শালিনী ভালো আছে
শালিনী নামে এক চমৎকার মেয়ের সঙ্গে কৌশিক নামে এক চমৎকার ছেলের প্রেম হয়েছে। শালিনী অফিসে চাকরি করে। কৌশিককে বলা আছে যেন অফিসটাইমে ফোন না করে। প্রয়োজনে মেসেজ চলতে পারে। তাও দুটোর বেশি নয়।
কৌশিক অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘কেন! মেসেজ দুটোর বেশি নয় কেন? মেসেজে কী সমস্যা?’
‘সমস্যা আছে। তুমি বুঝবে না। একটা অল্পবয়সি মেয়ে অফিসে বসে যদি রাতদিন পুটুরপুটুর করে মেসেজ করে…।’ এইটুকু বলে চুপ করে গেল শালিনী।
কৌশিক ‘কাঁধ ঝাঁকানো’ গলায় বলল, ‘তো কী?’
শালিনী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তো কী বুঝতে পারছ না?’
কৌশিক গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, ‘না, পারছি না। সরকারি চাকরিতে দুটোর বেশি মেসেজ করা বারণ আছে নাকি!’
শালিনী আদুরে ভঙ্গিতে বলল, ‘অবুঝের মতো কথা বোলো না সোনা। দুটো-তিনটে বড় কথা নয়। ঘন ঘন মেসেজ এলে লোকে কী ভাববে? সন্দেহ করবে। মেয়ের বিয়ে থা হয়নি, কাজ ফেলে সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে আছে। এটা কলেজ-ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন নয় কৌশিক। এটা অফিস।’
কৌশিক ‘ফোঁস’ আওয়াজে নিশ্বাস ফেলে। বলে, ‘বিয়ে থা হয়নি বলেই তো মেয়েরা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। বিয়ে হলে জ্যান্ত মানুষ নিয়ে পড়ত।’
শালিনী হালকা ধমক দেয়, ‘চুপ করো তো। তোমাকে যা বলছি তাই করবে। অফিসে হুটপাট ফোন করবে না।’
কৌশিক মুখ ব্যাজার গলায় বলে, ‘ঠিক আছে করব না।’
এর পরেও কৌশিক ইচ্ছেমতো দশটা-বারোটা মেসেজ পাঠায়। হুটপাট ফোন করে। আজও করেছে।
শালিনীর বয়েসে রিংটোনে নানারকম গানবাজনা থাকা স্বাভাবিক। আজকাল রবীন্দ্রসঙ্গীতের খুব চল। নর্মাল রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। বাংলা সিনেমার গিটার বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত। গান বাজলে বাসে-ট্রামে সবাই ঘুরে দ্যাখে। যেন এতক্ষণ ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’ শোনার জন্য মন হাঁকুপাকু করছিল। এবার মন জুড়লো। শালিনীর গা জ্বলে যায়। ফোন এলে সবাইকে ঢাক পিটিয়ে জানানোর কী আছে! এই কারণে তার রিংটোনে গানবাজনা কিছু নেই। সাধারণ, চেনা ক্রিং-ক্রিং। কেউ তাকায় না। তবু অফিসে ঢোকার পরপরই শালিনী রিংটোন বন্ধ করে ফোনকে ‘ভাইব্রেট’ মোডে নিয়ে যায়। ব্যাগ থেকে বের করে ফাইলের ওপর রাখে। কেউ ফোন করলে যন্ত্র থরথর করে কাঁপে, পিড়িং পিড়িং করে আলো জ্বলে। শালিনী হাতে তুলে নাম দ্যাখে।
কৌশিকের নাম দ্যাখে শালিনী বিরক্ত হল। মোবাইল কানে চেপে ধরতে ধরতে আড়চোখে তাকাল। পুরো আড়চোখে নয়, আধখানা আড়চোখে। আধখানা আড়চোখ কোনও সহজ বিষয় নয়। আড়চোখ ব্যাপারটাই আধখানা। তারও আধখানা মানে চারভাগের এক ভাগ। ট্যাবলেট ভেঙে খাওয়ার মতো জটিল প্রক্রিয়া। শালিনী এই জটিল প্রক্রিয়া অভ্যেস করেছে। বাধ্য হয়েই করেছে। অফিসে যার তিন হাতের মধ্যে দেবযানী সিংহের মতো সহকর্মী বসে তার জটিল প্রক্রিয়া অভ্যেস করা ছাড়া অন্য উপায় কী? ফোন এলে কথা শুরুর আগে দেখে নিতে হয় দেবযানী সিংহ কী করছে। ফাইল দেখছে? নাকি ড্যাবড্যাব করে তার কথা শুনছে? দেবযানী সিংহকে দেখেই শালিনী প্রথম জানতে পেরেছে ‘ড্যাবড্যাব’ করে শুধু দেখা যায় না, শোনাও যায়। গা জ্বলে যায়।
এই মুহূর্তে দেবযানী সিংহ কিন্তু দেখছে না। তার সামনে ফাইল খোলা। মাথা নীচু। ভুরু কোঁচকানো। কালো, মোটা ফ্রেমের চশমা চাপা নাকের ওপর খানিকটা নেমে এসেছে। সম্ভবত ঘামে স্লিপ করেছে। সম্ভবত কেন, তাই হবে। দেবযানী সিংহর নাক সবসময়েই ঘামে। শীত, গ্রীষ্ম বাদ নেই। একটু কাছে গেলেই নাকের পাশে বিজবিজ ঘাম দেখা যায়। বিচ্ছিরি লাগে। মহিলার গায়ের রং ময়লা। কালো হলে মেয়েদের অনেক সময় ফর্সার থেকেও সুন্দর লাগে। ময়লা হলে লাগে না। এসবের ওপর এই মহিলার মুখ ফোলা ফোলা, গাল ভারী। নিশ্চয় থাইরয়েড ধরনের কিছু আছে। তুলনায় চোখদুটোও ছোট। যেদিন যেদিন রং লাগাতে ভুলে যায় পাশ ফিরলে কানের পাশে পাকা চুল দেখা যায়। হাওয়ায় উড়ছে। আজও দেখা যাচ্ছে। অফিসের রেকর্ডে দেবযানী সিংহর বয়স বিয়াল্লিশ। এই বয়েসে পাকা চুল দেখতে পাওয়ার কথা নয়। বয়সে জল আছে কি না কে জানে। শালিনীর বিশ্বাস, নিশ্চয় আছে।
দেবযানী সিংহ ফাইলে ডুব দিয়ে আছেন। ভাবটা এমন যেন ফাইলে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া গেছে। এখন যদি ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে, কাজকর্ম ফেলে সবাই পড়িমড়ি করে দৌড়ও দেয়, উনি কিছুতেই চেয়ার ছেড়ে নড়বেন না। ঠান্ডা গলায় বলবেন, ‘তোমরা যাও। আমি ফাইল শেষ করে আসছি।’ শালিনীর সন্দেহ এটা অভিনয়। যতই চোখের সামনে ফাইল খোলা থাকুক, মহিলার কান খোলা এবং সেই কান তার দিকে তাক করা।
মোবাইলে ঠোঁট ঠেকিয়ে শালিনী নীচু গলায় বলল, ‘ফোন করলে কেন? তোমাকে না অফিসে দুমদাম ফোন করতে বারণ করেছি?’
ওপাশ থেকে কৌশিক নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘কেন করেছি?’
শালিনী চাপা গলায় বলল, ‘হাজারবার তো বলেছি। কথা বলতে অসুবিধে হয়। নতুন চাকরি।’
কৌশিক দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল, ‘নতুন চাকরি না কচু। আসল কারণ তোমাদের ওই দেবযানী রায়।’
শালিনী বলল, ‘রায় না সিংহ।’
কৌশিক চেবানো গলায় বলল, ‘বাঘ, সিংহ যাই হোক আসলে ইঁদুর। নইলে এভাবে আড়ি পাতে?’
শালিনী চাপা গলায় খিলখিল হেসে ফেলল, ‘তোমাকে কে বলছে ইঁদুর আড়িপাতে?’
‘কেউ বলেনি। মনে হল। ছুঁচোও হতে পারে। মেয়ে ছুঁচো।’
‘ছি:, ওভাবে বলে না।’
কৌশিক রাগি গলায়, ‘তাহলে কীভাবে বলব? বুড়ি মাগী… ভদ্রতা সভ্যতা নেই…অন্যের টেলিফোনে আড়ি পাতে…।’
শালিনী গর্বের হাসি হেসে বলল, ‘সবারটায় না, শুধু আমারটায় পাতে।’
কৌশিক আরও রেগে বলে, ‘কেন? তুমি কোন মহারানি যে তোমার ফোনে আড়ি পাততে হবে?’
শালিনী খুশি খুশি গলায় বলে, ‘মহারানি নয়, মহারাজকুমারী। সুন্দরী এবং অবিবাহিতা। মহারাজকুমারী কোন মহারাজকুমারের সঙ্গে কথা বলছে জানবার জন্য উনি ছুঁক ছুঁক করেন।’
‘বাজে কথা বোলো না শালিনী। ওই মহিলার পাশ থেকে উঠে গিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলো।’
শালিনী হিসহিসিয়ে গলায় বলল, ‘পাগল? এখন শুধু দেবযানীদি শুনছে, আমি উঠে কথা বললে ঘর সুদ্ধ সবাই হাঁ করে থাকবে।’
কৌশিক বলল, ‘তাহলে বারান্দায় চলে যাও। তোমাদের অফিসে বারান্দা নেই?’
শালিনী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আছে। সেখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে গুজগুজ করলে তখন আর ঘর নয়, গোটা অফিসে ফিসফিসানি শুরু হয়ে যাবে। সবাই বলবে, শালিনী মহাপাত্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রেম করে। অনেকে সিট ছেড়ে দেখতেও আসবে।’
‘লম্পটের দল। মেয়ে দেখলেই মাথা ঘুরে যায়।’
শালিনী ফিক করে হেসে বলল, ‘লম্পটের দল হবে কেন? সবাইকে তো আর দ্যাখে না। মনে হয় এই অফিসে অনেকদিন পর আমার মতো একজন সুন্দরী এসেছে।’
এই হাসি কৌশিকের গা জ্বলিয়ে দিল। বলল, ‘সুন্দরী না ছাই, মেয়ে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
কৌশিকের হিংসেতে শালিনী খুশি হল। আহ্লাদি গলায় বলল, ‘আমি অত কিছু জানি না। তুমি ফোন করবে না। কথা বললে সবাই ভাববে আমি প্রেম করছি।’
কৌশিক রাগের মাত্রা বাড়িয়ে বলল, ‘টেলিফোনে কথার সঙ্গে প্রেমের কী সম্পর্ক! অন্য কথাও তো হতে পারে। ফোন তো তোমার বাবা-মা করতে পারেন, মেয়েবন্ধুরা করতে পারে, ছোটমামা, মেজোমাসি, রাঙাবউদিও করতে পারে। পারে না?’
শালিনী এই বিরক্তিতেও মজা পেল। গলা নামিয়ে বলল, ‘সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? একটা আনম্যারেড মেয়ের ফোন করার কায়দা দেখলে বোঝা যায় কার সঙ্গে কথা বলছে।’
কৌশিক নাক দিয়ে ফু: ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘বিরাট ফোন ওস্তাদ এসেছে রে। তুমি আজই সিট চেঞ্জ করো শালিনী। অন্য টেবিলে যাও। দেবযানী সিংহ থেকে দূর হট।’
শালিনী একটু চুপ করে রইল। এই কথাটা সে ভাবেনি এমন নয়। তবে বিষয়টা নিয়ে এগোয়নি। তার কারণ দুটো। এক তার চাকরি এখনও নতুন। এই অল্পদিনে সিট চেঞ্জ করতে চাওয়া ডিপার্টমেন্টের কেউ ভালো চোখে দেখবে না। আর দু-নম্বর কারণ হল, কোন যুক্তিতে অন্য জায়গায় উঠে যাবে? পাশে বসা কলিগ ফোন করার সময় তার দিকে তাকায় বলে? তাও পুরুষকর্মী হলে কথা ছিল।
শালিনী বলল, ‘সরকারি অফিসে ইচ্ছেমতো টেবিল বদলানো যায় না।’
‘যত্তসব ফালতু নিয়ম।’
শালিনী নাক দিয়ে ‘উঁ উঁ’ ধরনের লম্বা আওয়াজ করে বলল, ‘তখন তো গভর্মেন্ট সার্ভিস নেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করেছিলে। করোনি? এখন এসব বলছ কেন?’
কথাটা সত্যি। সরকারি চাকরির ব্যাপারে সবথেকে চাপ দিয়েছিল কৌশিক। শালিনীর বয়স পঁচিশ। মাঝারি ধরনের সুন্দরী। বড় হওয়ার কারণে চোখে একধরনের মায়া ভাব। নাক টিকোলো। গায়ের রং খুব ফর্সা না হলেও ফর্সা। সবথেকে বড় কথা মেয়েটার মাথায় এক ঢাল চুল রয়েছে। আজকাল মেয়েদের মাথায় এত চুল চট করে দেখা যায় না। হয় তারা বেশি চুল কেটে ফেলে, নয়, বেশি চুল লুকিয়ে ফেলে। শালিনী চুল যত্ন করে রেখে দিয়েছে। কখনও লম্বা বেণি করে। কখনও খুলে রেখে রঙিন ব্যান্ড লাগিয়ে নেয়। বেশি চুলের কারণে মেয়েটার চেহারায় একধরনের অতিরিক্ত লাবণ্য ভাব রয়েছে। সরকারি অফিস ঘরের শুকনো, মলিন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে শালিনীর সৌন্দর্য যেন আরও বেশি করে চোখে পড়ে। তার বয়সি এবং সুন্দরী কোনও মেয়ে এই ঘরে বসেও না। তবে শুধু দেখতে নয়, শালিনী লেখাপড়াতেও ভালো। কলেজে তার বিষয় ছিল কেমিস্ট্রি। ন’মাস এবং ন’মাস সাতদিন হল সে চাকরি পেয়েছে। চাকরির দুটো তারিখ হওয়ার কারণ পরপর দুটো চাকরি পাওয়া। বেসরকারি চাকরি আর সরকারি চাকরি। বেসরকারি চাকরিতে পদ ছিল কেমিস্টের। কোম্পানি সাবানের। বজবজ পেরিয়ে ওয়ার্কশপ। সেখানে বসতে হবে। এসি লাগানো আলাদা ঘর। যাওয়া আসার জন্য গাড়ি। সাবানের প্রস্তুত প্রণালীর ওপর নজরদারি করতে হবে। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট কোনও বিষয় ছিল না। যেমন পোস্টিং হবে তেমন কাজ। স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা, শিল্প থেকে পশুপালন যে-কোনও দপ্তরই হতে পারে।
দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়ে শালিনী বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ল। সে চাইল বেসরকারি কোম্পানির ‘কেমিস্ট’ হতে। শুনে সবাই হাউমাউ করে ওঠে। পরিণত গাধা ছাড়া এই ভুল কেউ করে না। সরকারি চাকরি পাওয়ার মানে এতদিন ছিল হাতে শুধু চাঁদ পাওয়া। এখন চাঁদ-সূর্য দুটোই পাওয়া যায়। আয়েসের চাঁদ আর বেতনের সূর্য। খাটাখাটনি আগের মতো কমসমই রয়েছে, অথচ বেতন বেড়েছে গাদাখানেক। বেসরকারি জায়গা মানে শুধুই অনিশ্চয়তা। যখন তখন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আগে ঝাঁপ ফেলতে দু-চারদিন লাগত। এখন লাগে একবেলা। সকালে আছে তো বিকেলে নেই। ফোল্ডিং খাট আলমারির মতো এখন সব ফোল্ডিং কোম্পানি। প্যাক করে গাড়ির ডিকিতে তুললেই ল্যাটা চুকে গেল। তাও বজবজের বদলে বেঙ্গালুর হলে একটা কথা ছিল। সুতরাং এই ভুল কিছুতেই করা যাবে না। সবথেকে বাগড়া দিল কৌশিক।
‘তোমার মাথাটা কি পুরো গেছে শালিনী?’
শালিনী অবাক হয়ে বলল, ‘মাথা খারাপের কী আছে? পড়াশোনা করেছি কেমিস্ট্রি নিয়ে, কাজও করব কেমিস্ট্রি নিয়ে।’
‘বড় বড় কথা বোলো না। এমন একটা ভান করছ যেন অক্সফোর্ডে ডক্টরেট করতে যাচ্ছ। তুমি স্কুল-কলেজে পড়াবেও না যে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন নিয়ে ক্লাস নিতে হবে।’
শালিনী মিনমিন করে বলে, ‘মাইনে তো অনেকটা বেশি। তাছাড়া ফেসিলিটি আছে। গাড়ি প্রাোভাইড করবে।’
কৌশিক ভুরু তুলে বলে, ‘ওইটাই তো ভয়ের। মাইনে কম হলে ভয় ছিল না। প্রাইভেট কোম্পানি হল তুবড়ির মতো। চোখ ধাঁধিয়ে জ্বলে তারপর ফুস করে নিভে যায়। সরকারি চাকরিতে সেই চিন্তা নেই। টিমটিম করে হলেও জ্বলতেই থাকে, জ্বলতেই থাকে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে জ্বলছে।’
তুবড়ি জ্বলা এবং নেভার প্রক্রিয়া কৌশিক হাত দিয়ে ডেমনস্ট্রেট করে দেখাল।
তারপরেও শালিনী বোঝাতে যায়। বলে, ‘বন্ধ হয়ে গেলে অন্য কোম্পানিতে জয়েন করে যাব। সমস্যা কিছু নেই। বরং ভালো। এক্সপিরিয়েন্স হবে। বেটার কোথাও শিফট করতে সুবিধে হবে।’
কৌশিক উড়িয়ে দেয়, ‘রাখো তোমার এক্সপিরিয়েন্স। এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে গাদাগাদা ছেলেমেয়ে হেদিয়ে মরছে। আমার মামাতো ভাই সন্তুকে দ্যাখো। ঝোলা ভরতি সার্টিফিকেট, অথচ চাকরির জন্য মাথা খুঁড়ে কপালে আলু বানিয়ে দিল। তার ওপর আমার কথাটা তো একবার ভাববে।’
শালিনী স্বর ঘন করে বলে, ‘সে তো সবসময়েই ভাবি।’
‘আহা সে ভাবার কথা বলছি না। বলছি আমার কাজকর্মের কথা। সেটাও তো নড়বড়ে। কতদিন থাকবে তার কোনও ঠিক নেই। প্রাইভেট অফিসের অ্যাকাউনটেন্ট। মালিক তো রোজই মুখ শুকিয়ে বসে থাকে। ব্যবসা নাকি চলছে না। মাইনে দেওয়ার দিন কান্নাকাটি করে। চোখে জল দেখেছি। কে জানে বেটা সিনেমার অ্যাক্টরদের মতো গ্লিসারিন মারে কিনা। নিশ্চয় মারে। চাকরি কবে চলে যাবে ঠিক নেই। অ্যাকাউনটেন্টের চাকরি চলে গেলে বিরাট বিপদ। এখন হিসেব দেখার লোক পথেঘাটে পাওয়া যায়।’
শালিনী রসিকতার ঢঙে বলে, ‘তোমার চাকরি চলে গেলে সমস্যা কী! তুমি তো আর আমার পয়সায় খাও না।’
‘আ:, শালিনী, বোকার মতো কথা বোলো না। আজকের কথা বলিনি, ফিউচারটা তো ভাবতে হবে। সংসারে দুজনের চাকরি চলে গেলে কেলেঙ্কারি হবে।’
শালিনী হাসে। বলে, ‘সংসারই হল না, তার আবার একজন, দুজন।’
কৌশিক সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, ‘আজ হয়নি, কাল হবে।’
শালিনী থমকে গেল। এই ‘কাল হবে’তে তার সমস্যা আছে। তবে সমস্যাটা কৌশিককে সে বুঝতে দেয় না। বরং উলটো কথা বলে। কৌশিক ধাঁধা খেয়ে যায়।
‘রাখো তোমার সংসার। আমাদের সংসার আর হয়েছে। তোমার হাজার ফ্যাকড়া। বোনের বিয়ে, মায়ের অসুখ, কাকাদের সঙ্গে সম্পত্তির মামলা। কবে সেসব মিটবে আর কবে বিয়ে হবে। আমার সব বোঝা হয়ে গেছে। প্রেম করতে করতেই চুল পেকে যাবে।’
কথায় অভিমান ঝরিয়ে দেয় শালিনী। মেয়েরা এই জিনিস অতিরিক্ত ভালো পারে। মিথ্যে রাগ আর বানানো অভিমান তাদের কাছে জলভাত। পুরুষমানুষ ধরতে পারে না। বোকা হলে তো একেবারেই নয়। কৌশিক বোকা। সে টেবিলের ওপর হাত বাড়িয়ে শালিনীর আঙুল ধরার চেষ্টা করে। শালিনী হাত সরিয়ে নেয়।
‘আরে বাবা মিটে যাবে বলছি তো। আর বেশিদিন নয়। ছোটকা তো মিটিয়ে ফেলতেই চায়, মেজকা গোল পাকাচ্ছে। মেজকার উকিলটাই যত নষ্টের গোড়া। হারামি একটা।’
শালিনী মুখ ঘুরিয়ে, চোখ বড় করে বলল, ‘তাহলে তোমার মেজকার উকিলের জন্য আমরা বিয়ে করতে পারব না?’
কৌশিক ঝুঁকে পড়ে আবার শালিনীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ছুঁয়ে যদি মান ভাঙানো যায়। বলে, ‘আহা, তুমি রাগ করছ কেন?’
শালিনী বুঝতে পারে তার অভিনয় কাজ করেছে। সে আরও সুযোগ নেয়। বলে, ‘রাগ করবার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই করছি। আর ক’দিন অপেক্ষা করতে হয় দেখব।’
কৌশিক বলে, ‘এত ছটফট কোরো না সোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। চিনির জন্য ছেলে দেখা চলছে। যে-কোনও মোমেন্টে ফাইনাল হয়ে যেতে পারে।’
শালিনী জোর দিয়ে বলল, ‘অবশ্যই ছটফট করব। একশোবার করব, হাজারবার করব। আমার বিয়ের জন্য আমি ছটফট করব না তো কে করবে?’
কৌশিক পরিতৃপ্তির হেসে বলল, ‘লক্ষ্মী সোনা।’
শালিনী মোটেই বিয়ের জন্য ছটফট করছে না। এখন বিয়ে করাটাই তার কাছে ‘সমস্যা’। সে অপেক্ষা করতে চায়। সব কারণেই চায়। বয়স টু ননদ। পঁচিশ বছর বিয়ের জন্য কোনও বয়স নয়। সবে চাকরি পেয়েছে। এখন ক’টাদিন রোজগারপাতি করে স্বাধীন ভাবে টাকা খরচ করে জীবন উপভোগ করতে হবে। শখ-আহ্লাদ মেটাতে হবে। এটা সেটা কিনতে হবে। এখানে-ওখানে বেড়াতে হবে। কৌশিকের বাড়িতে হাজার ঝামেলা। মা অসুস্থ। সাধারণ হাঁচি-কাশির অসুখ নয়, একেবারে শয্যাশায়ী। তার মানে এখন বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে পুত্রবধূ কাম আয়ার ভূমিকা পালন করতে হবে। এই মুহূর্তে শালিনী কিছুতেই শাশুড়ির বড় বাইরে, ছোট বাইরে নিয়ে ব্যস্ত হতে রাজি নয়। তার সঙ্গে আছে চিনি। কৌশিকের বোন। সাতাশটা পার্টি দেখেও বিয়ে ফাইনাল হল না। সব পাত্রই চিনির অপছন্দ। ছেলে বেঁটে, ছেলে মোটা, ছেলের বয়স বেশি —হাজার বায়নাক্কা। আসলে ঠেঁটা টাইপ মেয়ে। তার বিশ্বাস তার বিয়ে হবে কোনও ফুলকুমারের সঙ্গে। নেহাত যোগাযোগ হচ্ছে না তাই। এই ননদকে নিয়ে ঘর করা অসম্ভব। সবসময় ঠোকাঠুকি হবে। তার বিয়ের পর পরই যদি চিনির বিয়ে ফাইনাল হয়ে যায় সে-ও ফ্যাকড়া। ননদের বিয়ের সব ঝক্কি বউদির ঘাড়ে পড়বে। শুধু ঝক্কি নয়, গাদাগাদা খরচ। জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাবে। তার বাবা-মাকেও খরচ করতে হবে। নতুন বেয়াইবাড়ি বলে কথা। চিনির বিয়ে হয়ে গেলে তখন আর এই সমস্যা থাকবে না। ঝাড়া হাত-পায়ে গিয়ে ওঠা যাবে। এর সঙ্গে সম্পত্তির ঝগড়াঝাঁটিটাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ঘরবাড়ির কে কোনটা নেবে, কে কোনটা পাবে সব আগে থেকে ঠিকঠাক হওয়াই ভালো। কিন্তু এসব কথা কৌশিককে বলা যায় না। বেচারি দু:খ পাবে। ছোট মনের মানুষ ভাববে। বিয়ের আগে ছেলেরা প্র্যাকটিক্যাল জিনিসটা বুঝতে চায় না। সরল রেখার মতো সব ভাবনা। যাকে বলে স্ট্রেট লাইন থিংকিং। তাদের ধারণা প্রেমিকা বিয়ে করে বাড়ি ঢুকলে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর ননদ এমনকী কাজের লোককেও আছাড়িপিছাড়ি দিয়ে ভালোবাসতে শুরু করবে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সবার কথা শুনে সরকারি অফিসে যোগ দিয়েছে শালিনী। খালবিলের হিসেব রাখা অফিস। বিভিন্ন জেলা থেকে হিসেব আসে। সেই হিসেব সাজিয়ে গুছিয়ে রিপোর্ট লিখতে হয়। সম্প্রতি খালবিলের সঙ্গে ‘ডোবা’ এবং ‘পানাপুকুর’ যুক্ত হয়েছে। কোথায় কত ডোবা, পানাপুকুর আছে, কী অবস্থায় আছে তার রিপোর্ট। শালিনীকে ‘পানাপুকুর’ পার্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কাজ শুরু হওয়ার মুখেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। ঠিক কাকে ‘পানাপুকুর’ বলা হবে? ‘ডোবা’ বা ‘নয়ানজুলি’র সঙ্গে তার পার্থক্য কী? পানাপুকুর কি দৈর্ঘ্যপ্রস্থ দিয়ে মাপা হবে? নাকি গভীরতা? যদি গভীরতা দিয়ে মাপা হয় তাহলে এঁদো ডোবার সঙ্গে তার পার্থক্য কী হবে? ‘পানাপুকুর’-এর সংজ্ঞার বিষয়ে কোনও সরকারি জিও এখনও বেরোয়নি। বিষয়টা ওপরওয়ালাকে জানিয়ে একটা চিঠি ড্রাফট করছিল শালিনী। এই সময়ে কৌশিকের ফোন এসেছে।
কৌশিক গলা নামিয়ে বলল, ‘একটা খবর আছে।’
শালিনী বলল, ‘কী খবর!’
‘ওই ব্যাপারে।’
শালিনী বলল, ‘কোন ব্যাপার?’
কৌশিক গলা আরও নীচু করে বলল, ‘বুঝতে পারছ না কোন ব্যাপার?’
শালিনী অবাক হয়ে বলল, ‘কই না তো!’
কৌশিক ফিসফিস করে বলল, ‘অনিমেষদার ফ্ল্যাটটা শনিবার ফাঁকা থাকবে। হারামজাদা অফিসের কাজে আসানসোল যাচ্ছে। আমাকে চাবিটা দিয়ে যাবে। ওদিন তোমার অফিস ছুটি, বন্ধু-টন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে চলে আসবে। আমরা দুজন দরজা বন্ধ করে সারাদিন ওই ফ্ল্যাটে থাকব।’
শালিনীর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘ধ্যাৎ।’
ওপাশে কৌশিক ভেংচি কাটার ঢঙে বলল, ‘এখন ধ্যাৎ না? তখন তো খালি বলতে টেলিফোনে, মেসেজে আর কত চুমু খাবে? বলতে না? এবার মজা দেখাব।’
শালিনীর শরীর শিরশির করে উঠল। চাপা গলায় বলল, ‘অ্যাই মার খাবে।’
‘ঠিক আছে মেরো। অ্যাই জানো অনিমেষদের বাথরুমটা দারুণ। শাওয়ারের জন্য আলাদা জায়গা। সব দিক থেকে জল পড়ে। দুজনে একসঙ্গে ওখানে স্নান করব।’ বলতে বলতে গলা গাঢ় হয়ে গেল কৌশিকের।
শালিনীর কান গরম। যতই এই সময়ের মেয়ে হোক, শরীরের ব্যাপারে শালিনী খানিকটা প্রাচীনপন্থী। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুদের সঙ্গে সেক্স নিয়ে কম গসিপ করেনি, উত্তেজনাও দেখিয়েছে অনেক, কিন্তু নিজেরবেলায় আঁটিসুঁটি থেকেছে। বন্ধুরা ‘ঠাকুমা’ বলে খেপাত। হিস্ট্রির তনুশ্রী ছিল বেশি ফাজিল। শালিনীর থুতনি নেড়ে বলত, ‘এখন থেকে প্র্যাকটিস না করলে আসল যুদ্ধের সময় যে ধেড়াতে হবে মামণি। ইতিহাস পড়োনি তো, পড়লে বুঝতে পারতে। অভিজ্ঞতার অভাবে কত বড় বড় দূর্গের পতন হয়েছে। আক্রমণ হলে সামলাতে হবে যে। সব সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতে হবে। বর অশ্বারোহী এগোলে তোমাকে পাঠাতে হবে পদাতিক। বর যেই কামান দাগবে অমনি তুমি গোলা ছুঁড়ে মারবে…হি-হি…।’ বলতে বলতে শালিনীর কোলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত বিচ্ছুটা। রীনা বলত, ‘আমি কিন্তু বাপু দূর্গের পতনই চাই। কাজে না লাগলে দূর্গ রেখে করব কী?’ আবার একচোট হাসি হত।
শালিনী বুঝতে পারছে ইদানীং কৌশিকের ছটফটানি হয়েছে। চান্স পেলেই হাত ধরে। কাঁধে হাত দেয়। কনুই ধরে। সেদিন সিনেমা হলে বুকেও হাত দিয়েছে। তবে সামলে সুমলে। অ্যালাও করছে শালিনী। বেশি আপত্তি করলে অন্য কিছু সন্দেহ করতে পারে। এখনই বিয়ে না করার পরিকল্পনা গোপন রাখতে হবে। তা বলে একেবারে ফাঁকা ফ্ল্যাটে…!
শালিনী বিড়বিড় করে বলল, ‘না, না।’
কৌশিক আবদারের ঢঙে বলল, ‘লক্ষ্মীটি না কোরো না। এরকম সুযোগ আবার কবে আসবে ঠিক নেই।’
শালিনী নিজেকে সামলে বলল, ‘সুযোগের কী আছে? বিয়ে করে ফেললেই তো হয়।’
কৌশিক অধৈর্য গলায় বলল, ‘সে হবেক্ষণ। আমার আর তর সইছে না। তুমি কিন্তু সেদিন অফিস ড্রপ করবে। সারাদিন থাকব।’
শালিনী ফিসফিস করে বলল, ‘বাড়াবাড়ি কোরো না।’
‘একশোবার করব। অন্য কোনও মেয়েকে নিয়ে তো করছি না, বাড়াবাড়ি করছি হবু বউকে নিয়ে।’
শালিনী চুপ করে রইল। একটু থমকেই গেল যেন। কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যি তো সে কৌশিকেরই স্ত্রী হবে। সম্পর্কের কথা অনেকেই জানে। বাড়িতেও বলা আছে। সবটা নয়, ঠারেঠোরে বলে রেখেছে।
‘মা, আমার বিয়ে নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। সময় হলে আমিই বলব।’
‘তোর পছন্দের কেউ আছে?’
‘বলছি তো মাথা ঘামিয়ো না। আমি ঠিক বলব।’
‘আহা, আমাকে বল না। ছেলেটা কে?’
শালিনী মায়ের গাল ধরে হাসতে হাসতে বলেছে, ‘বোম্বাগড়ের রাজা।’
‘সে আবার কী!’
শালিনী মায়ের দু-কাঁধে হাত রেখে, চোখ বড় বড় করে বলেছে, ‘সে আছে। ঠিক সময় অ্যাপিয়ার করবে। তুমি বাপিকে বুঝিয়ে বলো। আর আমাকে ঝাড়া হাতপায়ে ক’টাদিন চাকরি করতে দাও।’
এই ইঙ্গিতেই মা মোটামুটি বুঝে গেছে। আর বিরক্ত করেনি।
কৌশিক বলল, ‘কী হল চুপ করে আছ কেন?’
শালিনী মুহূর্তখানেক ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে পরে বলব। এখন ছাড়ছি।’
কৌশিক বলল, ‘পরে নয়, এখনই। নইলে ফোন ছাড়ব না। তোমার অফিসে গিয়ে হাজির হব।’
কৌশিকের ছটফটানিতে শালিনীর হাসি পেল, ভালোও লাগল। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে থাকার খুব শখ হয়েছে বাবুর! ‘তুমি তো আমায় জানো কৌশিক…আমি এসব একদম পারি না…জানো না?’
কৌশিক ঘন গলায় বলল, ‘তোমাকে কিছু পারতে হবে না। যা পারবার আমিই পারব। বেশি কিছু নয়, শুধু একটু আদর…। সেদিন না হয় ধরেই নেব আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।’
বিয়ে হয়ে গেছে! শিরশিরানির সঙ্গে শালিনীর শরীর এবার হালকা কেঁপে উঠল। সেই কাঁপুনিতে লজ্জা, উত্তেজনা দুটোই আছে। ফিসফিস আর আহ্লাদ মেশানো গলায় বলল, ‘বেশি কিছু নয় কিন্তু। তোমার আজকাল খুব খারাপ স্বভাব হচ্ছে।’
কৌশিক খুশি হল। আঁশটে হেসে বলল, ‘বর বউকে আদর করবে তার আবার কমবেশি কী?’
নেকা নেকা, হাস্যকর এবং বোকামির চূড়ান্ত তবু কৌশিকের মুখে ‘বউ’ কথাটা বার বার শুনতে ভালো লাগছে। কথাটার মধ্যে ছলাকলা কিছু নেই। না, ছেলেটা সত্যি বোকা।
শালিনী বানানো রাগ দেখিয়ে মোবাইলে মুখটা ঠেকিয়ে বলল, ‘চুপ করো। আমি কিন্তু বলে রাখছি, বাড়াবাড়ি করতে পারবে না। তেমন হলে আমি সোজা চলে আসব।’
কৌশিক বলল, ‘ঠিক আছে মহারানি, সরি মহারাজকুমারী, আগে তো রাজকুমারের কাছে এসো।’
শালিনী হেসে বলল, ‘রাজকুমার না ইয়েকুমার। অ্যাই, আমি এখন রাখছি। উরিবাবা কতক্ষণ বকলাম…।’
মোবাইল রেখে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল শালিনী। ছেলে খুব বেড়েছে। ঠিক আছে দেখা যাবে কত বেড়েছে। কথাটা ভেবে শালিনী ফের একটা হালকা উত্তেজনা বোধ করল। নিজের মনেই হাসল। সামান্য এইটুকুতেই উত্তেজনা! হবু স্বামীর সঙ্গে স্নান করবে ভেবে! সত্যি যখন স্নান করবে তখন কী হবে? তনুশ্রী ফাজিলটা থাকলে নিশ্চয় হেসে গড়িয়ে পড়ত। বলত, ‘ঠকঠক করে কাঁপবি আর কৌশিককে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরবি।’ যাই হোক, এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। শুধু আদরের কারণে নয়, অন্য ব্যাপারও আছে। সেদিন কৌশিক প্রস্তাব দিয়েছে, এখনই বিয়েটা সেরে ফেলা যাক। না হয় বাইরে কোথাও ভাড়া বাড়ি নেওয়া যাবে। রোজ যাতায়াত করলেই তো হল। গভীর ভাবে কিছু বলেনি কৌশিক, হালকা ভাবেই কথাটা তুলেছে। এটাও বিপদের। ধারণা মাথায় গেঁথে গেলে মুশকিল। এইসব সিচ্যুয়েশনে আলাদা হয়েও লাভ হয় না। বরং ঝক্কি বাড়ে। এ-বাড়ি, ও-বাড়ি ছোটাছুটি করে হেদিয়ে মরতে হবে। শাশুড়ি ‘ওরে বাবলু, মারা যাচ্ছি’ বলে রোজ মাঝরাতে ডেকে পাঠাবে। অন্যভাবে তার থেকে সবকিছু থিতু হোক। তার আগে না হয় মাঝে মাঝে এরকম অনিমেষদের ফ্ল্যাট-ট্যাট পেলে ছেলেটা খানিকটা শান্ত হবে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘাড় ঘোরালো শালিনী। দেবযানী সিংহ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ইস! মহিলার কথা একেবারে মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিছু শুনতে পেল নাকি? নিশ্চয় পেয়েছে। এত কথার মধ্যে দুটো-একটা কী শুনবে না? ছি-ছি। কিছু বুঝতে পারেনি তো? মহিলার ঠোঁটের কোনায় হালকা একটা হাসির মতো কেন? নিশ্চয় চোখ-মুখ দেখে কিছু বুঝতে পেরেছে। নার্ভাস হেসে শালিনী স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।
যা কোনওদিন করেনি, দেবযানী সিংহ আজ তাই করলেন। চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, ‘সমস্যা?’
শালিনী ঢোঁক গিলে বলল, ‘কী বিষয় বলুন তো দেবযানীদি?’
দেবযানী সিংহ বললেন, ‘না, কোনও বিষয় নয়। ফোনে যখন তুমি কথা বলছিলে দেখলাম…।’
চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল শালিনীর। কী সাহস! নিজেই বলছে কথা বলার সময় দেখছিলাম! অদ্ভুত নির্লজ্জ মহিলা তো! আজই কড়া ভাবে বলে দিতে হবে। শালিনী মুখ গম্ভীর বলল, ‘কী দেখছিলেন?’
দেবযানী সিংহ খানিক সামলে নিয়ে বললেন, ‘মুখের ভাব দেখে কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগল।’
শালিনী মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘না, কিছু হয়নি।’
কথাটা বলে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খেল শালিনী। মুখ মুছতে মুছতে ঠিক করল এই নির্লজ্জ মহিলাকে আজই বলতে হবে। অনেক হয়েছে। আর ভদ্রতা নয়। দেরিও নয়। এ আবার কী কথা! এ তো বাড়াবাড়ির চরম! ফোনের সময় মুখের ভাবভঙ্গি দেখছে! শালিনী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবে। দেবযানী সিংহর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে তারপর নীচু গলায় বলবে।
‘শুনুন দেবযানীদি, আপনি সিনিয়র মানুষ, কথাটা বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু না বলে পারছি না…আগেও লক্ষ করেছি…আমি যখন ফোনে কথা বলি আপনি শোনবার চেষ্টা করেন…দয়া করে এটা করবেন না…আমার অসুবিধে হয়।’
নাকি আরও কড়া ভাবে বলবে?
‘শুনুন দেবযানীদি, অন্যের কথা লুকিয়ে শোনাটা একটা অন্যায়। আপনি কোনও ছেলেমানুষ নন। তবু দিনের পর দিন সেই অন্যায় কাজটা করেন। প্লিজ ডোন্ট ডু ইট। যদি করেন আমাকে স্টেপ নিতে হবে।’
শালিনী কিছু বলার আগেই দেবযানী সিংহ শালিনীকে চমকে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। দাঁড়ালেন পাশে এসে। ঝুঁকে পড়ল, নীচু গলায় বললেন, ‘একটা কথা বলব শালিনী?’
শালিনী বিস্মিত চোখে তাকাল।
‘তোমার মায়ের ফোন নম্বরটা একটু দেবে?’
‘মায়ের ফোন নম্বর কেন?’
দেবযানী সিংহ হালকা হেসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘সেটা তোমার মাকেই বলব। যদি বলো, তোমার বাড়িই চলে যাই। সেটাই ভালো। এই শনিবারই যাব। দেরি করব না।’
হতভম্ব শালিনী আমতা আমতা করে বলল, ‘আপনি…আমার বাড়ি! মানে…।’
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দেবযানী সিংহ হাসি মুখেই বললেন, ‘ঠিকানাটা বলো।’
অবাক শালিনী আরও অবাক হয়ে লক্ষ করল, ময়লা রঙের, নাক চাপা, চোখ ছোট মহিলার কথার মধ্যে একধরনের জোর এবং আত্মবিশ্বাস আছে। কী হয়েছে!
শনিবার সকালে দেবযানী সিংহ শালিনীর বাড়ির দরজায় বেল টিপলেন।
শালিনী এখন থাকে ছোট একটা শহরে। খুব সুন্দর। মাঝেমধ্যে মনে হয়, সত্যি নয়, আঁকা। লন্ডন শহর থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। বাংলোটা চমৎকার! সমীরের মতোই ঝকঝকে আর স্মার্ট। তার মতোই যেন সবসময় হাসিখুশি! বিয়ের এক বছর হুড়মুড় করে কেটে গেল! বিয়েটা হয়েছিলও হুড়মুড়িয়ে। সাতদিনের নোটিশ। শনিবার কথা, রবিবার দেখা, বুধবার রেজিস্ট্রি। শালিনী কলকাতায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। কখনও মেলে, কখনও স্কাইপে, কখনও সরাসরি ফোনে। নিজের বাবা-মাকে করে, সমীরের আত্মীয়দেরও করে। কৌশিককেও করেছে। তার মায়ের খবর নিয়েছে। আনন্দের কথা, উনি খানিকটা ভালো আছেন। চিনি মেইল করেছিল—’লিনীদি, সমীরের মতো আমার একটা বর খুঁজে দাও। বিদেশে থাকে। বাংলো না থাকুক, ফ্ল্যাট থাকলেই চলবে।’
শালিনী খোঁজাখুজি শুরু করেছে। চিনি দারুণ উত্তেজিত। সবমিলিয়ে শালিনীর ওপর সবাই খুশি। শালিনী নিজেও।
শুধু যেদিন যেদিন আকাশ মেঘলা করে আসে, বহুদিন থাকার পরও অচেনা অজানা শহর জুড়ে কুয়াশা নামে, তখন কান্না পায়। খুব জোর কিছু নয়। হালকা কান্না। শালিনী ভাবে খানিকটা কেঁদে হালকা হলে কেমন হয়? চেষ্টাও করে। কান্না বাইরে আসে না। ভেতরেই বাজতে থাকে।
শালিনী বুঝতে পারে একটা চমৎকার ছেলের জন্য তার মন কেমন করছে। তার ভালো লাগে। সে ভালো আছে।