একুশে ফেব্রুয়ারী ও সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ

একুশে ফেব্রুয়ারী ও সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মুখ্যতঃ একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও শুধুমাত্র তার মধ্যেই এর পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়। প্রথম দিকে এর চরিত্র এদিক দিয়ে অনেকখানি অনির্দিষ্ট হলেও পরবর্তী অধ্যায়ে এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকেনি। এর কারণ কোন সাংস্কৃতিক আন্দোলনই কখনো রাজনৈতিক পরিচয়হীন হতে পারে না। যে কোন সমাজের রাজনীতির সাথে তার সংস্কৃতির যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন। ভাষার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ নিয়ে কোন বিতর্ক বা সমস্যা যে সাংস্কৃতিক জীবনের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না সেটাতে বিস্মিত হওয়া বা তাকে ব্যতিক্রম মনে করার কারণ নেই।

পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত চিন্তার একটা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় সব সময়ই ছিল। সর্বোপরি তার সাথে সংযুক্ত ছিল সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা অনেক জোর দিয়ে বলা হয়েছিল। এ আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের সাথে ভাষার মর্যাদার প্রশ্ন স্বভাবতঃই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকালে এ সমস্ত তত্ত্বগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় অথবা প্রয়োজন মুসলিম লীগের নেতা এবং সমর্থকদের ছিল না। এই ঔদাসীন্যের ফলে শুধু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নয়, কোন প্রশ্নেরই কোন পূর্ববিবেচনা সম্ভব হয়নি। এমনকি এসব প্রশ্ন উত্থিতও হয়েছিল খুব অল্প ক্ষেত্রেই। এজন্যেই স্বাধীনতা লাভের পর বহু জটিল প্রশ্ন যখন একে একে উপস্থাপিত হতে শুরু করলো তখন এদেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যেও দেখা দিল অনেক জটিলতা।

পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলমানদের ‘তাহজীব’, ‘তমদ্দুন’ ইত্যাদির অনেক দোহাই দেওয়া হলেও এসবের সত্যিকার চেহারা সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞতা ছিল সর্বস্তরে বিদ্যমান ‘তাহজীব’, তমদ্দুন’ ইত্যাদি সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণার অবর্তমানে কেউ এসবের দ্বারা মনে করলো কোর্মা, পোলাও, কোফতা এবং গরু খাওয়ার স্বাধীনতা। কেউ বা আবার মনে করলো ভাষার মধ্যে যথেচ্ছভাবে আরবী ফারসী শব্দের আমদানীর স্বাধীনতা। কেউ ভাবলো মরুভূমির উপর কবিতা লেখার স্বাধীনতা। কারও কাছে বা মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে বোঝালো মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্য-বাদনের পরিবর্তে মুসলমানদের সেই কাজের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কারও কাছে এর অর্থ হলো বিদ্যাসাগর- বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করে তার স্থলে আলাওল, গরীবুল্লা এবং কায়কোবাদকে অভিষিক্ত করা। অনেকের, বিশেষ করে মুসলিম লীগেরা দক্ষিণপন্থীদের, মনে এসবগুলি মিলিয়ে একটা অপরিচ্ছন্ন ধারণা ‘তাহজীব’ ও ‘তমদ্দুন’ রক্ষার নামে জাগ্রত রইলো। এদিক দিয়ে মুসলিম লীগের অল্পশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত সমর্থকদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না এবং পরবর্তীকালেও সে পার্থক্যর কোন চিহ্ন এঁদের চিন্তার মধ্যে দেখা যায়নি।

পাকিস্তান আন্দোলনকালে সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের ধুলো উড়িয়ে সাধারণ লোকের দৃষ্টিকে অনেকখানি আচ্ছন্ন করলেও স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই ধুলোর মহিমা সাধারণ মানুষের মন থেকে অনেকাংশে অন্তর্হিত হলো। আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে এক্ষেত্রে কি বোঝায়, মানুষ শুরু করলো তার সম্পর্কে শৃঙ্খলাবদ্ধ চিন্তা। রাষ্ট্রভাষার সাথে সম্পর্কিত চিন্তা এই শৃঙ্খলাবদ্ধ চিন্তারই একটি নিশ্চিত অভিব্যক্তি।

প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দানা বাঁধে কতকগুলি সরকারী প্ররোচনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে। এগুলির মধ্যে আরবী হরফে বাঙলা লেখার প্রস্তাবই সর্বপ্রধান। এর পর থেকে বাঙলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করা তো দূরের কথা নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বাধীনতা-উত্তরকালে তার স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এ ব্যবস্থাগুলির দ্বারা বাঙলা ভাষার উন্নতি ব্যাহত হওয়ার উপক্রম তো হলোই উপরন্তু বাঙালীর ভাত কাপড়ের প্রশ্নও তার সাথে জড়িত হয়ে পড়লো। কারণ রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাঙলা যদি তার স্বীকৃতি না পায় তাহলে সমস্ত সরকারী কাজকর্মই চলবে উর্দুর মাধ্যমে। এর ফলে বাঙলার মতো একটি উন্নত ভাষার পরিবর্তে অন্য একটি আধা-বিদেশী ভাষা তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হবে শুধুমাত্র জীবিকা অর্জনের তাগিদে। এ অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে এক অন্যায় প্রতিযোগিতায় বাঙালীদের বহুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। এ ক্ষতিকে ইসলামের নামে তথাকথিত ‘তাহজীব’ ‘তমদ্দুনের’, নামে পূর্ব পাকিস্তানীরা আর সহ্য করতে সম্মত হলো না। তারা শুরু করলো এ নিয়ে সুষ্ঠু চিন্তা যা পরিণতি লাভ করলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা লাভ করলো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।

কিন্তু এই স্বীকৃতির দ্বারা বাঙালীরা তাদের সাংস্কৃতিক সংকট উত্তীর্ণ হলো না। আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙলা একটা মর্যাদা লাভ করলেও এ ভাষাকে, এবং এ ভাষা যে সংস্কৃতির বাহন তার বিকাশকে রুদ্ধ করার প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। আরবী হরফে বাঙলা লেখার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাঙলা ভাষাকে কৃত্রিম উপায়ে কিভাবে তথাকথিত ‘হিন্দু-বাঙলা’ থেকে ‘মুসলমান বাঙলায় রূপান্তরিত করা চলে তার জন্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল মহলের চেষ্টার অন্ত নেই। যে কোন ভাষার মধ্যে বিদেশী শব্দ অনেক থাকে এবং ক্রমাগত আমদানীও হতে থাকে। এ প্রক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক এবং তাতে আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু ‘মুসলমান বাঙলা’র নামে আজ এক শ্রেণীর বাঙালী লেখকরা সংস্কৃত উদ্ভূত শব্দসমূহকে ‘হিন্দু-শব্দ’ বলে বর্জন করে তার স্থানে কতকগুলি উদ্ভট আরবী ফারসী শব্দের প্রচলনের যে চেষ্টা করেছেন তাকে একটা প্রহসন ব্যতীত অন্য কিছু আখ্যা দেওয়া যায় না।

হিন্দু দেবদেবী অথবা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির কোন চিহ্ন যে সকল শব্দের বা বইপত্রের মধ্যে আছে সেগুলি ব্যবহার এবং পাঠ করা তাঁদের বিবেচনায় ইসলামী ‘তাহজীব-তমদ্দুনের’ পক্ষে মারাত্মক এবং ক্ষতিকর। কাজেই তাঁদের প্রচেষ্টা সংস্কৃত-উদ্ভূত শব্দ এবং বাঙলা ভাষায় হিন্দু লেখকদের বইপত্র এ দুইকেই বিষবৎ বর্জন করে দুর্বোধ্য আরবী ফারসী শব্দ জর্জরিত ভাষায় ‘ম. সাইমুম’ এবং ‘হাতেম তাঈ’য়ের উপর লেখা কাব্যরসের দ্বারা পাকিস্তানী মুমীনদের’ অন্তরকে সিক্ত করা। এই রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দুরভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টার দ্বারা বাঙলা ভাষার বিকাশ এবং তার সাথে আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষতঃ অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের, মনের বিকাশ কিভাবে রুদ্ধ হচ্ছে তার নিখুঁত পরিমাপ করা সম্ভব না হলেও তার পরিচয় আমাদের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক জীবনে সহজেই লক্ষণীয়।

ইস্কুলের নিম্নতম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত বাঙলা বইপত্র পাঠের হিসাব নিলে দেখা যায় যে সেখানে রীতিমতো এক নৈরাজ্য বিরাজ করছে। বাঙলা সাহিত্যের মধ্যে যে সব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের সাথে এদের পরিচয়ের বিশেষ সুযোগ নেই। কারণ সামান্য দুই এক ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম হলেও সন্তোষজনকভাবে তাঁদের লেখা তাদের পাঠ্যতালিকার অন্তর্গত নয়। কিন্তু পাঠ্যতালিকাতে না থাকলেও তারা হয়তো অন্য কোন স্থান থেকে সংগ্রহ করে সেগুলি পড়তে পারে। এ সুযোগ থেকেও যাতে তারা বঞ্চিত হয়ে “ইসলামী তমদ্দুনের উন্নতিতে আগ্রহশীল হয় তার জন্যে প্রভাবশালী মহল থেকে ভারতীয় কোন লেখকের বই পাঠ অথবা আমদানী কমানো এবং বদ্ধ করার প্রতিও অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যেসব বই পত্র তাদের ইস্কুল কলেজের পাঠ্য-তালিকাভুক্ত হচ্ছে সেগুলির প্রভাবে তাদের মনের বিকাশ না ঘটে তাদের চিত্ত হচ্ছে সঙ্কুচিত এবং চিন্তা হচ্ছে বিকৃত। এবং এর ফলে পরিশেষে তাদের দ্বারা পুঁথিচর্চার বেশী অন্য কিছুই সম্ভব হচ্ছে না।

বাঙলাদেশের বাঙলা ভাষার এই সংকটময় দুর্দিনে একুশে ফেব্রুয়ারীর তাৎপর্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যান্য অনেক দিক থাকলেও এর মুখ্য পরিচয় বাঙালীদের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম হিসাবে। কিন্তু সে আত্মনিয়ন্ত্রণ কি আজ বাঙালীদের দ্বারা অর্জিত হয়েছে? এ প্রশ্নই আজ জোর দিয়ে উত্থাপন করা কর্তব্য। কারণ এর মাধ্যমে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারীর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যে আন্দোলন আজও সত্য অর্থে সাফল্য অর্জন করে নি. তাকে তার সাফল্য এবং পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *