ছাত্র রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন

ছাত্র রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন

ছাত্র রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই দেশের সাধারণ রাজনৈতিক অবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পূর্ব পাকিস্তান সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতির আলোচনাকালেও তাই এ দেশের সাধারণ রাজনৈতিক অবস্থাকে উপেক্ষা করা চলে না। পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। নানা শ্রেণীর শিল্পশ্রমিকদের সংখ্যাও আজ ক্রমাগত বর্তমান। কিন্তু এই সংখ্যাগুরুত্ব সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে কৃষক ও শিল্পশ্রমিকেরা তুলনায় অনেক গুরুত্বহীন এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি আজ মধ্যবিত্ত – কেন্দ্রিক। এই মধ্যবিত্তকেন্দ্রিকতার দ্বারাই এ দেশের রাজনীতির চরিত্র আজ প্রায় সর্বতোভাবে গঠিত।

কিন্তু মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক রাজনীতির অর্থ কি? পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা এবং আন্দোলনসমূহকে বিশ্লেষণ করলেই এর অর্থ পরিষ্কার হবে। প্রথমেই চোখে পড়বে যে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির কর্মসূচীর মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকলেও মূলতঃ এগুলি নানা-প্রকার দেশহিতৈষী কার্যের প্রতিশ্রুতিতে অতিশয় মুখর। এ প্রতিশ্রুতির দৈর্ঘ্য কৃষক শ্রমিক থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের অবস্থার উন্নতি পর্যন্ত প্রসারিত। কিন্তু এই বিস্তৃত প্ৰতিশ্ৰুতি সত্ত্বেও তাদের বাস্তব কার্যক্রমের মধ্যে দরিদ্র চাষীমজুরদের দাবী দাওয়া নিয়ে কোন সুষ্ঠু, শক্তিশালী এবং দেশব্যাপী আন্দোলনের প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় না। শুধু তাই নয়। রাজনৈতিক দলগুলির বিশিষ্ট নেতা এবং কর্মীরা সাধারণতঃ গ্রামদেশের সত্যিকার অবস্থা এবং ভূমিহীন ক্ষেতমজুর থেকে শুরু করে অন্যান্য বহু শ্রেণীর চাষী মজুরদের সমস্যাসমূহের সাথেও যথাযথভাবে পরিচিত নন। এজন্যে তাঁরা এদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে খোলা মাঠে অনেক সময় অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা দান করলেও কোন্ সমস্যার চরিত্র কি এবং তার সমাধানের জন্যে কোন্ পথ অবলম্বন করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞানের পরিধি বিস্ময়করভাবে সীমাবদ্ধ। এটাই অন্যতম কারণ যার জন্যে এদেশের চাষী মজুরদের সমস্যা নিয়ে কোন বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত এখনো সম্ভব হয় নি 1

স্বাধীনতার পর থেকে কৃষক শ্রমিকদের অবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হলেও মধ্যবিত্তশ্রেণী ক্রমাগত বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে কারণ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নতি বর্তমানে যে খাতে প্রবাহিত তাতে শ্রেণীগতভাবে মধ্যবিত্তরাই সর্বাপেক্ষা উপকৃত। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যবিত্তের প্রগতি এবং উন্নতির গতি কিন্তু আজ সমান নয়। পূর্ব পাকিস্তান একদিক দিয়ে পশ্চিমের থেকে অনেকখানি পিছিয়ে আছে এবং মধ্যবিত্তের এই পশ্চাদপদতাই রূপান্তরিত হয়েছে বর্তমান পাকিস্তানী রাজনীতির তীব্রতম সমস্যারূপে। আজকের রাজনৈতিক আন্দোলনের সীমানা তাই একদিকে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্ন এবং অন্যদিকে দুই অংশের সমান উন্নতির প্রশ্নের দ্বারাই বিশেষভাবে চিহ্নিত। এজন্যেই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই প্রচলিত সংবিধান সংশোধন, সংরক্ষণ অথবা বর্জন করার চিন্তায় এখন নিমগ্ন হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানী মধ্যবিত্তের মধ্যে আজ উপার্জন, উপভোগ এবং সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষা অন্য সব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আদর্শকে আচ্ছন্ন করে নিজেকে ব্যাপ্ত করেছে চতুর্দিকে। এ ব্যাপ্তি এবং প্রতাপে আপাততঃ বাধা দেওয়ার ক্ষমতা পূর্বাঞ্চলের অন্য কোন শ্রেণীর নেই। এ বাধা বর্তমানে আসছে পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যবিত্তের থেকে। পূর্ব ও পশ্চিমের ভাগ বাঁটোয়ারার ক্ষেত্রে সমতার অভাব এই দুই অংশের মধ্যবিত্ত পরস্পরের সাথে রেষারেষি এবং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। উদ্যত হয়েছে তারা পরস্পরকে যথাসাধ্য খর্ব করতে, ঠিক যেমনটি স্বাধীনতাপূর্ব পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান মধ্যবিত্ত নিযুক্ত হয়েছিল পরস্পরের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে খর্ব করতে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এই পার্থক্য ও প্রতিযোগিতা শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারাই স্বীকৃত নয়। বর্তমান সংবিধানেও একথা স্বীকৃত হয়েছে এবং এটাই আজ পাকিস্তানের মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক রাজনীতির বাস্তবতা।

দুই

ছাত্র সম্প্রদায় শিক্ষাদীক্ষা, স্বার্থ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির দিক থেকে সম্প্রদায় হিসাবে নিশ্চিতভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। আমাদের দেশের ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র গ্রাম্য পরিবারভুক্ত হলেও শিক্ষালাভকালে এবং বিশেষ করে তার পরবর্তী পর্যায়ে তাদের মানসিকতা মধ্যবিত্তসুলভ স্বার্থচিন্তার দ্বারা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ দারিদ্রপীড়িত পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশে মানুষ হলেও তাদের নোতুন শিক্ষা তাদের জন্য প্রস্তুত করে নানান সুযোগ-সুবিধার বিস্তৃত ক্ষেত্র। এ সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করার প্রবণতা ও প্রচেষ্টা মানুষের পক্ষে নিতান্ত স্বাভাবিক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রতিরোধ্য। কাজেই ছাত্রসম্প্রদায়ভুক্ত কেউ কেউ মধ্যবিত্ত শ্রেণীস্বার্থ উপেক্ষা করতে সক্ষম হলেও সাধারণভাবে তারা এ শ্রেণীর দোষগুণের দ্বারাই মোটামুটিভাবে গুণান্বিত।

কিন্তু মধ্যবিত্তশ্রেণীভুক্ত হলেও ছাত্রসম্প্রদায়ের সাথে অন্যান্যদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। তাদের বয়স অপেক্ষাকৃত অল্প থাকায় এবং কোন উপার্জন কর্মে তারা সরাসরিভাবে লিপ্ত না থাকার ফলে তাদের মধ্যে শ্রেণীস্বার্থের চেতনা থাকলেও সেটা ততখানি প্ৰবল হয়ে দেখা দেয় না। একারণেই তাদের মধ্যে কিছু পরিমাণ আদর্শ চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি এজন্য তাদের দৃষ্টি স্বভাবতঃই উপার্জনরত মধ্যবিত্তের তুলনায় কিছুটা বেশী পরিমাণে নিবদ্ধ থাকে। সম্প্রদায়গতভাবে ছাত্রদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের এটাই অন্যতম কারণ।

কিন্তু শিক্ষা এবং আদর্শবাদ ছাত্র রাজনীতির অন্যতম প্রধান নির্ণায়ক হলেও সে রাজনীতির গুরুত্বকে এর দ্বারা ব্যাখ্যা করা চলে না। তার জন্য প্রয়োজন দেশের সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টিপাত করা। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ছাত্র রাজনীতি যে যে দেশে যত বেশী প্রবল ও প্রতাপশালী সে দেশে সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাব ও সংগঠন ততখানি দুর্বল। এর কারণ দেশের বিবিধ সমস্যার সমাধান সম্পর্কে বৃহত্তর রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে যদি গঠনমূলক চিন্তা এবং সাংগঠনিক প্রচেষ্টা না থাকে তাহলে সমাজের মধ্যে শিক্ষা এবং আদর্শবাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছাত্র সম্প্রদায়ই সেখানে আবির্ভূত হয় রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকায়। এ ভূমিকা পালনে ছাত্র সম্প্রদায়ের অনুকূলে আর একটি অবস্থাও সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে।

শ্রমিকেরা যেমন তাদের কারখানাকে কেন্দ্র করে একটা সঙ্ঘবদ্ধ জীবন যাপন করে ছাত্ররাও তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত হলেও নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ছাত্রাবাসে এবং অন্যান্যভাবে কিছুটা সঙ্ঘবদ্ধ জীবন যাপন করার সুযোগ পায়। এর ফলে মধ্যবিত্তের অন্যান্য অংশ থেকে সাংগঠনিক কার্যকলাপ পরিচালনা করার সুবিধা ছাত্র সম্প্রদায়ের ছাত্র হিসাবে অনেক বেশী। সামান্য প্রচেষ্টাতেই তারা নিজেদেরকে অনায়াসে একত্রিত করতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এ সুবিধার গুরুত্ব কম নয়।

কাজেই ছাত্র রাজনীতির মূল কারণগুলি হলো দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি ও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব, অল্প বয়স ও শিক্ষার জন্য তাদের আদর্শবাদ ও সমাজচেতনা এবং শিক্ষার প্রয়োজনে তাদের সঙ্ঘবদ্ধ জীবনযাপন। এ কারণগুলির মধ্যে প্রথমটি আবার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যদি যথার্থভাবে বিভিন্ন সমস্যার দূরীকরণের প্রতি তাদের প্রচেষ্টাকে পরিচালিত করে তাহলে ছাত্ররাজনীতি সাধারণভাবে খুব বেশী প্রভাবশীল হতে পারে না। কিন্তু এর অন্যথা হলে সেটা সহজেই সম্ভব হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোন দেশে বৃহৎ এবং সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলসমূহ সুষ্ঠুভাবে নানা ক্রিয়াকর্ম পরিচালনা করা সত্ত্বেও কোন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে উপেক্ষা করলে সেই বিশেষ ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব সে দেশে নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। এটাই প্রধান কারণ যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে উপলক্ষ করে সেখানকার ছাত্র সম্প্রদায় আজ রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে অনেকখানি সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রজাতন্ত্রী এবং গণতন্ত্রী উভয় দলই ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে চরম প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুসরণ করে চলেছে। এর কারণ এই যুদ্ধের সাথে উভয় দলেরই শ্রেণীস্বার্থ সরাসরিভাবে যুক্ত। কিন্তু মার্কিন ছাত্র সম্প্রদায় সমশ্রেণীভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের বিশেষ সম্প্রদায়গত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সাধারণ প্রজাতন্ত্রী অথবা গণতন্ত্রীর মতো ততখানি কঠিনভাবে শ্রেণীস্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ নয় এবং এজন্যই তারা ভিয়েতনামে ‘গণতান্ত্রিক’ মার্কিনী হামলার বিরুদ্ধে এত জোরালো এবং ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করতে সক্ষম।

তিন

কিন্তু এসব সত্ত্বেও ছাত্র রাজনীতির কতকগুলি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আছে, যার মধ্যে সর্বপ্রধান হলো তাদের গঠনগত চরিত্র। এ ক্ষেত্রে তাদের সাথে শিল্পশ্রমিকদের পার্থক্য সহজেই লক্ষিত হবে। ছাত্রেরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে শ্রমিকদের মতো বাস করলেও এ জীবন তাদের অতি অল্প-কাল স্থায়ী। অর্থ্যাৎ শ্রমিক তার সমস্ত জীবনব্যাপী শ্রমিকই থাকে কিন্তু রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ছাত্রের ছাত্রাবস্থা কয়েক বৎসরের বেশী স্থায়ী হয় না। ছাত্র সম্প্রদায় বজায় থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রেরা তাদের অধ্যয়নকালীন জীবন উত্তীর্ণ হয়ে অবতীর্ণ হয় জীবনের বিস্তীর্ণ কর্মক্ষেত্রে, ছড়িয়ে পড়ে শহরে-বন্দরে, দেশ-দেশান্তরে। এর ফলে তাদের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধ জীবন এবং ভাবনাহীন চিত্তের আদর্শবাদ এ দুইয়েরই অবসান ঘটে। নদীর স্রোতের মতো ছাত্র সম্প্রদায় গতিশীল হওয়ার ফলে ব্যক্তিবিশেষ সেই স্রোতের গতিতে ভেসে যায় এবং এই ক্ষণস্থায়িত্বের কিছুতেই ঘোচে না। কর্মীরা কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় শেষের দিকে কিছুটা দক্ষ এবং রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হয়, কিন্তু তারপরই তারা অবতীর্ণ হয় বৃহত্তর জীবনক্ষেত্রে, সুযোগ সুবিধা স্বার্থ রক্ষার রণক্ষেত্রে। ক্ষেত্রবিশেষে অল্প- সংখ্যক ছাত্র পরবর্তী জীবনেও রাজনীতির সাথে জড়িত থাকে কিন্তু যে অসংখ্য ছাত্রদের নিয়ে ছাত্র রাজনীতি তাদের প্রায় সকলেই নিজেদেরকে বিযুক্ত করে সক্রিয় রাজনীতি থেকে। এই গতিশীলতার জন্য ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে কোন বলিষ্ঠ এবং দীর্ঘমেয়াদী নেতৃত্বের সম্ভাবনা থাকে না, যেমনটি থাকে কৃষক শ্রমিক এবং অন্যান্য শ্রেণী-স্বার্থভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলনের মধ্যে। ছাত্র সমাজের রাজনীতি এ জন্যেই ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যবিত্ত স্বার্থকে উপেক্ষা করে কৃষকশ্রমিক এবং বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার প্রতি সচেষ্ট হলেও সে চেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাদের ক্রিয়াকর্ম আবার আবর্তিত হতে থাকে মধ্যবিত্ত স্বার্থকে কেন্দ্র করে। এজন্যই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে দুর্বলতার কারণে ছাত্র রাজনীতি প্রভাবশালী হলেও তার মধ্যে কোন সুদূরপ্রসারী ও বৈপ্লবিক সম্ভাবনা থাকে না। সে সম্ভাবনা দেখা দেয় একমাত্র তখনই যখন ছাত্র সম্প্রদায় দেশের সর্বপ্রধান বা অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত না হয়ে কোন বৃহত্তর ও সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন এবং প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে রাজনীতি-ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়।

বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের অবর্তমানে এবং রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রেরণার অভাবে ছাত্র রাজনীতি দেশে সুষ্ঠু নীতি গঠনকার্যে খুব বেশী সহায়ক হয় না। অধ্যয়নকাল উত্তীর্ণ হলে নিজেদের রাজনৈতিক জীবনকে টিকিয়ে রাখার শক্তি তারা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্য কোথাও থেকে সঞ্চয় করতে পারে না। এ জন্যে দেখা যায় যে, যে-সমস্ত ছাত্ররা ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির মধ্যে খুব বেশী নিমজ্জিত থাকে তারা প্রথমতঃ সচেষ্ট হয় নানাভাবে তাদের ছাত্রজীবনকে দীর্ঘতর করতে এবং পরিশেষে যখন সেটা আর সম্ভব হয় না তখন তারা নিযুক্ত হয় তাদের গার্হস্থ্য জীবন গঠনকার্যে।

চার

পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তার মধ্যে আজ যথেষ্ট সুবিধাবাদ, নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এর জন্য ছাত্রদের নিজেদের থেকে দেশের সামগ্রিক অবস্থাই অনেক বেশী দায়ী। কাজেই বর্তমান অবস্থাকে সেই পটভূমিকাতেই বিচার করতে হবে। এ দেশের মধ্যবিত্তের মধ্যে সুবিধাবাদের আধিপত্য উৎকটভাবে বৃদ্ধিলাভ করেছে এবং তার দ্বারা ছাত্র সম্প্রদায়ও এখন দারুণভাবে আচ্ছন্ন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এজন্যই দেখা যায় যে এখনকার ছাত্রেরা আগের থেকে রাজনীতি- ক্ষেত্রে অনেক বেশী সক্রিয় হলেও তাদের মধ্যে যথার্থ আত্মত্যাগ এবং স্বার্থহীনতার উদাহরণ খুব উল্লেখযোগ্য নয়। যারা ছাত্ররূপে রাজনীতিতে অংশ নেয় এবং দেশের কল্যাণ কামনা করে এ বিষয়ে তাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আশু সুবিধার কথা চিন্তা না করে সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলের পরিপ্রেক্ষিতে যদি তারা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে তাহলেই এ দুর্বলতা তারা অনেকাংশে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হবে। শুধু তাই নয়। সে অবস্থায় তাদের চিন্তা এবং কর্মের মধ্যে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা এবং মধ্যবিত্তসুলভ সুবিধাবাদের পরিবর্তে দেখা দেবে সুস্থ সমাজ চেতনা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ চিন্তা। একমাত্র তখনই তারা সক্ষম হবে বিভিন্ন সমস্যা ও ঘটনার প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল চরিত্র এবং শত্রুমিত্রের ভেদাভেদ নির্ণয় করতে। অন্যথায় শত্রুকে মিত্র ও মিত্রকে শত্রুজ্ঞান করে এবং নানান সমস্যার যথার্থ চরিত্র নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়ে তারা নিজেদের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে সৃষ্টি করবে নৈরাজ্য যার ফলে দেশের প্রগতিশীল শক্তির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহই হবে অধিকতর সমৃদ্ধ ও শক্তিসম্পন্ন।

ছাত্র রাজনীতির মধ্যে মধ্যবিত্তসুলভ সুবিধাবাদকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আবার ছাত্রদের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত হওয়া অসম্ভব। কারণ রাজনীতি-ক্ষেত্রে ছাত্রদের প্রভাব স্বাভাবিক না হলেও সেটা দেশের সামগ্রিক দুরবস্থার অন্যতম উপসর্গ। দেশের বর্তমান আর্থিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থার অবসান না ঘটলে ছাত্র রাজনীতির এ প্রভাবের অবসানও কিছুতেই ঘটবে না।

কাজেই ছাত্রেরা রাজনীতি করবে। এখন প্রশ্ন হলো নানা অসুবিধাজনক অবস্থার মধ্যে এ রাজনীতি কিভাবে দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারে। এ প্রশ্ন-বিচার সব দিক থেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পাঁচ

সুস্থ সাংস্কৃতিক জীবনগঠনের আন্দোলন প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু তাই নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ব্যতীত কোন সুস্থ রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পূর্ণ অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক জীবন আজ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাই এই সংকটের প্রধান কারণ। পাকিস্তান আদর্শবাদী এবং ইসলামী রাষ্ট্র এই অজুহাতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে, বিশেষতঃ নিম্ন পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। এর ফলে বাঙলাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রদের যোগাযোগ সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাঙলা ভাষার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদালাভ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিতান্তই মৌখিক ব্যাপার। কারণ বাঙলা ভাষা যে সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বাহন সেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বাঙলা ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে এক শ্রেণীর লোক আজ দারুণ সচেষ্ট। এ প্রচেষ্টা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক তাতে সন্দেহ নেই। পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে তার সমগ্র চিন্তা-ভাবনার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার জাল বিস্তার করতে সক্ষম হলে সত্য অর্থে এ দেশের লোকের পক্ষে কোন প্রগতিশীল আন্দোলনের সূত্রপাত পর্যন্ত করা সম্ভব হবে না একথা খুব সহজবোধ্য। সাম্প্রদায়িকতাকে সহস্র উপায়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করার প্রচেষ্টা পাকিস্তানে অত্যন্ত সক্রিয় এবং যথেষ্ট কার্যকরী। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দান করলেও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রভাব সৃষ্টি দ্বারা তারা বাঙলা ভাষার সত্যিকার চর্চা এদেশে আজ বন্ধ করতে উদ্যত। সাংস্কৃতিক জীবনে এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল পূর্ব পাকিস্তানে অনেকাংশে সফল হয়েছে। এ জন্যেই পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্রেরা নিজেদের ক্ষতিসাধন না করে রমজানের সময় ইস্কুল কলেজ করলেও পূর্ব পাকিস্তানে রমজানের ছুটি ‘ধর্মীয় কারণে অবশ্যই হতে হয়। এবং সেটা হয় প্রধানতঃ ছাত্রদের দাবীর জোরে। এ জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানে রবিবারে ইস্কুল কলেজ বন্ধ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে শুক্রবার হলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ জন্যই আমরা আরবী ফারসী বহুল উদ্ভট বাঙলাতে লেখা যে কোন বইকে ইসলামী সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ মনে করে আত্মহারা হই এবং সংস্কৃত শব্দ-সম্বলিত বাঙলায় লেখা সাহিত্যকে বিজাতীয় এবং বিধর্মী জ্ঞানে বর্জন করার আওয়াজ তুলি। এই সাম্প্রদায়িক প্রভাবের জন্যই আমরা প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারীতে মাতৃভাষার জন্য অশ্রুপাত করলেও নানাভাবে সেই মাতৃভাষার চর্চা এবং প্রগতিকে বদ্ধ এবং রুদ্ধ করার প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে দ্বিধাবোধ করি না।

পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র সম্প্রদায় সমাজতান্ত্রিক কারণে রাজনীতি করবে। কিন্তু ছাত্রেরা যদি তাদের এবং সমগ্র দেশের রাজনীতিকে সুস্থ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে বর্তমানের কলুষিত রাজনৈতিক আবহাওয়াকে পরিচ্ছন্ন করতে চায় তাহলে তাদেরকে আজ সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। তাদেরকে দেখতে হবে এ জীবনকে নানাভাবে পঙ্গু করার জন্য কোন্ কোন্ শক্তি কত বিভিন্ন উপায়ে এখন সক্রিয় এবং এ শক্তিসমূহকে বিনাশ করার উপায় কি। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য ছাত্র সম্প্রদায় সম্প্রদায় হিসাবে অত্যন্ত উপযুক্ত। এর মাধ্যমেই তারা পূর্ব পাকিস্তানের সত্যিকার প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাতে যথার্থভাবে সহায়ক হতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *