ঊনিশ শতকে মুসলিম শিক্ষা ও মাতৃভাষা চর্চা

ঊনিশ শতকে মুসলিম শিক্ষা ও মাতৃভাষা চর্চা

ইংরেজ রাজত্বের প্রথমদিকে মুসলমানরা পাশ্চাত্য বিদ্যা বর্জন করলেও ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি তাঁরা এই বর্জননীতির অসারতা উপলব্ধি করতে শুরু করেন। এর পূর্বে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কলকাতা এবং হুগলী মাদ্রাসার মাধ্যমে ইংরেজী শিখেছিলেন। কিন্তু সে শিক্ষা যাঁরা গ্রহণ করতেন তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় নিতান্তই নগণ্য এবং তাঁদের শিক্ষার পরিধিও ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। কাজেই বৃহত্তর মুসলমান সমাজের উপর তাদের প্রভাব তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না।

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি এদেশীয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের মধ্যে নানা পরিবর্তনের সূচনার ফলে মুসলমান সমাজেও ইংরেজী শেখার একটা অন্তর্নিহিত তাগিদ অনুভূত হলো। আদালত এবং অন্যান্য সরকারী কাজকর্মে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী প্রচলন হওয়াতে বাঙলাদেশের বহু হিন্দু মুসলমান আকস্মিকভাবে দারুণ অসুবিধায় পড়লেন। হিন্দুরা অবশ্য ফারসীর বদলে ইংরেজী শিখতে শুরু করে সহজেই সে অসুবিধা উত্তীর্ণ হলেন। ফারসী তাঁরা শিখেছিলেন জীবিকার প্রয়োজনে। তেমনি জীবিকার প্রয়োজনেই আবার তাঁরা ফারসীকে বাদ দিয়ে ইংরেজী শেখায় রত হলেন। তাতে দোষের কিছু ছিল না। কিন্তু মুসলমানেরা এই পরিবর্তনের মধ্যে দোষ দেখলেন। তাঁরা হিন্দুদের ইংরেজী চর্চাকে দেখলেন ইংরেজ-হিন্দুর এক যুক্ত ষড়যন্ত্র হিসাবে–যে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য “স্বাধীনচেতা মুসলমানদের’ স্বার্থকে খর্ব করে তার স্থানে ‘দাস মনোভাবাপন্ন’ হিন্দুদের স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতা এবং উন্নতিসাধন করা। অবস্থার পরিবর্তনে, ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় নিয়মে মুসলমানদের এ সংকীর্ণ চিন্তার মধ্যেও পরিবর্তনের সূত্রপাত হলো। অবশ্য সে পরিবর্তন এলো অতি ধীরগতিতে এবং বহুতর জটিলতার সৃষ্টি করে।

উচ্চ শিক্ষিত মুসলমান সমাজের শিক্ষা-চিন্তার পরিবর্তনও হিন্দুদের মতো প্রধানতঃ তার জীবিকা-চিন্তা থেকেই উদ্ভূত। এজন্যে দেখা যায় যে, উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত যে সমস্ত মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষার সপক্ষে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্থে কথা বলছেন অথবা সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করছেন তাঁদের ইংরেজী শিক্ষা বিষয়ক আলাপ-আলোচনার এবং অন্যান্য কাজকর্মের সাথে তাঁদের সমশ্রেণীর হিন্দুদের অনুরূপ চিন্তা এবং কাজকর্মের অনেক সাদৃশ্য আছে। আভিজাত্য-অভিমানী যে সকল মুসলমান কিছুকাল পূর্বে হিন্দুদের ইংরাজী শিক্ষা গ্রহণকে ‘দাস মনোভাবাপন্ন’ বলে ধিক্কার দিয়েছিলেন সেই শ্রেণীর প্রভাবশালী মুসলমানেরাই ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ সুবিধা-সমাজে যাতে বিস্তার লাভ করে তার জন্যে পরবর্তীকালে যত্নবান হলেন। মুসলমানদের চিন্তার মধ্যে এই পরিবর্তন কোন আলৌকিক ঘটনা নয়। অন্যান্য চিন্তার মতো এ চিন্তারও উদ্ভব বাস্তব সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে।

দুই

ঊনিশ শতকে মুসলমান সমাজে নোতুন শিক্ষা চিন্তার সূত্রপাত হয় বাঙলাদেশ এবং উত্তর প্রদেশে নবাব আবদুল লতিফ ও স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে। মুসলমান সমাজকে ইংরেজী শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিভাবে সচেতন করা যায় এ সম্পর্কে তাঁরা দুজনেই সুষ্ঠুভাবে চিন্তা এবং অনেক বাস্তব পন্থা অবলম্বন করেন। তাঁরা উভয়েই উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজী শিক্ষা বর্জন করার ফলে আর্থিক এবং সামাজিক দিক থেকে মুসলমান সমাজ ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইংরেজী শিক্ষার ফলে হিন্দুরা নানা প্রকার অর্থকরী কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ-সুবিধা যতখানি লাভ করেছে মুসলমানরা তা পায়নি সে সুবিধা অর্জন করতে হলে প্রাথমিক প্রয়োজন শিক্ষা সম্পর্কে তাদের পুরাতন চিন্তাকে বাতিল করে ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চার আয়োজন করা। আবদুল লতিফ এবং সৈয়দ আহমদ উভয়েই এই প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করেন।

নবাব আবদুল লতিফের এ প্রচেষ্টা শুরু হয় ১৮৫৩ সালে। সে বছর ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মুসলমান সমাজকে কিছুটা সচেতন করার জন্যে তিনি মুসলমান ছাত্রদের জন্যে ইংরেজী শিক্ষা কতখানি সুবিধাজনক’ এই বিষয়ে একটি রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। এই প্রতিযোগিতার ফল কিছুটা সন্তোষজনক হয় তবে অনেকে এ কাজের জন্যে তাঁকে স্বধর্মবিরোধী এবং ধর্মনাশকারী বলেও অভিহিত করেন। ১৮৬৩ সালে ‘মহামেডান লিটারারী সোসাইটি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আবদুল লতিফের নেতৃত্বে স্থাপিত হয়। এ সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল আরবী, ফারসী, উর্দু এবং ইংরেজী ভাষায় নানা প্রকার আলোচনা এবং সভাসমিতির মাধ্যমে উচ্চ-শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটানো। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হওয়ার অল্প কিছুকাল পর স্যার সৈয়দ আহমদ কলকাতা আসেন এবং সোসাইটির আয়োজিত একটি সভায় পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেন।

নবাব আবদুল লতিফ স্যার সৈয়দ আহমদের মতো মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করলেও তাঁদের দু’জনের চিন্তার মধ্যে অনেকখানি পার্থক্য ছিল। এবং এই পার্থক্যের প্রভাব বাঙলাদেশ এবং উত্তরপ্রদেশের মুসলমানদের শিক্ষা চিন্তা এবং পরবর্তী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছিল।

সৈয়দ আহমদ পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার মুসলমানদের সামনে উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার জন্যে মাদ্রাসার গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থাকে যুক্ত করতে চান নি। নিজে অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি সরাসরি ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনেরই পক্ষপাতী ছিলেন। আবদুল লতিফ কিন্তু এ ব্যাপারে স্যার সৈয়দের মতো অতখানি অগ্রসর হতে প্রস্তুত ছিলেন না। ছিলেন গতানুগতিক মাদ্রাসা শিক্ষার পক্ষপাতী এবং সে শিক্ষাকে বাঙলাদেশে বাতিল না করে তার বুনিয়াদকে আরও শক্তিশালী এবং তার শাখা-প্রশাখাকে আরও বিস্তার করার ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব অনেকখানি।

হাজী মহম্মদ মহসীনের দানপুষ্ট হুগলী কলেজে ইংরেজী শিক্ষা দেওয়া হতো এবং সেখানে হিন্দু ছাত্রেরাই অধিক সংখ্যায় পড়াশোনা করতো। এর থেকে আবদুল লতিফ এই সিদ্ধান্ত করলেন যে, হাজী মহম্মদ মহসীনের দানের টাকায় হিন্দু ছাত্রেরা লাভবান হচ্ছে কাজেই সরকারকে দিয়ে সেখানে অর্থ সাহায্য কমানো দরকার। তিনি এই মর্মে স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল এবং লর্ড নর্থব্রুকের কাছে অনেক আবেদন নিবেদন করেন এবং পরিশেষে ১৮৭৩ সালে বাৎসরিক পঞ্চাশ হাজার টাকা মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যে বরাদ্দ করান। এর ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে তিনটি নোতুন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যে বহু সংখ্যক বৃত্তিরও ব্যবস্থা হয়।

নবাব আবদুল লতিফের এই মাদ্রাসাপ্রীতি একথাই বিশেষভাবে প্রমাণ করে যে, ইংরেজী শিক্ষা প্রচলনের দিকে তাঁর চিন্তা ছিল রীতিমতো রক্ষণশীল। তা যদি না হতো তাহলে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা বাদ দিয়ে গতানুগতিক এবং নিরর্থক মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করার জন্যে সরকারকে কোন মতেই পরামর্শ দিতেন না। এখানেই তাঁর সাথে স্যার সৈয়দ আহমদের পার্থক্য। আবদুল লতিফের নিজের মতে তিনি মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার জন্যে সরকারকে যে পরামর্শ দেন প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রতিষ্ঠা তারই একটা পরোক্ষ ফল। কিন্তু সে কথা স্মরণ রেখেও তাঁর শিক্ষা নীতির বিচারকালে একথা বলা চলে যে, সৈয়দ আহমদের তুলনায় তিনি অনেক বেশী রক্ষণশীল এবং প্রাচীনপন্থী ছিলেন।

ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে শিক্ষা-চিন্তার ক্ষেত্রে হিন্দুদের মধ্যেও যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল। সে সময় একদল সংস্কৃত শিক্ষা এবং অন্য দল ইংরেজী শিক্ষার ওকালতী করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রথম দলের প্রভাব অচিরেই বিলুপ্ত হয় এবং সাধারণভাবে হিন্দুরা ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিদ্যা অর্জনে নিযুক্ত হন। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঠিক সে রকমটি ঘটলো না। মুসলমানরা সাধারণভাবে পাশ্চাত্য বিদ্যার্জনের বিরোধী ছিলেন এবং যাঁরা তা ছিলেন না তাঁরাও নেহাৎ জীবিকা অর্জনের জন্যে সামান্য যে টুকু ইংরেজী ভাষার জ্ঞান প্রয়োজন তার থেকে বেশী শিক্ষা মুসলমানদেরকে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁরা শিক্ষা বলতে মোটামুটিভাবে বুঝতেন মাদ্রাসা শিক্ষা। এদিক দিয়ে সৈয়দ আমীর আলী একজন ব্যতিক্রম কিন্তু শিক্ষা-চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব আরও অনেক পরের কথা।

সে সময় মুসলমান সমাজনেতাদের মধ্যে আবদুল লতিফই ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য। এবং ইংরেজ দরবারে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল যথেষ্ট। এজন্যে মুসলমানদের শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁরা সব সময়ে তার পরামর্শকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু তাঁর পরামর্শ মতো যে সমস্ত সংস্কার সেকালে সাধিত হয় তার ফলে মুসলমানদের উন্নতি যেটুকু হয়েছিল তার তুলনায় সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশী।

পাশ্চাত্য বিদ্যার সাথে আবদুল লতিফের নিজের পরিচয় ছিল অতিশয় সীমিত এবং শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর ধারণার মধ্যেও সংকীর্ণতার অভাব ছিল না। ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে ঊনিশ শতকের হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণীর কিছুসংখ্যক মানুষের মধ্যে যে বৈপ্লবিক এবং উদারনৈতিক চেতনার সঞ্চার হয় তার কোন লক্ষণ নবাব আবদুল লতিফের চিন্তার মধ্যে ছিল না। তাঁর চিন্তাভাবনা মোটামুটিভাবে এক ক্ষয়িষ্ণু এবং জীর্ণ কাঠামোর মধ্যেই নিয়ন্ত্রিত হতো। এর ফলে মুসলমানদের বৈষয়িক উন্নতির জন্যে ইংরেজী ভাষা আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেও পাশ্চাত্য উদারনৈতিক শিক্ষা অর্জনে বাঙলাদেশের মুসলমানদেরকে উৎসাহিত এবং উদ্বুদ্ধ করার কোন চেষ্টা তাঁর মধ্যে দেখা যায় নি। এজন্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নবোখিত মধ্যবিত্ত হিন্দুরা সংস্কৃতের মাধ্যমে পণ্ডিতী শিক্ষা বাতিল করে পাশ্চাত্য বিদ্যা অর্জনে যে উৎসাহের সাথে নিযুক্ত হলেন তার কোন চিহ্ন ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মুসলমানদের মধ্যে লক্ষিত হলো না। তাঁরা একদিকে ইংরেজী শিক্ষা এবং অন্যদিকে মাদ্রাসার রক্ষণশীল সেকেলে শিক্ষা এ দুইয়ের মধ্যে পড়ে নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি চিন্তার ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকে দীর্ঘ স্থায়ী করলেন।

তিন

নবাব আবদুল লতিফ ১৮৬৩ সালে মহামেডান লিটারারী সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আরবী, ফারসী, উর্দু এবং ইংরেজীর মাধ্যমে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সাথে পাশ্চাত্য বিদ্যার পরিচয় ঘটানো। এছাড়া দেশের আইন – কানুন এবং অন্যান্য ব্যবস্থা, বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেও সেখানে নিয়মিত বক্তৃতা এবং আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হতো। বাঙলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে এ জাতীয় সভাসমিতির আবির্ভাব বেশ কিছুকাল পূর্বেই হয়েছিল কিন্তু মুসলমান সমাজে মহামেডান লিটারারী সোসাইটিকেই বলা চলে এ ধরনের সর্বপ্রথম উদ্যোগ। ১৮৬৩ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ এই সোসাইটির যষ্ঠ মাসিক সভায় উপস্থিত হন এবং ‘স্বদেশপ্রেম ও ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা’র উপর বক্তৃতা করেন। সোসাইটির বহু সদস্যদের সাথেও তাঁর নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। কলকাতা থেকে ফিরে যাওয়ার অল্পকাল পরেই সৈয়দ আহমদ সুলভ মূল্যে ভারতবর্ষীয় লেখকদের রচিত হিন্দী, উর্দু, ফারসী এবং আরবীতে লেখা বই মুদ্রণ এবং এই সকল ভাষায় বিখ্যাত ইউরোপীয় এবং আমেরিকান লেখকদের বইপত্র অনুবাদের জন্যে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ করেন।

মহামেডান লিটারারী সোসাইটিতে তত্ত্বমূলক কিছু আলোচনা মাঝে মাঝে অনুষ্ঠিত হলেও জ্ঞানচর্চার দিকে নবাব আবদুল লতিফ অথবা সোসাইটির অন্য সদস্যদের তেমন কোন উৎসাহ ছিল না। এজন্যে বইপত্র রচনা, অনুবাদ অথবা প্রকাশের তেমন কোন ঝোঁক তাঁদের থাকে নি। কখনো কখনো দুই এক বিষয়ে তাঁরা কিছু প্রকাশ করে থাকলেও কোন পত্রিকার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্যকে সাধারণের সামনে উপস্থিত করার কোন প্রয়াস তাঁদের ছিল না। এদিক দিয়ে বলা চলে যে, লিটারারী সোসাইটির পরিধি ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। এর ফলে তার প্রভাবও তেমন সুফলপ্রসূ অথবা সুদুর প্রসারী হয় নি। নবাব আবদুল লতিফ এ সমিতিকে উচ্চশ্রেণীর এবং বিত্তবান মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন এবং আঠারোশো ষাটের দিকে তাঁদের সংখ্যা অল্পই ছিল।

স্যার সৈয়দ আহমদের ট্র্যানস্লেশন সোসাইটি এবং নবাব আবদুল লতিফের মহামেডান লিটারারী সোসাইটির মধ্যে মূল পার্থক্য ছিল মোটামুটি তিনটি বিষয়ে। প্রথমতঃ, ট্র্যানস্লেশন সোসাইটি অল্প মূল্যে পুস্তক প্রকাশ এবং পাশ্চাত্য বইপত্রের অনুবাদের দ্বারা ভারতবর্ষের, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের, হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করার যে চেষ্টা করেন সে জাতীয় কোন প্রচেষ্টা লিটারারী সোসাইটি করে নি। দ্বিতীয়তঃ, ট্র্যানস্লেশন সোসাইটি প্রধানতঃ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে হলেও প্রথম দিকে তার মাধ্যমে জাতিধর্ম নির্বিশেষে শিক্ষিত ভারতীয়দের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বিস্তৃত জ্ঞান চর্চা এবং বিতরণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু লিটারারী সোসাইটির কাজকর্ম, উদ্যোগ- আয়োজন সমস্ত কিছু অভিজাত এবং উচ্চবিত্ত মুসলমানদের মধ্যেই বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ ছিল। তৃতীয়তঃ, (এবং এটাই সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য) সৈয়দ আহমদ ‘ট্যানস্লেশন সোসাইটি’র মাধ্যমে আরবী ফারসীর সাথে হিন্দী এবং উর্দু অর্থাৎ উত্তর প্রদেশের হিন্দু-মুসলমান অধিবাসীর মাতৃভাষাতে বইপত্র প্রকাশ এবং অনুবাদের প্রস্তাব করেন এবং সে কাজে ব্রতী হন। মহামেডান লিটারারী সোসাইটি আরবী ফারসীর সাথে উর্দুতে সভাসমিতির কাজ পরিচালনা করলেও বাঙলাদেশের লোকের মাতৃভাষা বাঙলার কোন স্থান, তাঁদের কোন কাজকর্ম অথবা ব্যবস্থার মধ্যে ছিল না। মাতৃভাষার প্রতি স্যার সৈয়দ আহমদ এবং নবাব আবদুল লতিফের দৃষ্টিভঙ্গীর এই পার্থক্য তাঁদের উভয়ের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তা এবং প্রচেষ্টার মূল্য নির্ণয়ে অনেকখানি সহায়ক। [১]

মহামেডান লিটারারী সোসাইটিতে বাঙলার কোন স্থান না থাকার প্রধান কারণ তার মধ্যে বাঙলাভাষী সাধারণ মুসলমানদের কোন স্থান ছিল না। সোসাইটির সদস্যরা সকলেই অভিজাত উচ্চশ্রেণী অথবা বিত্তবান মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত যাঁরা উর্দুকে নিজেদের মাতৃভাষা মনে করতেন। এঁদের মধ্যে অনেকে বাঙলা একেবারেই জানতেন না। আবার নবাব আবদুল লতিফের মতো অনেকের আসল মাতৃভাষা বাঙলা হওয়ার ফলে বাঙলা মোটামুটিভাবে জানলেও তাঁরা সে কথা অস্বীকার করে উর্দুকেই মাতৃভাষা জ্ঞান করতেন। বাঙলাদেশের এই সকল সমাজনেতাদের ভাষাবিষয়ক চিন্তাকে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে শুধু যে ঊনিশ শতকের মুসলমানদের সাংস্কৃতিক সংকটের পরিচয় পাওয়া যাবে তাই নয়, দেখা যাবে যে, আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক জীবনের সংকট, দৈন্য এবং দুর্দিনের ঐতিহাসিক কারণও অনেকখানি তার মধ্যেই নিহিত আছে।

১৮৮২ সালের তিসরা ফেব্রুয়ারী লর্ড রিপন সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার আনুপূর্বিক তদন্তের জন্যে হান্টারের সভাপতিত্বে একটি কমিশন নিয়োগ করেন। নবাব আবদুল লতিফকে কমিশন তাঁদের সামনে সাক্ষ্যদানের জন্যে আহ্বান করে তাঁকে চারটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেন। এই প্রশ্নগুলির মধ্যে চতুর্থটি ছিল কোন ভাষায় বাঙলা এবং বিহারের মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়া হবে সেই সম্পর্কে। প্রশ্নটির জবাবে বাঙলাদেশ সম্পর্কে তিনি লিখিতভাবে বলেন যে, নিম্নশ্রেণীর মুসলমান, যারা জাতিগতভাবে হিন্দুদের থেকে পৃথক নয়, তাদের জন্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙলায় শিক্ষা দেওয়া চলতে পারে। তবে সে বাঙলা অবশ্য হিন্দুদের দ্বারা ব্যবহৃত এবং সংস্কৃত প্রভাবিত বাঙলা নয়। সে বাঙলাকে মুসলমানদের (অর্থাৎ উচ্চবিত্ত মুসলমানদের) মধ্যে প্রচলিত অসংখ্য আরবী-ফারসী-উর্দু শব্দ দ্বারা পরিশুদ্ধ করা প্রয়োজন। উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মুসলমানদের জন্যে অবশ্য তাঁর সুপারিশ অন্যরকম ছিল। আবদুল লতিফের মতে তাঁদের শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত উর্দু। কারণ প্রথমতঃ, সে ভাষাতেই তাঁরা শহরে এবং গ্রামাঞ্চলেও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। দ্বিতীয়তঃ, উর্দু না জানলে মুসলমানেরই সম্ভ্রান্ত মহলে কোন প্রকার গতিবিধি সম্ভব নয়। তাছাড়া উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মুসলমানেরা আরব, ইরান, এবং এশিয়া থেকে আগত বাঙলাদেশের প্রথম মুসলমান বিজেতা, শাসনকর্তা, ধর্মনেতা আলেম প্রভৃতিদের বংশধর। কাজেই সেদিক দিয়ে সাধারণ নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের সাথে তাঁদের কোন আত্মীয়তা অথবা সম্পর্ক নেই। উর্দুকে তাঁরা স্বভাবতঃই নিজেদের মাতৃভাষা বিবেচনা করেন এবং সেজন্যেই তাঁদের শিক্ষার মাধ্যম উর্দুই হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাঙলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মাতৃভাষা সম্পর্কে এই মত পোষণ করলেও ছাত্রদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের (অবশ্য বাঙলার ক্ষেত্রে শুধু প্রাথমিক পর্যায়ে) উপর আবদুল লতিফ যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন যে, উপযুক্ত শিক্ষা দানের জন্যে মাতৃভাষার আশ্রয় গ্রহণ নিতান্তই প্রয়োজনীয়।[২]

বাঙলাদেশের মুসলমানদের জাতি এবং মাতৃভাষা সম্পর্কে নবাব আবদুল লতিফের উপরোক্ত ধারণার সরল অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এদেশে দুই শ্রেণীর মুসলমান আছে। একটি নিম্নশ্রেণীর এবং অপরটি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। কিন্তু এই শ্রেণীভেদ আর্থিক জীবনের উপর নির্ভরশীল নয়। ভেদাভেদ এখানে আরও গভীর। নিম্নশ্রেণীর মুসলমান হলো তারা যারা বঙ্গদেশীয় অর্থাৎ এদেশের আদি বাসিন্দা। উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমান হলো তারা যাদের আদি বাসভূমি আরব, ইরান এবং মধ্য এশিয়া। কাজেই ইসলামী ধর্মতত্ত্বে যাই থাক তাঁদের মতে বঙ্গদেশীয় বাঙলাভাষী মুসলমানেরা নিম্নশ্রেণীভুক্ত। এবং বহিরাগত অবাঙলাভাষী, অর্থাৎ এক্ষেত্রে উর্দুভাষী মুসলমানেরা উচ্চ-শ্রেণীভুক্ত। এ জাতীয় চিন্তা যদি নবাব আবদুল লতিফ এবং তাঁদের সমসাময়িক আভিজাত্যভিমানী সমাজনেতাদের মাথার মধ্যেই আবদ্ধ থাকতো তাহলে মুসলমান সমাজ সামগ্রিকভাবে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। কারণ তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী, ইংরেজ দরবারে তাঁদের সুপারিশের মূল্য ছিল। নবাব আবদুল লতিফের এ জাতীয় সুপারিশের জোরেই মহসীন তহবিলের অর্থ হুগলী কলেজ থেকে সরিয়ে এনে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্যে ব্যয় না করে আরবী, ফারসী ইত্যাদি শিক্ষার জন্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

স্যার সৈয়দ আহমদ হিন্দী উর্দু, বিশেষ করে উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তারের যে পরিকল্পনা করেন সেটাই ছিল তাঁর সমগ্র শিক্ষাপ্রচেষ্টার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য জিনিষ। এর কারণ হিন্দী এবং উর্দু উত্তর প্রদেশের সাধারণ মানুষের মাতৃভাষা। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের জন্যে যে ভাষা প্রগতির বাহন ছিল সে ভাষাই বাঙলাদেশে ছিল প্রতিক্রিয়ার অস্ত্র।

বহু তর্কবিতর্ক আলাপ-আলোচনার পর শিক্ষার, বিশেষতঃ, উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজী বৃটিশ ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রচলিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক জীবনে মাতৃভাষা বিভ্রাটের জন্যে উত্তর প্রদেশ এবং বাঙলাদেশের মুসলমানদের জীবন প্রবাহিত হয় অনেকখানি ভিন্ন খাতে। মাতৃভাষা উর্দু চর্চার ফলে উত্তর প্রদেশের মুসলমানেরা আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতির যে পর্যায়ে অল্পকালের মধ্যে উন্নীত হন বাঙলাদেশের মুসলমানদের দ্বারা তার এক ভগ্নাংশও সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ উত্তর প্রদেশের মুসলমানেরা ইংরেজী ও মাতৃভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিদ্যা শিক্ষা করে নিজেদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করলেন এবং কিছুটা বিলম্বে হলেও হিন্দুদের মতো চাকরী বাকরী ব্যবসা বাণিজ্যে নিযুক্ত হলেন। কিন্তু বাঙলাদেশের মুসলমানেরা আরও বেশ কিছুকাল মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে শুধু আরবী, ফারসী, উর্দু জবান রপ্ত করার চেষ্টা চালালেন। তার ফলে ইংরেজ শাসনের নোতুন কাঠামো এবং আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবিকা উপযুক্ত সংস্থানের অভাবে এ জাতীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানেরা মাদ্রাসা মক্তবে মৌলভীগিরী, মসজিদে ইমামতী, পীরমুর্শেদী ইত্যাদি দ্বারা জীবিকা অর্জন করতে বাধ্য হলেন এবং সমগ্র মুসলমান সমাজের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রগতিকে দারুণভাবে ব্যবহৃত করলেন। স্যার সৈয়দ আহমদের চিন্তার মধ্যেও অনেক সামন্ততান্ত্রিক বিভ্রান্তি এবং ধর্মীয় সংস্কার ছিল কিন্তু নবাব আবদুল লতিফের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক বেশী সমজদার মানুষ। এজন্যেই স্যার সৈয়দ আহমদ শুধু উত্তর প্রদেশ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালে নবাব আবদুল লতিফের থেকে অনেকখানি অধিক প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হন।

চার

নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের শিক্ষার জন্যে নবাব আবদুল লতিফ যে সুপারিশ করেন তার মধ্যে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় বাঙলা ভাষায় আরবী ফারসী শব্দ আমদানী এবং প্রচলন করার প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের মধ্যেই তাঁর সুপারিশের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী বিশেষতঃ ফারসী শব্দের প্রচলন নবাব আবদুল লতিফ এবং তাঁর সমশ্রেণীর মুসলমানদের সুপারিশের উপর কোনকালেই নির্ভরশীল ছিল না। এ ভাষা নিজের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবেই অসংখ্য আরবী, ফারসী, তুর্কী শব্দ ইতিমধ্যেই এমনভাবে অঙ্গীভূত করেছিল যে, তাদের আদি শব্দরূপ আরবী না তুর্কী না ফারসী এ নিয়ে বাঙলাদেশের হিন্দু মুসলমান কেউই মাথা ঘামাতো না। এ সকল শব্দ আরও অনেক বিদেশী শব্দের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঙলাদেশেরই নিজস্ব সম্পদ। এ সম্পদ অপহরণ করার ক্ষমতা এদেশের হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান কারো ছিল না এবং এখনো নেই। তাঁরা সকলেই সহজ ও স্বাভাবিকভাবে এগুলির ব্যবহার করতেন এবং এখনো করে থাকেন। এ জাতীয় শব্দের কতকগুলি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন : জমি (ফা, জমীন), ফসল (ফা), বেয়াদবী (ফা), আশকারা (ফা), আস্তিন (ফা), আস্তানা (ফা), বেইমান ( বে ফা. ইমান – আরবী), উজবুক (তুর্কী. উজবক), নিয়মকানুন (নিয়ম – সংস্কৃতঃ কানুন – আ), কাবার (আ. কুব্র), কামান (ফা. কমান), কারসাজি (ফা), হজম (আ). কারিগর (ফা), কাহিল (আ), চাকরী (ফা), চাদর (ফা), দরওয়ান (ফা), দস্তানা (ফা), দেনা আরবী – দয়েন), বালিশ (ফা), তোষক (ফা), বেকার (ফা), বেকায়দা (বে – ফা. কায়দা – আ), বেইজ্জৎ (বে – ফঅ. ইজ্জৎ – আ), জানোয়ার (ফা), হজম (ফা), ইত্যাদি। এই আরবী, ফারসী, তুর্কী শব্দগুলি যে কেবলমাত্র বাঙলাদেশের মুসলমানদের ঘরোয়া শব্দ হিসাবেই ব্যবহৃত হয় তা নয়, বাঙলাভাষী হিন্দুরাও এগুলিকে একইভাবে ব্যবহার করেন। যেহেতু শব্দগুলো আরবী এবং ফারসী অথবা তার থেকে উদ্ভুত সেজন্যে সেগুলো ব্যবহার করলে তাঁদের ধর্মনাশ হবে অথবা বাঙালীত্ব খর্ব হবে, একথা কেউ মনে করেন না। কাজেই ‘জমি’ শব্দটিকে বর্জন করে ‘ভূমি’, ‘ফসলকে’ বর্জন করে ‘শস্য’, ‘বালিশকে’ বর্জন করে ‘উপাধান’, ‘কলম’কে বর্জন করে ‘লেখনি’, ‘দেনাকে’ বৰ্জন করে “ঋণ” শব্দ প্রচলনের দিকে তাঁদের কোন ঝোঁক নেই। চাদর, তোষক, উজবুক বেয়াদবী ইত্যাদি শব্দগুলি সম্পর্কেও সেই এক কথাই প্রযোজ্য। তার জন্যে সংস্কৃত – উদ্ভুত কোন শব্দ খুঁজে বের করে দৈনন্দিন কথাবার্তায় চালু করার কথা তাঁদের মনে আসে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, শুধু উপরোল্লিখিত আরবী ফারসী শব্দগুলিই নয়, প্রায় আড়াই হাজার আরবী ফারসী তুর্কী শব্দ কয়েক শতকের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাঙলা ভাষায় সহজভাবেই প্রচলিত হয়ে এসেছে এবং সে গুলি বাঙলার নিজস্ব সম্পদেই পরিণত হয়েছে। বাঙলা ভাষার যে কোন অভিধানের পাতা উল্টালেই এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে।

একথা যদি সত্য হয় তাহলে নিম্নশ্রেণী ও বাঙলাভাষা সম্পর্কে ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞা সত্ত্বেও নবাব আবদুল লতিফ এবং তাঁদের সমশ্রেণী লোকদের বাঙলাভাষায় আরবী-ফারসী শব্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর উদ্দেশ্য কি? এর আসল উদ্দেশ্য বাঙলা ভাষার শব্দসম্ভার বাড়িয়ে তাকে সমৃদ্ধ করা নয়। সেদিকে তাঁদের কোন খেয়ালই ছিল না। কারণ বাঙলা তো তাঁদের মতে নিম্নশ্রেণীর ‘ছোটলোকদের’ ভাষা, উচ্চশ্রেণীর সংস্কৃতিবান পুরুষদের ভাষা নয়। এর আসল উদ্দেশ্য তাই ছিল ‘আধা-মুসলমান’ নিম্নশ্রেণীর লোকদেরকে আরও কিছুসংখ্যক আরবী ফারসী উর্দু শব্দ শিখিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা সত্যিকার ধর্মভাব জাগ্রত করা, তাদেরকে সত্যিকার মুসলমান হওয়ার পথ নির্দেশ করা। তাঁদের ধারণা অনুসারে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা বাঙলাতে সম্ভব নয়। সে শিক্ষা আরবী ফারসী উর্দুর মাধ্যমেই সম্ভব। তবে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানরা যেহেতু বাঙলায় কথা বলে এবং বেহেশতী জবানগুলো তাদের কবজার বাইরে কাজেই তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্যে যত অধিক সংখ্যায় সম্ভব আরবী ফারসী শব্দ তাদের ভাষায় জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার। একমাত্র এভাবেই নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা বাঙলাকে পরিশুদ্ধ করে তার মাধ্যমে তাদের মধ্যে কিছুটা সত্যিকার ধর্মভাব জাগ্রত করা সম্ভব।

এ জাতীয় চিন্তার জন্ম সামন্ততান্ত্রিক চেতনা এবং বিবেচনার মধ্যে। এর সাথে তাই প্রগতিশীল শিক্ষা-চিন্তার কোন সম্পর্ক ছিল না। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজী এবং বাঙলা চর্চা ভালভাবেই শুরু হয়েছিল কিন্তু সেটাকে তাঁরা একটা সন্তোষজনক অবস্থা বলে মনে করেন নি। এজন্যে দেখা যায় যে, আঠারোশো চল্লিশের দিকেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সংবাদ প্রভাকর ইত্যাদি প্রভাবশীল পত্রপত্রিকাতে বাঙলা ভাষার চর্চা এবং অনুশীলনের উপর লেখালেখি এবং বিতর্ক চলতে থাকে। এ আন্দোলনের মূলকথা ছিল ইংরেজীর পরিবর্তে বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করা, তার জন্যে যথাযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা। মাতৃভাষার প্রতি বাঙলাদেশের উচ্চশিক্ষিত হিন্দুদের যখন এই মনোভাব তখনো এদেশের একই শ্রেণীর মুসলমানরা আরবী ফারসী উর্দুর আলখেল্লা পরে কুচকাওয়াজ করছেন। এই কুচকাওয়াজের কারণ বাঙলাদেশের উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু সম্পদশালী ও প্রভাবশীল লোকেরা নিজেরা বিদেশী ভাষায় কথা বলতেন এবং অন্য শ্রেণীর অর্থাৎ নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদেরকে তারা মানুষ মনে করতেই প্রস্তুত ছিলেন না। এই সামন্ততান্ত্রিক চিন্তার দ্বারা তাঁরা তাঁদের সমসাময়িক মুসলমানদের উপর যথেষ্ট মন্দ এবং ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

পাঁচ

ঊনিশ শতকে কেবলমাত্র মুসলমানদের নয়, হিন্দুদের জীবনও ধর্মপ্রভাবে আচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মের প্রভাব তাদের উভয়ের ক্ষেত্রে একইভাবে কার্যকরী হয় নি। এর কারণ হিন্দুদের ধর্মচর্চার সাথে মাতৃভাষা বাঙলা চর্চার সংযোগ সাধিত হয়েছিল কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। শুধু তাই নয়। মুসলমানরা ধর্মচর্চা এবং মাতৃভাষা চর্চাকে মনে করতেন পরস্পর বিরোধী।

খৃস্টান পাদ্রীদের ধর্মপ্রচার এবং ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর বৈপ্লবিক চিন্তা ও কার্যকলাপের মোকাবিলা করার জন্যে সমাজের মধ্যে নানা প্রকার ধর্মান্দোলনের উৎপত্তি হয়। তার ফলে একদিকে ব্রাহ্মধর্মের একেশ্বরবাদ এবং অন্যদিকে সনাতনী হিন্দু ধর্মের আন্দোলন শুরু হয়। এছাড়া আরও নানাপ্রকার ধর্মালোচনায় বাঙলাদেশের পরিমণ্ডল হয় মুখরিত। এই সমস্ত ধর্মান্দোলনের ভাষা কিন্তু সংস্কৃত ছিল না, ছিল বাঙলা। এর ফলে বাঙালী হিন্দুর ধর্মচর্চা কতখানি সাফল্য লাভ করেছিল সেটা তর্কসাপেক্ষ হলেও তাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার সুফল সম্পর্কে তর্কের কোন অবকাশ নেই।

হিন্দুদের মধ্যেও মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থাদি শোনা অথবা পাঠ করা শাস্ত্রশাসনে নিষিদ্ধ ছিল। মধ্যযুগে মাতৃভাষায় অষ্টাদশ পুরাণ অথবা রামচরিতাদি শুনলে রৌরব নরকে স্থান হবে বলে শাস্ত্রকাররা হিন্দুদেরকে শাসন করতেন। এবং এ সবের ফলে সেকালে মাতৃভাষায় শাস্ত্রচর্চার প্রচলন একরকম ছিলই না। তারও পূর্বে প্রাচীনকালে ধর্মশাস্ত্র পাঠ সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব হতো না কারণ সে কাজে একমাত্র ব্রাহ্মণদেরই অধিকার ছিল। অন্য কেউ সে চেষ্টা করলে তার অধিকারদোষ ঘটতো। কিন্তু এত নিষেধ সত্ত্বেও পনেরো শতকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং সতেরো শতকে কাশীদাসী মহাভারত বাঙলা ভাষায় সম্ভব হয়েছিল। রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, পুরাণ ইত্যাদির অনুবাদ এবং নোতুন ভাষ্য এর পর থেকে বাঙলাভাষাকে সমৃদ্ধ করার পথে অনেকখানি সহায়ক হয়। ঊনিশ শতকের দিকে বাঙলা ভাষায় ধর্মপ্রচারের বিরুদ্ধে কোন সংস্কার অথবা ধর্মীয় বাধা নিষেধ বাঙলাদেশে ছিল না। এ কারণেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আলোচনাই মাতৃভাষা বাঙলায় অনুষ্ঠিত হতো। ধর্মচর্চার সাথে মাতৃভাষা চর্চার এই সংযোগ সাধিত না হলে ঊনিশ শতকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস যে অন্যরকম হতো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

ঊনিশ শতকে মুসলমানদের জীবনও ধর্মপ্রভাবে আচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু সে প্রভাব তাদের সাধারণ সাংস্কৃতিক জীবনকে তেমনভাবে উন্নত এবং সমৃদ্ধ করে নি। এই দুর্যোগকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে তাদের ধর্মচর্চার ইতিহাসে মাতৃভাষা চর্চার স্থান যথাযথভাবে নির্ণয় করা প্রয়োজন। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ঊনিশ শতকে মুসলমানদের ধর্মচর্চারও একটি শ্রেণীগত রূপ ছিল অর্থাৎ দুই শ্রেণীর লোকে এই সময় ধর্মচর্চা করেছিল। এদের একটি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং অপরটি নিম্নশ্রেণীর দ্বারা গঠিত। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা অর্থ এবং সামাজিক মর্যাদার জোরে অধিকতর শিক্ষিত। তাদের ভাষা, অন্ততঃ তাদের সংস্কৃতির ভাষা উর্দু। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা দরিদ্র এবং মোটামুটিভাবে অশিক্ষিত। তাদের ভাষা ছিল বাঙলা এবং তাদের গতানুগতিক ধর্মচর্চার মধ্যে তেমন কোন নোতুনত্ব অথবা সম্ভাবনা ছিল না। খৃষ্টানদের হাত থেকে তাদের ধর্ম রক্ষা করার জন্যে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে যেসব ধর্মনেতারা তাঁদের মধ্যে কাজ করতেন তারা বাঙলায় লেখালেখি করে ধর্ম প্রচার করলেও তাদের নিজেদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য শিক্ষা ছিল না। সে শিক্ষা ছিল প্রথম শ্রেণীর অর্থাৎ উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত লোকদের। তাঁরা কিছু কিছু পাশ্চাত্য শিক্ষারও অর্জন করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন নোতুন যুগেরই উৎপত্তি এবং কিছুটা নোতুন আবহাওয়ায় মানুষ। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি তাঁরা উদাসীন ছিলেন না। বরং তার প্রতি তাঁদের ব্যবহারিক এবং বিশেষ করে তত্ত্বগত আনুগত্য ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তবু একথা অনস্বীকার্য যে, তাঁদের ধর্মকথা বা ধর্মান্দোলন বাঙলাদেশের সাধারণ মুসলমানদের, এমনকি মধ্যবিত্ত মুসলমানদের জীবনেও তেমন কোন রেখাপাত করে নি। ফলে তার দ্বারা বাঙলাদেশের সাধারণ সংস্কৃতিও তেমন সমৃদ্ধ হয় নি। বাঙলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক জীবনে বাঙলার পরিবর্তে উর্দুর আধিপত্য উত্তরপ্রদেশের মুসলমান এবং বিশেষ করে বাঙলাদেশের হিন্দুদের থেকে তাদেরকে যে সব দিক দিয়ে অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছিল তাই নয়, মাতৃভাষার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গীকেও মারাত্মকভাবে পঙ্গু করেছিল। এ পঙ্গুত্বের হাত থেকে পূর্ব বাঙলার মুসলমানরা আজ পর্যন্ত মুক্তি লাভ করেন নি।

ছয়

নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী এবং তাঁদের সমশ্রেণীভুক্ত লোকেরা, যাঁরা বাঙলাকে নিম্নশ্রেণীভুক্ত মুসলমানদের ভাষা বলে অবজ্ঞা করতেন, তাঁদের উচ্চশ্রেণীর উর্দু সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙলা ভাষাকে মুসলমানী চরিত্র দান করার একটা প্রচেষ্টা ঊনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে শুরু হলো। সকলেই যে সম্পূর্ণভাবে এই প্রভাবের আওতায় পড়লেন তা নয়, বরং অনেকে এই চিন্তাধারার বিরোধিতা করে যে সাহিত্যসৃষ্টি করলেন কালের বিচারে সেগুলিই হলো অধিকতর রসোত্তীর্ণ। কিন্তু তবু মধ্যবিত্ত মুসলমান জীবনে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব উর্দু ভাষার মাধ্যমে যথেষ্ট প্রতাপশালী হয়ে থাকলো।

কিন্তু মুসলমানী বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বলতে কি বোঝায়? একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে তার অর্থ এমন কোন ভাষা ও সাহিত্য নয় যার মধ্যে মুসলমানদের জীবন এবং তাদের ভাষা প্রতিবিম্বিত হয় ও সমৃদ্ধি লাভ করে। মুসলমান সাহিত্যকরা সে কাজ সুসম্পন্ন করতে পারলে তাতে দোষের তো কিছু থাকতোই না উপরন্তু দ্বারা সামগ্রিকভাবে বাঙলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হতো – ঠিক যেমনটি হিন্দু জীবন চিত্রণের দ্বারা হিন্দু সাহিত্যকেরা শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন বাঙলা ভাষার। যে অল্পসংখ্যক মুসলমান কবি সাহিত্যিকেরা একাজকে সম্ভব করেছিলেন তাঁরা আজও সাধারণভাবে এদেশের হিন্দু মুসলমানের শ্রদ্ধা ও প্রশংসার পাত্র। কিন্তু মুসলমান বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বলতে ক্ষয়িষ্ণু মুসলমান অভিজাতশ্রেণী এবং তাদের প্রভাবপীড়িত মধ্যবিত্তেরা এসব বোঝেননি এবং বোঝাতে চান নি।

মুসলমানী বাঙলা ভাষার অর্থ তাদের কাছে সেই বাঙলা ভাষা যা সংস্কৃত ও সংস্কৃত-উদ্ভূত অর্থাৎ তৎসম ও তদ্ভব শব্দ সম্পূর্ণ বর্জিত। এই আদর্শ এবং লক্ষ্যের দিকেই তাঁদের ধর্মযাত্রা। এই উদ্দেশ্য কামিয়াব করার জন্যে তাঁরা বাঙালী মুসলমানদেরকে যে কর্তব্য নির্দেশ করেছিলেন এবং তাঁদের উত্তরসূরীরা আজও যে কর্তব্য নির্দেশ করে চলেছেন তার অর্থ বাঙলা ভাষা থেকে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি তৎসম তদ্ভব শব্দ খেদিয়ে মুসলমানী বাঙলা ভাষার গুদামঘরকে আরবী ফারসী উর্দু শব্দ দিয়ে বস্তাবোঝাই করা।

এখানে একটি জিনিষ কিন্তু আবার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সংস্কৃত শব্দ হলেই যে অভিজাত এবং মধ্যবিত্ত উগ্রপন্থী তমদ্দুনিক খাদেমেরা সেগুলিকে সব সময় বাতিল করার পক্ষপাতী এ কথা বললে অবশ্যই সত্যের অপলাপ হবে। কারণ এমন কতগুলি তদ্ভব শব্দ আছে যেগুলির ব্যবহারকে তাঁরা যে শুধু স্বীকার করে নিয়েছেন তাই নয়। উপরন্তু সেগুলির ব্যবহারকে মুসলিম বাঙলা চর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে তাঁরা মরণপণ করে আঁকড়ে ধরে আছেন। এজন্যেই দেখা যায় যে হিন্দু এবং মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতির তফাৎ দেখাতে গিয়ে তাঁরা এ শব্দগুলিরই আশ্রয় নেন। উদাহরণস্বরূপ হিন্দুরা যাকে জল বলেন মুসলমানেরা তাকে বলেন পানি (সংস্কৃত-পানীয়), হিন্দুরা যাকে ডিম বলেন মুসলমানরা তাকে বলেন আণ্ডা (সংস্কৃত-অণ্ড)। কেবলমাত্র এগুলিই নয়। নয়া (সং-নব), সুরুজ সং-সূর্য্য) রুটি (সং-রোটিকা), ভাইয়া (সং-ভ্রাতৃ), বহিন (স -ভগিনী), কুঠি (সং-কোষ্ঠিকা), পড়শী (সং-প্রতিবেশী), ঝুটা (স-জুষ্ট), পালঙ্গ (সং-পালঙ্ক), আধা (সং-অৰ্দ্ধ), কাম (সং-কৰ্ম্ম) ইত্যাদি আরও অসংখ্য সংস্কৃত-উদ্ভূত শব্দ আছে যেগুলি তমুদ্দুনিক খাদেমদের মতানুসারে নিঃসেন্দেহে মুসলমানী শব্দ।

কিন্তু শব্দগুলোর এই ধর্মান্তর সম্ভব হলো কেমন করে? এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সূত্র ধরেই বাঙলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতির মরুভূমিতে হাজির হওয়া চলে। উপরোক্ত শব্দগুলো সংস্কৃত-উদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানী শব্দে পরিণত হওয়া কারণ সেগুলি উর্দু ভাষার মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত শ্রেণীর জবান দিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালী মুসলমানদের মাথায় ঢুকেছে। এর অর্থ তাহলে দাঁড়ায় এই যে, কোন শব্দ শুধু সংস্কৃত – উদ্ভূত হলেই যে সেটা বর্জনীয় তা নয়। উর্দুভাষীয় মুসলমানেরা যদি সে শব্দগুলোকে নিজেদের ভাষার অঙ্গীভূত করে থাকেন (উর্দু ভাষার সাথে সংস্কৃতের যোগ শব্দসম্ভারের দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য), তাহলে উর্দুর মাধ্যমে সেগুলিকে বাঙলা ভাষায় আমদানী করলে শব্দগুলির ধর্মান্তর হয় এবং সেগুলিকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে মুসলমানী বাঙলা ভাষার বৈশিষ্ট্য। এ মারফতী যে কেন এবং কি কারণে সম্ভব হয়েছে সেটা সাধারণ মুসলমানদের তো বটেই এমন কি বহু বাজার-গরম করা তমুদ্দুনিক খাদেমদেরই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। কাজেই তাঁরা জলকে ‘পানি’ এবং ডিমকে ‘আণ্ডা’ বলে মুসলমানী বাঙলা ভাষা, ইসলামী তমদ্দুন এবং পাক-বাঙলার কালচারের গোড়ায় জল সেচন করছেন!

তথ্যনির্দেশ

১. Two Mahomedans on Mahomedan Education: Two eminent Mahomedan officers of Government have propounded two schemes for the education of the Mahomedan masses, and as both bring considerable practical knowledge on the subject they threat of, it may not be without interest to discuss the main features of their respective schemes. The two offiers in question are alike distinguised in their respective walks of life. They are none other than Moulvie Abdool Luteef, the Deputy Magistrate of Alipore, and Member of Council, and Syud Ahmed-Khan, the learned and active Principal Sudder Ameen of Ghazipore. Moulvie Abdool Luteef discusses the broad question, whether the education to be imparted to his co-religionists should be wholly Persian and Arabic, or wholly English, or a mixture of both. He justly regrets that his co-religionists in India do not evince the same avidity to learn English as the Hindoos. Himself educated in English, he fully appreciates the advantages of English Education, both to the learner and to the Government that teaches him. “It would be”, say he, “beneficial alike to the Mahomedans and to the Government, If the former could be induced to learn English.” Under the British Government, English is the language of commerce and fast becoming the language of the Courts. If any language in India could lead to the advancement in life of the learner, it is the English. At the same time, the political benefits of the education of the Mahomedans in English, both to themselves and to the Government, are many and apparent. The Mahomedan who has been eaucated in English can understand the motives of the Government. He knows the power, intelligence, perseverance and resources of the British Nation. His attachment to the Government rests on a firm basis. He cannot be misled and no one will attempt to mislead him. He knows that the safety of life and property depends upon the stability of the British Rule, and will naturally resent any attempts by his ignorant and misguided countrymen against that stability. He will do his utmost to persuade all within his influence of the benefits of the British Rule and where his representations of those benefits fail, his representations of the power of Government might deter them from evil designs against it.

But the Mahomedan Religion and Mahomedan society, continues the Moulvie, exact from the followers of the one and the memberes of the other, the study above all others of the Persian and the Arabic languages. In fact, no Mahomedan would be considered, and we think justly too, a gentleman, who was not possessed of a respectable knowledge of his National Classics. The pride which the Mahomedan takes in his National Literature is, in our opinion, a sign of National greatness. But at the same time we must condemn the illiberality and bigotry which seek to confine knowledge to the teachings of Arabic authors only, the dominion of the mind should not be limited to one particular region. Its scope should be as wide and catholic as practicable. Moulvie Abdool Luteef proposes a combination of the study of English with that of the Persian and Arabic. He says, “The fruits of English Education will show off to the best advantage, in conjunction with scholarship in the Mahomedan Classics. Unless a Mahomedan in a Persian and Arabic scholar, he cannot attain a respectable position in Mahomedan Society, i.e, he will not be regarded of respected as a scholar, and unless he has such a position, he can have no influence in the Mahomedan community. Consequently, a Mahomedan who has a English Education, and has omitted the study of the Persian and Arabic, is little able to impart the benefits of that education to the members of his community; he cannot persuade others into an appreciation of the beneficene of the British Rule and the greatness of the British power. But, if he knows Persian and Arabic along with English he acquires influence in society and is, of course, sure to use his influence in the interests of the Government. …

The Scheme of Syud Ahmed Khan will make a fit supplement to the above. The people’s Friend furnishes the leading features of that Scheme, which are as follows:-

“Syud Ahmed Khan proposes to establish a Society the object of which is to print cheaply and well in Hindi, Urdoo, Persian and Arabic -Ist, the best works of our own authors, and 2nd, transtlaions of the best works of European and American authors.

The society will consist of Members paying a monthly subscription of Rs 2 each (one year’s subscription paid in advance) to meet such portion of the necessary expenses of the project as may not be covered by the sale of the books published. Members will receive gratis one copy of each work published by the Society. In the admission of members no distinction of caste, creed, of place of birth will be made. One great and holy bond of union will exist between all, a desire to advance the cause of enlightenment and civilisation and do good to their fellow creatures.

Through friends and members, depots for the sale of books should be established in every large town in these provinces, and the object of the Society should be to publish very few but very good books and secure a very large sale of these at a very low rate.

It apprears that the want of good books is as much felt by mohomedans as by Hindus. It is essentail to a sound system of elementary education that good, useful and cheap books should be multiplied. The agency proposed by Syud Ahmed khan is certainly best suited to that end. But we would warn Syed Ahmed Khan of the mistakes of the Vernacular

Literature Society. We glad to note that the composition of Syud Ahmed Khan’s Society will not be restricted to race, color or creed. Its catholic constitution will conduce to catholicty of taste and views, we hope Mahomedans of all ranks, who have the welfare of their community at heart will join this Society. The present is a turning point in their national existence in India. The Government is fully alive to the task of their regeneration and deep is the interest which members of government individually take in this great and work. They have no two more earnest and sincere friends of their Community than the Lieutenant-Governor of Bengal and our Finance Minister, and their leaders will commit a fatal mistake if they let slip this golden opportunity to regenerate their co- religionists, who form one sixth of the population of India.”-The Hindoo Partriot, Calcutta. October 26th, 1863.

2. Answers to question no. 4: I have already, in the course of my answers to the pervious questions, anticipated the subject of the vernacular Language, which I think should be taught to Mahomedans in Bengal. Briefly summarised, my opinion as regards Bengal is that Primary Instruction for the Lower classes of the people, who for the most part are ethnically allied to the Hindoos, should be in the Bengali Language- purified, however from the superstructure of Sanskritism of learned Hindoos and supplemented by the numerous words Arabic and Persian origin which are current in everyday speech; for this the Bengali of the Law-courts furnishes a good example.

For the middle and the upper classes of Mahomedans, the Urdoo should be recognized as the vernacular. That is the Language which they use in their own society in the town and country alike and no Mahomedan would be received in respectable Society amongst his own co-religionists if he were not acquainted with Urdoo. The middle and upper classes of Mahomedans are descended from the origional conquerors of Bengal, or the pious, the learned, and the brave man, who were attracted from Arabia, Persia and Central Asia to the Service of the Mahomedan Rulers of Bengal; of from the Principal officers of Government, who, after the absorption of the province into the Empire of Delhi, were appointed and sent from the Imperial court, many of whom permanently settled in these parts. All these, for the most part, naturally retain the Urdoo as thier Vernacular. I need not however dwell at any length upon the importance of imparting the earliest lessons in the Vernacular of the pupil. I think that these linguistic drawbacks and difficulties prove a great stumbling block in the path of Mahomedan students in the existing system of education, and can to some extant account for their dificient progress. [From a footnote of Nawab Abdul Leteef’s A Short Account of My Humble Efforts To Promote Education Specially Among The Mahomedans.]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *