শিক্ষার মাধ্যম

শিক্ষার মাধ্যম

বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করার জন্যে অনেক মহল থেকেই কথাবার্তা এবং আন্দোলন হচ্ছে। এর মধ্যে ছাত্র সম্প্রদায়ের কথাই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত তারাই ছিল আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্ৰ। তাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চেতনার মধ্যেই এর সূত্রপাত এবং তাদের সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এর সাফল্য। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক অর্থে অনেকাংশে সফল হলেও সাংস্কৃতিক অর্থে তার সাফল্য যে এখনো সুদূরপরাহত একথা আজ অনেকাংশে স্বীকৃত। এজন্যেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হলেও ভাষা হিসাবে বাঙলা আজ পর্যন্ত কোন স্থানেই পূর্বাপেক্ষা অধিকতর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এমনকি শিক্ষার মাধ্যম হিসাবেও তার প্রগতি এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক জীবনের এই দৈন্য আজ অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং শিক্ষক ও ছাত্র সম্প্রদায়ের চিন্তার মধ্যেও সে দায়িত্বের চেতনা অনুপস্থিত নেই।

স্বাধীনতালাভের পর ইংরেজীকে বিদেশী ভাষা বলে একেবারে বর্জন করা সম্ভব না হলেও স্কুল পর্যায়ে ইংরেজী চর্চার ক্ষেত্রে একটা ঔদাসীন্য ক্রমাগত বৃদ্ধিলাভ করছে। এ ঔদাসীন্য যদি বাঙলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহবৃদ্ধির অনুপাতে কমে আসতো তাহলে অসুবিধা হতো না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ইংরেজীর চর্চা ভয়ানকভাবে কমে এলেও ভাষা হিসাবে বাঙলার চর্চা তেমন বৃদ্ধিলাভ করে নি। এর ফলে শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক জীবন আজ এক দারুণ দুর্দিনের সম্মুখীন হয়েছে। ইস্কুল কলেজে এখন ছাত্রদেরকে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে স্বভাবতঃই অনেক গাফলতি এবং ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজী, বাঙলা অথবা অন্য কোন ভাষার উপরই যদি ছাত্রদের একটা দখল অথবা কার্যকরী জ্ঞান না থাকে তাহলে কোন শিক্ষাই কখনো সম্পূর্ণ হতে পারে না। এবং পূর্ব পাকিস্তানে সেটা হচ্ছেও না। এর ফলে আমরা যারা শিক্ষকতা কার্যে নিযুক্ত আছি তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি যে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনায় সময় ব্যয় এবং সাধ্যমত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক সাধারণ জিনিষকেই তারা আয়ত্তের মধ্যে আনতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রথমতঃ যে বইগুলি তাদেরকে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহার করতে হয় সেগুলির অধিকাংশই ইংরেজীতে লেখা। দুর্বল ইংরেজী জ্ঞানের জন্যে এ বইগুলির মর্মোদ্ধার তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক সময় হয়তো তারা বহু পরিশ্রমের ফলে বইগুলির বিষয়বস্তুর সাথে মোটামুটিভাবে পরিচিত হয়। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে বইগুলির বক্তব্য তারা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু তারপর আর এক সমস্যা দেখা দেয়। এ সমস্যা হচ্ছে নিজেকে ব্যক্ত করার সমস্যা। ছাত্রদের এ নিয়ে মাথা ঘামাতেই হয় কারণ টিউটোরিয়াল ক্লাসে এবং পরীক্ষার খাতায় লেখার উপরই তো ছাত্রজীবনের সাফল্য প্রায় সর্বতোভাবে নির্ভরশীল।

এই লেখার ব্যাপারে তাদের দুর্দশা সহজেই লক্ষণীয়। ইংরেজী বই পড়ে তার অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝাই তাদের পক্ষে এক গুরুতর সমস্যা। কাজেই লেখার ক্ষেত্রে এ সমস্যা স্বভাবতঃই আরো ঘোরতর আকার ধারণ করে। এ কারণেই নিজের ইংরেজীতে গুছিয়ে একটা ভাবকে ব্যক্ত করার প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে একেবারেই ওঠে না। এর ফলে পরীক্ষাপাশের জন্যে তাদেরকে চক্ষুকর্ণের উপর নির্ভর করে সব কিছুই পাঠ্যপুস্তকগুলি থেকে কপি করে সরাসরি মুখস্থ করতে হয়। শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজীর সাফল্য এখন এই পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। শিক্ষার তথাকথিত মাধ্যম হিসাবে তাকে টিকিয়ে রেখেও তার উপযুক্ত চর্চার প্রতি ঔদাসীন্যের ফলে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাই রূপান্তরিত হয়েছে একটা প্রহসনে। এই অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে কোন ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বজায় রাখলেই তার মাধ্যমে শিক্ষা সন্তোষজনক হবে এমন কথা নেই। কিন্তু এর জন্যে কোন ভাষা কি বিশেষভাবে দায়ী? অর্থাৎ বর্তমানে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে যে ফাঁক দেখা যাচ্ছে সেটার জন্যে আমরা ইংরেজী ভাষাকে কতখানি দায়ী করবো?

এ প্রশ্নের আলোচনার পূর্বে সমস্যাটির অন্য একটি দিক বিবেচনা করা যেতে পারে। ইংরেজী শুধু আজকেই আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে জেঁকে বসে নি। এটা আমাদের দেশে প্রায় দেড়শো বছর ধরে প্রচলিত। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজীর যে দুরবস্থা আজ আমরা লক্ষ্য করছি সেটা এর পূর্বে ছিল না। ইংরেজী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ঔদাসীন্য এখন দেখা যাচ্ছে সে ঔদাসীন্য ইংরেজ রাজত্বে ছিল না। বিদেশী ভাষা হলেও সে সময়ে তার চর্চা এখনকার থেকে অনেক সন্তোষজনক ছিল এবং এজন্যে বিদেশী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতা-পূর্বযুগে শিক্ষাদীক্ষার সাধারণ মান এখনকার থেকে ছিল অনেক বেশী উন্নত। কাজেই যে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে ভাষা চর্চার গুরুত্ব।

এ গুরুত্ব উপলব্ধির অভাবই বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান বাধা। সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এক ভাষার পরিবর্তে অন্য একটি ভাষার উপর দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা একটি কঠিন সাধনা এবং এ সাধনায় ব্রতী হতে হবে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে কোন ভাষাকে কাগজে কলমে প্রতিষ্ঠিত করা এর তুলনায় অনেক সহজ কাজ। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবর্তী পর্যায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা সহজেই বোঝা যাবে।

বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং অফিস আদালতের ভাষা করার জন্যে প্রতি বৎসর ফেব্রুয়ারী মাসের একুশে তারিখে দেশব্যাপী আলোচনা, শপথগ্রহণ ইত্যাদি হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে বৎসরের অবশিষ্ট তিনশো চৌষট্টি দিনের কাজ-কর্মের হিসাব নিলে দেখা যাবে যে বাঙলা ভাষা আমাদের চিন্তার মধ্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঠাঁই পায় না। এমন কি ছাত্রদের মনেও না।

এর ফলে দেখা যায় যে ছাত্রছাত্রীরা বহু প্রচেষ্টার ফলে ইংরেজী পাঠ্যপুস্তকের মর্মোদ্ধার করতে কোন ক্ষেত্রে মোটামুটিভাবে সমর্থ হলেও সেটাকে নিজের ভাষাতে, ইংরেজীতে তো নয়ই, এমনকি বাঙলাতেও ব্যক্ত করতে পারে না। এই ব্যর্থতা খুবই উল্লেখযোগ্য কারণ এর মধ্যেই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাঙলাকে চালু করার অন্যতম প্রধান সমস্যা আমাদের সামনে উদ্‌ঘাটিত হয়। কোন বিষয় সম্পর্কে কিছুটা সন্তোষজনক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বক্তব্যকে বাঙলা ভাষায় ব্যক্ত করতে ছাত্রছাত্রীরা অক্ষম হলে একতা সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায় যে বাঙলা ভাষার জ্ঞান তাদের অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ এ ভাষার উপর তাদের বিশেষ কোন অধিকার নেই। পরীক্ষার মাধ্যম ইংরেজী হওয়ার ফলে অনেকে সে কথা বিবেচনা করে বাঙলাতে লেখালেখি করে সময় নষ্ট করতে চায় না একথা আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্ন যেসব ক্ষেত্রে ওঠে না সেসব ক্ষেত্রে ছাত্রদেরকে বাঙলায় লেখা সুযোগ দিলেও তারা সে সুযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করে না এবং ব্যবহার করলেও তার মধ্যে উৎসাহের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে নানা অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে দে ছাত্রেরা বাঙলা ভাষা নিয়ে যতই আন্দোলন এবং দাবী দাওয়া উপস্থিত করুক বাঙলা ভাষা তারা উপযুক্তবাবে আর শিখছে না। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজীকে রাখার ফরে এটা ঘটছে একথা বললে সমস্যাটির যথার্থ বিশ্লেষণ হবে না। কারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজী উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করলেও নিম্নস্তরে বাঙলা শেখার পক্ষে সেটা প্রতিবন্ধক নয়। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত এখন ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্ত কিছু বাঙলার মাধ্যমে সম্পন্ন করার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজীর দ্বারা তারা সত্র অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। তারা এ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঙলা না জানার ফলে, বাঙলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে নিদারুণ ঔদাসীন্য এবং কতকগুলি আত্মঘাতী নীতি অবলম্বনের ফলে। এই ঔদাসীন্য এবং আত্মঘাতী নীতিগুলিই আজ এদেশে বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং শিক্ষার অন্যান্য পর্যায়ে চালু করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান বাধা। এই বাধাগুলির গুরুত্ব যতদিন পর্যন্ত না আমরা যথোপযুক্তভাবে উপলব্ধি করবো ততদিন ইংরেজী শিক্ষার গাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে আমরা মাতৃভাষার উন্নতির জন্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও সে উন্নতির ক্ষেত্রে কোন অর্থেই সহায়ক হবো না।

কিন্তু ছাত্রেরা বর্তমান অবস্থায় ভালভাবে বাঙলা শিখতে সক্ষম হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণকালে একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা আমাদের সামনে ধীরে ধীরে উদ্ঘাটিত হবে। এবং আমরা সহজেই দেখতে পাবো যে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এ দেশের অগণিত জনসাধারণ এবং বিশেষ করে ছাত্র সম্প্রদায় রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্রে বিজয় – গৌরব অর্জন করলেও বৃহত্তর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবনে সে গৌরবকে খর্ব করার জন্যে এক সামগ্রিক প্রচেষ্টা তার সুদূরপ্রসারী জাল বিস্তার করেছে।

শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাঙলাকে শেষ পর্যন্ত তার উপযুক্ত স্থান দিতে হবে একথা স্বীকার করেও শিক্ষাব্যবস্থাকে মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত করার পরিকল্পনা কিছুদিন পূর্বেই নেওয়া হয়েছিল। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমেই বস্তুতঃ এই প্রস্তাব উপস্থিত করা হয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে উচ্চমাধ্যমিক ইস্কুলগুলি এখন প্রচলিত আছে সেগুলি ছাড়াও ক্যাডেট কলেজে ইংরেজীর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের পর বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারী প্রচেষ্টা অত্যন্ত নগণ্য। কিন্তু ক্যাডেট কলেজগুলিতে ইংরেজীর মাধ্যমে শিক্ষা চালু রাকার প্রস্তাব গৃহীত হবার পর বহু ব্যয়সাধ্য হলেও সে কলেজগুলি স্থাপিত হতে সময় লাগেনি। শুধু তাই নয়। এ ধরনের দুই-একটি কলেজ স্থাপিত হওয়ার অল্পকাল পরই এগুলির সাফল্য এবং প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে ক্ষমতাশীল মহল থেকে অনেক বক্তৃতা হয়েছে এবং এ ধরনের কলেজ যাতে দেশের প্রতিটি জেলায় স্থাপিত হয় তার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা চলেছে। অন্যদিকে সারা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলার মাধ্যমে যে সমস্ত বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষা দেওয়া হয় সেগুলির অবস্থা এখন রীতিমতো শোচনয়ি। প্রতি বছর হয়তো অল্পকিছু টাকা এই সমস্ত ইস্কুল কলেজ খাতে আগের থেকে বেশী খরচ হচ্ছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলির সংখ্যা-বৃদ্ধির তুলনায় এই সরকারী ব্যয়ের দ্বারা অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। এর ফলে বাঙলা মাধ্যমিক ইস্কুল কলেজগুলিতে উপযুক্ত শিক্ষক, বইপত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষের অভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি ঘটছে। ছাত্র-ছাত্রীরা এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলিতে শুধু যে ইংরেজী অথবা বাঙলা ভাষা উপযুক্তভাবে শিখতে পারছে না তা নয়। বাস্তবতঃ তারা সেখানে কোন কিছুই ভালভাবে শিখছে না। এর ফলে এ দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা আজ সম্মুখীন হয়েছে এক দারুণ বিপর্যয়ের।

বিত্তবান ও প্রভাবশালী বাঙালীরা এ নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। কারণ নিজেদের পুত্রকন্যাদেরকে বিত্ত এবং অভাবের জোরে ইংরেজী মাধ্যমিক ইস্কুল এবং ক্যাডেট কলেজগুলিতে পড়িয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপযোগী শিক্ষাদানের কথা ভেবে তাঁরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। এসব কারণে আজ দেখা যাচ্ছে যে বাঙলা ভাষার জন্যে যে সমস্ত নেতারা পথে-ঘাটে অনেক বক্তৃতা করে বেড়ান তাঁরাও নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকে তথাকথিত ভাল শিক্ষা দেওয়ার জন্যে সেই সব প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন যেগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজী। শুধু তাই নয়। এ ধরনের বহু ইস্কুলে অনেকক্ষেত্রে বাঙলা শিক্ষা দেওয়া হয় না এবং এর ফলে এই সমস্ত ছেলেমেয়েরা বাঙলা শেখেও না। আশ্চর্য মনে হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ঢাকার নবোত্থিত অনেক উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালীদের ঘরে এখন বাঙলার পরিবর্তে ইংরেজীতে ছেলে- মেয়েদের সাথে কথা বলা একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এ বিষয়ে তাঁদের গর্বের শেষ নেই।

ক্যাডেট কলেজগুলিতে প্রতিষ্ঠা এবং প্রসার থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানের বুকে বিত্তশালী এবং বিত্তহীন ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দানের জন্যে দুই জাতীয় পরিকল্পনা কার্যকরী হতে চলেছে। এই ক্যাডেট কলেজগুলি অনেকটা বিলেতী পাবলিক ইস্কুলগুলির মতো, যেখানে অর্থ এবং পারিবারিক প্রতিপত্তির জোরে কিছু-সংখ্যক ছাত্রেরা বিশেষ ধরনের আদবকায়দা শিখে অন্য ধরনের অর্থাৎ বাঙলা মাধ্যমে পড়া ছাত্রদেরকে ঘৃণা করতে শিখবে। শুধু তাই নয়। তুলনামূলকভাবে ভালো শিক্ষকদের কাছে পড়াশুনা করে এবং অন্যান্য অনেক সুবিধা লাভ করে তারা ব্যবসা বাণিজ্য চাকরী বাকরীতে ভাল অবস্থায় এবং উচ্চপদে বহাল হয়ে সারা দেশময় রাজত্ব করবে।

কাজেই বাঙলাকে সত্য অর্থে একটি জাতীয় ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করার সুসংগঠিত প্রচেষ্টার অভাবই যে শুধু আছে তাই নয়। সে প্রচেষ্টা যদি কোন মহল থেকে করা হয় তাহলে তাকে বিচিত্র উপায়ে বানচাল করার ব্যবস্থাও বজায় আছে। এ ব্যবস্থাগুলির মধ্যে বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের সাথে পূর্ব পাকিস্তানীদের যোগকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা আবার সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক। ইংরেজী শিক্ষিত ব্যক্তি এবং ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজীতে কোন বিষয় পড়ে বোঝার পর বাঙলায় নিজেদের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে অক্ষম হওয়ার এটা একটা অন্যতম প্রধান কারণ। সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে ইচ্ছা এবং প্রয়োজনমত রস সংগ্রহ করার শিক্ষা এবং স্বাধীনতা যদি প্রাথমিক পর্যায় থেকে ছাত্রদেরকে দান করা না হয় তাহলে শুধু বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ ভালভাবে তাদেরকে শেখালেও বাঙলা ভাষা তাদের আয়ত্তের মধ্যে কিছুতেই আসবে না। আজকাল ইস্কুলে ব্যাকরণ চর্চা নেই বললেই চলে কিন্তু সেটা কোন কোন ক্ষেত্রে থাকলেও উপযুক্ত সাহিত্যচর্চার অভাবে শিক্ষা সেখানে কিছুতেই সন্তোষজনক হয় না।

পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা নীতি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চাকে আজ এক শোচনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। এ দেশের অধিবাসীরা অধিকাংশই মুসলমান এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি তাদের অনুরাগ কম বেশী যাই হোক না কেন এখানকার সাহিত্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ চিত্র এবং চিন্তা অনুভূতিই নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত ও চিত্রিত হবে। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে সত্য। কাজেই এ বিষয়ে আইন পাশ করা অথবা বেআইনীভাবে এবং নানা কৌশলে চাপ দেওয়ার চেষ্টা নিতান্তই নিরর্থক। কিন্তু সাহিত্যসৃষ্টির দিক থেকে এ জাতীয় প্রচেষ্টা নিরর্থক হলেও তাকে বজায় রাখা হয়েছে। এবং সেটা প্রায় সর্বাংশে রাজনৈতিক কারণবশতঃ। এজন্যেই আজ বলা হচ্ছে যে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র কাজেই এদেশের সব কিছুই হতে হবে ধর্মভিত্তিক অর্থাৎ আসলে সাম্প্রদায়িক।

এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে চেষ্টা হয় এক ভাষাকে হিন্দু এবং অন্য ভাষাকে মুসলমান আখ্যা দেওয়ার। এর ফলেই হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখাকে বিধর্মী জ্ঞানে অবজ্ঞা এবং বর্জন করার নীতির দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে শিক্ষানীতি হয় বিশেষভাবে চিহ্নিত। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে বাঙলাদেশের মুসলমানরা যে সমস্ত স্বধর্মীদের সাহিত্য নিয়ে গর্ববোধ করেন, যেমন মীর মশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, ওয়াজেদ আলী, কাজী ইমদাদুল হক, এমনকি আকরম খাঁ পর্যন্ত, তাঁরা সকলেই তথাকথিত হিন্দু সাহিত্যকে প্রগাঢ় নিষ্ঠার সাথে পাঠ করেছিলেন এবং এ নিষ্ঠার ফলেই তাঁরা যথেষ্ট দক্ষতার সাথে শুধু তৎসম শব্দ নয়, প্রচুর আরবী ফারসী এবং অন্যান্য বিদেশী শব্দের ব্যবহার দ্বারা সক্ষম হয়েছিলেন সৃষ্টিশীল সাহিত্যের এমনকি সার্থক ধর্মীয় সাহিত্যের জন্ম দান করতে। মীর মশাররফ হোসেনের গদ্যরীতিকে বঙ্কিমী ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না, যেমন চলে না মৌলানা আকরম খাঁর গদ্য রীতিকেও। কিন্তু গদ্যরীতির দিক থেকে তাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বারা প্রভাবিত বলে তাঁদের লেখার দ্বারা বাঙলা দেশের মুসলমানদের ধর্মনাশ হয়েছে অথবা ঐতিহ্য বিপন্ন হয়েছে একথা কোন যোগ্য ব্যক্তিই স্বীকার করবেন না।

আরবী ফারসী শব্দ ব্যবহারে কাজী নজরুল ইসলাম যে শিল্পীসুলভ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তাকে উত্তীর্ণ হওয়ার আজ পর্যন্ত কারো পক্ষে সম্ভব হয় নি। নজরুল ইসলাম ‘মুসলমান’ কবি হিসাবে ‘হিন্দু সাহিত্যের চর্চা থেকে বিরত হওয়ার ফলে কি এই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন? অথবা এ দক্ষতা তাঁর এসেছিল সামগ্রিকভাবে বাঙলা সাহিত্য এবং নিজের সমাজের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে? নজরুল ইসলাম সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিফহাল তাঁরাই এ প্রশ্নের জবাব দেবেন।

পূর্বসূরীদের কথা এখানে উল্লেখ করার কারণ হলো তাঁদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের নোতুন পুরুষদের ঐতিহ্যগত শিক্ষা ও সৃষ্টিশীলতার তুলনা করা। বর্তমানে এ দেশের দু-চারজন ভালো কবি সাহিত্যিক আজ পর্যন্ত যে নানা বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আংশিক সার্থকতার সাথে সাহিত্যচর্চা করতে পারছেন তার কারণ এঁদের শিক্ষাকাল পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের সাথে মুসলমানদের বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রচেষ্টা হয় নি অথবা হলেও তা কার্যকরী হয় নি। এজন্যে তথাকথিত হিন্দু সাহিত্যের সাথে এঁদেরও যথেষ্ট পরিচয় আছে। এমনকি আরবী ফারসী শব্দ নিয়ে মাতা-মাতি এবং কৃত্রিমভাবে কবিতার মধ্যে এ সমস্ত শব্দের প্রয়োগ চেষ্টার দ্বারা নিজের সৃষ্টিশীলতাকে অনেকখানি খর্ব করলেও ফররুখ আহমদের মতো কবিও যে এক সময় কিছু ভালো এবং বিশিষ্ট কবিতা লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন এটাই তার অন্যতম প্ৰধান কারণ। কিন্তু তথাকথিত হিন্দু সাহিত্যের সাথে নিজেদের পরিচয় থাকলেও সে পরিচয়ের দ্বার বর্তমানে ছাত্রছাত্রীদের সামনে রুদ্ধ করার জন্যে অনেকে আজ সচেষ্ট। এই প্রচেষ্টার দ্বারা তাঁরা এদেশের নোতুন পুরুষদের ভাষা ও সাহিত্যজ্ঞানকে যে ভাবে পঙ্গু এবং সীমাবদ্ধ করে চলেছেন তার ফলাফল আমরা এখন সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি।

বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে সার্থকভাবে চালু করার জন্যে দরকার হাজার হাজার বই বাঙলায় লেখা এবং বিদেশী ভাষা থেকে অনুবাদকার্যকে দ্রুতগতিতে অব্যাহত রাখা এজন্যে আবার প্রয়োজন অসংখ্য সাহিত্যকর্মীর এবং বাঙলা ভাষায় দক্ষ ব্যক্তির। এই সাহিত্যকর্মী এবং ভাষাজ্ঞানীরা এদেশে যত অধিক সংখ্যায় সৃষ্টি হতে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য ততই সমৃদ্ধ হবে এবং বাঙলা ভাষায় উপযুক্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাদান ততই হবে ত্বরান্বিত। কিন্তু যে ভাষা ও শিক্ষানীতি বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে অনুসৃত তার মাধ্যমে এ কাজ সম্ভব নয়। সে জন্যে প্রয়োজন এই ভ্রান্ত নীতিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা এবং রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বর্জিত সমাজ ও জাতীয় চেতনার উপর আমাদের ভাষা সাহিত্য এবং শিক্ষানীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *