বিশ্বজোড়া বিশ্বকাপ

বিশ্বজোড়া বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ শুরুর আগের কথা

খেলার কথা উঠলে প্রথমেই যে নামটি জিভের ডগায় এসে যাবে সেটি হল ফুটবল। আর ফুটবল বললেই প্রথমে মনে পড়বে বিশ্বকাপের কথা। এক মাস ধরে এর দক্ষতা, এর স্টাইল, এর সব কিছুই খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে যায় ফুটবলপ্রেমী কোটি কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাপী সংযোগ ব্যবস্থার ফলে এর ফলাফল পৃথিবীর কোণে কোণে মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় আর এই টেলিভিশনের যুগে হাজার মাইল দূরের মানুষও আমাদের কাছে আন্তর্জাতিক খেলার প্রবাদ পুরুষ হয়ে ওঠে। অথচ সত্তর—আশি বছর আগেও যদি কেউ ফুটবল পেশাদারদের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার সম্ভাবনার কথা বলত তাহলে লোকে ধরে নিত তার মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে।

১৯০৪ সালের ২১ মে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন আর সুইৎজারল্যান্ড এই ছয়টি দেশের কয়েকজন লোক প্যারিসে ফুটবলের যে বিশ্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেশন ইন্ট্যারন্যাশনাল দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনস (ফিফা) গড়েছিলেন, তার সংবিধানে তাঁরা একটি ধারা রেখেছিলেন—ভবিষ্যতে যদি কখনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয় তাহলে একমাত্র ফিফা—ই হবে তার সংগঠক। ওই সময় বিশ্ব প্রতিযোগিতা বলতে ছিল শুধুমাত্র অপেশাদারদের জন্য ওলিম্পিক গেমস। কিন্তু পেশাদার ফুটবলাররাও সেখানে অংশ নিয়ে ওলিম্পিক আদর্শ নষ্ট করছিল। ১৯২৪ প্যারিস ওলিম্পিক গেমসেই ইওরোপ ও আমেরিকার মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফুটবল যোগাযোগ ঘটে। আর তখনই সারা বিশ্বের চোখ খুলে যায়। ৫০ হাজার দর্শকের সামনে উরুগুয়ে চমৎকার দক্ষতায় পাঁচটি খেলায় ২০ গোল দিয়ে ও দুটি মাত্র খেয়ে ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হতেই বিশ্বকাপ সংগঠনার সম্ভাবনা, এই প্রতিযোগিতা থেকেই মাথা চাড়া দিল।

এর দু বছর পর ফিফা কংগ্রেসে ফ্রান্সের প্রতিনিধি দেলুনি বললেন, ”আন্তর্জাতিক ফুটবল এখন আর শুধুমাত্র ওলিম্পিকসের গণ্ডিতেই বাঁধা থাকতে পারে না। বহু দেশে এখন পেশাদারিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে তাই তারা তাদের সেরা খেলোয়াড়দের ওলিম্পিকসে পাঠাতে পারছে না। এবার পেশাদারদের জন্য নিজস্ব প্রতিযোগিতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।” এই ধরনের ভাবনা—চিন্তার জোরেই ১৯২৯—এ বার্সিলোনায় ফিফা—র বার্ষিক কংগ্রেসে, পাঁচটি ইওরোপীয় দেশের আপত্তি ভোটের ফলাফলে অগ্রাহ্য হয়ে, প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের ভার দেওয়া হল ১৯২৪ ও ১৯২৮ ওলিম্পিক গেমস চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়েকে। আশ্চর্যের কথা, সংগঠিত ফুটবল খেলায় যারা বিশ্বে প্রথম পথ প্রদর্শক সেই ব্রিটেনের চারটি— ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলশ ও উত্তর আয়ারল্যান্ড—কিন্তু ফিফা গড়ার ব্যাপারে বা বিশ্বকাপের প্রথম তিনটি অনুষ্ঠানে কোন অংশ নেয়নি।

উরুগুয়ে প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠান করতে চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রাজধানী মন্তিভিদিওতে নতুন একটি আধুনিক স্টেডিয়াম গড়বে এক লক্ষ দর্শকের জন্য আর যে সব দেশ অংশ নিতে আসবে তাদের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে দেবে। কিন্তু প্রতিযোগিতা শুরুর দু মাস আগেও ইওরোপের কোন দেশ যোগ দেবার সম্মতিপত্র পাঠাল না। তাদের ভাবখানা ছিল এইরকম,—জাহাজে অত দূরে গিয়ে খেলার জন্য তিন মাস সময় লাগবে। অত দিন ধরে পরিবার আর কাজকর্ম ছেড়ে যাবার জন্য তারা তাদের খেলোয়াড়দের বলতে পারবেন না। অবশেষে অনেক ধরাধরির পর চারটি ইওরোপীয় দেশ—ফ্রান্স, যুগোশ্লাভিয়া, বেলজিয়াম আর রুমানিয়া—খেলতে যেতে রাজি হয়। এই চারটি দেশ ছাড়া প্রথম বিশ্বকাপে খেলেছিল আরও নয়টি দেশ। তারা—আর্জেন্তিনা, মেক্সিকো, চিলি, ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, প্যারাগুয়ে, যুক্তরাষ্ট্র এবং উরুগুয়ে। ১৯৩০—এ ফিফা—র সদস্য দেশের সংখ্যা ছিল ৪১। বিশ্বকাপ ট্রফির তখন কোন নাম ছিল না। ১৯২০ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত তাদের প্রেসিডেণ্ট ফ্রান্সের জুল রিমে (Jules Rimet), যাঁর ঐকান্তিক ও নিরলস চেষ্টায় বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা সম্ভব হয়ে ওঠে, তাঁর নামে ট্রফির নামকরণ হয় ১৯৪৬—এ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জন্য ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৫০—এ এই প্রতিযোগিতা আবার শুরু হলে প্রথমবারের মতই জুল রিমে কাপ জেতে উরুগুয়েই।

১৯৩০ উরুগুয়ে

১৯৩০ ছিল উরুগুয়ের শতবার্ষিকীর বছর। মাত্র আট মাসে তারা বন্দর রাজধানী মন্তিভিদিওতে তৈরি করে ফেলে এক লক্ষ দর্শকের জন্য সেণ্টিনারি স্টেডিয়াম। দু বছর আগে উরুগুয়ে তার ওলিম্পিক ফুটবল খেতাব ধরে রেখেছে আর্জেন্তিনাকে ফাইনালে হারিয়ে তাই উরুগুয়েই ছিল প্রথম বিশ্বকাপের ফেভারিট। কঠোরভাবে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করার জন্য তারা দলটিকে রাজধানীর একটি হোটেলে দু মাস রাখে। এই সময় খেলোয়াড়দের বাড়িতে পর্যন্ত যেতে দেওয়া হত না। একদিন রাতে দেখা গেল তাদের বিশ্বখ্যাত ওলিম্পিক গোলকিপার মাজ্জালি পা টিপে টিপে পিছনের দরজা দিয়ে হোটেলে ঢুকছে। ধরা পড়ামাত্র তাকে দল থেকে বার করে দিয়ে অন্য গোলকিপার দলে নেওয়া হয়।

ইওরোপের চারটি দেশ খেলতে আসার জন্য খুব ইচ্ছুক ছিল না। অনেক দেরিতে তারা সিদ্ধান্ত জানায়। ফ্রান্স তো প্রতিযোগিতার মাত্র একমাস আগে ঠিক করে খেলতে যাবে। তাদেরই দেশের লোক ফিফা প্রেসিডেণ্ট এবং তিনি ১২1/2ইঞ্চি উচ্চতার নিরেট সোনার একটি ট্রফি প্রদান করেছেন সুতরাং খেলতে না গেলে সেটা ভাল দেখাবে না ভেবেই তারা উরুগুয়ে পাড়ি দিয়েছিল। রুমানিয়া দল নির্বাচন করেছিলেন তাদের রাজা ক্যারল স্বয়ং। সেখানে ব্রিটিশ অয়েল কম্পানিতে দেশের বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় ফুটবলাররা চাকরি করতেন। কম্পানি থেকে বলা হয়, উরুগুয়েতে খেলতে যাবার অনুমতি দেওয়া হবে না। কেউ যদি যায় তাহলে চাকরি থাকবে না। এই সময় রাজা ক্যারল হস্তক্ষেপ করেন তার ফলে অনুমতি মিলে যায়। রাজা নিজেই খেলোয়াড় বেছে দল গড়ে পাঠিয়ে দেন। যুক্তরাষ্ট্র দলটিতে ছিলেন ছয়জন প্রাক্তন ইংলিশ ও স্কটিশ পেশাদার। সবাই বয়স্ক। যুক্তরাষ্ট্র দলকে কেউই বিশেষ পাত্তা দেয়নি। ট্রেনিংয়ের সময় তাদের চেহারা আর গাজোয়ারি খেলা দেখে এক ফরাসি সাংবাদিক মন্তব্য করেন, ফুটবল না খেলে ওদের শট পাটার হওয়া উচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র দলকে এরপর সবাই ‘শট পাটার’ বলে ডাকত।

সবাই ধরে নিয়েছিল উরুগুয়ের কঠিনতম প্রতিদ্বন্দ্বী হবে তার প্রতিবেশী আর্জেন্তিনা। তার কারণও আছে। দু বছর আগে আমস্টারডাম ওলিম্পিকস ফাইনালে তাদের খেলার ফলটা ছিল খুব কাছাকাছি (১—১, ২—১)। যদিও আর্জেন্তিনার চমকপ্রদ লেফট উইঙ্গার রেইমন্দো ওরসি—কে ইতালির জুভেন্তাস ক্লাব টাকার টোপ দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে তাহলেও আবার তারা কঠিন ও শক্তিশালী দল গড়ে নিতে পেরেছে অ্যাটাকিং সেণ্টার হাফ লুইসিতো মন্তি—কে কেন্দ্র করে। এই মন্তিও অবশ্য পরে জুভেন্তাসে চলে যাবেন এবং ওরসিকে সঙ্গে নিয়ে ইতালিকে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ে সাহায্য করবেন।

পেরুকে ১—০, রুমানিয়াকে ৪—০, সেমিফাইনালে যুগোশ্লাভিয়াকে ৬—১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠে উরুগুয়ে দেশবাসীকে প্রায় পাগল করে তোলে। অন্যান্য খেলাতেও কিছু ঘটনা ঘটে। ফ্রান্সের সঙ্গে খেলায় আর্জেন্তিনা ১—০ জিতছে, খেলা শেষের ছয় মিনিট আগেই ব্রাজিলীয় রেফারি সমাপ্তির বাঁশি বাজিয়ে মাঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হন। অবশ্য ১৫ মিনিট পর খেলা আবার শুরু হয় এবং শেষপর্যন্ত ফল একই থাকে। আর একটি মজার ব্যাপার ঘটে আর্জেন্তিনা—যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচে। তাঁর দলের একজন আহত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেনার মেডিক্যাল ব্যাগ হাতে মাঠে ছোটেন এবং রেফারির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে হাতের ব্যাগটিকে মাটিতে আছাড় মারেন। ব্যাগের মধ্যে ছিল ক্লোরোফর্মের বোতল। সেটি ভেঙে তো যায়ই তিনিও হুমড়ি খেয়ে পড়েন তার উপর। এরপর অজ্ঞান ট্রেনারমশাইকেই স্ট্রেচারে মাঠের বাইরে আনতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্র সেমিফাইনালে উঠে কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। বেলজিয়াম ও প্যারাগুয়ে প্রত্যেককে ৩—০ গোলে হারিয়ে তারা সেমিফাইনালে পড়ে আর্জেন্তিনার সামনে এবং ১—৬ গোলে হারে। আর্জেন্তিনা তার আগে ফ্রান্সকে ১—০, মেক্সিকোকে ৬—৩ এবং চিলিকে ৩—১ গোলে হারায়।

১৯৩০—এর ৩০ জুলাই ফাইনাল খেলার ২৪ ঘণ্টা আগে থেকেই মন্তিভিদিওর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালো করা হয়। সারারাত ধরে বুয়েনস এয়ারেস থেকে নৌকোয় হাজারে হাজারে আর্জেন্তিনীয় সমর্থকরা আসতে থাকে। দাঙ্গা বাধার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু বাধেনি। স্টেডিয়ামে এক লক্ষ দর্শকের বসার ব্যবস্থা থাকলেও ৯০ হাজারের বেশি লোক ঢোকান হয়নি তাও তাদের প্রত্যেককে দেহ তল্লাশির পর। শেষ পর্যন্ত একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিসংবাদ ছাড়া আর কিছুই কিন্তু ঘটেনি। খেলা শুরুর আগে উরুগুয়ানরা বললেন তাদের বল দিয়ে খেলা হবে, আর্জেন্তিনীয়রাও ওই একই দাবি তুললেন। অবশেষে বেলজিয়ামের রেফারি জাঁ ল্যাঙ্গেনাস, সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে গোছের একটা ব্যবস্থা নিয়ে দু’পক্ষকে বাগে আনেন। দুই দলের বলেই খেলা হবে তবে দুই অর্ধে। যারা টস জিতবে তাদের বল খেলা হবে প্রথম অর্ধে। আর্জেন্তিনা টস জেতে।

১২ মিনিটে পাবলো দোরাদো উরুগুয়েকে ১—০ এগিয়ে দেন, ৩৫ মিনিটে কার্লস পসেল্লে ১—১ করেন এবং গিলারমো স্ত্যাবিলে ৪০ মিনিটে ২—১ করে আর্জেন্তিনাকে এগিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটে পেড্রো সিয়ার গোলে ২—২ হয়। ৬৫ মিনিটে স্যাণ্টোস ইরিয়ার্তে ও খেলার শেষ মুহূর্তে হেকটর কাস্ত্রো গোল দিয়ে উরুগুয়েকে ৪—২ গোলে বিজয়ী এবং বিশ্বকাপের প্রথম অধিকারী করে।

১৯৩০ প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ১৩টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করে, গ্রুপ জয়ীদের নিয়ে সেমিফাইনাল খেলা হয়। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ফ্রান্স ও মেক্সিকোর মধ্যে খেলাটির মাধ্যমে। বিশ্বকাপে প্রথম গোলটি করেন ৪—১ গোলে বিজয়ী ফ্রান্সের লুই লরেঁ। এই খেলায় ফ্রান্সের গোলকিপার ১০ মিনিটেই আহত হয়ে মাঠ ছাড়ায় তাদের লেফট হাফ জাঁ স্যাঁত্রেল বাকি ৮০ মিনিট গোলরক্ষা করেন। প্রথম বিশ্বকাপে মোট ১৮টি ম্যাচে ৭০টি গোল হয়। সবথেকে বেশি গোল করেন আর্জেন্তিনা, ১৮টি। তারপর উরুগুয়ে, ১৫টি। বলিভিয়া ও বেলজিয়াম একটিও গোল করতে পারেনি। উরুগুয়ে তিনটি মাত্র গোল খেয়েছিল। গোলদাতাদের শীর্ষে ছিল আর্জেন্তিনার গিলারমো স্ত্যাবিলে, ৮টি গোল। আর্জেন্তিনা অধিনায়ক ফেরেইরা প্রথম ম্যাচে আহত হওয়ায় দ্বিতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে স্ত্যাবিলে তার জায়গায় খেলেন এবং বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। মেক্সিকো ৩—৬ গোলে হেরেছিল। বিশ্বকাপে প্রথম মারপিট করে খেলার জন্য মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হন পেরুর অধিনায়ক ডি লা কেসিয়াস। এই ম্যাচে পেরু ১—৩ হারে রুমানিয়ার কাছে। আর্জেন্তিনা ও মেক্সিকো দুই ভাইকে খেলিয়েছিল তাদের দলে। আর্জেন্তিনার পক্ষে উয়ান ও মিগুয়েল এভারিস্তো এবং মেক্সিকোর পক্ষে ফারনাণ্ডো ও ম্যানুয়েল রোজাস। ওলিম্পিক এবং বিশ্বকাপ সোনার পদক জেতা প্রথম ফুটবলাররা হয় উরুগুয়ের সাতজন। এদের মধ্যে চারজন—নাসাজ্জি, আনদ্রেদে, স্কারোনে ও সিয়া আবার ‘ডাবল’ ওলিম্পিক (১৯২৪ ও ১৯২৮) সোনার পদকজয়ী। বিশ্বকাপ জয়ী দলে এখন পর্যন্ত উরুগুয়ের কাস্ত্রোর মত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কেউ খেলেনি। শিশুবয়সে দুর্ঘটনায় তার বাঁ হাতের বেশিরভাগটাই কেটে বাদ দিতে হয়। পেরুর বিরুদ্ধে একমাত্র গোলটি করে তিনি দেশকে জেতান বটে কিন্তু পরের দুটি ম্যাচে তাকে বসান হয়। ফাইনাল খেলায় তিনি রিজার্ভে ছিলেন। খেলার দু ঘণ্টা আগে আনসেলমো অসমর্থ বিবেচিত হওয়ায় কাস্ত্রো দলে স্থান পান এবং উরুগুয়ের চতুর্থ গোলটি করেন।

প্রথম বিশ্বকাপে একটা ব্যাপারে সংগঠকদের হুঁশ ছিল না—তৃতীয় স্থানাধিকারীর জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা। সেমিফাইনালে যুগোশ্লাভিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একই ফল, ১—৬ গোলে হারে এবং তাদের মধ্যে প্লে—অফ খেলা হয়নি। তবে গ্রুপের খেলায় যুক্তরাষ্ট্রের গোলের গড় একটু ভাল থাকায় তারা হয়তো তৃতীয় স্থান দাবি করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ইওরোপে অনুষ্ঠিত হবে বলে সবাই একমত হলেও কোন দেশে সেটি হবে স্থির করার জন্য ফিফা—কে দীর্ঘ আটটি বৈঠক করতে হয়। অবশেষে স্থির হয় ১৯৩৪—এ দ্বিতীয় বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নশিপ হবে ইতালিতে।

১৯৩৪
ইতালি

ইতালিতে তখন মারমুখো ফাসিস্ত দলের রাজত্ব। দলের প্রধান বেনিতো মুসোলিনির একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ইতালিকে বলশালী, সমৃদ্ধবান, মহান ও স্বাধীন রূপে বিশ্বে জাহির করা। বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের সুযোগটা পেয়ে তিনি অকাতর অর্থব্যয়ে একে স্মরণীয় ও বিশাল উৎসবের আকার দিতে মনস্থ করলেন ফাসিস্ত মতবাদের গৌরব প্রকাশের জন্য। আর এটাও সেইসঙ্গে বোঝা গেল, মুসোলিনি চাইছেন ইতালি বিশ্বকাপ জয় করুক—যে কোন মূল্যে।

ফিফার সদস্য সংখ্যা তখন ৪৬। নাম দিয়েছিল ২৯টি দেশ। চূড়ান্ত পর্বের ১৬টি দেশকে বাছাইয়ের জন্য বিশ্বের নানা দেশে যোগ্যতা নির্ধারক খেলা হয়। ঠিক হয় ১৬টি দেশের মধ্যে সোজা নকআউট পদ্ধতিতে, আটটি প্রথম রাউণ্ডের চারটি দ্বিতীয় রাউণ্ডের, দুটি সেমিফাইনালের ও ফাইনালের খেলা হবে। প্রথম বিশ্বকাপের গ্রুপ পদ্ধতিতে খেলার ব্যবস্থাটা এবার বাতিল হয়ে গেল। তৃতীয় স্থানাধিকারী নির্ণয়ের জন্য পরাজিত দুই সেমিফাইনালিস্টের মধ্যে খেলার ব্যবস্থাও রাখা হল।

চার বছর আগে ইওরোপের দেশগুলি অবহেলা দেখিয়ে যে ব্যবহার করেছিল উরুগুয়ে তা ভোলেনি। তাই তারা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ বর্জন করে। অবশ্য অন্য কারণও ছিল। টাকার ব্যাপারে তাদের দেশের খেলোয়াড়রা তখন ধর্মঘটের হুমকি দিচ্ছে, তাছাড়া দুটি ওলিম্পিক ও বিশ্বকাপ জেতান খেলোয়াড়রা অবসর নেওয়ায় উরুগুয়ে খুব দুর্বলও হয়ে পড়েছিল। আর্জেন্তিনা একটা কাঁচা দল পাঠায় এই ভয়ে যে, ভাল খেলোয়াড় পাঠালেই তো ইতালীয় ক্লাবগুলো টাকার জালে তাদের ধরে নেবে! এই ভয়টা মোটেই অমূলক নয়। ১৯৩০ ফাইনালের আগে উইঙ্গার ওরসিকে তারা হারিয়েছে। তারপর হারিয়েছে সেণ্টার হাফ অধিনায়ক মন্তি এবং অপর উইঙ্গার গুইতাকে। ইতালির ম্যানেজার এবং ফুটবলের অন্যতম প্রবাদপুরুষ ভিত্তোরিও পোজ্জো তার দলে এই তিনজনকে স্থান দিলেন ‘ওরিউণ্ডি’ অর্থাৎ ইতালিয়ানদের সন্তান হিসাবে। দুটি দেশের হয়ে যারা বিশ্বকাপে খেলেছে মন্তি হলেন তাদের মধ্যে প্রথমজন।

চূড়ান্ত পর্বে খেলার জন্য ইতালিতে হাজির হয় ষোলর বদলে সতেরোটি দেশ। বাড়তি অতিথিটি যুক্তরাষ্ট্র। এত দেরি করে তারা নাম পাঠায় যে যোগ্যতা নির্ধারক পর্বে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এসে যখন পড়েছে তখন কি আর করা যায়, তাদের জন্য একটা বিশেষ যোগ্যতা নির্ধারক খেলার ব্যবস্থা হল মেক্সিকোর সঙ্গে। হাইতি আর কিউবাকে হারিয়ে মেক্সিকো ইতালিতে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তারা ২—৪ গোলে হেরে বিদায় নিল।

দ্বিতীয় বিশ্বকাপ রোমে শুরু হল ইতালি আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ম্যাচটি দিয়ে আর ইতালি জিতল ৭—১ গোলে। শিয়াভিও হ্যাটট্রিক করল। অনুষ্ঠাতাদেশ এখন যেমন সরাসরি চূড়ান্ত পর্বে খেলে তখন সেই নিয়ম ছিল না। ইতালিকে যোগ্যতা নির্ধারক পর্বে খেলতে হয়েছিল গ্রীসের সঙ্গে এবং সহজেই ম্যাচদুটি জেতে। পোর্তুগালকে প্রথম ম্যাচে ৯—০ গোলে হারিয়ে রিটার্ন ম্যাচে স্পেন ১—২ হেরে যায়। তখন ঠিক হয় স্পেনই ইতালিতে খেলতে যাবে এবং বিশ্বকাপে তারাই প্রথম দল যারা গোলের গড় ভাল থাকার জন্য চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা পায়। বিশ্বকাপের একটি ম্যাচে চারটি গোল দেওয়া প্রথম লোক আইরিশ ফ্রি স্টেটের অর্থাৎ এখনকার আয়ারল্যাণ্ড প্রজাতন্ত্রের প্যাডি মুর। যোগ্যতা পর্বে বেলজিয়ামের সঙ্গে ৪—৪ ফলে তার নিজের দলের সবকটি গোলই মুরের। আয়ারল্যাণ্ড অবশ্য ইতালি যেতে পারেনি হল্যাণ্ডের কাছে হেরে যাওয়ায়।

প্যারিসে ১৯২৪ ওলিম্পিকে পদক জিতবে বলে খেলতে গিয়ে হাঙ্গেরি দল প্রথম রাউণ্ডেই অখ্যাত মিশরের কাছে ০—৩ গোলে হেরে দেশে ফিরে গেছল। এবার তাদের সঙ্গেই প্রথম খেলা। হাঙ্গেরি ৪—২ গোলে জেতে। দক্ষিণ আমেরিকার দুটি দল, ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনা প্রথম রাউণ্ডেই যথাক্রমে স্পেনের কাছে ১—৩ ও সুইডেনের কাছে ২—৩ গোলে হেরে যাওয়ায় দ্বিতীয় রাউণ্ডে ইওরোপীয়ানরা ছাড়া আর কেউ রইল না। স্পেনের বিরুদ্ধে পেনাল্টি পেয়ে ব্রাজিলের ডি ব্রিটো গোল করতে পারেননি। বিশ্বকাপে এমন ঘটনা এই প্রথম। এই ডি ব্রিটোই পরবর্তীকালে পেলেকে আবিষ্কার করে খেলা শিখিয়ে ছিলেন।

বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম অমীমাংসিত খেলা, প্রথম অতিরিক্ত সময় খেলা এবং প্রথম সফল পেনাল্টি কিকটি ঘটে অস্ট্রিয়া বনাম ফ্রান্সের খেলাতে। ফল ১—১ হওয়ায় অতিরিক্ত সময় খেলা হয়। ফ্রান্সের ভেরিয়েত পেনাল্টি কিকে গোল দেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত উগো মিজলের ‘ভুণ্ডার টিম’ রূপে খ্যাত অস্ট্রিয়া দল ৩—২ জেতে। প্রথম রি—প্লে ম্যাচটি হয় স্পেন ও ইতালির মধ্যে খেলা ১—১ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরই। স্পেনের বিশ্বখ্যাত গোলকিপার ও অধিনায়ক রিকার্ডো জামোরা এমন অসাধারণ খেলছিলেন যে তাকে আঘাতের পর আঘাত সহ্য করতে হয় কিন্তু সুইস রেফারি মার্সেট তা উপেক্ষা করেন। রি—প্লে ম্যাচে জামোরা আর মাঠে নামতে পারেনি তাই নয়, স্পেনকে সাতজন খেলোয়াড় বদলাতে হয় চোট পাওয়ার জন্য। ইতালি মিয়াজ্জার একমাত্র গোলে ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠে অস্ট্রিয়াকেও গুইতার গোলে ১—০ হারিয়ে ফাইনালে যায়। অপরদিকে চেকোশ্লোভাকিয়া সেমিফাইনালে জার্মানিকে ৩—১ হারিয়ে ইতালির মুখোমুখি হল।

৫৫ হাজার দর্শক রোম স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলা দেখে তার মধ্যে ছিলেন মুসোলিনিও। চেকদের পক্ষে প্রথম গোল করেন পুক ৭০ মিনিটে। ১২ মিনিট পর ওরসি গোলটি শোধ করেন। ১—১ খেলা শেষ হবার পর অতিরিক্ত সময়ের সাত মিনিটে শিয়াভিও গোল করে ইতালিকে বিশ্বকাপ জয়ী করান। তৃতীয় স্থান পায় জার্মানি ৩—২ গোলে অস্ট্রিয়াকে হারিয়ে। প্রথমবারের মত দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও গোল হয়েছে ৭০টি, ১৬টি ম্যাচ ও একটি রি—প্লে থেকে। সর্বাধিক গোল দেয় ইতালি ১২টি, তারপর জার্মানি ১১টি। প্রত্যেকটি দেশই গোল করেছে। ব্যক্তিগত সর্বাধিক গোল ৪টি করে দিয়েছিলেন।

তিনজন—শিয়াভিও (ইতালি), নিদলি (চেকোশ্লোভাকিয়া) এবং কোনেন (জার্মানি)।

১৯৩৮ ফ্রান্স

নিজ দেশে খেললে সুবিধা বেশি পাওয়া যায়, এই ধারণাটা প্রথম দুটি বিশ্বকাপের পর বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ফ্রান্সে ১৯৩৮ বিশ্বকাপে সেটা উৎপাটিত হল ইতালির খেতাব রক্ষার দ্বারা। ইওরোপে তখন যুদ্ধের ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে। জার্মানি দখল করে নিয়েছে অস্ট্রিয়া, স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলছে। বিশ্বকাপ অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল আর্জেন্তিনা কিন্তু না পাওয়ায় তারা বয়কট করেছে। উরুগুয়ে এবারও উপেক্ষা করল। অস্ট্রিয়া নাম প্রত্যাহার করায় শূন্যস্থান পূরণে ইংল্যাণ্ডকে আমন্ত্রণ করা হয় কিন্তু তারা অংশ নিতে রাজি হল না। ইতালির শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারার মত দেশগুলির কয়েকটি এবার অংশ নেয়নি। চার বছর আগে বিশ্বকাপ জয়ী দলটির মাত্র দু’জন, মিয়াজ্জা ও ফেরারি ছাড়া ১৯৩৮—এ সবাই নতুন মুখ। ১৯৩৬—এ ম্যানেজার পোজ্জোর গড়া দল ওলিম্পিক সোনা জেতে। সেই দলের তিনজনকে তিনি বিশ্বকাপ দলে তুলে আনেন আর আবিষ্কার করেন এক মারাত্মক সেণ্টার ফরোয়ার্ড—সিলভিয়ো পিওলা।

ফিফা—র সদস্য এখন ৫১। বিশ্বকাপে যোগ দেয় ৩৬টি দেশ। এইবারই প্রথম খেতাব দখলে রাখা দেশ এবং অনুষ্ঠাতা দেশ যোগ্যতা পর্ব থেকে না খেলে সরাসরি চূড়ান্ত পর্বে খেলছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসেছে শুধু ব্রাজিল। তাদের দলে আছে ‘ব্ল্যাক ডায়মণ্ড’ লিওনিদাস দা সিলভা নামে নতুন এক চাঞ্চল্যকর সেণ্টার ফরোয়ার্ড। এশিয়া থেকে প্রথম দেশ ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজ এবারই চূড়ান্ত পর্বে খেলতে এসেছে আর এসেছে কিউবা। বলাবাহুল্য দুটি দেশেরই এই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্বে শেষ আবির্ভাব। তবে কিউবা প্রথম রাউণ্ডে রুমানিয়ার সঙ্গে ৩—৩ করে রি—প্লেতে ২—১ গোলে জেতে। কিন্তু দ্বিতীয় রাউণ্ডে ০—৮ হারে সুইডেনের কাছে এবং গুস্তাফ ভেটারস্ট্রোম চারটি গোল করে। ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজকে প্রথম খেলাতেই ০—৬ গোলে হারায় হাঙ্গেরি। অস্ট্রিয়ার সেরা চারজন খেলোয়াড়কে শেপ হারবার্গার তাঁর জার্মান দলে নিয়ে সুইৎজারল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ১—১ করেন। রি—প্লে খেলায় জার্মানি ২—৪ গোলে হেরে যায়। বিশ্বকাপে প্রথম আত্মঘাতী গোলটি হয় এই খেলায় যখন জার্মানি দ্বিতীয় গোলটি পায় সুইৎজারল্যাণ্ডের লোয়েৎশারের দ্বারা।

প্রথম রাউণ্ডে ব্রাজিল ও পোল্যাণ্ডের খেলায় হয় মোট ১১ গোল। ৯০ মিনিট খেলার পর ফল থাকে ৪—৪, এত গোলে অমীমাংসিত থাকারও এটি রেকর্ড। একটি খেলায় দু’জনের হ্যাটট্রিক এবং দু’জনের প্রত্যেকের চারটি করে গোল দেওয়া (তৃতীয় লোক ভেটারস্ট্রোম) এটিও চূড়ান্ত পর্বের রেকর্ড এবং এখনো তা বজায় রয়েছে। ব্রাজিলের লিওনিদাস প্রথমার্ধে এবং পোল্যাণ্ডের আরনেস্ট ভিলিমৌস্কি দ্বিতীয়ার্ধে হ্যাটট্রিক এবং অতিরিক্ত সময়ে দু’জনেই আবার একটি করে গোল দেন। সমাপ্তির কিছু আগে ব্রাজিলের রোমু গোল দিয়ে ব্রাজিলকে ৬—৫ জেতান। এরপর ব্রাজিলকেই বিশ্বকাপের সম্ভাব্য বিজয়ীরূপে গণ্য করা হতে থাকে।

কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল ও চেকোশ্লোভাকিয়ার খেলায় এত বেশি বন্য পদ্ধতির প্রয়োগ হয়েছিল যে ব্রাজিলের দু’জন ও চেক দলের একজনকে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয়। চেক দলের গোলরক্ষক প্ল্যানিকার হাত এবং ইনসাইড লেফট নিদলির পা ভাঙে। খেলা ১—১ হয়। রি—প্লেতে দুটি দলই প্রায় নতুন খেলোয়াড়ে সাজান হয়। ব্রাজিলের লিওনিদাস ও গোলকিপার ওয়াল্টার ছাড়া আগের ম্যাচের আর কেউ ছিল না। চেক—রা নামায় নতুন ছয়জনকে। শান্তভাবে খেলাটি হয়। ব্রাজিল ২—১ গোলে যেতে।

সেমিফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে ব্রাজিলের ম্যানেজার পিমেণ্টা তৃতীয় বিশ্বকাপের সবথেকে গুরুতর ভুলটি করলেন দলের দুই সেরা, প্রতিযোগিতার দুই অসাধারণ নায়ক লিওনিদাস এবং টিমকে বসিয়ে রেখে। ‘ফাইনালের জন্য ওদের তুলে রাখলাম।’ দম্ভভরে তিনি এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে আর ব্রাজিলকে পৌঁছতে হল না। দুটি ম্যাচে ছয় গোল করা লিওনিদাসকে বাদ দিয়ে খেলতে নামার মাশুল গুনতে হল ব্রাজিলকে ১—২ গোলে হেরে। অন্য সেমিফাইনালে খেলার ৩৫ সেকেণ্ডে বিশ্বকাপে তখনকার দ্রুততম গোলটি করে সুইডেনের ওলে নাইবার্গ হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে দলকে এগিয়ে দিলেও তারপর পাঁচটি গোল খেয়ে ১—৫ গোলে হেরে যায়। প্যারিসে কলম্বেস স্টেডিয়ামে ৪৫ হাজার দর্শকের সামনে ফাইনাল খেলায় ইতালি ৪—২ গোলে হাঙ্গেরিকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতে। সুইডেনকে ৪—২ গোলে হারিয়ে ব্রাজিল তৃতীয় স্থানাধিকারী হয়।

তৃতীয় বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৫টি দলের মধ্যে ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজ ও হল্যাণ্ড কোন গোল করতে পারেনি। সর্বাধিক গোল করে হাঙ্গেরি, ১৫টি। তারপর ব্রাজিল, ১৪টি। ব্যক্তিগত গোল সবথেকে বেশি লিওনিদাসের, চারটি খেলায় আট গোল। এরপর হাঙ্গেরির জেলেঞ্জারের সাতটি। চারটি হ্যাটট্রিক হওয়ার রেকর্ড হয় এবং তা টিকে ছিল ১৯৫৮ পর্যন্ত। যে দশজন বিশ্বকাপ ইতিহাসে ওলিম্পিকস ও বিশ্বকাপ স্বর্ণপদক জিতেছেন তাদের শেষ তিনজন, ইতালির ফোনি, রাভা ও লোকাতেল্লি খেললেন এইবার। ওরা ১৯৩৬ ওলিম্পিকস ফাইনালে জিতেছিলেন।

১৯৫০ ব্রাজিল

১৯৩৯ সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা দীর্ঘ ১২ বছর বন্ধ থেকে চতুর্থবারের মত শুরু হয় ব্রাজিলে। ১৯৩৪ থেকে ১৬ বছর ধরে ইতালির দখলে ছিল বিশ্বকাপ ও বিশ্ব খেতাব। ফিফার ৬৮ সদস্যের মধ্যে ৩১টি দেশ নাম দেয় এবং চূড়ান্ত পর্বের ১৬ দলের মাত্র ১৩টি হাজির হয়। ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া এল না। জার্মানি তখনো ফিফা—র বাইরে। বহু অর্থব্যয় করে এতদূর এসে শুধু একটি ম্যাচ খেলেই কোন দেশকে যাতে ফিরে যেতে না হয় সেজন্য এইবার প্রতিযোগিতা নতুনভাবে বিন্যস্ত হল। প্রথম বিশ্বকাপের মত চারটি যোগ্যতা নির্ধারক গ্রুপ করে তার শীর্ষস্থানীয় চার দলকে নিয়ে চূড়ান্ত একটি লীগ খেলার ব্যবস্থার করা হয়, নক আউটের বদলে। লীগ বিজয়ীই পাবে জুল রিমে ট্রফি। উরুগুয়ে ২০ বছর পর আবার খেলতে এল আর এই প্রথমবার এল ইংল্যাণ্ড। গত দুইবারের বিজয়ী ইতালি খেতাব রক্ষার জন্য এল বটে কিন্তু তাদের আশা চূর্ণ হয়ে গেছল ১৯৪৯ মে মাসে বিমান দুর্ঘটনায় যখন তোরিনো ক্লাবের ১৭ জন খেলোয়াড় মারা গেলেন। ওদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ইতালির আন্তর্জাতিক ফুটবলার।

৩১৮ মিটার উঁচু এবং ৯৪৫ মিটার বৃত্তের এক নতুন স্টেডিয়াম এই বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার জন্য রিও ডি জেনিরোয় মারাকানা নদীর ধারে তৈরি করা হল। তাতে দু লক্ষ দর্শক খেলা দেখতে পারবেন। ১৯৫০—এর ২৪ জুন ব্রাজিল মারাকানা স্টেডিয়ামে ৪—০ গোলে মেক্সিকোকে হারিয়ে চতুর্থ বিশ্বকাপের উদ্বোধন করে। প্রথম দুটি গোল করেন আদেমির। ইংল্যাণ্ড এই স্টেডিয়ামেই তাদের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচটি খেলল চিলির সঙ্গে এবং জিতল ২—০ গোলে। তখন বিশ্বের নামী কয়েকজন খেলোয়াড় ছিলেন ইংল্যাণ্ড দলে, যেমন অধিনায়ক বিলি রাইট, ম্যানিয়ন, টম ফিনি, আলফ র‌্যামজি, বেণ্টলি, মর্টেনসন এবং স্ট্যানলি ম্যাথুজ। তবে প্রথম দুটি ম্যাচে ম্যাথুজকে খেলান হয়নি। তাদের দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, রিও থেকে ৩০০ মাইল দূরে বেলো হরাইজেন্তাো (বিউটিফুল হরাইজন) শহরে। এই যুক্তরাষ্ট্র দলটি ছিল যেন এক খুদে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর অধিনায়ক একজন স্কট, একজন ব্যাক ছিলেন বেলজিয়ান, সেণ্টার ফরোয়ার্ড গেতিয়েনস ছিলেন হাইতির লোক, তাছাড়া ছিলেন দু’জন ইতালিয়ান, একজন দক্ষিণ আমেরিকান, একজন আইরিশ—আমেরিকান ও দু’জন জার্মান—আমেরিকান। এরা প্রথম ম্যাচে স্পেনের কাছে ১—৩ হেরে মুখোমুখি হল ইংল্যাণ্ডের এবং বিশ্বকাপ ইতিহাসের বৃহত্তম আপসেটটি ঘটাল। জোড়াতালি দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রকে তুড়ি মেরে ওড়াব এমন এক মনোভাব নিয়ে ইংল্যাণ্ড মাঠে নেমেছিল। ৩৮ মিনিটে হেড করে গেতিয়েনসের দেওয়া গোলে ১—০ জিতে যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দেয়। ইংল্যাণ্ডের পরের ম্যাচ স্পেনের সঙ্গে। ম্যাথুজকে নামিয়েও তারা ১—০ হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রও বিদায় নেয় চিলির কাছে ৫—২ হেরে।

ইংরাজ কোচ জর্জ রেনরের হাতে গড়া সুইডেন দল ১৯৪৮ ওলিম্পিকসে সোনা জিতেছিল। ব্রাজিলে তিনি যে দলটি আনেন সেটি পুরোপুরিই অপেশাদার। ৩—২ গোলে এরা ইতালিকে হারায়। এরপর ইতালি ২—০ প্যারাগুয়েকে হারালেও আর এগোতে পারেনি। উরুগুয়ে ৮—০ বলিভিয়াকে হারিয়ে চার দলের চূড়ান্ত লীগে ব্রাজিলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। লীগে বাকি দুটি দল হল সুইডেন ও স্পেন। ব্রাজিল ৭—১ সুইডেনকে ও ৬—১ স্পেনকে হারিয়ে দেওয়ায় এবং উরুগুয়ে ২—২ স্পেনের সঙ্গে খেলা শেষ করায় কারুর আর কোন সন্দেহ রইল না বিশ্বকাপটি ব্রাজিলের অধিনায়ক অগাস্তোর হাতেই উঠছে। তারা তখন ২৫—১ ফেভারিট।

সরকারীভাবে বলা হয়েছিল ১৬ জুলাই লীগের শেষে খেলাটি দেখতে ১,৯৯,৮৫০ দর্শক মারাকানা স্টেডিয়ামে ছিল, আসলে ছিল দু’লক্ষেরও বেশি। বিশ্বকাপে এটা একটা রেকর্ড। খেলা শুধু ড্র রাখলেই ব্রাজিল ট্রফি জিতে যাবে। কিন্তু শেষের এই খেলাটি যে ধাক্কা দিল সেটা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যাণ্ডের পরাজয়ের থেকেও বেশি। হাফটাইমের দু মিনিট পর ব্রাজিলের ফ্রিয়াকা গোল দেন। ১৮ মিনিট পর শিয়াফিনো সেটি শোধ করেন। ৮০ মিনিটে ঘিগ্গিয়া গোল দিয়ে উরুগুয়েকে আবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করেন। তৃতীয় স্থান পায় সুইডেন ৩—১ স্পেনকে হারিয়ে।

চতুর্থ বিশ্বকাপে ২২টি খেলায় হয় ৮৭ গোল। সবথেকে বেশি গোল দেয় ব্রাজিল ২২টি, তারপর উরুগুয়ে ১৫টি। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চচ গোল ব্রাজিলের আদেমির করেন, ৭টি। ১৯৩০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের জোসে আন্দ্রাদে বিজয়ীর পদক পান, ১৯৫০—এ তার ভাইপো রডরিগুয়েজ আন্দ্রাদেও বিজয়ীর পদক পেলেন। দুই ভাই একই খেলায় গোল করার প্রথম নজির রাখলেন প্যারাগুয়ের আন্তাোনিও এবং ফ্রান্সেসকো লোপেজ। তারা গোল দেন সুইডেনকে।

১৯৫৪ সুইৎজারল্যাণ্ড

ফিফা—র ৫০ বছর পূর্তি এবং তার সদর দফতর জুরিখে সুতরাং পঞ্চম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা তো সুইৎজারল্যাণ্ডে হওয়াই স্বাভাবিক। চূড়ান্ত পর্বের বিন্যাস আর একবার বদলান হল। ১৬টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করে, প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দুটি দল নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল। সেখানে চার গ্রুপ বিজয়ীরা একদিকে এবং চার রানার্সরা অন্যদিকে নকআউট খেলে সেমিফাইনালে চারটি দল এবং তারপর ফাইনালে দুটি দল যাবে।

ইতিমধ্যে পশ্চিম জার্মানি বিশ্ব ফুটবল গোষ্ঠীতে আবার এসে ইওরোপে নতুন ফুটবল শক্তিধর রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। চমকপ্রদ প্রতিভাবান একটি প্রজন্মের উদয় ঘটেছে হাঙ্গেরিতেও। ইংল্যাণ্ড তখনো উটপাখির মত বালিতে মাথা ঢুকিয়ে বিশ্বাস করে যাচ্ছে, যারা পৃথিবীকে ফুটবল খেলা শেখাল তারাই তো সবার সেরা! বিশ্বাসের কারণ, দেশের মাটিতে তারা তখনো হারেনি। কিন্তু ১৯৫৩—র নভেম্বরে হাঙ্গেরিয়ানরা লণ্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে এসে ইংল্যাণ্ডের মোহ চূর্ণ এবং ঐতিহ্যের অসারত্ব প্রমাণ করে ৬—৩ গোলে এবং ছ’মাস পর বুদাপেস্তে, বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক তিন সপ্তাহ আগে আবার ৭—১ গোলে ইংরাজদের জবাই করে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়ে গেল দক্ষিণ আমেরিকার কাছ থেকে ফুটবল শ্রেষ্ঠত্ব ছিনিয়ে নিতে এবার একটা দল এসে গেছে। গত চার বছরে তারা একটিও আন্তর্জাতিক ম্যাচ হারেনি।

ফিফা—র ৮০ সদস্যের মধ্যে ৩৬টি দেশ অংশ নেয় পঞ্চম বিশ্বকাপে। উরুগুয়ে ও সুইৎজারল্যাণ্ড ছাড়া হাঙ্গেরিও বাছাই পর্বে না খেলেই চূড়ান্ত পর্বে চলে আসে যেহেতু তাদের গ্রুপের একমাত্র দল পোল্যাণ্ড নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ব্রাজিল পাঁচটি বিশ্বকাপের সবকটির চূড়ান্ত পর্বে খেলা প্রথম দেশ হল এইবারই। স্পেন ও তুরস্কের মধ্যে খেলায় দু দলই একটি করে জেতায় এবং প্লে—অফ ২—২ হওয়ায় অবশেষে লটারিতে তুরস্ক ভাগ্যবান প্রমাণিত হয়। অস্ট্রিয়া ৯—১ গোলে পর্তুগালকে হারায়। ফ্রান্স ৬—১, ৮—১ লাকসেমবুর্গকে এবং আয়ারল্যাণ্ডকে ৫—৩, ১—০ গোলে হারিয়ে চূড়ান্ত পর্বে আসে। দক্ষিণ কোরিয়া ৫—১ ও ০—০ ফলে জাপানকে হারিয়ে এবং গ্রুপের তৃতীয় দল চীন নাম প্রত্যাহার করায় তারা সুইৎজারল্যাণ্ড যাওয়ার ছাড়পত্র পায়। কিন্তু সেখানে প্রথম খেলাতেই তারা হাঙ্গেরির সামনে পড়ে। দু বছর আগে ওলিম্পিক সোনা জেতা হাঙ্গেরি দলের এগারোজনই মাঠে নামে এবং ৯—০ গোলে জিতে চূড়ান্ত পর্বে একটি খেলায় তখনকার সর্বাধিক গোল দেওয়ার রেকর্ড করে। উরুগুয়ে ৭—০ স্কটল্যাণ্ডকে, ব্রাজিল ৫—০ মেক্সিকোকে হারায়। ম্যাথুজ, ফিনি, লফটহাউস সমৃদ্ধ ইংল্যাণ্ড ৪—৪ করে বেলজিয়ামের সঙ্গে। প্রাথমিক গ্রুপের খেলায় বিশ্বকাপ ইতিহাসের একটা বিরাট ‘যদি’ তৈরি হল। পশ্চিম জার্মানির সেণ্টার হাফ লাইব্রিখ হাঙ্গেরির অধিনায়ক পুসকাসকে যদি লাথি মেরে জখম না করতেন, এই জখমের ফলে পুসকাস ফাইনালের আগে আর খেলতে পারেননি এবং ফাইনালে খেলেছিলেন সম্পূর্ণ ফিট না থেকে। ফাইনালে যদি পুসকাস ফিট থাকতেন তাহলে কি হতে পারত?

গ্রুপ লীগে তুরস্ক ৭—০ কোরিয়াকে হারিয়ে দুটি পয়েণ্ট পেয়েছে। কোঃ ফাইনালে ব্রাজিলের সম্মুখীন না হবার জন্য জার্মানির কোচ শেপ হারবার্গার স্থির করলেন তাদের বিরুদ্ধে গ্রুপের খেলায় হাঙ্গেরি জিতুক। তারপর জার্মানরা তুরস্ককে হারিয়ে দুটি পয়েণ্ট নিয়ে ওদের সঙ্গে সমান হলেই প্লে—অফ ম্যাচ হবে। সেই খেলায় জার্মানরা যে তুর্কিদের হারাবেই হারবার্গারের তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। পরিকল্পনা মতই জার্মানরা খেলল। ছয়জন রিজার্ভকে নামিয়ে হাঙ্গেরির কাছে ৩—৮ গোলে হেরে, তুরস্ককে ৪—১ এবং প্লে—অফে ৭—২ গোলে হারিয়ে তারা কোঃ ফাইনালে হাঙ্গেরির বদলে পড়ল যুগোশ্লাভিয়ার সামনে এবং ২—০ জিতল। চারটি গ্রুপের খেলা সম্পূর্ণ হল ৯২ গোলের রেকর্ড তৈরি করে।

কোঃ ফাইনালে ইংল্যাণ্ড ২—৪ গোলে উরুগুয়ের কাছে হারল। বার্ণ শহরে হাঙ্গেরি ও ব্রাজিলের মধ্যে খেলাটি ‘ব্যাটল অব বার্ণ’ নামে কুখ্যাতি লাভ করল মাঠে ও তার বাইরে খেলোয়াড়দের মধ্যে মারপিটের জন্য। খেলার চতুর্থ মিনিটে হিদেকুটির ও অষ্টম মিনিটে কোজিসের গোলে হাঙ্গেরি ২—০ এগিয়ে যায়। বিরতির ঠিক আগে পেনাল্টি কিক থেকে জালমা স্যাণ্টোস একটি গোল শোধ করেন। দ্বিতীয়ার্ধে হাঙ্গেরির ল্যানটস পেনাল্টি কিক থেকে একটি গোল দেন। জুলিনহো শোধ করেন একটি গোল। ব্রাজিল তখন ২—৩ গোলে পিছিয়ে। মাঠে তখন কুৎসিত মারামারি শুরু হয়ে যায়। ইংরাজ রেফারি আর্থার এলিস ব্রাজিলের নিলটন স্যাণ্টোস ও উমবার্তো তোজ্জিকে এবং হাঙ্গেরির বোজিককে মাঠ থেকে বার করে দেন। এরপর কোজিস হাঙ্গেরির চতুর্থ গোলটি করেন। এই খেলায় ৪২টি ফ্রি কিক, দুটি পেনাল্টি, চারজনকে হুঁশিয়ারি এবং তিনজনের বহিষ্কার ঘটে। খেলার পর ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা হাঙ্গেরির ড্রেসিংরুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে সেখানে আক্রমণ চালায়।

সেমিফাইনালে জার্মানরা ৬—১ গোলে হারাল অস্ট্রিয়াকে আর হাঙ্গেরি পরিচ্ছন্ন সুন্দর খেলে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে জিতল ৪—২ গোলে। বিশ্বকাপে ১৯৩০ থেকে উরুগুয়ের অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভেঙে গেল। বার্ণ—এ ১৪ জুলাইয়ের ফাইনাল নিছকই আনুষ্ঠানিক একটা খেলা হবে ধরে নেওয়া হয় কেননা হাঙ্গেরিকে তখনই বিশ্বকাপ বিজয়ী রূপে সবাই গণ্য করতে শুরু করে দিয়েছে। খেলাটা প্রচণ্ড গতিতে শুরু করে হাঙ্গেরি ছয় মিনিটে পুসকাসের ও সাত মিনিটে জিবরের দেওয়া গোলে ২—০ এগিয়ে যায়। কিন্তু তিন মিনিট পরই মোরলক এবং তার নয় মিনিট পর হেলমুট রাহন গোলদুটি শোধ করে দেন। এরপর বোঝা যেতে থাকে আনফিট পুসকাসকে খেলানোর সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। খেলা থেকে তিনি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যান। সমাপ্তির পাঁচ মিনিট আগে রাহন আবার গোল করে পশ্চিম জার্মানিকে অপ্রত্যাশিত জয় এনে দেন। তৃতীয় স্থান পায় অস্ট্রিয়া ৩—১ গোলে উরুগুয়েকে হারিয়ে।

পাঁচটি ম্যাচে হাঙ্গেরির ২৭ গোল এখনো বিশ্বকাপ রেকর্ড। স্যাণ্ডর কোজিসের ১১ গোল (দুটি হ্যাটট্রিকসহ) তখন রেকর্ড গণ্য হয়। জার্মানি ছয় খেলায় ২৫ গোল দেয়। চূড়ান্ত পর্বে মোট ১৪০ গোলের রেকর্ড হয়েছিল। স্কটল্যাণ্ড, কোরিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া একটি গোলও করতে পারেনি। জার্মানির ফ্রিৎশ এবং ওটমার ভাল্টার হলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা এবং সোনার পদক পাওয়া প্রথম দুই ভাই।

১৯৫৮
সুইডেন

ষষ্ঠ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ফিফার ৮৬ সদস্যের মধ্যে অংশ নেয় ৬০টি দেশ। চূড়ান্ত পর্বে এবারই প্রথম এল ওয়েলস, উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওয়েলসের সুইডেনে আসাটা বরাত জোরেই ঘটে। যোগ্যতা পর্বে তারা গ্রুপে চেকোশ্লোভাকিয়ার পরেই ছিল। এদিকে এশিয়ান—আফ্রিকান যোগ্যতা পর্বের গ্রুপের চারটি শাখা থেকে ইন্দোনেশিয়া, সাইপ্রাস, তুরস্ক ও ইজরায়েল শীর্ষ স্থান পায়। এবার এই চার দেশের মধ্যে খেলায় স্থির হবে কে সুইডেনে যাবে। কিন্তু তিনটি দেশ হঠাৎ নাম প্রত্যাহার করার ফলে ইজরায়েলই যোগ্যতা পায় একটি ম্যাচও না খেলে। কিন্তু ফিফা বলে তা হতে পারে না, একটি ম্যাচ খেলতেই হবে। ইওরোপের আটটি গ্রুপের রানার্সদের নিয়ে লটারি হয় এবং তাতে ওয়েলসের নাম ওঠে। তারা ২—০, ২—০ ইজরায়েলকে হারিয়ে চূড়ান্ত পর্বের জন্য যোগ্যতা পায়।

১৯৫৮—র ৬ ফেব্রুয়ারি মিউনিখে বিমান দুর্ঘটনায় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের যে আটজন ফুটবলার মারা যান তার মধ্যে প্রতিভাবান ডানকান এডোয়ার্ডস, রজার বায়ারন, টমি টেলর ও ডেভিড পেগ বিশ্বকাপে খেলার জন্য দলে থাকতেনই। এদের মৃত্যুতে ইংল্যাণ্ড অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বিমানে ম্যাট বুশবি গুরুতর জখম হন। স্কটল্যাণ্ড তাঁকে বিশ্বকাপে দলের ম্যানেজার নিযুক্ত করেছিল কিন্তু তিনি যেতে না পারায় স্কটল্যাণ্ড ম্যানেজার ছাড়াই বিশ্বকাপে খেলতে যায়। এমন ঘটনা আর দ্বিতীয় ঘটেনি।

দু বার বিশ্বকাপ জয়ী দুটি দেশকে সুইডেনে দেখা গেল না। যোগ্যতা বাছাই পর্বেই উরুগুয়ে ও ইতালি বিদায় নেয়। ১৯৫৬—র অভ্যুত্থান হাঙ্গেরির অসাধারণ ফুটবল দলকে খণ্ড খণ্ড করে দেয়। বিশ্বকাপ রানার্স দলের চারজন সুইডেন চলে যান। স্পেনে তিনজন, তাদের একজন পুসকাস। ১৯৫৮ গ্রুপ লীগে ওয়েলসের সঙ্গে তাদের সমান পয়েন্ট হয়। প্লে—অফ ম্যাচে হাঙ্গেরি ২—১ গোলে হারে। স্টকহলমে এই খেলায় ২,৮২৩ জন দর্শক মাঠে ছিল। বিশ্বকাপ চূড়ান্ত পর্বে এটি কম দর্শকের রেকর্ড।

ষষ্ঠ বিশ্বকাপে এমন কয়েকজন তরুণ প্রথমবার খেলেছেন যাঁরা পরবর্তীকালে প্রবাদপুরুষে পরিণত হন। রাশিয়ার লেভ ইয়াশিন, জার্মানির উভে জিলার, আয়ার্ল্যাণ্ডের ডেরেক ডুগান, ফ্রান্সের রেমণ্ড কোপা এবং জুস্ট ফঁত্যেন আর ব্রাজিলের গ্যারিনচা ও পেলে। ববি চার্লটনকে ইংল্যাণ্ড দলের সঙ্গে সুইডেনে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু তাকে একটি ম্যাচও খেলান হয়নি।

ব্রাজিল তাদের প্রথম ম্যাচটি খেলে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে। ইওরোপ এই প্রথম ৪—২—৪ ছক চাক্ষুষ করল। ৩—০ গোলে জেতা এই খেলায় মাজ্জোলা (আসল নাম আলতাফিনি) দুটি গোল করেন, অন্যটি নিলটন স্যান্টোসের। পরের খেলায় ব্রাজিল ০—০ ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলে, তৃতীয় ম্যাচে ২—০ গোলে হারায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। গোল দুটি ভাভা—র। রুশীদের বিরুদ্ধে গোটেনবার্গের ১৫ জুনের এই ম্যাচেই পেলে ও গ্যারিনচা প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে নামেন। কোঃ ফাইনালে ওয়েলসের বিরুদ্ধে গ্যারিনচা, দিদি, পেলে, মাজ্জোলা ও জাগালো সমৃদ্ধ ব্রাজিল ৭০ মিনিট গোল করতে পারেনি। ৭৩ মিনিটে পেলে একক চেষ্টায় তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ গোলটি করেন এবং ওই গোলেই ব্রাজিল জেতে। পেলে বলেছেন, ‘এটি তার খেলোয়াড় জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ গোল।’ সেমি ফাইনালে ফ্রান্সকে ৫—২ হারতে হয় ব্রাজিলের জাদুকরী খেলার কাছে। পেলে হ্যাটট্রিক করেন।

সুইডেন ১৯৫৮ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী খেলায় মেক্সিকোকে ৩—০ হারায়। পেশাদারী প্রথা সুইডেনে চালু হওয়ায়, ম্যানেজার জর্জ রেনর ইতালিতে খেলতে যাওয়া সুইডিশ ভাল খেলোয়াড়দের ডেকে আনেন। মেক্সিকো ১৯৩০ থেকে বিশ্বকাপে চারবার চূড়ান্ত পর্বে খেলে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। এরপর সুইডেন ২—১ হাঙ্গেরিকে হারিয়ে, ০—০ করে ওয়েলসের সঙ্গে। কোঃ ফাইনালে তারা রুশীদের হারায় ২—০ গোলে আর জার্মানদের ৩—১ গোলে হারায় সেমি ফাইনালে।

ফাইনালে বৃষ্টি ও ভিজে মাঠ এবং নিলস লিয়েডহোমের চতুর্থ মিনিটের গোলে পিছিয়ে পড়েও ব্রাজিল বিপন্নবোধ করেনি। পাঁচ মিনিট পরেই ভাভা গোলটি শোধ করেন, তারপরই ম্যাচের পুরো কর্তৃত্ব ব্রাজিলীয়রা পায়ে তুলে নেয়। ৩২ মিনিটে ভাভা আবার গোল পেলেন। ৫৪ মিনিটে পেলে অকল্পনীয় একটি গোল করলেন। নিলটন স্যান্টোসের পাঠানো পাস বুকে থামিয়ে বলটা উরুতে নামালেন, উরু থেকে সেটা সেন্টার হাফ গুস্তাফসনের মাথার উপর দিয়ে তুলেই তাকে পাশকাটিয়ে ছুটে গিয়ে বল মাটিতে পড়ার আগেই ভলি মেরে গোল করেন। মারিও জাগালো ব্রাজিলের চতুর্থ ও সিমোনসন সুইডেনের দ্বিতীয় গোল করার পর পেলে ব্রাজিলের পঞ্চম গোলটি যুক্ত করেন খেলা ভাঙার এক মিনিট আগে। ইওরোপের মাটিতে এই প্রথম দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বিশ্বকাপ জিতল। তৃতীয় স্থান পেল ফ্রান্স ৬—৩ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে। মরক্কো থেকে আসা ফ্রান্সের সেন্টার ফরোয়ার্ড জুস্ট ফঁত্যেন প্রতিটি ম্যাচে গোল দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে মোট ১৩টি গোল করার যে রেকর্ড করলেন তা এখনো অম্লান রয়েছে। পেলে রেকর্ড করলেন, সবথেকে কম বয়সে—১৭ বছর আট মাসে—চূড়ান্ত পর্বে খেলে, গোল দিয়ে এবং সোনার পদক জিতে। চারটি ম্যাচ খেলে তার গোল সংখ্যা ৬। ষষ্ঠ বিশ্বকাপে মোট গোল হয় ৩৫টি ম্যাচ থেকে ১২৬টি। সবথেকে বেশি গোল দেয় ফ্রান্স—২৩টি। তারপর ব্রাজিলের—১৬টি। তারা ১৯৩০ থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে চূড়ান্ত পর্বে এ পর্যন্ত ২৩টি ম্যাচ খেলল ১৪টি জিতে এবং ৬৬ গোল দিয়ে। শুধু একটি ম্যাচেই ব্রাজিল গোল দিতে পারেনি, ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ০—০ করে।

১৯৬২
চিলি

ফিফা—র ১০৪ সদস্য দেশের মধ্যে ৫২টি দেশ ৯১ ম্যাচ খেলে ১৪টিতে বাছাই হয়ে চিলি ও ব্রাজিলের সঙ্গে যোগ দেয় সপ্তম বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে। এদের মধ্যে কলম্বিয়া ও বালগেরিয়া নবাগত। এই বিশ্বকাপ খুব বেশি উচ্চতায় উঠতে পারেনি। দক্ষিণ আমেরিকার পাঁচটি দলের—উরুগুয়ে, কলম্বিয়া, আর্জেন্তিনা, চিলি ও ব্রাজিল— মধ্যমণি ছিল ব্রাজিল। পেলে মাত্র একটি পুরো ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন। ইতালি ও স্পেন দলে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকজন তারকা ছিলেন। ব্রাজিলের আলতাফিনি ও আর্জেন্তিনার সিভোরিকে ইতালি সঙ্গে আনে। স্পেন নিয়ে আসে উরুগুয়ের ১৯৫৪ বিশ্বকাপ খেলোয়াড় সান্তামারিয়াকে এবং রিয়্যাল মাদ্রিদ ক্লাবের দুই বিদেশী, হাঙ্গেরীয় ফেরেনস পুসকাস ও আর্জেন্তিনীয় আলফ্রেদো ডি স্তেফানোকে। অবশ্য চিলিতে আসার আগেই চোট থাকার অজুহাত দেখিয়ে ডি স্তেফানো একটি ম্যাচও খেলেননি। কারণটা ছিল ম্যানেজার হেলেনিও হেরেরার সঙ্গে ঝগড়া। যোগ্যতা বাছাই পর্বে ওয়েলসের বিরুদ্ধে স্পেন ১—০ জিতেছিল। গোলটি দিয়েছিলেন ডি স্তেফানো। এই বিরাট খেলোয়াড়ের এইটিই একমাত্র বিশ্বকাপ গোল। যোগ্যতা বাছাই পর্বে আর এক বিরাট খেলোয়াড় জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করেন। চিলিতে যাওয়ার যোগ্যতা না পাওয়া পর্তুগাল ২—৪ গোলে লাকসেমবুর্গের কাছে হারে এবং এই ম্যাচে তারা প্রথম খেলতে নামায় ১৯ বছরের ইওসেবিও ফেরেইরা দা সিলভা—কে। ইওসেবিও একটি গোল করেন।

চিলিতে স্পেনের প্রথম খেলা চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে পড়ে। ১৯৫৫—৫৬ থেকে ১৯৬১—৬২ ইওরোপীয়ান কাপের ছয়টি ফাইনালে উঠে পাঁচবার ট্রফি জেতা রিয়্যাল মাদ্রিদ ক্লাবের সান্তামারিয়া, দেল সল, পুসকাস ও জেন্টো সমৃদ্ধ স্পেনকে ০—১ হারিয়ে দেয় চেকরা। ব্রাজিল ১৯৫৮ ফাইনালের বেলিনি ও অরল্যাণ্ডোকে বসিয়ে তাদের জায়গায় মাউরো ও জোজিমোকে দলে এনে প্রথম ম্যাচে নামে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে। খুব ভাল তারা খেলেনি। জাগালো ও পেলের গোলে তারা ২—০ জেতে। চেকদের বিরুদ্ধে ব্রাজিল দলে বদল ঘটায়নি। কিন্তু ইয়ান পপলুহার ও জোসেফ মাসোপুস্ত ডিফেন্সকে এমন দুর্ভেদ্য করে রাখেন যে ব্রাজিলীয়রা গোল করতে পারেনি। এই খেলাতেই ৩৫ গজের একটি শট নিয়ে পায়ের পেশীতে টান ধরায় পেলে মাঠ ছেড়ে যান। তিনি আর এই প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেননি। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে হেরেরা আদ্যন্ত বদলানো এক স্প্যানিশ দল নামান এবং ৩৫ মিনিটে স্পেন ১—০ এগিয়েও যায়। দ্বিতীয়ার্ধে গ্যারিনচার চোখ ধাঁধানো খেলা ম্যাচের রঙ বদলে দেয়। তার তৈরি করে দেওয়া বল থেকে, পেলের জায়গায় নবাগত আমরিলডোর দুটি গোল ব্রাজিলকে ২—১ জেতায়। এই গ্রুপেই মেক্সিকোর শেষ খেলায় অধিনায়ক ও গোলকিপার আন্তাোনিও কারাবাল তাঁর ৩৩—তম জন্মদিনে খেলতে নামেন চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে। তাঁকে দারুণ একটা জন্মদিনের উপহার দেবার জন্য মেক্সিকানরা দারুণ খেলে ৩—১ গোলে জিতে নেয় ম্যাচটি। ৩২ বছর আগে বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নিয়ে মেক্সিকো এই প্রথম চূড়ান্ত পর্বে একটি ম্যাচ জিতল! কারাবালের এটি ১৯৫০ থেকে চতুর্থবার চূড়ান্ত পর্বে মাঠে নামা।

ইংল্যাণ্ড শুরু করে হাঙ্গেরির কাছে ০—২ গোলে হেরে। লায়স টিচি ও ফ্লোরিয়ান অ্যালবার্ত গোলদুটি করেছিলেন। এই ম্যাচেই বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নামেন ববি চার্লটন ও ববি মুর। অপ্রতিরোধ্য গ্যারিনচার দুটি ও ভাভাকে তার তৈরি করে দেওয়া একটি গোলে ব্রাজিল ৩—১ হারায় ইংল্যাণ্ডকে। সেমি ফাইনালে চিলির বিরুদ্ধে গ্যারিনচা এমনই তাণ্ডব শুরু করেন যে তাকে লাথি চালিয়ে থামাবার পদ্ধতি চিলিয়ানদের অবলম্বন করতে হয়। অবশেষে তিনি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। পাল্টা আঘাত করার জন্য তাঁকে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয়। বেরিয়ে আসার সময় দর্শকের ছোঁড়া বোতলে তাঁর মাথা গভীর ভাবে কেটে যায়। ব্রাজিলের ৪—২ জয়ে গ্যারিনচার ছিল দুটি গোল। চেকোশ্লোভাকিয়া ১—০ হাঙ্গেরিকে ও ৩—১ গোলে সেমি ফাইনালে যুগোশ্লাভিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়।

কাউকে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হলে পরের ম্যাচে তার মাঠে নামা নিষিদ্ধ। তাহলে গ্যারিনচা কি ফাইনালে খেলতে পারবেন না? ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে নগণ্য মজুরটিও উদ্বিগ্ন রইলেন ফিফা—র সিদ্ধান্তের জন্য। চব্বিশ ঘণ্টা পর ফিফা জানাল গ্যারিনচাকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে… তবে ফাইনালে তিনি খেলতে পারবেন। ১৭ জুন ব্রাজিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার দাবি নিয়ে সান্তিয়াগোর ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে নামল এবং ১৯৫৮—র মত তারা প্রথমে মাসোপুস্তের দেওয়া গোল খেল, ১৪ মিনিটে। দু মিনিট পর অসম্ভব দুরূহ কোণ থেকে শট নিয়ে আমারিলডো গোলটি শোধ করলেন। ৬৮ মিনিটে জিটো হেড করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন। নয় মিনিট পর গোলকীপার শ্রয়িফের হাত থেকে বেরিয়ে আসা বল গোলে ঠেলে ভাভা ৩—১ করে দেন। ব্রাজিল দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন ও চেকোশ্লোভাকিয়া দ্বিতীয়বার রানার্স হল। সপ্তম বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল দেয় ব্রাজিল, ১৬টি। সর্বাধিক ব্যক্তিগত গোলের সংখ্যা হল—চার। ছয় জন এর ভাগীদার : ব্রাজিলের ভাভা, গ্যারিনচা, হাঙ্গেরির অ্যালবার্ট, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইভানভ, চিলির ম্যানচেজ এবং যুগোশ্লাভিয়ার ইয়েরকোভিচ। রেফারি কর্তৃক বহিষ্কৃত খেলোয়াড়ের সংখ্যা—ছয়। গ্যারিনচা ছাড়া বাকি পাঁচজনকে কিন্তু একটি ম্যাচের জন্য সাসপেণ্ড হতে হয়!

১৯৬৬ ইংল্যাণ্ড

অষ্টম বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্বের জন্য ১৬টি দেশের নাম যখন ঠিক হল, দেখা গেল তাতে দু’জন নবাগত ছাড়া বাকি সবই পুরনো নাম। নবাগতরা হল পর্তুগাল ও উত্তর কোরিয়া। তখন ফিফা—র সদস্য সংখ্যা ১২৫। যোগ্যতা বাছাই পর্বে নাম দিয়েছিল ৭০টি দেশ। কিন্তু না খেলেই নাম প্রত্যাহার করে ১৭টি দেশ। কোরীয়দের চূড়ান্ত পর্বে আসাটাকে সবাই হাসির ব্যাপার বলে ধরে নেয়। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মাত্র দুটি ম্যাচে ৬—১ ও ৩—১ গোলে জিতেই তারা ইংল্যাণ্ডে আসার ছাড়পত্র পেয়ে যায়। উত্তর কোরীয়দের ফুটবল মান সম্পর্কে সারা বিশ্বই অন্ধকারে। তবু সবাই ধরে নিল বিশ্বকাপের দম বন্ধ করা গম্ভীর কাজকর্মের মধ্যে ওরা যদি কিছু হালকা প্রহসন এনে দেয় তাহলে মন্দ লাগবে না।

১৯৬৩—র শুরুতেই অপেশাদার আমলের ঝুলকালি পরিষ্কার করে ইংল্যাণ্ড পেশাদার কোচ আলফ র‌্যামজিকে জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার নিযুক্ত করে। র‌্যামজি ৩২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলেননি, ১৯৫০ বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজয়ের গ্লানিরও অংশীদার এবং ১৯৫৩—য় হাঙ্গেরিয়ানদের কাছ থেকে দুটি ম্যাচে হাতে—কলমে—পাওয়া শিক্ষাটাও হজম করেছেন। তিনি এটা বোঝেন ইংল্যাণ্ডের নির্বাচকরা শৌখিন অপেশাদার লোকেদের নিয়ে তৈরি। এদের দ্বারা গড়া দল নিয়ে ইওরোপের বা দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষ দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন একটি শর্তে, নির্বাচক কমিটি ভেঙে দিতে হবে এবং তিনি একাই নিজের দল বেছে নেবেন। ইংল্যাণ্ডের নতুন ফুটবল কর্তা হলেন র‌্যামজি। চাপাস্বভাবের হিসেবী, কম কথার মানুষ। ম্যানেজার নিযুক্ত হয়েই, তিনি বললেন, ‘আমরাই বিশ্বকাপ জিতছি।’ কারণ হিসাবে জানালেন, তাঁকে সাহায্য করবে ঘরের মাঠে খেলার সুবিধা, খাঁটি বিশ্ব পর্যায়ের তিনজন খেলোয়াড়কে দলের কেন্দ্রীয় শক্তি রূপে পাওয়া এবং খেলার ছক। তাঁর উদ্ভাবিত ৪—৩—৩ ছককে, ‘উইংলেস ওয়াণ্ডারস’ বলে তখন ব্যঙ্গও করা হয়।

অষ্টম বিশ্বকাপে দেখা গেল ব্রাজিলের বিস্ময়কর পতন। তাদের ১৯৫৮—র ম্যানেজার ভিসেন্ট ফিয়োলাই আবার দলের দায়িত্ব নিয়ে অরল্যাণ্ডো, বেলিনি, জালমা স্যান্টোস ও গ্যারিনচার মত প্রবীণদের ঘিরে দল গড়লেন। দলের সঙ্গে ১৬ বছরের এদু নামে একটি ছেলে এসেছিল কিন্তু তাকে খেলানো হয়নি। নির্মমভাবে লাথি মেরে প্রতিযোগিতা থেকে বার করে দেবার আগে পর্যন্ত পেলে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন। এবারের বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত চমৎকারিত্বের থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল দলগত খেলার সংগঠনের দিকটাই। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের প্রথম চাঞ্চল্যকর ঘটনা জুলরিমে ট্রফিটির চুরি যাওয়া। এক ডাকটিকিটের প্রদর্শনীর সঙ্গে ট্রফিটিও প্রদর্শিত হচ্ছিল ওয়েস্টমিনিস্টারের সেন্ট্রাল হলে। প্রচুর তল্লাশি চালিয়েও সেটির হদিশ পাওয়া যায়নি আট দিন। অবশেষে দক্ষিণ লণ্ডনের নরউডে একটি বাড়ির সামনে বাগানে ঝোপের মধ্যে সেটি খুঁজে পায় ‘পিকলস’ নামে এক কুকুর। এবারের বিশ্বকাপে ১৬টি দলের ৩৫২ জন ফুটবলারের জন্য বীমা করা হয় মোট দুই কোটি পাউণ্ডের। পেলের জন্য বীমা হয়েছিল আড়াই লক্ষ পাউণ্ডের।

উদ্বোধনী খেলায় ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে উরুগুয়ের ০—০ হল। পরের ম্যাচে ইংল্যাণ্ড ২—০ হারাল মেক্সিকোকে এবং একই ফলে ফ্রান্সকে। মেক্সিকোর ৩৯ বছর বয়সী গোলকীপার কারবাল ১৯৫০ থেকে পাঁচটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলে অনন্য একটি রেকর্ড গড়ে এবার অবসর নিলেন। পশ্চিম জার্মানি ৫—০ সুইৎজারল্যাণ্ডকে, ০—০ আর্জেন্তিনার সঙ্গে এবং ২—১ স্পেনকে হারিয়ে কোঃ ফাইনালে পৌঁছল। ব্রাজিল খেতাব রক্ষা করতে এসেছে ১৯৫৪—র কোঃ ফাইনালে হাঙ্গেরির কাছে পরাজয়ের পর অপরাজিত অবস্থায়। ১৯৬৬—তে প্রথম খেলায় পেলে ও গ্যারিনচার ফ্রিকিক থেকে বালগেরিয়ার বিরুদ্ধে ২—০ গোলে জিতল বটে কিন্তু পেলে চোট পাওয়ায় পরের ম্যাচে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া হল। ব্রাজিল ১—৩ গোলে হেরে গেল সেই খেলায়। ১৯৫৮ থেকে বিশ্বকাপে ১১ জয় ও দুটি ড্র—এর পর এই পরাজয় ঘটল। তৃতীয় খেলায় পর্তুগালের বিরুদ্ধে ব্রাজিল নয়টি পরিবর্তন ঘটাল, তার মধ্যে সাতজন বিশ্বকাপে এই প্রথম খেলছে। ২৫ মিনিটেই সিমোয়েস ও ইওসেবিওর গোলে পর্তুগাল এগিয়ে যায়। রিলদো একটি গোল শোধ দিলেও ইওসেবিও ফল ৩—১ করেন। দ্বিতীয়ার্ধে পেলেকে মারাত্মক জখম করে মোরেইস। খোঁড়াতে খোঁড়াতে পেলে মাঠ ছাড়েন এবং ড্রেসিংরুমে ফিরে বলেন, আর কখনো তিনি বিশ্বকাপে খেলবেন না। কথাটা অবশ্য তিনি রাখতে পারেননি। কিন্তু এবারের মত ব্রাজিল বিদায় নিল।

ইতালি প্রথম খেলায় চিলির বিরুদ্ধে ২—০ জেতে। প্রথম গোলটি দেয় আলেসান্দ্রো মাজ্জোলা। ১৯৪৯—এ সুপারগা বিমান দুর্ঘটনায় তোরিনো ফুটবল দলের যে খেলোয়াড়রা মারা যান তার মধ্যে ছিলেন ভ্যালেনতিনো মাজ্জোলা। ১৯৫০—এর বিশ্বকাপে ইতালির অধিনায়ক রূপে তিনি নির্দিষ্ট ছিলেন। দুটি ছেলে রেখে তিনি মারা যান। বড় ছেলেটিই এই আলেসান্দ্রো। দ্বিতীয় খেলায় ইতালি ০—১ হেরে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। মিডলসব্রাওয়ে এই গ্রুপেই উত্তর কোরিয়া যখন রুশীদের বিরুদ্ধে প্রথম খেলতে নামে তখন দর্শকরা তাদের দেখেই বুঝে নেন এরা কচুকাটা হবে। দলের সবথেকে লম্বা লোকটির উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি! কিন্তু ৩০ মিনিটেও রুশীরা গোল করতে পারেনি। পরে তারা বুঝে যায় শূন্যে খেলেই কোরীয়দের হারাতে হবে এবং সেই ভাবেই তিনটি গোল করে জেতে। গ্রুপে ইতালি শেষ খেলায় কোরীয়দের কাছে যেভাবে ভেঙে পড়ল, তার প্রতিধ্বনি ছড়াল বিশ্ব জুড়ে। কেউ প্রথমে বিশ্বাসই করেনি, যেমন ১৯৫০—এ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যাণ্ডের হারটাকে লোকে অবিশ্বাস করেছিল। ইতালির আন্তর্জাতিক নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে প্রতিটি বিষয়ে টক্কর দিয়ে এবং তাদের থেকে ভাল খেলে কোরীয়রা ১—০ জিতে যায় ৪১ মিনিটে পাক ডুক ইক—এর দেওয়া গোলে। এরপর তারা ইতালীয়দের এক ইঞ্চি জমিও ছাড়েনি। এরপর এশিয়ার এই দলটিকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা বন্ধ হয়ে গেল। কোরীয়রা আরও উচ্চ পর্যায়ে উঠল কোঃ ফাইনালে পর্তুগালের বিরুদ্ধে। খেলার ২৬ মিনিটেই বিশ্ববাসী নিজেদের শ্রবণযন্ত্রকে অবিশ্বাস করে শুনল উত্তর কোরিয়া ৩ : পর্তুগাল ০! প্রথম মিনিটেই গোল, ২৪ মিনিটে দ্বিতীয়টি, ২৬ মিনিটে তৃতীয়টি! এরপর খেলায় হাল ধরেন ইওসেবিও। কয়েক মিনিট পরই একটি এবং ৪২ মিনিটে পেনালটি থেকে দ্বিতীয় গোলটি করলেন। ৫৮ মিনিটে করলেন তৃতীয়টি আর ৬১ মিনিটে চতুর্থটি, পেনালটি থেকে। খেলা শেষের কিছু আগে তোরেস পর্তুগালের পঞ্চম গোলটি দিয়ে উত্তর কোরিয়ার উজ্জ্বল প্রস্থান নিশ্চিত করে দেন। সেমি ফাইনালে ওঠার আগে ইংল্যাণ্ডকে টপকাতে হল আর্জেন্তিনার বেড়া। এই ম্যাচে র‌্যামজি মারপিট করে খেলার জন্য আর্জেন্তিনীয়দের ‘পশু’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাদের অধিনায়ক র‌্যাতিনকে রেফারি মাঠ থেকে বার করে দেন। ইংল্যাণ্ড জেতে জিওফ হার্স্টের দেওয়া গোলে। পর্তুগালের বিরুদ্ধে ববি চার্লটন অনবদ্য খেলে দুটি গোল দিয়ে ইংল্যাণ্ডকে ফাইনালে তুলে আনেন। অবশ্য ববির ভাই জ্যাকি ফাঁকা গোলে ঢোকা বল হাত দিয়ে আটকে পর্তুগালকে পেনাল্টি পাইয়ে দেওয়ায় ইওসেবিও একটি গোল পান।

হাঙ্গেরিকে ২—১ গোলে হারিয়ে সেমি ফাইনালে উঠে রুশীরা একই ফলে জার্মানদের কাছে হেরে যায়। ফাইনালে ৯৭ হাজার দর্শকের সামনে জার্মানরাই প্রথম গোল করে ১২ মিনিটে, হেলমুট হ্যালার মারফৎ। তিন মিনিট পর হার্স্ট সেটি শোধ দেন। ৭২ মিনিটে মার্টিন পিটার্স ইংল্যাণ্ডকে এগিয়ে দেবার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে ভুলফগ্যাং ভেবার গোল দিয়ে ২—২ করে দেন। অতিরিক্ত সময়ের ১০ মিনিটে হার্স্টের গোলটি আজও তর্কের বিষয় হয়ে রয়েছে। তার শটটি বারের তলায় লেগে জার্মান গোলকীপার টিলকৌস্কির পিছনে মাটিতে পড়ে। সুইশ রেফারি ডাইয়েনসৎ গোলের বাঁশি বাজান। কিন্তু রুশী লাইনসম্যান আগেই পতাকা তুলেছিলেন হার্স্টের অফ—সাইড নির্দেশ করে। রেফারি তখন কথা বলেন লাইনসম্যানের সঙ্গে এবং তাঁর মতে হার্স্ট অফ—সাইড ছিলেন না। তাই লাইনসম্যানের সিদ্ধান্ত নাকচ করে গোলটি দেন। জার্মানিরা বলেন, বল গোল লাইন অতিক্রম করে গোলের ভিতরে যায়নি। যাই হোক ২—৩ পিছিয়ে পড়ে জার্মানরা গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় তাদের ডিফেন্স আলগা হয়ে যায় আর হার্স্ট আবার একটি গোল দিয়ে ফাইনাল ম্যাচে তিনটি গোল করার, এখনো পর্যন্ত একমাত্র সম্মানটির অধিকারী হন। খেলার ছকের সঙ্গে খেলোয়াড়দের যোগ্যতার চমৎকার মিলমিশ থেকে তৈরি বোঝাপড়ার গুণে এবং এগারোজনের সমবেত পরিশ্রমে ইংল্যাণ্ড এই সাফল্য পায়। তৃতীয় স্থান পায় পর্তুগাল ২—১ গোলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে। ১৬টি দল ৩২ ম্যাচে করে ৮৯ গোল। সর্বাধিক গোল দেয় পর্তুগাল—১৭টি আর তাদেরই ইওসেবিও ব্যক্তিগত সবথেকে বেশি গোল দেন—৯টি। ইংল্যাণ্ড তার ছয়টি ম্যাচই খেলেছে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে, যে সুবিধাটা বিশ্বকাপে কখনো কোন দল পায়নি। ১৯৫৪—য় জার্মানির ফ্রিৎশ এবং ওটমার ভাল্টার ভ্রাতৃদ্বয়ের পর বিশ্বকাপ জয়ীর সোনার পদক দ্বিতীয়বার পেলেন এক জোড়া ভাই ইংল্যাণ্ডের ববি ও জ্যাকি চার্লটন।

১৯৭০ মেক্সিকো

নবম বিশ্বকাপ চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুটেরও বেশি উপরে এবং যেখানে তাপমান নব্বুই ডিগ্রি ফারেনহাইটের ঘরে, এমন দেশ মেক্সিকোকে নির্বাচন করায় প্রথমে খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। তার উপর ইওরোপীয় টিভি কেন্দ্রগুলিকে খুশি করার জন্য খেলার ব্যবস্থা হয়েছিল মাঝ দুপুরে! ফিফা—র ১৩৮ সদস্যের ৬৯টি দেশ যোগ্যতা পর্বে ১৭৩টি ম্যাচ খেলে, ১৪টি দেশ শেষ পর্যন্ত মেক্সিকো ও ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে যোগ দেয় চূড়ান্ত পর্বে। এর মধ্যে গতবারের চমক তোলা উত্তর কোরিয়া নেই। এশিয়া—ওসেনিয়া গ্রুপে ইসরায়েলকে রাখার প্রতিবাদে তারা অংশ নিতে অস্বীকার করে। ইওসেবিও, কোলুনা, সিমোয়েস খেলা সত্ত্বেও পর্তুগাল বাছাই পর্ব থেকে উঠতে পারেনি। ব্যর্থ হয় ১৯৬৮ ওলিম্পিকসের সোনা জয়ী দলের আটজনকে দলে রেখে হাঙ্গেরিও। পশ্চিম জার্মানির গার্ড মুলার বাছাই পর্বের ছয়টি খেলায় ৯টি গোল করে নিজেকে জানান দিয়ে রাখলেন। আর্জেন্তিনা যোগ্যতা পেতে ব্যর্থ হলেও পেরু উঠে এল তাদের নতুন ম্যানেজার ব্রাজিলের দিদি—র তত্ত্বাবধানে। বাছাই পর্বে ১০টি গোল দেওয়া তোস্তাও—এর চোখে গুরুতর আঘাত লাগায় ব্রাজিল কমজোরি হয়ে পড়ে তার উপর তাদের ম্যানেজার জোয়াও সালধানার সঙ্গে পেলের মনোমালিন্য এমন পর্যায়ে যায় যে চূড়ান্ত পর্বের তিন মাস আগে ম্যানেজার বদল ঘটাতে হয়। সালধানার জায়গায় এলেন মারিও জাগালো যিনি দু বার বিশ্বকাপে স্বর্ণজয়ী ব্রাজিল দলের সদস্য ছিলেন। ইতালি নির্ভর করে রইল লুইগি রিভা—র উপর। জার্মানির আছে বেকেনবাউয়ার, ওভারট আর নতুন গোল দেওয়ার ‘যন্ত্র’ মুলার। ম্যানেজার হেলমুট শ্যোন ডেকে নিলেন প্রবীণ জিলারকেও। ইংল্যাণ্ডের ১৯৬৬—র বিজয়ী দলটিই রয়েছে তবে র‌্যামজি এবার কোন ভবিষ্যদ্বাণী করেননি। মেক্সিকোর উচ্চতা আর গরমে ইওরোপীয় দলগুলো কেমন ফল করে জানার জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে রইল।

চূড়ান্ত পর্বে আফ্রিকা থেকে প্রথমবার প্রতিনিধিত্ব করল মরক্কো আর প্রথম উঠল ইসরায়েল এবং এল সালভাদর। দ্বিতীয় বিশ্বকাপে যদিও আফ্রিকার দেশ মিশর ১৯৩৪—এ ইতালিতে খেলেছিল তখন মহাদেশ হিসাবে অঞ্চল ভাগ করে খেলা হত না। মরক্কো বালগেরিয়ার সঙ্গে ১—১ করে একটি পয়েন্ট নিয়ে নবম বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। ১৯৬২ থেকে চূড়ান্ত পর্বে খেলে বালগেরিয়া তিনবারে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। আর তাদেরই হারিয়ে পেরু ১৯৩০—এর পর এবারই চূড়ান্ত পর্বে প্রথমবার বিশ্বকাপে একটি ম্যাচ জিতল। গ্রুপের তিনটি ম্যাচে বালগেরিয়া ২০ জন খেলোয়াড়কে ব্যবহার করে, চূড়ান্ত পর্বের এটা একটা রেকর্ড।

নবম বিশ্বকাপ উদ্বোধনের আগে দুটি ঘটনার কথা বলা যায়। বাছাই পর্বে এল সালভাদর ও হোণ্ডুরাস, মধ্য আমেরিকার এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আকচাআকচি এমনি যে প্লে—অফ ম্যাচের চারদিন আগে তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় আর এল সালভাদর ১—০ জেতার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধ বাধে এই দুই দেশের মধ্যে। তিন দিন পর যুদ্ধ থামে। এতে দুই পক্ষের তিন হাজার লোক মারা যায়। অন্য ঘটনাটি হল, মেক্সিকো যাবার পথে ইংল্যাণ্ড দল কলম্বিয়ায় খেলতে যায়। বোগোটায় হোটেলের গহনার দোকান থেকে একটি হীরের ব্রেসলেট চুরি করার দায়ে অধিনায়ক ববি মুরকে আটকান হয়। চার দিন পর তিনি মেক্সিকোয় দলের সঙ্গে মিলিত হন। পরে অবশ্য স্বীকার করা হয়, অভিযোগের সমর্থনে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইংল্যাণ্ডের মনোবল নষ্ট করার জন্য এই ‘সাজানো চুরির’ অবতারণা হয়েছিল। গুয়াদালারায় র‌্যামজি স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করায় তারা চটে গিয়ে ইংরাজদের বিরুদ্ধে এমন লিখতে শুরু করে যে জনতা ক্ষেপে উঠে ব্রাজিলের সঙ্গে গ্রুপের খেলার আগের রাতে ইংল্যাণ্ড দলের হোটেলের চার পাশে সাররাত অবিরাম মোটরের হর্ন বাজিয়ে আর চিৎকার করে খেলোয়াড়দের ঘুমোতে দেয়নি।

পেলের তৈরি করে দেওয়া হলে জাইরজিনহোর একমাত্র গোলে ব্রাজিল জিতলেও স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল পেলের হেড থেকে ইংল্যাণ্ড গোলকীপার গর্ডন ব্যাঙ্কসের একটি গোল বাঁচান। জাইরজিনহোর একটা ক্রস পেলে পরিষ্কারভাবে মাথায় যখন লাগান তখন ব্যাঙ্কস ছিলেন অন্য প্রান্তের পোস্টে। নীচেরদিকে ঠুকে দেওয়া হেডটি মাটিতে পড়ে গোলে যখন ঢুকবে তখন ব্যাঙ্কস ডানদিকে শরীর ফিরিয়ে ঝাঁপালেন হাতটা বাড়িয়ে। মাটি থেকে বল যখন উঠছে তখন তিনি বলের তলায় ডান তালুর ধাক্কা দিয়ে সেটা বারের উপর দিয়ে তুলে দেন। পেলে বলেন, তিনি জীবনে এমনটি দেখেননি। গ্রুপ থেকে এই দুটি দল কোঃ ফাইনালে ওঠে। ইংল্যাণ্ড ৫০ মিনিটেই ২—০ এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে। কিন্তু বেকেনবাউয়ার ও জিলার সমতা ফিরিয়ে আনায় খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় আর মুলার একটি গোল করে ইংল্যাণ্ডের এবারের বিশ্বকাপ অভিযান থামিয়ে দেন। কিন্তু ব্রাজিলকে থামাতে পারল না পেরু। ৪—১ গোলে জিতে ব্রাজিল সেমি ফাইনালে উঠে উরুগুয়েকে হারাল ৩—১।

অন্যদিক থেকে মেক্সিকোকে ৩—১ গোলে হারিয়ে ইতালি সেমি ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে ৪—৩ হারায় জার্মানিকে। দুটি সেমি ফাইনালে এই একবারই বিশ্বকাপ বিজয়ী চারটি প্রাক্তন দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল। আবার এদের মধ্যে তিনটি দলের কাছে ট্রফিটি বরাবরের মত জিতে নেওয়ারও সুযোগ ছিল। এবং ব্রাজিল জিতে নিল।

১৯৭০—এর ২১ জুন প্রতিযোগিতা থেকে অন্তর্হিত হল জুল রিমে ট্রফি এবং স্থায়ী ঘর পেল ব্রাজিলে। অবিস্মরণীয় চোখ ধাঁধানো ফুটবল ফাইনালে খেলে তারা তর্কাতীত ভাবে প্রমাণ দিল তারাই বিশ্বশ্রেষ্ঠ। ইতালির নেতিমূলক রক্ষণাত্মক নীতিই তাদের পতন ডেকে আনে ৪—১ গোলে হারার জন্য। পেলের এটিই বিশ্বকাপে শেষ খেলা। উজ্জ্বল হয়ে তিনি বিরাজ করেছেন এবং প্রথম গোলটি করেন ১৮ মিনিটে। বোনিনসেনা ১—১ করেন ৩৮ মিনিটে। গারসন ৬৬ মিনিটে এবং জাইরজিনহো তৃতীয়টি করেন পেলের দেওয়া বল থেকে। খেলা ভাঙার তিন মিনিট আগে রক্ষণ থেকে উঠে আসা অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তোর দিকে পেলে বল গড়িয়ে দেন এবং তিনি প্রচণ্ড শটে চতুর্থ গোলটি করেন। পেলের গোলটির সঙ্গে ১৯৩০ থেকে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ব্রাজিলের শততম গোলটিও হল। চারটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলে প্রতিটিতেই তিনি কোন না কোন ম্যাচে গোল করেছেন। এই কৃতিত্ব এই বিশ্বকাপে আর অর্জন করলেন পশ্চিম জার্মানির জিলার। বিশ্বকাপে পেলে মোট ১২টি ও জিলার মোট ৯টি গোল করেছেন। পেলের মত দীর্ঘ ১২ বছরের (১৯৫৮—র পর ১৯৭০) ব্যবধানে আর কেউ ফাইনালে খেলেননি। ভাভার মত দুটি ফাইনালেই তিনি গোল করেছেন। নবম বিশ্বকাপে ফাইনালসহ প্রতিটি রাউণ্ডে ছয় ম্যাচে সাত গোল করে জাইরজিনহো নতুন রেকর্ড করলেন। তবে এবার সর্বাধিক গোল করায় কৃতিত্ব দেখালেন গার্ড মুলার— ছয়টি খেলায় ১০ গোল। তৃতীয় স্থানাধিকারী নির্ধারণ ম্যাচে পশ্চিম জার্মানি ওভারটের গোলে উরুগুয়েকে হারায় ১—০। এই ম্যাচটিতে মুলার গোল করলে বিশ্বকাপের সেরা রেকর্ডটি তিনি স্থাপন করতে পারতেন। যোগ্যতা পর্বের ছয়টি ম্যাচেই তিনি গোল করেন, মোট ৯টি এবং চূড়ান্ত পর্বের পাঁচটিতেই, মোট ১০টি। শুধু প্লে—অফে গোল পাননি। ১২ ম্যাচে ১৯ গোল। চূড়ান্ত পর্বে ১৩ গোল দিয়ে ফঁত্যেন ১৯৫৮—য় যে রেকর্ড করে রেখেছেন তার সঙ্গে মুলারের ১৯ গোলের রেকর্ডটিও যুক্ত হল—দুটিই এখনো বর্তমান। মেক্সিকোয় মোট ৯৪ গোল হয় তাতে সর্বাধিক অবদান ব্রাজিলের— ১৯টি। একটি গোলও করতে পারেনি শুধু এল সালভাদর। মাঠ থেকে রেফারি কর্তৃক একজনও বহিষ্কৃত হননি। এবারই প্রথম বিশ্বকাপে পরিবর্ত ব্যবহার করা গেল তাই ৯৫ জন পরিবর্ত হিসেবে খেলেছেন।

১৯৭৪
পশ্চিম জার্মানি

জুল রিমে ট্রফি চিরকালের জন্য ব্রাজিলের ঘরে চলে যাওয়ায় ফিফা নতুন ট্রফি তৈরি করাল। ইতালীয় ডিজাইনার সিলভিয়ো গাজ্জানিয়া বরাদ্দ পেলেন। বর্তমান ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফিটি ১৮ ক্যারেট সোনায় তৈরি, ২০ ইঞ্চি লম্বা, ওজন ১১ পাউণ্ড। ১৯৭৪—এ দাম ছিল ১৭ হাজার পাউণ্ড। ট্রফির সঙ্গে বদল ঘটল ফিফা প্রেসিডেণ্টেরও। ইংল্যাণ্ডের স্ট্যানলি রাউসকে ভোটে হারিয়ে চেয়ারে বসলেন ব্রাজিলের জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জে। ৮৯টি দেশ বাছাই পর্বে লড়াই করে চূড়ান্ত পর্বে স্থান পাবার জন্য। এইবারই প্রথম গোলের গড়ের বদলে গোল পার্থক্য নিয়ম প্রয়োগ করা হয় আর তার ফলে একটি ম্যাচও না হেরে, একটি গোলও না খেয়ে বেলজিয়াম বাছাই পর্বেই ছাঁটাই হয়ে যায়। গ্রুপে ছয়টি ম্যাচে তাদের মোট গোল ১২—০ কিন্তু হল্যাণ্ডের ২৪—২। তাই হল্যাণ্ডই চূড়ান্ত পর্বে গেল। সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজনৈতিক কারণে চিলির সঙ্গে খেলতে অস্বীকার করায় চিলি ওয়াকওভার পেয়ে চূড়ান্ত পর্বে ওঠে। এশীয় অঞ্চল থেকে ১১টি ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলিয়া যোগ্যতা পায় পশ্চিম জার্মানি যাবার কিন্তু সেখানে চিলির সঙ্গে ০—০ করা ছাড়া একটি গোলও করতে পারেনি। আফ্রিকা থেকে যোগ্যতা পায় জাইর ১০টি ম্যাচ খেলে। পূর্ব জার্মানি এবারই প্রথম চূড়ান্ত পর্বে উঠল এবং গ্রুপের খেলায় পশ্চিম জার্মানিকে ১—০ গোলে হারায়ও। কিন্তু বাছাই পর্বেই ব্যর্থ হয় ইংল্যাণ্ডে আর তিন মাস পরই ছাঁটাই হন ম্যানেজার স্যর আলফ র‌্যামজি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এইবারই প্রথম ডোপিং পরীক্ষা হল। ইতালির বিরুদ্ধে ম্যাচে ১—৩ গোলে হারার পর হাইতির ব্যাক আরনেস্ট জাঁ—জোসেফকে পরীক্ষা করে নিষিদ্ধ ড্রাগ পাওয়া যায়। তাকে প্রতিযোগিতায় আর খেলতে দেওয়া হয়নি।

বেয়ার্ন মিউনিখ ক্লাবের ছয়জনকে নিয়ে গড়া পশ্চিম জার্মান দল দু বছর আগে ইওরোপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই ক্লাবও ইওরোপীয় কাপ সবে জিতেছে। ইওরোপে সর্বস্তরেই তারা তখন শ্রেষ্ঠ। তাছাড়া ফাইনাল খেলা হবে বেয়ার্নের নিজের স্টেডিয়ামে। ব্রাজিল দলে পেলে, তোস্তাও, গারসন অনুপস্থিত। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ভয়টা এখন আর ততটা নেই। সুতরাং পশ্চিম জার্মানিই ফেভারিট আর তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ শুধু হল্যাণ্ড। এককোটি ৩০ লক্ষের ছোট্ট দেশটি দুর্দান্ত প্রতিভাবান এক ফুটবলার প্রজন্ম তুলে ধরেছে যার শিরোমণি তাদের অধিনায়ক ইওহান ক্রুয়েফ, বিস্ফোরক স্কিলে এবং শৈল্পিক স্পর্শে যিনি পেলের সঙ্গে তুলনীয়। বিশ্বকাপে তাঁরই জীবনবীমার পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ—১০ লক্ষ পাউণ্ড। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আক্রমণাত্মক কয়েকজন প্রতিভাধর—নিসকেনস, রেপ, হ্যাগেজেম ও রেনসেনব্রিঙ্ক।

দেশের লীগে ও আন্তর্জাতিক ম্যাচে মোট ১,১৪৩ মিনিট খেলার পর চূড়ান্ত পর্বের প্রথম ম্যাচে ইতালির গোলকীপার দিনো জোফ গোলের মধ্য থেকে প্রথমবার কুড়িয়ে আনলেন হাইতির স্যাননের দেওয়া গোলের বলটি। অবশ্য ইতালি ৩—১ জিতেছিল। পোল্যাণ্ড ৭—০ হারায় হাইতিকে আর ইতালিকে ২—১ গোলে।

চূড়ান্ত পর্বের দ্বিতীয় স্তরে হল্যাণ্ড আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আরো দুঃসাহসী। আর্জেন্তিনাকে ৪—০, পূর্ব জার্মানিকে ২—০ ও ব্রাজিলকে ২—০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা ফাইনালে পৌঁছয়। অন্যদিক থেকে পশ্চিম জার্মানি ও পোল্যাণ্ডের মধ্যে রেষারেষি চলে ফাইনালে ওঠার জন্য। কে উঠবে সেটা ঠিক হয় গ্রুপের শেষ ম্যাচে এই দুই দলের মধ্যে খেলায়। প্রথমার্ধে গোলশূন্য। দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানরা পেনাল্টি পায় কিন্তু হোনেসের কিক ধরে ফেলেন তোসাজেউস্কি। শেষ পর্যন্ত মুলারের গোলে জার্মানরা জেতে।

দেশের মাটিতে জার্মানরা ফাইনাল খেলছে, মাঠে ৭৮ হাজার আর পৃথিবী জুড়ে টিভি—তে কয়েক কোটি দর্শকের সামনে। হল্যাণ্ড কিক—অফ করেই জার্মান পেনাল্টি এলাকা পর্যন্ত এবং তার দুপাশে অবিচ্ছিন্ন পনেরোটি পাস খেলল। তারপরই আচমকা বিস্ফোরিত হলেন ক্রুয়েফ। বল নিয়ে তীরগতিতে পেনাল্টি এলাকায় ঢুকলেন আর তাকে আটকাতে না পেরে পা দিয়ে ফেলে দিলেন হোনেস। ইংরাজ রেফারি জ্যাক টেলর পেনাল্টি সিদ্ধান্ত দিতে দ্বিধা করলেন না। বিশ্বকাপ ফাইনালে এই প্রথম পেনাল্টি এবং দ্রুততম গোল। নিসকেনস যখন গোল করলেন খেলার বয়স তখন ৮০ সেকেণ্ড মাত্র। এর ২৬ মিনিট পর হোলজেনবিনকে অবৈধ ট্যাকলিংয়ের জন্য জার্মানি পেনাল্টি পায় এবং পল ব্রিটনার গোল শোধ করে দেন। ছয় মিনিট পর বোনহফ ডানদিক থেকে উঠে হ্যানকে গতিতে পিছনে ফেলে ক্রস করেন মুলারকে। তিনি দ্বিতীয় চেষ্টায় শরীর মুচড়ে পা বেঁকিয়ে শট নেন এবং বল ইয়ংব্লোডের নাগালের বাইরে দিয়ে গোলে ঢোকে। দ্বিতীয়ার্ধে হল্যাণ্ডেরই আধিপত্য ছিল কিন্তু ব্রিটনার ও বোনহফ ধাক্কা সামলান আর গোলে মেইয়ার ছিলেন অবিচল। মরণ অথবা গৌরব এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেকেনবাউয়ারের নেতৃত্বে জার্মানরা লড়াই করে বিজয়ী হয়। গৌরবের ভাগীদার ছিলেন তাদের ম্যানেজার হেলমুট শ্যোন—ও। ১৯৬৬—তে রানার্স ও ১৯৭০—এ তৃতীয় হওয়া পশ্চিম জার্মান দল তাঁরই তত্ত্বাবধানে খেলেছিল। এবার তৃতীয় স্থান পায় পোল্যাণ্ড ১—০ ব্রাজিলকে হারিয়ে।

দশম বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্বে মোট ৯৭ গোলের মধ্যে সব থেকে বেশি গোল পোল্যাণ্ডের—১৬টি। হল্যাণ্ডের ১৫টি। একটি খেলায় সর্বাধিক গোল দেওয়ার রেকর্ড স্পর্শ করল যুগোশ্লাভিয়া ৯—০ গোলে জাইরকে হারিয়ে। পোল্যাণ্ডের ল্যাতো ব্যক্তিগত সর্বাধিক গোল করেন—৭টি। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মোট গোলসংখ্যা এখন দাঁড়াল ১০৯ ও পশ্চিম জার্মানির ১০১। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে সবথেকে বেশি মোট গোল গার্ড মুলারের, ১৪টি। এটি এখনো রেকর্ড হয়ে আছে।

১৯৭৮ আর্জেন্তিনা

উরুগুয়েতে প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার আটচল্লিশ বছর পর তা আবার তার জন্মস্থানের খুব কাছাকাছিই ফিরে এল রিভারপ্লেটের অন্য তীরে আর্জেন্তিনায়। প্রথমবার রানার্স হওয়া ছাড়া এখনো পর্যন্ত তারা বড়মাপের কোন ফল দেখাতে পারেনি। আগের বিশ্বকাপগুলিতে ঘরের জনতা লক্ষণীয়ভাবে ফলাফলের উপর প্রভাব বিস্তার যদি করে থাকে তাহলে এবার সেটা প্রায় চূড়ান্ত ভূমিকা নিতে চলল। আর্জেন্তিনা একটি ম্যাচ জিতলেই রাস্তা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। গাড়ি চলাচল থেমে যায়, মোটরে অবিশ্রান্ত হর্ণ বেজে যায়। বাড়ির বারান্দায় লাউডস্পীকার লাগিয়ে আর্জেন্তিনীয় গোলের ধারাবিবরণের টেপ বাজান হয়। দলের নায়কদের সংবর্ধনা জানাতে স্টেডিয়ামে কাগজের কুচি এমন ছোঁড়া হয় যে কিছু আর তখন দেখা যায় না।

একাদশ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবার সময় আর্জেন্তিনা তখন কঠিনভাবে সামরিক একনায়কত্বের মুঠোয়। লড়াই চলছে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে মানবাধিকারের জন্য আন্দোলনকারীরা। বুয়েনস এয়ারেস প্রেস সেণ্টারে বোমা ফেটে একজন পুলিস মারা গেছে। বিশ্বকাপ সংগঠনের দায়িত্বে থাকা সরকার নিযুক্ত সামরিক জেনারেল খুন হয়েছেন। আর্জেন্তিনার পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ফিফা মেনে নিয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে সম্মত হল। প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয়।

অতীতে আর্জেন্তিনার ফুটবলে যে কর্কশ হিংস্র প্রবণতার স্পর্শ মাখান থাকত সেটা বহুল পরিমাণে মার্জিত, সুসংস্কৃত হয়ে ওঠে তাদের ম্যানেজার সিজার লুই মেনোত্তির তত্ত্বাবধানে। তিনি নতুন ভাবধারা আনেন, গতিময়তা ও উদ্দাম দৌড়—নির্ভর খেলায় বল্গা পরিয়ে তাকে খোলাখুলি আক্রমণাত্মক স্টাইলে নিয়ে আসেন। ১৯৭৭—এ দেশের মাঠে আর্জেন্তিনা ছয়টি জয় পায় ইওরোপীয় দলের বিরুদ্ধে, ১৯৭৮—এ পাঁচটি জয়। মেনোত্তির মুশকিল হল, আর্জেন্তিনার নামী খেলোয়াড়দের টাকার টোপ দিয়ে ইওরোপ তুলে নিয়ে যায়, বিশেষ করে স্পেন। ১৯৭৮—এ ছ’—সাতজন ভাল খেলোয়াড় বিদেশে খেলছে তাই তিনি ঘরের থেকেই লোক খুঁজলেন। স্পেন থেকে ফিরে এল শুধু কেম্পেস।

এবারের চূড়ান্ত পর্বে বড়দরের সুপারস্টার কোন দলেই নেই। পশ্চিম জার্মানির মুলার ও বেকেনবাউয়ার অবসর নিয়ে উত্তর আমেরিকা লীগে খেলছেন। ক্রুয়েফ বাছাই পর্বে হল্যাণ্ডকে সাহায্য করেছেন বটে কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে খেলতে রাজি হননি। উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের জর্জ বেস্ট বাছাই পর্বে খেলেছেন কিন্তু তার দেশ গ্রুপে তৃতীয় হয়। আফ্রিকা থেকে তিউনিসিয়া ও এশিয়া—ওসেনিয়া থেকে ইরান চূড়ান্ত পর্বের জন্য যোগ্যতা পায়।

রিভারপ্লেট স্টেডিয়ামে পশ্চিম জার্মানি ও পোল্যাণ্ডের মধ্যে উদ্বোধনী খেলাটি অসীম বিরক্তি তৈরি করে ০—০ হল। ১৯৬২ থেকে দেখা যাচ্ছে উদ্বোধনী ম্যাচে গোল হচ্ছে না। একটা ছক অনুযায়ী এটা ঘটছে। হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সকে একই ২—১ ফলে হারিয়ে আর্জেন্তিনা শুরু করল। অনেকের মতে খেলাদুটিতে জনতার হাতের পুতুল হয়ে পড়েছিলেন রেফারি। দু’পক্ষই মারপিট করেছে কিন্তু রেফারি মাঠ থেকে বার করে দেন শুধু হাঙ্গেরির দু’জনকে। সন্দেহজনক পেনাল্টিতে ফরাসিরা ডুবে যায় এবং ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তবে দু’জন দীর্ঘদেহী স্ট্রাইকার, লুকে ও কেম্পেস সহ আর্জেন্তিনা দলকে ভীতিকরই মনে হচ্ছিল। প্রবল জনমত অগ্রাহ্য করে মেনোত্তি বিশ্বকাপ চূড়ান্ত দল থেকে এক উদীয়মান কিশোরকে বাদ দিয়েছিলেন। ১৯৭৬—এ ষোড়শ জন্মদিনের দশ দিন আগে সে প্রথম লীগ ম্যাচ খেলে, চার মাস পর হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নামে, এরপর আরো তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। মেনোত্তি মনে করেন, ছেলেটি অল্পবয়সী কাঁচা, দীর্ঘসময় ধরে বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার চাপ সইবার মত অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি। এই বাদ পড়া ছেলেটি ১৯৭৮ দলে থাকলে আর্জেন্তিনার আক্রমণ নিশ্চয় আরো ভীতিকর হয়ে উঠত। ছেলেটির নাম দিয়েগো মারাদোনা।

প্রাথমিক গ্রুপ লীগে আর্জেন্তিনা তৃতীয় ম্যাচে ইতালির কাছে ১—০ হারলেও দ্বিতীয় স্তরে উঠল। সেখানে তাদের গ্রুপে রয়েছে ব্রাজিল, পোল্যাণ্ড ও পেরু। আর্জেন্তিনা ২—০ পোল্যাণ্ডকে ও ব্রাজিল ৩—০ পেরুকে হারাল। দু দলের পয়েণ্ট সমান হলেও গোল—পার্থক্যে ব্রাজিল এগিয়ে। এবার দুটি দল মুখোমুখি হয়ে খুব সাবধানে খেলে ০—০ করল। দুই দলের জন্য বাকি একটি করে ম্যাচ। একই দিনে খেলা দুটি। বিকেলে ব্রাজিল ৩—১ হারাল পোল্যাণ্ডকে। রাত্রে আর্জেন্তিনাকে তাহলে অন্তত চার গোলের ব্যবধানে পেরুকে হারাতে হবে যদি ফাইনালে উঠতে চায়। ফিফা—র কাছে ব্রাজিল প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল এইভাবে খেলার সময় স্থির করে আর্জেন্তিনাকে পরের ম্যাচ খেলতে দিয়ে, ঠিক কি কাজটা তাদের করতে হবে সেটা জানিয়েই দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদ অবশ্য গ্রাহ্য হয়নি। আর্জেন্তিনা ৬—০ গোলে জেতায় একটা সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে, পেরু পুরো চেষ্টা করেনি। আর প্রতিযোগিতায় একমাত্র অপরাজিত দল ব্রাজিল ছিটকে গেল ১৯৭৮ বিশ্বকাপ থেকে।

চার বছর আগে জার্মানিতে যে উচ্চতায় হল্যাণ্ড উঠেছিল তাদের এই দলটি সেই মানে এখানে খেলতে পারেনি। ইরানকে ৩—০ হারিয়ে, পেরুর সঙ্গে ০—০ ড্র করার পর তারা স্কটল্যাণ্ডের কাছে ২—৩ হেরে গোল—পার্থক্যে কোনক্রমে পরের ধাপে ওঠে। এই ম্যাচে ১৯৩০ থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের ১০০০—তম গোলটি করেন হল্যাণ্ডের রব রেনসেনব্রিঙ্ক, পেনাল্টি থেকে। পয়েণ্টে সমান হলেও স্কটল্যাণ্ডের থেকে হল্যাণ্ডের গোল খাওয়ার সংখ্যা তিন কম ছিল। পেরুর কাছে ৩—১ গোলে হারের পর স্কটল্যাণ্ডের উইলি জনস্টনের ডোপ টেস্ট ইতিমূলক হয়। তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে একটি বিশ্বকাপ ম্যাচ জেতা প্রথম দল হবার মর্যাদা পেল তিউনিসিয়া যখন তারা ৩—১ গোলে মেক্সিকোকে হারাল। পরের ম্যাচে ০—০ করে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে।

প্রথম রাউণ্ডের ভয় জাগানো অভিজ্ঞতাটা কাটিয়ে ওঠার পর হল্যাণ্ড দাপটে খেলতে শুরু করে। অস্ট্রিয়াকে ৫—১, ইতালিকে ২—১ গোলে হারিয়ে প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা খেলায় ২—২ করে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে। অনেকেই তখন ভাবতে শুরু করেন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপ জয়ী প্রথম ইওরোপীয় দল এরাই হবে। হতোও, যদি—না বাদ সাধত গোল পোস্ট। ফাইনাল খেলা শুরুর আগে আর্জেন্তিনা রেফারির কাছে প্রতিবাদ জানাল হল্যাণ্ডের উইঙ্গার রেনে ভ্যানডার কেরকহফের হাতে বাঁধা প্লাস্টার সম্পর্কে। খেলাটি শুরুর আগেই প্যাচপঁয়জরের কবলে পড়ে গেছে। হল্যাণ্ডও খুব ভাল আচরণ করেনি। সমান তালে তারাও ফাউল করে যায়। কেম্পেস প্রথমার্ধে গোল করে, দ্বিতীয়ার্ধে সেটা শোধ দেয় রেপ—এর পরিবর্ত খেলোয়াড় নানিঙ্গা। খেলার শেষ মিনিটে হল্যাণ্ডের চোখের সামনে ট্রফিটি ঝলসে উঠেই মিলিয়ে গেল যখন রেনসেনব্রিঙ্কের প্রচণ্ড শট গোলকিপার ফিলোলকে হার মানিয়ে পোস্টে লাগল। অতিরিক্ত সময়ে শ্রান্ত আর্জেন্তিনা বাড়তি উদ্দীপনা তুলে এনে খেলার ভারসাম্য নিজেদের দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। কেম্পেস ও বার্তোনি গোল দিয়ে বিশ্বকাপটি মাথার উপর তুলে ধরার গৌরব অধিনায়ক প্যাসারেলার জন্য এনে দেন। তৃতীয় স্থান নির্বাচনের খেলায় ব্রাজিল ২—১ হারায় ইতালিকে। সর্বোচ্চচ গোলদাতা হন কেম্পেস—৬ গোল। ৩৮ ম্যাচে মোট গোল হয়েছে ১০২। হল্যাণ্ড ও আর্জেন্তিনা সাতটি করে ম্যাচ খেলে সমান সংখ্যক—১৫ গোল দিয়ে যুগ্মভাবে সর্বাধিক গোলকারী দল হয়। ইতালির কাছে ১—২ গোলে হেরে যাওয়া ফ্রান্সের একমাত্র গোলটি বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্রুততম গোলের রেকর্ড তৈরি করে। কিক—অফের পর ৩১ সেকেণ্ডে হেড করে গোল দেয় লাকোমবে। অবশ্য ১৯৮২—তে এই রেকর্ডটি ভেঙে যায়। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে কয়েকটি নতুন মুখ দেখা গেল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, ইতালির রোসি, ব্রাজিলের জিকো, ফ্রান্সের প্লাতিনি, ইংল্যাণ্ডের কীগান ও পশ্চিম জার্মানির রুমানিগে।

১৯৮২ স্পেন

দ্বাদশ বিশ্বকাপ চূড়ান্ত পর্বেই প্রথমবার ১৬টি দলের বদলে ২৪টি দলকে খেলার সুযোগ দেওয়া হল। ফিফার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকা, এশিয়া এবং উত্তর মধ্য আমেরিকার ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশগুলি সোচ্চচার হয়ে উঠছিল এই বলে যে চূড়ান্ত পর্বে প্রতি অঞ্চল থেকে তিনটি দল কেন যাবে? এবার তাই তিনটি কমিয়ে দুটি দল করা হল। ইওরোপ থেকে ১৪টি, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ৪টি, ও বাকিদের প্রতিটি থেকে দুটি করে ৬টি। ম্যাচ হবে ৫২টি অর্থাৎ ১৪টি বেশি। প্রাথমিক রাউণ্ডে চারটির বদলে হবে ছয়টি গ্রুপ। গ্রুপের শীর্ষ দুটি দল পরের রাউণ্ডে চারটি গ্রুপ তৈরি করবে। তাদের বিজয়ীরা সেমিফাইনাল খেলবে।

অনুষ্ঠাতা দেশ পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে—উরুগুয়ে, ইতালি, ইংল্যাণ্ড, পশ্চিম জার্মানি ও আর্জেন্তিনা। সুতরাং দ্বাদশ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানি, ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনাকে ফেভারিট ধরা হলেও স্পেনকেও তাদের দলে রাখা হয়। গত চারটি প্রতিযোগিতায় উদ্বোধন ম্যাচে একটি গোলও হয়নি, এবার হল। বেলজিয়াম ১—০ জিতল আর্জেন্তিনার বিরুদ্ধে। উপগ্রহ মারফত সারা বিশ্বে ১৫০ কোটি দর্শক টেলিভিশনে উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখেন। কিন্তু উদ্বোধন ম্যাচটি দেখায়নি সম্প্রচারের স্বত্ব ক্রয়কারী ব্রিটেনের ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট টেলিভিশন। তখন ফকল্যাণ্ডকে নিয়ে ব্রিটেন ও আর্জেন্তিনার মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। প্রাথমিক গ্রুপে রেকর্ড করল হাঙ্গেরি ১০—১ গোলে এল সালভাদরকে হারিয়ে। হ্যাটট্রিক করেন লাজলো কিস। চূড়ান্ত পর্বে একটি খেলায় রেকর্ড ছিল ৯ গোলের, দ্বি—অঙ্কের সংখ্যা এই প্রথম। তবে বাছাই পর্বে ১৯৮১ অকল্যাণ্ডে নিউজিল্যাণ্ড সর্বোচ্চচ ১৩—০ গোলে একটি ম্যাচে হারিয়েছিল ফিজিকে। আর একটি উল্লেখ করার মত রেকর্ড হয়—দ্রুততম গোলের। বিলবাওয়ে খেলা শুরু হওয়ার ২৭ সেকেণ্ডেই ইংল্যাণ্ডের ব্রায়ান রবসন ফ্রান্সকে গোল দিয়েছিলেন। ইংল্যাণ্ড ৩—১ জেতে তাদের প্রথম খেলাটিতে। জিয়নে আলজেরিয়া প্রথম খেলাতেই স্তম্ভিত করল ২—১ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে। লকধর বেলুমি ও রাবা মাদের গোল দুটি করেন। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ জেতার পর জার্মানির এটি তৃতীয় পরাজয়। এর আগে ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনার কাছেই মাত্র তারা হেরেছিল। ম্যাচের আগে জার্মান ম্যানেজার জুপ ডারওয়েল বলেছিলেন, ‘আলজেরিয়াকে যদি আমরা হারাতে না পারি তাহলে পরের ট্রেনেই আমি বাড়ি ফিরে যাব।’ অবশ্য তিনি কথা রাখেননি। স্পেনের সঙ্গে হোণ্ডুরাস ১—১ এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে কুয়েত ১—১ করে বেশ সাড়া জাগিয়ে ফেলে। কুয়েত দল স্পেনে আসে তাদের ম্যাসকট একটি সত্যিকারের উট সঙ্গে নিয়ে।

প্রাথমিক গ্রুপের খেলায় আলজেরিয়া ০—২ গোলে অস্ট্রিয়ার কাছে হেরে গেলেও তারা পেরুকে হারায় ৩—২ গোলে। দ্বিতীয় রাউণ্ডে তাদের ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল কেননা অস্ট্রিয়ার সঙ্গে তাদের পয়েণ্ট সমান কিন্তু গোল—পার্থক্যটা খারাপ। পশ্চিম জার্মানির সামনে তখন অস্ট্রিয়াকে হারান ছাড়া অন্য পথ নেই কেননা তারা দু পয়েণ্ট পিছিয়ে। জার্মানরা জিতল বটে কিন্তু খেলাটা এমন নির্লজ্জ হাঁটি হাঁটি ভাবে হল যাতে দু দলই উপকৃত হয়। গত বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনা—পেরু ম্যাচের মতই হল ব্যাপারটা। সেবার ৬—০ করে ব্রাজিলকে বার করে দেওয়া হয় এবার জার্মানি ১—০ জিতে দুটি পয়েণ্ট নিয়ে এবং গোল বাড়াবার চেষ্টা না করে গোল—পার্থক্যে আলজেরিয়াকে খারিজ করে দিল। চারিদিকে ঢিঢিক্কার পড়ে গেলেও অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি দ্বিতীয় রাউণ্ডে উঠল।

ফ্রান্স বনাম কুয়েতের খেলাটি শেষ হবার দশ মিনিট আগে মাঠে প্রচণ্ড ঝামেলা তৈরি হয়। ৪—১ গোলে ফ্রান্স জেতে। কুয়েত গোলের পিছনে এক দর্শক প্রায়ই হুইসল বাজিয়ে ধাঁধার সৃষ্টি করছিল। একবার কুয়েতি ডিফেণ্ডাররা থমকে যায় হুইসল শুনে আর ফ্রান্সের চতুর্থ গোলটি জিরেস সেই ফাঁকে করেন। তীব্র প্রতিবাদ জানায় কুয়েত রুশী রেফারি স্তুপারের কাছে। কুয়েত ফুটবলের প্রেসিডেণ্ট এবং ফ্রান্সের ম্যানেজার হিদালগো মাঠে নেমে আসেন। মাঠে ধাক্কাধাক্কি, ঘুঁষোঘুষিও হয়। খেলা আট মিনিট বন্ধ ছিল। রেফারি চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত বদলে গোলটি বাতিল করেন। ফিফা কুয়েত দলকে সতর্ক করে দিয়ে ২৫ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা এবং স্তুপারকে সাসপেণ্ড করে।

উত্তর আয়াল্যাণ্ডের নর্ম্যাল হোয়াইটসাইড ১৭ বছর ৪০ দিন বয়সে যুগোশ্লাভিয়ার বিরুদ্ধে খেলে পেলের ১৭ বছর ৮ মাস বয়সে খেলার বিশ্বকাপ রেকর্ডটি ভেঙে দেন। খেলাটি ০—০ হয়। স্পেনকে ১—০ হারিয়ে আইরিশরা দ্বিতীয় রাউণ্ডে ওঠে আরো এগারোটি দলের সঙ্গে। এবার বিদায় নিল আর্জেন্তিনা ও ব্রাজিল দুই ফেভারিট দল। ইতালির কাছে ১—২ হারার পর ব্রাজিলের সঙ্গে খেলায় ১—৩ গোলে হেরে আর্জেন্তিনা বিদায় নিল। তাদের ব্যর্থতার কারণ রূপে বলা হল, ফকল্যাণ্ড যুদ্ধের টেনশ্যন আর গোল পাবার জন্য মারাদোনার মুখাপেক্ষী হওয়া। তখন পর্যন্ত মারাদোনা, ইতালির জেনতাইলে যে ধরনের রুক্ষ ট্যাকল করেছে তেমন ধরনের আচরণের সঙ্গে সড়গড় ছিলেন না আর তখন তাঁর মানসিকতাও বিপর্যস্ত ছিল বার্সিলোনা ক্লাবে যোগদানটা ঝুলে থাকার টানাপোড়েনে। মারাদোনার প্রথম বিশ্বকাপ খেলা শেষ হয় মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে, ব্রাজিলের সঙ্গে খেলায় বারবার মার খেয়ে ধৈর্য হারিয়ে বাতিস্তাকে পাল্টা লাথি মারার দায়ে। ব্রাজিল যে দাওয়াই দিয়েছিল মারাদোনাকে আর্জেন্তিনার ম্যানেজার মেনোত্তি জিকোর জন্য সেই ওষুধেরই ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রয়োগের দায়িত্বটা দিয়েছিলেন প্যাসারেলার উপর। ফলে খেলাটি রূপান্তরিত হয়েছিল লাথালাথিতে। জিকোকে মাঠ ছাড়তে হয় খোঁড়াতে খোঁড়াতে। পরের ম্যাচে ইতালির বিরুদ্ধে ব্রাজিল হেরে গেল ২—৩ গোলে। ব্রাজিলের জেতা ম্যাচ অন্তত ৩—৩ হতে পারত যদি ইসরায়েলি রেফারি জেনতাইলের ফাউলগুলো অগ্রাহ্য না করে, যেমন জিকোকে পেনাল্টি এলাকার মধ্যে টেনে ফেলে দেওয়া, শাস্তি দিতেন। ব্রাজিল এবং জিকো তাদের নিজেদের যাদুকরী খেলারই শিকার হলেন, যে ফুটবলকে তারা সমৃদ্ধশালী করেছেন তারই নয়া বাস্তবতার দ্বারা তারা দণ্ড পেলেন। এই বিশ্বকাপে জিকো প্রাথমিক পর্বে চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলে ‘নতুন রাজা’ বনে ছিলেন। তার প্রতিভাই তাকে বর্বরতার লক্ষ্য করে দেয়।

ইতালির ফুটবল লীগে ফাটকা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন পাওলো রোসি। দু বছর সাসপেণ্ড থাকার পর লীগে তিনটি ম্যাচ খেলেই বিশ্বকাপের জন্য ইতালি দলে স্থান পান। ম্যানেজার এনজো বেয়ারজোতের এমনই তার প্রতি আস্থা যে, প্রাথমিক পর্বে তিনটি ম্যাচেই ড্র করা ইতালির এই স্ট্রাইকার খারাপ খেলা সত্ত্বেও তাকে তিনি বসিয়ে দেননি। হঠাৎই খুলে গেল রোসির খেলা। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ইতালি ৩—০ জিতল তাঁর হ্যাটট্রিকে। সেমিফাইনালে পোল্যান্ড হার ২—০ এবং এবারও গোল দুটি রোসির। এর আগে বোনিয়েকের হ্যাটট্রিকে পোল্যান্ড ৩—০ হারিয়েছিল বেলজিয়ামকে।

পশ্চিম জার্মানির মূল স্ট্রাইকার অধিনায়ক রুমেনিগেও মার খেয়ে খেয়ে জখম হয়ে যান। সেমিফাইনালে প্রথমার্ধেই ফ্রান্স ১—৩ এগিয়ে যাওয়ায় নিরুপায় ডারওয়েল বাজি ধরার মতই আহত রুমেনিগেকে নামিয়ে ফল পেলেন। ৩—৩ হল রুমেনিগে ও ফিশারের দেওয়া গোলে। টাইব্রেকারে ফল যখন ৪—৪, জার্মান গোলকিপার শুমাখার একটি কিক আটকে দিয়ে মোট ৮—৭ গোলে জিতে জার্মানিকে ফাইনালে যেতে সাহায্য করেন।

ফাইনালের বিরতির সময় পশ্চিম জার্মানির সুইপার উলি স্টিয়েলাইক ম্যানেজার ডারওয়ালকে বললেন, যদি জখম থাকা রুমেনিগেকে বসান না হয় তাহলে ইতালির কাছে হারতে হবে। ডারওয়াল কথাটা অগ্রাহ্য করেন। মাদ্রিদের বার্ণাবু স্টেডিয়ামে খেলার ফল তখন ০—০। ইতালির সেরা ফরোয়ার্ড আন্তাোননি আহত থাকায় খেলছেন না। স্ট্রাইকার গ্রাজিয়ানি চোট পেয়ে মাঠ ছেড়ে গেছেন এবং কাব্রিনি একটা পেনাল্টি নষ্ট করেছেন। এতেই পশ্চিম জার্মানির ম্যানেজার বুঝে গেছেন ইতালি এবার ভেঙে পড়বে। স্টিয়েলাইক জবাব দেন, ‘ইতালির কাছে ঠকবেন না। ওদের হারাতে হলে আমাদের দরকার এগারোজন পুরো ফিট খেলোয়াড়। রুমেনিগে ফিট নয়। কিছু একটা করুন।’

ম্যানেজার কিন্তু খোঁড়া রুমেনিগেকেই মাঠে রাখলেন এবং ইতালি ৪৪ বছর অপেক্ষার পর তৃতীয়বার ৩—১ গোলে বিশ্বকাপ জিতে নিল। ইতালির ৭০ বছর বয়সী প্রেসিডেণ্ট সান্দ্রো পার্তিনি ছেলেমানুষের মত লাফালেন যখন রোসি, তারদেল্লি এবং আলতোবেলি জার্মান রক্ষণ ভেঙে খেলার শেষদিকে তিনটি গোল করলেন। একটি গোল শোধ দিয়েছিলেন জার্মানরা। তৃতীয় স্থান পায় পোল্যাণ্ড ৩—২ গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে। ৫২টি ম্যাচে মোট গোল হয়েছিল ১৪৬। সর্বোচ্চচ ব্যক্তিগত গোলদাতা হন রোসি—৬টি গোল। সর্বাধিক গোল দেয় ফ্রান্স—২০টি।

১৯৮৬ মেক্সিকো  

১৬ বছর পর মেক্সিকোয় দ্বিতীয়বার অনুষ্ঠিত হল চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা। যোগ্যতা বাছাই পর্বে ১১১টি দেশ খেলেছিল। ৩০৮ ম্যাচে ৮৩৫ গোল হয়। অপরাজিত থেকে চূড়ান্ত পর্বে আসে ব্রাজিল, ইংল্যাণ্ড এবং নবাগত কানাডা ও আলজেরিয়া। পশ্চিম জার্মানি সহজে পৌঁছলেও একটা রেকর্ড হারিয়েছে। কোনও বিশ্বকাপেই তারা বাছাই পর্বে কোন ম্যাচ হারেনি, এবার পর্তুগালের কাছে ১—২ গোলে একটি হেরেছে। তারা ১৯৩০ ও ১৯৫০ বিশ্বকাপে খেলেনি, এছাড়া বাকি এগারোটিতেই চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে, ইতালিও এগারোবার উঠল আর ব্রাজিল তো তেরোটি বিশ্বকাপেই চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। এবারের বিশ্বকাপে মেক্সিকোয় আসায় ব্যর্থ হয় দু’বারের রানার্স হল্যাণ্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়া, একবারের রানার্স সুইডেন। প্রথমবার চূড়ান্ত পর্বে খেলছে কানাডা, ডেনমার্ক ও ইরাক।

দীর্ঘপথ পেরিয়ে ইরাক এল মেক্সিকোয়। ইরান ও ইরাকে তখন যুদ্ধ চলায় ফিফা নির্দেশ দেয় ওই দুই দেশের জমিতে বাছাই পর্বের খেলা না হয়ে নিরপেক্ষ দেশে হবে। ইরান তা মানতে রাজি না হওয়ায় খারিজ হয়ে যায়। ইরাক তার ঘরের ম্যাচগুলি খেলে জর্ডানের সঙ্গে কুয়েতে, কাতারের সঙ্গে কলকাতায়, সিরিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবে। দশটি ম্যাচে ২৬ গোল দিয়ে তারা যে রেকর্ড করেছিল সেটা নষ্ট হয় লেবানন নাম প্রত্যাহার করায়। এর ফলে দুটি ম্যাচ ও ১২টি গোল বাদ যায় আর সর্বাধিক গোল দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে ওঠার নতুন রেকর্ড স্থাপনের সুযোগ পেয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। তারা ২২ গোল দিয়েছে।

এবারের বিশ্বকাপে নকআউট পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হল। ২৪টি দল প্রথমে ছয়টি গ্রুপে লীগ খেলবে। প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দুটি দল অর্থাৎ ১২টি দল আর তৃতীয় স্থানাধিকারী দলগুলির থেকে সেরা চারটি দল নিয়ে মোট ১৬ দলের মধ্যে দ্বিতীয় রাউণ্ডের নকআউট খেলা হবে।

প্রথম রাউণ্ড গ্রুপ লীগে ২৪টি দল মন্থর বিরক্তিকর ফুটবল খেলল শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ডেনমার্ক তাদের একটি ম্যাচে জোর দেয়। রুশীরা ৬—০ হাঙ্গেরিকে আর ডেনরা ৬—১ উরুগুয়েকে হারায়। নয়তো ১১টি ম্যাচ ড্র হয়, ৮টি ম্যাচে ফল হয় ১—০। ৩৬ ম্যাচে হল ৮৪ গোল। কোরীয়দের সঙ্গে প্রথম খেলায় মারাদোনার উপর অবৈধ বলপ্রয়োগ ঘটলেও তিনি মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। ৩—১ গোলে আর্জেন্তিনা জেতে। ব্রাজিল ১—০ স্পেনকে হারায় সক্রাটেসের গোলে। জিকোর চোট থাকায় তাকে খেলান হয়নি। চোট থাকায় রুমেনিগে মাত্র শেষ দশ মিনিট মাঠে নামেন উরুগুয়ের সঙ্গে ১—১ খেলায়। আলজেরিয়ার গোলকীপার দ্রিদের অসাধারণ খেলা ব্রাজিলকে কারেকার একমাত্র গোলটি ছাড়া আর সাফল্য দেয়নি। জিকোকে এই ম্যাচেও খেলান হয়নি। তৈমুমি এবং বুদারবালার মত বিশ্বমানের দু’জন খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করে মরক্কো পর্তুগালকে ৩—১ হারিয়ে অপরাজিত থেকে গ্রুপ শীর্ষে রইল। তাদের নীচে ইংল্যাণ্ড, পোল্যাণ্ড ও পর্তুগাল। দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য শুধু বালগেরিয়ার সঙ্গে ১—১। জিকো অবশেষে ব্রাজিলের তৃতীয় ম্যাচে উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে শেষ কয়েক মিনিট খেললেন এবং দেখালেন তিনি তাঁর দক্ষতার কিছুই হারাননি। আইরিশ গোলকীপার প্যাট জেনিংসের এই দিনই ছিল ৪১—তম জন্মদিন। বিশ্বকাপে তাঁর শেষ খেলায় তিনটি গোল খেয়ে অপ্রতিভ হলেও বিশ্বের সবথেকে বেশি, ১১৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ফুটবলারের মর্যাদাও সংগ্রহ করলেন। প্রিবেন এলকেয়ার ও মিখায়েল লুডরাপের খেলা দেখে অনেকেই ডেনমার্ককে সম্ভাব্য বিজয়ী রূপে ভাবতে শুরু করলেন। ইংল্যাণ্ডের গ্যারি লিনেকার হ্যাটট্রিক করলেন পোল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে খেলার ৩৬ মিনিটের মধ্যেই। ডেনমার্ক ২—০ পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে তাদের নিয়ে রূপকথা রচনার উপাদান আর একটু সরবরাহ করল।

কিন্তু পরের রাউণ্ডে ১৬টি দল যখন নকআউট স্তরে মাঠে নামল তখন দেখা গেল অনেক দলই নিজেদের আসল চেহারাটা লুকিয়ে রেখেছিল। স্পেন তার রক্ষণ কাজকে এত কঠিন ও দক্ষতার সঙ্গে বিন্যস্ত করল যে ডেনমার্কের আক্রমণ পা ফেলার জায়গা পেল না। পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়েও তারা পাঁচটি গোল খেয়ে এবারের মত বিশ্বকাপে তাদের নটে গাছটি মুড়িয়ে ফেলল। এমিলিও বুত্রয়েনো নামে ২২ বছরের সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকারটি চারটি গোল দিলেন। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাসে একটি ম্যাচে চার গোল দেওয়ার এটি অষ্টম ব্যক্তিগত নজির। শেষ এই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন ২০ বছর আগে ইওসেবিও। বিদায় নিল সোভিয়েত ইউনিয়নও ৩—৪ গোলে গ্রুপ লীগে তৃতীয় স্থান পাওয়া বেলজিয়ামের কাছে হেরে। দম বন্ধ করে দর্শকরা ম্যাচের ভাগ্যের ওঠা—নামা দেখেছেন। ২—২ হবার পর অতিরিক্ত সময়ে বেলজিয়াম করে ৪—৩। সোভিয়েতের বেলানভ প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকটি করেন। ৮৮ মিনিটে কোনক্রমে একটি গোল দিয়ে পশ্চিম জার্মানি হারাল মরক্কোকে। আর্জেন্তিনাও একই ফলে জিতল উরুগুয়ের কাছে। ৬০ বার ফাউলের হুইসল বাজলেও মারাদোনা খুবই পরিণত বোধসম্পন্ন ফুটবল খেললেন এই ম্যাচে। ব্রাজিল ৪—০ গোলে পোল্যাণ্ডকে মুছে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় মানুষ ধরে ধরে বিচার করলে এই বিশ্বকাপে তাদের মত প্রতিভাধর দল আর কেউ নেই। ০—২ গোলে হেরে যাবার পর ইতালির ম্যানেজার বেয়ারজোত বললেন, ‘আমরা ওদের মিডফিল্ড প্রতিভার কাছে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।’ ফ্রান্সের মিডফিল্ডে ছিলেন ফার্নান্দ, তিগানা, জিরেস ও ফর্মে ফিরে আসা প্লাতিনি। ইংল্যাণ্ডের ৩—০ গোলে প্যারাগুয়েকে হারানোয় দুটি গোল ছিল লিনেকারের। মেক্সিকোও শেষ আট দলে এল বালগেরিয়াকে ২—০ হারিয়ে।

কোয়ার্টার ফাইনালে চারটি খেলার তিনটি নিষ্পত্তি হয় টাইব্রেকারে। শুধু ৯০ মিনিটেই আর্জেন্তিনা ২—১ গোলে হারিয়েছে ইংল্যাণ্ডকে। এই ম্যাচে অক্লান্ত পরিশ্রমী মারাদোনাকে সূর্যের মত মাঝে রেখে সারা দলটি গ্রহের মত আবর্তিত হয়। গোলদুটি তারই দেওয়া, ইংল্যাণ্ডেরটি লিনেকারের। ৫১ মিনিটে মারাদোনা হেড করতে উঠে হাত দিয়ে গোলে বল পাঠান। তিউনিসিয়ার রেফারি নাসের সেটি গোল হিসাবে গ্রাহ্য করেন। এর চার মিনিট পরই ডানদিকে বল পেয়ে মারাদোনা প্রচণ্ড গতিতে স্টিভেনসকে কাটিয়ে, বুচারকে সম্মোহিত করে, ফেনউইককে পিছনে ফেলে, এবং শিলটনের মত বুদ্ধিমান গোলকীপারকে ধোঁকা দিয়ে যে গোলটি করেন তা সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যক্তিগত গোল হিসাবে গণ্য হয়েছে। ইংল্যাণ্ডের ম্যানেজার ববি রবসন পরে বলেন, ‘আমি ম্যাচের আগেই বলেছিলাম ও পাঁচ মিনিটের মধ্যে জিতে নিতে পারে। আসলে ও ১২ সেকেণ্ডে ৬০ গজের মধ্যে জিতে নিল।’ লিনেকার শোধ দেন একটি গোল। ট্রাইব্রেকারে পশ্চিম জার্মানি ৪—১ মেক্সিকোকে, বেলজিয়াম ৬—৫ স্পেনকে এবং ফ্রান্স ৫—৪ ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে গেল। ব্রাজিল কারেকার দেওয়া গোলে এগিয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে খেলা থেকে বিলীন হতে থাকে। ৪১ মিনিটে প্লাতিনি গোলটি শোধ দেন। ৭৯ মিনিটে মুলারের বদলে জিকো খেলতে নামেন আর তখনই ব্রাজিল পেনাল্টি পায়। ফুটবল দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে জিকো সেই পেনাল্টি থেকে গোল করায় ব্যর্থ হন। ব্রাজিলের জেতা ম্যাচ ট্রাইব্রেকারে ফ্রান্স জিতে নেয়।

সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ও আর্জেন্তিনা উভয়েই ২—০ জিতল যথাক্রমে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে। ফাইনালে আর্জেন্তিনার এই তৃতীয়বার ওঠা এবং পশ্চিম জার্মানির রেকর্ড পঞ্চমবার। ফাইনালে জার্মানদের লক্ষ্য ছিল মারাদোনাকে খেলতে না দেওয়া কিন্তু সুইপার ব্রাউন উঠে এসে একটি ফ্রি—কিক থেকে হেড করে ২২ মিনিটে আর্জেন্তিনার প্রথম গোলটি করেন। ৫৭ মিনিটে তারা ২—০ এগিয়ে যায় ভালদানোর গোলে। জার্মানরা দমে না গিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে এবং ৭৪ মিনিটে রুমেনিগে ও ৮২ মিনিটে ফোলার গোল শোধ করেন ব্রেহমের কর্নার থেকে। এরপর জার্মানরা চাপ সৃষ্টি করতে আটজন খেলোয়াড়কে প্রয়োগ করে। খেলা শেষের চার মিনিট বাকি থাকতে বুরুশাগা প্রায় ৩০ গজ ছুটে গিয়ে আগুয়ান গোলকীপার শুমাখারের পাশ দিয়ে গোলে বল পাঠান। ৩—২ জয়ে মারাদোনার কোন গোল নেই বটে কিন্তু জার্মানরা তার খেলা বন্ধ করতে পারেনি। শেষ গোলটি তারই বুদ্ধিদীপ্ত সরবরাহ থেকে বুরুশাগা পেয়েছিলেন। তৃতীয় স্থান পায় ফ্রান্স অতিরিক্ত সময়ে গড়ান খেলায় ৪—২ গোলে বেলজিয়ামকে হারিয়ে।

চূড়ান্ত পর্বে সর্বাধিক গোল দেয় আর্জেন্তিনা— ১৪টি। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চচ গোলদাতা— ইংল্যাণ্ডের গ্যারি লিনেকার—৬টি। ৫২টি ম্যাচে মোট গোল হয় ১৩২।

১৯৯০
ইতালি

১৯ মাসব্যাপী বাছাই পর্বের ৩১৩টি ম্যাচের পর, ইতালিতে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ চূড়ান্ত পর্বের জন্য ২২টি দেশ নির্দিষ্ট হয়। গতবারের বিজয়ী আর্জেন্তিনা ও অনুষ্ঠাতা ইতালিকে বাছাই পর্বে খেলতে হয়নি। ১৯৮৮ এপ্রিলে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো বনাম গুয়ানার মধ্যে ম্যাচটি দিয়ে বাছাই পর্ব শুরু হয় এবং ১৯৮৯ নভেম্বরে শেষ হয় যখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিগুরির শটে ত্রিনিদাদিয়দের চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার আশা ভেঙে, বল গোলে ঢোকে। ক্যালিগুরির শটটি ছিল ১১২টি দেশকে নিয়ে বাছাই পর্বের ৬৯২তম গোল। যুক্তরাষ্ট্র ৪০ বছর পর চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা পায়।

২৪ দেশের চূড়ান্ত পর্বের ১৪টি দেশ ইওরোপের, চারটি দক্ষিণ আমেরিকার। বাকি ছয়টি স্থান ভরায় এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য—উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের প্রতিটি থেকে দুটি করে দেশ। ১৯৮৬ চূড়ান্ত পর্বের মাত্র নয়টি দেশ—ইংল্যাণ্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পশ্চিম জার্মানি, স্কটল্যাণ্ড, স্পেন, বেলজিয়াম, উরুগুয়ে, ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়া— এবার চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা সংগ্রহ করতে পারে। না পারাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, পোল্যাণ্ড। একটি যুব প্রতিযোগিতায় মেক্সিকো বেশি বয়সী চারজন খেলোয়াড় খেলাবার অপরাধে ফিফা কর্তৃক দু বছর সাসপেণ্ড হওয়ায়, এবারের বাছাই পর্ব থেকে তারাই প্রথম বাতিল হয়।

চূড়ান্ত পর্বে প্রথমবার খেলতে এল রিপাবলিক অব আয়ার্ল্যাণ্ড, কোস্তা রিকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (ইউ এ আর)। চূড়ান্ত পর্বে বহু বছর পর খেলতে আসে মিশর (শেষবার ১৯৩৪), যুক্তরাষ্ট্র (১৯৫০) ও কলম্বিয়া (১৯৬২)। ব্রাজিল ও চিলির মধ্যে বাছাই পর্বের দ্বিতীয় খেলাটি ছিল যোগ্যতা নির্ধারক ম্যাচ। রিও—তে এই খেলায় চিলি গোলকিপার বোরোর্তো রোস—এর কাছাকাছি একটা পটকা ফাটে এবং তার মুখ রক্তাক্ত দেখায়। চিলি প্রতিবাদ জানিয়ে মাঠ ত্যাগ করে। পরে তদন্ত করে জানা যায় রোস অভিনয় করে এবং নকল রক্ত মুখে মাখিয়ে এই মিথ্যাচার করেছে। ফিফা তাকে চিরজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে ম্যাচটিতে ব্রাজিলকে বিজয়ী ঘোষণা করে। এর ফলে ব্রাজিল ১৯৩০ থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার একমাত্র সম্মানের অধিকারী হয়। পশ্চিম জার্মানি চূড়ান্ত পর্বে যতবার খেলেছে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে, সাতবার সেমিফাইনালে, পাঁচবার ফাইনালে এবং ১৯৫৪ ও ১৯৭৪—এ বিজয়ীর সুনাম নিয়ে ইতালিতে আসে। তাদের কোচ ফ্রানৎজ বেকেনবাউয়ার বাছাই পর্ব খেলার সময়ই জানিয়ে দিয়েছিলেন চূড়ান্ত পর্ব শেষ হলেই তিনি কোচ—এর পদ থেকে সরে যাবেন।

মধ্য—উত্তর আমেরিকান গ্রুপ প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ হতে পারেনি। এল সালভাদর ও গুয়েতামালার মধ্যে দুটি ম্যাচ, যদিও তখন ফলাফলের মূল্য ছিল না, কিন্তু ফিফা বাতিল করে দেয়, এল সালভাদরে গৃহযুদ্ধের জন্য। এশিয়া অঞ্চল থেকে দক্ষিণ কোরিয়া পরপর দ্বিতীয়বার চূড়ান্ত পর্বে উঠে আসে। সিঙ্গাপুরে নিরপেক্ষ দেশে অনুষ্ঠিত বাছাই পর্বের শেষ প্রতিযোগিতায় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও চীন খেলেছিল। সৌদি আরব ও চীন—এর মধ্যে কেউ দ্বিতীয় স্থান পাবে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু পিছন থেকে এসে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি দ্বিতীয় স্থান দখল করে ইতালি যায়।

১৯৮২ চূড়ান্ত পর্বে গ্রুপ লীগে তিনটি ম্যাচই অমীমাংসিত খেলে এবং অপরাজিত থেকে বাতিল হওয়া ক্যামেরুন আবার চূড়ান্ত পর্বে এল আফ্রিকা থেকে। এই মহাদেশের দ্বিতীয় দলটি হল মিশর। তারা প্লে—অফ ম্যাচে গত দু বারের চূড়ান্ত পর্বে খেলা আলজিরিয়াকে ১—০ হারিয়ে যোগ্যতা পায়।

রোম—এর ‘প্যালাজ্জো দেলো স্পোর্ত’—এ অর্থাৎ স্পোর্টস প্যালেসে ৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৯, অনুষ্ঠিত হয় ২৪ দেশ কে কোন গ্রুপে প্রথম রাউণ্ডে খেলবে তারই লটারি। ২৪ দেশকে ছয় গ্রুপে ভাগ করা হবে। প্রতিটি গ্রুপে থাকবে একটি করে বাছাই দল যাতে তারা প্রথমেই পরস্পরের সঙ্গে না খেলে। বিশ্বকাপে পূর্বফল এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বর্তমান গুণাগুণ ধরে বাছাই নির্বাচন হয়। এবার বাছাই হয় আর্জেন্তিনা, ইতালি, ব্রাজিল, পশ্চিম জার্মানি, স্পেন ও বেলজিয়াম। কিন্তু ইংল্যাণ্ড দাবি জানায় তাদের উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকদের হাঙ্গামা বাধাবার ভয় আছে তাই তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ভূমধ্য সাগরীয় দ্বীপ সার্দিনিয়ার রাজধানী ক্যালিয়ারিতে খেলা দেওয়া হোক বাছাই গণ্য করে। ফিফা এই যুক্তি মেনে স্পেনের বদলে ইংল্যাণ্ডকে বাছাই সম্মান দেয়। লটারির জন্য বিশ্বকাপ জয়ী ছয়টি দেশের ছয়জন প্রতিনিধিকে—পেলে (ব্রাজিল), প্যাসারেল্লা (আর্জেন্তিনা), সোসা (উরুগুয়ে), মুর (ইংল্যাণ্ড), রুমেনিগে (পশ্চিম জার্মানি) এবং কোন্তি (ইতালি)—আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। ছয়টি পাত্র থেকে তারা ২৪টি দেশের নামগুলি টেনে তোলেন। এক ঘণ্টার এই অনুষ্ঠান টিভি মারফৎ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেন।

গ্রুপ ভাগের তালিকা প্রকাশ হতেই আর্জেন্তিনা অধিনায়ক মারাদোনা সমালোচনা করে তির্যক মন্তব্য করেন, গড়াপেটা করে আগেই ঠিক করা হয়েছে কে কোন গ্রুপে খেলবে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইতালীয় লীগের শৃঙ্খলারক্ষা কমিশন তাকে ৭,৭০০ ডলার জরিমানা করে। আর্জেন্তিনা গ্রুপের দুটিম্যাচ খেলেছে নেপলসে কিন্তু ১৯৯০—এর ৮ জুন উদ্বোধনী ম্যাচ ক্যামেরুনের সঙ্গে খেলার জন্য তাদের যেতে হয় মিলানে।

বিশ্বের বৃহত্তম বাজি ধরার ব্যবসা সংস্থা লণ্ডনের ল্যাডব্রোকস, গ্রুপ বিন্যাসের পর সম্ভাব্য বিশ্বকাপ জয়ীদের সম্পর্কে বাজির যে দর প্রকাশ করেছিল তাতে প্রথমে ছিল ইতালি (৭—২ ফেভারিট), ব্রাজিল (৯—২), হল্যাণ্ড (৯—২), পশ্চিম জার্মানি (৬—১) ও আর্জেন্তিনা (৮—১)।

ভারত ও বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় এখন পর্যন্ত ভারত মাত্র একবারই বাছাই পর্বে অংশ নেয়। ১৯৮৬ প্রতিযোগিতার জন্য এশিয়ার তিন নম্বর গ্রুপের ‘বি’ সাব—গ্রুপে ভারত খেলে। তারা জাকার্তায় ১—২ গোলে ইন্দোনেশিয়ার কাছে, ব্যাঙ্ককে তাইল্যাণ্ডের সঙ্গে ০—০ ও ঢাকায় বাংলাদেশকে ২—১ গোলে হারায়। ভারতের গোল তিনটি দেন : কৃশানু দে, শিশির ঘোষ ও বিকাশ পাঁজি। ফিরতি খেলা তিনটি হয় কলকাতার সল্টলেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ভারত ১—১ করে ইন্দোনেশিয়ার ও তাইল্যাণ্ডের সঙ্গে এবং বাংলাদেশকে হারায় ২—১ গোলে। ভারতের পক্ষে গোল চারটি দেন : নরিন্দর থাপা, তরুণ দে, বিকাশ পাঁজি ও ক্যামিলো গঞ্জালেস। সাব—গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। ভারতের অধিনায়ক ছিলেন সুদীপ চ্যাটার্জি এবং কোচ অরুণ ঘোষ।

বিশ্বকাপ চূড়ান্ত পর্বে ১৯৩০—১৯৮৬

সেমি—ফাইনাল

আর্জেন্তিনা ৬, যুক্তরাষ্ট্র ১

উরুগুয়ে ৬, যুগোশ্লাভিয়া ১

ফাইনাল (মন্তিভিদিও)

উরুগুয়ে ৪, আর্জেন্তিনা ২

গোলদাতা—উরুগুয়ের : দোরাদো, সিয়া, ইরিয়ারতে, কাস্ত্রো।

আর্জেন্তিনার : পুচেল্লে, স্তাবাইলে।

উরুগুয়ে—বলেসতেরোস, নাসাজ্জি (অধি), মাসকেরোনি, আনদ্রাদে, ফার্নান্দেজ, গেস্তিদো, দোরাদো, স্কারোনে, কাস্ত্রো, সিয়া, ইরিয়ারতে।

আর্জেন্তিনা—বোতাসো, দেলা তোরে, প্যাতেরনোস্তার, জে এভারিস্তো, মোন্তি, সুয়ারেজ, পুচেল্লে, ভারাল্লো, স্তাবাইলে, ফেরেইরা (অধি), এম এভারিস্তো।

.

ইতালি ১৯৩৪

প্রথম রাউণ্ড

ইতালি ৭, যুক্তরাষ্ট্র ১

চেকোশ্লোভাকিয়া ২, রোমানিয়া ১

জার্মানি ৫, বেলজিয়াম ২

অস্ট্রিয়া ৩, ফ্রান্স ২

স্পেন ৩, ব্রাজিল ১

সুইৎজারল্যাণ্ড ৩, হল্যাণ্ড ২

সুইডেন ৩, আর্জেন্তিনা ২

হাঙ্গেরি ৪, মিশর ২

দ্বিতীয় রাউণ্ড

জার্মানি ২, সুইডেন ১

অস্ট্রিয়া ২, হাঙ্গেরি ১

ইতালি ১, স্পেন ১। (রিপ্লে) ইতালি ১—০ জেতে

চেকোশ্লোভাকিয়া ৩, সুইৎজারল্যাণ্ড ২

সেমি—ফাইনাল

চেকোশ্লোভাকিয়া ৩, জার্মানি ১

ইতালি ১, অস্ট্রিয়া ০

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

জার্মানি ৩, অস্ট্রিয়া ২

ফাইনাল (রোম)

ইতালি ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ১ (অতিরিক্ত সময়ে)

গোলদাতা—ইতালির : ওরসি, শিয়াভিও।

চেকোশ্লোভাকিয়ার : পুক।

ইতালি—কোম্বি (অধি), মোঞ্জেলিও, আলেমান্দি, ফেরারিস, মোন্তি, বার্তোলিনি, গুইতা, মিয়াজ্জা, শিয়াভিও, ফেরারি, ওরসি।

চেকোশ্লোভাকিয়া—প্ল্যানিকা (অধি), জেনিসেক, চাইরোকি, কোস্তালেক, ক্যাম্বাল, ক্রসিল, ইউনেক, সোবোদা, সোবোৎকা, নিদলি, পুক।

.

ফ্রান্স ১৯৩৮

প্রথম রাউণ্ড

সুইৎজারল্যাণ্ড ১, জার্মানি ১। (রিপ্লে) সুইৎজারল্যাণ্ড ৪—২ জেতে

কিউবা ৩, রোমানিয়া ৩। (রিপ্লে) কিউবা ২—১ জেতে

হাঙ্গেরি ৬, ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজ ০

ফ্রান্স ৩, বেলজিয়াম ১

চেকোশ্লোভাকিয়া ৩, হল্যাণ্ড ০

ব্রাজিল ৬, পোল্যাণ্ড ৫

ইতালি ২, নরওয়ে ১

দ্বিতীয় রাউণ্ড

সুইডেন ৮, কিউবা ০

হাঙ্গেরি ২, সুইৎজারল্যাণ্ড ০

ইতালি ৩, ফ্রান্স ১

ব্রাজিল ১, চেকোশ্লোভাকিয়া ১ (রিপ্লে) ব্রাজিল ১—০ জেতে

সেমি—ফাইনাল

ইতালি ২, ব্রাজিল ১

হাঙ্গেরি ৫, সুইডেন ১

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

ব্রাজিল ৪, সুইডেন ২

ফাইনাল (প্যারিস)

ইতালি ৪, হাঙ্গেরি ২

গোলদাতা—ইতালির; কোলাউস্সি (২), পিওলা (২)।

হাঙ্গেরির : তিতকস, সারোসি।

ইতালি—ওলিভিয়েরি, ফোনি, রাভা, সেরান্তনি, আন্দ্রিওলো, লোকাতেল্লি, বিয়াভাতি, মিয়াজ্জা (অধি), পিওলা, ফেরারি, কোলাউস্সি।

হাঙ্গেরি—জাবো, পোলগার, বিরো, জালে, জুকস, লাজার, সাস, ভিনজে, সারোসি (অধি), জেনগেলার, তিতকস।

ব্রাজিল ১৯৫০

পুল ১

ব্রাজিল ৪, মেক্সিকো ০

যুগোশ্লাভিয়া ৩, সুইৎজারল্যাণ্ড ০

যুগোশ্লাভিয়া ৪, মেক্সিকো ১

ব্রাজিল ২, সুইৎজারল্যাণ্ড ২

ব্রাজিল ২, যুগোশ্লাভিয়া ০

সুইৎজারল্যাণ্ড ২, মেক্সিকো ১

সুইডেন ২, প্যারাগুয়ে ২

ইতালি ২, প্যারাগুয়ে ০

.

সুইৎজারল্যাণ্ড ১৯৫৪

গ্রুপ ১

যুগোশ্লাভিয়া ১, ফ্রান্স ০

ব্রাজিল ৫, মেক্সিকো ০

ফ্রান্স ৩, মেক্সিকো ২

ব্রাজিল ১, যুগোশ্লাভিয়া ১

গ্রুপ ২

হাঙ্গেরি ৯, দক্ষিণ কোরিয়া ০

পশ্চিম জার্মানি ৪, তুরস্ক ১

হাঙ্গেরি ৮, পঃ জার্মানি ৩

তুরস্ক ৭, দঃ কোরিয়া ০

গ্রুপ ৩

অস্ট্রিয়া ১, স্কটল্যাণ্ড ০

উরুগুয়ে ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

অস্ট্রিয়া ৫, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

উরুগুয়ে ৭, স্কটল্যাণ্ড ০

গ্রুপ ৪

ইংল্যাণ্ড ৪, বেলজিয়াম ৪

ইংল্যাণ্ড ২, সুইৎজারল্যাণ্ড ০

সুইৎজারল্যাণ্ড ২, ইতালি ১

ইতালি ৪, বেলজিয়াম ১

প্লে—অফ ম্যাচ—সুইৎজারল্যাণ্ড ৪, ইতালি ১

কোঃ ফাইনাল

পঃ জার্মানি ২, যুগোশ্লাভিয়া ০

হাঙ্গেরি ৪, ব্রাজিল ২

অস্ট্রিয়া ৭, সুইৎজারল্যাণ্ড ৫

উরুগুয়ে ৪, ইংল্যাণ্ড ২

সেমি—ফাইনাল

পঃ জার্মানি ৬, অস্ট্রিয়া ১

হাঙ্গেরি ৪, উরুগুয়ে ২

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

অস্ট্রিয়া ৩, উরুগুয়ে ১

ফাইনাল (বার্ন)

পঃ জার্মানি ৩, হাঙ্গেরি ২

গোলদাতা—পঃ জার্মানির : মোরলক, রাহন (২)

হাঙ্গেরির : পুসকাস, জিবর

পঃ জার্মানি—টুরেক, পোসিপ্যাল, কোহলমেয়ার, একেল, লাইবরিখ, মেই, রাহন, মোরলক ও ভাল্টার, এফ ভাল্টার (অধি), শেফার।

হাঙ্গেরি—গ্রোসিস, বুজানস্কি, ল্যাণ্টস, বোজিক, লোরান্ত, জাকারিয়াস, জিবর, কোজিস, হিদেকুটি, পুসকাস (অধি), টট।

.

সুইডেন ১৯৫৮

.

পুল ১

পঃ জার্মানি ৩, আর্জেন্তিনা ১

উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

পঃ জার্মানি ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ২

আর্জেন্তিনা ৩, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১

পঃ জার্মানি ২, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ২

চেকোশ্লোভাকিয়া ৬, আর্জেন্তিনা ১

প্লে—অফ ম্যাচ—উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ১

গ্রুপ ২

ফ্রান্স ৭, প্যারাগুয়ে ৩

যুগোশ্লাভিয়া ১, স্কটল্যাণ্ড ১

যুগোশ্লাভিয়া ৩, ফ্রান্স ২

প্যারাগুয়ে ৩, স্কটল্যাণ্ড ২

ফ্রান্স ২, স্কটল্যাণ্ড ১

যুগোশ্লাভিয়া ৩, প্যারাগুয়ে ৩

.

গ্রুপ ৩

সুইডেন ৩, মেক্সিকো ০

হাঙ্গেরি ১, ওয়েলস ১

ওয়েলস ১, মেক্সিকো ১

সুইডেন ২, হাঙ্গেরি ১

সুইডেন ০, ওয়েলস ০

হাঙ্গেরি ৪, মেক্সিকো ০

.

প্লে—অফ ম্যাচ—ওয়েলস ২, হাঙ্গেরি ১

গ্রুপ ৪

ইংল্যাণ্ড ২, সোভিয়েত ইউঃ ২

ব্রাজিল ৩, অস্ট্রিয়া ০

ইংল্যাণ্ড ০, ব্রাজিল ০

সোভিয়েত ইউঃ ২, অস্ট্রিয়া ০

ব্রাজিল ২, সোভিয়েত ইউঃ ০

ইংল্যাণ্ড ২, অস্ট্রিয়া ২

প্লে—অফ ম্যাচ—সেভিয়েত ইউঃ ১, ইংল্যাণ্ড ০

কোঃ ফাইনাল

ফ্রান্স ৪, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ০

পঃ জার্মানি ১, যুগোশ্লাভিয়া ০

সুইডেন ২, সোভিয়েত ইউঃ ০

ব্রাজিল ১, ওয়েলস ০

সেমি—ফাইনাল

ব্রাজিল ৫, ফ্রান্স ২

সুইডেন ৩, পঃ জার্মানি ১

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

ফ্রান্স ৬, পঃ জার্মানি ৩

ফাইনাল (স্টকহলম)

ব্রাজিল ৫, সুইডেন ২

গোলদাতা—ব্রাজিলের : ভাভা (২), পেলে (২), জাগালো।

সুইডেনের : লিডহোম, সিমনসন।

ব্রাজিল—গিলমার, জালমা স্যাণ্টোস, নিল্টন স্যাণ্টোস, জিটো, বেলিনি (অধি), অরল্যাণ্ডো, গ্যারিঞ্চা, দিদি, ভাভা, পেলে, জাগালো।

সুইডেন—স্বেনসন, বার্গমার্ক, অ্যাজবম, বোয়েরশন, গুস্তাফসন, পার্লিং, হ্যামরিন, গ্রেন, সিমনসন, লিডহোম (অধি), শোলাণ্ড।

.

চিলি ১৯৬২

.

গ্রুপ ১

উরুগুয়ে ২, কলম্বিয়া ১

সোভিয়েত ইউঃ ২, যুগোশ্লাভিয়া ০

যুগোশ্লাভিয়া ৩, উরুগুয়ে ১

সোভিয়েত ইউঃ ৪, কলম্বিয়া ৪

সোভিয়েত ইউঃ ২, উরুগুয়ে ১

যুগোশ্লাভিয়া ৫, কলম্বিয়া ০

গ্রুপ ২

চিলি ৩, সুইৎজারল্যাণ্ড ১

পঃ জার্মানি ০, ইতালি ০

চিলি ২, ইতালি ০

পঃ জার্মানি ২, সুইৎজারল্যাণ্ড ১

পঃ জার্মানি ২, চিলি ০

ইতালি ৩, সুইৎজারল্যাণ্ড ০

গ্রুপ ৩

ব্রাজিল ২, মেক্সিকো ০

চেকোশ্লোভাকিয়া ১, স্পেন ০

ব্রাজিল ০, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

স্পেন ১, মেক্সিকো ০

ব্রাজিল ২, স্পেন ১

মেক্সিকো ৩, চেকোশ্লোভাকিয়া ১

গ্রুপ ৪

আর্জেন্তিনা ১, বালগেরিয়া ০

হাঙ্গেরি ২, ইংল্যাণ্ড ১

ইংল্যাণ্ড ৩, আর্জেন্তিনা ১

হাঙ্গেরি ৬, বালগেরিয়া ১

আর্জেন্তিনা ০, হাঙ্গেরি ০

ইংল্যাণ্ড ০, বালগেরিয়া ০

কোঃ ফাইনাল

যুগোশ্লাভিয়া ১, পঃ জার্মানি ০

ব্রাজিল ৩, ইংল্যাণ্ড ১

চিলি ২, সোভিয়েত ইউঃ ১

চেকোশ্লোভাকিয়া ১, হাঙ্গেরি ০

সেমি—ফাইনাল

ব্রাজিল ৪, চিলি ২

চেকোশ্লোভাকিয়া ৩, যুগোশ্লাভিয়া ১

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

চিলি ১, যুগোশ্লাভিয়া ০

ফাইনাল (সান্তিয়াগো)

ব্রাজিল ৩, চেকোশ্লোভাকিয়া ১

গোলদাতা—ব্রাজিলের : আমারিল্ডো, জিটো, ভাভা।

চেকোশ্লোভাকিয়ার : মাসোপুস্ত।

ব্রাজিল—গিলমার, জালমা স্যাণ্টোস, মাউরো (অধি), জোজিমো, নিল্টন স্যাণ্টোস, জিটো, দিদি, গ্যারিঞ্চা, ভাভা, আমারিল্ডো, জাগালো।

চেকোশ্লোভাকিয়া—শ্রুইফ, টিচি, নোভাক, প্লুসকাল, পপ্লুহার, মাসোপুস্ত (অধি), পসপিচাল, শেরার, কাশনিয়াক, কাদ্রাবা, ইয়েলিনেক।

.

ইংল্যাণ্ড ১৯৬৬

.

গ্রুপ ১

ইংল্যাণ্ড ০, উরুগুয়ে ০

ফ্রান্স ১, মেক্সিকো ১

উরুগুয়ে ২, ফ্রান্স ১

ইংল্যাণ্ড ২, মেক্সিকো ০

উরুগুয়ে ০, মেক্সিকো ০

ইংল্যাণ্ড ২, ফ্রান্স ০

গ্রুপ ২

পঃ জার্মানি ৫, সুইৎজারল্যাণ্ড ০

আর্জেন্তিনা ২, স্পেন ১

স্পেন ২, সুইৎজারল্যাণ্ড ১

আর্জেন্তিনা ০, পঃ জার্মানি ০

আর্জেন্তিনা ২, সুইৎজারল্যাণ্ড ০

পঃ জার্মানি ২, স্পেন ১

গ্রুপ ৩

ব্রাজিল ২, বালগেরিয়া ০

পর্তুগাল ৩, হাঙ্গেরি ১

হাঙ্গেরি ৩, ব্রাজিল ১

পর্তুগাল ৩, বালগেরিয়া ০

পর্তুগাল ৩, ব্রাজিল ১

হাঙ্গেরি ৩, বালগেরিয়া ১

.

গ্রুপ ৪

সোভিয়েত ইউঃ ৩, উঃ কোরিয়া ০

ইতালি ২, চিলি ০

চিলি ১, উঃ কোরিয়া ১

সোভিয়েত ইউঃ ১, ইতালি ০

উঃ কোরিয়া ১, ইতালি ০

সোভিয়েত ইউঃ ২, চিলি ১

কোঃ ফাইনাল

ইংল্যাণ্ড ১, আর্জেন্তিনা ০

পঃ জার্মানি ৪, উরুগুয়ে ০

পর্তুগাল ৫, উঃ কোরিয়া ৩

সোভিয়েত ইউঃ ২, হাঙ্গেরি ১

সেমি—ফাইনাল

পঃ জার্মানি ২, সোভিয়েত ইউঃ ১

ইংল্যাণ্ড ২, পর্তুগাল ১

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

পর্তুগাল ২, সোভিয়েত ইউঃ ১

ফাইনাল (লণ্ডন)

ইংল্যাণ্ড ৪, পঃ জার্মানি ২ (অতিরিক্ত সময়ে)

গোলদাতা—ইংল্যাণ্ডের : হার্স্ট (৩), পিটার্স।

পঃ জার্মানির : হলার, ভেবার।

ইংল্যাণ্ড—ব্যাঙ্কস, কোহেন, উইলসন, স্টাইলস, জ্যাকি চার্লটন, মুর (অধি), বল, হার্স্ট, হাণ্ট, ববি চার্লটন, পিটার্স।

পঃ জার্মানি—টিলকোউসকি, হটজেস, শুলজ, ভেবার, স্নেলিঞ্জার, হলার, বেকেনবাউয়ার, ওভারট, জিলার (অধি), হেল্ড, এমেরিখ।

.

মেক্সিকো ১৯৭০

.

গ্রুপ ক

মেক্সিকো ০, সোভিয়েত ইউঃ ০

বেলজিয়াম ৩, এল সালভাদর ০

সোভিয়েত ইউঃ ৪, বেলজিয়াম ১

মেক্সিকো ৪, এল সালভাদর ০

সোভিয়েত ইউঃ ২, এল সালভাদর ০

মেক্সিকো ১, বেলজিয়াম ০

গ্রুপ খ

উরুগুয়ে ২, ইজরায়েল ০

ইতালি ১, সুইডেন ০

উরুগুয়ে ০, ইতালি ০

ইজরায়েল ১, সুইডেন ১

সুইডেন ১, উরুগুয়ে ০

ইজরায়েল ০, ইতালি ০

.

গ্রুপ গ

ইংল্যাণ্ড ১, রোমানিয়া ০

ব্রাজিল ৪, চেকোশ্লোভাকিয়া ১

রোমানিয়া ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ১

ব্রাজিল ১, ইংল্যাণ্ড ০

ব্রাজিল ৩, রোমানিয়া ২

ইংল্যাণ্ড ১, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

গ্রুপ ঘ

পেরু ৩, বালগেরিয়া ২

পঃ জার্মানি ২, মরক্কো ১

পেরু ৩, মরক্কো ০

পঃ জার্মানি ৫, বালগেরিয়া ২

পঃ জার্মানি ৩, পেরু ১

বালগেরিয়া ১, মরক্কো ১

.

কোঃ ফাইনাল

উরুগুয়ে ১, সোভিয়েত ইউঃ ০

ইতালি ৪, মেক্সিকো ১

ব্রাজিল ৪, পেরু ২

পঃ জার্মানি ৩, ইংল্যাণ্ড ২

.

সেমি—ফাইনাল

ইতালি ৪, পঃ জার্মানি ৩

ব্রাজিল ৩, উরুগুয়ে ১

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

পঃ জার্মানি ১, উরুগুয়ে ০

ফাইনাল (মেক্সিকো সিটি)

ব্রাজিল ৪, ইতালি ১

গোলদাতা—ব্রাজিলের : পেলে, গার্সন, জাইরজিনহো, আলবার্তো।

ইতালির : বোনিনসেনা।

ব্রাজিল—ফেলিক্স, আলবার্তো (অধি), ব্রিটো, পিয়াজ্জা, এভারাল্ডো, গার্সন, ক্লোদোয়াল্ডো, জাইরজিনহো, পেলে, তোস্তাও, রিভেলিনো।

ইতালি—আলবারতোসি, বারনিচ, সিরা, রোসাতো, ফাচ্চেচত্তি (অধি), বার্তিনি (জুলিয়ানো), রিভা, দোমেনিনি, মাজ্জোলা, ডি সিস্তি, বোনিনসেনা (রিভেরা)।

.

পশ্চিম জার্মানি ১৯৭৪

.

গ্রুপ ১

পঃ জার্মানি ১, চিলি ০

পূঃ জার্মানি ২, অস্ট্রেলিয়া ০

পঃ জার্মানি ৩, অস্ট্রেলিয়া ০

পূঃ জার্মানি ১, চিলি ১

পূঃ জার্মানি ১, পঃ জার্মানি ০

চিলি ০, অস্ট্রেলিয়া ০

.

গ্রুপ ২

ব্রাজিল ০, যুগোশ্লাভিয়া ০

স্কটল্যাণ্ড ২, জাইর ০

ব্রাজিল ০, স্কটল্যাণ্ড ০

যুগোশ্লাভিয়া ৯, জাইর ০

স্কটল্যাণ্ড ১, যুগোশ্লাভিয়া ১

ব্রাজিল ৩, জাইর ০

.

গ্রুপ ৩

হল্যাণ্ড ২, উরুগুয়ে ০

সুইডেন ০, বালগেরিয়া ০

হল্যাণ্ড ০, সুইডেন ০

বালগেরিয়া ১, উরুগুয়ে ১

হল্যাণ্ড ৪, বালগেরিয়া ১

সুইডেন ৩, উরুগুয়ে ০

গ্রুপ ৪

ইতালি ৩, হাইতি ১

পোল্যাণ্ড ৩, আর্জেন্তিনা ২

আর্জেন্তিনা ১, ইতালি ১

পোল্যাণ্ড ৭, হাইতি ০

আর্জেন্তিনা ৪, হাইতি ১

পোল্যাণ্ড ২, ইতালি ১

.

গ্রুপ ক

ব্রাজিল ১, পূঃ জার্মানি ০

হল্যাণ্ড ৪, আর্জেন্তিনা ০

হল্যাণ্ড ২, পূঃ জার্মানি ০

ব্রাজিল ২, আর্জেন্তিনা ১

হল্যাণ্ড ২, ব্রাজিল ০

আর্জেন্তিনা ১, পূঃ জার্মানি ১

গ্রুপ খ

পোল্যাণ্ড ১, সুইডেন ০

পঃ জার্মানি ২, যুগোশ্লাভিয়া ০

পোল্যাণ্ড ২, যুগোশ্লাভিয়া ১

পঃ জার্মানি ৪, সুইডেন ২

সুইডেন ২, যুগোশ্লাভিয়া ১

পঃ জার্মানি ১, পোল্যাণ্ড ০

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

পোল্যাণ্ড ১, ব্রাজিল ০

ফাইনাল (মিউনখ)

পঃ জার্মানি ২, হল্যাণ্ড ১

গোলদাতা—পঃ জার্মানির : ব্রিটনার (পেনাল্টি), মুলার।

হল্যাণ্ডের : নিসকেনস (পেনাল্টি)

পঃ জার্মানি—মেইয়ার, ফোগৎস, শ্যোয়ারজেনবেক, বেকেনবাউয়ার (অধি), ব্রিটনার, বোনহফ, হোনেস, ওভারট, গ্রাবৌস্কি, মুলার, হোলজেনবিন।

হল্যাণ্ড—ইয়ংব্লোড, সুরবিয়ের, রাইসবারজেন (ডি ইয়ং), হ্যান, ক্রল, ইয়ানসেন, ভ্যান হ্যানেজেম, নিসকেনস, রেপ, ক্রুয়েফ (অধি), রেনসেনব্রিঙ্ক (আর ভ্যান ডার কারকফ)।

.

আর্জেন্তিনা ১৯৭৮

.

গ্রুপ ১

ইতালি ২, ফ্রান্স ১

আর্জেন্তিনা ২, হাঙ্গেরি ১

ইতালি ৩, হাঙ্গেরি ১

আর্জেন্তিনা ২, ফ্রান্স ১

ফ্রান্স ৩, হাঙ্গেরি ১

ইতালি ১, আর্জেন্তিনা ০

.

গ্রুপ ২

পঃ জার্মানি ০, পোল্যাণ্ড ০

তিউনিসিয়া ৩, মেক্সিকো ১

পোল্যাণ্ড ১, তিউনিসিয়া ০

পঃ জার্মানি ৬, মেক্সিকো ০

পোল্যাণ্ড ৩, মেক্সিকো ১

পঃ জার্মানি ০, তিউনিসিয়া ০

গ্রুপ ৩

অস্ট্রিয়া ২, স্পেন ১

ব্রাজিল ১, সুইডেন ১

অস্ট্রিয়া ১, সুইডেন ০

ব্রাজিল ০, স্পেন ০

স্পেন ১, সুইডেন ০

ব্রাজিল ১, অস্ট্রিয়া ০

.

গ্রুপ ৪

পেরু ৩, স্কটল্যাণ্ড ১

হল্যাণ্ড ৩, ইরান ০

স্কটল্যাণ্ড ১, ইরান ১

হল্যাণ্ড ০, পেরু ০

পেরু ৪, ইরান ১

স্কটল্যাণ্ড ৩, হল্যাণ্ড ২

গ্রুপ ক

পঃ জার্মানি ০, ইতালি ০

হল্যাণ্ড ৫, অস্ট্রিয়া ১

ইতালি ১, অস্ট্রিয়া ০

হল্যাণ্ড ২, পঃ জার্মানি ২

হল্যাণ্ড ২, ইতালি ১

অস্ট্রিয়া ৩, পঃ জার্মানি ২

গ্রুপ খ

ব্রাজিল ৩, পেরু ০

আর্জেন্তিনা ২, পোল্যাণ্ড ০

পোল্যাণ্ড ১, পেরু ০

আর্জেন্তিনা ০, ব্রাজিল ০

ব্রাজিল ৩, পোল্যাণ্ড ১

আর্জেন্তিনা ৬, পেরু ০

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

ব্রাজিল ২, ইতালি ১

ফাইনাল (বুয়েনস এয়ারেস)

আর্জেন্তিনা ৩, হল্যাণ্ড ১ (নির্ধারিত সময়ের পর ১—১)

গোলদাতা—আর্জেন্তিনার : কেম্পেস (২), বার্তোনি।

হল্যাণ্ডের : নানিঞ্জা

আর্জেন্তিনা—ফিলোল, প্যাসারেল্লা (অধি), ওলগুইন, গ্যালভান, তারানতিনি, আর্দিলেস (লারোসা), গ্যালেগো, ওর্তিজ (হাউসম্যান), বার্তোনি, লুকে, কেম্পেস।

হল্যাণ্ড—ইয়ংব্লোড, ক্রল (অধি), পোরতুলিয়েত, ব্র্যাণ্ডটস, ইয়ানসেন (সুরবিয়ের), হ্যান, নিসকেনস, ভিলি ভ্যান ডার কারকফ, রেপ (নানিঞ্জা), রেনেভ্যান ডার কারকফ, রেনসেনব্রিঙ্ক।

স্পেন ১৯৮২

.

প্রথম রাউণ্ড

.

গ্রুপ ১

ইতালি ০, পোল্যাণ্ড ০

পেরু ০, ক্যামেরুন ০

ইতালি ১, পেরু ১

পোল্যাণ্ড ০, ক্যামেরুন ০

পোল্যাণ্ড ৫, পেরু ১

ইতালি ১, ক্যামেরুন ১

.

গ্রুপ ২

আলজেরিয়া ২, পঃ জার্মানি ১

অস্ট্রিয়া ১, চিলি ০

পঃ জার্মানি ৪, চিলি ১

অস্ট্রিয়া ২, আলজেরিয়া ০

আলজেরিয়া ৩, চিলি ২

পঃ জার্মানি ১, অস্ট্রিয়া ০

.

গ্রুপ ৩

বেলজিয়াম ১, আর্জেন্তিনা ০

হাঙ্গেরি ১০, এল সালভাদর ১

আর্জেন্তিনা ৪, হাঙ্গেরি ১

বেলজিয়াম ১, এল সালভাদর ০

বেলজিয়াম ১, হাঙ্গেরি ১

আর্জেন্তিনা ২, এল সালভাদর ০

.

গ্রুপ ৪

ইংল্যাণ্ড ৩, ফ্রান্স ১

চেকোশ্লোভাকিয়া ১, কুয়েত ১

ইংল্যাণ্ড ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

ফ্রান্স ৪, কুয়েত ১

ফ্রান্স ১, চেকোশ্লোভাকিয়া ১

ইংল্যাণ্ড ১, কুয়েত ০

.

গ্রুপ ৫

স্পেন ১, হণ্ডুরাস ১

যুগোশ্লাভিয়া ০, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ০

স্পেন ২, যুগোশ্লাভিয়া ১

হণ্ডুরাস ১, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১

যুগোশ্লাভিয়া ১, হণ্ডুরাস ০

উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১, স্পেন ০

.

গ্রুপ ৬

ব্রাজিল ২, সোভিয়েত ইউঃ ১

স্কটল্যাণ্ড ৫, নিউজিল্যাণ্ড ২

ব্রাজিল ৪, স্কটল্যাণ্ড ১

সোভিয়েত ইউঃ ৩, নিউজিল্যাণ্ড ০

সোভিয়েত ইউঃ ২, স্কটল্যাণ্ড ২

ব্রাজিল ৪, নিউজিল্যাণ্ড ০

.

দ্বিতীয় রাউণ্ড

গ্রুপ ক

পোল্যাণ্ড ৩, বেলজিয়াম ০

সোভিয়েত ইউঃ ১, বেলজিয়াম ০

পোল্যাণ্ড ০, সোভিয়েত ইউঃ ০

.

গ্রুপ খ

পঃ জার্মানি ০, ইংল্যাণ্ড ০

পঃ জার্মানি ২, স্পেন ১

ইংল্যাণ্ড ০, স্পেন ০

.

গ্রুপ গ

ইতালি ২, আর্জেন্তিনা ১

ব্রাজিল ৩, আর্জেন্তিনা ১

ইতালি ৩, ব্রাজিল ২

.

গ্রুপ ঘ

উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ২, অস্ট্রিয়া ২

ফ্রান্স ১, অস্ট্রিয়া ০

ফ্রান্স ৪, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১

সেমি—ফাইনাল

ইতালি ২, পোল্যাণ্ড ০

পঃ জার্মানি ৮, ফ্রান্স ৭ (অতিরিক্ত সময়ের পর ৩—৩)

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

পোল্যাণ্ড ৩, ফ্রান্স ২

ফাইনাল (মাদ্রিদ)

ইতালি ৩, পঃ জার্মানি ১

গোলদাতা—ইতালির : রোসি, তারদেল্লি, আলতোবেলি।

পঃ জার্মানির : ব্রিটনার।

ইতালি—জফ (অধি), বারগোমি, সিরিয়া, কোল্লাভাতি, ক্যাব্রিনি, ওরিয়েলি, জেন্টাইলে, তারদেল্লি, কোন্তি, রোসি, গ্রাজিয়ানি (আলতোবেলি)।

পঃ জার্মানি—শুমাখার, কালৎজ, স্টাইলাইক, কার্ল—হাউঞ্জ ফরস্টার, বার্নড ফরস্টার, ড্রেমলার (রুবেশ), ব্রিটনার, ব্রিগেল, রুমেনিগে (অধি) (হানস মুলার), ফিশার, লিটবারশকি।

.

মেক্সিকো ১৯৮৬

.

প্রথম রাউণ্ড

গ্রুপ ১

ইতালি ১, বালগেরিয়া ১

আর্জেন্তিনা ৩, দঃ কোরিয়া ১

ইতালি ১, আর্জেন্তিনা ১

বালগেরিয়া ১, দঃ কোরিয়া ১

ইতালি ৩, দঃ কোরিয়া ২

আর্জেন্তিনা ২, বালগেরিয়া ০

গ্রুপ ২

মেক্সিকো ২, বেলজিয়াম ১

প্যারাগুয়ে ১, ইরাক ০

মেক্সিকো ১, প্যারাগুয়ে ১

বেলজিয়াম ২, ইরাক ১

মেক্সিকো ১, ইরাক ০

বেলজিয়াম ২, প্যারাগুয়ে ২

.

গ্রুপ ৩

ফ্রান্স ১, কানাডা ০

সোভিয়েত ইউঃ ৬, হাঙ্গেরি ০

সোভিয়েত ইউঃ ১, ফ্রান্স ১

হাঙ্গেরি ২, কানাডা ০

ফ্রান্স ৩, হাঙ্গেরি ০

সোভিয়েত ইউঃ ২, কানাডা ০

.

গ্রুপ ৪

ব্রাজিল ১, স্পেন ০

উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১, আলজেরিয়া ১

ব্রাজিল ১, আলজেরিয়া ০

স্পেন ২, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১

ব্রাজিল ৩, উঃ আয়ার্ল্যাণ্ড ১

স্পেন ৩, আলজেরিয়া ০

গ্রুপ ৫

উরুগুয়ে ১, পঃ জার্মানি ১

ডেনমার্ক ১, স্কটল্যাণ্ড ০

পঃ জার্মানি ২, স্কটল্যাণ্ড ১

ডেনমার্ক ৬, উরুগুয়ে ১

স্কটল্যাণ্ড ০, উরুগুয়ে ০

ডেনমার্ক ২, পঃ জার্মানি ০

.

গ্রুপ ৬

পোল্যাণ্ড ০, মরক্কো ০

পর্তুগাল ১, ইংল্যাণ্ড ০

ইংল্যাণ্ড ০, মরক্কো ০

পোল্যাণ্ড ১, পর্তুগাল ০

মরক্কো ৩, পর্তুগাল ১

ইংল্যাণ্ড ৩, পোল্যাণ্ড ০

.

দ্বিতীয় রাউণ্ড (প্রি—কোঃ ফাইনাল)

মেক্সিকো ২, বালগেরিয়া ০

বেলজিয়াম ৪, সোভিয়েত ইউঃ ৩ (নির্ধারিত সময়ের পর ২—২)

ব্রাজিল ৪, পোল্যাণ্ড ০

আর্জেন্তিনা ১, উরুগুয়ে ০

ফ্রান্স ২, ইতালি ০

পঃ জার্মানি ১, মরক্কো ০

ইংল্যাণ্ড ৩, প্যারাগুয়ে ০

স্পেন ৫, ডেনমার্ক ১

কোঃ ফাইনাল

ফ্রান্স ৫, ব্রাজিল ৪ (অতিরিক্ত সময়ের পর ১—১)

পঃ জার্মানি ৪, মেক্সিকো ১ (অতিরিক্ত সময়ের পর ০—০)

আর্জেন্তিনা ২, ইংল্যাণ্ড ১

বেলজিয়াম ৬, স্পেন ৫ (অতিরিক্ত সময়ের পর ১—১)

সেমি—ফাইনাল

পঃ জার্মানি ২, ফ্রান্স ০

আর্জেন্তিনা ২, বেলজিয়াম ০

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

ফ্রান্স ৪, বেলজিয়াম ২ (অতিরিক্ত সময়ের পর ২—২)

ফাইনাল (মেক্সিকো সিটি)

আর্জেন্তিনা ৩, পঃ জার্মানি ২

গোলদাতা—আর্জেন্তিনার : ব্রাউন, ভালদানো, বুরুশাগা।

পঃ জার্মানির : রুমেনিগে, ফোলার।

আর্জেন্তিনা—পম্পিদো, ব্রাউন, কুসিউফো, রাগেরি, জুলিও, গুইস্তি, বাতিস্তা, এনরিকে, মারাদোনা, ভালদানো, বুরুশাগা।

পঃ জার্মানি—শুমাখার, জেকবস, বের্টোল্ড, কার্ল—হাইঞ্জ ফোরস্টার, ব্রিগেল, ম্যাগাট (হোনেস), এডার, ব্রেহমে, ম্যাটাউস, রুমেনিগে, ফোলার।

.

(সংযোজন)

১৯৯০ ইতালি

”ইতালিয়া ৯০”—এর জন্য ফিফা স্লোগান দিয়েছিল—”গো ফর গোল”, গোল বলতে বিপক্ষের গোলের দিকে ধাওয়া, নিজের গোলের দিকে নয়। কিন্তু অধিকাংশ দলই গোল করার থেকে নিজেদের গোল খাওয়া বন্ধের দিকেই বেশি মনোযোগী হওয়ায় গোলের অনুপাত সর্বকালীন কমতির দিকে নেমে যায়। প্রথম রাউণ্ডের ৩৬ ম্যাচে গোল হয় ৮২টি। গড়ে ম্যাচ পিছু ২.২৭ গোল। সারা পৃথিবী জুড়ে দর্শকরা গোলের উত্তেজনা ও চমকদারিত্ব না পেয়ে বিরক্ত হয়ে পড়লেন। অথচ গোল বাড়াতে স্ট্রাইকারদের সুরক্ষা দেবার জন্য ফিফা রেফারিদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিল, গোল করা আটকাবার জন্য যেসব ডিফেণ্ডাররা ফরোয়ার্ডদের মেরে মাটিতে ফেলে দেবে তাদের যেন তখুনি মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয়। যারা একটা লাল বা দুটো হলুদ কার্ড দেখবে তাদের জন্য বড় রকমের জরিমানারও ব্যবস্থা হয়। কিন্তু সবই হল ভস্মে ঘি ঢালা।

আয়ার্ল্যান্ড চারটি ম্যাচের একটিও না জিতে এবং দুটি মাত্র গোল দিয়ে, এবং চারটি ম্যাচে ইংল্যান্ড তিনটি মাত্র গোল দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল। অথচ এই দুই দেশে গোল করাকেই নাকি ফুটবলের আসল ধর্ম বলে মনে করা হয়। আর্জেন্তিনা একটু ভাল ফল দেখায়—চার ম্যাচে দেয় চার গোল। তাদের ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জয়ী দলের ম্যানেজার লুই সিজার মেনোত্তি, প্রি—কোয়ার্টার ফাইনাল রাউণ্ডের পর বললেন, এত দীনদরিদ্র বিশ্বকাপ তিনি কখনও দেখেননি। ”অলৌকিক কিছু না ঘটলে এই প্রতিযোগিতাকে রক্ষা করা যাবে না। তবে মনে হয় না কোনরকম উন্নতি ঘটবে।” উন্নতি সত্যিই ঘটেনি।

প্রি—কোয়ার্টারের আটটি ম্যাচে নব্বই মিনিটের খেলায় হল ১৭ গোল। কোয়ার্টার ফাইনালের চারটি ম্যাচে নব্বুই মিনিটের নির্ধারিত সময়ের খেলায় ছয় গোল। সেমি—ফাইনালের দুটি ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের খেলায় চার গোল। ফাইনালে এক গোল এবং তৃতীয় স্থানাধিকারীর জন্য খেলায় তিন গোল। মোট ৫২ ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ের দেওয়া দুটি গোল ধরে (টাইব্রেকারের গোল বাদে) ১১৫ গোল। গড়ে ম্যাচ পিছু ২.২১ গোল। এত কম গোলের বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা আগে কখনও হয়নি।

প্রতি দলেই কয়েকজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকলেও, সাহসভরে আক্রমণাত্মক হওয়ার বদলে দেখা গেল রক্ষণাত্মক ট্যাকটিকসই খেলাগুলিকে পরিচালিত করেছে। চ্যাম্পিয়নশিপের প্রায় সব ম্যাচে দেখা গেল একই ছক, জয়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা নয়, কি করে হার এড়ান যায় সবার মাথায় যেন সেটাই ঢুকে রয়েছে। তার ফলে বামনাকৃতির দলও দৈত্যদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে খেলার সুযোগ পায়।

১৯৯০ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতাকে বলা হল, যেন পাস্তা বিনা ইতালিয় ভোজ, যাতে নেই সারবস্তু, নেই বৈচিত্র্য এবং ভোজন শেষে মনে হয় পেটটা যেন খালিই রয়ে গেল। ১৬ জনকে লাল এবং ১৬৯ জনকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে রেফারিরা খেলাকে পরিচ্ছন্ন রাখার যে প্রশংসনীয় চেষ্টা করেন, সেটা শেষপর্যন্ত ফাউল করে খেলার স্নানের সঙ্গে প্রবহমান ফুটবলের শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

ব্রাজিল তার স্বভাবসিদ্ধ প্রাণোচ্ছলতা পরিহার করে ইওরোপীয় ভঙ্গির আক্রমণ রীতি গ্রহণ করায় লাভ হল এই, দ্বিতীয় রাউন্ডেই তাদের বিদায় ঘটল। প্রচণ্ড গতি আর টিম স্পিরিটের উপর নির্ভর করে ক্যামেরুন, ভবিষ্যদ্বক্তাদের বোকা বানিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। সেখানেও ইংল্যান্ডকে ৮৩ মিনিট পর্যন্ত ২—১ গোলে পিছিয়ে রেখেছিল। অতঃপর গ্যারি লিনেকার পেনাল্টি থেকে গোল দিয়ে ম্যাচটিকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যান এবং আর একটি পেনাল্টি কিক থেকে ইংল্যান্ডকে সেমি ফাইনালে তোলেন। ব্রাজিলের জার্সিপরাদের থেকেও বেশি ব্রাজিলীয় ঢঙে খেলেছে ক্যামেরুন। প্রতিযোগিতার প্রথম ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্তিনাকে ১—০ হারিয়ে তারা বিশ্বকাপ ইতিহাসের একটা বড় আপসেট ঘটিয়ে দেয়। অতঃপর রোমানিয়া ও কলম্বিয়াকে হারিয়ে আফ্রিকাকে প্রথমবার বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে স্থাপন করে। প্রথমবার আফ্রিকা দ্বিতীয় রাউন্ডে এসেছিল ১৯৮৬—তে মরক্কোর সৌজন্যে। তবে ক্যামেরুনের উত্থান যতই রূপকথার মত মনে হোক না কেন, কাহিনীসূত্রটা কিন্তু সর্বদা ছোটদের উপযোগী ছিল না। তাদের সাফল্যের অনেকটাই আদায় হয়েছে নির্মমভাবে প্রতিপক্ষকে বাধা দেওয়ার দ্বারা। প্রথম চারটি খেলায়ই তাদের বিরুদ্ধে ১১৫ ফাউল, ১১ হলুদ কার্ড এবং প্রথম ম্যাচেই দুজনকে বহিষ্কারই এর সাক্ষ্য দেবে। প্রতিযোগিতার অপ্রত্যাশিত ‘হিরো’র আবির্ভাব কিন্তু ঘটল এস ক্যামেরুন দলের মধ্য থেকেই, ৩৮ বছর বয়সী রজার মিল্লা। প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় প্রবীণ ফুটবলার। ভারত মহাসাগরের দ্বীপ লা রিইউনিয়নে এক বছর অবসর যাপনে ছিলেন ও সেখানে অ্যামেচার ফুটবল খেলতেন। ক্যামেরুন প্রেসিডেন্টের অনুরোধে বিশ্বকাপ দলে তিনি স্থান পান। চারটি গোলই তিনি দিয়েছে পরিবর্ত রূপে মাঠে নামার পর। শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে তিনি মিনিটের মধ্যে মিল্লা তার দলের গোল দুটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। নিখুঁত স্ট্রাইকারের জাত তিন চিনিয়ে দেন এই বিশ্বকাপে। মিল্লার মত ৩৮ বছর বয়সী আর কেউ বিশ্বকাপে কখনও গোল করেননি।

প্রথম রাউণ্ডের গ্রুপ ম্যাচগুলির দমবন্ধ করা, হতাশকর ফুটবলের পর আশা করা গিয়েছিল প্রতিযোগিতা জীবন্ত ও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে দ্বিতীয় রাউণ্ড থেকে। কিন্তু তা হয়নি। আটটি খেলার নির্ধারিত সময়ে হল ১৩ গোল এবং মাত্র তিনটি দল—ইতালি, পশ্চিম জার্মানি ও চেকোশ্লোভাকিয়া—খানিকটা আশাব্যঞ্জক খেলা দেখিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এগিয়ে যায়।

প্রতিযোগিতা শুরুর আগের ফেভারিট ব্রাজিল ও হল্যান্ডের উচ্চচাকাঙ্ক্ষা চুরমার হওয়ার সঙ্গেই ফুটবল রসিকদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করার মত বিশ্বকাপ দেখার আশাও দ্রুত বিলীন হতে থাকে। আর্জেন্তিনা এবং মাঝেমধ্যে জ্বলে ওঠা আধাসমর্থ মারাদোনা এমন একটা গর্ত প্রতিযোগিতায় তৈরি করে যেটা ভরাট করা আর সম্ভব হয়নি। সোভিয়েত ‘রেড মেসিন’ ফাঁকা আওয়াজ করে দেশে ফিরে গেল সারাইয়ের জন্য। হল্যান্ড দলে ঈর্ষা করার মত তারকা সমাবেশ ঘটে, রুদ গুলিত, মার্কো ফান বাস্তেন, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড ও রোনাল্ড কোয়েম্যানের উপস্থিতিতে এবং সব থেকে বড় ডিগবাজি খেল হল্যান্ডই। কমলা রঙের জার্সির এই দল আগে মিষ্টিস্বাদের ফুটবল খেলে ইওরোপীয় খেতাব জিতেছিল, তারাই কচলানো পাতিলেবুর মত তেতো হয়ে গেল এই বিশ্বকাপে। গ্রুপের তিনটি ম্যাচ থেকে কোনওক্রমে গলে বেরিয়ে তারা পশ্চিম জার্মানির কাছে ১—২ হারে। প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা খেলা হিসাবে এটি গণ্য হয়। রাইকার্ড ও জার্মানির ফোলার এই ম্যাচে মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হন।

তিনবার বল পোস্টে লেগে ফিরে এল এবং সারা ম্যাচে প্রাধান্য রেখেও আর্জেন্তিনার গোলে ব্রাজিল একবারও বল ঢোকাতে পারল না। মারাদোনাতঙ্কে ভোগার জন্য ব্রাজিলের সন্ত্রস্ত ডিফেণ্ডাররা এই লোকটির দিকে বেশি নজর দেওয়ায় ক্লদিও ক্যানিজ্জিয়া যে সুযোগ পান তারই পরিণতিতে একটি গোল এবং আর্জেন্তিনা কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায়। দুটি ম্যাচে, দুটি টাই ব্রেকার এবং মাত্র একটি গোল করে—সেমি ফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে ক্যানিজ্জিয়ার ৬৬ মিনিটের সমতাকারী গোলটি—আর্জেন্তিনা হাজির হয় ফাইনালে। অপরিসীম ভাগ্য সর্বত্রই তাদের অনুসরণ করে না গেলে ফাইনালে ওঠার মত ফুটবল তারা একবারও খেলেনি। ইতালি প্রথম পাঁচটি ম্যাচের প্রতিটিই জিতে ভাগ্যের হাতে মার খেল ষষ্ঠটিতে যখন আর্জেন্তিনা তাদের থেকে ভাল পেনাল্টি শট নিল এবং বাঁচাল। আর্জেন্তিনার নতুন গোলকিপার গয়কোসিয়া দুটি পেনাল্টি শট বাঁচান, ইতালির গোলে ঢোকে চারটি শট, তার মধ্যে একটি ছিল মারাদোনার, প্রতিযোগিতায় তাঁর একমাত্র গোল। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এবারই দুটি সেমি—ফাইনাল খেলারই নিষ্পত্তি হল টাইব্রেকারে। অপরটিতে পশ্চিম জার্মানি—ইংল্যান্ড ম্যাচের ফলও হয় ৫—৪।

১৯৯০ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসে এশিয়ান দেশগুলি জিতেছে একটি মাত্র ম্যাচ। সেটি ঘটে ১৯৬৬ বিশ্বকাপে, উত্তর কোরিয়ার কাছে ইতালির ১—০ হারে। এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তাদের তিনটি ম্যাচেই পরাজিত হয়। আরবরা সর্বাধিক গোল খায়—১১টি। গতি ছাড়া কোরীয়দের খেলায় আর কিছু ছিল না। তিনটি ম্যাচে তারা গোলে শট নিতে পেরেছে মাত্র ছয়বার। তারা ফাউলও করে সর্বাধিক—৮৮টি। গড়ে ম্যাচ পিছু প্রায় ৩০টি। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে কোরীয়দের ফাউল ছিল ৩৬টি। ১৯৮২ থেকে তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের হিসাব থেকে দেখা যায় এশিয় দেশগুলি ১৫ ম্যাচের একটিও জিততে পারনি, ড্র দুটি এবার হার ১৩টি। গোল দিয়েছে ১২, খেয়েছে ৪৬। এরই পাশাপাশি, আফ্রিকার দেশগুলি এই তিন বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচের ছয়টিতে জিতেছে, আট ড্র ও সাতটিতে হেরেছে। পক্ষে গোল ১৮, বিপক্ষে ২৪। আফ্রিকা যে ফুটবল শক্তিরূপে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেটা ক্যামেরুনের চাঞ্চল্যকর সাফল্য থেকে আরও ভালভাবে বোঝা গেল। বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ে তাদের আরও একটি দেশকে স্থান দেবার জন্য আফ্রিকা চেষ্টা চালাচ্ছিল অবশেষে তারা সফল হল। ফিফা প্রেসিডেন্ট জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ এবারের প্রতিযোগিতার মাঝেই ঘোষণা করলেন, ১৯৯৪ বিশ্বকাপে আফ্রিকা থেকে তৃতীয় একটি দেশ স্থান পাবে এবং সেজন্য ইওরোপের ১৩ দেশ থেকে একটি দেশ কমবে। ফিফা নথিভুক্ত ফুটবলারের সংখ্যা এখন আফ্রিকায় ৫০ লক্ষ, এশিয়ায় ৫ কোটি ৪০ লক্ষ, ইওরোপে ২ কোটি ৮০ লক্ষ ও দঃ আমেরিকায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ।

১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের জন্য দুটি দল বাছাইয়ের প্রতিযোগিতায় এশিয় অঞ্চলের ২৫টি দেশ নিয়ে ছয়টি গ্রুপ গঠিত হয়। চতুর্থ গ্রুপের লীগে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও নেপালের সঙ্গে ছিল ভারত। কিন্তু লীগ শুরুর আগেই ভারত নাম প্রত্যাহার করে নেয়।

ফাইনাল খেলার নির্ধারিত সময় শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে, রোবার্তো সেনসিনি রুডি ফোলারকে ফাউল করায় মেক্সিকান রেফারি কোদেসাল যে দণ্ড দেন তাই থেকে পশ্চিম জার্মানির আন্দ্রিয়াস ব্রেহমে—র পেনাল্টি শট আর্জেন্তিনার খেতাব রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা শেষ করে দেয় রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। সারা ম্যাচে আর্জেন্তিনা গোলের দিকে একটি মাত্র শট নিতে পেরেছিল। তারা নয়জন খেলোয়াড় নিয়ে ম্যাচ শেষ করে। ৬৫ মিনিটে পেদ্রো মোনজোন ও ৮৭ মিনিটে গুস্তাভো দেজোত্তি মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হন। বিশ্বকাপ ফাইনালে বহিষ্কারের এহেন ঘটনা এই প্রথম। দক্ষিণ আমেরিকানদের লক্ষ্য ছিল নিজ মহাদেশের বাইরে, ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় দেশ রূপে বিশ্বকাপ জয়। বদলে তারা অর্জন করল ঈর্ষার অযোগ্য একটি রেকর্ড—বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করতে না পারা প্রথম দল। সাসপেণ্ড থাকায় ক্যানিজ্জিয়াসহ চারজনকে মাঠের বাইরে রেখে আর্জেন্তিনা নির্ভর করেছিল মাঝ মাঠ বন্ধ রাখার এবং সারা প্রতিযোগিতায় তারা যা করে এসেছে, রক্ষণাত্মক আঁটসাট নজরদারী খেলার উপর। পশ্চিম জার্মানি জোর দিয়েছিল অবিরাম আক্রমণে আর সেজন্য মধ্যমাঠে পিয়ের লিটবারস্কি ও টোমাস হ্যাসলার অক্লান্ত ভাবে বল যুগিয়ে গেছেন ক্লিন্সমান ও ফোলারকে। অন্যদিকে মারাদোনাকে নড়াচড়ার কোন সুযোগই দেননি গুইডো বুখভাল্ড এবং আর্জেন্তিনা অধিনায়ক কখনও যদি বা বলে পা ছুঁইয়েছেন অমনি সারা স্টেডিয়ামে বিদ্রুপ ধ্বনি উঠেছে।

ছয় বছর পশ্চিম জার্মান দলের ম্যানেজারির দায়িত্ব পালন করে ফ্রানৎজ বেকেনবাউয়ার বিশ্বকাপ জিতে দায়িত্ব থেকে এবার মুক্তি নিলেন। অধিনায়ক ও কোচ, দুই ভূমিকায় বিশ্বকাপ জয় তাঁর আগে আর কেউ করতে পারেননি। এই বিশ্বকাপের সমাপ্তির সঙ্গে ইংল্যান্ড ম্যানেজার ববি রবসনের দায়িত্বও শেষ হয়ে যায়। টাইব্রেকার পেনাল্টি দ্বৈরথে ইংল্যান্ডের হারের পর তিনি এই পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর মতে : এমন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় পেনাল্টিতে ম্যাচের জয়—পরাজয় নির্ধারণ ঠিক নয়। অতিরিক্ত সময়ের পর আরও পনেরো মিনিট খেলার নিয়ম থাকা দরকার এবং ততক্ষণই যতক্ষণ না কেউ গোল করছে। তাঁর মতে, পেনাল্টি মারার জন্য খেলোয়াড় আলাদাভাবে অন্যায্য চাপের মধ্যে পড়ে অথচ ফুটবল একটা দলগত খেলা। পেনাল্টি মারা শুরু হলে ব্যাপারটা তখন ভাগ্যের হাতে চলে যায়। অপরপক্ষে বেকেনবাউয়ার টাইব্রেকার প্রথা সমর্থন করে বলেন: ১২০ মিনিট খেলার পর নিষ্পত্তির জন্য এর থেকে ভাল পদ্ধতি আর কি হতে পারে? পরাজিতের কাছে ব্যাপারটা দুঃখের কিন্তু খেলাটা তো শেষ করতে হবে। আগে টস করে বিজয়ী নির্ধারিত হতো। সেটা কি খুব ভাল ছিল?

বিশ্বকাপে টাইব্রেকার পেনাল্টি পদ্ধতির প্রবর্তন হয় ১৯৮২ স্পেনে। এখন পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় আটবার এর প্রয়োগ ঘটেছে এবং পশ্চিম জার্মানি দুবার সেমি—ফাইনাল সহ মোট তিনবার এর সঙ্গে জড়িয়েছে ও সফল হয়েছে। টাইব্রেকার সমর্থন করে হ্যাভেলাঞ্জ বলেন : খেলার আইনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পেনাল্টি এবং সবাই এটা ব্যবহার করে। পশ্চিম জার্মানি ফুটবলের প্রতিটি দিক নিয়ে নিজেদের তৈরি করেছে এবং পেনাল্টিতে সফল হয়েছে। ওরা বিজয়ী হওয়ার উপযুক্ত। অন্য দলগুলিরও তাই করা উচিত।

ক্যামেরুনের কাছে ১—০ গোলে আর্জেন্তিনার, কোস্তা রিকার কাছে ১—০ গোলে স্কটল্যান্ডের পরাজয় বা মিশরের কাছে হল্যান্ডের ১—১ আটকে যাওয়া অথবা কষ্টেসৃষ্টে ইতালির ১—০ গোলে আয়ার্ল্যান্ডকে হারানোর মত বিস্ময়কর ফলের জন্য নানান কারণ দাখিল করা হয়। তার একটি হল : সারা বিশ্ব জুড়ে ফুটবল খেলোয়াড়রা ক্রমশ উন্নতি করেছে, তাদের কন্ডিশনিং ও স্কিল এখন প্রায় সমপর্যায়ে এসে গেছে। কোচিং কৌশল এখন সবদেশেই জানাজানি হয়ে যাচ্ছে আর সবারই মূলমন্ত্র ডিফেন্স। উঠতি দেশগুলির মধ্যে আয়ার্ল্যান্ড, যাদের দলে কোন তারকাই নেই, তারা শুধু ডিফেন্স আর দেহসক্ষমতার জোরেই পাঁচ ম্যাচে দুটি গোল করে বিপক্ষদের ভয় পাইয়ে দেয়। টাই—ব্রেকারে একটি গোল ছাড়া মারাদোনা আর গোলই পেলেন না! হল্যান্ডের গুলিত ও বাস্তেন তাদের দলকে দ্বিতীয় রাউন্ডেই ছিটকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারলেন না। গুলিত পান মাত্র একটি গোল, বাস্তেন তাও নয়। ব্রাজিলের কারেকা, বেলজিয়ামের বুরাগুয়েনো বা উরুগুয়ের রুবেন সোসা কেউই তাদের সুপারস্টার খ্যাতি অনুযায়ী খেলতে পারেননি। কিন্তু বেশি গোল করে গেলেন অখ্যাত নামারাই— চেকোশ্লোভাকিয়ার টোমাস সুরাভি, (কোস্তা রিকার বিরুদ্ধে হ্যাট্রিকসহ) ৫ গোল। রজার মিল্লা ৪ গোল। স্পেনের মিগুয়েল মিশেল (হ্যাটট্রিক দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে) ৪ গোল। অবশ্য তারকাদের মধ্যে ৪ গোল পেয়েছেন দুজন—পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক লোটার ম্যাটাউস ও ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার।

প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চচ ব্যক্তিগত গোলদাতা, ইতালির সালভাতোর শিলাচি—৬ গোল। সর্বাধিক গোল দেওয়া দল, পশ্চিম জার্মানি—১৫ গোল। ইতালির গোলরক্ষক ওয়াল্টার জেঙ্গা ৫১৮ মিনিট অপরাজিত থেকে ইংল্যান্ডের পিটার শিলটনের ৫০১ মিনিটের রেকর্ড ভাঙেন। এবার নিয়ে ১২টি বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানি খেলল সর্বাধিক ম্যাচ—৬৮। ব্রাজিল ১৪ বিশ্বকাপে খেলল ৬৬ ম্যাচ। বিশ্বকাপে প্রথমাবির্ভাবে জয়: কোস্তা রিকা ১, স্কটল্যান্ড ০। ”ইতালিয়া ৯০” টেলিভিশনে সারা বিশ্বে দেখেছেন রেকর্ড ২৬৭০ কোটি দর্শক গড়ে প্রতিম্যাচে ৫১.৩৩ কোটি। এশিয়ায় মোট দর্শকসংখ্যা ছিল ১২০০ কোটি। টিভি—তে সব থেকে বেশি লোক দেখেছেন ফাইনাল ম্যাচটি—১৬৭ দেশের ১০৬ কোটি দর্শক।

ইতালি ১৯৯০

.

প্রথম রাউন্ড

গ্রুপ ১

ইতালি ১, অস্ট্রিয়া ০

চেকোশ্লোভাকিয়া ৫, যুক্তরাষ্ট্র ১

ইতালি ১, যুক্তরাষ্ট্র ১

চেকোশ্লোভাকিয়া ১, অস্ট্রিয়া ০

ইতালি ২, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

অস্ট্রিয়া ২, যুক্তরাষ্ট্র ১

.

গ্রুপ ২

ক্যামেরুন ১, আর্জেন্তিনা ০

রোমানিয়া ২, সোভিয়েত ইউঃ ০

আর্জেন্তিনা ২, সোভিয়েত ইউঃ ০

ক্যামেরুন ২, রোমানিয়া ১

আর্জেন্তিনা ১, রোমানিয়া ১

সোভিয়েত ইউঃ ৪, ক্যামেরুন ০

গ্রুপ ৩

ব্রাজিল ২, সুইডেন ১

কোস্তা রিকা ১, স্কটল্যান্ড ০

ব্রাজিল ১, কোস্তা রিকা ০

স্কটল্যান্ড ২, সুইডেন ১

ব্রাজিল ১, স্কটল্যান্ড ০

কোস্তা রিকা ২, সুইডেন ১

.

গ্রুপ ৪

কলম্বিয়া ২, সং আ. আমিরশাহি ০

পঃ জার্মানি ৪, যুগোশ্লাভিয়া ১

যুগোশ্লাভিয়া ১, কলম্বিয়া ০

পঃ জার্মানি ৫, সং আ. আমিরশাহি ১

পঃ জার্মানি ১, কলম্বিয়া ১

যুগোশ্লাভিয়া ৪, সং আ. আমিরশাহি ১

.

গ্রুপ ৫

বেলজিয়াম ২, দঃ কোরিয়া ০

উরুগুয়ে ০, স্পেন ০

বেলজিয়াম ৩, উরুগুয়ে ১

স্পেন ৩, দঃ কোরিয়া ১

স্পেন ২, বেলজিয়াম ১

উরুগুয়ে ১, দঃ কোরিয়া ০

গ্রুপ ৬

ইংল্যান্ড ১, আয়ার্ল্যান্ড ১

হল্যান্ড ১, মিশর ১

ইংল্যান্ড ০, হল্যান্ড ০

আয়ার্ল্যান্ড ০, মিশর ০

ইংল্যান্ড ১, মিশর ০

আয়ার্ল্যান্ড ১, হল্যান্ড ১

দ্বিতীয় রাউন্ড (প্রি—কোয়ার্টার ফাইনাল)

ক্যামেরুন ২, কলম্বিয়া ১ (নির্ধারিত সময়ের পর ০—০)

চেকোশ্লোভাকিয়া ৪, কোস্তা রিকা ১

আর্জেন্তিনা ১, ব্রাজিল ০

পঃ জার্মানি ২, হল্যান্ড ১

ইতালি ২, উরুগুয়ে ০

আয়ার্ল্যান্ড ৫, রোমানিয়া ৪ (অতিরিক্ত সময়ের পর ০—০)

ইংল্যান্ড ১, বেলজিয়াম ০ (নির্ধারিত সময়ের পর ০—০)

স্পেন ২, যুগোশ্লাভিয়া ১

কোয়ার্টার ফাইনাল

ইতালি ১, আয়ার্ল্যান্ড ০

আর্জেন্তিনা ৩, যুগোশ্লাভিয়া ২ (অতিরিক্ত সময়ের পর ০—০)

ইংল্যান্ড ৩, ক্যামেরুন ২ (নির্ধারিত সময়ের পর ২—২)

পঃ জার্মানি ১, চেকোশ্লোভাকিয়া ০

সেমি—ফাইনাল

আর্জেন্তিনা ৫, ইতালি ৪ (অতিরিক্ত সময়ের পর ১—১)

পঃ জার্মানি ৫, ইংল্যান্ড ৪ (অতিরিক্ত সময়ের পর ১—১)

তৃতীয় স্থানের ম্যাচ

ইতালি ২, ইংল্যান্ড ১

ফাইনাল (রোম)

পঃ জার্মানি ১, আর্জেন্তিনা ০

গোলদাতা—ব্রেহমে।

পঃ জার্মানি—ইলগনার, বেরটোল্ড (রয়টার, ৭৩ মিঃ), কোহলার, আউগেনটালার, ব্রেহমে হাসলার, ম্যাটাউস, লিটবারস্কি, ক্লিনসম্যান, ফোলার।

আর্জেন্তিনা—গয়কোসিয়া, রাগেরি (মনজোন, ৪৬ মিঃ), সিমন, সেরিজুয়েলা, লোরেঞ্জো, বাসুয়াল্ডো, ত্রেগলিও, বুরুশাগা (কল্ডেরন, ৫৩ মিঃ), সেনসিনি, দিজোত্তি, মারাদোনা।

১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র

ফিফার মহাসচিব ব্ল্যাটার ১৯৯০ বিশ্বকাপ সম্পর্কে তিক্তস্বরে বলেছিলেন, ৫২ ম্যাচের গুটি তিনেক মাত্র দেখার যোগ্য হয়েছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আগে ফুটবলকে আকর্ষণীয় করার জন্য সময় নষ্ট বন্ধ করতে, গোল বৃদ্ধি করতে, খেলার গতি বাড়াতে এবং খেলাকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে খেলার নিয়মে কিছু রদবদল ঘটান হয়। হিসেব কষে দেখা গেছে ইতালিতে ৯০ মিনিটের ম্যাচ প্রকৃতপক্ষে খেলা হয়েছে গড়ে প্রতিটি ৪৬ মিনিট। বাকি সময়টা নানাভাবে নষ্ট করেছেন গোলকিপাররা বা আহত হয়ে মাঠে পড়ে থাকার ভান করে খেলোয়াড়রা। তাই ফিফা আইন সংশোধন করে ব্যাকপাস ধরতে গোলকিপারের হাতের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। দেখা গেল এই সংশোধনের ফলে খেলার সময়কাল শতকরা আটভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আহত হবার ভান করলেই ওয়ানির্ং পাবে, এই নিয়মের ফলে দেখা গেল হঠাৎই আহত খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ম্যাচে দুজন পরিবর্ত খেলোয়াড়ের বদলে তিনজন নামান যাবে, এই সংশোধনটি করা হয় ১৯৯৪ বিশ্বকাপ শুরুর সাড়ে তিনমাস আগে। তবে পরিবর্ত তিনজনের একজনকে অবশ্যই গোলকিপার হতে হবে এবং সে নামবে শুধু গোলকিপারেরই পরিবর্তে।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের জন্য চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি (এখন শুধুই জার্মানি) ও অনুষ্ঠাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র বাদে, ২২টি দল নির্বাচনের প্রাথমিক বাছাই পর্বে যোগ দেয় রেকর্ড সংখ্যক ১৪১টি দেশ। মোট ৫৮২টি প্রাথমিক পর্বের প্রথম ম্যাচটি খেলা হয় ২২ মার্চ, ১৯৯২—এ। স্যান্টো দ্যোমিঙ্গোয় এই ম্যাচে পোর্তো রিকো ২—১ হারায় দমিনিকান রিপাবলিককে। এর ১৪ মাস পর ফাইনাল পর্যায়ে প্রথম যে দেশ উত্তীর্ণ হল, তারা গতবারের বিশ্বকাপ নিষেধাজ্ঞার জন্য অংশ নিতে পারেনি। দেশটি হল মেক্সিকো। এই নিয়ে তারা দশমবার ফাইনাল পর্যায়ে উঠল।

নরওয়ে ৫৬ বছর প্রতীক্ষার পর দ্বিতীয়বার ফাইনাল পর্যায়ে উঠে এল। সুইৎজারল্যান্ড উঠল ২৮ বছর পর অথচ যোগ্যতা পর্বে যে পর্তুগীজরা তাদের ১—৬ গোলে হারিয়েছিল সেই পর্তুগাল ফাইনাল পর্যায়ে যেতে পারল না। একই ভাগ্য হল ইংল্যান্ডেরও। হল্যান্ডের কাছে যোগ্যতা পর্বে ০—২ হারার পর ফাইনালে উঠার একটাই উপায় তাদের কাছে খোলা ছিল—যদি পোল্যান্ডের কাছে হল্যান্ড হারে আর ইংল্যান্ড যদি সাত গোলের ব্যবধানে সান মারিনোকে হারাতে পারে। কিন্তু হল্যান্ড ৩—১ জিতল আর ইংল্যান্ড জিতল ৭—১। সান মারিনোর গোলটি হয় খেলার ১০ সেকেন্ডে, ৭০২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ইংল্যান্ড আগে কখনও এত দ্রুত গোল খায়নি। ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ার্ল্যান্ড ও ইংল্যান্ড যোগ্যতা পর্ব অতিক্রম করতে না পারার ১৯৫০—এর পর, এই প্রথম ফাইনাল পর্যায়ে কোন ব্রিটিশ দল রইল না। ১৯৫৮—র পর প্রথমবার হয়তো ওয়েলস ফাইনালে উঠতে পারত যদি রোমানিয়ার বিরুদ্ধে ১—১ অবস্থায় তাদের পল বোডিন পেনাল্টি নষ্ট না করতেন। ঘিয়র্ঘি হাজি ২—১ করে রোমানিয়াকে জেতান। ইওরোপের তৃতীয় গ্রুপের শেষ খেলায় স্পেনের কাছে (১৯ পয়েন্ট) ডেনমার্ক (১৮ পয়েন্ট) ০—১ হেরে যাওয়ায় ও আয়ার্ল্যান্ড (১৮ প) উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের (১৩ প) সঙ্গে ১—১ করায় গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় দল হিসাবে ফাইনালে ওঠে আয়ার্ল্যান্ড নিছকই গোল পার্থক্যের কারণে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের অনুষ্ঠাতা দেশ ফ্রান্সের এবারের যোগ্যতা পর্বেই বিদায় নেওয়াটা ঘটে বালগেরিয়া সঙ্গে শেষে খেলার শেষ মিনিটে। খেলা অমীমাংসিত রাখলেই ফ্রান্স ফাইনাল পর্যায়ে চলে যাবে এবং খেলার ফল ৮৯ মিনিট পর্যন্ত যখন ১—১ তখনই এমিল কোস্তাদিনভ ২—১ করে দেন। দলের দুটি গোলই তার। ফ্রান্স এর একমাস আগে ২—৩ হেরেছিল ইজরায়েলের কাছে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে রাশিয়াকে ১—০ হারিয়ে গ্রিস অপরাজিত থেকে শীর্ষস্থান পায়। তবে দুটি দেশই ফাইনাল পর্যায়ে ওঠে।

দুবার চাম্পিয়ন ও দুবার রানার্স আর্জেন্তিনা কোনক্রমে যোগ্যতা পর্ব থেকে উঠে আসে শেষ খেলায় অস্ট্রেলিয়াকে ১—০ হারিয়ে। তার আগে অপ্রত্যাশিত ০—৫ গোলে স্বদেশে হারে কলাম্বিয়ার কাছে। ব্রাজিলেরও প্রায় একই হাল হয়। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে গ্রুপের শেষ খেলায় অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যাওয়া ব্রাজিল স্পেনের বার্সিলোনা ক্লাব থেকে সঙ্কট মোচনের জন্য ডেকে আনে রোমারিওকে। তার দেওয়া দুটি গোলের কৃপায় ব্রাজিল ফাইনাল পর্যায়ে উঠে আসে। আফ্রিকা থেকে যোগ্যতা পাওয়া তিনটি দেশের মধ্যে প্রথমবার সফল হওয়া নাইজেরিয়া ব্রিটেনের কাছ থেকে ৩৪ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিল ফাইনাল পর্যায়ে ওঠার। তারা এখন অনূর্ধ ১৭ বছর বয়সীদের বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়ন। নাইজেরিয়া দল ”সুপার ঈগলস” নামে পরিচিত, দলের অনেকেই ইওরোপের ক্লাবগুলিতে খেলেন।

বিশ্বকাপ ফুটবলের বিষাদময় ঘটনা ঘটল ১৯৯৩—এর ২৮ এপ্রিল যখন জাম্বিয়ার ১৮ জন বিশ্বকাপ ফুটবলার বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। কিন্তু জাম্বিয়া পাঁচ মাসের মধ্যেই একটি ফুটবল দল তৈরি করে নেয় ঘরোয়া অনভিজ্ঞদের ও ইওরোপের ক্লাবে খেলা চারজন ফুটবলারকে নিয়ে। এর পর মরক্কোকে ২—১ হারিয়ে সেনেগলের সঙ্গে ০—০ ও ৪—০ জিতে এমন অবস্থায় আসে যে মরক্কোর সঙ্গে ফিরতি খেলাটি অমীমাংসিত রাখলেই ফাইনাল পর্যায়ে উঠে যাবে। কিন্তু ম্যাচটি কাসাব্লাঙ্কায় তারা ০—১ গোলে হেরে যায়। সামান্যের জন্য ব্যর্থ হওয়া জাম্বিয়া পায় বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের সমবেদনা ও অভিনন্দন।

এবারের বিশ্বকাপ যোগ্যতা পর্বে এশিয় অঞ্চলকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ২৯টি দেশ অংশ নেয়। ‘ডি’ গ্রুপে ভারতের সঙ্গে ছিল—দক্ষিণ কোরিয়া, বাহরিন, হংকং ও লেবানন। বেইরুটে গ্রুপের প্রথমার্ধের ম্যাচগুলিতে ভারত ২—২ করে লেবাননের সঙ্গে, ১—২ হারে হংকংয়ের, ১—২ হারে বাহরিনের এবং ০—৩ হারে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। সোল—এ গ্রুপের দ্বিতীয়ার্ধের ম্যাচগুলিতে ভারত ০—৩ হারে বাহরিনের, ০—৭ হারে দক্ষিণ কোরিয়ার, ১—২ হারে লেবাননের কাছে এবং ৩—১ গোলে হারায় হংকং—কে। এশিয় অঞ্চল থেকে ফাইনাল পর্যায়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে দক্ষিণ কোরিয়া এবং প্রথমবার সৌদি আরব। বলিভিয়া এবং গ্রিসও প্রথমবার ফাইনাল পর্যায়ে উঠে এল নাইজেরিয়া ও সৌদি আরবের সঙ্গে।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যায়ের ম্যাচগুলি খেলার জন্য নির্বাচিত হয় নয়টি শহর—বোস্টন, শিকাগো, ডালাস, ডেট্রয়েট, লস অ্যাঞ্জেলিস, নিউ ইয়র্ক, অরল্যান্ডো, সান ফ্রান্সিসকো এবং ওয়াশিংটন। এর মধ্যে বিস্ময়কর ডেট্রয়টের পণ্টিয়াক সিলভারডোম ইনডোর স্টেডিয়ামের নির্বাচন। ফাইবার গ্লাস দিয়ে আদ্যন্ত ঢাকা, ৭২,৭৯৪ জন দর্শক বসার এই বাতানুকূল সিন্থেটিক গ্লাসের স্টেডিয়ামে শক্ত গোড়ার ঘাস জন্মানো সম্ভব নয়। বুট পায়ে একবার ছুটলেই ঘাস উঠে যাবে। ফিফা বিশ্বকাপ নিয়মে আছে প্রাকৃতিক ঘাসের মাঠে খেলা হতে হবে। স্থানীয় সংগঠকরা জানালেন, ফিফা—র চাহিদামত মাঠ তারা তৈরি করবেন। তাদের এই প্রতিশ্রুতির পিছনে ছিল মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির তিনজন তৃণ গবেষকের দেওয়া আশ্বাস আর তাদের উপর সংগঠকদের বিশ্বাস। রৌদ্রালোকের অভাব ও অসংখ্য বাধা অতিক্রমের জন্য ক্যালিফোর্ণিয়ায় উন্মুক্ত জায়গায় ঘাসের মূল বসিয়ে তাকে পুষ্ট ও সজীব করে তুলে মিশিগানে পাঠান হয়। সেখানে সাড়ে সাত ফুট চওড়া ষড়ভুজাকার ধাতব পাত্রের উপরিভাগে ছয় ইঞ্চি মাটি রেখে সেই ঘাস রোপণ করা হয়। ১৯৯৩ জুন মাসে এখানে ইউ এস কাপ ‘ড্রেস রিহার্সাল’—এর জন্য একটি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের ব্যবস্থা হয়েছিল। খেলার কয়েকদিন আগে ধাতবপাত্রগুলি (এক একটির ওজন ৩০০০ পাউণ্ড) সিলভারডোমের মাঠে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়। খেলাটি স্বচ্ছন্দ্যে হয় এবং ঘাসের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দু সপ্তাহ ধরে চারটি বিশ্বকাপের ম্যাচ এখানে খেলা হবে, তখন মাঠটির অবস্থা কেমন হবে তা জানার জন্য ফুটবল বিশ্ব উৎসুক হয়ে থাকবে। এই সিলভারডোমেই ইউ এস কাপ ফাইনাল খেলেছে জার্মানি ও ইংল্যান্ড। জার্মান কোচ বার্টি ফোগৎস বলেছেন : মাঠটা একটা মিরাক্যাল। ফিফা জনসংযোগ কর্তা তোগনোনি বলেছেন: বিশ্বকাপ মানেরও ঊর্ধ্বে এই মাঠ। ফিফা মহাসচিব ব্ল্যাটার বলেন : ঘাসের এই জমির গুণগত মান এমনই অসাধারণ যে, তারিফ আর প্রশংসা ছাড়া আর কিছু বলার নেই।

ফাইনাল পর্যায়ের জন্য ২৪টি দলকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয় লটারির মাধ্যমে। চারটি প্লাস্টিক ভাণ্ডে প্রথমে দলগুলির নামে রঙিন ছোট ছোট বল রাখা হয়। প্রথম ভাণ্ডে ছিল ছয়টি বাছাই দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্তিনা, জার্মানি, ব্রাজিল, ইতালি ও বেলজিয়াম, দ্বিতীয়টিতে ছিল ইউরোপের ছয়টি দেশ—স্পেন, রাশিয়া, হল্যান্ড, রোমানিয়া, বালগেরিয়া ও আয়ার্ল্যান্ড। তৃতীয়টিতে ছিল আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি—মরক্কো, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো, বলিভিয়া ও কলম্বিয়া। চতুর্থটিতে ছিল অন্যান্য বহিরাগতরা—সুইডেন, সুইৎজারল্যান্ড, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও নরওয়ে।

সবাই ভেবেছিলেন অনুষ্ঠাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সহজ গ্রুপে রাখা হবে যাতে তারা দ্বিতীয় রাউণ্ডে উঠতে পারে। গত তিনটি বিশ্বকাপে সেইভাবেই গ্রুপ ভাগ করে আসা হয়েছে। গ্রুপ বিন্যাসের লটারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৩ ডিসেম্বরে লাস ভেগাসে। ১২৫ দেশের প্রায় ৫০ কোটি টি ভি দর্শক অনুষ্ঠানটি দেখেন। এই অনুষ্ঠানেই ফিফার নবপ্রবর্তিত ‘ওয়ালর্ড ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’ (১৯৯৩) নির্বাচিত হন ইতালির রোবার্তো বাজ্জিও। ফাইনাল পর্যায়ের খেলা ১৭ জুন শুরু হয়ে শেষ হবে লস অ্যাঞ্জেলিসে ১৭ জুলাই।

এইবারের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে পয়েন্ট দেওয়ার ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটান হল গতবারের রক্ষণাত্মক ও বিরক্তিকর খেলার কথা মনে রেখে। খেলাকে আক্রমণাত্মক করে তোলার ইচ্ছায় ফিফা স্থির করে প্রথম রাউণ্ডে বিজয়ী দল চিরাচরিত দুই পয়েন্টের বদলে তিন পয়েন্ট পাবে। এর ফলে রক্ষণাত্মক দলগুলির বিপদে পড়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। ছয় গ্রুপের ১২টি দলের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউণ্ডে আরও যে চারটি দল উঠবে তারা নির্বাচিত হবে গ্রুপে তৃতীয় সেরা স্থান পাওয়াদের মধ্য থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *