রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি

রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি

পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা এবং রক্ষা করার স্বর্গীয় দায়িত্ব যাঁরা গ্রহণ করেছেন তাঁদের মতে রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু’ ‘এবং ভারতীয়; কাজেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে অথবা রবীন্দ্র- কাব্যসাহিত্যের চর্চা করলে এদেশের ‘তৌহিদবাদী’ মুসলমানদের দুনিয়া এবং আখেরাত দুইই বরবাদ হবে। এই সমস্ত সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক ব্যক্তি আছেন যাঁরা মাত্র কিছুকাল আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে দিন গুজরান করেছেন। এখন রবীন্দ্রচর্চার দ্বারা আর বিশেষ সুবিধা নেই, কাজেই তাঁরা রবীন্দ্র-বিরোধী। তাঁদের প্রধান যুক্তি এই যে, রবীন্দ্রনাথ বাঙলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও পূর্ব পাকিস্তানী সংস্কৃতির তিনি কেউ নন। অর্থাৎ তাঁদের মতে পূর্ব পাকিস্তানী সংস্কৃতির সাথে বাঙলা সাহিত্য সম্পর্কহীন।

রবীন্দ্রবিরোধী এই আন্দোলনকে প্রথম দৃষ্টিতে উন্মাদ মনে হলেও আসলে এটা যে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা বিরোধী আন্দোলন একথা বোঝার জন্য খুব বেশী মস্তিক চালনার প্রয়োজন হয় না। এ আন্দোলন ১৯৪৮ বা ১৯৫২ সালের মতো সরাসরি বাঙলাকে অস্বীকার এবং বাতিল করার আন্দোলন নয়। এ আন্দোলন তার থেকে অনেক সূক্ষ্ম এবং পরোক্ষভাবে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যকে পঙ্গু করার আন্দোলন। এর অনেক দিক আছে এবং রবীন্দ্রবিরোধিতা তারই একটি। এ বিরোধিতাকে তাই বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে এর চরিত্রকে একটি সামগ্রিক পটভূমিতে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সেটা করলে দেখা যাবে যে রবীন্দ্র- বিরোধিতা, বাঙলা ভাষা সরলীকরণ, নববর্ষ উৎসব বন্ধ করার প্রচেষ্টা ইত্যাদি সমস্তই একই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বরং এ উদ্দেশ্যের সাথে ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের বাঙলা ভাষা- বিরোধী প্রচেষ্টা ওতপ্রোত যোগসূত্রে জড়িত।

পূর্ব পাকিস্তানকে যে বহুদিন থেকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে একথা আজ প্রায় সর্ববাদীসম্মত। এ দেশের সাংস্কৃতিক জীবনও আজ পঙ্গুদশাপ্রাপ্ত। যে কোন দেশের অথবা দেশের অংশবিশেষের সাংস্কৃতিক বিপর্যয় এবং পঙ্গুত্ব তার সামগ্রিক জীবনকে আচ্ছন্ন করতে বাধ্য। তার দেশপ্রেম, আত্মসম্মানবোধ এবং গৌরবচেতনা সব কিছুই তার সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে অবিচ্ছিন্ন এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে পঙ্গু এবং বিধ্বস্ত করতে সমর্থ হলে পরোক্ষভাবে সে সমাজের সামগ্রিক জীবনকে পঙ্গু ও বিধ্বস্ত করার কাজ অনেকখানি সফল ও দ্রুততর হয়। এখনকার রবীন্দ্রবিরোধিতা এবং বাঙলা ভাষা সরলীকরণের প্রচেষ্টা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সামগ্রিক জীবনকে এইভাবে বিধ্বস্ত করারই এক সূক্ষ্ম এবং দূরদর্শী পরিকল্পনা।

রবীন্দ্রসঙ্গীত বাতিল করার আন্দোলন রবীন্দ্রবিরোধিতার শেষ পর্যায় নয়। এটা একেবারে প্রথম পর্যায়। এরপর ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের কাব্য, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, চিঠিপত্র সব কিছুর মধ্যে ‘তৌহিদবাদ-বিরোধী’ মালমসলা যথাসময়ে আবিষ্কৃত হবে এবং মুমীনের দল সেগুলো বরদাশত করতে নারাজ বলে ঊর্ধ্ব গগনে মাদল বাজিয়ে ধরণীতল উতলা করবেন। এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাতিলের চেষ্টা হচ্ছে রেডিও-টেলিভিশন থেকে, তখন রবীন্দ্র- কাব্যসাহিত্য সম্পূর্ণভাবে বাতিল হবে পাঠ্যপুস্তক থেকে। কারণ রবি ঠাকুরের গান শুনলে যদি ধর্মনাশ হয় তাহলে তাঁর কাব্যসাহিত্য চর্চা করলে দেশের ধর্মরক্ষা পাবে কেমন করে? এ যুক্তি নিতান্তই অকাট্য এবং প্রথমটি স্বীকার করলে দ্বিতীয়টি অস্বীকার করার উপায় থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু’ এবং ‘ভারতীয়’, এই দুই কারণে তাঁকে নাকি বাতিল করা উচিত। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, তক্ষশীলাকে এঁরা পাকিস্তানের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে সগৌরবে প্রচার করে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাঁদের যত দুশ্চিন্তা এবং আপত্তি পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। এদেশের লোকের ঠুনকো ঈমান কোন্ কবিতা, গান অথবা উপন্যাসের দ্বারা বিনষ্ট হতে পারে সেদিকে তাঁদের সতর্ক দৃষ্টি। এ মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে কাফেরদের বর্জন করতেই হবে এবং তার সাথে মুনাফেকদেরকেও।

রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে ভারতীয়, কাজী নজরুল সে অর্থেই রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেক বেশী ভারতীয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তানের পূর্বেই দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু নজরুল ইসলাম এবং তার পরিবারের লোকজন সকলেই ভারতে এখনো দেহধারণ করে আছেন। নজরুল ইসলামকেও কি তাহলে বাতিল করা দরকার?

একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে নজরুলকে বাতিল করার ব্যাপারটি এখন আর ভবিষ্যতের হাতে নেই। বাতিল তিনি এমনিতেই হয়ে আছেন। কারণ তাঁর সমগ্র সাহিত্য এবং সঙ্গীত সাধনার সাথে পূর্ব পাকিস্তানীদের পরিচয়ের কোন সুযোগই রাখা হয় নি। রেডিওতে তাঁর কতকগুলি বাঁধাধরা গান ব্যতীত অন্য কোন গান দেওয়া হয় না। এমনকি অনেক সময় তাঁর গানের শব্দ পরিবর্তন করেও গাওয়া হয়। এসবের কারণ নজরুলের এই গানগুলি ‘তৌহিদবিরোধী’।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে মুমীনের দল যতখানি আত্মবিশ্বাসের সাথে মাদল বাজিয়েছেন, নজরুলের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে ততখানি করার সাহস তাঁদের এখনো নেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বিশ্বাসের বিস্ফোরণ হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ নজরুল-রবি ঠাকুরকে বাতিল না করলে হাতিম তাঈয়ের পুঁথি, কাওয়ালি আর মর্সিয়া সাহিত্যে রসিকজনের মনে বসবে কেন?

রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হলেও তিনি নাকি হিন্দু। উপনিষদ ইত্যাদির প্রভাবে তাঁর মানসচরিত্র অনেকাংশে গঠিত, এই অর্থে ধরে নেওয়া গেল তিনি হিন্দু। কিন্তু তাঁকে বাতিল করলে রক্ষা পায় কে? মাইকেল খৃষ্টান হলেও ঐ একই কারণে হিন্দু। ঈশ্বরচন্দ্র নাস্তিক হলেও তাই। বঙ্কিম-শরৎচন্দ্রের তো কথাই নেই। এ যুক্তি-স্রোতের ফল দাঁড়ায় এই যে পূর্ব পাকিস্তানীদের ঈমান রক্ষার জন্য সব হিন্দু সাহিত্যিকদের বাদ দেওয়া প্রয়োজন। এমনকি যে-সমস্ত মুসলমান লেখক হিন্দু-ঘেঁষা, তাঁদেরকেও সমানভাবে বাতিল করা দরকার। এই বাতিল কার্য সুচারুভাবে সমাধা করার পর যে সমস্ত জ্যোতিষ্ক পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যগগনে নিজেদের স্বর্গীয় আলোক দান করবেন, তাঁরা জন্মগ্রহণ না করলেও মানবজাতি অথবা বাঙলা সাহিত্যের কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না। কিন্তু মানবজাতি বা বাঙলা সাহিত্যের ক্ষতি না হলেও এতে তাঁদের নিজেদের ষোল আনা মুনাফা (আমাদের সৌভাগ্যবশতঃ এঁদের অধিকাংশই এখনো জীবিত)। এ মুনাফা সংগ্রহ করতে কোন সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই অস্বীকৃত হতে পারে না। কাজেই রবীন্দ্র কাব্যসাহিত্য সঙ্গীত বাতিল করে পুঁথির বাজার গরম করা প্রয়োজন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে দ্রুতগতিতে জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল তার কারণ রাষ্ট্রভাষার সমস্যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুতর সমস্যাসমূহের সাথে ছিল অবিচ্ছিন্ন। বাঙলা ভাষাকে একটা নামমাত্র স্বীকৃতি দান করলেও আজ চারদিক থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর যে আক্রমণ শুরু হয়েছে সে আক্রমণকে সাফল্যের সাথে প্রতিরোধ করতে হলে ভাষা ও সাহিত্যের সাথে বৃহত্তর জীবনের নিবিড় ও গভীর যোগাযোগের বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া দরকার। এ চেতনা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর অন্তরে জাগ্রত হলে তারা এ দুরভিসন্ধিমূলক প্রচেষ্টার স্বরূপ নিজেরাই উদ্ঘাটন করতে পারবে এবং বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাকে অব্যাহত রাখার আন্দোলনে তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মতোই সফলকাম হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *