দলবদলের আগে

দলবদলের আগে – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।। ১ ।।

দমদম থেকে ভি আই পি রোড ধরে কলকাতার দিকে যেতে ডান দিকে পড়বে সুশোভন পল্লি। তিরিশ ফুট চওড়া একটা পাকা রাস্তা ভি আই পি রোড থেকে বেরিয়ে ঢুকে গেছে এই পল্লির মধ্যে। রাস্তাটা বেড় দিয়ে রয়েছে বাইশ বিঘার এই বসতিকে। নামের সঙ্গে ‘পল্লি’ শব্দটা থাকায় অনেকেরই মনে হতে পারে এখানে মাটির বা ছ্যাঁচা বাঁশের দেয়াল দেওয়া খড় বা টালির চালের ঘর, চালের ওপর লাউ বা কুমড়ো গাছের পাতা, কাঁচা নর্দমা আর তাতে জমে থাকা পাঁক, দড়িতে বাঁধা দু—চারটে গোরু বা ছাগল এবং প্রতি বাড়ির সামনে কুকুর আর শুকোতে দেওয়া ভিজে শাড়ি—ব্লাউজ, পাজামা ইত্যাদি দেখা যাবে, তা হলে তিনি কিন্তু ভুল করবেন।

সুশোভন পল্লি সম্পন্ন গৃহস্থদের একটা ছোটখাটো উপনিবেশ। পঁচাত্তরটি প্লট নিয়ে এটি গড়ে উঠেছিল কুড়ি বছর আগে। প্রতি বাড়ির সামনে পনেরো ফুট চওড়া রাস্তা, বাড়িগুলোর অধিকাংশেরই বুকসমান ছোট্ট লোহার ফটক, তারপর সিঁড়ি আর ছোট একটা দালান, যেটা গ্রিল ঘেরা। চেয়ার পেতে সেটা বৈঠকখানাও করা যায়। অধিকাংশ ফটকের পাশের দেয়ালে পাথরের ফলকে বাড়ির নাম আর নম্বর। নামের সঙ্গে স্মৃতি, ভিলা, কুঞ্জ, নীড়, কুটির, নিকেতন প্রভৃতি যোগ করা।

একটি ছোট পুকুর ও চিলড্রেনস পার্ক আছে সুশোভনে। পুকুরে স্নান করা বারণ এবং মাছধরাও। তবে পুঁটি ও মৌরলা ছাড়া আর কিছু যে নেই, সে সম্পর্কে পল্লির বাসিন্দারা নিশ্চিত। কেননা, মাছ—চোরেরাই জানিয়ে দিয়েছে, এই পুকুরে জাল ফেলে তারা আর বোকামি করবে না। আধ বিঘার ছোট্ট পার্কটিতে দুটি দোলনা ও দুটি সি—শ্য ছাড়া আছে মুখোমুখি দুটি কংক্রিটের বেঞ্চ। পার্কের চারদিক ঘিরে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ এবং রাস্তা। পার্কটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার কালে দোপাটি, গাঁদা, কামিনী, জবা প্রভৃতি ফুলগাছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল। পল্লির অ্যাসোসিয়েশন থেকে একজন মালিও রাখা হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যে অধিকাংশ গাছ উধাও হওয়ায় সুশোভনকে শোভনীয় করার চেষ্টা থেকে অ্যাসোসিয়েশন ক্ষান্তি দেয়। পার্কের চারধারে যে বাড়িগুলি তার কয়েকটি চারতলা, কয়েকটি দোতলা এবং বাকিসব একতলা। পল্লির পেছন দিকে, যাঁরা দেরিতে প্লট কিনেছিলেন, তাঁদের বাড়িগুলির অধিকাংশই একতলা। কয়েকটা প্লটে প্লাস্টার ছাড়াই অসমাপ্ত বাড়িতে লোক বসবাস করছে। এই বাড়িগুলির পেছনে অর্থাৎ সুশোভন পল্লির এলাকার বাইরেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার মাঠ।

স্থানীয় লোকেরা এটাকে বলে ইলেকট্রিকের মাঠ। এখানে সকাল—বিকেল ফুটবল খেলা হয়, একটা ফাইভ—এ—সাইড, হাইটের টুর্নামেন্টও পাঁচ বছর আগে শুরু হয়েছে। বিন্দুবাসিনী চ্যালেঞ্জ শিল্ড বিজয়ীর জন্য, আর পাঁচকড়ি দে কাপ বিজিতের জন্য। কারখানা মালিকরা চার বছর আগে জমিটা বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল এক বিল্ডিং প্রোমোটারের কাছে। কিন্তু কীভাবে যেন সেটা জানতে পেরে নেতাজিনগর আর শহিদ কলোনির ছেলেরা বিক্রি বন্ধের দাবিতে লাঠি, বোমা এবং আরও কী সব জিনিস নিয়ে এমন রইরই কাণ্ড বাধিয়ে দেয় যে মালিকরা আজও কারখানামুখো হতে সাহস পাচ্ছে না।

এপ্রিলের মাঝামাঝি চৈত্রের শেষাশেষি এমন একটা দিনের ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সুশোভন পল্লির চারজন রাস্তা দিয়ে স্বাভাবিক গতির থেকে একটু জোরে হাঁটছেন। বেড়ানোও নয় জগিংও নয়, সমীরণ নাম দিয়েছে বেগিং। এইভাবে যাঁরা ভোরে রাস্তায় হনহনিয়ে হাঁটেন তাঁদের সে বলে ‘বেগার’। বাংলা করে বলে, ‘স্বাস্থ্য ভিক্ষুক’। ওর বোন শ্যামলা (শ্যামলী নয়) আর ভাই হিমাদ্রি ছাড়া এই নামকরণের ব্যাপারটা আর কেউ জানে না।

আর কেউ বলতে অবশ্য একজনকেই বোঝায়, তাদের পিসিমা রেখা গুপ্তা। মধ্য কলকাতায় মৌলালির কাছে মেয়েদের একটা স্কুলে ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের কাজ করেন আর কখনও কোনও শিক্ষিকা অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্লাস ঠাণ্ডা রাখতে। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি, সত্তর কেজি ওজনের, ছেচল্লিশের কাছাকাছি বয়সি রেখা গুপ্ত তখন ক্লাসে ঢুকেই সারা ঘরে প্রথমে চোখ বুলিয়ে শুধু একবার ”হুম” বলেন। সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ—পঁয়তাল্লিশ জোড়া চোখ ডেস্কের ওপর দৃষ্টি নামিয়ে আনে। ”তোমরা কি চাও এখন আমি তোমাদের পড়াই?” ক্লাস নিরুত্তর থাকে। ”গুড। তোমরা কি চাও এখন আমি গল্প করি?” মুহূর্তে একটা ”হ্যাঁ—আ—আ” শব্দ সিলিংয়ের দিকে উঠতে উঠতে রেখা আন্টির আর একটা হুম—এর ধাক্কায় ডেস্কের ওপর গোঁত খেয়ে নেমে আসে। কিন্তু দশাসই ধড়ের ওপর বসানো মিষ্টি মুখটিতে ঝকঝকে আয়ত চোখজোড়া যখন প্রশয়মাখা দুষ্টুমিতে পিটপিট করে ওঠে, তখনই ”আন্টি, গ অল—পোও” এই শব্দটা এবার প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে সিলিং ছুঁয়ে ঘরে ছড়িয়ে যায়। ঘণ্টা বাজলে আন্টি যখন বেরিয়ে আসেন, তখন সারা ঘর হাসিতে লুটোপুটি কিংবা ছলছল চোখে গম্ভীর। টিচার্সরুমে রেখা গুপ্তকে বলতে শোনা যায়, ”মেয়েগুলো গল্পের কাঙাল; এদের বাবা—মায়েরা কেমন লোক! রোজ গল্প শোনায় না কেন? কল্পনাপ্রবণ না করে তুললে মনের বিকাশ ঘটবে কী করে? আমি তো রোজ রাতে গল্প শোনাতাম।”

তিনি গল্প শোনাতেন নাককানমলা—দের। ডাকনাম অনুসারে নাক হল নাকু অর্থাৎ সমীরণ, কান হল কানু বা হিমাদ্রি আর মলা বলাবাহুল্য শ্যামলা। রেখা গুপ্ত বাস্কেটবল খেলায় ইউনিভার্সিটি আর স্টেটের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন কুড়ি বছর আগে পর্যন্ত। যখন তাঁর বউদি তিনটি শিশুকে রেখে মারা গেলেন এবং দাদা সুনীলবরণ আধা—সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন শুরু করলেন, তখন ছাব্বিশ বছরের পিসি চার ও দুই বছরের নাকু কানু আর তিন মাসের মলাকে বুকে তুলে নিয়ে একই সঙ্গে ওদের বাবা—মা হয়ে যান। রেখা গুপ্ত বিয়ে করেননি।

সমীরণ যাদের বেগার বলে, তাদের মধ্যমণিটি হলেন তারই পিসি। সুতরাং বেগার শব্দটি যাতে কোনওক্রমেই ওই একজনের কানে না পৌঁছয় সেই ব্যাপারে তিন ভাইবোন হুঁশিয়ার। পৌঁছলে কী হতে পারে সে বিষয়ে সমীরণের মোটামুটি একটা ধারণা আছে।

পাঁচ বছর আগে তিনটি শোবার ঘর, রান্নাঘর, কলঘর এবং খাবার দালানের মোট দশটি ছোট ও বড় জানলার কুড়িটি কাচের পাল্লা সাবান জল ও ন্যাতা দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়েছিল এবং এমনভাবে, যেন ন্যাতা বোলানোর দাগ না থাকে। ছিল বলে তিনটি জানলার রিপিট পরিষ্কার করতে হয়। যখন সে প্রথম ফার্স্ট ডিভিশন লিগে দর্জিপাড়া একতা—য় খেলতে শুরু করেছে তখন যুগের যাত্রীকে সে গোল দিতেই রেফারি অফসাইড জানিয়ে গোলটি বাতিল করে। অবশ্যই অনসাইড থেকে করা গোল, তা ছাড়া সমীরণের মতো আনকোরা ফুটবলারদের কাছে যাত্রীর মতো গত বছরের চ্যাম্পিয়ন দলকে ঘেরা মাঠে প্রথম খেলতে নেমেই গোল দেওয়া তো চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। রাগে জ্বলে উঠে সে মনের ভারসাম্য নষ্ট করে রেফারিকে বলেছিল, ”যাত্রীর চাকর” এবং আরও কিছু কথা। সঙ্গে সঙ্গে লাল কার্ড তাকে দেখতে হয়েছিল। পরদিন কাগজে তাকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার খবরটা পড়ে বেগারদের একজন, রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের অবসারপ্রাপ্ত কম্যান্ডান্ট জি. সি. দত্ত, এই ‘আনস্পোর্টিং ইনডিসিপ্লিনড বিহেভিয়ার”—এর দুঃসংবাদটি পিসির কানে তুলে দেন। ”লজ্জায় মাথাকাটা যাওয়া” রেখা গুপ্ত অতঃপর অপরাধী ভাইপোর আত্মপক্ষ সমর্থন শোনা ও রায় দেওয়ার জন্য কতক্ষণ সময় নিয়েছিলেন?

”রেফারিকে তুই চাকর বলেছিস! এই পরিবারের ছেলে এমন অভব্য, অসভ্য, জন্তু, এমন আনকালচার্ড হবে ভাবতেও পারি না!’

”পিসি, এর থেকেও খারাপ নোংরা কথা ছেলেরা রেফারিকে বলে। আমি তো সেই তুলনায়—”

”চুউপ।”

”পিসি, রেফারি ইচ্ছে করেই আমার গোলটা—”

”আবার কথা!”

”রেফারি যাত্রীর টাকা—” সমীরণের চুল ততক্ষণে পিসির হাতের মুঠোয় বন্দি।

”চাকর বলেছিলিস? ঠিক আছে, চাকরের কাজই করবি। বাড়ির সব জানলার কাচ…।

সমীরণ হিসাব করে দেখেছে। বিচার ও শাস্তিদানপর্ব দু’মিনিটেই সারা হয়েছিল। এখন যদি পিসি শোনে তার বন্ধুদের সে আড়ালে বেগার বলে, তা হলে নিশ্চিত তাকে বেগিং—এ নামিয়ে দেবে। হয়তো বলবে, ‘যাও, শ্যামবাজার কি মৌলালি মোড়ে এই বাটিটা হাতে নিয়ে ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করো। ভিক্ষের পয়সা থেকে আট আনা খাবার জন্য খরচ করে বাকিটা আমায় রাত্রে দেবে। বেগারদের জিলিপি কিনে খাওয়াব।” পিসিমার বেগার মানে সত্যিকারের ভিখারি, যারা রাস্তায় ভিক্ষা করে।

মাঝে মাঝেই বাজার করে ফেরার সময় হিমাদ্রি গরম জিলিপি কিনে রাস্তা দিয়ে খেতে খেতে আসত। বলাবাহুল্য, বাড়ি পৌঁছনোর আগেই জিলিপিগুলো শেষ করে ফেলত। হপ্তার ছ’টা দিন তাকে বাজার যেতে হয়। রবিবারে রবিবারে শ্যামলাকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করতে যান পিসি নিজেই। হিমাদ্রির জিলিপি খাওয়াটা একদিন দেখে ফেলে বেগারদের একজন, স্বাস্থ্য দফতরের রিটায়ার্ড ডেপুটি সেক্রেটারি অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য্য। যথারীতি পিসির কাছে ‘নোংরা হাতে, ধুলোবালি বীজাণু ওড়া রাস্তা দিয়ে, আন—হাইজিনিক পরিবেশে তৈরি চিনির রসে ডোবানো জিলিপি, যা খেলে ডায়বিটিস হতে পারে”, এমন জিনিস খাওয়ার সাঙ্ঘাতিক খবরটা পৌঁছে গেল।

সুশোভন পল্লিতে ঢোকার মুখে ভি আই পি রোডের ওপরই ‘জয় মা তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। হিমাদ্রি যথারীতি সেদিন বাজার থেকে বাঁচানো পয়সায় আটটা জিলিপি কিনে, ঠোঙাটার মুখ খুলে দু’আঙুলে ধরে, একটাকে টেনে সবেমাত্র বের করেছে আর ঠিক তখনই পেছন থেকে ”ঠোঙাটা আমায় দে তো কানু।” আঙুল থেকে জিলিপিটা প্রথমেই জমিতে খসে পড়েছিল। তারা মা—র সামনে বসে থাকা কুকুর জগা অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে একটা গোটা জিলিপি, সম্ভবত জীবনে প্রথম, পাওয়ার জন্য যার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেজ নেড়েছিল, সে তখন ফ্যাকাশে মুখের পিসির দিকে তাকিয়ে।

”তোর হাতটা দেখি।”

হিমাদ্রি ডান হাতের তালু মেলে ধরল। রেখা গুপ্ত তীক্ষ্ন চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে নাক কোঁচকালেন। ”এই তো আলুর মাটি, মাছের গন্ধ লেগে রয়েছে…এই হাতে…।”

ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ সঙ্গে বাচ্চচা একটা ছেলেকে নিয়ে দোকানের একধারে হাত পেতে চুপ করে দাঁড়িয়ে। পিসি হাতছানি দিয়ে ছেলেটিকে ডেকে জিলিপির ঠোঙা তার হাতে দিয়ে বলল, ”খেয়ে নে।”

হিমাদ্রি তখন ক্ষীণস্বরে বলেছিল, ”পিসি ওর হাতেও ময়লা আছে।”

”থাকুক, ও আমার ভাইপো নয়।”

এহেন পিসি প্রতিদিন ভোরে শ্যামলা আর সাত—আটটি বাচ্চচা ছেলেমেয়েকে নিয়ে ট্র্যাকস্যুট পরে সুশোভন পল্লিতে চক্কর দিয়ে ছোটেন। খুব জোরে নয়, আবার বেগারদের মতো অত ধীরেও নয়। ট্র্যাকস্যুটটা সমীরণের। গত বছর ইন্ডিয়া টিমের ক্যাম্পে নতুন একটা পাওয়ায় সে পিসিকে বলেছিল, ”শাড়ি পরে কি জগ করা যায়! কোনওদিন হোঁচট খেয়ে পড়বে, হাত পা ভাঙবে, বরং আমার একস্ট্রা একটা রয়েছে, তুমি এটা পরেই ছোটো।’

পিসি—ভাইপোর উচ্চতা এবং ওজন সমান সমান। বাড়িতে ট্র্যাকস্যুট পরে নাককানমলাদের সামনে ট্রায়াল দিতে পিসি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় আটবার ছুটে ওঠানামা করে বলেছিলেন, ‘জিনিসটা ভালই মনে হচ্ছে। অনেক ফ্রি লাগছিল। ওদেরও বলব ট্র্যাকস্যুট পরে দৌড়তে।”

ওঁরা অর্থাৎ বেগাররা একদিন আলোচনায় বসেছিলেন রেখা গুপ্তর প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে। বসাক দম্পতি অর্থাৎ বিল্ডিং কন্ট্রাক্টর সরোজ ও তাঁর স্ত্রী মালবিকা তাঁদের প্রধান অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন এই বলে—ট্র্যাকস্যুট পরলে তাঁদের যে হাইট তাতে আরও বেঁটে মনে হবে। স্বামী পাঁচ—এক, স্ত্রী চার—দশ। উচ্চতার ঘাটতি দু’জনেই পুষিয়ে নিয়েছেন প্রস্থে। ঢোলা জিনিসটার মধ্যে ঢুকে দৌড়লে তাঁদের যে চলমান পিপের মতো দেখাবেই, তাতে কোনওরকম সন্দেহ তাঁরা পোষণ করছেন না।

এহেন অকপট স্বীকারোক্তির পর ট্র্যাকস্যুট পরিধানের জন্য তাঁদের ওপর আর চাপাচাপি কেউ করলেন না। জি. সি. দত্ত অবশ্য বলামাত্র রাজি, তবে একটা শর্তে, ”আমাদের স্পিড বাড়াতে হবে।” যে স্পিডে তিনি সাব ইন্সপেক্টর থাকাকালীন একবার খোকাগুণ্ডার পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে ধরেছিলেন তিন মাইল দৌড়িয়ে (প্রতি দশ দিন অন্তর গল্পটা বলে থাকেন), তিনি সেই স্পিডে ফেরার বাসনাটাই জানিয়ে দিলেন। প্রাক্তন পুলিশ অফিসারের বক্তব্যের বিরুদ্ধে ঘোর প্রতিবাদ জানালেন প্রাক্তন ডেপুটি সেক্রেটারি।

”আমরা চোরগুণ্ডা ধরার জন্যই কি তা হলে রোজ সকলে দৌড় প্র্যাকটিস করব? ব্লাড সুগার, অম্বল, ডিসপেপসিয়া, এই তিনটেকেই আমি কন্ট্রোলে রাখার জন্য ঘড়ি ধরে মেপে হিসাব করে পা ফেলি, এর একটা ছন্দ আছে, তাল আছে। হুট করে স্পিড বাড়ানোটা উচিত হবে কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার।”

এরপর ট্র্যাকস্যুট পরার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ফললাভ হবে না বুঝে আর কথা বাড়ানো হয়নি। রেখা গুপ্ত একাই পরেন। আজও তিনি দৌড়চ্ছিলেন। প্রথমে রেল এঞ্জিনের মতো, তারপর সাত—আটটি ক্ষুদ্র বগি, শেষ গার্ডের মতো শ্যামলা। চারজন বেগার উলটো দিক দিয়ে ‘বেগিং’ করেন। আজও তাঁরা মুখোমুখি হতেই শ্যামলা বললে, ”আট”। অর্থাৎ, তাঁদের আট চক্কর দৌড় সম্পূর্ণ হল।

”ছয়।” গম্ভীর স্বরে জি. সি. দত্ত নিজেদের সংখ্যাটি জানিয়ে দিলেন।

”ছয় নয়, তিন।” ভটচায ভর্ৎসনা করলেন, ”মিছে কথা বলে লাভ কী?”

”আজ শনিবার, কার বাড়িতে চা খাওয়া সেটা কি ভুলে গেছেন?” দত্ত খিঁচিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।

সপ্তাহের পাঁচ দিন সকালের চা এবং কিঞ্চিৎ ‘টা’ পাঁচজনের বাড়িতে পর্যায়ক্রমে ওঁরা খান। শনিবারের পালা রেখা গুপ্তর, এইদিন ওঁর স্কুলের ছুটি থাকে। সাধারণত তিনি চায়ের সঙ্গে লুচি দেন, সহযোগে আলুছেঁচকি। অথবা লুচির বদলে হালুয়া। দেওয়ার পরিমাণটা নির্দিষ্ট হয়, ক’চক্কর দেওয়া হল তার ওপর। ছয় চক্কর মানে ছ’টি লুচি অথবা বৃহৎ ছ’চামচ হালুয়া।

চার চক্করের পরই চার বেগার পার্কের বেঞ্চে বসে পড়লেন। রেখা গুপ্ত পার্কের মধ্যে তখন বাচ্চচাদের ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করাচ্ছেন। সাইকেলে দুটি খবরকাগজওলা তিরবেগে সুশোভনে ঢুকল। একজন অন্যদিকে চলে গেল, অন্যজন ওদের কাছে এসে ঝটপট তিনটি কাগজ হাতে ধরিয়েই সাইকেলে লাফিয়ে উঠল। রেখা গুপ্তর কাগজ বাড়িতে দেওয়া হয়। তার দাদা প্রথম পড়ার পর অন্যরা হাতে পায়।

তিনজন তিনটি কাগজ খুলে চোখের সামনে ধরলেন। মালবিকা খবরটবরের ধার ধারেন না। তিনি বাচ্চচাদের ব্যায়াম করার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

”কপিলদেব কলকাতায় এসে কী বলেছে সেটা পড়ে দেখুন।” দত্তমশাই গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন।

”কী বলেছে?” ভটচায অবাক চোখে তাকালেন ওর মুখের দিকে।

”আপনার হাতেও তো একটা কাগজ রয়েছে।” দত্ত প্রাক্তন পুলিশি স্বর বের করলেন। ভটচায তাড়াতাড়ি হাতের কাগজটা তন্ন তন্ন দেখে বললেন, ”নাহ আমার কাগজে নেই।”

”আমার কাগজেও নেই।” বসাক যোগ করলেন।

”তা হলে শুনুন—ট্যালেন্ট থাকলেই হয় না, বড় ক্রিকেটার হতে গেলে চাই নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছে আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়ার ইচ্ছে। … কেউ যদি সত্যি যোগ্য হয় তাহলে তাকে আটকে রাখা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি না। সে ঠিক ফুঁড়ে বেরোবেই। … যে কোনও খেলাকে ঘিরেই কলকাতার লোকের এত উৎসাহ যে, আমার দারুণ লাগে। একই সঙ্গে এটা ভেবেও খারাপ লাগে যে, কেন এই শহর একটা টেস্ট ক্রিকেটার তৈরি করতে পারছে না।” দত্ত অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, ”ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন? কপিলদেব কী বলতে চায় সেটা হৃদয়ঙ্গম হল?”

”একটু একটু।” বসাক আমতা আমতা করে বললেন।

”আমি পুরোটাই হৃদয়ঙ্গম করেছি।” ভটচাযের মুখে হাসি ছড়ানো।

”তা হলে বলুন।” দত্ত দাবি জানালেন।

”বাংলায় কিসসু ক্রিকেট খেলা হয় না। এখানে সবাই হুজুগে। ট্যালেন্ট হয়তো আছে, কিন্তু সবাই ফুলবাবু, একটুও পরিশ্রম করে না, কারণ ইচ্ছেটাই নেই। শুধু খবরের কাগজে ছবি বেরোলেই এখানে লোকে ভাবে সে বোধ হয় খুব বড় প্লেয়ার।” ভটচায কথাগুলো বলে উদ্বিগ্ন চোখে দত্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন। দত্ত চোখ বন্ধ করে মাথাটা ঈষৎ কাত করে অনুমোদন দিলেন।

”আমাদের নাকু কিন্তু খুব খাটে। ইলেকট্রিক মাঠে সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, শুধু বল নিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি।” বসাক ফাঁক পেয়ে তাঁর কথাটা ঢুকিয়ে দিলেন।

”কথা হচেছ ক্রিকেট নিয়ে, ফুটবল নিয়ে নয়।” ভটচায ছোট্ট একটা দাবড়ানি দিলেন।

”কথাটা আসলে সব খেলা নিয়েই, শুধু ক্রিকেট নিয়ে নয়। বসাকবাবু ঠিকই বলেছেন, এই শুনুন কপিলদেবের আর—একটা কথা। ওকে জিজ্ঞেস করা হয় পরিশ্রম করার ইচ্ছা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন কী করে? তাইতে বলছে,—’এখানেই আমার মনে হয় পেশাদারদের সঙ্গে সাধারণ মানসিকতাসম্পন্ন লোকেদের তফাত। পেশাদারকে সবসময় সামনের দিকে চোখ রাখতে হয়। আরও, আরও, আরও, আরও। আমি এই নীতিতে বরাবর বিশ্বাসী। হাতির খিদে আমার’।”

”ওরে বাপস, হাতির!” চমকে উঠলেন ভটচায,”আমার তো দুটো লুচি খেলেই অম্বল। আচ্ছা, হাতিরা ক’টা লুচি খেতে পারে?”

”দুটো।” দত্ত খবরের কাগজে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বললেন।

”আচ্ছা দত্তবাবু, আমরা কি সাধারণ মানসিকতাসম্পন্ন লোকদের দলে পড়ি?” বসাক কাঁচুমাচু মুখ করে জানতে চাইলেন।

”সাধারণ মানসিকতা…” দত্ত চিন্তায় ডুবে গেলেন এবং আধ মিনিট পর ভেসে উঠে জানালেন, ”পরিস্থিতি—বিশেষে সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। আমি যখন খোকাকে তাড়া করি কোনও ওয়েপন আমার কাছে ছিল না, কিন্তু ওর কাছে পিস্তল ছিল।” এর পর তোমরা বুঝে নাও গোছের একটা হাসি দত্তর ঠোঁট মুচড়ে দিল।

রেখা গুপ্ত বাচ্চচাদের বাড়ি পাঠিয়ে তখন হাজির হলেন ওঁদের সামনে। ”চলুন, চলুন। রাতে লেচি করে রেখে দিয়েছি, বেলব আর ভাজব। তবে আজ কিন্তু শুধু আলুভাজা, আমি এগোলাম, ব্যাঙ্গালোর ক্যাম্প থেকে নাকুর আজই ফেরার কথা।”

দ্রুত পায়ে শ্যামলাকে সঙ্গে নিয়ে রেখা গুপ্ত বাড়ির দিকে এগোলেন। ওঁদের বাড়িটা সুশোভনের পেছন দিকে ইলেকট্রিক মাঠের লাগোয়া। মাঠে কয়েকটি ছেলে ফুটবল নিয়ে ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত। বরেন মুখোটির একটা লন্ড্রির দোকান আছে নামে মাত্রই, আসলে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ফুটবলার তৈরি করার কাজেই বেশি সময় দিয়েছেন। এখন পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও, কি শীত, কি বর্ষা প্রতিদিন সকালে মুখোটি একটা হুইসল গলায় ঝুলিয়ে মাঠে আসেন।

পাঁচ বছর আগে তাঁরই হাতে গড়া সমীরণকে তিনি দর্জিপাড়া একতার সেক্রেটারির কাছে নিয়ে যান। ”ছেলেটা ভাল খেলবে, ফুটবল সেন্সটা আছে, খাটিয়েও। সব থেকে বড় কথা স্বভাবচরিত্র ভাল। একে কয়েকটা ম্যাচ খেলিয়ে দেখুন।” মুখোটির এই ক’টি কথাই যথেষ্ট ছিল। অবশ্য সমীরণ তার প্রথম ম্যাচেই রেড কার্ড দেখে। সেক্রেটারি তখন বলেছিল, ”নিমাই আর দুলালকে এক ঝটকায় টলিয়ে ভেতরে ঢুকে কী শটটা নিল দেখলি? ওকে সব ম্যাচ খেলাব।”

সমীরণ সে বছর তেরোটা গোল দেয়। ষাট হাজার টাকায়, পরের বছর যুগের যাত্রী তাকে সই করায়। সই করাবার জন্য কথাবার্তা বলেছিল ঘুনু মিত্তির। তার পোশাকি নামটা যে কী, কেউ আর তা জানে না। পঁয়ত্রিশ বছর আগে খেলার দিন ক্লাবের সদস্য গেটে দাঁড়িয়ে সে কার্ড দেখে লোকেদের ভেতরে যেতে দিত। এরপর সেক্রেটারি নারায়ণ সেন—এর গাড়ির দরজা খুলে দেওয়ার অধিকার অর্জন করে। যাত্রীর কোনও ফুটবলার চোট পেলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন লোক পাওয়া যায় না তখন ঘুনু মিত্তিরই এগিয়ে যেত। এইভাবেই ধাপে ধাপে উন্নতি বা কুরে কুরে সেঁধিয়ে এখন সে কার্যকরী সমিতির সদস্য এবং নতুন সেক্রেটারি পতিতপাবন ওরফে পতু ঘোষের প্রায় ডান হাত।

ঘুনু প্রথমেই সমীরণকে জানিয়ে দিয়েছিল, ”তোর গোলটা ঠিকই হয়েছিল। তবে বড় ক্লাবের এগেনস্টে ছোট ক্লাব গোল করে সিজনের শুরুতেই দুটো পয়েন্ট নিয়ে নেবে আর বিশ লাখ টাকা দামের টিমের সাপোর্টাররা সেটা দাঁত বের করে দেখবে, তা তো হতে পারে না। সেটা ময়দানের নিয়ম নয়। সারথিকে গোল দিলেও রেফারি অফসাইড করে দিত। নইলে টেন্ট জ্বলে যাবে। কিছুদিন ময়দানের ঘাস চেন, তখন নিজেই সব বুঝতে পারবি। যাকগে, তোকে আমি যাত্রীতে নিয়ে যাব। বড় ক্লাবে খেলার সুযোগ এক বছর ছোট ক্লাবে খেলেই পাওয়াটা যে কত ভাগ্যের ব্যাপার সেটা কি তুই বুঝিস?” আকাশবাণী ভবনের ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের কথা হচ্ছিল। সমীরণ আবেগে আপ্লুত হয়ে শুধু মাথা কাত করে জানিয়েছিল, সে বোঝে।

”কিন্তু একটা কথা।’ ঘুনু গলা নামিয়ে চাপা স্বরে বলেছিল। ”যা কনট্রাক্ট হবে তার টেন পার্সেন্ট আমার। অ্যাডভান্স পাবি সিক্সটি পার্সেন্ট, ক্যাশ।”

সমীরণ এবারও মাথা কাত করে ঢোঁক গিলে বলেছিল, ”বেশ তাই হবে। কিন্তু কত দেবে আমায়?”

”চেষ্টা করব যাতে বেশি পাস, তুই বেশি পেলে তো আমিও বেশিপাব।”

ষাট হাজার টাকার টেন পার্সেন্ট ছ’ হাজার ঘুনু কেটে নিয়েছিল ছত্রিশ হাজার টাকার অ্যাডভান্স থেকে। একশো টাকার তিনশোখানা নোট যখন সে পিসিমার সামনে খাওয়ার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে প্রণাম করেছিল তখন তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে বা বলতে পারেননি। শ্যামলা আঁতকে উঠে বলেছিল, ”দাদা পুলিশ টুলিস আসবে কি? ব্যাঙ্ক ডাকাতি করিসনি তো?” হিমাদ্রি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে মন্তব্য করেছিল, ”কমই দিয়েছে। দাদার যা খেলা তাতে এক লাখ ষাট হাজার পাওয়া উচিত।”

নোটগুলো গুছিয়ে দু’হাতে তুলে রেখা গুপ্ত ছুটে গিয়েছিলেন কোণের ছোট ঘরটায়, তার দাদার কাছে। একটু পরে চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে এসে বলেছিলেন, ”খুব অবাক হয়ে গেল, বলল, ফুটবল খেলে এত টাকা পাওয়া যায় জানতাম না তো! বললাম আরও চব্বিশ হাজার পাবে। তুই গিয়ে প্রণাম করে আয়।”

সমীরণ গোঁজ হয়ে বসে থেকেছিল। বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের কোনওরকম সম্পর্ক নেই বললেই চলে। অফিস থেকে এসে ঘরে ঢোকেন, শুধু স্নান আর খাওয়ার সময়ই তাঁকে ঘরের বাইরে দেখা যায়, কারও সঙ্গে কথা বলেন না।

”যা না, খুব খুশিই হবে।”

সমীরণ ঘরে ঢুকে সুনীলবরণকে প্রণাম করতেই হাতের বইটা নামিয়ে তিনি ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসেন। বড় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, ”এত টাকা যখন নিচ্ছ, সেইমতন খেলাটাও দিয়ো। নিজেকে অপমান কোরো না।”

বাবার কথাগুলো সমীরণের মাথায় কীভাবে যেন গেঁথে গেছল। খাওয়ার টেবিলের কাছে এসে দেখল, পিসি কিছু নোট আলাদা করে গুনে রাখছেন।

”ওগুলো কী জন্য?” সমীরণ রীতিমতো অবাক হয়ে বলে।

”প্রণামীর টাকা। যে গুরুর কাছে প্রথম শিক্ষা নিয়েছিস, যিনি তোকে হাতে ধরে এগিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ঋণ কোনওদিনই তো শোধ করতে পারবি না। তবু প্রণামী বলে এই ছ’হাজার কাল সকালেই দিয়ে আসবি। খুব কষ্টে আছে ভাইপোদের সংসারে। দোকানটারও যা হাল হয়েছে।”

”দাদার আরও টেন পারসেন্ট গেল।” হিমাদ্রি হালকা স্বরে বলতেই হাত তুলে সমীরণ তাকে চুপ করিয়ে দেয়।

”কানু, এটাকে গেল বলিসনি। পিসি কেন গ্রেট লেডি জানিস? যে কাজটা সবার আগে করা উচিত সেটাই মনে করিয়ে দিয়ে অপরাধের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। বরেনদার কাছে কাল ভোরেই যাব। কিন্তু পিসি, আমাকে দিয়ে আবার যদি জানলার কাচ পরিষ্কার করাও তা হলে আমার মান—ইজ্জত আর থাকবে না।”

কথাটা গ্রাহ্যে না এনে পিসি ভ্রূ কুঁচকে সমীরণকে একপলক দেখে নিয়ে বলেন, ”মান—ইজ্জত বলতে কী বুঝিস? নিজের বাড়ির জানলা নিজের হাতে পরিষ্কার করলে ইজ্জত খোয়া যায়? কতবার তোদের বিদ্যাসাগর মশায়ের গল্প শুনিয়েছি না? আসলে তোর মান—ইজ্জত নির্ভর করবে তোর খেলার ওপর। টিম যেদিন হারবে, গোল যেদিন দিতে পারবি না সেদিন তোর ইজ্জত থাকবে কি?”

সিরিয়াস কথাবার্তায় পরিবেশ ভারী হওয়ার দিকে গড়াচ্ছে দেখে শ্যামলা হালকা করার জন্য বলেছিল, ”ওসব মান—ইজ্জতের কথা রাখো তো এখন, বলো এতগুলো টাকা নিয়ে তুমি কী করবে? তবে আমায় জিজ্ঞেস করলে বলব, একটা কালার টিভি আর—”

”আর দাদার জন্য একটা স্কুটার।” হিমাদ্রি থামিয়ে দিয়েছিল বোনকে। থতমত হয়ে শ্যামলা বলে, ”তা তো দাদা কিনবেই, তবে একতলা বাড়িতে থাকাটা এতবড় প্লেয়ারের পক্ষে একদমই মানায় না। ছাদে একটা অন্তত ঘর না তুললে দোতলা বাড়ি বলা যাবে না।”

সবাই কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেছল। অবশেষে পিসিই বলেন, ”ঘরে কে থাকবে?”

”তুমি।” সমীরণ বলেছিল।

”না। ওপরে আমায় তুলে দিয়ে নীচে তোমরা ভূতের নাচ নাচবে, এসব মতলব ছাড়ো। যদি ঘর হয় তো থাকবে দাদা, সঙ্গে বাথরুমও থাকবে।”

হাঁপ ছাড়ার নীরবতাটা কাটিয়ে উঠে সমীরণ বলেছিল, ”কারেক্ট ডিসিশন। আমার প্রস্তাবটা প্রত্যাহার করছি। কিন্তু, পিসি, তোমার কি কিছু দরকার নেই?”

”আমার দরকার!” পিসি হতচকিত হলেন এবং তিনজনের পীড়াপীড়িতে অবশেষে বলেন, ”একদিন আমার সকালের বন্ধুদের পেটভরে রেঁধে খাওয়াব।”

”তোমার সকালের বন্ধুদের?” হিমাদ্রি চোখ কপালে তুলে বলেছিল, ”তার মানে বেগা—আ—আ—আ—কথাটা সে শেষ করতে পারেনি যেহেতু শ্যামলার এক প্রচণ্ড রামচিমটি তখন অতি তৎপরতায় তার বগলের নীচে কামড় বসিয়েছিল। হিমাদ্রি অবশ্য খুব স্মার্টলি ”আ—আ—আ”—টাকে দম আটকানো কাশিতে রূপান্তরিত করে কাশতে কাশতে চেয়ার থেকে উঠে বেসিনের দিকে ছুটে গেছল।

”কী হল তোর? বেগা বলে বিষম খেলি কেন?” পিসি উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন।

”কানু হয়তো বলতে চেয়েছিল, রান্নাবান্নার মতো কাজে কেন ব্যাগার খাটবে তার থেকে চিনে দোকানের খাবার এনে—তাই তো রে?” সমীরণ ভাইয়ের দিকে তাকায়। মুখে জল দিতে দিতে হিমাদ্রি শুধু বলে, ”হুঁউ।”

”রান্না করে খাওয়ানোটাকে ব্যাগার খাটা বলছিস! কী আনন্দ হয় জানিস লোককে খাওয়াতে? টাকা থাকলে আমি রোজ ধরে এনে লোক খাওয়াতাম।”

 রেখা গুপ্ত তাঁর সকালের বন্ধুদের অবশ্যই ভূরিভোজন করিয়েছিলেন। কালার টিভি এবং স্কুটারও কেনা হয়েছিল। দোতলায় সে বছর আর ঘর তোলা যায়নি। পরের মরসুমেই সারথি সংঘ একলাখ দশ হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমীরণকে সই করায়। যুগের যাত্রীর কাছে তখন তার পাওনা ছিল দশ হাজার টাকা। সেটা আর সে পায়নি।

ময়দানের ঘাস এরপর থেকেই সে চিনতে শুরু করে।

।। ২ ।।

”না, না, আর না, আমার চারখানা খাওয়া হয়ে গেছে।’ ভটচায তাঁর প্লেটের ওপর দুই তালু ছড়িয়ে রেখা গুপ্তর লুচি নামাবার পথ বন্ধ করলেন। ”হাতিরা নাকি দুটো খায়, এই দত্তবাবুই বললেন।”

”হ্যাঁ দুটোই খায়…মিস গুপ্ত আমায় আর—একটা, আজ সাত চক্কর টোটাল—”

খুক খুক করে মালবিকা কেশে উঠলেন। দত্ত কটমটিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ”মিসেস বসাকের গণনায় কি সাত চক্কর হয়নি?”

”সাত মানে! আট হয়ে নয় হচ্ছিল তখনই তো ভটচাযদা বসতে বললেন।’ মালবিকা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন।

”তা হলে বোধ হয় গুনতে ভুল করেছি, ইয়ে, আমায় তা হলে আর—একখানা।” দত্তবাবু বলা শেষ করেই জুড়ে দিলেন, ”আর মিসেস বসাককেও।”

‘নাকুও ঠিক গুনে আটখানা খায়।” রেখা গুপ্ত তাঁর কাজ শেষ করে বসলেন সরোজ বসাকের পাশের চেয়ারে। ”বসাকদা আপনি তো ভটচাযদার মতোই চারটের বেশি নিলেন না!”

”আমরা এক পালকের পাখি তো, ওনার অম্বল আমার মেদ, চারটের বেশি হলেই প্রবলেম দেখা দেবে।”

ভটচায জোরে জোরে মাথা নাড়লেন দক্ষিণ ভারতীয় ঢঙে। আর সেই সময় বাইরে ফটকের কাছ থেকে কে বলল, ”এটা কি সমীরণ গুপ্তর বাড়ি?”

”মলা, দ্যাখ তো কে একজন নাকুকে খুঁজছে।” রেখা গুপ্ত চেয়ার থেকে নিজেকে সামান্য তুলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। ”দলবদলের সময় এসে পড়ল আর সেইসঙ্গে সমীরণ, সমীরণ, নাকু, নাকুদা, ভিখিরিদের মতো ফটকের কাছে ডাকাডাকিও শুরু হয়ে গেল। এরপর চলবে হাত—পা ধরে টানাটানি। কী অদ্ভুত যে এই দলবদলের নিয়মকানুন!”

”বাড়িতে কেউ আছেন?”

ফটকের কাছ থেকে উঁচু গলায় ডাক এল।

”ওরে মলা, দ্যাখ না।”

”রেখা, যত ডাকাডাকি আর টানাটানি, ততই তো দরবৃদ্ধি।” মালবিকা চোখ পিটপিট করলেন আড়চোখে তাকিয়ে।

”মিস গুপ্ত, এবার যদি হাত—পা ধরে টানাটানি করে, টেলিফোনটা তুলে আমাকে শুধু একটা খবর দেবেন, তারপর দেখব কার হাত কোথায় কার পা কোথায় থাকে।” দত্তবাবু দুই মুঠো পাকিয়ে সেই দুটি টেবিলে ঠুকলেন। ”অনেকদিন অ্যাকশনে নামিনি তো, শরীরটা কেমন যেন মাখন মাখন হয়ে যাচ্ছে।”

শ্যামলা বাইরে থেকে ঘুরে এসে বলল, ”দাদাকে খুঁজতে এসেছে যুগের যাত্রী থেকে। বললাম, দাদার তো আজ সকালে হাওড়ায় নামার কথা। বললেন, তিনি জানেন, বাঙ্গালোর থেকে মাদ্রাজ, সেখানে মাদ্রাজ মেলে উঠে আজ সকাল সাতটায় হাওড়া স্টেশনে নামবে। ট্রেন অবশ্যই লেট হবে। সেই সময়টা ধরেই স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে কম করে দশটা বেজে যাবেই।”

”এখন তো আটটাও বাজেনি!” ভটচায বললেন, ”তা হল উনি এত হিসেব কষেও এখন কেন হাজির হয়েছেন?”

”আমিও তাই বললাম। পিসির সঙ্গে দেখা করতে চায় বলল।”

”যুগের যাত্রীর লোক রেখার সঙ্গে দেখা করতে চায়!” মালবিকা চোখ ছানাবড়া—প্রায় করে রেখা গুপ্তর দিকে তাকালেন, ”তুমি আবার কবে থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করলে?”

”আরে, ফুটবলারের পিসিমাসিরাও দলবদলের আগে ভি আই পি হয়ে যায়।” সরোজ বসাক স্ত্রীকে বোঝাবার জন্য জুড়ে দিলেন, ”আমাদের দেশের ফুটবলাররা খুবই পরিবার—অন্ত—প্রাণ তো, তারা দিদি—বউদি, মা—মাসি, ভাই—বোন, এদের মত না নিয়ে দল বদলায় না, সেজন্য প্লেয়ারদের আগে এদেরই ধরাধরি করা হয়।”

সরোজের কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই দরজার কাছ থেকে মিহিস্বর ভেসে এল, ”আমি কি ভেতরে আসতে পারি?” বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ভেতরে ঢুকে এলেন।

নাতিউচ্চ মাঝারি গড়ন, ঈষৎ ক’টা চোখ, গায়ের রং এককালে গৌরবর্ণ ছিল, এখন তামাটে, বয়স ষাট—পঁয়ষট্টির মধ্যে, পাতাকাটা কাঁচাপাকা চুল, বিস্কুট রঙের ট্রাউজার্স ও একরঙা নীল বুশশার্ট, পাম্পশুটা অন্তত চারশো টাকা দামের। ”না বলেই প্রায় ঢুকলাম।” হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ”আমার নাম ঘুনু মিত্তির, বিখ্যাত লোক নই যে, নামটা শোনা থাকবে। যুগের যাত্রীকে ভালবাসি, ওদের কমিটিতেও আছি, আর প্লেয়ারদের সঙ্গে দুঃখেসুখে একাকার হয়ে গেছি। ওরা মুশকিলে পড়লে আমি সাহায্য করি, আমি অসুবিধায় পড়লে ওরা আমায় দেখে। এইমাত্র শুনলাম, কে যেন বলছিলেন ছেলেরা দলবদলের আগে মা—মাসি দিদি—বউদিদের মত নেয়! কথাটা ওয়ান—ফোর্থ সত্যি। বাকিটা খবরের কাগজের বানানো। ওরা কি দুগ্ধপোষ্য শিশু যে, এখনও মা—মাসির কথামতো চলবে? কেউ কেউ চলে, কারণ তাদের মা কি বউ টাকাকড়ির ব্যাপারটা তাদের থেকেও ভাল বোঝে। আমি কি বসতে পারি?”

”নিশ্চয় নিশ্চয়, বসুন।” রেখা গুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন। ডাইনিং টেবিলে খালি চেয়ার আর নেই। তাই দেখে বেগারদের অন্য চারজনও চেয়ার থেকে উঠে পড়ল।

”আরে আপনারা বসুন বসুন। মা, একটা টুল কি মোড়া থাকলে এনে দাও তো।” ঘুনু মিত্তির বললেন শ্যামলাকে।

প্রায় ছুটে গিয়ে শ্যামলা পিসির ঘর থেকে মোড়া আনল।

”নাকুর বাড়ি তো আমারও বাড়ি। এখানে আমি মেঝেতেও বসতে পারি।” এই বলে ঘুনু অবশ্য মোড়াটাতেই বসলেন। ”মনে হচ্ছে কারুরই চা বোধ হয় খাওয়া হয়নি।”

”না, এইবার চা হবে। আপনাকেও—” রেখা গুপ্ত ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন।

”চিনি ছাড়া, আমার ব্লাড সুগার একটু বেশির দিকেই।”

”কত এখন?” ভটচায দমবন্ধ অবস্থায় জানতে চাইলেন।

”দুশো একানব্বই।” ঘুনু খুব সহজ স্বরে বললেন। ”ওষুধপত্তর খাই না। ডাক্তার বলেছে স্ট্রেস আর টেনশন থেকে শুধু দূরে থাকবেন, আমি তাই থাকারই চেষ্টা করি।”

রেখা গুপ্ত ইশারায় শ্যামলাকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। সমীরণের কাছে তিনি ঘুনু মিত্তির সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন। তাই মনে মনে হঁশিয়ার হয়েও কিঞ্চিৎ সিঁটিয়ে রইলেন।

”যুগের যাত্রীতে কেউ কি টেনশন ছাড়া থাকতে পারে? শুনেছি ক্লাবের কুকুরগুলো পর্যন্ত নাকি ক্লাবের খেলা থাকলে টেনশন সইতে না পেরে বাবুঘাটে চলে যায়।” ভটচায কিন্তু কিন্তু করে বলে ফেললেন।

”কার কাছে শুনেছেন?”

”আমার শালার ছেলে যাত্রীর মেম্বার, সে বলেছে।”

”বাজে কথা, একদমই বাজে কথা। টেনশন একটু হয় ছোট ক্লাবের সঙ্গে খেলা থাকলে। তা সেজন্য তো আমি আছি। ওদের গোলকিপার আর একটা স্টপার কী একটা ব্যাককে ম্যানেজ করে ফেলি, সেটা মোটেই শক্ত ব্যাপার নয়।”

”নাকুকে কিন্তু পারেননি। লাস্ট ফাইভ ইয়ার্সে চার বছর যাত্রীর এগেনস্টে খেলেছে, রোভার্স, ডুরান্ড, ফেডারেশন, লিগ, শিল্ড সব মিলিয়ে সাতটা গোল দিয়েছে, তিনটে ডিসঅ্যালাউড হয়েছে। গত দশ বছরে কে পেরেছে … সোজা কথা, দশবার যাত্রীর জালে বল!” ভটচায উত্তেজনা দমন করতে করতে মুখ লাল করে ফেললেন। ”কিন্তু আমাদের নাকুকে ম্যানেজ করতে পারেননি।”

”জীবনে আমার এই একটাই ফেলিওর। দশ হাজার টাকা ক্লাব ওকে দেয়নি, সেই রাগটা দ্বিগুণ বিক্রমে ওকে খেলিয়ে দেয় যাত্রীর এগেনস্টে। তবে এবার তো একেবারেই নতুন কমিটি, নাকুকে টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওর দশ হাজার পাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব।”

পাঁচ কাপ চায়ের ট্রে নিয়ে শ্যামলা প্রথমেই ঘুনুর সামনে ধরে বলল, ”ডান দিকে কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছেরটা চিনি ছাড়া।”

ঘুনু হাসিমুখে কাপটা তুলে নিয়ে বললেন, ”ফুটবলারের বাড়ি তো, কথাবার্তাও সেরকম! আপনার বাড়িতে আজই প্রথম এলাম। বেশ বাড়িটা করেছেন।” রেখা গুপ্তর উদ্দেশে কথাগুলো বলে, ঘুনু ঘরটায় চোখ বুলিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন।

”বাড়ি আমার নয়, দাদার।”

”ওই হল। জায়গাটা ভাল, বেশ নিরিবিলি, খোলামেলা। দোতলায় ক’খানা ঘর?”

”একখানা।”

”কেন! আরও দু’খানা করতে পারেন, জায়গা তো রয়েছে! ক’তলার ভিত, তিনতলার নিশ্চয়।”

”হ্যাঁ।”

”তা হলে আরও দুটো ঘর তুলে ফেলুন।”

”সেজন্য টাকা লাগে।” রেখা গুপ্ত সন্তর্পণে কথাটা বলে ভাবতে শুরু করলেন, লোকটা শেষপর্যন্ত কোথায় আলোচনাটাকে নিয়ে যাবে।

”টাকার জন্য আপনার ভাবনা! ওসব নিয়ে কিছু ভাববেন না, আমি করে দেব।”

”আপনি করে দেবেন মানে!” রেখা গুপ্তর আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হল। ”আপনি কেন করে দেবেন?”

”কত লাগবে দুটো ঘর করতে? হাজার তিরিশ? সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যাত্রীতে নতুন যে কমিটি এবার এসেছে, টাকার ব্যাপারে কোনওরকম কেপ্পুনি তারা করবে না। দু’লাখ দেব বললে দু’লাখই দেবে, দেড় লাখ অ্যাডভান্স। চাইলে গুঁড়োও দেবে।”

”গুঁড়ো কী জিনিস?” জি. সি. দত্ত কৌতূহলী হলেন।

”সব টাকা তো আর কাগজে কলমে থাকে না, পঁচিশি—তিরিশ হাজার এধার—সেধার করে দেওয়া হয়। ওটা হিসাব ছাড়াই, লিখিত চুক্তির বাইরে। ওটাকেই গুঁড়ো বলি।”

”ধরুন, একটা প্লেয়ার অ্যাডভান্স নিল, গুঁড়োও নিল, তারপর অন্য ক্লাবে সই করে বসল—।”

সরোজ বসাকের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘুনু কথাটা ছোঁ মেরে তুলে নিল। ”ঠিক এই ব্যাপারই তো গত বছর দুলাল চক্রবর্তী করল। সওয়া লাখ অ্যাডভান্স আর কুড়ি হাজার গুঁড়ো নিয়ে বলল যাত্রী ছাড়া আর কোনও ক্লাবে মরে গেলেও খেলবে না। ব্লেড দিয়ে হাতে আঁচড় কেটে রক্ত বের করে বলল, ”দেখুন এর প্রত্যেক কণিকায় যুগের যাত্রীর নাম লেখা রয়েছে।”

”অ্যাঁ! রক্তে নাম লেখা?” মালবিকা চমৎকৃত হয়ে বললেন, ”তাও কখনও হয় নাকি!”

”হয়। কলকাতার ফুটবলাররা ক্লাবের প্রতি এতই অনুগত, ক্লাবের ভালমন্দ, মানমর্যাদা নিয়ে এতই ভাবিত যে, ওদের রক্তে ক্লাব মিশে যায়, ওদের নিঃশ্বাসেও ক্লাবের নাম বেরিয়ে আসে।”

”কী জানি বাবা, আমি তো সায়েন্স পড়েছি, বটানিতে বি. এস. সি., এমন কথা তো কখনও চোখে পড়েনি।” মালবিকা মিনমিন করে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন।

”আপনার চোখ নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু আমাদের ফুটবলারদের শরীরে বিশেষ এক ধরনের রক্ত বয়, সেটা ভাল চোখে দেখা যায় না।” ঘুনু মিত্তির এমনভাবে হাসলেন যার সাত—আট রকম অর্থ হয়। ”এই বছর যে প্লেয়ারের রক্তে যুগের যাত্রীর নাম, পরের বছর তারই রক্তে পাবেন সারথি সংঘের নাম, তার পরের বছর হয়তো লেখা থাকবে জুপিটারের নাম।”

”খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার তো!” জি. সি. দত্তর ঘাবড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। ”এদের আসল রক্ত, মানে বাপ—মা’র কাছ থেকে পাওয়া রক্তটা তো দেখছি আর নেইই। এদের রক্ত যদি ক্লাব—রক্ত হয় তা হলে মানুষের শরীরে দিলে তারা তো মারা যাবে।”

”যেতে পারে। ফুটবলার জানলে ব্লাড ব্যাঙ্ক হয়তো ভবিষ্যতে এদের রক্ত নেবে না। অবশ্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, এরা কখনও ব্লাড ডোনেট করে না।” ঘুনু মিত্তির সহজ স্বরে কথাটা বলেই পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরলেন। ”হ্যাঁ, গুঁড়োর কথা হচ্ছিল। দুলাল অ্যাডভান্স আর গুঁড়ো নিয়ে সই করার দু’দিন আগে সারথি—র বটা বিশ্বাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে ফোন করে আমায় বলল, বটার ছেলেরা ওকে রাস্তা থেকে ধরে, পিস্তল দেখিয়েই অবশ্য, গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে।”

”আপনারা পুলিশের হেলপ নিলেন তো?” ভটচায বলতে বলতে আড়চোখে জি. সি. দত্তর দিকে তাকালেন।

”মাথা খারাপ! পুলিশের কাছে গিয়ে কী হবে? দুলাল তো নিজেই ট্যাক্সি করে বটার ডেরায় গিয়ে উঠেছে। খবর আমি দশ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেছলাম। আমাদের থেকে পঁচিশ হাজার বেশি দেবে বলাতেই দুলাল টোপ খেয়ে নিল।”

”কিন্তু রক্তে যে যাত্রীর নাম লেখা!” মালবিকা আঁতকে উঠে বললেন। ঘুনু তাতে কান না দিয়ে বলে চললেন, ”আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কত বেশি দেবে বলেছে? বলল পঁচিশ হাজার। আমি বললাম, আরও তিরিশ হাজার দেব, চলে আয়। বলল, যাব কী করে, দরজার বাইরে, রাস্তায় ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে। তখন ফোন রেখে আমি দৌড়লাম দুলালের বাড়ি। ওর বউ মধুছন্দাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার স্বামী তিরিশ হাজার টাকা হারাবে যদি সারথিতে সই করে। তুমি ওকে সারথির ডেরা থেকে এখুনিই উদ্ধার করে আনো।”

”তারপর মধুছন্দা উদ্ধার করে আনল?” ভটচায চেয়ারের কিনারে টানটান হয়ে বসলেন। ঘরের সবাই উদগ্রীব।

”মধুছন্দা তখন আট মাসের ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আমায় বলল, চলুন তো, কোথায় ও রয়েছে সেখানে আমায় নিয়ে চলুন। তিরিশ হাজার টাকা ফ্যালনা নাকি! হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দেওয়া! পা দিয়ে ফুটবল খেলে বলে কি লক্ষ্মীকেও খেলবে?” ঘুনু অবিকল মধুছন্দার কণ্ঠস্বরে কথাগুলো বললেন।

”আপনি ওকে নিয়ে গেলেন তো?” উৎকণ্ঠিত মালবিকা জানতে চাইলেন।

”অবশ্যই। নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো গেছি। ট্যাক্সি করে বটা বিশ্বাসের বেহালার ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে ছেলেকোলে মধুছন্দাকে নামিয়ে দিয়ে বললাম, তিনতলায় ডান দিকে, আমি ট্যাক্সি নিয়ে এখানে অপেক্ষা করছি, দুলালকে একেবারে সঙ্গে করে আনা চাই। মনে রেখো তা না হলে তিরিশ হাজার হারাবে।” ট্যাক্সি থেকে নামতে গিয়েও থমকে গেল মধুছন্দা, বলল, ”হারাব আমি? তিরিশটা পঁয়ত্রিশ করুন।”

”কী মেয়ে ভাবুন তো! দরাদরি শুরু করল কিনা এই সময়ে, ট্যাক্সি থেকে এক পা রাস্তায় রেখে।”

”আপনি কী বললেন, পঁয়ত্রিশ দেবেন?” জি. সি. দত্ত যে মনে মনে হিমশিম হয়ে পড়েছেন সেটা তাঁর ঢোঁক গেলা থেকে বোঝা গেল।

”তা ছাড়া তখন আর উপায় কী। বললাম, পঁয়ত্রিশ দেব যদি দুলালকে এখনিই বের করে আনতে পারো।”

”কিন্তু বাইরে যে ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে?” সরোজ মনে করিয়ে দিলেন।

”কোথায় ছেলেরা!” ঘুনু মিত্তির পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করলেন। ”ছেলে ফেলে পাহারা দিচ্ছে, ওসব দুলালের বাজে কথা। যাই হোক, আমি তো ট্যাক্সিতে বসে রইলাম। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, আধঘণ্টা কেটে গেল। বাড়ি থেকে ওরা কেউ আর বেরোয় না। ভাবলাম হলটা কী! মধুছন্দাকেও আটকে রাখল নাকি?” ডিবে থেকে একটিপ নস্যি বের করে ঘুনু নাকের কাছে এনে থমকে গেলেন। ”তারপর দেখি ছেলেকে কাঁখে নিয়ে মধুছন্দা বেরিয়ে আসছে, একমুখ হাসি, সঙ্গে দুলালও।” নস্যিটা ঘুনু নাকে গুঁজে হাত ঝাড়লেন।

”সাকসেসফুল! অ্যাঁ, মধুছন্দা তা হলে পারল!” ভচটায প্রায় হাততালি দিয়ে ফেলেছিলেন যদি না তখন মালবিকা ‘হ্যাঁচ্চেচা’ করে উঠতেন।

”ওহহ, আই অ্যাম সরি।” ঘুনু কাঁচুমাচু হলেন।

”নস্যি একটা খুব বাজে নেশা।” এতক্ষণে রেখা গুপ্ত মুখ খুললেন। ঘুনু মিত্তিরকে এই প্রথম কোণঠাসার মতো দেখাল। শুধু নস্যির গুঁড়ো ছড়িয়ে একজন মাহিলাকে হাঁচিয়ে দেওয়ার জন্যই নয়, রেখা গুপ্তর বিরক্তি উৎপাদনের কারণ হওয়াটাই তাঁকে কিছুটা ঘাবড়ে দিল। আসলে তিনি এসেছেন তো নাকুর পিসিকে তুষ্ট করতে। ঘুনু খবর নিয়ে জেনেছেন; সমীরণ গুপ্তকে তুলতে হলে জালটা ফেলতে হবে তার পিসির ওপর। পিসি হ্যাঁ বললে ভাইপো কখনও না বলবে না।

”নস্যি আমি এখনিই ছেড়ে দেব। ঠিক বলেছেন, খুব বাজে নেশা।” ঘুনু ডিবেটা বাড়িয়ে দিল শ্যামলার দিকে, ”মা, তুমি এটা এখুনি বাইরে ফেলে দাও তো।”

সারা ঘরে থতমত অবস্থা। চারজন বেগার সমস্বরে ”না না না” বলে উঠলেন। শ্যামলা নিজের হাত টেনে নিল। রেখা গুপ্ত রীতিমতো অপ্রস্তুত।

”না কেন? আমি এখনই…ওঁর সম্মান, ওঁর কথা, ওঁর নির্দেশ আমি এখনই রক্ষা করব।” ঘুনু উত্তেজিত হয়ে মোড়া থেকে উঠে জানলার কাছে গেলেন। ডিবেটা কপালে ঠেকিয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুড়ে বলে উঠলেন, ”হতভাগা নস্যি, দূর হ। জীবনে আর তোকে নাকে ঢোকাব না।”

”আমি তো আর ফেলে দিতে বলিনি।” রেখা গুপ্তর গলায় অনুশোচনার মতো ক্ষীণ সুর। ঘুনুর কানে সেটা ধরা পড়ল। একটা নস্যির ডিবে, ক’টাই বা টাকা! কিন্তু চারভাগের তিন ভাগ কাজ তো এগিয়ে রইল।

”হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?” ঘুনু যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠলেন এমনভাবে তাকালেন।

”মধুছন্দা বেরিয়ে আসছে বটা বিশ্বাসের ফ্ল্যাট থেকে, সঙ্গে দুলাল আর কোলে বাচ্চচা।” ভটচায সঙ্গে সঙ্গে সূত্র ধরিয়ে দিলেন।

”হ্যাঁ, ওরা বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে উঠল। ট্যাক্সি ওদের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল। মধুছন্দা তখন খুশিতে ডগমগ হয়ে কী বলল জানেন?” ঘুনু চোখ বিস্ফারিত করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

”বটা বিশ্বাসের কবজা থেকে দুলালকে বের করে এনেছি।” সরোজ বললেন।

”সারথির টাকার ফাঁস খুলে দুলালকে বাঁচিয়ে দিলাম।” জি. সি. দত্তর অনুমান।

”পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বেশি দেবেন বলেছেন, মনে থাকে যেন।” মালবিকা নিশ্চিত স্বরে আন্দাজ করলেন।

ভটচায মাথা নেড়ে জানালেন তিনি কিছু বলতে চান না।

‘মধুছন্দার গলায় একটা সোনার হার ঝুলছে যেটা আগে দেখিনি। সেইটা হাতে করে তুলে আমায় বলল, ‘বটাদা এত ভাল, এত সুন্দর মানুষ, দেখুন হারটা, প্রায় দু’ভরি তো হবেই। জানেন, বউদিকে উনি বললেন, তোমার বোন আজ প্রথমবার এসেছে, ওকে একটা উপহার তো দেবে। তারপর নিজেই বউদির গলা থেকে হারটা খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, সুন্দর মেয়ের গলাতেই এই হার মানায়। উহ বটাদা যে কী ভাল! না না, দুলাল সারথিতেই থাকবে, বাড়তি পঁয়ত্রিশ হাজারে আমাদের দরকার নেই। বুঝলেন এবার?” ঘুনু সবার মুখের দিকে না তাকিয়ে এবার জানলার বাইরে দৃষ্টি পাঠালেন।

খুক খুক করে প্রথমে হেসে উঠল শ্যামলা। তারপর ঘুনু বাদে অন্যরা।

”কিন্তু দুলাল যে অ্যাডভান্স আর গুঁড়ো নিয়েছিল, তার কী হল?” জি সি দত্ত মনে করিয়ে দিলেন।

”ট্যাক্সি থেকে নেমে মধুছন্দা বাচ্চচা কোলে বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পর দুলাল আমার হাত ধরে বলল, ঘুনুদা পারিবারিক অশান্তির মধ্যে আর যাব না। অ্যাডভান্সের টাকা আমি ফিরিয়ে দেব তবে গুঁড়োটা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু ভেবো না যে মেরে দেব। সামনের বছর যাত্রীতেই আবার ফিরে আসব, তখন অ্যাডজাস্ট করে নিয়ো।”

”অ্যাঁ, সারথিতে সইসাবুদ করার আগেই বলে দিল পরের বছর দল পালটাবে! এ কী রে বাবা!” সরোজকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।

”কলকাতায় হাতে গোনা যে—ক’জন ফুটবল খেলতে পারে, দুলাল তাদের একজন। গত এগারো বছরে সাতবার সারথি আর যাত্রী করেছে। বয়স হয়ে গেছে, সত্তর মিনিটের ম্যাচ আগের মতো আর খেলতে পারে না। না পারলেও এক্সিপিরিয়েন্সের তো দাম আছে। সেটাও অনেকখানি কাজ দেয়। বহুবার ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে, নাম আছে, সাপোর্টাররাও নামী প্লেয়ার চায়।” ঘুনু মিত্তির এর বেশি আর কিছু বললেন না।

”তা হলে এ—বছর দুলাল চক্রবর্তী যাত্রীতে আসছে।” মালবিকা জানতে চাইলেন না, ঘোষণা করলেন। ঘুনু স্মিত হেসে মাথা কাত করলেন।

”তা আপনি এই সাতসকালে নাকুর খোঁজে এখানে এসেছেন, কী ব্যাপার?” রেখা গুপ্ত গম্ভীর গলায় সোজা প্রশ্ন রাখলেন।

”বুঝতেই তো পারছেন। যাত্রীতে নাকু এই বছর খেলবে এই প্রার্থনা নিয়েই আপনার কাছে আসা।” ঘুনু প্রার্থনা বোঝাতে হাতজোড় করলেন।

”ইয়ে,” জি. সি. দত্ত হাতঘড়ি দেখে খবরের কাগজ হাতে উঠে দাঁড়ালেন। ”নাতিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসার টাইম হল।”

বাকি তিনজনও উঠলেন। টাকাকড়ি, দলবদল—সংক্রান্ত আলোচনায় বাইরের লোকেদের থাকা উচিত নয়। অবশ্য ওঁরা জানেন, যা কিছু কথাবার্তা হবে সবই কাল সকালে জেনে যাবেন।

ভেতরের ঘরে ফোন বেজে উঠল। শ্যামলা ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলল।

”কে, মলা?”

”দাদা! কোত্থেকে ফোন করছিস?”

”হাওড়া স্টেশন থেকে, ট্রেন বেশি লেট করেনি। পিসি কী করছে?”

”ঘুনু মিত্তির নামে একটা লোক এসেছে তোমায় খুঁজতে, ডাইনিংয়ে বসে আছে।..”

”কী সব্বোনাশ, বাড়িতে এসে গেছে! বাঙ্গালোরেও এসেছিল যাত্রীর একজন, মহাদেব সামুই…কার সঙ্গে কথা বলছে?”

”পিসির সঙ্গে এবার কথা শুরু করবে। বেগারদা এতক্ষণ ছিল তাই…”

”শিগ্গিরি পিসিকে ডাক আমি কথা বলব, কায়দা করে ডাকিস ঘুনুদা যেন বুঝতে না পারে।”

শ্যামলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ”পিসি ফোন, তোমার এক ছাত্রীর মা কথা বলবেন।”

 রেখা গুপ্ত তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরলেন, ”হ্যালো, আপনি…”

”পিসি আমি নাকু, লোকটা কেন এসেছে?”

”বোধ হয় তোকে ওদের ক্লাবে খেলতে বলবে।”

”তুমি কিচ্ছু কমিট করবে না, বলবে যা বলার নাকুকেই বলুন।”

”তাই বলব। তোর ভাত তা হলে রাখব তো?”

”না, রাখার দরকার নেই। এখন আমি বাড়িমুখোই হব না। দুপুরে কোথাও খেয়ে নেব, রাতে ফিরব। এখন একবার দুলালদার মানে দুলাল চক্রবর্তীর অফিসে যাব। ঘুনুদা আশপাশে কোথাও নির্ঘাত ঘাপটি মেরে থাকবে। সন্ধে পর্যন্ত আমি বাড়ির দিকে মাড়াব না।”

”তা হলে ওকে এখন কী বলব?”

”বললাম তো, নাকুর সঙ্গে কথা বলবেন, নাকুর ফুটবলের ব্যাপারে আমি নাক গলাই না, ব্যাস। এখন রাখলাম।”

রেখা গুপ্ত চিন্তিত মুখে রিসিভার রাখলেন। সেই মুখ নিয়েই এসে বসলেন ঘুনু মিত্তিরের সামনে।

”কোনও দুঃসংবাদ?”

”হ্যাঁ। আমার এক ছাত্রীকে কারা যেন কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছে। ওর মা ভয় পেয়ে মেয়েকে আমার কাছে কিছুদিন রাখতে চাইছে।” রেখা গুপ্ত খুবই অস্বস্তিভরে বললেন। মিথ্যা কথা অম্লান বদনে তিনি বলতে পারেন না।

”কী ভয়ঙ্কর কথা! পুলিশে খবর দিয়েছে? ছাত্রীর বয়স কত? নিশ্চয় খুব বড়লোক।’ উত্তেজিত ঘুনু মোড়া থেকে নিজেকে বিঘতখানেক তুলে আবার নামিয়ে রাখলেন।

”দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ কী করতে পারে? তারা বলেছে মেয়েকে এখন বাড়ি থেকে বের করবেন না। আট বছর বয়স, সারাদিন বাড়িতে বন্দি থেকে বেচারার কী কষ্ট হচ্ছে ভাবুন তো? ওকে বরং আমার এখানেই নিয়ে আসি।”

”কিন্তু এখান থেকেও তো কিডন্যাপ হতে পারে।” ঘুনু বিপদ সম্পর্কে হুঁশ করিয়ে দিলেন।

”আমার এখান থেকে!” রেখা গুপ্ত যেন স্তম্ভিত হলেন ঘুনু মিত্তিরের অজ্ঞতার পরিচয় পেয়ে। ”আমি রয়েছি, মলা রয়েছে, এই ওঁরা এতক্ষণ যাঁরা এখানে ছিলেন, পেছনের নেতাজিনগর আর শহিদ কলোনির লোকেরা—কিডন্যাপওলাদের সাহস হবে? বরং ওদের ধরে আমিই কিডন্যাপ করে রেখে দেব।”

”কিন্তু তাদের পাবেন কী করে? তারা তো মোটরে করে আসবে, মেয়েটার মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলেই বোঁওও করে… দেখেন না টিভি সিরিয়ালে কীভাবে বাচ্চচাদের ধরে?”

 ”দেখেছি। ওইভাবে ধরতে আসুক না। তা হলে আমিও এইভাবে…” রেখা গুপ্ত হঠাৎ ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে ঘুনু মিত্তিরের বুশ শার্টের কলার ধরে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুনুও উঠলেন। ”কিডন্যাপ করতে আসা?…অ্যাঁ কিডন্যাপ? দেখাচ্ছি মজা।” কলার ধরে পাকা জাম পাড়ার মতো ঘুনুকে ঝাঁকি দিয়ে আবার বললেন, ”কিডন্যাপ করে টাকা কামাবে ভেবেছে?”

”আ—আমি কিডন্যাপার নই, উঁহুহু লাগছে, ছাড়ুন ছাড়ুন।” ঘুনুর মুখে রক্ত জমে লাল, চোখ দুটি গর্ত থেকে প্রায় এক কিলোমিটার বেরিয়ে এসেছে।

রেখা গুপ্ত লজ্জিত হয়ে কলার ছেড়ে দিলেন। ”একসাইটেড হয়ে…ছি, ছি, আমায় মাফ করবেন।” হাত জোড় করলেন তিনি।

”উফফ কী গায়ের জোর!” বিড়বিড় করলেন ঘুনু মিত্তির। শ্যামলা চুপচাপ ব্যাপারটা দেখছিল। নম্রস্বরে বলল, ”বরফ আনব? গলায় ঘষলে ব্যথা আর থাকবে না।”

”না না, বরফ টরফ দরকার নেই, আমার কিছু হয়নি।”

”পিসি একটু রাগি, নইলে মানুষটা খুবই নরম।” শ্যামলা ঢোঁক গিলল কটমট তাকিয়ে থাকা পিসির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে।

”সত্যিই আমার মনটা খারাপ লাগছে। আমার এখন মুন্নির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে, মলা যাবি আমার সঙ্গে?” বলেই রেখা গুপ্ত ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ”হ্যাঁ, বলছিলেন কী যেন দরকার আছে আমার সঙ্গে? তাড়াতাড়ি বলুন।”

ঘুনু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন পিসির এলোমেলো কথা আর আচরণে। নিজেকে ধাতস্থ করতে করতে বললেন, ”নাকু এ বছর যাত্রীতে আসুক…ওর পুরনো যা পাওনা সবই পেয়ে যাবে আর সারথিতে যা পাচ্ছে তার থেকে…আপনি জানেন তো নাকুকে আমিই দর্জিপাড়া থেকে যাত্রীতে এনেছিলাম ষাট হাজার টাকায়? আজ আবার আমি এসেছি এক লাখ ষাট হাজার দর নিয়ে।”

”তা আমার কাছে কেন? নাকুর আর ফুটবলের ব্যাপার এটা, আমি এর মধ্যে নাক গলাতে চাই না।” রেখা গুপ্ত মৃদু শান্ত স্বরে বললেন।

”আপনি যে নাকুর কতখানি তা কি আমি জানি না? রোজগারের এটাই বয়স। টপ ফর্মে থাকার সময় কিছু কামিয়ে নেওয়া। এবার আমরা খুব ভাল টিম করব, ওর মতো একটা স্ট্রাইকারের যা দাম তা আমরা নিশ্চয়ই দেব। সারথিতে পাচ্ছে তো এক—তিরিশ, আমরা এক ষাট দেব।” ঘুনু ধীরে মেপে মেপে কথাগুলো বলার সময় রেখা গুপ্তর মুখভাব লক্ষ করছিলেন। কিন্তু কোনও ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে অস্বস্তিতে পড়লেন।

”আপনি এসব কথা নাকুকেই বলবেন। আমি চাকরি করি, দাদা চাকরি করেন, নাকু তো করেই, আমাদের এতেই মোটামুটি চলে যায়।” রেখা গুপ্ত আরও মৃদু স্বরে বললেন।

”না, না, টাকার লোভ আপনাদের দেখাব, এত ধৃষ্টতা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নাকু এখন বড় প্লেয়ার। ইন্ডিয়া ক্যাম্পে রয়েছে, ক্যাপ্টেন হবে বলেই শুনেছি। দেশের ক্যাপ্টেন হওয়া তো বিরাট মর্যাদা। আমাদের ক্লাবও সেই মর্যাদার কিছুটা পাবে যদি নাকু যাত্রীতে আসে।” ঘুনুর অস্বস্তি আরও বাড়ল কারণ রেখা গুপ্তর মুখভাব এখনও ধ্যানী বুদ্ধের মতোই রয়ে গেছে।

”পিসি, মুন্নিদের বাড়ি যাবে না?” শ্যামলা মনে করিয়ে দিল।

”ওহ হ্যাঁ, স্নানটা করেই…” রেখা গুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে আলোচনায় ইতি টেনে দিয়ে বললেন, ”যা বলার নাকুকেই বলবেন। আমায় বলে কোনও লাভ নেই।”

ঘুনু মিত্তির চলে যাওয়ার পরই পিসি আর ভাইঝির খুকখুক হাসি হোহো—তে রূপান্তরিত হল।

।। ৩ ।।

দুলাল চক্রবর্তী চাকরি করে ব্যাঙ্ক অব বেনারসের চৌরঙ্গি শাখায়। হাওড়া স্টেশন থেকে সমীরণ ট্যাক্সিতে যখন ব্যাঙ্কের সামনে নামল তখন বেলা প্রায় এগারোটা। সঙ্গে একটা সুটকেস। কয়েকবার সে এই ব্যাঙ্কে দুলালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, অনেকের সঙ্গেই তার চেনা। এখানে সারথি এবং যাত্রী দুই ক্লাবেরই কিছু সমর্থক কাজ করে। কাউন্টারের বাইরে সমীরণকে দেখেই অল্পবয়সি একজন টেবিলের কাজ ফেলে উঠে এল।

”সমীরণদা, বাঙ্গালোর থেকে কবে ফিরলেন?”

”এইমাত্র। হাওড়ায় নেমেই সোজা এখানে।” সমীরণ সুটকেসটা দেখাল। ”অরুণ, দুলালদা কোথায়?”

”এই তো মিনিট কুড়ি আগে সারথির নির্মাল্য রায় এসে ওঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সামনেই তো ক্লাবের ইলেকশন, হয়তো ভোট ক্যানভাসিংয়ের জন্য গেছে। আপনাকেও যদি পায় তো কাজে নামিয়ে দেবে।” অরুণ গলা নামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল।

”পাবে না। এসব কাজ যে আমি করি না সেটা সবাই জানে।”

”কারা জিতবে মনে হয়? বটা বিশ্বাসরা তো খুব তোড়জোড় করেই নেমেছে।”

”বটাই জিতুক কি নির্মাল্যই জিতুক, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার কাজ যেটা, আমি শুধু সেটাই করি।” সমীরণ হাসল। তার কাজটা যে কী সেটা আর বলার দরকার হল না।

”দুলালদার কাছ শুনেছি কেরল থেকে বিনু জন—কে আনার জন্য লোক গেছিল। গোয়ার আলবুকার্কের সঙ্গেও নাকি কথাবার্তা চলছে। দু’জনেই তো স্ট্রাইকার। ওরা এলে তো আপনার…” অরুণের মুখে বিপন্নতার মতো একটা ভাব ফুটে উঠল। যেন সমীরণ নয়, সে নিজেই মুশকিলে পড়বে, এই দু’জন সারথিতে এলে।

সমীরণের কপালে একটা ভাঁজ উঠেই মিলিয়ে গেল। কথাটা সে দিনদশেক আগে বাঙ্গালোরেই শুনেছে কেরলের নুর মহম্মদের কাছে। বিনু জনের বাবার কাছে সারথি থেকে একজন গেছল। সে নাকি বলেছে সমীরণের সঙ্গে ক্লাব অফিসিয়ালদের সম্পর্ক ভাল নয়, তাই সারথি ওকে ছেড়ে দেবে যদি বিনু খেলতে রাজি হয়। সেদিন শুনে সমীরণ মনে মনে হেসে কথাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল।

তার সঙ্গে অফিসিয়ালদের সম্পর্ক খারাপ, এমন একটা কথা ক্লাবে বছর দুই ধরে চাউর হয়েছে। ক্লাবের দুটো গোষ্ঠীর কোনওটির সঙ্গেই তার মাখামাখি নেই, সে কোনও কর্তার অনুগ্রহে খেলছে না, নিজস্ব কোনও চক্র সে তৈরি করেনি। এই তিনটিই তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। সবার সঙ্গে সদভাব রেখে যে চলবে কলকাতার তারকা ফুটবল সমাজে সে সন্দেহজনক লোক বলে চিহ্নিত হবে। সমীরণেরও তাই হয়েছে। শত্রু নেই এ কেমন লোক! সুতরাং এ বিপজ্জনক, একে ভাগাও।

সমীরণকে ভাগাবার চেষ্টা গত বছরই হয়েছিল পঞ্জাব থেকে কার্নাইল সিং আর আলিগড় থেকে ইরানি ছাত্র রফসঞ্জানিকে এনে। দু’জনে মোট চারটে ম্যাচ খেলে কলকাতা থেকে বিদায় নিয়ে আর আসেনি। রটনা হয়েছিল, সমীরণ এবং আর কয়েকজন প্লেয়ার ‘ক্লিক’ করে ওই দু’জনকে খেলার সময় বল না দিয়ে বা ধরা যায় না এমন পাশ দিয়ে হাজার হাজার সমর্থকদের সামনে অপদস্থ করেছে। আরও কী, বন্ধু খবরের কাগজের রিপোর্টারদের দিয়ে নাকি ওদের বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো মন্তব্যও লিখিয়েছিল। এই সবই নাকি সমীরণের মস্তিকপ্রসূত!

সমীরণ জানে, সব রটনাই বটা বিশ্বাসের ‘কোটারি’ থেকে বেরিয়েছে। রটনাকে সে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। মাথার মধ্যে গেঁথে থাকা একটা কথাকেই শুধু সে সারসত্য বলে মেনে রেখেছে; এত টাকা যখন নিচ্ছ, সেইমতন খেলাটাও দিয়ো। সারথির সাপোর্টাররা স্বচক্ষেই মাঠে দেখেছে সমীরণের খেলায় আন্তরিকতা। সে জানে ওরাই তার রক্ষাকবচ।

কিন্তু এই জানাটাই তো এখনকার কলকাতার ফুটবলে শেষ কথা নয়। বড় ক্লাবে ক্ষমতা দখল আর প্রতিপত্তি বিস্তারের লড়াই অবিরাম চলেছে। কর্তাদের এক একজনের তাঁবে থাকে দু—চারজন অনভিজ্ঞ, চলনসই, নবাগত ফুটবলার আর ফর্ম ঝরে যাওয়া, বয়স্ক, নামী ফুটবলার। উভয়েই কর্তাদের দলাদলিতে দাবার বোড়ে হয়ে তাদের নির্দেশমতো মাঠে খেলে, পয়েন্ট খুইয়ে কোনও কর্তাকে বিপদে ফেলে দেয়, কোনও প্লেয়ারকে খেলার মধ্যেই অপ্রতিভ করিয়ে তাকে বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে, চোট আঘাতের অজুহাতে শক্ত ম্যাচগুলোয় না খেলে ক্লাবকে জব্দ করে। বিনিময়ে পায় অনুগ্রহ, আরও এক বছর ক্লাবে থাকার ছাড়পত্র অর্থাৎ টাকা বাড়িয়ে নতুন চুক্তি। সমীরণ এইসব নীচতাকে প্রশয় দেয়নি। সে শুধু নিজের খেলাকে আরও ওপরে তোলার চেষ্টা করে গেছে। সব কর্তারাই জানে সমীরণকে দরকার, কিন্তু একটা গোষ্ঠী তলায় তলায় চেষ্টাও চালিয়ে যাচেছ, বাইরে থেকেও সমমানের কাউকে আনিয়ে সমীরণকে সারথি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য।

”দুলালদার কথা থেকে মনে হয়েছে,” অরুণ দু’পাশে আড়চোখে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ”আপনি সারথিতে থাকুন এটা উনি চান না।”

”কেন?” সমীরণের কপালে আবার ভাঁজ পড়ল।

”মনে হয়, উনি নিজেও বোধ হয় থাকবেন না, আবার যাত্রীতেই ফিরে যাবেন।”

”যদি থাকবেনই না আবার, তা হলে ভোট ক্যানভাসিংয়ে নেমেছে কেন!”

”যদি বটা বিশ্বাসের গ্রুপকে হারানো যায়, মানে একটা চান্স নিচ্ছে।”

”বটাদাই তো ওকে যাত্রী থেকে এনেছে, এখন তাকে হারানোর জন্য দুলালদা চেষ্টা করবে কেন? আমি এই ক্লাব পলিটিক্সের মাথামুণ্ডু এখনও বুঝতে পারলাম না। কে যে কখন কার দিকে হয়! কখন যে কার স্বার্থে ঘা লাগে। যাক গে, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, এখন আমি চলি।” সমীরণ সুটকেসটা তুলে নিল।

”শুনছি মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর ট্যুরে আপনিই ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হবেন।” সমীরণের হাত থেকে সুটকেসটা প্রায় কেড়ে নিয়েই দরজার দিকে যেতে যেতে অরুণ বলল।

”এইরকম একটা কথা নোভাচেকের কাছে আমিও শুনেছি। তবে এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।”

”নোভাচেক কেমন কোচ?”

”সেটা এখন কী করে বলি! সবে তো কয়েক মাস হল এসেছে। তবে খাটাচ্ছে। স্পিড আর স্ট্যামিনার ওপরই জোরটা বেশি দিচ্ছে, মডার্ন ফুটবলের মূল জিনিস এই দুটো তো একদমই আমাদের নেই। থাক, তোমায় আর যেতে হবে না, আমি ট্যাক্সি ধরে নিচ্ছি।” সমীরণ সুটকেসটা অরুণের হাত থেকে নিয়ে হাত তুলে থামাল একটা খালি ট্যাক্সিকে।

এরপর সে মুশকিলে পড়ল ট্যাক্সিতে বসে, কোথায় যেতে বলবে ট্যাক্সিওলাকে? ঘুনুদা এতক্ষণ বাড়িতে বসে নেই নিশ্চয়ই, কিন্তু যদি কাছাকাছি কোনও লোক রেখে থাকে? তাকে বাড়ি ফিরতে দেখলেই ওর কাছে খবর পৌঁছে যাবে! কিছু বিশ্বাস নেই এই লোকটিকে। সব পারে।

”কোথায় যাবেন?” ট্যাক্সিওলা গন্তব্য জানতে চাইল।

”নাগেরবাজার।”

কেন যে নামটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল সমীরণ বুঝতে পারল না। দমদম এলাকার মধ্যে জায়গাটা বাড়িরও কাছাকাছি, এটা একটা কারণ, তা ছাড়া নাগেরবাজারে একটা গলিতে থাকে তার স্কুলের বন্ধু বাসব। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। বাসবের একটা নাটকের দল আছে। একাধার সে নাট্যকার, নির্দেশক আর অভিনেতা। এমন একটা লোককে হঠাৎই এখন মনে পড়ে যাওয়া কেন? বছর চারেক আগে যখন সে প্রথম যুগের যাত্রীতে খেলছে তখন কিছুদিনের জন্য তার অভিনয় করার ইচ্ছা জেগেছিল। তিন—চারবার মহলা দিয়েই ইচ্ছাটা লোপ পায়। স্টেজে নামা আর মাঠে নামার মধ্যেকার তফাতটা সে দ্রুত বুঝেছিল।

সমীরণ হেসে ফেলল। একটু আগেই অরুণ নোভাচেকের নাম করেছিল। বাসবের চেহারার সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে চেকোশ্লোভাকিয়ার এই লোকটির। দু’জনেই তামাটে—ফরসা, পাতলা, লম্বা ওপরের দুটি দাঁত একটু বেরিয়ে থাকে। মাথার গড়নটা একই রকম। তবে কারেলের গলা মিহি, বাসবের জলদগম্ভীর। তবে ওদের যতটুকু চেহারার মিল তাইতেই হয়তো বাসবকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে।

কারেল নোভাচেক ডিসিপ্লিন মানেন কঠোরভাবে। বাঙ্গালোর থেকে আসার সময় সমীরণকে বারবার বলেছিলেন, বাইশ তারিখের মধ্যে না ফিরলে এই ক্যাম্প থেকে তোমাকে ছাঁটাই করব। ছ’জনকে তিনি পত্রপাঠ বিদায় করেছেন মাত্র একদিন দেরিতে পৌঁছানোর জন্য। এ. আই. এফ. এফ. সেক্রেটারি অনুরোধ করেছিলেন, ছ’জনকে মাফ করে ক্যাম্পে যোগ দিতে দেওয়া হোক। কারেল জানিয়ে দেন, তা হলে পদত্যাগপত্র আপনার দপ্তরে পৌঁছে দেব।

সমীরণের মাথার মধ্যে ‘বাইশ’ শব্দটা কানামাছির মতো বোঁ বোঁ করে উড়ে চলেছে আর ঠোক্কর খাচ্ছে। বাইশ থেকেই হয়তো বাসবকে মনে পড়ল। চব্বিশে তারা কোঝিকোড় যাবে নাগজি টুর্নামেন্টে খেলতে। টিম কেমন সেট করেছে কারেল তা পরখ করে নেবেন বলেই নাগজিতে তাদের নামাচ্ছেন। ওঁর কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সমীরণের কাছেও । এ. আই. এফ. এফ. দলের ক্যাপ্টেন সে হচ্ছেই, এটা কারেলই তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। বারো বছর আগে যেদিন সে ফাইভ বুলেটস—এর ক্যাপ্টেন হয়ে, পাতিপুকুর থেকে শিল্ড জিতে বাড়ি ফিরেছিল পাড়ার ছেলেদের কাঁধে চড়ে, সেদিন পিসিকে সে বলেছিল, ”আমি ইন্ডিয়ার হয়ে খেলব, তুমি দেখে নিয়ো।” তারপর বলেছিল, ”আমি ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেনও হব।” প্রথম স্বপ্নটা সম্ভব হয়েছে, দ্বিতীয়টা বাকি রয়ে গেছে। বাইশে তাকে কোঝিকোড় পৌঁছতেই হবে। কারেল বড় কড়া মানুষ।

নাগেরবাজার থেকে দমদম স্টেশনের দিকে যেতে ডান দিকে মতিঝিল কমার্স কলেজের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে ভেতরে দিকে চলে গেছে। ট্যাক্সিটা ঢুকতে গিয়েই বাধা পেল। একটা লরি ধাক্কা দিয়েছে আরোহী সমেত সাইকেল রিকশাকে। দুই মহিলা আরোহীর রাস্তায় ছিটকে পড়া ছাড়া বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, তুমুল কাণ্ড ঘটাবার পক্ষে এটাই যথেষ্ট। বিতণ্ডা চলছে, লরিটাকে পুড়িয়ে ফেলা হবে কি না। আশপাশের বাড়ির বাসিন্দা ও দোকানদাররা চাইছে, বড় রাস্তায় নিয়ে গিয়ে পোড়াও, নইলে আগুনে তাদেরও সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিছু লোক চাইছে, ঘটনা যেখানে পোড়ানো সেখানে।

ট্যাক্সিভাড়া চুকিয়ে সমীরণ সুটকেস হাতে, ভিড় ঠেলে কয়েকমিনিট হেঁটে পৌঁছল বাসবের বাড়ি। একতলায় বড় একটা ঘরে বাসব একাই থাকে, পরিবারের সবাই দোতলায়। এই ঘরেই অভিনয়ের মহলা হয়। চাকরি করে না, একমাত্র ছেলে, যথেষ্ট বিষয়সম্পত্তি আছে, তাই বাসব সামান্য মাত্রায় অলস। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছে। সমীরণ তাকে এখন বাড়িতে পাবে আশা করেই ডোর—বেলের বোতাম টিপল, বেল বাজার শব্দ হল না। তা হলে বোধ হয় পাওয়ার কাট।

সমীরণ দরজা খটখটাল, একবার, দু’বার।

”কে—এ—এক—এ! ঘুমজড়ানো গলায় ভেতর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল, আর ঠিক সেই সময়…

”সমীরণদা, আমাদের খুব বিপদ।”

কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমীরণ দেখল তিনটি যুবক, কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স, গলির মধ্যে ছুটে এল। একজন গোলকিপারের মতো ডাইভ দিয়ে তার পায়ের দুটো গোছ আঁকড়ে ধরল। আর একজন নিলডাউন হয়ে করজোড়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তৃতীয়জন ফাঁকা জায়গা না পেয়ে ছুটে তার পেছনে এসে জড়িয়ে ধরল।

”একী, একী! হচ্ছে কী?” সমীরণ সুটকেস আঁকড়ে ধরে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। ছিনতাই করার নানান পদ্ধতির এটাও একটা বলে তার মনে হচ্ছে।

”আমরা ডুবে যাব, বিশ্বাস করুন আমরা গাড্ডায় পড়ে যাব, পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না আর।” নিলডাউন যুবক সকাতরে বলল।

পায়ের গোছ ধরা যুবক প্রায় ডুকরে উঠে বলল, ”আপনি, শুধু আপনিই আজ আমাদের বাঁচাতে পারেন।”

জাপটে ধরা তৃতীয়জন তাদের আশ্বাস দিয়ে বলল, ”পিন্টু কাঁদিস না, ভগবান আমাদের সহায় তাই সমীরণদাকে ঠিক সময়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

”হচ্ছে কী? অ্যাঁ, ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।” সমীরণ কনুই দিয়ে কোঁতকা দিল জাপটে ধরাকে। টান মেরে ডান পা, বাঁ পা তুলে গোছ ছাড়িয়ে নিল।

”রাগ করবেন না সমীরণদা। আজ আমাদের ফুটবল ফাইনাল, আটদিন আগে তুষার মৈত্র রাজি হয় প্রধান অতিথি হতে। বলেছিল তিনটের সময় বাড়িতে গাড়ি নিয়ে যেতে। আমরা সকাল থেকে রিকশায় মাইক নিয়ে অ্যানাউন্স করে ঘুরেছি, হাতে লিখে পোস্টারও মেরেছি অন্তত গোটা কুড়ি। আজ সকাল দশটায় তুষার ফোন করে বলল আসতে পারবে না, তাকে নাকি দুপুরে বর্ধমানে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। সেখানে ওর শালাদের ক্লাবেরও ফুটবল ফাইনাল, ওকে চিফ গেস্ট হতে হবে তাই আমাদের এখানে আসতে পারবে না।”

তুষার মৈত্র শুধু যাত্রীরই সেরা নয়, ভারতেও একসময় ওর মতো স্টপার দু—তিনজন মাত্র ছিল। ভীষণ জনপ্রিয়। এগারো বছর ধরে ক্লাব বদলায়নি। ওর সঙ্গে সমীরণের বহুবার কলকাতার এবং বাইরের মাঠে লড়াই হয়েছে। ফলাফল প্রায় সমান—সমান। তবে গত দু’বছর ধরে সমীরণ লক্ষ করেছে পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি বয়সি তুষার আগের মতো আর ঝটতি ঘুরতে পারছে না, দ্রুতগতির ফরওয়ার্ডরা ওকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে, স্পট জাম্পে ততটা আর শরীর উঠছে না। বহু জুনিয়র ছেলের কাছে শুনেছে, এখন জার্সি টেনে ধরে বা পেটে ঘুসি মেরে তাদের আটকায়, রেফারিরা ওর বিরুদ্ধে ফাউল দিতে ভয় পায়। যাত্রীর এক কর্তা সুবোধ ধাড়ার গ্রুপের প্লেয়ার বলেই সবাই তুষারকে জানে। সেক্রেটারি পতিতপাবন ওরফে পতু ঘোষের বিরোধী গোষ্ঠী হল ধাড়া গোষ্ঠী।

”তুষারদা আসতে পারবে না তো আমি কী করব? বর্ধমান থেকে তাকে ধরে আনব?” সমীরণ ঝাঁঝালো চোখে তিনজনকে তার বিরক্তি জানিয়ে দিল।

”আপনি রাগ করবেন না সমীরণদা, আজ আমাদের উদ্ধার করে দিন।” বলতে বলতে আবার নিলডাউন।

”আমরা আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।” বলার সঙ্গে ডাইভও। কিন্তু সমীরণ সাইড স্টেপ করে পায়ের গোছ সরিয়ে নিতে পেরেছে।

তৃতীয়জন আর জাপটে না ধরে, বিগ্রহের সামনে ভক্ত যেভাবে জোড়হাতে দাঁড়ায় তেমনভাবে শুধু দাঁড়িয়ে রইল।

বাড়ির দরজা খুলে এই সময় বাসব বেরোল, পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে জড়ানো স্বরে বলল, ”কী রে নাকু, ব্যাপার কী? এই অসময়ে? আয়।”

বাসব আবার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে, তখন নিলডাউন লাফিয়ে উঠে ”বাসুদা, বাসুদা”, বলে তার পিছু নিল।

”মরে যাব আমরা। আপনি বলুন সমীরণদাকে। মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য। দুটো টিমের সঙ্গে ইন্ট্রোডিউস আর প্রাইজ দেওয়া।”

”এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম রে! দুটো রাত ট্রেনে কাটিয়েছি বাঙ্গালোর থেকে হাওড়া পর্যন্ত। এখনও বাড়ি যাইনি, খাওয়া হয়নি, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে, ঘুম পাচ্ছে—সমীরণ হতাশভাবে শুকনো স্বরে তার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে করুণ চোখে তাকাল বাসবের দিকে।

”দাদা, শুধু পাঁচটা মিনিট।”

”খেলার আগে ইন্ট্রোডাকশন, খেলার পর প্রাইজ দেওয়া—পাঁচ মিনিটে হয়? চালাকি করার আর লোক পাওনি?” সমীরণ তেরিয়া গলায় বলল।

”তুই এখনও খাসনি!” বাসব ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ”এই শোন এখন তোরা ওকে ছেড়ে দে। আগে চান—খাওয়া করে নিক তারপর কথা বলিস।”

”বাসুদা আপনি ওকে…”

”আরে বাবা বলব, বলব। যাবে, যাবে। এখন তোরা ভাগ তো।” বাসব নিশ্চিন্ত স্বরে তিনজনকে আশ্বাস দিল।

সমীরণ দাঁতে দাঁত ঘষে বাল্যবন্ধুর দিকে তাকানো ছাড়া আর কী করবে ভেবে পেল না।

”অ্যাই চল, বাসুদা যখন ভার নিয়েছে আর কিছু ভাবতে হবে না। সমীরণদা আপনি এখন রেস্ট নিন। একটু ঘুমিয়েও নিন। আমরা ঠিক সময়ে এসে তুলে নিয়ে যাব। এই রানা তুই এখানে থাক।” নিলডাউনের হাবভাব, গলার স্বর মুহূর্তে কড়া, রুক্ষ হয়ে উঠল। এই ”থাক”—এর অর্থ বুঝতে সমীরণের অসুবিধা হল না। পাহারায় থাক, যেন না পালায়।

”যাত্রীর প্লেয়ার পেলাম না তো কী হয়েছে, সারথির এত নামী একজনকে তো পেয়েছি! সমীরণদা আমাদের এলাকায় দু’দলের সাপোর্টারই আছে।” জাপটে ধরার ভাবভঙ্গিতে স্বস্তি এবং সাফল্য দুটোই টানটান।

”পিন্টু, মাইক নিয়ে বেরো।”

ওরা চলে যেতেই সমীরণ বলল, ”বাসু, এটা কী হল?”

”কী আবার হবে! পাড়ার ছেলে, জলে বাস করে কুমিরদের সঙ্গে… আগে চান কর, মা’কে বলছি, ভাতটাত করে দিতে।”

কথামতোই ওরা এসে সমীরণকে ঘুম থেকে তুলল। হাঁটলে মাঠটা মিনিট পাঁচেক দূরে, ওরা সাইকেল রিকশায় জোর করেই তুলল।

”এতবড় প্লেয়ার হেঁটে যাবে? তাই কখনও হয়। আমাদের নিন্দে হবে না?” সেই নিলডাউন একদম নতুন ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বলল এবং উঠে সমীরণের পাশে বসল।

”আমি তো চিফ গেস্ট, আজকের সভাপতি কে?”

”নীলমণি গড়গড়ি, আপনি চেনেন? খুব বড় প্লেয়ার ছিলেন একসময়ে।”

”আলাপ হয়নি, নাম শুনেছি, উনি যখন খেলতেন তখন আমি জন্মাইনি।”

দূর থেকে লাউডস্পিকারে ভেসে আসছে ”নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালনায় সেভেন—এ—সাইড ফুটবল প্রতিযোগিতা, শহিদ বিপুল কুণ্ডু চ্যালেঞ্জ কাপ ও তিনকড়ি চ্যালেঞ্জ শিল্ডের ফাইনাল খেলা এখনই শুরু হতে যাচ্ছে। আজকের খেলায় সভাপতি অতীত দিনের প্রখ্যাত খেলোয়ার এবং কোচ নিলু গড়গড়ি … নীলমণি গড়গড়ি, আর প্রধান অতিথি….” একটু থেমে, ”সমীরণ গুপ্ত, যার কোনও পরিচয় দেওয়ার দরকার হবে বলে মনে করি না।”

”শুনলেন?”

”হুঁউ।”

আবার ভেসে এল, ”নির্দিষ্ট প্রধান অতিথি তুষার মৈত্রর শাশুড়ি মারা যাওয়ায় তিনি আজ সকালে বর্ধমান চলে গেছেন, এজন্য আমরা দুঃখিত।”

সমীরণ চোখ বড় করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিলডাউনের দিকে তাকাল।

”এসব না বললে পাবলিক ম্যানেজ করা যায় না। ফুটবলারদের চরিত্র যে কী, দাদা আপনি কিছু মনে করবেন না, লোকে একদমই জানে না। আমরা ছোটখাটো ক্লাব করি, এইসব টুর্নামেন্ট থেকেই তো ফুটবলার বেরিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের দিকে বড় বড় ক্লাব, বড় বড় ফুটবলার কোনও নজর দেয় না। পাড়ার লোক, দোকানদার এদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে টুর্নামেন্ট চালাই। দেনাও হয়। আস্তে আস্তে শোধ করি। আমাদের দোষ—ত্রুটি—অপরাধ আপনি মাফ করে দেবেন সমীরণদা।”

শুনতে শুনতে সমীরণের মাথা নীচের দিকে নেমে গেল। ফুটবলটা আসলে কারা বাঁচিয়ে রেখেছে তা সে বোঝে। এইরকম ছোট ছোট ক্লাব বাংলার সর্বত্র রয়েছে। তাদের পাড়াতে এমন একটা ক্লাব থেকেই তো সে খেলা শুরু করেছিল। যদি ক্লাবটা না থাকত, যদি বরেন মুখোটি তাকে ফুটবলের গোড়ার জিনিসগুলো না শেখাতেন তা হলে আজ সে এত খ্যাতি, এত টাকার মুখ কি দেখত?

রিকশা মাঠের ধারে পৌঁছে গেছে। তক্তপোশের ওপর মঞ্চটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। একটা টেবিলে একটি কাপ ও একটি শিল্ড আর ছোট দুটি কাপ। পিতলের ফুলদানিতে রজনীগন্ধার গোছা। জমিতে রাখা একটা টেবিলে পুরস্কার সামগ্রী—শস্তার কিটব্যাগ ও তোয়ালে।

”সমীরণ গুপ্ত এসে গেছেন। খেলা এখনই আরম্ভ হবে। প্রতিযোগী দল দুটিকে অনুরোধ করা হচ্ছে প্রধান অতিথি সমীরণ গুপ্তর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তারা যেন এবার সেন্টার লাইনের কাছে সার দিয়ে দাঁড়ায়। রেফারি, লাইন্সম্যান, আপনারাও দাঁড়াবেন।”

সভাপতি ও প্রধান অতিথিকে মালা দেওয়া হল। সমীরণের মনে হচ্ছে সে যেন ইলেকট্রিক মাঠে রয়েছে। চারদিকে বাড়ি, অসমান ঘাসহীন জমি, মাঠ ঘিরে বালক, মাঝবয়সি, এমনকী বৃদ্ধরাও ঠেলাঠেলি করছে সাইড লাইনের ধারে। ছাদে, বারান্দায়, গাছেও মানুষ। এদের বেশিরভাগই কলকাতার ময়দানে কখনও খেলা দেখেনি, যদিও এখান থেকে বাসে ময়দান যাওয়া যায়। ছোট মাঠে, আজীবন এই ফুটবল দেখেই খুশি থাকবে কত লোক! তার নাম শুনেছে, কাগজে ছবি দেখেছে, হয়তো টিভিতেও খেলা দেখেছে, কিন্তু তাকে সামনাসামনি এই প্রথম দেখছে। এরা কী ভাবছে তার সম্পর্কে?

টিম দুটোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য মাঠের মাঝে যেতে যেতে সমীরণ মাথা ঘুরিয়ে দর্শকদের দিকে তাকাল। হাততালি পড়ছে।

তার জন্যই কি? সে খেলতে নামছে না, তবু এই উচ্ছ্বসিত হওয়া কেন? এখানে তো শুধুই সারথির সাপোর্টার নেই, যাত্রীরও আছে। তারাও তো তাকে হাততালি দিল!

এইভাবে আমিও দাঁড়াতাম। সার দিয়ে দাঁড়ানো প্লেয়ারদের সঙ্গে হাতে হাত দিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সরে যাওয়ার সময় সমীরণের মনে হল এদের মধ্যে কেউ একজন সে নিজেও। কোনজন সে? সবাইকেই তার একাকার লাগছে। ওরা এক পা বেরিয়ে এসে সামান্য ঝুঁকে নিজের নাম বলে যাচ্ছে—হোসেনুর আলম, অরূপ মুখার্জি, রামকুমার সাউ, প্রশান্ত বর্মন…সমীরণ গুপ্ত, সমীরণ গুপ্ত, সমীরণ গুপ্ত…।

পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর গ্রুপ ফোটো তোলা হল। মঞ্চে ফিরে আসার সময় সমীরণ দর্শকদের উদ্দেশ্যে নমস্কার জানাতেই আবার হাততালি পড়ল।

নিলু গড়গড়ি মঞ্চেই থেকে গেছেন। দুটো টিমের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য মাঠের মধ্যে যেতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, ”আমি কে? ওরা কি আমায় চেনে, না জানে? আমার নামও বোধ হয় শোনেনি। আমি যখন খেলেছি তখন ওদের বাবারা খেলা দেখতে যেত। এখন এই বাচ্চচাদের হিরো তো সমীরণরা। ওরা আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে মোটেই ধন্য বোধ করবে না। সমীরণ, তুমিই যাও।”

সমীরণ বুঝে গেছল, নিলু গড়গড়ির শরীর যেমন শুকনো কাঠের মতো, কথাগুলো ঠিক তেমনই হওয়ার একমাত্র কারণ, আশাভঙ্গ। পুরনো যুগের এইরকম ফুটবলার সে কিছু দেখেছে। এখনকার ফুটবলারদের এঁরা সহ্য করতে পারেন না, বিশেষত এত পাবলিসিটি, এত টাকা পাওয়াটাকে। ওঁরা খেলার জন্যই খেলেছেন, সেজন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন, অনেক কিছু হারিয়েছেন, পেয়েছেন শুধু প্রশংসা। এখন আর কি তা মনে রেখেছে?

সমীরণের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কয়েকটি ছেলে মঞ্চের পাশে ভিড় করে এল। সে একে একে সই করে দিল। তার পাশে বসা নীলমণি গড়গড়ির দিকে ওরা ফিরেও তাকাল না। তার বলতে ইচ্ছা করছিল, ওঁর সইটাও তোমরা নাও। কেন জানি বলতে পারল না।

সমীরণ আর গড়গড়ি পাশাপাশি বসে খেলা দেখল, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলল না। খেলা শেষ হতেই মঞ্চের সামনে ভিড় জমে গেল। পুরস্কার দেওয়া দেখতে তো বটেই, কাছের থেকে সমীরণকে দেখা আর তার ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা লক্ষ করা এবং শোনার জন্যও এই ভিড়।

বারাসাতের তরুণ মিলন সঙ্ঘ দু’গোলে পাইকপাড়ার ফ্রেন্ডস ইউনিয়নকে হারিয়েছে। ঘেমে যাওয়া, শ্রান্ত দুটো টিম মঞ্চের সামনে মাটিতে বসে। সভাপতি বক্তৃতা দেওয়ার পর প্রধান অতিথি পুরস্কার হাতে তুলে দেবে আর তারপর দু—চার কথা বলবে। সমীরণ ইতিমধ্যেই নিলডাউনকে বলে দিয়েছে, বক্তৃতা দেওয়ার প্রতিভা তার নেই সুতরাং দিতে পারবে না।

”আপনারা একটু পিছিয়ে দাঁড়ান। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান এখনই শুরু হবে। তার আগে আজকের এই ফাইনালের সভাপতি শ্রীনীলমণি গড়গড়ি ভাষণ দেবেন।

গড়গড়ি মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। চশমার কাচ মুছলেন পাঞ্জাবির খোঁটায়। গলা খাঁকারি দিয়ে, মাথাটা নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে শুরু করলেন, ”উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী, পুত্রবৎ সমীরণ গুপ্ত, আজকের দুই দলের খেলোয়াড়রা। এই ফুটবল ফাইনাল অনুষ্ঠানে আমাকে সভাপতিত্ব করার জন্য যখন আমন্ত্রণ করা হয় তখন আমি, যাঁরা আমার কাছে গেছলেন আমন্ত্রণ জানাতে, তাঁদের বলেছিলাম, আমাকে কেন? আমি তো পুরনো দিনের একটা ফসিল। এখনকার ফুটবল, তার পরিবেশ, হালচাল সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার চিন্তা—ভাবনা অন্যরকম, কোনও যোগাযোগই নেই ময়দানের ফুটবলের সঙ্গে। আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে যদি কিছু কথা বলি সেটা অন্যরকম শোনাবে। শুনে লোকে হাসবে। ওঁরা বললেন, আপনি যা বলবেন লোকে তা শুনবে, কেউ হাসবে না।

”না, হাসির কথা বলে আপনাদের হাসাবার জন্য আমি এখানে মাইকের সামনে দাঁড়াইনি। আমাদের ফুটবল যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে হাসির বদলে এখন কান্নার সময় এসে গেছে। তার কারণ আমাদের ফুটবল এখন মারা গেছে। তবে আমরা মৃতদেহটাকে না পুড়িয়ে বা কবর না দিয়ে নিজেদের স্বার্থে সেটা মমি করে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঠিকমতো নিয়ম না জানায় মমিটাও ঠিকমতো করা হয়ে উঠছে না, ফলে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।

”দুর্গন্ধ কী? আপনারা জানেন দু’বছর আগে ময়দানেই একটা খেলা গড়াপেটা করে হচ্ছে বুঝতে পেরে দর্শকরা—সাপোর্টাররা হাঙ্গামা বাঁধায়, টেন্টে আগুন ধরাতে যায়, প্লেয়ারদের মারে, ক্লাবকর্তাদের মারে। এটাই হল দুর্গন্ধ। গত বছর কাগজে পড়ি একজন বড় প্লেয়ার দলবদলের আগে ক্লাবে থেকে যাবে বলে অ্যাডভ্যান্স নিয়েছে, নেওয়ার সময় বলেছে, এই ক্লাবের তাঁবু তার কাছে মন্দিরের মতো। পড়ে কী ভাল যে লাগল! এই অবিশ্বাস, দুর্নীতি আর অবক্ষয়ের যুগে, ম্যানেজ আর গড়াপেটার যুগে একজনও অন্তত ফুটবলকে ঈশ্বর উপাসনার মতো ব্যাপার মনে করে। টাকাকড়িটা, তার কাছে বড় কথা নয়। কিন্তু তিনদিন পর কাগজেই দেখলাম সেই ফুটবলার আর এক বড় ক্লাবের এক কর্তার ফ্ল্যাটে গিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে দরাদরি করছে। এটাও হল দুর্গন্ধ।

”ফুটবলকে মেরে ফেলল কারা? প্রাণবন্ত ছিল আমাদের সময়ের ময়দান, এখন তা শ্মশান। ঘুরে বেড়াচ্ছে শেয়াল—কুকুর, যাদের বলা হয় ক্লাব কর্মকর্তা। এখন বিখ্যাত হওয়ার শর্টকাট রাস্তা হল বড় ক্লাবের অফিসিয়াল হওয়া। ট্যাঁকের জোর থাকলে ভাল, না থাকলেও ক্ষতি নেই। এক পয়সাও ইনভেস্ট না করে লাখ টাকার পাবলিসিটি পাওয়া যায়। অফিসিয়াল হতে পারলে তখন যা বলবেন কাগজে বড়—বড় করে ছাপা হয়ে যাবে, লোকের কাছে পরিচিতি পেয়ে যাবেন। ক্লাব ভাঙিয়ে কানেকশান বাড়ানো যাবে, তাই দিয়ে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে অনেক কর্তার দুনম্বরি কারবার চলছে বলেও কাগজে পড়েছি। এইসব প্রচারলোভী, ময়দানে না এলে লোকে যাদের কোনওদিনই চিনত না, এইসব ক্ষমতালোভী, যারা ফুটবলকে ভালবাসে না, সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমের কোনও দাম যাদের কাছে নেই, তারা মনে করে যেহেতু তাদের টাকা আছে তাই ময়দানটাকে ইচ্ছে করলেই কিনে নিতে পারে, ফুটবলারদের যারা কুকুর—বেড়ালের মতো মনে করে, তাদের মুখের সামনে টাকার থলি ধরে তু তু করে টেন্টে নিয়ে আসে। এই টাকার লোভই আমাদের ফুটবলের সর্বনাশ করেছে।”

নিলু গড়গড়ি হঠাৎ থামলেন। অনর্গল বাক্যস্রোতে শ্রোতারা ভেসে যাচ্ছিল। তাদের পাড়ে ভিড়িয়ে দিতেই বোধ হয় তিনি বক্তৃতা বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে সমীরণের দিকে তাকালেন। শ্রোতারাও তাকাল। সমীরণ বিব্রত বোধ করল।

”সমীরণ আমার ছেলের বয়সি। এখনকার ফুটবলারদের সম্পর্কে কিছু বললে সেটা নিশ্চয় ওর গায়ে লাগবে তাই আগেই মার্জনা চেয়ে রাখছি। কুকুর—বেড়াল পর্যায়ে আজকের ফুটবলারদের নেমে আসার জন্য কিন্তু তারা নিজেরাই দায়ী। এরা বলে ক্লাব গুরুত্ব দিচ্ছে, মর্যাদা দিচ্ছে, তাই রয়ে গেলাম বা গুরুত্ব—মর্যাদা দিচ্ছে না বলে ক্লাব ছাড়লাম, কিন্তু লক্ষ লক্ষ ফুটবলপ্রেমী মানুষ কাগজে যা এদের সম্পর্কে পড়ছে তাতে তো মনে হয় এক মিলিগ্রাম মর্যাদাবোধও এদের নেই। দলবদলের সময় তো এসে গেছে, আর চার—পাঁচদিন পরই সই করা শুরু হবে। কাগজেই আপনারা পড়ছেন কত নাটক হচ্ছে, ফুটবলাররা ডায়লগ ঝাড়ছে। কিন্তু সইটা করার আগে কত রকম ডিগবাজি যে খাবে, শুধু সেটাই এখন লক্ষ করার।”

ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল সমীরণের কান। মাথাটা একটু নিচু হয়ে গেল। নিলু গড়গড়ির কথার মধ্যে এখনও সে অন্যায্য কোনও বস্তু পায়নি। কিন্তু তার সামনে এসব কথা তোলা কেন? সে নিজে তো কখনও মর্যাদা হারাবার মতো কোনও কাজ করেনি! শুধু পাঁচ বছর আগে যখন সে প্রথম ময়দানে খেলতে নেমেছিল, যখন অনভিজ্ঞ কাঁচা ছিল তখন লাল কার্ড দেখেছিল রেফারিকে অপমান করে। পরের বছর ছোট ক্লাব থেকে বড় ক্লাবে, যা সব তরুণ ফুটবলারই চেষ্টা করে। তার পরের বছর অন্য ক্লাবে গেছে বেশি টাকার অফার পেয়ে। এতে অন্যায়টা কী? এ তো তার উন্নতিরই স্বীকৃতি।

কিন্তু তারপর তো সে আর ক্লাব বদলায়নি। টাকাকড়ি নিয়ে দরাদরি, প্যাঁচ কষে দর বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কাগজে আজেবাজে কথা বলা, গ্রুপবাজি করা এসব তো সে কখনও করেনি। ইন্ডিয়া ক্যাম্প থেকে বাংলার অনেকে ছাঁটাই হয়েছে নোভাচেকের কঠিন মাপকাঠিতে অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায়। সে কিন্তু রয়ে গেছে। তাই নয়, দেশের ক্যাপ্টেনও হতে চলেছে। তার পক্ষে মর্যাদাহানিকর কাজ করা সম্ভবই নয়।

”এরাই সব মর্যাদাবান ব্যক্তি”, এই বলে নিলু গড়গড়ি শ্লেষ মাখানো কণ্ঠে একের পর এক উদাহরণ দিয়ে গেলেন, কোন ফুটবলার মাঠের মধ্যে রেফারির গায়ে থুথু দিয়েছে, রেফারির কান ধরেছে, রেফারিকে লাথি কিল চড় মেরেছে। কোন ফুটবলার এটাই আমার শেষ বছর, তারপর রিটায়ার করবে বলেও পরের বছর বলল ক্লাবের জনতা চাইছে তাই অবসর নেব না। কোন ফুটবলার খেলার কয়েক ঘণ্টা আগে বলেছে বাকি টাকা হাতে না পেলে পায়ে বল ছোঁবে না। গড়গড়ি বলে যাচ্ছেন আর সমীরণ আড়চোখে লক্ষ করল নানান বয়সি শ্রোতা, হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা টপাটপ মুখে ফেলে চিবোবার মতো বক্তৃতাটা পরমানন্দে চিবোচ্ছে, চোখেমুখে গড়াচ্ছে মজা পাওয়ার রস।

বক্তৃতা শেষ হলে প্রচুর হাততালি পেয়ে চেয়ারে বসে গড়গড়ি পাশে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ”তুমি হয়তো অন্যদের মতো নও, কিন্তু পাপের ভাগ তোমাকে তো নিতেই হবে।”

জবাবে সমীরণ শুকনো হাসি ছাড়া আর কিছু দিতে পারল না, নিলু গড়গড়ি তা লক্ষ করলেন।

”এমন একটা সময় শিগগিরই আসবে যখন গাল দিতে গাধা—গোরু বলা হবে না, বলা হবে ফুটবলার। এক সময় ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল খেলেছি, একথা ভাবলে এখন আমি কষ্ট পাই। হয়তো তুমিও পাবে।” গড়গড়ি আলতোভাবে সমীরণের বাহু স্পর্শ করলেন, যেন আগাম সমবেদনা জানিয়ে।

সমীরণ কাপ, শিল্ড এবং অন্য প্রাইজগুলো হাতে হাতে তুলে দিল। দেওয়ার সময় সবার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে হাসলও, কিন্তু কিছুই তার মনে ছাপ রাখছে না। সে কিছুই দেখছে না, কিছুই শুনছে না। তার ভেতরে কোথায় যেন একটা শর্ট সার্কিট ঘটে গিয়ে ইন্দ্রিয় নামক ডায়নামোটাকে বিগড়ে দিয়েছে।

”সমীরণদা, আপনি কিছু বলুন, অন্তত দুটো কথা। ছোট ছোট ছেলেরা আপনার মুখ থেকে দুটো কথা শোনার জন্য খুব আশা করে আছে।”

ক্লান্ত দৃষ্টিতে সমীরণ সামনের ভিড়ের দিকে তাকাল। যা বলব এরা কি বিশ্বাস করবে? নিলু গড়গড়ির কথাগুলো কানে নেওয়ার পর এদের শোনাবার মতো কোনও কথাই সে খুঁজে পাচ্ছে না।

”সমীরণদা…”

সে মাইকের সামনে উঠে এল। কোনও ভনিতা না করেই শুরু করল, ”গড়গড়িদা আমার পিতৃতুল্য, তাঁর বক্তব্য আমি মাথা পেতে গ্রহণ করলাম। আমাদের দু’জনের খেলার সময়ের মধ্যে অন্তত চল্লিশ বছরের ফারাক, এর মধ্যে ময়দানে প্রচুর পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেটা ভালর না মন্দের দিকে গেছে তা ভবিষ্যৎকালই বিচার করবে। যদি মন্দের দিকে গিয়ে থাকে তা হলে আমাদের জ্যেষ্ঠরা তা যেতে দিলেন কেন? দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে তাঁরা বাধা দিতে পারতেন।

”খারাপ লোকেরা এখন ক্লাব চালাতে আসছেন, কিন্তু তাঁরা ক্লাবের কর্তা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন কী করে? আমাদের ফুটবল সেট—আপটা কারা গড়েছেন? নিশ্চয়ই এখনকার ফুটবলাররা নয়। আমরা পেশাদারের মতো টাকা নিই, কিন্তু ফাঁকি মারি এই সেট—আপের গলদের সুযোগ নিয়ে। ফুটবলকে মেরে ফেলা ফুটবলারদের একার ক্ষমতায় সম্ভব নয়, কলকাতার ফুটবলে মৃত্যুর বীজাণু বহুকাল আগেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর সেটা করেছেন আমাদের পূর্বসূরিরা। হ্যাঁ, ফুটবলকে মমি করে রাখতে চাওয়া হচ্ছে কিন্তু সেই কাজটা তো বয়স্ক লোকেরাই করছেন।” সমীরণ লক্ষ করল ভিড়ের নজর মাঝে মাঝেই নিলু গড়গড়ির দিকে সরে যাচ্ছে। সেই নজরে মজার ঝিলিক নেই।

”টাকার প্রতি লোভ নেই, টাকার প্রয়োজন নেই এমন কেউ যদি এখানে থাকেন, অনুগ্রহ করে এগিয়ে আসবেন কি?”

সমীরণ কথা বন্ধ করল। ভিড় থেকে একটা গুঞ্জন উঠেই নীরবতা নেমে এল। সে ধীরে ধীরে মাথাটাকে দু’বার ঘুরিয়ে দুপাশে তাকাল। অর্থবহ একট নৈঃশব্দ্য তৈরি হল।

”এখনকার ফুটবলাররা আপনাদের মতো ঘরেরই ছেলে। তাদেরও টাকার প্রয়োজন আছে। আপনাদের নমস্কার জানিয়ে আমার নিবেদন শেষ করলাম।”

সমীরণ চেয়ারে ফিরে না গিয়ে মঞ্চের সিঁড়ির দিকে এগোল। ছোট ছোট ছেলেদের জন্য কোনও কথাই বলা হল না। এজন্য মনটা ভার লাগছে বটে আবার কিছুটা হালকাও বোধ করল নিলু গড়গড়ির থমথমে মুখটা দেখে।

”তুই পরশুই আমার রিহার্সালে হাজির হবি।” উচ্ছ্বসিত বাসব ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। ”দাঁড়িয়ে শুনছিলাম তোর বক্তৃতা। কী গলা, কী ডেলিভারি, কী ড্রামাটিক পঅজ,কী পিচ কন্ট্রোল, কী…” বাসবের দমবন্ধ হয়ে এল।

”তাড়াতাড়ি চল, সুটকেসটা নিয়েই বাড়ি রওনা হব, অনেক কাজ আছে।” সমীরণ জোরে পা চালাল।

”সমীরণদা একটু বসবেন না, একটু মিষ্টি…”

”না, না, মিষ্টি আমি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’

”সমীরণদা, আপনার জন্য রিকশা…”

”দরকার নেই, হেঁটেই…”

”সমীরণদা, মালাটা অন্তত নিয়ে যান।”

”ওটা গড়গড়িদাকে দিয়ো।”

।। ৪ ।।

রাত্রের খাওয়া শেষ করে টেবিলেই ওরা গল্প শুরু করেছিল। প্রায় রাতেই ওরা চারজন কিছুক্ষণ বসে সারাদিনের ভালমন্দ অভিজ্ঞতার বা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলে থাকে। আজ ঘুনু মিত্তির এবং নিলু গড়গড়ি প্রসঙ্গ ওঠে।

”ফুটবলারদের গাধা—গোরু বলল! তার মানে, নাকু তুই…” রেখা গুপ্তর অসহ্য বিস্ময় আরপ্রচণ্ড রাগ মিশে গিয়ে তাঁকে বাক্য শেষ করার সুযোগ দিল না।

সুযোগ নিল শ্যামলা। ”একটা গাধা—গোরু। সমীরণ গুপ্ত, নামের পাশে টাইটেল গা গো।” তারপর সমীরণের কানে কানে বলল, ”যেমন তুই বেগার শব্দটা তৈরি করেছিস।”

”ঠাট্টা নয় মলা, ঠাট্টা নয়।” হিমাদ্রির মুখ সিরিয়াস হয়ে উঠল। ”দাদা তো আর বাংলা কাগজগুলো বাঙ্গালোরে পড়ার সুযোগ পায়নি, পেলে বুঝতে পারত স্টার ফুটবলাররা এক—একটা সত্যিই গা গো। এই তো সারথির রণেন পাল আর দেবী মাইতিকে যাত্রীর পতু ঘোষ দু’লাখ আশি হাজার দর দিয়েছিল। ওরা বলে বটা বিশ্বাসের সঙ্গে কথা না বলে কিছু করবে না। ওরা এসে বটাকে বলল যাত্রী এই টাকা দেবে, আপনি দর না বাড়ালে যাত্রীতে চলে যাব। বটা তখন দুজনকে দু’লাখ ষাট করে দেবে বলল। আর দু’জনের গতবারের বকেয়া ছিল পঁচিশ হাজার করে, সেটাও মিটিয়ে দেবে বলল। ওরা মেনে নিয়ে অ্যাডভান্স নিল। তারপর কী করল জানো? দু’জনেই পতু ঘোষের কাছে গিয়ে বলল, আমাদের যদি তিন লাখ করে দেন তা হলে সারথির অ্যাডভান্স ফিরিয়ে দেব।”

”এইসব কথা কাগজে বেরিয়েছে, না কি তুই বানিয়ে বানিয়ে বলছিস কানু!” রেখা গুপ্ত অবাক হয়ে বললেন।

”পিসি, কাগজগুলো এখনও ঘরে রয়েছে তোমাকে সব দেখাতে পারি, লাইন—বাই—লাইন সত্যি। কিন্তু তোমাকে দেখাব না।”

”কেন?”

”তা হলে তুমি দাদাকে আর ফুটবল খেলতে দেবে না।”

”কেন দেব না? পরিশ্রম করে খেলা শিখেছে, বছরে এত গাদা গাদা ম্যাচ খেলছে রক্ত জল করে, সেজন্য টাকাকড়ি নেবে না? নিশ্চয় নেবে। মজুরি বাড়াও, মাইনে বাড়াও করে শ্লোগান দেবে, মিছিল করবে কুলিমজুর, কেরানিরা, তার বেলা দোষ হয় না, আর ফুটবলাররা দুটো টাকা বাড়াতে চাইলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল! নাকু এবার যারা বেশি টাকা দেবে তুই সেখানেই খেলবি।”

সমীরণ হাসল। মাথা নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মন্থর ভারী গলায় বলল, ”নিলু গড়গড়ির কথাগুলোর মধ্যে অনেক সত্যি জিনিস আছে পিসি। ফুটবলাররা নিজেদের মর্যাদা নিজেরাই খুইয়েছে নানানভাবে। দর বাড়াবার জন্য এই যে একবার পতু একবার বটা আবার পতু, এতে কয়েক হাজার টাকা হয়তো বাড়ানো যাবে কিন্তু ক্লাবের সমর্থকরা কি এদের মানুষ হিসাবে উঁচুতে স্থান দেবে না কি ওরা নিজেরাই নিজেদের সৎ মানুষ ভাববে? ভেবে দ্যাখো পিসি, দেশে এখন অন্যান্য খেলার সঙ্গে তুলনায় ফুটবলের স্থান কোথায়? শুধু বাংলাতেই ফুটবল নিয়ে নাচানাচি হয়। এখানে রাস্তায় হাঁটলে বহু মানুষই তাকায়, ছেলেরা অটোগ্রাফ চায়। কাজকর্ম, দরকার নিয়ে কোথাও গেলে আগে সেটা করে দেয়। কিন্তু বাংলার বাইরে ফুটবলারদের এখন আর কোনও খাতির নেই কেননা ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে আমাদের কোনও পারফরমেন্সই নেই। আছে ক্রিকেটের, ওরা বিশ্বকাপও জিতেছে। তাই ক্রিকেটারদের পেছনে সবাই ছোটে। আমি নিজে বড় বড় শহরে, কেরল বাদে সব জায়গায়, এটা লক্ষ করেছি। কেন এমন হবে?” সমীরণ তার মর্মবেদনা কণ্ঠস্বরে প্রকাশ করল।

”কিন্তু সেজন্য ফুটবলাররা দায়ী হবে কেন?” হিমাদ্রি তর্ক চালাবার একটা রাস্তা পেয়ে যুক্তির সাইকেলে উঠে পড়ল। ”ভারত ইন্টারন্যাশনাল পর্যায়ে খেলতেই যায় না, না গেলে ফুটবলাররা তৈরি হবে কী করে? ক্রিকেটে যেসব লোক বোর্ডে যায় তারা বেটার ক্লাস অব পিপল, আর ফুটবলে পতু, বটা, ঘুনু এই তো সব নাম! নামেই বোঝা যায় কী ক্লাসের লোক!” হিমাদ্রি ঠোঁট বাঁকাল।

”কানু, তুই ভুলে যাচ্ছিস, বিরাশির এশিয়ান গেমস দিল্লিতে হয়েছিল। তাইতে আমাদের ফুটবল টিম তৈরি করার জন্য বহুবার বাইরে খেলতে দল পাঠানো হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্টে। তখনই আমাদের দেশে নেহরু কাপও শুরু হয়। ভারত এই কাপে এখন পর্যন্ত চৌত্রিশটা ম্যাচ খেলে জিতেছে মাত্র একটা। ইডেনে যুগোশ্লাভিয়াকে হারিয়েছিল সেই বিরাশিতে। গোল দিয়েছে মোট সতেরোটা, খেয়েছে চৌষট্টিটা। নিজের দেশের মাটিতে এত বছর ধরে ইন্টারন্যাশনাল খেলছি, দেশের লোকের সামনে। এতে আলাদা বাড়তি একটা প্রেরণাও প্লেয়ারদের পাওয়ার কথা। দেশের সম্মান দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্য, বাড়াবার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়াই তখন একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে।”

সমীরণ কথা থামিয়ে তিনজনের মুখের দিকে তাকাল। পিসি ও মলা গম্ভীর হয়ে গেছে। কানুর সাইকেলের চাকা থেকে হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে।

”প্রত্যেকবারই ভারত সবার শেষে। ক্যাম্পে নোভাচেক একদিন বলল, স্যাম, আমাকে সমীরণ বলে না, তোমাদের দেশে কি ফুটবল খেলা হয়? কেমন ফুটবল খেলা হয়? হেলথ নেই, স্পিড, স্ট্রেংথ, স্ট্যামিনা নেই। কিন্তু বেসিক স্কিলগুলো? এখনও পাস ধরতে পারে না, শুটিং পাওয়ার জিরো, কারেক্ট বল দিতে জানে না, এয়ারে ভেরি পুওর, কখন কোথায় থাকতে হবে সেই জ্ঞানটাও নেই। তোমাদের স্কুল লেভেলে কিছুই শেখবার ব্যবস্থা নেই। অজ্ঞ আনস্কিলড, খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি বয়সে ক্লাব ফুটবলে আসে। সেখানেও কিছু উন্নতির সুযোগ পায় না। খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে সারা বছরই অবিরাম খেলে খেলে এত ক্লান্ত হয়ে থাকে যে, স্কিল বাড়াবার জন্য খাটার ইচ্ছে আর থাকে না। তারপর ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে ওরা যখন আসে, আর তখন কী ফুটবল যে খেলে, সেটা তো খেলার ফলই বলে দিচ্ছে।

”শুনতে শুনতে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। তারপর রাগও হয়।” সমীরণ হঠাৎ সোজা হয়ে বসে রাগী দাঁতচাপা স্বরে বলল, ”ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করে দিই কলকাতার ফুটবলকে। শুধু ট্রফি জেতা, লিগ জেতা ছাড়া আর কিছু এরা ভাবে না। সারা পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, এমনকী পাশের এই বাংলাদেশও আমাদের ফেলে এগিয়ে গেছে আর আমরা এখানে ট্যাকটিকস আর স্ট্র্যাটেজি ভেঁজে বড় বড় বুলি কপচাচিছ। বাইরে থেকে প্লেয়ার ধরতে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে এই দুটো ক্লাব। ভাবতে পারো বিনু জন, আলবুকার্ক, কার্নাইল এরা কিনা প্লেয়ারের জাত? অথচ এরাই এখন ময়দানের আরাধ্য দেবতা। এদের আনার চেষ্টা হচেছ আমাকে কোণঠাসা করার জন্য।”

”সে কী রে!” পিসি আঁতকে উঠলেন। ”কোণঠাসা তো ওরাই হবে তোর কাছে।”

”তোকে কি সারথির আর দরকার নেই?” হিমাদ্রি ভ্রূ তুলে জানতে চাইল। ”তোকে যাত্রীতে যাওয়ার সুযোগ দিলে ইলেকশনে বটার কী অবস্থা হবে?”

”কথাটা দরকার বা অদরকারের নয়, টাকা দিয়ে আমায় অবশ্যই ধরে রাখবে। বটা বিশ্বাস যতই আমায় অপছন্দ করুক, সে জানে আমি যা সার্ভিস ক্লাবকে দেব, আর কেউ সারা বছর ধরে তা দিতে পারবে না। এটা সারথির জনতাও জানে। কিন্তু বটা বিশ্বাস ওর নিজের ক্লাবের কয়েকটা প্লেয়ার দিয়ে মাঠে আমায় সারা বছর খাস্তা করার চেষ্টা করবেই। ম্যাচ গড়বড় হলেই ওর পোষা ছেলেরা টেন্টে ইট ছুড়ে আগুন ধরিয়ে ঝামেলা পাকাবে আর দোষটা আমার ঘাড়ে ফেলবে। অবশ্য ওর গোষ্ঠীতে যদি ভিড়ি তা হলে কিছুই হবে না।”

”তুই তো বাঙ্গালোর চলে যাবি, তোকে তো তা হলে আর খেলতে হচ্ছে না।” শ্যামলা বলল, ঝামেলা এড়াবার একটা রাস্তা বাতলে।

”আরে, চলে যাওয়াটা কি চিরকালের জন্য? ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেবে, তখন এসে খেলব। আবার ডাকবে, চলে যাব। আমাকে বাইশ তারিখের মধ্যে কোঝিকোড় পৌঁছতেই হবে। নাগজির খেলা শেষ হলে নোভাচেক যদি মনে করে তা হলে ধরে রাখতে পারে একসঙ্গে ট্রেনিংয়ের জন্য। আবার লিগে খেলার জন্য ছেড়েও দিতে পারে। সবই ওর ইচ্ছের ওপর।”

”তোকে তো সারথি কন্ট্র্যাক্ট করতে বলবে।” হিমাদ্রি জানতে চাইল না, একটা স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা যেন বিবৃত করল। ”যাত্রীও তোকে চাইছে, বেশি টাকা দেবে বলেছে। দু’পক্ষের দরটা আগে শুনে নে।”

”দরটর শুনে কাজ নেই। নাকু, তুই আগে ভাল করে খেলাটা তৈরি কর। ওই চেক সাহেবের কাছ থেকে যত্ন করে সব শিখে নে। সম্মান বাড়া দেশের, দেখবি তাতে তোরও সম্মান বাড়বে।” পিসির কথাগুলো দৃঢ়স্বরে বলা এবং তাইতে বাকি তিনজন অস্বস্তিতে পড়ল।

”পিসি, দাদা তো দেশের সম্মান নিয়ে ভাবছেই, কিন্তু টাকাটাই বা ছাড়বে কেন?” শ্যামলা বাস্তবের কাছাকাছি পিসিকে ধরে রাখার চেষ্টা করল। ”এই তো একটু আগে বললে, রক্তজল করে খেলে সেজন্য টাকাকড়ি নিশ্চয় নেবে, যারাই বেশি টাকা দেবে…”

”মলা তুই ভুল করছিস।” হিমাদ্রি থামিয়ে দিল। ”পিসি বলতে চায় টাকা তো নেবেই কিন্তু দেশের মর্যাদাও বাড়াতে হবে, তাই তো?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই—ই”, পিসি সমাধানটা পেয়ে গিয়ে হাঁপ ছাড়লেন। আর ঠিক তখনই বাড়ির সামনে মোটরগাড়ির দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো শব্দ ভেসে এল।

”এখন আবার কে!” সমীরণ ওয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ”এই সাড়ে দশটায়!”

হিমাদ্রি জানলার কাছে উঠে গেল। শ্যামলা ফটকের আলোটা জ্বেলে দিল।

সবুজ মারুতির দরজা খুলে নামছে ঘুনু মিত্তির। রাস্তায় পা রেখেই বাড়ির জানলার দিকে ইশারা করে আলো নিভিয়ে দিতে বলল।

”ঘুনুটা আবার এসেছে, মলা আলো নিভিয়ে দে।’ হিমাদ্রি রিলে করল জানলা থেকে। দরজা খুলতে খুলতে সে বলল, ”এত রাতে যে, কী ব্যাপার?”

”এত রাত আর কোথায়, মাত্র তো সাড়ে দশ। কলকাতায় এখনও ট্রাম—বাস চলছে, খাবারের দোকান খোলা রয়েছে। তোমাদের অবশ্য একটু বেশি রাতই। যারা ফুটবলার ক্যাচ করে বেড়ায় তাদের কাছে দুপুর একটা রাত একটা সমানই ব্যাপার।” ঘুনু সমীরণকে দেখে খুবই হৃষ্টমনে ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে পড়ল। ”হুঁ হুঁ বাবা, একটু রাত না করলে কি বাড়িতে যাওয়া যায়?”

”আর একটু দেরি করলে দাদাকে আর পেতেন না।’ হিমাদ্রি গম্ভীর গলায় বলল। ঘুনু চমকে উঠলেন, ”কেন, কেন?”

”সারথির লোক দু’বার এসে খোঁজ করে গেছে। হয়তো রাতেও আসবে। তাই দাদা রাতে বাড়িতে থাকবে না।” হিমাদ্রির থেকেও শ্যামলা আর একটু গম্ভীর গলায় বলল।

”সারথির লোক!” ঘুনু বিরক্তি, ভয়, উদ্বেগ মিশিয়ে তাকালেন। ”বঙ্কু? নির্মল? নাম বলেছে?”

”বলেনি। এইভাবে যখন—তখন ঘনঘন ডিস্টার্বেন্স হলে…আমার পার্টওয়ান পরীক্ষার আর দু’ মাসও বাকি নেই—” শ্যামলা ঈষৎ অনুযোগ কণ্ঠে এবং চাহনিতে ফুটিয়ে তুলল।

”ঠিক, ঠিক, ডিস্টার্বড মাইন্ডে পড়াশোনা, পরীক্ষার প্রিপারেশন হয় না, ফুটবল তো খেলাই যায় না। নাকু, গুছিয়ে নে। দুটো শার্ট, একটা প্যান্ট, একটা পাজামা হলেই হবে।”

”দুটো শার্ট, দুটো প্যান্ট গুছিয়ে নে, তার মানে?”

সমীরণের আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। এমনটি তার আজই হয়েছিল যখন বাসবের গলিতে ওরা তিনজন আচমকা ছুটে এসে তাকে ধরেছিল।

”মানে হল, পতুর বাড়িতে এখনই তোকে নিয়ে যাব।”

”নিয়ে যাবে মানে?”

”ওখানে থাকবি, ওখান থেকে সই করতে যাবি, সই করেই সোজা দমদমে গিয়ে প্লেনে উঠবি। কোথাকার টিকিট কাটব বল? মাদ্রাজ, বাঙ্গালোর, না হায়দরাবাদের? মাদ্রাজেরই কেটে রাখি, ওখান থেকে সাউথের সব ফ্লাইটগুলোই পাবি।”

”থামুন, থামুন।” সমীরণ দু’হাত তুলল। ”পতুদার বাড়িতে আমি যাব কেন?”

কথাটা শুনে ঘুনু অবাক হয়ে পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ”কেন কী রে? দু’বার যে ঘুরে গেছে। এরপর কি তোকে আর ছেড়ে রাখা যায়!”

”নাকুকে ধরে রাখবেন?” পিসির নির্বিকারত্ব এতক্ষণে ঘুচল। কথার মধ্যে প্রবেশ করলেন সন্দেহ—কুটিল চোখ নিয়ে।

”নিশ্চয়।”

”আমি বেঁচে থাকতে!” চাপা গর্জন আর পিসির উঠে দাঁড়ানো দেখে ঘুনু চেয়ারে তাঁর অবস্থান পালটে ইঞ্চিখানেক পিছোলেন। বাঁ হাতটা আপনা থেকেই বুশ শার্টের কলারের কাছে উঠে গেল।

”কেন? কী করেছে ও? যেখানে খুশি ও খেলবে, যার সঙ্গে খুশি ও যাবে। ও কি গাধা—গোরু যে, দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবেন?”

”আহাহা আপনি এত চটছেন কেন, নাকুর তো দুটোই পা, ও কেন গাধা—গোরু হতে যাবে? আমরা ওই পা দুটোই চাইছি। অন্য কেউ এসে ওর পা ধরে যাতে টান না মারে সেজন্যই ওকে পতুর বাড়িতে সরাতে চাচ্ছি। আপনি অল্পেই রণচণ্ডী মূর্তি ধরেন। আজ সকালে আমার…” ঘুনু গলায় হাত বোলাতে শুরু করলেন। রেখা গুপ্ত অপ্রতিভ হয়ে আড়চোখে তিনজনের মুখ লক্ষ করে বুঝলেন সকালের কাজটা নিয়ে এরা বহুদিন তাঁর পেছনে লাগবে।

”ঘুনুদা, আপনি কি আমায় বাচ্চচা ছেলে ভেবেছেন? কেউ ধরে নিয়ে যাবে বললেই কি অমনই ধরা দিয়ে দেব। তা ছাড়া, আমি যাত্রীতে খেলব এ ধারণাটাই বা আপনাদের হল কী করে?” সমীরণ বিরক্তি লুকোবার চেষ্টা করল না।

”তোর জায়গায় তিনটে প্লেয়ার আনছে, সেটা তো জানিস? আমাদের বুকুকেও টোপ দিয়েছে। সারথি এখন ডেসপ্যারেট একটা—দুটো স্ট্রাইকার পাওয়ার জন্য। নইলে গত তিন বছর একটাও বড় ম্যাচে গোল করতে না পারা বুকুকে কিনা দু’লাখ অফার দেয়?” ঘুনু তাজ্জব বনেছেন বোঝাতে চোখ পিটপিট করলেন।

”তা হলে বুকু চলে যাক সারথিতে।” সমীরণ আলস্য ভাঙার জন্য দু’হাত তুলে দেহে মোচড় দিল। ”দু’লাখ পেলে যাওয়া উচিত।”

”পাগল হয়েছিস। সারথিতে গিয়েই যাত্রীকে গোল দেবে। ওকে যেতে দেওয়া চলবে না, দুই—পঁচিশে ও রাজি হয়েছে। আজকেই ওকে পতুর বাড়িতে জিম্মে করে দিয়ে এলাম। তুইও এবার চল।”

”বুকু অর্থাৎ কিশলয় দত্তকে দুই—পঁচিশ, যে গত তিন বছর ধরে বড় ম্যাচে গোল করতে পারেনি। আর সমীরণ গুপ্তকে এক লাখ ষাট হাজার! বাহ!” হিমাদ্রি দাদার হয়ে দরাদরির প্রথম ধাপে পা রাখল। ”আর দুলাল চক্রবর্তীর মতো বানপ্রস্থের সময় হওয়াকে কত অফার দিয়েছেন?”

ঘুনু মেজাজ হারালেন না। খোঁচাটাকে সরল হাসি দিয়ে ভোঁতা করে বললেন, ”মানছি দুলালের বানপ্রস্থের সময় হয়ে গেছে এখন ও পঁয়ত্রিশ মিনিটের প্লেয়ার। কিন্তু বড় ম্যাচে এখনও ওর জায়গায় খেলবার মতো লোক এদেশে নেই। এজন্যই ওকে নিতে হবে। বলেছি তো, ছেঁকে তুলে নেব এবার, টাকাপয়সা নিয়ে কোনও কার্পণ্য যাত্রী করবে না। তা হলে নাকু?” ঘুনু চেয়ার থেকে ওঠার মতো ভাব দেখালেন।

”তা হলে কী?” সমীরণ পা দুটো ছড়িয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে জানিয়ে দিল, সে ব্যস্ত নয়।

”মামণির পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, সামনেই পার্ট ওয়ান। পতুর গাড়ি নিয়েই এসেছি। ব্যাগে শার্ট—প্যান্টটা ভরে এবার বেরিয়ে পড়, পাজামা নিতে ভুলিসনি।” অত্যন্ত নিশ্চিন্তে কথাটা বলে, কী যেন ভাবতে ভাবতে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘুনু, নস্যির নতুন ডিবেটা বের করে ঢাকনায় কয়েকটা চাঁটি দিলেন। রেখা গুপ্তর চোখ নিবদ্ধ হল ডিবেটায়। শ্যামলা হাত দিয়ে মুখ চাপল। হিমাদ্রি হঠাৎ বিষম খেয়ে বেসিনের দিকে ছুটে গেল।

সমীরণ এসব লক্ষ করেনি। কারণ চোখ বন্ধ করে সে তখন ভাবছিল। ”ঘুনুদা, আমি যাত্রীতে যাব না।”

নীল আকাশ থেকে ঘুনুর মাথায় বাজ পড়লেও এত অবাক তাঁকে দেখাত না। ”যাবি না! আমি যে পতুকে দিব্যি গেলে বলে এসেছি, তোকে নিয়ে যাবই! আমার মাথাকাটা যাবে, লজ্জা রাখবার জায়গা থাকবে না…”

”থাক ঘুনুদা, এসব কথা বলে লাভ নেই। আমার সঙ্গে কথা না বলেই দিব্যি গেলে ফেলেছেন?” সমীরণ কঠিন গলায় ইঙ্গিত দিল বাজে কথা সে শুনতে চায় না।

”দাদাকে কি গা—গো ভেবেছেন?” শ্যামলা ফুট কাটল।

”গা—গো!” ঘুনু ঘাবড়ে গেলেন, ”তার মানে?”

”ও কিছু নয়।” সমীরণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল। ”মলার মাথায় পোকা আছে, সেগুলো মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে।”

”আহহ।” নিশ্চিত বোধ করে ঘুনু নস্যির ডিবের ঢাকনাটা খুলে আঙুল ঢোকালেন। তাই দেখে রেখা গুপ্ত কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, শ্যামলা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাঁকে চুপ থাকতে ইশারা করল।

”দ্যাখ নাকু এক—ষাটটা হল চুক্তি, আর গুঁড়ো পঞ্চাশ হাজার। তা হলে দু’লাখ দশ হাজার। গত দু’বছর ধরে তোর পেছনে লেগে রয়েছি, এবার আর…” টেবিলে হুমড়ি খেয়ে ঘুনু আঙুলের টিপে নস্যি সহ সমীরণের দিকে দু’হাত বাড়ালেন। ”সীতেশের গ্রুপের ছেলে বুকু । ওকে প্রোটেক্ট করার জন্য সীতেশই দু’বছর ধরে তোকে যাত্রীতে আনার ব্যাগড়া দিয়ে গেছে। এ—বছর পতু এসে ওকে কোণঠাসা করে দিয়েছে, তবে বুকুকেও পতু রাখতে চায়। তুই প্রথম দুটো ম্যাচে গোল কর, বুকু ফুকু ফুটে যাবে, সীতেশরাও ভেসে যাবে।”

”যাকে ফোটাতে চান, তার থেকে দাদা পনেরো হাজার কম নেবে কেন?” হিমাদ্রি জেরা করার ভঙ্গিতে বলল। ”সাতটা গোল তিন বছরে, এক—একটার দাম কত হবে বলে মনে হয়!”

ঘুনু তাকালেন সমীরণের দিকে। ভাইয়ের প্রশ্নটা দাদার চোখেও। হতাশভাবে ঘাড় নেড়ে ঘুনু নস্যিটা নাকে ঢুকিয়ে হাত ঝাড়তে গিয়েই মুখ ফ্যাকাশে করে ফেললেন। পর্যায়ক্রমে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হেসে বললেন, ”দ্যাখো, কী ভুলো মন যে আমার। আবার আমি নস্যি নিতে শুরু করেছি। এটা যে আজই ত্যাগ করেছি সেটা আর মনেই নেই!”

”এই ডিবেটাও কি জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন?” খুব সাধারণ স্বরে শ্যামলা জানতে চাইল।

”নাহ।” ঘুনু মাথা নাড়ালেন। ”ফেলব না। থাক। বেইজ্জত হতে আর বাকি রইল না। তোমরা সবাই আমাকে ধাপ্পাবাজ, ভণ্ড, অ্যাক্টর বলে নিশ্চয় ধরে নিয়েছ। বোধ হয় আমি তাই। ক্লাব করে করে সোজাভাবে চলাটাই ভুলে গেছি।”

করুণ হয়ে উঠেছে ঘুনুর মুখ, কিন্তু ঝট করে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে সরল হাসি ছড়িয়ে বলে উঠলেন, ”যাকগে এসব, বরং তুই পতুর সঙ্গে একবার নিজেই মুখোমুখি কথা বল। এক একটা গোলের দাম কত সেটা ওই ধার্য করবে’খন। মনে হচ্ছে আজ আর তোকে নিয়ে যেতে পারব না, তা হলে কালকে চল।”

”আপনি আমাকে পতুদার ফোন নাম্বারটা দিন, কবে যাব সেটা ফোন করে জানিয়ে দেব।” সমীরণ আন্তরিক ভাবে বলল।

ঘুনুদাকে এগিয়ে দিতে ওরা সবাই বাইরের বারান্দায় এল। হঠাৎ তিনি রেখা গুপ্তর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ”মুন্নার বাড়িতে গেছলেন কি?”

”অ্যাঁ, মুন—না! কে—?” রেখা গুপ্ত থতমত হয়ে আমতা আমতা করছেন, ততক্ষণে ঘুনু মিত্তির মারুতির দরজায় হাত রেখেছেন।

”আহ, পিসি, তুমি মাটি করলে। মুন্না কে তা ভুলে গেলে এর মধ্যে?” চাপা ঝাঁঝ শ্যামলার গলায় এবং সেটা অপ্রতিভতার লজ্জা সহ।

”লাস্ট সেকেন্ডে পেছন থেকে এসে গোল করে দিয়ে গেল। নিশ্চয় সারাদিন ওত পেতে ধারে কাছে ছিল।” হিমাদ্রি ঠোঁট কামড়াল।

”নাকু, ভদ্দরলোকের কাছে যে আমি মিথ্যাবাদী হয়ে রইলাম।” রেখা গুপ্ত কাঁদো কাঁদো হয়ে সমীরণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ”কী ভাবছেন উনি আমার সম্পর্কে, মলার সম্পর্কে!”

”কিচ্ছু ভাবছে না, এসব ধড়িবাজ লোককে আমি চিনি। এরা সত্যি মিথ্যের ধার ধারে না।” সমীরণ আশ্বস্ত করার জন্য বলল।

”কিন্তু আমি তো ধরি। আমিও তো ধড়িবাজ হলাম। উহহহ, এবার নরক যন্ত্রণা শুরু হবে। নাকু তুই আমায় উদ্ধার কর…তুই বরং ওর ক্লাবেই এবার যা, তাহলে আমি খানিকটা শান্তি পাব।” বলেই রেখা গুপ্ত দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে খাটে বসে কান ধরে বিড়বিড় শুরু করলেন, ”মিথ্যা বলা মহাপাপ, নরকে গমন…মিথ্যা বলা মহাপাপ…।”

ডাইনিংয়ে তখন হিমাদ্রি বলছে, ”গ্রেট লেডির অর্ডার, অমান্য করলে কিন্তু ভি আই পি রোডে নিশ্চিত নিলডাউন।”

।। ৫ ।।

”কে, সমীরণ নাকি, আমি ধাড়াদা, সুবোধ ধাড়া বলছি।”

টেলিফোন বাজার শব্দে সমীরণের ঘুম ভেঙে গেছল। খাবার দালান থেকে রেখা গুপ্তর ঘরে যাওয়ার সরু গলিটার মধ্যে দেয়ালে আঁটা র‌্যাকে টেলিফোন। সে ভেবেছিল মলা বা কানু ফোন ধরবে। ক্রমাগত বেজে যাওয়ায় বিছানা থেকে তাকে উঠতেই হল। আজ রবিবার বেগিং বন্ধ। পিসি আর মলা তা হলে বাজারে গেছে। কানুও বাড়িতে নেই।

”বলুন।” সমীরণ এক চোখ বুজে ঘড়ি দেখল। সওয়া ছ’টা।

”ঘুম ভাঙালাম নাকি?”

”সারারাত লোডশেডিং, এই সকালের দিকে ঘুমটা এসেছিল।” হাই তোলার শব্দ যে ফোন মারফত পাঠিয়ে দিল।

”এহেহেহে, তা হলে তো অন্যায় হয়ে গেল। তুই তা হলে এখন ঘুমো, আমি বরং পরে ফোন করব।”

”ঘুম আর আসবে না, বলুন, কী বলবেন।” বিরক্তি চেপে অমায়িক গলায় সে বলল।

”বলব আর কী, ক্লাবে যা চলছে। এরা, মানে ঘুনুরা, আর কোচ খুঁজে পেল না, শেষে কিনা অজয় তালুকদারকে! কী যোগ্যতা আছে ওর? কোনওদিন কোনও বড় টিমকে কোচ করল না, দুটো ছোট টিমকে কোচ করে ‘বি’ গ্রুপে তাদের নামিয়ে দেওয়া ছাড়া যার আর কোনও সাকসেস নেই, কোচিংয়ের ডিগ্রি ডিপ্লোমা নেই, ফুটবল সেন্স নেই, ঝালচচ্চচড়ি অম্বল রাঁধার বাইরে আর কিছু সে রাঁধতে জানে না তাকে কিনা ফাইভ স্টার হোটেলের চিফ শ্যেফ করে দিল!… হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস?”

”পাচ্ছি। আপনি বলে যান। কিন্তু এই সক্কালবেলায় এসব কথা আমায় শোনাচ্ছেন কেন? আমি তো যাত্রীর প্লেয়ার নই।”

”ঘুনু তোর বাড়িতে কাল গেছল তোকে তুলে আনতে। পারেনি। আমি জানতুম পারবে না। তোর মতো প্লেয়ারের মানমর্যাদা, ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হতে যাচ্ছিস, এখন যারা কমিটিতে এসেছে তারা কি দিতে পারবে? ভেবেছে টাকা ছড়ালেই সমীরণ গুপ্ত ছুটে আসবে, তা কি কখনও হয়! হাঘরে ছেলেদের মতো টাকার জন্য আজ এ ক্লাব কাল সে ক্লাব, এসব তো তোর পক্ষে সম্ভব নয়। কী ফ্যামিলির ছেলে তুই, আমি তো তা জানি। …হ্যালো, ক’দিন ধরে লাইনটা খারাপ, হ্যালো…”

‘আমি ঠিকই শুনতে পাচ্ছি, বলুন।”

”ঘুনু কেমন লোক তা তো তুই ভালই জানিস। ক্লাস এইট পর্যন্ত তো বিদ্যে, আগে নারান সেনের গাড়ির দরজা খুলে দিত, এখন পতুর গাড়িতে চেপে প্লেয়ার ক্যাচ করে বেড়াচ্ছে। নারানদার আমলে সেক্রেটারির ঘরে না ডাকলে ঘুনু ঢুকতে পারত না। আর এখন ও পতুর চেয়ারেও মাঝে মাঝে বসে। ক্লাবের ডিগনিটি বোধটাই নষ্ট হয়ে গেল এদের জন্য। তোর দশ হাজার টাকা তো আজও পেলি না।”

সমীরণ শুনতে শুনতেই বুঝে গেল সুবোধ ধাড়া তাকে ভাংচি দিতে এইসব বলছে। তার মাথায় দুষ্টুমি খেলল। এইসব লোককে নিয়ে মজা করার সুযোগ চট করে তো পাওয়া যায় না।

”ধাড়াদা, কে যেন বলল, টাকাটা নাকি আপনিই…”

”কী বললি, কী বললি, আমি তোর টাকা মেরেছি? জীবনে আজ পর্যন্ত একটা পাই—পয়সাও কাউকে ঠকাইনি। নিশ্চয় ঘুনু বলেছে। আসলে তোর টাকাটা ঘুনুই সই করে তুলে নিয়েছিল। আমি নিজে ভাউচারে ওর সই দেখেছি।”

”তখন আমায় সেটা, এইরকম একটা ফোন করে জানাননি কেন? না ধাড়াদা, আমাকে এত ভালবাসেন অথচ এই খবরটা আমায় দেননি। যদি দিতেন তা হলে আমি হ্যাঁ বলতাম না।”

”হ্যাঁ মানে! হ্যাঁ ব্যাপারটা কী? ঘুনুকে হ্যাঁ বলেছিস নাকি?”

”বলব না? পৌনে তিন লাখ টাকার অফার পেলে কি না বলব?”

”পউউনে তিন!”

সমীরণ দশ সেকেন্ড কোনও শব্দ পেল না ওধার থেকে। হাসল সে। ওষুধ ধরেছে।

”ধাড়াদা হ্যালো, লাইন ঠিকই আছে, হ্যালো, ঘুনুদা বললেন, গত বছর বুকু যা ধেড়িয়েছে তাতে নাকি আমাকেই এখন সবাই চাইছে। মেম্বার নাকি বলেছে হিরো থেকে হিরোইন হয়ে গেছে বুকু দত্ত। এখন যাত্রায় নামুক। পতুদা নাকি বলেছেন ব্ল্যাঙ্ক চেকে সই করে দিচ্ছি, সমীরণকে এনে দাও। আচ্ছা দেখুন তো কী মুশকিলে পড়লাম। আমি যাত্রীতে গেলে এদিকে বটাদা বলেছেন আমাদের বাড়ির সামনে অনশন শুরু করবেন—আমরণ। কী করি বলুন তো?”

”ঘুনুকে হ্যাঁ বলেছিস মানে ফাইনাল কথা, নাকি ল্যাজে খেলাচ্ছিস?”

”ওহো ধাড়াদা, এখন কি ফাইনাল কথা বলে কোনও কথা আছে? সই করার আধঘণ্টা আগেও তো ডিগবাজি খেয়েছে কত তারকা!”

”এখন কিন্তু ওসব খাওয়ার পথ বন্ধ। অলরেডি বটা আর পতু তাঁদের খোঁয়াড়ে মাল ভরে ফেলেছে। বুকুও ঢুকে গেছে পতুর বাড়িতে। বাকি যারা রয়েছে তাদের একজন তুই, আশ্চর্য হচিছ, বটা এখনও কী বলে তোকে ছেড়ে রেখেছে! তোকে কি সারথির দরকার নেই? বিনু জন তো কাল এসে গেছে, কার্নাইল আজ আসছে, তা হলে কি তোকে আর সারথি রাখবে না?”

সমীরণ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাঠ হয়ে রইল বিনু আর কার্নাইলের খবরটা পেয়ে। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল, ”বিনু যতদূর জানি আসবে না আর কার্নাইলকে পঞ্জাব পুলিশ ছাড়বে না। তবে ইলেকশনে জেতার জন্য বটাদা রটাবে ওদের আনিয়ে ফেলেছে।”

একটা হালকা খিকখিক হাসি সমীরণের কানে ধাক্কা দিয়ে জানিয়ে দিল তার কথা নস্যাৎ হয়ে গেছে।

”তুই বড় ছেলেমানুষ সমীরণ। বিনুকে কাল আমিই আমার বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলে রেখেছি চন্দননগরে। বটাকে ইলেকশনটা জেতাতে হবে যাত্রীর স্বার্থেই তো। আলবুকার্ক সারথিতে আসছে আসছে এমন একটা রব তুলতে হবে। আরে খবরের কাগজ আমার মুঠোয়, রব তুলিয়ে দেব। কার্নাইলের জন্য বটার হয়ে আমি অনেক হেলপ ওকে করেছি।”

”কেন করেছেন? পতুদাকে ডোবাবার জন্য?”

”হ্যাঁ।” দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ ফোনের মধ্য দিয়ে সমীরণের কানে সুড়সুড়ি দিল। সুবোধ ধাড়া হঠাৎ যেন খেপে উঠল বলে মনে হচ্ছে। ”আর শুনে রাখ, যাত্রীতে তুই যদি আসিস তা হলে তোকেও ডুবতে হবে।”

সমীরণের ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠল কথাটা শুনে। সতর্ক হয়ে সে বলল, ”পতুদাকে ডোবাতে আপনি কিন্তু যাত্রীরই ক্ষতি করবেন।”

”করব, ক্লাবের জন্য করব। একটা প্ল্যান নেই, পরিকল্পনা নেই, দু’হাতে টাকা ছড়িয়ে শুধু প্লেয়ার ধরছে। এসব ঘুনুর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। যত টাকা খরচ হবে ততই ওর হিস্যের টাকাও বাড়বে। এত প্লেয়ার নিয়ে শেষে বিপদে পড়তে হবে। ভাব তুই, লেফট ব্যাকই চারজন, মিডফিল্ড ন’জন। এইভাবেই রিক্রুট হচ্ছে, অ্যাডভান্স দেওয়া হচ্ছে। পাগল না হলে এমন কাজ কেউ করে? অজয় বলেছে সমীরণকে আনো। ওর ফার্স্ট চয়েস তুই। যদি তুই ফেল করিস তা হলেই বুকু টিমে জায়গা পাবে। এইভাবে কি টিম তৈরি হয়? তুই ফেল করলে তবেই বুকু টিমে আসবে। যাত্রী কি অজয়ের বাপের ক্লাব?”

”ধাড়াদা আপনি তো ক্লাবের শুভাকাঙ্ক্ষী, বুকুরও গডফাদার। শুনেছি ক্লাব লিগ না পেলে একমাস হবিষ্যি করেন, জুতো পরেন না। তা হলে গত বছর সারথির সঙ্গে লিগ ম্যাচের মাঝখানে বুকুর মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বলে টেলিফোন করে হঠাৎ ওকে মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন কেন? বুকু তখন তো বেশ ভালই খেলছিল। হয়তো বহুদিন পর গোলও পেয়ে যেত। নিজের ওপর কনফিডেন্সটা ফিরে পাওয়ার জন্য গোল পাওয়া ওর খুবই দরকার ছিল। সেদিন আপনি একই সঙ্গে বুকুর আর ক্লাবের ক্ষতি করেছেন।”

সমীরণ ধীরস্বরে, মেপে মেপে কথাগুলো বলল মাথা নামিয়ে চোখ বন্ধ করে। একজন ভাল ফুটবলারের সর্বনাশ হওয়া দেখতে তার কষ্ট হয়। ফুটবলার হিসাবে বুকুকে সে সমীহ করত। কিন্তু এখন আর করে না। ক্লাবের রাজনীতিতে ধাড়া গ্রুপের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে বুকু নিজের ক্ষতি নিজেই করেছে। এইসব দেখে আর শুনে সারথিতে গোষ্ঠী—ঝগড়া থেকে সমীরণ শত হাত দূরে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে।

”সমীরণ তুই বুদ্ধিমান, শিক্ষিত। নোংরামিতে থাকিস না বলে ময়দানে তোর সুনাম আছে। একটা গরিব ঘরের ছেলে, তিন পুরুষ যা পেত না তাই পেয়ে গেছে সাত—আট বছরে। কম করে লাখ দশেক যাত্রী থেকে আর হাজার তিনেক মাসে মাসে ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে। দু’বছর আগেই লক্ষ করেছি বুকুর ভেতর থেকে খেলার ইচ্ছেটা ফুরিয়ে গেছে। ও আর কোনওদিন খেলায় ফিরতে পারবে না এটা আমি জেনে গেছি বলেই মাঠ থেকে বের করে নেওয়ার জন্য মায়ের হার্ট অ্যাটাকের টেলিফোনটা করিয়েছিলুম। ওর এজন্য কোনও ক্ষতিই হয়নি। কিন্তু আমি যা ঘটাতে চেয়েছিলুম সেটা হয়েছিল। ম্যাচ হেরে গ্যালারিতে আগুন জ্বলেছিল। হয়তো সেদিন বুকু একটা গোল করে ফেলত কিন্তু সেলফ কনফিডেন্স ও ফিরে পেত না। তা পেতে হলে খেলাকেই ধ্যানজ্ঞান করতে হয়। বুকু আর তা পারবে না বলেই ওকে আমি নিজের কাজে লাগাচ্ছি। আর ও এটা জানে, এখন ওভারটাইম খেটে উপরি আয় করার কাজ যতদিন পারে ওকে করে যেতে হবে। কিন্তু তুই অ্যামবিশাস, ফুটবলে বড় হতে চাস, তুই ডেঞ্জারাস।”

”এটা প্রশংসা, না নিন্দে?”

কথাটায় কান দিল না ধাড়া। শুধু বলল, ”যেজন্য ফোন করা, তুই সারথিতেই থেকে যা, তোর দর আমি বাড়িয়ে দেব। যাত্রীতে আড়াই লাখ টাকার অফার পেয়েছিস বলে খবরের কাগজে রটিয়ে দেব। সারথি দু’লাখ অফার দিয়েছে শুনে তো বুকুকে তুলে নিয়ে গেছে পতু। তোকেও বটা তুলবে।”

সমীরণ আবার খিকখিক করে হাসি শুনল। সে দ্বিধাভরে বলল, ”দু’লাখ, আড়াই লাখ, এসব কি লোকে বিশ্বাস করবে?”

”করবে কেন, করেছে। আবার বলছি, যাত্রীতে এলে ঝামেলায় পড়বি, খেলতে পারবি না..খেলতে দেব না।”

ওধারে টেলিফোন রাখার আর ডোর—বেল বাজার শব্দ প্রায় একই সঙ্গে হল। বাজার নিয়ে রেখা গুপ্ত আর শ্যামলা ফিরল।

”দাদা তোর কী অসম্ভব লাক, কতদিন পর আজই কিনা বাজারে শুঁড় থেকে টেইল প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা বাগদা উঠেছে! ‘এ’ ব্লকের সেই মেমসাহেব, হাউসকোর্ট পরে যিনি বাজার করেন, তিনি মাছওলার সামনে ঝুঁকে আঙুল দিয়ে বাগদার নাড়ি টিপে টিপে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন। আর পিসি, চল্লিশ হাত দূর থেকে ভিড়ের মধ্য দিয়ে…এককালে যে বাসকেট খেলত সেটা এবার বিশ্বাস হল।”

”মলা!” রান্নাঘর থেকে গম্ভীর স্বরে ডাক পড়ল।

”না পিসি সবটা আমি বলব না।” শ্যামলা চেঁচিয়ে আশ্বাস দিয়েই সমীরণের দিকে বড় বড় চোখ করে বলল, ”অসম্ভব একটা ড্রিবল করে ছুটল। তিন—চারজন ভদ্রলোক ধাক্কা খেয়ে কোনওক্রমে টাল সামলালেন বটে, কিন্তু মেমসাহেবকে নির্ঘাত রেড কার্ড দেখানোর মতো ফাউল পিসি করেছে। সোজা গিয়ে একটা সাইডপুশ, মেমসাহেব দড়াম, এক থাবায় চিংড়িগুলো ধরে পাল্লায় চাপিয়ে দিয়েই পিসি বলল, ”ওজন করো, সবগুলো নেব।” এক অ্যাকশনে সব ঘটে গেল। মাছওলা পিসিকে জানে। সে বিনা বাক্যবায়ে বাটখারা চাপিয়ে ডিক্লেয়ার করল, ”এক কিলো পঞ্চাশ গ্রাম, আশি টাকা আর চার টাকা, চুরাশি টাকা…দু’টাকা কম দেবেন, সমীরণদা কাল ফিরেছেন জানি। মেমসাহেব যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন মাছগুলো আমার থলিতে এসে গেছে।”

”মলা।” আবার রান্নাঘর থেকে।

”এই যাই, আর একটু বাকি আছে পিসি। তারপরই বুঝলি দাদা, মেমসাহেব তো চিৎকার শুরু করলেন। মাছওলা তখন প্রায় ধমকেই তাকে বলল, ‘পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল পেয়ে কী করতে হয় সমীরণ গুপ্তর পিসিমা সেটা জানেন, আপনি অত লেট করলেন কেন? টাটকা বাগদা আর আপনি কিনা টেপাটেপি করছেন। ফাস্টাইম শট নেবেন তো!’ মেমসাহেব তো মাছওলার কথা কিছুই বুঝলেন না। আর পিসি তো হাতজোড় করে প্রচুর মাফটাপ চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিল জীবনে আর কখনও মেমসাহেবকে ধাক্কা মারবে না, এমনকী জীবনে আর কখনও চিংড়ি মাছও কিনবে না বলতে যাচ্ছিল…”

”মলা, মিথ্যে কথা বোলো না।” রান্নাঘর থেকে প্রায় করুণ স্বর ভেসে এল।

”আহা, আমি তো বলেছি বলতে প্রায় যাচ্ছিলে, সত্যিই কি আর বলেছ? আমি যদি তখন ‘পিসি ওই দ্যাখো এঁচোড়’ না বলতাম তা হলে তো তুমি নির্ঘাত বলেই ফেলতে।”

এই সময় রান্নাঘরের দরজায় এসে রেখা গুপ্ত একটা চিংড়ি তুলে গদগদ স্বরে বললেন, ”কী রকম টাটকা বল, আর কত শস্তা, আশি টাকা মাত্র!”

”সর্ষে বাটা আর কষে ঝাল দিয়ে…” সমীরণ টাকরায় জিভ লাগিয়ে একটা শব্দ করল। বহু…বহুদিন বাগদা খাইনি।”

”না, পিসি, নারকোল আর কিসমিস দিয়ে টক—মিষ্টি মালাইকারি।” শ্যামলা নাকিসুরে আবদার জানাল।

”দাঁড়া, দাঁড়া, এঁচোড় দিয়ে একখানা যা ডালনা…” রেখা গুপ্ত রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।

”মলা শিগগিরি গিয়ে ধরে পড়, এঁচোড় ফেচোড় বন্ধ কর।”

”তুই গিয়ে বল।”

ভাইবোনের মধ্যে কথা নিয়ে যখন ঠেলাঠেলি চলছে তখন স্কুটার ফটফটিয়ে হিমাদ্রি বাড়ির সামনে থামল। জিলিপির ঠোঙাটা টেবিলে রেখে, ”তিরিশটা আছে, সবার ছ’টা ছ’টা, ইনক্লুডিং বাবা।” তারপরেই একটু উত্তেজিত স্বরে বলল, ”ট্যাক্সিটা থামিয়ে দুটো লোক, তারা—মা’র সামনে আমায় জিজ্ঞেস করল, সমীরণ গুপ্তর বাড়িটা কোথায়? দেখে মনে হল যাত্রী কি সারথির দলবদলের পার্টি, বললাম জানি না, ভেতরে গিয়ে খোঁজ করুন। ওরা সুশোভনেই ঢুকল, এক্ষুনি এসে পড়বে। বাইরে গিয়ে কথা বলবি।”

হিমাদ্রির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেই ডোরবেল বাজল। সমীরণ বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এল।

দু’জনেই সারথির। বটা বিশ্বাসের বিশ্বস্ত দিলীপ আর বাপি। প্রথমজন তার ব্যক্তিগত কাজগুলো করে, অন্যজন তার দেহরক্ষীর মতো সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। সমীরণের সঙ্গে মৌখিক আলাপ ছাড়া ঘনিষ্ঠতা নেই।

”কী ব্যাপার, আপনারা?”

”বটাদা তোমায় একবার ডেকেছে।” দিলীপ জরুরি ভাব দেখিয়ে বলল, ”ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।”

”কিন্তু আমি তো এখন যেতে পারব না। পিসিমা বাগদা চিংড়ি এনেছেন।” সমীরণের সহজ হালকা গলা।

”মানে!” দিলীপ বুঝতে পারল না।

”পিসিমা বাজার থেকে আমার জন্য বাগদা কিনে এনেছেন। এখন তার খোলা ছাড়াচ্ছেন তারপর রাঁধবেন। সেটা না খাওয়া পর্যন্ত আমি তো বাড়ি ছাড়তে পারব না।” সমীরণ হাসিমুখে বলল কিন্তু অন্য দু’জনের মুখে হাসি ফুটল না।

”বটাদা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।” দিলীপের গলায় ব্যস্ততা একটু বেশিই ফুটে উঠল।

”মাছফাছ এসে খাবে’খন, আগে বটাদার সঙ্গে কথা সেরে আসবে চলো।” বাপি কেউকেটা ভাব দেখিয়ে দু’পা এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।

সমীরণের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। স্থির দৃষ্টিতে দিলীপের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটা—কাটা স্বরে বলল, ”পিসিমার রান্না না খেয়ে, কোথাও আমি যাব না। এটা আমার কাছে আপাতত সবথেকে জরুরি ব্যাপার। বিকেলের দিকে বটাদার সঙ্গে দেখা করব, উনি তখন কোথায় থাকবেন?”

ওরা দু’জন একটু অবাক ও কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে সমীরণের কথা শুনল। বটাদা ডাকছে শুনে আঁকপাক করে দেখা করার জন্য ছুটল না, এমন অদ্ভুত ব্যাপার তারা দেখেনি। কিন্তু সমীরণকে ওরা চেনে। কঠিন গলা ও চাহনি থেকে ওরা বুঝে গেছে এখন একে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

”যাত্রী থেকে কেউ এসেছিল?” দিলীপ নরম স্বরে জানতে চাইল।

”হ্যাঁ। ঘুনু মিত্তির।” সমীরণ জানে সব খবরই এরা পায়।

”অফার দিয়েছে?” দিলীপের নিচু গলা।

”হ্যাঁ, তবে আমি কোনও কথা দিইনি।”

দুজনেই যেন আশ্বস্ত হল। ওরা জানে সমীরণ ছলচাতুরি করে কথা বলে না।

”বিকেলে বটাদা শোভাবাজারে অভয় কুণ্ডুর বাড়িতে থাকবে, তুমি বাড়িটা চেনো?”

অভয় কুণ্ডু একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিন বছর আগে অনেকের সঙ্গে সে অভয় কুণ্ডুর মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। বাড়িটা যে ঠিক কোথায়, তার মনে নেই। তবে মাঝারি একটা রাস্তা থেকে গলির মধ্যে, খুব পুরনো বাড়ি, মোটা দেয়াল, উঁচু সিলিং, শ্বেত পাথরের মেঝের হলঘর, সদর দরজার পাল্লা দুটো খুব ভারী, এইটুকুই মনে আছে।

”জায়গাটা জানি, বাড়িটা মনে নেই।”

”তা হলে ঠিক ছ’টায় শোভাবাজার মোড়ে বাপি অপেক্ষা করবে। তুমি ট্যাক্সি ওখানে থামাবে, ও নিয়ে যাবে অভয়দার বাড়িতে। ঠিক ছ’টায়, পাক্কা?”

”হ্যাঁ যাব।” সমীরণ মাথা হেলাল।

।। ৬ ।।

সমীরণ পৌঁছেছিল দশ মিনিট দেরিতে। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কঠোর নিয়ম মানলেও, সর্ষে—কাঁচালঙ্কা মাখানো বাগদাকে যথোচিত মর্যাদা দেওয়ার জন্য এবং মালাইকারিকে অবজ্ঞা করে রুচিহীনতার কবলে না পড়তে চাওয়ায় সে তার খাওয়ার বিধিনিষেধকে আজ শিকেয় তুলে দেয়। অবশ্য শুধু আজকের জন্যই। মনে মনে শুধু বলেছিল, ‘হাজার হোক আমি তো বাঙালিই রে বাবা!’ মাছের সঙ্গে ভাতও আনুপাতিক হারে বেশি খেয়ে ফেলায় সমীরণকে একটি ভাতঘুমের সাহায্যও নিতে হয় হাঁসফাঁসানিকে সুস্থির করতে। অতঃপর দশ মিনিট বিলম্বকে সে দেরি মানতে চাইল না। অবশ্য ট্যাক্সিতে উঠে বাপি শুধু একবারই বলেছিল। ”আমি সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে দাঁড়িয়ে।”

ট্যাক্সিটা শোভাবাজার মোড় থেকে পশ্চিমে গঙ্গার দিকের রাস্তা ধরে এগোল। সমীরণ হাটখোলা পোস্ট অফিসটা দেখে মনে করতে পারল এই পথেই সে গিয়েছিল নেমন্তন্ন খেতে। আর একটু এগিয়ে বাপির নির্দেশমতো ট্যাক্সি ডান দিয়ে একটি রাস্তায় ঢুকল। তারপর বাঁ দিকে একটা কানাগলির মুখে দাঁড়াল।

সামনেই চায়ের দোকান। সাত—আটটি যুবক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর বোর্ড রেখে ক্যারম খেলছিল। ট্যাক্সি থামতেই তিনজন এগিয়ে এল। বিগলিত সম্ভ্রম মুখে মাখানো।

”সমীরণদা এসে গেছে রে…আসুন সমীরণদা।” একজন দরজা খুলে ধরল।

একজন ঝুঁকে হাত বাড়াল নামায় সাহায্য করতে। সমীরণ নামার সময় একমুখ হাসল কিন্তু হাতটা ধরল না।

”সমীরণদা, লিগটাই হল আসল জিনিস, এবার কিন্তু ওটা চাই। শিল্ড, কাপফাপ হোক বা না—হোক, আপনাকে কিন্তু…”

”আরে, একা কি কেউ লিগ জেতাতে পারে। এগারোজনের খেলা, এতদিন ধরে এতগুলো ম্যাচ, টিম কি সবদিন সমানভাবে খেলতে পারে?” বিব্রতভাবে কিন্তু হাসিমুখে সমীরণ বলল। এই ধরনের কথার সামনে বহুবার তাকে পড়তে হয়েছে। বেশি কথাবার্তায় যেতে নেই। মুখে হাসি মাখিয়ে, ”অবশ্যই চেষ্টা করব”, এবং ”এবার নিশ্চয় লিগ জিতব” ধরনের কথা বলে সে পাগল—সমর্থকদের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে।

”না, সমীরণদা, এ—কথা বললে হবে না, টিম আমাদের এবার খুব ভাল, বিনু জন তো…’ আচমকা বাপির ধমক খেয়ে ছেলেটি থতমত হয়ে কথা শেষ করতে পারল না।

”কোথায় কী তার ঠিক নেই, বিনু জন নিয়ে হেদিয়ে মরছে। সমীরণ গুপ্ত থাকতে আর কাকে দরকার?” বাপি উত্তেজিত চোখে কটমটিয়ে তাকাতেই ছেলেটি গুটিয়ে গেল। সমীরণের পিঠে মৃদু ঠেলা দিয়ে বাপি বলল, ”চলো চলো, এইসব কিসসু যারা বোঝে না জানে না, এদের সঙ্গে…”

সেই পুরনো বড় বাড়িটাই। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে বিরাট একটা অ্যালসেশিয়ান দেয়ালের কড়ার সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা। উপুড় হয়ে, চোখ বোজানো। পায়ের শব্দে একটা চোখ খুলে শুধু তাকাল। ওঠার সময় সমীরণের মনে পড়ল সুবোধ ধাড়ার কথাটা, ”বিনুকে কাল আমিই আমার বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলে রেখেছি চন্দননগরে।” আর এই ছেলেটা সবে যখন বলছিল, ”বিনু জন তো,” ঠিক তখনই বাপি খিঁচিয়ে উঠে ওর মুখ বন্ধ করে দিল।

বিনুকে আনিয়ে বটা বিশ্বাস তার ওপর চাপ তৈরি করে রাখতে চায়। তারপর আলবুকার্ক, তারপর কার্নাইলও আসবে। একটা বিষাক্ত আবহাওয়া তৈরি করে বটা বিশ্বাস তার দমবন্ধ করে দেবে। পারস্পরিক দোষারোপ শুরু হবে, খবরের কাগজে বেরোবে কে কার বিরুদ্ধে কী বলল আর তার জবাবে আর—একজন কী বলল। মেজাজ নষ্ট হবে, খেলায় স্ফূর্তি আসবে না। সাপোর্টাররা অকথ্য ভাষায় গাল দেবে।

হলঘরে দুটো সোফায় চারজন লোক বসে। সমীরণ চারজনকেই চেনে। ক্লাবটা এখন এরাই চালায়। বটা বিশ্বাস হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে একটা টাইপ করা কাগজ পড়ছিলেন। বয়স দেখে মনে হয় চল্লিশ—পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, আসলে পঞ্চান্ন। গোলাকার মুখ, পাঞ্জাবির নীচে পেটের কাছে ফুলে রয়েছে চর্বি, গায়ের রং খুবই ফরসা, ডান হাতের আঙুলে পলা ও পোখরাজ বসানো দুটি আংটি। লোকটি সৌম্যদর্শন, কথা বলেন ধীরে। হাতের কাগজটা রেখে চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে সমীরণের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে মুখ ভরে গেল অনাবিল হাসিতে।

”কাল এসেছিস অথচ খবর দিসনি। ফোনেও তো জানাতে পারতিস।” সস্নেহ অনুযোগ করলেন বটা বিশ্বাস। নিজের পাশে বসানোর জন্য সোফায় চাপড় দিতে দিতে বললেন, ”বোস, বোস।”

”কাল বাড়ি ফিরলামই তো রাত্রে। খুব টায়ার্ড ছিলাম।” সমীরণ বসার আগেই সতর্কভাবে বলল। বটা বিশ্বাস সব খবরই রাখে সুতরাং আড়াল দিয়ে কথা না বলাই ভাল।

”টায়ার্ড তো হওয়ারই কথা। স্টেশন থেকে দুলালের ব্যাঙ্ক, তারপর দমদমে প্রধান অতিথি, ধকল তো কম নয়।” বটা বিশ্বাস মিটিমিটি হাসছেন।

লোকটার কাছে এইসব খবরও পৌঁছে গেছে। আশ্চর্য বোধ করছে, এটা কোনওভাবেই যাতে মুখে ফুটে না ওঠে সমীরণ সেই চেষ্টায় সফল হল। মুখটা ব্যাজার করে বলল, ”তার ওপর রাতে আবার ঘুনুদার ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হল।”

বটা বিশ্বাস বিস্ময় প্রকাশ করলেন না ঘুনু নামটা শুনে। ঘুনু প্রসঙ্গ না তুলে খুবই স্বাভাবিক গলায় বললেন, ”এ—বছর সারথিতেই তো থাকবি?”

প্রশ্ন বা উৎকণ্ঠা নয়, বটা বিশ্বাসের বলার ভঙ্গিটা যেন একটা বিবৃতি শুরু করার মতো। ”প্রচুর দেনা রয়ে গেছে গত বছরের। এই দ্যাখ, ব্যাঙ্ক তাগিদ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। কীভাবে যে এবার টিম করব ভেবে পাচ্ছি না।”

”সুদে—আসলে এগারো লাখ ব্যাঙ্ক এখন পাবে।” শুকনো গলায় বটা বিশ্বাসের পাশে বসা সহসচিব অপূর্ব মজুমদার বললেন।

সমীরণ এই ধরনের কথা গত বছরও দলবদলের আগে শুনেছে। তখন ধারের অঙ্কটা ছিল আট লাখ। এখন যে কাগজটা দেখাল সেটা সত্যিই ব্যাঙ্কের চিঠি কি না তাতে সন্দেহ হলেও সে চুপ করে রইল।

”তুই তো ঘরের ছেলে, যা দেব তাই নিবি সোনামুখ করে। কিন্তু সবাই তো তা নয়।”

”সবাই তো সমীরণ গুপ্ত নয়।” অন্য সোফায় বসা অভয় কুণ্ডু নিজেকে তাড়াতাড়ি জুড়ে দিলেন বটা বিশ্বাসের সঙ্গে।

”তুই ছিলিস না, কী অসুবিধেয় যে পড়েছিলাম। কাকে কাকে নেব, কাকে কাকে ছেড়ে দেব, এই নিয়ে কথা বলার লোকই পাচ্ছিলাম না। নির্মলকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বিপ্লব বোস, গৌতম চ্যাটার্জিকে যাত্রী থেকে নিতে বলল। বোঝ, ও দুটো কি প্লেয়ার। একটার তো ডান পা বলে কিছু নেই, শুধু পারে লম্বা লম্বা দৌড়। আর অন্যটা ফুলবাবু, সাজিয়ে গুজিয়ে পায়ে বল পৌঁছে দিলে তবেই তিনি নড়বেন। মডার্ন ফুটবল এইসব প্লেয়ার দিয়ে খেলা যায়?”

বটা বিশ্বাসের মুখে ”মডার্ন ফুটবল” কথাটা শুনে সমীরণ হাসি চাপল।

”মডার্ন ফুটবলে সারাক্ষণই তো দৌড়াদৌড়ি করতে হবে,” অভয়ের সংযোজন।

সোফায় বসা চতুর্থজনের দিকে মাথা হেলিয়ে বটা বিশ্বাস বললেন, ”পুলকেশবাবু ছোট টিমের চারটে ছেলের নাম দিয়েছেন। ওদের অ্যাডভান্স করা হয়ে গেছে।”

”বাইরে থেকে কাকে পাচ্ছেন, কার্নাইলের ট্রান্সফার নিয়ে নাকি প্রব্লেম হচ্ছে?” সমীরণ জানতে চাইল। দল গড়ার ব্যাপারে গত তিন বছরে কখনও তার মতামত বা পরামর্শ কেউ নেয়নি। এইবার তাকে খাতির দেখাবার এই ভানটায় তার ভেতরটা কাঠ হয়ে উঠল।

”কার্নাইলের কেসটা একটু কমপ্লিকেটেড। এ আই এফ এফ জানিয়েছে, কার্নাইল ওর অফিস থেকে লোন নিয়েছে, টাকা শোধ না করা অবধি রিলিজ অর্ডার দেবে না। সরকারি অফিস তো, তাই ফ্যাচাং আছে। আলবুকার্কের এগেনস্টে রয়েছে সন্তাোষ ট্রফির খেলায় রেফারির ম্যাচ রিপোর্ট। আর বিনু জন ইন্টার স্টেট ট্রান্সফার চেয়েছে বাংলা আর মহারাষ্ট্রে। এটা তো হয় না। দুটো স্টেটে খেলতে চাইলে পারমিশন দেবে কী করে?” বটা বিশ্বাস অসহায়ভাবে সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। সবাই মাথা নেড়ে তাদের অসহায়তাও বুঝিয়ে দিল।

সমীরণ খটকায় পড়ে গেল। সুবোধ ধাড়া যে বললেন বিনু এসে গেছে? কিন্তু উনি তো বাজে কথা বলার লোক নন। ঠিক এই সময়ই বছর—বারোর একটি ছেলে ভেতর থেকে হলঘরের দরজায় এসে বলল, ”বাবা, চন্দননগর থেকে একজন ফোন করেছে।”

অভয় কুণ্ডু প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। হাত তুলে তাকে নিরস্ত করে বটা বিশ্বাস সোফা থেকে উঠলেন। ”ব্যস্ত হতে হবে না, আমিই ধরছি।”

বটা বিশ্বাস ফোন ধরতে গেলেন। ঘরে সবাই চুপ করে বসে রইলেন। নীরবতা অস্বস্তিকর লাগায় সমীরণ অভয় কুণ্ডুকে বলল, ”সুখেনদা থাকছেন তো?”

সুখেন কর সারথির কোচ। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, দরদি। কথা কম বলেন এবং ডিসিপ্লিন সম্পর্কে নোভাচেকের মতোই কঠোর। গত বছর মাঠে এসেও, শরীর ভাল নেই বলে ট্রেনিংয়ে না নামায় দুলাল চক্রবর্তীকে সাতদিন ট্রেনিং করতে দেননি সুখেন কর। তাই নিয়ে জোট বেঁটে দুলালের নেতৃত্বে কয়েকজন বয়স্ক ফুটবলার ছোটখাটো একটা বিদ্রোহ করে ফেলেছিল। বটা বিশ্বাসের মধ্যস্থতায় বিদ্রোহ প্রশমিত হয়।

”নিশ্চয়। সুখেন কর ছাড়া আর কারও কথা আমরা ভাবছিই না। তবে নির্মাল্যরা চাইছে হেমন্ত গাঙ্গুলিকে। আরে, যার কোনও কোচিং ডিগ্রি—ডিপ্লোমা নেই সে কিনা সারথির মতো ক্লাবে কোচ হবে।” অভয় কুণ্ডু আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলেন।

সমীরণের মনে পড়ল, সুবোধ ধাড়াও ঠিক একই ভাবে অজয় তালুকদারকে যাত্রীর কোচ করার বিপক্ষে এই যুক্তিটাই দিয়েছিলেন। একই মানসিকতা দুটো ক্লাবে। ডিগ্রি—ডিপ্লোমার প্রতি এত ভক্তি, মডার্ন ফুটবলের জন্য এত ব্যাকুলতা অথচ ক্লাব চালাতে লক্ষ লক্ষ টাকা দেনা না করে এরা থাকতে পারে না।

”অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কি হায়ার সেকেন্ডারি ফেল—মারা কোনও ছাত্রের পড়ার সুযোগ পাওয়া উচিত? যদি পায় বুঝে নিতে হবে, সে সুযোগ পাচ্ছে খুঁটির জোরে, নিয়মবহির্ভূতভাবে। হেমন্ত সম্পর্কে আমার কোনও অ্যালার্জি নেই। কিন্তু আমাদের তো সারথির স্বার্থের কথাটাই ভাবতে হবে। ও যখন যাত্রীতে খেলত তুই তখন গড়ের মাঠ চোখে দেখিসনি। তখন সারথিকে একটা ম্যাচে দু’গোল দিয়েছিল। আমাদের মেম্বার গ্যালারির দিকে কী অশ্লীল অসভ্য অঙ্গভঙ্গি যে হেমন্ত সেদিন করেছিল তা আজ পনেরো—ষোলো বছর পরও চোখে ভাসছে। ওর পরিচয় তো যাত্রীর ছেলে হিসাবেই, সারথির মেম্বাররা ওকে মোটেই মেনে নেবে না।”

”মেম্বার চায় ট্রফি। ট্রফি পাইয়ে দিলে কোচ কার ছেলে কার নাতি এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।” সমীরণ বিরক্তি চেপে বলল।

এবার পুলকেশবাবু আসরে নামলেন। চাপা গলায়, খুবই গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ”বাংলার কোচ হয়ে হেমন্ত সন্তাোষ ট্রফি নিয়ে এল মাদ্রাজ থেকে, সে তো স্রেফ চুরি করেই, বাঁকা পথে। এখন এ আই এফ এফ সেক্রেটারি পদ্মনাভন তো মাদ্রাজেরই লোক। সে তো বলেইছে, বাংলাকে এর মাশুল গুনতে হবে। সেই হেমন্তকে সারথির কোচ করলে, তুমি কি ভেবেছ পদ্মনাভন খুব গদগদ হয়ে আমাদের সুনজরে দেখবে?”

”কার্নাইল, আলবু, বিনুর ক্লিয়ারেন্সে নো অবজেকশন লিখে দেবে?” অভয় কুণ্ডুর সংযোজন।

ঘরে ফিরে এলেন বটা বিশ্বাস। ওরা দু’জন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সমীরণকে একপলক দেখে নিয়ে বটা বিশ্বাস বললেন, ”না, তেমন কিছু নয়। ওখানে থাকতে একটু অসুবিধে হচ্ছে…কলকাতায় আসতে চায়। হ্যাঁ, ভাল কথা সমীরণ, ঘুনু তোকে যে অফার দিয়েছে, জানি, আমি জানি কত টাকা বলেছে, কিন্তু অত টাকা সারথি তোকে দিতে পারবে না।” বটা বিশ্বাস ব্যাঙ্কের চিঠিটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে হাতে রেখে বললেন, ”গতবারের থেকে বিশ হাজার বেশি দেব।”

”তার মানে পুরো দেড় লাখ।” অভয় কুণ্ডুর সংযোজন।

সমীরণ তখন মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। তার মাথায় ঘুরছে চন্দননগরের ফোন। বিনু জনই করেছে। ধাড়াদা বাজে কথার লোক নন। ওখানে বন্ধুর বাড়িতে তিনিই বিনুকে তুলে রেখেছেন।

”তোকে কবে ক্যাম্পে ফিরতে হবে?” বটা বিশ্বাস জানতে চাইলেন।

”বাইশের মধ্যে কোঝিকোড় ফিরতে হবে।”

”তা হলে তো আর মাত্র ক’টা দিন।” পুলকেশবাবু ক্যালেন্ডার খুঁজতে লাগলেন দেয়ালে।

”বটাদা, যাত্রী কিন্তু আমায় অনেক বেশি অফার দিয়েছে।”

”দিক না, দেবী আর রণেনকেও তো দু’লাখ আশি হাজার করে অফার দিয়েছে, ওরা তিন লাখ করে চেয়েছে। পতু ঘোষ ভাববার জন্য সময় নিয়েছে। আমি সময় টময় নিইনি। দু’জনকেই বলেছি দু’লাখ দশ হাজার, অ্যাডভান্স চল্লিশ হাজারের চেক এখুনি দেব। ওরা চেক নিয়ে গেছে।”

”চেক নিয়ে গেছে?” সমীরণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

”শুধুই কি নিয়ে গেছে, খবরের কাগজে স্টেটমেন্ট গিয়ে দেবী বলেছে, শত প্রলোভনেও দল ছাড়ছি না, ক্লাব এখন রক্তে মিশে গেছে। হ্যাঁ, ক্লাব যদি অবহেলা করত তা হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছি তাতে আমাদের ক্ষোভ থাকার কথা নয়। আমাদের অনুরোধেই সুখেনদাকে কোচ করা হয়, প্রতি ম্যাচে দল গড়ার সময় আমাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, এবারেও ক্লাব নির্বাচনের ডামাডোলে কর্তারা ব্যস্ত কিন্তু আমাদের অনুরোধ মেনে চল্লিশ হাজার করে ধার চাইতেই বটাদা ধার দিয়ে দিলেন…”

মৃদুমন্থর কণ্ঠ পুলকেশবাবুর কথা কেড়ে নিয়ে অভয় কুণ্ডু উচ্চগ্রামে বেগসঞ্চার করে যোগ করলেন, ”এত গুরুত্ব এত ভালবাসা আর কোথায় পাব, টাকাটাই তো জীবনের সব নয়, লক্ষ লক্ষ সারথি সমর্থকের ভালবাসার দাম কি টাকায় হয়?” অভয় কুণ্ডু নিজেকেই প্রায় হাততালি দিয়ে ফেলছিলেন। সেটা না করে, বটা বিশ্বাসের দিকে আপ্লুত চোখে শুধু তাকালেন।

শুনতে শুনতে নিলু গড়গড়ির বক্তৃতা সমীরণের মনে পড়ছিল। কলকাতার ফুটবল মরে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গড়গড়ি বলেছিলেন, গত বছর কাগজে পড়ি একজন বড় প্লেয়ার ক্লাবে থেকে যাবে বলে অ্যাডভান্স নিয়ে বলেছিল এই ক্লাবের তাঁবু তার কাছে মন্দিরের মতো কিন্তু তিনদিন পরই সেই ফুটবলার আর এক ক্লাবের এক কর্তার ফ্ল্যাটে গিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে দরাদরি করছে। এটাই হল দুর্গন্ধ।

সমীরণের গা গুলিয়ে উঠল। গত বছরের ওই ফুটবলারটি আর কেউ নয়, দেবী। তার মনে হল, পুরনো এই বাড়ির হলঘরটা যেন একটা মর্গ, শবাগার। এই লোকগুলো এক একটা ডোম। এখান থেকে বেরিয়ে না গেলে সে বমি করে ফেলবে।

”যাত্রীকে গিয়ে কিন্তু তুই খেলতে পারবি না। বিরাট ঝগড়া, গোলমাল, কামড়াকামড়ি চলছে, সারা বছরই চলবে। তোর খেলা ও—ক্লাবে গেলে শেষ হয়ে যাবে। টাকা কম দেবে সারথি, তোর দামের থেকে অনেক কম। এখানে কিন্তু নিজের খেলাটা খেলতে পারবি।” বটা বিশ্বাস তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন। সমীরণ মাথা নিচু করে দ্রুত ভেবে চলেছে। বটা বিশ্বাস ধরে নিলেন, এই নীরবতার অর্থ, সম্মতি।

”ওপরের তিনটে ঘরে এখন রয়েছে প্রফুল্ল, মানিক, অরবিন্দ আর সতু। তুই প্রফুল্লের ঘরে চলে যা। প্রথম দিন এখান থেকেই সই করতে যাবি। তোকেও অ্যাডভান্স দিচ্ছি চল্লিশ হাজার।”

সমীরণ শুনতে শুনতে থ’ হয়ে গেল। এখানে বন্দি হয়ে থাকতে হবে। ব্যাপারটাই তো লজ্জার, অপমানেরও। সে কি গাধা না গোরু? তাকে বিশ্বাস করে এরা ছেড়ে রাখতে চায় না।

”এখানে বাপির ছেলেরা রয়েছে। যাত্রী কোনওরকম হাঙ্গামা হুজ্জুত করতে আসবে না, তাহলেই চেম্বার বেরোবে এটা ওরা জানে। তোফা খাবিদাবি, ঘুমোবি, ভিডিও—র সিনেমা দেখবি, পঞ্চাশটা হিন্দি—ইংরেজি মারপিটের ফিল্মের ক্যাসেট রয়েছে, কত দেখবি দেখ না। একদমই বোর লাগবে না।” গৃহকর্তা অভয় কুণ্ডু দরাজ স্বরে আতিথ্য গ্রহণের আহ্বান জানালেন।

”বটাদা, পিসিমার সঙ্গে কথা না বলে এখন আমি কথা দিতে পারব না।”

বটা বিশ্বাসের ভ্রূ কুঁচকে উঠেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। ”এজন্য তোকে পিসিমার সঙ্গে কথা বলতে হবে?”

পুলকেশবাবু বলে উঠলেন, ”তা কী করে হয়।”

অভয় কুণ্ডু বললেন, ”টেলিফোনে কথা বলে নে।”

”না, এসব কথা টেলিফোনে হয় না। আমাকে বাড়ি যেতেই হবে।” সমীরণের দৃঢ়স্বর বুঝিয়ে দিল তার সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না।

”তা হলে পিসিমার সঙ্গে কথা বলে আয়। অভয়বাবু, বাপিকে ডাকুন একবার, সমীরণকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার সঙ্গে করেই নিয়ে আসুক।” বটা বিশ্বাসকে হঠাৎ ক্লান্ত দেখাল।

”আজ রাতে আর আসা সম্ভব নয়, কাল সকালে এসে আপনাকে জানাব।” সমীরণ উঠে দাঁড়াল।

”তা হলে বাপির ছেলেরা সারারাত তোর বাড়ির সামনে পাহারা দেবে। না, না। অন্য কিছু নয়। ওরা সারথিকে যেমন ভালবাসে তেমনই তোকেও। তোর জন্য ওরা প্রাণ দিতেও পিছপা হবে না, তেমনই প্রাণ নিতেও। তুই সারারাত নিশ্চিন্তে থাকবি।” বটা বিশ্বাস সোজা সমীরণের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন শীতল দৃষ্টিতে। সমীরণ চোখ সরিয়ে নিল না। নিরুচ্চচার একটা চ্যালেঞ্জ বিনিময় ঘটল।

অভয় কুণ্ডুর অ্যাম্বাসাডরের পেছনের সিটে সমীরণ আর বাপি, ড্রাইভারের পাশে নারান নামে একটি ছেলে। পেছনে একটা ট্যাক্সিতে আরও তিনজন।

সিগারেট বের করার ছলে বাপি বুশশার্ট তুলে প্যান্টে গোঁজা পিস্তলটা বের করে সিটে রাখল।

”ওটা দেখাবার দরকার নেই, যথাস্থানে রেখে দাও।”

”না না, তোমাকে দেখাচ্ছি না।” বাপি অপ্রতিভ হয়ে ওটা তুলে নেয়। ”তোমার জন্য তো নয়, নিজেদের সেফটির জন্য এটা রাখতে হয়।”

এর পর সারা পথটাই সমীরণ সিটে হেলান দিয়ে বাঁ হাত কপালের ওপর রেখে চোখ বুজে রইল।

বাপি আর নারান মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছিল কিন্তু সমীরণের কানে তার একটা শব্দও ঢোকেনি।

।। ৭ ।।

মোটর থেকে নেমেই সমীরণ ফটক খুলে ভেতরে এসে ডোর—বেলের বোতাম টিপল। সব জানলায় পরদা টানা, খাবার দালানে শুধু আলো। পেছনে তাকিয়ে দেখল ফটকের সামনে পাঁচজন দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছে। সময় দেখার জন্য বারান্দার কিনারে এসে রাস্তায় আলোয় বাঁ হাতটা তুলল। আটটা বেজে দুই।

রাস্তা নির্জন। এখন টিভি—তে সিনেমা দেখানো হচ্ছে তাই একেবারেই শুনশান। তাদের দু’পাশের বাড়িগুলোর জানলা বন্ধ মশাদের ঢোকা আটকাতে।

আবার সে বেল বাজাল। বাড়িতে কি কেউ নেই? দরজার পাল্লায় কান লাগিয়ে সাড়াশব্দ পাওয়ার চেষ্টা করল। পিসির ঘরে বসে সবাই টিভি দেখতে থাকলে, অন্তত হিন্দি সিনেমার নাচগান কি মারপিটের আওয়াজ তো ভেসে আসবে। তাও আসছে না। টিভি বন্ধ।

হঠাৎ দরজার পাল্লা খুলে গেল। সুনীলবরণ। বাবাকে দেখে সমীরণ হতভম্ব।

”কী ব্যাপার, আপনি? ওরা সব গেল কোথায়?” একবার পেছনে তাকিয়ে, ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সমীরণ বলল। সব ঘর অন্ধকার, শুধু আলো জ্বলছে খাবার দালানে।

”কানু, মলা আর রেখা গেছে অনিরুদ্ধ ভটচাজ মশায়ের বাড়িতে। ভদ্রলোক সাইকেলের ধাক্কায় পা ভেঙেছেন বিকেলে। ওরা দেখতে গেছে।” সুনীলবরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলেন।

সমীরণ দ্রুত ভাবতে শুরু করল। এখন কী করা যায়। কার্যত সে এখন গৃহবন্দি। বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই ওরা তাকে জোর করে ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে। সকালে ওদের পাহারাতেই বটা বিশ্বাসের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকতে হবে।

অসম্ভব।

যদি বলি সারথিতে খেলব না, তা হলে জোর করে আটকে রাখতেও পারে। কিন্তু বাইশের মধ্যেই তাকে কোঝিকোড় পৌঁছতে হবে, যেভাবেই হোক। ইন্ডিয়া টিমের জন্য ক্যাম্প তো টানা সারা বছর ধরে চলবে না, প্লেয়ারদের ছেড়ে দেবে। তখন কলকাতায় এসে খেলতেই হবে। সমীরণ দোটানায় পড়ল। খেললে হয় সারথিতে, নয় যাত্রীতে। দুটো ক্লাবের যেটাতেই সে খেলুক, আই এফ এ—তে নাম রেজিস্টার্ড করতেই হবে। সে শুনেছে ক্যাম্পের প্লেয়ারদের অন্য নিয়ম হয়েছে নির্দিষ্ট দিনের পরেও এটা করা যাবে।

সে ঘরে গিয়ে সন্তর্পণে জানলার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকাল। একজনকে দেখতে পেল, রাস্তার ওধারে রঙের ব্যবসায়ী অমিয় চাটুজ্যের ফটকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। বাকি চারজনকে সে দেখতে পেল না। বোধ হয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একসঙ্গে সবাই জটলা করলে লোকে সন্দেহ করতে পারে ডাকাত বলে। তবে সমীরণ নিশ্চিত, এখানকার সব লোকই শিক্ষিত, অতএব ডাকাত ধরার চেষ্টা করবে না। সেজন্য একটু সাহস দরকার।

কিন্তু এভাবে কোনও ক্লাবে খেলার কথা এখন সে ভাবতে পারছে না। যদি সকালে ওদের সঙ্গে যেতে সে অস্বীকার করে? সমীরণ বুঝে উঠতে পারছে না, তা হলে কী ঘটনা তখন ঘটতে পারে। শুনেছে বছর ছয়েক আগে নাকি হেদায়েত আলিকে নিয়ে এইরকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল। যাত্রীতে যেতে চেয়েছিল হেদায়েত, জুপিটার তাকে সুবোধ ধাড়ার পটলডাঙার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছল বোমা ফাটিয়ে। রাস্তার একটা লোক তাইতে মারাও যায়। ধাড়ার একতলাটা তছনছ করে দিয়েছিল।

যদি এরাও তাই করে। সমীরণের মাথার মধ্যে অসাড় হয়ে আসছে। অন্ধকার ঘরে খাটে বসে সে দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। কেউ তাকে চাপা স্বরে এখন পরামর্শ দিল, ”পালিয়ে যা, এখান থেকে যেভাবেই হোক, পালিয়ে যা। আজ রাতেই।” বটা বিশ্বাসের কথাটা এখন ভীষণভাবে তার মনে পড়ল। ”তোর জন্য ওরা প্রাণ দিতেও পিছপা হবে না। তেমনই প্রাণ নিতেও।” কথাগুলোর মানে খুবই স্পষ্ট।

বাবা, পিসিমা, কানু, মলা এদের আহত রক্তাক্ত দেহ পলকের জন্য তার চোখে ভেসে উঠেই অদৃশ্য হল। সে ফিসফিসিয়ে নিজেকেই বলল, ”আমার জন্য এরা কেন বিপদে পড়বে? হতে পারে না, তা হয় না। এদের বাদ দিয়ে আমি কেউ নই, আমার কোনও অস্তিত্বই থাকবে না।”

সমীরণ খাট থেকে উঠে আবার পরদা সরিয়ে দেখল। একজনও নেই। ব্যাপার কী! ওরা কী চলে গেল? দোতলার ছাদে গিয়ে কি একবার দেখবে? এইসব যখন সে ভাবছে, তখন ধীর গতিতে কথা বলতে বলতে দু’জন বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। একজনকে সে চিনল, নারান।

ওরা তা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারারাতই কি ওরা ঘুরবে? সমীরণ ভেবে কুলকিনারা পেল না। সে পায়চারি শুরু করল।

হঠাৎ ডোর—বেল বেজে উঠল। সমীরণ লাফ দিয়ে পরদা সরিয়ে তাকাল। রাস্তা ফাঁকা। টিভি—তে হিন্দি খবর পড়ার শব্দ আসছে। বারান্দায় একটা কোণ দেখা যায় কোনওক্রমে। তার মনে হল পিসিরা বোধ হয় ফিরল।

দ্বিতীয়বার বেল বাজার সঙ্গেই দরজা খুলল সমীরণ। পিসি, মলা আর কানু দাঁড়িয়ে। প্রথমেই সে তিনজনের পেছনে ফটকের দিকে তাকাল। মনে হল রাস্তায় কেউ একজন সরে গেল।

”আর বলিসনি, ভটচাযদার যা কাণ্ড! পায়ের ওপর দিয়ে সাইকেল রিকশার চাকা চলে গেছে।” রেখা গুপ্ত হাসি চাপতে চাপতে বললেন।

”এমন চেঁচাচ্ছেন যেন পা’টা দু’খণ্ড হয়ে গেছে।” শ্যামলা বলল।

”দাদা, তোর কথাবার্তার কতদূর? কত অফার দিল?” হিমাদ্রি জানতে চাইল।

”বোসো সবাই। বিপদ হয়েছে। রাস্তায় কি কাউকে ঘুরে বেড়াতে দেখলে?” সমীরণের চাপা স্বর আর উৎকণ্ঠিত মুখ দেখে তিনজনের মুখের ভাবও বদলে গেল।

”কেন কী বিপদ হয়েছে? রেখা গুপ্তর গলা অজানা ভয়ে কেঁপে গেল।

”রাস্তায় দুটো লোক দেখলাম আমাদের পেছন পেছন আসছিল। আর ওই মোড়ে কুকুরওলা বাড়ির কাছে একটা লোক ছিল। তা ছাড়া তো আর কাউকে দেখলাম না।” শ্যামলা মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল।

”ওই লোকগুলো গুণ্ডা, পাঁচজন রয়েছে, বটা বিশ্বাসের লোক ওরা, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।”

”অ্যাঁ, কেন?”

”আস্তে কথা বলো, পিসি।” শ্যামলা চাপা ধমক দিল।

”ওরা সারারাত আমার ওপর নজরদারি করবে। কাল সকালে আমাকে সঙ্গে করে আবার বটা বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যাবে।”

”কেন?” হিমাদ্রি জানতে চাইল।

”আমাকে সারথিতেই খেলতে হবে। ওরা ছাড়বে না। পিসির সঙ্গে কথা বলে কাল সকালে জানাব এই কড়ারে বাড়ি এসেছি। ওরা সঙ্গে এসেছে। পাছে আমি পালিয়ে যাত্রীর ঘরে গিয়ে উঠি, তাই সেটা আটকাবার জন্য ওরা রয়েছে। একজনের কাছে পিস্তল আছে দেখেছি।” সমীরণ ধীর নিচু গলায় কথাগুলো বলল। কেউ কোনও কথা বলল না। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং চমকে কথা বলার অবস্থা কারও নেই।

”এটা কি মগের মুল্লুক?” হিমাদ্রি গর্জে উঠল। ”আমার ইচ্ছেমতো কি কোথাও খেলতে পারব না। ঘাড় ধরে খেলাবে আর আমায় খেলতে হবে।”

সমীরণ ভাইয়ের মুখের দিকে শুধু নীরবে তাকিয়ে রইল। রেখা গুপ্ত ব্যাকুলভাবে বললেন, ”পুলিশে খবর দিলে হয় না?”

”পুলিশ কী করবে?” সমীরণ বলল।

”ওদের অ্যারেস্ট করবে।”

”কোন অপরাধে?”

”তোকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে বলে।”

”প্রমাণ কই যে, ধরে নিয়ে যেতে এসেছে? পুলিশ শুধু তো অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে অ্যারেস্ট করতে পারে না।” সমীরণকে হতাশ দেখাল। ”তা ছাড়া ওরা তোমাদের ওপরও হামলা করতে পারে। আমি যদি এখন পালিয়ে যেতে পারতাম—।”

”আচ্ছা পিসি, তোমাদের জি.সি.দত্ত তো পুলিশ অফিসার ছিলেন, ওঁকে বলে দেখলে হয় না?” শ্যামলা বলল।

”তিনি কী করবেন?” হিমাদ্রি কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যভরে জানতে চাইল।

”উনি তো বলেন খোকাগুণ্ডা না কাকে যেন পিস্তল সমেত ধরে ফেলেছিলেন। তা এখানেও তো পিস্তল নিয়ে একজন রয়েছে, তাকে এসে ধরুন না, আর দাদাও বাড়ি থেকে সেই ফাঁকে বেরিয়ে যাবে।” শ্যামলা খুব সহজ একটা সমাধান পেশ করে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।

”এই রাতে বেরিয়ে কোথায় যাবে?” হিমাদ্রি বিশদ হতে চাইল।

”কোথাও একটা, এখানেই কারও বাড়িতে।” আমতা আমতা করে শ্যামলা বলল।

”তারপর?” সমীরণ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

”মলা ঠিকই বলেছে, দত্তবাবু ধরুন বা না—ধরুন, ওদের ভয় তো দেখাতে পারবেন।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই রেখা গুপ্ত ফোনের কাছে উঠে গেলেন।

”পিসি তুমি এদের চেনো না।” সমীরণ উঠে এল। ”এদের ভয় দেখানো দত্তবাবুর কর্ম নয়।”

রেখা গুপ্ত ততক্ষণে ডায়ালে পঞ্চাশ সংখ্যাটি ঘুরিয়ে ফেলেছেন। সমীরণ হালছাড়া ভাবে ঘরে এসে পরদা সরিয়ে বাইরে তাকাল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওদের কাউকে দেখতে পেল না। তার বদলে স্বামী—স্ত্রী আর একটা বাচ্চচা ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখল। ছাদে গিয়ে পাঁচিলের আড়াল থেকে কাউকে দেখা যায় যদি, এই ভেবে সে সিঁড়ির দিকে এগোল। পিসির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে শুনল—”তা হলে আর বলছি কী, দারুণ গুপ্তা, আপনি যেমনটি পছন্দ করেন ঠিক সেইরকম।”

”পিসি বলো পিস্তলও আছে।” শ্যামলার ব্যগ্র স্বর।

”না, ওসব বললে দত্তবাবু খেপে যেতে পারেন।” রিসিভারে হাতচাপা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে পিসিকে বলতে শুনল সমীরণ, সিঁড়িতে ঘোরার সময়।

সুনীলবরণের ঘরের দরজায় পরদা ঝুলছে। সামান্য ফাঁক, তার মধ্যে দিয়ে একনজরে সমীরণ দেখতে পেল টেবিলে ঝুঁকে বাবা কিছু লিখছেন। মোটা দু’খানা বই খোলা রয়েছে। সন্তর্পণে দরজা পার হয়ে গুঁড়ি মেরে সে চোখ দুটি শুধু পাঁচিলের কিনারে রাখল।

বাঁ দিক থেকে তিনজন বেড়াবার মতো শ্লথভঙ্গিতে আসছে। দূর থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল, ”অ্যাই, অ্যাই।”

ওরা তিনজন ঘুরে দাঁড়াল। সমীরণ মুখটা একটু তুলে দেখতে পেল, লুঙ্গি আর গেঞ্জিপরা জি.সি. দত্তর দশাসই চেহারাটি বেগিং—এর গতিতে এগিয়ে আসছে।

”কে তোমরা এখানে এত রাতে কী করছ?” দত্তর উচ্চ স্বরে দুটো বাড়ির বারান্দায় লোক টেনে আনল, একতলার জানলা খুলিয়ে দিল।

তিনজন কী জবাব দিল সমীরণ তা শুনতে পেল না। দত্ত যে জবাবে একদমই সন্তুষ্ট হননি, সেটা তাঁর আচরণে প্রকাশিত হল। খপ করে তিনি পুলিশি কায়দায় দু’জনের জামার কলার ধরলেন।

”আমাকে ধোঁকা দেবে? তোমাদের উদ্দেশ্য আমি বুঝিনি ভেবেছ? এত বছর পুলিশে—” কথা অসমাপ্ত রেখে জি. সি. দত্ত হঠাৎই কণ্ঠস্বর বদলে, ”অ্যাই, অ্যাই কী হচ্ছে।” বলতে বলতে দু’হাতে লুঙ্গি চেপে ধরলেন। তারপরই ”য়্যা—আ—আ” ধরনের একটা শব্দ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত মাথার ওপর ওঠালেন। লুঙ্গিটি তখন তাঁর পায়ের গোছে নেমে এল।

জি.সি. দত্ত কাতরকণ্ঠে কী যেন বললেন। বাপির গলা শোনা গেল, ”তুলে বেঁধে দে।”

একজন লুঙ্গিটা তুলে দত্তর কোমরে গ্রন্থিবদ্ধ করে দিল। সমীরণ এইবার দেখতে পেল বাপির হাতের পিস্তলটা। বাপি কিছু একটা বলল। দত্ত দু’হাত তোলা অবস্থাতেই ঘুরলেন। এই সময় দোতলার বারান্দাগুলো নিমেষে নির্জন হয়ে গেল, জানলার পাল্লাগুলো ফট ফট শব্দে বন্ধ হল। বাপি ঝুঁকে দত্তর কানে কিছু বলেই পিস্তলের নলটা দিয়ে খোঁচা দিল।

সঙ্গে সঙ্গে জি. সি. দত্ত দু’হাত তুলে বাড়িমুখো রওনা হলেন। একটা ব্যাপার সমীরণ বুঝতে পারছে, জি. সি. দত্ত পরোপকারী, আন্তরিক, দরাজ মানুষ, না হলে এইভাবে, ফোন পাওয়ামাত্রই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছুটে আসতেন না। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবের সঙ্গে ওঁর তেমন কোনও যোগ নেই। উনি এখনও খোকাগুণ্ডার আমলেই রয়ে গেছেন, বাপিগুণ্ডাদের সম্মুখীন কখনও হননি।

ডান দিক থেকে দু’জন আসছে। সমীরণ মুখটা নামিয়ে নিল। তাদের বাড়ির সামনেই পাঁচজন দাঁড়াল। হাসাহাসি করল। একজন বলল, ”আরে, এখানে শিক্ষিত লোকেরা থাকে। কেউ ঝামেলা করবে না।”

আর—একজন বলল, ”বাপিদা খিদে পেয়েছে।”

”বাইরে বড় রাস্তায় দেখেছি তারামা না ফারামা নামে একটা দোকান রয়েছে, তোরা খেয়ে আয়। আচ্ছা, চল, আমিও যাচ্ছি, গোরা তুই তা হলে এখানে থাক। আবার কেউ হুজ্জত করতে এলে কিছু বলবি না, কাটিয়ে বেরিয়ে চলে আসবি।” বাপি গলা নামিয়ে কথা বলার দরকার আর বোধ করছে না। প্রতিটি কথা সমীরণ শুনতে পেল।

চারজন মন্থর গতিতে ভি আই পি রোডে মিষ্টির দোকানে খাওয়ার জন্য সুশোভন পল্লির প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেল। সমীরণ ছাদ থেকে নীচে নামার সময় শুনতে পেল টেলিফোনে পিসি কথা বলছে।

”বলছেন কী দত্তবাবু?…আপনি দু’জনের ঘাড় ধরে…তা হলে ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই?…তা তো হবেই, আপনাকে আর চিনবে না।…হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেন কী, খেলনা পিস্তল!…তাই বলুন, আচ্ছা আচ্ছা।”

টেলিফোন রেখে উদ্ভাসিত মুখে রেখা গুপ্ত কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, সমীরণ তাঁকে থামিয়ে বলল, ”পিসি ঘুনু মিত্তির যে টেলিফোন নাম্বারটা দিয়ে গেল সেটা কোথায়? মলা, তুই টুকে রেখেছিস।”

”কেন, ঘুনু মিত্তির কী করবে?” রেখা গুপ্ত বিভ্রান্ত।

”এখন ওর বুদ্ধিটাই দরকার। বাপিদের মোকাবিলা ওকে ছাড়া সম্ভব নয়।” সমীরণ টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল।

শ্যামলা ফোন নাম্বার লেখা কাগজটা দিতেই সমীরণ ডায়াল করল।

”হ্যালো, এটা কি পতিতপাবন ঘোষের বাড়ি?”

”হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?” সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন এল।

”আমার নাম সমীরণ গুপ্ত, আমি ঘুনুদার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

ওধারে কিছুক্ষণ কথা বন্ধ। ফিসফিস করে কাকে তখন বলা হচ্ছে ”সমীরণ, সমীরণ গুপ্ত।”

”হ্যালো…।”

”ঘুনুদা তো এখানে নেই, বাড়িতে চলে গেছেন। আপনার কী দরকার বলুন।”

”ওঁর বাড়ির ফোন নাম্বারটা দিন, দরকারটা ওঁকেই বলব।”

নাম্বার লিখে নিয়ে ঘুনু মিত্তিরের বাড়িতে সমীরণ ফোন করল। ”হ্যালো” শুনেই সে বুঝতে পারল ঘুনুদা রিসিভার তুলেছেন।

”আমি নাকু বলছি।”

”বল। বটার ছেলেরা তো তোর বাড়িতে গেছে।” নিশ্চিন্তে চিবিয়ে চিবিয়ে ঘুনু বললেন।

”আমি সারথিতে থাকব না ঠিক করেছি। এখনই আমাকে বের করে নিয়ে যান।” কথাক’টি বলতে গিয়ে সমীরণের হাঁফ ধরল। টানটান হল হাতের পেশি। বুকের কাছে চিনচিন করে উঠল। তিন বছরের সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে কষ্ট তো হবেই। কিন্তু এখন দুঃখে মুহ্যমান হওয়ার সময় নেই।

ঘুনু কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন কথাগুলো মগজের ভেতর—দেশে চালানোর জন্য। চমকে উঠলেন না, উল্লসিত হলেন না, ধীর শান্ত গলায় বললেন, ”এখন তোর পজিশনটা কী?”

”বাড়িতে বন্দি। রাস্তায় পাঁচজন ঘোরাফেরা করছে। একজনের কাছে চেম্বার আছে।”

”অ। গোলমালের মধ্যে গিয়ে কোনও লাভ নেই। তুই যে—কোনওভাবেই হোক, আজ রাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবি? আমি গাড়ি নিয়ে থাকব কোথাও। এসব কাজে দেরি করতে নেই।”

”বেরোনো?” সমীরণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, ”ছাদ থেকে বাড়ির পেছনদিকে নেমে একটা মাঠ, ইলেকট্রিকের মাঠ।”

”আলোটালো নেই তো? অন্ধকার তো?”

”একদম ঘুটঘুটে।”

”এখন আর বেশি কথা নয়। আমি ওই মাঠের ধারে, রাস্তায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব, ঠিক দুটোয়।”

”আপনি চিনে আসতে পারবেন মাঠে?”

”আরে, আমি ঘুনু মিত্তির। তারামা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গা দিয়ে শহিদ কলোনির দিকে যাওয়ার রাস্তা, মাঠটা তো তার ওপরই। বরেন মুখোটি ওই মাঠেই ট্রেনিং করায় না?”

”হ্যাঁ।”

”হুঁ হুঁ বাবা, এ হল ঘুনু মিত্তিরের মেমারি। শোন, ঠিক দুটোয় নেমে আসবি। ছেলেগুলো তখন কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে আগে সেটা দেখে নিবি। ছাড়ছি। ঠিক দুটোয়।”

তিনজন হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে। সমীরণ ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ব্যাগটা কোথায়? শার্ট, প্যান্ট, টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, শেভিংকিট…পিসি হাজার তিনেক টাকা কাল কানুকে দিয়ে আমার জন্য প্লেনের টিকিট কেটে রাখবে। কানু, একুশ তারিখের কোঝিকোড়ের টিকিট, ভায়া বোম্বে, একদিনেই তা হলে পৌঁছতে পারব। না পেলে বাঙ্গালোরের, ওখান থেকে ঘণ্টা দশেকের বাস—জার্নি। ঘুনুদা ঠিক দুটোয় ইলেকট্রিক মাঠের ঘরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন। আমি ছাদ থেকে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠব।”

”উঠে কোথায় যাবি?” উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন রেখা গুপ্তর।

”জানি না।”

সমীরণ ঘরে ঢুকে গেল। আলো জ্বালবে কি জ্বালবে না ভাবতে ভাবতে জ্বেলেই ফেলল। জানলার পরদা সরিয়ে দিয়ে কাঁধে ঝোলানোর পলিথিন ট্রাভেলিং ব্যাগটা আলনা থেকে নামাল। রাস্তা থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে। স্লিপিং সুট ব্যাগ থেকে বের করে নাড়াচাড়া করল। সে যে এখন ঘুমোতে যাচ্ছে, এটা যেন ওরা বুঝে যায়। আলো নিভিয়ে ডোরাকাটা পাজামা আর ঢিলে জামাটা পরে নিয়ে আবার আলো জ্বালাল। এইসব করার সময় সে একবারও বাইরের দিকে তাকাল না।

শ্যামলাকে ডেকে এক গ্লাস জল চাইল। জল খেয়ে গ্লাসটা ওর হাতে দেওয়ার সময় সে বলল, ”তোরা খেতে বোস টেবিলে, আমারটা এখানে দিয়ে যা, ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাব, শোব, তুই মশারিটা ফেলে গুঁজে দিবি, আলো নেভাবি। সব যেন নর্মাল ভাবে হয়। আর শোন, ছাদ থেকে নামার জন্য একটা শাড়ি কি বেডকভার ঠিক করে রাখ। ঠিক দেড়টায়, সারা বাড়ি যেন অন্ধকার থাকে।”

 ।। ৮।।

বাড়ি অন্ধকারই ছিল। জানলার পরদা অল্প সরিয়ে হিমাদ্রি এবার—ওধার তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, ”কাউকে তো দেখছি না।”

”সর, আমি দেখছি।” শ্যামলাও রাস্তার দু’ধারে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে না। জানলার ধার ঘেঁষে মাথাটা চেপে, এক চোখ দিয়ে বাঁ দিকটা দেখতে দেখতে সে এবার অস্ফুট শব্দ করে ছিটকে সরে এল।

”কী কাণ্ড! ওরা আমাদের বাইরের বারান্দায় শুয়ে রয়েছে।”

”ভালই হয়েছে। পাঁচজনই আছে কি?” হিমাদ্রির গলায় খুশি ফুটে উঠল।

”সবটা তো দেখা যায় না, তা ছাড়া রাস্তার আলোও তো কম।” শ্যামলার চাপা স্বর।

”দরজা জুড়ে শুয়েছে পালানোর পথ বন্ধ করার জন্য। এভাবেই যেন শুয়ে থাকে। দাদা চটপট এবার রেডি হয়ে নে।”

”রেডিই আছি। এই স্লিপিং সুট পরেই চলে যাব। একটা বেডকভারেই তো হয়ে যাবে, আর—একটা জোড়ার দরকার কী?”

”দরকার আছে। কানু ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দেখেছে জমির অনেক ওপর পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। লাফিয়ে পড়লে শব্দ হবে।” রেখা গুপ্ত বেডকভারটা আঁকড়ে বললেন, ”আমি আর—একটা বেঁধে নিয়েছি। ছাদে চল। আর শোন, যেখানেই যা, পৌঁছেই ফোন করে জানাবি কিন্তু।”

সুনীলবরণের ঘরের দরজা বন্ধ। চারজন নিঃসাড়ে ঘরটা পেরিয়ে পাঁচিলের ধারে এল। নীচেই বাড়ির পেছনে সরু গলি। তারপর পাঁচ ফুট উঁচু সীমানার পাঁচিল। ওটাও সমীরণকে টপকাতে হবে এবং বহুবারই সে এটা করেছে মাঠে যাওয়ার জন্য শর্টকাট করতে গিয়ে।

বেডকভার ঝুলিয়ে হিমাদ্রি আর শ্যামলা ধরে রইল। কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে সমীরণ কার্নিসে নেমে বেডকভার আঁকড়ে সন্তর্পণে একটা পা প্রথমে ঝোলাল। পা রাখার মতো জায়গা নেই।

”দুর্গা, দুর্গা।” পাঁচিলে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে রেখা গুপ্ত ভাইপোর মাথা স্পর্শ করলেন।

হিমাদ্রি ও শ্যামলা প্রাণপণে টেনে রয়েছে। প্রায় সত্তর কেজি ওজনের টান সামলাতে দু’জনেরই দাঁতে দাঁত লেগে গেছে।

”আহহ”, সমীরণ কাতরে উঠল।

”কী হল নাকু?” রেখা গুপ্ত ঝুঁকে পড়লেন।

”একটু টেনে তোলো, একটা শিক, তাড়াতাড়ি, লাগছে।

রেখা গুপ্ত প্রায় লাফিয়েই এসে বেডকভার ধরলেন। তার ধাক্কায় হিমাদ্রির মুঠো আলগা হয়ে গেল। অবশ্য পিসির মুঠো ততক্ষণে শক্ত করে ধরে ফেলেছে। একটা টানেই তিনি সমীরণকে প্রায় দু’হাত তুলে নিলেন।

”কানু জিজ্ঞেস কর, আর তুলব?”

হিমাদ্রি পাঁচিলে ঝুঁকে ফিসফিস করে ফিরে এল। ”এইভাবে ধরে থাকতে বলল।”

রেখা গুপ্ত বেডকভার ধরে শরীরটা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি পেছনে হেলিয়ে দিলেন। টানটান বেডকভার হঠাৎই ঢিলে হয়ে গেল, আর রেখা গুপ্ত ছাদের ওপর চিত হয়ে পড়লেন, শ্যামলাকে বুকের ওপর নিয়ে।

”নাকু তা হলে এখন মাটিতে।” রেখা গুপ্তর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় আশ্বস্তের ভাগটাই বেশি। ধড়মড়িয়ে উঠে তিনি পাঁচিলের কাছে যাওয়ার আগে, বেড়ালের মতো লাফিয়ে পাঁচিল টপকে সমীরণ ইলেকট্রিক মাঠে নেমে পড়েছে।

তিনজন তীক্ষ্ন নজরে অন্ধকার চিরে চিরে সমীরণকে খুঁজে পেল না। একটু পরে মোটর স্টার্ট দেওয়ার ক্ষীণ শব্দ পেয়ে শ্যামলা তালি দিয়ে উঠল। হিমাদ্রি বলল, ”সেফলি পৌঁছে গেছে।” রেখা গুপ্ত জোড়হাত কপালে ঠেকালেন।

কী বা অন্ধকার কী বা আলো, ইলেকট্রিক মাঠটাকে সমীরণ চেনে তার হাতের রেখাগুলোর মতো। তার একটাই শুধু ভয় ছিল, কাছাকাছি কুকুরগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না। রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে সে খুঁজল মোটরগাড়ি। যে মারুতিটায় ঘুনুদা এসেছিলেন নিশ্চয় সেটাতেই আসবেন। কুকুরের ডাক উঠল না, তবে ছোট্ট করে একবার হর্ন বেজে উঠল। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা মোটরের ছায়া দেখে সে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল।

”ঢুকে পড়।” দরজা খুলে মিষ্টি স্বরে ডাক দিলেন। গাড়ির এঞ্জিন চালু হয়ে গেছে। সমীরণ পেছনের সিটে বসে দরজা বন্ধ করার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

”কোনও ঝামেলা হয়নি?” ঘুনু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন। ভি আই পি রোডে পড়ে ডান দিকে সবেগে বাঁক নিয়েই নির্জন রাস্তায় মারুতি প্রায় উড়ে চলল।

”ছেলেগুলো আমাদের বাইরের বারান্দায় ঘুমোচ্ছে। কাল সকালে যখন জানতে পারবে, কী যে তখন করবে কে জানে।”

”কিছু করতে পারবে না। তোর পিসিকে যতটুকু বুঝেছি তাতে এটুকু বলতে পারি, হাড়গোড় আস্ত রেখে সবকটা যদি ফিরে যেতে পারে তা হলে সেটা হবে ওদের বাপের ভাগ্যি।”

”ঘুনুদা, এখন কোথায় যাচ্ছি?”

”যেখানে তুই সবথেকে নিরাপদ থাকবি পতুর বাড়ি।”

এতক্ষণে সমীরণের খেয়াল হল, পেছনের সিটে আর—একজন বসে রয়েছে। অন্ধকারে তাকে চিনতে পারল না।

”আমি দুলালদা।”

সমীরণ ‘অ্যাঁ’ বলে চমকে উঠতে যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে বলল, ”তুমিও সারথি ছাড়লে?”

”হ্যাঁ। নির্মাল্যদার জেতার কোনও আশা নেই।” দুলাল মৃদুস্বরে কথাটা বলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

উল্টোডাঙা মোড়, ফুলবাগান, বেলেঘাটা রোড, কনভেন্ট রোড হয়ে সি. আই. টি. রোড এবং পতু ঘোষের বিরাট পাঁচতলা বাড়ির গেট দিয়ে মারুতি যখন ঢুকল তখন রাত আড়াইটে।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে পর পর দুটো দরজা। বাঁ দিকেরটির ডোর বেল বাজিয়ে ডান দিকের দরজাটি দেখিয়ে ঘুনু বললেন, ”পতুর প্রাইভেট ড্রইংরুম। অবশ্য ভেতর দিয়েও ওদিকে যাওয়ার দরজা আছে।”

ঘুম—চোখে দরজা খুলল অল্পবয়সি একটি ছেলে। ভেতরে ঢুকে সমীরণ ঘরটা দেখল। দেয়াল থেকে দেয়াল কার্পেট, তাতে পা ডুবে যায়, এত পুরু আর নরম। নিচু টেবিল, কোচ, সোফা, টিভি, টেবিল ল্যাম্প, এয়ার কুলার, আলমারিতে বই, দেয়ালে কয়েকটা পেইন্টিং, রেফ্রিজারেটর, ইনভারটার, জানলায় মেঝে—ছোঁয়া ভারী পরদা। তার দেয়ালে বিচিত্র লাইট শেড। এটা বসার ঘর। এর একদিকের দেয়ালে পাশাপাশি দুটি ঘরের দরজা।

ঘুনু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”দেবু, খাবারদাবার কী আছে?”

”বিরিয়ানি আর কড়াপাকের সন্দেশ আছে।”

”নাকু?”

”না, না, ঘুনুদা, আমি খেয়ে এসেছি।”

”লজ্জা করিস না। এখানে অঢেল ব্যবস্থা। যা খেতে ইচ্ছে করবে দেবুকে বলবি। তুষার তো কাল থেকে শুধু ফিশফ্রাই আর চিনে খাবারই খেয়ে যাচ্ছে।”

”তুষারদা এখানে?”

”বুকুও তো রয়েছে। কড়াপাক বোধ হয় ওর জন্যই আনা?” ঘুনু তাকালেন দেবুর দিকে।

”আজ পঁচিশটা এনেছি, বুকুদা পনেরোটা খেয়ে নিয়েছে।”

”ভাল। গরিবের ছেলে তো, একটু খাই খাই ভাব রয়ে গেছে। নাকু তুই দুলালের সঙ্গেই এক ঘরে থাক।” পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করলেন।

”আগে একটা টেলিফোন করব পিসিকে।”

”টেলিফোন? কিন্তু ওটা তো ওদিককার ড্রইং রুমে। দরজার চাবি দেওয়া।” ঘুনু আমতা আমতা করলেন। ”কাল সকালে করিস।”

দেবু একবার ঘুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সিলিংয়ে তুলল। দুলাল বলল, ”ঘুম পাচ্ছে, আয়।”

”আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি, কথাটথা কাল হবে। অবশ্য বলার মতো কথা আর কীই—বা আছে। নিজেই এলি, এতে আমার কী আনন্দই যে হচ্ছে। তোর কোনও ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হবে না। ক্লাব পলিটিক্স কলকাতায় কী রকম হয় তা তো জানিসই। সুবোধ কি সীতেশ চেষ্টা করবে তোকে খচাবার, কিন্তু পারবে না। যা এখন, শুয়ে পড়।”

ঘুনু চলে গেলেন। দুলালের সঙ্গে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই সমীরণের মনে হল কোনও ফাইভ স্টার হোটেলের ঘরে যেন সে ঢুকল।

”পুতুদার গেস্টরা এসে এখানে থাকে, সেইভাবেই সাজানো। কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার, কয়লা আর স্টিল… কোটি কোটি টাকা।” দুলাল সসম্ভ্রমে বলল পাজামা পরতে পরতে। ”কিন্তু মানুষটাকে দেখে তোর মনেই হবে না, এত টাকার মালিক। ব্যবসার কাজে এখন কানপুর গেছে… তুই কতয় এলি?”

”দুই—দশ অফার দিয়েছেন ঘুনুদা।”

”রাজি হয়ে ভালই করেছিস। সারথিতে থাকলে পুরো টাকা কখনওই পেতিস না। আমি এখনও পনেরো হাজার পাব, কিন্তু বটা বিশ্বাস আটকে রেখেছে। যাত্রী দেবে পৌনে দুই, ওখানের থেকে পঁচিশ বেশি।”

”দুলালদা, এখন এসব টাকাপয়সার কথা থাক। তিনটে বাজতে চলল, এবার শোব।” সমীরণ বালিশটা কার্পেটের ওপর ছুড়ে দিয়ে বিছানা থেকে বেডকভারটা তুলে নিল।

”তুই মেঝেয় শুবি?”

”নিশ্চয়ই। ওই ফোম রবারের ওপর শুলে আরাম পাওয়া যায়, কিন্তু শরীরটার তেরোটা বাজবে। এই এয়ার কুলারের ঠান্ডাটা খুবই আরামের, তবে আমার পছন্দ পাখার হাওয়া।”

”এয়ার কুলার কিন্তু আমি বন্ধ করব না।” দুলাল বেশ কড়া গলায় সমীরণকে জানিয়ে দিল।

”আলো নেভাব?”

”হ্যাঁ।”

আলো নিভিয়ে, স্লিপিং সুট পরা সমীরণ বেডকভারটা গায়ের ওপর টেনে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর দুলাল বলল, ”সমীরণ, একটা কথা বলব?”

”হুঁ, বলো।”

”তুই কেন জানি একটু অন্যরকম। সেজন্যই তোকে আমার ভাল লাগে। লেখাপড়া করা প্লেয়ার বা আমার মতো ‘ক—অক্ষর গোমাংস’ প্লেয়ার কম তো দেখলাম না,কেউ কিন্তু গভীর শ্রদ্ধা ফুটবলকে দেয় না। দিলে সে সবার আগে শরীরের যত্ন নিত, ক্ষমতা বাড়াত, স্কিল বাড়াত, ডিসিপ্লিন লাইফ লিড করত। কিন্তু শ্রদ্ধা যে আনব বা দেব তারও তো একটা সঙ্গত কারণ থাকা চাই। বেশিরভাগই আমার মতো গরিব ঘর থেকে এসেছে, অশিক্ষিত। সবার আগে নিরাপত্তা, টাকা, এটাই আমাদের মাথায় থাকে। এটা কি অন্যায়?”

”অন্যায় তো নয়ই, প্রফেশনালিজমের এটাই আসল ভিত।”

”বলছিস?”

”হুঁ। টাকার জন্যই মারাদোনা, গাওস্কর, লেন্ডল, কার্ল লুইসরা ফর্ম ধরে রাখতে প্রাণপণ করে গেছেন আর সাকসেসও পেয়েছেন। তুমি—আমি তো কোন ছার। টাকাকে অশ্রদ্ধা কোনওমতেই করা উচিত নয়। আসলে আমাদের পরিবেশটাই এত খারাপ যে, এক লাখ কি দু’লাখ পাচ্ছি শুনলেই লোকে চমকে ওঠে। এরা একবারও ভেবে দেখে না টিভি—তে যাদের খেলা দেখে আহা আহা করে তারা বছরে কোটি টাকা পায়। তাদের একটা নিরাপত্তা আছে। এখানে আমার কী আছে?”

”কিচ্ছু নেই। আর সেজন্যই আমাকে উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়।”

”তা হলে এবার তুমি ঘুমোও।”

সমীরণ বেডকভার টেনে নিজেকে ঢেকে দিল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেবুর দেখা গেল।

”চা দেব?”

”হ্যাঁ, তার আগে ফোন করব।”

”যান না ও—ঘরে, ঘরের দরজা তো শুধু বন্ধ করা।”

”চাবি দেওয়া নয়?”

কালকের মতো সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেবু বলল, ”ঘুনুবাবুর কথার ওপর কথা বলা বারণ।”

সমীরণ দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ”চিরটাকাল একই রকম থেকে গেল।”

তিক্ততায় ভরে উঠল সমীরণ। এত টাকা খরচ করছে যাত্রী ভাল একটা দল গড়ার জন্য, অথচ এইসব ক্ষুদ্রতা নীচতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না।

পতু ঘোষের ব্যক্তিগত ড্রইংরুম তার গেস্টরুম থেকে একটু বেশি সমৃদ্ধ। পরদার এবং সোফার কাপড় আরও দামি, কার্পেটের নকশা আলাদা, দেওয়ালে পেইন্টিং তো আছেই। তা ছাড়া করাত দিয়ে কাটা বাকলসহ বিশাল একটা গাছের গুঁড়ির টুকরো রাখা হয়েছে, ঘরের একধারে। ফোনের রিসিভারেই ডায়াল বাটন।

”হ্যালো, কে মলা?”

”দাদা?”

”খবর কী, ওই ছেলেগুলো—”

”আ বলিসনি। পিসি তো আজ বেগিংয়ে বেরোয়নি। কাল ছাদে পড়ে গিয়ে কোমরে লেগেছে। এখন বিছানায়। আমি মাদার ডেয়ারির বুথ থেকে দুধ আনতে যাব বলে দরজা খুলে বেরিয়েই দেখি পাঁচ মূর্তি বসে রয়েছে বারান্দায়। বললাম, ”এ কী আপনারা বাড়ির মধ্যে কেন?” একজন বলল, ”পিসির সঙ্গে সমীরণদা কথা বলা কি শেষ হয়েছে? তাড়াতাড়ি আসতে বলুন।” বললাম, ”কাকে আসতে বলব?” বলল, ”সমীরণদাকে। বটাদা বলে দিয়েছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে।” তখন বললাম, ”দাদা তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে চলে গেছে।” তাই শুনেই তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ। ভেতরে ঢুকে সব ঘর, ছাদ তন্নতন্ন করে দেখে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, ”কোথায় গেছে সমীরণদা, বলুন কোথায় গেছে?” কানু বলল, ”কলকাতার ফুটবলের হাল দেখে বোধ হয় সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় চলে গেছে।” আমি বললাম, ”দাদা তো সন্ন্যাসী হওয়ার লোক নয়, দেখুন গিয়ে তারামা’য় বসে হয়তো জিলিপি খাচ্ছে।” শোনামাত্র পড়িমড়ি দৌড়ল তারামা’র দিকে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল চলে যাওয়ার সময় ওদের মুখ দেখে।”

”মলা শোন, আমি এখন পতু ঘোষের বাড়িতে। ফোন নাম্বারটা রেখে দিস, দরকার হলেই ফোন করবি।”

”জায়গাটা কেমন?”

”ফুটবলারদের ধ্বংস করার জন্য যা দরকার সেটা এখানে ভালমতোই আছে, প্রচুর টাকা, প্রচুর আরাম। ভাল কথা, কানু যেন প্লেনের টিকিটটা কেটে রাখে।”

”ওখানেও কি জেলখানা?”

”বুঝতে পারছি না, কয়েক ঘণ্টা তো এসেছি। আজকের দিনটা দেখে বুঝতে পারব।”

”পিসিকে কিছু বলতে হবে?”

”না, না, কিছু বলার দরকার নেই। শুয়ে থাকতে দে। মনে হয় না বটা বিশ্বাস বাড়িতে এসে গোলমাল করবে, এখন রাখছি।”

গেস্টরুমগুলোর লাগোয়া, ঘরের মাপের একটা ডাইনিং স্পেস। ছ’জনের জন্য একটা টেবিল। পরদা টেনে দিলেই এই খাবার জায়গাটা বসার জায়গা থেকে আলাদা হয়ে যায়। টেবিলে দেবু থরে থরে খাদ্য সাজিয়ে রেখেছে। বিশাল এক বৌলে স্যালাড। আপেল, কলা, আঙুর, স্তূপ করা। বাটিভরা মাখন আর জেলি। প্লেটে দুধে ডোবানো কর্নফ্লেকস। ধরে ধরে সাজানো সেঁকা পাউরুটি। কড়াপাকের সন্দেশ।

দুলাল ছুরি দিয়ে মাখন লাগাচ্ছে রুটিতে, এক একটা স্লাইসে প্রায় একশো গ্রাম। তুষার বিরক্ত চোখে মাখনের বাটিটা পাওয়ার জন্য তাকিয়ে রয়েছে দুলালের দিকে। বুকু অবাক হয়ে গেল সমীরণকে দেখে।

”তুই! এখানে?”

”কাল রাত্তিরে এসেছে”, তুষার একদৃষ্টে মাখনের বাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”কীরে দুলে, রুটির ওপর মাখনের ড্রিবলিং অনেকক্ষণ তো চালাচ্ছিস, এবার পাসটা বাড়া।”

”তুই জেলি মাখানো শুরু কর না। ওভারল্যাপটা কখনওই ঠিক সময়ে তোর দ্বারা আর হয়ে ওঠে না। আচ্ছা এই নে।”

দুলালের ঠেলে দেওয়া মাখনের বাটিটার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে তুষার বলল, ”এটা নিয়ে করব কী! কিছুই তো রাখিসনি। চিরকালই তোর ফাইনাল পাসটা এমন জায়গায় হয় যে, গোল আর করা যায় না। সন্দেশের প্লেটে কিন্তু হাত দিবি না বলে রাখলুম।”

”ওটা বুকুর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নে।” গোলমরিচের গুঁড়ো রুটিতে ছিটিয়ে কামড় বসাবার আগে দুলাল বলল।

”নাকু, তুই তো সারথিতেই থেকে যাবি শুনেছিলাম!” বুকুর বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি।

”মত বদলালাম।”

”কেন? দরে পোষাল না?”

সমীরণ উত্তর দিতে গিয়েও দিল না। শুধু মাথা নাড়ল। বুকু চোখ সরু করে তেরছা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল। সমীরণ প্লেটে স্যালাড তুলতে তুলতে সেটা লক্ষ করে হাসল।

”নাকু তুই হাসলি যে?” দুলাল বলল।

”সারথির পাঁচটা ছেলে বাড়ির সামনে পাহারা দিচ্ছিল কাল রাতে। এখন বটাদা তাদের কী বলছে সেটা মনে করেই হাসি পেল। আচ্ছা দুলালদা, পৃথিবীতে আর কোনও দেশে কি এইভাবে দলবদলের আগে ফুটবলারদের গাধা—গোরুর মতো খোঁয়াড়ে পোরা হয়?”

”একটা দারুণ কথা নাকু তুই বললি।” তুষার মুখভরা রুটির মধ্যে একটা ফাঁক তৈরি করে বাক্যটি বের করে আনল। ”মানুষকে গাধা—গোরু কখনওই বানানো যায় না যদি না সে নিজেই তা হতে চায়। আমরা হতে চেয়েছি তাই ওরা বানিয়েছে। না চাইলে বানাতে পারত না। এখানে লাস্ট চারটে ওয়ার্ল্ড কাপের সাত—আটটা ম্যাচের ক্যাসেট আছে। তুই তার যে—কোনও একটা ম্যাচ দ্যাখ। তোর মনে হবে গাধা—গোরুরা নয়, বাঘ—সিংহের লড়াই হচ্ছে। ওদের খোঁয়াড়ে ভরার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাববে না।… দুলে কড়াপাকের দিকে আর তাকাসনি বাবা। আগের সিজনে বুকু যে—ক’টা সিটার মিস করেছে ঠিক সেই ক’টাই এখন রয়েছে। ওর থেকে যদি খাস—।” তুষারের কথা থেমে গেল। রাগ করে বুকু উঠে পড়েছে।

”সব সময় পেছনে লাগার স্বভাবটা তোমার আর গেল না। আমি ক’টা মিস করেছি তার ফর্দ তুমি রেখেছ, আর তুমি ক’টা গলিয়েছ তার হিসাবটাও কি রাখো?”

”রাখি।” নির্বিকার মুখে তুষার বলল। যত্নভরে কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে সে আড়চোখে একবার সমীরণের দিকে তাকাল! ”কলকাতার মাঠে লাস্ট সিজনে চারবার বিট হয়েছি শুধু নাকুর কাছে। কিন্তু ও গোল দিতে পারেনি। হ্যাঁ মানছি, চারবারই সারথির পেনাল্টি পাওয়া উচিত ছিল। এবার আর নাকুকে মেরে থামাতে হবে না ভেবে পুণ্য অর্জনের সম্ভাবনায় ঠিক করেছি স্যাক্রিফাইস করব।”

তিনজোড়া চোখ তুষারের ওপর গেঁথে গেল।

”সন্দেশগুলো, বুকু তুই একাই খেয়ে নে।”

”আমার মুশকিলটা কী জানো তুষারদা, তোমার এগেনস্টে খেলার সুযোগ একবারও পেলাম না। পেলে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে পারতাম…।” বুকু অর্থপূর্ণ হাসি তিনজনকে উপহার দিল।

তুষার ভ্রূ তুলে বলল, ”কী বুঝিয়ে দিতিস?”

”বুঝিয়ে দিতাম তোমার রিটায়ার করার সময় এসে গেছে।”

বুকু কথাটা বলেই টেবিল থেকে উঠে বসার জায়গায় গিয়ে টিভি সেটের সুইচ টিপল। ধীরে ধীরে তুষারের মুখ থমথমে হয়ে উঠল।

”খবরের কাগজ কখন আসে?” সমীরণ বলল প্রসঙ্গটা সহজ করার জন্য দুলালকে লক্ষ্য করে। এইসব আকচাআকচি, হিংসা, মনোমালিন্য তার মনটাকে ঘুলিয়ে দেয়। সে শুনেছে ক্লাবে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এই দু’জনের মধ্যে লড়াই চলছে। দু’জনে দুই কর্তার প্লেয়ার।

”আসে না।”

”মানে? তোমরা কাগজ পড়ো না?”

”পড়ি।”

”তা হলে?”

”তা হলে আবার কী?” দুলাল বিরক্তিভরে বলল, ”আমাদের খবরের কাগজ পড়া বারণ, তাই আসে না।”

স্তম্ভিত হয়ে গেল সমীরণ। সে বুঝে উঠতে পারছে না কাগজ পড়ার মতো একটা সাধারণ ব্যাপারে আপত্তি কেন?

দুলাল ওর মনের কথাটা আন্দাজ করেই বলল, ”ক্লাব অফিসিয়ালদের বিবৃতি, ইন্টারভিউ, প্লেয়ারদের হাম্বা হাম্বা, কে কাকে ধরতে গিয়ে ফসকে গেল, কে বলছে অমুক ক্লাবে খেলব তমুক ক্লাবে যাব না, কাকে কত টাকা অ্যাডভ্যান্স দেওয়া হল আর কে অ্যাডভান্স নিয়েও বিরোধী ক্যাম্পে গিয়ে উঠল, অফিসিয়ালদের কে নিজের ক্লাবের বিরুদ্ধেই কথা বলল—এইসব যাতে আমরা জেনে না যাই সেজন্যই খবরের কাগজ দেওয়া হয় না।” দুলাল ফিক ফিক হেসে চামচে কর্নফ্লেকস তুলে মুখে দিল।

”এটা অত্যন্ত অন্যায়, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।” সমীরণ রেগে উঠল।

দুলাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল দেবু এসে তাকে বলল, ”বউদির ফোন।”

দুলাল ব্যস্ত হয়ে উঠে গেল। তুষারও উঠল। সমীরণ টেবিলে একা বসে রুটি চিবোতে চিবোতে দেবুকে বলল, ”চা দাও।”

”চা নয়, হরলিকস খেতে হবে।”

শুনেই সমীরণ চোখ সরু করল। ”খেতে হবে। যাক, দরকার নেই।”

পাংশু মুখে ফিরে এল দুলাল। সমীরণের সামনের চেয়ারে বসে নার্ভাস স্বরে বলল, ”মুশকিলে ফেলল দেখছি। বটা বিশ্বাসের ষাট—সত্তরটা ছেলে বাড়ির সামনে চিৎকার করছে, গালাগাল দিচ্ছে আমার নামে। কী করা যায় বল তো।” অস্থিরভাবে দুলাল সোফায়—বসা তুষারের কাছে চলে গেল।

”তুষার, এখন কী করি বল তো?”

”কী আবার করবি। বউকে বল দরজা জানলা বন্ধ করে, কানে তুলো দিয়ে বসে থাকতে। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে ওরা আপনা থেকেই চলে যাবে।”

”তাই—ই বলেছি। কিন্তু বটাদা টেলিফোন করে বউকে বলেছে দেখা করতে আসবে। এটাই তো ভয়ের কথা। ছন্দা তো বটাদা বলতে অজ্ঞান।”

”হোক না অজ্ঞান! তোর জ্ঞানটা ঠিক থাকলেই হল।”

”ছন্দাকে তো চিনিস না, ও অজ্ঞান হলে আমাকেও যে অজ্ঞান হতে হবে এটা বটাদা জানে। গত বছর ওকে দিয়ে বটাদা এমন প্রেশার দেওয়াল যে, যাত্রীর অ্যাডভান্স নিয়েও সারথিতে যেতে হল।”

সমীরণ এসে দু’জনের সঙ্গে বসল। বুকু সঙ্গে সঙ্গে টিভি বন্ধ করে ঘরের মধ্যে চলে গেল। ডোর—বেল বেজে উঠল। দেবু দরজা খুলে দিতেই সুবোধ ধাড়া, সীতেশ রায় এবং সাত—আটজন যুবক ও মাঝবয়সি লোক ভেতরে ঢুকল।

সমীরণকে দেখেই সুবোধ ধাড়া একগাল হাসল।

”বটাকে ম্যাজিক দেখালি? ভাল, ভাল, এবার মাঠে নেমে পায়ের জাদুটাও দেখাস।”

সমীরণ চুপ করে রইল। দুলাল ইশারায় সুবোধ ও সীতেশকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। ওদের সঙ্গে আর যারা ঢুকেছে তারা সোফায় বসে নিজেদের মধ্যে জোর গলায় কথা বলা শুরু করল—কোন প্লেয়ারকে আনা দরকার, কার কত দর হওয়া উচিত, আর পঁচিশ হাজার বাড়ালেই কাকে পাওয়া যাবে, কাকে একদমই বিশ্বাস করা যায় না, কে ল্যাজে খেলাচ্ছে, এইসব কথার থেকে সরে যাওয়ার জন্য সমীরণ বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়াল।

মরক্কো চামড়া—বাঁধানো ইংরেজি এবং বাংলা নানাবিধ বই থেকে সে অনুমান করল পতু ঘোষ লোকটা উটকো এবং সাজানো বনেদি নয়। শিক্ষা, রুচির একটা ভিত পরিবারে আছে। আলমারির পাল্লা টানতেই খুলে গেল। সে বঙ্কিম গ্রন্থাবলীর একটা খণ্ড বের করে পাতা ওলটাল। কয়েকটা উপন্যাস রয়েছে এই খণ্ডে। বইটা নিয়ে সে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে পরদা টেনে দিল। জানলার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা অফিসবাড়ি। দোতলায় ব্যাঙ্ক। রাস্তার কিছুটা চোখে পড়ে। বাস, মোটর ইত্যাদি চলছে। আকাশ কষ্টেসৃষ্টে দেখা যায়। সে একটা চেয়ারে বসে আর—একটায় দুটো পা তুলে দিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে ‘কপালকুণ্ডলা’য় ডুবে গেল।

উপন্যাসটা যখন প্রায় শেষ করে এনেছে, হঠাৎ একটা মেয়েগলার চিৎকারে সমীরণ বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল।

”কোথায় দুলাল চক্রবর্তী? তাকে কোথায় রেখেছেন, বের করে দিন।”

”কে আপনি?”

”আমি ওর বউ মধুছন্দা।”

”এখানে দুলাল চক্রবর্তী নেই।”

”নেই মানে, আজ সকালেই ফোনে কথা বলেছি। আমায় বলল, এখানে ওকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। আমি সব ঘর সার্চ করব।”

”বলছি তো এখানে নেই। আপনি যেতে পারেন।”

সমীরণ পরদার ওপারের সংলাপ শুনে বুঝল সুবোধ ধাড়াদের সঙ্গে আসা সেই লোকগুলি ছাড়া ওখানে আর কেউ নেই। নিশ্চয় আগাম জেনেছে মধুছন্দা আসছে তাই কেটে পড়েছে।

”আমায় আটকাবেন না বলছি। নীচে একশো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা আমার স্বামীকে অবৈধভাবে এখানে ধরে রেখেছেন।”

”আপনি যদি ঘর দেখতে চান, দেখতে পারেন, কিন্তু অন্য কাউকে ঢুকতে দেব না, সেটাও তা হলে অবৈধ ব্যাপার হবে।”

”ঠিক আছে, এই তোমরা এখানে দরজার বাইরেই থাকো।”

”না বউদি, আমরাও আপনার সঙ্গে থাকব।”

”আপনাকেও যদি আটকে রেখে দেয়?”

”অ্যা অ্যা অ্যা, আটকাবে আমাকে? জ্বালিয়ে দেব না সারা বাড়ি। আমি একাই দেখছি, তোমাদের ঢুকতে হবে না।”

বটা বিশ্বাস তা হলে এর মধ্যেই অর্গানাইজ করে ছেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। সমীরণ পাতার সংখ্যাটা দেখে বই বন্ধ করল। কিন্তু যদি তাকে এখন দেখে ফেলে? যদি জবরদস্তি চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যায়? তারপরই মনে হল, প্লেয়ার তোলা এভাবে হয় না। যাকে তোলে সে স্বেচ্ছায়ই হাজির হয়।

ঘরের দরজা খোলা আর বন্ধের শব্দের সঙ্গে মধুছন্দার গলা ভেসে এল। ”কোথায় ওকে সরিয়েছেন আপনারা বলুন, নয়তো কুরুক্ষেত্র বাধাব বলছি।”

”বললাম তো আপনাকে, দুলাল চক্রবর্তী আধঘণ্টা আগে ওর জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। হঠাৎ, নিজের থেকেই। যওয়ার সময় শুধু বলল, এখানে থাকব না, বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। যদি বউ খোঁজ করতে আসে—”, কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সমীরণ শুনল তুষারের গলা, ”তা হলে বলে দেবে, বটাদা এবার কত ভরির হার দেবে সেটা জেনে নিয়ে যেন বাড়িতে বিকেলে ফোনের পাশে বসে থাকে। পাঁচ ভরির কম হলে সারথিতে থাকব না।”

”তুষারদা, আপনি তো একজন বড় প্লেয়ার, আপনিই বলুন, ফুটবলারদের কি বিশ্বাস করা যায়? ওদের কথার কি কোনও দাম আছে?”

”ছন্দ, আমিও কিন্তু একজন ফুটবলার।”

”না, না, আপনাকে বলছি না, আপনি বাদে আর সবাই। আমাকে বলল একটা হিরের নাকছাবি করিয়ে দেবে সারথির টাকাটা পেলেই। এক বছর হয়ে গেল, কোথায় নাকছাবি? এবার বলল যাত্রীর অ্যাডভান্স পেলেই—না, না, আমি আর বিশ্বাস করছি না। বলুন না তুষারদা ও কোথায়? বটাদা বলেছেন মামনকে লরেটোয় ভর্তি করিয়ে দেবেন। উনি এককথার মানুষ, যা বলেন তাই করেন।”

”লরেটোয় তো পতুদাও ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন।”

”পারেন? আপনি একটু বলবেন তুষারদা?”

”তুমি নিজেই বলো না।”

”ঠিক আছে আমিই বলব। জানেন, আমার বড়দির মেয়ে কী ফটাফট ইংরিজি বলে। মেমসাহেবদের মতো উচ্চচারণ। শুনলুম পতুদা এখানে নাকি নেই?”

”কাল—পরশুই এসে যাবে, তুমি বরং পরশুই এসো।”

সমীরণ ভেবে পাচ্ছে না, হাসবে, না, রাগবে। একটা ফুটবলারকে জীবনে কতজনের কতরকমের স্বার্থ, লোভ দেখে চলতে হয়। দুলালদা প্রায়ই বলে, ”গুছিয়ে নে, নাকু, গুছিয়ে নে। এই খেলা চিরকাল তো থাকবে না, যা পারিস বাগিয়ে নে।” দুলালদা বাগিয়ে নেওয়ার জন্য যাত্রী আর সারথির মধ্যে লাথি খাওয়া বলের মতো যাতায়াত করছে।

বইটা খুলে আবার সে পড়তে শুরু করল। কয়েক মিনিট পর দেবু পরদা সরিয়ে মুখ বাড়াল।

”দুপুরে কী খাবেন?”

”যা হোক।”

”তুষারদা ইলিশ খাবে বলেছে, বুকুদা চিকেন। যে যা চাইবে তাই দেওয়া হবে। বুকুদা তো কাল এগারোটা ক্যাডবেরি চকোলেট খেল।”

”আমি খাব ভাত, ডাল, তরকারি আর যে—কোনও একটা মাছের ঝোল।”

”আর?”

”আবার কী?” সমীরণ তাকাল দেবুর বিড়ম্বিত মুখের দিকে। ”রোজ যা খাই তাই খাব, তবে ইলিশভাজা পেলে ছাড়ি না আর দই পেলে তো খুবই ভাল হয়।”

দেবুর স্বস্তি পাওয়া মুখ দেখে সে বলল, ”বউদি চলে গেছেন, না দলবল নিয়ে নীচে বসে আছেন?”

”বসেটসে নেই, একদমই চলে গেছেন। এদিকে এরাও সব তুষারদাকে নিয়ে বড়বাবুর ড্রইংরুমে গিয়ে বসেছে। মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরের দরজাও লক করে দিয়েছি। বড়বাবুর কড়া অর্ডার প্লেয়ার ছাড়া এদিকে কেউ থাকবে না। ঝামেলটামেলা হলে ওদিককার ঘরেই হোক। কাল গৌরবন্ধু বেরা—র বাবা এসে যা চেঁচামেচি করল।”

”গৌরবন্ধু, মানে সারথির তিন নম্বর গোলকিপার?”

”হ্যাঁ। ওকে সত্তর হাজার দেওয়ার কথা হয়েছে। লোকটা এসে বলে একলাখ পঁচিশ চাই। ভাবুন একবার, জুনিয়ার বেঙ্গলে একটা ম্যাচ শুধু খেলেছে, সিনিয়ার বেঙ্গল টিমের রিজার্ভে ছিল, সারথিতে গত বছর চারটে একজিবিশন ম্যাচে নেমেছে, আপনি তো আমার থেকেও ভাল জানবেন, এই প্লেয়ার কিনা চাইছে সোয়া লাখ! দু’ঘণ্টা ধরে ওর বাপ চেঁচাল, রাগ দেখাল, তারপর কান্নাকাটি, হাতজোড়, মানে শান্তিগোপাল, স্বপনকুমারও হার মেনে যাবে!”

”চাইবে না কেন? সারা ময়দানে রটে গেছে টাকার বস্তা নিয়ে পতু ঘোষ প্লেয়ার কেনার দোকান খুলেছে। কানা, খোঁড়া, নুলো, খোকা, বুড়ো যাকে পারছে অ্যাডভান্স ধরাচ্ছে। গৌরবন্ধুর কতয় রফা হল?”

”আশি হাজার।”

”অ্যাঁ। ওর দাম তো আশি টাকাও নয়, আর কিনা পাবে আশি হাজার।”

”আপনি অ্যাডভান্স নিয়েছেন?” দেবুর স্বরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা।

”না।” সমীরণ হুঁশিয়ার হল। এইসব বিষয় নিয়ে এই পর্যায়ের লোকের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়।

”চাইলে অ্যাডভান্স কেন, পুরো টাকাটাই আপনাকে দিয়ে দেবে। আপনি যাত্রীর বড় ক্যাচ, আপনাকে যে পাব এটা তো আমরা আশাই করিনি।”

এই সময় চেঁচিয়ে একজন বলে গেল, ”সমীরণ তোমার ফোন এসেছে।”

নিশ্চয় বাড়ি থেকে। আর তো কেউ জানে না সে এখানে! সমীরণ প্রায় ছুটেই ড্রইংরুমে গেল।

”কে, দাদা? আমি কানু।”

”পিসি স্কুলে গেছে?”

”যায়নি। হটওয়াটার ব্যাগ নিয়ে সেঁক দিচ্ছে। শোন, এইমাত্র বাঙ্গালোর থেকে তোর ফোন এসেছিল।”

মাথার মধ্যে ঝনাৎ শব্দ করে সমীরণের শরীর শক্ত হয়ে গেল। ”কে করেছে?”

”পদ্মনাভন, এ.আই.এফ.এফ. সেক্রেটারি। এক্ষুনি তোকে রওনা হতে বলল।”

”এক্ষুনি রও—” সে থেমে গেল। সারা ঘর কান পেতে, সব চোখ এখন তার দিকে। খোলাখুলি কথা বলা নয়।

”কেন বলল?”

”নাগজি টুর্নামেন্টে তোরা খেলছিস না, কারণ চেকোশ্লোভাকিয়া ট্যুর গভর্নমেন্ট স্যাংশন করেছে। দশদিনের মধ্যেই টিম রওনা হবে। তোর জন্য নোভাচেক অপেক্ষা করছে। মিনিটখানেক কথা হল।”

সমীরণের হাতের ফোন থরথর কাঁপছে। তার জীবনের স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ফোনের মধ্য দিয়ে সারা শরীরকে সুখে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটা সন্দেহ কাঁটার মতো তার মগজে বিঁধল। ফোনটা বাঙ্গালোর থেকে, না কি শোভাবাজারের অভয় কুণ্ডুর বাড়ি থেকে? এটা আগে যাচাই করে নেওয়া দরকার। কলকাতার ফুটবলে নোংরামির তো অন্ত নেই।

”কানু, তুই একবার পদাকে ফোন কর, এক্ষুনি?” নম্বরটা লেখা আছে ফোন—গাইডে।”

”পদা কে?”

”আহা, একটু আগেই তো বললি তোকে ফোন করেছিল পদা।” সমীরণ আড়চোখে ঘরের লোকেদের দিকে তাকাল। ”আমার সুটকেসের একটা নোট বইয়ে নোভুদার ফোন নাম্বার আছে। ওখানে করলেও হবে।”

”পদ্মনাভন, নাকি নোভাচেক, আগে কাকে করব?”

”যাকেই হোক, জিজ্ঞেস করে কনফার্মড হয়ে নে। অন্য কেউ ধাপ্পা দেওয়ার জন্য এভাবে বলছে কি না সেটা বাজিয়ে নেওয়া দরকার। যদি সত্যি হয় তা হলে যা কিনতে বলেছি সেটা কিনে ফেল।”

”কিনতে মানে প্লেনের টিকিট কাটতে বলেছিলিস।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। তবে বো নয় বা।”

”আরে বাঙ্গালোরেরই কাটব। আমার বন্ধুর দাদা, সারথির পাগল সাপোর্টার, এখনও জানে না তুই যাত্রীতে উঠেছিস, তিনি এয়ারলাইন্সের অ্যাকাউন্টসে আছেন। তাঁকে ফোন করে কালকের বোম্বাইয়ের টিকিট চেয়েছিলাম, বললেন হয়ে যাবে। এখন আবার বাঙ্গালোরের চাইতে হবে। অবশ্য প্রথমে পদার কাছ থেকে জেনে নিয়ে।”

”জেনেই আমাকে জানাবি, এক সেকেন্ডও দেরি করবি না। ভীষণ ক্রুশিয়াল এটা আমার কাছে।”

সমীরণ রিসিভার রাখতেই প্রশ্ন হল, ”নাকু, কোনও খারাপ খবর?”

”অ্যাকসিডেন্ট নাকি সমীরণ?”

”তোমার পিসিমার?”

দুর্ভাবনা—পীড়িতের মতো দেখাচ্ছে সমীরণকে। এখন তাকে এই ভাবটা দেখাতেই হবে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া সহজ কর্ম নয়। তাকে আটকে দেবেই। যাত্রীর সে বড় ক্যাচ।

”হ্যাঁ, তুষারদা, একজন ফোন করে ভাইকে বলেছে স্কুলের সামনে বাস থেকে পিসিমা পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়ায় চোট পেয়েছে। কথাটা সত্যি কি না কনফার্ম করার জন্য ভাইকে বললাম, পদাদা, আমার এক মামাতো দাদা, পিসিমার স্কুলের পাশেই থাকেন, তাকে ফোন করে জেনে নিয়ে আমাকে জানাতে। কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না, বাড়িতেও কেউ নেই যে—।” সমীরণ ক্লিষ্ট মুখে ধীরে ধীরে তুষারের পাশে বসে পড়ল।

অভিনয়! এখন সে স্টেজের ওপর। ঘাগু দর্শকদের সামনে তাকে অভিনয় করতে হচ্ছে। একটু এধার—ওধার হলেই এরা ধরে ফেলবে। বাসব কী যেন বলেছিল? ”কী গলা, কী ডেলিভারি, কী পিচ কন্ট্রোল!” এসে একবার দেখে যাক সমীরণ গুপ্তর অভিনয়।

”পিসিমার তো দারুণ স্বাস্থ্য, প্রচণ্ড ফিট। শুনেছি এককালে রেগুলার বাস্কেট খেলতেন।” তুষার সমীহ করে বলল।

জবাব না দিয়ে সমীরণ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টেলিফোনটার দিকে। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। কানু কি সুটকেস থেকে নোটবইটা পেয়েছে?… ট্রাঙ্ককলে লাইন পেতে কত সময় লাগবে?… নোভাচেক কি পদ্মনাভন এখন যদি কোথাও বেরিয়ে গিয়ে থাকে? অন্য কেউ ফোন ধরলে সে নিশ্চয় বলতে পারবে ইন্ডিয়া টিম ট্যুরে যাচ্ছে কি না। যদি যায় তা হলে অবশ্যই তাকে জলদি যেতে বলবে। যেতে হলে প্রথম এখান থেকে তাকে বেরোতে হবে।

”পিসিমার যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে আমাকে তো যেতেই হবে।” সমীরণ ব্যাকুল হয়ে বলল।

”যাওয়া তো দরকারই।” তুষার সমর্থন করল।

রুগণ, লম্বা মাঝবয়সি লোকটি, সমীরণ যাকে আগে কখনও দেখেনি, বলল, ”ঘুনুদা না বললে তো যাওয়া সম্ভব নয়।”

আর—একজন বলল, ”তোমার ভাই, কনফার্মড হয়ে আগে তো তোমাকে জানাক, তারপর দেখা যাবে।”

দপদপ করে উঠল সমীরণের কানের দু’পাশ। কিন্তু সে জানে রাগারাগি করে কোনও লাভ নেই। সবার আগে তাকে কাজটা হাসিল করতে হবে।

”আমি ঘরে যাচ্ছি, ফোন এলেই খবর দেবেন।” এই বলে সে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এসে খাবার টেবিলে রাখা বঙ্কিম গ্রন্থাবলীটা তুলে নিয়ে, নিজের ঘরে এসেই অবাক হল। বুকু শুয়ে রয়েছে, দুলালের শূন্য বিছানায়। বুকের ওপর টেপ রেকর্ডারে নিচু স্বরে বাজছে হিন্দি গান।

”কী ব্যাপার, এখানে?” সমীরণ বলল।

”তুষারদার সঙ্গে থাকব না, অত্যন্ত বাজে লোক।”

সমীরণ আর কথা না বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। কপালকুণ্ডলা শেষ করার বাসনা এখন আর তার নেই। তার মাথায় এখন চেকোশ্লোভাকিয়া ট্যুর, বাঙ্গালোর, কানুর ট্রাঙ্ককল, প্লেনের টিকিট, পতু ঘোষের বাড়ি থেকে বেরোনো, ঘুনু মিত্তিরের অনুমতি এবং নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ পর—পর খেলে চলেছে।

”তোদের ক্যাম্পে ছিল নাগাল্যান্ডের খাংমা, ঘুনুদা তাকে আনতে কোহিমা যাচ্ছে।” টেপরেকর্ডার বন্ধ করে বুকু বলল।

সমীরণ নিজের ভাবনার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তার মধ্যেই বুকুর কথাটা তার মগজে আঘাত করল। অবাক হয়ে বলল, ”খাংমা মানে সেই স্টপারটা? নোভাচেক তো ওকে তিনদিন দেখেই ক্যাম্প থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়!”

”হ্যাঁ, ওকেই আনতে যাচ্ছে। অজয় তালুকদার ওকে চেয়েছে। ওর মধ্যে নাকি ভারতের সেরা স্টপারটা লুকিয়ে আছে, অজয়দা তাকে বের করে আনবে। অতএব ব্রিফকেস নিয়ে ঘুনু মিত্তির এবার প্লেনে উঠবে।”

”একটা হাতির ঘুরতে যে সময় লাগে খাংমার লাগে তার আটগুণ সময়। বিনু কি আলবু তো তাস খেলতে খেলতে ওকে বিট করবে!”

”তাতে কী হয়েছে, ছ’ফুটের ওপর লম্বা, পঁচাশি কেজি ওজন, এটাই তো যথেষ্ট দেড় লাখ টাকার পক্ষে। গৌরবন্ধু, খাংমা, এইসব নিয়ে গোল খাবে আর সেই গোল শোধ করতে হবে আমাকে, এবার থেকে তোকেও। আর না পারলে কী অবস্থাটা আমাদের হবে… পাবলিক জানে অলরেডি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা যাত্রী খরচ করে বসে আছে।” বুকু টেপরেকর্ডারটা আবার চালিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্বরগ্রাম কমিয়ে বলল, ”তুই আসায় আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত নই।”

সমীরণ বিছানা থেকে উঠে ঘরের বাইরে এল। ঘরের কোণে টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িটা টুংটাং শব্দ করল। এগারোটা। সমীরণ অস্থির মনে পায়চারি করতে করতে একসময় ড্রইংরুমে ঢুকল। লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে। তাদের মধ্যে তিন—চারজনকে মস্তানগোছের বলে তার মনে হল। যাত্রীর দু’জন ফুটবলারও রয়েছে এর মধ্যে, বোধ হয় দরাদরি করার জন্য এসেছে। ট্রেজারার মহাদেব সামুই একটা বালিশ বগলে রেখে সোফায় কাত হয়ে আধশোয়া।

ফুটবলারদের একজন সামুইকে তখন বলছিল, ”সারথির নির্মাল্য রায় কাল এসেছিল।”

”চুঁচড়োয়? তোর বাড়িতে?”

”হ্যাঁ, বললেন ফুড কর্পোরেশনে, নয়তো কোল ইন্ডিয়ায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন।”

”ভাল কথা, তা হলে সারথিতেই চলে যা।”

ফোন বেজে উঠল। সামুইয়ের হাতের কাছে ফোন, তিনি তুললেন, শুনলেন এবং উদগ্রীব সমীরণের দিকে সেটি বাড়িয়ে ধরলেন।

”কে, কানু?”

”কারেক্ট খবর। নোভাচেককেই ফোন করেছিলাম, বলল ট্যুরটা হঠাৎই ক্লিয়ারেন্স পেয়ে গেছে। সম্ভব হলে স্যাম আজই ফ্লাই করুক, নয়তো পজিটিভলি যেন কাল করে। একদিন দেরি হলে ওকে বাদ দেব। হাতে একদমই সময় নেই। দাদা, আমি এখন টাকা নিয়ে এয়ারলাইন্স দৌড়চ্ছি।”

”কিন্তু আমি যাব কী করে কানু, এখানে আমায় নজরবন্দি করে রেখেছে, ধরে রেখেছে। আই অ্যাম ইন এ জেইল।” সমীরণ চিৎকার করে উঠল। ঠকঠক কাঁপছে তার দেহ। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঘাম ফুটেছে কপালে। ”যেভাবে পারিস উদ্ধার করে নিয়ে যা। আমি ভারতের ক্যাপ্টেন হয়ে খেলতে চাই, সবার আগে আমি একটা মানুষ হতে চাই।”

সমীরণ আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছে মহাদেব সামুই।

”কী আজেবাজে কথা বলছিস সমীরণ! এটা কি জেলখানা? যাত্রীর সেক্রেটারির বাড়িকে তুই জেলখানা বলছিস? তুই আছিস যাত্রীর গেস্ট হয়ে, পতুর গেস্ট হয়ে, আর বলছিস কিনা… এমন বদনাম… ছি ছি ছি, কেউ দেবে না।”

”তা হলে আমাকে যেতে দিন।” সমীরণ দরজার দিকে পা বাড়াল। তিন—চারজন যুবক ছুটে গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়াল। সমীরণ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মুখটা নামাল। কাঁধ দুটো হতাশায় ঝুলে সে কুঁজো হয়ে গেছে। পায়ে পায়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। টেপরেকর্ডারে তখনও হিন্দি গান হয়ে চলেছে।

।। ৯।।

”কী বলল?” খাটের ওপর ধীরে ধীরে উঠে বসলেন রেখা গুপ্ত। ”যেভাবে পারিস উদ্ধার করে নিয়ে যা!… আমায় ধরে রেখেছে! আমার নাকুকে ওরা ধরে রেখেছে? আমি যাব।”

খাট থেকে নামলেন রেখা গুপ্ত। পিসির চোখমুখ দেখে শ্যামলা জড়িয়ে ধরে টেনে এনে তাঁকে খাটে বসাল।

”কোথায় যাবে তুমি?”

”যেখানে নাকুকে ধরে রেখেছে। কত ক্ষমতা আছে ওই ঘুনু মিত্তিরদের, আমি দেখব।”

”ওখানে গিয়ে কোনও লাভ হবে না পিসি। দাদাকে যদি বের করে আনতে হয় তা হলে অন্য উপায় ভাবতে হবে।” শ্যামলা ঠান্ডা গলায় বলল।

”কী উপায়?” রেখা গুপ্তর চোখের আগুন অল্প স্তিমিত হল।

”ভাবতে হবে।”

”তা হলে তাড়াতাড়ি ভাব।”

”এসব কি একা ভাবা যায়? তুমিও ভাবো।”

”আমি কী ভাবব, আমার মাথার কিছু ঠিক নেই এখন। এখন ইচ্ছে করছে জেল ভেঙে, ওদের হাত—পা গুঁড়িয়ে, মাথা ফাটিয়ে নাকুকে বের করে আনতে। এছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। ভটচাযদের মতো ঠান্ডা মাথা তো আমার নয়।”

”হয়েছে।” শ্যামলার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল চিচিংফাঁক হওয়া গুহাটা। ”ওকেই বলে দেখি। তুমি চুপ করে এখন শুয়ে থাকো। কানুর এয়ারলাইন্স অফিস থেকে ফিরতে দেড়—দু’ ঘণ্টা তো লাগবেই, ততক্ষণে আমি ভটচায—জেঠুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।”

”দত্তবাবুকেও ব্যাপারটা বলিস। পুলিশে ছিলেন তো, বদমাইশ লোকেদের শায়েস্তা করার ব্যাপারটা জানেন।”

আধ ঘণ্টার মধ্যে ডাইনিং টেবিল ঘিরে বসে গেল বেগারদের শলাপরামর্শের অধিবেশন। সরোজ বসাক কাজে বেরিয়েছেন, তাই অনুপস্থিত। সমস্যাটা বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়ে শ্যামলা বলল, ”তা হলে কী উপায়?”

”শঠে শাঠ্যং ছাড়া কোনও উপায় তো দেখছি না।” ভটচায চিন্তিত চোখে ব্যান্ডেজ জড়ানো পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মালবিকা ইতস্তত করে বললেন, ”মলা তুমি বলছ বিনু না পিনু জন, তাকে পাওয়ার জন্য এই ঘুনু মিত্তির দু’—দু’বার এর্নাকুলম পর্যন্ত ছুটেছিল?”

”কাল রাত্তিরে মশারি গুঁজে দেওয়ার সময় বলল, ‘টুলে বসে একটু কথা বল যাতে বাইরে থেকে ওরা বুঝতে পারে আমি রিল্যাক্সড আছি।’ তখনই তো দাদা বলল, ‘বিনু জনকে পাওয়ার জন্য ঘুনুদার এত ছোটাছুটি, পয়সা খরচ হল, অথচ সে এখন কিনা চন্দননগরে সারথির কবজায়।”’

”নাকুর সঙ্গে বিনুর আলাপ কেমন?” ভটচায জানতে চাইলেন।

”খুব আলাপ।” দাদা বলল, ”ও তো আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসতেও চেয়েছিল।”

”হুমম।” ভটচাযের আঙুলগুলো টেবিলের কাঠে ঢাকের বোল তুলল। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে।

”বিনু জনকে দিয়ে এখন কী হবে!” জি. সি. দত্ত অধৈর্য হয়ে পড়লেন। ”এখন দরকার কুইক অ্যাকশন। বহুদিন হাত—পা গুটিয়ে রেখে শরীরটা আমার মাখন মাখন হয়ে পড়েছে। আমি বরং রেইড করতে যাই পতু ঘোষের বাড়িতে। যা হওয়ার হবে।”

”কাল রাতে তিনটে গুণ্ডাকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন বলে কি ভেবেছেন, সবাই আপনাকে ভয় পাবে?” মালবিকা প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল।

হাত তুলে, চেয়ার থেকে ওঠা দত্তর চ্যালেঞ্জ গ্রহণটাকে বসিয়ে দিয়ে ভটচায বললেন, ”আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। যাত্রীর কাউকে আমরা যদি হোস্টেজ রাখতে পারি তা হলে বন্দি বিনিময়ের মতো—”

”কাশ্মীরে যা হচ্ছে?” মালবিকা বললেন।

”আসামেও তো হচ্ছে।” দত্ত জানিয়ে দিলেন তিনিও ওয়াকিবহাল।

”মলা তুমি একটু পাশের ঘরে এসো, কথা আছে।”

পাশের ঘরে ওরা দু’জন মিনিটসাতেক ফিসফিস করে বেরিয়ে এল।

”এটা কিন্তু ঠিক হল না মিস্টার ভটচায।” জি. সি. দত্ত দেরিতে হলেও তাঁর ক্ষোভটা জানালেন। ”আমাদের সামনে কি কথা বলা যেত না?”

”যেত, তবে কিনা আমি অত্যন্ত গুরুতর একটা ব্যাপার নিয়ে, মানে একটি তরুণের বড় হওয়ার চেষ্টাকে সাহায্য করার একটা কাজ নিয়ে ফেলেছি। তাই বুদ্ধিটাকে থিতিয়ে নিয়ে, মানে অবান্তর কথাবার্তা থেকে সরে গিয়ে এখন কাজে নামা দরকার।” ভটচায এত আন্তরিক ও গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বললেন যে, দত্ত পর্যন্ত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে ফেললেন, ”তা তো বটেই।”

”মলা, তা হলে ফোন করো।” ভটচায নির্দেশ দিয়ে চেয়ারে টান হয়ে বসলেন।

শ্যামলা ডায়াল করে ঘরের সকলের দিকে নার্ভাস চোখে একবার তাকাল।

”হ্যালো, এটা কি ঘুনু মিত্তিরের বাড়ি?… তিনি কি আছেন?… আমি? আমি সমীরণ গুপ্তর বাড়ি থেকে বলছি, ওর বোন।… ঘুমোচ্ছেন? খুব জরুরি একটা দরকার, যাত্রীর জন্য একটা ইনফরমেশন দেব যেটা ওঁর খুব কাজে লাগবে…আচ্ছা ধরছি।”

শ্যামলা ঘরের ওপর চোখ বুলিয়ে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ল। প্রত্যেকের চোখমুখ, এমনকী বসার ভঙ্গিতে সিঁটোনো ভাব। যেন তার ওপর নির্ভর করছে সমীরণের মুক্তি।

”হ্যালো কাকাবাবু, আমি নাকুর বোন মলা। আমাদের বাড়িতে ঘণ্টাখানেক আগে”, শ্যামলা ঝপ করে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ”বিনু জন এসেছে।… বিনু জন, বিনু জন কেরলের। বাঙ্গালোর ক্যাম্পে দাদার সঙ্গে তো ওর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অনেকবার বলেছে তোমাদের বাড়িতে যাব, কয়েকদিন থেকে কলকাতাটা দেখব। তা সারথির লোকেরা তো তিন—চারবার ওর কাছে গেছল। শেষে ওর বাবার হাতে অ্যাডভান্স ধরিয়ে দিয়েছে… দাদার কাছেই এসব কথা কাল রাতে শুনেছি। তা সেই বিনু জন সই করার জন্য চলে এসেছে। কিন্তু এয়ারপোর্টে সারথির কেউ ছিল না। বোধহয় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমাদের ঠিকানাটা ওর কাছে ছিল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আমাদের বাড়ি চলে এসেছে।… কাকাবাবু, আমার মেজো ভাই কানু, ও বলল, তুই লুকিয়ে চট করে ঘুনুদাকে ফোন করে ব্যাপারটা বল। সারথির হাতে পড়ার আগেই বিনু জনকে যেন যাত্রীর ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায়… য়্যাঁ, ফোনটা বিনু জনকে দিতে বলছেন?” শ্যামলা ঢোঁক গিলল। ভটচায ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে, নিজের বাড়ির দিকে আঙুলটা তুলে, কানে অদৃশ্য ফোনের রিসিভার ধরলেন।

”কাকাবাবু, আমি এখানকার ভটচাযবাড়ি থেকে ফোন করছি।… কী বললেন? বিনু সম্পর্কে আর ইন্টারেস্টেড নন? অ, আচ্ছা…না না আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, ভাবলাম যাত্রীর যদি এতে লাভ হয়, অন্তত ওকে আটকে রেখেও সারথিকে বঞ্চিত করে… হ্যাঁ, নমস্কার।”

শ্যামলা হতাশ চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রিসিভার রাখল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন রেখা গুপ্ত। ভটচায মাথা চুলকোচ্ছেন, মালবিকা কপালে ঠুকলেন হাতের মুঠি। জি. সি. দত্ত ”ঘোঁত” ধরনের একটা শব্দ মুখ থেকে বের করে কী একটা বলতে যাচ্ছেন তখনই ফোন বেজে উঠল।

শ্যামলা রিসিভার তুলতে যাচ্ছে, ভটচায চিৎকার করে উঠলেন, ”না, না, তুমি নও। হয়তো ঘুনু মিত্তিরই ফোন করে তোমার কথাটা যাচাই করতে চায়। মিস গুপ্ত, আপনি ধরুন, বলবেন বিনু জন এখন বাড়ি নেই, রান্না—করা কিছু নেই, কানু ওকে খাওয়াবার জন্য ‘তারামা’য় নিয়ে গেছে। মহা ঘাঘু লোক, এটা মনে রাখবেন।”

”মিথ্যে কথা বলব?” রেখা গুপ্ত অসহায়ভাবে তাকালেন।

”হ্যাঁ মিথ্যে বলবেন, নাকুর জন্যই বলবেন।” জি. সি. দত্ত—র দারোগাগর্জনে তিনটি হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠলেও চতুর্থজন সটান হয়ে ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

”হ্যালো… ওহ নমস্কার, আমি নাকুর পিসিমা বলছি।… ফোন ধরার তো কেউ নেই, আমি শয্যাশায়ী, কাল ছাদ থেকে নামবার সময় আমি নিজেই পড়ে গিয়ে… এখন একটু ভাল আছি। সকালে উঠতে পারিনি, রান্নাবান্নাও কিছু হয়নি, এদিকে নাকুর এক বন্ধু, কী যেন নাম বলল পিনু না বিনু, সে এসে হাজির। ঘরে খাবারদাবার নেই, তাই কানুকে বললাম তারামা থেকে কিছু এনে দে, বেচারা কখন প্লেনে উঠেছে, উপোস করে আছে… ছেলেটি তো এখন বাড়ি নেই, কানুর সঙ্গে বেরিয়েছে। বাঙালির মিষ্টি কত রকমের, কেমন চেহারার হয় দেখার খুব ইচ্ছে, তাই ওর সঙ্গে দোকানে গেছে। মলাটাও যে শুট করে কোথায় বেরোল। তা কী জন্য ফোন করছেন? নাকু ভাল আছে তো?… অ, আচ্ছা আচ্ছা, কানুকেই বলব পিনু জনকে যাহোক করে বসিয়ে রাখতে, আপনি এসে ওকে নিয়ে যাবেন… নমস্কার।”

রেখা গুপ্ত কাঁপা হাতে রিসিভারটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলা ”পিসি… গো—ও—ও—ল।” বলে দু’হাত তুলে ভাংরা নাচের মতন শরীরটা ঝাঁকাল।

মালবিকা জড়িয়ে ধরলেন রেখা গুপ্তর দুটি হাত। ”আমি এতক্ষণ ভগবানকে ডাকছিলাম, হে ভগবান রেখা যেন গুছিয়েগাছিয়ে মিথ্যে কথাটা বলতে পারে।”

”মনে হচ্ছে খুব আন্তরিকভাবেই ডেকেছেন। আমারও ভয় হচ্ছিল এই বুঝি গুবলেট করলেন। তবে এজন্য দত্তবাবুই ক্রেডিট পাবেন। নাকুর নামটা না করলে উনি এত শক্ত হতে পারতেন না।” ভটচাযের সপ্রশংস নজরে দত্তর বুকের ছাতি ও বাইসেপস ফুলিয়ে দিলেন।

”আর দেরি নয়, দেরি নয়, আমাদের জেলখানা কোনটে হবে?” মালবিকা তাড়া দিলেন।

সবাই তাকাল দত্তর দিকে। এ—ব্যাপারে পুলিশের অভিজ্ঞতার কাছে তাদের হাত পাততেই হবে। জি. সি. দত্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ”ঘরগুলো আগে দেখব।”

শ্যামলাকে নিয়ে তিনি তিনটি শোবার ঘর, তাদের গ্রিল, জানলা, দরজা, মায় দেয়াল পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে পরখ করলেন। রান্নাঘরে, এমনকী বাথরুমেও ঢুকলেন। দোতলায় উঠে সুনীলবরণের ঘর দেখলেন।

”ছাদের ঘরটাই মনে—”

”না। দাদার ঘরে ওইসব পাজি লোক ঢোকাব না।” রেখা গুপ্তর কঠিন গলা দত্তকে দ্বিতীয় নির্বাচনে ঠেলে দিল।

”তা হলে কোণের ওই ছোট ঘরটা।” দত্ত অনুমোদনের জন্য রেখা গুপ্তর দিকে তাকালেন।

”কানুর ঘর, হ্যাঁ হতে পারে।”

এর পর দত্তর নির্দেশে দালানের জানলা বাদ দিয়ে সব ঘরের জানলা বন্ধ করা হল। চাপা গলায় তিনি বলতে লাগলেন, ”ফটক খোলা থাক। বেল বাজলে মলা দরজা খুলে ওকে সোজা নিয়ে যাবে কানুর ঘরে। এই সময়টা খুব ক্রুশিয়াল, একটু সন্দেহ হলেই কিন্তু পালিয়ে যেতে পারে। বিছানায় শুয়ে থাকবেন মিস গুপ্ত, চাদর মুড়ি দিয়ে। লোকটা ঘর ঢুকলেই আমি ছুটে এসে দরজা বন্ধ করে দেব।”

”তারপর আমি কী করব?” রেখা গুপ্ত ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন।

”দরজা বন্ধের শব্দ পেলেই আপনি চাদর ফেলে লাফ দিয়ে উঠবেন। তারপর আপনি জাপটে ধরবেন লোকটাকে।”

”এ আপনি কী বলছেন, রেখা জাপটে ধরবে?” মালবিকা প্রতিবাদ এবং ভর্ৎসনা করলেন।

”খোকাকে তো আমি জাপটেই—”

”দত্তবাবু এ খোকা নয়, খোকার জ্যাঠা। অন্যভাবে ধরার প্ল্যান করুন।” ভটচাযকে বিরক্ত দেখাল।

”তা হলে একটা ডান্ডা হাতে রাখুন। লাফ দিয়ে উঠেই সেটা মাথায়—।”

”তারপর সত্যিকারের থানা, পুলিশ, জেল হোক রেখার।” মালবিকা হাত তুলে মনে হল ডান্ডাটা ধরলেন।

”আচ্ছা, আমরা তো তখন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে ঘুনু মিত্তিরকে ঘিরে ধরতে পারি, গায়ে হাতটান না দিয়েই।”

শ্যামলা সমাধানের পথ বাতলাল।

”হ্যাঁ, তাও হতে পারে।” দত্ত হাঁফ ছাড়লেন।

অতঃপর রেখা গুপ্ত একটা চাদর নিয়ে কানুর ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অন্যরা দরজা ভেজিয়ে নাকুর ঘরে বসে রইলেন। দালানে পায়চারি করতে লাগল শ্যামলা।

অবশেষে পতু ঘোষের সবুজ মারুতি ফটকের সামনে থামল। শ্যামলা পরদা ফাঁক করে জানলায় উঁকি দিয়ে দেখল ঘুনু মিত্তির ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নামলেন এবং পেছনের সিটে বসা দুটি লোককে কী যেন বললেন। তারপর পকেট থেকে ডিবে বের করে নস্যি নাকে দিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে ডিবেটা ড্রাইভারের হাতে জমা দিলেন।

সঙ্গে দুটো লোক! শ্যামলা রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। এটা তো হিসাবের মধ্যে রাখা হয়নি। লোক দুটো যদি অপেক্ষা করে করে ঘুনু মিত্তিরকে বেরিয়ে আসতে না দেখে তখন তো খোঁজ করতে বাড়ির মধ্যে আসবে। সঙ্গে নিশ্চয় চেম্বার আছে। প্লেয়ার তুলতে এসব তো সঙ্গে রাখতেই হয়। তা হলে উপায়?

শ্যামলা দৌড়ে কানুর ঘরে এসে দেখল চাদর ঢেকে শুয়ে থাকার বদলে পিসিমা খাটের ওপর কাঠ হয়ে বসে, হাতে চাদর।

”সব্বোনাশ হয়েছে পিসি, লোকটার সঙ্গে আরও দুটো লোক। তারা অবশ্য গাড়িতেই বসে।”

ডোর—বেল বাজল।

”মলা আমি কী করব?” করুন মুখে রেখা গুপ্ত বললেন।

”যা বলা হয়েছে তাই করো, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ো।” শ্যামলা ঠেলা দিয়ে রেখা গুপ্তকে বিছানার ওপর ফেলে চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিল।

দ্বিতীয়বার বেল বাজার সঙ্গেই দরজা খুলল শ্যামলা। ”ওহ আপনি এসে গেছেন।” গলা নামিয়ে এর পর বলল, ”খুব টায়ার্ড, ও ঘরে ঘুমোচ্ছে। আপনি এখন এখানেই বসুন।”

”সব বন্ধ কেন, অন্ধকার অন্ধকার লাগছে।” ঘুনু মিত্তির চেয়ারে বসলেন হাসি হাসি মুখে। ”তুমি মা খুব বুদ্ধিমতী। ছেলে হলে তোমাকে ট্রেনিং দিয়ে যাত্রীর রিক্রুটিং অফিসার করে নিতাম। এমন সব বোকাহাবাদের নিয়ে কাজ করতে হয়। বিনু জন যে কলকাতায়, এটা তুমি না জানালে আমি জানতেই পারতাম না।”

”ওকে এখন কোথায় নিয়ে যাবেন?”

”দেখি কোথায় রাখা যায়।”

”কিন্তু ও তো সারথিতে খেলবে বলে এসেছে, আপনার সঙ্গে যাবে কেন?”

”আহা আমি তো সারথিরই লোক।” ঘুনু মিত্তির ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ টিপলেন। ”ও কি আর চেনে কে যাত্রীর আর কে সারথির! সইসাবুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও আমাদের কাছে থাকবে।”

”যেমন দাদাকে আপনারা রেখে দিয়েছেন। কিন্তু কাকাবাবু, দাদাকে এই মুহূর্তেই যে আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে। বাঙ্গালোর থেকে আজ ট্রাঙ্ককল এসেছে, ইন্ডিয়া টিম চেকোশ্লোভাকিয়া ট্যুরে যাচ্ছে। দাদাকে এক্ষুনি বাঙ্গালোর ফিরে যেতে হবে। সুতরাং সমীরণ গুপ্তকে এখনই বাড়িতে পাঠিয়ে দিন, কাল ভোরের ফ্লাইটে সে বাঙ্গালোর যাবে।”

”ইম্পসিবল। নাকুকে আমি ছাড়ব না। ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হয়ে, ইন্ডিয়ার হয়ে খেলে ওর কি ল্যাজ গজাবে?” কী পাবে ও? তোমরা অত দেশ দেশ করে চ্যাঁচাও কেন? চেকোশ্লোভাকিয়ায় গিয়ে দশটা ম্যাচ খেলে তো চল্লিশটা গোল খেয়ে আসবে। ক’টা টাকা পাবে দেশের হয়ে খেলে? এসব চিন্তা ও ছাড়ুক। তার থেকে ক্লাবে খেলুক, টাকা কামাক, অর্জুন ফর্জুন হোক, তারপর কোচিংয়ে নামুক। তাতেও ভাল পয়সা, অফিসেও উন্নতি করুক, অফিসার হোক ব্যস বাঙালির ছেলের জীবনে আর কী চাই?”

”হ্যাঁ, আরও চাই। মনের গভীরে একটা সুখ, যেটা লাখ টাকা আয় করেও মেলে না। এটা আমার নয়, দাদার কথা। আপনি আমার দাদাকে এনে দিন।”

”নাকু আমার অনেকদিনের টার্গেট, ওর আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভগবান যখন পাইয়ে দিয়েছেন তখন আর হাতছাড়া করব না।”

”সেক্ষেত্রে, আপনিও আর এ—বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না।” শ্যামলা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল এবার চেয়ারে বসল।

”তার মানে?”

”যেভাবে দাদাকে আটকে রেখেছেন, সেইভাবে আপনিও এই বাড়িতে আটকা থাকবেন। সে ছাড়া পেলে আপনিও পাবেন।”

”তা হলে বিনু জনের ব্যাপারটা ধাপ্পা?”

”পুরোপুরি।”

”তা হলে জেনে রাখো, নাকুকে আমি ছাড়ব না। তোমরা যা করতে পার করো।”

”তা হলে যেটা পারি তা হল, একটা একটা করে আপনার হাত, পা আমি ভাঙব, চোখ দুটো উপড়ে নেব।”

ঘুনু মিত্তির আর শ্যামলা চমকে চেয়ার থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। রেখা গুপ্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর দু’চোখে ঠান্ডা চাহনি। অত্যন্ত ঠান্ডা চাহনি। ঘুনু মিত্তিরের দু’হাতে কাঁটা উঠল। ঘাড়টা সিরসির করছে।

”নাকুর জীবন যাত্রীর নয়, সারথির নয়, আপনার নয়, আমারও নয়, নাকুর জীবন নাকুরই। সেই জীবন যা চায় তাই—ই করবে। আপনি তা করতে দেবেন না। তা হলে আমিও—”। রেখা গুপ্ত দু’হাতে ঘুনু মিত্তিরের কলার ধরলেন, ”আমিও আপনার স্বাধীনতা কেড়ে নেব।”

একটা হ্যাঁচকা টানে ঘুনু মিত্তির টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়লেন। তাঁর দুটি হাত পিছমোড়া করে ধরে একটু ঝুঁকে ঘুনুর কানের কাছে মুখ এনে, রেখা গুপ্ত বরফের মতো গলায় বললেন, ”প্রথমে দুটো হাত, তারপর দুটো পা। সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে।” বলেই তিনি হাতে মোচড় দিলেন।

ঘুনু মিত্তির যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলেন। শ্যামলা চোখ বন্ধ করে ফেলল। পিসির এই মূর্তি সে আগে কখনও দেখেনি। নাকুর ঘরের দরজার পাল্লা ঈষৎ ফাঁক হল এবং বন্ধ হয়ে গেল।

”আমার দুটো ছেলেকে মোটরে রেখে এসেছি, আমি কিন্তু এবার চ্যাঁচাব।”

”তা হলে ঘাড় মটকে দিয়ে চেঁচানি বন্ধ করে দেব।” রেখা গুপ্ত কথার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আবার মোচড় দিলেন। আবার আর্তনাদ।

”ফুটবল টুটবল আমি বুঝি না। এই তিনটে ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছি। এরা আমার বুকের তিনটে পাঁজর। এর একটা ভেঙে দিলে আমি মরে যাব। আর জেনে রাখুন, মরতে যদি হয় তা মেরে মরব, ফাঁসিতে যেতে হয় তো যাব।”

তাঁর গলার দু’পাশের পেশি ফুলে উঠেছে। রক্ত জমে মুখ লাল। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে দাঁতে দাঁত চাপার জন্য। রেখা গুপ্ত শেষবারের মতো একটা মোচড় দিয়ে ঘুনু মিত্তিরকে ছেড়ে দিলেন। ঘুনু নিথর হয়ে টেবিলের ওপর থুবড়ে পড়ে রইলেন। দুটো হাত ঝুলছে।

”এখুনি টেলিফোন করে বলে দিন, নাকুকে যেন পৌঁছে দিয়ে যায়, নইলে—” এবার দুটো তালু সাঁড়াশির মতো ঘুনুর ঘাড়ে এঁটে বসল। ”আমার শরীরে অল্পস্বল্প জোর আছে। এই ঘাড়টা ইচ্ছে করলেই—”। দশটা আঙুলের ব্যূহ ছোট হয়ে এল ঘুনুর শীর্ণ গলাটি ঘিরে।

এবার আর আর্তনাদ নয়, চাপা কান্নার মতো আওয়াজ হতেই হুঁশ ফিরে এল শ্যামলার। এগিয়ে এসে রেখা গুপ্তকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ধমকে উঠল, ”পিসি, তুমি কি পাগল হলে? এখনি দমবন্ধ হয়ে মরে যেত।” তারপর ঘুনুকে মিনতির সুরে সে বলল, ”কাকাবাবু, পিসিকে থামানো যাবে না। আপনি ওর কথা শুনুন, ফোন করে দিন।”

ঘুনুর চোখ বন্ধ, মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। শুধু মাথাটা নাড়লেন।

”ফোন করবেন?”

”হ্যাঁ। আমার হাতে কোনও জোর নেই, নাড়াতে পারছি না।” হাঁপাচ্ছেন। দুই চোখে ছেয়ে রয়েছে আতঙ্ক।

”আপনি বসুন, আমি ডায়াল করে রিসিভারটা আপনাকে দিচ্ছি।”

শ্যামলা যখন ডায়াল করছে, রেখা গুপ্ত তখন প্রায় ছুটেই কানুর ঘরে চলে গেলেন।

”হ্যালো, এটা কি পতু ঘোষের বাড়ি?… একটু ধরুন, ঘুনুদা কথা বলবেন… হ্যাঁ ঘুনু মিত্তির।”

রিসিভারটা ঘুনুর হাতে তুলে দেওয়ার সময় শ্যামলা মুখ ঘুরিয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল, চাদরে নিজেকে ঢেকে নিয়ে পিসি বিছানায় উপুড় হয়ে। ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ।

”কে, মানু নাকি?… শোন, নাকু কোথায়?… আচ্ছা, ওকে এখনি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যা।” ঘুনু আড়চোখে শ্যামলার মুখটা দেখে নিলেন। শ্যামলা মাথা নাড়ল। ”একটা ট্যাক্সি করে নে, ওর যা জিনিস আছে সে সবও যেন নিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি করিস, নইলে—”। ঘুনু রিসিভারটা তুলে দিলেন শ্যামলার হাতে।

”কাকাবাবু আপনি একটু চা খান, আমি করে আনছি।”

ঘুনু সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন কথা না বলে। তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা নামিয়ে টেবিলে কপাল রাখলেন। শ্যামলা রান্নাঘরে গেল। তখন নাকুর ঘরের দরজার একটা পাল্লা সন্তর্পণে খুলে পা টিপে টিপে তিনজন বেরিয়ে এলেন। ফটক পার হয়েই বেগিংয়ের থেকে দ্রুত গতিতে তাঁরা বাড়ির পথ ধরলেন।

.

”…আই সি ফ্লাইট নাম্বার সেভেন সেভেন ওয়ান ফর বাঙ্গালোর আর রিকোয়েস্টেড টু প্রসিড…” সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য ঘোষণা হচ্ছে।

শ্যামলা তাড়া দিল, ”দাদা লাইন পড়ে গেছে।”

”পড়ুক।” সমীরণ ব্যস্ততা না দেখিয়ে বইয়ের দোকানের দিকে এগোল। ওখানে খবরের কাগজও বিক্রি হয়। সাড়ে পাঁচটা এখন। এত ভোরে এয়ারপোর্টে কাগজ পাওয়া যাবে কি না তাই নিয়ে সে উদ্বিগ্ন থাকায় লক্ষ করেনি লোকটিকে।

”দাদা।”

শ্যামলার দৃষ্টি অনুসরণ করে সমীরণ অবাক হয়ে দেখল, লাউঞ্জের একটা চেয়ারে ঘুনু মিত্তির বসে রয়েছেন। কোলে ব্রিফ কেস। বাঁ হাতের কনুইয়ের মোটা ব্যান্ডেজ, হাতটা গলায় বাঁধা ব্যান্ডেজে ঝুলিয়ে বুকের কাছে তুলে রাখা। ঘুনু তাদের দিকেই নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রয়েছেন। ”আপনি এখন এখানে?” সমীরণ বলল।

”খাংমাকে ধরতে যাচ্ছি। আমার প্লেন আটটা—চল্লিশে, একটু আগেই এসে গেলাম।… তুই সত্যি সত্যিই বাঙ্গালোর যাচ্ছিস, না ধাপ্পা মেরে বটার ঘরে উঠছিস সেটা তো দেখতে হবে।” ঘুনু মিত্তিরের গলায় কোনওরকম আবেগ নেই। বারো ঘণ্টা আগে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, মনে হচ্ছে না তার কণামাত্রও তিনি মনে করে রেখেছেন।

”ট্যুর থেকে ফিরে এসেও তো দাদা সই করতে পারবে আর করলে পিসি যা বলেছে, সেই ক্লাবেই করবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।” অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাঁসফাঁসানিটা শ্যামলার গলা থেকে বেরিয়ে এল।

”তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে বলছ?” ঘুনু মিত্তিরের মুখের নির্বিকারত্ব মুছে গিয়ে হাসি ফুটে উঠল।

”ভি আই পি রোডের ওপর নিলডাউন হয়ে থাকার থেকে আপনার হাতে ধরা দেওয়া অনেক ভাল।” সমীরণের মুখও নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল।

ঘুনু মিত্তির ডান হাতটা সেলামের ভঙ্গিতে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ”তোর পিসিকে নমস্কার।”

সিকিউরিটি চেকিংয়ের জন্য দ্বিতীয় ডাক শোনা গেল।

”নাকু, একটা কথা বলে রাখি, তোর কাছে দেশ যেমন বড়, আমার কাছে তেমনই ক্লাব… আমি ক্লাবের কাজ হাসিল করার জন্য নিজেকে যতটা ঢেলে দিই, আশা করব তুইও দেশের কাজটা সেইভাবে করবি।” তারপরেই চোখ টিপে নিচু গলায় বললেন, ”কিন্তু, পা বাঁচিয়ে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *