একটি আজগুবি গল্প
কদিন ধরে একটা বিচ্ছিরি অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম। মন দিয়ে কাজ করতে পারছিলাম না। মনের ভেতর একটা কাঁটা সবসময় খচখচ করছিল। এখন আর সে ঝামেলা নেই। মনের অস্বস্তি, খচখচানি সব দূর হয়েছে।
কাল দিবাকরকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। অফিস ছুটির পর তাকে ডেকে বলেছি, ‘তোমাকে আর আসতে হবে না। এই খামটা ধরো, এতে তোমার দু-মাসের মাইনে রয়েছে। আর শোনো, তোমাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হল এই কথাটা কাউকে বলবে না। আমিও বলব না। এতে তোমারই ক্ষতি হবে। সবাই ভুল ভাববে। ভাববে তুমি কোনও খারাপ কাজ করেছ বলে তোমার চাকরি চলে গেছে। তোমার অন্য কাজ পেতে অসুবিধে হবে।’
দিবাকর আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘স্যার আমি কী করেছি?’
আমি মুখ নামিয়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘তুমি অন্য কোনও কাজ খুঁজে নিও। তুমি কাজের লোক, কাজ পেতে অসুবিধে হবে না। যদি বলো একটা সার্টিফিকেট লিখে দিতে পারি। দেব?’
দিবাকর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘স্যার এখন কাজ চলে গেলে খুব বিপদে পড়ব।’
আমার হালকা খারাপ লাগছিল। সত্যি তো লোকটার কোনও দোষ নেই। কিছু করার নেই। আমি কাজে মন দেওয়ার ভান করলাম। কঠিন গলায় বললাম, ‘দিবাকর, তুমি এখন যাও। আমার অনেক কাজ রয়েছে।’
দিবাকর মাইতি। আমার অফিসের একজন অতি সাধারণ কর্মচারী। কাজ করত ডেসপ্যাচে। তিরিশ-বত্রিশ বছরের এই লোকটি সৎ এবং পরিশ্রমী। আমার এখানে বেশিদিন কাজ করছে না। মাস ছয়েক হবে। এর মধ্যেই তার কাজের প্রশংসা হয়েছে। ইনচার্জ বদ্যিনাথ ঘোষাল খুঁতখুঁতে মানুষ। সে পর্যন্ত সন্তুষ্ট। মাস দুয়েক আগে একদিন বদ্যিনাথ আমার ঘরে এসে একথা-সেকথার পর বলল, ‘একজন ভালো লোক পেয়েছি স্যার।’
বদ্যিনাথ ‘ভালো’ বলছে মানে সত্যি ‘ভালো’। আমি বললাম, ‘তাই নাকি! লোকটা কে?’
বদ্যিনাথ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘দিবাকর মাইতি। আর ক’টা দিন গেলেই ওর মাইনে বাড়ানোর জন্য আপনাকে বলব। ডেসপ্যাচে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ার পর পাগলের মতো লোক খুঁজছিলাম। কাজটা তো ঝামেলার। লেখাপড়াও জানতে হবে আবার লেবারদের সঙ্গে গায়ে গতরে খাটতেও হবে। এমন সময় দিবাকর এসে হাজির হল। বলল, কোথায় যেন কাজ করত। দুম করে কাজ চলে গেছে। আমি বললাম, দুম করে কাজ চলে গেল কেন? নিশ্চয় চুরিচামারি করেছিলে বাপু। সে বলল, কেন কাজ গেছে সে জানে না। যারা ছাড়িয়েছে তারা কোনও কারণ বলেনি। শুধু বলেছে, তোমাকে আর আসতে হবে না। বেচারি খুব বিপদে পড়েছে। আমি বললাম, দশদিন দেখব। পচ্ছন্দ না হলে তাড়িয়ে দেব। কিছু বলতে পারবেন না। রাজি? লোকটা রাজি হয়ে গেল। দশদিন লাগল না, সপ্তাহখানেকের মধ্যে বুঝতে পারলাম, ওই লোক খাটিয়ে। ফাঁকি দেয় না, সৎ। মালের ওজন এদিক-ওদিক হলে চেপে ধরে। নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার বদ অভ্যাস নেই। ভুলচুক যে একটু-আধটু করে না এমন নয়, করে। কিন্তু সে তো সবাই করে। আর একটা ব্যাপার আছে।’
বদ্যিনাথ চুপ করলে আমি বললাম, ‘আর কী ব্যাপার?’
বদ্যিনাথ হেসে বলল, ‘ডিউটি হয়ে গেলে এক মুহূর্ত অফিসে থাকতে চায় না। বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। কিছুতেই আটকে রাখা যাবে না। জোর করলে মুখ গোমড়া করে থাকে। ভেবেছিলাম, নেশাভাঙ করে। পরে জানলাম, না, সেরকম কিছু নয়, অন্য ঘটনা।’
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘অন্য ঘটনা! কী ঘটনা?’
বদ্যিনাথ কিছু বলল না। মাথা নামিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। মনে হল, ঘটনা এমনই যে বসকে বলতে চায় না। আমিও আর কৌতূহল দেখায়নি। অফিসের অধস্তন এক কর্মচারী ডিউটি শেষে কেন বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে তা নিয়ে কোম্পানির মালিকের মাথা ব্যথা হওয়ার কোনও কারণ নেই। তখন জানতাম না কিছুদিনের মধ্যেই এই কর্মচারী আমার মাথা ব্যথার কারণ হবে এবং আমি তাকে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেব। তাড়িয়ে দেওয়ার কথা কাউকে জানতে দেব না। জানাজানি হলে, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কারণ এই সৎ, পরিশ্রমী কর্মচারীকে দুম করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কারণ একটা আজগুবি গল্প। মজার কথা হল, এই আজগুবি গল্প দিবাকর নিজেই বলে বেড়িয়েছে। গত কয়েকমাস ধরে একটু একটু করে অফিসে ছড়িয়েছে। আমার কানে এসেছে বাইরে থেকে। সেদিন এক পার্টির কাছে গিয়েছিলাম পেমেন্টের জন্য। টাকাপয়সা দেওয়ার পর ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে মশাই, আপনার অফিসে নাকি একজন স্টাফ আছে, দিবাকর না সুধাকর কী যেন নাম? শুনলাম সেই লোক নাকি…।’
গোড়াতে আমি দিবাকর নামটা মনে করতে পারিনি। খানিক পরে মনে পড়ল। বদ্যিনাথের দিবাকর। হাসতে হাসতে বললাম, ‘দাদা, এসব আজগুবি গল্প আপনি কোথা থেকে শুনলেন?’
ভদ্রলোকও হাসলেন। বললেন, ওই লোকই সবাইকে বলে। এর পরে যেদিন আপনার ওখানে যাব, সুধাকর না দিবাকরকে দেখে ফিরব। যে লোক…তাকে একবার না দেখলে…আমার স্ত্রীকে গল্প করছিলাম, সে তো ভয় পেয়ে গেছে…।’
কথা শেষ করে ভদ্রলোক খুব হাসতে লাগলেন। আমিও হাসলাম। হাসতে হাসতে বললাম, যত্ত সব পাগলের কাণ্ড।’
গাড়ি চালিয়ে ফিরতে ফিরতে ভেবে দেখলাম, এটা একটা খারাপ ঘটনা। এই ধরনের আজগুবি গল্প ছড়ালে ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে। এখন জিনিসটা হাসিঠাট্টার পর্যায়ে আছে, সিরিয়াস হয়ে যেতে কতক্ষণ? কোন পার্টি কীরকম কে বলতে পারে? কতরকম সংস্কার আছে। এখন ব্যবসার সামান্য ক্ষতি হলে চলবে না। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়ার চেষ্টা করছি। অফিসে ঢুকে বদ্যিনাথকে ডেকে পাঠালাম।
‘তোমার ওই দিবাকর লোকটা কি পাগল?’
বদ্যিনাথ অবাক হয়ে বলল, ‘পাগল! কই না তো! কেন স্যার? এই তো আজকেই দুটো মাল ভুল অ্যাড্রেসে চলে যাচ্ছিল। রায়পুরের বদলে রাণীগঞ্জ। দিবাকরই খেয়াল করে আটকাল। নইলে অনেক টাকা ডেমারেজে যেত। এই লোক পাগল হবে কেন! কী হয়েছে স্যার?’
আমি বললাম কী শুনে এলাম। বদ্যিনাথ হেসে বলল, ‘আমিও শুনেছি।’
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ‘কার কাছে শুনেছ?’
গম্ভীর গলায় বদ্যিনাথ একটু থতমত খেয়ে গেল। নীচু হয়ে, ‘স্যার ওর কাছেই শুনেছি। এই অফিসে সবাই শুনেছে।’
‘কই আমাকে তো কিছু বলোনি!’
কথাটা বলেই আমার মনে পড়ে গেল, সেদিন বদ্যিনাথ কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গিয়েছিল। মাথা নামিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। সেটাই কি এই আজগুবি গল্প? বদ্যিনাথ অপরাধী গলায় বলল, ‘এটা আপনাকে কী বলব স্যার! সবাই হাসে। ওই জন্যই নাকি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। সবার ধারণা গল্পটা বলে দিবাকর মজা করে, ভয় দেখায়।’
আমি চাপা ধমক দেওয়া গলায় বললাম, ‘বদ্যিনাথ, এটা গল্প করার জায়গা নয়। এটা অফিস।’ এই ধরনের মজা ব্যবসার ক্ষতি করে। ঘটনাটা বাইরে যদি জানাজানি হয়ে যায়, সবাই ভাববে আমার অফিসে পাগলরা কাজ করে। পার্টি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। কথাটা দুদিনের একজন কর্মচারী না জানলেও তোমার জানা উচিত ছিল। তাই না?’
বদ্যিনাথ মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘সরি স্যার।’
‘তুমি আজই ওই লোককে বলে দেবে, এই ধরনের কথা যেন আর কখনও সে না বলে।’ কথাটা বলেই আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম। বললাম, ‘ঠিক আছে, তোমাকে বলতে হবে না। ওকে আমার কাছে পাঠাও। যা বলার আমি বলব।’
বদ্যিনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মনে হল, কাজটা ঠিক হল না। আমি কেন লোকটার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম! দিবাকর কে? একজন অতি সামান্য কর্মচারী। সে ভয় দেখানোর জন্য কাকে কী গাঁজাখুরি গল্প করছে তাতে আমার কী? এরকম একটা তুচ্ছ বিষয়ে আমার নাক গলানো ঠিক নয়। আজগুবি গল্পটা শোনার জন্য আমি কোনওরকম আকর্ষণ বোধ করছি না তো?
দিবাকর ঘরে ঢুকলে তাকে চিনতে পারলাম না। অফিসের ভেতর ঘোরাঘুরি করি ঠিকই কিন্তু সব কর্মচারী, লেবারদের মুখ মনে রাখা কঠিন। আগে যখন লোকজন কম ছিল তখন পারতাম। লোকটার বয়স তিরিশ-বত্রিশ বলে মনে হল না। মনে হল আরও কম। বেশ দেখতে। কোনওরকম অস্বাভাবিকতা নেই। বরং হাবভাবে এক ধরনের সারল্য আছে। সারল্য না বোকামি? চেহারা একটু রোগার দিকে। তবে অসুস্থ নয়। মাথায় বেশি চুল। চোখদুটোয় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সরাসরি কথায় গেলাম, ‘তোমার নামই দিবাকর?’
‘হ্যাঁ স্যার। দিবাকর মাইতি।’
এই লোককে আমার ধমক দেওয়া মানায় না। আমাকে ঠান্ডা গলাতেই কথা বলতে হবে। যেটুকু যা বারণ করার সেটা করতে হবে শান্ত ভাবে। বললাম, ‘তুমি নাকি অফিসে কী সব আজগুবি গল্প বলে বেড়াও।’
দিবাকর একটু নড়ল। বলল, ‘আজগুবি গল্প! স্যার, আপনি কী বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।’
আমি গলায় হালকা বিরক্তি এনে বললাম, ‘বুঝতে পারছ না? সবাই যে বলছে। তারা মিথ্যে বলছে? তুমি নাকি গল্প করো যে তুমি তোমার মৃত স্ত্রীর সঙ্গে থাকো? ঘর সংসার করো? এই গল্প তো তুমি করো?’
দিবাকর একটু চুপ করে রইল। তারপর মাথা নামিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘গল্প নয় স্যার, সত্যি। আমার স্ত্রী স্যার দেড় বছর আগে মারা যায়। আট মাস হল ফিরে এসেছে।’
কথাটা বলার ভঙ্গিতে একটা সহজ, নিশ্চিন্ত ভাব। যেন স্বাভাবিক বিষয়। মৃত স্ত্রী স্বামীর কাছে ফিরে আসতেও পারে! আমি থমকে গেলাম। লোকটা হয় পাগল নয়, নয় বদ। সহকর্মীদের সঙ্গে যে ধরনের রসিকতা করা যায় কম্পানির মালিকের সঙ্গেও সেই ধরনের রসিকতা করছে! উঠে গিয়ে লোকটার গালে কী একটা চড় লাগাব? নাকি ভয়ংকর জোর ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেব? আমি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলালাম। কেটে কেটে বললাম, ‘তোমার মৃত স্ত্রী সত্যি ফিরে এসেছে!’
দিবাকর মুখে হালকা খুশির ভাব এনে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার এসেছে। একটু রোগা হয়ে গেছে।’
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। লোকটা কী বলছে! এর মাথা তো পুরো গেছে। বদ্ধ উন্মাদ! আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে বললাম, ‘কী করে ফিরে এল?’
দিবাকর উৎসাহ নিয়ে গদগদ ভঙ্গিতে বলল, ‘তখন আমি আগের অফিসে কাজ করি। একদিন বাড়ি ফিরতে খুব রাত হল। দেখি, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। আমি অবাক হলাম। সকালে তালা বন্ধ করে বেরিয়েছিলাম, তালা খুলল কে? ভেতরেই বা কে ঢুকেছে? কড়া নাড়লাম। কেউ সাড়া দিল না। আবার কড়া নাড়লাম। তাও সাড়া পেলাম না। তখন দরজায় কান পাতলাম। চুড়ির শব্দ, শাড়ির খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভয় পেলাম, আবার অবাকও হলাম স্যার। ঘরের মধ্যে মেয়েমানুষ কোথা থেকে এল? আঁখি তো এক বছর আগে মারা গেছে।’
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘আঁখি কে?’
‘আমার বউ স্যার। বিয়ের কয়েকমাস পর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে জ্বরে ফট করে মরে গেল। তখন ওরকম খুব হচ্ছিল। অজানা জ্বরে মানুষ মরছিল। কাগজে লেখালিখি হত। লাভ হত না।’
আমি দিবাকরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তারপর?’
দিবাকর বলল, ‘একটু পরেই বুঝতে পারলাম, ভেতরে আঁখি রয়েছে। আসলে বন্ধ দরজার এপাশ থেকেই গন্ধ পাচ্ছিলাম। তেল, সাবানের চেনা গন্ধ। আঁখির গা থেকে সবসময় বেরোত। কড়া আর মিষ্টি মিষ্টি। একটু পরে আঁখি দরজা খুলল। চোখ দেখে মনে হল, ঘুমোচ্ছিল। আমাকে রাগ দেখিয়ে বললে, এরপর রাতে দেরি করে ফিরলে আর দরজা খুলবে না।’ কথা শেষ করে দিবাকর সামান্য হাসল।
আমি অস্ফুটে বললাম, ‘তোমার ভয় করেনি?’
দিবাকর লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে মাথা চুলকে বলল, ‘একদম করেনি তা নয়, তবে মরা হোক আর জ্যান্ত হোক, নিজের বউ তো…। এখন সয়ে গেছে। তবে একটাই ব্যাপার আছে স্যার, আঁখি আপনার আসে সন্ধের পর। একটু রাতের দিকে। আবার ভোরের আগেই চলে যায়।’
একেবারে ছেলেমানুষদের জন্য গল্প ফেঁদেছে লোকটা। ব্যাঙ্গের ঢঙে বললাম, ‘কেন? দিনের আলোয় ভয় করে?’
দিবাকর বোকার মতো হাসল। বলল, ‘আঁখি বলে পাড়ার লোকে দেখলে ভয় পাবে। যদিও আমার বাড়ির দিকটা ফাঁকা ফাঁকা, লোকজন কম। তবু ও ঝুঁকি নিতে চায় না। আমি বলেছি, ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝবে। এলেই হল। সন্ধের পর এসে ও ঘরসংসারের কাজকর্ম করে। রুটি করে। আমি স্যার সেই রুটি অফিসে টিফিনে নিয়ে আসি। আজও এনেছি।’
আর না, অনেক হয়েছে। এবার অস্বস্তি হচ্ছে। ঠিকই ধরেছি, লোকটা পাগল। পুরোটা নয়, মনের একটা অংশে গোলমাল হয়ে গেছে। সেই অংশ মৃত স্ত্রীকে নিয়ে হাবিজাবি কল্পনা করে। হালকা মায়া হল। মাথা নামিয়ে গম্ভীর নরম গলায় বললাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে আর বলতে হবে না। দিবাকর, এই গল্প আর কখনও তুমি অফিসে বলবে না। এখন যাও।’
দিবাকর চলে যাওয়ার পর আমি খানিকক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম। তারপর বদ্যিনাথকে ডেকে পাঠিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দিবাকর কি আবার বিয়ে করেছে? তোমরা কি কিছু জানো।’
বদ্যিনাথ একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘ওর গল্প শুনে আমাদের বুকিং সেকশনের মন্টু একদিন লুকিয়ে ওর বাড়ি গিয়েছিল। দিবাকর তখন অফিসে। ঘরে তালা দেওয়া ছিল। আশপাশে লোকজন কম। তবু দু-একজনকে ধরে মন্টু জেনে এসেছে, দিবাকর একাই থাকে।’
ক’দিন খুব অস্বস্তির মধ্যে কাটল। অস্বস্তিটা ঠিক কীসের বুঝতে পারলাম না, কিন্তু একটা খচখচানি হতেই লাগল। মরা বউ নয়, দিবাকরের শান্ত, স্বাভাবিক ভঙ্গিটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না। আমি আড়াল থেকে দেখেছি, লোকটা খুব সহজ ভাবে টেবিলে বসে খাতা লিখছে। কীভাবে! এরপরই সিদ্ধান্ত নিলাম, এই লোককে রাখব না। বিদায় করব। গোপনে করব কারণ, ঘটনা জানাজানি হলে লোকে আমাকে নিয়ে হাসবে। বলবে, আজগুবি ভূতের গল্পে ভয়ে পেয়েছি। তারা আমার অস্বস্তির কারণ বুঝতে পারবে না।
রাত ন’টা। একটু বেশিই হতে পারে। অফিস ফাঁকা। আমি দোতলায় নিজের ঘরে বসে ব্যাঙ্ক লোনের কাগজপত্র বানাচ্ছি। নীচে কোথাও ভীম আছে। আমাদের দারোয়ান। হঠাৎই তীব্র একটা গন্ধে মনোযোগ ভাঙল। আমি নাক কোঁচকালাম। কীসের গন্ধ? ফাইল থেকে মুখ তুললাম। ঘর ফাঁকা। ফুসফুস করে এসি চলছে। লম্বা করে নাক টানলাম। গন্ধটা কেমন যেন! কোনও কেমিক্যালস? রং, বার্নিস ওই ধরনের কিছু? আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের দরজা খুললাম। গন্ধটা আরও জোরালো হয়ে নাকে ধাক্কা মারল। একতলার গোডাউনে কোনও ড্রাম-ট্রাম উলটে যায়নি তো? কেউ কি গোলমাল করতে এসেছে? দিবাকর মাইতি? প্রতিশোধ নিতে এসেছে? হতে পারে। আধ খ্যাপা লোক, কাজ চলে গেছে। আমার বুকটা ধক করে উঠল। তেল ধরনের কিছুতে আগুন ধরিয়ে দিলে গোটা অফিস বাড়িটা পুড়ে যাবে। আমার গলা শুকিয়ে এলও। ভীম কোথায়? আমি সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত ছুটে এলাম। সিঁড়িতে আলো জ্বলছে। গন্ধটা এখানে বেশি। চড়া অথচ মিষ্টি! আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘ভীম, ভীম…।’
ভীমের সাড়া নয়, সিঁড়ির বাঁক থেকে কাচের চুড়ির শব্দ ভেসে এল। এত রাতে অফিসে মেয়ে! আমি টলতে টলতে কোনওরকমে সিঁড়ির রেলিং চেপে ধরলাম। শাড়িতে খসখস আওয়াজ করে কে যেন উঠে আসছে ওপরে। তেল আর সাবানের তীব্র গন্ধে ম-ম করছে চারপাশ।
আমি দিবাকরের মতো স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। যেন এমন হয়। হতেই পারে।