বাঙালী সংস্কৃতির সংকট

বাঙালী সংস্কৃতির সংকট

বাঙ্গালীত্ব এবং মুসলমানত্বের মধ্যে বিরোধের কল্পনা সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতাসৃষ্ট। ঊনিশ ও বিশ শতকে সমগ্র ভারতবর্ষে, বিশেষতঃ বাঙলাদেশে, সম্প্রদায়গত বিরোধ যত তিক্ত এবং তীব্র হলো, মুসলমানরা অর্থাৎ মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা ততই সরে আসার চেষ্টা করলো বাঙলার সংস্কৃতি থেকে। তাদের কাছে বাঙলার সংস্কৃতি মনে হলো বিধর্মী, কাজেই বিজাতীয়। বাঙলা দেশের হিন্দুরা যেহেতু নিঃসন্দেহে বাঙালী এবং মুসলমানেরা যেহেতু হিন্দুর থেকে পৃথক কাজেই তাদের বাঙালী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারে না। সে পরিচয় দিতে সক্ষম হলে বাঙলা দেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ কখনও খুব বেশী তীব্র আকার ধারণ করতো না। হিন্দু-মুসলমান সকলেই নিজেদেরকে সমভাবে বাঙালী মনে করলে ধর্মীয় বিরোধের গুরুত্ব অনেকখানি কমে আসতো। কিন্তু সেটা না হয়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ গুরুতর আকার ধারণ করলো এবং তার ফলে মুসলমানেরা বাঙালী বলে নিজেদের পরিচয় দিতে শুধু দ্বিধা এবং সঙ্কোচই নয়, অনেকক্ষেত্রে ঘৃণাও বোধ করলো। কারণ তাদের মতে বাঙালী সংস্কৃতির মধ্যে হিন্দু ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল, কাজেই বাঙালী সংস্কৃতির দ্বারা তাদের মুসলমানত্ব খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা।

বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে এ চিন্তাধারা আজ নোতুন নয়। এর উৎপত্তি মোটামুটিভাবে ঊনিশ শতকের ইংরেজ রাজত্বকালে। এ সময় তিনটি সংস্কৃতির ধারা বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিকে গঠন করতে শুরু করে। এদের প্রথমটি দেশজ, দ্বিতীয়টি ইসলাম ধর্ম ও সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্য-উদ্ভূত এবং তৃতীয়টি পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। ঊনিশ শতকে হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে দেশজ এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যোগাযোগ স্থাপনের ফলে সৃষ্টি হয় অনেক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের, যেগুলির দ্বারা বাঙলার সংস্কৃতি হয়ে ওঠে অনেক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়।

মুসলমানদের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য প্রভাব কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার ক্ষেত্রে তেমন কার্যকরী অথবা সুফলপ্রসূ হলো না। এর প্রধান কারণ একদিকে তাদের ইংরেজ বিদ্বেষ এবং অন্যদিকে হিন্দুদের প্রতি বিরূপতা। মুসলমান নবাব বাদশা এবং আমীর ওমরাহদের পতনের পর অভিজাত এবং উচ্চবিত্ত বাঙালী মুসলমান সমাজের মধ্যে এ সময় ক্ষয়িষ্ণুতার লক্ষণ দেখা দেয়। এর ফলে তারা হয়ে ওঠে একদিকে ইংরেজ এবং অন্যদিকে – হিন্দু বিদ্বেষী। ইংরেজ বিদ্বেষের ফলে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার প্রতি অনেক ক্ষেত্রে হয় বিরূপ মনোভাবসম্পন্ন। আবার হিন্দু বিদ্বেষের ফলে তারা ভারতীয় সংস্কৃতি এবং বাঙলার সংস্কৃতি থেকেও নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। পাশ্চাত্য এবং বাঙালী সংস্কৃতিকে প্রায় অস্বীকার করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা গঠন করতে উদ্যত হয় তাদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। এ প্রচেষ্টা যে কৃত্রিম এবং অস্বাভাবিক সেটা তার ব্যর্থতার দ্বারাই অনেকাংশে প্রমাণিত হয়।

অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে হিন্দুদের থেকে নিজেদেরকে পৃথক করে দেখার চেষ্টার মধ্যেই ‘আমরা বাঙালী না মুসলমান?’ এ প্রশ্নের উদ্ভব এবং সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যেই এ চিন্তাধারার বিকাশ।

দুই

‘আমরা বাঙালী না মুসলমান?’ এ প্রশ্ন বাঙলাদেশের মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মনকে কিছুদিন থেকে আলোড়িত করে এলেও আজ সেটা আবার অল্পসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনে নোতুন করে দেখা দিয়েছে। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে আমরা বাঙালী, না মুসলমান, না পাকিস্তানী? – এ প্রশ্ন তত্ত্বগতভাবে মোটেই অর্থপূর্ণ নয়। অর্থাৎ সোজা কথায় এটা নিতান্তই একটা অর্থহীন প্রশ্ন।

প্রশ্নটির যথার্থ চরিত্রকে বোঝার জন্য অন্য কতকগুলি প্রশ্নের সাথে তার তুলনা এবং সাদৃশ্য বিচার করা প্রয়োজন। কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কি বাঙ্গালী, না মৎস্যভোজী, না সঙ্গীতামোদী, না বিশ্বশান্তিকামী?’ তাহলে প্রশ্নকারীকে অনেকেই অস্বচ্ছ চিন্তা করার দায়ে অভিযুক্ত করবেন। এবং সে অভিযোগ ন্যায়সঙ্গতই হবে। কারণ এটা বোঝার কোন অসুবিধা নেই যে একজন বাঙালীর পক্ষে মৎস্যভোজী, সঙ্গীতামোদী এবং বিশ্বশান্তিকামী হওয়ার পথে কোন বাধা বিপত্তি নেই। এজন্য অর্থপূর্ণভাবে একজনকে মৎস্যভোজী, সঙ্গীতামোদী, বিশ্বশান্তিকামী বাঙালী হিসাবে বর্ণনা করা সম্ভব। অর্থাৎ মৎস্যভোজন, সঙ্গীত-শ্রবণ এবং বিশ্বশান্তিকামনার দ্বারা তাঁর বাঙালীত্ব খর্ব হয় না। এটা হয় না তার কারণ এ কাজগুলির মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব অথবা বিরোধ নেই। এদের একটির জন্য অন্যদিকে তাই বর্জন করার প্রয়োজন হয় না। ‘আমরা বাঙালী, না মুসলমান, না পাকিস্তানী?’ এই প্রশ্নের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বলা যেতে পারে।

অপর এক জাতীয় প্রশ্নের সাথে এ প্রশ্নটির তুলনা করলে এ বিষয়ে বক্তব্য আরও কিছু স্পষ্ট হবে। কোন ব্যক্তি যদি প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কি হিন্দু, না মুসলমান’ না খৃষ্টান, না অন্য কিছু?’ তাহলে সে প্রশ্নের জবাব হবে একটি : হিন্দু অথবা মুসলমান অথবা খৃষ্টান অথবা অন্য কিছু। কিন্তু এর জবাবে একথা বলা চলে না যে আমরা হিন্দু – মুসলমান — খৃষ্টান। কেউ সে রকম জবাব দিলে সেটা অর্থবোধক হয় না। কারণ কোন ব্যক্তি একই সাথে হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান হতে পারেন না। তিনি হিন্দু হলে তাঁর পক্ষে মুসলমান অথবা খৃষ্টান হওয়া সম্ভব নয়। আবার মুসলমান হলে তিনি হিন্দু অথবা খৃষ্টান হতে পারেন না। এগুলি বিভিন্ন ধর্মমত, কাজেই এক্ষেত্রে এক মত পোষণ করলে অন্য মতকে বর্জন এবং পরিত্যাগ করতেই হবে। কাজেই ‘আমরা হিন্দু, না মুসলমান, না খৃষ্টান?’ এ প্রশ্নের একটা সোজাসুজি উত্তর পাওয়া সম্ভব এবং সে উত্তর দান কালে একটিকে বেছে নিয়ে অন্যগুলিকে বর্জন না করলে প্রশ্নটির কোন যথার্থ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।

উপরের প্রশ্ন বিচার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ‘আমরা কি বাঙালী, না মুসলমান, না পাকিস্তানী?’ এ প্রশ্নটির সাথে ‘আমরা কি মুসলমান, না হিন্দু, না খৃষ্টান?’ এ প্রশ্নের চরিত্রগত প্রভেদ আছে। প্রথমোক্ত প্রশ্নটি সত্যঅর্থে প্রশ্নই নয়। কারণ তার মধ্যে ‘বাঙালী’, ‘মুসলমান’ এবং ‘পাকিস্তানী’ এই তিনটি শব্দকে পরস্পরবিরোধী হিসাবে ব্যবহার করা হলেও আসলে সেগুলি মোটেই পরস্পরবিরোধী নয়। বাঙালী, মুসলমান এবং পাকিস্তানীর মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত বিরোধ অথবা দ্বন্দ্ব সেই অর্থাৎ একই ব্যক্তি পাকিস্তানী বাঙালী মুসলমান হিসাবে নিজের পরিচয় স্বাচ্ছন্দে এবং অর্থপূর্ণভাবে দিতে পারেন। এটা পারেন বলেই ‘আমরা বাঙালী, না মুসলমান, না পাকিস্তানী?’ এ প্রশ্ন অর্থহীন, যেমন অর্থহীন ‘আমরা কি বাঙালী, না মৎস্যভোজী, না সঙ্গীতামোদী, না বিশ্বশান্তিকামী?’ এ প্রশ্ন।

উপরে দুই জাতীয় প্রশ্নের মৌলিক চরিত্রগত প্রভেদ থাকলেও ‘আমরা বাঙালী, না মুসলমান, না পাকিস্তানী?’ এ প্রশ্নটি করার সময় প্রশ্নকারীরা ধরে নেন যে তাঁদের প্রশ্নের অন্তর্গত শব্দগুলির অর্থ পরস্পরবিরোধী, কাজেই একটিকে গ্রহণ করলে অন্যগুলিকে বর্জন না করে সেটা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ তাঁরা মনে করেন বাঙালী হলে মুসলমান অথবা পাকিস্তানী হওয়া চলে না। এই ভুল ধারণা নিয়ে শুরু করার ফলে তাঁদের সমস্ত চিন্তা এবং যুক্তিই ভুল পথে চালিত হয়।

তিন

কিন্তু বাঙালী বলতে কাদেরকে বোঝায়? এর উত্তর খুবই সহজ। বাঙলা দেশের যে – কোন অংশে যারা মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাঙলা ভাষায় কথা বলে, বাঙলা দেশের আর্থিক জীবনে অংশগ্রহণ করে এবং বাঙলার ঐতিহ্যকে নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে, তারাই বাঙালী। কাজেই কে কোন্ ধর্মাবলম্বী সে প্রশ্ন এক্ষেত্রে খুব বেশী প্রাসঙ্গিক নয়। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান যে-কোন ধর্মাবলম্বী লোকই যদি বাঙলাদেশে বসবাস করে, বাঙলায় কথা বলে, বাঙলার আর্থিক জীবনে অংশ গ্রহণ করে এবং বাঙলার ঐতিহ্যকে সাধারণভাবে নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে তাদের তাকে বাঙালী বলার অথবা তার নিজের পক্ষ থেকে বাঙালী হিসাবে পরিচিত হওয়ার কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু একথাও আবার অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাঙলাদেশের মুসলমানেরা অনেকক্ষেত্রে নিজেদেরকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা এবং সঙ্কোচ বোধ করেন। এই দ্বিধা এবং সঙ্কোচের উৎপত্তি সাম্প্রদায়িকতায়। সাম্প্রদায়িকতার জন্যই বাঙলার সাধারণ সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক মুসলমানেরা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বলে স্বীকার করতে সহজে প্রস্তুত হন না।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে একথা সত্য ছিল এবং এখনও পূর্ব বাঙলার অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানের মনে এ সংশয় এবং প্রশ্ন রীতিমতো জাগ্রত। তাঁদের ধারণা আমরা বাঙালী বলে নিজেদের পরিচয় দিলে হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয় ইসলাম – বিরোধিতা করে বসবো। এ ধারণা যে কত ভ্রান্ত সেটা অন্যান্য দেশ এবং জাতির ইতিহাসের কতা স্মরণ করলে সহজেই বোঝা যাবে।

চার

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানী দ্বিধাবিভক্ত হয়। ফলে তার পূর্ব অংশ হয় কম্যুনিস্ট এবং পশ্চিম অংশ হয় পশ্চিমী গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই জার্মানীর এই দুই অংশভুক্ত রাষ্ট্রদ্বয়ের দর্শন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। শুধু তাই নয়। তারা বিশেষ অর্থে পরস্পরবিরোধী। কিন্তু পরস্পরবিরোধী জীবনদর্শনের জন্যে তাদের এক অংশ নিজেকে জার্মান এবং অপর অংশ নিজেকে অ-জার্মান বলে মনে করে না। তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রভুক্ত হলেও জার্মানীর বিভিন্ন অংশের অধিবাসী, জার্মান ভাষায় তারা কথা বলে এবং জার্মানীর ঐতিহ্যকে নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে। এ ক্ষেত্রে উভয় অংশের আর্থিক জীবন স্বতন্ত্র হলেও তাদের পক্ষে নিজেদেরকে জার্মান বলে পরিচয় দেওয়ার কোন অসুবিধা হয় না। কম্যুনিস্ট পূর্ব জার্মানীর সরকার অথবা লোকেরা একথা ভাবে না যে পূর্ববর্তীকালে যাঁরা জার্মান সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন তাঁরা কম্যুনিস্ট ছিলেন না, ছিলেন বুর্জোয়া শ্ৰেণীভুক্ত কাজেই তাঁদের সৃষ্টিকার্য বর্তমান পূর্ব জার্মানীর ঐতিহ্যের অন্তর্গত নয়। উপরন্তু তারা পূর্ববর্তীদের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত জার্মানীর ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসাৎ করে এক নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে আজ সচেষ্ট। জার্মানীর সাথে বাঙলা দেশের তুলনা সেদিক দিয়ে অনেকখানি প্রাসঙ্গিক। কারণ বাঙলাদেশও বিভক্ত হয়ে দুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এই দুই অংশের অধিকাংশ অধিবাসীদের ধর্মও স্বতন্ত্র। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর অধিবাসীরা যে ভয় কোন সময়েই করে না সেই ভয়ে আমরা অহরহ আড়ষ্ট এবং আতঙ্কিত। পূর্ব-পাকিস্তানী মধ্যবিত্ত মুসলমানদের অনেকের ধারণা যে বাঙালী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিলে ধর্মনাশ হবে, তাদের রাষ্ট্রের বুনিয়াদ শিথিল হবে। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে ভারসাম্যের এই অভাবই তাদের সৃষ্টিহীনতার জন্যে অনেকাংশে দায়ী। এ কারণেই তারা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হতবুদ্ধিতা উত্তীর্ণ হয়ে দিক নির্ণয় করতে আজ পর্যন্ত সমর্থ হয় নি।

পাঁচ

শুধু জার্মানী নয়, পৃথিবীর অপরাপর বহু দেশই সাম্রাজ্যবাদের মহিমার দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে এবং তাদের দুই অংশের মধ্যে আর্থিক জীবন এবং সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য যথেষ্ট I কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা উভয়পক্ষই নিজেদেরকে আইরিশ, ভিয়েত্নামী, কোরীয় ইত্যাদি বলে পরিচয় দিতে কোন প্রকার দ্বিধা অথবা সঙ্কোচ বোধ করে না। শুধু তারাই নয়। বাঙলা দেশের মত পাঞ্জাব প্রদেশও দেশবিভাগের সময় দুই ভাগে বিভক্ত হয় এবং তার এক অংশ হয় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তানী পাঞ্জাবের অধিবাসীরা পাঞ্জাবী বলে নিজেদের পরিচয় দিতে কোন প্রকার সঙ্কোচ অথবা দ্বিধাবোধ করে এর প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের অধিবাসীরা সকলেই দুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবী হিসাবে পরিচিত এবং তাদের এই পরিচয় দানের ফলে তাদের ধর্মনাশ হচ্ছে আর তারা রাষ্ট্রের বুনিয়াদ ধ্বংস করছে এ অভিযোগ কেউ করছে না। এ বাধা-নিষেধ এবং চিন্তার বিকৃতি একমাত্র বাঙালীদের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে এবং এর জন্যে বাঙালীরা নিজেরাই বহুলাংশে দায়ী। শত শত বছর ধরে একই দেশে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের পক্ষে সেই দেশ এবং তার ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার প্রচেষ্টা ‘বাঙালী মুসলমান’ ছাড়া অন্য কেউ কখনো করেছে অথবা করার চেষ্টা পর্যন্ত করেছে তার কোন উদাহরণ নেই। এটাই অন্যতম কারণ যার জন্যে বাঙালী মুসলমানেরা আজ পর্যন্ত নিজেদের সঠিক পরিচয় নির্ধারণ করতে সক্ষম হয় নি এবং তার ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা উল্লেখযোগ্য কোন সৃষ্টি করতেও সমর্থ হয় নি।

ইংরেজী ভাষাভাষী লোকেরা-হোক তারা ইংরেজী, আমেরিকান, ক্যানাডীয়ান, অষ্ট্রেলিয়ান বা অন্য কিছু – যে এক সাধারণ সাংস্কৃতিক ধারার অন্তর্গত একথা তারা অস্বীকার করে না। শুধু তাই নয়। এই স্বীকৃতির দ্বারা তারা যে নিজেদের রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে এ চিন্তা তাদের মনেও আসে না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কেউ যদি বলে যে আমরা পূর্ব এবং পশ্চিম বাঙলার বাঙলা ভাষাভাষী লোকেরা সাধারণভাবে একই সাংস্কৃতিক ধারার এবং ঐতিহ্যের অন্তর্গত তাহলে তখনই অনেকের মনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রশ্ন ওঠে। তারা তৎক্ষণাৎ মনে করে যে এই স্বীকারোক্তি দ্বারা আমরা ইসলাম এবং পাকিস্তানকে অস্বীকার এবং ধ্বংস করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সঙ্গীতচর্চার জন্যে মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ করার যে কোন প্রয়োজন নেই একথা তাদেরকে বোঝাবে কে?

ছয়

বাঙালী মুসলমানেরা বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র এমনকি মাইকেল রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত নিজেদের তথাকথিত ঐতিহ্য থেকে বাদ দেওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁদের ধারণা বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ যে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক সে সংস্কৃতি শুধুমাত্র হিন্দু সংস্কৃতি, কাজেই মুসলমানদের পক্ষে বর্জনীয়। এ উন্মত্ততার উদাহরণ অন্য কোন দেশের ইতিহাসে পাওয়া মুস্কিল। টলষ্টয় একজন বিশ্বাসী খৃষ্টান ছিলেন এবং তাঁর গল্প উপন্যাস এবং অন্যান্য লেখার মাধ্যমে তিনি খৃষ্টধর্মের বাণীই প্রচার করেছেন। বিপ্লবের পর কিন্তু তাঁর খৃষ্টধর্মপ্রীতির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ধর্ম বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মত একজন সৃষ্টিশীল লেখককে বর্জন করেনি। উপরন্তু তাঁকে উপযুক্ত সম্মানের সাথে স্বীকার করে নিয়ে তারা নোতুনভাবে নির্মাণ করেছে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভিত্তি। টলষ্টয়কে সোভিয়েট ইউনিয়ন এই স্বীকৃতিদানের প্রধান কারণ তিনি অত্যন্ত উঁচু দরের সৃষ্টিশীল রাশিয়ান লেখক। তাঁকে এবং তাঁর মত অপরাপর শিল্পীদেরকে বাদ দিয়ে রাশিয়ান সংস্কৃতির কথা চিন্তা করলে সে চিন্তা নিতান্তই অক্ষম হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়। বিপ্লবপূর্ব যুগের শিল্পী সাহিত্যিকেরা বিপ্লবের দর্শনে বিশ্বাসী নন এই অজুহাতে যদি তাদেরকে বর্জন করা হতো তাহলে রাশিয়ান সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে যা কিছু সৃষ্টিশীল এবং মহৎ সেগুলিই বাদ পড়তো এবং তার ফলে সমসাময়িক রাশিয়ান সংস্কৃতির দারিদ্র্য উৎকট আকার ধারণ করতো। রাশিয়ান শিল্পী সাহিত্যিকদের অনেক সময় সরকার সমাজবিরোধী ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছে কিন্তু রাশিয়ান হওয়ার জন্যে তাদেরকে কখনো শাস্তি পেতে হয় নি।

আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা এই সত্যকে যতদিন পর্যন্ত না যথার্থভাবে উপলব্ধি করবো অর্থাৎ যতদিন না আমরা চণ্ডীদাস, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, অবনীন্দ্রনাথ প্রভৃতিকে নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হিসাবে গণ্য এবং স্বীকার করতে শিখবো ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে সৃষ্টির গতিবেগ সঞ্চার করতে আমরা সমর্থ হবো না। আমাদের চারিধারে নানাপ্রকার কৃত্রিম বাধার দেওয়াল তুলে আমরা নিশ্চল ডোবার পানিতেই শুধু অবগাহন করবো। এর বেশী অন্য কিছু সংস্কৃতিক্ষেত্রে আমাদের দ্বারা আর সম্ভব হবে না।

সাত

পূর্ব পাকিস্তান কৃষিপ্রধান দেশ, সে জন্যে নগরবাসী মধ্যবিত্তের সংখ্যা এখানে অনুপাতে অনেক কম। কিন্তু বাঙালী সংস্কৃতি বলতে সাধারণত; আমরা যা বুঝি সে সংস্কৃতি মোটামুটিভাবে এই অল্পসংখ্যক মধ্যবিত্তেরই সংস্কৃতি। দেশের অগণিত কৃষক শ্রমিকের মধ্যে যে সংস্কৃতি আজও প্রচলিত তার মধ্যে পরিবর্তনের চাঞ্চল্য কিছু কিছু এলেও তাদের সাধারণ সংস্কৃতির ধারা এবং জীবনযাত্রা পূর্বের নির্দিষ্ট খাতেই প্রবাহিত। একথা পশ্চিম বাঙলার গ্রাম্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রায় সমানভাবে প্রযোজ্য।

হিন্দু মধ্যবিত্তের সাথে মুসলমান মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষের প্রভাব বাঙলাদেশের সাধারণ সাংস্কৃতিক জীবনে ছায়াপাত করে। এর ফলে মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালী সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে ধরে নিয়ে চেষ্টা করে তাকে বর্জন করতে। এবং এই প্রচেষ্টার মধ্যেই বাঙালী সংস্কৃতির সংকটের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যবিত্তের আর্থিক এবং রাজনৈতিক জীবনের সংকট তাদের সাংস্কৃতিক জীবনে এই দুর্যোগ সৃষ্টি করলেও তার সাথে সাধারণ গ্রাম্য মুসলমানদের বিশেষ কোন যোগাযোগ থাকেনি। গ্রাম বাঙলার সংস্কৃতিক্ষেত্রে বহুকাল পূর্ব থেকেই হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক ও ধর্মীয় ভাবধারার সমন্বয় তুলনায় অনেকখানি সার্থক হয়েছিল বাঙলার লোকসাহিত্যেই তার অন্যতম প্রধান স্বাক্ষর। মুসলমান মধ্যবিত্তের জীবনক্ষেত্রে যে সাংস্কৃতিক সংকট আমরা লক্ষ্য করি সে সংকট সাধারণ গ্রাম্য মুসলমানদের মধ্যে আজও অনুপস্থিত। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিবর্তনের অনেক ঢেউ এদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গ্রাম বাঙলার মধ্যে এ জাতীয় সংকট এখনো সৃষ্টি হয়নি। কারণ এ সংকট মুখ্যতঃ সাম্প্রদায়িকতা-সৃষ্ট এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীই এই সাম্প্রদায়িকতার জনক।

মুসলমান বাঙালীর জীবনে এই সাংস্কৃতিক সমস্যা সাম্প্রদায়িকতার সমসাময়িক। সাম্প্রদায়িকতা যখনই তীব্র আকার ধারণ করেছে ‘আমরা বাঙালী না মুসলমান?’ – এ প্রশ্ন তখনই আনুপাতিক প্রচণ্ডতার সাথে মাথা তুলে এ সাংস্কৃতিক সংকটকে করে তুলেছে দুরূহতর। এজন্যেই সাম্প্রদায়িকতা যে পর্যন্ত আমাদের মানসলোকে রাজত্ব করবে সে পর্যন্ত আমরা এই সাংস্কৃতিক সংকটের হাত থেকে রেহাই পাবো না। এ সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বস্তরে এবঙ সর্বভাবে খর্ব করা এবং উত্তীর্ণ হওয়া। এ প্রচেষ্টায় সফলকাম হলে ‘আমরা বাঙালী, না মুসলমান, না পাকিস্তানী?’ এ ধরনের অদ্ভুত প্রশ্ন বাঙালী মুসলমানেরা আর কোনদিন নিজেদের কাছে উত্থাপন করবে না। এবং তখনই তারা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হবে নিজেদের জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *