর দুশো, পর পর তিনটে রেসে নামতে চাওয়ায় আমি তো ভেবড়ে গেছলুম। তখন তোর বয়সের কথা ভেবে আমি তো রাজিই হইনি তোর এন্ট্রি নিতে। মনে আছে?” নারান শুনে যায় আর মিটমিটি হাসে আর বলে, ”সে বছর যে ওলিম্পিকে জ্যাটোপেক তিনটে সোনা জিতেছিল! …আমাদের যে একই তারিখে জন্ম।” মাণ্টাবাবু হেসে শ্যামলবাবুকে বলেছিলেন, ”বুঝলে শ্যামল, আমি বিরক্ত হয়ে ওকে বলেছিলুম, তুই কি জ্যাটোপেক হয়ে গেছিস ভেবেছিস?”

নারান সেদিন খেলার বিভাগে এসে দেখল একজন বসে কপি অনুবাদ করছে। একে সে দেখেছে, কিন্তু নাম জানে না। এ—ও বোধহয় তাকে চেনে না। দেয়ালের ধারে টুলে বসে আছে অমিয়। নারান তাকে জিজ্ঞেস করল, ”শৈলেনবাবু, শ্যামলবাবু কখন আসেন?”

”এবার তো মাঠ থেকে আসার সময় হল। আপনি বরং শশধরবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, ওই যে টেবিলে বসে।”

নারান কুণ্ঠিতভাবে শশধরের পাশে দাঁড়াল। নমস্কার করে বলল, ”আমার নাম নারান হালদার, এখানে বেয়ারার কাজ করি। অনেক দিন খেলার বিভাগে ছিলাম, তারপর স্টোরে। অনেক বিভাগ ঘুরে এখন পোস্ট বক্সে আছি। রবিবাবু, টোলুবাবু, মাণ্টাবাবু আমায় খুব ভালবাসতেন। আপনি বোধহয় ওদের দেখেননি।”

শশধর ভ্রূ কোঁচকাল। ”নাম শুনেছি, মাণ্টাবাবু ছাড়া কাউকে দেখিনি।”

সংক্ষেপে জবাব দিল শশধর, নিরাসক্ত স্বরে। সে ধরে নিয়েছে, এই কৃশকায়, কৃষ্ণবর্ণ, আধময়লা হাফ—হাতা পাঞ্জাবিপরা লোকটি এবার পকেট থেকে চার ভাঁজ করা ময়লা একটি কাগজ বার করে বলবে, ”পাড়ার ফাইভ এ সাইড রবারের বল ফাইনাল, খবরটা যদি একটু…”

”একটা খবর…”

”কিন্তু এসব আর ছাপা হয় না।” বিব্রত স্বরে শুরুতেই নারানকে থামিয়ে দিল শশধর।

থতমত নারান লাজুক গলায় বলল, ”আজ্ঞে ছাপাতে নয়, একটা খবর জানতে এসেছি।”

শশধর এবার লজ্জা পেল, অপ্রতিভও বোধ করল। গত বছর অফিসের স্পোর্টসে এই নারান হালদারকে সে দৌড়তে আর প্রাইজ নিতে দেখেছে।

”কী খবর?”

”কাগজে দেখলুম, এ মাসের সাতাশে ক্রীড়া দিবস হবে। তাতে নাকি এমিল জ্যাটোপেক আর তার বউ ডানা কলকাতায় আসবেন।…সত্যি নাকি?”

”হ্যাঁ, সেইরকমই তো আমাদের বলেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী।”

”কোথায়, কখন ওঁদের দেখা যাবে, জানেন নাকি?”

”এখনও কিছু আমাদের জানানো হয়নি। হলে কাগজে নিশ্চয় দেখতে পাবেন। আজ বেঙ্গল অ্যামেচার অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশনের একটা প্রেস কনফারেন্স আছে, শ্যামলদা গেছে। হয়তো জ্যাটোপেকের প্রোগ্রাম সম্পর্কে কিছু জানা যাবে।”

নারানের যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। জ্যাটোপেকের আসার কথাটা তা হলে সত্যিই। টোলুবাবুকে একদিন বলেছিল, জীবনে এত বড় দুঃখ সে আর কখনও পায়নি। ওঁকে দেখার ওই প্রথম আর শেষ সুযোগ সে হারিয়েছে। তখন টোলুবাবু বলেছিলেন কোনটে বড় আর কোনটে ছোট দুঃখ, সে সবের হিসেব কষে শুধু মন খারাপ আর সময় নষ্ট হয়। …জীবনে এমন একদিন আসবে যখন জ্যাটোপেককে তোর আনইম্পর্ট্যান্ট মনে হবে।

তিরিশ বছর আগের সেই প্রথম আর শেষ সুযোগটা আবার তার সামনে আসছে। এবার আর সে হাতছাড়া করবে না। ট্রেনকে আর বিশ্বাস করবে না। যদি একদিন আগেও কলকাতায় গিয়ে থাকতে হয় তা হলেও সে শেয়ালদার স্টেশনে কিংবা অফিসে রাত কাটাবে।

ইলেকট্রিক ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিরিশ বছর আগের সেই দিনটার কথা তার মনে পড়তে লাগল। ময়দান থেকে অফিসে ফিরে গেছিল নাইট ডিউটি করতে। টেবিলে আলোচনা হচ্ছিল জ্যাটোপেকের দৌড় নিয়ে।

মাণ্টাবাবু বললেন, ”বুঝলেন রবিদা, জ্যাটোপেক যখন দৌড়চ্ছিল কীরকম একটা কষ্টের ছাপ ওর মুখে ফুটে উঠছিল। কাঁধটা, দুটো হাত, শরীর যেন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি মাটিতে লুটিয়ে পড়বে!”

”মাণ্টা, এটাই ওর দৌড়বার স্টাইল। আসলে এত কষ্ট আর অসুবিধের মধ্যে ট্রেনিং করেছে যে মুখে হাসি ফোটাবার মতো অবস্থা ছিল না। ভাবতে পারো, জ্যাটোপেক যখন দু’বছর মিলিটারিতে ছিল, তখন জঙ্গলের মধ্যে ওর ক্যাম্পের কাছে শুধু চারশো মিটারের একটা মাটির রাস্তা ছাড়া দৌড়বার মতো কোনও জায়গা ছিল না। বৃষ্টিতে কাদায়, শীতকালে বরফে ঢাকা। তাই ভেঙে ভারী মিলিটারি বুট পরে আর শরীরের ওজন বাড়াবার জন্য ভারী ভারী ওভারকোট গায়ে দিয়ে, রুকস্যাক পিঠে বেঁধে দৌড় প্র্যাকটিস করত। ওই চারশো মিটার ষাটবার তার মধ্যে দু’শো মিটার স্প্রিন্ট অর্থাৎ, চব্বিশ হাজার মিটার, মানে চব্বিশ কিলোমিটার ওইভাবে প্রতিদিন!”

”তার মানে প্রায় পনেরো মাইল, প্রতিদিন!” টোলুবাবু হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ছিলেন।

”প্রতিদিন, দু’বছর! কাদায় পা আটকে যেত বলে তাই উঁচু করে হাঁটু তুলে দৌড়ত। এটাই পরে নতুন এক টেকনিক হয়ে যায়। স্পিডের জন্য জোরে দৌড় আর এনডিওরেন্সের জন্য বারবার রিপিট করা। দৌড়ের মধ্যে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে কিছুটা ছুটে যাওয়া, তারপরই আবার সহজ ছন্দে ছুটতে থাকা। এটা নতুন ব্যাপার—একে ইন্টারভ্যাল রানিং বলে।”

শুনতে শুনতে নারান রোমাঞ্চ বোধ করেছিল। এইভাবে ট্রেনিং! ওর তো পেটের দায়, সংসার চালাবার দায় ছিল না, তা হলে এমন পাগলের মতো একা একা পরিশ্রম কীসের জন্য? রাতে ডিউটি করার পর খালি পেটে, শুধু চা আর এক আনার বিস্কুট খেয়ে আটাশ মাইল সাইকেল চালানো, নারানের মনে হল, জ্যাটোপেকের ট্রেনিংয়ের কাছে কিছুই নয়।

”টোলু, একজন জিজ্ঞেস করেছিল জ্যাটোপেককে, দৌড়বার সময় আপনার মুখে কষ্টের ছাপ ফুটে ওঠে। হাসতে পারেন না? তাইতে উত্তর দিয়েছিল : একই সঙ্গে দৌড় আর হাসি, এই দুটো জিনিস করার মতো যথেষ্ট প্রতিভা আমার নেই।”

কথাটা শুনে সবার সঙ্গে নারানও তখন হেসে উঠেছিল। ট্রেনে যেতে যেতে তিরিশ বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ায় তার মুখে হাসি ফুটল। রাতের বনগাঁ লোকালের ভিড়ের মধ্যেও হাসি? নারান নিজেকে নিয়ে অবাক হল। জীবনের পিছন দিকে তাকালে এখন তার হাসিই পায়। কত জিনিস তুচ্ছ, অকারণ, বাহুল্য মনে হয়। যেমন, শিবুর দোকানে রসগোল্লার হাঁড়িটা ভেঙে ফেলার কোনও দরকার ছিল কি? শঙ্কর, নারু, শচীন হালদাররা কেউই আজ বেঁচে নেই। প্রাইজ হাতে নিয়ে গত মাসেও ফিরেছে, কেউ তাকিয়েও আর দেখে না।

”এমন একদিন আসবে যখন জ্যাটোপেককে তোর আনইম্পর্ট্যান্ট মনে হবে”…না না, টোলুবাবু, এটা আপনি ঠিক বলেননি। কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু ঘটনা চিরকাল আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট থেকে যাবে। …আমাকে কেডস কিনে দেওয়া…।

”বসে পড়ুন দাদু, সিট খালি হয়েছে।” পাঞ্জাবির কোণ ধরে টানল এক ছোকরা। নারান বসে পড়ল।

এখন তার পাকা একতলা বাড়ি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের হাজার পঞ্চাশ টাকা পাবে। তখন দোতলা তুলবে। তিন বছর আগে সে টিভি কিনেছে। অবনী ডবলু বি সি এস হয়ে এখন বীরভূমে আছে বউ আর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে। নবনী জোড়া নিমতলা স্কুলে সায়েন্সের মাস্টার। রজনী বি এস সি পাশ করে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করছে। দু’বার ক্লাস এইটে ফেল করে পড়া ছেড়ে দিয়ে গৌতম এখন প্রথম ডিভিসনে ফুটবল খেলছে। মহামায়া প্রবল আপত্তি তুলেছিল, নারান তা নাকচ করে বলেছিল, ”খেলাটাও তো এক ধরনের শিক্ষার ব্যাপার। যদি টাকা রোজগার করতে পারে তা হলে খেলুক না!” নয়নের বিয়ে হয়েছেই শুধু নয়, তার বড় মেয়ে শর্মিষ্ঠা এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। হাবড়া বাজারে জামাইয়ের কাটা ছিট কাপড়ের দোকান।

পরদিন কাগজে খেলার পাতায় নারানের চোখ আটকে গেল একটা খবরে—রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, সারা ভারত আমন্ত্রণী ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা! সল্ট লেক স্টেডিয়াম থেকে সকাল সাতটায় শুরু হয়ে আবার স্টেডিয়ামেই শেষ। ”সমাপ্তি—সীমায় প্রতিযোগীদের অভিনন্দন জানাতে উপস্থিত থাকবেন জ্যাটোপেক—দম্পতি।”

নারান অনেকক্ষণ খবরটার দিকে তাকিয়ে রইল। তা হলে সত্যিই ওঁরা আসছেন। গড়ের মাঠে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে শনিবার দুপুর একটায় মিছিল বেরিয়ে যাবে সল্টলেক স্টেডিয়ামে। জ্যাটোপেক—দম্পতি এগারোটায় দমদমে নামবেন। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে ব্রিগেড প্যারেড মাঠে। তাঁরা মিছিলের সূচনা করবেন।

খবরের আর কিছু জানার দরকার সে বোধ করল না। এমিলকে যদি কাছ থেকে দেখতে হয় তা হলে ব্রিগেড মাঠের বিরাট ভিড়ের মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। পরে ওঁদের সল্টলেক স্টেডিয়ামেও নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সেখানেও ভিড় হবে। ধাক্কাধাক্কিতে কোথায় যে ছিটকে যাবে তার ঠিকঠিকানা নেই। সে কাছের থেকে ওঁদের দুজনকে দেখতে চায়।

ঠিক তিরিশ বছর আগে, মোহনবাগান মাঠে ওঁর দৌড়ের ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। ছবিটা নারান কেটে রেখে দিয়েছে। জ্যাটোপেক সম্পর্কে একটা লেখাও তখন বেরিয়েছিল, টোলুবাবুর লেখা। সেটাও সে কেটে রেখে দিয়েছে।

নারান খাটের নীচে হামা দিয়ে ঢুকে কবজা—ভাঙা একটা টিনের তোরঙ্গ বার করে আনল। এর মধ্যে তার পুরনো জিনিস রাখা আছে। নানারকমের রেশমের, পশমের ছেঁড়া জামা—কাপড়, কাঠের ভাঙা খেলনা, সাইকেলের টিউব, স্পোর্টসের স্মারক পুস্তিকা ঘেঁটে সে একটা খাম বার করল।

খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া কয়েকটা টুকরো। লালচে হয়ে গেছে। তারই একটা জ্যাটোপেকের দৌড়ের ছবি। সন্তর্পণে সে ভাঁজ খুলল। হাতকাটা গেঞ্জি, পায়ে জুতো। ওঁর পিছনেই খালি পায়ে একজন অনুসরণ করছে। দেখা যাচ্ছে ট্র্যাকের দাগ, ওলটানো একটা মাটির গ্লাস। পিছনে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে দর্শকরা, মাটিতেও বসে আছে অনেকে। জ্যাটোপেকের মাথার সামনের দিকের চুল উঠে গেছে। তখন ওঁর বয়স ছিল ছত্রিশ। নারানের মনে হল, এত বছর কেটে গেছে, এখন বয়স ছেষট্টি, নিশ্চয় টাক পড়ে গেছে! ডান পায়ের হাঁটু উঠিয়েছেন, ঊরুর পেশিতে একটা ভাঁজ। নারান অনুমান করতে পারল, কী প্রচণ্ড শক্তি ওই ভাঁজটা থেকে কুঁচকি পর্যন্ত ফুলে—ওঠা অংশে জমা হয়ে আছে।

কিন্তু দৌড়ের সময় ওঁর মুখে নাকি কষ্টের ভাব ফুটে ওঠে, অথচ খুব খুঁটিয়ে দেখেও সে তেমন কিছু খুঁজে পেল না। হয়তো সহজ রেস, তাই সহজ ভাবে দৌড়চ্ছেন। উনি তো জানেনই পৃথিবীতে তাঁকে হারাবার মতো কেউ তখন নেই। অফিসের স্পোর্টসে অমন আলগা মেজাজে সেও তো দৌড়ত। মুগ্ধ চোখে অনেকক্ষণ ছবিটা দেখে সে কাগজের আর—এক টুকরো তুলে নিল।

টোলুবাবুর লেখা। চার ভাঁজ করে রাখা। খোলা মাত্র ভাঁজ থেকে কেটে আলাদা হয়ে গেল কাগজটা। সযত্নে আবার তুলে রাখতে গিয়ে সে কী মনে করে একটা টুকরো তুলে পড়তে শুরু করল :

‘তারপর ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি ওলিম্পিকে ৫০০০ মিটার, ১০০০০ মিটার এবং ম্যারাথন দৌড়ে বিজয়ীর মঞ্চে যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন দৌড়ের বিস্ময়, নব—ইতিহাসের স্রষ্টা এবং রক্তমাংসের বাষ্পীয় যান নামে অভিহিত করল তাঁকে বিশ্বের অগণিত নরনারী। পঞ্চদশ ওলিম্পিকের নতুন নামকরণ করল জনসাধারণ ওই বিজয়ী বীরের নামে—হেলসিঙ্কি ওলিম্পিক—জ্যাটোপেকের ওলিম্পিক।’

নারান আর একটা কাগজের টুকরো তুলে নিল।

‘কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। স্বামীর কৃতিত্বে উদ্বেলিত হৃদয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন ওই দৌড়বীরের সাধ্বী স্ত্রী। সহধর্মিণী শুধু নন, সহকর্মিণী হিসাবে স্বামীর গৌরবকে আরও গৌরবান্বিত আরও মহিমান্বিত করার জন্য এগিয়ে এলেন বর্শা হাতে বীর নারী। বর্শা ছুড়ে দিলেন প্রিয় স্বামীকে স্মরণ করে। ঝলসিয়ে উঠল সূর্যকিরণে সেই বর্শাফলক। তির বেগে এগিয়ে চলল সেই বর্শা। শ্যামল কোমল দূর্বাদলের মধ্যে যখন সেই শাণিত বর্শার মুখ গিয়ে বিঁধল মাটিতে তখন বিচারকেরা বিস্মিত বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন সেই কম্পমান বিদ্ধ বর্শার দিকে। ঘোষণা করা হল বর্শা নিক্ষেপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নূতন ওলিম্পিক রেকর্ড। স্বামী—স্ত্রী উভয়ে উভয়ের গৌরবে আলিঙ্গন করলেন একে অপরকে।’

পড়তে পড়তে আচ্ছন্ন হয়ে গেল নারান। কী মিষ্টি ভাব, কী মিষ্টি ভাষা দিয়ে টোলুবাবু লিখেছেন। চোখের সামনে যেন ঘটনাটা দেখা যায়।

”কী দেখছ অমন করে ছেঁড়া কাগজে?” মহামায়া পিছন থেকে বলল।

”কিছু না, পুরনো একটা খবর।” নারান কাগজগুলো যত্ন করে খামে ভরে পিছনে তাকাল।

”আজকের কাগজ কি পড়া হয়েছে? নবু চাইছে একটা খবর দেখার জন্য।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যাও।” কাগজটা মহামায়ার হাতে দেবার আগে সে আর—একবার খেলার পাতাটায় চোখ বোলাল। আমন্ত্রণী ম্যারাথন প্রতিযোগিতার খবরটার নীচে ঘন গভীর কালো অক্ষরে লেখা। লাইনগুলোয় তার চোখ আটকে গেল। ‘সোমবার সন্ধ্যায় সিটি ক্লাব তাঁবুতে জ্যাটোপেক—দম্পতিকে বাংলার অ্যামেচার অ্যাথলেটিক সংস্থা সংবর্ধনা জানাবেন। তিনি আরও বলেন তখন ম্যারাথন বিজয়ীর হাতে ট্রফি তুলে দেবেন সেই কিংবদন্তির মানুষটিই যিনি বলেছিলেন, ‘দৌড়তেই যদি চাও তা হলে দৌড়ও এক মাইল। যদি অন্য এক জীবনের অভিজ্ঞতা চাও তা হলে দৌড়ও ম্যারাথন।’

অন্য এক জীবন!

কী সেই জীবন? কেমন সেই জীবন?…তার হাত থেকে কাগজটা তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মহামায়া। নারান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আবার ভাবল, এখন আমার বয়স ছেষট্টি, আর কী অভিজ্ঞতা, আর কী জীবন বাকি আছে?

সন্ধ্যার সময় সে খেলার বিভাগে অনাদিবাবুর সামনে দাঁড়াল।

”কী ব্যাপার নারান, অফিস স্পোর্টস তো হয়ে গেছে, তা হলে আবার যে তুমি…এবারই তো ছিল শেষবারের মতো মাঠে নামা?” অনাদিবাবু প্রশ্নটা করার সময় স্বর নামিয়ে নিলেন। নারান লক্ষ করল, ওঁর মাথার চাঁদিতে টাক পড়েছে। অনাদিবাবুর চাকরিও প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল।

”নারানদাকে একটা ফেয়ারওয়েল দিতে হবে যেদিন ফাইনালি রিটায়ার করবেন।” শ্যামল বলল।

”স্পোর্টস থেকে না চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টের ফেয়ারওয়েল, শ্যামল?” শৈলেন পকেট থেকে নোটবই বার করে টেবিলে রাখল। ”নারানদাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, আরও বছর দশেক প্রাইজগুলো নিতে পারেন। …শশধর মোহনবাগান টু ফিফটি টু অল আউট, অরুণলাল হান্ড্রেড টেন। …আমি ক্যান্টিন থেকে ঘুরে আসছি।”

”একটা কথা ছিল অনাদিবাবু।” নারান ঝুঁকে, লাজুক স্বরে বলল, ”খবর দেখলাম, একটা আমন্ত্রণী ম্যারাথন প্রতিযোগিতা হবে, জ্যাটোপেক তার ফিনিশিংয়ে রানারদের অভিনন্দন জানাবেন। …সত্যি?”

”ও অ্যাথলেটিকসের ব্যাপার, তুমি বরং শ্যামলকে জিজ্ঞেস করো। ওই খবরটবর করে।”

নারান টেবল ঘুরে শ্যামলের পাশে গেল।

সে জিজ্ঞেস করার আগেই শ্যামল বলল, ”হ্যাঁ, জ্যাটোপেক থাকবেন ফিনিশিং পয়েন্টে।”

”অভিনন্দন জানাবেন…মানে হ্যান্ডশেক করবেন?”

”হ্যান্ডশেক করবেন কি আলিঙ্গন করবেন, তা আমি কী করে বলব? হয়তো গালে চুমুও খেতে পারেন…সাহেব তো!” শ্যামল গোছা করা কপি টেনে নিল।

”আমি ম্যারাথনে নামব…ব্যবস্থা করে দেবেন?”

এত মৃদু স্বরে নারান কথাটা বলল যে, টেবলের কেউই শুনতে পেল না। সে সেকেন্ড কুড়ি অপেক্ষা করে, একটু জোরে বলল, ”যে ম্যারাথনটা হবে তাতে আমি দৌড়তে চাই…শ্যামলবাবু আপনার তো চেনাশোনা…।”

”কী বললেন?” সিধে হয়ে বসল শ্যামল। ”আর একবার বলুন!”

”ম্যারাথনে আমি দৌড়ব।”

নারান এবার স্পষ্ট স্বরে বলল। তিনজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে, পাতলা হাসিতে মুখ ভরিয়ে সে আবার বলল, ”কোথায় কাদের কাছে নাম দিতে হবে জানি না। আমায় দেখলে হয়তো তারা নাম নিতে রাজি হবে না, তাই আপনাদের সাহায্য চাই।”

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। তিনজনই তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। অবশেষে অনাদিবাবু একটু বিরক্ত স্বরেই বললেন, ”নারান এটা অফিসের স্পোর্টস নয়…ম্যারাথন কী জিনিস জানো?”

”ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচাশি গজ…”

”দূরত্বটা কতখানি সে সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে?” শ্যামল জানতে চাইল।

”প্রায় অতটাই আমি রোজ সাইকেল চালিয়ে কাগজ বিলি করেছি, আট বছর ধরে।”

”কবে?” শশধর তার জ্যেষ্ঠদের কথার মাঝে নিজের প্রশ্নটা গুঁজে দিল।

”তা প্রায় ছাব্বিশ—সাতাশ বছর আগে।”

”আর তারই জোরে আপনি এখন ম্যারাথন দৌড়তে চান?” শ্যামল ভ্রূ তুলে, কপালে ভাঁজ ফেলে তেরছা চোখে তাকাল।

”গত কুড়ি বছর ধরে রোজ সকালে আমি দৌড়ই। আমার বউ হাঁটে। …কুড়ি বছর ধরে, আমরা দু’জনে…বৃষ্টি হলে অবশ্য বেরোই না, মাটি পিছল হয়ে থাকে।”

”ক’ মাইল দৌড়ন?”

”তা কি আমি মেপে দেখেছি? পাঁচটার সময় বেরোই, সাড়ে ছ’টার মধ্যে ফিরে আসি। বউকে রান্না করতে হবে, আমাকে অফিসের ট্রেন ধরতে হবে তো।”

”দেড় ঘণ্টা! তার মানে…।” শ্যামল জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল অনাদিবাবুর দিকে। ওই সময়ের মধ্যে কতটা দৌড়োনো সম্ভব সেটারই আন্দাজ পাবার জন্য সে সাহায্য চাইছে।

”দেড় ঘণ্টায় কতটা দৌড়বে, শশধর?” অনাদিবাবু সাহায্য চাইলেন, বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকা শশধরের কাছে।

”দেড় ঘণ্টায়…তা ধরুন গিয়ে…এখন তো পুরুষদের ম্যারাথন দু’ঘণ্টা দশ মিনিটে দৌড়োনোটাই ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।” শশধর গাম্ভীর্য টেনে দিল মুখের উপর।

”তুমি কি বলতে চাও, নারান রোজ একটা থ্রি—ফোর্থ ম্যারাথন দৌড়য়? কী যে বলো!”

”না না তা বলছি না,” শশধর কাঁচুমাচু হল। ”নারানদের পক্ষে…আচ্ছা এখন আপনার বয়স ঠিক কত?”

”ছেষট্টি।”

”অ্যাঁ!” শুধু শশধরেরই নয়, আরও দু’ জোড়া চোখ নারানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

”পুরো ছেষট্টি নয়, এখনও সাতমাস বাকি। ওঁর আর আমার জন্ম তারিখ একই, উনিশে সেপ্টেম্বর।” নারানের স্বরে ঈষৎ গর্ব চাপা রইল না।

”ওঁর মানে?” শ্যামলের প্রশ্ন।

”জ্যাটোপেকের।”

”কিন্তু নারান, এই বয়সে তুমি ম্যারাথনে নামবে! কেন? এখন তো বানপ্রস্থে যাবার কথাই তোমার ভাবা উচিত।”

”অনাদিবাবু, আজীবন সংসারের জন্য খেটে এসেছি। বানপ্রস্থ ফ্রস্থ নিয়ে মাথা ঘামাবার টাইম আর পেলাম কই? ম্যারাথন মানে তো অন্য এক জীবনের অভিজ্ঞতা পাওয়া! এইটে পাওয়া হলেই রিয়াটার করব সব জায়গা থেকে।…আমার জন্য যদি আপনারা একটু ব্যবস্থা করে দেন।” নারান হাত জোড় করল।

নারানের কণ্ঠস্বরে এমন এক মিনতি, উৎকণ্ঠা, অসহায়তা আর সারল্য মিলিয়ে রয়েছে যা প্রত্যেকের মন ছুঁয়ে গেল।

শ্যামল বলল, ”ঠিক আছে, নারানদা কাল আপনি ঠিক ছ’টায় সিটি টেন্টের সামনে থাকবেন। ওখানেই অ্যাথলেটিকসের কর্তাদের পাওয়া যাবে। আমি আপনাকে নিয়ে গিয়ে কথা বলব। তবে একটা কথা, ওরা যদি আপনার বয়সের জন্য রিসক নিতে না চায়, তা হলে কিন্তু আমি কিছু করতে পারব না।”

”নারানকে তো অনায়াসে পঞ্চাশ বলে চালানো যায়, যায় না শশধর? ওর মুখের চামড়া কোঁচকায়নি, ঝুলে পড়েনি। চুল তো সবই কালো শুধু কয়েকটা মাত্র সাদা হয়েছে।” অনাদিবাবু বললেন।

”কিন্তু ওরা পঞ্চাশ বছর বয়সিকেও কি দৌড়তে দেবে?” শশধর সন্দেহ প্রকাশ করল।

”দেখা যাক। নারানদা তা হলে কাল ছ’টায়, সিটি টেন্টের সামনে।”

নারান যখন চলে যাচ্ছে, ওরা তিনজনই মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখতে লাগল।

”রোজ দেড়ঘণ্টা দৌড়োনো কি সোজা ব্যাপার! অতক্ষণ হাঁটতে বললে তো পারব না।”

”এই বয়সে!”

”গাঁজা দিয়ে গেল না তো।”

পরদিন সাড়ে পাঁচটা থেকেই নারান দাঁড়িয়ে রইল সিটি টেন্টের সামনে। শ্যামল এল ছ’টায়।

”দেরি হয়ে গেল। চলুন ক্যান্টিনে চা খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন তো…যা ট্র্যাফিকের অবস্থা!”

চা খেতে খেতে শ্যামল নিচু গলায় বলল, ”বয়স টয়স যা বলার আমি বলব, আপনি শুধু সায় দিয়ে যাবেন।”

চা খাওয়ার পর শ্যামল তাকে টেন্টের বাইরে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ভিতরে গেল। নারান দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে রইল। জনা চারেক লোক টেবলে, শ্যামল তাদের সঙ্গে কথা বলছে। নোটবই বার করে কী সব টুকতে লাগল। নারানের মনে হল, শ্যামলের সঙ্গে ওদের সর্ম্পকটা যথেষ্টই ভাল, বন্ধুর মতোই।

মিনিট—পনেরো পর শ্যামল তার কাছে এসে বলল, ”হয়ে যাবে। এন্ট্রি ফর্মটা নিন।”

ফর্মটা হাতে নিয়ে নারান অবিশ্বাসীর মতো দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল, ”হবে? সত্যি!”

”হবে না? এত মিথ্যে কথা তা হলে কী জন্য বললুম! দিল্লিতে ম্যারাথনে ফিফটিনথ, পুণে ম্যারাথনে এইটিনথ, আপনি তো উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের লোক, এখন বাংলায় থাকেন…সার্টিফিকেট দেখাবেন কী, আমার মুখের কথাই তো যথেষ্ট! আসলে কী জানেন—”নারানের কনুই ধরে শ্যামল তাকে টেনে আনল বাইরে ফুটপাথে। ”আসলে যত এন্ট্রি পাবে ভেবেছিল তা আর পাচ্ছে না। বাংলার প্রথম সারিতে পড়ে যারা, তারা নামছে না। বলল, বাইরে থেকে বিরাশি জন বাংলার বাহান্ন জন, মোট একশো চৌত্রিশ জন নামবে। কিন্তু কথা শুনে মনে হল এর অর্ধেকও হবে না। প্রাইজ মানি নেই তো, তাই নামকরাদেরও কোন উৎসাহ নেই। …আপনার বয়স সম্পর্কে আমি কোনও উচ্চবাচ্য করিনি। যা বলার এন্ট্রি ফর্মে লিখে দেবেন।”

”কিন্তু জ্যাটোপেকের সামনে ফিনিশ করবে, এর থেকে বড় প্রাইজ আর কী হতে পারে!” নারান অবাক হয়ে তাকাল শ্যামলের দিকে।

”আরে দূর! জ্যাটোপেকের নামই এরা শোনেনি। আপনাদের সময়ের হিরো ছিল বলে কি এখনও তাই থাকবে? খেলার দুনিয়ার আজ যে ওয়ার্লড রেকর্ড করে হিরো, কালই আর একজন সেটা ভেঙে দিয়ে হিরোকে জিরো করে দিচ্ছে।”

”কিন্তু জ্যাটোপেকের তিনটে বড় দৌড় সাতদিনের মধ্যে জেতা…আজও তো পৃথিবীতে কেউ পারল না!”

”পারবে। স্পোর্টস টেকনোলজি তেমন অ্যাথলিক ঠিকই তৈরি করে দেবে। বাহান্ন সালে মানুষ মহাকাশে যাবার কথা ভাবতেই পারেনি আর এখন তো ডজন ডজন যাচ্ছে আর আসছে।”

নারান চুপ করে গেল। শ্যামলের কথাগুলো মিথ্যে নয়। তবু সে কেন জানি মন থেকে সায় দিতে পারল না। মানুষের শরীরের এতবড় একটা কৃতিত্ব বিজ্ঞান ভেঙে দেবে?

পরদিনই সে এন্ট্রি ফর্ম পুরণ করে শ্যামলের হাতে দিল জমা দেবার জন্য।

।। ৭।।

রবিবার সকাল সাতটায় যখন তারা সল্ট লেক স্টেডিয়ামের ফটকের সামনে দাঁড়াল তখন অল্প কয়েকজন অফিসিয়াল ছাড়া আর ছিল বেলেঘাটার স্থানীয় কয়েকজন দর্শক। নারান গত রাত্রেই এসে স্টেডিয়ামের একতলায় একটা বড় ঘরে অন্যদের সঙ্গে ছিল।

নারান ছেলেদের কিছু বলেনি। সে ধরেই নিয়েছে, বললে অবশ্যই ওরা তাকে ম্যারাথন দৌড়তে বাধা দেবে। শুধু মহামায়কে সে বলেছিল, ”একটা রোড রেস হবে কলকাতায়। অফিসের তিন—চারজন নাম দিয়েছে, আমিও দিয়ে দিলাম।”

”কতটা দৌড়তে হবে?” মহামায়া জানতে চায়।

”বেশি নয়, দু’ মাইল। ভোরবেলায় শুরু হবে, তাই রাতে ওখানে গিয়ে থাকতে হবে। থাকার জায়গা ওরাই দেবে, খাওয়াও। আমাকে নিয়ে যেতে হবে বিছানা আর মশারি। তুমি হাওয়া—বালিশ, সুজনি আর আলোয়ানটা দাও। মশারি লাগবে না। একটা রাত তো, কত আর কামড়াবে!”

”কী প্রাইজ দেবে? রুপোর কাপ?”

”হ্যাঁ। তবে আমি পাচ্ছি না। এই বয়সে কি জেতা যায়!”

”মোটে দু’ মাইল তো! একটু জোরেই শুরু থেকে ছুটবে।”

মহামায়ার অলক্ষে নারান হেসেছিল।

শনিবার সে অফিসে ছুটি নিল। দুপুরে ঘুমিয়ে ছ’টা চব্বিশের ট্রেন ধরল। বিধাননগর স্টেশনে নেমে উল্টোডাঙা—ভি আই পি রোডের মোড়ে এসে দেখল প্রচুর লোক। হেঁটে, লরিতে তারা ফিরছে। একজনের কাছে শুনল, এমন মিছিল হয়েছে যে সারা কলকাতায় ট্র্যাফিক জ্যাম! লোকেদের খুব অসুবিধা হয়েছে। ব্রিগেড প্যারেড মাঠ থেকে সল্ট লেক স্টেডিয়াম প্রায় আট মাইল পথ। স্কুলের বাচ্চচা বাচ্চচা ছেলেমেয়েরা হেঁটে আসতে পারছিল না। অনেকে কান্না জুড়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পরও মিছিলের শেষভাগ স্টেডিয়ামে পৌঁছতে পারেনি।

ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে স্টেডিয়ামের দিক থেকে যারা হেঁটে ফিরে আসছে তাদের একজনকে সে জিজ্ঞেস করল, ”জ্যাটোপেক এসেছেন কি?”

”আরে দূর মশাই জ্যাটেপেক! ব্রিগেড গ্রাউন্ডে অপেক্ষা করে করে শুনলাম তাঁর প্লেন সাড়ে চারঘণ্টা লেট। এতটা পথ হেঁটে এসে আর মশাই পারছি না। স্টেডিয়ামের কাছে যা ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, তাতে আর ভেতরে যেতে ইচ্ছে করল না। কাগজে কাল ছবিতেই ওঁকে দেখে নেব।”

লোকটিকে বিরক্ত, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নারান আর কোনও প্রশ্ন না করে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে হাঁটতে শুরু করে। যত এগোচ্ছে ভিড় ততই বাড়ছে। বিছানার পোঁটলাটা বগলে নিয়ে চলতে অসুবিধা হচ্ছে। রাত বেশি হয়ে যাবার ভয়ে, ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা স্টেডিয়ামে না ঢুকেই ফিরে যাচ্ছেন। নারানের মনে হল, এত বিশৃঙ্খলা বোধহয় সে জীবনেও দেখেনি।

স্টেডিয়ামটা সে দেখতে পাচ্ছে। আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। থোকা থোকা বেলুন, পতাকা। দেখে নারানের মন ভরে উঠল খুশিতে, শরীরে চনমনানি লাগল।

”ভাই, জ্যাটোপেক কি এসেছিলেন?” নারান মাঝবয়সি একজনকে জিজ্ঞেস করল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ, অল্প অল্প ঠাণ্ডা, কিন্তু লোকটি ঘামছে।

”হ্যাঁ। এই তো চলে গেলেন।”

”চলে গেলেন!” নারানের ভিতরটা চোপসানো বেলুন হয়ে গেল। দেখা হল না।”একটু দেরি হয়ে গেল।” আপনমনে সে বলল।

লোকটি অবাক হয়ে বলল, ”একটু বলছেন কী, জ্যাটোপেকের প্লেন কত দেরি করে এসেছে জানেন?”

”সাড়ে চারঘণ্টা, শুনলাম।”

”তবে? তার ওপর এই মিসম্যানেজমেন্ট।”

”ওঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে তো?” উৎকণ্ঠিত দেখাল নারানকে।

”নিশ্চয় হয়েছে। আমি কিছুই দেখতে পাইনি। বক্তৃতার একটু একটু কানে এল, এই পর্যন্তই।” লোকটি পা বাড়াল যাবার জন্য, নারান তার হাত টেনে ধরল।

”কী বললেন?”

লোকটি হাত ছাড়িয়ে বিরক্তভাবে বলল, ”শুধু টাকা রোজগারটাই খেলোয়াড়—জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়” লোকটি চলে যেতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল। ”আর একটা কথা বলেছেন, ”একজন অ্যাথলিট আসলে একজন ডাকপিওনের মতো। তার সামাজিক দায়িত্ব আছে। সেটা পালনের জন্য তাকে দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে। এখন আর খেলা শুধুই মজার জিনিস নয়।”

লোকটি ভিড়ে মিশে যাবার পরও নারান তাকিয়ে ছিল। কথাগুলোর অর্থ সে ধরতে পারছে না। অ্যাথলিট দরজায় দরজায় ঘুরে ডাকপিওনের মতে কড়া নেড়ে চিঠি পৌঁছে দেবে, মানে খবর পৌঁছে দেবে। কী খবর পৌঁছে দেবে। স্পোর্টসম্যান হও! জীবনের সর্বক্ষেত্রে খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখাও! জীবনে হারজিতকে সমানভাবে হাসিমুখে মেনে নাও…এইসব খবর কি পৌঁছে দেওয়া খেলোয়াড়দের কাজ?

রাতে বড় হলঘরে সারি দিয়ে শোওয়া অ্যাথলিটদের সঙ্গে নারানও আলোয়ান মুড়ি দিয়ে শুয়ে ভেবে যাচ্ছিল। তার কানে এল একজনের নিচুগলার কথা : ”আমি তো দশ—বারো মাইল দৌড়েই বসে যাব। কী লাভ বল এইসব আজেবাজে কম্পিটিশনে মিছিমিছি দৌড়ে? কী পাব? একটা সার্টিফিকেট আর কিছু স্যুভেনির! তার জন্য এই পরিশ্রম করব কেন?”

”ঠিক বলেছিস। ন্যাশানাল মিট হলেও নয় কথা ছিল, চাকরিতে কিছু সুবিধে করা যেত। স্টেট আমাকে কী দেয় যে বাংলার হয়ে নামব? ন্যাশনাল মিটে আমার সিলেকশন পাওয়ার জন্যই তো তুই এখানে নামছিস? আমার ওসব চিন্তা নেই, আমি অটোমেটিক সিলেকশন পাব আমার অফিস স্টিল অথরিটি থেকে।”

”বাংলা থেকে ক’জন কাল নামছে জানিস? মোটে বারোজন!”

”বলিস কী!”

”হ্যাঁ। এর মধ্যে আট জন জীবনে কখনও আগে ম্যারাথনই করেনি। বোঝ তা হলে?”

”বারোজনে আটজন নভিস?”

”শুধু তাই নয়, কাউকে বলিসনি, আমি খুব ভাল জায়গা থেকেই শুনেছি, তার মধ্যে একজনের বয়স নাকি ষাটের ওপরে!”

”সেরেছে। পথেই কোলাপস করে, মরে টরে না যায়!”

”ফিনিশ করার সময় বেঁধে দিয়েছে—দু’ ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট। ওর মধ্যে পৌঁছতে না পারলে রাস্তা থেকেই কম্পিটিটারদের তুলে নেওয়া হবে। দেখা যাক, অতক্ষণ ক’জন দৌড়তে পারে।”

দাঁতে দাঁত চেপে নারান শুনল এই কথোপকথন। মুখ ঢাকা আলোয়ানটা আর একটু টেনে সে কাত হয়ে গেল। কাল তাকে শেষ করতেই হবে। কিছুতেই সে নিজেকে তুলে নিতে দেবে না। যেভাবেই হোক। …হেঁটে হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে… যেভাবেই হোক, সে দরজায় দরজায় যাবে…কড়া নাড়বে। খট খট খট…খট…খট…খট…। কড়া নাড়তে নাড়তে নারান ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল সাতটায় স্টেডিয়াম—ফটক থেকে রওনা হল সাতান্নজন। নারানের বুকে আঁটা নম্বর হল: ৫১। শ্যামলবাবু তা হলে ঠিকই বলেছিলেন, যা বলেছিল কর্তারা, তার অর্ধেকও হয়নি। নারান একটু দমে গেল। তার চারপাশে সবাই অচেনা। যে রাস্তা দিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে সেটা অবশ্য তার চেনা। বাসে কয়েকবার সে ধান্যকুড়িয়া থেকে কলকাতায় এসেছে।

দৌড়ের রুট খুব সহজ। প্রথমে দক্ষিণ মুখে রওনা। ইস্টার্ন বাইপাস থেকে ডাইনে বেলেঘাটা মেইন রোড। তারপর আবার ডাইনে ফুলবাগান। এরপর সোজা উত্তরে দমদম এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে, সি আই টি রোড কাঁকুড়গাছি মোড়, উল্টোডাঙার মোড়, কেষ্টপুর মোড়, বাগুইআটি মোড়, কৈখালি পিছনে ফেলে যশোর রোড। ডান দিকে পুবে ঘুরে মধ্যমগ্রাম, বারাসত যাবার বাসরুট ধরে, এয়ারপোর্টের পাঁচিল ডানদিকে রেখে ছুটতে হবে। তারপর একসময় আসবে একটা মোড়। যশোর রোড বাঁ দিকে ঘুরে মধ্যমগ্রামের দিকে, আর একটা রাস্তা সোজা গিয়ে গঙ্গানগরের মধ্য দিয়ে কাটাখালের পোল পার হয়ে বাঁ দিকে ঘুরে আবার মিশেছে যশোর রোডে। এই কাটাখালের পোল পর্যন্ত গিয়ে ম্যারাথনারদের ফিরে আসতে হবে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে।

মন্থরভাবে সবাই শুরু করল। নারান রয়েছে ঝাঁকের মাঝে। এত লম্বা রেসে আরম্ভ থেকেই কেউ জোরে দৌড়য় না। দম যাতে শেষ পর্যন্ত থাকে, সেটাই আগে দেখতে হবে। নারান ঠিকই করে রেখেছে, কোনওভাবেই জোরে ছোটার জন্য প্রলোভিত হবে না। কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পটা আজ সকালেও তার মনে পড়েছে। তাকে স্লো আর স্টেডি থাকতে হবে।

নারান ফুলবাগানের মোড় থেকে দেখল সে সবার পিছনে। সবার আগে সাদা পতাকা বাঁধা একটা মোটর, তার আগে একটা পুলিশভ্যান। প্রথমে যাচ্ছে যে রানার সে তাকে দেখতে পেল না। দেখার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। তার সামনে শুধু অনেক মাথা আর কাঁধ, দুলছে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে উঠছে। যাক সবাই এগিয়ে, সে প্রাইজ জেতার জন্য দৌড়চ্ছে না।

ফুটপাথে লোক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বারান্দায় বাচ্চচা—বুড়ো, মেয়েরা। রবিবার সকালে ছুটির মেজাজ। এখন হালকা রোদ। নারানের কষ্ট হচ্ছে না। সে একই গতিতে দৌড়ে পৌঁছল উল্টোডাঙার মোড়ে। সামনেই একটা ব্রিজ। বোর্ডে লেখা রয়েছে : নজরুল ইসলাম সরণি। লোকে এটাকেই ভি আই পি রোড বলে।

”দাদা, আরও জোরে ছুটুন। সবাই যে এতক্ষণে লেকটাউনে পৌঁছে গেছে।” একজন চেঁচিয়ে বলল।

”লেকটাউন কী বলছেন! প্রথম ঝাঁকটা কতক্ষণ আগে গেছে জানেন?” আর একজন বলল।

নারান মাথা নামিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। শুনতে চায় না সে। এগুলোই প্রলোভন। এই সব কথাবার্তাই ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, তাতিয়ে দেয়। সে কোনও কথা শুনবে না, ডাইনে—বাঁয়ে তাকাবে না। রোজ সকালে যেভাবে দৌড়য় সেইভাবেই দৌড়বে।

মাথাটা একটু বাঁকিয়ে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে নারান ছুটে চলল। পাশ দিয়ে বাস, মোটর, ট্রাম ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির জানলা দিয়ে কৌতূহলী মুখ তাকে দেখছে। সে ভ্রূক্ষেপ করল না।

একটা মোটরবাইকে দু’জন অফিসিয়াল। তার পাশে এসে গতি মন্থর করে বলল, ”শেষ করতে পারবেন তো?”

”হ্যাঁ।” নারান ওদের দিকে তাকাল না।

”দু’ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে ফিনিশ করতে হবে, না হলে কিন্তু তুলে নেওয়া হবে গাড়িতে।” বলেই ওরা বিকট শব্দ করে মোটরবাইকটা চালিয়ে দিল। নারান একবার মুখ তুলে দেখল, সামনে কোনও রানার আর চোখে পড়ল না।

রাস্তার ধারে টেবল পেতে গ্লুকোজ মেশানো জল, বরফ নিয়ে ভলেন্টিয়াররা রয়েছে। তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু খাওয়াটা কি উচিত হবে? ঘাম দিচ্ছে শরীরে। গেঞ্জি সপসপ করছে। সে একটা গ্লাস তুলে নিল।

”খুব পিছিয়ে আছেন।”

”আপনি ব্যস্ত হবেন না দাদা, যেমন যাচ্ছেন যান। ফিনিশটা করুন।”

”একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। যশোর রোডে লরি আর বাস বড্ড বেপরোয়া চলে।”

গ্লাস রেখে মাথা হেলিয়ে হেসে নারান আবার ছুটতে শুরু করল। ফুসফুস সমান তালে কাজ করছে। ঊরু আর পায়ের গোছ ভারী লাগছে না। নারান নিরুদ্বিগ্ন বোধ করল। এয়ারপোর্ট হোটেল ছাড়িয়ে ডান দিকে ঘুরে সে আটকে গেল বাস আর সাইকেল রিকশর ভিড়ে। ট্র্যাফিক দেখার জন্য বিশেষ পুলিশ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আর কোনও রানার নেই ভেবে তারা ঢিলে দিয়েছে।

এইবার রাস্তা সত্যিই বিপজ্জনক। পিচবাঁধানো রাস্তার উপর দিয়ে ছুটতে তার ভয় করল। পিছন থেকে যে কোনও সময় গাড়ির ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে রাস্তার ধারের মাটির কাঁচা পথ ধরে ছুটতে শুরু করল। এখানেও পদে পদে বাধা। মানুষজন রিকশ, গোরুর গাড়ি, বাজার—ছোটা অসম্ভব।

এইবার তার বাঁ হাঁটুতে সামান্য একটা চিড়িক দিল। থমকে থমকে ছোটার জন্য তো বটেই, দু’ বার গর্তে পা পড়েছিল। পতন সামলাতে গিয়ে হাঁটুতে ধাক্কা লাগে। কাঁচারাস্তা ছেড়ে সে এইবার পিচের রাস্তায় উঠল। এখানেও ভাঙাচোরা, পাথরকুচি ছড়ানো। তবু কাঁচারাস্তার থেকে তো ভাল!

বিশাল একটা প্লেন নামছে তার মাথার উপর দিয়ে। এত কাছ থেকে নারান কখনও প্লেন দেখেনি। বড় একটা সাদা পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে হালকাভাবে ভেসে এল। জানলায় মুখ দেখা যাচ্ছে। মেঘ গর্জনের বদলে একটা তীক্ষ্ন শিশের মতো শব্দ করে রানওয়েতে চাকা ছুঁইয়েই ঝাঁকুনি খেল। নারান দেখতে দেখতে দৌড়চ্ছিল, এবার মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়েই অবাক হল।

পুলিশের জিপ তার পিছনে ছ—সাতজন রানার ফিরে আসছে গঙ্গানগর থেকে। তাকে দেখে সবাই তাকাল। দু—তিনজন হাত তুলল। সবাই অল্পবয়সি। মাথায় টুপি, রোদ থেকে চোখ বাঁচানোর জন্য। আঠারো, চব্বিশ, ছাব্বিশ…এই ক’টা নম্বর সে পড়তে লাগল।

যাক। জোয়ান ছোকরারা আগে যাবে না তো কি ছেষট্টি বছরের বুড়ো প্রথমে যাবে!

আর একটু এগিয়ে সে আর কয়েকজনকে ফিরতে দেখল। সেই মোটরবাইক আবার তার কাছে এল।

”এইভাবে চললে ফিনিশ করবেন কখন? তেইশ জন ইতিমধ্যেই গাড়িতে উঠে পড়েছে।”

”উঠুক…আমাকে নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না…আমি শেষ করবই।

”কবে? আজকেই কি?” অধৈর্য, বিরক্ত প্রশ্ন।

নারান হাসল।

”আমরা কি সারাদিন স্টেডিয়ামে বসে থাকব ভেবেছেন?”

নারান জবাব দিল না। মোটরবাইক চলে গেল। আরও কয়েকজন রানার ফিরে চলেছে। ক্লান্ত পদক্ষেপ, চোখ মুখ বসা। দেখে মনে হল, আর একটু পরেই এরা বসে যাবে। একজন হুমড়ি খেয়ে রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়ল। তাকে পাশ কাটিয়ে অন্যরা এগিয়ে গেল। কেউ ফিরে তাকালও না। একটা ভ্যান এসে দাঁড়াল। রানারটিকে দু’জন লোক ধরে তুলছে। নারানও আর তাকাল না। তাকে এখন অনেক পথ দৌড়তে হবে।

গঙ্গানগর কাটাখাল থেকে ফেরার সময় সে অনুভব করল, শরীরে গোলমাল ঘটছে। কোমরের পিছন দিকে একটা খচ—খচানি শুরু হয়েছে। আগে কখনও এখানে ব্যথা হয়নি। আজই প্রথম। বাঁ পায়ের ডিমের কাছে শিরাটা মাঝে মাঝে টেনে ধরছে। কেডসটা গরম হয়ে পায়ের তলা জ্বালা করছে। ফোসকা পড়ার মতো অবস্থা। রোদ্দুরে চোখ—করকরানি শুরু হয়েছে।

এইবার ক্লান্ত লাগছে। ঊরু দুটো ভার ভার লাগছে। একটু দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নেবে কি? নারান মনে মনে ইতস্তত করল। এখন ক’টা বাজে?

.

না, ঘড়ি দেখবে না। আর সেজন্যই তো সে বাড়িতে হাতঘড়িটা রেখে এসেছে। সময় নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তার দরকার দৌড়টা শেষ করা…জ্যাটোপেকের সামনে।

”ছোটো…ছোটো…নারান হালদার, ছোটো।” বিড়বিড় করে সে নিজেকে বলল।

পায়ের জ্বালাটা এবার অসহ্য লাগছে। নারান উবু হয়ে বসে কেডস জোড়া খুলে হাতে নিয়ে, খালি পায়েই আবার ছুটতে শুরু করল।

”সারা জীবন পরিশ্রম করেছ, আর এটুকু পরিশ্রম করতে পারবে না? …ছোটো, ছোটো…থামছ কেন…পায়ের শির টেনে ধরছে? তা হলে কি শেষ করতে পারবে না?”

নারান দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঝুঁকে বাঁ পায়ে হাত বোলাতে গিয়ে আবার সিধে হয়ে ছুটতে শুরু করল।

”টোলুবাবু, আপনি আমার সঙ্গে নেমেছিলেন। বলেছিলেন, ফাঁকা মাঠে গোল দিলে সম্মান থাকে না, অসম্মান নিয়ে জিতবে কেন? আমাকে সম্মান দিতে আপনি সে দিন নেমেছিলেন। …আর এই দেখুন এই রেসে এখন আমি সবার পিছনে একা ছুটছি। কেউ নেই সঙ্গ দেবার জন্য…বলেছিলেন স্পোর্টসম্যানশিপ দেখাতে জানি। টোলুবাবু, আপনি বলেছিলেন, নারান আমি ফিনিশ করবই। …আমি ফিনিশ করবই…স্পোর্টসম্যানশিপ…ডাকপিওনের মতো দরজায় দরজায় পৌঁছে দিতে হবে।”

নারান ছুটে যাচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে। সেই একই রাস্তা ধরে তার ফিরে—যাওয়া। যশোর রোড থেকে নজরুল ইসলাম সরণি। কৈখলি… রাস্তার ধারে টেবলে জল নিয়ে বসা লোকেরা আর নেই। পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়ে তারা চলে গেছে।

বাগুইআটি। মোড়ে জমাট ভিড়। অবাক চোখে সবাই দেখছে। নারান কিন্তু কিছুই দেখছে না। শূন্য দৃষ্টি সামনে রেখে সে ছুটছে। যতক্ষণ ফুসফুস কাজ করবে থামা চলবে না।

একের পর এক, কেষ্টপুর, বাঙুর, লেকটাউন, শ্রীভূমি আর বাঁদিকে সল্ট লেক উপনগরী পিছনে রেখে নারান উল্টোডাঙা মোড়ে পৌঁছল। এবার বাঁদিকে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে সোজা স্টেডিয়াম। বলে দিয়েছে, পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। একটা চক্কর দিয়ে থামতে হবে মঞ্চের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এমিল আর ডানা।

”আরে দেখে, দেখে মশাই, মোটরের সামনে পড়তেন যে।”

মাথা নাড়ল নারান। এসব কথা গ্রাহ্য করার মতো অবস্থা তার এখন নেই। সে ছুটছে, না হাঁটছে তাও সে জানে না। শুধু অনুভব করছে সে এগোচ্ছে, ফিনিশিং লাইনের দিকে ক্রমাগত নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।…পাঁচ নম্বর গেট তার চাই।

বাইপাসের ধারে টিনের ঘর। কয়েকটা বাচ্চচা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। জুতো হাতে নারানকে ছুটে আসতে দেখে তারা এগিয়ে এল। মজা পাওয়ার জন্যই তারা ওর পাশে পাশে ছুটতে শুরু করল। কিছু দূর গিয়ে তারা থেমে পড়ল।

বাঁ দিকে কাদাপাড়ার মাটির পাহাড়ে জঙ্গল। এবার বঁ দিকে স্টেডিয়ামের পাঁচিল ধরে এগোলে ঢোকার গেট। রাস্তাটা নির্জন! একটা মিনিবাস আসছে। নারান ধারে সরে গেল।

পাঁচ নম্বর গেট। খোলাই রয়েছে। ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকে চক্কর শুরু করতে হবে।

নারান ডান হাতটা তুলল। কী সুন্দর, হলুদ, নীল রঙের চেয়ার দিয়ে ফুলের মতো সাজানো। সে কি কখনও ভেবেছিল এমন একটা জায়গায় দৌড়বে।

কিন্তু লোকজন কই। নিস্তব্ধ। কয়েকজন মজুর ছাড়া একটা লোকও নেই। এ কী, মঞ্চটা খোলা হচ্ছে কেন? এমিল কই, ডানা কই? নারান সমাপ্তি—সীমায় দাঁড়িয়ে টলতে শুরু করল।

ধুতি—শার্ট পরা এক প্রৌঢ় নারানকে দেখে, মঞ্চ খোলায় ব্যস্ত মজুরদের কাছ থেকে এগিয়ে এল।

”আপনি কি ম্যারাথন রেসে ছিলেন?”

”হ্যাঁ।”

লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

”সব গেল কোথায়?” নারান হাঁফাচ্ছে। চোখে মুখে হতাশা।

”সবাই তো চলে গেছে। ক’টা বাজে দেখেছেন?” লোকটি বাঁ হাত তুলে ঘড়ি দেখাল। ”এগারোটা পঞ্চাশ! এতক্ষণ কি কেউ বসে থাকে?”

”জ্যাটোপেক কোথায়, তাঁর যে থাকার কথা।”

”তাঁর কি আর কাজকর্ম নেই! আপনি আসবেন পাঁচ—ঘণ্টা পর, আর সেজন্য বসে থাকবেন? শেষ তো করেছে মাত্র দশজন, আপনি হলেন এগারো। দু’ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেছে মাত্র চারজন। আমি তখন ছিলাম না। শুনলাম ওদের কনগ্র্যাচুলেট করেই সস্ত্রীক তিনি চলে গেছেন। চাঁপাদানিতে ওদের রিসেপশন দেওয়া হবে?”

নারান শূন্য স্টেডিয়ামের চারধারে চোখ বোলাল। ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে উঠল অদ্ভুত এক হাসি। মাথা নাড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে তার হাসিটাও উজ্জ্বল হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল সারা মুখে।

সন্ধ্যাবেলায় পোঁটলা বদলে নারান বিধাননগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখন বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সি, কোট—প্যান্ট—টাই—পরা একটি লোক তাকে কয়েকবার লক্ষ করে এগিয়ে এসে বলল, ”কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”

”বলুন।”

”আচ্ছা আপনি কি এক সময় সাইকেলে ঝাউডাঙায় খবরের কাগজ বিক্রি করতেন?”

”হ্যাঁ।”

লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ”ঠিক ধরেছি আমি। আপনাকে চিনতে পারলাম, কারণ আপনি এত বছরে…প্রায় ত্রিশ—পঁয়ত্রিশ তো হবেই, একটুও বদলাননি, একই রকম রয়ে গেছেন। আমি হলাম ঝাউডাঙার বাদল নস্করের নাতি। আপনার জন্য আমি রোজ তখন অপেক্ষা করতাম।”

নারান হাসিমুখে তাকাল। সেদিন এই লোকটি এক কিশোর ছিল। হ্যাঁ, মুখখানি চেনা ঠেকছে।

”আপনাকে আরও মনের রেখেছি কেন জানেন? …বোকার মতো বলেছিলাম, কে জ্যাটোপেক? …রেকর্ড তো কতই হচ্ছে কে মনে করে রাখে?”

”হ্যাঁ আমার মনে আছে।”

”তখন কত বোকা ছিলাম। …আপনি এখানে কোথায় এসেছিলেন?”

”এসেছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। একটু দেরি করে ফেলায় তার সঙ্গে আর দেখা হল না। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”

ম্লান, বিষণ্ণ হাসিতে নারান কথাগুলোকে মুড়ে দিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোড়কটা খুলে বলল, ”অবশ্য সেজন্য আমার কোনও দুঃখ নেই।”

”আগে খবর দিয়ে না এলে এইরকম হয়রান হতে হয়। আপনি বন্ধুকে বোধহয় আগে বলে রাখেননি?”

”না, বলে রাখিনি। ভেবেছিলাম হঠাৎ দেখা করে অবাক করে দেব।”

”এখন কি বাড়ি ফিরবেন?”

”হ্যাঁ, ধান্যকুড়িয়া। ওখানেই সাতচল্লিশ সাল থেকে আছি।”

”ওখান থেকে সাইকেলে ঝাউডাঙায় রোজ আসতেন কাগজ বিক্রি করতে!” ভদ্রলোকের বিস্ময় গলা আর চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল। নারান শুধু হাসল।

”আপনি কি এখনও ঝাউডাঙায় থাকেন?”

”দমদমে বাড়ি করেছি। ওখানেই আমার কারখানা, জানলা দরজার গ্রিল তৈরি করি। এখানে এসেছিলাম জ্যাটোপেককে দেখার জন্য।”

”দেখলেন?” নারান উত্তেজনা দমন করে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল।

”হ্যাঁ। বেশ মোটা হয়ে গেছে। মাথার চুল তো কম ছিলই, এখন একেবারেই টাক।”

”আর কী দেখলেন?”

”আর কী দেখার আছে। এখন তো উনি নিবে যাওয়া আগ্নেয়গিরি।”

”উনিশশো বাইশের উনিশে সেপ্টেম্বর।” অস্ফুটে নারান বলল, ”দু বছরের ছোট।”

”য়্যাঁ?” লোকটি বুঝতে না পেরে জানতে চাইল।

”কিছু না, একটা জন্মসাল মনে পড়ল তাই। আমার বন্ধু যে আমার থেকে দু’ বছরের ছোট এটা ভুলেই গেছলাম। তা হলে জ্যাটোপেককে দেখে আপনি খুবই নিরাশ হয়েছেন।”

ট্রেনের আলো এগিয়ে আসছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো লোকেরা লাইনের ধার থেকে একটু পিছিয়ে এল। নারানের কথার জবাব না দিয়ে লোকটি তাকিয়ে রইল স্টেশনে প্রবেশরত ট্রেনের দিকে।

ট্রেনের দরজায় ওঠানামার একটা ধাক্কাধাক্কি প্রথমে হবেই। এই অনুমান করে নারান একটু বেশি পিছিয়ে এল। মুখ পাশে ফিরিয়ে তাকাল প্ল্যাটফর্মের ভিড় আর মন্থর হতে হতে থামা ট্রেনের দিকে। হঠাৎ তার মনে হল এই ট্রেনটাই যেন জ্যাটোপেক আর এই লোকগুলো যেন তার জীবনের পেরিয়ে আসা বছর। দুবার সে চেষ্টা করে এই ট্রেনটা ধরতে পারেনি।

হুড়মুড়িয়ে কামরা থেকে লোক নামছে আর ট্রেন ছেড়ে দেবার ভয়ে মরিয়া লোকেরা ঠেলেঠুলে ঢোকার চেষ্টা করছে। নারান যার সঙ্গে কথা বলছিল সেই লোকটি কোনদিকে যেন ছিটকে গেছে। ধাক্কাধাক্কি শেষ হবার পর সে পুঁটলি বগলে শান্ত ভাবে সামনের কামরায় উঠে দাঁড়াবার মতো জায়গা পেল।

ট্রেন চলতে শুরু করার পর নারান কামরার মধ্যে চোখ বোলাল। নানা ধরনের মানুষ, ছোট বড়, লম্বা বেঁটে, নানারকমের মুখ, পোশাক কথাবার্তা। এতগুলো, এত রকমের বছর! এরই মধ্যে আমলকীর, বাদামের, মুসম্বি লেবুর ফেরিওয়ালা নিজেদের পসরা বিক্রি করে যাচ্ছে। নারানের মনে হল, কত বছর ধরে সে ট্রেনে যাতায়াত করেছে কিন্তু এমন করে কখনও তো সে মানুষজনের দিকে তাকায়নি!

ট্রেনটা দুলছে। নারান চোখ বন্ধ করে পিছনের দিকে যত দূর দৃষ্টি যায় দেখার চেষ্টা করল। চেষ্টা করতে করতে তার মনে হল, জীবন তাকে অনেক কিছুই তো দিয়েছে। তার কোনও অভিযোগ নেই, জ্যাটোপেককে দেখতে না পাওয়ার জন্য কোনও আফশোস নেই। মানুষের সব আকাঙ্ক্ষাই কি পূরণ হয়? পূরণ হলে সেটাকে আর জীবন বলা যায় না।

রাত্রে বাড়ি ফিরে মহামায়ার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে নারান বলল, ”আমি তো বলেই ছিলাম, এই বয়সে কি জেতা যায়?”

”শেষ করেছিলে তো?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মহামায়া জানতে চাইল।

উদ্ভাসিত মুখে নারান বলল, ”নিশ্চয়ই। এইটুকু পথ দৌড়তে পারব না! যতদিন পারি হুসহুস করে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *